০৪. ঘুম থেকে ওঠার পর

ঘুম থেকে ওঠার পর অংশুমান চৌধুরী প্রথমে খানিকক্ষণ গড়গড়া টানলেন। জানলা দিয়ে বাইরের মেঘলা আকাশ দেখা যাচ্ছে। একটু পরেই, জোর বৃষ্টি সামবে। অংশুমানের মুখে একটা খুশি-খুশি ভাব ফুটে উঠল। বৃষ্টি পড়লে তাঁর মেজাজ ভাল থাকে।

তিনি হাঁক দিলেন, ভীমু! ভীমু!

বারান্দার দিকের দরজা খুলে একটি রোগা ছোটখাটো চেহারার লোক উঁকি মেরে জিজ্ঞেস করল, স্যার, কিছু বলছেন?

অংশুমান হাতছানি দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, একটু ভেতরে এসে বসো তো!

লোকটি ঘরের মধ্যে ঢুকে বসল না, কাচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে রইল। এই লোকটির চেহারা একসময় ছিল খুব গাঁট্টাগোট্টা, তখন এর নাম ছিল ভীমরঞ্জন ঘোষ। তারপর কী একটা অসুখে পড়ে রোগা টিংটিং-এ হয়ে গেছে। এখন আর ভীম নামটা মানায় না বলে অংশুমান ওকে ভীমু বলে ডাকেন।

অংশুমান গড়গড়ার নলে আবার টান দিয়ে বললেন, আচ্ছা ভীমু, ওই যে রাজা রায়চৌধুরী নামে লোকটা, যাকে সবাই আজকাল কাকাবাবু বলে ডাকে, তার ওপর তোমার দুদিন ধরে ওয়াচ রাখতে বলেছিলুম। এবারে বলো, কী কী দেখলে।

ভীমু ঘোষ পকেট থেকে কয়েকটা কাগজ বার করে চোখ বোলাতে বোলাতে বলল, স্যার, ওই লোকটা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে জেগে বই পড়ে।

অংশুমান বললেন, প্রথমেই রাত্তির দিয়ে শুরু করলে, বাবা! তা তুমি কী করে জানলে ও রাত জেগে বই পড়ে? তুমি কি ওই ঘরে ঢুকে দেখেছ?

ভীমু খুব লজ্জা পেয়ে বলল, না, স্যার, ঘরে ঢুকে দেখিনি, তবে, ওদের বাড়ির সামনের রাস্তায় রাত একটা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করে দেখেছি, ওই রাজা রায়চৌধুরীর ঘরে তখনও আলো জ্বলছে।

আলো জ্বললেই যে বই পড়বে, তার কী কোনও মানে আছে? ভাইপোর সঙ্গে ক্যারাম খেলতে পারে! যাক গে যাক, আর কী দেখলে?

ভোরবেলা মর্নিংওয়াকে যায়।

অনেক রাত পর্যন্ত জাগে, আবার ভোরে হাওয়া খেতে বেরোয়? সন্দেহজনক, খুবই সন্দেহজনক!

স্যার, ওই রাজা রায়চৌধুরী প্রতিদিন সকালে পার্কের একটা কোণের ছোট চায়ের দোকানে চা খায়।

এটা খুবই বোকামি করে। ইচ্ছে করলেই যে-কেউ ওর চায়ে একদিন বিষ মিশিয়ে দিতে পারে, তাই না?

দেব স্যার; দেব? আমি কালই ওকে খতম করে দিতে পারি।

ভীমুর চোখ-মুখ উত্তেজিত হয়ে উঠল। যেন এতক্ষণে সে একটা সত্যিকারের কাজের কথা শুনেছে।

অংশুমান হাসতে হাসতে বললেন, আরে না, না। তোমাকে তো আগেই। বলে দিয়েছি, ওই রাজা রায়চৌধুরীর গায়ে আঁচড়টি না লাগে, তা দেখবে! রাজা রায়চৌধুরী বেঁচে না থাকলে আমি আমার অপমানের শোধ নেব কী:করে?

ভীমু বলল, আপনি যে বিষ মিশিয়ে দেওয়ার কথা বললেন, স্যার?

আমি বিষ মেশানোর কথা বলিনি। বললুম, অন্য যে-কেউ বিষ মিশিয়ে দিতে পারে। সেরকম যাতে কেউ না দেয়, তুমি দেখবে। তারপর বলো?

বইয়ের দোকানে গিয়ে খালি ম্যাপ কেনে। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়েও ম্যাপ দেখে।

হুঁ, তারপর?

ক্রাচ নিয়ে হাঁটে, ইচ্ছে করলে জোরে হাঁটতে পারে। কিন্তু দৌড়তে পারে না।

এটা তুমি ভারী নতুন কথা বললে! ক্রাচ বগলে নিয়ে কেউ দৌড়তে পারে নাকি? ক্রাচ কি র-পা?আর কী আছে বলো?

আর কিছু নেই।

ভীমু, এ কাজে দেখছি তোমাকে রিটায়ার করিয়ে দিতে হবে। দুদিন ঘুরে তুমি মোটে এই খবর জোগাড় করলে? ওদের বাড়িতে কুকুর আছে কি না খোঁজ নিয়েছ?

হ্যাঁ, স্যার, কুকুর আছে। ওই ভাইপোটার পোেষা। সেই কুকুরের নাম রকুকু।

এই খবরটাই তুমি এতক্ষণ বলোনি? এই জন্যই তো আমি নিজে ওখানে যেতে পারব না। কী ঝামেলা বলো তো? আচ্ছা, সন্ধের দিকে রায়চৌধুরী কোথায় যায়, তা খবর নিয়েছ?

হ্যাঁ, স্যার, দুদিনই দেখলাম, সন্ধেবেলা ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে বেরোচ্ছেন। তারপর হেঁটে-হেঁটে ময়দানের দিকে যান।

বাঃ বাঃ! খুব খবর। এটা ভাল খবর। ভীমু, গাড়ি বার করতে বলো। আজ আমি বেরোব। প্রায় দশদিন বোধহয় বাড়ির বাইরে যাইনি, তাই না?

বড় জোর বৃষ্টি নেমেছে।

সেই জন্যই তো। যত বৃষ্টি, তত ভাল। তুমি তৈরি হয়ে গাড়িতে বসো। আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে নীচে নামছি।

ভীমু বেরিয়ে যেতেই অংশুমান ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। একটা ছোট্ট আলমারি খুলে বার করলেন নকল দাড়ি-গোঁফ, পরচুল। সেগুলো যত্ন করে লাগিয়ে মুখ দেখলেন আয়নায়। এখন তাঁর চেহারা সম্পূর্ণ বদলে গেছে, বয়েসও মনে হচ্ছে। অনেক কম।

পাজামা ও পাঞ্জাবি পরে, হাতে একটা রূপোবাঁধানো ছড়ি নিলেন, পায়ের জুতোটা কাপড়ের।

অংশুমানের গাড়িটা আলাদা ধরনের। সমস্ত কাঁচে সবুজ রং করা। ভেতরে বসলে বাইরের রাস্তার কিছুই দেখা যায় না। গাড়ি চলার সময় সমস্ত কাঁচ বন্ধ থাকে, যাতে রাস্তার কোনও কুকুর-বেড়াল দেখতে না হয়।

গাড়ির ড্রাইভারের নাম গুঙ্গা। সে আবার বোবা। তার বয়েস তেইশ চব্বিশের বেশি নয়। বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা। বাচ্চা বয়েসে এই ছেলেটা রেল-স্টেশনে ভিক্ষে করত। অংশুমান ওকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে মানুষ করেছেন। তারপর ও লেখাপড়া শিখতে পারবে না বুঝে ওকে গাড়ির ড্রাইভারি শিখিয়েছেন। ভাল খাওয়া-দাওয়া করে ছেলেটার স্বাস্থ্য ফিরে গেছে।

গাড়িটা এসে থামল চিড়িয়াখানার সামনে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। এখানে আজ আর একটাও গাড়ি নেই। চিড়িয়াখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কোনও লোকজনও দেখা যাচ্ছে না।

অংশুমান ঘড়ি দেখে বললেন, সওয়া-সাতটা। রোজ কটার সময় তুমি রাজা রায়চৌধুরীকে বেরোতে দেখেছ?

ভীমু বলল, সাড়ে সাতটা থেকে আটটা।

তাহলে অপেক্ষা করে দেখা যাক। যদি এই বৃষ্টির জন্য আজ আগেই চলে যায়?

স্যার, বৃষ্টি পড়ছে অনেকক্ষণ ধরে।

তা ঠিক।

অংশুমান একটা পাইপ ধরিয়ে টানতে লাগলেন।

মিনিট পনেরো বাদে বৃষ্টি একটু ধরেই এল। একেবারে থামল না, টিপিটিপি পড়ে চলল।

একটু বাদে দেখা গেল, ন্যাশনাল লাইব্রেরির বড় গেট দিয়ে বেরিয়ে এলেন কাকাবাবু। তিনি ছাতা ব্যবহার করেন না। একটা রেইন কোট গায়ে দিয়েছেন, মাথায় টুপি। তিনি কিছু চিন্তা করতে করতে আপনমনে আসছেন।

অংশুমান গুঙ্গার পিঠে চাপড় দিয়ে একটা ইঙ্গিত করলেন। গুঙ্গা বোবা বলে কানেও শুনতে পায় না। কিন্তু সামান্য ইশারা ও চমৎকার বোঝে।

সে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে ঝট করে একটা ইউ টার্ন নিল। কাকাবাবু তখনও অনেক দূরে। গাড়িটা কাকাবাবুকে ছাড়িয়ে চলে গেল। অংশুমান আবার ইঙ্গিত করে গুঙ্গাকে থামতে বললেন। তিনি চান গাড়িটা কাকাবাবুর পেছন দিক দিয়ে আসবে।

কাকাবাবু চিড়িয়াখানার কাছে এসে একটু থেমে এদিক-ওদিক তাকালেন। ট্যাক্সি পাওয়ার আশা নেই। ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল পর্যন্ত হেঁটেই যাবেন ঠিক করলেন।

তিনি ব্রিজের কাছাকাছি এসেছেন, এমন সময় একটা কাণ্ড ঘটল। মাথায় ফেট্টি বাঁধা দুজন গুণ্ডা চেহারার লোক ঘিরে ধরল তাঁকে। একজনের হাতে ভোজালি, অন্য জনের হাতে রিভলভার। কাকাবাবু বাধা দেওয়ার কোনও সময় পেলেন না, তারা কাকাবাবুর দুহাত চেপে ধরে টেনে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল।

অংশুমান গাড়ির মধ্যে বসে, এই দৃশ্য দেখে অবাক। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ভীমু, এসব কী!

ভীমু বলল, জানি না তো, স্যার। অন্য পার্টি!

অংশুমান তখন গুঙ্গার পিঠে বড় বড় দুটো চাপড় মারলেন। গুঙ্গা তখনি গাড়িখানা ফুলস্পীডে চালিয়ে একেবারে ওদের পাশে এসে ঘ্যাঁচাক করে ব্রেক কষল।

অংশুমান সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে হাতের ছড়িটা বন্দুকের মতন তুলে বললেন, এক সঙ্গে দুটা গুলি বেরোবে। কে কে মরতে চাও?

কাকাবাবুকে যে দুজন ধরে ছিল তারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। লড়াই। করার চেষ্টা না করে তারা দৌড় মারল ব্রিজের তলার দিকে।

অংশুমান কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কোনও ক্ষতি হয়নি তো? একী, আপনি মিঃ রাজা রায়চৌধুরী না?

কাকাবাবুর মাথার টুপিটা পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। তিনি সেটা তুলে নিয়ে হেসে বললেন, কী ব্যাপার বুঝতে পারছি না। হঠাৎ আমি খুব জনপ্রিয় হয়ে গেছি মনে হচ্ছে! একদল আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য, আবার ঠিক সেই মুহূর্তেই এক দল এসে পড়ল আমাকে রক্ষা করতে! এ যে সিনেমার মতন ঘটনা!

অংশুমান বললেন, আপনাকে তো আগে চিনতে পারিনি। হঠাৎ দেখলুম দুটো গুণ্ডা এসে রাস্তায় একজন লোককে চেপে ধরল। তাই তাড়াতাড়ি গাড়িটা চালিয়ে বাধা দিতে এলাম।

কাকাবাবু অংশুমানের মুখের দিকে ভাল করে লক্ষ করলেন। চিনতে পারলেন না। তিনি বললেন, আজকাল তো অন্যের বিপদ দেখলেও কেউ সাহায্য করতে আসে না। আপনি দেখছি ব্যতিক্রম। ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি আমাকে চিনলেন কী করে!

অংশুমান বললেন, কাছে এসে চিনলাম। আপনার ছবি দেখেছি। দূর থেকেও আপনাকে দেখেছি কয়েকবার। আপনি অবশ্য আমায় চিনবেন না। আমার নাম রতনমণি ঘোষ দস্তিদার। আমি কাগজের ব্যবসা করি। আসুন, আপনি গাড়িতে উঠে আসুন!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোন্ দিকে যাচ্ছিলেন?

আপনি যেদিকে যাবেন সেইখানেই পৌঁছে দেব।

বাঃ, এতো চমৎকার প্রস্তাব। ভাগ্যিস ওই গুণ্ডা দুটো এসে পড়েছিল, তাই আপনার গাড়ির লিষ্ট পেলাম। গুণ্ডা দুটোকেই আমার ধন্যবাদ জানানো উচিত।

কাকাবাবু গাড়িতে উঠে বসলেন। অংশুমান আগে বসেছিলেন ড্রাইভারের পাশে। এবারে ভীমুকে সেই জায়গায় বসিয়ে তিনি এলেন পেছনে। তারপর বললেন, আপনার মতন মানুষ, আপনার অনেক শত্ৰু। আপনি এভাবে একা একা সন্ধের পর যাতায়াত করেন? এটা ঠিক নয়।

কাকাবাবু জোরে জোরে হেসে বললেন, আমার জীবনটা খুব দামি হয়ে গেছে নাকি?

গাড়িটা চলতে শুরু করার পর কাকাবাবু বললেন, দুটো রাস্তার গুণ্ডা আমার ওপর হামলা করতে এল কেন? আমার কাছে তো দামি কোনও জিনিস নেই, টাকা-পয়সাও বিশেষ নেই। কেউ ওদের ভাড়া করে পাঠিয়েছে, কী বলেন?

অংশুমান বললেন, আমারও তাই মনে হয়।

আপনার কাগজের দোকান না মিল?

মিল।

কোথায় আপনার মিল?

এই ইয়ে কাঁচড়াপাড়ায়!

কাকাবাবু হেসে অংশুমানের দিকে ফিরে বললেন, আমার বিশেষ ক্ষমতা আছে। তাতে আমি লোকের মিথ্যে কথা শুনে চট করে ধরে ফেলতে পারি। কাঁচড়াপাড়ায় কোনও কাগজের মিল নেই। কস্মিনকালেও আপনার কাগজের ব্যবসা ছিল না। আপনার নামও রতনমণি ঘোষ দস্তিদার নয়। এবারে বলুন তো সত্যি করে। আপনি কে?

গাড়িটা বারুইপুরের দিকে গেল না। অংশুমান মাঝে মাঝে গুঙ্গার ডান কাঁধ আর বাঁ কাঁধ চাপড়াতে লাগল, সেই অনুযায়ী সে ডান দিকে বা বাঁ দিকে ঘোরাতে লাগল গাড়িটা। কাকাবাবু বললেন, আমাকে বাড়িতে নামানোর ইচ্ছে। নেই আপনার? একবারও জিজ্ঞেস করলেন না, আমি কোথায় যাচ্ছি?

কাকাবাবু অংশুমানের আসল পরিচয় জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেছিলেন, ঠিক আছে, প্রথম রাউন্ডে আপনি জিতলেন। আপনি ধরে ফেলেছেন যে আমি কাগজের ব্যবসায়ী রতনমণি ঘোষ দস্তিদার নই। আমি কে তা একটু পরেই জানবেন।

তারপর অংশুমান মাথা হেলান দিয়ে চুপ করে ছিলেন খানিকক্ষণ।

এবারে কাকাবাবুর প্রশ্ন শুনে বললেন, আপনার বাড়ি কোথায়, তা আমি জানি। আপনি বিখ্যাত লোক, আপনার বাড়ির খোঁজ পাওয়া তো শক্ত নয়। তবে মুশকিল হচ্ছে কী, আপনার ভাইপো বাড়িতে কুকুর পোষে।

কাকাবাবু অবাক হয়ে বললেন, আমার ভাইপো কুকুর পোষে, তাতে আপনার মুশকিলের কী হল? ও, আপনি কুকুর পছন্দ করেন না, তার মানে…তার মানে…আপনি বারুইপুরের অংশুমান চৌধুরী…যিনি জন্তু জানোয়ারদের ঘৃণা করেন?

অংশুমান বললেন, হ্যাঁ, এখন বারুইপুরে থাকি বটে, কিন্তু আপনি এর মধ্যে আমার চিঠি পাননি?

আপনার চিঠি? কুন্তলপুর, মানে কালা পুরা?

মনে আছে-মিঃ রায়চৌধুরী?

মনে ছিল না। আপনার ওই রহস্যময় বাক্স দুটি পাওয়ার পর সব মনে পড়ে গেল। সেই ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত, অংশুবাবু!

শুধু দুঃখিত বললেই চুকে গেল? তাতেই আমি সব ভুলে যাব?

তা হলে এতদিন পরে আপনি আমায় কোনও শাস্তি দিতে চান?

অংশুমান ভীমুর দিকে তাকালেন, সে এমনভাবে হাঁ করে আছে যে, মনে হয় সে কান দিয়ে শোনে না, মুখ দিয়ে শোনে।

অংশুমান তাকে ধমক দিয়ে বললেন, মুখ বন্ধ কর।

সে সঙ্গে সঙ্গে মুখ বন্ধ করে অন্যদিকে তাকাল।

অংশুমান আবার কাকাবাবুকে বললেন, আমার ড্রাইভার কানে শুনতে পায়, আবার আমার এই অ্যাসিস্টান্টটি সব কথা শুনতে পায় বটে কিন্তু সব কথার মানে বোঝে না। আপনি একরকম বলবেন, ও অন্যরকম বুঝবে। সেইজন্য আমি ওর সামনে সবরকম কথা আলোচনা করতে চাই না। কোথায় নিরিবিলিতে বসে কথা বলা যায় তাই ভাবছি।

কাকাবাবু বললেন, এই ময়দানেই তো কত ফাঁকা জায়গা। একটা কোথাও গাড়ি থামিয়ে কথা সেরে নেওয়া যেতে পারে।

অংশুমান নাক কুঁচকে বললেন, এই ময়দানে! এখানে বড় গোবরের গন্ধ।

এতবড় ময়দান, বৃষ্টি পড়ছে…এখানে আপনি গোবরের গন্ধ পাচ্ছেন?

কত গোরু-ঘোড়া-ভেড়া এখানে চরে বেড়ায় না; ভাবতেই আমার গা ঘিনঘিন করে।

তা হলে কোথায় যেতে চান, বলুন, আমি আপনাকে একঘন্টার বেশি সময় দিতে পারব না কিন্তু।

মিঃ রাজা রায়চৌধুরী, এখন আপনি আমার গাড়িতে বসে আছেন। এ-গাড়ি থেকে কখন নামবেন, সেটা আপনার ইচ্ছের ওপর নির্ভর করছে না, কী বলেন।

অন্যের ইচ্ছেতে গাড়ি করে ঘুরতে আমার একটুও ভাল লাগে না। আপনি আপনার গাড়িতে তুলেছেন সে জন্য ধন্যবাদ। এখন আমি বৃষ্টির মধ্যেও হেঁটে যেতে রাজি আছি। গাড়িটা থামাতে বলুন।

আরে আরে, আপনি জোর করে নামতে চান নাকি? আমার হাতে যে ছড়িটা দেখছেন, এটা একটা সাঙ্ঘাতিক অস্ত্র। আপনার কাছে বন্দুক-পিস্তল থাকলেও কোনও লাভ নেই।

কাকাবাবু কপাল কুঁচকে বললেন, আমি সব সময় বন্দুক-পিস্তল সঙ্গে নিয়ে ঘুরব কেন? আমি কি চোর-ডাকাত নাকি? আপনিই বা আমাকে এরকম ভয় দেখাচ্ছেন কেন?…এটা কি আপনার উচিত হচ্ছে?

অংশুমান বললেন, ঠিক আছে, চলুন, গঙ্গার ধারে যাওয়া যাক। এত বৃষ্টি বাদলার মধ্যে ওখানে কেউ এখন থাকবে না আশা করি।

তিনি গুঙ্গার কাঁধে আবার চাপড় মারলেন।

আউটরাম ঘাট পেরিয়ে একটা জায়গায় গাড়িটা থামল। এখনও বেশ মাঝারি-জোরে বৃষ্টি পড়ছে। যারা রোজ এখানে বেড়াতে আসে, তারা কেউ

নেই। জায়গাটা বেশ অন্ধকার মতন।

গাড়ির পেছন থেকে একটা ছাতা নিয়ে অংশুমান বললেন, আপনি বসুন,

আগে আমি ভাল করে দেখে নিই।

দরজা খুলে তিনি নামতে গিয়েই বিকৃত গলায় চিৎকার করে ডাকলেন, ভীমু! ভীমু!

গাড়ি যেখানে থেমেছে, তার খুব কাছেই একটা কদমগাছের নীচে একটা কুকুর চুপচাপ বসে আছে।

ভীমু গাড়ি থেকে নেমে হুশ হুশ করে ছুটে গেল। সে কুকুর বেচারা বুঝলই না সে কী দোষ করেছে। সে ল্যাজ তুলে দৌড়ল। ভীমু এদিক-ওদিক দেখে এসে বলল, আর কিছু নেই, স্যার।

অংশুমান কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। তাঁর শরীর কাঁপছে। কুকুর দেখলে তাঁর এমন অবস্থা হয়। এমন মানুষকে তো জব্দ করা খুব সহজ!

একটুবাদে অংশুমান নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, আর কিছু নেই, ঠিক দেখেছিস?

ভীমু বলল, হ্যাঁ স্যার! আসুন, মিঃ রায়চৌধুরী, আমরা গঙ্গার ধারে দাঁড়াই। রেল লাইন পেরিয়ে দুজনে এলেন গঙ্গার ধারের রেলিং-এর কাছে। অংশুমান ভীমু আর গুঙ্গাকে নির্দেশ দিলেন খানিকটা দূরে দূরে দুপাশে দাঁড়িয়ে থেকে পাহারা দিতে।

কাকাবাবুর ছাতার দরকার নেই। তাঁর গায়ে রেইন কোট, মাথায় টুপি।

অংশুমান ছাতা মাথায় দিয়ে কাকাবাবুর কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললেন, কান্টালাপুরে আপনি আমায় যে অপমান করেছিলেন, তার প্রতিশোধ নেওয়ার মতো আপনাকে আমি এক্ষুনি মেরে গঙ্গায় ফেলে দিতে পারি, বুঝলেন? আপনাকে মেরে লাশটা জলে ফেলে দেব, ভাসতে-ভাসতে সেটা বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে যাবে, কেউ কোনওদিন আপনার খোঁজ পাবে না।

কাকাবাবু হেসে বললেন, এই ভয় দেখাবার জন্য আপনি আমাকে বৃষ্টির মধ্যে গঙ্গার ধারে টেনে আনলেন? আমাকে মেরে ফেলার ভয় এ-পর্যন্ত কত লোক দেখিয়েছে, কেউ কিন্তু এখনও মারতে পারেনি।

অংশুমানও কাষ্ঠহাসি দিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে যে অস্ত্র আছে, সেটা আমার নিজের তৈরি। সেটা ব্যবহার করলে আপনার মুণ্ডুটা এই মুহূর্তে ছাতু হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা আমি ব্যবহার করব না। কেন জানেন? কারণ আমি খুনি নই। আমি একজন বৈজ্ঞানিক। আমি মানুষের ক্ষতি করি না। উপকার করি। কান্টালাপুরে আপনি আমায় যে অপমান করেছিলেন…

শুনুন, অংশুমানবাবু কান্টালাপুরে সেবার আমি একটা সরকারি কাজে গিয়েছিলাম। আমাকে সেখানে অনেকে বলল, সেখানে একজন এমন অদ্ভুত লোক আছে যে, জলকে মদ করে দিতে পারে, লোহাকে সোনা করে দিতে পারে, ফুলকে প্রজাপতি বানিয়ে দেয়…সেই লোকটা একটা গুহার মধ্যে থাকে। শুনে আমার কৌতূহল হল। প্রথমে ভাবলুম, কোনও সাধুটাধু হবে বোধহয়। কিন্তু আপনি এমন একটা অদ্ভুত পোশাক পরে ছিলেন, তার ওপর আবার সেই গুহার মধ্যে অনেকরকম যন্ত্রপাতি…আপনাকে দেখে তো আমি বাঙালি বা ভারতীয় বলে চিনতে পারিনি। মনে হয়েছিল একটা বুজরুক। সেই লোকটা সাধারণ ম্যাজিক দেখিয়ে লোকদের ঠকাচ্ছে!

ঠকাচ্ছে মানে, আমি কি কারও কাছ থেকে পয়সা নিতাম? ওখানকার লোকদের ভক্তি-শ্রদ্ধা আদায় করা আমার দরকার ছিল। আমার আসল উদ্দেশ্য ছিল ওই গুহটা ব্যবহার করা। ওই গুহাতে অন্য গ্রহ থেকে কয়েকটা বুদ্ধিমান প্রাণী এসেছিল, তাদের ফেলে যাওয়া একটা যন্ত্র আমি পেয়েছিলাম। ব্যাপারটা খুব গোপন রাখার জন্য…

অন্য গ্রহের প্রাণীর ব্যাপার আমি কিছু বুঝি না। আমি এখনও পৃথিবীর মানুষদের বোঝবার চেষ্টা করি। আমার ধারণা হয়েছিল, মিথ্যে কথা বলে লোকজনদের ঠকাচ্ছেন। লোহাকে সোনা করা, ফুলকে প্রজাপতি করা, এসব তো অতি সাধারণ ম্যাজিক।

যারা ম্যাজিক দেখায় তারা বুঝি লোককে ঠকায়? তারা তো লোকদের আনন্দ দেয়।

কিন্তু তারা পরে বলে দেয়, এই সবই ম্যাজিক। মিথ্যে অন্য কথা বলে না। যাই হোক, আমি হয়তো একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলাম। অত লোকজনের সামনে আপনার ম্যাজিক ফাঁস করে দেওয়া ঠিক হয়নি। তাতে লোকজন যে অত খেপে উঠবে, আপনার মাথা ন্যাড়া করে দেবে, তা আমি বুঝতে পারিনি।

তারপর থেকে আমার মাথায় চুল গজায়নি?

সেজন্য আমি দুঃখিত। খুবই দুঃখিত!

আপনি দুঃখিত বলেই আমার অপমান চুকে গেল? বাঃ, বাঃ।

কাকাবাবু এবারে একটি অদ্ভুত কাণ্ড করলেন। একটা হাতের ঝটকায় অংশুমানের ছাতাটা ফেলে দিয়ে তারপর দুহাতে তার ঘাড় চেপে ধরে একটা ঝটকা মারলেন। অংশুমানের অতবড় লম্বা শরীরটা শুন্যে উল্টে গেল। কাকাবাবু তাঁকে রেলিং-এর ওপাশে নিয়ে গিয়ে ঝুলিয়ে ধরে রইলেন কয়েক মুহূর্ত।

তারপর বললেন, কেউ আমার দিকে অস্ত্র উঁচিয়ে ভয় দেখালে তার ওপর আমি একটু না একটু প্রতিশোধ না নিয়ে পারি না। এটা আমার একটা প্রতিজ্ঞা বলতে পারেন, এখন আপনাকে নীচের কাদার মধ্যে ফেলে দেব।

অংশুমানের ওই অবস্থা দেখে দূর থেকে ছুটে এল ভিমু আর গুঙ্গা।

কাকাবাবু আবার আর এক হ্যাঁচকা টানে অংশুমানকে রেলিংয়ের পাশে ফিরিয়ে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন।

অংশুমানের হাত থেকে খসে পড়া ছড়িটা তিনি নিজে তুলে নিয়ে ওদের বললেন, যাও, যাও, ঠিক আছে। যেখানে ছিলে, সেখানে যাও।

অংশুমান দুতিন মিনিট কোনও কথা বলতে পারলেন না। কাকাবাবুর ইঙ্গিতে ভীমু আর গুঙ্গা সরে গেল দূরে।

কাকাবাবু অংশুমানের পিঠে চাপড় মেরে বললেন, কী হল, এত ঘাবড়ে গেলেন কেন? অন্যদের মেরে ফেলার ভয় দেখাতে পারেন, আর নিজে এইটুকু বিপদে পড়েই কাবু! যান, শোধবোধ! আপনার ওপরে আমার আর কোনও রাগ নেই। আপনিও রাগ মুছে ফেলুন!

অংশুমান দুহাতে মুখ ঢেকে দিলেন। এবার হাত সরিয়ে বলনেল, মিঃ রায়চৌধুরী, সেই কান্টালার ঘটনার পর আমিও প্রতিজ্ঞা নিয়েছি, আপনার ওপর কোনও প্রতিশোধ না নিলে আমার জীবনে কোনও শান্তি আসবে না। আমার সে প্রতিজ্ঞা কি ব্যর্থ হবে?

ঠিক আছে, কী প্রতিশোধ নিতে চান, বলুন? আমার ক্ষমা চাওয়া যথেষ্ট নয়?

আপনি একা-একা আমার কাছে ক্ষমা চাইলে কী হবে। সবার সামনে আমার কাছে আপনাকে অপমান সইতে হবে। কিংবা কোনও প্রতিযোগিতায় আপনি হেরে যাবেন, তারপর সকলের সামনে সেটা স্বীকার করবেন।

কীরকম প্রতিযোগিতা বলুন; সেটা ঠিক করেছেন?

মধ্যপ্রদেশের আদিবাসীদের এক গ্রামে টারকোয়াজের মূর্তি আছে। সেটা উদ্ধার করতে আপনিও যাবেন, আমিও যাব। দেখা যাবে, কে আগে সেটা উদ্ধার করতে পারে। আপনি, না আমি!

কাকাবাবু প্রথমে কপাল কুঁচকে রইলেন। তারপর রাগ করার বদলে হেসে ফেলে বললেন, আপনিই ওতে জিতবেন, আমি হার স্বীকার করছি। ওই প্রতিযোগিতাতে আমি নামছি না!

অংশুমান দুদিকে মাথা নেড়ে বললেন, তা বললে তো আমি মানছি না। আপনাকে যেতেই হবে। না গিয়ে আপনার উপায় নেই।