০৪. স্টকহলম থেকে ট্রেনে

স্টকহলম থেকে ট্রেনে ওঠার সময় আমাদের কামরা ছিল ভরতি। আমি দূরপাল্লার যাত্রী, অন্য যাত্রী-যাত্ৰীনীরা কেউ-কেউ মাঝ পথে উঠছে নামছে। এক সময় কামরাটা ফাঁকা হয়ে গেল, আমি হাত-পা ছড়িয়ে বসলুম। নরওয়ে পৌঁছতে আমার বেশ রাত হয়ে যাবে।

নির্জন কামরা আমার খুব পছন্দ। বিদেশ বিভুই-এ অচেনা যাত্রীদের সঙ্গে খানিকটা আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকতেই হয়। একলা যাত্রার সময় শরীরটা হালকা হয়ে যায়। কিন্তু পরবর্তী স্টেশানেই একজন যুবতী ও একজন যুবক উঠল। এরা কেউ কারুর চেনা নয়। যুবতীটির সঙ্গে একটা ছোট্ট ঝোলা, আর যুবকটির হাতে বই।

যুবতীটি খুব সম্ভবত সত্যজিৎ রায়ের সমান লম্বা, কিংবা, এতটা না হলেও, আমার চেয়ে যে মাথায় উঁচু, তাতে কোনও সন্দেহই নেই। তার গায়ের জামাটা টকটকে লাল রঙের, মুখখানা খুব সারল্য মাখা।

সুইডেনে রোদ খুব কম ওঠে বলে এখানকার মেয়েরা অন্যান্য মেম-সাহেবদের চেয়েও ফর্সা। অনেকেরই মাথার চুল একেবারে সোনালি, কারুর-কারুর লালচে। চোখের মণি নীল। সব মিলিয়ে ঠিক যেন মানুষ বলে মনে হয় না। মনে হয় যেন অন্য কোনও গ্রহ থেকে বেড়াতে এসেছে।

যুবকটির গায়ের রং কিন্তু হলদে ধরনের, মাথার চুল কালো। সে ইটালিয়ান বা গ্রিক হতে পারে। চেহারা দেখেই কোন দেশের মানুষ, তা চেনা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বসার পরেই যুবকটি চোখের সামনে একটা বই মেলে ধরল। যেন সে এক মিনিটও সময় নষ্ট করতে চায় না। মেয়েটি ধরাল একটা লম্বা, কালো রঙের সিগারেট, তার ধোঁয়ায় সুমিষ্ট গন্ধ। এটা ধূমপায়ীদের কামরা, সেই জন্যই সে এখানে উঠেছে।

মেয়েটি আমার দিকে দু-একবার চকিতে চেয়েই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিচ্ছে। আমার স্পষ্ট বিদেশি চেহারা দেখে তার একটু কৌতহল হবেই। সে নিজে থেকে আমার সঙ্গে কোন কথা না বললে অযাচিতভাবে কোনও বিদেশিনীর সঙ্গে আলাপ করার সাহস আমার নেই। আমি আবার মনে-মনে অনুমানের খেলা শুরু করলুম। এই মেয়েটির পরিচয় কী হতে পারে? সে কি নর্তকী? তার হাতের আঙুলগুলি লীলায়িত। দু-হাতে চার পাঁচটা আংটি। সে নর্তকী হলে যুগ্ন নাচের সময় তার পক্ষে সঙ্গী পাওয়া মুশকিল! মেয়েদের চেয়ে পুরুষরা ছোট হলে চোখে লাগে। নর্তকী যদি না হয়, তবে এ মেয়েটি হয়তো টেনিস খেলোয়াড়। টেনিস খেলায় সুইডিশ ছেলে-মেয়েরা জগৎ বিখ্যাত।

কিন্তু খেলোয়াড় মেয়ে হলে কি এত সিগারেট খাবে? একটি সিগারেট শেষ করেই সে আর একটা ধরাচ্ছে।

যুবকটির বয়স বাইশ তেইশ। বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে সে একবারও চোখ তোলেনি। সে কি কোনও লেখক? তার এলোমেলো চুল ও মুখের খোঁচা-খোঁচা দাড়িতে সে খানিকটা বাউন্ডুলেপনার ভাব আছে। লেখক কিংবা পর্যটক।

জানালার বাইরের দৃশ্য প্রায় একই রকম।

ঘন ঝাউ গাছের সারি, জঙ্গল অথবা জলাভূমি। সুইডেন দ্বীপময় দেশ। চাষের জমি কিংবা লোক বসতি খুবই কম দেখা যায়।

মাঝে-মাঝে দু-একটি ছোটখাটো স্টেশান।

সেই স্টেশনগুলোর চেহারা অনেকটা আমাদের দেশেরই মতন। তবে মানুষজন খুব কম। দশ-বারো জনের বেশি মানুষ ওঠানামা করে না।

ক্রমে অন্ধকার হয়ে আসছে। বাইরে আর দেখবার কিছু নেই। কামরার মধ্যে তাকাতেই চোখাচোখি হল মেয়েটির সঙ্গে।

এর সঙ্গে ভাব হলে বেশ হত। কিন্তু আলাপ শুরু করি কী করে?

একটু পরে অন্য একটি কামরা থেকে একজন লোক এদিক দিয়ে যেতে-যেতে মেয়েটিকে দেখে থমকে দাঁড়াল। সুইডিশ ভাষায় বিস্ময়ের সঙ্গে কী যেন বলল।

মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়েই লোকটিকে জড়িয়ে ধরে তার দু’গালে তিনবার চুমু দিল। তারপর কলকল করে দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলতে-বলতে তারা দু’জনেই চলে গেল এ কামরা ছেড়ে।

এই সব কথাবার্তায় আমার পাশের ছেলেটি প্রথম চোখ তুলল। মেয়েটি আর ফিরে এল না। পাশের ছেলেটি চেয়ে রইল আমার দিকে এক দৃষ্টিতে। ভুরু যে কুঁচকে গেছে তার। সে আমাকে কিছু একটা সন্দেহ করেছে।

আমি তার দিকে তাকিয়ে ভাব করার ভঙ্গিতে হাসলুম।

সে জিগ্যেস করল, ইরানিয়ান?

আমার সঙ্গে ইরানিদের চেহারার কিছুমাত্র মিল আছে এমন তো মনে হয় না। আমেরিকার পশ্চিম অঞ্চলে ঘোরার সময় কেউ-কেউ আমাকে মেক্সিক্যান বলে ভুল করত।

ওখানকার মিশ্র আদিবাসীদের গায়ের রং অনেকটা আমাদের মতন।

আমি তাকে মাথা নেড়ে বললুম, না, আমি ইরানিয়ান নই। সে আবার জিগ্যেস করল, ইজিপশিয়ান?

-না। আমি ভারতীয়।

সে গভীর বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। যেন সুইডেন থেকে নরওয়ে যাওয়ার ট্রেনে কোনও ভারতীয় উপস্থিতি একেবারেই অসম্ভব।

তারপরই সে খুব উৎসাহের সঙ্গে বললে, ইনডিয়ান। গুড! গুড! গুড পিপল! সে একটা সিগারেট প্যাকেট বার করে জোর করে আমার হাতে গুঁজে দিল। তার ইংরিজি বেশ দুর্বল। চিন্তা করে তাকে শব্দ খুঁজতে হয়। বিদেশে আমার চেয়েও যে ইংরিজি কম জানে, তার সঙ্গে কথা বলতে আমার বেশ আরাম হয়।

সে বলল, আমি ইরাক থেকে আসছি…ইরাক আমার দেশ! তুমি বাগদাদের নাম শুনেছ?

আমি বললুম নিশ্চয়ই। বাগদাদের নাম কে না শুনেছে? ইতিহাস-প্রসিদ্ধ নগর।

সে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ ভালো দেশ।

সুইডেন ভালো না! খুব পচা জায়গা। আমার সুইডেন ভালো লাগে না। সুইডিশ মেয়েরা খুব পাজি!

এবার আমার অবাক হবার পালা! অতিশয় দুর্মুখের পক্ষেও সুইডেনকে খারাপ দেশ বলা সম্ভব নয়। প্রকৃতি এখানে চোখ জুড়িয়ে দেয়। মানুষজন বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করে। সুইডেনের কোথাও আমার একটিও অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা হয়নি।

আর সুইডেনের মেয়েরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরীদের মধ্যে হলিউডের গ্রেটা গার্বো থেকে ইন গ্রিড বার্গমান পর্যন্ত কত নায়িকা সুইডেনের। স্টকহলমের রাস্তায় দাঁড়িয়ে যদি একশোটি মেয়েকে দেখা যায়, তাদের মধ্যে অন্তত সত্তরজনই চোখ জুড়িয়ে দেয়।

সেই সুইডেন এবং তার মেয়েদের নিন্দে করছে এই ইরাকি যুবকটি।

সে আবার বলল, ওই যে মেয়েটি এতক্ষণ বসে ছিল, কী বিচ্ছিরি দেখতে না? খে জ্বর গাছের মতন।

তার সঙ্গে আমার কোনপ্রকার মতের মিল না হলেও আমি প্রতিবাদ করলুম না। বরং জিগ্যেস করলুম, তুমি কি এদেশে বেড়াতে এসেছ?

সে বলল, না, আমি দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছি। দু-বছর আগে।

তারপর কথা খুঁজতে-খুঁজতে ভাঙা-ভাঙা ভাষায় বলল, এখানে একটা কারখানায় কাজ করি। শুধু কাজ শিখলে হবে না। এরা বলে পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। এত বই পড়তে কাদের ভালো লাগে? দূর ছাই!

হাতের বইটা সে ছুঁড়ে মারল কামরার মেঝেতে। তারপর তাতে একটা লাথি কষাল!

ছেলেটি ইংরেজি খুবই কম জানে। সুইডিস ভাষাও নিশ্চয়ই এখানে এসেই শেখার চেষ্টা করেছে, দু-বছরে আর কতটা শিখবে! এইসব বিমাতৃ ভাষায় খটোমটো বই পড়া নিশ্চয়ই তার পক্ষে কষ্টকর।

ভালো না লাগলেও তাকে এদেশে থাকতে হবে টাকা রোজগারের জন্য। এসব দেশে অনেক টাকা মাইনে দেয় বটে কিন্তু খুব খাঁটিয়ে মারে।

বইটা আবার তুলে নিয়ে সে ধুলো ঝাড়ল। তার মুখে আপমানে ও বেদনার একটা অদ্ভুত রং।

হঠাৎ চোখ তুলে সে জিগ্যেস করল, এর পরে স্টেশানে আমি নামব। তুমি নামবে আমার সঙ্গে?

এরকম একটা আমন্ত্রণ অস্বাভাবিক।

আমি বললুম, না। আমাকে অসলোতে যেতে হবে। স্টেশানে আমার জন্য বন্ধুরা অপেক্ষা করবে।

সে আবার মুখ বিকৃত করে বলল, অসলো গিয়ে কী করবে? নরওয়ে আর একটা বাজে দেশ। সেখানে কখনও রোদ ওঠে না।

এখন যাচ্ছ দেখবে বৃষ্টি। তুমি আমার সঙ্গে এখানে নামো। এখানে আমার গার্ল ফ্রেন্ড থাকে, সে খুব ভালো সুইডিশ রান্না খাওয়াবে। চলো, আমরা অনেক গল্প করব।

এবারে আমি জিগ্যেস করলুম, তোমার গার্ল ফ্রেন্ড, সে কি সুইডিশ? তুমি যে বললে সুইডিশ মেয়েদের একেবারে পছন্দ করো না?

সে বেশ জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ, পছন্দ, করিই নাতো! এইসব মেয়েরা কি ইরাকি মেয়েদের পায়ের নখের যোগ্য? তোমাদের ইন্ডিয়ার মেয়েরাও কত ভালো, কত নরম। কিন্তু কী করব, এদেশে থাকতে গেলে গার্ল ফ্রেন্ড ছাড়া চলে না। তোমার যদি গার্ল ফ্রেন্ড থাকে, তাহলে শুক্র-শনিবার সন্ধেবেলা, তুমি একলা, তোমার অন্য কোনও বন্ধু থাকবে না। তোমার গার্ল ফ্রেন্ড না থাকলে আরও অন্য খারাপ খারাপ মেয়ে এসে তোমাকে বিরক্ত করবে। এই মেয়েটার তবু একটা গুণ আছে। রান্না করে খাওয়াতে ভালোবাসে। যদি আমাকে সিটিজেনশিপ না দেয়, তাহলে এই মেয়েটাকেই বিয়ে করে ফেলব।

-এদেশে তোমার এত খারাপ লাগে, তবু তুমি এখানে থাকতে চাও কেন? ফিরে যেতে পারো না?

-বললুম না, আমার দেশ থেকে পালিয়ে এসেছি। কিছু যদি মনে করো, তাহলে জানতে পারি কি, তুমি কেন পালিয়ে এসেছ?

–না পালিয়ে এলে আমাকে যুদ্ধ করতে যেতে হত। এতদিনে হয়তো একটা কামানের গোলা খেয়ে মরে যেতাম। তুমি জানো না, আমাদের দেশের সঙ্গে ইরানের যুদ্ধ চলছে?

-হ্যাঁ, জানি, মানে খবরের কাগজে প্রায়ই দেখি।

-তুমি বলতে পারো কেন ইরাক আর ইরানের মধ্যে যুদ্ধ চলছে? কী নিয়ে ঝগড়া?

-তা আমি ঠিক জানি না অবশ্য।

-আমিও জানি না! আমার দেশের সঙ্গে ইরানের কেন যে যুদ্ধ চলছে, তা আমি কিছুতেই বুঝি না। ইরানিদের সঙ্গে আমার তো কোনও ঝগড়া নেই। এদেশে কয়েকজন ইরানিকে দেখেছি, তায়া আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে না। তবে কেন ওদের সঙ্গে আমি যুদ্ধ কর মরতে যাব?

ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়ে জলভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাগদাদ থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে আমাদের বাড়ি। খুব চমৎকার জায়গা, তোমাকে ঠিকানা দেব, তুমি যাবে?

আমার মা তোমাকে খুব যত্ন করবে।

আমি আর কবে ফিরতে পারব জানি না। আমি শুধু-শুধু যুদ্ধে মরতে চাই না। মারতেও চাই না। কিন্তু আমার খুব দেশে যেতে ইচ্ছে করে। আমি প্রায়ই আমার বাড়িটাকে স্বপ্নে দেখি। আমার বন্ধুরা কে বেঁচে আছে, কে মরে গেছে জানি না…

তারপর অনেকক্ষণ সে চুপ করে রইল। কী অসহায় তার মুখ! সে একটা সরল, নিরীহ ছেলে, দেশ ছেড়ে বিদেশে পড়ে থাকার একটুও ইচ্ছে নেই তার, কিন্তু কী এক

অকারণ যুদ্ধ তাকে প্রবাসে মন-মরা করে রেখেছে।

যারা এসব যুদ্ধ বাধায়, এসব যুদ্ধ চালায়, তারা এই সব ছেলেদের কথা বোধ হয় একবারও ভাবে না।