০৬. বৃষ্টি থেমেছে

কাকাবাবু বললেন, দ্যাখ তো, বৃষ্টি থেমেছে কি না।

সন্তু গম্বুজের লোহার দরজাটা খুলে বাইরে উঁকি মোরল।

এখানে এই এক অদ্ভুত। যখন-তখন বৃষ্টি, আবার একটু পরেই ঝকমকে রোদ। দুপুরে এমন বরফ-বৃষ্টি শুরু হয়েছিল যে, মনে হয়েছিল, আর থামবেই না। সারাদিন। কিন্তু এখন আকাশ একেবারে পরিষ্কার। ফুটফুটে নীল।

কাকাবাবু উঠে এসে বললেন, চল, একটু ঘুরে আসি।

ক্রাচ বগলে নিয়ে এই বরফের ওপর দিয়ে হাঁটা খুব বিপজ্জনক। গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ ছড়ানো থাকলে তেমন অসুবিধে নেই। কিন্তু এক-এক জায়গায় বরফ পাথরের মতন শক্ত আর সেখানেই পা পিছলে যায়।

একটা তাঁবুর দড়ির ওপর আলতোভাবে বসে মাউথ অগনি বাজাচ্ছিল মিংমা। ওদের দেখে সে উঠে এসে জিজ্ঞেস করল, কিধার যাতা, সাব?

কাকাবাবু বললেন, চলো, আকাশ পরিষ্কার আছে, কালাপাথর পর্যন্ত গিয়ে দেখি যদি এভারেস্ট দেখা যায়।

সন্তুর দিকে তাকিয়ে মিংমা বলল, সন্তু সাব, গ্লাভস কাঁহা? গ্লাভস পরে আসুন। সনঝে হলেই বহুত শীত লাগবে?

সত্যিই তো, সন্তু মনের ভুলে খালি হাতে চলে এসেছিল। শীত তো লাগবেই। তা ছাড়া, মাঝে-মাঝেই আছোড় খেয়ে পড়তে হয়, বরফে হাত লাগে। কাকাবাবু আগেই সাবধান করে দিয়েছেন, বেশি ঠাণ্ডার মধ্যে খালি হাতে বরফ ছুলে ফ্রস্ট বাইট হতে পারে। বরফ কামড়ায়। তাতে অনেক সময় হয়তো আঙুল কেটে বাদ দিতে হয়।

সন্তু গম্বুজে ফিরে গিয়ে গ্লাভস পরে এল।

চতুর্দিকে বরফে সাদা হয়ে গেছে। মিংমা আর কাকাবাবু এগিয়ে গেছেন অনেকখানি। বরফের ওপর দিয়ে দৌড়েবার উপায় নেই। সন্তু বকের মতন লম্বা-লম্বা পা ফেলে পৌঁছে গেল ওদের কাছে।

কাকাবাবু শেরপা মিংমাকে জিজ্ঞেস করলেন, মিংমা, তুমি কেইন শিপটনের নাম শুনেছ?

মিংমা বলল, হাঁ সাব, সবকেই জানে শিপটন সাবের কথা। হাম দেখা হায় উনকো। ইতনা তাগড়া জোয়ান, মুখমে দাড়ি আর মোচু। আহা বেচারা মর গিয়া।

তুমি শিপটন সাহেবের দলের সঙ্গে এসেছিলে নাকি?

না, সাব। উস্ টাইম আমার বুখার হয়েছিল। পেট মে বহুত দরদ!

তোমার চেনা কেউ এসেছিল শিপটনের সঙ্গে? নোরবু এসেছিল?

না, সাব, নরবুভি আসেনি। লেকিন আমার দোস্তু শেরিং আয়া থা!

শিপটন কী করে মারা গেলেন, তুমি শুনেছ?

হাঁ, সাব। সবাই জানে। এহি তো জায়গামে ছিল উনাদের বেস ক্যাম্প। শিপটন সাবকে দেখে সবাই ভেবেছিল, এ সব ঠিক এভারেস্ট পীক-এ উঠে যাবে। ইতনা থা উনকা তন্দুরাস্তি।

মারা গেলেন কী ভাবে?

ব্যস, বিলকুল বন্দ নাসিব। বহুত হিম্মত আর সাহস ছিল তো, তাই একেলা একেলা ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন। পাহাড়মে এহি কানুন হায় সাব, কোথাও কেউ একেলা যাবে না। একেলা যানেসেই ভয়। দু-জন যাও, কুছু না হোবে। শিপটন সাব সে-কথা মানেননি। একেলা গেলেন, তারপর কোথায় বরফ তাঁকে টেনে নিল।

তার দেহটাও তো পাওয়া যায়নি।

নেহি মিলা। গরমিন্টের লোক এসে কত টুড়িল। আমরিকা থেকে ভি আউর বহুত সাহাবলোক এসে টুড়ল। তবু মিলল না। শিপটন সাব সির্ক বরফকা অন্দর গায়েব হো গিয়া।

কিন্তু মিংমা, এই বেস ক্যাম্প থেকে একজন লোক এক-একা হেঁটে আর কত দূর যেতে পারে? বেশি দূর তো যাবে না। এর মধ্যে কেউ কোনও খাদে পড়ে গেলে তার দেহ পাওয়া যাবে না কেন? খুব বড় খাদ তো এখানে নেই।

কভি কভি এইসা হোতা হ্যায়, সাব, বরফ মানুষকো অন্দর টান লেতা হ্যায়। হাঁ সাব, বরফ মানুষকে টেনে নেয়।

সন্তু বলল, ক্রিভাস!

কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকালেন। সন্তুকে তিনি যতটা ছোট মনে করেন, সে তো ততটা ছোট নয়, সে অনেক কিছু জানে।

সন্তু অ্যাডভেঞ্চারের বই পড়ে কথাটা শিখেছে। সে বলল, বরফের মধ্যে মাঝে-মাঝে ক্রিভাস গর্ত থাকে, তার মধ্যে পা ফস্কে পড়ে গেলেই একেবারে মৃত্যু।

কাকাবাবু বললেন, ঠিকই বলেছিস, কিন্তু কথাটা ক্রিভাস নয়। ফরাসিতে বলে ক্ৰভাস, আর ইংরেজিতে বলে ক্রেভিস। তুই দুটো মিলিয়ে একটা বাঙালি উচ্চারণ করে ফেলেছিস।

মিংমাও ক্রেভিস কথাটা জানে। সাহেবদের কাছ থেকে শুনে শুনে শিখেছে। সে বলল, না সাব, ইধার ক্ৰোভিস নেহি হ্যায়। আরও দূরে আছে। লেকিন বরফ মানুষকে টেনে নেয়, ইয়ে, সাচ বাত হায়।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এ-রকমভাবে আরও লোক মরেছে? যাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়নি?

হর এক্সপিডিশানেই তো একজন দুজন আদমি মরে। কখনও লাশ পাওয়া যায়, কখনও পাওয়া যায় না! শেরপা মরে, কুলি মরে, সাহাব লোকভি মরে! গত বরষমে। আমিও তো একবার মরতে মরতে বাঁচ গিয়া।

সন্তু বলল, এত বিপদ, তবু তোমরা এখানে আসো কেন?

মিংমা গর্বের সঙ্গে বলল, আমরা পাহাড়ি মানুষ। আমরা বিছানায় শুয়ে মরতে চাই না। বিছানায় শুয়ে মরে ডরপুক আর জেনানারা। আমরা পাহাড়মে, নেহি তো বরফের মধ্যে মরতে চাই। বরফমে মরো, শান্তি, বহুত শান্তি!

মিংমা বুকের ওপর আড়াআড়িভাবে দুটো হাত রাখল, যেন এর মধ্যেই সে মরে গেছে।

কাকাবাবু হাসি মুখে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে।

তারপর আবার হাঁটতে শুরু করে বললেন, আমরা যেমন বিকেলবেলা বেরিয়েছি, কেইন শিপটনও বেরিয়েছিল বিকেলে। বিকেলবেলা বেস ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে সে আর কতদূর যাবে? যতই সাহসী হোক অভিযাত্রী হিসেবে শিপটন নিশ্চয়ই এটুকু জানত যে, রাত্তিরবেলা তাঁবুর বাইরে থাকতে নেই। সুতরাং সে সন্ধের আগেই ফিরে আসবার কথা চিন্তা করেছিল নিশ্চয়। শিপটনের সঙ্গের লোকেরা বলেছে যে, পর পর তিন দিন শিপটন এইরকম বিকেলবেলা একা একা বেরিয়েছিল। এর মধ্যে একদিন সে তাঁবুতে ফিরে একটা অদ্ভুত কথা বলেছিল তার দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে। তারা কেউ বিশ্বাস করেনি। শিপটনের এমনি বানিয়ে-বানিয়ে মজার কথা বলার অভ্যোস ছিল।

মিংমা বলল, হয়, শিপটন সাব বহুত জলি আদমি থা। আমার দোস্ত শেরিং বলে যে, শিপটন সাব এমুন কথা বলতেন যে, হাঁসতে হাঁসতে পেটমে বেথা। হয়ে যেত!

কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, শিপটনের একটা ডায়েরি পাওয়া গেছে। তাতেও সে বানিয়ে-বানিয়ে ঐ রকম কোনও মজার কথা লিখেছে কি না সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন। ডায়েরিতে সাধারণত কেউ মিথ্যে কথা লেখে না। অথচ সে যা লিখেছে, তাও বিশ্বাস করা যায় না।

শিপটন কী লিখেছিলেন, কাকাবাবু? কাকাবাবু তক্ষুনি সন্তুর কথার উত্তর না দিয়ে মিংমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কতবার এক্সপিডিশানে এসেছ, মিংমা?

মিংমা মুচকি হেসে বলল, সওয়া সাতবার আংকল সাব।

সওয়া সাতবার মানে?

এহি বার তো আধা ভি নেহি হুয়া, সিকি হুয়া।

ও, বুঝেছি। তা এতবার যে তুমি এসেছ, কখনও এইদিকে অস্বাভাবিক কিছু দেখেছ? ধরে ইয়েতি কিংবা বড় ভালুক কিংবা কোনও দৈত্যদানো?

নেহিসাব! কভি নেহি!

তোমার চেনা শুনো কেউ দেখেছে?

কভি তো শুনা নেহি।

তুমি তেনজিং নোরগের নাম জানো?

মিংমা অমনি সেলামের ভঙ্গিতে কপালে এক হাত ছুইয়ে বলল, জরুর। শেরপা লোগকে গুরু হ্যায়, তেনজিং!

সেই তেনজিং নোরগে আমায় বলেছেন যে, তাঁর বিশ্বাস ইয়েতি বলে একরকম মানুষের মতন প্রাণী সত্যিই আছে। কর্নেল হান্টও সেই কথা বলেন। অবশ্য স্যার এডমন্ড হিলারি এ সম্পর্কে কিছু বলতে চান না। তা তোমরা কেউ ইয়েতির কথা জানো না কিংবা মানো না?

মিংমার মুখখানা যেন শুকিয়ে গেল। সে কোনও উত্তর না দিয়ে কাকাবাবুর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

এদিকে এতবার অভিযাত্রীরা এসেছে, কেউ কিছু দেখেনি?

সাব, একঠো বাত বলব!

বলো।

সাব, আপ ইয়েতি টুড়িতে এসেছেন, এ-কথা যদি জেনে যায়, তবে কুলি লোগ সব ভোগে যাবে। ইয়েতি কেউ দেখেনি, তবু সবাই ইয়েতির নাম দেবতা মাফিক ভয় করে, ভক্তি ভি করে!

তাই নাকি? তুমিও ভোগে যাবে না তো?

মিংমা নিজের বুকে চাপড়ে মেরে বলল, নেহি সাব। মিংমা কভি ডরতা নেই! কিসিকো ডরতা নেই।

বাঃ ভাল কথা। আমি অবশ্য ইয়েতি খুঁজতে আসিনি।

এর পর স্বভাব-গম্ভীর কাকাবাবু খানিকটা যেন ঠাট্টার সুরে বললেন, ইয়েতি খোঁজা কি আমার কাজ? আমি খোঁড়া মানুষ, ইয়েতি তাড়া করলে কি আমি পালাতে পারব? আমি এসেছি। এভারেস্টে উঠতে।

যেন ইয়েতির তাড়া খেয়ে পালানোর চেয়ে এভারেস্টে ওঠা অনেক সহজ কাজ! কথাটা বলে কাকাবাবু আপন মনে হাসতে লাগলেন।

সন্তু বলল, কাকাবাবু—

কাকাবাবু বললেন, ঐ শিপটনের ডায়রিতে কী লেখা ছিল, সেটা জানতে চাইছিস তো? বলছি। শিপটন লিখেছে যে, ঐ যে সামনে কালাপাথর নামে ছোট পাহাড়টা, ওর কাছে একদিন সন্ধের মুখে-মুখে ও একজন মানুষকে দেখেছিল, চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সেই মানুষটি শিপটনের প্রায় দ্বিগুণ লম্বা, ঠিক কোদালের ফলার মতন তার দাঁত। অর্থাৎ মনে কর, একজন ঘটোৎকচের মতন মানুষ।

তারপর?

সেই মানুষটি শিপটনকে দেখে তেড়েও আসেনি, কাঁচা খেয়েও ফেলেনি, আবার পালিয়েও যায়নি। সে শুধু শিপটনের দিকে একবার অবাক হয়ে তাকিয়েছিল, তার পরের মুহুর্তেই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।

অ্যাঁ?

শিপটন সেই কথাই লিখেছে। তার চোখের সামনেই লোকটা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। শিপটন বোধহয় একটা রূপকথা বলতে চেয়েছিল। ইয়েতি সম্বন্ধে যে অনেক রকম গল্প আছে, তার মধ্যে একটা আজগুবি গল্প হচ্ছে, ইয়েতিরা নাকি বরফের তলায় একরকম ঘাসের মতন গাছ জন্মায়, সেইগুলো খুঁজে-খুঁজে খায়। আর তার গুণে যখন-তখন অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে।

মিংমা হো-হো হা-হা করে হাসতে লাগল। যেন সে হাসির তোড়ে মাটিতে লুটোপুটি খাবে!

সন্তু জিজ্ঞেস করল, এত হাসছ কেন?

মিংমা বলল, কেয়া তাজব কি বাত! ইয়েতিরা ঘাস খায় আর তারপরেই ভ্যানিশ হয়ে যায়।

কাকাবাবু বললেন, পাহাড়ের অনেক উঁচুতে উঠলে অনেকেই চোখে নানা রকম ভুল দেখে। অনেক অভিযাত্রীই এ-কথা লিখেছেন। গভীর সমুদ্রে যারা এক-একা বোট নিয়ে পাড়ি দেয়, তারাও নাকি দেখেছে যে, জল থেকে বিরাট চেহারার কোনও মানুষ উঠে আসছে। এ অনেকটা মরুভূমিতে মরীচিকা দেখার মতন।

মিংমা আবার হাসতে হাসতে বলল, ঘাস খেয়ে ভ্যানিশ। হো-হে হা-হা।

কাকাবাবু বললেন, শিপটন ঐ কথা ডায়েরিতে লিখেছে, তারপর সে নিজেও অদৃশ্য হয়ে গেছে। তা হলে কি সে-ও ঐ ঘাস খুঁজে পেয়ে খেয়ে দেখেছিল?

মিংমা এই কথাতেও হাসতে লাগল। শেরপারা একবার হাসতে শুরু করলে আর সহজে থামতেই চায় না।

এই সময় সন্তু একটা জিনিস দেখতে পেল। ডান দিকে পনেরো-কুড়ি গজ দূরে একটা ছোট্ট সবুজ চারা গাছ, তাতে একটি সাদা রঙের ফুল ফুটে আছে। এখানে আশেপাশে কোনও গাছ নেই। হঠাৎ বরফের মধ্যে একটা ফুলগাছ এল কী করে?

সন্তুর বুকটা ধক করে উঠল। হঠাৎ তার মনে হল, এইটাই বোধহয় বরফের মধ্যে সেই ঘাসের মতন গাছ, যা খেয়ে ইয়েতির অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে।

বরফের মধ্যে যে দৌড়তে নেই, সে-কথা ভুলে গিয়ে সন্তু গাছটার দিকে দৌড়ল। কাকাবাবু আর মিংমা সামনের দিকে হেঁটে যেতে লাগলেন কথা বলতে বলতে।

সন্তু প্ৰায় গাছটার কাছাকাছি পৌঁছে হোচট খেয়ে পড়ল। একটা হাত পড়ল গাছটার ওপরেই। সঙ্গে-সঙ্গে একটা অদ্ভুত কাণ্ড হল।

ঠিক যেন কোনও গর্তের ওপর আলগা বরফ বিছানো, সন্তুর মাথাটা ঢুকে গেল বরফের মধ্যে, আর সঙ্গে সঙ্গে সেই রকমভাবে নেমে যেতে লাগল নীচের দিকে। সেই অবস্থায় চাঁচাবার উপায় নেই। তার পা দুটো ছটফট করতে লাগল ওপরে।

কাকাবাবু আর মিংমা কিছুই দেখতে পেলেন না, তখনও তাঁরা কথাবার্তায় মগ্ন।