০৪. কর্নেল সমর চৌধুরীর বাংলোটি প্রকাণ্ড

কর্নেল সমর চৌধুরীর বাংলোটি প্রকাণ্ড। একতলা-দোতলায় একই রকম গোল বারান্দা, সামনের বাগানে একদিকে ফুলের গাছ, অন্যদিকে ফলের গাছ। বাইরের লোহার গেট থেকে বারান্দার সিঁড়ি পর্যন্ত লাল সুরকির রাস্তা। বাগানে একটা ঘোড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে আছেন কর্নেল সমর চৌধুরী। তাঁকে দেখলে বাঙালি বলে মনে হয় না। কাবুলিওয়ালাদের মতন লম্বা-চওড়া চেহারা, ফরসা রং, নাকের নীচে মোটা থেকে সরু হয়ে আসা মিলিটারি গোঁফ, মাথায় ঝাঁকড়াঝাঁকড়া চুল। তিনি পরে আছেন একটা ড্রেসিং গাউন, দাঁত দিয়ে কামড়ে আছেন পাইপ।

কাকাবাবুদের দলটিকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বললেন, আসুন, আসুন! আপনিই মিস্টার রায়চৌধুরী? আপনি খোঁড়া লোক হয়েও পাহাড়-পর্বতে ওঠেন শুনেছি। আশ্চর্য ব্যাপার! কী করে পারেন?

কাকাবাবু হেসে বললেন, আমি কিন্তু অনেক কিছুই পারি না। কেউ তাড়া করলে দৌড়ে পালাতে পারি না। তাড়াতাড়ি কোনও সিঁড়ি দিয়ে নামতে-উঠতে পারি না। গাড়ি চালাতে পারি না!

অনির্বাণ বলল, রিভলভারে কী সাঙ্ঘাতিক টিপ। এরকম আমি আগে দেখিনি। ঠিক অরণ্যদেবের মতন!

সমর চৌধুরী ভুরু তুলে বললেন, তাই নাকি?

কাকাবাবু বললেন, খোঁড়া লোকদের হাত দুটোই তো সম্বল।

সমর চৌধুরী বললেন, কত লোকেরই তো দুটো হাত আর দুটো পা থাকে, কিন্তু তাদের কি আপনার মতন সাহস থাকে?

অনির্বাণ সন্তুর কাঁধে একটা চাপড় মেরে বলল, এই ছেলেটিরও দারুণ সাহস। কীভাবে একটা পাগলা কুকুরের সঙ্গে লড়ে গেল!

সমর চৌধুরী বললেন, অনির্বাণ, তুমি লোকটাকে অ্যারেস্ট করলে না কেন? একটা পাগলা কুকুর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল!

অনির্বাণ বলল, ব্যাপারটা তো আমাদের চোখের সামনে ঘটল। আমরা ওপরে বসে ছিলাম, আর সন্তু ছিল জলের ধারে। কুকুরটা যে হঠাৎ ওইভাবে ফিরে এসে সন্তুকে আক্রমণ করবে, তা আমরা কেউ বুঝতে পারিনি। কুকুরের মালিক কোনও ইশারা-ইঙ্গিত করেনি। সুতরাং মালিককে দোষ দেওয়া যায় না।

সমর চৌধুরী ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, তুমি অন্য কোনও ছুতোয় ওকে ধরতে পারো না? থানায় নিয়ে গিয়ে ভাল করে পেটালেই ওর পেট থেকে সব কথা বেরিয়ে পড়বে। ব্যাটার নিশ্চয়ই কোনও বদ মতলব আছে। রাত্তিরবেলা ওসব আলো-ফালো জ্বেলে কী করে?

অনির্বাণ বলল, আপনারা কি মনে করেন পুলিশের অঢেল ক্ষমতা? নির্দিষ্ট অভিযোগ না পেলে অ্যারেস্ট করব কী করে? কোর্টে তো নিতেই হবে, তখন জজসাহেব আমাদের ধমকে দেবেন!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কর্নেল সাহেব, আপনি হেলিকপটার নিয়ে গিয়ে কিছু দেখতে পাননি?

সমর চৌধুরী বললেন, কিছু না! লোকটা মহা ধুরন্ধর। আমার চপারের আওয়াজ পেলেই সব কিছু নিভিয়ে দেয়। তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। আর কিছুই দেখা যায় না। শুধু শুধু পণ্ডশ্রম।

আপনি কবার গিয়েছিলেন?

দুবার না তিনবার? হ্যাঁ, তিনবার।

গ্রামের লোক বলছে অন্তত পাঁচবার।

তাই বলছে? আরও বাড়াবে। এর পর বলবে সাতবার, তারপর দশবার। গ্রামের লোক তো সব কিছুই বাড়িয়ে বলে।

আবার যাবেন?

না, গিয়ে তো কোনও লাভ হচ্ছে না। শুধু-শুধু তেল পুড়িয়ে কী হবে। তবে আপনি যদি যেতে চান, তা হলে একবার নিয়ে যেতে পারি।

সে পরে ভেবে দ্যাখা যাবে। আজ রাত্তিরে আমি আলোটা দেখি।

অনির্বাণ বলল, আমাকে কিন্তু তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। আপাতত আমি টোবি দত্তকে নিয়ে মাথা ঘামাতে পারছি না। সে কোনও ক্রাইম করেনি। কিন্তু এই পর-পর খুনের ঘটনা খুব ভাবিয়ে তুলেছে। খুন আর অস্বাভাবিক মৃত্যু হচ্ছে বিভিন্ন গ্রামে। কিন্তু ধরনটা এক। কোচবিহারে এরকম খুনটুন আগে হত না। শান্ত জায়গা।

কর্নেল চৌধুরী তাড়াতাড়ি খাবারের ব্যবস্থা করলেন। খেয়েই অনির্বাণ কাকাবাবুদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ওঁদের বনবাজিতপুরে পৌঁছে দিয়ে সে ফিরে গেল কোচবিহারে। সন্ধের সময় গাড়ির ড্রাইভার সুটকেস দুটো দিয়ে যাবে।

হেডমাস্টারমশাই এর মধ্যেই দোতলার একখানা ঘর গুছিয়ে রেখেছেন। যে-কোনও জিনিসের দরকার হলে কাজু নামে একজন ভৃত্যকে ডাকলেই সে ব্যবস্থা করবে। কাকাবাবুদের সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন।

পাশাপাশি দুখানা খাট। তার একটাতে শুয়ে পড়ে কাকাবাবু বললেন, আজ বোধ হয় রাত জাগতে হবে। এখন একটু ঘুমিয়ে নিলে মন্দ হয় না। সন্তু, শুয়ে পড়। তোর জ্বরটর আসছে না তো?

সন্তু বলল, না। আমার কিছু হয়নি।

কাকাবাবু বললেন, তুই জলের মধ্যে ছিলি তো, তাতে খানিকটা সুবিধে হয়েছে। কুকুরটার লালার বিষ তোর গায়ে লাগতে পারেনি। আচ্ছা সন্তু, তুই টোবি দত্তকে তো দেখলি। দেখে তোর কী ধারণা হল? সন্তু বলল, সায়েন্টিস্ট বা বিজ্ঞানী মনে হল না।

কেন? বিজ্ঞানীরা খানিকটা আধ-পাগলা কিংবা আপন-ভোলা ধরনের হয় বলে তোর ধারণা? সে তো গল্পের বইয়ের চরিত্র। একালের বড় বড় বিজ্ঞানীরা খুব ডিসিপ্লিন্ড হয়। তাদের চেহারা কিংবা সাজপোশাকও হয় সাধারণ মানুষের মতন।

তবু কেন যেন মনে হল, জ্ঞানী লোক নয়।

বিদেশ থেকে অনেক টাকা নিয়ে ফিরেছে। বিদেশে কী কাজ করত সেটা কেউ জানে না।

স্মাগলার হতে পারে।

সেরকম একটা সম্ভাবনা আছে বটে! এখান থেকে অন্য দেশের বর্ডার খুব দূরে নয়। কিন্তু স্মাগলার হলে রাত্তিরবেলা ছাদে ওরকম আলো জ্বালিয়ে রাখবে কেন? ওদের তো অন্ধকারেই সুবিধে।

অন্য স্মাগলারদের কাছে নিশ্চয়ই সিগন্যাল পাঠায়। তারা ওই আলো দেখে বুঝতে পারবে যে ঠিক সময় হয়েছে।

তাতে যে পুলিশেরও নজর পড়বে। যেমন অনির্বাণরা খোঁজখবর নিচ্ছে। নিশ্চয়ই আশেপাশে পাহারাও রেখেছে।

এই সময় দরজার কাছে একটি মেয়ে এসে দাঁড়াল। চোদ্দ-পনেরো বছর বয়েস, একটা ড়ুরে শাড়ি পরা। এক হাতে খানিকটা আচার, তাই চেটে-চেটে খাচ্ছে।

একটুক্ষণ সে এমনই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, এই, তোমার নাম বুঝি সন্তু?

সন্তু বলল, হ্যাঁ। তুমি জানলে কী করে?

মেয়েটি বলল, বাঃ, আমি বুঝি বই পড়ি না? কাকাবাবুকে তো দেখেই চিনতে পেরেছি। সবুজ দ্বীপের রাজা-তে এইরকম ছবি ছিল।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তুমি নিশ্চয়ই মণিকা?

মেয়েটি মুখ ফিরিয়ে বলল, আপনি কী করে জানলেন?

কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, আমি বই না পড়েও জানতে পারি।

মণিকা সন্তুকে জিজ্ঞেস করল, এই, তুমি আচার খাবে? খুব ভাল কুলের আচার। আমি নিজে বানিয়েছি।

সন্তু বলল, হ্যাঁ, খেতে পারি।

কাকাবাবু বললেন, আমায় দেবে না?

মণিকা বলল, যাঃ, বৃদ্ধ লোকেরা আচার খায় নাকি?

কাকাবাবু বললেন, যাঃ, তুমি আমাকে বৃদ্ধ বানিয়ে দিলে? আমি কিন্তু ততটা বৃদ্ধ হইনি। তা ছাড়া তুমি জানো না, বয়স্ক লোকদের অনেক ছেলেমানুষি লোভ থাকে। আমি আচার খেতে খুব ভালবাসি।

মণিকা বলল, আমার বাবা খায় না। একটু খেলেই দাঁত টকে যায়। অবশ্য আমার বাবা তোমার মতন হিমালয় পাহাড়েও ওঠেনি, জাহাজে করে সমুদ্রেও যায়নি।

মণিকা এক ছুটে গিয়ে একটা বাটিতে অনেকটা আচার নিয়ে এল। সন্তুর সঙ্গে সঙ্গে কাকাবাবুও সেই আচার তারিয়ে তারিয়ে খেতে লাগলেন।

মেয়েটির মুখখানার মতন গলার আওয়াজও খুব মিষ্টি। কিন্তু তার তৈরি আচার বেশ ঝাল।

একটা চেয়ারে বসে পড়ে সে বলল, তোমরা বুঝি এখানে কোনও ডাকাত ধরতে এসেছ?

কাকাবাবু বললেন, না গো, মণিকা, আমরা এমনিই তোমাদের বাড়িতে থাকতে এসেছি। তোমাদের এখানকার আকাশে রাত্তিরবেলা কী যেন দেখা যায়, সেটা দেখতে এসেছি। তুমি সেটা দেখেছ?

চোখ-মুখ ঘুরিয়ে মণিকা বলল, হ্যাঁ দেখেছি। মস্ত বড়, জটায়ু পাখির মতন, সারা গায়ে আলো, মাঝে-মাঝে পাখা ঝাপটায় আর মুখ দিয়ে আগুন ছড়ায়। আর কী দারুণ শব্দ হয়, আমি ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছিলুম!

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুমি কখনও হেলিকপটার দেখেছ, মণিকা?

মণিকা বলল, তাও দেখেছি। দিনহাটায় মামাবাড়িতে গেছিলাম, সেখানে একজন মন্ত্রী এসেছিলেন হেলিকপটারে, খেলার মাঠে নেমেছিল। আমাদের এই পাখিটা কিন্তু সে রকম মোটেই না। সবাই বলে, এই পাখিটা আসে মঙ্গলগ্রহ থেকে। ওর পিঠে বেঁটে-বেঁটে মানুষ বসে থাকে। আমি অবশ্য মানুষগুলো দেখিনি।

সন্তু আবার বলল, মঙ্গলগ্রহের বেঁটে-বেঁটে মানুষরা তোমাদের গ্রামে কী করে?

মণিকা বলল, তারা টোবি দত্তর সঙ্গে দেখা করতে আসে। সেইজন্যই তো ছাদে আলো জ্বেলে রাখে।

তোমাদের বাড়ি থেকে টোবি দত্তর ছাদের আলোটা দেখা যায়?

না, গাছপালার আড়াল হয়ে যায়। পুকুরধারে গেলে দেখা যায়। বড় রাস্তায় গেলেও দেখা যায়। আরও অনেক জায়গা থেকে দেখতে পারো।

টোবি দত্তর বাড়ির একেবারে কাছে যাওয়া যায় না?

সবাই যেতে ভয় পায়। রাত্তিরবেলা বন্দুকধারী দরোয়ান ঘুরে বেড়ায়। কেউ কাছে গেলেই গুলি করে মেরে ফেলবে।

এ-পর্যন্ত একজনকেও মেরেছে?

না, তা মারেনি অবশ্য। তবু সবাই ভয় পায়।

আমরা আজ রাত্তিরে ওই আলোটা দেখতে যাব। তুমি যাবে আমাদের সঙ্গে?

না গো, কী করে যাব। বাবা বারণ করেছেন। আলোটা জ্বলে রাত বারোটার সময়, ওই সময় মেয়েদের বাইরে বেরোতে নেই। অনেকে বলে, মঙ্গলগ্রহের লোকরা ধরে নিয়ে যেতে পারে। আমার কিন্তু ইচ্ছে করে, ওরা আমাকে ধরে নিয়ে যাক। তা হলে বেশ মঙ্গলগ্রহটা দেখে আসা যাবে।

কাকাবাবু হাসতে-হাসতে বললেন, তারপর যদি ওরা তোমাকে আর না ছাড়ে?

মণিকা বলল, ইস, অত সহজ নাকি? সে আমি ঠিক ফিরে আসব।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, মণিকা, তুমি কলকাতায় গিয়েছ কখনও?

মণিকা বলল, না, এখনও যাইনি। শুধু দুবার শিলিগুঁড়ি গেছি।

কাকাবাবু বললেন, তুমি কলকাতা দেখার আগেই মঙ্গলগ্রহ ঘুরে আসতে চাও?

মণিকার সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ গল্প হল।

সন্ধের সময় অনির্বাণের গাড়িটা নিয়ে এল সুটকেস দুটো। গাড়ির ড্রাইভার বলল যে, সে এখানেই থেকে যাবে। কাকাবাবুদের কাজে লাগতে পারে।

এ বাড়িতে খাওয়াদাওয়া চুকে যায় রাত নটার মধ্যে। হেডমাস্টারমশাই। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন। সন্তু আর কাকাবাবুও নিজেদের ঘরে এসে শুয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর ঠিক পৌনে বারোটার সময় তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

গাড়িটা সঙ্গে নিতে চাইলেন না কাকাবাবু। হেঁটেই যাবেন। হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে বুঝে নিয়েছেন কোন দিক দিয়ে যেতে হবে। অনির্বাণ যে বলেছিল টোবি দত্ত নতুন বাড়ি বানিয়েছে, তা ঠিক নয়। এই গ্রামে ছিল টোবি দত্তর মামাবাড়ি। তার মামারা ছিলেন বেশ ধনী। কিন্তু এই মামারা টোবি দত্তের মায়ের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতেন না। একবার টোবি দত্তর বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে টোবির মা এখানে সাহায্য চাইতে এসেছিলেন। ছোট ছেলে টোবিও মায়ের সঙ্গে ছিল তখন, কিন্তু ওর বড়মামা অপমান করে মাকে তাড়িয়ে দেয়। তারপর বহুদিন কেটে গেছে। সেই মামার বংশধররা এখন খুবই গরিব। আর টোবি দত্ত বিদেশ থেকে বহু টাকা সঙ্গে নিয়ে এসেছে। সেই মামাদের বাড়িটাই কিনে নিয়েছে সে। সারিয়ে ঠিকঠাক করেছে ভাঙা বাড়িটাকে।

পুকুরের ধার দিয়ে রাস্তা। খানিকটা গেলে বড় রাস্তায় পড়া যাবে। চতুর্দিকে জমাট অন্ধকার। আকাশেও চাঁদ নেই। দিনের বেলা বেশ গরম ছিল, এখন বাতাসে ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ভাব। রাত বারোটায় সমস্ত গ্রাম ঘুমিয়ে পড়ে। কোথাও কোনও শব্দ নেই।

হঠাৎ পেছনে কীসের শব্দ শুনে এরা দুজন ঘুরে দাঁড়াল। কে যেন ছুটে আসছে। কাকাবাবু পকেটে হাত দিয়ে অন্য হাতে টর্চ জ্বালালেন। একটু পরেই দেখা গেল মণিকাকে।

সে হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, আমি যাব তোমাদের সঙ্গে!

কাকাবাবু বললেন, সে কী, তোমার বাবা যে বারণ করেছেন?

মণিকা বলল, বাবা তো ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালের আগে জাগবে না। কিছু জানতে পারবে না।

কাকাবাবু মাথা নাড়িয়ে বললেন, তা হয় না, মণিকা। তোমার বাবার অনুমতি ছাড়া তোমাকে আমরা সঙ্গে নিতে পারি না।

মণিকা বলল, চলো না। কিচ্ছু হবে না। বলছি তো, বাবা টেরও পাবে না!

কাকাবাবু বললেন, উঁহু, সেটা অন্যায়। কাল বরং তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করে আমরা অন্য একটা জায়গায় যাব।

মণিকা ছটফটিয়ে বলল, তোমরা বেশ মজা করতে যাচ্ছ। আর আমি বাড়িতে একলা-একলা শুয়ে থাকব? আমার একটুও ভাল লাগছে না।

কাকাবাবু ওর পিঠে হাত দিয়ে বললেন, লক্ষ্মীটি, আজ গিয়ে ঘুমোও। দেখো, কাল কিছু একটা হবে।

খুব অনিচ্ছার সঙ্গে শরীর মোচড়াতে-মোচড়াতে ফিরে গেল মণিকা।

কাকাবাবুরা এগিয়ে গেলেন বড় রাস্তার দিকে। তাঁর ক্রাচ দুটির তলায় যদিও রাবার লাগানো আছে, তবু এই নির্জনতার মধ্যে একটু-একটু শব্দ হচ্ছে। সন্তুর পায়ে টেনিস-শু, সে পরে আছে হাফ প্যান্ট আর টি-শার্ট।

রাস্তায় কোনও মানুষজন নেই, একটা কুকুর ওদের দিকে ছুটে এসেও কাকাবাবুর ক্রাচ দেখে ভয়ে পালিয়ে গেল।

টোবি দত্তর বাড়িটা ফাঁকা জায়গায়। দুপাশে অনেকটা জমি, পেছন দিকে সরু নদীটার ওপাশেই জঙ্গল। ছাদে এখনও আলো জ্বলেনি, গোটা বাড়িটাই অন্ধকার।

মূল বাড়িটা থেকে খানিকটা সামনে একটা লোহার গেট, তার পাশে ছোট্ট গুমটি ঘর, ভেতরে টিমটিম করে লণ্ঠন জ্বলছে। সেখানে কোনও পাহারাদার বসে আছে বোঝা যায়। পুরো এলাকাটা কিন্তু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা নয়, হয়তো এক সময় ছিল, এখন ভেঙেচুরে নষ্ট হয়ে গেছে।

কাকাবাবু আর সন্তু বাড়িটার চারপাশ ঘুরে দেখল। ভেতরে কোনও মানুষজন আছে কি না বোঝাই যায় না। টোবি দত্ত বিদেশ থেকে একা ফিরে এসেছে, তার বউ-ছেলেমেয়ে আছে কি না তা জানে না কেউ। একটা পোষা কুকুর ছিল, সেটাও তো মরে গেল!

সব দিক দেখে কাকাবাবু নদীর ধারেই বসলেন। আকাশ বেশ মেঘলা, আজ আর চাঁদ ওঠার আশা নেই। অন্ধকারে প্রায় কিছুই দেখা যায় না, তবু নদীর ধারে বসলে ভাল লাগে।

সন্তু পকেট থেকে একটা ছোট্ট ক্যামেরা বের করল।

কাকাবাবু বললেন, এই অন্ধকারে ক্যামেরা দিয়ে কী করবি?

সন্তু বলল, যদি ইউ এফ ও আসে, ছবি তুলব। ছবি তুলতে পারলে জোজো আমাকে একটা দারুণ জিনিস খাওয়াবে বলেছে!

কী খাওয়াবে!

সেটা একটা নতুন কিছু জিনিস, আমি নাম ভুলে গেছি।

জোজোকে এবার সঙ্গে নিয়ে এলি না কেন? ও থাকলে বেশ মজার মজার কথা শোনা যায়।

তুমি তো তখন জোজোকে সঙ্গে নেওয়ার কথা বললে না! তা ছাড়া ওকে নাকি জাপানের সম্রাট নেমন্তন্ন করেছে।

তা হলে আর আসবে কেন বল! কোথায় জাপানের রাজবাড়িতে ভোজ খাওয়া আর কোথায় কোচবিহারের পাড়াগাঁয়ে রাত্তিরবেলা বসে মশার কামড় খাওয়া!

কাকাবাবু, একটা কীসের শব্দ হচ্ছে।

কাকাবাবু কান খাড়া করে শুনলেন। একটা বড় গোছের ডায়নামোবা। জেনারেটর চালু হওয়ার মতন শব্দ আসছে টোবি দত্তের বাড়ির ভেতর থেকে। শব্দটা ক্রমে বাড়তে লাগল, তারপর ফট করে জ্বলে উঠল আলো।

বাড়ির অন্য কোথাও আলো নেই, শুধু ছাদ থেকে একটা আলোর শিখা উঠে গেল আকাশের দিকে। ফ্লাড লাইটের মতন ছড়ানো আলো নয়, একটাই শিখা। ভারী সুন্দর দেখতে আলোটা, গাঢ় নীল রং, দারুণ তেজী আলো, মেঘ কুঁড়ে চলে গেছে মনে হয়।

সেইদিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে কাকাবাবু আপনমনে বললেন, এটা যদি ওর শখের ব্যাপার হয়, তা হলে অদ্ভুত শখ বলতেই হবে! মাঝরাতে রোজ এরকম একটা আলো জ্বালিয়ে রাখার মানে কী?

সন্তু বলল, নিশ্চয়ই অন্য কাউকে কিছু সংকেত জানাতে চায়।

কাকাবাবু বললেন, প্রত্যেকদিন আলো জ্বেলে কী সংকেত পাঠাবে?

সন্তু বলল, অন্য কেউ যাতে সন্দেহ না করে, সেইজন্য রোজই আলো জ্বালিয়ে দেয়।

প্রায় আধ ঘণ্টা ওরা তাকিয়ে রইল। আলোটা সমানভাবে জ্বলতেই লাগল। আর কিছুই ঘটছে না।

কাকাবাবু এক সময় বললেন, আলোটা তো দেখা হল, চল আর বসে থেকে লাভ কী? এরকম একটা জোরালো আলো তৈরি করাও কম কৃতিত্বের কথা নয়।

সন্তু বলল, এ-গ্রামের লোকজন মাঝরাত্তিরে আলোটা দেখে ঘুমিয়ে পড়ে। কেউ তো সারা রাত জেগে বসে থাকে না। হয়তো ভোর রাতে কিছু একটা ঘটে।

কাকাবাবু বললেন, তুই কি সারারাত এখানে বসে থাকতে চাস নাকি?

সন্তু বলল, সত্যি যদি ওই লোকটা মহাকাশের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে, একটা ইউ এফ ও আসে, তা হলে কিন্তু দারুণ ব্যাপার হয়।

এই সময় আলোটা বেঁকতে শুরু করল। এতক্ষণ আলোটা সরলরেখায় স্থির হয়ে ছিল, এবার নামতে লাগল নীচের দিকে। এদিকেই নামছে, এক সময় সন্তু

আর কাকাবাবুকে ধাঁধিয়ে দিল।

কাকাবাবু বলে উঠলেন, সন্তু, শুয়ে পড়, মাটিতে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়।

কয়েক মুহূর্তের জন্য জায়গাটা দিনের আলোর চেয়েও বেশি আলোকিত হয়ে গেল। আলোটা কিন্তু এক জায়গায় থেমে রইল না। সন্তু আর কাকাবাবুর পিঠের ওপর দিয়ে সরে গেল নদীর ওপারের জঙ্গলে। সেখানে আলোটা কেঁপে-কেঁপে যেন জায়গা করে নিচ্ছে, গাছপালার ফাঁক দিয়ে এক জায়গায় আলোর সুড়ঙ্গের মতন হয়ে গেল। চলে গেল অনেক দূর পর্যন্ত।

কাকাবাবু উঠে বসে গায়ের জামা থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হল যেন আমাদের ওপর আলো ফেলে তারপর গুলি চালাবে!

সন্তু বলল, আমাদের দেখতে পেয়েছে নিশ্চয়ই।

জায়গাটা আবার অন্ধকার হয়ে গেছে। সন্তু আর কাকাবাবু সরে গেলেন। আলোটা এখন জঙ্গলের মধ্যে স্থির হয়ে রয়েছে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, আলো ফেলে কি কাউকে রাস্তা দেখানো হচ্ছে?

কাকাবাবু বললেন, খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে দেখা যাক, কেউ আসে কি না।

জঙ্গলের দিক থেকে কেউ এল না, কিন্তু আকাশে একটা শব্দ শোনা গেল। ফট ফট ফট ফট শব্দ, সেইসঙ্গে এগিয়ে আসছে একটা আলো।

সন্তু আর কাকাবাবু অবাক হয়ে সেদিকে চেয়ে রইলেন। আরও কাছে এগিয়ে আসার পর বোঝা গেল, সেটা একটা হেলিকপটার। কিন্তু সেটাকে বেশি আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে। আর সেটা থেকে মাঝে-মাঝে আগুনের ফুলকি বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে যাচ্ছে আকাশে। সেইজন্যই সেটাকে দেখে ভয়ঙ্কর কিছু মনে হচ্ছে।

সন্তু আবিষ্ট গলায় বলল, ইউ এফ ও!

কাকাবাবু ধমক দিয়ে বললেন, দুর বোকা, হেলিকপটার চিনিস না?

সন্তু বলল, কিন্তু কর্নেল সমর চৌধুরী, আর তো হেলিকপটার আনবেন না বলেছেন। তা হলে এটা এল কী করে?

কাকাবাবু বললেন, অন্য কেউ আনতে পারে। কিন্তু এটা যে হেলিকপটার তাতে কোনও সন্দেহ আছে? এতে চেপে মহাশূন্য থেকে আসা যায় না।

সন্তু ক্যামেরা বের করে ফটাফট ছবি তুলতে-তুলতে বলল, হেলিকপটার কি এরকম আগুন ছড়াতে-ছড়াতে আসে?

কাকাবাবু বললেন, ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে!

টোবি দত্তর বাড়ির আলোটা এবার আবার ওপরের দিকে উঠেই নিভে গেল!

সন্তু বলল, ক্যামেরার লেন্সে ওটাকে ঠিক একটা আগুনের পাখির মতনই মনে হচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, ইস, একটা বায়নোকুলার আনা উচিত ছিল। আরও ভাল করে দেখা যেত।

আগুনের পাখিটা টোবি দত্তর বাড়ির ওপর চক্কর দিল দু-তিনবার। বেশি নীচে নামতে পারবে না, কারণ দোতলা বাড়ির চেয়েও উঁচু-উঁচু গাছ রয়েছে চারপাশে।

হঠাৎ সেই আগুনের পাখিটারও সব আগুন আর আলো নিভে গেল, শব্দও থেমে গেল! আবার সব দিক নিঃশব্দ, অন্ধকার।

সন্তু বলল, ওটা ছাদে নামছে?

কাকাবাবু বললেন, না, ওপরে থেমে আছে। চুপ করে শোন, কে যেন কী বলছে।

মনে হল, সেই হেলিকপটার কিংবা সেইরকম জিনিসটা থেকে কেউ চেঁচিয়ে কিছু বলল। টোবি দত্তর ছাদ থেকেই কেউ কিছু উত্তর দিল। মাত্র এক-দেড় মিনিটের ব্যাপার। হেলিকপটার শূন্যে এক জায়গায় থেমে থাকতে পারে না।

তারপরই খানিকটা দূরে শোনা গেল ফট-ফট শব্দ। আলো না জ্বেলেই সেটা আবার উড়তে শুরু করেছে। একটুক্ষণের মধ্যেই মিলিয়ে গেল দিগন্তে!