০৬. মোহন সিং কাকাবাবুকে নিয়ে গেল

মোহন সিং কাকাবাবুকে নিয়ে গেল শর্মাজির সঙ্গে দেখা করাতে। অন্য একটা তাঁবুতে কাকাবাবুকে বসিয়ে বিনীতভাবে বলল, আপনি একটু আরাম করুন রায়চৌধুরী সাব, আমি শর্মাজিকে খবর দিচ্ছি। সকাল থেকে ওঁর শরীরটা আবার খারাপ যাচ্ছে।

কাকাবাবু শান্তগলায় বললেন, অত বুড়ো মানুষকে তোমরা এখানে নিয়ে এলে কেন? উনি কেমন আছেন, তা দেখতেই তো আমি এসেছি।

মোহন সিং হেসে বলল, কী করব, বলুন! ওঁর যে সিনেমায় পার্ট করার শখ হয়েছে। উনি বিজয়নগরের হিস্ট্রি নিয়ে রিসার্চ করে নতুন-নতুন খবর বার করেছেন। তাই নিয়ে গল্প লিখেছেন। সে গল্প নিয়ে সিনেমা হচ্ছে বলে উনি নিজেই বুড়ো রাজার পাট করতে চান।

কাকাবাবু বললেন, বুড়ো বয়েসের শখ। কিন্তু এত ধকল কি ওঁর শরীরে সইবে?

মোহন সিং এমনভাবে কথা বলছে যেন কাকাবাবুর সঙ্গে কোনওদিন তার ঝগড়া হয়নি। সে আবার বলল, আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা সঙ্গে একজন ভাল ডাক্তার রেখেছি। আর একদিনের শুটিং হলেই শমজিকে আমরা বাড়িতে পাঠিয়ে দেব। আপনি বসুন, আমি আসছি।

এই তাঁবুর মধ্যে রয়েছে একটা সিংহাসন, আরও দুটি মখমলের চেয়ার। কাকাবাবু সেগুলোতে না বসে বসলেন একটা নেমন্তন্ন বাড়ির চেয়ারের মতন কাঠের চেয়ারে। ক্রাচ দুটো পাশে দাঁড় করিয়ে রাখলেন।

একটু পরেই খুব সাজগোেজ করা একটি মেয়ে তাঁবুর মধ্যে ঢুকে বলল, নমস্তে, আমার নাম কস্তুরী। আপনি ভাল আছেন রায়চৌধুরী সাহেব?

কাকাবাবু মেয়েটিকে চিনতে পারলেন। এই মেয়েটিই রাস্তার চায়ের দোকানে অসুস্থ ভগবতীপ্রসাদ শর্মার মাথাটা কোলে নিয়ে সেবা করছিল। এখন তার পোশাক অন্যরকম, হাতে একটা চাবুক।

কাকাবাবু বললেন, নমস্কার। শর্মাজির আবার শরীর খারাপ হয়েছে। শুনলাম! আমি ওঁকে দেখতে এসেছি।

কস্তুরী বলল, এখন ঠিক হয়ে গেছেন। অত বুড়ো হলেও মনের জোর আছে খুব। সব কথা মনে থাকে।

একটি লোক একটা লম্বা-গেলাসে শরবত এনে বলল, লিজিয়ে সাব!

কাকাবাবু বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ, আমি এখন শরবত খাব না!

খেয়ে দেখুন, সাব। বহুত বঢ়িয়া শরবত! পেস্তা আর মালাই আছে।

কাকাবাবু বললেন, আমি একটু আগে চা খেয়েছি। এখন শরবত খেতে পারব না। এটা নিয়ে যাও।

লোকটি বলল, তা হলে চা নিয়ে আসব? চা আনছি এক্ষুনি!

কাকাবাবু বললেন, চা-ও লাগবে না। চা খেয়ে এসেছি বললুম যে!

কস্তুরী বলল, এই জগগু, উনি খাবেন না বলছেন, তাও কেন জোর করছিস। কিছু লাগবে না, যা!

লোকটি চলে যাবার পরেই মোহন সিং ধরে-ধরে নিয়ে এল বৃদ্ধ শমজিকে। তাঁর হাতে একটা রুপো বাঁধানো ছড়ি, পরে আছেন একটা জরির চুমকি বসানো লম্বা আলখাল্লা। সাদা ধপধপে চুল ও দাড়ি আর ওইরকম আলখাল্লার জন্য তাঁকে অনেকটা রবীন্দ্রনাথের মতন দেখাচ্ছে এখন। তিনি বুকে হাত দিয়ে কয়েকবার খুকখুক কাশলেন।

কাকাবাবু তাঁকে দেখে সম্মানের সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, শমজি, হেঁটে আসতে আপনার কষ্ট হয়েছে! আপনি যেখানে শুয়ে ছিলেন, সেখানে আমাকে ডেকে পাঠালেই তো পারতেন।

শর্মাজি কাশি থামিয়ে বললেন, না, না, ঠিক আছি। এখন ঠিক আছি। শুটিং করবার সময় হাঁটা-চলা করতে হবে না? ঘোড়ার পিঠেও চড়তে হবে। আমি সব পারব। আপনি, রায়চৌধুরী। আপনি এসেছেন, আমি খুব খুশি হয়েছি।

কাকাবাবু বললেন, আপনি আমাকে আসতে বলেছিলেন। আপনার সঙ্গে দেখা করে আমার সঙ্গের ছেলেমেয়েদের বিজয়নগর রুইনস একটু ঘুরিয়ে দেখাব। এখানকার ইতিহাস তো অনেকেই জানে না।

শর্মাজি বললেন, হ্যাঁ, দেখান কিন্তু তারপর তাড়াতাড়ি চলে গেলে চলবে। আপনি আমাদের শুটিং-এর সঙ্গে থাকুন, আমাদের অ্যাডভাইস দিন! হিস্ট্রির কোথাও যদি ভুল হয়, আপনি আমাকে ধরিয়ে দেবেন!

কাকাবাবু হেসে বললেন, আপনি থাকতে আমি আর কী ভুল ধরাব? আপনার চেয়ে বেশি কেউ জানে?

শর্মাজি বললেন, আমি তো শুটিং-এ ব্যস্ত থাকব, আমি কি সব দিক দেখতে পারব? আপনার মতামতে আমাদের অনেক উপকার হবে। মোহন সিং, তুমি রায়চৌধুরীর থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে দাও!

বৃদ্ধ শর্মাজি বসলেন সিংহাসনটিতে, আর ভেলভেটের চেয়ার দু খানায় বসল মোহন সিং আর কস্তুরী।

কাকাবাবু বললেন, আপনি তা হলে রাম রায়-এর পার্ট করছেন? আপনাকে মানাবে ভাল।

শর্মাজি বললেন, হ্যাঁ, আমি সাজছি রাম রায়। মোহন সিং হবে আলি আদিল শাহ। আর কস্তুরী হচ্ছে রাজা সদাশিবের বউ, মহারানি পদ্মিনী। তার ছোট বোন ধারাদেবীর ভূমিকায় আছে সুজাতাকুমারী। আরে, তোমরা রায়চৌধুরীকে শরবত দিলে না? কাউকে আনতে বলল!

কাকাবাবু বললেন, এনেছিল আমার জন্য। আমি এখন খাব না।

শর্মাজি বললেন, রায়চৌধুরী, আপনাকে কাল রাত্তিরে কানে কানে কী বলেছিলাম, মনে আছে তো? আপনি এবার সেই কথা এদের সামনে বলে দিতে পারেন।

কাকাবাবু মোহন সিং আর কস্তুরীর মুখের দিকে তাকালেন একবার। তারপর বললেন, হ্যাঁ, এখন বলে দিলে ক্ষতি নেই। আপনি বলেছিলেন যে, আলি আদিল শাহ কথা বলার সময় একটু স্ট্যামার করবে। মানে একটু তোতলা। শুটিং-এর আগে সেটা মনে করিয়ে দিতে। কোনও ইতিহাস বইতে একথা লেখা হয়নি আগে।

শর্মাজি একটু চমকে উঠে বললেন, এই কথা বলেছিলাম? ও ব্র্যা! তখন আমার খুব জ্বর ছিল তো। কী বলতে কী বলেছি মনে নেই। আর কী বলেছিলাম বলুন তো?

কাকাবাবু সামান্য চিন্তা করে বললেন, আপনাকে ঠিক সময় সরবিট্রেট ওষুধ খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিতে বলেছিলেন।

শর্মাজি বললেন, হ্যাঁ, ঠিক! আর?

কাকাবাবু বললেন, রাম রাজার কাটা মুণ্ডু দেখাতে হবে। সেজন্য মাটির মুণ্ডু তৈরি করে সেখানে আলতা মাখিয়ে রক্ত বোঝাতে হবে।

শর্মাজি এবার রেগে গিয়ে মোহন সিংকে বললেন, এই লোকটা আমাদের সঙ্গে চালাকি করছে!

কাকাবাবু এবার জোরে হেসে উঠলেন। পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছে বললেন, হ্যাঁ চালাকিই তো করছি। নয়তো কি বোকামি করব? এই লোকটা তো শমজির ডামি। আসল শর্মাজি কোথায়?

মোহন সিং সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। কস্তুরী তার চাবুকটা উঁচিয়ে ধরল।

শর্মাজি তাদের দিকে হাত উঁচু করে থামতে ইঙ্গিত করে বললেন, এ আপনি কী বলছেন, রায়চৌধুরী সাহেব? আমার কোনও ডামি নেই। আমি তো যুদ্ধ করব না। আপনি এদের সঙ্গে ঠাট্টা করছেন নিশ্চয়ই!

কাকাবাবু বললেন, কিসের ঠাট্টা? এই মোহন সিং-এর দল সবাইকে এত বোকা ভাবে কেন? একটা লোককে ভগবতীপ্রসাদ সাজিয়ে আনলেই আমি তা বিশ্বাস করব? কাল রাত্তিরে আমি যাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। আজ তাঁকে চিনতে পারব না? শর্মাজি আমাকে আপনি বলে কথা বলেন না, তুমি বলেন। আমাকে রায়চৌধুরী বলে ডাকেন না, রাজা বলেন। তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, তাঁর স্মৃতিশক্তি খুব ভাল। আমি এতক্ষণ বানিয়ে বানিয়ে যেসব কথা বলে গেলুম, তা শুনেই এই লোকটা হ্যাঁ-হ্যাঁ করল! আমি প্রথম এসে দেখেই বুঝতে পেরেছি। আসল শর্মাজি কোথায়। আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে চলো!

মোহন সিং কস্তুরীকে বলল, আমি আগেই বলেছিলাম না, এই লোকটা ঝঞ্ঝাট পাকাবে। একে এখানে আসতে দেওয়াই ঠিক হয়নি।

কস্তুরী চাবুকটা তুলে শপাং-শপাং করে বলল, এবার ওর উচিত শিক্ষা হবে।

মোহন সিং বলল, দেরি করে লাভ নেই, ওকে খতম করে দিই?

কাকাবাবুর হাতে ততক্ষণে তার রিভলভার চলে এসেছে। সেটা মোহন সিং-এর দিকে তুলে কড়া গলায় বললেন, মোহন সিং, কাল তোমায় একটুর জন্য প্রাণে মারিনি, মনে নেই? আমাকে শিক্ষা দেওয়া অত সহজ নয়। শর্মাজি আমাকে বারবার বলেছেন, এখানে এসে দেখা করতে। সেইজন্যই আমি এসেছি। শর্মাজির সঙ্গে দেখা না করে আমি যাব না।

নকল শর্মাজি হুকুম দিল, এই লোকটার মুণ্ডু কেটে জলে ভাসিয়ে দাও!

কাকাবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়েও পারলেন না।

তাঁবুর পেছন দিকে একটা ঢোকার জায়গা আছে। সেখান দিয়ে জগণ্ড নামের লোকটা কখন ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে, কাকাবাবু টেরও পাননি। তিনি পেছন ফিরে তাকাবারও সময় পেলেন না।

জগ্‌গু একটা লাঠি দিয়ে খুব জোরে মারল কাকাবাবুর মাথায়।

কাকাবাবু হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। রিভলভারটা হাত থেকে ছিটকে গিয়ে একটু দূরে পড়তেই মোহন সিং সেটাকে পা দিয়ে চেপে ধরল। তারপর সে কস্তুরীর হাত থেকে চাবুকটা কেড়ে নিয়ে এক ঘা কষাতে গেল কাকাবাবুর পিঠে।

কাকাবাবু নিজেকে একটু সামলে নিয়ে সেই চাবুকটা ধরে ফেলেন। ততক্ষণে জগু আর-একবার লাঠি তুলেছে। প্রথম আঘাতেই কাকাবাবুর মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরোতে শুরু করেছে। দ্বিতীয় আঘাত লাগলে তাঁর বাঁচবার আশা থাকবে না।

তিনি স্পষ্ট গলায় বললেন, থামো! আমাকে মেরে ফেললে তোমাদের কোনও লাভ হবে না। হিরেটা কোনওদিন খুঁজে পাবে না তোমরা। বিজয়নগরের হিরের সন্ধান আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ জানে না। শর্মাজি যে ম্যাপটা এঁকে দিয়েছেন তাতে মাত্র অর্ধেকটা আছে। যদি তোমরা ওঁকে ফাঁকি দাও, সেইজন্য উনি পুরোটা আঁকেননি। সেটা তোমরা কিছুই বুঝবে না। সেই ম্যাপের বাকি অংশটার কথাই তিনি আমাকে কানে কানে বলে দিয়েছিলেন!

কাকাবাবু এক হাতে মাথাটা চেপে ধরলেন। তবু রক্ত বন্ধ হল না। যন্ত্রণায় মুখটা কুঁচকে গেল, চোখ দুটো বুজে এল।

কস্তুরী লাফিয়ে উঠে বলল, শিগগির ডাক্তার ডাকো। লোকটাকে বাঁচিয়ে তোলো! বিজয়নগরের হিরে আমার চাই-ই চাই! চাই-ই চাই!

কাকাবাবুর জ্ঞান ফিরে এল মিনিট-পনেরো পরেই। তিনি বুঝতে পারলেন যে, তাঁকে এনে একটি খাটে শোওয়ানো হয়েছে, একজন ডাক্তার তাঁর মাথায় ব্যান্ডেজ করছে। তিনি কোনও কথা বললেন না। মাথার যন্ত্রণাটা অনেকটা কমে গেছে। তা হলে খুব বেশি কাটেনি।

ব্যান্ডেজ বাঁধার পর ডাক্তার তাঁর ডান হাতের জামা গুটিয়ে একটা ইঞ্জেকশান দিতে এল। কাকাবাবু বাধা দিলেন না। একটু পরেই তাঁর আবার ঘুম পেয়ে গেল।

পরের বার যখন ঘুম ভাঙল, তখন প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে। কাকাবাবু ওঠবার চেষ্টা করতেই বুঝলেন যে তাঁর সমস্ত শরীর শক্ত কোনও দড়ি দিয়ে বাঁধা। হাত দুটো পেছন দিকে মোড়া, একটু নড়াচড়া করাও সম্ভব নয়। ঘুমন্ত অবস্থাতেও তাঁকে ওরা বিশ্বাস করেনি, তাই এরকমভাবে বেঁধে রেখেছে।

কাকাবাবু চিৎকার করে ডাকলেন, মোহন সিং! মোহন সিং!

কয়েকবার ডাকাডাকি করার পর প্রথমে অন্য একজন তোক ঘরের মধ্যে উঁকি মারল। তারপর সে চলে গিয়ে ডেকে আনল মোহন সিংকে। সঙ্গে এল কস্তুরী, তার হাতে একটা মোমবাতি।

দুজনে এসে কাকাবাবুর খাট ঘেঁষে দাঁড়াল।

কাকাবাবু বললেন, মোহন সিং, আমাকে বেঁধে রেখেছ কেন? তুমি আমাকে এখনও চেনোনি মনে হচ্ছে। কিন্তু তোমার ভাই আমাকে চিনেছিল, সে এখনও জেল খাটছে, তাই না? আমাকে কিছুতেই তোমরা মেরে ফেলতে পারবে না। আমাকে বেঁধে রাখলে আমার পেট থেকে একটা কথাও বার করতে পারবে না?

মোহন সিং দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, রায়চৌধুরী, তুমি আমার ভাইকে জেল খাটিয়েছ। কাল সন্ধেবেলা আচানক আমার গলা টিপে ধরেছিলে। আমি আজ তার শোধ নেব। তোমার মাংস একটু-একটু করে কেটে কুকুরকে খাওয়াব।

কাকাবাবু বললেন, বেশ, তাই খাওয়াও, দেখি তোমার কেমন সাধ্য! তোমার মতন দুবৃত্ত আমি আগে অনেক দেখেছি। আজ পর্যন্ত তো কেউ আমার কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। আমার একটা পা যে ভাঙা দেখছ, এটা হঠাৎ একটা অ্যাকসিডেন্টে হয়েছে, কেউ ভেঙে দেয়নি। এবারে তুমি কী করতে পারো দেখা যাক!

মোহন সিং কাকাবাবুর গলা টিপে ধরতে যাচ্ছিল, কস্তুরী তাকে বাধা দিয়ে বলল, আহা, থামো না। আগে আমি দু-একটা কথা বলি!

তারপর সে খুব মিষ্টি গলায় বলল, রায়চৌধুরীবাবু, আমি আপনার সাহস দেখে অবাক হয়ে গেছি। মোহন সিং-এর ভাইকে আপনি পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন। আপনার ওপর মোহন সিং-এর এত রাগ, তবু আপনি এখানে

এলেন কেন?

কাকাবাবু বললেন, আমি তো মোহন সিং-এর কাছে আসিনি। এসেছিলাম প্রোফেসার শর্মার সঙ্গে দেখা করতে। তিনি আমাকে আসতে বলেছিলেন। তিনি আমার গুরুর মতন, তিনি আসতে বললেও মোহন সিং-এর ভয়ে আমি আসব না?

কস্তুরী বলল, সঙ্গে কয়েকটি অল্পবয়েসী ছেলেমেয়ে নিয়ে এলেন, তাদের বিপদের কথাও চিন্তা করলেন না?

কাকাবাবু বললেন, জীবনে কতরকম বিপদ আসে। ভয় পেয়ে দূরে থাকলে কি সব বিপদ কাটানো যায়? ওরা নিজের ইচ্ছেতে আমার সঙ্গে এসেছে, ওদের যদি কোনওরকম বিপদ হয়, ওরা নিজেরাই বাঁচার চেষ্টা করবে। এইভাবে বাঁচতে শিখবে।

মোহন সিং বলল, ওদের আর তুমি দেখতে পাবে না কোনওদিন।

কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? তা হলে বিজয়নগরের হিরের সন্ধানও ৪৩২

তোমরা কোনওদিন পাবে না?

মোহন সিং বলল, আলবাত পাব। আমরা এমন ব্যবস্থা করেছি যে, কোনও জায়গা খুঁজতে বাকি থাকবে না।

কাকাবাবু বললেন, অতই সহজ? চারশো বছর ধরে কত লোক সেই হিরে খুঁজেছে, কেউ পায়নি। তোমরা সমস্ত বিজয়নগর খুঁড়ে ফেললেও পাবে না, এই আমি বলে দিচ্ছি।

কস্তুরী বলল, এই মোহন সিং, আস্তে কথা বলো। বাবুজি, আমরা এখানে কেন এসেছি জানেন? আমরা এসেছি এখানে ফিল্মের শুটিং করতে। তার সঙ্গে হিরের কী সম্পর্ক আছে?

কাকাবাবু বললেন, ফিল্মের শুটিং-এর নাম করে এসে তোমরা পুরো জায়গাটা ঘিরে ফেলেছ। পুলিশ বসিয়েছ। বাইরের লোকদের ঢুকতে দিচ্ছ না। সেই সুযোগে তোমরা বিজয়নগরের বিখ্যাত হিরে খুঁজে বার করবে। প্রোফেসর শমা তোমাদের এই বুদ্ধি দিয়েছেন, আমি জানি। কিন্তু শর্মাজি তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি ধুরন্ধর। সেই হিরে পেলেও তিনি তোমাদের সেটা দিতেন না। সেই হিরে আবিষ্কার করলে সারা পৃথিবীতে তাঁর নাম ছড়িয়ে যাবে, সেটাই হবে তাঁর শেষ কীর্তি, তিনি এই কথা ভেবে এসেছেন।

কস্তুরী বলল, শর্মাজির কথা বাদ দিন। অত বুড়ো মানুষ দিয়ে কাজ চলে না। আমি সেই হিরে খোঁজার জন্য যা বন্দোবস্ত করেছি, তাতে আমার এর মধ্যেই পনেরো লাখ টাকা খরচা হয়ে গেছে।

কাকাবাবু বললেন, বিজয়নগরের হিরে পাওয়া গেলে তার দাম হবে পনেরো কোটি টাকারও বেশি। কোহিনূরের চেয়েও দামি!

কস্তুরী বলল, আপনি সেই হিরে বার করে দিন। আপনি কত টাকা। নেবেন?

কাকাবাবু বললেন, বাঃ বেশ! আমাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে সামনে দাঁড়িয়ে মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলা হচ্ছে। আগে বাঁধন খুলে দাও, তারপর কথা হবে!

মোহন সিং গর্জে উঠে বলল, খবদার, কস্তুরী ওর কথা শুনো না। এ লোকটা সাপের মতন, একবার ছাড়লে কী করবে তার কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। ওকে ছাড়া হবে না!

কস্তুরী তার দিকে চোখ রাঙিয়ে বলল, তুমি চুপ করো!

তারপর কাকাবাবুকে বলল, আগে আপনার সঙ্গে কথাবার্তা ঠিক হোক, তারপর আপনার হাত-পায়ের দড়ি খুলে দেওয়া হবে তো নিশ্চয়ই! আপনি বলুন, আপনি আমাদের সাহায্য করার বদলে কী নেবেন? মনে রাখবেন কিন্তু, মোহন সিং আপনাকে যখন-তখন খতম করে ফেলতে রাজি। আমি আপনাকে বাঁচাব। আপনার প্রাণের দাম কি একটা হিরের চেয়েও বেশি নয়?

কাকাবাবু বললেন, শর্মাজি আমাকে বলেছিলেন, তিনি বেঁচে থাকতে আমি যেন হিরের ব্যাপারে নাক না গলাই। তাতে তাঁর ক্রেডিট নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি কোনও কারণে মরে গেলে, তারপর যেন আমি ওই কাজে হাত দিই। তিনি আমাকে সব বাতলে দিয়েছেন, আমিও তাঁর কাছে শপথ করেছি। শর্মাজি কোথায়?

মোহন সিংয়ের দিকে একবার দ্রুত দেখে নিয়ে কস্তুরী বলল, ওঁর আজ সকাল থেকে হঠাৎ প্যারালিসিস হয়ে গেছে, কোমার মতন অবস্থা। কথা বলতে পারছেন না। বোধহয় আর জ্ঞান ফিরবে না। হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

কাকাবাবু অবিশ্বাসের সুরে বললেন, এটা সত্যি কথা?

কস্তুরী বলল, জি হাঁ, এটা সত্যি কথা। আপনাকে শুধু-শুধু মিথ্যে কথা বলব কেন! শর্মাজি খুবই অসুস্থ। তিনি এখানে নেই। ডাক্তাররা বলেছেন, তাঁকে এবারের মতন বাঁচাবার চেষ্টা হলেও তিনি আর কথা বলতে পারবেন না। লিখতেও পারবেন না। তাতেই আমাদের খুব মুশকিল হয়ে গেল।

কাকাবাবু বললেন, তোমাদের যে কোন্টা সত্যি আর কোন্টা মিছে, তা বোঝা মুশকিল। যাকগে, আমার সঙ্গে যে আর চারজন ছিল, তারা কোথায় গেল?

মোহন সিং রুক্ষ গলায় বলল, তাদের কথা বাদ দিন! কথা হবে শুধু আপনার সঙ্গে আর আমাদের সঙ্গে। আমার যে ভাই জেল খাটছে, তাকে নিয়ে। কি আমি দরাদরি করছি? আপনার সঙ্গে যারা এসেছিল, তারা বাড়ি চলে গেছে। আপনি কী শর্তে আমাদের সাহায্য করতে চান, সেটাই বলুন।

কাকাবাবু বললেন, কোনও শর্ত নেই। আমার সঙ্গে যে চারজন ছিল, তাদের আগে এনে হাজির করো, নইলে তোমাদের মতন স্বার্থপর লোকদের সঙ্গে আমি কোনও কথাই বলব না?

মোহন সিং আর রাগ সামলাতে না পেরে কস্তুরীর থেকে চাবুকটা নিয়ে দু ঘা কষিয়ে দিল কাকাবাবুর বুকে। গরগর করতে করতে বলল, হারামজাদা, তোমাকে এক্ষুনি খুন করে ফেলতে পারি। তবু তুমি বড় বড় কথা বলছ? বাঁচতে চাও তো শিগগির বলল, হিরেটা কোথায়?

কাকাবাবু বললেন, কে জানে হিরেটা কোথায়? মোহন সিং, তুমি যে আমাকে দুঘা চাবুক কষালে, ঠিক সেই দুঘা তুমি আবার ফেরত পাবে!

মোহন সিং চাবুক তুলে বলল, তোমাকে আমি যদি এক্ষুনি খতম করে দিই তা হলে কে আমাকে আটকাবে?

কস্তুরী বলল, কী পাগলের মতন কথা বলছ, মোহন সিং! শর্মাজি আমাদের যে ম্যাপ দিয়েছেন, তা দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। রায়চৌধুরীর সাহায্য আমাদের দরকার। ৪৩৪

কাকাবাবু বললেন, মোহন সিং, আমাকে যত ইচ্ছে চাবুক মেরে হাতের সুখ করে নিতে চায় নিক, কিন্তু আমি আর একটাও কথা বলব না! আমার সঙ্গের চারজন ছেলেমেয়েকে আমি আগে দেখতে চাই এখানে?

মোহন সিং বলল, হবে না! আমার যে ভাই জেল খাটছে, আমি কি তাকে ছেড়ে দেবার কথা বলেছি? ওর লোকেরাও কোথায় আছে আমি জানি না!

কাকাবাবু মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলেন। তাঁর চোখ কিংবা মুখ এরা বাঁধেনি। তবু তিনি যেন এদের আর মুখ দেখতে চান না।

কস্তুরী বলল, আমি একটা শর্ত করছি। আপনি বিজয়নগরের হিরের একটা কিছু রাস্তা দেখিয়ে দিন, আজই আমি আপনার সামনে আপনার দলের কোনও ছেলেমেয়েকে হাজির করব। শুধু একজন। ঠিক আছে?

কাকাবাবু বললেন, তারা কোথায় আছে আমি জানতে চাই!

কস্তুরী বলল, আপনি একজনকে দেখতে পাবেন। তার মুখেই জানতে পারবেন সব কথা।

কাকাবাবু বললেন, মোহন সিং-কে আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু তুমি একটি মেয়ে, আশা করি তুমি কথার খেলাপ করবে না! হিরেটার কাছে পৌঁছবার চারটে স্টেপ আছে। আমি শুধু প্রথম স্টেপটার কথা বলব। একটা গোপন লোহার দরজা! সেটা যদি তোমরা বার করতে পারো, তা হলে আমার দলের একজনকে আমার সামনে হাজির করবে? কথা দিচ্ছ?

কস্তুরী বলল, বাবুসাহেব, এই হিরেটার জন্য আমি বহু টাকা খরচ করে ফেলেছি। যে কোনও উপায়ে সেটা আমার চাই। আপনি কথা রাখলে আমিও কথা রাখব।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে। ভাল করে শুনে নাও। বিঠলস্বামী মন্দিরের মেইন গেটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তারপর দক্ষিণ দিকে সোজা পা ফেলে-ফেলে এগোবে। ঠিক তিনশো পা গিয়ে থামবে। তুমি নিজে মাপবে, কোনও পুরুষকে দিয়ে মাপালে বেশি হয়ে যাবে। তোমার মতন কোনও মেয়ের তিনশো পা। দড়ি ফেলে দাগ টেনে দেখে নেবে ঠিক সোজা তিনশো পা হয়েছে কি না। তারপর সেই জায়গাটা খুঁড়তে শুরু করবে। তিনশো যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখানে পাঁচ ফুট ব্যাসের একটা বৃত্ত এঁকে নিয়ে খুড়বে। একটা কুয়োর মতন করে সেই পাঁচ ফুট খুঁড়ে ফেলবে। দশ ফুট গভীর হবে। তারপর সেখানে একজন লোককে নামিয়ে দেবে। সেই লোকটি বিঠলস্বামী মন্দিরের দিকে মুখ করে দাঁড়াবে। দাঁড়িয়ে সেই কুয়োর দেয়ালে হাত বুলোলে একটা লোহার দরজা পাবে। বড় দরজা নয়, একটা লোহার সিন্দুকের দরজার মতন, কোনওরকমে একজন মানুষ সেখানে ঢুকতে পারে। ব্যস, এই পর্যন্ত বলে দিলাম। এবার যাও, খুঁজে দ্যাখো। যা বললাম, ঠিক ঠিক মনে আছে তো, না লিখে নেবে?

কস্তুরী বলল, লিখে নিচ্ছি, লিখে নিচ্ছি।

মোহন সিং বলল, দাঁড়াও! যদি পুরোটাই এই বাঙালিবাবুর ধোঁকা হয়? শমজির ম্যাপে বিঠলস্বামীর মন্দিরের উত্তর দিক পর্যন্ত দেখানো আছে। আর এ বলছে সম্পূর্ণ উলটো, দক্ষিণ দিক।

কস্তুরী একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে বলল, আমাদের শুধু-শুধু ধোঁকা দিয়ে ওর কী লাভ?

মোহন সিং বলল, সময় নষ্ট করিয়ে দেবে। কাল সকালের মধ্যে আমাদের শুটিং শেষ করার কথা, গভর্নমেন্ট তার বেশি পারমিশান দেবে না।

কাকাবাবু বললেন, দশ ফুট গর্ত খুঁড়তে কত সময় লাগবে? একসঙ্গে বিশজন লোক লাগিয়ে দাও, দু ঘন্টায় হয়ে যাবে! তারপরই দেখতে পাবে,

সেখানে লোহার দরজা আছে কি না?

মোহন সিং আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কস্তুরী তার হাত ধরে থামিয়ে দিল। চোখের ইঙ্গিতে কী যেন বোঝাল তাকে।

তারপর কাকাবাবুর দিকে ফিরে বলল, ঠিক আছে, রায়চৌধুরীবাবু। আপনার কথামতন আমরা খুঁড়ে দেখব। যদি সত্যিই লোহার দরজা পেয়ে যাই, আপনিও আপনার দলের একজনকে ফেরত পেয়ে যাবেন। আর যদি আমাদের ধোঁকা দিয়ে থাকেন, আপনার মাংস আমরা কুকুর দিয়ে খাওয়াব। তারপর কঙ্কালটা জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসব। সবাই জানবে, জংলি জানোয়াররা আপনাকে মেরে ফেলছে।

কাকাবাবু হেসে বললেন, জংলি জানোয়ার কি শুধু জঙ্গলেই থাকে? মানুষের পোশাক পরেও ঘোরাফেরা করে। নাঃ, আপাতত আমার মরার কোনও ইচ্ছে নেই। যাও, খুঁড়তে শুরু করো। ঠিক যেরকমভাবে বললাম, ভুল না হয়।

মোহন সিং আর কস্তুরী দ্রুত বেরিয়ে গেল।

কাকাবাবুর ইচ্ছে হল পাশ ফিরে শুতে। হাত নাড়াবার চেষ্টা করে বুঝলেন, খুব শক্ত করে বেঁধেছে, সারা শরীরে দড়িটা একেবারে কেটে-কেটে বসে গেছে। এখন আর কিছু করবার নেই। সন্তু, রঞ্জনরা কোথায় আছে কিছু বুঝতে পারছেন না। প্রফেসার শর্মা অসুস্থ হয়ে না পড়লে মোহন সিং এতটা নিষ্ঠুরতা দেখাতে সাহস পেত না। কাল রাত্তিরে শর্মাজিকে দেখে মনে হয়েছিল, মনের জোরেই তিনি টিকে যাবেন।

সত্যিই কি তাঁর প্যারালিসিস হয়ে কথা বন্ধ হয়ে গেছে? এতবড় একজন পণ্ডিত বাড়ি থেকে এত দূরে এসে এইভাবে মারা যাবেন? বিজয়নগরের বিখ্যাত হিরেটা উদ্ধার করার জন্য তিনি অন্তত তিরিশ বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। হিরেটা পাওয়া গেলে সারা পৃথিবীতে হইচই পড়ে যাবে। কোহিনুরের চেয়েও অনেক দামি হিরে।

চোখ বুজে নানারকম চিন্তা করতে করতে কাকাবাবু ঘুমিয়ে পড়লেন একসময়।

খানিকবাদে তাঁর আচমকা ঘুম ভেঙে গেল। গোটাচারেক লোক এসে তাঁর পা আর মাথা ধরে তুলে ফেলল খাট থেকে।

কাকাবাবু বললেন, আরে, আরে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?

লোকগুলো কোনও উত্তর দিল না। একটা বালির বস্তার মতন তাঁকে কাঁধে নিয়ে চলল। একজন কাকাবাবুর ক্রাচ দুটোও তুলে নিল।

বাইরে এসে কাকাবাবু দেখলেন, আকাশ মেঘলা-মেঘলা। চতুর্দিক অন্ধকার, দু-তিনটে জায়গায় আলো জ্বলছে। তিনি আন্দাজে বুঝলেন, একটা আলো জ্বলছে বিঠলস্বামী মন্দিরের কাছে। ওখানে এখনও খোঁড়াখুঁড়ি চলছে।

লোকগুলো কাকাবাবুকে বয়ে নিয়ে এসে মাঠের মাঝখানে নামিয়ে দিল। সেখানেও একটা আলো জ্বলছে। সিংহাসনের ওপর বসে আছে নকল ভগবতীপ্রসাদ শর্মা, এখন তার মাথায় একটা জরির পাগড়ি। কোলের ওপর রাখা একটা তলোয়ার। সে একটা সিগারেট টানছে। আসল শর্মাজি জীবনেও সিগারেট খাননি।

কাকাবাবুকে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে দেবার পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? দিব্যি খাটে শুয়েছিলাম, হঠাৎ আমাকে মাঠের মধ্যে আনা হল কেন?

নকল শর্মা বলল, ক্যামেরা আসছে। শুটিং হবে। আসল কাজের সঙ্গে-সঙ্গে ফিল্মের শুটিংও চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। এখানে একটা সিন তুলব। রাজা রাম রায়ের সামনে আনা হয়েছে একজন বন্দীকে। তুমিই সেই বন্দী। তোমাকে অবশ্য দেখানো হবে পিছন দিক থেকে। তোমার মুখ দেখা যাবে না!

কাকাবাবু বললেন, চারশো বছর আগেকার এক বন্দীর গায়ে নাইলনের দড়ি? তখনকার বন্দীদের শুধু হাত দুটো শেকল দিয়ে বাঁধা হত!

নকল শর্মা বলল, হিন্দি সিনেমায় এসব চলে যায়! অত কেউ খুঁটিয়ে দ্যাখে না।

কাকাবাবু বললেন, চারশো বছর আগেকার রাজা সিগারেটও খাবে নাকি?

নকল শর্মা সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, আরে, ক্যামেরাম্যান, লাইটসম্যানরা সব কোথায় গেল? সবাই মিলে মাটি খোঁড়া দেখতে গেলে কী করে চলবে? ওরে কে আছিস?

কাকাবাবুকে নামিয়ে রেখে সেই চারজন লোক চলে গেছে। কাছাকাছি আর কেউ নেই। নকল শর্মা চেঁচিয়ে আরও কয়েকবার ডাকল। কেউ সাড়া দিল না। তলোয়ারটা হঠাৎ পড়ে গেল তার কোল থেকে। সেটা তুলে সে সিংহাসনের এক পাশে রাখল।

তারপর সে কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে মজা করে বলল, কুয়ো তো খোঁড়া হচ্ছে, সেখানে যদি লোহার সিন্দুকের দরজা না পাওয়া যায়, তা হলে তোমার কী হবে বলে তো? মোহন সিং বলছে, কুকুর দিয়ে তোমাকে খাওয়াবে। কস্তুরী বলছে, এইরকম হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তোমাকে নদীতে ফেলে দেবে। আর আমি ভাবছি, সিনেমার শুটিং-এ তোমাকে কাজে লাগাব। প্রথমে আমি আমার পায়ের জুতো দিয়ে তোমার নাক ঘষে দেব! তারপর লাথি মেরে-মেরে তোমার দাঁতগুলো ভাঙব। তারপর তোমার চোখ…

কাকাবাবু বললেন, বুঝেছি, বুঝেছি! তুমি একটু-একটু করে কষ্ট দিয়ে আমায় মারবে। তাই তো? এবারে উলটো দিকটা বলল। আমি যদি হিরেটা তোমাদের উদ্ধার করে দিই, তা হলে কী হবে?

নকল শর্মাজি বলল, হিরে যদি তুমি খুঁজে দিতে পারো, সত্যি দিতে পারো, তা হলে তোমাকে ছেড়ে দেব। বাঁধন খুলে দেব। ইউ উইল বি ফ্রি! মরদ কা বাত, হাতি কা দাঁত! কথা যখন দেওয়া হয়েছে, হিরে পাওয়া গেলেই তোমার ছুট্টি!

কাকাবাবু বললেন, কিন্তু হিরেটা পাওয়া গেলে নেবে কে? তুমি, না মোহন সিং, না কস্তুরী?

নকল শর্মা ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলল, মোহন সিং? ছছাঃ! ও তো একটা সামান্য লোক। ওকে আমরা যা বলি, ও তাই করে। অবশ্য ও একটু গোঁয়ার। কথায় কথায় মারামারি করতে যায়। কিন্তু হিরের ওপর কোনও অধিকার নেই। আর কস্তুরী? হ, সে কিছু টাকা খরচ করেছে বটে। সে টাকা ফিল্ম থেকেই উঠে যাবে। হিরেটা হবে আমার! বিজয়নগরের হিরেটা আমার চাই!

কাকাবাবু কৌতু েসঙ্গে বললেন, এ যে নতুন কথা শুনছি। কস্তুরী এতক্ষণ বলছিল, হিরেটা সে-ই নেবে। অন্য কোনও ভাগীদার নেই। এখন দেখছি, আপনিও একজন ভাগীদার!

নকল শর্মা বলল, ভাগীদার মানে? না, না, অন্য কাউকে আমি ভাগ-টাগ দেব না। আমার সব বন্দোবস্ত করা আছে, হিরেটা পেলেই আমি বম্বে চলে যাব।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে তো খুব মুশকিল হল। আমি হিরেটা কস্তুরীকেই খুঁজে দেব কথা দিয়েছি। কস্তুরীর সঙ্গে আমার চুক্তি হয়েছে।

নকল শর্মা বলল, ঠিক আছে, তুমি হিরেটা কস্তুরীর জন্যই খোঁজো! এমনকী সবার সামনে তুমি হিরেটা কস্তুরীর হাতে তুলে দিতে পারো। তারপর ওর কাছ থেকে সেটা বাগিয়ে নিতে আমার কোনও অসুবিধে হবে না। সেটা আমি বুঝব। তোমার সঙ্গে আমার যে কথা হল, তা খবদার বলবে না আর কাউকে। কস্তুরীকে যদি আগে থেকে কিছু বলার চেষ্টা করো, তা হলে তোমার আমি জিভ কেটে নেব।

কাকাবাবু বললেন, আমার জিভ কেটে নিলে একটু মুশকিল আছে। আমি যদি কথা বলতে না পারি, তা হলে হিরেটা তোমরা পাবে কী করে?

নকল শর্মা চোখ কটমট করে বলল, রায়চৌধুরী, একটা কথা মনে রেখো। তুমি বাঁচবে কি মরবে, সেটা আমার ওপর নির্ভর করছে। কস্তুরী হাজার চেষ্টা করলেও তোমাকে বাঁচাতে পারবে না।

সিংহাসনের পাশে হাত চাপড়ে সে তলোয়ারটা খুঁজল। সেটা সেখানে নেই। আবার নীচে পড়ে গেছে ভেবে সে মাথা ঝুকিয়ে দেখল, সেখানেও নেই।

সে অবাক হয়ে বলল, আরে, আমার তলোয়ারটা কোথায় গেল? সিংহাসনের পিছন থেকে সামনে ঘুরে এসে সন্তু বলল, এই যে!

সন্তুর হাতে সেই খাপ খোলা তলোয়ার। তার ডগাটা সে নকল শর্মার গলায় ছুঁইয়ে বলল, চুপ! কোনও শব্দ করবে না। তা হলেই গলা ফুটো করে দেব!

আতঙ্কে নকল শমার চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল। সন্তুর বদলে সে যেন ভূত দেখছে!

সন্তু বলল, জোজো, শিগগির কাকাবাবুর বাঁধন খুলে দে!

অন্ধকার থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসে জোজো কাকাবাবুর দড়ির বাঁধন খোলার চেষ্টা করতে লাগল।

কাকাবাবু বেশ সন্তুষ্টভাবে বললেন, যাক, তোরা ভাল আছিস তা হলে? রিঙ্কু, আর রঞ্জন কোথায়?

জোজো বলল, এখনও দেখতে পাইনি। এই গিটগুলো খুলতে পারছি। একটা ছুরি পেলে ভাল হত।

কাকাবাবু বললেন, নাইলনের দড়ি ছুরি দিয়েও কাটা খুব শক্ত। গিটগুলোই। খোলার চেষ্টা কর। কোনওরকমে আমার হাতটা আগে খুলে দে!

সন্তু সামনের দিকে তাকিয়ে অধীরভাবে বলল, তাড়াতাড়ি, তাড়িতাড়ি! লোজন আসছে!

জোজো তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে আরও দেরি করে ফেলল। নখ দিয়ে চেপে ধরেও সে গিট খুলতে পারছে না। কেনওরকমে কাকাবাবুর হাতের বাঁধনটা খুলতে-না-খুলতেই হইহই করে ছুটে এল সেখানে চার-পাঁচজন লোক। তাদের মধ্যে একজন মোহন সিং। সে ফুর্তিতে চিৎকার করে বলতে বলতে এল, পাওয়া গেছে! পাওয়া গেছে! লোহার দরজা বেরিয়েছে!

সন্তু আর জোজো পালাবার সুযোগ পেল না। কাকাবাবুকে ফেলে পালাবার কথা তাদের মনেও এল না।

মোহন সিং এসেই খপ করে জোজোর চুলের মুঠি চেপে ধরে বলল, এ কী?

সন্তু তলোয়ারটা নকল শর্মার গলায় আর-একটু চেপে বলল, শিগগির কাকাবাবুকে ছেড়ে দাও, নইলে একে আমি মেরে ফেলব!

মোহন সিং কয়েক মুহূর্ত দারুণ বিস্ময়ে চেয়ে রইল সন্তুর দিকে। যেন সে বিশ্বাসই করতে পারছে না যে, সন্তুরা এরই মধ্যে বেঁচে এখানে ফিরে এসেছে।

তারপরেই সে ঘোর কাটিয়ে ফস করে একটা রিভলভার বার করে বলল, তুই ওর গলা কাটবি? কাট! তার আগে এক গুলিতে আমি তোর মাথা উড়িয়ে দেব।

কাকাবাবু শান্ত গলায় বললেন, সন্তু, তলোয়ারটা ফেলে দে!

সন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও তলোয়ারটা নামিয়ে রাখল পায়ের কাছে। একজন লোক ছুটে গিয়ে সন্তুকে চেপে ধরল।

নকল শর্মা রাগের চোটে সপাটে এক চড় কষাল সন্তুর গালে। তারপর মোহন সিংকে বলল, লোহার দরজা পাওয়া গেছে? তা হলে আর রায়চৌধুরীকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ কী? ওকে খতম করে দিলেই তো হয়?

মোহন সিং চওড়া করে হেসে বলল, আমিও তো তাই ভেবেছি। মাটির নীচে সত্যি একটা লোহার দরজা আছে। এবার দরজা ভেঙে আমরাই হিরেটা বার করতে পারব! এ লোকটাকে আর দরকার নেই। এই বিচ্ছুগুলোকেও ওর সঙ্গে…

কাকাবাবু হাত দুটো ঘষতে ঘষতে বললেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও! একেই বলে কালনেমির লঙ্কা ভাগ! মোহন সিং, তুমি একটা বেওকুফ! আমাকে কি তোমার মতনই বুন্ধু ভেবেছ? আমি জানতুম, তোমরা কথার খেলাপ করবে! হিরেটার খোঁজ পেয়ে গেলেই আমাকে মেরে ফেলতে চাইবে! হিরে পাওয়া এত সহজ? ওই লোহার দরজা খুলে দ্যাখো, ওর মধ্যে কিছু নেই!

নকল শর্মা আর মোহন সিং একসঙ্গে বলে উঠল, কেয়া? কুছ নেহি?

কাকাবাবু বললেন, দরজাটা ভাঙবার দরকার নেই। ধাধাক্কি করলেও খুলবে না। সামনের দিকে জোরসে টান দাও, তা হলেই খুলে যাবে। ওই সিন্দুকের মধ্যে হিরে-মুক্তো কিছুই নেই। এর আগে অন্তত পনেরোজন লোক ওই সিন্দুক খুলে দেখেছে! গত চারশো বছর ধরে কত লোক এই বিজয়নগরের বিখ্যাত হিরে খুঁজছে জানো?

এবারে কস্তুরী এসে পৌঁছল সেখানে। সে সব কথা শুনে হতাশ হয়ে বলল, আঁ? ওই সিন্দুকের মধ্যে কিছু নেই? রায়চৌধুরীবাবু, তুমি শুধু-শুধু আমাদের দিয়ে এতখানি মাটি খোঁড়ালে? তুমি আমাদের ধোঁকা দিয়েছ?

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, বেশ মজা তো! আমি ধোঁকা দিয়েছি? তোমরা যে লোহার দরজাটা দেখামাত্রই আমাকে মেরে ফেলতে চাইলে, সেটা কী? আমি তোমাদের এই অমূল্য হিরে খুঁজে দেব, আর তোমরা তারপর আমাকে মেরে ফেলবে। বাঃ, কী চমৎকার!

মোহন সিং বলল, ওই হিরে না পেলেও কি তোমাকে আমরা বাঁচিয়ে রাখব ভাবছ?

কাকাবাবু বললেন, তাতে তোমাদের ভারী লাভ হবে! শুধু-শুধু মানুষ খুন করাই হবে, হিরে পাবে না। যে জন্য এত কাণ্ড করে এখানে এসেছ, সব নষ্ট হবে! প্রোফেসর শর্মার কথা বন্ধ হয়ে গেছে, তিনি কিছু বলতে পারবেন না। আমিও যদি মরে যাই, তা হলে চিরকালের মতন হারিয়ে যাবে বিজয়নগরের হিরে!

কস্তুরী বলল, না, না, তা হতে পারে না। হিরেটা আমাদের চাই! রায়চৗধুরীবাবু, আপনাকে কেউ মারবে না! আপনার সঙ্গের লোকদেরও ছেড়ে দেওয়া হবে! আমি কথা দিচ্ছি!

কাকাবাবু বললেন, তোমার কথার যে কী দাম আছে, তা তো দেখলাম! আর আমি তোমাদের বিশ্বাস করছি না।

মোহন সিং জোজোকে এক ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে বলল, বিজু, বিরজু! এই ছোকরাটার একটা-একটা করে কান কেটে দে। তারপর নাক কাটবি। তা দেখেও রায়চৌধুরী হিরের কথা লুকিয়ে রাখতে পারে কি না দেখতে চাই।

বিরজু এগিয়ে এসে চুলের মুঠি ধরে জোজোকে আবার দাঁড় করাল। একটা ছুরি বার করে বলল, কাটব?

জোজো কাকাবাবুর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। কাকাবাবুর মুখের হাসি-হাসি ভাব দেখে সে ভয় পেল না।

কাকাবাবু বললেন, আবার একটা বোকামি করছ, মোহন সিং! এরকমভাবে জোর করলে আমি তো তোমাদের আর-একটা ধোঁকা দেব! আর-এক জায়গার মাটি খুঁড়তে বলব। দু-তিন ঘন্টা লেগে যাবে। তারপর দেখবে, সেখানেও কিছু নেই! এই করে করে রাত ভোর হয়ে যাবে! আমার লোকদের গায়ে একবার হাত ছোঁয়ালে আমি কিছুতেই সত্যি কথা বলব না।

কস্তুরী এগিয়ে এসে বলল, বিরজু, ছেলেটেকে ছেড়ে দাও! এভাবে কিছু হবে না। সময় বেশি নেই। রায়চৗধুরীবাবু, আপনার কাছে আমি, মোহন সিং আর কর্নেলসাহেব একসঙ্গে শপথ করব যে, হিরেটা পেলেই আপনাকে আমরা ছেড়ে দেব। আপনার সঙ্গের লোকজনদেরও ছেড়ে দেব। তা হলে আপনি মানবেন তো?

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কর্নেল কে?

কস্তুরী নকল শর্মার দিকে হাত দেখাল।

কাকাবাবু বললেন, তোমাদের ওই শপথ-টপথে আমি মোটেও বিশ্বাস করি। এবার আমার শর্ত বলছি শোনো। আমার বাঁধন খুলে দাও। আমি নিজে হিরেটা খুঁজতে যাব। আমি নিজে না গেলে অন্য কেউ ঠিকমতন বার করতে পারবে না। অনেক কিছু শেখাতে হবে।

কস্তুরী সঙ্গে-সঙ্গে বলল, বাঁধন খুলে দাও! খুলে দাও!

বিরজু গিটগুলো খুলে দিল খানিকটা চেষ্টা করে।

কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, উঃ, সারা গায়ে ব্যথা হয়ে গেছে। এমন শক্ত করে কেউ বাঁধে! শুধু হাত দুটো বাঁধাই তো যথেষ্ট ছিল। আমি খোঁড়া মানুষ, আমি কি দৌড়ে পালাতে পারতুম?

ক্রাচ দুটো তুলে নিয়ে তিনি বললেন, যে-কুয়োটা খোঁড়া হয়েছে, সেটার কাছে চলো! আমি তোমাদের পুরোপুরি ধোঁকা দিইনি। মিছিমিছি মাটি খুঁড়তে বলিনি!

পুরো দলটা চলে এল বিঠলস্বামীর মন্দিরের কাছে।

নতুন খোঁড়া গর্তটার মুখের কাছে দাঁড়িয়ে কাকাবাবু বললেন, লোহার দরজাটা খুলতে পেরেছ?

একজন বলল, জি হ, খোলা হয়েছে। ভেতরে কিছু নেই। সিন্দুকটা খালি।

কাকাবাবু বললেন, একেবারে খালি নয়। একেবারে পিছনের দেওয়ালের গায়ে দ্যাখো একটা ত্রিশূল গাঁথা আছে। খুব সাবধানে শাবলের চাড় দিয়ে সেই ত্রিশূলটা খুলে নিয়ে এসো!

বিরজু নিজে সেই কুয়োর মতন গর্তে নেমে গেল। একটু পরেই সে বলল,, হ্যাঁ, একটা ত্রিশূল আছে।

সে আবার ওপরে উঠে আসার পর দেখা গেল, তার হাতে একটা সাধারণ লোহার ত্রিশূল। বেশ মোটা। অনেক কালের পুরনো হলেও সেটার গায়ে মরচে পড়েনি!

কাকাবাবু সেই ত্রিশূলটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখে বললেন, এই ত্রিশূল আমি আগে দেখেছি, ফার্গুসনসাহেব দেখেছেন, মানুচ্চিসাহেব দেখেছেন, আরও অনেকে দেখেছেন, আমরা কেউই বুঝতে পারিনি, মাটির অত নীচে একটা লোহার সিন্দুকে এরকম একটা সাধারণ ত্রিশূল রাখার মানে কী! আমরা ভেবেছি, আগে বোধহয় ওখানে দামি কোনও মূর্তি ছিল, কেউ চুরি করে নিয়েছে। ভগবতীপ্রসাদ শর্মা মাত্র কিছুদিন আগে একটা বহু পুরনো পুঁথি আবিষ্কার করেছেন। সেটা পড়ে তিনি জানতে পেরেছেন, এই ত্রিশূলটা আসলে চাবি! অন্য একটা সিন্দুকের চাবি। সেইজন্যই এটাকে এত যত্ন করে এমন গোপন জায়গায় রাখা হয়েছে।

মোহন সিং সেই ত্রিশূলটা কাকাবাবুর হাত থেকে কেড়ে নেবার চেষ্টা করতেই কাকাবাবু বললেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও, অত সহজ নয়! যে সিন্দুকের চাবি এই ত্রিশূলটা, সেটা কোথায় আছে তুমি জানো? সাত জন্মেও খুঁজে পাবে না। যদি খুঁজে পাও, তা হলেও এই চাবি দিয়ে খুলতে পারবে না। কতবার ডান দিকে আর কতবার বাঁদিকে ঘোরাতে হবে, তা একটা শ্লোকের মধ্যে লেখা আছে। সেই শ্লোক না জানলে কোনও লাভ নেই।

কস্তুরী বলল, এই মোহন, রায়চৌধুরীবাবুর কাজে বাধা দিও না! আচ্ছা, রায়চৌধুরীবাবু, একটা কথা বলুন তো! প্রোফেসর শর্মাজি যখন এই চাবিটার কথা জানতে পারলেন, তখন তিনি নিজে কেন আগে এসে হিরেটা নিলেন না?

কাকাবাবু বললেন, উত্তরটা খুব সোজা। তিনি একা এসে খোঁড়াখুঁড়ি করতে পারতেন না। গভর্নমেন্টকে জানাতে হত। আর গভর্নমেন্টের সাহায্য নিয়ে এই বিখ্যাত ঐতিহাসিক হিরেটা খুঁজে বার করলে, সেটা গভর্নমেন্টকেই দিয়ে দিতে হত। সেইজন্যই তিনি তোমাদের সাহায্য নিয়েছিলেন। ফিল্ম তোলার নাম করে এলে জায়গাটা ঘিরে রাখা যায়, রাত্তিরেও কাজ করা যায়। মাটি খুঁড়লেও কেউ সন্দেহ করে না।

পেছন ফিরে কাকাবাবু আবার হাঁটতে লাগলেন কোণাকুণি আর-একটা ছোট্ট মন্দিরের দিকে। এটা একটা অতি সাধারণ শিবমন্দির, ছাদের অনেকটা ভেঙে পড়েছে, দরজার পাল্লাও নেই। ভেতরে মস্ত বড় একটা শিবলিঙ্গ, তার মাথার কাছটাও কিছুটা ভাঙা।

কাকাবাবু বললেন, রাজধানী বিজয়নগর যেদিন ধ্বংস হয়, সেদিন আক্রমণকারীরা এখানকার অনেক মন্দিরও ভেঙে একেবারে গুঁড়িয়ে দেয়। শুধু বিঠলস্বামীর মন্দিরটা তারা ভাঙেনি বিশেষ কারণে। মন্দিরের সব কটা থাম থেকে একটা অদ্ভুত গানের সুর বেরোচ্ছিল, তা শুনে ওরা ভয় পেয়ে যায়। এই ছোট্ট মন্দিরটাও তারা ভাঙতে চেষ্টা করেছিল। এই দ্যাখো, এই শিবলিঙ্গটা এত শক্ত পাথরের তৈরি যে মাত্র একটুখানি ভাঙতে পেরেছে! ডিনামাইট দিয়ে না ওড়ালে এটা ভাঙা যাবে না।

তারপর তিনি হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বললেন, দেখি তো, এর বেদীর মাঝখানে একটা গর্ত থাকার কথা।

সত্যি তাই, সেই শিবলিঙ্গের তলার বেদীতে চৌকো করে খানিকটা কাটা।

কাকাবাবু সেই কাটা অংশের মধ্যে ত্রিশুলটা ঢোকাতে যেতেই তার ভেতর থেকে ধড়ফড় করে একটা গিরগিটি বেরিয়ে এল। সে বেচারা ভয় পেয়ে পালাতে গিয়ে লাফিয়ে উঠল কস্তুরীর গায়ে। কস্তুরী তিড়িং করে একটা লাফ দিয়ে আর্ত গলায় বলল, ওরে বাপ রে, এটা কী রে!

কাকাবাবু বললেন, ওটা একটা নিরীহ গিরগিটি। কামড়াবে না। কিন্তু এর মধ্যে সাপখোপ আরও কত কী আছে কে জানে!

চোখ বুজে কিছু চিন্তা করে ত্রিশূলটা কয়েকবার ডান দিকে, কয়েকবার বাঁ দিকে ঘোরালেন। অত বড় শিবলিঙ্গটা আস্তে-আস্তে সরে যেতে লাগল।

সেখানে বেরিয়ে পড়ল একটা অন্ধকার গর্ত।

সবাই মুখ দিয়ে বিস্ময়ের শব্দ করে উঠল।

কাকাবাবু মোহন সিং-এর দিকে ফিরে বললেন, তুমি কি ভাবছ, এটা সিন্দুক? তা মোটেই না। আসল সিন্দুক আছে অনেক নীচে। এরকম আরও তিনবার চাবি ঘোরাতে হবে তিন জায়গায়। বিজয়নগরের রাজারা সাবধানী ছিলেন খুব?

উঠে দাঁড়িয়ে, ত্রিশূলটা খুলে নিয়ে তিনি সেই অন্ধকার গর্তের মধ্যে পা বাড়িয়ে বললেন, আমি এর ভেতরে নামব। সন্তু, জোজো, তোরাও সঙ্গে আয়।

মোহন সিং বলল, না, ওরা যাবে না। ওরা বাইরে জামিন থাকবে। আপনি ফিরে এলে ওদের ছাড়ব।

কাকাবাবু বললেন, জামিন আবার কী! আমি খোঁড়া পায়ে একা সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারব না। ওদের সাহায্য লাগবে। তোমরা এই গর্তের বাইরে অপেক্ষা করো।

মোহন সিং বলল, তা আমাদেরও একজন আপনাদের সঙ্গে-সঙ্গে যাবে। আমি নিজেই যাচ্ছি।

কাকাবাবু বললেন, তুমি এত মোটা, তুমি যেতে পারবে না। এক জায়গায় আটকে যাবে।

বিরজু বলল, আমি যাচ্ছি। আমি ওদের পাহারা দেব! আমাকে একটা টর্চ দাও।

শুধু টর্চ নয়, মোহন সিং বিরজুর হাতে তুলে দিল নিজের রিভলভারটাও।

প্রথমে কাকাবাবু, তারপর সন্তু, জোজো আর বিরজু নেমে গেল সেই গর্ত দিয়ে। মোহন সিং, কস্তুরীরা উঁকি দিয়ে রইল গর্তের মুখে।

অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে ওরা নামছে তো নামছেই। ক্ষীণভাবে দেখা যাচ্ছে টর্চের আলো। একসময় সেটাও মিলিয়ে গেল। বোধহয় সুড়ঙ্গটা বেঁকে গেছে সেখানে।

হঠাৎ অনেক নীচ থেকে একটা বিকট ভয়ের চিৎকার শোনা গেল। সেটা কার গলার আওয়াজ তা বোঝবার আগেই কিসের যেন ধাক্কায় ছিটকে গেল মোহন সিং আর কস্তুরীরা। দড়াম করে একটা শব্দ হল।

শিবলিঙ্গটা আবার আগের জায়গায় ফিরে এসেছে। সুড়ঙ্গের মুখটা বন্ধ হয়ে গেছে।

মোহন সিং হুঙ্কার দিয়ে উঠল, বন্ধ করে দিয়েছে! ও ইচ্ছে করে বন্ধ করে দিয়েছে।