[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

০৫. কিছুই মেলে না

কিছুই মেলে না, না রে? পায়ের নীচে এই তো সত্যি-সত্যি প্যারিস। সামনে স্যেন নদী, ওই যে নতরদাম গিরজা–এসব সত্যি, যেমন তুই আমার সামনে বসে আছিস, আমি এই যে পা দোলাচ্ছি–এসব সত্যি। অথচ যা ভেবেছিলুম, তা কি মিলেছে? সত্যি করে বল।

আমি বললুম, রেণু, তুই বোধহয় এবার কেঁদে ফেলবি? অমন গলা ভারী করে বলছিস কেন? রেণু স্থির চোখে আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। পুব হাওয়ায় ফুরফুরিয়ে উড়ছে ওর চূর্ণ চুল, সবুজ রঙা শাড়ির সঙ্গে মেলানো পান্নার দুল দুটো চিকিচিকিয়ে উঠছে মাঝে-মাঝে, ডান হাতের তর্জনী চিবুকে ছোঁয়ানো, রেণু উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ রেণু ভঙ্গি বদলাল, মুখখানা ভেংচে বলল, তাই আয় না, দু’জনে মিলে ছেলেবেলার মতন ভেউ ভেউ করে কান্না শুরু করে দিই। তুই তো জন্ম হিঁচকাঁদুনে, একবার বললেই হল, চোখ দিয়ে গঙ্গা বইবে!

–বাজে কথা বলিস না।

–বাজে কথা? মনে নেই, ছোট কাকার পকেট থেকে সিকি চুরি করেছিলি, ধরা পড়ে মার খাওয়ার আগেই কেঁদে ভাসালি?

–পয়সা চুরি করেছিলুম?কী মিথ্যাবাদী তুই রেণু?

–আহা-হা, এখন কোট-টাই পরে সাহেব সেজেছিস–তাই স্বীকার করতে লজ্জা! পয়সা কি তুই মোটে একবার চুরি করেছিলি? আমার পুতুলের বাক্সে ছ’আনা জমিয়েছিলাম–তা কে চুরি করেছিল? আমার সব মনে আছে!

–ভারী তো ছ’আনা পয়সা। নে, তোকে পাঁচ ফ্র্যাংক দিয়ে দিচ্ছি এখন। সুদে-আসলে সব শোধ হয়ে যাবে।

রেণু খিলখিল করে হেসে উঠল। দুষ্টুমি-ভরা উদ্ভাসিত মুখে বলল, ভারী টাকা দেখানো হচ্ছে এখন। ছেলেবেলায় ছ’আনা বড় হলে এক হাজার টাকা দিলেও শোধ হয় না। তখন কাচপুঁতির মালা কিনতে পারিনি, সে দুঃখ আমার এখন ঘুচবে?

–তখন কাচপুঁতির মালা কিনতে পারিসনি বলেই তো সে-কথা তোর এখনও মনে আছে!

–আমার সব মনে আছে।

–সব? সেই তোর জ্যাঠামশাইয়ের পিকচার পোস্টকার্ড…

রেণু আর আমি প্যারিসের নদীপাড়ে হেমন্তসন্ধ্যায় বসে বসে শৈশব স্মৃতি মেলাতে লাগলুম। কলকাতার ভবানীপুর থেকে প্যারিস কত দূর, তার চেয়েও অনেক দূরে রেণুকে আমি ফেলে এসেছিলাম।

গত দশ বছরে বোধহয় রেণুর কথা আমার একবারও মনে পড়েনি। তারও আগে রেণু নামে অন্য মেয়ের সঙ্গেও আমার ভাব হয়েছিল। হাজারিবাগে গিয়ে সুজিতের বোন রেণুর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, বিকেলবেলা ব্যাডমিন্টন খেলায় সে হত আমার জুটি, তারপর একদিন ক্যানারি হিলস-এ বেড়াতে গিয়ে আমরা ইচ্ছে করে হারিয়ে গিয়েছিলাম, কালকাসুন্দি ঝোঁপের আড়ালে গিয়ে আমি তাকে চুমু খেয়েছিলাম। জীবনে সেই প্রথম। ক্ষুরিত ওষ্ঠাধরে সুজিতের বোন রেণু আমার দিকে বিস্ময় বিহুল চোখে তাকিয়েছিল। আমি অতীব লজ্জা পেয়ে কিছুটা কথা বলার জন্যই বোকার মতন বলেছিলাম, জানো, আমি রেণু নামে আর একটা মেয়েকে চিনতাম। সে তখন ঈষৎ আলোছায়ায় সরে গিয়ে বলেছিল, সে বুঝি দেখতে খুব সুন্দর ছিল! তাকে বুঝি তুমি…? আমি তাড়াতাড়ি উত্তর দিয়েছিলাম, না, না, সে একটা কেলটি রোগা মেয়ে, কানভরতি পুঁজ…শুধু নামের মিল…

এক মেয়ের সামনে যে অন্য মেয়ের প্রশংসা করতে নেই, সেটা সেই সদ্য কৈশোর-উত্তীর্ণ বয়সেই আপনা-আপনি জেনে গিয়েছিলাম। কিন্তু খুব বেশি মিথ্যে কথাও তো বলতে হয়নি। আজ আমার সামনে যে বসে আছে, এই আঁটো শরীরের যুবতী, নারকোল পাতার মতন ঝকঝকে কালচে-নীল রং, চোখেমুখে বিচ্ছুরিত আলো–এই সেই ভবানীপুরের রেণু!

মহিম হালদার স্ট্রিটের এক পুরোনো বাড়িতে আমরা পাশাপাশি ভাড়াটে থাকতাম। রেণুর বাবা পোস্ট অফিসে কাজ করতেন, ওরা সাত ভাই-বোন ছিল, জিরজিরে নড়বড়ে সংসার। এতদিনে আর একটা পোস্ট অফিসের কেরানি কিংবা কোর্টের মুহুরির সঙ্গে বিয়ে হয়ে রেণুরও চার-পাঁচ সন্তান বিইয়ে চেতলা কিংবা উলটোডাঙ্গায় সংসার পেতে বসার কথা ছিল। তার বদলে, রেণু অনর্গল ইংরেজি আর ফরাসি বলছে, ছুটি কাটাতে যায় সুইজারল্যান্ডে, নামের আগে ডক্টরেটের শোভা বা বোমা। জীবনে কিছুই মেলে না।

রেণু কিন্তু কিছুই মেলে না বলছে অন্য মানে ভেবে। এক হিসেবে ওর সবই ঠিকঠাক মিলে গেছে। রেণু আর আমি ছিলাম একেবারে সমান বয়সি। সাত বছর বয়েস থেকে বারো বছর পর্যন্ত আমরা একবাড়িতে পাশাপাশি ছিলাম। রেণু আর আমি এক ক্লাসে পড়তুম। রেণুর স্বভাব ছিল অনেকটা ছেলেদের মতন, কালো-রোগা চেহারা, প্রায়ই কানে পুঁজ হত, দশ-এগারো বছর বয়সে রেণুর মাথায় উকুন হয়েছিল বলে ওর মা ওকে ন্যাড়া করে দিয়েছিলেন। ছোট ছোট চুল, রেণু তখন অবিকল ছেলেদের মতন, তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে ছোটাছুটি করত, আমি যখন ঘুড়ি ওড়াতুম, তখন লাটাই ধরত রেণু। সুতো মাঞ্জা দেওয়ার সময় ওকে দিয়ে হামানদিস্তেয় কাঁচ গুঁড়ো করাতুম। পাড়ার লাইব্রেরি থেকে আমি কাঞ্চনজঙ্ঘা সিরিজের বই এনে ওকেও পড়তে দিতুম বলে রেণু আমাকে ওর মায়ের কুলের আচার চুরি করে এনে খাওয়াত। রেণুর সঙ্গে ওরকম বন্ধুত্ব ছিল বলেই মেয়েদের সম্পর্কে কোনও আলাদা কৌতূহল তখনও জাগেনি। আমি আর একটা মেয়ে যে কীসে আলাদা–তা বুঝিনি। হাফ প্যান্ট কিংবা ফ্রকের রহস্যের কথা মনে আসেনি। ছাতের ঘরে রেণু আর আমি বারো বছরের দুই কিশোর-কিশোরী যখন পাশাপাশি শুয়ে বই পড়তুম–তখন কখনও আমার ইচ্ছে হয়নি রেণুর জামার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিই। চুমু খাওয়ার ব্যাপার তো জানতুমই না।

কিন্তু, সেই ভবানীপুরের এঁদো বাড়ির গুমোট সংসারে মাঝেমাঝে বিলেতের হাওয়া আসত। রেণুর এক জ্যাঠামশাই বহুঁকাল ধরে ইংল্যান্ডে প্রবাসী। কবে যেন ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলেন, আর ফেরেননি, কোনওদিন ফিরবেনও না। তিনি মাঝেমাঝে ওদের উপহার পাঠাতেন। কী সুন্দর সব প্যাকেট আসত, রেণুদের ভাইবোনদের জন্য চমৎকার রঙিন সোয়েটার আর জামা। রেণুদের সেইরকম প্যাকেট এলে হিংসেয় আমার বুক জ্বলে যেত! আর আসত ছবির পোস্টকার্ড। রেণুর জ্যাঠামশাই ফ্রান্স, ডেনমারক, হল্যান্ড বেড়াতে গেলে সেইসব জায়গা থেকে ছবির পোস্টকার্ডে ওদের চিঠি পাঠাতেন।

আমাদের পরিবারে কেউ কখনও বিলেত যাওয়া তো দূরের কথা, বাংলাদেশের বাইরেও আমাদের কোনও আত্মীয়-স্বজন ছিল না। আমরা কখনও ওরকম চিঠি পাইনি। রেণু এই এক ব্যাপারে আমায় টেক্কা দিত। আলতোভাবে পিকচার পোস্টকার্ডগুলো ধরে আমাকে দেখাত, আমি হাত দিতে গেলে বলত, এই, এই, ওরকম ভাবে ধরে না, বাবা বলেছেন, ছবির মাঝখানে আঙুল লাগলে ছবি খারাপ হয়ে যায়। আমি তখন রেগে বলতুম যা যা, দেখতে চাই না, ভারী তো ছবি!

রেণু বলত, জানিস, আমিও একদিন বিলেতে যাব! ইজেরের দড়ি ছিঁড়ে গেছে বলে বাঁ-হাত দিয়ে ইজেরটা চেপে ধরা ঢলঢলে ফ্রকটা কাঁধ থেকে বারবার নেমে যাচ্ছে, কদম ছাঁটা চুল, নাক দিয়ে ফ্যাৎ-ফ্যাৎ করে শিকনি টানছে একটা কালো কুচ্ছিৎ মেয়ে–সে বিলেতে যাবে! আমি হি হি, ইল্লি আর টকের আলু, অত খায় না।

রেণু বলত, হ্যাঁ, দ্যাখ না, জেঠু লিখেছেন, আমি ভালো করে লেখাপড়া করলে আমাকেও বিলেত নিয়ে যাবেন। বাবা তো লিখেছিলেন, আমি এবার ফার্স্ট হয়েছি।

আমি বলতুম, ভ্যাট, মেয়েরা আবার বিলেতে যায় নাকি? দেখিস, আমিই বরং একদিন বিলেত যাব।

–তুই বিলেত যাবি? হি-হি, তুই তো অঙ্কে গাড়ু পেয়েছিস এবার।

–তাতে কী হয়! আমি জাহাজে চাকরি নেব, আমি নাবিক হয়ে সারা পৃথিবী ঘুরব।

–তোর যা প্যাংলা চেহারা, তোকে জাহাজে চাকরি দেবে না ছাই!

আমি তখন ঠাঁই করে রেণুর মাথায় একটি চাঁটি মেরে বলতুম, আমি প্যাংলা? আর তুই কী রে কেলটি?

তখন ঝটাপটি মারামারি শুরু হত।

আবার যখন দুজনে খুব ভাব থাকত, রেণু আর আমি পাশাপাশি গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে সেই ছবির পোস্টকার্ড দেখতুম। জ্যাঠামশাই-এর চিঠি পড়ে পড়ে রেণু আমার তুলনায় বেশি জানত, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলত, এই যে এটা দেখছিস, এটার নাম নতরদাম গিরজা, সেই যে বইটা পড়লুম হাঞ্চব্যাক অব নরদাম–সেই একই, একদিন আিম এটার পাশ দিয়ে হাঁটব, ভেতরে ঢুকব,…এটার নাম টাওয়ার অব লন্ডন, এটা আসলে একটা দুর্গ–ইতিহাসে পড়িসনি, এটার মধ্যে ওয়াল্টার র্যালেকে বন্দি করে রেখেছিল–কত দেখার জিনিস আছে এর মধ্যে, জেঠু লিখেছেন আমাদের কোহিনূর হীরেও ওখানে আছে,…এই জায়গাটার নাম ভেনিস…এখানে জলের রাস্তা…আমি একদিন এখানে বেড়াব, উঃ সেদিন যা লাগবে না আমার!

আমি নেহাত গায়ের জোরে বলার চেষ্টা করতুম, দেখিস, আমিও ঠিক যাব। হঠাৎ একদিন বিলেতের রাস্তায় দেখা হয়ে যাবে। ভারী তোর জ্যাঠামশাই আছে, আমি একাই…

পরের বছর রেণুর বাবা পাটনায় বদলি হয়ে যেতে ওরা সবাই পাটনা চলে যায়। আমরাও ভবানীপুরের বাড়ি ছেড়ে পাইকপাড়ায় উঠে গেলাম। তারপর, সেখানকার ইস্কুলে বিমল বলে গোঁফকামানো বখা ছেলের সঙ্গে ভাব হল, সে আমায় ছাদের ট্যাংকের পাশে বসে সিগারেট খাওয়া ও আরও সব অসভ্যতা শেখাতে লাগল, তার সঙ্গে আমি দুপুরে টিফিন পালিয়ে সিনেমায় যাওয়া শুরু করলুম। অর্থাৎ বড়দের নিষিদ্ধ জগতে প্রবেশের উত্তেজনায় তখন আমি ব্যাকুল, তখন কোথায় রেণু হারিয়ে গেল। রেণুর আর খোঁজ রাখিনি।

কিন্তু রেণুর সব মিলে গেছে। রেণু পড়াশুনোয় ভালো ছিল। জ্যাঠামশাই-এর বিশেষ সাহায্য নিতে হয়নি, রেণু এম . এস . সি-তে বটানিতে ফার্স্টক্লাস পেয়েছিল, সুতরাং স্কলারশিপ পেতে তেমন অসুবিধে হল না। ছেলেবেলায় জ্যাঠামশাই-এর সেইসব পিকচার পোস্টকার্ড দেখে ওর যে বিলেত যাওয়ার তীব্র ইচ্ছে জেগেছিল–সেই ইচ্ছের জোরেই ও পড়াশুনোয় অত ভালো করেছে। ওদের পরিবারে তেমন শিক্ষার আবহাওয়া ছিল না, ওর ভাই বোনরা কেউ বেশিদূর এগোতে পারেনি। রেণু আমাকে বলত, তুই বিলেত যাবি কী করে? তুই তো অঙ্কে গাড়ু পেয়েছিস! অঙ্ক না জানলে আর লেখা পড়া হয়? সেই রোগা কালো মেয়েটা কিন্তু অঙ্কে তখন একশো পেত। পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুলে গর্বের সঙ্গে রেণু বলত, দেখিস, আমি ঠিক বিলেত যাব, জেঠুর কাছে থাকব, কত দেশ বেড়াব, ইস, তখন যা মজা হবে–আমার চেহারাও ভালো হয়ে যাবে…ফরসা হব…

রেণুর সব মিলে গেছে। ফরসা হয়নি বটে, কিন্তু শরীরে একটা সুস্বাস্থ্যের উজ্জ্বল আভা এসেছে, রং মেলানো রুচিময় পোশাক, পাঁচ বছর বিলেতে থেকে ও এখন ঝানু প্রবাসী। ছুটিতে সত্যিই সেই ছেলেবেলার স্বপ্নের মতো সুইডেন কিংবা ইটালি বেড়াতে যায়।

আর, বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার মতন আমিও দৈবাৎ বিদেশে চলে এলাম, এবং রেণুর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। মাঝখানে কত বছর দেখা হয়নি, শৈশবের চেনা ডাক এক মুহূর্তে মনে পড়ল। ভারতীয় দূতাবাসের পার্টিতে ভিড় ঠেলে রেণু আমার সামনে এসে বলল, কী রে নীলু, তুই? সত্যিই তুই…। দুর্ঘটনার মতন এই ছেলেবেলার কথা মিলে যাওয়া। কিছুতেই যেন বিশ্বাস হয় না।

রেণুনদীতে একটা ঢিল ছুঁড়ে আবার বলল, কিছুই মেলে না, না রে? আমি বললুম, কোথায় মেলেনি? তোর ছেলেবেলার সব কথাই তো মিলে গেল। রেণু উদাসীনভাবে ঠোঁট উলটে বলল, দূর! কিছুনা!

–তুই ওই মাদ্রাজিটাকে বিয়ে করলি কেন?

রেণু মুখ ফিরিয়ে খানিকটা রাগি গলায় বলল, কী অসভ্য! ‘মাদ্রাজিটা’ কী? নাম নেই?

–রাগ করছিস কেন? আমি অবহেলা দেখাবার জন্যে বলিনি। খটমটো নাম তো, কী নাম যেন?কানাড় চেনাস্বামী! হঠাৎ ওর সঙ্গে তোর কী করে বিয়ে হল?

–হঠাৎ আবার কী! ভালো লেগেছে, তাই! তুই কি ভেবেছিলি আমি তোকে বিয়ে করার জন্যে বসে থাকব? তোর মতন একটাৎকো কালো-ভাল্লুক!

–আহা, তুই পায়ে ধরে সাধলেও যেন আমি তোকে বিয়ে করতুম!

–তোর পায়ে ধরে সাধব? কী ভাবিস রে তুই নিজেকে?

–রেণু, তোর কথাবার্তা এখনও কীরকম ছেলে-ছেলে! চেহারাখানা তো বেশ সুন্দর করেছিস, স্বভাবটা একটু মেয়েলি করতে পারলি না।

–মেয়েলি স্বভাব হলে আর এ দেশে টিকতে হত না!

–বাজে কথা বলিস না। আমি কত মেমকে দেখেছি, কী নরম আর ঠান্ডা স্বভাব।

–ইস, খুব মেম দেখা হয়েছে! তোকে কেউ পাত্তা দিয়েছে!

–তোর স্বামীর সঙ্গে তুই কি ভাষায় কথা বলিস? সবসময় ইংরেজিতে?

–ও কী সুন্দর বাংলা জানে, তুই অবাক হয়ে যাবি। শান্তিনিকেতনে পড়ত।

সন্ধে গাঢ় হয়ে এসেছিল, ইফেল টাওয়ারের সব আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। ল্যাটিন কোয়ার্টার্সের দিকে একটা গোলমাল শোনা গেল, কিছু লোক ছুটোছুটি করছে, বোধহয় কোনও আলজিরিয়ান চোর ধরা পড়েছে। আমরা উঠে পড়লুম। রেণুর স্বামী খুব সিরিয়াস প্রকৃতির মানুষ, লাইব্রেরিতে পড়াশুনো করতে গেছেন, আমাদের সঙ্গে ন’টার সময় মার্তে-র একটা সিনেমা হলের সামনে দেখা করবেন। নতরদাম গির্জার বাগানে কী সব খোঁড়াখুঁড়ি চলছে, আজ ভেতরে ঢোকা যাবে না। আমরা দুজনে গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওপরের দিকে চাইলুম। কতবার সিনেমায় দেখেছি এসব, গির্জার দড়ি ধরে ঝুলে কোয়াসিমোদা বিদ্যুৎবেগে এসেছিল এসমারেল্ডার কাছে…হঠাৎ আমার মনে পড়ল, রেণুর জ্যাঠামশাই-এর ছবির পোস্টকার্ডের কথা! আমি রেণু, তোর মনে আছে? সেই ছবি, তুই বলেছিলি, একদিন এর সামনে দাঁড়াব…এই তো আমরা দাঁড়িয়ে…সব মিলে গেল।

–কিছুই মেলে না!

–তার মানে?

–তুই বুঝবি না! ভালো লাগছে না! চল এখান থেকে চলে যাই…

–ভালো লাগছে না? কেন?

রেণু উত্তর দিল না। নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল। রেণুর চেহারায় ব্যক্তিত্ব এসেছে, পাশ দিয়ে কত হালকা ফুরফুরে ফরাসি সুন্দরীরা হেঁটে যাচ্ছে–তার মাঝখানেও আজ রেণুকে রূপসি মনে হয়। ছেলেবেলার বান্ধবীর হাতে-হাতে ধরে বেড়াবার অপূর্ব মাদকতা ভোগ করছিলুম আমি, রেণুর হাতে সামান্য চাপ দিলুম! রেণু বলল, কী?

আমি বললুম, তোর ভালো লাগছে না কেন রে রেণু? আমার তো বিষম ভালো লাগছে!

রেণু ভ্রূভঙ্গি করে বলল, তুই আছিস বলেই ভালো লাগছে না। কেন যে মরতে তোর সঙ্গে দেখা হল এখানে?

আমি অপমানিত বা আহত হব কি না ঠিক করতে পারলুম না, রেণুর গলার সুরটা ঠাট্টার কিনা বোঝা যায় না। জিগ্যেস করলুম, আমি আছি বলে? তোর স্বামীর জন্য মন কেমন করছে নাকি? বাবা রে বাবা, একটু পরেই তো দেখা হবে।

রেণু আমার দিকে রহস্যময়ভাবে তাকাল। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। তারপর বলল, চল, কোনও কাফেতে গিয়ে বসি। সাঁজেলিঝেতে যাবি? না থাক, মার্তেই গিয়ে বসা যাক, ওখানে তো যেতেই হবে!

আমরা টুপ করে মাটির নীচে নেমে গেলুম। মেট্রোতে চেপে মার্তে এসে ফের মাটির ওপরে উঠলুম। খানিকটা ঢালু রাস্তা ধরে নেমে এসে একটা মজার ধরনের কাফে রেণুই খুঁজে বার করল –চত্বরের মধ্যে অনেকগুলো রঙিন ছাতার নীচে টেবিল পাতা, মৃদু আলো স্বপ্ন-স্বপ্ন পরিবেশ। রেণু ফরাসি বলে অনর্গল–হ্যাম স্যান্ডউইচ আর কফির অর্ডার দিয়ে আমার জন্যে এক বোতল ওয়াইনও নিল। একজন দাড়িওয়ালা আর্টিস্ট এসে বলল, মস্যিও-মাদাম, আপনাদের ছবি এঁকে দেব? এক্ষুনি? মাত্র দশ ফ্রাঁ লাগবে

আমি রেণুকে বললুম, ছবি আঁকাবি?

রেণু বলল, ভ্যাট! তুই শুধু নিজেরটা আঁকা!

–না দুজনের একসঙ্গে।

–না! তুই আঁকা! আমি পরে এসে আমার স্বামীর সঙ্গে একসঙ্গে আঁকাব।

আমি হাসতে-হাসতে বললুম, বিলেতে এলে কি হয়, আসলে একেবারে ভেতো বাঙালি। সংস্কারের ডিপো। কেন, আমার সঙ্গে একসঙ্গে ছবি আঁকালে কী হত? সতীত্বে কলঙ্ক হত!

রেণু হাত নেড়ে আর্টিস্টকে বারণ করে দিয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, নীলু, তোকে একটা সত্যি কথা বলব? কিছু মনে করবি না?

–এত ভণিতা কেন? বল না!

–তোর সঙ্গে দেখা হয়ে আমার ভালো লাগছে না! কেন যে সেদিন পার্টিতে আমি সেধে তোর সঙ্গে কথা বলতে গেলুম!

–আমাকে ভালো লাগছে না?

–না!

আমি থতমত খেয়ে গেলুম। উনিত্রিশ বছরের জীবনে কম দুঃখ পাইনি, কিন্তু কোনও মেয়ে এ পর্যন্ত মুখের ওপর বলেনি, আমাকে ভালো লাগছে না। আর রেণু? আমার শৈশবের বান্ধবী, যাকে দেখে আমি উল্লসিত হয়ে উঠেছিলুম, আকস্মিক বিস্ময়ের ঘোর এখনও কাটেনি, সেই রেণু।

আমি দীর্ঘ চুমুকে গেলাসের পানীয় শেষ করলুম। টেবিলের ওপর থেকে সিগারেট-দেশলাই গুছিয়ে নিয়ে বললুম, আমার রাস্তা চিনতে কোনও অসুবিধে হবে না। আমি আমার হোটেলে ফিরে যাচ্ছি।

বিল মেটাবার জন্য আমি ফ্র্যাঙ্কের নোটগুলো বার করছিলুম পকেট থেকে, রেণু বলল, তোকে টাকা দিতে হবেনা। আমি এখানে আর একটু বসব। ও তোনটার সময় আসবে–

–আচ্ছা রেণু, আমি চলি।

–তোর একা থাকতে খারাপ লাগবে? কী করব বল, তুই একটা অপয়া, তোর সঙ্গে থাকতে থাকতে আমার ক্রমশ বেশি মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে, তুই বরং

–ঠিক আছে, আমার জন্য তোকে ভাবতে হবে না, আমি একা থাকব না, উইশ ইউ ভেরি গুড টাইম…

রেণু আর কথা না বলে চেয়ে রইল, আমি চেয়ারের ওপর থেকে রেনকোটটা তুলে নিয়ে উঠে পড়লাম। আর পিছনে না চেয়ে বেরিয়ে পড়লাম রেস্তোরাঁ থেকে। সবেমাত্র রাস্তায় পা দিয়েছি, অমনি রেণু চেঁচিয়ে উঠল, এই সুনীল, একটা কথা–

দৃশ্যটা এমনিতেই বিসদৃশ। পুরুষ ও মহিলা একসঙ্গে এসে ঢুকল, তারপর মহিলাকে একা রেখে পুরুষের চলে যাওয়াটা দৃষ্টিকটু, তারপর রেণুর ওই রকম বাংলা ভাষায় চিৎকার অনেকেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। আমি বাধ্য হয়েই ফিরলাম। রেণু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, মুখে অকপট বিস্ময়, বলল, একটা কথা, তুই রাগ করছিস না তো? বুঝতে পেরেছিস তো, আমি কী বলতে চাই?

আমি নিজেকে সামলাতে পারছিলুম না, অসম্ভব অভিমান আমার বুকে বাষ্প হয়ে জমছিল, তবু অতিকষ্টে স্বাভাবিক গলায় বললুম, না রে, রাগ করব কেন? সবার তো আর ভালোলাগা একরকম নয়।

–ও মা, তুই সত্যি ভীষণ রেগে গেছিস। একটু বোস প্লিজ, একটুখানি–রাগ করিস না।

রেণুর কণ্ঠস্বর ব্যাকুল। হাত বাড়িয়ে আমার কোটের প্রান্ত ধরে আমাকে জোর করে চেয়ারে বসাতে চাইল। আমি অগত্যা বসে রুক্ষ গলায় বললুম, কী ছেলেমানুষি করছিস, রেণু? সবাই দেখছে–ভাবছে আমি ঝগড়া করছি তোর সঙ্গে! আমাকে তোর ভালো লাগছে না–আমি চলে যাচ্ছি, সোজা কথা, এর মধ্যে রাগের কী আছে?

–তোকে আমার ভালো লাগছে না? কে বলল?

–তুই-ই তো বললি।

–আমি বললুম?কখন?

–কী ন্যাকামি হচ্ছে, রেণু? প্যারিসের রেস্তোরাঁ না হলে কান ধরে এক চাঁটি মারতুম। তুই চাসনি, আমি এখান থেকে চলে যাই?

টেবিলের ওপর মাথা ঝুঁকিয়ে আচ্ছন্নের মতন বসে আছে রেণু। আঙুল দিয়ে টেবিলের ওপর দাগ কাটতে কাটতে বলল, আমার মনে হচ্ছে, তোর চলে যাওয়াই ভালো তোর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমার কিছুই তেমন ভালো লাগছে না, কিন্তু তোকে আমার ভালো লাগবে না কেন?

-–থাক, আর বলার দরকার নেই। রেণু, তুই নিশ্চয়ই জানিস, তোর সম্বন্ধে আমার কোনওই দুর্বলতা নেই। পনেরো-ষোলো বছর তোকে দেখিইনি, তোর কথাও মনে ছিল না। হঠাৎ দেখা হল, চিনতে পারলুম, স্বাভাবিকভাবেই সবার ভালো লাগে বিদেশে এরকম হঠাৎ দেখা হলে–এক সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে হয়। এর মধ্যে বিশেষ ভালোলাগা মন্দলাগা কিছু নেই। তুই যদি অন্যকিছু ভেবে থাকিস–

রেণু যেন আমার কথা শুনলই না। বলল, তুই এখনও রেগে আছিস। তোকে ভালো লাগছে, কখন বললাম? তোকে ভালো না লাগার মানে তো নিজের ছেলেবেলাকেই ভালো না লাগা। মুশকিল হয়েছে কী জানিস, ছেলেবেলাটাকেই এখন বেশি ভালো লাগছে। সেই জন্যই তো তোকে চলে যেতে বললাম!

–ধাঁধা শুরু করেছিস এবার। রেণু তুই অনেক বদলেছিস, চালিয়াতও হয়েছিস খুব। আমার অত চালিয়াতি পোষায় না। আমার ভালোলাগা মন্দলাগা দুটোই খুব সরল।

–তুই এখনও বুঝতে পারলি না? শোন, প্যারিসে এসেছি বেড়াতে, ঘুরব, আনন্দ করব, তাই করছিলুম, হঠাৎ তোর সঙ্গে দেখা হল। তুই তো আর কিছু না, তুই আমার ছেলেবেলা। ছেলেবেলার কথা মনে পড়তেই সব গোলমাল হয়ে গেল এখন আর এখানে কিছু ভালো লাগছে না। তোর ভালো লাগছে?

–ছেলেবেলাটা কী এমন মধুর ছিল!

–ছেলেবেলায় সেইসব স্বপ্ন? ছেলেবেলায় ভাবতুম, এখানে এলে কী অসম্ভব ভালো লাগবে। কই, সেরকম ভালো লাগছে? সত্যি করে বল!

–আমার তো ভালোই লাগছে!

–তুই কিছু বুঝিস না! কিংবা তোর ছেলেবলোর কথা মনেই পড়েনি। আমি যখনই ভাবছি ছেলেবেলার কথা, তখন কত বেশি ভালো লাগার কথা কল্পনা করতুম–সেই তুলনায় কি এমন…কিছুই মেলে না, এই তো প্যারিস, এই তো মার্ত, এই তো শা নোয়া রেস্তোরাঁ–কিন্তু কী এমন মনে হচ্ছে, এমন কিছুই না। তুই সব মাটি করে দিলি!

–আমি?

–হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুই। এর আগে, আমার স্বামীর সঙ্গে বেড়াতুম, তুই বোধহয় ভুল ভাবছিস–আমাদের দুজনের মধ্যে কোনও ফাটল নেই, আমরা দুজনে দুজকে খুব ভালোবাসি, ও এমন চমৎকার লোক যে ভালো না বেসে পারা যায় না–ওর সঙ্গে যখন বেড়াই তখন আর সবার যেমন ভালো লাগে–আমারও সেই রকম, এখানকার যে আমি–তার ভালো লাগা! কিন্তু তুই এলি আমার ছেলেবেলাটাকে নিয়ে, সেই চোখ দিয়ে দেখতে গিয়ে দেখছি কিছুই মিলছে না! কোথায় সেই অপূর্ব ভালোলাগার দেশ–ছেলেবেলায় যার কথা ভাবতুম! এই যে প্যারিস–জগৎবিখ্যাত–এও হেরে গেল।

–রেণু, ছেলেবেলার মতন কি আর বয়স্কদের সত্যিই এত বেশি ভালো লাগে? আমাদের তিরিশের কাছাকাছি বয়েস–এখন আর কিছু দেখে আচ্ছন্ন হওয়ার মতন–

–সেই কথাই বলছি! তোর সঙ্গে দেখা না হলে–আমার স্বামীর সঙ্গে বয়স্কদের মতন ভালো লাগত কিন্তু তুই কেন ছেলেবেলাটাকে…আঃ, কেন যে পনেরো বছর বাদে ভূতের মতন এসে উদয় হলি–তাই তো মনে হল, তুই চলে গেলেই আবার এখানকার বয়সে ফিরে আসব, এখানকার চোখে সবকিছু–

–রেণু, আমি বুঝতে পেরেছি। আমি চলেই যাচ্ছি। কিন্তু, একবার মনে পড়লে আর কি ভুলতে পারবি?