০৩. জাতীয় গ্রন্থাগারে কাকাবাবু

জাতীয় গ্রন্থাগারে কাকাবাবু একটা দরকারি বইয়ের খোঁজে এসেছিলেন। এখানে অনেকেই তাঁর চেনা। প্রধান গ্রন্থাগারিক নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে চা খাওয়ালেন। তারপর কাকাবাবু বই দেখলেন অনেকক্ষণ ধরে। সেখান থেকে বেরুতে বেরুতে সন্ধে হয়ে গেল। গেটের বাইরে এসে তিনি একটাও ট্যাক্সি দেখতে পেলেন না। সাধারণত চিড়িয়াখানার সামনে এই সময় অনেক ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকে। পরপর দুটো বাস এল, তাতে দারুণ ভিড়। কাকাবাবু খোঁড়া পা নিয়ে এরকম ভিড়ের বাসে উঠতে পারেন না। তিনি ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

এক সময় একজন মোটাসোটা চেহারার লোক তাঁর সামনে থমকে দাঁড়াল। বিগলিতভাবে হেসে বলল, কেমন আছেন, স্যার?

তারপর সে নিচু হয়ে কাকাবাবুর এক পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।

কাকাবাবু খুব বিব্রত বোধ করলেন। তিনি যাকে-তাকে প্রণাম করেন না, যার-তার প্রণাম নেওয়াও পছন্দ করেন না। তিনি একটুখানি পিছিয়ে গেলেন।

।লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কোথায় গেছিলেন, স্যার?

কাকাবাবু বললেন, এই একটু ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে…

লোকটি কাকাবাবুর চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আস্তে-আস্তে বলল, আপনাকে অনেকদিন ধরে খুঁজছি, আপনার সঙ্গে আমার জরুরি দরকার আছে।

কাকাবাব এবারে একটু কড়া গলায় বললেন, কিন্তু আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি। দরকার থাকলে আপনি আমার বাড়িতে এসে দেখা করবেন।

লোকটি জিজ্ঞেস করল, আপনার ঠিকানাটা… কাকাবাবু পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে দিয়ে বললেন, এই যে, এতে আমার ঠিকানা পাবেন।

লোকটি কার্ডটা উল্টেপাল্টে দেখে নিয়ে বলল, বাঃ! খুব উপকার হল। দেখা করব একদিন। সত্যি খুব দরকার।

লোকটি আর দাঁড়াল না, হনহন করে চলে গেল ডান দিকে। কাকাবাবু সেদিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। কে লোকটা, আগে কোথাও দেখেছেন কি না কিছুই মনে পড়ল না।

পুলিশ কমিশনার বলেছিলেন, মিঃ রায়চৌধুরী, দিনকাল ভাল নয়। আপনি একলা একলা রাস্তায় বেরোবেন না। বিশেষত সন্ধের পর। আপনার তো শত্রু কম নয়, কে কখন প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবে, তার ঠিক কী! যদি চান

তো আপনার একজন বডিগার্ড ঠিক করে দিতে পারি।

কাকাবাবু পুলিশ কমিশনারের এই প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়েছিলেন। সব সময় সঙ্গে একজন বডিগার্ড নিয়ে ঘোরার কথা তিনি ভাবতেই পারেন না। তাঁর ওপর অনেকের রাগ আছে বটে। তিনি গুপ্তচক্র ভেঙেছেন, অনেক বদমাশকে জেলে ভরেছেন। তাদের সঙ্গী সাথীরা তাঁর ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা। করতে পারে। কিন্তু কাকাবাবুর ধারণা, যে-মানুষ নিজে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না, তার ঘর থেকে বেরোনোই উচিত না।

আরও মিনিটপাঁচেক দাঁড়াবার পর কাকাবাবুর ধৈর্য নষ্ট হয়ে গেল। ট্যাক্সি পাওয়ার আর আশা নেই। কাকাবাবু হাঁটতে লাগলেন। ময়দানের দিকে গেলে নিশ্চয়ই ট্যাক্সি পাওয়া যাবে।

ক্রাচে ভর দিয়ে তিনি হাঁটতে লাগলেন আস্তে-আস্তে। চিড়িয়াখানার পাশ দিয়ে এসে তিনি ব্রিজের ওপর উঠতে লাগলেন। সন্ধে হয়ে এসেছে। রাস্তার দুদিকে ছুটন্ত গাড়ির হেডলাইট। এইখানটায় কেমন যেন বুনো-বুনো গন্ধ পাওয়া যায়। ক্যাঁকাও ক্যাঁকাও করে কী একটা পাখি ডেকে উঠল তীক্ষ্ণ স্বরে। কাকাবাবু ভাবলেন, অনেকদিন চিড়িয়াখানায় আসা হয়নি। মাঝে-মাঝে এলে মন্দ হয় না। চিড়িয়াখানায় এলে নতুন করে বোঝা যায়, এই পৃথিবীতে মানুষ ছাড়াও কতরকম প্রাণী আছে!

ব্রিজটার মাঝামাঝি যখন এসেছেন, তখন তাঁর পাশে একটি ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল। সেটা খালি। ড্রাইভারটি মুখ বার করে জিজ্ঞেস করল, স্যার, কোথায় যাবেন?

কাকাবাবু বললেন, হাওড়া স্টেশনেও যেতে পারি, টালিগঞ্জেও যেতে পারি। যেখানে আমার খুশি।

ড্রাইভারটি বলল, উঠে পড়ুন।

কাকাবাবু তবু জিজ্ঞেস করলেন, আমি যেখানে যেতে চাইব, সেখানেই যাবেন তো?

ড্রাইভারটি বলল, নিশ্চয়ই!

কাকাবাবু এবারে দরজা খুলে ভেতরে এসে বললেন, আপনি কি দেবদূত? আজকাল তো ট্যাক্সিওয়ালারা সন্ধের পর কোথাও যেতে চায় না!

ড্রাইভারটি হেসে বলল, আমি তো আপনাকে চিনি। আমার গাড়িতে আপনি অনেকবার চেপেছেন। এখন কোথায় যাবেন, বলুন স্যার।

কাকাবাবু তাকে বাড়ির ঠিকানা জানালেন। তাঁর মনটা খুশি হয়ে গেল। কলকাতা শহরটা তা হলে একেবারে খারাপ হয়ে যায়নি। পুলিশ কমিশনার তাঁকে বিপদের ভয় দেখিয়েছিলেন, আবার এরকমও তো হয়, সন্ধেবেলা এক ট্যাক্সিওয়ালা অযাচিতভাবে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিতে চান। কিংবা তিনি খোঁড়া বলেই কি ট্যাক্সিওয়ালাটির মায়া হয়েছে? সেটাও খারাপ কিছু নয়। অনেক সময় তো এরা অসুস্থ লোককেও নিতে চায় না।

বাড়িতে ফিরেও মনটা খুশি-খুশি রইল। দরজা দিয়ে ঢোকার পর তাঁর বউদি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, সন্তু তোমার সঙ্গে যায়নি?

কাকাবাবু বললেন না তো? আমি দুপুরে ন্যাশনাল লাইব্রেরি গিয়েছিলাম।

বউদি বললেন, সাতটা বেজে গেল, সন্তু এখনও ফিরল না!

কাকাবাবু কিছু না বলে হাসলেন। সন্তু এখন কলেজে পড়ে, মাঝে মাঝে একটু-আধটু দেরি তো হতেই পারে। ও তো আর ছোট ছেলেটি নেই।

তিনি উঠে গেলেন ওপরে।

সন্তু ফিরল রাত নটার একটু পরে। মায়ের বকুনি ভাল করে না শুনেই সে ছটফটিয়ে বলল, দাঁড়াও, পরে সব বলছি। কাকাবাবুর সঙ্গে আমার খুব দরকারি কথা আছে।

দুমদাম করে ওপরে ছুটে এসে সে বলল, কাকাবাবু, তুমি অংশুমান চৌধুরীকে চেনো? আজ তাঁর সঙ্গে…

কাকাবাবু রিভলভিং চেয়ার ঘুরিয়ে বললেন, হাঁপাচ্ছিস কেন? জামাটা ঘামে ভিজে গেছে। যা, আগে জামা-টামা খুলে চান করে আয়!

কিন্তু সন্তুর এক মিনিটও তর সইছে না। সে এক্ষুনি বারুইপুরের ঘটনাটা কাকাবাবুকে জানাতে চায়। সে আবার কিছু বলার চেষ্টা করতেই কাকাবাবু আবার বাধা দিয়ে বললেন, উঁহু, এখন আমি কিছু শুনতে চাই না। আগে চানটান করে, খাবার খেয়ে, সেই সঙ্গে তোর মায়ের বকুনি খেয়ে তারপর আয়। তখন সব শুনব।

চেয়ার ঘুরিয়ে কাকাবাবু আবার বই পড়ায় মন দিলেন।

সন্তুকে বাধ্য হয়ে নীচে গিয়ে বাথরুমে ঢুকতে হল। আবার সে ওপরে উঠে এল প্রায় আধঘন্টা বাদে।

কাকাবাবু বললেন, বোস! এবার বল, কলেজ থেকে কোথায় গিয়েছিলি?

সন্তু কাকাবাবুর কাছে একটা মোড়া টেনে নিয়ে বসে পড়ে বলল, দুপুরে কলেজ থেকে আজ হঠাৎ বারুইপুরে চলে গিয়েছিলুম আমার দুই বন্ধুর সঙ্গে। সেখানে..

কাকাবাবু তাকে বাধা দিয়ে বললেন, ট্রেনে গিয়েছিলি, না বাসে?

সন্তু বলল, ট্রেনে। আমার বন্ধু জোজোর পিসেমশাই থাকেন সেখানে। তাঁরই নাম অংশুমান চৌধুরী। তিনি নাকি একজন বৈজ্ঞানিক।

কাকাবাবু বললেন, তারপর, তিনি কী বললেন?

সন্তু উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে বলল, তুমি তাঁকে চেনো না? নাম শুনে কিছু মনে পড়ছে না?

কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, তোর বন্ধুর পিসেমশাইকে আমি চিনব কী করে?

উনি যে বললেন, উনি একজন খুব বড় বৈজ্ঞানিক?

তা হতে পারে। কিন্তু সব বৈজ্ঞানিককে তো আমি চিনি না!

উনি তোমাকে চেনেন। তোমার নাম জানেন!

কেমন চেহারা ভদ্রলোকের?

অংশু মানে তো চাঁদ। ওর মাথাটা চাঁদের মতন!

তার মানে?

ফর্সা মাথাটা ঠিক চাঁদের মতন চকচকে। একটাও চুল নেই। উনি বেশ লম্বা। আর রোগা।

কাকাবাবু একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে চিন্তা করে বললেন, নাঃ, এরকম চেহারার কোনও লোককে চিনি বলে তো মনে হচ্ছে না।

তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আফগানিস্তানে। বেশ কয়েক বছর আগে। ও হ্যাঁ, তখন ওঁর মাথায় টুপি ছিল। বাইরে বেরোবার সময় উনি নিশ্চয়ই টুপি পরেন। উনি বললেন, তুমি ওঁর কথা শুনলেই সব বুঝতে পারবে।

কাকাবাবু আপনমনে বললেন, আফগানিস্তানে? টুপি পরা বাঙালি? কী জানি! আফগানিস্তানে তো আমি বেশ কয়েকবার গেছি! সেরকম কোনও বাঙালির সঙ্গে দেখা হলেও হতে পারে। এখন মনে পড়ছে না! তুই এত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন, সন্তু? ভদ্রলোককে যে আমার মনে পড়তেই হবে, তার কী মানে?

সন্তু চোখ বড় বড় করে বলল, কারণ আছে, কারণ আছে! ওই অংশুমান চৌধুরী তোমার শত্রু!

কাকাবাবু হা-হা করে অট্টহাসি হাসলেন এবারে! সন্তু বলল, তুমি বিশ্বাস করছ না? উনি নিজের মুখে বললেন সেকথা। তুমি ওর জীবনের সব চেয়ে বড় শত্রু!

কাকাবাবু হাসি থামিয়ে বললেন, বড়বড় ক্রিমিনালরা আমাকে শত্রু বলে মনে করতে পারে। কিন্তু তোর বন্ধুর পিসেমশাই, তিনি আবার বড় বৈজ্ঞানিক, তিনি আমার শক্ত হতে যাবেন কেন?

সন্তু বলল, দশ বছর আগে তুমি আফগানিস্তানে কী একটা ব্যাপারে ওঁকে হারিয়ে দিয়ে অপমান করেছিলে।

কাকাবাবু বললেন, ধ্যাৎ! কী সব বাজে কথা! তুই এখন যা তো! ওসব নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না। ভদ্রলোক নিশ্চয়ই তোর সঙ্গে রসিকতা

করেছেন।

সন্তু আরও অনেক কিছু বলতে গেল, কিন্তু কাকাবাবু তাকে বাধা দিয়ে থামিয়ে দিয়ে আবার বই পড়ায় মন দিলেন।

সন্তু ক্ষুন্নভাবে ফিরে গেল নিজের ঘরে।

পরদিন সকালবেলা সন্তু কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে এমন সময় একজন লোক এসে খোঁজ করল কাকাবাবুর। কাকাবাবু প্রত্যেক সকালবেলা বেড়াতে বেরোন, কোনও-কোনও দিন দুচারজন লোকের সঙ্গে দেখা করে একটু দেরিতে ফেরেন। আজ তিনি এখনও ফেরেননি।

লোকটি বলল, সে এসেছে বারুইপুর থেকে। কাকাবাবুর জন্য একটা জিনিস আছে। সই করে সেটা রাখতে হবে।

জিনিসটা একটা ছোট্ট পিচবোর্ডের বাক্স। তার ওপরে লেখা, টু রাজা রায়চৌধুরী। ফ্রম অংশুমান চৌধুরী, বারুইপুর।

সন্তু বলল, আমি সই করে রাখলে চলবে না?

লোকটি মাথা নাড়ল। অর্থাৎ তাতেও হবে।

লোকটি যাওয়ার পর সন্তু আর কৌতূহল সামলাতে পারল না। খুলে ফেলল বাক্সটা।

প্রথমে সন্তুর মনে হল বাক্সটার মধ্যে কিছুই নেই। একেবারে ফাঁকা। কেউ ঠাট্টা করে পাঠিয়েছে। তারপর সে ভাল করে দেখল, তলায় এক কোণে পড়ে আছে কয়েকটা চুল। মানুষের চুল বলেই মনে হয়।

একতলার ঘরে খেতে বসে সন্তু উদগ্রীব হয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগল কাকাবাবুর জন্য। একটা বাক্সের মধ্যে শুধু কয়েকটা চুল পাঠাবার মানে কী? এটা দেখে কাকাবাবু কী বলবেন? ওঁর কি কোনও কথা মনে পড়ে যাবে?

সাড়ে দশটার মধ্যেও কাকাবাবু ফিরলেন না। সন্তু আর অপেক্ষা করতে পারছে না। তাকে কলেজে যেতেই হবে।

যাওয়ার সময় সে মাকে বলে গেল, মা, কাকাবাবু এলেই এই বাক্সটা দেখিও। খুব দরকারি!

রাস্তায় বেরিয়ে দৌড়ে গিয়ে বাসে ওঠবার আগেও সন্তু একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল, কাকাবাবুকে দেখা যায় কি না। দেখা গেল না। সন্তুর চিন্তার মধ্যে একটা দারুণ কৌতূহল রয়ে গেল।

কাকাবাবু ফিরলেন আরও এক ঘন্টা বাদে, সঙ্গে দুজন ভদ্রলোককে নিয়ে। তিনি তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ওপরে উঠে যাচ্ছিলেন, এমন সময় মা ডেকে বললেন বাক্সটার কথা।

কাকাবাবু বাক্সটা হাতে তুলে নিয়ে ওপরে লেখা নামগুলো পড়লেন। তারপর বাক্সটা খুলে তিনি কিছুই দেখতে পেলেন না। চুলগুলো তাঁর নজরে পড়ল না। তিনি ভুরু কুঁচকে কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বেশি। সময় খরচ করলেন না।

তিনি বিশেষ আগ্রহ না দেখিয়ে বাক্সটা বসবার ঘরের একটা টেবিলের ওপর রেখে দিলেন। তারপর রান্নার ঠাকুরকে বললেন, তিন কাপ কফি চাই, আমার ঘরে দিয়ে এসো!

দোতলায় কাকাবাবুর ঘরে একটা লম্বা সোফা ও কয়েকটা চেয়ার রয়েছে। বিশেষ কাজের কথা থাকলে তিনি কোনও-কোনও লোককে ওপরের ঘরে নিয়ে আসেন। আজ যাঁরা কাকাবাবুর সঙ্গে এসেছেন, তাঁরা দুজনেই অবাঙালি। এর মধ্যে একজনের নাম মাধব রাও, ইনি এ বাড়িতে আগেও এসেছেন দু-একবার। ইনি পরে আছেন পা-জামা পাঞ্জাবি, অন্য লোকটি বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট, সাফারি সুট-পরা, সোফায় বসে তিনি একটি চুরুট ধরালেন।

কাকাবাবু একটুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন সেই লোকটির দিকে। তারপর বললেন, মাফ করবেন, এখানে চুরুট না খেলে কি আপনার খুব অসুবিধে হবে?

লোকটি তাড়াতাড়ি ঠোঁট থেকে চুরুটটা নামিয়ে বললেন, না, মানে, কেন বলুন তো! আপনার এখানে বুঝি…

কাকাবাবু লজ্জিতভাবে বললেন, আসলে ব্যাপার কী জানেন, আমি নিজে একসময় খুব চুরুট খেতাম। একসময় প্রতিজ্ঞা করে ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু চুরুট সম্পর্কে দুর্বলতাটা ছাড়তে পারিনি। সামনে কেউ চুরুট টানলে, সেই গন্ধটা নাকে এলে আমি দুর্বল হয়ে পড়ি। কাজের কথায় মন বসাতে পারি না।

লোকটি সঙ্গে সঙ্গে সামনের অ্যাশট্রেতে চুরুটটা নিভিয়ে দিয়ে বললেন, না, থাক। আগে কাজের কথা হয়ে যাক।

তিনি তাকালেন মাধব রাও-এর দিকে। অর্থাৎ কথাবাতা মাধব রাও-ই চালাবেন।

মাধব রাও একটু ইতস্তত করে বললেন, মিঃ রায়চৌধুরী, প্রথমেই আমি বলে রাখি, আমাদের প্রস্তাবটা শুনে আপনার একটু অদ্ভুত লাগতে পারে। কিন্তু আপনি চট করে রেগে যাবেন না। আমাদের কথাটা আপনি একটু মন দিয়ে শুনুন। তারপর ভাল মন্দ যা হয় আপনার মতামত জানাবেন। এর আগে আমি দুএকবার আপনার কাছে এসেছি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে। কিছু কিছু ব্যাপারে সাহায্য চাইবার জন্য। কিন্তু এখন আমি রিটায়ার করেছি। সুতরাং এবারে আমি সরকারি পক্ষ থেকে আসিনি।

কাকাবাবু কোনও কথা না বলে মাথা নাড়লেন।

মাধব রাও আবার বললেন, আমার সঙ্গে যিনি এসেছেন, তাঁর একটু পরিচয় দিই। এঁর নাম অনন্ত পট্টনায়ক, ওড়িশার একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং আমার বন্ধু। ওঁদের পরিবার খুব নামকরা পরিবার। সম্বলপুরে ওঁদের বাড়িতে বহু পুরনো মূর্তি ও ছবির সংগ্রহ আছে। আপনি যদি চান, আপনাকে সেখানে একবার নিয়ে গিয়ে সব দেখাতে চাই।

মাধব রাও কথা বলছেন ইংরেজিতে। এবারে অনন্ত পট্টনায়ক ভাঙা বাংলায় বললেন, আপনার জন্য সব সময় নেমন্তন্ন রইল। আপনি যদি চান তো আপনাকে গাড়ি করে নিয়ে যেতে পারি কলকাতা থেকে। এই সপ্তাহে যেতে পারবেন?

কাকাবাবু সামান্য হেসে বললেন, না, এক্ষুনি তো যাওয়া হবে না। পরে যদি কোনও সুযোগ হয় নিশ্চয়ই যাব।

মাধব রাও এবারে জিজ্ঞেস করলেন, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি কখনও মধ্য প্রদেশের বস্তার জেলায় গেছেন? ওদিকটা সম্পর্কে আপনার কোনও ধারণা আছে?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, একবার গিয়েছিলাম, প্রায় বছর পনেরো আগে, তখন আমার দুটো পা-ই ভাল ছিল। অনেক ঘুরেছিলুম জঙ্গলে আর পাহাড়ে।

মাধব রাও বললেন, আপনি অবুঝমার পাহাড়ের দিকেও গিয়েছিলেন, যেখানে সহজে কেউ যেতে চায় না। ওখানকার আদিবাসীদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে আপনি কয়েকদিন ওদের মধ্যে ছিলেন।

কাকাবাবু একটু অবাক হয়ে ভুরু তুলে বললেন, সেকথা আপনি জানলেন কী করে?

সেবার আপনার সঙ্গে পলাশ নন্দী বলে একটি ছেলে গিয়েছিল, দিল্লিতে সেই ছেলেটি কিছুদিন আমার আন্ডারে চাকরি করেছে, তার কাছ থেকে আপনার এই অভিযানের গল্প শুনেছি।

তা হলে আপনি জিজ্ঞেস করলেন কেন, আমি কখনও বস্তার জেলায় গেছি কি না?

মাধব রাও শুকনোভাবে হেসে ওঠে বললেন, অনেকদিন আগে গিয়েছিলেন তো, আপনার মনে আছে কি না…তা ছাড়া এইভাবেই তো কথাবার্তা শুরু করতে হয়।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে এবারে আসল কাজের কথা হোক।

মাধব রাও বললেন, ওই বস্তার জেলায় ঝুংগি নামে একটা জায়গা আছে। সেটা জগদীশপুর থেকে একশো মাইল দূরে। সেখানে একজন আদিবাসী থাকে, তারা কিন্তু মারিয়া কিংবা মুরিয়া নয়, তারা আলাদা, তাদের নাম রোরো। এই রোরোদের মন্দিরে একটা মূর্তি অছে। কিন্তু সেখানে ওরকম কোনও মূর্তি থাকবার কথাই নয়। সেটা সূর্যমূর্তি। ভুবনেশ্বর টেম্পলের দেওয়ালে যেরকম একটি গামবুট-পরা পুরুষের মূর্তি আছে। অবিকল সেই রকম।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সেই মূর্তিটা আপনি নিজের চোখে দেখেছেন?

মাধব রাও বললেন, না, আমি নিজের চোখে দেখিনি। তবে ছবি দেখেছি। কিছুদিন আগে পল হাউসমান নামে একজন বিদেশি ওই। মধ্যপ্রদেশের আদিবাসীদের নিয়ে একটি বই বার করেছেন, সেই বইতে ওই মন্দিরের ছবি। মূর্তির ছবি। রোরোদের গ্রামের ছবি সব আছে। আপনাকে দেখাবার জন্য বইটা আমরা সঙ্গে এনেছি।

কাকাবাবু বললেন, কিন্তু মধ্যপ্রদেশের আদিবাসীদের গ্রামে কী মূর্তি রয়েছে তার সঙ্গে আপনাদের এখানে আমার আছে আসার সম্পর্ক কী তা তো বুঝতে পারছি না?

মাধব রাও ভুরু তুলে খুব আশ্চর্য হবার ভাব দেখিয়ে বললেন, ওই রকম জায়গায় গামবুট-পরা সূর্যের মূর্তি কী করে গেল, সে কথা জানার জন্য আপনার কৌতূহল হচ্ছে না?

কাকাবাবু বললেন, তার চেয়েও বেশি কৌতূহল হচ্ছে আপনারা আমার কাছে কী চান তা জানবার জন্য!

মাধব রাও এবারে অনন্ত পট্টনায়কের দিকে তাকালেন। তিনি একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, রায়চৌধুরীবাবু, ওই মূর্তিটা ছিল আমাদের বাড়ির সম্পত্তি। বেশ কিছু বছর আগে ওটা আমাদের বাড়ি থেকে চুরি গেছে। বাড়িরই কোনও কাজের লোক ওটা চুরি করছিল বলে আমাদের বিশ্বাস। আমার বাবা তার ডায়রিতে এই মূর্তির কথা লিখে গেছেন। এতদিন ওই মূর্তিটার কোনও খোঁজ ছিল না। এখন পল হাউসমানের বইয়ের ছবি দেখে বোঝা গেল, আমাদের পারিবারিক সম্পত্তিটিই ওখানে পৌঁছে গেছে। কোনওভাবে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ওই মূর্তিটা আপনাদের বাড়িতে এসেছিল কীভাবে? তার কোনও রেকর্ড আছে?

অনন্ত পট্টনায়ক বললেন, না, তা নেই।

মাধব রাও বললেন, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। ওই রকম মূর্তি আদিবাসীদের পক্ষে বানানো সম্ভব নয়। ওরা নিজেরা এখন জুতো পরতেই জানে না, ওরা কি গামবুট পরা কোনও দেবতার মূর্তি বানাতে পারে? ওটা চোরাই মূর্তি।

কাকাবাবু বললেন, আপনাদের বাড়ি থেকে মূর্তি চুরি গেছে পুলিশে খবর দিন। পুলিশ সেটা উদ্ধার করে দেবে।

অনন্ত পট্টনায়ক বললেন, কিন্তু ওই মূর্তিটা যে চুরি গেছে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে। আমার ঠাকুরদার আমলে। তখন তো কিছু করা হয়নি। এতদিন পরে ও কথা বললে আর কে বিশ্বাস করবে? তবে, মূর্তিটা আমাদেরই। ওরকম নীল পাথরের সূর্য মূর্তি আর কোথাও নেই।

মাধব রাও বললেন, আমি মধ্যপ্রদেশের পুলিশের আই জি-র সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি বললেন, আদিবাসীদের গ্রাম থেকে ওই মূর্তি উদ্ধার করতে গেলে দাঙ্গা লেগে যাবে। ওরা যদি একবার খেপে যায়, তা হলে পুলিশকেও পরোয়া করে না।

কাকাবাবু বললেন সে তো ঠিকই বলেছেন তিনি।

মাধব রাও বললেন, সেই জন্যই আপনার কাছে আসা। আপনি ওই সব আদিবাসীদের মধ্যে ঘুরেছেন। ওদের সঙ্গে থেকেছেন। ওই মূর্তিটা আদিবাসী গ্রামে কী করে গেল, সে রহস্য একমাত্র আপনিই সমাধান করতে পারেন।

অনন্তবাবু বললেন, আপনি যদি মূর্তিটি উদ্ধারের ব্যবস্থা করে দেন, তা হলে আপনার কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকব। এজন্য আপনার খরচখরচা যা লাগবে, সব আমরা দিয়ে দেব তো বটেই। আমরা একলক্ষ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে রাজি আছি!

কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আচ্ছা নমস্কার। আপনারা এবারে আসুন। আমাদের কথাবার্তা শেষ হয়ে গেছে।

মাধব রাও বললেন, এই রে, এই রে, আপনি রেগে যাচ্ছেন? প্রথমেই তো বলেছি, আমাদের সব কথা শুনুন আগে..

কাকাবাবু এবারে তীব্র স্বরে বললেন, আপনাদের সব কথা আমার শোনা হয়ে গেছে। আপনারা আমাকে আদিবাসীদের গ্রাম থেকে একটা মূর্তি চুরি করতে বলছেন? চোর হিসেবে আমার এমন সুনাম আছে, তা তো জানতুম না।

মাধব রাও বললেন, আরে, ছি ছি ছি, আপনি শুধু শুধু ভুল বুঝছেন আমাদের। আপনি নানারকম অদ্ভুত রহস্যের সমাধান করেন, সেই জন্যই ভেবেছিলাম, আদিবাসীদের গ্রামে গামবুট-পরা একটি মানুষের মূর্তি কী করে গেল, সেই রহস্য সম্পর্কে আপনি কৌতূহলী হবেন। তারপর…ওদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে…ওদের ক্ষতিপূরণ…ওদের মন্দিরের জন্য আলাদা মূর্তি গড়িয়ে দিয়ে তারপর যদি আমাদের মূর্তিটা উদ্ধার করা যায়…আমার বন্ধু সেই কথাই বলছিলেন! আপনাকে আমরা শ্রদ্ধা করি…

কাকাবাবু বললেন, ধন্যবাদ। আমার সব কথা শোনা হয়ে গেছে। আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড!

অনন্তবাবু বললেন, শুনুন, ওই মূর্তিটা যে আমাদেরই পরিবারের সম্পত্তি, সে সম্পর্কে যদি একটা প্রমাণ আপনাকে এনে দেখাতে পারি?

কাকাবাবু তাঁর চোখে চোখ রেখে বললেন, বললুম না, আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড অ্যাট অল। আমার সময়ের দাম আছে।

এই সময় রঘু এসে হাজির হল তিন কাপ কফি নিয়ে।

তাতে কাকাবাবুর মেজাজ আরও চড়ে গেল। এত দেরি করে কফি আনবার কোনও মানে হয়? এখন এই লোক দুটিকে কফি না খাইয়ে বিদায় করে দেওয়াটা অভদ্রতা। অথচ এই লোকদুটির সঙ্গে তাঁর আর এক মুহূর্তও সময় কাটাবার ইচ্ছে নেই।

মাধব রাও এবং অনন্ত পট্টনায়কও উঠে দাঁড়িয়েছেন। কাকাবাবু শুকনো গলায় বললেন, কফিটা খেয়ে যান।

মাধব রাও হেসে বললেন, ধন্যবাদ, এখন কফি খেতে গেলে গলায় বিষম লাগবে। আর একদিন এসে কফি খাব।

অনন্ত পট্টনায়ক বললেন, আমি কফি খাই না। মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি এত রেগে গেলেন কেন বুঝলাম না। আপনার কাছে আমরা একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি, আপনি তাতে রাজি হতে পারেন, নাও হতে পারেন। ব্যাস, এইটুকুই! আপনি রাজি না হলে ফুরিয়ে গেল!

কাকাবাবু অতিকষ্টে রাগ দমন করে বললেন, আমি যদি রূঢ় ব্যবহার করে থাকি, সে জন্য মাপ চাইছি। এ-ধরনের কাজ আমি করি না। আপনারা অন্য কারও কাছে যান।

লোক দুটি চলে যাওয়ার পরেও কাকাবাবু ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে লাগলেন। তাঁর মাথাটা জ্বলছে। তিনি একটি বই খুলে পড়বার চেষ্টা করলেন, তাঁর মন বসল না।

একটু পরে স্নান করে, খেয়ে নিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। ফিরলেন অনেক রাতে।

কলেজ থেকে ফিরেই সন্তু দেখল, বারুইপুর থেকে পাঠানো সেই বাক্সটা বসবার ঘরেই পড়ে আছে। সে কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করার জন্য ছটফট করছিল। কাকাবাবু যখন ফিরলেন, তখন সে ঘুমিয়ে পড়েছে।

পরদিন সকালে বারুইপুর থেকে একটি লোক আবার ঠিক ওই রকম একটি বাক্স নিয়ে এল!

আজ সন্তুর কলেজ ছুটি, আজ সে কাকাবাবুর সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলবে। অংশুমান চৌধুরী এসব কী অদ্ভুত জিনিস পাঠাচ্ছেন? ভদ্রলোকের চোখের দৃষ্টি সেদিন সন্তুর ভাল লাগেনি। কাকাবাবুর ওপর খুব রাগ। উনি কাকাবাবুর কিছু একটা ক্ষতি করবার চেষ্টা করবেন নিশ্চয়ই। অথচ ওঁর কথা সন্তুর মুখে শুনে কাকাবাবু একটুও পাত্তাই দিলেন না।

আজ যে বাক্সটা পাঠিয়েছেন, সেটার মধ্যেও প্রায় কিছুই নেই বলতে গেলে। চৌকো কাগজের বাক্সটা সুন্দরভাবে প্যাক করা, ওপরে কাকাবাবুর নাম লেখা। কিন্তু ভেতরে যে জিনিসটা রয়েছে, সেটা কেউ এরকম প্যাকেট করে পাঠাতে পারে, তা বিশ্বাসই করা যায় না। একটুখানি আলুর তরকারি! দুতিন টুকরো আলু, তাতে মশলা মাখানো, কিন্তু ঝোল নেই, একেবারে শুকনো।

প্রথম দিন এল দুতিনটে মানুষের চুল। তারপর এক চিমটে আলুর তরকারি। এর তো মাথা মুণ্ডু কিছুই বোঝা যায় না। কালকের বাক্সটা দেখে কাকাবাবু কোনও মন্তব্যও করেননি, কিন্তু সন্তু যে এই ব্যাপারটা কিছুতেই মাথা থেকে তাড়াতে পারছে না।

কাকাবাবু এখনও মর্নিং ওয়াক থেকে ফেরেননি। দরজার কলিং বেল শুনে। সন্তু ছুটে গেল। খাকি প্যান্ট ও হাফ-শার্ট পরা একজন পিওন শ্রেণীর লোক দাঁড়িয়ে আছে। সে জিজ্ঞেস করল, ইয়ে রাজা চৌধুরী বাবুকা কোঠি হ্যায়? সাহাব হ্যায় ঘর মে?

সন্তু বলল, না, সাহেব আভি নেহি হ্যায়। আপকা কেয়া জরুরৎ হ্যায়?

লোকটি বলল, হামারা সাহাব রায় চৌধুরী বাবুকো বুলায়া।

সন্তু একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, আপকা সাহাব কৌন হ্যায়?

লোকটি পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বার করে সন্তুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ইসমে লিখা হ্যায়। রায়চৌধুরীবাবু লৌটনেসে তুরন্ত ইধার যানে বলিয়ে! বহুতই আর্জেন্ট হ্যায়।

লোকটি কাগজটা দিয়ে চলে গেল। কাগজটি খুলে সন্তু আর-একপ্রস্থ অবাক হল। একটা সাধারণ হ্যান্ডবিল। পার্কস্ট্রিটের একটা কাপড়ের দোকানের নাম লেখা। বিজ্ঞাপন হিসেবে এরকম কাগজ রাস্তায় ছড়ানো হয়। ঠিকানার নীচে কেউ লাল কালির দাগ দিয়ে হাতে লিখে দিয়েছে ওয়ান পি. এম.।

সন্তুর চড়াত করে রাগ ধরে গেল। কাকাবাবুকে কেউ কখনও পিওন দিয়ে ডেকে পাঠায় না। কাকাবাবু সচরাচর কারও বাড়িতে যান না। কারও খুব দরকার থাকলে বাড়িতে এসে কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করে। কাকাবাবুর তো ডিটেকটিভগিরি করা পেশা নয়। চুরি-ডাকাতি বা খুন-জখমের কেস নিয়ে যারাই আসে, কাকাবাবু তাদের বলেন, আমার কাছে এসেছেন কেন, পুলিশের কাছে যান।

আর এই লোকটার এত সাহস, সাধারণ একটা হ্যান্ডবিল পাঠিয়ে সেই ঠিকানায় কাকাবাবুকে দেখা করতে বলেছে? কে লোকটা? এখনও দৌড়ে গেলে হয়তো ওই পিওনটিকে ধরা যায়। কিন্তু ও সম্ভবত কিছুই বলতে পারবে না!

কাকাবাবু ফিরলেন একটু পরেই।

সন্তু প্রথমেই বলল, কাকাবাবু, বারুইপুরের অংশুমান চৌধুরী কাল তোমাকে একটা বাক্স পাঠিয়েছেন, সেটা তুমি দ্যাখোনি?

কাকাবাবুর মুখখানা আজও থমথমে কোনও ব্যাপারে খুব চিন্তিত। গম্ভীরভাবে বললেন, হ্যাঁ, দেখেছি, ওর মধ্যে তো কিছু নেই। যা ছিল তুই বার করে নিয়েছিস?

না তো। বাক্সটা ওই রকমভাবেই এসেছে। ওর মধ্যে শুধু কয়েকটা চুল পড়ে আছে। মানুষের চুল বলেই মনে হয়।

চুল?

হ্যাঁ, আজও একটা বাক্স এসেছে। তার মধ্যে যা আছে, সেটাও পাঠাবার কোনও মানে বুঝতে পারছি না।

আজ আবার কী এসেছে, দেখি?

সন্তু দৌড়ে গিয়ে দ্বিতীয় বাক্সটা নিয়ে এল। কাকাবাবু সেটার মধ্যে কয়েক পলক দেখলেন মাত্র। তারপর বিরক্তভাবে বললেন, ধ্যাত.? এ তো মনে হচ্ছে কোনও পাগলের কাণ্ড। ফেলে দে। এগুলো সব ফেলে দে।

তারপর সন্তু একটু আগের হ্যান্ডবিলটার কথা বলল। কাকাবাবু হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে বললেন, এই দোকানে আমি কখনও যাইনি। চেনা কেউ পাঠায়নি। মনে হচ্ছে, কেউ কেউ আমাকে অকারণে বিরক্ত করবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। তাতে তাদের কী লাভ কে জানে?

কাকাবাবু, তুমি অংশুমান চৌধুরীকে একেবারেই চেনো না!

কিছুই তো মনে পড়ছে না। তা ওই সব বাক্স-টাক্স না পাঠিয়ে সে নিজে এসে দেখা করতেই তো পারে।

আমার বন্ধু জোজোকে ডাকব। ওর পিসেমশাই হয়, ও অনেক কিছু বলতে পারবে। তাতে তোমার মনে পড়ে যেতে পারে।

এরকম পাগলকে নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না এখন। তবু ঠিক আছে, ডাকিস তোর বন্ধুকে, শুনে দেখব!

এরপর কাকাবাবু ওপরে উঠে গেলেন।

সন্তু ঠিক করল, দুপুরবেলাতেই সে বেরিয়ে জোজোকে ডেকে আনবে। জোজো কাকাবাবুর সামনে কতরকম গুল ঝাড়তে পারে, সেটা দেখা যাক।

একটু বাদেই অরিন্দম এসে হাজির হল। সন্তু খুশি হয়ে বলল, তুই। এসেছিস ভালই হয়েছে। চল। একটু পরে জোজোদের বাড়ি যাব। জোজোর সেই পিসেমশাই কী কাণ্ড করেছে জানিস। কাকাবাবুকে রোজ একটা করে বাক্স পাঠাচ্ছে।

অরিন্দম বলল, কিসের বাক্স?

সন্তু ওকে খুলে বলল। বাক্স দুটো এনে দেখাল। অরিন্দম হেসে উঠে বলল, আরে জোজোর পিসেকে দেখে আমি ভেবেছিলুম, দ্বিতীয় এক প্রোফেসর শঙ্কু। এখন দেখছি বোম্বাগড়ের রাজা। ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখে। আমসত্ত্ব ভাজা! অতদূর থেকে তোক দিয়ে এত বড় একটা বাক্স ভরে পাঠাচ্ছে এঁটো দু টুকরো আলুর দম। কেন বাবা, বেশি করে পাঠালেই পারত, আমরা খেয়ে নিতুম। আর এগুলো যে মানুষের চুল তুই কী করে বুঝলি, সন্তু? ভাল্লুকের লোমও তো হতে পারে!

সন্তু বলল, উনি জন্তুজানোয়ার সহ্য করতে পারেন না, মনে নেই? সেই জন্যই আমি বুঝে নিয়েছি মানুষের চুল।

অরিন্দম বলল, আমাদের বড় জামাইবাবু সায়েন্স কলেজে পড়ান। তাঁকে ওই নামটা বললুম, বড় জামাইবাবু বললেন তিনি ওই নাম জন্মে শোনেননি। তবে সেলফ-মেই সায়েন্টিস্ট হতে পারে। এরকম অনেক আছে। নিজের বাড়িতে কয়েকটা যন্ত্রপাতি লাগিয়ে তারপর নিজেদের সায়েন্টিস্ট বলে প্রচার করে।

কাকাবাবুর ওপর এত রাগ কেন, সেটাই বুঝতে পারছি না। কাকাবাবুও কিছুই মনে করতে পারছেন না।

হঠাৎ ওপর থেকে কাকাবাবু জোরে জোরে ডাকলেন, সন্তু! সন্তু!

অরিন্দম বলল, তোকে কাকাবাবু ডাকছেন, যা শুনে আয়। আমি এখানে বসছি।

সন্তু বলল, তুইও চল না আমার সঙ্গে। কাকাবাবুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব।

কাকাবাবু অরিন্দমকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এই-ই তোর বন্ধু জোজো নাকি?

সন্তু বলল,না, এর নাম অরিন্দম। এই অরিন্দমও আমাদের সঙ্গে বারুইপুরে গিয়েছিল।

কাকাবাবুর মুখে এখন সেই গাম্ভীর্যের ভাবটা নেই। বরং ঠেটি চাপা হাসি। তিনি বললেন, ওই বারুইপুরের ভদ্রলোকের বাড়িতে টেলিফোন আছে?

সন্তু বলল, তা তো ঠিক বলতে পারছি না। লক্ষ করিনি।

এ ভদ্রলোকের দেখছি সত্যিই মাথায় ছিট আছে। উনি আমায় এই যে এক-একটা বাক্স পাঠাচ্ছেন, এগুলো আসলে সাংকেতিক চিঠির একটা একটা টুকরো; বুঝলি! এরকম আরও পাঠাবেন। কিন্তু তার আর দরকার নেই, উনি কী বলতে চান আমি বুঝে গেছি। আমার সব মনে পড়ে গেছে। কিন্তু আফগানিস্তানে তো নয়, ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল পাঞ্জাব আর বেলুচিস্তানের সীমান্তে একটা ছোট জায়গায়। অনেকদিন আগেকার কথা। সেই জায়গার নাম ছিল কান্টালাপুরা। ভদ্রলোকের বাড়িতে টেলিফোন থাকলে আমি বলে দিতুম যে আপনাকে আর কষ্ট করে চিঠি পাঠাতে হবে না।

কাকাবাবু, উনি চুল আর আলুর তরকারি পাঠিয়ে কী চিঠি লিখলেন?

তোদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আমার আগেই ধরা উচিত ছিল, কিন্তু আমি মাথা ঘামাইনি। শোন, বুঝিয়ে দিচ্ছি, চুলের ভাল বাংলা কী?

কেশ।

আর একটা আছে, কুন্তল। আর ওই যে আলুর তরকারিটুকু, ওটা কী জানিস, একটা শিঙাড়া ভাঙলে তার মধ্যে ঠিক ওইটুকু তরকারি দেখতে পাবি। ওকে বলে পুর। কচুরি, শিঙাড়া, পিঠে এই সবের মধ্যে নানারকম পুর দেওয়া থাকে না? তা হলে কী হলো, কুন্তলপুর। ওই যে কান্টালাপুরা জায়গাটার কথা বললুম, অনেকে বলে, ওই জায়গাটার আগেকার নাম ছিল কুন্তলপুর।

অরিন্দম বলল, শুধু ওই নামটা একটা কাগজে লিখে পাঠিয়ে দিলেই পারতেন?

সেইজন্যই তো বলছি, ভদ্রলোকের মাথায় খানিকটা ছিট আছে। তবে লোক খারাপ নয়। একটু ছেলেমানুষ মতন, এই যা। তবে, সেবারে আমি ওর সঙ্গে খানিকটা খারাপ ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছিলুম ঠিকই।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, কী হয়েছিল সেবারে?

সেটা আর তোদের শুনে দরকার নেই। তবে শেষ পর্যন্ত স্থানীয় লোকেরা রেগে গিয়ে ভদ্রলোকের মাথার সব চুল কামিয়ে কী : যেন আঠা মাখিয়ে দিয়েছিল, সেটা আমি চেষ্টা করেও আটকাতে পারিনি।

ওই জন্যই ওঁর মাথা জোড়া টাক। আর একটাও চুল গজায় না।

ভদ্রলোক যখন আমার ওপর এখনও খুব রেগে আছেন, তখন, আমি ওঁর কাছে ক্ষমা চাইতে চাই। কিন্তু টেলিফোন না থাকলে মুশকিল। একটা চিঠি লিখলে তোরা পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারবি?

জোজোকে বললে দিয়ে আসতে পারে।

আচ্ছা তাই-ই লিখে দেব তা হলে।

দুপুরবেলা সন্তু আর অরিন্দম গেল জোজোর বাড়িতে। দরজার বেল বাজাতেই দোতলার বারান্দায় জোজো এসে ওদের দেখল, তারপর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ওদের চুপ করতে বলে ইশারায় জানাল যে সে নেমে আসছে।

অরিন্দম সন্তুর মুখের দিকে তাকাল, সন্তু বলল, আমরা তো জোজোর নাম ধরে ডাকিনি, শুধু বেল বাজিয়েছি, তবু ও আমাদের চুপ করতে বলল কেন?

অরিন্দম বলল, সবাই যেরকম ব্যবহার করে, জোজোও তাই করবে, তুই এরকম আশা করিস কী করে?

জোজো দরজা খুলে বাইরে এসে অতি সন্তর্পণে দরজাটা বন্ধ করে দিল। তারপর নিজে পা টিপে টিপে এগিয়ে যেতে যেতে বন্ধুদেরও সঙ্গে ডাকল।

সন্তু আর অরিন্দম ওর দুপাশে চলে এল, অরিন্দম জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, দুপুরবেলা তোর বাড়ি থেকে বেরনো নিষেধ বুঝি?

জোজো ফিসফিস করে বলল,না,না, তা নয়। আমাদের বাড়িতে এখন কে এসেছেন তোরা কল্পনাও করতে পারবি না। বাবার সঙ্গে নিরিবিলিতে আলোচনা করছেন। গণ্ডগোল হলে বাবার ডিসটার্বেল হয়।

অরিন্দম জিজ্ঞেস করল, কে এসেছে রে, কে?

জোজো বলল,সে নামটা বলা যাবে না ভাই। তা হলে ওয়ার্ল্ড পলিটিক্‌সে গণ্ডগোল হয়ে যেতে পারে। উনি এসেছেন ছদ্মবেশে।

তোদের বাড়ির সামনে কোনও গাড়ি টাড়ি তো দেখছি না।

তোদের মাথা খারাপ, আমাদের বাড়ির সামনে একটা বিরাট গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলে স্পাইরা সব জেনে যাবে না?

থাক বাবা, তা হলে নাম জেনে দরকার নেই। তোরা হঠাৎ দুপুরবেলা এলি? কী ব্যাপার?

সন্তু বলল, তোকে অসময়ে এসে ডিসটার্ব করলুম, সে জন্য দুঃখিত। ব্যাপার কী জানিস, তোর পিসেমশাই আমাদের বাড়িতে দুটো চিঠি পাঠিয়েছেন…

জোজো থমকে গিয়ে বলল, চিঠি? অসম্ভব! আমার পিসেমশাই জীবনে কাউকে চিঠি লেখেন না। আমার বাবাকেই কক্ষনো চিঠি লেখেননি। আমার পিসিমা যতদিন বেঁচে ছিলেন, উনিও চিঠি পেতেন না। উনি নাকি কলমও ছুঁতে চান না।

অরিন্দম বলল, কেন, কলম তো কোনও জন্তু জানোয়ার নয়!

জোজো বলল, এটা ঠাট্টার ব্যাপার নয় অরিন্দম। সবাইকে নিয়ে ঠাট্টা করা যায় না। আমার পিসেমশাই তোদের বাড়িতে চিঠি পাঠিয়েছেন, মোট কথা এটা আমি বিশ্বাস করি না।

সন্তু বলল, উনি কলম দিয়ে কাগজে লিখে চিঠি পাঠাননি বটে, কিন্তু যা পাঠিয়েছেন তাকে চিঠিই বলা যায়। এখন কাকাবাবু একটা উত্তর দিতে চান। উনি অবশ্য হাতে লিখেই দেবেন, সেই চিঠিটা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবি! কিংবা ঠিকানাটা বল পোস্ট করে দেব।

জোজো আঙুল তুলে একটা জিপ গাড়ি দেখাল। একদম নতুন নীল রঙের জিপ। তার সামনের সিটে দুজন লোক অলস ভঙ্গিতে বসে আছে। যেন তাদের কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই।

অরিন্দম বলল, তুই কি ভূতের মতন চারদিকে স্পাই দেখছিস নাকি? স্পাই তোর কী করবে?

জোজো বলল, আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। আমাকে তোদর আড়ালে লুকোতে দে!

জিপ গাড়ির লোক দুজন এক সঙ্গে জিপ থেকে নেমে দৌড়ে এল ওদের দিকে।