[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

০৭. এমন বিশাল ও জমকালো অনুষ্ঠান

ম্যাডেলিনের কবিতা উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মতন এমন বিশাল ও জমকালো অনুষ্ঠান আমি জীবনে আর কোথাও দেখিনি, ভবিষ্যতেও দেখব বলে মনেও হয় না।

এর সঙ্গে কিছুটা তুলনীয় এক কবি সম্মেলন দেখেছিলাম যুগোশ্লাভিয়ার ওখরিদ নামে ছোট্ট একটি শহরে।

তারপর যুগোশ্লাভিয়া টুকরো-টুকরো হয়ে গেছে, এখন সেই অঞ্চলটি মাকেঁদোনিয়া বা ম্যাসিডোনিয়া।

সেখানে কবি সম্মেলনটি হয়েছিল একটি নদীর বুকের ওপর, আক্ষরিক অর্থেই। একটি তন্বী, ছিমছাম, তরঙ্গবতী নদী, চওড়ায় বড়জোর চৌরঙ্গির মতন একটা রাস্তার সঙ্গে তুলনীয়, সেই নদীর ওপরে একটি সেতুকেই মঞ্চ বানানো হয়েছে। আর নদীর দুপাশে ঘাসের ওপর বসে আছে শ্রোতারা। আমরা কবিতা পাঠ করেছি সামনের দিকে তাকিয়ে, যেন নদীকেই উদ্দেশ্য করে।

সেবারে ওই কবি সম্মেলনের কয়েকটি দিনে অ্যালেন গিলসবার্গ আর প্রখ্যাত রুশ কবি ভজনেসেনস্কির সঙ্গে তুমুল আড্ডা হয়েছিল।

ম্যাডেলিনের অনুষ্ঠানটি আরও বেশি বর্ণাঢ্য ও অভিনব।

বাসে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল পাহাড়ের গায়ে একটি জায়গায়।

ম্যাডেলিন শহরটি একটি জামবাটির মতন। উপত্যকার সব দিকেই গোল করে ঘেরা পাহাড়। শহর বিস্তৃত হতে-হতে পাহাড়ের গায়ে-গায়ে অনেকটা ওপরে উঠে গেছে।

সেরকমই, উঁচুতে একটি স্থানে পাহাড় কেটে-কেটে বানানো হয়েছে গ্যালারি। অন্তত পঞ্চাশ ষাটটি ধাপ। অনেক নীচে তৈরি হয়েছে বড় মঞ্চ। গ্যালারিটি স্টেডিয়ামের মতন বেঁকে গেছে ডান দিকে ও বাঁ-দিকে। সেখানে বসে আছে পাঁচ-সাত হাজার নারী পুরুষ, কত রঙের পোশাক, অনেকের পোশাক প্রায় নেইও বলা যায়, পুরুষ ও নারীর সংখ্যা সমান সমান তো হবেই, হয়তো নারীর সংখ্যাই কিছু বেশি। তাদের দিকেই তো আগে চোখ পড়ে। নারীরা নানা বয়েসি, কিশোরী থেকে বৃদ্ধা।

মঞ্চে বিদ্যুৎ বাতি ও মাইক্রোফোন আছে, শ্রোতাদের মধ্যে মাঝে-মাঝে রয়েছে লাউড স্পিকার। কিন্তু বিদ্যুতের আলো নেই, দাউ দাউ করে জ্বলছে অনেকগুলি মশাল। একেবারে ওপরে ফুচকা, আলুকাবলি, চপ-কাটলেটের দোকান। (ওগুলো নয় অবশ্য, তার বদলে সসেজ, বেগেল, হ্যামবার্গার ও মাটন রোলের মতন কিছু একটা।)

এই অনুষ্ঠানে কোনও মন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি-রাজ্যপাল নেই, কোনও সভাপতি নেই, কোনও ভাষণও নেই। শুধু শুরুতে একজন একটা ইস্তাহার বা ঘোষণাপত্র পড়ে গেল মিনিট দশেক ধরে, সেটা স্প্যানিশ ভাষায় হলেও আর একজন সঙ্গে-সঙ্গে ইংরিজি অনুবাদ করে দিচ্ছিল বলে বোঝা গেল, তাতে শুধু বিশ্বের সব কবিদের জয়গান। মূল বক্তব্য, যেন কবিরাই অবসান ঘটাতে পারো সব যুদ্ধের, ঘুচিয়ে দিতে পারে মানুষের হিংসা প্রবৃত্তি।

খুবই লম্বা দাবি। তবে শুনতে ভালোই লাগে।

এরপর কবিতা পাঠ। মোট দশজন কবি প্রথম দিনের জন্য নির্বাচিত, তাঁদের মধ্যে আমি নেই। আমি সেরকম আশাও করিনি। শোনা গেল, আশিটি দেশের কবিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে (শেষপর্যন্ত এসে পৌঁছেছেন বাহাত্তর জন), এ ছাড়া রয়েছেন বেশ কয়েকজন স্থানীয় কবি, এঁদের মধ্য থেকে দশজন বেছে নেওয়া খুবই শক্ত। তাই প্রতি বছর ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে এক-এক দেশের কবিদের এই সুযোগ দেওয়া হয়। গত বছরই এক ভারতীয় হিন্দি কবি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ে গেছেন। তবে, সব আমন্ত্রিত কবিদেরই বসানো হয়েছে মঞ্চে।

কবিরা পড়েছেন নিজেদের মাতৃভাষায়, সঙ্গে আর একজন পড়ে দিচ্ছেন স্প্যানিশ অনুবাদ। সুতরাং দশজনের মধ্যে ন’জন কবিরই শুধু কণ্ঠস্বর উপভোগ করা গেল, বোঝা গেল না একটি পংক্তিও। একমাত্র অস্ট্রেলিয়ান মহিলা পড়লেন ইংরিজিতে। তাঁর প্রথম কবিতার শিরোনাম, আমার বাবা-মা কীভাবে বিছানায় প্রেম করতেন।

শ্রোতারা উৎসাহে যেন টগবগ করছে। তারা তো স্প্যানিশ অনুবাদে বুঝতে পারছে সব কটিই। এক একটি পাঠের শেষে কী বিপুল হাততালি। শুনলেই মনে পড়ে, ইদানীং আমলের দেশের দর্শক বা শ্রোতাদের অধিকাংশেরই যেন হাতে বাত হয়েছে কিংবা প্রাণ খুলে হাততালি দিতে ভুলে গেছে।

এখানে কয়েক হাজার সমবেত হাততালির শব্দে কর্ণপটহ বিদীর্ণ হওয়ার জোগাড়। কোনও কোনও কবিতা বেশ ভালো লাগলে শ্রোতারা ই-ই-ই করে একরকম শব্দ করছে, মনে হয় যেন এই প্রথাটা ইওরোপীয় নয়, স্থানীয় আদিবাসীদের কাছ থেকে শেখা।

আমাদের দেশের হাততালির রক্তাল্পতা কিংবা মিনমিনে সাধু-সাধু রবের থেকে এখানকার শ্রোতাদের এই উদ্দামতা দেখতে অনেক ভালো লাগে।

আমি যতদূর সম্ভব মহিলা শ্রোতাদের মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে কিছুক্ষণ খুঁজলাম ইলিয়ানাকে। যদি সে এর মধ্যে কোথাও বসে থাকে। এ এক অসম্ভব যুক্তিহীন কৌতূহল। ইলিয়ানা তো ম্যাডেলিন শহরেই আসেনি, সে এই কবি সম্মেলনে উপস্থিত হবে কী করে? কাকতালীয়র ওপর আমার এত বিশ্বাস বা ভক্তি হল কবে থেকে।

ইলিয়ানার বয়েসি অনেক মহিলাই এখানে রয়েছে। তাদের কাব্যপ্রীতি ফুটে উঠেছে চোখে মুখে।

মঞ্চে আমার পাশে যে কবিটি বসে আছে, সে এক সময় আমাকে জিগ্যেস করল, তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ।

আমার দেশের নাম শুনে সে বলল, আমিও ইন্ডিয়ান। তবে মেক্সিকোর, আমি মায়া।

রহস্যময় ও অল্প-জ্ঞাত মায়া সভ্যতার এক প্রতিনিধি আমার পাশে বসে আছে, শুনলেই রোমাঞ্চ জাগে।

সে আবার জিগ্যেস করল, তুমি কি হিন্দু ভাষায় লেখো?

বললাম, হিন্দু ভাষা বলে কোনও ভাষা নেই। ভারতের অনেক ভাষা, তরে মধ্যে একটি হিন্দি, আর একটি বাংলা, আমি সেই ভাষায় লিখি। তুমি বাংলা ভাষার নাম শুনেছ?

সে দু-দিকে মাথা নেড়ে, ঠোঁট উলটে জানাল, শোনেনি।

হায়, ‘মোদের গরব মোদের আশা’! বিশ্বের পঞ্চম ভাষা, তবু বিশ্বের শতকরা পাঁচজন লোকও বাংলা ভাষার অস্তিত্বের কথাই জানে না।

আমার অন্য পাশের কবিটি এসেছে তাহিতি থেকে। সেই তাহিতি, যেখানকার মেয়েদের ছবি এঁকেছেন পল গগ্যাঁ। তাঁর মৃত্যুও সেই দ্বীপে।

কিন্তু তাহিতির কবিটির সঙ্গে যে আলাপ করব, তার উপায় নেই। সে করুণভাবে মাথা নেড়ে নেড়ে বলতে লাগল, নো ইংলিশ, নো ইংলিশ!

এই ভাষার বাধা পরবর্তী দিনগুলিতে আমায় জ্বালিয়ে মেরেছে।

তারিখ পয়লা জুন, কলকাতায় অসহনীয় রকমের গরম, ম্যাডেলিনে নরম-নরম শীত, পনেরো-ষোলো ডিগ্রি, সন্ধের পর এরকম খোলা জায়গায় কোট গায়ে দিলেও আরাম লাগে। এখানকার অনেকের গায়েই অবশ্য সাধারণ রঙিন জামা, মেয়েদের অর্ধেক বুক ভোলা। অনেক জায়গাতেই দেখেছি, মেয়েদের শীতবোধ কম।

উদ্বোধন অনুষ্ঠানটি, কবিতা পাঠ সমেত ঠিক দু-ঘণ্টা। তারপর দলে-দলে বাসে চেপে হোটেলে প্রত্যাবর্তন।

হোটেলটির নাম নুটিবারা। খুব উচ্চাঙ্গের কিছু নয়, সম্ভবত তিন তারা, কিছুটা মলিন হলেও মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। আটতলার ওপর আমার ঘরটি বেশ বড়, টিভি, টেলিফোন ও ফ্রিজ আছে, দুটি আলাদা বিছানা, তাতে দিনে ও রাতে বদলাবদলি করে শোওয়া যায়।

এই ঘরটি আমার এগারো দিনের আস্তানা। একটানা এগারো দিন একই হোটেলে থাকার অভিজ্ঞতা আমার জীবনে আগে কখনও হয়নি।

ঘরটির প্রধান বৈশিষ্ট্য, এর একদিকে পুরোটা কাচ, পরদা সরিয়ে দিলে দেখা যায় পাহাড়, খুব বেশি দূরেও নয়, রাত্তিরবেলা সেই পাহাড়ের গায়ের বাড়িগুলিতে আলো জ্বলে, মনে হয় যেন স্থায়ী দেওয়ালি। আর সন্ধের পর থেকে যত রাত বাড়ে, ততই এই আলোর প্যাটার্ন বদলায়। কিছু আলো নিভে যায়, কিছু নতুন করে জ্বলে ওঠে, বেশিরভাগ আলোই সারারাত জ্বলে।

খুব কাছাকাছি বাড়িগুলির জানলায় হঠাৎ-হঠাৎ দেখা যায় চলন্ত মনুষ্য মূর্তির ছায়া। নারী না পুরুষ? এ কৌতূহল চিরন্তন।

ঘরটির আর একটি চমৎকার ব্যাপার আছে। প্রথমবার দেখে চমকে উঠেছিলাম। দরজার পেছনটা জুড়ে একটা মস্ত বড় আয়না। দরজা বন্ধ করে ঘরের আলো নিভিয়ে দিলে অমনি দেখা যায় উলটোদিকের জানলার ওপাশে সেই আলোকোজ্জ্বল পাহাড়ের পটভূমিকা। অর্থাৎ ঘরটার দুদিকেই যেন পাহাড়, দুদিকেই আলোর খেলা।

সন্ধের পর একলা এ ঘরে থাকতে খারাপ লাগার কথা নয়। কারণ ঘরের বাইরে অনেকখানি দৃশ্যমান প্রকৃতি।

আহারাদির ব্যবস্থা হোটেলের দোতলায় প্রশস্ত ভোজন কক্ষে। প্রাতরাশ, মধ্যাহ্ন ভোজ ও রাত্রির খাবার, কোনও কুপন-টুপনের দরকার নেই। ঘরের চাবিটা দেখালেই হয়। সব খাদ্যদ্রব্য পর পর সাজানো থাকে, প্লেটে ইচ্ছেমতন তুলে নেওয়া যায়। বুফে সিস্টেম যাকে বলে। এই বুফে কথাটার বাংলা প্রতিশব্দ হয় না। সুতরাং এই ফরাসি শব্দটিকে বাংলা ভাষায় ঢুকিয়ে নেওয়াই উচিত। গোটা তিরিশেক টেবিল আছে, তার যে-কোনও একটিতে অন্য কবিদের সঙ্গে বসে পড়লেই হয়। তাতে অন্যান্য দেশের কবিদের সঙ্গে আলাপচারি করা যায়। এটাই তো খুব ভালো ব্যবস্থা। এই সব আন্তর্জাতিক কবি-লেখকদের সমাবেশে প্রকাশ্য অনুষ্ঠানের চেয়েও আড্ডায়, পারস্পরিক মত বিনিময়ে অনেক সুফল পাওয়া যায়।

এখানে সেই সুফল থেকে আমি বঞ্চিত হলাম।

কোনও একটা টেবিলে হয়তো চার-পাঁচজন কবি খাবারের প্লেট সামনে নিয়ে প্রবল আড্ডা ও হাসাহাসিতে মেতে আছে, আমি একটা চেয়ার টেনে বসামাত্র তারা থেমে যায়। আড়ষ্টভাবে তাকায় আমার দিকে। যেন আমি এক অবাঞ্ছিত আগন্তুক।

আমাকে অপদস্থকরার বিশেষ কোনও কারণ নেই, আমার চেহারা তেমন একটা বীভৎস কিছু নয়, আমার গায়ের রংটাও কারণ নয়, কেন না, এখানকার আমন্ত্রিত কবিদের মধ্যে কালো রঙের নারী-পুরুষদেরই প্রাধান্য।

তা হলে?

ভাষার ব্যবধান! প্রায় সকলেই স্প্যানিশভাষী, সেই কারণেই তাদের অস্বস্তি।

কেউ-কেউ অল্প ইংরিজি জানে, তা নিয়ে নিছক মামুলি কথাবার্তা চালানো যায়, কিন্তু যাঁরা কবি এবং ভাষাশিল্পী, তাঁরা যদি নিজেদের মনের ভাব ঠিক মতন প্রকাশ করতে না পারেন, তা হলে একটু পরে নিজের ওপরেই বিরক্ত হয়ে ওঠেন।

তার থেকে কথা না বলাই ভালো।

সিগমুন্ড ফ্রয়েড মোটামুটি ভালোই ফরাসি ভাষা শিখে প্রথমবার এলেন প্যারিস শহরে। কিন্তু সে শহরের রাস্তার লোকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখলেন, পারস্পরিক উচ্চারণ বুঝতে খুবই অসুবিধে হচ্ছে, ফ্রয়েডকে এক কথা বলতে হচ্ছে বারবার। অন্যের কথাও ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। তিনি নিজের ওপর রেগে গিয়ে বললেন, কী! আমি অশিক্ষিতের মতন অন্যের ভাষা শুনে বারবার অ্যাাঁ অ্যাঁ বলব? শিশুরোগ বিষয়ে একটা সেমিনারে তাঁর যোগ দেওয়ার কথা ছিল। যোগ দিলেন না। ফিরে গেলেন নিজের দেশে!

ইংরিজি সাহিত্যে আইরিশ লেখকরা এক সময় আধিপত্য করেছেন। আমাদের অল্প বয়েসে বার্নাড শ’ ছিলেন ইংরেজি ভাষার প্রধান নাট্যকার এবং এক প্রবল ও বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর মাতৃভাষা ইংরিজি ছিল না। আয়ার্ল্যান্ড থেকে তিনি চোস্ত ইংরিজি শিখে এসে প্রথমবার লন্ডন শহরে পা দিয়ে ঘোড়াগাড়িওয়ালাদের ককনি একটা অক্ষরও বুঝতে না পেরে বুঝেছিলেন, তাঁর ইংরিজি ভাষা শিক্ষা সব অসম্পূর্ণ।

আমি যাঁদের টেবিল বসছি, তাঁরা নিজের নিজের দেশে বিশিষ্ট কবি, তাঁদের ভাষায় উচ্চ শিক্ষিত, আমি ভারতীয় জেনে তাঁরা আগ্রহান্বিত, কিন্তু নিজেদের ঠিক মতন প্রকাশ করতে পারছেন না বলে তাঁদের মুখে ফুটে উঠছে অপ্রস্তুত-রেখা। তাঁদের আড্ডা নষ্ট করে দিচ্ছি বলে আমারও নিজেকে অপরাধী মনে হয়।

এখানে এসেই বোঝা গেল, ইংরিজি ভাষার আধিপত্য অনেক দেশেই অকিঞ্চিৎকর। গোটা দক্ষিণ আমেরিকায়, একমাত্র ব্রাজিলে চলে পোর্তুগিজ, বাকি প্রায় সবগুলি দেশে স্প্যানিশ। আরব দেশ ও পৃথিবীর অন্যান্য কয়েকটি দেশের কবিরা ফরাসি ভাষায় স্বচ্ছন্দ, ইংরেজি শেখার দরকারই মনে করেন না।

এই ডাইনিং হলে আমি দুদিন পর থেকেই রাত্রে আসা বন্ধ করেছিলাম। তা শুধু ভাষাগত এই সমস্যার জন্য মোটেই না। সকালে ও দুপুরে আসতে হয় নেহাত ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য। বাইরে খেতে গেলে অনেক পয়সার খরচ হয়, তা ছাড়া রাত্রে অতি স্বল্পহার কিংবা খাদ্যবস্তু একেবারেই বাদ দেওয়া আমি অনেকদিন অভ্যাস করে ফেলেছি। সন্ধের পর শক্ত খাদ্য কিছুই না খেলেও আমি দিব্যি থাকি।

কলম্বিয়া রাজ্যটির খাদ্যবৈশিষ্ট্য কিংবা রন্ধনস্বাদ সম্পর্কে শুধু একটি হোটেলের খাদ্য তালিকার ওপর নির্ভর করে মন্তব্য করা হয়তো উচিত নয়। বাইরের কোনও হোটেল ও রেস্তোরাঁয় গিয়ে আমার খাদ্যের স্বাদ নেওয়া হয়ে ওঠেনি, কারণ ওই যে, একা একা রাস্তায় বেরিয়ে কোথাও খাওয়া সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা!

পৃথিবীর যত হোটেলেই গেছি, ডাইনিং হলের টেবিলের ওপর লরেল ও হার্ডির মতন পাশাপাশি নুন ও গোলমরিচের দুটি শিশি দেখা যায়। এই হোটেলে শিশি মাত্র একটি, শুধু নুনের। গোলমরিচ বলে কোনও বস্তু নেই। বোধহয় সেটা এখানে খুব দামি। সব রান্নাতেই মশলার কোনও চিহ্ন নেই।

সম্ভবত কোনও মশলাই এ দেশে তৈরি হয় না এবং খুব দুর্লভ। কাঁচালঙ্কাও দেখিনি একদিনও। মশলাহীন, ঝালহীন সব রান্না। তা বলে খুব যে স্বাস্থ্যকর খাদ্য, তাও বলা যায় না। মুরগিগুলো অতিশয় বুড়ো, তারা ঠাকুরদা মুরগি, সেইসব মুরগির মাংস ও রুটি দাঁতের বদলে পা দিয়ে ছিড়লে সুবিধে হয়। মাঝে মাঝে যে সুপ দেয়, তা অতি বিস্বাদ, ব্ল্যান্ড যাকে বলে, কোনওরকম সস নেই। একদিন মাশরুম সুপ এই নাম দেখে খুব উৎসাহ করে এক বাটি নিয়ে দেখি, তার মধ্যে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজলেও মাশরুম দেখা যাবে না। পুরোটাই বার্লি। মাঝে মাঝে যে মাছভাজা পাওয়া যায়, তা অতিরিক্ত নোতা।

পাউরুটির সঙ্গে মাখনও দেওয়া হয় না। চিনেও অনেক হোটেলে টোস্টের সঙ্গে মাখন পাইনি, সেটা অবশ্য অপ্রাপ্যতার জন্য নয়। চিনে দুগ্ধজাত সামগ্রীর এখন বিশেষ চল নেই, দই জিনিসটা ওদেশে অজ্ঞাত। রবীন্দ্রনাথ চিন ভ্রমণে গিয়ে ঘরে পাতা দই খেয়েছিলেন বলে, এক চিনা পণ্ডিত নাকি তা দেখে দৌড়ে বাইরে গিয়ে বমি করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন কবি পচা দুধ কী করে খাচ্ছেন!

খাবারের স্বাদ যদি একেবারেই জিভ বিরোধী হয়, আর চেহারা দেখে মুখে নিলেও নিরাশা কিংবা বিবমিষার কারণ হয়, তা হলে তো সব না খাওয়াই ভালো। হোটেলের ঠিক সামনেই, একটা দোকানে আলুভাজা, বাদাম ভাজা ও নানারকম বিস্কিটের প্যাকেট পাওয়া যায়, সেগুলি অনেক রকম জমিয়ে সন্ধের পর থেকে আমি নিজের ঘরে একা।

হোটেলের ঘরের দরজা বন্ধ করলেই বাইরের পৃথিবী থেকে একেবারে বিযুক্ত।

তখন নিজের সঙ্গে নিজের দেখা হয়।

সে বড় জটিল মনোবিজ্ঞান। অধিকাংশ মানুষই নিজের সঙ্গে দেখা করতে চায় না। সেইজন্য একটু ফাঁকা পেলেই ডিটেকটিভ বই পড়ে, কিংবা টিভি দেখে, বউয়ের সঙ্গে প্রেম ঝালিয়ে নিতে গিয়ে আবার ঝগড়া শুরু করে দেয়–

বাধ্য হয়ে একা থাকা আর স্বেচ্ছা-একাকিত্ব এক নয়।

জেলখানায় অনেক বন্দি থাকে নিঃশব্দ কুঠুরিতে, তাদের হাজর জনের মধ্যে এক জনেরও আত্ম-উপলব্ধি হয় না।

আমি ইচ্ছে করলেই হোটেল লবিতে নেমে যেতে পারি। দু-চারজন ইংরিজি-জানা তো আছেই। এমনকী বাংলাতেও কথা বলা যায়।

বাংলাদেশ থেকে এসেছে হায়াৎ সইফ, এটা তার আসল নাম নয়, এই নামে সে কবিতা লেখে, আসল নামে সে মস্ত বড় সরকারি অফিসার। হায়াৎকে অনেকদিন থেকেই চিনি। জিয়াউল করিম নামে একটি অল্পবয়েসি, সুশ্রী সাংবাদিকও এসেছে তার সঙ্গে। অর্থাৎ তিনজন বাংলাভাষী। ব্রেকফাস্টের সময় আমরা এক টেবিলেই বসি, তাতে কেউ একজন ঈষৎ বিদ্রুপের সুরে বলেছিল, তোমরা বাঙালিরা বুঝি সবসময় একসঙ্গে থাকো?

আমি বাকসংযম করে একলা ঘরের মধ্যে নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করি।

সে কাজটাও কিন্তু মোটেই সহজ নয়।

মনটা যেন একটা পানা পুকুরের মতন। পানা সরিয়ে-সরিয়ে যেমন পরিষ্কার জল বার করতে হয়, সেই রকমই অনেক অবান্তর চিন্তা ঢেকে রেখে দেয় স্বচ্ছতা। আয়নার দিকে তাকিয়ে আছি, নিজের মুখের বদলে দেখতে পাচ্ছি একটা টেলিফোন। সেটাকে মুছে দিতেই সেখানে এসে জুড়ে বসল এক ঝুড়ি আভোমাডো। এই ফলটা এখানে খুব পাওয়া যায়।

আবার পানা সরিয়ে সরিয়ে নিজের প্রতিবিম্বটা খোঁজা। তাকে প্রশ্ন করতে হবে, জীবনে কী কী ভুল করেছ?

দ্বিতীয় দিন গভীর রাতে কিছু একটা শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল।

দরজায় কেউ দুমদুম করে ধাক্কা দিচ্ছে।

টেবল ল্যাম্প জ্বেলে ঘড়ি দেখলাম। পৌনে তিনটে। এত রাতে কে আমাকে এই নতুন দেশে ডাকাডাকি করবে? টরেন্টোর একটা হোটেলে একবার এরকম মাঝরাতে দরজায় ধাক্কা দিয়ে কেউ জানিয়েছিল, আগুন লেগে গেছে, শিগগিরি নীচে চলে যাও!

সেটা ঠাট্টা ছিল না, সত্যিই আগুন লেগেছিল হোটেলের একতলায়। এরকম সময় কোনও জিনিসপত্রের জন্য এক মুহূর্তও দেরি করতে নেই, হাতে কোনও কিছু না নিয়ে লিফটের বদলে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামতে হয়। সেবার আমাদের সঙ্গে সেই হোটেলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও ছিল। মনে আছে, সৌমিত্র, স্বাতী ও আমি চোদ্দোতলা সিঁড়ি ভেঙে, একবস্ত্রে রাস্তায় এসে শীতের মধ্যে কেঁপেছিলাম। সে আগুন অবশ্য মারাত্মক হয়নি। নিভিয়ে ফেলা হয়েছিল অচিরেই।

এখানেও সেরকম কিছু ব্যাপার নাকি?

দরজার কাছে এসে জিগ্যেস করলাম, কে?

একটি নারীকণ্ঠ স্প্যানিশ ভাষায় কিছু বলল। বুঝতে না পেরে আমি জানালাম, ইংরেজিতে বলো, কী ব্যাপার।

নারীকণ্ঠ এবার ইংরিজিতেই বলল, ওপন দ্য ডোর!

কেন?কী হয়েছে?

আবার সেই একই কথা, ওপন দ্য ডোর। এই কণ্ঠস্বরে কোনও মিনতি নেই, লাস্য নেই, প্রলোভন নেই। যেন অতি ব্যস্ততা।

কারণ না জানলে এত রাতে দরজা খুলব কেন?

এবার সে বলল, দরজাটা আগে খোল। তুমি আমাকে চেনো!

এ পর্যন্ত কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে আমার টুকরো-টুকরো কথাবার্তা হয়েছে বটে, কিন্তু এমন পরিচয় কারুর সঙ্গেই হয়নি, যে এই ঘোর নিশীথে আমার ঘরে আসতে চাইবে।

হোটেলের ঘরে অচেনা মেয়েদের আনাগোনা পৃথিবীর অনেক দেশেই আছে।

আমার এরকম প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিল ব্যাংককে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের আমল থেকে ব্যাংককে তৈরি হয়েছিল একটা বিরাট নারী মাংসের বাজার।

আমি সেবারে সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানি ঘুরতে ঘুরতে বিমান কোম্পানির সৌজন্যে দুদিন ব্যাংককে বিনা খরচে থাকার কুপন পেয়েছিলাম। এখন ব্যাংককে বিশাল ও অত্যাধুনিক বিমানবন্দর তৈরি হয়েছে, তখন বিমানবন্দরটি ছিল ম্যাড়মেড়ে আর ছোট আকারের। আমাদের দেশে যেমন অনেক তীর্থস্থানেই রেল স্টেশনে পাণ্ডারা হেঁকে ধরত এক সময়ে, ব্যাংককেও বিমানবন্দরের বাইরে একদল লোক চিলুবিলু করছিল, তারা গাইড হতে চায়। কেউ-কেউ হাত চেপে ধরেছিল আমার। খুবই ক্লান্ত ছিলাম, ঠেলাঠেলি করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত একজন মোটাসোটা লোককে বলেছিলাম, ঠিক আছে, চলো আমার সঙ্গে।

ওরে বাবা, সে কী গাইড! তার নিজস্ব গাড়ি আছে, সে গাড়িতে তুলে সে আমায় তার একটি সচিত্র পরিচয়পত্র দেখাল।

সে একজন পুলিশ। ছুটির দিনে অতিরিক্ত রোজগারের জন্য সে গাইডের কাজ করে। সারাদিন সে আমার কাজে নিযুক্ত থাকবে, আমাকে ট্যাক্সি ভাড়ার অতিরিক্ত খরচ করতে হবে না।

সে আমাকে নিয়ে তুলল একটি মাঝারি হোটেলে। সে হোটেলের ম্যানেজার থেকে পরিচারিকা পর্যন্ত সবাই মেয়ে, একজনও পুরুষ নেই। কিন্তু তাদের ব্যবহার খুবই ভদ্র ও নম্র। খাবার-দাবারও বেশ সুস্বাদু ও স্বাভাবিক দামের। সুতরাং নালিশ করার কিছু নেই। বরং নারীদের এই স্বাধীন উদ্যোগ ও কর্মক্ষমতা দেখলে ভালোই লাগে।

কিন্তু আমাকে জ্বালিয়ে খেয়েছে পুলিশ-গাইডটি। সারারাত বিমানে কাটিয়ে পৌঁছেছি সকালে। এখন কিছুক্ষণ চা-টা খেয়ে বিছানায় গড়াগড়ি না দিলে গায়ের ব্যথা মরবে না। কিন্তু ঘরে পৌঁছবার পাঁচ মিনিট পরেই শ্রীমান এসে উপস্থিত। দন্ত্যবর্ণ বহুল ইংরিজিতে সে বলল, চলো, বেড়াতে যাবে না? আমি বললাম, এখন কী! আগে স্নান করব, বিশ্রাম নেব, ঘুম-ঘুম পাচ্ছে, তুমি দুপুরে এসো।

তা সে শুনবেই না। সে সারাদিন আমার কাজ করার জন্য তৈরি। সারাদিনের জন্য এক রেট, তা হলে শুধু-শুধু সময় নষ্ট করছি কেন? তাতে আমার কিছু আসে যায় না, তবু সে নাছোড়বান্দা, এমনই কর্তব্যপরায়ণ। তার পীড়াপীড়িতে আমাকে বেরুতেই হল।

লোকটি পুলিশ কর্মী বলে আমি ধরে নিয়েছিলাম, সে চোর জোচ্চোর হবে না এবং অন্য চোর জোচ্চোরদের কাছ থেকে আমাকে আড়াল করে রাখবে।

সে আমাকে তিরিশ হাজর জীবন্ত কুমির, বুদ্ধ মন্দির-টন্দির দেখাবার পর নিয়ে এল একটা বাড়ির সামনে। আমি সোনার গয়না ও জামা-কাপড় কিনব কিনা জানতে চাইলে তাকে জানালাম, আমার ওসব কিছু দরকার নেই। এবার হোটেলে ফিরে চলো, একদিনের পক্ষে যথেষ্ট দেখা হয়েছে, এখন আমার শরীর বিশ্রাম চাইছে।

এইসব দোকান থেকে কেনাকাটি করলে গাইডরা কমিশন পায়, জানি, তাই সে একটু নিরাশ হয়ে বলল, আর একটা জায়গায় শুধু চলো–

সে বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম দোতলায়। একটা লম্বা টানা বারান্দা, রেস্তোরাঁর মতন পরপর অনেকগুলি টেবিল ও চেয়ার, কিন্তু আলো প্রায় নেই, অন্ধকারই বলা যায়।

আমরা টেবিলে বসা মাত্রই একজন লোক দু-প্লেট সসেজ ও দু-বোতল বিয়ার দিয়ে গেল। এ কী ব্যাপার! কিছু না চাইতেই এসব দেবে কেন? গাইডটি মুচকি হেসে বলল, ফ্রি-ফ্রি।

কিন্তু বিনা পয়সার খাদ্য-পানীয়তে আমার বিন্দুমাত্র রুচি নেই। তা নিয়ে আপত্তি জানাতে জানাতেই হঠাৎ একসঙ্গে জ্বলে উঠল অনেক আলো। দেখা গেল একটা অদ্ভুত দৃশ্য। বারান্দার পাশে একটা হলঘর, সেখানে একটা গ্যালারি, তাতে থাকে-থাকে দাঁড়িয়ে আছে তিরিশ-বত্রিশটা মেয়ে। তাদের পোশাক বলতে কিছুই নেই, প্রত্যেকের গলায় সুতোয় বেঁধে ঝোলানো কার্ডে এক একটি নম্বর। অন্য টেবিল থেকে একজন চেঁচিয়ে একটা নম্বর বলতেই সেই নম্বরের মেয়েটি গ্যালারি থেকে নেমে এসে দেখাতে লাগল তার অঙ্গ সৌষ্ঠব।

হঠাৎ আমার অস্বাভাবিক রাগ হয়ে গেল। ব্যাবসার জন্য এরা মেয়েদের এত নীচে নামিয়ে এনেছে। এ যেন গরু-ছাগলের হাট। শরীর-স্বাস্থ্য দেখিয়ে এক-একটি মেয়েকে বিক্রি করা হবে এক-দুঘণ্টার জন্য। পুরুষরা চালাচ্ছে এই ব্যাবসা, পুরুষরাই খদ্দের। আমি নিজে একজন পুরুষ বলে লজ্জায় ঘেন্নায় প্রায় চোখে জল এসে যাচ্ছিল।

আমি গাইডকে জিগ্যেস করলাম, তুমি কেন আমায় এখানে এনেছ?

সে আবার হেসে বলল, ‘ফ্রি, ফ্রি।’

অর্থাৎ সে বলতে চাইল, আমি কোনও মেয়েকে সাময়িকভাবে কিনতে না চাইলেও শুধু দেখতে কোনও খরচ নেই। অথবা সে নিজেও দেখতে চায়।

ধুত্তোর বলে আমি দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে, সামনেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে চলে এলাম হোটেলে।

লোকটি খানিক বাদে হোটেলে এসে উপস্থিত হল, সে আমার রাগের কারণই বুঝতে পারল না। অধিকাংশ ভারতীয়ই নাকি এই সব জায়গায় যেতে চায়। অনেকে ওরকম চার-পাঁচ জায়গায় ঘোরে। সন্ধের পর সে আমাকে আরও আকর্ষণীয় জায়গায় নিয়ে যাবে।

আমি বললাম, তোমাকে আর আমার দরকার নেই, তুমি বিদায় হও।’

সে পাঁচশো ডলার হেঁকে বলল।

একবেলা মাত্র কয়েকটি জায়গায় নিয়ে গেছে, তার জন্য পাঁচশো ডলার? এ কি মামদোবাজি! তার গাড়ির ভাড়া ও তার মজুরি হিসেব করে আমি পঞ্চাশ ডলার বার করে বললাম, এটা নিতে চাও, নাও। নইলে আমি পুলিশ ডাকব।

পুলিশ ডেকে আর একজন পুলিশকে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে আমি সুফল পেতাম, না আরও বেশি বিপদে পড়তাম, তা জানি না। কিন্তু তখন আমার মেজাজ এমনটা চড়ে ছিল যে ওই মুখটাই দেখতে ইচ্ছে করছিল না, ও আর বেশি কথা বললে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে হয়তো ওকে মেরেই বসতাম।

আমার ওই উগ্রমূর্তি দেখে ও আর দরাদরি না করে বিদায় নিয়েছিল।

সেই হোটেলেও মাঝরাত্তিরে ঠুকঠুক শব্দ হয়েছিল দরজায়। খুবই মৃদু এবং কোনও কণ্ঠস্বর ছিল না। কয়েকবার শোনার পর দরজা খুলে দিয়েছিলাম। একটি রমণী খুবই লাজুকভাবে জিগ্যেস করেছিল, আপনার কি মালিশ করাবার দরকার আছে।

আমার দরকার নেই শুনেও সে আমাকে একটি কাগজ দেখিয়েছিল। তার যে-কোনও অসুখ নেই, সেই মর্মে একটি ডাক্তারি সার্টিফিকেট। আমার পুনশ্চ প্রত্যাখানের পর সে খুবই কুণ্ঠিতভাবে সরি স্যার, থ্যাংক ইউ স্যার বলে বিদায় নিয়েছিল, একটুও জ্বালাতন করেনি।

সাংহাই-এর হোটেলের লিফটে এক উগ্র সাজে সজ্জিতা রমণী ওই একই প্রশ্ন করেছিল, তোমার মালিশের প্রয়োজন আছে? তোমার রুম নাম্বার কত? তাকে আমি বলেছিলাম, আমি একজন গরিব লোক, মালিশ করাবার মতন বিলাসিতা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রবল শীতের মধ্যে এক হোটেলের বাইরে দশ বারোটি পাতলা পোশাক পরা রমণীর দাঁড়িয়ে থাকার করুণ দৃশ্যটি এখনও আমার চোখে ভাসে। ওখানে তখন সব জিনিসের অগ্নিমূল্য, নিজের বা পরিবারের সকলের খিদের জ্বালায় ওই মেয়েরা নিজেদের বিক্রি করতে এসেছিল, হোটেলের দারোয়ান মাঝে-মাঝে তাদের তাড়া করে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, কোনও পুরুষ সঙ্গী না থাকলে তাদের ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই।

আমি মেয়েদের কাছ থেকে মাধুর্য চাই, দয়াও চাইতে পারি। মেয়েদের ওপর জোর জবরদস্তি করা কিংবা তাদের অসহায় অবস্থার সুযোগ নেওয়া নিকৃষ্টতম অন্যায়, তবু পৃথিবীতে এই অন্যায়টাই চলছে সবচেয়ে বেশি।

এখানে এই কলম্বিয়ার হোটেলে কী ঘটছে? একটি মেয়ে জোর জবরদস্তি করে ঢুকতে চাইছে আমার ঘরে? একবার দরজা খুললে সে ভেতরে এসে আমার নামে যে-কোনও মিথ্যে অভিযোগ দিতে পারে।

আমি দরজা খুলব না বলায় সে একই রকম ধাক্কা দিতে-দিতে একই কথা বলতে লাগল, খোলো, খোললা, তুমি আমায় চেনো!

আমি বললাম, এবার আমি পুলিশ ডাকব।

তবু সে নিরস্ত হচ্ছে না দেখে আমি টেলিফোনে অপারেটরকে ডেকে বললাম, দ্যাখো, একজন কেউ আমার ঘরে এসে হামলা করছে, তোমরা লোক পাঠাও। একটা কিছু ব্যবস্থা করো।

হা হতোস্মি! অপারেটর এক বর্ণ ইংরিজি জানে না। এর আগেও দেখেছি। এই হোটেলের অপারেটর ইংরিজি ওয়ান-টু-ও বোঝে না, এখানে ঘর থেকে আন্তর্জাতিক কল করার ব্যবস্থা নেই, আমি তাকে যতবার নম্বর বলেছি, সে বুঝতে পারেনি, শেষ পর্যন্ত একটা কাগজে সংখ্যাটা লিখে দিতে হয়েছিল।

সুতরাং এখন আমি যা বলতাম, তা সে কিছুই বোঝেনি, এবং সে স্প্যানিশেকী যে বলে যেতে লাগল, তাও আমার বোধগম্য হল না।

আমার ঘরের দরজায় এত জোর শব্দ হচ্ছে, অন্য কোনও ঘর থেকে কেউ বেরিয়ে আসছে না? ছিটকিনি বন্ধ আছে, দরজা যদি ভেঙে ঢুকতে চায় তো ঢুকুক। চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আর উপায় কী?

খানিক পরে সব শব্দ থেমে গেল।

এরপর কি আর সহজে ঘুম আসে?

আমার স্বভাব এই, এমন কোনও একটা ঘটনা যদি ঘটে যায়, যার আমি ব্যাখ্যা খুঁজে পাই। ব্যাখ্যা খুঁজতে-খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে গেলে এক সময় মনে হয়, সত্যিই কি এরকম কিছু ঘটেছিল? কিংবা সবটাই অলীক?

একটা মাত্র ক্ষীণ ব্যাখ্যা মনে আসে। রমণীটি কি অন্য কোনও চেনা লোকের ঘরের বদলে ভুল করে ধাক্কা মারছিল আমার ঘরে? বারবার বলছিল, তুমি আমাকে চেনো। তুমি আমাকে চেনো!

এটাও ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।

কয়েক রাত পরে আবার একটা কিছুটা অন্য রকমের ব্যাপার ঘটল।