০৮. সন্তুর নাম শুনে

সন্তুর নাম শুনে কাকাবাবু একটু থমকে গেলেন। সম্বলপুরে সন্তু? দুজন ভদ্রলোক একদিন একটা বিদঘুটে প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল তাঁর কাছে। একটা নীল পাথরের মূর্তি উদ্ধারের ব্যাপারে। তাঁকে সম্বলপুর নিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিল খুব। তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে সেখানেই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সন্তুকে আগেই ধরে নিয়ে গেছে। এই অংশুমান চৌধুরী লোকটিকে পাগল বলে মনে হয়। সন্তুকে নিয়ে কী করবে কে জানে!

কাকাবাবু দরজা বন্ধ করে ফিরে দাঁড়িয়ে কড়া গলায় বললেন, মিঃ চৌধুরী, আমার ওপর আপনার রাগ থাকতে পারে, তা বলে আমার ভাইপো একটা ছোট ছেলে, তাকেও জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন? আপনাকে আমি ভদ্রলোক ভেবেছিলাম! সন্তুর কয়েক বেলা পড়াশুনো নষ্ট হবে… – অংশুমান চৌধুরী মেঝে থেকে তাঁর রুপো বাঁধানো লাঠিটা কুড়িয়ে নিয়ে সেটার ওপর এমন মমতার সঙ্গে হাত বুলোত লাগলেন, যেন সেটা তাঁর নিজের হাত কিংবা পা।

মুখ না তুলে তিনি বললেন, আপনাকে ক্রাচ দুটো ব্যবহার করতে দিয়েছি। সেটাই কি আমার ভদ্রতা নয়? তা বলে যখন তখন ক্রাচ তুলে মারতে আসবেন, এটাই কি আপনার ভদ্রতা? আমি ইচ্ছে করলেই আপনার ক্রাচ দুটো সরিয়ে রাখতে পারতুম কি না? তখন তো এক পাও হাঁটতে পারতেন না।

তরুণ ডাক্তারটি এক কোণে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাকাবাবুর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে বলল, এই রকম মারামারির ব্যাপার হবে জানলে আমি অসতুম না। আমাকে এনগেজ করা হয়েছিল ট্রেনে একজন অসুস্থ লোকের দেখাশুনো করার জন্য।

অংশুমান চৌধুরী বললেন, তোমার কাজ ফুরিয়ে গেছে। আমার এক্সপেরিমেন্ট সাকসেসফুল! তোমাদের মেডিক্যাল সায়েন্স যা জানে না সেরকম একটা ওষুধ আমি আবিষ্কার করেছি। সেই ওষুধ একটা পিনের ডগায় অতি সামান্য একটু লাগিয়ে যেকোনও মানুষের শরীরে ফুটিয়ে দিলে, সে পাঁচ-ছ। ঘণ্টার জন্য ঘুমিয়ে পড়বে! কত বড় আবিষ্কার ভেবে দ্যাখো তো! বড় বড় খুনে ডাকাতকেও এই সামান্য একটা পিন ফুটিয়ে কাবু করে দেওয়া যাবে! এই আবিষ্কারের জন্য আমার নোবেল প্রাইজ পাওয়া উচিত।

কাকাবাবু বললেন, আপনার সেই ওষুধ আমার গায়ে ফুটিয়ে পরীক্ষা করেছেন? আমাকে জিজ্ঞেস না করে?

অংশুমান চৌধুরী কাকাবাবুর দিকে আঙুল তুলে বললেন, দাঁড়িয়ে রইলেন, কেন? বসুন! আমার ঝুলিতে এরকম আরও অনেক রকম ওষুধ আছে, বুঝলেন? কাজেই এর পর আর হঠাৎ ওরকম যখন-তখন ক্রাচ তুলে মারবার চেষ্টা করবেন না। আপনার একটা পা তো নষ্ট হয়ে গেছেই। এরপর যদি আপনার একটা হাত কিংবা একটা চোখ নষ্ট হয়, সেটা কি ভাল হবে?

কাকাবাবু সামান্য হেসে বললেন, আপনি আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছেন বুঝি? আমাকে মেরে ফেলা বরং সহজ, কিন্তু আমাকে ভয় দেখানো কিন্তু খুব শক্ত।

অংশুমান চৌধুরী ডাক্তারটির দিকে ফিরে বললেন, পাশের কেবিনে গিয়ে বলুন তো, আমাদের জন্য কফি আর টোস্ট দিতে। একটু খিদে-খিদে পাচ্ছে।

কাকাবাবু বুঝতে পারলেন, অংশুমান চৌধুরী গোটা একটা সেলুন কার ভাড়া নিয়েছেন। অনেক টাকার ব্যাপার। এত টাকা কে খরচ করছে? অংশুমান চৌধুরী নিজে না সম্বলপুরের সেই দুই ভদ্রলোক? নীল পাথরের মূর্তিটা তা হলে সাধারণ কোনও মূর্তি নয়। এবারে তাঁর কৌতূহল জেগে উঠল,মূর্তিটা একবার অন্তত দেখা দরকার। তাছাড়া যদি সন্তুকে সম্বলপুরে ধরে নিয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে সে পর্যন্ত তো যেতেই হবে।

দরজার কাছ ছেড়ে তিনি সিটে এসে বসলেন।

অংশুমান চৌধুরী কাষ্ঠ হাসি হেসে বললেন, আপনার ভাইপোর জন্য চিন্তা করছেন তো? আপনি আপনার ভাইপোর পড়াশুনোর কোনও খোঁজ খবরই রাখেন না। ওদের কলেজে পরীক্ষার সিট পড়েছে বলে পরশু থেকে ওদের সতেরো দিন ছুটি। এই ছুটিতে আমাদের সঙ্গে একটু জঙ্গলে বেড়িয়ে আসবে তাতে ক্ষতি কী? আপনারও চোখ কিংবা হাত নষ্ট করার ইচ্ছে আমার নেই। আমি শুধু আপনার মাথা ন্যাড়া করে দিতে চাই। আমার মতন আপনার মাথাতেও চুল থাকবে না।

কাকাবাবু বললেন, মিঃ চৌধুরী, আপাতত আপনার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে আমার ইচ্ছে হচ্ছে না। আমি বরং আর একটু ঘুমিয়ে নিই। সম্বলপুর এলে আমায় ডেকে দেবেন।

আপনি কফি-টোস্ট খাবেন না?

ধন্যবাদ। এখন আমার আর কিছুর দরকার নেই।

কাকাবাবু লম্বা সিটের ওপর পা ছড়িয়ে দিয়ে পাশ ফিরে চোখ বুজলেন। কয়েক মিনিট বাদে ঘুমিয়ে পড়লেন সত্যি-সত্যি।

কয়েক ঘণ্টা বাদে একজন কেউ তাঁর গায়ে ঠ্যালা মেরে জাগাল। কাকাবাবু চোখ মেলে দেখলেন। এ সেই রোগা ভীমু।

সে বলল, উঠুন স্যার, নামতে হবে।

কাকাবাবু উঠে বসলেন, ট্রেন থেমে আছে। কামরার দরজা খোলা। ডাক্তারটি আগেই নেমে গেছে, অংশুমান চৌধুরী মাথায় টুপি পরে ছড়িটি হাতে নিয়ে তৈরি হয়ে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন কাকাবাবুর দিকে।

অংশুমান চৌধুরী বললেন, আপনি নামুন আগে। আমি সব শেষে নামব। ভীমু সব ঠিক ঠাক আছে তো?

ভীমু বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ, স্যার!

এমন সময় প্ল্যাটফর্মে ঘ্যা-ঘ্যা-ঘ্যা করে একটা দিশি কুকুর ডেকে উঠল। অংশুমান চৌধুরী সঙ্গে সঙ্গে আর্ত চিৎকার করে বলে উঠলেন, ভীমু! ও কিসের ডাক? কোন জন্তুর?

ভিমু বলল, স্যার, চারজন কুলি লাগিয়েছি সব কুকুর বেড়াল তাড়িয়ে দিতে। একটা বোধহয় কোনওরকমে আবার এদিকে চলে এসেছে। ওরা ঠিক তাড়িয়ে দেবে।

অংশুমান চৌধুরী বললেন, আগে দরজার ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখে নাও সব ক্লিয়ার কি না?

ভীমু দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। অনেকখানি মুখ ঝুকিয়ে দিয়ে বলল, ওই যে চলে যাচ্ছে, একটা ছোট্ট নেড়ি কুত্তা। এই ভাগাও, ভাগাও, একদম বাহার হাটাও, উধার খাড়া রহো!

অংশুমান চৌধুরী বললেন, প্ল্যাটফর্মে গন্ধ স্প্রে করে দাও। আমি এখানেও বদ গন্ধ পাচ্ছি।

কাকাবাবু পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখটা মুছে নিলেন। তারপর ক্রাচ দুটি বগলে নিয়ে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে।

প্ল্যাটফর্মে তিন-চারজন লোক দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। কাকাবাবুকে দেখে একজন এগিয়ে এসে বলল, নমস্কার রাজাবাবু! নমস্কার! পথে কোনও কষ্ট হয়নি তো! বড্ড লম্বা জার্নি। ঘুম হয়েছিল আশা করি।

কাকাবাবুকে সিঁড়ি দিয়ে নামবার জন্য খানিকটা কসরত করতে হয়। সেই লোকটি কাকাবাবুকে সাহায্য করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেও কাকাবাবু নিজেই কোনওক্রমে নামলেন নীচে। তারপর বললেন, আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।

নীল রঙের সাফারি সুট পয় লম্বা মতন সেই লোকটি বিগলিতভাবে হেসে বলল, আমার নাম অসীম পট্টনায়ক। আমার দাদা আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। আপনার মতন বিখ্যাত লোক যে এখানে আসতে রাজি হয়েছেন সে জন্য আমরা খুব কৃতজ্ঞ হয়েছি। আজ সন্ধে বেলাতেই মিটিং, আপনি দুপুরে রেস্ট নিয়ে নেবেন, তারপর…

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, মিটিং, কিসের মিটিং?

যুবকটি বলল, এখানকার দু-তিনটি ক্লাব মিলে একটা মিটিং অ্যারেঞ্জ করেছে, সেখানে আপনি আপনার দু-চারটি অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনাবেন। আমার দাদা বলেছেন কী আপনি আসতেই চাইছিলেন না… আমরা খুব আশা করে ছিলাম..।

যুবকটি পিছন ফিরে বলল, এই মালা, মালা কোথায়?

পেছন থেকে দুজন লোক ফুলের মালা নিয়ে এগিয়ে এল এবং কাকাবাবু কোনও আপত্তি জানাবার আগেই তাঁর গলায় পরিয়ে দিল।

কাকাবাবু মনে-মনে রাগলেও মুখের ভাবটা গম্ভীর করে রাখলেন। তাঁকে। যে জোর করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে, তা যাতে কেউ বুঝতে না পারে সেই জন্যই বোধহয় এইসব ফুলের মালা টালার ব্যবস্থা! মিটিংএ বক্তৃতা দেওয়ার কথা তো তাঁকে এর আগে কেউ একবারও বলেনি।

অসীম পট্টনায়ক বলল, আসুন স্যার। এদিকে আসুন। গাড়ি রয়েছে।

কাকাবাবু বিনা প্রতিবাদে এগিয়ে গেলেন ওদের সঙ্গে ট্রেন জার্নির পরই তাঁর স্নান করতে ইচ্ছে করে। জামা কাপড় পালটাতে ইচ্ছে করে। তাঁর সঙ্গে অন্য কোনও পোশাক নেই। এইসব চিন্তাই তাঁর মাথায় ঘুরছে এখন। অন্য কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না।

স্টেশনের বাইরে এসে একটা বড় স্টেশান ওয়াগানে উঠতে গিয়ে তিনি দেখলেন, কাছেই একটা থামের আড়ালে একটা ছোট বিড়াল ছানা বসে আছে গুটিসুটি মেরে। কাছাকাছি আর কোনও কুকুর বিড়াল দেখতে পেলেন না। ভীমুর লোক সেগুলোকে সব তাড়িয়ে দিয়েছে। এই বিড়াল ছানাটি বোধহয় ওদের চোখে পড়েনি।

গাড়িতে উঠে কাকাবাবু অসীম পট্টনায়ককে জিজ্ঞেস করলেন, এখান থেকে কত দূর যেতে হবে?

অসীম বলল, খুব বেশিদূর নয় স্যার। মাত্র চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিটের জার্নি।

যাওয়ার পথে আমরা কি শহরের মধ্য দিয়ে যাব?

তা যেতে পারি। যদিও অন্য রাস্তা আছে। কেন বলুন তো স্যার?

একটা জামাকাপড়ের দোকানের সামনে নামতে হবে। আমার দু-একটা গেঞ্জি-জামা কেনা দরকার।

সেজন্য চিন্তা করবেন না, স্যার। সেসব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমাদের এখানে যখন দয়া করে এসেছেন, তখন আপনার সব দায়িত্ব আমাদের।

আমার গেঞ্জি জামা আমি নিজে দেখে কিনতে চাই।

বলছি তো স্যার, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এই তো, উনিও এসে গেছেন। কাকাবাবু দেখলেন স্টেশন গেট পেরিয়ে বাইরে আমাদের অংশুমান চৌধুরী। চোখে কালো চশমা। এক হাতে তিনি নিজের নাক টিপে আছেন, অন্য হাত ধরে আছে তাঁর সহকারী ভীমু। খুব সম্ভবত চোখ বুজে আছেন অংশুমান চৌধুরী।

অসীমরা এগিয়ে গেল তাঁকে গাড়ির কাছে খাতির করে নিয়ে আসার জন্য। অংশুমান চৌধুরীর জন্য আর-একটা আলাদা গাড়ির ব্যবস্থা করা আছে। পাশেই সেই গাড়িটা দাঁড়াল। সে গাড়ির সব কাচ রং করা। সিনেমার নায়ক-নায়িকারা এই রকম কাচ ভোলা গাড়িতে যায়।

অংশুমান চৌধুরী সেই গাড়ির কাছে এলেন। তখনও চোখ খোলেননি। তবে নাক থেকে হাতটা সরিয়ে বললেন, ভীমু আমার লাঠিটা কই?

ভীমু বলল, লাঠিটা যেন কার হাতে দিলাম? লাঠি, লাঠি, এই, স্যারের লাঠিটা দাও।

অংশুমান চৌধুরী বিরক্তভাবে বললেন, আমার লাঠি তুই অন্য লোকের হাতে দিয়েছিস? ইডিয়েট, বলেছি না, ওটা কক্ষনো কাছ ছাড়া করবি না। কোথায় গেল লাঠি, কে নিল?

উত্তেজিতভাবে অংশুমান চৌধুরী একটু ঘুরে দাঁড়াতে যেতেই তাঁর এক পায়ের একটা ধাক্কা লাগল বিড়াল ছানাটার গায়ে, অমনি বিড়াল ছানাটা ভয় পেয়ে খুব জোরে ডেকে উঠল। ম্যা-ও-ও! ফ্যাঁচ!

সঙ্গে সঙ্গে অংশুমান চৌধুরী তিড়িং করে এক লাফ দিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, ও কী? ওটা কী? ওরে ভীমু ওটা কোন্ প্রাণী।

অসীম বলল, ও কিছু নয় স্যার, একটা সামান্য বিড়াল!

অংশুমান চৌধুরী বললেন, আমায় আঁচড়ে দিয়েছে? ভীমু, আঁচড়ে দিয়েছে? কামড়ে দিয়েছে?

ভীমু বলল, না স্যার, কিছু করেনি!

অংশুমান চৌধুরী বলল, হ্যাঁ, আঁচড়ে দিয়েছে। আমি টের পাচ্ছি! জ্বালা করছে। ওরে বাপরে, মেরে ফেলবে আমাকে! ভীমু বিশ্বাসঘাতক…

কথা বলতে বলতে অংশুমান চৌধুরী অত বড় লম্বা শরীরটা নিয়ে ধপাস করে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন।