০৫. ধীরেনদা রিনাদি

ধীরেনদা, রিনাদিরও কাকাবাবুকে দেখে যেমন চমকে উঠলেন, তেমনই খুশি হলেন।

মিংমাও আংকল সাব বলে লম্বা একটা সেলাম দিল।

কাকাবাবু অবশ্য আমাদের দেখে একটুও অবাক হলেন না। বরং তাঁর মুখে একটা রাগ-রাগ ভাব। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, মিংমা, তুমহারা কানসে খুন গিরতা। কেয়া হুয়া?

এবার দীপ্তর বদলে আমিই সবিস্তারে ঘটনাটা জানালুম।

কাকাবাবু এতেও বিচলিত হলেন না। শুধু বললেন, হুঁ। তারপর পকেট থেকে রুমাল বার করে মিংমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, মুছে ফেলো! আর ঐ যে গাঁদা ফুলের গাছ দেখছ, ওর কয়েকটা পাতা হাত দিয়ে চিপে সেই রসটা কাটা জায়গায় লাগিয়ে দাও!

ধীরেনদা বললেন, কাকাবাবু, আপনি ভূপালে এসেছেন, সেটা আমাদের বিরাট সৌভাগ্য। কিন্তু-আপনি এ জায়গায় কী করে রাস্তা চিনে এলেন? আপনি ভীমবেঠকার কথা আগে জানতেন?

কাকাবাবু কোনও উত্তর দেবার আগেই আশ্রমের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক সাধু। গেরুয়া কাপড় পরা, রোগা লম্বা চেহারা, থুতনিতে একটু-একটু দাড়ি, মাথায় চুলও কম।

কাকাবাবু বললেন, নমস্তে, সাধুজি! আচ্ছা হ্যায় তো?

সাধুজি চোখ কুঁচকে কাকাবাবুকে ভাল করে দেখে তারপর বললেন, কওন? আরে, ইয়ে তো রায়চৌধুরীবাবু! রাম, রাম! ভগবান আপকা ভাল করে

বুঝলুম, কাকাবাবু যে শুধু ভীমবেঠকার কথা আগে থেকে শুনেছেন তাই নয়। তিনি এখানকার সাধুজিকেও চেনেন!

আরও দু একটা কথা বলার পর কাকাবাবু সাধুজিকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, সাধুজি, আপনার এখানে কোনও পাগল-টাগল ঘুরে বেড়ায়? এরা একজনকে দেখেছে বলল–

সাধুজি হিন্দিতে বললেন, হা, পাগল তো এক আমিই আছি। আর কোন পাগল এখানে থাকবে?

একটু থেমে সাধুজি আবার বললেন, তবে কী জানেন, রায়চৌধুরীবাবু, রাত্তিরের দিকে কারা যেন এখানে আসে! আমি শব্দ পাই। আগে, জানেন তো, ভূত-প্রেতের ভয়ে সাঁঝের পর এখানে মানুষজন আসত না। কাছাকাছি গাঁয়ের লোক তো এ-জায়গার নাম শুনলেই ভয় পায়। আমি ভূতপ্ৰেত মানি না। আমি জানি ওসব কিছু নেই। কিন্তু এখন রাত্তিরে কারা আসে তা আমি জানি না?

কাকাবাবু বললেন, হুঁ, আমিও তাই ভেবেছিলুম।

উঠে দাঁড়িয়ে ক্রাচ্‌ বগলে নিয়ে কাকাবাবু বললেন, সাধুজি, আমি একটু পরে ঘুরে আসছি। আপনার সঙ্গে অনেক কথা আছে।

তারপর আমাদের দিকে চেয়ে বললেন, চলো?

ধীরেনদা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কখন পৌঁছলেন ভূপালে?

কাকাবাবু হাঁটতে হাঁটতে বললেন, এই, এগারোটার সময়। রুমি বলল, যে, সন্তুরা সবাই ভীমবেঠকায় গেছে। তাই আমিও একটা গাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে এলুম।

রিনাদি বললেন, তা হলে তো আপনার খাওয়া-দাওয়া হয়নি। আমাদের সঙ্গে খাবার আছে, আসুন আমরা খেয়ে নিই।

কাকাবাবু বললেন, বেশ তো!

গাড়ি থেকে আমরা টিফিন কেরিয়ারগুলো আর জলের বোতল নামিয়ে নিলুম। তারপর গিয়ে বসলুম একটা বিরাট পাথরের ছায়ায়।

রিনাদি যে কতরকম খাবার এনেছেন তার ঠিক নেই। হ্যাম স্যাণ্ডুইচ, সসেজ, স্যালামি, চিকেন রোস্ট, রাশিয়ান স্যালাড, আরও কত কী!

খাওয়া শুরু করার পর আমি জিজ্ঞেস করলুম, কাকাবাবু আপনি হঠাৎ ভূপালে এলেন কেন? তখন না বলেছিলেন–

কাকাবাবু বললেন, আসতে হল বাধ্য হয়ে। ঐ যে নিপু, ও একটা গাধা! কলকাতায় গিয়ে বারবার বলছিল, ভুপালে তিনটে খুন হয়েছে! খুনি ধরা কি আমার কাজ? কিন্তু নিপু একবারও বলেনি, যে তিনজন খুন হয়েছেন, তাঁরা তিনজনই পরস্পরকে চিনতেন, তিনজনেই গবেষণা করতেন ইতিহাস নিয়ে।

ধীরেনদা বললেন, হ্যাঁ, অৰ্জ্জুন শ্ৰীবাস্তবকে সব সময় ইতিহাসের বইই পড়তে দেখেছি।

কাকাবাবু বললেন, অৰ্জ্জুন শ্ৰীবাস্তব, সুন্দরলাল বাজপেয়ী, মনোমোহন ঋ-এরা তিনজনেই ইতিহাসের নাম-করা পণ্ডিত। সুন্দরলাল বাজপেয়ীর সঙ্গে আমার ভাল পরিচয় ছিল, একবার ভুপালে এসে আমি সুন্দরলালের বাড়িতে অতিথি হয়েছিলাম।

রিনাদি বললেন, তা হলে তো ডক্টর চিরঞ্জীব শাকসেনাও…

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, ঐতিহাসিক হিসেবে ওঁর ভারতজোড়া নাম। চিরঞ্জীব আমার বিশেষ বন্ধু। একবার আফগানিস্তানে আমরা দুজনে একসঙ্গে এক্সকাভেশানে গিয়েছিলাম। সেবারেই একটা দুর্ঘটনায় আমার একটা পা নষ্ট হয়ে যায়।

ধীরেনদা বললেন, ডক্টর চিরঞ্জীব শাকসেনা নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন শুনেই আপনি ভুপালে এসেছেন তা হলে?

কাকাবাবু বললেন, অৰ্জ্জুন শ্ৰীবাস্তব, সুন্দরলাল বাজপেয়ী আর মনোমোহন ঝাঁ-র মৃত্যুর খবর কলকাতার কাগজে বেরোয়নি। নিপু যদি এঁদের নাম বলত, তা হলে আমি তখুনি বুঝতে পারতুম। যাই হোক, চিরঞ্জীব শাকসেনার উধাও হয়ে যাবার খবর সব কাগজেই বেরিয়েছে। সেইসঙ্গে আগের তিনটে খুনের খবর। তখনই আমি বুঝতে পারলুম, এগুলো সাধারণ খুন নয়। কেউ একজন বেছে-বেছে ঐতিহাসিকদের মারছে কেন? এর মধ্যে কোনও যোগসূত্র আছে। এদের সরিয়ে দেওয়ায় কার কী স্বার্থ থাকতে পারে, সেটাই আগে দেখা দরকার। সেইজন্যই আমি এসেছি।

ধীরেনদা বললেন, আশ্চর্য! বেছে-বেছে শুধু ইতিহাসের পণ্ডিতদের মেরে কার কী লাভ? কেউ কি কোনও ইতিহাস মুছে দিতে চায়?

কাকাবাবু বললেন, সেই জন্যই রুমির কাছে শোনামাত্র চলে এলুম এখানে। মনে হল, তোমাদের এখানে কোনও বিপদ হতে পারে।

আমি আর ধীরেনদা দু জনেই একসঙ্গে বলে উঠলুম, এখানে, কেন?

কাকাবাবু বললেন, ছোটখাটো একটা বিপদ যে ঘটেই গেছে, তা তো দেখাই যাচ্ছে!

তারপর মিংমার দিকে চেয়ে গম্ভীরভাবে বললেন, মিংমা, তুমি চিন্তা কোরো না। তোমায় যে আঘাত করেছে, তাকে শাস্তি পেতেই হবে। আমার হাত থেকে সে কিছুতেই ছাড়া পাবে না।

মিংমা বলল, ও আদমি আভিতক ইধার উদ্ধার হ্যায়?

কাকাবাবু বললেন, রায়নে দেও। ধরা সে পড়বেই।

রিনাদি বললেন, তোমরা কাকাবাবুকে পাঁচমারির ঘটনোটা বলো?

ধীরেনদা তখন ডঃ চিরঞ্জীব শাকসেনার ভাই বিজয় শাকসেনার সঙ্গে পাঁচমারিতে দেখা হয়ে যাওয়া এবং তারপরের ঘটনা জানালেন কাকাবাবুকে।

কাকাবাবু একটুক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর অনেকটা আপন মনেই বললেন, তিনজন খুন হয়েছে, আর একজন নিরুদ্দেশ, প্রত্যেকেই ইতিহাসের পণ্ডিত। এমনও হতে পারে, ইতিহাসের কোনও একটা বিষয় নিয়েই এরা চারজন গবেষণা করছিলেন। চিরঞ্জীব শাকসেনা এই ভীমবেঠক নিয়ে একটা প্ৰবন্ধ লিখেছেন গত মাসে। সেইজন্য আমার সন্দেহ হচ্ছে, সমস্ত রহস্য আছে এই ভীমবেঠক পাহাড়ের গুহাগুলোর মধ্যেই। খাওয়া শেষ তো, এবার ওঠা যাক, অনেক কাজ বাকি আছে। ধীরেনবাবু, আপনার ওপর দুএকটা দায়িত্ব দেব।

ধীরেনদা বললেন, আমাকে বাবু আর আপনি বলবেন না। শুধু ধীরেন বলুন।

কাকাবাবু বললেন, বেশ তো ধীরেন, তুমি এখন মিংমাকে কোনও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও, ওর চোটের জায়গায় ওষুধ লাগিয়ে দেবে। তারপর ফোলডিং

খাট কোথায় ভাড়া পাওয়া যায়, সেরকম দুটো খাটও জোগাড় করা দরকার।

আজ সন্ধের পর থেকে মিংমা আর আমি এখানে থাকব।

ধীরেনদা অবাক হয়ে বললেন, এখানে থাকবেন? রাত্তিরবেলা?

হ্যাঁ। আমি আগেও তো এখানে থেকেছি। ১৯৫৮ সালে এই গুহাগুলো আবিষ্কার হবার ঠিক পরের বছরই চিরঞ্জীব আর আমি এখানে এসে দু রাত্তির ছিলাম। তখন গুহাগুলোর মার্কিং হচ্ছিল।

আমি বললুম, তাহলে তিনটে খাট লাগবে। আমিও থাকব।

ধীরেনদা রিনাদির দিকে চেয়ে বললেন, তুমি যদি বাচ্চাদের নিয়ে বাড়ি সামলাতে পারো, তা হলে আমিও কাকাবাবুর সঙ্গে এখানে থেকে যাই। যদি কাকাবাবুর সঙ্গে নতুন অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গী হতে পারি-

রিনাদি বললেন, সে তোমার ইচ্ছে হলে থাকো না! আমি বাড়িতে ঠিক ম্যানেজ করতে পারব।

কাকাবাবু বললেন, অত লোক থাকলে কোনও লাভ হবে না। ধীরেন তোমাকে শহরে থেকেই কিছু কাজ করতে হবে। সন্তুরও থাকবার দরকার নেই। মিংমা তো থাকছেই। আমার সঙ্গে।

মিংমা বলল, নেহি, সন্তু সাবভি রহেগা। আচ্ছা হোগা!

কাকাবাবু বললেন, তবে তাই হোক। চলো, এখন আমাকেও একবার শহরে যেতে হবে। কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে, কিছু কেনাকাটাও আছে।

কাকাবাবু যে গাড়িটা এনেছিলেন, সেটা এখনও রয়েছে। মিংমা ধীরেনদাদের গাড়িতে উঠল, আমি রইলুম কাকাবাবুর সঙ্গে সঙ্গে। ঠিক হল যে, বিকেল পাঁচটার সময় আমরা ধীরেনদার বাড়িতে আবার মীট করব।

গাড়িতে ওঠার সময় কাকাবাবু বললেন, ধীরেন, তোমরা একটু সাবধানে থেকে। হঠাৎ কোনও বিপদ হতে পারে। রাত্তিরবেলা বাড়ির দরজা-জানলা সব ভালভাবে বন্ধ করে রাখবে।

ধীরেনদা হেসে বললেন, বারে! আমরা থাকব নিজেদের বাড়িতে, আর আপনারা থাকবেন পাহাড়ের ওপর খোলা জায়গায়। আপনি আমাদের বলছেন সাবধানে থাকতে?

আমাদের তো অভ্যোস আছে। আমরা আগে থেকে বিপদের গন্ধ পাই। কিন্তু তোমরা যে আজ ভীমবেঠকায় এসেছ, আমার সঙ্গে তোমাদের যোগাযোগ আছে, এতে তোমাদের ওপর শত্রুপক্ষের নজর পড়তে পারে। যতদূর বোঝা যাচ্ছে, কোনও সাঙ্ঘাতিক নিষ্ঠুর আর ভয়ঙ্কর দল এর পেছনে আছে। যারা এইরকম বীভৎসভাবে খুন করতে পারে—

আপনারা এখানে কদিন থাকবেন? তার কোনও ঠিক নেই। এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।

তা হলে আমি কিন্তু একটা রাত অন্তত আপনাদের সঙ্গে এখানে কটাব।

আচ্ছা সে দেখা যাবে। তা হলে বিকেল পাঁচটায়?

দুটো গাড়িই ছাড়ল একসঙ্গে। কাকাবাবু কয়েকটা জায়গায় থামলেন। আমাকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে উনি যেন কার কার সঙ্গে দেখা করে এলেন। দেখা যাচ্ছে কাকাবাবু ভুপালের অনেককেই চেনেন।

তারপর আর-একটা বাড়ির সামনে এসে বললেন, সন্তু এবার তুই চল আমার সঙ্গে।

সেই বাড়ির গেটের পাশে নেম প্লেটে লেখা। ডঃ চিরঞ্জীব শাকসেনার নাম।

বেশ বড় তিনতলা বাড়ি, সামনে-পেছনে অনেকখানি বাগান। বড়-বড় ইউক্যালিপটাস গাছ রয়েছে সেই বাগানে। কয়েকটা পাথরের মূর্তিও দেখতে পেলাম। এক জায়গায় একটা বেঞ্চে বসে আছে দুজন বন্দুকধারী পুলিশ।

এত বড় বাড়িটা কিন্তু একদম চুপচাপ। কোনও লোকজনের শব্দ নেই। আমরা গেট ঠেলে ঢুকতেই একজন পুলিশ এগিয়ে এল আমাদের দিকে।

কাকাবাবু জানালেন, যে তিনি ডক্টর শাকসেনার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চান।

পুলিশটি বলল যে, তিনি কারুর সঙ্গেই দেখা করছেন না। খবরের কাগজ থেকে অনেক লোক এসেছিল, সবাই ফিরে গেছে। ডক্টর চিরঞ্জীব শাকসেনা নিরুদ্দেশ হয়েছেন প্রায় আটদিন আগে, এই কদিনে তাঁর স্ত্রী একবারও তিনতলা থেকে নীচে নামেননি।

কাকাবাবু নিজের একটা কার্ড দিয়ে বললেন, এটা ভেতরে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন। উনি আমার সঙ্গে ঠিকই দেখা করবেন।

একটু বাদেই বাড়ির ভেতর থেকে বুড়োমতন একজন লোক বেরিয়ে এসে আমাদের ডেকে বলল, আপলোগ আইয়ে।

চিরঞ্জীব শাকসেনার স্ত্রীর বয়েস পঞ্চাশের কাছাকাছি। গায়ের রং একদম মেমসাহেবের মতন। একটা চওড়া হলুদপাড় সাদা শাড়ি পরে আছেন। এর মুখে পরিষ্কার বাংলা শুনে আমি চমকে উঠেছিলুম। পরে জানলুম, ইনি গুজরাটের মেয়ে হলেও একটানা আট বছর ছিলেন শান্তিনিকেতনে।

বসবার ঘরে ঢুকেই উনি কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, এ কী, আপনি কবে এসেছেন?

কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বসুন, ভাবিজি, বসুন। আজই এসেছি, দাদার খবরটা শুনেই চলে এলুম। ব্যাপারটা ঠিক কী হয়েছিল বলুন তো

ভদ্রমহিলা বেশ শক্ত আছেন, শোকে-দুঃখে ভেঙে পড়েননি। এই আট দিনের মধ্যেও যে চিরঞ্জীব শাকসেনার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি, এক হিসেবে সেটাই ভাল খবর। তার মানে ওঁকে এখনও মেরে ফেলা হয়নি। কোনও এক জায়গায় আটকে রাখা হয়েছে নিশ্চয়ই।

উনি বললেন, আমি নিজেই কিছু বুঝতে পারছি না তো আপনাকে কী বলব। উনি আগের দিন বিদেশ থেকে ফিরলেন, খুব ক্লান্ত ছিলেন, ভাল করে কথাই বলতে পারিনি-পরদিন থেকেই নিখোঁজ। কখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন, কার সঙ্গে গেলেন, কিছুই জানি না।

এর মধ্যে অন্য কেউ কোনও চিঠি বা খবর পাঠায়নি?

না। এই ছেলেটি কে?

ও আমার ভাইপো, ওর নাম সন্তু। আচ্ছা ভাবিজি, একটা কথা মনে করে বলুন তো, অৰ্জ্জুন শ্ৰীবাস্তব, মনোমোহন ঝাঁ। আর সুন্দরলাল বাজপেয়ী—এঁরা শেষ কবে আপনার বাড়িতে এসেছিলেন? এদের আপনি চেনেন নিশ্চয়ই?

হাঁ চিনি। এরা তো প্রায়ই আসতেন।

শেষ কবে এসেছিলেন?

দাঁড়ান, দাঁড়ান, ভেবে দেখি, হ্যাঁ, উনি বিদেশ যাবার ঠিক আগের সন্ধেবেলাতেই তো এসেছিলেন সবাই। আরও অনেকে এসেছিলেন, কিন্তু ওঁরা ছিলেন অনেক রাত পর্যন্ত।

কী কথা হয়েছিল বলতে পারেন?

তা তো জানি না। ওঁরা তো প্রায়ই দরজা বন্ধ করে কী সব আলোচনা করতেন। সেদিন ওঁরা চার-পাঁচজন মিলে খুব চিল্লাচিল্লি করেছিলেন বটে।

চার-পাঁচজন? ঠিক কজন ছিলেন?

তা তো জোর দিয়ে বলতে পারব না। তবে ওরা সবাই তো খুব চায়ের ভক্ত, কয়েকবার করে চা পাঠাতে হয়েছে। প্ৰত্যেকবার পাঁচ কাপ করে।

তার মানে অন্তত পাঁচজন। আমরা চারজনের হিসেব পাচ্ছি, আর একজন কে?

তা জানি না। ওরা চারজনই বেশি আলোচনা করতেন, হয়তো সেদিন আরও কেউ একজন ছিলেন। অনেকেই তো আসতেন নানা কাজে।

চিরঞ্জীবদাদা বিদেশে থাকার সময় ওঁর যে তিনজন বন্ধু এখানে খুন হয়েছেন, সে-কথা উনি জেনেছিলেন?

যেদিন ফিরলেন, সেদিনই আমি বলিনি। ভেবেছিলাম কী, পরে এক সময় বলব। আসার সঙ্গে-সঙ্গেই এমন একটা আঘাত-

অন্য কেউ বলে দিতে পারে?

আমি বিজয়কেও নিষেধ করে দিয়েছিলাম।

হ্যাঁ, ভাল কথা। ভাবিজি, বিজয়ের কোনও খোঁজ পাওয়া গেছে?

সে তো হোসাঙ্গাবাদ হাসপাতালে আছে। পাঁচমারিতে ডাকাতরা তাকে গুলি করেছিল। তবে জখম বেশি হয়নি, দু চারদিনের মধ্যে ফিরে আসবে।

চিরঞ্জীবদাদার যে একজন খুব বিশ্বাসী লোক ছিল, সব সময় সঙ্গে থাকত, কী নাম যেন-ও হ্যাঁ, ভিখুসিং, সে কোথায়?

উনি বিদেশে যাবার সময় যে ছুটি নিয়ে নিজের বাড়ি গিয়েছিল। ওর বাড়ি বিলাসপুর। এতদিনে তার ফিরে আসার কথা। কিন্তু সে আসেনি।

হুঁ! ঠিক আছে, ভাবিজি, আমরা এবার যাব। বেশি চিন্তা করবেন না। আজ বা কাল যদি দৈবাৎ চিরঞ্জীবদাদা ফিরে আসেন, তবে বলবেন যে, আমি ভীমবেঠ্‌কায় আছি।

এতক্ষণ বাদে চমকে উঠলেন চিরঞ্জীব শাকসেনার স্ত্রী বীণা দেবী। তিনি বললেন, ভীমবেঠকায়? কেন? আপনি ওখানে থাকবেন?

হ্যাঁ।

কেন? ভীমবেঠকায় তো থাকার জায়গা নেই, রাত্তিরবেলা কোনও বিপদ হতে পারে-মানে, আপনার দু পা ঠিক নেই।না, না, ও-কাজ করবেন না।

ভাবিজি, কিছুদিন ধরে চিরঞ্জীবদাদা ঐ ভীমবেঠক নিয়ে খুব চিন্তা করছিলেন, তাই না?

হ্যাঁ। ওখানে যে ব্ৰাহ্মী লিপি আছে, তার নাকি পাঠোদ্ধার অনেকখানি করেছেন, এরকম তো শুনছিলাম।

অনেকখানি করেছেন? পুরোটা পারেননি?

সেই রকমই তো জানি।

বুঝলাম। এবার তা হলে আমরা উঠি।

বীণাদেবী ব্যাকুলভাবে বললেন, আপনি রাতে ঐ নিরালা জায়গায় থাকবেন এটা আমার মনে ভাল লাগছে না। দিনকাল ভাল না, কখন কী হয়…।

কাকাবাবু হেসে বললেন, আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আমার সঙ্গে অন্য আরও লোক থাকবে। তা ছাড়া আমি তো চিরঞ্জীবদাদার মতন ভালমানুষ নই, আমার সঙ্গে রিভলভার থাকে।

বীণাদেবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা চলে এলুম ধীরেনদার বাড়িতে।

মীংমাকে ডাক্তার ইঞ্জেকশান আর ওষুধ দিয়েছেন। একটা ব্যাণ্ডেজও বেঁধে দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা খুলে ফেলেছে মিংমা। ও বলেছে, ব্যাণ্ডেজের কোনও দরকার নেই।

সে-কথা শুনে কাকাবাবু বললেন, ও ঠিক আছে।

তিনখানা ফোলডিং-খাট, কম্বল, নানারকম খাবার-দাবার গুছিয়ে রাখা হয়েছে। এর মধ্যেই। ছোড়দিরাও এখানে এসে জড়ো হয়েছে। আমরা তিনজন ভীমবেঠক পাহাড়ে থাকব। শুনে ধীরেন।দার মতন নিপুদা আর রত্নেশদা যেতে চাইল সঙ্গে। কিন্তু কাকাবাবু আর কারুকে নেবেন না।

ছোড়দি আমায় কিছুতেই যেতে দিতে চায় না। কাকাবাবুকে তো আর কেউ ফেরাতে পারবে না। কিন্তু ভূপালে এসে আমার যদি কোনও বিপদ হয়, তবে সেটা যেন ছোড়দিরই দায়িত্ব।

আমি গম্ভীরভাবে বললুম, বাবা আমায় কী বলে দিয়েছেন জানিস না? কাকাবাবু যখন যেখানে থাকবেন, সব সময় আমাকে ওঁর সঙ্গে থাকতে হবে।

আর দেরি করলে পাহাড়ে উঠতে বেশি রাত হয়ে যাবে। সেইজন্য কাকাবাবু বললেন, চলো, এবার বেরিয়ে পড়া যাক।

ধীরেনদা বললেন, কিন্তু আপনাদের খবর পাব কী করে? কাল সকালে কি আমরা কেউ যাব?

কাকাবাবু বললেন, না, তোমাদের যাবার দরকার নেই। আমরা দুদিনের মতন খাবারদাবার সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। তার মধ্যে যদি না ফিরি, তা হলে একজন কেউ কিছু খাবার পৌঁছে দিয়ে এসো।

কিন্তু আপনার ভাড়া-করা গাড়িটা তো ওখানে দুদিন থাকবে না, পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসবে। হঠাৎ যদি আপনাদের ভুপালে আসার দরকার হয়, তা হলে আসবেন কী করে?

সে-ব্যবস্থা হয়ে যাবে ঠিকই, তোমাদের যাতে বেশি চিন্তা না হয়, সেই জন্য এটা তোমাদের দেখিয়ে রাখছি।

কাকাবাবু তাঁর কিট ব্যাগ খুলে রেডিওর মতন যন্ত্র দেখালেন। ওটা একটা শক্তিশালী ওয়্যারলেস ট্রান্সমিশন সেট। বহু দূরে খবর পাঠানো যায়।

আমি জানি, কাকাবাবু কলকাতার বাইরে কোথাও গেলেই ঐ যন্ত্রটা সব সময় সঙ্গে রাখেন।

মিংমা আর আমি ড্রাইভারের পাশে বসলুম। কাকাবাবু পেছনের সীটে আরাম করে হেলান দিয়ে বসে বললেন, পৌঁছতে অন্তত দেড়-দু ঘণ্টা লাগবে, ততক্ষণ আমি একটু ঘুমিয়ে নিই।