[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

০৩. লন্ডন বিমানবন্দরে অপেক্ষা

লন্ডন বিমানবন্দরে অপেক্ষা করতে হবে প্রায় ঘণ্টা তিনেক।

ইচ্ছে করলে আমি লন্ডন শহরে দু-একদিন থেকেও যেতে পারতাম, আমার অনেক বছরের ভিসা আছে। কিন্তু লন্ডনে আর আমার যেতে ইচ্ছে করে না। ভবিষ্যতে আর কোনওদিনই যাব না বোধহয়।

এই প্রথম আমি এই বিমানবন্দরে একা।

এর আগে যতবারই এসেছি, চোখ বুজেই দেখতে পেতাম ভাস্করকে।

শ্যামবাজারের টাউন স্কুলে ভাস্কর আমি পড়েছি ক্লাস টু থেকে। এত অল্প বয়েসের বন্ধুর সঙ্গে সারা জীবন সম্পর্ক রাখার সৌভাগ্য ক’জনের হয়!

স্কুল ছেড়ে কলেজে আসার পর আমাদের বিষয় ছিল আলাদা আলাদা, তবু দেখা হত প্রায় প্রত্যেকদিন। এক লাইনও কবিতা না লিখে ভাস্কর কৃত্তিবাস কবিগোষ্ঠীর সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিল।

ভাস্কর পড়েছিল কমার্স ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি, কলকাতায় কিছুদিন চাকরি করার পর ভাস্কর বলল, একবার লন্ডনটা ঘুরে আসি। ওখানে একটা আমার নামে রাস্তা বানিয়ে ফিরে আসব।

কিন্তু ফেরা অত সহজ নয়, ভাস্কর ইংল্যান্ডে থেকে গেল ঠিক পঁয়ত্রিশ বছর। লন্ডনে ওর নামে রাস্তা হয়নি বটে, কিন্তু হ্যারোতে বাঙালি তথা ভারতীয়দের মধ্যে বিশিষ্ট ভূমিকা নিয়েছিল এবং বর্ণবৈষম্যের ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আলোচনায় ওর ছিল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। ওকে স্যার উপাধি দেওয়ার কথাও উঠেছিল শোনা যায়, যদিও স্যারের বদলে লর্ড হলেই যেন ওকে বেশি মানায়। বন্ধুরা অনেক সময়ই ওকে লর্ড ভাস্কর বলে ডাকত। চেহারাটাও ছিল তেমনি সুন্দর। অবশ্য টাক পড়ার আগে।

বনেদি বাড়ির ছেলে ভাস্কর। বেশিদিন চাকরি করা ওর পোয়নি, ওর ছোট ভাই বরুণের সঙ্গে মিলে, লন্ডন থেকে বেশ খানিকটা দূরে করবি নামের শিল্পাঞ্চলে স্থাপন করেছিল একটা হাই-টেক রাবারের কারখানা।

একবার ভাস্কর আমাকে সেই কারখানাটা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। গেট দিয়ে ঢোকার সময় এবং অভ্যর্থনা কক্ষে সাহেব-মেম কর্মচারীরা মালিককে দেখে সমম্ভমে বলছিল, গুড মর্নিং স্যার, গুড মর্নিং মিস্টার ডাটা! ভাস্কর আমার দিকে চোখ টিপে একটা ইঙ্গিত করল। অর্থাৎ, দেখলি দেখলি, সাহেব-মেমরা, আমাকে কীরকম সেলাম ঠুকছে!

লন্ডনের কোনও হোটেলে থাকার উপায় আমার ছিল না। প্রত্যেকবার এয়ারপোর্ট থেকেই ভাস্কর বগলদাবা করে নিয়ে যেত ওর বাড়িতে। কখন কোনও প্রতিনিধি দলের সঙ্গে গিয়ে আমার হোটেলে ওঠার কথা থাকলেও ভাস্কর সেখানে আমায় শুধু খাতায় নামটা মাত্র লিখতে দিয়েছে, তারপরই আমার সুটকেসটা নিজে তুলে নিয়ে বলত, চল-চল, আমার বাড়িতে ভিকটোরিয়া রান্না করে রেখেছে! শুধু আমি নয়, আমাদের বন্ধুবান্ধব যে-ই লন্ডনে গেছে, কিম্বা লন্ডন ছুঁয়ে অন্য কোথাও যেতে হয়েছে, ভাস্করের হ্যারোর বাড়ি ছিল সকলের অবশ্য গন্তব্য।

ভাস্করের স্ত্রী ভিকটোরিয়া, মেমসাহেবের মতন ফরসা বাঙালি মেয়ে, যেমন মধুর স্বভাবের, তেমনই কাজের মেয়ে এবং রান্নায় অদ্বিতীয়া। সে আবার দু-তিন জনের জন্য রান্না করতে পারে, যে পদই রাঁধে তা অন্তত বারো-চোদ্দোজনের যোগ্য। ভাস্কর বলত, মাঝে-মাঝে আমায় কী করতে হয়, জানিস না তো? রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আমাকে লোক ডাকতে হয়, ওগো, আমার বাড়িতে খাবে এসো, খাবে এসো! কে কে খাবে, চলে এসো, চলে এসো।

সুদীর্ঘ প্রবাসেও ভাস্কর কয়েকটি জিনিস একেবারে ছাড়েনি। যেমন খাঁটি উত্তর কলকাতার ভাষা, আচ্ছা রীতি এবং বন্ধুদের প্রতি টান। আড্ডার কৃতিত্বে ভাস্কর ছিল আমার চেনাশুনো সকলের মধ্যে অদ্বিতীয়। প্রথম-প্রথম যখন লন্ডনে গেছি, সকালবেলা এয়ারপোর্ট থেকে বাড়িতে নিয়ে, ভাস্কর তখন চাকরি করত, তবু বলে উঠত, আজ আর অফিসে যাব না! শুধু সেদিনই নয়, পরপর দু-তিনদিন। বিলেত-আমেরিকায় এরকমভাবে ছুটি নেওয়া যে কত কঠিন, তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।

একবার বেলজিয়ামে লিয়েজ নামে একটা ছোট্ট শহরের কাব্য সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেয়ে আগে লন্ডনে পৌঁছেছি। ভাস্করকে খবর দিয়েছিলাম শেষ মুহূর্তে। পরের দিন নেহাত কথার কথা হিসেবে ভাস্করকে বলেছিলাম, কী রে আমার সঙ্গে বেলজিয়াম যাবি নাকি? ভাস্কর যাকে বলে এক পায়ে খাড়া, সঙ্গে-সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল।

অফিস কামাই করে সেখানে আমার সঙ্গে রয়ে গেল পাঁচদিন, তারপর আবার প্যারিসে। আর একবার বার্লিনে একটা ইন্ডো-জার্মান লেখক সমাবেশে যোগ দিতে গেছি, হঠাৎ দেখি সেখানে ভাস্কর উপস্থিত। আলোচনা সভায় ভাস্কর আমাদের সঙ্গে বসত এক টেবিলে, অন্য লেখকদের সঙ্গে তার ভাব জমাতে বেশিক্ষণ লাগত না, সান্ধ্যআসরে সে-ই হয়ে উঠত সবচেয়ে জনপ্রিয়। অন্য লেখকরা জিগ্যেস করেছিল, আপনি কি লন্ডন থেকে প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন? ভাস্করের উত্তর, না আমি লেখক-টেখক কিছুনই, আমি এসেছি স্রেফ আড্ডা দিতে।

এরকম আরও অনেক দেশে। নিজের পয়সা খরচ করে, কাজ ফেলে রেখে অন্য দেশে গিয়ে আড্ডা দেওয়ার এমন দুঃসাহসিক নেশা আর ক’জনের থাকে?

আড্ডার আর একটি কেন্দ্র প্যারিস, অসীম রায়ের বাড়ি। প্যারিসে অসীম ছাড়াও প্রীতি ও বিকাশ সান্যাল, ভূপেশ দাশ ও আরও কয়েকজনের একটি ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠী আছে। এ ছাড়া কেউ গেলে ভাস্কর লন্ডন থেকে চলে আসবেই। কোনওবার এর ব্যতিক্রম হয়নি।

একবার অসীম রায়ের বাড়িতে আরও অনেকের সঙ্গে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীও ছিলেন। তিন চারদিন অবিশ্রান্ত আড্ডার পর বিশেষ কাজ আছে বলে ভাস্করকে আগে লন্ডন ফিরে যেতেই হবে। সেইজন্য সে খুবই দুঃখিত। তার খুব ভোরবেলা ফ্লাইট, আগের রাতে প্রায় শেষ প্রহর পর্যন্ত আজ্ঞা হয়েছে, অ্যালার্ম দিয়ে জেগে উঠে ভাস্কর আমাদের কারুকে না ডেকে একা ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেল। সকালবেলা উঠে নীরেনদা হতভম্ব। ভাস্কর নিজেরটার বদলে নীরেনদার প্যান্ট পরে ও নীরেনদার চশমা নিয়ে ততক্ষণে পৌঁছে গেছে লন্ডনে। এটা সাধারণ বদলাবদলি নয়, নীরেনদা ভাস্করের থেকে অন্তত পাঁচ ইঞ্চি লম্বা এবং তাঁর চশমার ক্ষমতার সঙ্গে ভাস্করেরটির দূরত্ব বিস্তর। ওরকম প্যান্ট পরে এবং প্রায় অন্ধ হওয়ার মতন চশমা চোখে দিয়ে ভাস্কর কী করে বিমানে চেপে যথাস্থানে পৌঁছেও গেল, সেটাই এক রহস্য।

পরিণত বয়েসেও ভাস্কর যেন এক দূরন্ত শিশু।

গত আট-দশ বছর ভাস্কর খুব বেশি করে জড়িয়ে পড়ে দেশের সঙ্গে। তার দেশ কোনটা? সে ততদিনে ব্রিটিশ নাগরিক কিন্তু মনেপ্রাণে রয়ে গেছে উত্তর কলকাতার দত্ত বাড়ির ছেলে আর বাংলাভাষা প্রেমিক।

সে ঠিক করেছিল, বছরের তিন-চারমাস অর্থাৎ শীতের সময়টা কলকাতাতেই কাটাবে। এখানকার তরুণ কবিদের সঙ্গে সে মিশে গিয়েছিল সমবয়েসি বন্ধুদের মতন, তরুণ কবিদের জন্য দুটি পুরস্কারের প্রবর্তন করে সে। বনগাঁ-র পথের পাঁচালি সেবা সমিতির সঙ্গেও জড়িত হয়ে পড়ে ভাস্কর গ্রামের দরিদ্র মানুষদের জন্য অনেক কিছু করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। এ ছাড়া আচ্ছা ও ভ্রমণ তো আছেই।

ভাস্কর, অসীম, স্বাতী ও আমি এই চারজনের একটা টিম বহু জায়গায় বেড়াতে গেছি, বিদেশে এবং এদেশে। বছর দু-এক আগে, শীতকালে স্বাতী ও অসীমের ইচ্ছে কোনও জঙ্গলে গিয়ে কয়েকটি দিন কাটানোর, কিন্তু ভাস্কর ঠিক করল যাওয়া হোক কুলু-মানালি অঞ্চলে। তার এক ভাগনে খুব উচ্চ পদে রয়েছে, সুতরাং ব্যবস্থাপনার অনেক সুবিধে পাওয়া যাবে। ভাস্কর আর অসীম ঠান্ডার দেশেই থাকে, তবু পাহাড়ি উচ্চতায় শীতের মধ্যে যে আমাদের যাওয়া ঠিক নয়, তা তখন বুঝিনি।

মানালিতে গিয়ে ভাস্কর অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেখানকার হোটেল থেকে আমরা প্রস্তুত হয়ে বেরুচ্ছি, সেদিনই ফিরে আসব। লম্বা বারান্দা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে ভাস্করের পা দুটি দুর্বল হয়ে গেল, আমি আর অসীম তাকে ধরলাম দুদিক থেকে। আর কয়েক পা গেলেই বাইরে গাড়ি অপেক্ষমাণ, ভাস্কর হঠাৎ থমকে গিয়ে বলল, এটা কী হচ্ছে? এটা কী হচ্ছে?

খুব বিস্ময়ের সঙ্গে সে কী যেন বলতে চেয়েছিল, সেটা আর জানা হল না। সেটাই ভাস্করের শেষ কথা।

এমন স্বার্থপরের মতন আমাদের ছেড়ে হঠাৎ চলে যাওয়ার মতন কাজ ভাস্কর সারা জীবনে কখনও করেনি। পঁয়তিরিশ বছর বিলেতে থেকেও সে তার শরীরটা মিশিয়ে দিল হিমালয়ের ক্রোড়ে বিপাশা নদীর ধারে।

ভাস্কর চলে যাওয়ার পর একবারই গত বছরে আমাকে লন্ডনে আসতে হয়েছিল। সেবারে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে গেল এক সরকারি প্রতিনিধি, উঠতে হল হোটেলে। যদিও দু-একদিন পরই ভাস্কর ও আমার বন্ধু এখন লন্ডনের টেগোর সোসাইটির সভাপতি অমলেন্দু বিশ্বাস আতিথ্য দিল তার বাড়িতে, তার স্ত্রী অরুন্ধতী খুবই যত্ন করেছেন, ভাস্করের স্ত্রী ভিকটোরিয়ার কাছে গিয়ে থাকারও অসুবিধে ছিল না। লন্ডন থেকে অনেকটা দূরে একটা ছোট জায়গায় আন্তরিক আতিথ্য দিয়েছিল রাখী ও নবকুমার বসু নামে ডাক্তার দম্পতি। সমরেশ বসুর ছেলে নবকুমারকে চিনি ওর ছোটবেলা থেকে, সে নিজেও লেখক, ওদের সঙ্গে উপভোগ্য আড্ডা হয়। তবু মনটা পালাই-পালাই করছিল। ভাস্কর-বিহীন লন্ডন আমার সহ্য হচ্ছিল না।

এবারে লন্ডন এয়ারপোর্টে আমি সম্পূর্ণ একা। কাটাতে হবে তিন ঘণ্টা সময়। একটা রেস্তোরাঁয় কফি আর হট ডগ নিয়ে বসে রইলাম। লন্ডনে আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু আছে, রয়েছে অনেক বাংলাদেশি সুহৃদ, তাদের দু-একজনকে ফোন করলে আমায় নিয়ে যেতে পারত, একটা দিন এখানে বিশ্রাম নিয়ে যাওয়াই ছিল সুবিধেজনক, কিন্তু ইচ্ছে হল না। এয়ারপোর্টে হরেক রকমর সহস্র মানুষ, পৃথিবীতে যে কত জাতের, কত চেহারার, কত রকম পোশাকের মানুষ আছে, তার খানিকটা নমুনা পাওয়া যায় হিথরো বিমানবন্দরে। এবং সবাই ব্যস্ত। এসবের মাঝখানে একেবারে চুপচাপ বসে থাকারও এক ধরনের উপভোগ্যতা আছে। বইও পড়ছি না। শুধু চেয়ে আছি। এই যে কতরকম রঙিন মানুষের শশব্যস্ত চলাচল, এর মধ্যেও যেন একটা ছন্দ অনুভব করা যায়। কখনও মনে হয় চার্লি চ্যাপলিনের ফিল্ম।

অনেকক্ষণ পরে খেয়াল হল, আরে, আমার তো টার্মিনাল বদল করতে হবে!

হিথরো বিমানবন্দরটি প্রায় একটি শহরের মতন। এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনাল যেতে হয় বাসে চেপে। আর দেরি করলে আমাকে ফ্লাইট মিস করতে হত!

আমাকে যেতে হবে অনেক দূরে, দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়া রাজ্যে। সেখানে একটি আন্তর্জাতিক কবি সম্মেলনের আমন্ত্রণ। কলম্বিয়ায় কবি সম্মেলন? সেখানকার নাম শুনলেই তো মনে পড়ে ড্রাগ ও খুনোখুনির কথা। আবার মার্কেজের মতন লেখক কলম্বিয়াতেই জন্মেছেন।

গত বছরেও এই আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম, গ্রহণ করতে পারিনি অন্য অপরিহার্য কাজের জন্য। যদিও যাওয়ার খুবই ইচ্ছে ছিল, কারণ দক্ষিণ আমেরিকার কোনও দেশ আমি কখনও দেখিনি। এ বছরেও আমন্ত্রণ পাওয়াটা আশাতীত।

তবে, আমন্ত্রণ ও সত্যি সত্যি যাওয়ার ব্যবস্থাপনার মধ্যে অনেকগুলি ফাঁক থাকে।

কলম্বিয়া গরিব দেশ। তারা মোট আশিটি দেশের কবিদের প্রতি ডাক পাঠিয়েছে, এদের ভাড়া জোগানোর মতন সংস্থান কি তাদের আছে? এই বিশাল সম্মেলনের উদ্যোক্তা একটি সাহিত্য

প্রতিষ্ঠান, সরকার নয়।

আমার চিঠির সঙ্গে তাঁরা জানিয়েছিলেন, কোনও কবিকে তাঁরা যাতায়াতের ভাড়া দিতে পারবেন না। সব কবিদেরই নিজের নিজের সরকারের কাছ থেকে বিমান ভাড়া সংগ্রহ করতে হবে, সে জন্য উদ্যোক্তারাও দূতাবাসগুলির কাছে অনুরোধ জানাবেন।

পরের চিঠিটিই তাঁরা জানালেন যে তোমাদের দেশের সরকার তোমার বিমান ভাড়া দিতে রাজি হয়নি।

এতে আমি বিশেষ বিস্মিত হইনি। কোনও কারণে বর্তমান ভারত সরকার আমার প্রতি সদয় নন, বাংলাদেশের সঙ্গে সরকারি বাস যাত্রার উদ্বোধন অনুষ্ঠানেই আমি তা কিছুটা টের পেয়েছিলাম। তা হলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল। আমার নিজের পক্ষে তো অত ভাড়া দিয়ে যাওয়া সম্ভবই নয়।

পরের চিঠিতে সত্যিই চমকপ্রদ। আমি যেতে পারব না জানিয়ে দেওয়ার পরেও কবি সম্মেলন কমিটির সভাপতি আমাকে জানালেন যে, ভারত থেকে এ বছর আমিই একমাত্র আমন্ত্রিত, এত বড় সম্মেলনে ভারতের কোনও প্রতিনিধি থাকবে না, এটা তাঁদের মনঃপূত নয়, সেই জন্য ব্যতিক্রম হিসেবে আমার বিমান ভাড়া তাঁরাই দিয়ে দেবেন।

এরকম আনন্দ-সংবাদ আমি বহুদিন পাইনি।

এ বছরই আর একটি আমন্ত্রণ পেয়েছি অস্ট্রেলিয়ার কয়েকজন বাঙালির কাছ থেকে। সেখানেও আমি আগে কখনও যাইনি। তা হলে দক্ষিণ আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া ঘুরে এলেই সবক’টি মহাদেশ আমার ছুঁয়ে আসা হবে। কৈশোরে জাহাজের নাবিকের চাকরি নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণের কল্পনায় বিভোর হয়ে থাকতাম। সেটা যে এভাবে সম্ভব হবে, তা আমার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল।

অবশ্য আন্টার্কটিকা নামের তুষারময় মহাদেশটি বাদ রইল। সেটা বাদই থেকে যাবে। আন্টার্কটিকায় আর আমার ইহজীবনে পদার্পণ সম্ভব হবে না। যেমন, আর কিছুকালের মধ্যেই মহাশূন্যে সশরীরে পর্যটন শুরু হতে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের কাছে তা মানসভ্ৰমণ হয়েই রইল।

আন্টার্কটিকা বাদ দিয়ে অন্য সবক’টি মহাদেশ সফরের এই যে আমার গোপন আনন্দ, এটা এক ধরনের ছেলেমানুষিও বটে। আমার যেমন খুবই ভ্রমণের উদ্দীপনা আছে, আবার মাঝে মাঝে এও মনে হয়, না দেখলেই বা কী এমন ক্ষতি হত! অনেকে তো নিজের ঘরে শুয়েই বিশ্বদর্শন করে। মহাদেশগুলির বিভাজনও যে কত অলীক, তার প্রমাণ তো ইস্তানবুল শহরেই পেয়ে গেছি।

অনেক দৌড়ঝাঁপ, শারীরিক কষ্ট সহ্য করেও পৌঁছেছি কোনও দূর-দুর্গম দেশে। আবার এ কথাও মনে হয়, মনসা মথুরা ব্রজই সম্ভবত সর্বোৎকৃষ্ট ভ্রমণ।

এবারে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ছেড়ে আমাকে যেতে হবে আমেরিকার এয়ারলাইন্সে নিউ ইয়র্ক। কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটায় পৌঁছোবার জন্য নিউ ইয়র্ক যাওয়ার কোনও প্রয়োজনই নেই, এ যেন ঘুরিয়ে নাক দেখানো!

কিন্তু এই একই সময়ে নিউ ইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলিসে বাংলাদেশিদের উদ্যোগে দুটি বই মেলায় সাংস্কৃতিক উৎসব হচ্ছে, আমার দক্ষিণ আমেরিকা যাওয়ার খবর শুনে (আজকাল ইন্টারনেটের মাধ্যমে কোনও জাদুবলে যেন সবাই সবকিছু জেনে যায়। সেখানকার উদ্যোক্তারা আমাকে এই দুটি শহর ঘুরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছিলেন। আমি রাজি হয়েছিলাম এই জন্য যে, কলকাতা থেকে কলম্বিয়া পর্যন্ত সুদীর্ঘ একটানা যাত্রার ধকল খানিকটা কমবে মাঝপথে থেমে গেলে, আর নিউ ইয়র্কের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গেও দেখা হবে এক ঝলক। নিউ ইয়র্ক থেকে বাসে বা ট্রেনে চেপে বস্টনেও ঘুরে আসা যেতে পারে পুপলু আর চান্দ্রেয়ীর কাছে, হাতে সেই জন্য কয়েকটা দিন সময় রেখেছি।

টার্মিনাল বদল করে একেবারে শেষ মুহূর্তে পৌঁছবার জন্যই এবারেও জানলার ধারে আসন পাওয়া গেল না। এবারের আকাশ যাত্রায় আমাকে আকাশ বঞ্চিত হয়েই থাকতে হবে মনে হচ্ছে।

তিনটির বদলে দুটি সিট, জানলা দখল করেছে একটি অল্পবয়েসি শ্বেতাঙ্গিনী মেয়ে। তার চেহারাটা ছোট নয়, অনেকটা বেলুনের মতন, তবে মুখটা দেখলে বয়েস বেশি মনে হয় না। ত্যারছাভাবে তার দিকে কয়েকবার তাকিয়ে মনে হল, মেয়েটির নিশ্চয়ই কিছু মাথার রোগ আছে, প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টা ধরে যাত্রাকালে সে অনবরত কিছু না কিছু খেয়েই চলল, তার পায়ের কাছে একটা মস্ত ব্যাগ, সেটা খাবারে ভরতি। সে কিন্তু বিমানের খাবার প্রত্যাখ্যান করল। তার হাতের খোলা বইটি হ্যারি পটারের কাহিনি, সবাই বলে এই গাঁজাখুরি কাহিনি একেবারে রুদ্ধশ্বাস পাঠ্য। সে কিন্তু একটা পাতাও ওলটাল না। তাকে দেখে আমার একটু ভয় ভয়ই করছিল, তাই সে, যখন রোদ্দুর আড়াল করার জন্য জানলাটা বন্ধই করে দিল, আমি মুখের ভাবেও আপত্তি প্রকাশ করিনি।

বিমান যাত্রায় সাধারণত কোনও নাটকীয় ঘটনা ঘটে না। আমাদের এদিকে অনেক যাত্রী অন্য যাত্রীর সঙ্গে চেঁচিয়ে কথা বলে বটে, ওদিকে সেটা ঠিক শোভন নয়। কেউ অন্যের কথা শুনতে পায় না।

এ যাত্রায় সামান্য একটা ঘটনা ঘটল। আমার ঠিক সামনের সারিতে একটি পুরুষ ও নারী কণ্ঠের উত্তেজিত কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল মাঝে-মাঝে। ভাষা আমি বুঝিনি, খুব সম্ভবত স্প্যানিশ।

ঘণ্টাখানেক পরে মহিলাটি উঠে দাঁড়ালেন।

বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য সেই রমণী। প্রথমত তাঁর উচ্চতা অধিকাংশ মেয়েদের চেয়ে বেশ বেশি, একেবারেই স্থূলকায় নয় অথচ বড়সড়ো শরীর, মুখের ভঙ্গিতে এমন একটা আভিজাত্য আছে যে মনে হয়, ইংরেজি সিনেমায় এরকম কোনও রানিকে দেখেছি। বাংলাদেশের লেখিকা দিলারা হাসেনের সঙ্গে যেন খানিকটা সাদৃশ্য আছে তাঁর মুখের রেখায়। তরুণী নয়। এঁর বয়েস অন্তত পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি।

মহিলাটি একজন এয়ার হোস্টেসকে ডেকে যা বললেন, তাতে বোঝা গেল, ইনি জায়গা বদল করতে চান।

পাশের পুরুষটি কিছু বলার চেষ্টা করল, তার জড়িত কণ্ঠস্বরই প্রমাণ করে দেয় যে সে নেশাগ্রস্ত এবং রসস্থ।

তার কথায় কান না দিয়ে নিজের হ্যান্ডব্যাগটি নিয়ে জানলার ধার ছেড়ে বেরিয়ে এলেন মহিলাটি, এয়ার হোস্টেসের সমভিব্যাহারে চলে এলেন অন্যদিকে।

এ হচ্ছে, সেই ধরনের রূপ, যা একবার দেখলেই মনের মধ্যে একটা চিরস্থায়ী ছবি হয়ে যায়।

মহিলাটিকে মনে রাখবার আরও কারণ আছে। নিউ ইয়র্কে পৌঁছে তিনি আমার অশেষ উপকার করেছিলেন।

শেষের দিকে আমি ঘুমিয়ে নিয়েছিলাম অনেকখানি। বিমানটি আমেরিকার ভূমি স্পর্শ করার পর সেই ঝাঁকুনিতে আমার ঘুম ভাঙল। এ রকম আচমকা ঘুম ভাঙলে প্রথম কয়েক মুহূর্ত বোঝাই যায় না আমি কোথায় আছি। এটা বিকেল না সকাল?