০৮. এই বোটটা বেশ বড় আর সুসজ্জিত

এই বোটটা বেশ বড় আর সুসজ্জিত। বসবার জায়গা বেশ আরামদায়ক আর ঠাণ্ডা, একটা ছোট রান্নাঘরও আছে।

সকাল থেকে প্রায় কিছুই খাওয়া হয়নি। যাত্রা করার সময় কিছু পাউরুটি, ডিম আর কফি তুলে নেওয়া হয়েছে। সন্তু আর রাধা দুজনে মিলে টোস্ট আর ডিমসেদ্ধ বানিয়ে ফেলল, তবু খাওয়াটা ঠিক জমল না। এই মিনি কিচেনে নুন নেই, নুন আনার কথাও কারুর মনে পড়েনি। নুন ছাড়া ডিমে কি স্বাদ হয়!

কফিতে চুমুক দিতে দিতে কাকাবাবু সুরেশ নাইড়ুকে জিজ্ঞেস করলেন, নাইড়ুসাহেব আপনি রবার্টস আয়ল্যান্ডে ভূতের ব্যাপারে কী শুনেছেন?

নাইড়ু বললেন, শোেনা যায় তো অনেকরকম গল্প। একবার কোনও গল্প ছড়াতে শুরু করলে তাতে নানারকম রং চড়তে থাকে। দেখুন, শুধু অফিসে বসে কাজ করতে আমার ভাল লাগে না। আমি এই বোটে কিংবা আরও বড় লঞ্চে প্রায়ই সমুদ্রের বুকে ঘুরে বেড়াই। এদিকে তো খুব স্মাগলারদের উপদ্রব, তাই টহল-দেওয়াটাও আমাদের কাজ। ওই দ্বীপে আমি নিজে অন্তত তিনবার গেছি, কিছুই দেখিনি।

সেলিম বললেন, স্যার, আমিও একবার আপনাদের সঙ্গে এসেছি, আপনার মনে আছে?

নাইড়ু বললেন, হ্যাঁ। সেবারে শুধু একটা কচ্ছপ ধরা পড়েছিল, তাই না? অতবড় কচ্ছপ আমি আগে দেখিনি।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, সেই কচ্ছপের মাংস আপনারা খেয়ে ফেললেন? খেতে কেমন?

নাইড়ু বললেন, না, না, সেটাকে আমরা আবার জলে ছেড়ে দিলাম। কচ্ছপ মারা এখন নিষেধ। তবে, ছোটবেলায় আমি কচ্ছপের মাংস খেয়েছি, খুবই ভাল স্বাদ। সেলিম, তুমি খেয়েছ?

সেলিম বলল, না, আমাদের পরিবারে কেউ কচ্ছপ খায়নি কখনও। তবে ছোটবেলায় আমিও দেখেছি, বাজারে কচ্ছপ বিক্রি হত।

কাকাবাবু বললেন, সমুদ্রে খুব বড় বড় কচ্ছপ থাকে। তবে প্রকৃতি ওদের ওপর বড্ড অবিচার করেছে। ও রকম একটা শক্তপোক্ত প্রাণী, কিন্তু ওদের মারা কত সহজ। একবার ধরে উলটে দিতে পারলেই হয়, আর পালাতে পারে না।

রাধা জিজ্ঞেস করল, কচ্ছপ কী?

কাকাবাবুরা কথা বলছেন ইংরিজিতে। ওঁরা তো কচ্ছপ বলেননি, বলেছেন টরটস, রাধা তাও বুঝতে পারেনি।

নাইড়ু বললেন, তুমি দ্যাখোনি কখনও? জ্যান্ত না দেখলেও ছবিতে? সেই যে কচ্ছপ আর খরগোশের দৌড় প্রতিযোগিতার গল্প আছে?

রাধা বলল, ও টারটুল! পিঠটা খুব শক্ত…।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক, আমরা পুরনো ইংরিজি বলি। এখন টারই বলে, বিশেষত সমুদ্রের কচ্ছপকে। যাই হোক সেই কচ্ছপ ছাড়া আর কিছু দেখেননি? রাত্তিরেও ছিলেন?

সেলিম বললেন, হ্যাঁ, এক রাত কাটিয়েছি। তবে এত চমৎকার হাওয়া দেয়। সন্ধে হতে না হতেই ঘুমে চোখ টেনে আসে। এক ঘুমে রাত কাবার। সারা রাত কোনও শব্দ হয়নি। ভূতেরা তাণ্ডব করে ঘুম ভাঙায়নি। আমার মতে, ওই দ্বীপে খুব ভাল টুরিস্ট সেন্টার হতে পারে।

নাইড়ু বললেন, তা সম্ভব নয়। দশ-বারো বছর আগে পুরো দ্বীপটা ড়ুবে গিয়েছিল কয়েক দিনের মতো। সেরকম আবার হতে পারে যে-কোনও সময়। যে রবার্ট সাহেব ওই দ্বীপে বাড়ি বানিয়েছিলেন, তিনি নাকি জলে ড়ুবেই মারা যান। সে অনেকদিন আগেকার কথা। তবু, জেলেরা কেউ কেউ নাকি মাঝে মাঝে রবার্ট সাহেবকে দেখেছে। তিনি জলের ওপর দিয়ে হেঁটে যান। বিশাল চেহারা।

সন্তু বললেন, জলে ড়ুবে মারা যাবার পর ভূত হয়ে জলের ওপর দিয়ে হাঁটতে শিখলেন!

রাধা বলল, ভূতদের তো ওজন থাকে না!

সন্তু জিজ্ঞেস করল, রাধা তুমি কখনও ভূত দেখেছ?

রাধা সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ্যাঁ, দেখেছি। অনেকবার। সিনেমায়।

সবাই হেসে উঠল।

সন্তু বলল, দূরে একটা লঞ্চ দেখা যাচ্ছে।

নাইড়ু একটা দূরবিন বার করে দেখতে দেখতে বললেন, মনে হচ্ছে মাছ ধরা ট্রলার। তবু আমরা চেক করব, পাশ দিয়ে যাব।

এই বোটচালকের পাশে চারজন কমান্ডো বসে আছে। তিনজনের কাছে। অটোমেটিক রাইফেল আর একজনের হাতে সাব মেশিনগান। যে-কোনও ডাকাতের দলের সঙ্গেই ওরা মোকাবিলা করতে পারবে।

কাছে গিয়ে দেখা গেল, সেটা সত্যিই মাছ ধরার ট্রলার। অনেক মাছ পেয়েছে। বেশির ভাগই ম্যাকারেল আর পমফ্রেট। একটা বড় মাছ খুব অদ্ভুত ধরনের। সেটার কেউ নাম জানে না।

আর একটু যাওয়ার পর চোখে পড়ল দু-একটা গাছ। নাইড়ু বললেন, ওই যে শশা দ্বীপ।

এর মধ্যে বিকেল হয়ে এসেছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে বলে আলোও কম। দ্বীপটার কাছের দিকে কেউ নেই।

নাইড়ু বললেন, মাঝে-মাঝে এখানে পিকনিক পার্টি আসে, আজ কেউ আসেনি। অবশ্য কেউই সন্ধে পর্যন্ত থাকে না।

দ্বীপের অন্য অংশের দিকে যেতেই দেখা গেল, সেখানে আগুন জ্বলছে, কয়েকজন লোকও ঘোরাফেরা করছে।

নাইড়ু কমান্ডোদের সতর্ক হতে বলে রাধা সন্তুকে বললেন, তোমরা শুয়ে পড়ো। ওরা যদি ডাকাত হয়, গুলি চালাতে পারে।

ঠিক তাই, এই বোটটা আর একটু কাছে যেতেই পর পর দুটো গুলির আওয়াজ শোনা গেল।

কাকাবাবু উত্তেজিতভাবে বললেন, ওরা আমাদের ভয় দেখাচ্ছে? ওরা কজন হতে পারে? আমাদের চারজন কমান্ডো, আর আমরা তিনজন, সবাই দ্বীপে নেমে ওদের ঘিরে ধরব।

নাইড়ু বললেন, দাঁড়ান, ব্যস্ত হবেন না। কোনও পিকনিক পার্টি এত দূর চলে এলে গুলির আওয়াজ শুনলেই ভয়ে পালিয়ে যাবে। ওরা বোধহয় সেইরকমই ভেবেছে। দাঁড়ান, আগে ব্যাপারটা বুঝে নিই।

তিনি মিলিটারি কমান্ডারের ভঙ্গিতে কমান্ডো চারজনকে বললেন, ফায়ার!

তারা ঠিক চার রাউন্ড গুলি চালাবার পরই তিনি হাত তুলে বললেন, স্টপ!

তারপর লাউড স্পিকারের চোঙা তুলে নিয়ে তিনি বলতে লাগলেন, পুলিশ। আমরা দ্বীপটা সার্চ করতে এসেছি। তোমরা যে-ই হও, সারেন্ডার করো। তোমরা লড়াই করার চেষ্টা করলে কেউ বাঁচবে না। সারেন্ডার!

ওদিক থেকে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

নাইড়ু এবার যে কমান্ডোর হাতে সাব মেশিনগান, শুধু তাকে বললেন, ফায়ার!

সে একঝাঁক গুলি চালিয়ে দিল।

এবার ওদের একজন এগিয়ে এল জলের ধারে। তার হাতের বন্দুকটা মাথার ওপর তোলা।

নাইড়ু হুকুম দিলেন, ড্রপ দা গান।

সে অস্ত্রটা ফেলে দিল মাটিতে।

নাইড়ু বললেন, আর কজন আছে? সবাই জলের ধারে এসে লাইন করে পঁড়াও!

মোট চারজন এসে দাঁড়াল। আরও একজনের হাতে বন্দুক।

কাকাবাবু বললেন, এদের বোট কোথায়? সেটা তো দেখা যাচ্ছে না।

সেলিম বলল, এদের নামিয়ে দিয়ে হয়তো কিছু জিনিসপত্র আনতে গেছে। নাইড়ু এ বোটটা কাছে নিয়ে যেতে বললেন। এখানে একটা জেটিও করা আছে।

বোটটা জেটিতে লাগবার আগেই সন্তু এক লাফে নেমে পড়ে ছুটে গেল একটা ঘরের দিকে।

শুধু একটা টালির চালের ঘর। আর কিছু নেই। ঠেলা দিয়ে ঘরের দরজাটা খুলে ফেলে সন্তু চেঁচিয়ে উঠল। জোজো!

ঘরের মধ্যে কেউ নেই।

ঘরে একটা খাটিয়া ছাড়া আর কোনও আসবাবও নেই। সন্তু খাটিয়ার তলায় উঁকি মেরে দেখল, সেখানে গোটাচারেক কচ্ছপ বেঁধে রাখা রয়েছে।

ঘর থেকে বেরিয়ে দারুণ হতাশায় সন্তু আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, কাকাবাবু, জোজো এখানে নেই।

বাইরে আরও কয়েকটা কচ্ছপকে উলটে রাখা রয়েছে, তাদের পাশে পড়ে আছে অনেকগুলো ডিম।

কাকাবাবুরাও নীচে নেমে এসে সব দেখলেন।

সেলিম বলল, কচ্ছপরা এখানে ডিম পাড়তে আসে। এই লোকগুলো ঠিক সময় বুঝে এসে সেগুলোকে ধরে। এই সব কচ্ছপ বিদেশে চালান দেয় লুকিয়ে লুকিয়ে।

কাকাবাবুও হতাশা লুকোতে পারলেন না। মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ইস, এখানেও জোজোকে পাওয়া গেল না? এরা তো পেটি ক্রিমিনাল, এরাও বন্দুক রাখে?

নাইড়ু বললেন, এখন সবাই বন্দুক-পিস্তল রাখে। বেশ শস্তায় কিনতে পাওয়া যায়।

কাকাবাবু বললেন, এখন এদের নিয়ে কী করবেন? আমাদের বোটে তো এত লোকের জায়গা হবে না।

নাইড়ু বললেন, নাঃ, এদের নিয়ে যাওয়া যাবে না। আপাতত বন্দুক দুটো বাজেয়াপ্ত করা যাক।

তিনি সেই চারজনকেই হুকুম করলেন, সব কটা কচ্ছপকে বাঁধন খুলে জলে ছেড়ে দাও! এক্ষুনি, আমার সামনে। আমি কাল আবার আসব, তখনও যদি তোমাদের এখানে দেখি, একেবারে জেলে ভরে দেব!

লোকগুলোর মুখে কোনও কথা নেই। এক এক করে সব কটা কচ্ছপকে ছেড়ে দিল সমুদ্রে। তারপর তাদের দাঁড় করিয়ে রেখে পুলিশের বোটটা আবার স্টার্ট দিল।

নাইড়ু বললেন, সন্ধে হয়ে আসছে। এখন কি আর রবার্টস আয়ল্যান্ডে যাবেন?

কাকাবাবু বললেন, যাব না মানে? সে জায়গাটা চেক করে দেখতেই হবে। একটুও সময় নষ্ট করার উপায় নেই।

নাইড়ু বললেন, সন্ধের পর আমরা সাধারণত সমুদ্রে থাকি না। বোট চালাতে অসুবিধে হয়, মাঝে-মাঝে উঁচু পাথর আছে।

সেলিম বললেন, স্যার, তা হলেও ওই দ্বীপটা একবার দেখে যাওয়া দরকার। এতদূর যখন এসেছি, আর বড় জোর আধঘণ্টা যেতে হবে। সেখানেও পাওয়া না গেলে বুঝতে হবে, সমুদ্রে ওরা নেই। খুঁজতে হবে পাড় ধরে ধরে।

নাইড়ু বললেন, চলুন তা হলে!

রাধা বলল, ওই লোকগুলো রাত্তিরবেলা দ্বীপে থাকবে, ওদের যদি হাঙরে খেয়ে ফেলে?

নাইড়ু বললেন, হাঙর তো পাড়ে ওঠে না। হাঙরের ঝাঁক আসে বটে মাঝে-মাঝে। কুমির থাকলে ওপরে উঠে আসতে পারত, কিন্তু এ সমুদ্রে কুমির দেখা যায় না।

রাধা বলল, আর সাপ?

সেলিম বললেন, সাপ আছে, খুবই বিষধর, তবে সাপ তো মানুষকে তেড়ে এসে কামড়ায় না। মানুষ সাপের খাদ্য নয়।

সন্তু আর কাকাবাবু কোনও কথা বলছেন না। এর পরের দ্বীপটাতেও জোজোকে পাওয়া না গেলে আর কোথায় খোঁজা হবে? রাত্তিরবেলা আর কোথাও যাওয়া যাবে না। ওরা মাত্র তিনদিন সময় দিয়েছে, বাকি থাকবে শুধু কালকের দিনটা।

রাধা বলল, আমার একটা দ্বীপে থাকতে ইচ্ছে করে।

সেলিম বললেন, তোমাকে রাবার দ্বীপে আমরা রেখে আসব। তুমি একা থাকতে পারবে?

রাধা অনেকখানি ঘাড় হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ।

সন্তু বলল, যখন খিদে পাবে, তখন কী করবে? রাধা একটু চিন্তা করে বলল, একটা না একটা জাহাজ তো যাবে পাশ দিয়ে, সেই জাহাজকে ডাকব।

নাইড়ু বললেন, জাহাজের লোকগুলো ভাববে, আকাশ থেকে একটা পরী নেমে এসেছে এই দ্বীপে।

হঠাৎ রাধা বলল, দূরে ওটা কী? তিমি মাছ?

চোখে দূরবিন লাগিয়ে নাইড়ু বললেন, না ওটাই সেই রবার্টস আয়ল্যান্ড।

আরও কাছে যাওয়ার পর দ্বীপটাকে ভাল করে দেখা গেল। আকাশের একদিক এর মধ্যে অন্ধকার হয়ে গেছে, অন্যদিকে আগুনের মতন লাল রেখা।

দ্বীপের কাছেই রয়েছে একটা বোট, সেটা ঢেউ লেগে দুলছে। বোটের মাঝখানে অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে দুজন লোককে। নাইড়ু নিজেদের বোটটা থামিয়ে দিতে বললেন।

কাকাবাবু রিভলভার বার করে বললেন, খুব সাবধানে এগোতে হবে। ওরা চোখের নিমেষে গুলি চালিয়ে দেয়। নিশ্চয়ই আমাদের বোট দেখতে পেয়েছে।

কমান্ডোরা অস্ত্র হাতে নিয়ে তৈরি হয়ে নিল।

নাইড়ু লাউড স্পিকারের চোঙাটা নিয়ে ঘোষণা করলেন, আমরা পুলিশ থেকে বলছি। পুলিশ। বোটটা একবার সার্চ করে দেখব!

কাকাবাবু আপন মনে বললেন, জোজোকে যখন ধরে নিয়ে যায়, তখন নকল পুলিশ সেজে ওরাই এই কথা বলেছিল।

নাইড়ুর দুবারের ঘোষণাতেও কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।

সেলিম বললেন, স্যার, খুব জোর হাওয়া বইছে, আমাদের বোটটাও অনেকটা দূরে, ওরা বোধহয় শুনতে পাচ্ছে না।

নাইড়ু চালককে বললেন, আরও একটু এগিয়ে চলো তো। বেশি না। সন্তু আর রাধা, তোমরা শুয়ে পড়ো, নইলে গুলি লাগতে পারে।

বোটটা খানিকটা এগিয়ে গিয়ে থামল। খুব তাড়াতাড়ি আকাশের আলো মিলিয়ে যাচ্ছে, তবু অস্পষ্ট হলেও বোঝা গেল, অন্য বোটটাতে মানুষ রয়েছে।

কাকাবাবু দ্বীপটার দিকে দেখলেন ভাল করে। সেখানে কোনও মানুষজন দেখা যাচ্ছে না।

নাইড়ু আরও তিনবার একই ভাবে মুখে চোঙা দিয়ে ঘোষণা করলেন। কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

তিনি আবার বললেন, বোটের চালককে বলছি, মাথার ওপর হাত তুলে উঠে দাড়াও।

কেউ উঠে দাঁড়াল না।

এবার এই বোটের জোরালো সার্চ লাইট ফেলা হল অন্য বোটে।

এবার দেখা গেল, কয়েকজন লোক পাশাপাশি শুয়ে আছে। মনে হয় যেন ঘুমন্ত। এই সন্ধেবেলা সবাই মিলে ঘুমিয়ে পড়বে, তাও তো বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।

সেলিম বলল, মটকা মেরে শুয়ে আছে। নিশ্চয়ই কোনও মতলব আছে। নাইড়ু একজন কমান্ডোকে শূন্যে একবার গুলি চালাতে বললেন।

সেই গুলির আওয়াজে, ওদিক থেকে সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। সবাই শুয়ে রইল একভাবে।

সেলিম বললেন, আরও একটু কাছে গিয়ে দেখা হবে?

কাকাবাবু চিন্তিতভাবে বললেন, খানিকটা অপেক্ষা করে দেখা যাক। ওরা নিশ্চয়ই চাইছে আমরা আরও কাছে যাই। তারপর একটা কিছু করবে। আমি একা ওদের বোটের কাছে যেতে পারলে ভাল হত। কিন্তু তার তো উপায় নেই।

নাইড়ু বিস্মিতভাবে বললেন, কেন, আপনি একা যেতে চাইছেন কেন? ওরা এত সাঙ্ঘাতিক লোক…

কাকাবাবু বললেন, ওরা তো আমাকে মারবে না। আমাকে দিয়েই তো ডিমেলোকে ছাড়াতে চাইছে। আমাকে মারলে ওদের কোনও লাভ হবে না।

হঠাৎ জলে একটা শব্দ হল। জুতো আর প্যান্ট খুলে সন্তু সমুদ্রে নেমে পড়েছে।

নাইড়ু চেঁচিয়ে উঠলেন, এ কী, এ কী! ততক্ষণে সন্তু ড়ুবসাঁতার দিয়েছে?

কাকাবাবু বললেন, সন্তু খুব ভাল সাঁতার জানে। ও অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে চুপিচুপি ওই বোটের কাছে গিয়ে দেখতে চায় আসল ব্যাপারটা।

সেলিম বললেন, এটা তো ডেঞ্জারাস। ওরা নিশ্চয়ই নজর রাখছে।

কাকাবাবু বললেন, সন্তুকে বারণ করেও লাভ হত না। ও জোজোকে এত ভালবাসে।

সবাই ব্যগ্রভাবে তাকিয়ে রইলেন।

এখানে বেশি ঢেউ নেই। তবে বাতাসে ছলচ্ছল শব্দ হচ্ছে। সন্তু এক-একবার মাথা তুলছে, আবার ড়ুবে যাচ্ছে। একটু পরেই তাকে আর দেখা গেল না।

কাকাবাবু নাইড়ুকে বললেন, সার্চ লাইটটা অফ করে দিন।

নাইড়ু চোখে দূরবিন লাগিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু অন্ধকারে সবই কালো হয়ে গেছে।

একটু বাদে রাধা প্রথমে বলল, কীসের একটা আওয়াজ শোনা গেল না ও মানুষের গলা!

সেলিম বললেন, হ্যাঁ। কেউ আর্ত চিৎকার করছে। সন্তু ধরা পড়ে গেছে? কাকাবাবু বোটচালককে বললেন, শিগগির ওই বোটের কাছে চলো।

আবার জ্বালানো হল সার্চ লাইট। ওই বোটের ওপর দেখা গেল সন্তুকে। আর একটু কাছে যেতে শোনা গেল তার কথা। সে চেঁচিয়ে ডাকছে, কাকাবাবু, কাকাবাবু, এদিকে চলে এসো।

অন্য বোটের কাছে পৌঁছতেই কাকাবাবুর বুকটা ধস করে উঠল।

এখানে-সেখানে শুয়ে আছে চারজন। তাদের মধ্যে জোজোও আছে, কেউ নড়ছে না।

সবাই মরে গেছে?

সেলিম এক লাফে অন্য বোটটায় গিয়ে বসলেন, সবাই কী করে একসঙ্গে মরে গেল?

সন্তু বলল, একজনও মরেনি। আমি জোজোর নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখেছি, নিশ্বাস পড়ছে।

এর পর নাইড়ু আর কাকাবাবুও চলে এলেন এই বোটে। প্রত্যেককেই পরীক্ষা করে দেখা হল। কেউই মৃত নয়। অজ্ঞান হয়ে আছে।

নাইড়ু বললেন, এ তো ভারী আশ্চর্যের ব্যাপার। কারুর গায়ে আঘাতের চিহ্ন নেই। মারামারি হয়নি বোঝা যাচ্ছে। তবু অজ্ঞান হল কী করে?

কাকাবাবু বললেন, এটা আমিও বুঝতে পারছি না।

সেলিম বললেন, আমরা আশঙ্কা করছিলাম গোলাগুলি চলবে। তার কিছুই হল না। জোজোকেও খুঁজে পাওয়া গেছে। বাকি লোকগুলোকেও হাতকড়া পরিয়ে ধরে নিয়ে যেতে পারি। এত সহজে সব হয়ে গেল?

কাকাবাবু বললেন, ঘুমন্ত অবস্থায় কারুর হাত বাঁধা কি উচিত। দেখুন না চেষ্টা করে, এদের জাগানো যায় কি না!

সন্তু এর মধ্যে জোজোর হাত আর মুখের বাঁধন খুলে দিয়েছে। তার গালে ছোট ছোট চাপড় মেরে ডাকতে লাগল, জোজো, এই জোজো!

একটু বাদেই জোজো চোখ মেলে চাইল। ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, সন্তু কখন এলি?

সন্তু বলল, এই তো এক্ষুনি। তোর কী হয়েছিল?

জোজো বলল, কিছু হয়নি তো। ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদের দেখে বলল, জানিস সন্তু, এই লম্বা লোকটার নাম রকেট। আর ও হচ্ছে ভিকো। অতি খারাপ লোক। আর বোট চালাচ্ছে, আমাদের সেই ফ্রেড।

কাকাবাবু বললেন, জোজো, এরা সবাই এই সন্ধেবেলা ঘুমিয়ে আছে কেন?

জোজো বলল, তা তো জানি না। আমার খুব ঘুম পেয়েছিল। মুখ বাঁধা। থাকলে কথা বলা যায় না, তখন তো জেগে থাকার বদলে ঘুমিয়ে পড়াই ভাল।

নাইড়ু সেলিমকে বললেন, এই বোট থেকে সব অস্ত্রগুলো সরিয়ে ফেলুন। আগে।

তারপর তিনি রকেট হায়দরাবাদির গালে চাপড় মারতে লাগলেন।

সেও জেগে গেল একটু পরেই।

নাইড়ু তার কপালে রিভলভার ঠেকিয়ে বললেন, রকেট হায়দরাবাদি, তোমাকে গ্রেফতার করা হল। বাধা দেবার চেষ্টা করে লাভ নেই।

রকেটের দুচোখে হাজার বিস্ময়।

সে আমতা আমতা করে বলল, আপনারা… আপনারা কখন এলেন? আমাদের কী হয়েছিল?

নাইড়ু বললেন, তোমরা ধরা দেবার জন্য অপেক্ষা করে করে ঘুমিয়ে পড়েছিলে ক্লান্ত হয়ে।

খপ করে তার হাত দুটি ধরে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে দেওয়া হল। সে এমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে যে, আর কোনও কথা বলতে পারছে না।

সেলিম বললেন, আমি এত বছর পুলিশে চাকরি করছি, কখনও এমন অভিজ্ঞতা হয়নি। কালপ্রিটরা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ধরা দিল! আমাদের কিছুই করতে হল না?

কাকাবাবু বললেন, এরকম অভিজ্ঞতা আমারও প্রথম হল।

অন্যদের একই রকমভাবে জাগিয়ে হাতকড়া পড়িয়ে দিলেন নাইড়ু।

ভিকো শুধু প্রথমে জোরাজুরি করার চেষ্টা করল, সেলিম তার দিকে রিভলভার তুলে বললেন, গুলি খেয়ে মরতে চাও?

ভিকো তখন উঠে দাঁড়িয়ে হু-আ-হা-হা, হু-আ-হা-হা করে চিৎকার করে উঠল। আকাশ ফাটিয়ে।

জোজো বলল, কী করছে? কারুকে ডাকছে নাকি!

সন্তু বলল, এখানে কে ওর ডাক শুনতে পাবে?

সেলিম বললেন, এটা ওর কান্না। এমনি এমনি ধরা পড়েছে তো তাই ওর অপমান হয়েছে।

সত্যিই ভিকোর দুচোখ দিয়ে জল পড়ছে। রকেট বসে আছে হাঁটুতে মাথা গুঁজে।

নাইড়ু বললেন, আর দেরি করে লাভ কী? এবার গেলেই হয়। কিন্তু একটা মুশকিল হচ্ছে, এই বোটটা চালাবে কে? এ লোকটাকে বিশ্বাস করা যায় না।

ফ্রেড বলল, আমি কী দোষ করেছি? আমার বোট কেউ ভাড়া নিলে সে যেখানে যেতে বলবে, সেখানে যাব।

সেলিম বললেন, চোপ! তুমি একটাও কথা বলবে না।

নাইড়ু বললেন, আমাদের একটা বোটে তো এত লোক ধরবে না। সেলিম, তুমি বোট চালাতে জানো?

সেলিম বললেন, না স্যার।

কাকাবাবু বললেন, আমি জানি। কিন্তু আমি একটা অন্য কথা ভাবছি। এ বোটটা আপাতত এখানে থাক। আমি আর সন্তু এই দ্বীপে থেকে যাচ্ছি, আপনারা ওদের নিয়ে একটা বোটে চলে যান।

নাইড়ু অবিশ্বাসের সুরে বললেন, আপনারা এই দ্বীপে থেকে যাবেন মানে? কেন?

কাকাবাবু বললেন, এখন তো আর কোনও বিপদের ভয় নেই। আমরা তো এই দ্বীপে রাত কাটাব বলেই যাত্রা করেছিলাম।

নাইড়ু বললেন, না, না। এখন তার দরকার নেই। সবাই মিলে গাদাগাদি করে হয়ে যাবে। মিস্টার রায়চৌধুরী, ফিরে চলুন।

কাকাবাবু বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি এখানে থাকব বলেই ঠিক করেছি।

কাকাবাবুর গলার আওয়াজ শুনেই বোঝা যায়, তিনি মত বদলাবেন না।

জোজো বলল, আমিও থাকব।

কাকাবাবু বললেন, তোর ওপর এত ধকল গেছে। তুই বরং শহরে গিয়ে বিশ্রাম নে। যদি ডাক্তার দেখাতে হয়…

জোজো বলল, মোটেই ডাক্তার দেখাতে হবে না। এক ঘণ্টা ধ্যান করব, তাতেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কাকাবাবু, আমরা রাত্তিরে কী খাব?

কাকাবাবু বললেন, সে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমাদের বোটে ডিম আর পাউরুটি আছে, সেগুলো রেখে দেব। এই বোটে কিছু আছে কি না দ্যাখ তো!

এই বোটেও রয়েছে কিছু ডিম আর পাউরুটি, আর দুপ্যাকেট খেজুর আর পেস্তাবাদাম। কফি আর গুঁড়ো দুধ।

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, চমৎকার খাওয়া হবে।

সন্তু বলল, এই জোজো, দ্যাখ তো নুন আছে কি না। নুন ছাড়া ডিম খাওয়া যায় না।

শুধু নুন নয়, পাওয়া গেল গোলমরিচের গুঁড়োও।

নাইড়ু বললেন, মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনি সত্যি থেকে যাবেন, এই ছোট ছেলেদুটিকে নিয়ে?

সেলিম বললেন, আমারও থেকে যেতে ইচ্ছে করছে। আমিও তা হলে থাকি স্যার?

নাইড়ু বললেন, সেলিম, তুমিও পাগল হলে নাকি?

সেলিম বললেন, এই দ্বীপটা সম্পর্কে কতরকম গল্প শুনেছি। খুব কৌতূহল। হচ্ছে।

রাধা এবার বলল, আর আমি কী করব?

নাইড়ু বললেন, তুমি তো অবশ্যই আমাদের সঙ্গে ফিরে যাবে। তোমার থাকার প্রশ্নই ওঠে না।

রাধা বলল, মোটেই না, মোটেই না। আমি কাকাবাবুর সঙ্গে থাকব।

অনেক চেষ্টা করেও রাধাকে বোঝানো গেল না। সে কাকাবাবুর কোটটা চেপে ধরে রইল।

শেষ পর্যন্ত কাকাবাবুর দলটা বেশ বড়ই হয়ে গেল।

সন্ত, জোজো, রাধা, সেলিম আর একজন কমান্ডো। নাইড়ু জোর করে রাখতে চাইলেন তাকে। তার হাতে লাইট মেশিনগান।

বন্দিদের অন্য বোটে তোলবার পর নাইড়ু বললেন, আমাকে তো আজই ওদের নিয়ে গিয়ে থানায় জমা দিতে হবে। কাল দুপুরের মধ্যেই আমি আপনাদের এখানে ফিরে আসছি।

সেলিম বললেন, সেই ভাল স্যার। আসবার সময় বেশি করে খাবার নিয়ে আসবেন।

জোজো বলল, মশলা বোসা আনতে পারবেন না? ডিম-পাউরুটি আর কতবার খাওয়া যায়?

নাইড়ুদের লঞ্চটা ছেড়ে যাওয়ার পর কাকাবাবু এই লঞ্চটার চালকের আসনে বসলেন।

অনেকদিন অভ্যেস নেই, বেশ কয়েক মিনিট স্টার্ট দিতে অসুবিধে হল।

কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, কী রে, এটা চলবে না নাকি?

সঙ্গে সঙ্গে ধক ধক শব্দ করে উঠল ইঞ্জিন।