০৬. সন্ধে হয়ে গেছে

সন্ধে হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও পুরোপুরি আলো মিলিয়ে যায়নি। দূর থেকে ভীমবেঠক পাহাড়টা দেখলে কিছুই বোঝা যায় না। মনে হয় যেন একটা সাধারণ উঁচু টিলা। এর ভেতরে যে অতগুলো গুহা আছে, তা কল্পনা করাই শক্ত। আসলে পাহাড়টা একটা মৌচাকের মতন, রক শেলটার বা গুহাতেই ভর্তি।

কাকাবাবু নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিলেন। ওপরে পৌঁছবার পর আমরা ওঁকে জাগিয়ে দিলুম। মালপত্রগুলো সব বয়ে নিয়ে যাওয়া হল সাধুবাবার আশ্রমের কাছে। তারপর গাড়িটা ফিরে গেল।

প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঝুপ করে নামল অন্ধকার। সেই অন্ধকার এমন কুচকুচে কালো যে পাশের লোককেও দেখা যায় না। শুধু দূরে দেখা যায় ধুনির আগুন।

সাধুবাবা সত্যিকারের সাহসী লোক। রাত্তিরে এখানে উনি একা থাকেন। যে দু তিনজন লোককে দিনের বেলা ওঁর আশ্রমে দেখছিলুম, তারা পাহাড়ের নীচের গ্রামের লোক। সন্ধেবেলা ফিরে যায়।

ধুনির আগুনের কাছাকাছি আমাদের খাটগুলো পেতে ফেলা হল। রাত্তিরে মিংমা আমাদের জন্য রান্না করবে। মিংমা দারুণ খিঁচুড়ি রাঁধে।

সাধুবাবা ধ্যানে বসেছেন, ওঁর সঙ্গে কোনও কথা বলা গেল না। কাকাবাবু ঘড়ির ওপর টর্চের আলো ফেলে বললেন, সাড়ে সাতটা বাজে, রাত দশটা আন্দাজ চাঁদ উঠবে, তখন আমরা একটু বেড়াতে বেরুব।

জায়গাটা যে কী অসম্ভব নিস্তব্ধ, তা বলা যায় না। এখানে বিঝির ডাক পর্যন্ত নেই। সেরকম একটা জঙ্গলও দেখিনি এই পাহাড়ে। মাঝে-মাঝে একটা দুটো বড় গাছ, তবে ছোট গাছই বেশি। অবশ্য দুপুরবেলা গুহাগুলো দেখতে যখন পাহাড়ের পেছন দিক দিয়ে নীচে নামছিলাম, তখন আরও নীচের দিকে জঙ্গলের মতন দেখেছি। আমরা ঘুরেছিলাম মাত্ৰ চল্লিশ-পয়তাল্লিশটা গুহায়, এ ছাড়াও, কত গুহা না-দেখা রয়ে গেছে।

দিনের বেলায় ধীরেনদার সেই কথাটা মনে পড়ল। তাই আমি কাকাবাবুকে বললুম, আচ্ছা কাকাবাবু, আমরা এই কদিন একটা বেশ ভালমতন গুহার মধ্যে থাকলে পারতুম না?

কাকাবাবু বললেন, হিংস্র জন্তুর হাত থেকে বাঁচবার জন্য সেকালের মানুষের পক্ষে গুহায় থাকাই সবচেয়ে সুবিধের ছিল। কিন্তু একালে মানুষই সবচেয়ে হিংস্র। আমাদের যদি কেউ মারতে চায়, তাহলে গুহার বাইরে থেকে গুলি চালিয়ে খুব সহজেই মেরে ফেলতে পারে। তা ছাড়া, আমরা একটা গুহার মধ্যে ঢুকে বসে রইলে চারিদিকে নজর রাখতে পারব না।

তারপর সাধুবাবার আশ্রমের দিকে হাত তুলে বললেন, দেখেছিস, সাধুজি কী চমৎকার জায়গা বেছেছেন। সামনে এতখানি পরিষ্কার জায়গা, তিন দিকে যেন ঠিক পাথরের উঁচু দেয়াল। সবাইকে এখানে সামনে দিয়েই আসতে হবে। এখানে বসে থাকলে গাড়ির রাস্তা পর্যন্ত দেখা যায়।

সাধুবাবা একটা হরিণের ছালের ওপর জোড়াসনে শিরদাঁড়া একদম সোজা করে বসে আছেন। চোখ দুটো বোজা। আমরা যে নিজেদের মধ্যে কথা বলছি, তাতেও উনি একবারও চোখ খোলেননি।

মিংমা মুগ্ধ হয়ে সাধুবাবার দিকে তাকিয়ে আছে। ও নিশ্চয়ই হিমালয় পাহাড়ে এরকম আরও সাধু দেখেছে, তাই ওর চেনা লাগছে। আমি গল্পের বইয়ের ছবিতে ছাড়া এরকম কোনও ধ্যানমগ্ন সাধুকে দেখিনি। উনি কি সারারাতই এইভাবে থাকবেন নাকি?

কাকাবাবু আমায় বললেন, খাওয়া হয়ে গেলে তুই আর মিংমা যখন ইচ্ছে ঘুমিয়ে পড়তে পারিস। আমি রাত আড়াইটে পর্যন্ত জগব। তারপর মিংমাকে তুলে দেব।

কাকাবাবু আবার ঘড়ি দেখলেন। পৌনে আটটা মোটে। সময় যেন কাটতেই চায় না।

একটু বাদে মিংমা স্টেভ জেলে রান্না চাপিয়ে দিল। আমি ওর পাশে বসে ব্যগ্রভাবে চেয়ে রইলুম। রান্না দেখা ছাড়া আর তো কোনও কাজ নেই।

হঠাৎ একটা বিকট শব্দ শুনে আমি চমকে ভয় পেয়ে একেবারে মাটিতে শুয়ে পড়ছিলুম। আর একটু হলে। মিংমা হিহি করে হেসে উঠল। আসলে আওয়াজটা মোটেই বিকট কিংবা অদ্ভুত নয়। আমি অন্যমনস্ক ছিলুম বলেই প্রথমে মনে হয়েছিল, দুপুরবেলা শোনা গুহার বাইরে সেই শব্দের কথা।

আগে লক্ষ্য করিনি, আশ্রমের সামনের চাতালের এক কোণে একটি গোরু শুয়ে আছে। দুপুরে বরং এখানে একটি কুকুর দেখেছিলুম, সেটা এখন নেই। বোধহয় গ্রামবাসীদের সঙ্গে নীচে নেমে গেছে।

কিন্তু গোরুটা হঠাৎ ডেকে উঠল। কেন? আমি টর্চ নিয়ে গেলুম গোরুটার কাছে। অন্ধকারের মধ্যে গোরুর চোখে টর্চের আলো পড়লে ঠিক আগুনের ভাটার মতো জ্বলজ্বল করে। মনে হয় কোনও হিংস্ৰ প্ৰাণী।

গোরুটা আর একবার ডাকল, হা-ম-বা।

আর অমনি সাধুবাবা চেঁচিয়ে বললেন, বোম ভোলা-মহাদেও-শঙ্করজি!

এবার সাধুবাবার ধ্যানভঙ্গ হল। মনে হল, গোরুটাই যেন সাধুবাবার ঘড়ির কাজ করে। সাধুবাবা যাতে ধ্যান করতে করতে সারা রাত কাটিয়ে না দেন ংবা ঘুমিয়ে না পড়েন, সেই জন্য গোরুটা রোজ এই সময় ওঁর ধ্যান ভাঙিয়ে দেয়।

কাকাবাবু সাধুবাবাকে বললেন, সাধুজি, আমরা আপনার অতিথি হয়ে এসেছি। এখানে থাকব।

সাধুবাবা বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, থাকুন। আরামসে থাকুন। কোই বাত নেই। এ-পাহাড় তো আমার নয়। পাহাড়, সমুন্দর, জঙ্গল–এ সবই ভগবানকা, যে-কোনও মানুষ থাকতে পারে।

কাকাবাবু বললেন, আপনি ঠিক বললেন না, সাধুবাবা। দিন কাল বদলে গেছে। ভগবানের আর অত বেশি সম্পত্তি এখন নেই। পৃথিবীর সব পাহাড় আর জঙ্গলই এখন কোনও না কোনও গভর্নমেন্টের। আমি যদি এই পাহাড়ে বাড়ি বানিয়ে থাকতে যাই, অমনি সরকারের লোক এসে আমাদের ধরবে। সমুদ্রের কিছুটা জায়গা এখনও খালি আছে বটে।

সাধুবাবা বললেন, আমি তো এখানে আছি বহোত দিন।

আপনাদের কথা আলাদা। আপনি সাধুবাবা, আমাদের সরকার এখনও সাধু-সন্ন্যাসীদের কিছু বলে না। আচ্ছা সাধুজি, আপনি যে বলছিলেন, রাত্রে এখানে শব্দ শুনতে পান, তা কিসের শব্দ? মানুষের চলাফেরার?

হাঁ, হাঁ।

একজন মানুষ, না অনেক?

দো-তিন আদমি আসে মনে হয়।

আপনি কোনও গাড়ির শব্দ পান? তারা গাড়িতে আসে?

না, গাড়ির আওয়াজ পেয়েছি না।

হুঁ। আচ্ছা, আপনি রাত্রে কী খাবেন? আমাদের হাতের রান্না। আপনি খবেন কি?

সাধুজি জানালেন, না, উনি রাত্রে শুধু এক বাটি দুধ ছাড়া আর কিছু খান না। উনি ঘুমোনও খুব তাড়াতাড়ি। ধুনির আগুনে মাঝে-মাঝে কাঠ ফেলার জন্য অনুরোধ জানিয়ে উনি একটু বাদেই চলে গেলেন আশ্রম-গুহার মধ্যে।

মিংমা রান্না সেরে ফেলার পর আমরাও খেয়ে নিলুম।

কাকাবু ঠিকই বলেছিলেন। সাড়ে নটা বাজবার পরে পাশের পাহাড়ের আড়াল থেকে একটু-একটু করে উঠতে দেখা গেল চাঁদের মুখ। আস্তে আস্তে গাঢ় অন্ধকারটা পাতলা হয়ে একটু আলো ফুটে উঠল।

কাকাবাবু বললেন, চলো, সবাই মিলে একটু ঘুরে আসা যাক। খাওয়ার পর একটু হাঁটাও হবে।

খানিকক্ষণ হেঁটে আমরা প্রথম সারির গুহাগুলোর কাছে দাঁড়ালুম। টর্চ নিভিয়ে দিতেই গাটা কেমন ছমছম করে উঠল। এ রকম অদ্ভুত অনুভূতি আমার আর কোনও জায়গায় গিয়ে হয়নি। মনে হল, আমরা যেন পঞ্চাশ হাজার কিংবা এক লক্ষ বছর আগেকার সময়ে ফিরে গেছি। আদিম গুহাবাসী মানুষরা এখানে থাকে। এক্ষুনি তাদের কারুকে দেখতে পাব। আবছা আলোয় একটু দূরের পাথরের চাইগুলোকে মনে হচ্ছে কালো কালো হাতির পাল।

আর থাকতে না পেরে আমি টর্চ জেলে ফেললুম।

তারপরই দারুণ ভয় পেয়ে বলে উঠলুম, ও কী?

টর্চের আলোটা সোজা যেখানে গিয়ে পড়েছে, সেখানে একটা পাথরের ওপর গুটিসুটি মেরে বসে আছে। একজন মানুষ।

কাকাবাবুও দেখতে পেয়েই সঙ্গে-সঙ্গে রিভলভার উঁচিয়ে বললেন, হু ইজ দেয়ার? উধার কৌন হ্যায়?

লোকটি তাতেও নড়ল না।

কাকাবাবু আবার বললেন, দো হাত উপর উঠাকে সামনে চলা আও। নেহি তো গোলি চালায় গা!

লোকটি এবার আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়াল। ধুতি আর শার্ট পরা, গ্ৰাম্য লোকের মতন চেহারা। কিন্তু মুখে একটা হিংস্র ভাব। আমাদের দিকে কয়েক পলক চেয়ে রইল, তারপর সামনে এগিয়ে আসার বদলে চট্ট করে লুকিয়ে পড়ল একটা পাথরের আড়ালে।

সেইটুকু সময়ের মধ্যেই কাকাবাবু ওকে গুলি করতে পারতেন বটে, কিন্তু মারলেন না।

চাপা গলায় আমায় বললেন, সন্তু, টর্চটা নিভিয়ে দিয়ে চট্ট করে শুয়ে পড় মাটিতে।

প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই একটা বড় পাথরের টুকরো গিয়ে পড়ল আমাদের পেছনে। ঐ পাথরটা মাথায় লাগলে আর দেখতে হত না।

তারপরই মিংমার গলার আওয়াজ পেলুম, আংকেল সাব, পাকড় গ্যয়া।

মিংমা বুদ্ধি করে। এরই মধ্যে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে পেছন দিক দিয়ে গিয়ে লোকটাকে ধরে ফেলেছে। আমি টর্চ জেলে ছুটে গেলুম সেই পাথরটার কাছে।

মিংমা সেই লোকটার দুটো হাত পেছন দিকে মুচড়ে ধরে আছে। ছোটখাটো চেহারা হলেও মিংমার শরীরে দারুণ শক্তি। এ লোকটা ওর সঙ্গে জোরে পারবে কেন!

ক্রচ নিয়ে কাকাবাবুর এসে পৌঁছতে একটু দেরি হল। তিনি বললেন, সন্তু, এর মুখে ভাল করে আলো ফেলে দ্যাখ তো, এই লোকটাই দুপুরে তোদের ভয় দেখিয়েছিল। কিনা?

আমি সঙ্গে-সঙ্গেই বললুম না।

মিংমাও মাথা ঝাঁকাল। কারণ, এই লোকটা বেশ রোগা আর মুখখানা লম্বাটে। বয়েসও যথেষ্ট, প্রায় ষাটের কাছাকাছি। পরচুলা আর নকল দাড়ি লাগিয়েও ওর পক্ষে আদিম গুহাবাসীর ছদ্মবেশ ধরা সম্ভব নয়।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে এ-লোকটা এখানে একা বসে আছে কেন? সন্তু, দ্যাখ তো ওর জামার পকেটে কী আছে? মিংমা, ভাল করে ধরে থাকো ওকে।

জামার পকেটে একটা বিড়ির কৌটো, দেশলাই আর কিছু খুচরো পয়সা ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না। কাগজপত্র কিছু নেই। কিন্তু লোকটির কোমরের কাছে কী যেন একটা শক্ত, উঁচু জিনিস হাতে লাগল। জামোটা তুলে দেখলুম, একটা বেশ বড় ভোজলি ওর কোমরে গোঁজা।

কাকাবাবু বললেন, হুঁ! সঙ্গে এত বড় ছুরি, আবার পাথর ছুঁড়ে আমাদের মারতে চেয়েছিল, তা হলে তো উনি সাধারণ কোনও লোক নন। এই, তুমি কৌন হায়?

লোকটি কোনও উত্তর না দিয়ে কট্‌মট্‌ করে তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে।

তুম কাঁহে পাথথর ফোকা? হামলোগ তুমহারা দুশমন হ্যায়?

লোকটা তবুও চুপ।

ইত্‌না রাতমে কাঁহে ইধার বৈঠা থা? তুমহারা মতলোব কেয়া হ্যায় ঠিক বাতু বাতাও!

লোকটা তবু কোনও সাড়া-শব্দ করে না।

কাকাবাবু এবার মিংমাকে বললেন, আর একটু জোরে চাপ দাও তো! দেখি ও কথা বলে কি না!

মিংমা লোকটার হাত দুটো বেশি করে মুচড়ে দিতে লাগল। একটু একটু করে লোকটার মুখে ফুটে উঠল ব্যথার চিহ্ন। তারপর এক সময় সে চিৎকার করে উঠল, অ্যাঁ, অ্যাঁ-।

ঠিক বোবা মানুষদের মতন আওয়াজ!

টর্চের আলোয় দেখা গেল, লোকটার মুখের মধ্যে জিভ নেই। জিভ ছাড়া কোনও মানুষের মুখ তো আমি আগে দেখিনি! মুখের ভেতরটা অদ্ভুত গোল, দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে।

আমি উত্তেজিতভাবে বললুম, কাকাবাবু!

কাকাবাবু বললেন, তুই বুঝতে পেরেছিস, সন্তু? এ লোকটা নিশ্চয়ই মনোমোহন ঝাঁর সেই চাকর, যার জিভ কেটে দেওয়া হয়েছে।

আমি বললুম, ওকে জিভ-কাটা অবস্থায় এই পাহাড়ের কাছেই পাওয়া গিয়েছিল।

কাকাবাবু বললেন, এখানকার পুলিশের কাছে সেই খবর শুনে আমার আরও সন্দেহ হয়েছিল, এই পাহাড়টা ঘিরেই সব রহস্য আছে।

এই লোকটা কথা বলতে পারবে না। আর লিখতে-পড়তেও জানে না-।

কিন্তু জায়গা চেনার ক্ষমতা ওর আছে। খুঁজে-খুঁজে এখানে আবার এসেছে। নিশ্চয়ই প্ৰতিশোধ নেবার জন্য।

কাকাবাবু মিংমাকে বললেন, লোকটিকে ছেড়ে দিতে। তারপর ওকে বললেন, শুনো, হামলোগ তুমহারা মনিব মনোমোহন ঝাঁ-জিকা দুশমন নেহি! হামলোগ তুমহারা ভি দোস্তু হ্যায়। খুনিকো হামলোগ পাকাড়নে চাতা হ্যায়।

লোকটি কাকাবাবুর কথা কতটা বুঝতে পারল কে জানে। তবে মনোমোহন ঝাঁর নামটা শুনে একটু বোধহয় ভাবান্তর দেখা গেল।

কাকাবাবু আবার হিন্দিতে বললেন, তুমি আমাদের সঙ্গে এসো। আমরা এখানে থাকছি, তুমিও সঙ্গে থাকবে।

লোকটিকে আমাদের সঙ্গে আসবার ইঙ্গিত করে কাকাবাবু চলতে শুরু করলেন। লোকটা কয়েক পা এল পেছন-পেছন। তারপরই হঠাৎ দৌড় লাগাল।

মিংমা আর আমি দুজনেই দৌড়লাম ওকে ধরবার জন্য। কিন্তু লোকটা যেন অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল চোখের নিমেষে।

খানিকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর ব্যর্থ হয়ে আমরা ফিরে এলুম কাকাবাবুর কাছে। দিনের বেলায়ই কেউ এখানে লুকোতে চাইলে তাকে খুঁজে বার করা মুশকিল, আর রাত্তিরবেলা তো অসম্ভব।

কাকাবাবু আফসোস করে বললেন, রাগে-দুঃখে লোকটার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। নইলে আমাদের কথা শুনল না কেন? ও এক এক কী করে প্রতিশোধ নেবে? শত্রুপক্ষ যে অতি ভয়ংকর, তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই। চল, আমরা এবার শুয়ে পড়ি।

আমরা আবার ফিরে এলুম আশ্রমের কাছে। শুয়ে-শুয়ে অনেকক্ষণ ধরে ভাবতে লাগলুম ঐ জিভ-কাটা মানুষটির কথা! ইশ, মানুষ এত নিষ্ঠুরও হয় যে, অন্য একজন মানুষের জিভ কেটে দিতে পারে! ওরা তো আরও তিনজন নিরীহ ঐতিহাসিককে খুন করেছে। মনোমোহন ঝাঁর এই সঙ্গীটিকে তো ওরা খুন করতে পারত, তার বদলে শুধু জিভ কেটে দিল কেন? আরও বেশি অত্যাচার করবার জন্য?

সহজে ঘুম আসতে চায় না। চিৎ হয়ে শুলেই ওপরে দেখা যায় আকাশ। এখন কয়েকটা তারাও ফুটেছে। বেশ ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে মাঝে-মাঝে। দু একটা শুকনো পাতা উড়ে যাবার খরখর শব্দ শুনতে পাচ্ছি এক-একবার। তারপর দূরে এক জায়গায় যেন একটা পাথর গড়িয়ে পড়ার শব্দ পেলাম। কাকাবাবু বললেন, ও কিছু না।

তারপর কখন যেন চোখ বুজে এসেছিল। আর-একবার একটা শব্দ পেয়ে আবার জেগে উঠলুম।

কাকাবাবু ধুনির আগুনে কাঠ ছুঁড়ে দিচ্ছেন। কাকাবাবুর হাতে একটা কাপ। এর মধ্যে কখন যেন নিজের জন্য কফি বানিয়ে নিয়েছেন। রাত এখন কটা বাজে কে জানে। পাশের খাটে মিংমা ঘুমোচ্ছে অঘোরে।

এক সময়ে চোখে আলো পড়তে ঘুম ভেঙে গেল। ওমা, সকাল হয়ে গেছে। দেখছি! তাহলে সারা রাত কিছুই ঘটেনি?

কাকাবাবু আর মিংমা সাধুবাবার সঙ্গে চা-খেতে-খেতে গল্প করছেন। তা হলে আমাদের তৈরি চা খেতে আপত্তি নেই সাধুবাবার।

তড়াক করে নেমে পড়লুম খাট থেকে।

কাকাবাবু বললেন, বিছানা তুলে খাটটা ফোলাড করে ফ্যাল, সন্তু! খাটগুলো সব আশ্রমের পিছন দিকে লুকিয়ে রাখতে হবে। দিনের বেলা এখানে কিছু-কিছু লুক আসতে পারে। আমরা যে এখানে থাকি, তা তাদের জানানোর দরকার নেই।

এখানে জলের বেশ সমস্যা আছে। আমরা দুটো বড় ফ্ল্যাস্ক ভর্তি জল এনেছিলাম, সে তো মুখ হাত ধুতেই ফুরিয়ে যাবে। সারাদিন আমাদের অনেক জলের দরকার হবে।

সাধুবাবা জানালেন যে, পাহাড়ের নীচে নেমে খানিকটা দক্ষিণে গেলে যে গ্রামটা আছে, সেখানকার কুয়ো থেকে জল আনা যায়। অথবা, পাকা রাস্তা ধরে নেমে গেলে মাইল দুএক দূরে যে লেভেল ক্রসিং আছে একটা, সেখানকার গুমটি-ঘরের পাশে টিউবওয়েল আছে।

আমরা জলের ব্যবস্থার কথা আগে চিন্তা করিনি। ঠিক হল যে, আমি আর মিংমা নীচে যাব জলের সন্ধানে। সাধুবাবার শিষ্যরা তাঁর জন্য দুতিন দিন চলার মতন জল একেবারে এনে দেয়।

আমরা পাউরুটি আর জেলি খেয়ে নিলুম। তারপর কাকাবাবুকে রেখে মিংমা আর আমি বেরিয়ে পড়লুম জলের জন্য।

কাল রাত্তিরবেলা অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় পাহাড়টাকে কী রকম ভয়ের জায়গা বলে মনে হচ্ছিল। এখন দিনের লাওয় সব কিছুই সুন্দর। সেই জিভকাটা লোকটা কি এখনও লুকিয়ে আছে। এই পাহাড়ের মধ্যে? তাহলে সে খাবে কী? আর সেই লোকটা, যে গুহা-মানব সেজে আমাদের ভয় দেখিয়েছিল?

দিনের আলোয় ভয় থাকে না, তবু আমরা এগোতে লাগলুম সাবধানে। গুহাগুলো সবই পাহাড়ের এক দিকে, অন্য দিকটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে নীচের উপত্যকায়। আমরা হাঁটতে লাগলুম সেই ফাঁকা দিকটা ঘেঁষে।

কিছুক্ষণ নামবার পর একটা গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল। মিংমাকে নিয়ে আমি লুকোলুম একটা গাছের আড়ালে। গাড়িটা এই পাহাড়ের ওপরেই আসছে।

গাড়িটা হুশ করে আমাদের পেরিয়ে যাবার পর আমি চেঁচিয়ে উঠলুম, আরেঃ! এই থামো, থামো!

চ্যাঁচামেচি শুনে গাড়িটা একটু দূরে দাঁড়িয়ে আবার ব্যাক করে এল। গাড়িতে ধীরেনদা আর রত্নেশদা। ওঁরা বোধহয় আর থাকতে পারেননি, ভোর রাতেই বেরিয়ে পড়েছেন আমাদের খোঁজ নিতে।

ধীরেনদা বললেন, কী, তোমরা সব ঠিকঠাক আছ তো?

আমরা গাড়িতে উঠে পড়ে বললুম, গাড়ি ঘোরান, আমাদের জল আনতে যেতে হবে। আপনারা এসে পড়েছেন, বেশ ভালই হল, হাঁটতে হবে না।

ধীরেনদা বললেন, তাই তো, এখানে যে জল নেই, সেটা আমারও খেয়াল হয়নি।

যখন এক সময় মানুষ থাকত, তখন তারা জল পেত কোথায়?

ধীরেনদা বললেন, তখনকার লোকেদের তো কোনও কাজ ছিল না, তারা পাহাড়ের তলা থেকে রোজ জল নিয়ে আসত। কিংবা তখন হয়তো, কোনও ঝরনা ছিল এই পাহাড়ে। এখন শুকিয়ে গেছে। এক লক্ষ বছর আগে কী ছিল, তা তো বলা যায় না!

আমরা ফ্ল্যাস্ক দুটো এনেছিলাম, কিন্তু ঐটুকু জলে তো চলবে না। তাই ধীরেনদা আমাদের নিয়ে গেলেন। কাছাকাছি একটা ছোট শহরে। জায়গাটার নাম ওবায়দুল্লাগঞ্জ। সেখান থেকে কেনা হল বড়-বড় তিনটে কলসি। এক দোকান থেকে বেশ গরম-গরম জিলিপি আর কচুরি খেয়ে নিলাম পেট ভরে। কাকাবাবুর জন্যও নিয়ে যাওয়া হল কিছু।

ফেরার পথে কলসির জল ছলাত ছলাত করে পড়তে লাগল। গাড়িতে। আমি আর মিংমা ধরে বসে আছি।

রত্নেশদা বলল, কাল সকালেও তো আবার জল আনতে যেতে হবে। মুবার আসতে হবে আমাদের।

ধীরেনদা বললেন, ভাবছি, একজন ড্রাইভারসুন্ধু একটা গাড়ি জোগাড় করে আজ বিকেলে এখানে পাঠিয়ে দেব। যে-কদিন দরকার, সে এখানে থাকবে।

আমি বললুম, না, না, গাড়ির দরকার নেই। যেমনভাবে আগেকার গুহাবাসীরা নীচে থেকে জল আনত, সেইরকমভাবে কাল থেকে আমি আর মিংমা জল বয়ে আনব।

পাহাড়ের ওপরে পৌঁছে আশ্রমের সামনে কাকাবাবুকে দেখতে পেলুম না। সাধুবাবাও নেই।

গুহাগুলোর দিকে গিয়ে একটু খোঁজাখুঁজি করতেই অবশ্য কাকাবাবুকে পাওয়া গেল। যে বড় গুহাটার নাম অডিটোরিয়াম অর্থাৎ প্রেক্ষাগৃহ, সেটার সামনে একটা বড় পাথরের ওপর বসে কাকাবাবু একটা কাগজে সেটার ছবি আকিছেন।

ধীরেনদাদের দেখে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী হে, তোমরা কেমন আছ? রাত্তিরে কোনও বিপদ-টিপদ হয়নি তো?

ধীরেনদা হেসে ফেলে বললেন, না, কিছু হয়নি। আপনারাও তো ভালই আছেন দেখছি।

কিছুক্ষণ গল্প করার পর ধীরেনদারা চলে গেলেন। তার একটু পরেই আবার শুনতে পেলুম একটা গাড়ির আওয়াজ।