০৭. খানিক পরে এসে পৌঁছোলেন কর্নেল

খানিক পরে এসে পৌঁছোলেন কর্নেল। তাঁর হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার। বারান্দায় উঠে টেবিলের উপর রাখলেন সেটা।

কাকাবাবু আবার বই নিয়ে বসেছেন, মুখ তুলে বললেন, আসুন, কর্নেল।

কর্নেল বললেন, বাড়ি থেকে মান দোপিঁয়াজা বানিয়ে এনেছি। একটুও ঝাল নেই। দেখতে হবে, ছেলেটা খেতে পারে কি না। সে কোথায়?

কাকাবাবু বললেন, সে তো নেই।

কর্নেল বললেন, নেই মানে? আবার পালিয়েছে?

কাকাবাবু বললেন, না, পালায়নি। গত দুদিন সে আর পালাবার চেষ্টা করেনি। কিছুক্ষণ আগে ওকে নিয়ে চলে গেল।

কর্নেল এবার দারুণ অবাক হয়ে বললেন, নিয়ে চলে গেল? কে?

কাকাবাবু বললেন, ওর কাকা। খবরের কাগজে ওর ফোটো দেখে চলে এসেছেন ইন্দোর থেকে। ও তিন বছর বয়সে জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছিল।

কর্নেল বললেন, এল আর নিয়ে চলে গেল? ছেলেটা কি ওর কাকাকে চিনতে পেরেছিল?

কাকাবাবু বললেন, না, তা চিনবে কী করে? ছেলেটা সহজে যেতেও চায়নি।

কর্নেল বললেন, তা তো হবেই। ভদ্রলোককে বললেন না কেন, দু- তিনদিন এখানে থেকে ধীরেসুস্থে ওকে বুঝিয়ে তারপর নিয়ে গেলেই হত।

কাকাবাবু বললেন, আমি সেটা বলেছিলাম। ইনি বললেন, ওঁর সময় নেই, ব্যাবসার কাজ আছে।

জোজো আর সন্তুও কর্নেলের সাড়া পেয়ে বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে।

জোজো বলল, দেখুন না, ওকে কীরকম বিচ্ছিরিভাবে টানতে টানতে নিয়ে গেল, হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে।

কর্নেল বললেন, হ্যান্ডকাফ পরিয়ে? কেন? ও কি ক্রিমিনাল নাকি?

সন্তু বলল, দু-তিনজন মিলে ঠেলাঠেলি করে নিয়ে গিয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, আপনি যদি দেখতেন সে দৃশ্য। ছেলেটা শরীর শক্ত করে দাঁড়িয়ে বাচ্চা বাঘের মতোই হুংকার দিচ্ছিল।

কর্নেল বললেন, আমি থাকলে ওকে যেতে দিতামই না।

কাকাবাবু হেসে বললেন, কী করতেন? ওর নিজের কাকা নিতে এসেছে। মা কান্নাকাটি করছে। আপনি আটকে রাখতেন কোন অধিকারে। সঙ্গে পুলিশও ছিল। পুলিশের উপর তো কথা বলা যায় না।

কর্নেল বললেন, পুলিশ অফিসারের নাম কী?

কাকাবাবু বললেন, মোহনকুমার। তবে, ওর কাকাকে মনে হল ভাল লোক। তবে আমি বলেছি, দেখবেন, ছেলেটার সঙ্গে যেন কেউ খারাপ ব্যবহার না করে। উনি বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না। মাকে দেখলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তা তো হতেই পারে।

একটুক্ষণ গুম হয়ে থেকে কর্নেল বললেন, সন্তু, জোজো, তোমরাই মাংসটা খাও। একটু কাঁচালঙ্কার ঝাল মিশিয়ে নিতে পারো।

তারপর তিনি কাকাবাবুকে বললেন, রায়চৌধুরীসাহেব, কাল তা হলে আমরা সকালবেলা বেরিয়ে পড়ি? এই দশটা আন্দাজ, কী বলেন?

কাকাবাবু বললেন, কাল সকালে? কোথায় যাব?

কর্নেল বললেন, বাঘ-গুহার ছবিটবি দেখতে যাব। আগেই তো সেরকম কথা ছিল। মাঝখানে এই সব ঝাটের জন্য যাওয়া হল না। এখন ঘুরে আসা যাক।

কাকাবাবু বললেন, সে আর হবে না। কাল সকালেই আমরা ফিরে যাচ্ছি।

কর্নেল বেশ আশ্চর্য হয়ে বললেন, কাল সকালেই ফিরে যাবেন? সে কী? কেন, এত তাড়াহুড়োর কী আছে। না, না, কাল আপনাদের যাওয়া হবে না।

কাকাবাবু বললেন, কর্নেল, আর দেরি করা যাবে না। গাড়ি ঠিক করে ফেলেছি, সকাল সাড়ে দশটায় রওনা হব।

কর্নেল বললেন, আপনি না হয় বাঘ-গুহা দেখেছেন, কিন্তু অমন চমৎকার জায়গা এই ছেলে দুটো দেখবে না?

কাকাবাবু বললেন, এই ছেলে দুটোর কলেজ খুলে যাচ্ছে। আমার নিজেরও কিছু কাজ আছে।

কর্নেল বললেন, আপনার আবার কাজকী? আপনাকে তো অফিসটফিসে যেতে হয় না?

কাকাবাবু এবার হেসে বললেন, যারা অফিসে যায় না, তারা বুঝি কেউ কোনও কাজ করে না? আমার কিছু কিছু কাজ থাকেই।

কর্নেল বললেন, হা, কাজ থাকে, আবার তার থেকে ছুটিও বের করা যায়। আর ওদের কলেজ, দু-চারদিন ফাঁকি দিলে এমন কিছু ক্ষতি হয় না। আমরাও কলেজ জীবনে এরকম ফাঁকি দিয়েছি। কী, তোমরা বাঘ-গুহা দেখতে চাও না?

সন্তু আর জোজো কিছু বলল না। কাকাবাবু যা বলবেন, তার উপরে তো ওরা কোনও কথা বলতে পারে না!

কাকাবাবু বললেন, ওরা পরে আবার আসবে। তখন নিজেরা সব কিছু ঘুরে দেখবে। এবারের মতো বেড়ানো শেষ।

কর্নেল বললেন, আশপাশে কত সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। আমি ঠিক করেছিলাম, আপনাদের নিয়ে ঘুরব। আমি সব ভাল চিনি, আমার চেয়ে ভাল করে আর কেউ দেখাতে পারবে না। এমনকী ভাবছিলাম, একবার ইন্দৌরও ঘুরে আসব। ওই ছেলেটার বাড়িটাও দেখে আসা হবে। মায়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ছেলেটা কী করল, মাকেও চিনতে পারল কি না, তা জানতে আপনাদের ইচ্ছে করে না?

কাকাবাবু বললেন, আর ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী হবে? বাড়ির লোক নিয়ে গিয়েছে, ও ছেলে নিশ্চয়ই আস্তে আস্তে মানিয়ে নেবে নিজেকে।

আমাদের মতো বাইরের লোকের আর নাক গলানো উচিত নয়।

হঠাৎ খুব তেড়ে বৃষ্টি এসে গেল। পাহাড়ি জায়গায় যেমন হয়। এত জোর বৃষ্টির ছাঁট যে, বারান্দায় আর বসা যাবে না।

সবাই উঠে গেলেন ঘরের মধ্যে।

কর্নেলসাহেব আরও কিছুক্ষণ ধরে কাকাবাবুকে আর কয়েকটা দিন থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে যেতে লাগলেন। কিন্তু কাকাবাবু অনড়।

কিছুক্ষণ অন্য গল্পও হল, তারপর কর্নেল বিদায় নিলেন বৃষ্টির মধ্যেই।

তারপরেই মান্টো সিংহ এসে কাকাবাবুদের ডাকল খাবারের ঘরে যাওয়ার জন্য।

আজই এই গেস্টহাউসে কিছু নতুন লোক এসেছে, তাদের মধ্যে অবশ্য বাঙালি কেউ নেই। তাদের মধ্যেও কয়েকজন কাকাবাবুর কাছে টাইগার বয়ের কথা জানতে চাইল। কিন্তু তাঁর আজ গল্প করার মুড নেই।

খাওয়ার পর নিজেদের ঘরে ফিরে এসে কাকাবাবু বললেন, সন্তু, তোদের সুটকেস গুছিয়ে নে। কাল সকালের জন্য ফেলে রাখিস না। আমরা চা খেয়েই বেরিয়ে পড়ব। রাস্তায় কোথাও ব্রেকফাস্ট খাব।

সারা ঘরেই জিনিসপত্র ছড়ানো।

বড় ঘরটায় একটা খাটে কাকাবাবু, অন্য খাটে জোজো আর সন্তু। এর মধ্যে কয়েক দিন বুনো ছেলেটি শুয়েছে সন্তুর সঙ্গে, আর জোজো গিয়েছে। কাকাবাবুর খাটে। বুনো অনেক জিনিস এদিক-সেদিক ছুড়ে দিত। যেসব জিনিস সে আগে কখনও দেখেনি, যেমন ঘড়ি, টর্চ, সাবান এইসব সে হাতে নিয়ে গন্ধ শুঁকে দেখেছে, তারপর ফেলে দিয়েছে।

একটা ছোট্ট ট্রানজিস্টার রেডিয়ো থেকে হঠাৎ মানুষের গলা শুনে সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তার একটা প্যান্ট আর শার্ট পড়ে আছে খাটের নীচে।

সন্তু আর জোজো টপাটপ সব তুলে ভরতে লাগল দুটো সুটকেসে।

প্রায় সবই তোলা হয়ে যাওয়ার পর সন্তু জিজ্ঞেস করল, হারে জোজো, সেই হিরের আংটিটা কোথায় গেল? সেটা তো দেখছি না?

জোজো বলল, সেটা তো একটা ভেলভেটের বাক্সে ছিল এখানে এই টেবিলের উপরে। দুপুরেও দেখেছি। তারপর তুই রাখিসনি?

সন্তু বলল, না তো?

জোজো বলল, তা হলে কাকাবাবু বোধহয় কোথাও সরিয়ে রেখেছেন। সন্তু বাইরের বারান্দায় এসে কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করল, তোমার কাছে কি হিরের আংটিটা আছে?

কাকাবাবু বই থেকে চোখ তুলে বললেন, উঁহু।

সন্তু বলল, সেটা কোথাও পাচ্ছি না।

কাকাবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, কোথায় আবার যাবে? ভাল করে খুঁজে দ্যাখ।

এরপর আবার দুজনে মিলে সারা ঘর তন্নতন্ন করে খোঁজা হল। কোথাও সে আংটি নেই। এ ঘরের বাইরে তো সেটা কখনও নিয়ে যাওয়া হয়নি।

তা হলে কি চুরি?

তা ছাড়া আর অন্য কিছু তো ভাবা যাচ্ছে না। এবার কাকাবাবুকে আবার বলতেই হল।

কাকাবাবু একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে রইলেন। ঘরের মধ্যে এসে চারদিক তাকিয়ে বললেন, পাওয়া যাচ্ছে না? অন্য কেউ নিয়েছে নিশ্চয়ই।

জোজো জিজ্ঞেস করল, কে নিতে পারে?

কাকাবাবু বললেন, তা তো বলা মুশকিল। আমরা তো বাইরে বেরোবার সময় দরজায় তালা দিই না। যে কেউ এসে নিয়ে যেতে পারে। আমাদেরই জিনিসটা সাবধানে রাখা উচিত ছিল। যাকে-তাকে সন্দেহ করা আমি পছন্দ করি না। ধরে নাও হারিয়েই গিয়েছে।

তবু একটু পরে মান্টো সিংহ ঘরে জলের বোতল দিতে এলে, জোজো জিজ্ঞেস করে ফেলল, মান্টো সিংহ, হিরের আংটি দেখা? হিয়া পর থা।

মান্টো সিংহ বলল, নেহি তো! নেহি দেখা।

জোজো বলল, একটা ভেলভেটের বাক্সে ছিল, কেউ নিয়ে গিয়েছে।

মান্টো সিংহ বলল, ওই জঙ্গল কা লেড়কা, ও নিয়ে যায়নি তো?

কাকাবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন,যাঃ, বাজে কথা বোলো না। ও ছেলেটা আংটির কিছুই বোঝে না। টাকাও চেনে না। ও কেন নিতে যাবে? গিয়েছে, গিয়েছে, ওই আংটির কথা ভুলে যাও!

কাকাবাবু ও বিষয়ে আর কাউকে কোনও কথাই বলতে দিলেন না।

পরদিন সকালবেলা চা-বিস্কুট খেয়ে তৈরি হয়ে নিল সন্তু আর জোজো। সুটকেস বন্ধ করা হয়ে গিয়েছে। তবু মন খুঁতখুঁত করছে ওদের দুজনের। আবার খুঁজে দেখল সব জায়গায়। কোথাও নেই সেই আংটি।

খানিক পরেই এসে গেলেন কর্নেল। বললেন, আপনাদের বিদায় জানাতে এলাম। আপনারা দেখছি একদম রেডি।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, রেডি। একটু পরেই ভাড়ার গাড়ি এসে যাবে।

কর্নেল একটা চেয়ার টেনে বসে বললেন, আপনাদের সেই দামি আংটিটা চুরি গিয়েছে শুনলাম?

কাকাবাবু ভুরু তুলে বললেন, হা, কিন্তু আপনি তা জানলেন কী করে?

কর্নেল বললেন, গেটের কাছেই মান্টো সিংহ বলল আমাকে। ও লোকটি খুব বিশ্বাসী, ও চুরি করবে না।

কাকাবাবু বললেন, ওকে আমরা সন্দেহও করিনি।

কর্নেল বললেন, তা হলে কাকে সন্দেহ হয়?

কাকাবাবু বললেন,কাউকেই না। ওইটুকু একটা ছোট্ট জিনিস, কেউ নিয়ে লুকিয়ে রাখলে খুঁজে পাওয়ার উপায় নেই। শুধু শুধু কাউকে সন্দেহ করার তো কোনও মানে হয় না।

কর্নেল বললেন, আপনি কত বড় বড় রহস্যের সমাধান করেছেন। আর এই সামান্য একটা আংটি-চোরকে ধরতে পারবেন না?

কাকাবাবু হেসে বললেন, সামান্য বলেই পারব না। এত সামান্য ব্যাপার নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। চোর ধরা আমার কাজ নয়।

কর্নেল বললেন, তা হলে আমিই চেষ্টা করি। ডিটেকটিভ গল্পে পড়েছি, যাদের একেবারেই সন্দেহ করা যায় না, তাদের মধ্যে একজন কেউ কালপ্রিট হয়। সেইভাবে শুরু করা যাক। প্রথমেই ধরা যাক আপনি, মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনাকে সন্দেহ করার কোনও উপায়ই নেই, কারণ আংটিটা আপনারই। নিজের জিনিস কেউ চুরি করে না। কী বলো, সন্তু?

সন্তু একটু হাসল।

কর্নেল বললেন, সন্তুকেও সন্দেহ করা যায় না, কারণ আংটিটা ওকেই। দেওয়ার কথা। ও কেন চুরি করবে শুধু শুধু। তবে, জোজো, তাকে সন্দেহ করা যেতে পারে। সে ইচ্ছে করলে, মানে, তার পক্ষেই আংটিটা নেওয়া সবচেয়ে সুবিধেজনক।

জোজো ফস করে রেগে উঠে বলল, কী, আপনি আমাকে আংটি-চোর বলছেন? আমাদের বাড়িতে ওরকম কত আংটি আছে আপনি জানেন? কত রাজা-মহারাজারা এসে আমার বাবাকে উপহার দেন। হিরের আংটি, মুক্তোর আংটি, চুনি-পান্নার আংটি। আমাদের বাথরুমেও ওসব আংটি গড়াগড়ি যায়।

কর্নেল বললেন, তোমাদের বাড়িতে অনেক আংটি, তা তো বুঝলাম। কিন্তু বাথরুমে আংটি গড়াগড়ি যায় কেন?

জোজো বলল, আমার মা নতুন নতুন আংটি পরেন। বাথরুমে স্নান করতে গিয়ে আংটি খুলে রাখেন, আর পরে নিতে ভুলে যান। ওগুলো সেখানেই পড়ে থাকে।

কর্নেল বললেন, ও।

জোজো এবার আঙুল তুলে বলল, আপনাকেও সন্দেহ করা যেতে পারে। আপনিও আমাদের ঘরে এসে বসেছিলেন।

কর্নেল বললেন, এটা ঠিক বলেছ। খুব বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেছ। আমাকে তো সন্দেহ করা যেতেই পারে। আমি তো ইচ্ছে করলেই আংটিটা টপ করে পকেটে ভরে নিতে পারতাম!

তিনি নিজের হাতটা কোটের পকেটে ভরলেন। তারপর ম্যাজিশিয়ানের ভঙ্গিতে হাতটা আবার বের করে বললেন, এই দ্যাখো! আমিই নিয়েছিলাম। কেন বলো তো?

সন্তু অস্ফুটভাবে বলল, ক্রিপটোম্যানিয়াক!

কর্নেল মাথা নেড়ে বললেন, না, না, ক্রিপটোম্যানিয়াক মানে তো যারা কোনও দরকার না থাকলেও গোপনে অন্যের জিনিস নিয়ে নেয়, আমি তা নই! আমি আংটিও পরি না। এটা নিয়েছিলাম, যাতে তোমাদের আরও দু-তিনদিন এখানে আটকে রাখা যায়। কাল অত করে অনুরোধ করলাম, তোমাদের কাকাবাবু কিছুতেই থাকতে রাজি হলেন না। ভেবেছিলাম, এরকম একটা দামি জিনিস হারালে নিশ্চয়ই অনেক খোঁজাখুঁজি করবেন, পুলিশে খবর দেবেন। এমনকী, বুনো ছেলেটাকে সন্দেহ করলে ইন্দৌরও যেতে রাজি হতে পারেন। এখন তো দেখছি, ইনি একজন মহাপুরুষ! এক লাখ-দেড় লাখ টাকা দামের একটা জিনিস হারিয়ে গেল কিংবা চুরি হল, তাও উনি গ্রাহ্যই করলেন না? পুলিশে খবর দিলেন না?

কাকাবাবু হেসে বললেন, মহাপুরুষ টহাপুরুষ কিছু নয়। সাধারণ বুদ্ধিতে আমি জানি, আংটি চুরি গেলে পুলিশ কোনও দিনই তা খুঁজে দিতে পারে না। শুধু শুধু আর এখানে বসে থেকে লাভ কী? আর, ওই বুনোকে আমি কিছুতেই সন্দেহ করতাম না। যে কথা বলতে পারে না, অর্থাৎ মিথ্যে কথাও শেখেনি। যারা মিথ্যে কথা বলতে শেখে না, তারা চুরিও করে না।

কর্নেল বললেন, তা বোধহয় ঠিক। যাই হোক, চলেই যখন যাচ্ছেন, আপনাকে দু-একটা খবর দিই। কাল আপনাদের এখান থেকে বেরিয়ে আমি একবার থানায় গিয়েছিলাম। মোহনকুমার লোকটা ভাল নয়, ঘুষটুষ খায়। যাই হোক, ওর কাছ থেকে আমি সুরজ সিংহের ঠিকানা নিয়ে নিলাম। কারণ, ওই বুনো ছেলেটা কেমন থাকেটাকে, তা আমার একবার দেখে আসার ইচ্ছে আছে। ইন্দৌরের পুলিশ কমিশনার সুজনপ্রসাদ আমার বিশেষ বন্ধু। কাল রাত্তিরেই তাকে ফোন করে বললাম, সে যেন ছেলেটার বাড়িতে গিয়ে একটু খোঁজখবর নেয়। প্রথম প্রথম কিছু প্রবলেম তো হতেই পারে, পুলিশ যদি সাহায্য করে…।

কাকাবাবু বললেন, এটা আপনি ভালই করেছেন।

কর্নেল বললেন, আজ সকালেই সুজন প্রসাদের ফোন পেয়েছি। সে বলল, ইন্দৌর শহরে সুরজ সিংহ নামে কোনও ব্যবসায়ী নেই, যে ঠিকানা সে দিয়ে গিয়েছে, ওই নামে ইন্দৌর কোনও রাস্তা নেই। সবটাই মিথ্যে।

জোজো বলল, ও মা, তা হলে ওরা বুনোকে কোথায় নিয়ে গেল? কর্নেল বললেন, আমার সন্দেহ হচ্ছে, ও লোকটা বুনোর কাকা নয়।

জোজো বলল, আমারও একবার তাই মনে হয়েছিল।

কাকাবাবু বললেন,যাঃ! ওই বয়সের কত গরিবের ছেলে রাস্তায় থাকে, ভাল করে খেতে পায় না, কেউ কি তাদের বাড়ি নিয়ে যেতে চায়? তবে এই ছেলেটার জন্য কেন একজন লোক মিথ্যে পরিচয় দিয়ে এত দূর ছুটে আসবে? হয়তো ঠিক ইন্দৌর নয়, কাছাকাছি অন্য কোনও শহরে ওদের বাড়ি।

কর্নেল বললেন, সুরজ সিংহ আপনাকে কোনও কার্ড দিয়েছে?

কাকাবাবু বললেন, না। আমিও চাইনি। পুলিশের কাছেই তো ঠিকানা রেখে গিয়েছে। আপনার বন্ধু সুজনপ্রসাদকে আবার খোঁজ নিতে বলুন।

সন্তু বলল,দমদম কিংবা বরানগরে যারা থাকে, তারাও তো বাইরে এসে বলে, কলকাতায় থাকি। সেইরকম সুরজ সিংহরাও বোধহয় ইন্দোরের আশপাশে কোথাও…।

কর্নেল বললেন, অত তাড়াহুড়ো করে ছেলেটাকে নিয়ে গেল, ইন্দৌর ঠিকানাটা মিলছে না, তাই কীরকম যেন রহস্যজনক লাগছে।

কাকাবাবু বললেন, সব কিছুর মধ্যে এমন রহস্য খুঁজে লাভ নেই। ছেলেটা ভালই থাকবে আশা করি। আমাদের তো এর বেশি আর কিছু করার নেই। চল রে সন্তু। এবার আমাদের বেরোতে হবে।

কর্নেল বললেন, আপনাদের কিন্তু আবার এখানে আসতে হবে। অনেক কিছুই তো দেখা হল না।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ। দেখা যাক, আবার কবে হয়। আপনি কলকাতায় গেলে অবশ্যই আমাদের বাড়িতে আসবেন। তখন অনেক গল্প হবে।

কর্নেল একে একে সন্তু আর জোজোকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন। তারপর কাকাবাবুর হাত ধরে বললেন, আবার দেখা হবে। ভাল থাকবেন?