[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

০৩. কোনও কোনও নতুন শহরে এসে

কোনও কোনও নতুন শহরে এসে পৌঁছবার সময় মনে হয় কেউ আমার জন্য এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে থাকবে। ঈষৎ ক্লান্ত রুক্ষ মুখে একটু এদিক ওদিক তাকাতেই দেখতে পাব কেউ আমার জন্য হাতছানি দিচ্ছে। মুহূর্তে কাস্টমসের সামনে দাঁড়ানো বিরক্তি অন্তর্হিত হয়ে যাবে।

অসম্ভব এই আশা। জুরিখে আমি কারুকে চিনি না। এখানে কোথাও আমার কোনও হোমিওপ্যাথিক সম্পর্কের আত্মীয়-বান্ধব আছে বলেও শুনিনি। তা ছাড়া সেদিন জুরিখে আমার পৌঁছবার কথা আমি নিজে ছাড়া আর কেউ জানে না। তবু যুক্তিহীনভাবে আকাঙ্ক্ষা করছিলুম, কেউ আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে এয়ারপোর্টে।

এয়ারপোর্ট পেরিয়ে যখন আসছি, দেখি দূরে দাঁড়িয়ে এক বাঙালি ভদ্রমহিলা হলুদ রঙের শাড়ি-পা, পাশে একটি দেবকান্তি শিশু এবং হ্যানডলুমের শার্ট পরা এক ভদ্রলোক–আগত যাত্রীদের দিকে দেখছেন। হয়তো ওঁরা আমারই জন্য দাঁড়িয়ে আছেন, হয়তো আমার কোনও মাসিমা কিংবা বৌদির ননদ হঠাৎ এখানে এসেছেন আমি জানতুম না, কী করে ওঁরা আমার আসার খবর পেলেন ইত্যাদি এসব ভেবে লাভ নেই, নিশ্চয়ই ওঁরা আমারই জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। সারাক্ষণ ধরে বুক চাপা মন খারাপ, কোনও কারণ নেই তবু মন খারাপ, এক একটা নতুন শহর দেখবার আগেই একটা চমৎকার উত্তেজনা থাকে বুকের মধ্যে, আবার কোনও কোনও নতুন শহরে আসবার আগে মনে হয়–এই সম্পূর্ণ নতুন জায়গায় আমার সম্পূর্ণ একাকিত্ব হয়তো এক এক সময় অসহ্য হয়ে উঠবে। মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে–অনেক সময় একা একা রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময়ও নিজেকে একা মনে হয় না, কিন্তু ক্রমাগত নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হতে থাকলে, নিজের একাকিত্ব হঠাৎ বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে, তখন ইচ্ছে হয়, হঠাৎ কেউ পিছন থেকে আমার কাঁধে চাপড় দিয়ে বলুক, আরেঃ তুই এখানে!

আমি সেই ভদ্রমহিলা, শিশু ও পুরুষটির ছোট্ট দলের দিকেই এগুতে লাগলুম। ওদের দেখলেই মনে হয় ওঁরা কারুর জন্য অপেক্ষা করছেন, এই প্লেনেরই কোনও যাত্রীর জন্য। কিন্তু আমার এ প্লেনে আর তো কোনও বাঙালি যাত্রী দেখিনি। ওঁরা কি আমারই জন্য! আমার খুব দরকার একটি চেনা মুখ, আমি এই শহরে অচেনা আগন্তুক হয়ে থাকতে চাই না। আমি জানি, তবে জুরিখ আমার ভালো লাগবে না! জেনিভা আর জুরিখের মধ্যে রেষারেষি আছে, ফরাসি আর জার্মান ভাষার মন কষাকষি। তা থাক, আমি আগে জেনিভা গেছি বলেই জুরিখের প্রতি আমার কোনও বিদ্বেষ নেই। কিন্তু এই অকারণ মন খারাপের তো কোনও যুক্তি নেই। এরকম মন খারাপ থাকলে মনে হয়, কিছুই ভালো লাগবে না। অনবরত ভাঙা ইংরেজি বলতে-বলতে মনে বোবা হয়ে গেছি।

আশ্চর্য, সেই ভদ্রমহিলা ও শিশুটি আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়াতে লাগলেন। ওরা নিশ্চয়ই ভুল করেছেন, আমাকে অন্য কেউ ভেবেছেন–আমার তো কেউ চেনা নেই এখানে, আমি যে জুরিখে আজ আসব, তা তো আমি নিজেই জানতুম না গতকাল পর্যন্ত। কিন্তু ওদের ভুল হোক, ক্ষতি নেই–আমিও ওদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লুম। আমিও তো ওঁদের চেনা লোক বলে ভুল করতে পারি!

ওঁরা হাত নাড়া বন্ধ করলেন না। আর খুব বেশি দূরে নেই মহিলার লাবণ্যময় বাঙালি মুখ, শিশুটির বাংলা হাসি, পুরুষটির বাঙালি ধরনের সিগারেট টানা। কিন্তু, এ কথা নিশ্চিন্ত, এঁদের আমি আগে কখনও দেখিনি, আমার কোনও আত্মীয় হওয়া এঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবু আমি নিবৃত্ত হলুম না। ওঁদের তো এখনও ভুল ভাঙেনি। আমি তখনও হাত নেড়ে হাসিহাসি মুখে এগিয়ে যেতে লাগলুম। আমার মন খারাপ অনেকটা কেটে যাচ্ছিল। ওঁদের কাছে তখুনি কৃতজ্ঞ হয়ে পড়েছিলুম। এবার একেবারে মুখোমুখি।

বিদেশে যা হয়, দেশের লোক দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া! আমি তখনও হাসিমুখে আশা করছিলুম ওঁরাই প্রথম কথা বলবেন। ওদের মুখে হাসি–পুরুষ ও মহিলাটি সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলেন, হ্যালো মিঃ ব্যাবকক। আমি মুহূর্তে পিছনে তাকিয়ে দেখলুম, আমার পিছনেই একজন বুলডগ মুখো জারমান বিশাল থাবা বাড়িয়েছে ওঁদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার জন্য। ওঁরা আমার দিকে ভ্রূক্ষেপও করলেন না।

এই তো স্বাভাবিক, ওঁদের চেনা কোনও লোককে নিতে এসেছেন। আমি কেউ নই, অন্য লোক, অচেনা–আমার সঙ্গে সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। কিন্তু ওই সামান্য ঘটনার জন্যই জুরিখ শহর একেবারে ভালো লাগল না।