[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

০৪. প্রবল স্রোতের বিরুদ্ধে

প্রবল স্রোতের বিরুদ্ধে তবু সাঁতার কাটার চেষ্টা করা যায়। কিন্তু বিমান বন্দরে মানুষের স্রোতের বিরুদ্ধে হাঁটার চেষ্টা করা তার চেয়ে অনেক কঠিন।

গন্তব্যে পৌঁছবার পর বিমান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নামার জন্য সব যাত্রীই অস্থির হয়ে ওঠে। নেমেই সবাই প্রায় ছুটতে থাকে। কারণ দেরি হলেই ইমিগ্রেশানের লাইন লম্বা হয়ে যায়। বাইরে অপেক্ষামান কোনও বন্ধু বা প্রিয়জনের সঙ্গে হাত মেলাবার জন্যও অধীরতা থাকে।

সবার সঙ্গে পা মিলিয়ে আমিও যখন আধা ছুটন্তু, হঠাৎ আমার কেন যেন অস্বস্তি বোধ হল। শরীরটা একটু হালকা-হালকা লাগছে না? কী যেন নেই! হাত দিয়ে দেখলাম, চশমা আছে, বুক পকেটে পাসপোর্ট আছে, কাঁধে ঝোলা ব্যাগও আছে। তবে? তবু যেন শরীরটা একটু হালকা।

প্যান্টের পকেট থাবড়ে দেখলাম, মানিব্যাগটা নেই।

বুকটা ধস করে উঠল। আবার?

কবি বা লেখকরা নাকি অধিকাংশই ভুলোমনা এবং ন্যালাখ্যাপা ধনের হয়। আমি ততটা বড় কবি বা লেখক নই বলেই এই গুণগুলি অর্জন করতে পারিনি। এত ঘোরাঘুরি করি, তবু আমার পাসপোর্ট বা জিনিসপত্র কখনও হারায় না। এক যাত্রায় একাধিকবার বিমান পালটাতে হলেও সময়ের গোলমাল করে ফেলিনি কখনও।

শুধু দুবার মানিব্যাগ পকেটমার হয়েছে।

একবার ঢাকায়, একবার ইতালির ফ্লোরেন্স নগরীতে।

ঢাকার ঘটনাটিতে প্রায় সম্পূর্ণ দোষ ছিল আমারই। আসলে মানিব্যাগ ব্যবহার করার অভ্যেসই আমার নেই, সেই জন্য পকেটে মানিব্যাগ রাখলে যে ধরনের সতর্ক থাকা দরকার সেটাই আমি খেয়াল করি না। কলকাতায় কিম্বা দেশের মধ্যে যেখানেই যাই, ঘড়ি আর মানিব্যাগ, কোনওটাই আমার লাগে না। বিদেশে পকেট থেকে টাকা বার করা দৃষ্টিকটু, তাই ব্যাগ রাখতে হয়।

ঢাকায় কয়েক বছর আগে জাতীয় কবিতা উৎসবে এক সকালে প্রথমে গিয়েছিলাম দল বেঁধে শহিদ মিনারে পুস্পার্ঘ্য দিতে, তারপর মঞ্চে কবিতা পাঠ। ঢাকায় কবিতা নিয়ে যেমন উন্মদনা, সেরকম আর কোথাও দেখিনি এ পর্যন্ত। হাজার হাজার নারী-পুরুষ কবিতা শুনতে আসে।

কবিতা পাঠের পর মঞ্চ থেকে যেই নেমে এসেছি, যথারীতি বহু অল্পবয়েসি ছেলেমেয়ে ঘিরে ধরেছে অটোগ্রাফের জন্য। (কলকাতায় একরমই ছোটখাটো একটা দৃশ্য দেখে একজন বেলজিয়াম ফরাসি কবি আপশোশ করে বলেছিলেন, আমাদের দেশে এখন আর কেউ কবিদের কাছ থেকে অটোগ্রাফ চায় না!) ঢাকায় সাধারণত আমি পাজামা-পাঞ্জাবি পরেই কাটাই। সেই সকালে আমার মানিব্যাগটা হোটেলে রেখে না এসে কেন যে ঢোলা পাঞ্জাবির পকেটে নিয়ে আসার দুর্মতি হয়েছিল কে জানে! সেটার কথা আমার মনেও ছিল না।

ছেলেমেয়েরা অটোগ্রাফের জন্য চিলুবিলু করছে, আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সই মেরে যাচ্ছি, শেষই হচ্ছে না, হঠাৎ স্পষ্ট বুঝতে পারলাম কেউ আমার পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমি এই, এই, কী হচ্ছে বলে চেঁচিয়ে উঠে ভিড় সরাতে সরাতেই তার মধ্যে গোপন হাতটি মানিব্যাগ নিয়ে অদৃশ্য।

স্বাক্ষর সংগ্রহকারীদের মধ্যে কেউ আমার পকেট মেরেছে, এ তো হতেই পারে না, বরং ওরকম বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখে কোনও পকেটমার ওদের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। ঢোলা পাঞ্জাবির পকেটে ওরকম অরক্ষিতভাবে মানিব্যাগ রাখার উচিত শিক্ষাই আমি পেয়েছি।

ফ্লোরেন্সের ঘটনাটি একটি নিখুঁত চক্রান্ত।

ফ্লোরেন্সে (এখনকার নাম ফিরিঞ্জিয়া) শহরের কেন্দ্রে অনেকটা অঞ্চলে গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ। সেখানে বহু মূল্যবান শিল্প ও পুরাকীর্তি আছে, গাড়ির ধোঁয়ায় সেগুলির ক্ষতি হতে পারে। (ইদানীং তাজমহলের এক-দেড় মাইলের মধ্যেও পেট্রোল-ডিজেলের গাড়ি চলতে দেওয়া হয় না, ব্যাটারিচালিত বাস যাতায়াত করে। সুতরাং আমরা হেঁটে বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। কয়েকদিন আগেও বেশ শীত ছিল, সেদিনই হঠাৎ উকট গরম পড়েছে, তাই কোট খুলে রেখে এসে গায়ে ছিল শুধু টি-শার্ট, যার বুকপকেট নেই। যদি গাড়িতে ঘুরতাম কিংবা আমার গায়ে কোট থাকত, তা হলে আর আমাকে ওভাবে গালে চড় খেতে হত না।

ভাস্কর, অসীম, স্বাতী ও আমি ঘুরছি ফ্লোরেন্সের রাস্তায়, এক সময় ওরা খানিকটা এগিয়ে গেছে: আমি সিগারেট ধরাবার জন্য থেমেছি, হঠাৎ যেন মাটি খুঁড়ে এসে চারটি মেয়ে আমাকে ঘিরে ধরল।

বাঘ যেমন শিকার ধরার আগে কিছুক্ষণ লক্ষ ও অনুসরণ করে, এরাও নিশ্চিত লক্ষ করছিল আমাদের। ভারতীয় বলে চিনতে পেরে ধরে নিয়েছিল, আমার পকেটে ক্রেডিট কার্ডের বদলে ক্যাশ টাকা থাকতে পারে। আমি যে-ই দল ছাড়া হয়েছি, অমনি ওরা সেই সুযোগ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

একটি মেয়ে দাঁড়িয়েছে একেবারে আমার সামনে, মুখোমুখি। তার পেটটা অনেকটা উঁচু, অর্থাৎ গর্ভবতী, সেখানে হাত রেখে সে যা বলতে চাইল, তার মানে না বুঝলেও বোঝা যায় সেটা ভিক্ষে চাইবার ভাষা। মেয়েটি আমার পথ জুড়ে এমনভাবে আমার গাঁ ঘেষে দাঁড়িয়েছে, যেন আমার বুকের ওপর এসে পড়বে। আরে করছ কী, করছ কী, এই ভঙ্গিতে আমি হাত দুটো তুলতেই, দুদিক থেকে অন্য দুটি মেয়ে আমার হাত চেপে ধরে পৃথিবীর সব ভিখারিনীর মতনই কিছু বলতে লাগল আনুনাসিক সুরে।

আমি বুঝতে পারছি, এরা নিছক ভিখিরি নয়। কিন্তু একটি গর্ভবতী মেয়েকে কি কোনও পুরুষ ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে পারে? অন্য দুটি মেয়ে এত শক্তভাবে আমার হাত চেপে ধরেছে যে ছাড়াতে পারছি না।

পুরুষ হলে যত জোরে ঝটকা মারতে পারতাম, মেয়ে বলেই তা সম্ভব নয়। এই সুযোগে, চতুর্থ মেয়েটি আমার প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল।

সবই আমি দেখতে ও বুঝতে পারছি, চেঁচিয়েও উঠেছি, কিন্তু পুরো ঘটনাটি ঘটল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে। এমনই ওদের চমৎকার ট্রেনিং।

আমার পকেটের মানিব্যাগে ছিল সামান্য কিছু টাকা ও খুচরো পয়সা। আর একটি খামে ভ্রমণের যাবতীয় টাকা। মেয়েটি দুটিই তুলে নিয়েছে, কিন্তু এক সঙ্গে হাতের মুঠোয় রাখতে পারল না। মানিব্যাগটাই ধরে রাখতে পারল না, শুধু খামটি নিয়ে দৌড় লাগাল। ওদের ভাগ্য কত ভালো, মানিব্যাগের বদলে খামটি খসে পড়লে আমার বিশেষ কিছুই ক্ষতি হত না।

এই সব কাণ্ডকারখানা দেখে ও আমার চিৎকার শুনে রাস্তার অনেক লোক থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সাহায্যের জন্য হাত বাড়াবার প্রথা অবশ্য ওসব দেশে নেই। কয়েকজন ইচ্ছে করলেই মেয়েগুলিকে, অন্তত একজনকেও ধরে ফেলতে পারত, কিন্তু ওরা প্রায় চোখের নিমেষে পাশের একটা গলিতে ঢুকে পালাল। মানিব্যাগটি পড়ে আছে দেখে পথচারীরা কেউ-কেউ মন্তব্য করল, যাক, লোকটা খুব জোর বেঁচে গেছে।

আমার বদলে ওই মেয়ে পকেটমাররা যদি ভাস্কর বা অসীমের পকেটে হামলা করত, তাতে ওদের প্রায় কিছুই লাভ হত না। ওরা লন্ডন-প্যারিসে থাকে, ওদের পকেটে ক্রেডিট কার্ড।

ওই মেয়েগুলি সম্ভবত রুমানিয়ান জিপসি, চুরি-ছিনতাই, পকেটমারিতে খুব দক্ষ। আমরা পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে গিয়েছিলাম, তারা গ্রাহ্যই করেনি। সব টাকাপয়সা হারিয়েও স্বা তাঁকে ও আমাকে যে দারুণ বিপদে পড়তে হয়নি, তার কারণ, সঙ্গে ছিল দুই বন্ধু।

কিন্তু এবারে বিমানের মধ্যে কে আমার পকেট মারবে?

হিথরো এয়ারপোর্টে আমি ওই মানিব্যাগ থেকে টাকা ভাঙিয়ে রেস্তোরাঁর বিল মিটিয়েছি, বিমানের মধ্যেও মানিব্যাগটা আমার কাছে ছিল, হ্যাঁ মনে আছে।

হুড়-হুড় করে বিমান থেকে বেরিয়ে আসছে শয়ে-শয়ে মানুষ, সবাই একমুখী, এই সময় আমাকে উদভ্রান্তের মতন উলটো দিকে যেতে দেখে প্রত্যেকেই বিরক্ত হয়, ধাক্কাধাক্কি লাগে, তবু আমাকে তো খোঁজ করতে যেতেই হবে।

ক্ষুধার্ত মানুষ নাকি আকাশের চাঁদের দিকে তাকায় না।

আমার মতন এমন বিপদাপন্ন অবস্থার মধ্যেও কি কোনও মানুষের নারীর রূপসুধা পানের দিকে মন থাকে? যাত্রীদের মধ্যে সেই দীর্ঘদীপিতদেহা রমণীকে দেখতে পেয়ে আমি ভুলে গেলাম আমার উদ্বেগ কয়েক মুহূর্তের জন্য। অন্যদের মতন তিনি দৌড়োচ্ছে না, হাঁটছেন ব্যক্তিত্বময়ীর মতন ধীর পদক্ষেপে। এরকম রমণীর জন্য পৃথিবীতে বহু যুদ্ধবিগ্রহ ঘটে গেছে।

কী আশ্চর্য, আমাকে দেখতে পেয়ে সে মহিলাও থমকে দাঁড়ালেন।

আমি উলটো স্রোতের সাঁতারু বলে সবাই একবার করে দেখছে আমাকে। কেউ কোনও মন্তব্য করছে না। এ মহিলা এগিয়ে এলেন আমার দিকে। বিমানের মধ্যে এঁর সঙ্গে আমার একটাও কথা হয়নি। চোখাচোখিও হয়নি, আমাকে চেনার কোনও প্রশ্নই নেই।

কাছে এসে তিনি স্প্যানিশ ভাষায় কিছু বললেন আমাকে।

আমি অসহায় ভাবে জানালাম, স্প্যানিশ ভাষা আমার বোধগম্য নয়।

তখন তিনি ইংরেজিতে জিগ্যেস করলেন, আপনার কিছু হারিয়েছে?

সঙ্গে-সঙ্গে বললাম, হ্যাঁ, মানিব্যাগ।

তিনি বললেন, আমি একটা সিটের পাশে মানিব্যাগ পড়ে থাকতে দেখেছি, পার্সারের কাছে জমা দিয়ে এসেছি। তার কাছে খোঁজ করুন।

তিনি আর দাঁড়ালেন না, আমিও ছুটলাম।

যাত্রীরা সবাই শেষ হয়ে যাওয়ার পর বিমানকর্মীরাও নামছে, আমি কিছু জিগ্যেস করার আগেই তাদের একজন ‘পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’-র ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল, কিছু হারিয়েছে?

আমার মানিব্যাগ।

লোকটি বলল পার্স, না বিলফোলড? পাতলা ধরনের মানিব্যাগ, যার মধ্যে খুচরো রাখা যায় না, শুধু নোট রেখে ভাঁজ করা যায়, আমেরিকানরা তাকেই বলে বিলফোলড। আমার ব্যাগটা পাতলা ধরনের, তার মধ্যে অল্প কিছু টাকাই ধরে, (আমেরিকানদের কাছে অল্প শ’তিনেক ডলার, আমাদের দেশের টাকার হিসেবে অনেকটাই) তাই বললাম, বিলফোলড।

লোকটি জিগ্যেস করল, ভেতরে তোমার কিছু প্রমাণ আছে? কার্ড কিংবা ঠিকানা? কিংবা কোনও ছবি?

না, সেরকম কিছুই নেই। ঠিক ঠিক টাকার অঙ্কটা গোনা নেই।

লোকটি বলল, তুমি যে বললে, কিছুই প্রমাণ নেই, সেটাই প্রমাণ। ভেতরে কোনও কাগজ বা ছবি নেই, আমি এটা জমা দিতে যাচ্ছিলাম। এই নাও।

অনেকেরই কোনও না কোনও সময় টাকাপয়সা হারায়, কিন্তু হারানো টাকা অবিকল ফেরত পাওয়া অতি দুর্লভ ঘটনা নয়?

আমাদের দেশে এরকম অবস্থায় কত ফর্ম ভরতি করা আর কতক্ষণ যে অপেক্ষা করতে হত, তার ঠিক নেই।

এখানেও যদি ইমিগ্রেশান কাউন্টার পেরিয়ে যেতাম, তা হলে আর বিমানের দিকে ফিরে আসা অসম্ভব ছিল। যাত্রীরা নেমে গেলেই ঝাড়ুদাররা ওঠে, তারা কেউ ব্যাগটা পেলে হজম করে ফেলত না?

বাংলাদেশের মুক্তধারা নামে বইয়ের অন্যতম প্রকাশক বিশ্বজিৎ সাহা নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে একটি ছোট্ট বাংলা বই ও ক্যাসেটের দোকান খুলেছিল, এখন সে দোকানটি অনেক বড় হয়েছে, নিউ ইয়র্কে বাংলা বইমেলার সেই প্রধান উদ্যোক্তা। সেই বিশ্বজিৎ আর অভিজিৎ নামে আর একটি যুবক আমার জন্য অপেক্ষা করছিল বাইরে।

এই বইমেলা ও সাহিত্যসভা উপলক্ষ্যে ঢাকা থেকে এসেছে হুমায়ুন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলন আর কলকাতা থেকে সমরেশ মজুমদার। তারা পৌঁছে গেছে আমার আগেই, যে হোটেলে রয়েছে, সেখানকার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামবার সময় আমার চশমাটা খুলে পড়ে গেল ফুটপাথে।

লেনস দুটি অক্ষত থাকলেও ফ্রেমটাই ভেঙে গেছে, সেটা আর ব্যবহার করা যাবে না!

একবার মানিব্যাগ হারাচ্ছি, একবার চশমা ভাঙছে, এ ধরনের ট্যালামি আমায় পেয়ে বসল কী করে? সত্যি-সত্যি বুড়ো হয়ে গেলাম?

নিজের ওপর এমনই রাগ হল যে তখনই অস্ফুট স্বরে শপথ নিয়ে নিলাম, যদি এর পর এরকম আর একটা ভুল হয়, তাহলে এ-ভ্রমণ অসমাপ্ত রেখে দেখে ফিরে যাব!

অনেক দিনের জন্য বাইরে বেরুলে দ্বিতীয় একটা চশমা সঙ্গে রাখতেই হয়। আমার দ্বিতীয় চশমাটি অনেক দিনের পুরোনো, লেনসের পাওয়ার কম, তাতে একটু ঝাঁপসা- ঝাঁপসা দেখি, কোনও রকমে কাজ চলে। তা হলে কি বাকি দিনগুলি আমাকে ঝাঁপসা দৃষ্টিতে কাটাতে হবে?

বিশ্বজিতের স্ত্রী রুমা অবশ্য বিশেষ যত্ন নিয়ে নিউ ইয়র্ক ছাড়ার আগেই আমাকে ফ্রেমটা বদল করে নতুন চশমা করিয়ে এনে দিয়েছিল।

নিউ ইয়র্কে বাংলা বইয়ের মেলা? তাতেই বোঝা যাবে, কত বাঙালি গিয়ে থিতু হয়েছে সেখানে। বলাই বাহুল্য, তাদের মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যাই পশ্চিমবঙ্গীয়দের তুলনায় অনেকগুণ বেশি। শুধু তাই-ই নয়, বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি রক্ষা ও মর্যাদা বাড়াবার কাজে বাংলাদেশিদেরই উদ্যম বিদেশের বহু শহরে চোখে পড়ে।

নিউ ইয়র্ক থেকেই বাংলা পত্রিকা বেরোয় অন্তত ন’খানা, সব কটাই বাংলাদেশিদের, পশ্চিমবঙ্গীয়দের একটাও না। এবং সেসব পত্রিকা নিছক শখের বা লিটল ম্যাগাজিন নয়, সংবাদপত্রও আছে। সেরকম দু-তিনটি সংবাদপত্র কার্যালয় দেখতে গিয়েছিলাম, রীতিমতন কম্পিউটার ও ফটোগ্রাফি বিভাগ সমেত আধুনিক অফিস, সেখানে যে কয়েকজন কর্মী কাজ করেন, সেটাই তাঁদের জীবিকা।

প্রতি বছর উত্তর আমেরিকার কোনও না কোনও বড় শহরে বিশাল আকারে একটি বঙ্গ সম্মেলন হয়, তার উদ্যোক্তা পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালিরা। এ সম্মেলনের প্রায় শুরু থেকে আমি অনেকবারই দেখেছি, লক্ষ করেছি, ক্রমশই সেই বঙ্গ-যজ্ঞে থিয়েটার-নাচ-গান-বাজনার প্রাধান্য বাড়ছে, সাহিত্য হয়ে যাচ্ছে গৌণ। বাংলাদেশিরাও আলাদাভাবে এরকম বড়-বড় সম্মেলনের আয়োজন করে। সেখানে গায়ক-গায়িকাদের তুলনায় লেখক-লেখিকাদের ভূমিকা ও সম্মান কিছুমাত্র কম নয়।

মনে পড়ে, অনেককাল আগে শিকাগোর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে একটা বইয়ের দোকানের কাঁচের জানলায় একটি বইয়ের মলাটের বাংলা অক্ষর দেখে রোমাঞ্চে আমার শরীরে শিহরণ হয়েছিল। সেটি এডোয়ার্ড ডিমক অনূদিত ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর, থিফ অফ লাভ’, মলাটে ব্যবহৃত হয়েছিল কয়েকটি বাংলা অক্ষর। আমেরিকায় বসে বাংলা বই, পত্র-পত্রিকা সংগ্রহ করার একমাত্র উপায় ছিল অনেক বেশি ব্যয়ে দেশ থেকে আনানো। এখন কত বটল ঘটে গেছে। বাংলা বই ও ক্যাসেট তো অনেক জায়গায় পাওয়া যায়ই, জ্যাকসন হাইটের কয়েকটি রাস্তায় বাংলাদেশিরা তাদের দোকানের সাইনবোর্ডেও ব্যবহার করে বাংলা ভাষা। টিউব ট্রেনে যেতে যেতে দেখা যায়, কেউ-কেউ স্থানীয় বাংলা কাগজ পড়ছে। লন্ডনের মতন নিউ ইয়র্কেও অনেক স্কুলে বাংলা পড়াবার ব্যবস্থা আছে।

সবচেয়ে বেশি চমক লেগেছিল টেলিফোনে। ভুল নাম্বার ডায়াল করলে কিংবা কোড নাম্বার ভুল করলে রেকর্ড বা সংশোধনীবাণী শোনাবার ব্যবস্থা প্রায় সব দেশেই আছে। নিউ ইয়র্কে সেরকম একটা ভুল টেলিফোন করে শুনতে পেলাম বাংলায় নির্দেশ। ইংরিজিও আছে অবশ্যই, ইংরিজি ও বাংলা পরপর বলে যাচ্ছে।

আমার এবারের স্বল্পস্থায়ী নিউ ইয়র্ক অবস্থানে সব বন্ধুদের বাড়িতে যাওয়া সম্ভব নয়। শুধু এক বিকেলে গিয়েছিলাম যামিনীদা ও সুমিত্রা মুখখাপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে। আর এক সন্ধেবেলা বড় আকারের জমায়েত হয়েছিল মীনাক্ষী ও জ্যোতির্ময় দত্তের বাড়িতে। এসেছিলেন করবী ও মণি নাগ, নূপুর লাহিড়ি ও অ্যান্ডঅর, প্রীতি সেনগুপ্ত, স্নিগ্ধা মুখোপাধ্যায়, তনুশ্রী ভট্টাচার্য, আরও অনেকে, অনেক গান ও হাসিঠাট্টার অট্টরোল হল, কেন জানি না, আমি ঠিক মন বসাতে পারছিলাম না, ভেতরে-ভেতরে একটা অস্থিরতা কাজ করছিল, তাও কীসের জন্য, বোঝার উপায় নেই।

যেন আমার জীবনে একটা পরিবর্তন অবধারিতভাবে আসন্ন। নিউ ইয়র্কে গিয়ে একবার অন্তত গ্রিনিচ ভিলেজে না যাওয়ার কোনও মনে হয় না। গৌতম দত্ত, মহুয়া চৌধুরী ও সৌবীর আমাকে ও সমরেশকে নিয়ে গেল শেষ রাত্রিটিতে। সাত-আট মাস আগেও আমি একবার এসেছিলাম এখানে। যত বারই আসি, খুব বেশি করে অ্যালেন গিনসবার্গের কথা মনে পড়ে। অ্যালেনই একমাত্র আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান কবি, যার সঙ্গে কলকাতার সম্পর্ক ছিল তার জীবনের প্রায় শেষ দিন পর্যন্ত।

দেখতে-দেখতে অ্যালেনের মৃত্যুর পর চার বছর কেটে গেল। এই ভিলেজের রাস্তায়-রাস্তায় অ্যালেনের সঙ্গে কতবার হেঁটেছি। আমার চিঠি লেখার অভ্যেস খুব কম, তবু অ্যালেন হঠাৎ হঠাৎ চিঠি পাঠালে তার উত্তর দিতাম, ১৯৯৭ সালে ওকে লিখেছিলাম, আমি শিগগিরই আবার আসছি, তুমি সেই সময় নিউ ইয়র্কে থাকবে তো? অ্যালেন অনেক সময় কলোরাডোর বোল্ডার শহরের কাছে নারোপা বৌদ্ধ মহাবিদ্যালয়ে অধ্যয়ন, অধ্যাপনা ও ধ্যান করতে যেত। আমার চিঠির উত্তরে সে লিখল, হ্যাঁ, আপাতত নিউ ইয়র্কে আছি, তুমি সরাসরি এসে আমার অ্যাপার্টমেন্টে উঠবে। আমার আসতে একটু দেরি হয়েছিল, তার আগেই শেষ নিশ্বাস ফেলে চলে গেল সে। মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে অ্যালেন তার শেষতম কবিতাটি লেখে, তার নাম Things Ill not do (Nostalgias)। জীবনে আর কী-কী করতে পারবে না সেই তালিকা দিতে দিতে অ্যালেন এক জায়গায় লিখেছে, ‘Or return to have Chat older Sunil & te young Coffee shop Poets.’ মনে পড়েছিল কলকাতা ও তার বন্ধুদের কথা?

অ্যালেন, পিটার অরলভস্কি আর গ্রেগরি করসোর সঙ্গে যেবার প্রথম এসেছিলাম এই গ্রিনিচ ভিলেজে, তখন এ জায়গাটা ছিল কত ফাঁকা-ফাঁকা, দোকানপাট অনেক কম, গরিব পাড়া বলে যত রাজ্যের বাউণ্ডুলে কবি-শিল্পীরা এখানে এসে আস্তানা গেড়েছিল। মাঝে-মাঝে সারারাত ধরেও চলত শিল্পের পাগলামি। তারপর তাদের দেখার জন্য আস্তে-আস্তে পর্যটকদের ভিড় জমতে থাকে। এখন শুধু পর্যটকদেরই গিজগিজে ভিড়। অজস্র রেস্তোরাঁ, কবি-শিল্পীরা অদৃশ্য হয়ে গেছে।

লস অ্যাঞ্জেলিসে যাওয়ার সময় আবার একটি কাণ্ড হল।

হুমায়ুন আমেদ আর সমরেশ মজুমদারেরও যাওয়ার কথা থাকলেও ওদের দেশে ফিরে যেতে হল বিশেষ কারণে। তবে ইমদাদুল হক মিলন আর বিশ্বজিৎ এবং মঝহারুল ইসলাম সমেত প্রকাশকদের একটি দলের সঙ্গী হব আমি। মিলন খুব ভালো ভ্রমণসঙ্গী, দুজনে আগেও গেছি নানান জায়গায়। এবারে দলবল মিলে এয়ারপোর্টে আসা হল, মালপত্র চেক-ইন আর বোর্ডিং কার্ডও প্রত্যেকের হাতে, বিমানের গেট পর্যন্ত পৌঁছতে হল অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে, কারণ জে এফ কে বিমানবন্দরটির অনেক অংশ ভেঙেচুরে আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়া চলছে।

একেবারে শেষ গেটের সামনে, বিমানে ওঠার মুখে বিমানকর্মীরা আটকে দিল আমাদের। মিলন-বিশ্বজিৎদের টিকিটগুলি কনফার্মেশন নাকি ঠিক নেই, একমাত্র আমারটি ও.কে.। সুতরাং

আমি ভেতরে যেতে পারি, ওদের অপেক্ষা করতে হবে।

চেক-ইনের সময় কিছু বলল না, মালপত্র ওজন, এক্স-রে, বোর্ডিং পাস দেওয়ার পরেও এরকম আপত্তি? সাহেবদের দেশে এমন অব্যবস্থা আগে দেখিনি।

আমি ভেতরে গিয়ে নির্দিষ্ট আসনে বসলাম, মনে হল, ওদের নিশ্চিত একটুপরেই ছেড়ে দেবে, ওদের মালপত্রও তো তোলা হয়ে গেছে।

ক্রমে বিমানটি অন্য যাত্রীতে ভরে গেল, ওরা কেউ আসতে পারল না।

আবার আমি একা।

বিমানটি আকাশে ওড়ার পর হঠাৎ খেয়াল হল, আমি কোথায় যাচ্ছি? লস অ্যাঞ্জেলিসের বইমেলার উদ্যোক্তাদের কারুকে আমি চিনি না, কারুর নামও জানি না, সব যোগাযোগ হয়েছে বিশ্বজিতের মারফত। কোথায় উঠব, সে সম্পর্কেও কোনও ধারণা নেই।

যদি আমাকে কেউ ওখানকার এয়ারপোর্টে নিতে না আসে?

এবারে জানলার ধারে একটা আসন পেয়েছি বটে, কিন্তু রাত হয়ে গেছে, আকাশ দেখা যাবে না। বিমানের মধ্যে আলো জ্বলে বলে বাইরের অন্ধকারও দেখার উপায় নেই, ভেতরের প্রতিচ্ছায়ই থাকে বাইরে।

তবু তো জানলা। বিমানটির অবতরণের সময়ে তো অন্তত দেখা যাবে আলোকোজ্জ্বল মহানগরী। বিন্দু বিন্দু জোনাকির মতন আলো ক্রমশ হয়ে ওঠে দীপাবলি। যতবার দেখি, পুরোনো হয় না।

তা হলেও বারবার অমার ওই একই কথা মনে হতে লাগল। যদি কেউ আমায় নিতে না আসে? লস অ্যাঞ্জেলিস একটা বিতিকিচ্ছিরি রকমের লম্বা শহর, আগে কয়েকবার এলেও রাস্তাঘাট চিনি না। বিমানটি পৌঁছবে অনেক রাতে, তখন আমি কোথায় যাব? বিশ্বজিৎ অবশ্যই ওখানকার কারুকে টেলিফোনে জানাবে। যদি ভুলে যায়? টেলিফোনে যদি না পায়? লস অ্যাঞ্জেলিস শহরে আমার নিজস্ব কোনও বন্ধুও নেই।

বই পড়ায় মন বসছে না, অন্য কোনও কথাও ভাবছি না, শুধু ওই এক দুশ্চিন্তা। এক সময় নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হল।

কেউ বিমানবন্দরে আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে না এলেও কী আসে যায়! আমি কি সাঁতার না জানা বাচ্চা ছেলে যে জলে পড়ব?

একা একা অনেক অচেনা বিদেশি শহরে যাইনি এর আগে? যেমন ইস্তানবুলে, যেমন কায়রোতে, যেমন রোমে, যেমন ব্যাংককে। ওসব জায়গায় এয়ারপোর্টে কেউ নিতেও আসেনি, পরেও কারুর সঙ্গে পরিচয় হয়নি।

এই লস অ্যাঞ্জেলিসেই জীবনে প্রথমবার আসার সময় পরিচিত কেউ ছিল না, শুধু শহরটা দেখব বলেই চলে এসেছিলাম আইওয়া থেকে। তখন ট্যাক্সি নেওয়ার মতন বিলাসিতা করারও সামর্থ্য ছিল না, এয়ারপোর্ট থেকে বাসে চেপে গিয়েছি সিটি সেন্টারে, তারপর একটা সস্তার হোটেল খুঁজে নিয়েছি। রোমহর্ষক সেই হোটেল-অভিজ্ঞতা।

সস্তার হোটেল, তাতেও আরও সস্তার ঘর পাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে কাউন্টারের লোকটি বলেছিল, যে-দুটি মাত্র ঘর খালি আছে, সে দুটিই সুইট, সেইজন্য ভাড়া দ্বিগুণ, তোমাকে একটা ঘর দিতে পারি, তার ভাড়া অর্ধেকেরও কম।

কেন আমার প্রতি এই বিশেষ উদারতা? একটা ঘর কোনও একজন ব্যক্তি তিন মাসের জন্য টাকা দিয়ে ভাড়া নিয়ে রেখেছে, মাঝে-মাঝেই সে থাকে না। কিন্তু ঘরটাও ছাড়ে না। তবে সেই ক’টা দিনের জন্য হোটেলের মালিক যদি ঘরখানা অন্য কাউকে ভাড়া দেয়, তাতে তার আপত্তি নেই। আমার ভাড়া অনেক কম লাগবে বলে আমি তাতেই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।

ঘরে ঢুকেই চক্ষুস্থির। মূল ভাড়াটের বহু জিনিসপত্র সারা ঘরে ছড়ানো। তার আন্ডার প্যান্ট থেকে আধা ভরতি মদের বোতল পর্যন্ত। (মদের বোতল কখনও অর্ধেকটা খালি বলতে নেই) লোকটির স্বভাব খুবই এলোমেলো নিশ্চিত, জামা-প্যান্ট ইত্যাদি যেন ছুঁড়ে-ছুঁড়ে যেখানে সেখানে ফেলা রয়েছে। শুধু বিছানাটা ব্যবহারযোগ্য।

প্রথম মধ্যরাতেই দরজায় করাঘাতে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। বেল নয়, দুম দুম করাঘাত। দরজা খুলেই দেখি এক বিশালকায় ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে, সত্যজিৎ রায়ের চেয়েও লম্বা, চওড়াতেও তাঁর চেয়ে ঢের বেশি। মুখ ভরতি দাড়ি, তার কাঁধে ঝোলানো গিটারের মতন কিছু একটা বাদ্যযন্ত্র। সে ক্রিয়াপদবর্জিত ইংরিজি বলতে লাগল, যেমন, হু ইউ? মাই রুম দিস! এবং তার প্রতিটি বাক্যে প্রচুর হুইস্কির গন্ধ মেশানো।

ভয়ে আমার বুক তো কেঁপে উঠতেই পারে। প্রথমেই মনে হল, লোকটি যদি বলে, তার কোনও জিনিস আমি চুরি করেছি? তার মদের বোতল থেকে চুমুক দিয়েছি? (দিইনি, তার কোনও জিনিসই ছুঁইনি।) দোষ আমার নয়, হোটেল মালিকের, কিন্তু বেশি রাতে কাউন্টারে কেউ থাকে না, তা ছাড়া এই মাতাল কি আমার কোনও কথা বুঝবে? এ আমাকে তুলে আছাড় মারলেও বাধা দেওয়ার উপায় নেই।

পরিণতিটি সেরকম ভয়াবহ হয়নি শেষ পর্যন্ত। মিনমিন করে তাকে জানিয়ে দিলাম যে সে সাত দিনের আগে ফিরবে না বলে হোটেলের ম্যানেজার আমাকে এই ঘরে থাকতে দিয়েছে। তোমার আপত্তি থাকলে আমি এক্ষুনি বেরিয়ে গিয়ে অন্য হোটেল খুঁজে নিতে পারি। তোমার জিনিসপত্র সব বুঝে নাও।

লোকটি আমার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থাকে, দুলতে-দুলতে বলল, অ্যানাদার হোটেল? অ্যাট দিস আওয়ার?নট সেইফ ম্যান।

তারপর জিগ্যেস করল, তুমি কোন দেশের লোক?

লোকটি একজন উঠতি গায়ক। সেই সময়টায় আমেরিকান গায়ক-শিল্পী-কবিরা ভারতীয়দের সম্পর্কে কিছুটা দুর্বলতা পোষণ করত। তখন ভারতের দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার দিকে এরা আকৃষ্ট হচ্ছে অনেকেই।

রাত্তিরের লস অ্যাঞ্জেলিসের রাস্তা রীতিমতন বিপদসঙ্কুল, তাই লোকটি আমাকে তো বেরুতে দিল না বটেই, সে রাতটা তার ঘরে থেকে যেতে বলল। কাঁধের ঝোলা থেকে বার করল স্যান্ডুইচ, আর তার মদের বোতলেও ভাগ নেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল বারবার।

প্রায়ই এই ধরনের অভিজ্ঞতা আমার আরও বেশ কয়েকবার হয়েছে। তবে, এবারে আমি ভয় পাচ্ছি কেন? বয়েস বেড়েছে বলে গেরেমভারি হয়েছি? খাতির-যত্ন পাওয়ার অভ্যেস হয়ে গেছে? এরকম অভ্যেস হওয়া মানেই পর্যটকের মৃত্যু। তা হলে একা-একা ঘোরাঘুরি এবার থামাতে হবে।

নিজেকে বকুনি দিয়ে বোঝালাম, এত চিন্তার কী আছে?

এখন বাসের বদলে ট্যাক্সি করতে পারি, খুব সস্তার বদলে ভদ্রগোছের মাঝারি হোটেলে এক রাত থাকার মতন টাকাও আছে, কাল সকালে ফোন-টোনে যোগাযোগ হবেই।

লস অ্যাঞ্জেলিসে নেমে বিমানবন্দরে ফুলের তোড়া হাতে অপেক্ষমাণ কাউকে দেখতে পেলাম না। আমার নাম লেখা বোর্ড হাতে নিয়েও দাঁড়িয়ে নেউ কেউই।

আগের থেকে মনস্থির করে ফেলেছি বলে হতাশা জাগল না।

নিজের সুটকেসটা সংগ্রহ করার জন্য এগিয়ে চলেছি নির্দিষ্ট স্থানটির দিকে, কখন যেন অলক্ষে একটি যুবক পাশে এসে পড়ে বলল, সুনীলদা তো? আপনার হ্যান্ডব্যাগটা আমাকে দ্যান!

সে আমাকে চিনল কী করে, সে প্রশ্ন অবান্তর। এই ফ্লাইটে আমিই ছিলাম একমাত্র অশ্বেতাঙ্গ যাত্রী।

যুবকটির নাম শাহিন। তার বাড়িতেই আমার থাকার ব্যবস্থা।

গাড়িতে উঠে শাহিন বলল, আপনাকে একটা সারপ্রাইজ দেব। এটা শুনুন।

সে চালিয়ে দিল একটা ক্যাসেট। তাতে শোনা গেল স্পষ্ট, সুমিষ্ট গলায় একটি কবিতার আবৃত্তি। কেউ কথা রাখেনি।