০৪. পুলিশের বুটের আওয়াজ

একটু পরেই সমস্ত বগি জুড়ে শোনা গেল পুলিশের বুটের আওয়াজ। গার্ডসাহেব হাতে একটা লণ্ঠন নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে লাগলেন। অনেক যাত্রী একসঙ্গে উত্তেজিতভাবে ডাকাতদের বিবরণ দিতে লাগল, কারও কথাই ঠিকমতন বোঝা যায় না।

দুজন পুলিশ যখন এই কিউবিল-এ উঁকি মারল, কাকাবাবু তখন ঘুমের ভান করে রয়েছেন, সন্তু আর জোজো বই খুলে বসে আছে, ডালিমকুমার আংটিগুলো আবার আঙুলে পরে ফেলে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখছেন।

পুলিশরা জিজ্ঞেস করল, আপনাদের কিছু খোয়া গেছে?

জোজো আর ডালিমকুমার বলে উঠলেন, না, না কিচ্ছু না!

পুলিশরা আবার জিজ্ঞেস করল, আপনাদের এখানে কেউ ঢোকেনি?

জোজো বলল, কেউ না। আমরা কিছু টের পাইনি। বাইরে চেঁচামেচি শুনেছি। কী হয়েছিল বলুন তো?

উত্তর না দিয়ে পুলিশরা চলে গেল। একজনকেও ধরতে পারেনি বলে তারা বেশ নিরাশ হয়েছে। ডাকাত ধরতে পারলে পুলিশদের বেশ লাভ হয়।

বেশ কিছুক্ষণ পরে আবার চলতে শুরু করল ট্রেন। কাকাবাবু উঠে বসে বললেন, যাক বাঁচা গেল, আমাকে মিথ্যে কথা বলতে হল না। সন্তু, এবার দরজা বন্ধ করে দে, আর ছেলেটাকে বেরিয়ে আসতে বল। ওখানে ওর দমবন্ধ হয়ে যাবে।

ডাকাত ছেলেটি মুখের রুমালটা খুলে ফেলেছে, এখন আর তাকে ডাকাত মনে হয় না, মনে হয় সাধারণ একটি যুবক। তেমন লম্বা-চওড়া নয়, দাড়ি-গোঁফ নেই, মাথার চুল অবশ্য খুব বড়-বড়। থুতনিতে একটা কাটা দাগ। সন্তুদের পাশে সে বসল।

ডালিমকুমার বললেন, রায়চৌধুরীবাবু, আপনার এই ভাইপোটি তো খুব সাঙ্ঘাতিক ছেলে। জুডো ক্যারাটে-ফ্যারাটে সব জানে। জাপানিদের কাছে শিখেছে নাকি?

কাকাবাবু বললেন, না, নিজে নিজেই শিখেছে। বইটই পড়ে প্র্যাকটিস করেছে। ওর ভরসাতেই তো আমি বাইরে বেরোই!

জোজো বলল, আর আমি কীরকম চেন টেনে দিলাম! পুলিশ ডাকলাম!

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, জোজোর কৃতিত্ব স্বীকার করতেই হবে। এ তো সামান্য ছিচকে ডাকাত, জোজো অনেকবার অনেক বড় বড় বিপদ থেকে আমাদের বাঁচিয়েছে। আচ্ছা ডালিমবাবু, আপনাদের যাত্রায় তো অনেক মারামারির দৃশ্য থাকে। হিরো হিসেবে আপনাকে ফাইট করতে হয়। আপনি তলোয়ার খেলা, ঘুসোঘুসি, বন্দুক চালানো এসব জানেন?

ডালিমকুমার লাজুকভাবে হেসে বললেন, অত কী আর জানতে হয়! পেছন থেকে বাজনা আর আলো দিয়ে ম্যানেজ করে দেয়।

কাকাবাবু বললেন, ইংরিজি সিনেমায় যারা পার্ট করে, তারা কিন্তু ওসব শিখে নেয়।

ডাকাত ছেলেটির দিকে চেয়ে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ও হে, তোমার নাম কী?

ছেলেটি বলল, অংশুমালী দাস। ডাকনাম হেবো। কাকাবাবু বললেন, খবরের কাগজে যত ছোটখাটো চোর-ডাকাতদের নাম দেখি, সব এইরকম, হেবো, কেলো, ল্যাংচা, ভোঁদড়, পচা—সবার এইরকম বিচ্ছিরি-বিচ্ছিরি নাম হয় কেন?

ডালিমকুমার বললেন, ঠিক বলেছেন।

কাকাবাবু বললেন, কিংবা এইরকম বিচ্ছিরি নাম বাপ-মা দেয় বলেই কি এরা চোর-ডাকাত হয়? অংশুমালী তো সুন্দর নাম, তার ডাকনাম হেবো কেন হবে? ওহে অংশু, পুলিশ তো চলে গেছে, তুমি এবার পালাবার চেষ্টা করবে?

অংশু বলল, আজ্ঞে না সার, আপনি যা বলেন তাই শুনব!

কাকাবাবু বললেন, তুমি কি একটা পাইপগান সম্বল করেই ডাকাতি করতে বেরিয়েছ? আমার ভাইপো সন্তু তোমার চেয়ে বয়েসে কত ছোট, তার সঙ্গে গায়ের জোরে পারলে না? কুস্তি-জুডো কিছু শেখোনি?

অংশু বলল, ওসব কথা আর বলবেন না সার। এই কান মুলে বলছি, আজ থেকে ও-লাইন ছেড়ে দিচ্ছি একেবারে!

কাকাবাবু বললেন, এর মধ্যেই ভাল ছেলে! দেশের কী অবস্থা, চোর-ডাকাতরাও শারীরচর্চা করে না! তোমার বাড়িতে কে-কে আছেন?

অংশু সংক্ষেপে তার জীবনকাহিনী জানাল।

সে একজন ছুতোর মিস্তিরির ছেলে। মা সবসময় অসুস্থ থাকে, বাড়িতে সাতটি ভাইবোন। অভাবের সংসার। সে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়ে স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। কোনও চাকরি পায়নি। বাড়ির কাছেই একটা বস্তির কিছু ছেলে তাকে ডাকাতির লাইনে নিয়ে এসেছে। এর আগে দুবার ট্রেন-ডাকাতি করেছে, ধরা পড়েনি।

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, তা হলে তো তোমাকে ঠিক বেকার বলা যায় না। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়েছ, কে চাকরি দেবে? ছুতোর মিস্তিরির ছেলে, তুমি বাবার কাছ থেকে কাজ শেখোনি কেন? কাঠের কাজের খুব ডিমান্ড, অনেক পয়সা রোজগার করা যায়। কেন সে কাজ শেখোনি?

অংশু কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ভাল লাগেনি সার।

কাকাবাবু ধমক দিয়ে বললেন, আসলে তুমি একটা বখা ছেলে। বাজে বন্ধুদের পাল্লায় পড়েছিলে। ভেবেছিলে ডাকাতি করাটাই সহজ। কম পরিশ্রমে বেশি টাকা। ধরা পড়লে পুলিশ মারতে-মারতে হাত-পা ভেঙে দেয় না? এই সন্তুই তোমার একখানা হাত ভেঙে দিতে পারত। ওই পাইপগান দিয়ে কখনও কোনও লোককে গুলি করেছ?

অংশু দাঁড়িয়ে উঠে কাকাবাবুর পা ছুঁতে গিয়ে বলল, না সার, কখনও মানুষ মারিনি, বিশ্বাস করুন, আপনার পা ছুঁয়ে বলছি।

কাকাবাবু আবার ধমক দিয়ে বললেন, পা ছুঁতে হবে না, বলল! তোমাকে আমি একটা চাকরি দিয়ে পরীক্ষা করে দেখব, তুমি ঠিক পথে থাকতে পারো কি না। আপাতত তোমাকে আমাদের সঙ্গে অনেকদূরে যেতে হবে। রাত্তিরে যখন আমরা ঘুমোব, তখন পালাবার চেষ্টা কোরো না, কোনও লাভ হবে না।

জোজো বলল, পালাতে গেলেই ওর একখানা হাত ভেঙে দেওয়া হবে। আমার ঘুম একবারে কুয়াশার মতন পাতলা।

কাকাবাবু বললেন, ডালিমবাবু, আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারেন। একই। রাতে একই ট্রেনে পরপর দুবার ডাকাত পড়ার কোনও বিশ্বরেকর্ড নেই!

ডালিমবাবু তবু অংশুর দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললেন, তবু একে। এতটা বিশ্বাস করা কি ঠিক হবে? যদি ঘুমের মধ্যে গলা টিপে ধরে? কথায় আছে, কয়লাকে একশোবার ধুলেও তার কালো রং যায় না।

কাকাবাবু বললেন, ও সত্যিই কয়লা, না ধুলো-ময়লা-মাখা এমনিই একটা পাথর, সেটা আগে জানা দরকার।

বাকি পথটায় আর তেমন কিছু ঘটল না। সন্তু আর জোজো ভাগাভাগি করে রইল নীচের বার্থে, ওপরের একটা বার্থ ছেড়ে দেওয়া হল অংশুঁকে। টিকিট চেকার আসার পর অংশুর জন্য একটা টিকিট কাটা হল, চারজনের রাত্তিরের খাবার ভাগাভাগি করে খেল পাঁচজন। এমনকী অংশু একবার একলা বাথরুমে গেল, ফিরেও এল।

জব্বলপুর থেকে গাড়ি বদল করে সাতনা যেতে হবে। ডালিমকুমাররা সদলবলে থেকে গেলেন সেখানে। বিদায় নেওয়ার সময় ডালিমকুমার বারবার কাকাবাবু ও সন্তু-জোজোকে বলে গেলেন একবার তাঁদের যাত্রা দেখতে যাওয়ার জন্য। কাকাবাবু বললেন, নিশ্চয়ই যাব, অনেকদিন যাত্রা দেখিনি।

সাতনা স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন কামালসাহেব। নরেন্দ্র ভার্মার কাছ থেকে তিনি টেলিগ্রাম পেয়েছিলেন। তিনি দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন।

কাকাবাবু তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কামাল আতাতুর্ক, কতদিন পর দেখা হল! আমিও এদিকে আসিনি এর মধ্যে, তুমিও কলকাতায় যাওনি।

কামাল বললেন, আমি দুবার গিয়েছিলাম কলকাতায়। আপনার খোঁজ করেছি, দুবারই আপনি বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন।

কাকাবাবু আলাপ করিয়ে দিলেন, এই আমার ভাইপো সন্তু, ওর বন্ধু জোজো। আর অংশু নামে এই ছেলেটি আমাদের পথের সঙ্গী।

কামালসাহেবের চেহারাটি দেখবার মতন। ছ ফুটের বেশি লম্বা, বুকখানা যেন শক্ত পাথরের তৈরি, গায়ের রং বেশ ফরসা। হঠাৎ দেখলে বাঙালি বলে মনেই হয় না। অতবড় শরীর হলেও চোখ দুটি খুব কোমল।

তাঁর ডান দিকের ভুরুর ওপর একটা গভীর কাটা দাগ। ভুরুর খানিকটা উঠেই গেছে। সেদিকে তাকিয়ে খানিকটা অবাক হয়ে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তোমার চোখের ওপরে ওটা কী হয়েছে? আগে তো দেখিনি।

কামাল বললেন, ও একটা ব্যাপার হয়েছে কিছুদিন আগে। আপনাকে পরে বলব।

সবাইকে বাইরে এনে একটা স্টেশান-ওয়াগনে তুললেন কামালসাহেব। নিজেই সেটা চালাতে-চালাতে বললেন, আমার বাড়িতে অনেক জায়গা আছে, আপনারা সেখানেই থাকতে পারতেন। কিন্তু নরেন্দ্র ভার্মা জানিয়েছেন আপনারা গেস্ট হাউসে থাকতে চান। তাও ঠিক করে রেখেছি।

কাকাবাবু বললেন, তোমার বাড়িতে গিয়ে তোমার বউয়ের সঙ্গে দেখা করে আসব, একদিন তার হাতের রান্নাও খাব। তোমার বিয়ের সময় আমি আসতে পারিনি।

কামাল বললেন, আমার দুটি ছেলেমেয়ে, তাদেরও আপনি দেখেননি!

সাতনা শহরটি ছোট হলেও মাঝখানের এলাকাটা বেশ ঘিঞ্জি। অনেক দোকানপাট। গাড়ি, টাঙ্গা, ঠেলাগাড়ি, স্কুটারের যানজট। সেই জায়গাটা পেরিয়ে যাওয়ার পর রাস্তাটা ভারী মনোরম, দুপাশে লম্বা-লম্বা গাছ।

একটা টিলার পাশে অতিথি ভবনটি ঠিক ক্যালেন্ডারের ছবির মতো। সামনে বাগান, ডানপাশে একটা ছোট নদী, কাছাকাছি আর কোনও বাড়ি নেই। এই বাড়িটি ফিকে নীল রঙের দোতলা, দু তলাতেই চওড়া বারান্দা। গেটের দুপাশে দুটি মোটা-মোটা ইউক্যালিপটাস গাছ, সে-গাছের গুঁড়ির রং এমন ফরসা যে, মনে হয় সাহেব গাছ।

কামাল বললেন, এখানেই আপনাদের জন্য রান্নাবান্নার সব ব্যবস্থা আছে। বাইরে যেতে হবে না। অবশ্য যখন ইচ্ছে বেড়াতে যেতে পারেন, সবসময় একটা গাড়ি থাকবে।

একতলার বারান্দায় অনেক বেতের চেয়ার পাতা। কাকাবাবু একটা চেয়ারে বসে পড়ে আরামের নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, আঃ! ভারী ভাল জায়গা। এখানে আমাকে কেউ চেনে না, কেউ বিরক্ত করতে আসবে না। এখানে শুধু গল্প হবে। কামাল, তোমার কাছে আমরা গল্প শুনব।

কামাল লাজুকভাবে হেসে বললেন, আমি কি গল্প জানি!

কাকাবাবু বললেন, আফগানিস্তানের গল্প। এই ছেলেরা শুনতে চেয়েছে। এখন এককাপ করে চা খাওয়াও।

কামাল গলা চড়িয়ে ইউসুফ, ইউসুফ বলে ডাকলেন।

একজন লোক এসে দাঁড়াল, তার মুখে ধপধপে সাদা দাড়ি, চুলও সব সাদা। দেখলে বুড়ো বলে মনে হলেও চেহারাটা বেশ শক্তপোক্ত, টানটান। লুঙ্গির ওপর ফতুয়া পরা।

কামাল বললেন, এই হচ্ছে বিখ্যাত ইউসুফ মিঞা, এর হাতের রান্না খেলে আর ভুলতে পারবেন না। এটা তো কোল ইন্ডিয়ার গেস্ট হাউস, বড়বড় সব অফিসাররা আসেন। তাঁরা ইউসুফের রান্না খেয়ে অনেক সার্টিফিকেট দিয়ে গেছেন।

ইউসুফকে কাকাবাবু হাত তুলে সেলাম জানালেন।

কামাল হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলেন, ইউসুফ, সাহেবরা তো এসে গেছেন। আজ কী খাওয়াবেন?

ইউসুফ বললেন, মোগলাই না ইংলিশ, কোনটা খাবেন বলুন। বাঙালি রান্না ভাত, মাছের ঝোলও করে দিতে পারি।

কাকাবাবু ছেলেদের দিকে তাকাতেই জোজো বলল, মোগলাই!

ইউসুফ বললেন, তা হলে শাহি কাবাব, মুর্গ মশল্লা, বাদশাহি বিরিয়ানি, রোগন জুস, মটন কোপ্তা।

কাকাবাবু হাত তুলে বললেন, অত না, অত না। কোনও ভেজিটে নেই? আমি কোনও সবজি বা তরকারি ছাড়া খেতে পারি না। এখন একটু চা দিন আমাদের।

কামাল বললেন, আপনাদের যা খেতে ইচ্ছে করে তাই-ই অর্ডার করবেন। নরেন্দ্র ভামা জানিয়েছেন, আপনাদের কোনও খরচ লাগবে না। সব তিনি দেবেন। যতদিন ইচ্ছে থাকবেন।

কাকাবাবু বললেন, এ যে দেখছি তোফা ব্যবস্থা। বহুদিন এরকম ছুটি কাটাইনি। কোনও ভাবনাচিন্তা নেই। কামাল, এখান থেকে পান্না কতদূরে?

কামাল বললেন, বেশিদূর নয়। গাড়িতে নিয়ে যাব একদিন।

কাকাবাবু বললেন, জানিস সন্তু, এখানে পান্না নামে যে জায়গাটা আছে—

কাকাবাবু শেষ করার আগেই সন্তু বলল, পান্নায় হিরের খনি আছে। ভারতের একমাত্র হিরের খনি!

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ। সেখানকার মাঠে-মাঠে ঘুরলেও হঠাৎ একটা হিরে পাওয়া যেতে পারে। দ্যাখ যদি তোরা হিরে আবিষ্কার করে ফেলতে পারিস।

জোজো উৎসাহের সঙ্গে বলল, সেখানে কবে যাব?

কাকাবাবু বললেন, আজ বিশ্রাম। আজ কোথাও না।

ইউসুফ একটা ট্রেতে সাজিয়ে পাঁচকাপ চা নিয়ে এলেন। কাকাবাবু একটা কাপ তুলে চুমুক দিয়েই বললেন, এ কী, এ যে দেখছি বাদশাহি চা! শুধু দুধে তৈরি, এলাচ-দারচিনিরও গন্ধ আছে।

কামাল বললেন, আপনাদের জন্য স্পেশ্যাল।

কাকাবাবু বললেন, ইউসুফসাহেব, এতসব বাদশাহি খানাপিনা আমাদের সহ্য হবে না। আমরা সাধারণ মানুষ। আমাকে খুব কম দুধ-চিনি দিয়ে পাতলা চা দেবে। আমি ঘন-ঘন চা-কফি খাই।

কামাল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনারা তা হলে এখন বিশ্রাম নিন। আমি সন্ধের দিকে আসব।

কাকাবাবু বললেন, সেই ভাল, সন্ধের পরই গল্প জমে। আর হ্যাঁ, ভাল কথা। এই অংশু নামের ছেলেটিকে একটা চাকরি দিতে হবে, একটু খোঁজখবর নিয়ো তো!

অংশু চা শেষ করে বাগানে ঘুরছে। কামাল চলে যাওয়ার পর কাকাবাবু ডাকলেন, অংশু, অংশু!

অংশু সাড়া দিল না।

কাকাবাবু আবার ডাকলেন, ও অংশু, এখানে একবার এসো, একটা কথা শুনে যাও!

অংশু তবু ফিরে তাকাল না। কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, কী ব্যাপার, ও শুনতে পাচ্ছে না?

জোজো বলল, বুঝতে পারছেন না, ওর নাম অংশু নয়। আমাদের কাছে। মিথ্যে নাম বলেছে।

কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? সন্তু, ওকে ডেকে আন তো।

সন্তু দৌড়ে গিয়ে ছেলেটির হাত ধরে নিয়ে এল।

কাকাবাবু বললেন, তোমায় অংশু, অংশু বলে ডাকছিলাম, তুমি শুনতে পাওনি?

ছেলেটি বলল, আপনি যেন কাকে ডাকছিলেন, আমি বুঝতে পারিনি যে আমাকেই …

হঠাৎ সে থেমে গেল। কেমন যেন করুণ হয়ে গেল মুখের চেহারা। তারপরে আস্তে-আস্তে বলল, অনেকদিন আমায় কেউ ওই নামে ডাকেনি, সবাই হেবো-হেবো বলে, আমি নিজেই ভুলে গিয়েছিলাম।

কাকাবাবু বললেন, তোমায় কেউ ভাল নামে ডাকে না?

অংশু বলল, না সার। পুলিশের লোকও আমাকে ওই নামেই জানে।

কাকাবাবু বললেন, একটা ভাল নাম যখন রয়েছে, তখন কেউ সে-নামে ডাকবে না, এ ভারী অন্যায়। এখন থেকে তুমি আর হেবো নও, এখানে তোমার ও-নাম কেউ জানে না। এখন থেকে তুমি অংশু। নিজের মনে-মনে বারবার বলবে, আমি অংশু, আমি অংশু। আমার নতুন জীবন শুরু হচ্ছে।

অংশু মাথা চুলকে বলল, সার, আপনি আমাকে একটা চাকরি দেবেন বলেছিলেন।

কাকাবাবু বললেন, ওসব কথা পরে হবে। তোমার পুরো নাম অংশুমালী। এ-নামের মানে জানো?

অংশু কাঁচুমাচু ভাবে বলল, আগে জানতাম বোধ হয়। এখন ভুলে গেছি!

কাকাবাবু বললেন, কী কাণ্ড, একজন মানুষ নিজের নামের মানেই জানে!

কাকাবাবু জোজো আর সন্তুর মুখের দিকে তাকালেন। জোজো সঙ্গে-সঙ্গে বলল, অংশু মানে চাঁদ।

কাকাবাবু হেসে বললেন, আন্দাজে ঢিল মেরেছ। হয়নি কিন্তু। অংশু মানে কিরণ বা রশ্মি। অংশুমালী মানে যার কিরণ বা রশ্মি আছে। চাঁদের কি নিজস্ব রশ্মি বা আলো আছে? সূর্যের আলো চাঁদের পাথরে গিয়ে ঠিকরে পড়ে,

তাই আমরা চাঁদের আলো দেখি।

সন্তু বলল, অংশুমালী মানে সূর্য। জ্যোতির্ময়।

কাকাবাবু বললেন, ওহে অংশু, আর যেন ভুলে যেয়ো না। তুমি হেবো নও, তুমি অংশুমালী, তোমার নামের মানে সূর্য। আচ্ছা অংশু, তুমি কখনও কবিতা লিখেছ?

অংশু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, কী বললেন সার?

জোজো হো-হো করে হেসে উঠল।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তুমি হাসলে কেন জোজো?

জোজো বলল, কাকাবাবু, আপনি মাঝে-মাঝে এমন সব অদ্ভুত কথা বলেন! যে ট্রেনে ডাকাতি করত, সে কবিতা লিখবে? কবিরা কখনও ডাকাত হয়?

কাকাবাবু বললেন, কবিরা ডাকাত হয় না বটে, কিন্তু কোনও ডাকাত যদি ডাকাতি ছেড়ে দেয়, তা হলে সে কবি হতে পারে। কী, পারে না? আমাদের দেশে একজন ডাকাত মহাকবি হননি?

সন্তু কিছু বলতে যেতেই জোজো তার মুখ চেপে ধরে বলল, এই, তুই সব বলবি কেন রে? এটা আমি জানি। রত্নাকর থেকে বাল্মীকি!

কাকাবাবু বললেন, তবে? শোনো অংশু, তোমাকে চাকরির জন্য চিন্তা করতে হবে না। আমি যখন কথা দিয়েছি, এখানেই তোমার একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়ে যাবে!

অংশু ফ্যাকাসে মুখে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, এখানে? না, না সার, এতদূরে আমি চাকরি করতে পারব না!

কাকাবাবু বললেন, কেন পারবে না? পঞ্জাবিরা পঞ্জাব থেকে কলকাতায় এসে কতরকম কাজ করে। উত্তরবঙ্গে জঙ্গলের মধ্যে দেখবে একজন মাড়োয়ারি দোকান খুলে বসে আছে। গুজরাতিরা আফ্রিকায় ব্যবসা করতে যায়। আর বাঙালিরা ঘরকুনো হয়ে বসে থাকবে? এই দ্যাখো না, কামালও

তো বাঙালি, সে এখানে থেকে গেছে।

অংশু বলল, আমি পারব না। আমার অসুবিধে আছে। বাড়িতে ছোট-ছোট ভাইবোন, তাদের টাকা দিয়ে আমি সাহায্য করি

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ট্রেনে ডাকাতি করে তাদের টাকা দিয়েছ?

অংশু বলল, হ্যাঁ, দিয়েছি।

কাকাবাবুর মুখ এবার কৌতুকের হাসিতে ভরে গেল। তিনি বললেন, এ যে দেখছি সত্যিই রত্নাকর! তুমি ভাইবোনদের কিংবা বাবা-মাকে বলেছ যে ডাকাতি করে টাকা রোজগার করো?

অংশু সবেগে দুদিকে মাথা নাড়ল।

কাকাবাবু বললেন, যদি বলতে, দেখতে, ওরা তোমাকে ঘেন্না করত! যাই হোক, তোমাকে এখানেই চাকরি করতে হবে। যদি না চাও, তা হলে তোমাকে পুলিশের হাতে তুলে দেব। কোনটা চাও, বেছে নাও।

অংশু চুপ করে রইল।

কাকাবাবু আবার বললেন, তার আগে কিছুদিন তোমাকে পরীক্ষা করা দরকার। তোমার স্বভাব শুধরেছে কিনা সেটা জানতে হবে তো! সেইজন্য এক কাজ করো, তুমি কবিতা লিখতে শুরু করো।

অংশু এবার রীতিমতো ভয় পেয়ে দু হাত নেড়ে বলতে লাগল, পারব না সার। পারব না। কবিতা কাকে বলে আমি জানিই না!

কাকাবাবু ধমক দিয়ে বললেন, আলবাৎ তোমাকে পারতেই হবে। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত যখন পড়েছ, তখন কবিতা পড়োনি? শোনো, তোমাকে আমি একটা লাইন বলে দিচ্ছি। তুমি পরের লাইনটি মিলিয়ে লিখবে। বনের ধারে কেউ ডেকেছে, নাচছে দুটো উল্লুক, এর পরের লাইনটা তুমি ভাবো।

জোজো বলল, উল্লুকের সঙ্গে মেলাতে হবে। বেশ শক্ত আছে।

কাকাবাবু জোজোকে বললেন, এই, তোমরা কেউ কিছু বলবে না। ওকে সাহায্য করবে না। অংশু, তোমাকে আমি তিনদিন সময় দিলাম!