০৬. জোজো দোতলায় উঠে এসে দেখল

জোজো দোতলায় উঠে এসে দেখল, কাকাবাবুর ঘরের দরজা বন্ধ। সে বাইরে থেকে দুবার ডাকল, কাকাবাবু, কাকাবাবু!

কোনও উত্তর নেই।

সে আবার বলল, কাকাবাবু, আমি জোজো।

তাও কোনও উত্তর নেই!

জোজো আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, আপনি ব্যস্ত আছেন?

এবারে ভিতর থেকে শোনা গেল কাকাবাবুর গলা। তিনি বললেন, না, ব্যস্ত নেই। কিন্তু দরজা খুলতে ইচ্ছে করছে না। তুমি পরে এসো।

জোজো অবাক হয়ে কয়েকবার চোখ পিটপিট করল। তারপর পা টিপে টপে উঠে গেল উপরে।

বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে বুকের উপর বই রেখে পড়ছে সন্তু আর একটা গান বাজছে মিউজিক সিস্টেমে।

জোজো ঘরে ঢুকে বলল, ব্যাড হ্যাবিট, ব্যাড হ্যাবিট। শুয়ে শুয়ে বই পড়া মোটেই ভাল নয়। তা হলে আর চেয়ার-টেবিল বানানো হয়েছে কেন?

সন্তু বলল, তুই যে বিছানায় বসে বসে ব্রেকফাস্ট খাস? তা হলে খাওয়ার টেবিল থাকে কেন বাড়িতে?

জোজো বলল, ওটা হচ্ছে রোমান স্টাইল। রোমের বড় বড় লোকেরা বিছানায় শুয়ে শুয়ে খেত আর বিরাট বিরাট ঢেকুর তুলত। আমার অবশ্য ঢেকুর ওঠে না।

সন্তু বলল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুয়ে শুয়ে লিখতেন আর পড়তেন।

জোজো জিজ্ঞেস করল, তুই বুঝি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শুয়ে শুয়ে পড়তে দেখেছিস?

সন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলল, তুই বুঝি সেকালের রোমের লোকদের শুয়ে শুয়ে খেতে দেখেছিস?

জোজো বলল, হ্যাঁ দেখেছি, সিনেমায়!

সন্তু উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, তুই আমার শরদিন্দু গ্রন্থাবলিটা ফেরত এনেছিস?

জোজো বলল, এখনও শেষ হয়নি। আস্তে আস্তে পড়ছি।

সন্তু বলল, তোর কাছে আমার অনেক বই জমে যাচ্ছে, জোজো।

জোজো বলল, আমি একসঙ্গে তিন-চারটে বই পড়ি। একবার এ বইয়ের দুপাতা, আবার বিকেলে আর-একটা বইয়ের তিন পাতা… হঠাৎ কথা থামিয়ে জোজো সন্তুর দিকে একটুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, কাকাবাবুর কী হয়েছে রে সন্তু?

সন্তু বলল, কেন, তুই কী দেখলি?

জোজো বলল, দরজা বন্ধ। এই সময় কোনওদিনও তো দরজা বন্ধ থাকে। আমাকে দেখলেই জিজ্ঞেস করেন, নতুন খবর কী জোজোসাহেব? আজ আমি ডাকলাম, তবু দরজা খুললেন না!

সন্তু বলল, আজ কাকাবাবুকে ডিস্টার্ব করা চলবে না। ওঁর খুব মনখারাপ। আমাদের বাড়িসুদ্ধ সকলেরই মনখারাপ। কাকাবাবু কারও সঙ্গে কথাই বলতে চাইছেন না।

জোজো ভুরু কুঁচকে বলল, বাড়িসুদ্ধ সকলেরই মনখারাপ? কেন রে? কী হয়েছে?

সন্তু বলল, সেটা আর কাউকে জানানো নিষেধ। তোকে বললে তো তুই দুনিয়াসুদ্ধ লোককে জানিয়ে দিবি।

জোজো বলল, আই প্রমিস।

সন্তু বলল, তুই বিন্দুকে চিনিস তো? আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসে।

জোজো বলল, বিল্টুকে চিনব না কেন? ও তো ছবি এঁকে একটা দারুণ প্রাইজ পেয়েছে। কী হয়েছে বিন্দুর?

সন্তু বলল, বিন্দুকে পাওয়া যাচ্ছে না। মানে, তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। সাংঘাতিক একদল লোক কুড়ি লাখ টাকা চেয়েছে। টাকাটা ঠিক সময় না পেলে…

জোজো বলল, এই ব্যাপার? এ জন্য কাকাবাবু শুধু শুধু মনখারাপ করবেন কেন? তিনি তো ইচ্ছে করলেই লোকগুলোকে ধরে ফেলতে পারেন।

সন্তু বলল, না, শোন। আজ ভোরবেলা সিদ্ধার্থদা ফোন করেছিলেন। আমাকে বললেন, খবরটা জানাননি বলে খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু লোকগুলো শর্ত দিয়েছে, পুলিশে খবর দেওয়া চলবে না। আর কাকাবাবুকে কিছুতেই এর মধ্যে জড়ানো যাবে না। এমনকী কাকাবাবু এখন বিলুদের বাড়িতে যেতেও পারবেন না। কাকাবাবু কিছু করতে গেলেই ওরা বিলুকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েছে। সিদ্ধার্থদা আমাকে বললেন, কাকাবাবুকে এইসব কথা বুঝিয়ে বলতে। ওঁরা টাকা দিয়েই বিন্দুকে ছাড়িয়ে আনতে চান। এইসব কথা শুনেই কাকাবাবু কেমন যেন হয়ে গেলেন। একটা কথাও বললেন না। তারপর… জোজো, তুই কখনও কাকাবাবুকে কাঁদতে দেখেছিস?

জোজো বলল, কোনওদিন না। কাকাবাবু কেঁদেছেন?

সন্তু বলল, প্রথমে চোখ দিয়ে জল নেমে এল। তারপর কিছুক্ষণ ফুঁপিয়েফুঁপিয়ে কাঁদলেন। একটু পরে সেই যে দরজা বন্ধ করলেন, আর কারও ডাকে। সাড়া দিচ্ছেন না! কাকাবাবু বিন্দুকে খুব ভালবাসেন।

জোজো বলল, কাকাবাবু সব ছোট ছেলেমেয়েদেরই ভালবাসেন। ছোটদের কষ্ট উনি সহ্য করতে পারেন না। এখন কী হবে?

সন্তু বলল, সিদ্ধার্থদা বলেছেন, আগে যেভাবেই হোক বিলুকে উদ্ধার করতে হবে। তারপর ওদের শাস্তির ব্যবস্থা।

জোজো বলল, ইস, আমার বাবা এখন এখানে নেই। তিব্বতে গিয়েছেন। বিশেষ কাজে।

সন্তু বলল, তোর বাবা থাকলে কী হত?

জোজো বলল, বাবা কার্লোসকে বলে দিতেন। কার্লোস এক ধমক দিলেই ওরা সুড়সুড় করে এসে বিন্দুকে ফেরত দিয়ে যেত।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কার্লোস কে?

জোজো বলল, তুই কার্লোসের নাম শুনিসনি? পৃথিবীতে যত কিডন্যাপিং-এর দল আছে, কার্লোস হচ্ছে তাদের হেড। তাকে সকলে ভয় পায়। সে যে কোন দেশের লোক, কী জাত, তা কেউ জানে না। সে আঠাশ রকম ছদ্মবেশ ধরতে পারে! আঠাশ রকম ভাষাও জানে! তার মধ্যে বাংলাও বলে ঝরঝর করে!

সন্তু আবার তাকে জিজ্ঞেস করল, তোর বাবা তাকে চিনলেন কী করে?

জোজো বলল, এইসব লোকের একটা কিছু দুর্বলতা থাকে। এমনিতে লোকটা দারুণ সাহসী, সাতবার মিলিটারির হাতে ধরা পড়েও পালিয়েছে। দুহাতে রিভলভার চালাতে পারে। এমন লোকও ঘুমোলেই খুব ভয়ের স্বপ্ন দ্যাখে! দারুণ ভয়ের স্বপ্ন। ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠে। তারপরই ঘুম ভেঙে যায় আর ঘুমোতে পারে না। জেগে বসে থাকে। অনেক চিকিৎসা করিয়েছে। কিন্তু কিছুতেই এই ঘুমের মধ্যে ভয় পাওয়ার অসুখ সারেনি, বুঝলি? তারপর কার্লোস একবার কলকাতা এসে আমার বাবার নাম শুনে দেখা করতে আসে। না, ভুল বললাম, আমার বাবার নাম আগেই শুনে তারপর কলকাতায় এসেছিল। বাবা তাকে বিশল্যকরণী গাছের কয়েকটা শিকড় রোজ চিবিয়ে খেতে বলেন। তাতে কী হয় বল তো? অনেক স্বপ্ন দেখা যায়। অনেক স্বপ্ন আর ভাল ভাল স্বপ্ন। তাই ভয়ের স্বপ্ন আর পাত্তা পায় না। ভাল স্বপ্নগুলো গুতোগুতি করে খারাপ স্বপ্নটাকে তাড়িয়ে দেয়। আর কার্লোস আরাম করে ঘুমোয়। ইস, কার্লোসকে একটা খবর দিতে পারলে কত ভাল হত। ও কলকাতায় সব গুন্ডা-বদমাইশদের চেনে। ও বাবাকে কথা দিয়েছে, বাঙালিদের কখনও ক্ষতি করবে না।

সন্তু বলল, তোর কাছে কার্লোসের কথা এই প্রথম শুনলাম।

জোজো ঠোঁট উলটে বলল, এরকম আরও কত আছে! শুনবি আস্তে আস্তে। এখন কথা হচ্ছে, কাকাবাবু মাথা না গলালেও বিন্দুকে উদ্ধার করার জন্য তুই আর আমি কিছু করতে পারি না?

সন্তু বলল, কী করতে পারি বল? এক তো, কার্লোসকে পাওয়া গেল না।

জোজো বলল, দাঁড়া, একটু ভেবে দেখি।

তখনই বুলবুলিপিসি এসে ঢুকলেন ঘরে। চিন্তিতভাবে বললেন, এ কী ব্যাপার হচ্ছে রে সন্তু? ছোড়দা যে কিছুতেই দরজা খুলছেন না। ব্রেকফাস্ট খেলেন না, কফি খেলেন না, শরীরটরির খারাপ হল নাকি?

সন্তু বলল, শরীর খারাপ নয়, মনখারাপ।

বুলবুলিপিসি বললেন, তা তো জানি। কিন্তু মনখারাপ থেকেই শরীর খারাপ হয়। কিছু না খেলে চলে? সন্তু, একটা কিছু ব্যবস্থা কর।

সন্তু খানিকটা অসহায়ভাবে বলল, আমি কী করব বলো তো পিসি?

বুলবুলিপিসি বললেন, তুই গিয়ে ডাক। তোর কথা শুনবেন। দরজা খুলবেন।

সন্তু বলল, তোমরা কাকাবাবুকে সব সময় হেসে হেসে কথা বলতে দ্যাখো। ওঁর রাগ তো দ্যাখোনি। ওরে বাবা, ওঁর রাগের সময় আমিও সামনে দাঁড়াতে ভয় পাই।

জোজো বলল, আমি একটা কথা বলব? চলো, সকলে মিলে একসঙ্গে যাই। তিনজন একসঙ্গে ডাকব। তা হলে কাকাবাবু ঠিক দরজা খুলতে বাধ্য হবেন। আমি একেবারে সামনে দাঁড়াব। যদি আমার উপর বেশি রাগ করেন, তাতে আমার কিছু আসে-যায় না। আমি ফটাস করে হেসে দেব।

বুলবুলিপিসি বললেন, ফটাস করে হাসি মানে? সেটা আবার কেমন?

জোজো বলল, আছে, আছে, দেখলে বুঝবে।

তিনজনই নেমে এল নীচে।

কাকাবাবুর বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তিনজনেই একসঙ্গে ডাকল, কাকাবাবু! ছোড়দা!

কোনও উত্তর নেই।

সন্তু এবার জোজোর কানে কানে কী যেন বলে দিল।

জোজো চেঁচিয়ে বলল, কাকাবাবু, তুমি যদি দুমিনিটের মধ্যে দরজা না খোলো, তা হলে তোমার দাদা পায়ের ব্যথা নিয়েও উপরে উঠে আসবেন বলেছেন।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে গেল!

কাকাবাবুর ভুরু কোঁচকানো গম্ভীর মুখ দেখে সন্তু সরে গেল পিছনে।

কাকাবাবু বললেন, আঃ, তোমরা কেন আমাকে বিরক্ত করছ?

জোজো বলল, সকলে ভিতরে চলে এসো, ভিতরে চলে এসো।

জোজো প্রথমে কাকাবাবুকে প্রায় ঠেলেই ঢুকে পড়ল ঘরের মধ্যে। সন্তুরও হাত ধরে টেনে আনল।

বুলবুলিপিসি নিজেই ভিতরে এসে জোজোর দিকে তাকালেন।

জোজো বলল, এখনও ফটাস হাসির সময় হয়নি। এখনও কাকাবাবু আলাদা করে আমাকে বকেননি।

কাকাবাবু বুলবুলিপিসির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার তোমাদের?

বুলবুলিপিসি বললেন, বিল্টুর জন্য আমাদের সকলেরই খুব মনখারাপ। কিন্তু সকাল থেকে উপোস করে থাকলে কি কোনও লাভ হবে? ছোড়দা, তুমি কফিও খাওনি?

কাকাবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, শুধু মনখারাপ নয় রে বুলবুল। এখন অসহ্য রাগে আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে, রিভলভারটা নিয়ে এখনই বেরিয়ে গিয়ে ওদের গুলি করে মেরে ফেলি!

বুলবুলিপিসি জিজ্ঞেস করলেন, ওদের মানে কাদের?

কাকাবাবু বললেন, যারা বিন্দুর মতো ছোট ছেলেদের চুরি করে নিয়ে যায়। মেরে ফেলার ভয় দেখায়, তাদের!

বুলবুলিপিসি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তাদের তুমি পাবে কোথায়?

কাকাবাবু বললেন, তাদের যে আমি খুঁজে বের করব, তারও তো উপায় নেই। বিল্টুর বাবা-মা তা চায় না। আমি কিছু না করে ঘরের মধ্যে বসে থাকব? ওঃ, অসহ্য! অসহ্য!

জোজো বলল, কাকাবাবু, আপনি সত্যি সত্যি তাদের দেখতে পেলেও গুলি করে মেরে ফেলতে পারবেন? আপনি তো কাউকেই শেষ পর্যন্ত। মারেন না।

কাকাবাবু বললেন, আগে পারতাম না। অনেক অপরাধীকেই শেষ পর্যন্ত ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু ছোট ছেলেমেয়েদের জীবন নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলে, তাদের মতো খারাপ মানুষ আর হয় না। তারা মানুষ নয়, অমানুষ। তাদের একেবারে মেরে ফেলাই উচিত।

কাকাবাবুর পিঠে হাত রেখে বুলবুলিপিসি বললেন, ছোড়দা, রাগে তোমার শরীর কাঁপছে। একটু শান্ত হও! বসো, আমি তোমার ব্রেকফাস্ট এনে দিচ্ছি।

কাকাবাবু ইজিচেয়ারে বসে পড়ে চোখের সামনে খবরের কাগজ তুলে নিলেন।

সন্তু ফিসফিস করে জোজোকে বলল, চল, আমরা উপরে যাই!

টোস্ট, অমলেট আর কফি খাওয়ার পর কাকাবাবু বাইরে বেরোনোর পোশাক পরে নেমে এলেন নীচে।

বুলবুলিপিসি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ছোড়দা, তুমি বেরোচ্ছ? কোথায় যাচ্ছ?

কাকাবাবু ঝঝের সঙ্গে উত্তর দিলেন, কোথায় যাচ্ছি মানে? আমি পুলিশের কাছে যাব না, বিন্দুদের বাড়ির দিকেও যেতে পারব না। তা হলে কি আমাকে নিজের বাড়িতে বন্দি হয়ে থাকতে হবে? এই একটু ঘুরে আসছি।

দরজা খুলে কাকাবাবু বেরিয়ে এলেন রাস্তায়। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলেন। বাড়ি থেকে কোথাও যেতে হলে তিনি সাধারণত ট্যাক্সি নেন। বাসের ভিড়ে তার অসুবিধে হয়। আজ ট্যাক্সি না ডেকে খানিকটা হেঁটে এলেন পার্কের কাছে। একটু দাঁড়াতেই সেখানে একটা দোতলা বাস এসে থামল। এখন বেলা সাড়ে এগারোটা। তবু বাসে বেশ ভিড়। কাকাবাবু ক্রাচদুটো নিয়ে সাবধানে বাসে উঠলেন। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলেন বাসের হাতল ধরে।

 

 

কিছু দূর গিয়ে বাস বদল করে আর-একটা বাসে উঠলেন কাকাবাবু। তারপর নামলেন খিদিরপুরের কাছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে বুঝতে চাইলেন, কেউ তাকে অনুসরণ করছে কিনা। কেউ নেই। খানিকটা হেঁটে একটা গলির মুখে এসে তিনি একটা বাড়ির গেটের কাছে থামলেন। বেশ উঁচু লোহার গেট, ভিতরে মোরাম ঢালা একটু রাস্তা, তারপর শ্বেতপাথরের সিঁড়ি। বাড়িটি বেশ বড় আর পুরনো আমলের। এক পাশ দিয়ে দেখা যায় গঙ্গা নদী।

গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে বেশ লম্বা চেহারার, পাগড়িপরা দরোয়ান। কাকাবাবু শার্টের পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে দরোয়ানকে দিয়ে বললেন, আমি জগৎ মল্লিকের সঙ্গে দেখা করতে চাই। এই কার্ডে আমার নাম লেখা আছে।

দরোয়ান গেট না খুলে কার্ডটা নিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেল। একটু পরে ফিরে এল সঙ্গে আর-একজন লোক নিয়ে।

ধুতির উপর সাদা শার্ট পরা সেই লোকটি কাছে এসে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, আপনি সত্যিই রাজা রায়চৌধুরী? মল্লিকবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন?

কাকাবাবু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, সত্যি না তো মিথ্যে হবে কেন? হ্যাঁ, আমিই রাজা রায়চৌধুরী। মল্লিকবাবু বাড়িতে আছেন নিশ্চয়ই?

লোকটি দরোয়ানকে গেট খুলে দেওয়ার ইঙ্গিত করে কাকাবাবুকে বলল, আসুন।

একটা মস্ত বড় বসার ঘরে কাকাবাবুকে বসিয়ে লোকটি ভিতরে চলে গেল। কাকাবাবু দেওয়ালের ছবিগুলো দেখতে লাগলেন।

খানিক পরে লোকটি ফিরে এসে জিজ্ঞেস করল, বাবু আছেন তিনতলার ঘরে। এখন নামতে পারবেন না। আপনি সেখানে যেতে চান?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, যেতে চাই। শুধু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে অসুবিধে হবে, আস্তে আস্তে উঠব।

বাইরে একটা লম্বা বারান্দা, একপাশে উঠোন। সিঁড়ির পাশে এসে দাঁড়িয়ে লোকটি বলল, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। লিফট আছে পাশেই।

কাকাবাবু বললেন, এটা নতুন। আগে ছিল না।

উপরে উঠে এসে কাকাবাবুকে লোকটি নিয়ে এল আর-একটি ঘরে। এটাও একটা বসার ঘর, সোফা দিয়ে সাজানো। জানলা দিয়ে দেখা যায়, গঙ্গা দিয়ে যাচ্ছে স্টিমার। ঘরে কেউ নেই। কাকাবাবুকে বলা হল কোণের দিকে একটা সোফায় বসতে।

কাকাবাবু বসতে যেতেই লোকটি হঠাৎ পিছন থেকে জাপটে ধরল কাকাবাবুকে। তারপর এক হাতে কাকাবাবুর গলাটা পেঁচিয়ে ধরে অন্য হাতটা ঢুকিয়ে দিল তার প্যান্টের পকেটে। কাকাবাবুও চোখের নিমেষে লোকটির সেই হাতটা ধরে এমন জোরে মুচড়ে দিলেন যে লোকটি যন্ত্রণায় আঁ আঁ করে উঠল।

কাকাবাবু লোকটিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললেন, ছিঃ, অন্য লোকের পকেটে ওরকমভাবে হাত দিতে নেই। আমার রিভলভারটা বের করে নেওয়ার তাল করছিলে তো? সেটা মুখে বললেই হত। পাছে রাগের চোটে কাউকে আজ গুলি করে ফেলি, তাই রিভলভারটা আমি সঙ্গেই আনিনি। এই দ্যাখো! কাকাবাবু সব পকেট উলটে দেখালেন।

তখনই একদিকের পরদা সরিয়ে ঘরে ঢুকলেন জগৎ মল্লিক। খুব ফরসা রং, লম্বা-চওড়া চেহারা। পুরুষ্টু গোঁফ আছে, একটু একটু টাক পড়তে শুরু করেছে। কোচানো ধুতি আর ফিনফিনে সাদা পাঞ্জাবি পরা।

জগৎ মল্লিক দাঁড়িয়ে থেকেই বললেন, আমি এখনও যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না! সত্যি সত্যি রাজা রায়চৌধুরী এসেছেন, নিজের ইচ্ছেতে, এই বাঘের গুহায়?

কাকাবাবু হেসে বললেন, না, না, বাঘের গুহা কেন হবে? এটা আপনার মতো একজন বনেদি মানুষের বাড়ি। এ বাড়িতে তো আমি আগেও এসেছি। তাই না?

জগৎ মল্লিক বিদ্রুপের সুরে বললেন, আপনাকে এখনই যদি মেরে ফেলি, কে আপনাকে বাঁচাতে আসবে? রিভলভারও তো সঙ্গে আনেননি শুনলাম।

কাকাবাবু বললেন, অমনভাবে কি মানুষকে মেরে ফেলা যায়? আপনি বড়জোর চেষ্টা করতে পারেন। চেষ্টা করলেই যে পারবেন, তারও তো কোনও মানে নেই। আমার আবার বেঁচে থাকার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। যাই হোক, বসুন, বসুন, আপনার সঙ্গে কাজের কথা আছে।

জগৎ মল্লিক ধমক দিয়ে বললেন, বাজে কথা ছাড়ুন। আপনার সঙ্গে আবার কাজের কথা কী! আপনাকে দেখেই রাগে আমার গা জ্বলছে। আপনাকে খুন করে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।

কাকাবাবু বললেন, মৃতদেহ হয়ে গঙ্গার জলে ভাসার একটুও ইচ্ছে আমার নেই। এখন আমার কথা শুনুন। তা হলে আপনার রাগ কমে যাবে।

জগৎ মল্লিক গর্জন করে বললেন, রাগ কমবে মানে? আপনার জন্য আমি পাঁচ বছর জেল খেটেছি। ছাড়া পেয়েছি মাত্র সাতদিন আগে। জেলে বসে প্রতিটা দিন আমি ভেবেছি, রাজা রায়চৌধুরীর উপর আমি প্রতিশোধ নেবই নেব। প্রাণে না মারলেও আর-একটা পা খোঁড়া করে দেব।

কাকাবাবু বললেন, সে যখন দেওয়ার তখন দেবেন। আপনি জেল খেটেছেন। দামি দামি সব মূর্তি বিদেশে পাঠাতে গিয়ে ধরা পড়েছেন বলে।

জগৎ মল্লিক বললেন, আপনি আমাকে আর আমার ভাইকে ধরিয়ে দিয়েছেন।

কাকাবাবু বললেন, ওই সব অসৎ কাজ না করলে ধরা পড়ার কিংবা জেল খাটার প্রশ্নও ছিল না। যাই হোক, মল্লিকবাবু, আপনারা কি কখনও ছোট ছেলেমেয়েদের বিদেশে বিক্রির ব্যাবসা করেছেন? কিংবা ছোট ছেলেমেয়েদের চুরি করে তাদের মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে বাবা-মায়ের কাছ থেকে মোটা টাকা আদায় করার কারবার করেছেন?

রাগে জগৎ মল্লিকের ফরসা মুখোনা লাল হয়ে গেল! আবার তিনি গর্জন করে বলল, কী, আমরা ওসব নোংরা কাজ করি? কখনও না। বিদেশ মূর্তি চালান দেওয়া আমাদের অনেক দিনের ব্যাবসা। তার মধ্যে কোনটা চোরাই কিংবা কোনটা পাঠানো বেআইনি তা আমরা জানব কী করে? ছোট ছেলেমেয়ে বিক্রির মতো কুৎসিত কাজ আমরা কখনও করি না।

কাকাবাবু বললেন, আমারও তাই ধারণা। টাকার জন্য আপনারা অত। নীচে নামবেন না। কিন্তু কারা ওই সব নোংরা কাজ করে, তাদের নিশ্চয়ই আপনারা চেনেন?

জগৎ মল্লিক বললেন, ওরকম দু-একটা দলের কথা জানি বটে।

কাকাবাবু বললেন, একটা ছোট ছেলে, আট-সাড়ে আট বছর বয়স, সে আমার খুবই প্রিয়। ছেলেটি খুবই গুণীও বটে। তাকে ওইরকম একটা দল ধরে নিয়ে গিয়েছে। ছেলেটির কোনও ক্ষতি হলে আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারব না। কোন দল ওই ছেলেটিকে ধরে রেখেছে, সে খবর আপনারা নিশ্চয়ই চেষ্টা করলে জানতে পারবেন। আজকের মধ্যেই সে দলটার নাম আমাকে জানালে আমার খুব উপকার হয়।

জগৎ মল্লিক বললেন, আপনার উপকার হয়? চেষ্টা করলে খবরটা আমরা জানতে পারি। কিন্তু আপনার সেই উপকার আমরা করব কেন?

কাকাবাবু বললেন, তার বদলে আমিও আপনাদের এমন একটা উপকার করতে পারি।

এমন সময় কে যেন হুংকার দিয়ে বলে উঠল, কই, কই কোথায় সে? পরদাটা সরিয়ে ঢুকল আর-একজন লোক। ঠিক থিয়েটারের মতো! লোকটির চেহারা হুবহু জগৎ মল্লিকের মতো। শুধু ধুতি-পাঞ্জাবির বদলে প্যান্ট-শার্ট পরা। বোঝাই যায়, এরা যমজ ভাই। এঁর নাম মাধব মল্লিক।*

মাধব মল্লিকের হাতে একটা ঝকঝকে তলোয়ার! সেই তলোয়ার তুলে তিনি বললেন, এই যে, সত্যিই রাজা রায়চৌধুরী। এবার ঘচাং করে ওর মুন্ডুটা এক কোপে কেটে ফেলব!

কাকাবাবু শান্তভাবে বললেন, নমস্কার মাধববাবু। বসুন, কথা আছে। মাধব মল্লিক বিকৃত গলায় বললেন, কথা? কোনও কথা নেই। এখন। আমি রক্তগঙ্গা বইয়ে দেব! এঁর জন্য আমরা দুভাই জেল খেটেছি!

মাধব মল্লিক খুব কাছে এগিয়ে আসছে দেখে কাকাবাবু উঠে দাঁড়ালেন। একটা ক্রাচ তুলে নিয়ে আটকালেন মাধব মল্লিকের হাতের উদ্যত তলোয়ার। মাধব মল্লিক আবার মারার চেষ্টা করতেই কাকাবাবু আটকালেন। এরকম দুতিনবারের পরই কাকাবাবু ওর ডান হাতের কবজিতে এত জোরে মারলেন যে তলোয়ারটা খসে পড়ে গেল মেঝেতে।

কাকাবাবু সেটাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললেন, মাধববাবু, তলোয়ার শুধু হাতে ধরলেই হয় না, ভাল করে চালানো শিখতে হয়। ওসব না শিখে রাজা রায়চৌধুরীকে আক্রমণ করা যায় না। বসুন, এখন কাজের কথা হবে!

এবার জগৎ মল্লিকও বললেন, বোসো মাধব। উনি কী বলছেন, একবার শুনে নিই।

মাধব মল্লিক ডান হাতটা নাড়তে নাড়তে ফুঁ দিতে লাগলেন।

কাকাবাবু বললেন, ছেলেটির নাম বিলু। ভাল নাম নীলধ্বজ। তিনদিন আগে তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। কারা তাকে চুরি করেছে, কোথায় তাদের আসল ঘাঁটি, এসব আমার জানা দরকার।

জগৎ মল্লিক বললেন, ধরুন আপনাকে জানালাম। তার বদলে আপনি আমাদের কী উপকার করবেন?

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ছেলে বিশ্বজিৎ এখন কোথায়?

জগৎ মল্লিকের মুখোনা একটু যেন ম্লান হয়ে গেল। আস্তে আস্তে তিনি বললেন, সে কোথায়, তা তো আমি জানি না।

কাকাবাবু বললেন, সে কোথায়, তা আপনারা ঠিকই জানেন। আমিও জানি। আপনারা তাকে লুকিয়ে রেখেছেন। এত অল্প বয়সে সে লেখাপড়া ছেড়ে বাজে দলের সঙ্গে মিশে একেবারে বখে গিয়েছে। তিনটে পেট্রোল পাম্প ডাকাতির ব্যাপারে সে জড়িত। কোচবিহারের বিখ্যাত মদনমোহন মূর্তি সে চুরি করে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। সেখানকার মন্দিরের এক পুরোহিতের সে তিনখানা দাত ভেঙে দিয়েছে। পুলিশ তাকে খুঁজছে হন্যে হয়ে। ঠিক বলছি কিনা?

দুই ভাই, জগাই-মাধাই চুপ করে রইলেন।

কাকাবাবু বললেন, বেশিদিন সে ফেরার হয়ে থাকতে পারবে না। ধরা সে পড়বেই। মাত্র তেইশ বছর বয়স। এই বয়সে সে জেলে গিয়ে পাকা পাকা ক্রিমিনালের সঙ্গে মিশে নিজেও পাকা ক্রিমিনাল হয়ে উঠবে! আপনারা তাই চান?

জগৎ মল্লিক জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী বলতে চান, খুলে বলুন।

কাকাবাবু বললেন, আমি তাকে সৎপথে ফেরাতে চাই। জেলে পাঠালে সেটা হবে না। বরং এবারের মতো তাকে ক্ষমা করে দিলে আপনারা চেষ্টা করে তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দিতে পারেন। সেখানে আবার পড়াশোনা শুরু করতে পারবে। অন্যরকম পরিবেশে সে আর অপরাধের পথে যাবে না। আমি ব্যবস্থা করব, যাতে পুলিশ তাকে না ধরে এবারের মতো। শুধু মদনমোহনের মূর্তিটা ফেরত দিলেই তাকে ক্ষমা করা হবে।

জগৎ মল্লিক বললেন, আপনি সত্যিই সে ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন? আপনি বাঁচাতে পারবেন আমার ছেলেটাকে?

কাকাবাবু বললেন, মানুষকে শাস্তি দেওয়ার বদলে তাকে ভাল পথে ফেরানোর আনন্দই তো বেশি। আমি কথা দিচ্ছি, পুলিশ তাকে এবার ধরবে না। তবে, আবার যদি সে কোনওরকম কুকাজ করে, তবে তার ডবল শাস্তি হবে, এটাও ঠিক।

জগৎ মল্লিক বললেন, না, না, তাকে আমরা জার্মানি পাঠিয়ে দেব। আপনার এই কথার উপর নির্ভর করা যায়?

কাকাবাবু বললেন, রাজা রায়চৌধুরী কোনও কথা দিলে তার খেলাপ করে না কখনও। বিশ্বজিৎ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমার ওই খবরগুলো আজই বিকেলের মধ্যে চাই।

জগৎ মল্লিক বললেন, আজই বিকেলের মধ্যে পারব কিনা জানি। কিছুটা সময় তো লাগবেই। কালকের মধ্যে সব জেনে যাব আশা করি।

কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, একেবারে পাকা খবর চাই। দলের পাণ্ডা কে আর কোথায় তাদের ঘাঁটি?

জগৎ মল্লিক বললেন, যেমন ভাবেই হোক, সেসব খবর আমি জোগাড় করবই। আমার ছেলেটাকে আপনি বাঁচান।

কাকাবাবু মাধব মল্লিকের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার কবজিতে একটা কিছু মলম লাগান। নইলে কিন্তু ওই জায়গাটা ফুলে যাবে আর খুব ব্যথা হবে।

 

————
*এই দুই যমজ ভাইয়ের কথা আছে কলকাতার জঙ্গলে বইয়ে।