০৬. ট্যাক্সি থেকে নেমে

ট্যাক্সি থেকে নেমে কাকাবাবু দেখলেন, ভাতের হোটেলটি বন্ধ হয়ে গেছে। দরজা বন্ধ।

রাস্তা পেরিয়ে এসে তিনি দরজাটা ঠেলতেই সেটা খুলে গেল।

ভেতরে একটামাত্র আলো জ্বলছে টিমটিম করে। হোটেলেরই দু-তিনজন কর্মচারী বসে খাচ্ছে আর গল্প করছে নিজেদের মধ্যে।

কাকাবাবুকে ঢুকতে দেখে একজন বলে উঠল, এখন কিছু পাওয়া যাবে না। বন্ধ হয়ে গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে!

কাকাবাবু তবু ক্রাচ খটখটিয়ে এগিয়ে এসে গম্ভীরভাবে সেই লোকটিকে বললেন, আমার নাম রাজা রায়চৌধুরী, আমি ময়নার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি!

লোকটি খাওয়া থামিয়ে কয়েক মুহূর্ত অবাক ভাবে কাকাবাবুর দিকে চেয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, কী নাম বললেন আপনার?

কাকাবাবু আবার বেশ জোরে নিজের নাম উচ্চারণ করলেন।

লোকটি পেছন ফিরে কাউকে ডেকে বলল, অনন্ত, অনন্ত, কে এসেছে দ্যাখো, বড় মালিককে খবর দাও!

সেদিকের দরজা খুলে একজন লোক বেরিয়ে এল।

কাকাবাবু তাকে চিনতে পারলেন। আগের দিন এই লোকটি লোহার ডাণ্ডা দিয়ে পাড়ার বখাটে ছেলেদের পিটিয়েছিল। আজও তার হাতে একটা ডাণ্ডা আছে।

কাছে এসে সে বলল, আসুন আমার সঙ্গে।

পেছনদিকে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়।

সেখানে এসে লোকটি কাকাবাবুকে ওপরে ওঠার ইঙ্গিত করতেই তিনি বললেন, তুমি আগে আগে-ওঠো।

লোকটি ভুরু কুঁচকে একবার তাকাল, কিন্তু আপত্তি করল না।

ওপরে একটি অফিসঘর। সাধারণ একটা ভাতের হোটেলের এমন সাজানো-গোছানো অফিসঘর আশা করা যায় না। খুব দামি সোফা আর চেয়ার-টেবিল। দুজন লোক সেখানে বসে আছে পাশাপাশি, একজন পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, আর একজনের নিখুঁত সুট-টাই, থুতনিতে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, দুহাতের আঙুলে অনেক আংটি। দুজনেই মাঝবয়েসি।

আংটি-পরা লোকটি কাকাবাবুর আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে বলল, আপনিই রাজা রায়চৌধুরী? নমস্কার। আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম। আমি চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিয়েছিলাম, আপনি বেশ তাড়াতাড়ি এসে পড়েছেন তো! বসুন!

কাকাবাবু ওদের মুখোমুখি বসে বললেন, হ্যাঁ, দেরি করে লাভ কী? আপনি আমার নাম জানেন, আপনার নাম কী?

লোকটি বলল, আমার নাম জানার দরকার কী? কাজের কথা শুরু হোক। আপনি একা এসেছেন কেন? কার্তিক কোথায়?

কাকাবাবু বললেন, সে ভাল জায়গাতেই আছে। কিন্তু আমার কথা আপনারা যদি মেনে না চলেন, তা হলে তাকে কিছুতেই খুঁজে বার করতে পারবেন না।

লোকটি ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলল, আমরা কী পারি আর না পারি, সে সম্পর্কে আপনার কোনও ধারণাই নেই।

হঠাৎ দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল ময়না।

কাকাবাবুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কিল চড় মারতে-মারতে বলল, হারামজাদা। শয়তান! কার্তিককে কেন আনিসনি! আমার কার্তিকের গায়ে যদি একটা আঁচড় লাগে, তোকে গলা টিপে মেরে ফেলব! কোথায় কার্তিক? বল, বল!

সে কাকাবাবুকে মারছে আর কাঁদছে। কাকাবাবু একটুও বাধা দিলেন না।

ওই দুজন লোক ময়নাকে জোর করে সরিয়ে নিল। ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতন ফুঁসতে লাগল সে।

কাকাবাবু তার চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন, তোমার ছেলেকে কেউ ধরে নিয়ে গেছে, তাই তোমার এত কষ্ট হচ্ছে। সব মায়েরই হয়। বাংলাদেশ থেকে যে বাচ্চাদের চুরি করে এনেছ, তাদের মায়েদের কি একই অবস্থা হয়নি? তুমি নিজে মা হয়ে তাদের কষ্ট বোঝো না?

ময়না খানিকটা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, কে ছেলে চুরি করে এনেছে? বাজে কথা। মিথ্যে কথা। আমি তো কিছুই জানি না।

কাকাবাবু বললেন, তুমি এদের চেনো? এদের জিজ্ঞেস করে দ্যাখো। তুমি এখানে একা কাঁদছ, ওখানে দশ-বারোজন মা কাঁদছে। এদের বলো সবকটা বাচ্চাকে ফেরত দিতে, না হলে কিন্তু তোমার কার্তিককে আর কোনওদিনই তুমি দেখতে পাবে না।

ময়না আবার ড়ুকরে কেঁদে উঠে বলল, আমার কার্তিককে এক্ষুনি ফেরত দাও, তার শরীর ভাল না, কাশির অসুখ।

আংটি-পরা লোকটি ধমক দিয়ে বলল, এই ময়না, চুপ কর! অনন্ত, একে বাইরে নিয়ে যাও!

ডাণ্ডা-হাতে লোকটি বাইরেই অপেক্ষা করছিল, সে এসে ময়নাকে টানতেটানতে নিয়ে গেল জোর করে ময়না তখনও ছটফটিয়ে কাঁদছে।

আংটি-পরা লোকটি এবারে একটা সিগারেট ধরিয়ে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল, রাজা রায়চৌধুরী, আমি আগে আপনার সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। আজ অনেক খোঁজখবর নিয়েছি। আপনি তো পুলিশের লোক নন? আপনি আমাদের ব্যাপারে মাথা গলাতে এসেছেন কেন? এসব লাইন তো আপনার নয়। আপনার তো পাহাড়-জঙ্গলে গিয়ে ভূত তাড়া করার কথা।

কাকাবাবু বললেন, আমি পুলিশের লোক নই, কিন্তু আমি মানুষ। তোমাদের মতন অমানুষ নই। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা কষ্ট পাচ্ছে শুনলে আমার কষ্ট হয়। শুধু কষ্ট নয়, মাথা গরম হয়ে ওঠে।

আংটি-পরা লোকটি বলল, উঁহু, মাথা গরম করা মোটেই ভাল নয়। মাথা গরম করেই তুমি হুট করে এখানে চলে এসেছ! কাজটা মোটেই ভাল করোনি। এখান থেকে কী করে ফিরে যাবে, সে চিন্তা করোনি!

পাশের লোকটি এবারে বলে উঠল, আরে ওস্তাদ, এর সঙ্গে তুমি এত ধানাইপানাই করছ কেন? সাফ-সাফ কথা বলে দাও। ময়নার ছেলেটাকে ফেরত না দিলে ওর ওই মেয়েটার একটা হাত কেটে ফেলা হবে!

কাকাবাবু বললেন, দেবলীনার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করলে ময়নার ছেলেকে কোনওদিনই ফেরত পাবে না। আমি যা বলছি আগে শোনো, তা হলে সব গণ্ডগোল মিটে যাবে।

সে লোকটি উঠে এসে কাকাবাবুর গলায় হাত দিয়ে বলল, চোপ! তুই আবার কী বলবি রে? আমরা যা বলব তা তোকে শুনতে হবে।

কাকাবাবু ধমকের সুরে বললেন, গলা থেকে হাত সরাও! আমার গায়ে কারও হাত ছোঁয়ানো আমি পছন্দ করি না।

লোকটি এবারে আরও জ্বলে উঠে বলল, চোপ, হারামজাদা, ল্যাংড়া! যদি এক্ষুনি তোর গলা টিপে মেরে রেললাইনে ফেলে দিয়ে আসি, তুই কী করবি?

কাকাবাবু বললেন, কাউকে মেরে রেললাইনে ফেলে দিয়ে আসাই তোমাদের কায়দা?

সে লোকটি আরও কিছু বলার আগে আংটি-পরা লোকটি হাত তুলে বলল, দাঁড়া দাঁড়া, ডাবু, যা বলার আমি বলছি!

ডাবু বলল, ওস্তাদ, এ-ল্যাংড়াটা আমারই ঘরে বসে আমাকে ধমকাবে, তা আমি সহ্য করব?

ওস্তাদ বলল, এরা লেখাপড়া জানা ভদ্দরলোক তো, প্রথম-প্রথম এরকম চোটপাট করে। দু-চারটে পুলিশের সঙ্গে চেনাশোনা আছে বলে মনে করে, ওদের সবাই ভয় পাবে। পেটে দু-চারটে কোঁৎকা মারলেই দেখবি, হাউমাউ করে কেঁদে ফেলবে। পা জড়িয়ে ধরবে। ওসব ভদ্দরলোক আমার ঢের দেখা আছে।

কাকাবাবুর ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠল।

ওস্তাদ বলল, ঠিক আছে, রায়চৌধুরীবাবু, তুমি কী বলতে চাও, আগে শুনি। তারপর আমাদের কাজ শুরু হবে।

কাকাবাবু বললেন, আমার একটাই শর্ত আছে। তোমরা দেবলীনা দত্ত নামে মেয়েটিকে ছেড়ে দেবে, যে বাচ্চা ছেলেগুলোকে চুরি করে এনেছ, তাদেরও ছেড়ে দেবে আমার সামনে, তারপরই ময়নার ছেলেকে ফেরত পাবে।

ওস্তাদ ভুরু তুলে অবাক হওয়ার ভান করে বলল, আমরা ছেলে চুরি করি, তোমায় কে বলল? না, না, ওসব আমাদের কাজ নয়। আমরা জিনিস সাপ্লাই করি। বর্ডারের ওপার থেকে যেসব জিনিস পাঠায়, তা আমরা এক-এক জায়গায় পৌঁছে দিই। কখন কী জিনিস পাঠাচ্ছে, তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না।

কাকাবাবু বললেন, তোমরা আর কী-কী চোরাই জিনিস সাপ্লাই করো, তা নিয়ে আমিও মাথা ঘামাতে চাই না। সেসব আটকানো পুলিশের কাজ। কিন্তু বাচ্চা শিশুদের বিদেশে চালান করা আমি সহ্য করব না কিছুতেই। বারোটি দুধের বাচ্চাকে তোমরা আটকে রেখেছ, আমি জানি!

ওস্তাদ হো-হো করে হেসে উঠে বলল, তুমি সহ্য করতে পারবে কি না, তাতে আমাদের কী আসে যায়? তুমি তো ভারী মজার কথা বলো!

কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার আর কিছু বলার নেই। বাচ্চাগুলোকে আর মেয়েটিকে ছেড়ে না দিলে তোমরা ময়নার ছেলেকে ফেরত পাবে না।

ওস্তাদ বলল, আরে, আরে, যাচ্ছ কোথায়? ডাবু নামের লোকটি এক লাফে উঠে এসে কাকাবাবুকে জাপটে ধরতে গেল। কাকাবাবু এক ঝটকায় তাকে ফেলে দিলেন মাটিতে। ডাবু লোকটি বেশ শক্তিশালী, কিন্তু কাকাবাবুর হাতে যে এতটা জোর, তা সে ভাবতেই পারেনি। মাটিতে পড়ে গিয়ে সে চেঁচিয়ে ডাকল, অনন্ত, দিনু–

ওস্তাদ পকেট থেকে রিভলভার বার করল। বাইরে থেকে দুজন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল কাকাবাবুকে, তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু রিভলভার বার করলেন না, কাউকে ঘুসি-টুসিও মারলেন না। একবার ওদের হাত ছাড়িয়ে চলে এলেন দরজার কাছে, আবার ওরা চারজন মিলে চেপে ধরল, একজন একটা মিষ্টি গন্ধমাখা রুমাল ঠেসে দিল তাঁর নাকে। তাতেই তাঁর হাত-পা অবশ হয়ে গেল, তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে।

ওস্তাদ বলল, ডাবু, দ্যাখ তো, লোকটার কাছে নিশ্চয়ই অস্তর আছে।

ডাবু কাকাবাবুর কোটের পকেট চাপড়ে রিভলভারটা খুঁজে পেয়ে গেল।

ওস্তাদ বলল, এটা বার করার সময় পায়নি। আমারটা দেখেছে তো, তাই বুঝে গেছে যে আর কোনও লাভ নেই।

ডাবু জিজ্ঞেস করল, অনন্ত, বাইরে পুলিশের গাড়ি আছে?

অনন্ত বলল, কাছাকাছি নেই, দেখে এসেছি।

ওস্তাদ বলল, গন্ধ শুঁকে-শুঁকে ঠিক আসবে। এখন হোটেলটা বন্ধ রাখতে হবে কিছুদিন। এখানে ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। এ লোকটাকে আমাদের আসল ডেরায় নিয়ে চল। ময়নাকেও এখান থেকে সরিয়ে ফেলা দরকার। ময়না চলুক আমার সঙ্গে।

ওদের দুজন কাকাবাবুকে চ্যাংদোলা করে নামিয়ে নিয়ে গেল সিঁড়ি দিয়ে।