০৩. বিল্টুদের পাশের বাড়ির দুটি মেয়ে

বিল্টুদের পাশের বাড়ির দুটি মেয়ে পড়ে মর্ডান হাই স্কুলে। আর পার্কের দুপাশে বাড়ির দুটি ছেলে পড়ে সেন্ট লরেন্সে। বিল্টু ডন বস্কোতে। এই পাঁচজন একসঙ্গে স্কুলে যায়। একটা ভাড়ার গাড়ি ওদের তুলে নিয়ে যায়, ছুটির পরে ফিরিয়ে আনে। কোনওদিন ভুল হয় না। তিনটে স্কুলেরই ছুটির সময় মোটামুটি এক। কোনওদিন কারও একটু আগে ছুটি হয়ে গেলে সে অপেক্ষা করে গাড়ির জন্য।

বিকেল সাড়ে চারটের কাছাকাছি সময় বাড়ির সামনে একবার হর্ন বাজলেই বিল্টুর মা বুঝতে পারেন যে বি এসে গিয়েছে। সেই সময় সদর দরজা খোলাই থাকে। একটু পরেই মা শুনতে পান সিঁড়িতে ধুপধাপ শব্দ। রিনি কলেজে পড়ে। তার ফিরতে ফিরতে সাড়ে পাঁচটা বেজে যায়। বাবা অফিস থেকে ফেরেন সাতটার পর।

বিল্টুর মা জয়ন্তী শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছিলেন। রিনিকে ঘরে ঢুকতে দেখে তিনি বইটা সরিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, আজ তাড়াতাড়ি ফিরে এলি যে?

রিনি বলল, তাড়াতাড়ি? এখন পৌনে ছটা বাজে।

জয়ন্তী ধড়মড় করে উঠে বসে বললেন, পৌনে ছটা? বিন্দু যে এখনও ফেরেনি!

রিনির ভুরু কুঁচকে গেল। সে আপনমনে বলল, বিল্টু এখনও ফেরেনি?

সে চলে এল বারান্দায়। রেলিং-এ একটু ঝুঁকে ডাকল, খুশি, এই খুশি!

দু-তিনবার ডাকার পর পাশের বাড়ির বারান্দায় একটি লম্বামতো ছেলে এসে দাঁড়াল। সে বলল, কী বলছেন, দিদি?

রিনি বলল, শিবু, খুশি আর টুসি ফিরেছে স্কুল থেকে?

শিবু বলল, না গো দিদি, ওদের স্কুলের গাড়ি এখনও আসেনি।

রিনি বলল, এখনও আসেনি? প্রায় ছটা বাজে। এত দেরি হবে কেন?

শিবু বলল, আমরাও তো তাই ভাবছি। হয়তো ট্রাফিক জ্যামে আটকেছে। টিভির খবরে বলছিল, পার্ক সার্কাসে নাকি কীসের একটা মিছিল বেরিয়েছে।

রিনি জিজ্ঞেস করল, ওই ভাড়া গাড়ির ড্রাইভারের কাছে মোবাইল নেই?

শিবু বলল, আছে তো। কিন্তু আমি তো নম্বর জানি না। দিদিমণিরা জানেন।

রিনি বলল, আমার মোবাইলে বোধহয় নম্বরটা ভোলা আছে। আচ্ছা, আমি দেখছি।

ঘরের ভিতরে এসে হ্যান্ডব্যাগের মধ্যে মোবাইলটা খুঁজতে খুঁজতে রিনির মনে পড়ল, আগের সপ্তাহেই তার পুরনো মোবাইলটা হারিয়ে গিয়েছে। এটা নতুন। এটার মধ্যে কোনও নম্বরই সেভ করা নেই।

জয়ন্তী এসে দাঁড়ালেন বারান্দায়। এই রাস্তা দিয়ে অনেক গাড়ি যায়। বিদের জন্য ভাড়া গাড়িটা সাদা রঙের। ডান দিক দিয়ে কোনও সাদা গাড়ি আসতে দেখলেই জয়ন্তী উদগ্রীব হয়ে তাকাচ্ছেন। কিন্তু কোনও গাড়িই থামছে না।

একটু পরেই জয়ন্তী অস্থির হয়ে বললেন, রিনি, এখনও তো এল না। কী করা যায় বল তো!

রিনি বলল, ওরা পাঁচজন একসঙ্গেই তো আছে। চিন্তার কিছু নেই। তবু আমি স্কুলে একটা ফোন করে দেখছি।

ডন বস্কো স্কুলে ফোন বেজে গেল। অনেকক্ষণ ছুটি হয়ে গিয়েছে। অফিসে কেউ নেই।

এবার একটা সাদা গাড়ি থামল পাশের বাড়ির গেটের কাছে। রিনি এসে দাঁড়াল বারান্দায় মায়ের পাশে। গাড়ি থেকে নামল খুশি আর টুসি। বিল্টু তো নামল না! খুশি আর টুসি নিজেদের বাড়িতে না ঢুকে তাকাল এই বারান্দার দিকে।

জয়ন্তী চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বিল্টু নামছে না? ও গাড়ির মধ্যে বসে আছে কেন?

খুশি বলল, বিল্টু গাড়িতে নেই। ও বাড়ি ফিরে আসেনি?

রিনি বলল, না তো! ও একলা ফিরবে কী করে? ও তো তোদের সঙ্গেই ফেরে।

গাড়ির ড্রাইভার বিমল রাস্তায় নেমে বলল, আমি উপরে আসছি। মাসিমা।

পাশের বারান্দা থেকে শিবু দেখছে। তার দিকে হাত নেড়ে খুশি আর টুসিও বিমলের সঙ্গে চলে এল এ বাড়ির দোতলায়।

বিমল বলল, মাসিমা, বিন্দু তো স্কুলে নেই।

জয়ন্তী বললেন, নেই মানে? কোথায় বিল্টু?

খুশি বলল, আমাদের যেতে একটু দেরি হয়েছে। গেটের দরোয়ান বলল, বি ওখানেই ছিল, হঠাৎ কোথায় যেন চলে গিয়েছে!

টুসি বলল, আর-একজন দরোয়ান বলল, রাস্তা পেরিয়ে উলটো দিকে গিয়েছে বোধহয়। দ্যাখো গিয়ে পার্কে।

জয়ন্তী বললেন, ও নিজে নিজে রাস্তা পেরোবে? ওই রাস্তায় কত গাড়িটাড়ি চলে!

বিমল বলল, আমরা বারণ করেছি ও শোনেনি। পার্কে তো ফুটবল খেলা হয়। ও রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে সেই খেলা দ্যাখে।

টুসি বলল, আজও সেখানে খেলা হচ্ছে। আমরা সকলে মিলে গেলাম। কিন্তু সেখানেও বিল্টু নেই। অনেক খুঁজলাম।

জয়ন্তী ঝাঝালো গলায় বললেন, তারপর তোমরা বিলুকে না নিয়ে চলে এলে?

বিমল বলল, আমরা ভাবলাম, বিন্দু নিজেই বাড়ি চলে এসেছে।

রিনি ধমক দিয়ে বলল, এ কথা তোমরা ভাবলে কী করে? ওইটুকু ছেলে একা একা বাড়ি ফিরতে পারে?

বিমল এবার টুসি আর খুশির মুখের দিকে তাকাল। তারপর কাঁচুমাচুভাবে বলল, একটা কথা আপনাদের বলা হয়নি। কয়েক দিন আগে…

টুসি বলল, গত সোমবার…

বিমল বলল, গত সোমবার, আমরা বাড়ি ফিরছি, আপনাদের ছেলে তো যেমন জেদি, তেমনই সাহসী, কী নিয়ে যেন টুসির সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। গাড়িটা যখন একটা সিগনালের লাল আলোয় থেমেছে, বিল্টু অমনই বলল, আমি টুসির সঙ্গে বাড়ি যাব না! বলে সঙ্গে সঙ্গে সে গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়ল।

জয়ন্তী একটা ভয়ের শব্দ করে উঠলেন।

বিমল বলল, নেমেই সে ছেলে উঠে পড়ল একটা রিকশায়। রিকশাওয়ালাকে বলল, অ্যাই, আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো। সোজা রাস্তা। অন্য কোনওদিকে গেলে স্কেল দিয়ে তোমায় মারব! রিকশাটা চলতে শুরু করেছিল। আমি সামনে গিয়ে সেটাকে আটকালাম। কিন্তু যতই কাকুতি-মিনতি করি, কিছুতেই সে শুনতে চায় না। সে রিকশাতেই বাড়ি ফিরবে।

খুশি বলল, বিল্টুর হাতে একটা স্কেল। সেই স্কেল দিয়ে সে সকলকে মারবে!

বিমল বলল, রাস্তায় ভিড় জমে গিয়েছিল!

টুসি বলল, তারপর কী হল জানো তো মাসি? আমার সঙ্গে তো বিন্দুর ঝগড়া হয়েছিল। আমিও টপ করে সেই রিকশায় উঠে পড়ে বললুম, আমার উপর রাগ করেছিস তো? ঠিক আছে, ওই স্কেল দিয়ে আমাকে মার। কিংবা আমিও তোর সঙ্গে এই রিকশায় যাব!

খুশি বলল, তাতেও ছেলের রাগ যায় না। সে একাই বাড়ি ফিরবে। তখন আমি আর টুসি দুদিক থেকে যে-ই কাতুকুতু দিলাম, অমনই হাসতে হাসতে…

বিমল বলল, তাই ওকে না পেয়ে ভাবলুম, একা রিকশায় বাড়ি ফেরার সাহস যখন ওর হয়েছে, আজও আমাদের দেরি দেখে ও বাড়ি চলে আসতে পারে।

রিনি জিজ্ঞেস করল, তোমাদের যেতে দেরি হল কেন?

বিমল বলল, পার্ক সার্কাসের কাছে মিছিলে অনেক গাড়ি আটকে গিয়েছিল, রাস্তা জ্যাম।

জয়ন্তী উতলা হয়ে বললেন, কিন্তু রিকশায় এলেও তো এতক্ষণে পৌঁছে যাওয়ার কথা। একেবারে সোজা রাস্তা।

বিমল কঁচুমাচু হয়ে বলল, আমি গোটা রাস্তা খুব আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে এলুম। কোনও রিকশাতেই বিন্দুবাবু নেই।

রিনি বলল, চলো তো বিমল, তোমার গাড়িতেই আমি স্কুল পর্যন্ত একবার ঘুরে আসি। দেখি যদি কোথাও…

জয়ন্তী বললেন, আমিও যাব তোর সঙ্গে।

রিনি বলল, না, মা, তুমি থাকো। তুমি বরং সিদ্ধার্থদাকে একটা ফোন করো। না, থাক, এখনই ফোন করার দরকার নেই। আমি ফিরে আসি, তখনও যদি কোনও খবর না পাই… রিনি নেমে গিয়ে বিমলের গাড়িতে উঠে বসল।

এর মধ্যে সন্ধে হয়ে এসেছে। আলো জ্বলে উঠেছে রাস্তায়। সব বাড়িতেও আলো জ্বলছে। রাস্তা দিয়ে হাঁটছে অনেক মানুষ, প্রচুর গাড়িও চলছে স্বাভাবিকভাবে। সব কিছুই অন্য দিনের মতো। শুধু বিল্টুর দেখা নেই!

রিনি স্কুল পর্যন্ত গেল। গেট একেবারে বন্ধ। উলটো দিকের পার্কেও ফুটবল খেলা শেষ হয়ে গিয়েছে। তা হলে বিল্টু কোথায় গেল? সে এমনিতে যতই দুষ্টুমি করুক, একা-একা বাড়ির বাইরে কোথাও যায় না।

রিনি ফিরে এসে দেখল, জয়ন্তীর দুপাশে বসে আছে খুশি, টুসি, আর ওদের মা শিখা টেলিফোন করছেন। বিল্টুর ক্লাসের কয়েকটা ছেলের কাছে জানা গিয়েছে যে, বিল্টু শেষ পর্যন্ত ক্লাসেই ছিল। ছুটির পর সে কোথায় গিয়েছে, তারা জানে না। রিনির বাবার অফিস সল্টলেকে। এক-একদিন তার ফিরতে বেশ দেরি হয়ে যায়। আজ তিনি বলে গিয়েছেন, তার জরুরি মিটিং আছে। এখনই তাকে খবর দিলে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। কাজ শেষ না করেই নিশ্চয়ই চলে আসবেন। তার আগে রিনি ফোন করল তার দিদির বাড়িতে।

স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করল, কী রে রিনি, হাফাচ্ছিস কেন? কী হয়েছে? সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গিয়েছিস?

রিনি বলল, না, দিদি, শোনো, একটা ব্যাপার হয়েছে, আগেই ভয় পেয়ে যেয়ো না। মানে, বিল্টু এখনও স্কুল থেকে ফেরেনি, আর সকলে ফিরে এসেছে।

স্নিগ্ধা ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, আঁ, কী বলছিস? বিল্টু? কী হয়েছে? অ্যাক্সিডেন্ট?

স্নিগ্ধার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে সিদ্ধার্থ জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে রে রিনি? তোর দিদির তো মনে হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক হবে! বিন্দু কোথায়? কখন অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে?

রিনি বলল, অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে কিনা জানি না। যে গাড়িটা বিন্দুকে স্কুল থেকে আনতে যায়, সে গাড়িতে বিল্টু আসেনি। ওরা তাকে খুঁজে পায়নি।

সবটা শোনার পর সিদ্ধার্থ বলল, শোন, এখন মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। অনেক কিছুই হতে পারে, আবার হয়তো কিছুই হয়নি। এখনই হয়তো কেউ বিল্টুর হাত ধরে পৌঁছে দিতে পারে। এরকম হয়। আমি তোর দিদিকে নিয়ে আধঘণ্টার মধ্যে তোদের বাড়িতে পৌঁছে যাব। তার আগে দু-একটা হাসপাতালে খোঁজ নিতে হবে।

সিদ্ধার্থ রেখে দেওয়ার একটু পরেই আবার বেজে উঠল ফোন।

এবার একটি অচেনা কণ্ঠ প্রথমেই বলল, পুলিশে খবর দেননি তো? দিলেও অবশ্য পুলিশ এত তাড়াতাড়ি কোনও অ্যাকশন নেয় না। শুনুন।

রিনি জিজ্ঞেস করল, আপনি কে বলছেন?

ভদ্রলোকটি বললেন, আমার নাম সুপ্রিয় রায়। আপনার ভাই আমার কাছে আছে। চিন্তার কিছু নেই। একটু পরেই ফেরত যাবে।

রিনি আবার জিজ্ঞেস করল, আমার ভাই আপনার কাছে গেল কী করে? আপনাকে তো আমি চিনতে পারছি না!

সুপ্রিয় রায় বললেন, আমায় চিনবেন কী করে? আমিও তো আপনাকে চিনি না। একটু আগে আপনার ভাইয়ের কাছে আপনার নাম শুনলাম। ফোন নম্বরটাও জেনে নিলাম।

রিনি বলল, আমার ভাই, আমার ভাইকে আপনি আগে চিনতেন?

সুপ্রিয় বললেন, না। আজ বিকেলবেলা ছেলেটি একটি পার্কের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল, এমন সময় একটা স্কুটারের সঙ্গে ওর ধাক্কা লাগে। যে চালাচ্ছিল, তার খুব দোষ নেই। ছেলেটি হঠাৎ দৌড়ে এসে পড়েছিল। ধাক্কা লেগে ছেলেটি ছিটকে পড়ে যায়, তাতে ওর মাথা ফেটে… আরে শুনুন, শুনুন, তেমন সিরিয়াস কিছু নয়। ছোট ছেলেমেয়েদের মাঝে মাঝে ওরকম মাথা ফাটে। তাতে এমন কিছু হয় না। খানিকক্ষণ অজ্ঞান হয়ে ছিল, এখন জ্ঞান ফিরেছে। দিব্যি কথা বলছে, এক গেলাস গরম দুধও খেল।

রিনি বলল, বিল্টু আপনার কাছে আছে। আপনার বাড়ি কোথায়?

সুপ্রিয় বললেন, এই তো বেকবাগানে। আমি ডাক্তার, এখানেই আমার চেম্বার। সেই স্কুটার চালকই আমার কাছে পৌঁছে দিল। আমি ভাল করে পরীক্ষা করে দেখেছি, সব ঠিকঠাক আছে, হাড়টাড় কিছু ভাঙেনি, চিন্তা করবেন না। অকারণ থানা-পুলিশ করে কোনও লাভ নেই। এখনই আমার চেম্বার বন্ধ হবে, আমি নিজে গিয়ে ওকে পৌঁছে দিয়ে আসছি। বড়জোর আধঘণ্টা লাগবে।

রিনি বলল, আপনি কেন কষ্ট করে আসবেন। আপনি যথেষ্ট উপকার করেছেন। আপনি ঠিকানাটা বলুন, আমরাই ওকে নিয়ে আসছি।

সুপ্রিয় বললেন, কষ্টের কী আছে? আমি ওই পথ দিয়েই যাব। ছেলেটিকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।

রিনি বলল, ডাক্তার রায়, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি আমাদের জন্য যা করলেন!

সুপ্রিয় হেসে বললেন, দাঁড়ান, আগে পৌঁছে দিই। তারপর তো ধন্যবাদ দেবেন। শুধু ধন্যবাদ দিলে চলবে না, মিষ্টি খাওয়াতে হবে। ঠিক আধঘণ্টা থেকে চল্লিশ মিনিটের মধ্যে…

ফোনটা রেখে দেওয়ার পর রিনির চোখে জল এসে গেল। খুব আনন্দের সময় এরকম হয়। জয়ন্তী অন্য একটা রিসিভারে সব শুনেছেন, তিনি এসে জড়িয়ে ধরলেন রিনিকে।

রিনি বলল, দ্যাখো, পৃথিবীতে এখনও কত ভাল মানুষ আছেন। এই ডাক্তারটি বিন্দুকে সুস্থ করে তুলেছেন, আবার নিজে পৌঁছে দিতে আসছেন। বিন্দুকে দুধও খাইয়েছেন।

জয়ন্তী বললেন, বাড়িতে তো কিছুতেই দুধ খেতে চায় না। ওখানে খেয়ে নিল?

রিনি বলল, ডাক্তাররা জানেন কী করে খাওয়াতে হয়!

জয়ন্তী জিজ্ঞেস করলেন, হারে, কতটা মাথা ফেটেছে? অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল?

রিনি বলল, খুব বেশি নয় নিশ্চয়ই। তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফিরেছে। গত মাসেও তো বিলুর একবার মাথা ফেটেছিল। এ ছেলেকে আরও শক্ত করে সামলে রাখতে হবে মা।

জয়ন্তী বললেন, আমার এখনও বুক কাঁপছে। ভাবতেই পারছি না। স্কুটারের ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল ছেলেটা…এখন সে কী অবস্থায় আছে?

রিনি বলল, আর আধঘণ্টার মধ্যেই তো দেখতে পাবে।

এরপর শুধু প্রতীক্ষা। এখন প্রতিটি মিনিটই মনে হয় খুব লম্বা। রাস্তায় যে-কোনও গাড়ি থামলেই দৌড়ে যেতে হয় বারান্দায়। এর মধ্যে আবার লোডশেডিং হয়ে গেল। সমস্ত পাড়া জুড়েই অন্ধকার। সময় যেন আর কাটতেই চায় না। আলোর চেয়ে অন্ধকারকে আরও বেশি লম্বা মনে হয়।

ঘরের মধ্যে গরম, তাই মা আর মেয়ে দুজনেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে। একসময় বেজে উঠল ফোন। অন্ধকারে ঝনঝন শব্দটাও যেন বেশি জোরালো।

এবারে ফোন ধরলেন জয়ন্তী। তিনি হ্যালো বলতেই একটি গম্ভীর কণ্ঠ জিজ্ঞেস করল, এ বাড়িতে কি পুরুষমানুষ কেউ নেই?

জয়ন্তী বললেন, আপাতত কেউ নেই। আপনি কী বলতে চান, আমাকে বলতে পারেন।

সেই গম্ভীর কণ্ঠ বলল, আপনাকে বললে ঠিক কাজ হবে না। ব্যাবসাবাণিজ্যের ব্যাপার। আপনাদের ছেলে এখন আমাদের কাস্টডিতে আছে। আপনারা তাকে ফিরে পেতে চাইলে কয়েকটি শর্ত মানতে হবে।

জয়ন্তী চমকে উঠে বললেন, আপনি কে বলছেন? আপনি ডাক্তার সুপ্রিয় রায়?

গম্ভীর কণ্ঠ বিরক্তভাবে বলল, কে সুপ্রিয় রায়?

জয়ন্তী বললেন, আপনি একটু আগে ফোন করেননি? আপনি যে বললেন, আপনি আমার ছেলেকে নিয়ে আসছেন?

লোকটি বলল, কে ওই সব বলেছে, আমি জানি না। আপনার ছেলে এখন আমার কাছে। তাকে এখন ফেরত পাওয়া যাবে না।

জয়ন্তী চিৎকার করে বলে উঠলেন, অ্যাঁ এসব কী বলছেন? কে আপনি?

লোকটি বলল, এই জন্যই মেয়েদের সঙ্গে আলোচনা করা যায় না। আপনার হাজব্যান্ড কখন ফিরবেন?

বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে থামল। রেলিং থেকে ঝুঁকে রিনি দেখতে চাইল, সেই গাড়ি থেকে বিল্টু নামছে কিনা। তারপর চেঁচিয়ে বলল, মা, দিদি-সিদ্ধার্থদারা এসে গিয়েছে। আমি নীচে গিয়ে দরজা খুলে দিচ্ছি।

টেলিফোনের লোকটি বলল, ঠিক আছে। আমি আবার দুঘণ্টা পরে ফোন করব।

জয়ন্তী বললেন, না, না, ধরুন, ধরুন, এসে গিয়েছে!

লোকটি বলল, কে এসে গিয়েছে? আপনার স্বামী ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে আমি কথা বলব না।

জয়ন্তী বললেন, এ আমাদের বাড়ির জামাই। বাড়ির ছেলেরই মতো। ও সব কিছুর দায়িত্ব নিতে পারে।

লোকটি বলল, আমি আর ঠিক তিরিশ সেকেন্ড ফোন ধরে থাকব।

জয়ন্তী চেঁচিয়ে বললেন, সিদ্ধার্থ, তাড়াতাড়ি, খুব তাড়াতাড়ি এসো।

এক-এক লাফে দু-তিনটে সিঁড়ি পেরিয়ে সিদ্ধার্থ উঠে এল দোতলায়। অন্ধকারের মধ্যে হোঁচট খেল একবার।

জয়ন্তীর উঁচু করা হাত থেকে ফোনটা নিয়ে সে বলল, হ্যালো, সিদ্ধার্থ ঘোষ স্পিকিং।

গম্ভীর গলার লোকটি বলল, আমি একটা বিজনেস কোম্পানি থেকে বলছি। প্রথম কথাই হল, আপনাদের বাড়ির ছেলে বিল্টু আমাদের কাছে আছে। সে বেশ ভাল আছে। তার জন্য চিন্তা করার কোনও কারণ নেই।

পাশ থেকে জয়ন্তী বললেন, ওর মাথা ফেটেছে!

লোকটি বলল, না, মাথাটাথা ফাটেনি। হঠাৎ মাথা ফাটবে কেন? গায়ে একটু ধুলোও লাগেনি। শুনুন, বেশি সময় নেই…

সিদ্ধার্থ জিজ্ঞেস করল, আপনাদের কীসের বিজনেস?

লোকটি বলল, অর্ডার সাপ্লাই। অনেক কিছু সাপ্লাই করি। তার মধ্যে ছোট ছেলেদের বাজারদর খুব ভাল।

সিদ্ধার্থ বলল, বাজারদর মানে? আপনারা ছোট ছেলেদের ধরে ধরে বিক্রি করেন?

লোকটি বলল, আমরা ধরি না। ওসব ঝামেলায় আমরা যাই না। অন্য লোকেরা ধরে, তারপর আমাদের কাছে বিক্রি করতে দিয়ে যায়। আমরা কমিশন নিই। আর প্রশ্ন করবেন না, পরপর যা বলি শুনে যান। কাগজ-কলম থাকলে লিখেও নিতে পারেন।

রিনি দৌড়ে পাশের ঘর থেকে একটা ছোট্ট টেপ রেকর্ডার এনে নিঃশব্দে রাখল ফোনের পাশে।

সিদ্ধার্থ বলল, কাগজ-কলম লাগবে না। আপনি বলুন, আমার মনে থাকবে।

লোকটি বলল, প্রথম কথা হল, আমি কোথা থেকে ফোন করছি, তা কোনওক্রমেই খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর কোনও পুলিশই পারবে না। সুতরাং, এখানকার পুলিশদের জানালে কোনও লাভই হবে না। দুনম্বর, পুলিশকে জড়ালে আপনাদের বিপদই হবে। পুলিশকে কিছু জানাবেন না। তিন, যে বেশি দাম দেবে, তাকেই আমরা জিনিস বিক্রি করব। এটাই তো ব্যাবসার নিয়ম। ছোট ছেলেদের বিদেশে খুব চাহিদা। তবে কম বয়সের ছেলে হলে আগে আমরা বাবা-মায়ের কাছেই অফার দিই। এ ছেলের দাম ধরা হয়েছে কুড়ি লাখ টাকা। আগামী পাঁচদিনের মধ্যে পুরো টাকা দিয়ে দিলে ছেলেকে আমরা নিখুঁত অবস্থায় ফেরত দেব। কোয়ালিটি গ্যারান্টিড। ছেলে হাসতে হাসতে ফিরে আসবে। চার, টাকা দেওয়ার ব্যাপারে কোনও গন্ডগোল করলে কিংবা পিছনে পুলিশ নিয়ে এলে আপনাদের ছেলের প্রাণের দায়িত্ব আমরা নিতে পারব না। ও কে? এটা ভাল করে মনে রাখতে হবে। ছেলেকে ফিরে পেতে হলে টাকাটা দিতে হবে। এ ছাড়া আর কোনও অল্টারনেটিভ নেই।

সিদ্ধার্থ এর মধ্যে বলে উঠল, কিন্তু এত টাকা আমরা দেব কী করে? আমরা কী দোষ করেছি?

লোকটি বলল, নো কোয়েশ্চেন, নো কোয়েশ্চেন! আমি যা বলব, শুনে যান। টাকাটা কবে, কখন আর কোথায় দিতে হবে, তা আমরা দুদিনের মধ্যে জানিয়ে দেব। কুড়ি লাখ টাকা!

সিদ্ধার্থ বলল, শুনুন, শুনুন, এর মধ্যে যদি আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়, তা হলে কোথায় যোগাযোগ করব? বিল্টুর বাবা এখনও কিছু জানেন না। তিনি যদি কথা বলতে চান আপনাদের সঙ্গে, কোন নম্বরে আপনাদের পাব?

লোকটি ঠিক দুবার শুকনোভাবে হা হা করে হাসল। তারপর বলল, খুব চালাক, তাই না? আমরা একটা নম্বর দেব, অমনই একঝক পুলিশ গিয়ে সেখানে হাজির হবে? না, না, না, না, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনও দরকার নেই। আমরাই যোগাযোগ করব। এবার শেষ দরকারি কথা। আপনাদের এক খোঁড়া আত্মীয় আছে, রাজা রায়চৌধুরী, অনেকে তাকে কাকাবাবু বলে। সে লোকটা যেন কোনওক্রমেই এর মধ্যে মাথা না গলায়। তাকে আপনারা জানিয়ে দেবেন, তার উপর আমরা নজর রাখছি। সেই রাজা রায়চৌধুরী কোনওরকম কায়দাকানুন করতে গেলে ছোট ছেলেটির জীবন সম্পর্কে আমাদের আর দায়িত্ব থাকবে না। প্রথমে তার ডেডবডি ডেলিভারি দেওয়া হবে। তারপর রাজা রায়চৌধুরী খুন হবে। ক্লিয়ার? বুঝলেন তো? আপনাদের ভালর জন্যই রাজা রায়চৌধুরীকে দূরে রাখুন। ঠিক আছে, আজ এই পর্যন্ত।

ফোন বন্ধ হয়ে গেল!