০৫. সমাজতান্ত্রিক আলোচনা নয়

প্রথমেই বলে রাখি, এটা কোনও সমাজতান্ত্রিক আলোচনা নয়। আমার অভিজ্ঞতাপ্রসূত একটি লঘু সন্দৰ্ভমাত্র।

নিছক যোগাযোগ বা দুর্ঘটনাবশতই হোক, আমি আমেরিকার নানা জায়গায় দেখেছি, শিল্প সংস্কৃতির চূড়ামণি হিসেবে বা পৃষ্ঠপোষক হয়ে বসে আছেন এক একজন প্রৌঢ়া বিধবা। এইসব প্রৌঢ়া রমণী যেমন নানান বাতিকগ্রস্ত তেমনি অর্থব্যয়ে মুক্তহস্তা এবং একটু অভিভূত হলে দয়ার আঁধার।

আমেরিকার ধনীদের অনেকেরই ঘন-ঘন বউ বদলানো স্বভাব। আর ওদের ধনীরা তো আর জাত-কুল-মান দেখে বিবাহ করেন না, পাত্রী নির্বাচন করেন রূপ ও নামডাক দেখে। অর্থাৎ সমাজে ও দেশে যে-রমণীর বেশি সুনাম বা দুর্নাম তাকে বিবাহ করার জন্য ধনীরা তখন উদগ্রীব, তা হোক না সে রমণী কোনও নর্তকী বা অভিনেত্রী বা প্রাক্তন সেনাপতির নির্যাতিত স্ত্রী। এইসব বেশি বয়সে বিয়ে করা স্বামীরা যখন হঠাৎ একদিন দুম করে মারা যান, তখন তাদের বিধবা পত্নীরা প্রথমটায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে যান। বিবাহিত জীবনের হয়তো সুখভোগ, আমোদ-বিলাসিতার চূড়ান্ত ছিল ঠিকই, কিন্তু টাকা পয়সার হিসেব নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতে হয়নি, কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা দেখলেন যে, তাঁর হাতে এখন অঢেল টাকা, কোটি-কোটি টাকা, ব্যাংকের সিন্দুকে টাকায় শ্যাওলা পড়ছে–তা ছাড়াও, টেকসাসের কোনও তেল কোম্পানি কিংবা চেইন স্টারের মালিকানা থেকেও প্রতি বছর আসছে লক্ষ-লক্ষ টাকা। এখন এত টাকা নিয়ে তিনি করবেন কী?

বেশি বয়সে বিয়ের ফলে অনেকেরই সন্তান থাকে না। আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখারও কোনও পার্ট নেই সে দেশে। থাকলেও অত টাকার মালিক কোনও বিধবা আত্মীয়স্বজনদের বিশ্বাস করতে পারেন না। আবার বিয়ে করতেও ভরসা হয় না, কেন না, যে বিয়ে করবে সে নিশ্চিত টাকার লোভ ছাড়া প্রৌঢ়া বিধবাকে বিয়ে করতে কেন রাজি হবে। যে দেশে যুবতী মেয়েদেরই বর জোটে না।

সুতরাং অত টাকা নিয়ে বিধবারা শিগগিরই ক্লান্ত হয়ে ওঠেন। তা ছাড়া বিলাসিতায় টাকা খরচ করারও তো একটা সীমা আছে। কত টাকা আর পার্টি ডেকে কিংবা নৌকা বিলাসে খরচ করা যায়। আরও যে অঢেল টাকা, সবসময় ঝনঝন করে বিরক্ত করে।

সুতরাং তখন তাদেরও ইচ্ছে হয় টাকা খরচ করে বিখ্যাত হতে। টাকা খরচ করে কাগজে ছবি ছাপাতে। সারা দেশের লোকের মুখে তাঁর নাম ছড়াতে।

এখন প্রৌঢ়া রমণীদের বিখ্যাত হবার উপায় হঠাৎ নাটকীয়ভাবে আত্মহত্যা করা অথবা শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক হওয়া। রুচির তাগিদেই হোক বা বিখ্যাত হবার ঝোঁকেই হোক, ইদানীং প্রৌঢ়া বিধবাদের শিল্প-সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক আমেরিকার সংস্কৃতির পক্ষে উপকারীই হয়েছে।

কোথাকার যেন এক ডাচেস এক আমেরিকান ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে নিউইয়র্কে বসবাস করেছিলেন, কস্মিনকালেও কেউ তাঁর নাম শোনেনি। বিধবা হওয়ার পর তিনি হঠাৎ কিছু টাকা দান করে ফেললেন। নিউইয়র্কের একটি কবিদের সংঘে তিনি দান করলেন এককালীন সাড়ে সতেরো লক্ষ ডলার, পরদিন প্রত্যেক কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় তাঁর নাম। তাঁকে সংবর্ধনা জানাবার জন্যে এক সভায় এসেছিলেন আমেরিকার শ্রেষ্ঠ কবিরা। ভদ্রমহিলার ওই দানকে নেহাৎ সাহিত্যপ্রীতি বলা যায় না, কারণ তিনি পশুক্লেশ নিবারণী সমিতিকেও ওই পরিমাণ অর্থ দান করেছিলেন। তা যাই হোক ওই টাকা পেয়ে কবিদের মধ্যে আনন্দের হুল্লোড় পড়ে গিয়েছিল।

আর একটি বিধবা রমণীর বাড়িতে দৈবাৎ দাওয়াত খেতে গিয়েছিলুম, হার্ডসন নদীর পাড়ে তার প্রাসাদোপম অট্টালিকায়। সেই অট্টালিকার বৈভবের বর্ণনা করতে পারি–এমন সাধ্য আমার নেই, তবে দুটি ঘরের কথা বলি। সেই দুটি ঘরকে বলা যায় সোনার খনি। অথবা, একটা সোনার খনি অন্যটা রূপোর। ভদ্রমহিলার শখ ছবি কেনা। একটি ঘরে আছে পিকাসো ব্রাক, রেমব্রান্ট, রুশো, ক্যানডিনসকি, মদিপ্লিয়ানি, দেগা–এঁদের আঁকা আসল ছবি। অর্থাৎ সেই ঘরখানির মূল্য কয়েক কোটি টাকা। অন্য ঘরে আছে তরুণ জীবিত শিল্পীদের ছবি অধিকাংশই অখ্যাত, নানান একজিবিশনে ঘুরে তিনি প্রতি সপ্তাহে একখানি করে ওই রকম পছন্দ মতন ছবি কেনেন, তাঁর ধারণা এদের মধ্যে কেউ না কেউ পরে বিখ্যাত হবেই। নতুন শিল্পীর ছবির জন্য তাঁর দাম ঠিক করাও আছে, প্রতিটি ছবি পঞ্চাশ হাজার ডলার। সুতরাং ওই মহিলার কৃপা পাবার জন্য সারা আমেরিকার শিল্পীরা লালায়িত।

আর একটি বিধবাকে চিনতাম, যিনি একটি বিখ্যাত জামা কাপড়ের চেইন স্টোরসের মালিকানী। তাঁর বাতিক রেকর্ড সংগ্রহ। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে আমেরিকা তো বটেই, গায়ক-সঙ্গীত শিল্পীদের তিনি বাড়িতে ডেকে এনে, তাঁর টেপ রেকর্ডারে তাঁদের সঙ্গীত তুলে রাখেন। শুনেছি, পন্ডিত রবিশঙ্করও একবার সে বাড়িতে গিয়েছিলেন। এ বাবদে তিনি এ পর্যন্ত ব্যয় করেছেন সাড়ে তিন কোটি টাকা। মহিলার গর্ব, আইনস্টাইনেরও বেহালা বাজাবার রেকর্ড আছে তাঁর বাড়িতে।

এরকম মহিলা আমি আরও অনেক দেখেছি। অনেক ছোটখাটো শহরেও, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়তো ছাত্র-ছাত্রীদের অভিনয় করার আলাদা হল নেই, কোনও সহৃদয় বিধবা সঙ্গে-সঙ্গে সমস্ত নির্মাণ ব্যয়টা চাঁদা দিয়ে দিলেন। এ ছাড়া হাজার রকম সমিতি গড়াও এদের ব্যসন। অনেক সেবা বা উন্নয়নমূলক কাজেও ওঁরা অংশগ্রহণ করেন, যেমন বিকলাঙ্গ শিশুদের সেবা, অনাথআশ্রম কিংবা বিদেশিদের আতিথ্য দেওয়া। হায়! আমাদের দেশের এরকম কোনও ধনী বিধবার সঙ্গে আজও আমার পরিচয় হল না।