০৪. মস্কো থেকে লেনিনগ্রাড

মস্কো থেকে লেনিনগ্রাড দু-ঘণ্টার বিমান পথ। ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে এসে দেখলুম লবিতে প্রচণ্ড ভিড়, নানারকম ভাষায় কলস্বর। আমাদের জন্য দুটি ঘর অবশ্য আগে থেকেই বুক করা ছিল, ভিড় ঠেলে কাউন্টারে পৌঁছতেই ব্যবস্থা হয়ে গেল।

বিখ্যাত নেভা নদীর ধারেই এই হোটেল লেনিনগ্রাড। খুবই বড় হোটেল এবং অত্যাধুনিক কায়দার। অর্থাৎ সবকিছুই চৌকো কিংবা রেকটানগুলার। গত শতাব্দী পর্যন্ত পৃথিবীর প্রায় সব দেশেরই স্থাপত্যে গম্বুজ, খিলান, গোল গোল থাম দেখা যেত, আধুনিক স্থাপত্যে এসবের কোনও স্থান নেই। মস্কোর হোটেলটিতে তবু খানিকটা পুরোনো-পুরোনো ভাব ছিল, কিছু এই হোটেলটি একেবারে ঝকঝকে সাম্প্রতিক ধরনের। এখানকার লিফটগুলি স্বয়ংক্রিয়।

আট তলার ওপর সারগেই আর আমি পাশাপাশি দুটো ঘর পেয়েছি। সামনের জানলাটার পরদা সরাতেই অপূর্ব দৃশ্য। নেভা নদীর দু-পাশে সুন্দর গড়নের সব প্রাসাদের সারি। দূরে-দূরে দেখা যায় গির্জার চূড়া। নেভা নদী বেশ প্রশস্ত, অনায়াসেই জাহাজ যেতে পারে। এখান থেকে সমুদ্র বেশি দূরে নয়।

নিজের ঘরে জিনিসপত্র রেখে এসে সারগেই আমাকে জিগ্যেস করল, সুনীলজি, ক্লান্ত?

মাত্র দু-ঘণ্টা প্লেন জার্নিতে ক্লান্ত হব কেন? তা ছাড়া শীতের দেশে এমনিতেই ক্লান্তি বোধ কম হয়।

আমি বললুম, না, না, চলো, বেরুবে নাকি?

সারগেই বলল, আমি লেনিনগ্রাডে আগে আসিনি। চলুন, খানিকটা হেঁটে শহরটাকে অনুভব করে আসি।

পোশাক না বদলেই বেরিয়ে পড়লুম। হোটেলের গেটের সামনে ভিড় আরও বেড়েছে। অনেকেই বোধহয় জায়গা পায়নি। আগামীকাল মে-দিবসের মিছিল দেখবার জন্যই বাইরে থেকে বহু টুরিস্ট আসছে।

নেভা নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে একটা ছোট ব্রিজ পেরিয়ে এলুম। এই শহরের মধ্যে দিয়ে অনেকগুলি খাল এসে নেভা নদীতে পড়েছে। আমাদের হোটেলটি সেরকম একটি মোহানার কাছেই। বিশাল বিশাল বারোক স্টাইলের অট্টালিকা দেখলেই বোঝা যায়, এগুলি জার-এর আমলে সম্রান্ত ব্যক্তিদের বাড়ি ছিল, এখন বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়।

লেনিনগ্রাডের ইতিহাস আমরা সবাই কিছু-কিছু জানি। এই শহরের বয়েস কলকাতার চেয়েও কিছু কম। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পিটার দা গ্রেট এখানে এই বন্দর শহরটির পত্তন করে রুশ সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন। তখন এর নাম ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গ। সুপরিকল্পিতভাবে অভিজাতদের জন্যই গড়া হয়েছিল নগরীটি। ডেকে আনা হয়েছিল ইউরোপের বিখ্যাত স্থপতিদের। চওড়া চওড়া রাস্তা, বড়-বড় পার্ক ঘিরে জমকালো সব বাড়ি। মাঝে-মাঝে খাল কেটে জলপথেরও ব্যবস্থা। এই শহরের পথে-পথে ঘুরে বেড়ালে চোখের আরাম হয়।

প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় এই শহরটির নাম পালটে যায়। সেন্ট পিটার্সবার্গের বার্গ অংশটুকু জার্মান ভাষা, তার মানে দুর্গ। সুতরাং এ শহরের নতুন নাম হল পেট্রোগ্রাড। বিপ্লবের প্রধান কেন্দ্রও ছিল এই শহর। ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার জন্য পেট্রোগ্রাড নাম আবার বদল করা হয়।

হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছে, শীত বেশি নেই। এইসব শীতের দেশে সন্ধ্যাগুলো খুব লম্বা হয়। এখন সাড়ে সাতটা বাজে, কলকাতায় এখন রীতিমতন অন্ধকার, লোডশেডিং হলে তো কথাই নেই, আর এখানে বেশ পরিষ্কার আলো। এইরকমই চলবে প্রায় ন’টা পর্যন্ত।

মোহানার মুখে একটা থেমে-থাকা জাহাজ দেখিয়ে সারগেই জিগ্যেস করল, সুনীলজি, এই জাহাজটার কথা জানেন? এই হচ্ছে বিখ্যাত অরোরা।

আমি ব্যাটলশিপ পোটেমকিনের কথা জানি, অরোরার নাম আগে শুনিনি।

সারগেই জানাল যে, এই অরোরা থেকেই বিপ্লবের সংকেত দিয়ে প্রথম তোপধ্বনি হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সব স্কুলের ছেলে-মেয়েরাও এর নাম জানে। এখন জাহাজটিকে একটি মিউজিয়াম হিসেবে এখানে রাখা হয়েছে। যে-কেউ ভেতরে ঢুকে দেখতে পারে। তবে পাঁচটার মধ্যে আসতে হবে।

আমি সারগেইকে সামনে দাঁড় করিয়ে অরোরার একটি ছবি তুললুম। তারপর আর একটু বেড়িয়ে ফিরে এলুম হোটেলে। সারগেইকে এখন কিছু ফোনটোন করতে হবে। এখানকার এ পি এন অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করা, কাল সকালে মে-দিবস প্যারেড দেখতে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি ঠিক করা ইত্যাদির ব্যবস্থা করবার জন্য সে চলে গেল। আমি জানলার কাছে চেয়ার টেনে বসে রইলুম চুপচাপ। নদীতীরের বাড়িগুলিতে আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে আলোকসজ্জা।

হঠাৎ এক সময় আমার শরীরে রোমাঞ্চ হল। এই সেই সেন্ট পিটাসবার্গ, এখানকার রাস্তা দিয়ে স্টয়েভস্কি হেঁটেছেন। নিকোলাই গোগোল এখানে ইতিহাসের মাস্টারি করতে-করতে একদিন বুঝেছিলেন, সাহিত্যই তাঁর মুক্তির পথ; পুশকিন লিখেছিলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস, একটি নিগ্রোকে নিয়ে। সাহিত্য জগতের বিশাল বিশাল বনস্পতিদের স্মৃতিজড়িত সেই শহরে আমি বসে আছি?

অনেকক্ষণ বসে রইলুম জানলার ধারে। যেন একটা ঘোরের মধ্যে। খানিকবাদে ফিরে এল সারগেই। কাঁচুমাচু মুখে জানাল, ট্যাক্সি জোগাড় করা গেল না কিছুতেই। কাল মে ডে’র প্যারেডের জন্য অনেক রাস্তাতেই ট্রাফিক বন্ধ থাকবে, কোনও ট্যাক্সিই উইনটার প্যালেসে পৌঁছতে পারবে না। সুনীলজি, আপনি হেঁটে যেতে পারবেন তো?

সারগেই-এর মুখে সুনীলজি ডাক শুনে প্রত্যেকবারই আমার মজা লাগে। বাঙালিদের মধ্যে জি ব্যবহার করার রেওরাজ নেই। উত্তর ভারত ও পশ্চিম ভারতে ওই ডাক চলে। আমি অবশ্য সারগেইকে নিরস্ত করি না। ওর মুখে ওই ডাক বেশ মিষ্টি লাগে, আমার এক মহারাষ্ট্রীয় বন্ধুর কথা মনে পড়ে।

হোটেল লেনিনগ্রাডের বিভিন্ন তলায় টুরিস্টদের মনোরঞ্জনের জন্য নানা ধরনের রেস্তোরাঁ আছে। তার মধ্যে দু-একটিতে গান-বাজনা, নাচেরও ব্যবস্থা রয়েছে, আমরা ঘুরে ঘুরে সব ক’টি দেখে নিয়ে মাঝারি ধরনের একটিতে নৈশভোজ সেরে নিলুম।

আমার দরজার কাছে এসে যখন শুভরাত্রি বলে বিদায় নিতে গেল সারগেই, আমি ওর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললুম, আমায় কিছু পয়সা দেবে?

সারগেই অবাক।

আমি হাসতে-হাসতে বললুম, সকালবেলা তোমার আগেই যদি আমার ঘুম ভাঙে তাহলে আমি এক কাপ চা কিনে খেতে চাই!

সারগেই ব্যস্ত হয়ে বললেন, আপনার যখনই দরকার হবে আমাকে ডাকবেন। এমনকী মাঝরাত্তিরেও দরকার হলে ডাকবেন বিনাদ্বিধায়।

তবু আমি নাছোড়বান্দার মতন ওর কাছ থেকে এক রুবল আদায় করলুম।

রাত্রে শুয়ে শুয়ে আমার সহজে ঘুম এল না। কাল রাতে মস্কো ছিল নতুন জায়গা, আজ আবার নতুন জায়গায় এসেছি, বিছানার সঙ্গে দু-এক রাত্তির ভাব না জমলে ভালো ঘুম হয় না। আমার এই ঘরটি ডাবল বেড। ঘরের দুপাশে দুটি বিছানা পাতা। আমি একবার এক বিছানায় আর একবার অন্য বিছানায় শুতে লাগলুম। যেন আমি একাই দুজন মানুষ।

কাঁচের জানালায় পরদা টানিনি বলে ভোরের প্রথম আলো চোখে পড়ামাত্র ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়িতে অবশ্য খুব ভোর নয়, পৌনে আটটা বাজে, কিন্তু বাইরে আবছা আবছা অন্ধকার রয়েছে এখনও। পাজামা-পাঞ্জাবি আর চটি পরেই বেরিয়ে এলুম ঘরের বাইরে। আমাদের ফ্লোরের এক প্রান্তে একটি ছোট রেস্তোরাঁ আগেই দেখে রেখেছিলুম, সেখানে এসে দেখলুম, সেটি সদ্য খুলেছে, একজন বৃদ্ধা বসে আছেন কাউন্টারে। আমিই প্রথম খদ্দের।

বৃদ্ধা মহিলা হেসে রাশিয়ান ভাষায় আমায় সুপ্রভাত জানালেন, আমি জানালুম ইংরেজিতে। প্রথমে এক কাপ চা নিলুম, তার স্বাদ আমার মনঃপূত হল না, তারপর এক কাপ কফি নিয়ে স্বাদটা বেশ ভালো লাগল।

ফিরে এসে দিনের প্রথম সিগারেটটি উপভোগ করার পর বেজে উঠল টেলিফোন। সারগেই বলল, সুনীলজি, এযার বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ুন, আমাদের সাড়ে আটটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে হবে। ব্রেকফাস্ট বাইরে কোথাও খেয়ে নেব।

আমি বললুম, আমি তো তৈরি!

আজ আকাশ সামান্য মেঘলা। গরম জলে স্নান সেরে নেওয়ার ফলে শরীরটা বেশ তরতাজা লাগছে। এখন আমি পাঁচ-দশ মাইল অনায়াসে হেঁটে যেতে পারি।

নেভা নদী পার হওয়ার সময় ব্রিজের মাঝখানে একবার দাঁড়ালুম। যে-কোনও নতুন নদী প্রথমবার পার হওয়ার সময় বেশ কিছুক্ষণ নদীর সৌন্দর্য না দেখে আমার যেতে ইচ্ছে করে না। তাড়াহুড়ো করে, অন্যমনস্কভাবে কোনও নদী পার হওয়া উচিত নয়। সমস্ত জলেরই চরিত্র আলাদা।

আমরা ছেলেবেলায় ভূগোলে পড়েছিলুম যে এই নেভা নদীর জল বছরে চার-পাঁচ মাস জমাট বরফ হয়ে থাকে। নদীর মোহনাতেও এত বরফ জমে যে জাহাজ ঢুকতে পারে না। এখন কিন্তু জলের প্রবাহ বেশ স্বাস্থ্যবান।

সারগেই জিগ্যেস করল, আপনি জলের দিকে তাকিয়ে কী দেখছেন?

আমি বললুম, কিছুই না। এমনিই, জল দেখতে আমার ভালো লাগে।

সারগেই বললেন, নদীর স্রোতের সঙ্গে মানুষের জীবনের একটা মিল আছে, না? দুটোই বয়ে চলেছে, আমরা শুধু ওপরের দিকটা দেখতে পাই, গভীরতা চোখে পড়ে না–

আমি হাসলুম। আমার অবশ্য এরকম কোনও কথা মনে পড়ে না। সারগেই এখনও ছেলেমানুষ, ও বোধহয় সবকিছুই উপমা দিয়ে দেখতে ভালোবাসে।

ব্রিজ পার হওয়ার পর বড় একটা স্কোয়ার। রাস্তা চলে গেছে নানা দিকে। সারগেই নিজের রাস্তা চেনে না। পুলিশদের জিগ্যেস করে করে এগুতে লাগলম। ক্রমেই। গেল, রাস্তার দু-পাশে বহু গাড়ি থেমে আছে, কোথাও কোথাও রাস্তার মাঝখানে বড় বড় গাড়ি দাঁড় করিয়ে ট্রাফিক চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দলে দলে মিলিশিয়া পাহারা দিচ্ছে সেখানে। আমরা পরিচয়পত্র দেখিয়ে এক একটা বাধা পার হতে লাগলুম।

মস্কোয় যেমন ক্রেমলিন, লেনিনগ্রাডে প্রায় সেই রকমই হচ্ছে উইন্টার প্যালেস। এক সময় আমরা সেখানে পৌঁছে গেলুম। একটি বিশাল চত্বরের চার পাশ ঘিরেই সুরম্য সব প্রাসাদ। এইখান থেকেই মে দিবসের শোভাযাত্রা শুরু হবে। একদিকে কাঠের গ্যালারি করা আছে আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য। ঠিক দশটার সময় উৎসব শুরু হবে, গ্যালারির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বহু মানুষ। দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে অনেক ছোট ছোট দোকান। কফি, চা, ঠান্ডা পানীয়, স্যান্ডউইচ, সসেজ, আলুর চপ, ডোনাট ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে। এইসব টুকিটাকি খাবার খেয়ে আমরা ব্রেকফাস্ট সেরে নিলুম। হঠাৎ টিপি টিপি বৃষ্টি হতেই শীত বেড়ে গেল। শীত তাড়াবার জন্য কফি খেতে লাগলুম ঘন-ঘন।

একটা জিনিস লক্ষ করলুম, সমবেত দর্শকদের মধ্যে প্রায় সবাই বয়স্ক পুরুষ ও মহিলা, সঙ্গে বাচ্চা বা কিশোর-কিশোরীরাও আছে, কিন্তু যুবক-যুবতী একজনও নেই। একটু পরেই এর কারণ বুঝেছিলুম।

গ্যালারিতে ভিড় হয়ে যাচ্ছে দেখে আমরা আমাদের আমন্ত্রণপত্র দেখিয়ে নির্দিষ্ট গেট দিয়ে ঢুকে এলুম ভেতরে। যে অংশটায় আমাদের আসন, সেখানে সবাই মনে হল বিদেশি। অনেকেরই হাতে টিভি ক্যামেরা, মুভি ক্যামেরা। পৃথিবীর বহুদেশের মানুষ রয়েছে, কিন্তু ভারতীয় আর একজনও চোখে পড়ল না।

মাঝে এক পশলা বেশ জোর বৃষ্টি হয়ে গেল। আমি ওভারকোট এনেছি বটে, কিন্তু মাথার টুপি কিংবা দস্তানা আনিনি। এত ঠান্ডা লাগছে যে কোটের পকেট থেকে হাত যার করতে পারছি না। অন্য সকলেরই গলায় টাই বা স্কার্ফ জড়ানো। ১৯৬৩ সালে মার্কিন দেশের একটি ছোট শহরে আমি গলা থেকে টাই খুলে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে প্রতিজ্ঞা করেছিলুম, জীবনে আর কখনও টাই পরব না। এখন মনে হল, একটা অন্তত মাফলার আনলে মন্দ হত না!

ঠিক দশটার সময় দেখা গেল ময়দানের এক প্রান্ত দিয়ে একটি শোভাযাত্রা ঢুকছে। তাদের হাতে নানারকম পতাকা ও ছবি। কয়েক মিনিটের মধ্যে চত্বরটি পূর্ণ হয়ে গেল। শোনা গেল অনেক ধরনের যন্ত্র-সঙ্গীত। চতুর্দিক থেকে মাইক্রোফোনে ধ্বনি উঠল, রুশ ভাষায়, শ্রমিক ও কৃষক ঐক্য, হু-র-রা! অমনি সমবেত কণ্ঠ বলে উঠল, হু-র-রা!

তারপর শোভাযাত্রার স্রোত বইতেই লাগল। অতি সুন্দর বর্ণময় দৃশ্য! প্রথম দিকে এল সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রতিনিধিরা, তারপর নানারকম কল কারখানার কর্মী, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, কৃষক, বুদ্ধিজীবী। এরা প্রায় সবাই তরুণ তরুণী। প্রান্তর পূর্ণ হয়ে গেলে একদল গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে যাচ্ছে, বিপরীত দিক থেকে ঢেউ-এর পর ঢেউ আসছে। মাইক্রোফোনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা করে বলা হচ্ছে হু-র-রা!

মে-দিবসের মিছিল সম্পর্কে আমার একটা ভুল ধারণা ছিল। আমি ভেবেছিলুম এখানে কামান-বন্দুক-মিসাইলেরও প্রদর্শনী হয়। সেসব কিছু না! সকলে একরকম পোশাক পরেও আসেনি, সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিরা ছাড়া। এখানে এসেছে সবাই ছুটির উৎসবের মেজাজে, পোশাকেও নানারকম বৈচিত্র্য। অনেকেই বেশ সাজগোজ করে এসেছে।

যৌবনের এই আনন্দময় দৃশ্যের তুলনা হয় না। এই মিছিলে কোনও ধরাবাঁধা নিয়মের কড়াকড়ি নেই। হাস্যময় তরুণ-তরুণীরা গান গাইতে-গাইতে আসছে, জয়ধ্বনি দিচ্ছে, আবার চলে যাচ্ছে। এই যৌবন জলতরঙ্গের যেন শেষ নেই।

শীতের মধ্যে টানা দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলুম। আরও কতক্ষণ চলবে কে জানে!

সারগেই একসময় জিগ্যেস করল, সুনীলজি, এবারে যাবেন, না আরও দেখবেন?

শেষ হওয়ার আগেই চলে যাওয়া উচিত কি না আমি মনে-মনে ভাবছিলুম। সারগেই-র প্রশ্ন শুনে বললুম, এবারে গেলে মন্দ হয় না।

গ্যালারি থেকে নেমে আমরা চলে এলুম রাস্তায়। এখান দিয়েও মিছিল চলছে। একই মিছিল ভেদ করে অন্যদিকে যাওয়ার উপায় নেই, তা সঙ্গতও নয়। একমাত্র উপায় এই মিছিল যোগ দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে যাওয়া। তাই করলুম।

ছাত্রজীবনে আমি কলকাতায় কয়েকবার মে-দিবসের মিছিলে যোগ দিয়েছিলুম বটে, কিন্তু কোনওদিন কি স্বপ্নেও ভেবেছি যে একদিন রাশিয়ায় মে-দিবসের মিছিলে আমি অংশগ্রহণ করব? এ এক বিচিত্র অনুভূতি! কেউ আমার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে না, দু-একটা বাচ্চা ছেলে ছাড়া।

সেই মিছিলের সঙ্গে সঙ্গে চলে এলুম নেভা নদী পর্যন্ত। এবারে দেখলুম, এক একটা দল মিছিল ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে যার যার বাড়ির দিকে। সুতরাং আমরাও যেতে পারি।

আমাদের পাশে পাশে একটা ছোট দল যেতে লাগল নানারকম গান গাইতে গাইতে ও হাসাহাসি করতে-করতে। গানের সুর শুনে মনে হয় কোনও পল্লিগীতি। মনে হয় খুব চেনা।

দুপুরে খেয়েদেয়ে একখানা ঘুম দেওয়ার জন্য খুব মন কেমন করছিল। কিন্তু তার উপায় নেই। তিনটের সময়েই আর একটা প্রোগ্রাম আছে। এখন বাসে করে যেতে হবে মাইল তিরিশেক দূরে, পুশকিন শহরে।