০৩. আয়ওয়া সিটি

‘শকুন্তলার পতি মহারাজ
রাজ্যজয়ের ক্লান্তি শরীরে
হর্ষ পেলেন পুনরায় দেখে
বিরহিনী যালা আছে পথে চেয়ে
কৃশ ও পাণ্ডু উদ্বেগে, প্রেমে
আদর করছে হরিণ শিশুকে…’
–গিয়ম আপোলিনেয়ার

আয়ওয়া সিটি একটি ছোট জায়গা, একান্তই বিশ্ববিদ্যালয়-নির্ভর, জনসংখ্যা তখন ছিল মাত্র সাতাশ হাজার। নামে শহর হলেও একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম বলা চলে, কাছাকাছি কলকারখানা কিছু নেই, কিন্তু রেল স্টেশন ও এয়ারপোর্ট আছে এবং অনেকরকমের দোকানপাট, যেখানে বিশ্বের যাবতীয় দ্রব্যই পাওয়া যায়। একটা বইয়ের দোকান এত বড়, যে-রকম কলকাতা শহরেও একটিও নেই।

নিউইয়র্ক কিংবা সানফ্রান্সিসকোর মতন বড় শহরের বুদ্ধিজীবীরা আয়ওয়ার মতন অঞ্চলের নাম শুনলে অবজ্ঞায় ঠোঁট উলটে বলে, মিড ওয়েস্ট? ও তো চাষাভুষোদের জায়গা, ওখানে আবার কোনওরকম সংস্কৃতি আছে নাকি? হ্যাঁ, পল এঙ্গেল একটা সাহিত্য কেন্দ্র খুলেছে বটে, কিন্তু ওই ধাধধাড়া গোবিন্দপুরে কে যাবে?

শেষ দিন পর্যন্ত আমার আসা এমনই অনিশ্চিত ছিল যে আমি আমার বন্ধু অ্যালেন গিনসবার্গকেও কোনও খবর দিতে পারিনি। এখান থেকে তাকে একদিন ফোন করলাম, আমার কণ্ঠস্বর চিনতে পেরেও সে বিশ্বাসই করতে চায় না, বারবার বলতে লাগল, এ যে অতি সুখকর চমক! সুখকর চমক! কিন্তু সুনীল, তুমি কলকাতার ছেলে, ওই গণ্ডগ্রামে কি টিকতে পারবে? শিগগির চলে এসো নিউইয়র্কে। আমার অ্যাপার্টমেন্টে তোমার থাকার জায়গা হয়ে যাবে!

আমি তখুনি যাইনি অবশ্য।

কলকাতা থেকে ষোলো হাজার মাইল দূরে চলে এলেও মাঝখানে ইউরোপ আমেরিকার কোনও বড় শহর দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। যেন একটা ঝড় দেড়দিনের মধ্যে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে এসে ফেলেছে আমেরিকার শস্যক্ষেত্রের মাঝখানে। একদিক থেকে হয়তো সেটাই ভালো হয়েছে, অচেনা বড় শহরের হইহল্লার মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশ কয়েকদিন সময় লাগে। সেই তুলনায় আয়ওয়ার মতন শান্ত জায়গায় স্নায়ুগুলি স্নিগ্ধ হওয়ার অবসর পায়।

হলিউডের ছবিতে আমরা তখন আমেরিকার যে-চিত্র দেখেছি, তার সঙ্গে আয়ওয়ার কোনও মিল নেই। এখানে কেউ মদ খেয়ে মাতলামি করে না, কথায় কথায় ছুরি-বন্দুক বেরোয় না, একটি নারীকে নিয়ে দুজন পুরুষের টানা-হ্যাঁচড়া চলে না। যখন তখন স্বামী স্ত্রীর ডিভোর্সও হয় না, বরং কোনও ডিভোর্সের ঘটনা ঘটলে তা নিয়ে রীতিমতন গুঞ্জন চলে। এখানকার মানুষ সর্বক্ষণ ছোটে না, যা ট-রেস প্রত্যক্ষ করা যায় না। বরং এখানে জীবন চলে ধীর ছন্দে, রাস্তায় ঘাটে অচেনা লোকও ডেকে আলাপ করে, দোকানদাররা রসিকতা করতে ভালোবাসে।

এই শহরের আশেপাশের চাষারা বেশ বড়লোক। অনেকেরই নিজস্ব প্লেন আছে। স্থানীয় ফুটবল ম্যাচের দিয়ে স্টেডিয়ামের বাইরে সারি সারি প্লেন দাঁড়িয়ে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেভ কিছুদিন আগে এসেছিলেন আয়ওয়া রাজ্যে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সেই প্রথম সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনও কর্ণধারের আমেরিকায় আগমন। আয়ওয়ার এক গমের খেতের পাশে দাঁড়িয়ে ক্রুশ্চেভ ভুরু তুলে বলেছিলেন, চেকোশ্লোভাকিয়ার চাষারা আমাকে মিথ্যে কথা বলেছিল। এক একর জমিতে এত ফসল সমাজতান্ত্রিক কোনও দেশেই ফলে না।

আমাদের মতন গরিব দেশের মানুষদের আমেরিকার ফসল উৎপাদনের কারবার শুনে চোখ ছানাবড়া হয়ে যেত। এক এক বছর গমের উৎপাদন এত বেশি হত যে কয়েকটি জাহাজে গমের বস্তা ভরে তা ডুবিয়ে দেওয়া হত সমুদ্রে, না হলে গমের দাম খুব কমে যাবে, চাষিরা মার খাবে। পরে অবশ্য আমেরিকা তার কৃষিনীতি বদল করে। চাষের আগেই হিসেব করা হয়, নিজের দেশে সারা বছর কতখানি গম প্রয়োজন, তা ছাড়া পৃথিবীর কিছু কিছু দেশে দান-খয়রাতি করা হবে কতটা এবং আর কোন কোন দেশ কী পরিমাণ কিনতে পারবে। সেই অনুযায়ী চাষ। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতি বছরই আমেরিকা থেকে গম কেনে। চাষের আগেই তাদের অর্ডার দিয়ে রাখতে হয়। অধিক ফসল যাতে না ফলে যায়, সেইজন্য সরকার কোনও কোনও চাষিকে নির্দেশ দেয়, এ বছর তুমি চাষ কোরো না, জমি এমনি ফেলে রাখো। চাষের বাবদ তোমার যা লাভ হত, সেই টাকাটা সরকার থেকেই দিয়ে দেওয়া হবে। অর্থাৎ ফসল না ফলিয়েও, বাড়িতে আরাম-চেয়ারে পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে থেকে উপার্জন।

আমেরিকান এক শ্রেণির মানুষ বিশেষজ্ঞ, আর বেশিরভাগ মানুষই নানা বিষয়ে অজ্ঞ। আমাদের দেশের অশিক্ষিত গরিব চাষি হয়তো বাইরের পৃথিবীর বিশেষ খবর রাখে না, কিন্তু আমেরিকার মোটামুটি শিক্ষিত, প্লেন চালাতে জানা ধনী চাষিরাও যে নিজের দেশের বাইরে যে-পৃথিবী, সে-সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানে না, তা দেখে বেশ অবাক লাগে। আমাকে একজন চাষা জিগ্যেস করেছিল, তুমি ভারতীয় না পাকিস্তানি? আমি যখন বললাম, আমি ভারতীয়, তখন সে জানতে চাইল পাকিস্তানটা ভারতের কোন দিকে? আমি যখন জানালাম যে পাকিস্তান ভারতের দুদিকে, পশ্চিমে আছে, পুবেও আছে, তা শুনে সে হোহো করে হাসতে লাগল। তার ধারণা, এটা আমার রসিকতা!

এই সরল, ভালোমানুষ চাষারা বিদেশিদের সম্পর্কে বেশ কৌতূহলী। বর্ণ বিদ্বেষের ব্যাপারটা এ অঞ্চলে একেবারেই নেই বলা চলে। চাষিরা আমাদের মতন বহিরাগত লেখক-শিল্পীদের প্রায়ই নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে চায়। বেশ মজার অভিজ্ঞতা হয় আমাদের। গোবরের গন্ধ নেই, এ আবার কীরকম চাষির বাড়ি? গরু-মোষের সঙ্গে চাষের সম্পর্ক এসব দেশ থেকে বহুদিন উঠে গেছে। কোনও কোনও বাড়ির ছেলেমেয়েরা একটাও জ্যান্ত গরু দেখেনি কখনও, কারণ কোনও গরুই মাঠে চরে না। বাড়িগুলি দেখে মনে হয় ছবির বই দেখে বানানো। এরা খাওয়ায়-দাওয়ায় ভালো, আর নানারকম উদ্ভট প্রশ্ন করে। একজন জানতে চেয়েছিল তাজমহল নামে বস্তুটা জাপানে, না ইজিপ্টে? কেউ কেউ কাঁচুমাচু মুখে বলে, আমি তোমাদের দেশ সম্পর্কে কিছুই জানি না। তোমাদের ভাষাও জানি না, কিন্তু তোমরা আমাদের ভাষা জানলে কী করে?

নতুন পরিবেশের সঙ্গে আস্তে আস্তে নিজেকে মানিয়ে নিলেও মনের মধ্যে সবসময় এই প্রশ্নটা ঘোরে, আমি এখানে থাকব কেন? যখন তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে কলকাতা, তার জন্য যে মন কেমন করে তা নয়, বরং কিছুটা অপরাধবোধ আমাকে কুরে কুরে খায়। কলকাতায় আমার আত্মীয়-স্বজন, অনেক বন্ধু-বান্ধবের তুলনায় আমি যে এখানে আরামের জীবনযাপন করছি, সেটা কি স্বার্থপরতা নয়? যারা এদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য আসে, কিংবা বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ চায় কিংবা বিশাল কোনও চাকরির উচ্চাকাঙ্ক্ষী, তাদের তবু থেকে যাওয়ার যুক্তি আছে, আমি বাংলা ভাষায় লেখালিখি করতে চাই, আমি কেন পড়ে থাকব এমন একটা জায়গায়, যেখানে সারাদিনে একটিও বাংলা কথা শোনা যায় না?

এখানে পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সংখ্যা তখন পঞ্চাশ-ষাট জন, তাঁদের মধ্যে দু-তিনজনের সঙ্গেই আমার আলাপ হয়েছিল। তাঁরা সকলেই বিজ্ঞানের ছাত্র, সাহিত্যের সঙ্গে অনেকেরই কোনও সম্পর্ক নেই। দু-একটি শনিবারের সন্ধ্যায় তাঁদের বাড়িতে আমন্ত্রিত হয়ে দেখেছি, শুধু রান্না-বান্নার রেসিপি-বিনিময়েই অর্ধেক সময় কেটে যায়, এ ছাড়া কে কোন গাড়ি কিনেছেন বা কিনবেন, সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। আমি কোনও আলোচনাতেই অংশগ্রহণ করতে পারি না।

বাঙালি মেয়ে দেখেছি মাত্র একজনকেই, তার নাম ভারতী মুখার্জি, সে ইংরিজি সাহিত্যের ছাত্রী। ভারতী অবশ্য বাংলা না-জানা বাঙালি। কিছুদিনের মধ্যেই ক্লার্ক ব্লেইজ নামে এক তরুণ কেনেডিয়ান লেখকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়, পরবর্তীকালে ভারতী উত্তর আমেরিকায় লেখিকা হিসেবে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করে, তার ‘টাইগার্স ডটার’ নামে উপন্যাসটি বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। ভারতী আর ক্লার্ক দু’জনে মিলেও একটি বই লিখেছিল, ‘ডেইজ অ্যান্ড নাইটস ইন ক্যালকাটা’, সত্যজিৎ রায়ের ফিলম ‘অরণ্যের দিন রাত্রি’ অনুকরণে এই নামকরণ।

ক্লার্ক আর ভারতীর সঙ্গে আমি মাঝে মাঝে আড্ডা দিলেও অন্য বাঙালিদের এড়িয়ে চলতাম, কারণ দেখা হলেই তাঁরা আমাকে উপদেশ দিতেন, তুমি শুধু শুধু সময় ও সুযোগ নষ্ট করেছ কেন? তোমার তো পয়লা লাগবে না, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দু-একটা কোর্স করে নাও, ইংরিজি সাহিত্য, জার্নালিজম, ফোটোগ্রাফি, মার্কেটিং, লাইব্রেরিয়ানশিপ, ম্যানেজমেন্ট যা খুশি। যে-কোনও একটা কোর্স করলেই চাকরি-বাকরির অনেক সুবিধে! তাঁরা সহৃদয়, আমার উন্নতির জন্য তাঁরা বিনা স্বার্থে মাথা ঘামাতেন, কিন্তু ওসব কথা শুনলেই আমার পালাতে ইচ্ছে করত। ফর্মাল লেখাপড়া সম্পর্কে তখন আমার গভীর উপেক্ষা জন্মে গেছে, আমি আর ছাত্র সাজতে রাজি নই। দেশে থাকতে আমি অনর্থক একটা এম এ পরীক্ষা দিয়েছিলাম, যদিও জানতাম, ওই ডিগ্রি আমার কোনওদিনই কাজে লাগবে না, কারণ মাসটারি কিংবা অধ্যাপনা করা আমার ধাতুতে নেই। আমার মা বলেছিলেন, তোর মামা সবাই এম এ পাশ, আর আমার ছেলেরা কেউ এম এ হবে না? কয়েক বছর পরে অবশ্য আমার অন্য ভাইবোনেরাও মাকে খুশি করেছে।

আমাদের রাইটার্স ওয়ার্কশপটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরিজি বিভাগের সঙ্গে যুক্ত। সেখানে হাজিরা দেওয়ার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। নদীর ধারে ঘাসের ওপর বিভিন্ন দেশের লেখক-লেখিকারা যদি একসঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়, সেটাও রাইটার্স ওয়ার্কশপ। পল এঙ্গেলের বাড়ি সন্ধেবেলা নেমন্তন্ন খেতে খেতে কেউ চেঁচিয়ে নিজের কবিতা পড়ে শোনাল, কেউ কেউ তর্ক বাধাল, সেই-ই তো যথেষ্ট। পল এঙ্গেল আমায় বলেছি একজন লেখকের শ্রেষ্ঠ ওয়ার্কশপ অবশ্য তার নিজস্ব টেবিল। কোনও লেখা মাথায় আসুক বা না আসুক, সেই টেবিলে প্রত্যেকদিন কয়েক ঘণ্টা বসা উচিত।

অন্য লেখক বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে যাওয়া কিংবা সারাদিন সম্পূর্ণ একা কাটাবার স্বাধীনতা আমার ছিল। এক একদিন আয়ওয়া নদীর ধার দিয়ে একা একা ঘুরে বেড়াই। এই শহরটি সুন্দর, পাশে পাশে ছোট ছোট টিলা, প্রচুর সবুজের সমারোহ, একমাত্র অসুন্দর এই নদীটি। বাগবাজারের খাল কিংবা টালির নালার চেয়ে একটু বেশি চওড়া, জলের রং নোংরা-কালো। দূরের কোনও কোনও কারখানার পরিত্যক্ত গাদ বোধহয় এই নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়, তাই এ নদীতে কেউ স্নান করতে নামে না, এখানে কেউ মাছ ধরে না। তবু এই নদীটিকে সুন্দর করার কতরকম চেষ্টা। এই তো একরত্তি শহর, তা হলেও এখানে এই নদীর ওপর অন্তত গোটা ছয়েক সেতু, প্রত্যেকটির ডিজাইন আলাদা। দুই তীরে নানারকম ফুলের কেয়ারি।

একদিন নদীপ্রান্ত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অন্য পারে দেখলাম সেই ফরাসি মেয়েটিকে। একগাদা বইপত্র হাতে নিয়ে সে প্রায় দৌড়োচ্ছে। তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার আগেই সে মিলিয়ে গেল। মেয়েটি আর আমার বাড়িতে এল না তো? অপোলিনেয়ারের কবিতায় শকুন্তলার উল্লেখ আছে, সে আমার কাছে শকুন্তলার কাহিনি শুনতে চেয়েছিল।

ওর ঠিকানা বা ফোন নম্বর আমি রাখিনি, কিন্তু ও ফরাসি বিভাগে পড়ায়, সেখানে গেলেও ওর খোঁজ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু নিজে থেকে গিয়ে তাকে ডাকতে খুব সঙ্কোচ হয়। ডোরি ক্যাটজ নামে আর একটি মেয়ের ও বান্ধবী, ডোরির সঙ্গেই প্রথম দিন আমার বাড়িতে এসেছিল। সেই ডোরির সঙ্গে এর মধ্যে অনেকবার দেখা হয়েছে, কিন্তু তার কাছেও লজ্জায় মুখ ফুটে মার্গারিটের কথা জিগ্যেস করতে পারিনি।

মেয়েটি নিশ্চয়ই সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে আসে। এরপর তিন চারদিন আমি লাইব্রেরিতে অনেকক্ষণ সময় কাটাতে লাগলাম।

এই বিশ্ববিদ্যালয় শহরের লাইব্রেরির ব্যবস্থা দেখে মুগ্ধ না-হয়ে উপায় নেই। দরজা খোলে সকাল সাতটায়, বন্ধ হয় রাত দুটোয়। চাঁদা লাগে না, এখান থেকে একসঙ্গে যত খুশি বই বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যায়। যাদের গাড়ি আছে, তারা এক একবারে পঞ্চাশ ষাটখানা বইও নিয়ে গিয়ে বাড়িতে সাজিয়ে রাখে। সেই বই অন্য কারুর প্রয়োজন হলে লাইব্রেরি কর্মী বাড়িতে টেলিফোন করে অনুরোধ জানাবে ফেরত দিয়ে যাওয়ার জন্য। অনেক ভাষার বই এখানে, বহু দেশের সংবাদপত্র। আমাদের টাইমস অফ ইন্ডিয়া, দ্য স্টেটসম্যান, এমনকী আনন্দবাজার পত্রিকার ফাইলও দেখেছি।

রাত একটায় কোনওদিন হয়তো একজন মাত্র বসে পড়াশুনো করছে, তার জন্য জেগে আছে তিন-চারজন লাইব্রেরি কর্মী!

কয়েকদিন এই লাইব্রেরিতে বসে কিছু কিছু পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে কয়েকটি বিচিত্র তথ্যের সন্ধান পাই। এই ছোট্ট শহরে রবীন্দ্রনাথও এসেছিলেন একবার। কবিতা পাঠ করতে এসেছিলেন ডিলান টমাস, তিনি অবশ্য এমন একটা কীর্তি রেখে গেছেন, যা আর কেউ ভাঙতে পারবে না। ট্রেন থেকে নামার সময় টমাস আছাড় খেয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান, তখন তিনি বদ্ধ মাতাল। তিনদিন পরে সেইরকম মাতাল অবস্থাতেই তাঁকে আবার ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়। তাঁর অপূর্ব কণ্ঠের কবিতা পাঠ শোনার সৌভাগ্য এখানে কারুর ঘটেনি।

আমরা যে রাইটার্স ওয়ার্কশপের সদস্য, এ বছর থেকেই সেখানে বিদেশি লেখক লেখিকাদের আমন্ত্রণ জানানো শুরু হয়েছে। এর আগে ওয়ার্কশপ-এ যোগ দিতেন শুধু আমেরিকান কবি-সাহিত্যিকরা। একেবারে গোড়ার দিকে এখানে এসেছিলেন প্রখ্যাত নাট্যকার টেনেসি উইলিয়ামস, একথা জেনে রোমাঞ্চ হয়। এর মধ্যে তিনি আর আসবেন না।

একদিন সন্ধেবেলা লাইব্রেরি থেকে বেরুচ্ছি, দেখি যে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে মাথাভরতি উশকোখুশকো সোনালি চুলওয়ালা সেই মেয়েটি। আমি বললাম, হাই! সে-ও হাই বলে আমাকে পাশ কাটিয়ে উঠে যাচ্ছিল, আমি আবার বললাম, তুমি আমার কাছে। শকুন্তলার গল্প শুনতে এলে না?

এবার সে থমকে দাঁড়িয়ে মুখ ফেরাল। তারপর হাসি ছড়িয়ে বলল, আমি তো আমাকে ডাকোনি?

আমি অবাক হয়ে বললাম, কিন্তু সেদিন যে তুমি বললে তুমি ভারতীয় চা খেতে আর গল্প শুনতে আসবে?

মার্গারিট বলল, হ্যাঁ, কিন্তু তারপর তুমি আমাকে নেমন্তন্ন করবে না? তুমি নিজে থেকে তোমার বাড়িতে দুবার গেছি, তারপরেও কি আবার সেধে সেধে যাব?

একে আমার আমন্ত্রণ জানান উচিত ছিল। তা তো ঠিকই। সে কথাটা আমার মাথাতেই আসেনি। বাঙাল আর কাকে বলে?

আমি মিনমিন করে বললাম, তোমার ঠিকানা জানি না।

সে বলল, এই লাইব্রেরিই তো আমার ঠিকানা। ফ্রেঞ্চ ডিপার্টমেন্ট আমার ঠিকানা।

আমি বললাম, সত্যি ভুল হয়ে গেছে। আমি কি এখন তোমাকে আমন্ত্রণ জানাতে পারি? আজ সন্ধেবেলা যদি তোমার সময় থাকে।

মার্গারিট এবার খিলখিল করে হেসে বলল, তুমি এদেশের নিয়মকানুন কিছু শেখোনি? খানে কোনও মেয়ের সঙ্গে একটা সন্ধে কাটাতে চাইলে অন্তত চারদিন আগে আমন্ত্রণ জানাতে হয়। নইলে মেয়েটি অপমান বোধ করে।

এ প্রথার কথা এখানে শুনেছি বটে, কিন্তু সবসময় কি মনে থাকে। আমাদের কলকাতায় আচ্ছা ছিল একেবারে নারী-বর্জিত। সে সময়ে কুমারী মেয়েদের সন্ধের পর বাড়ির বাইরে থাকা দারুণ অপরাধ বলে গণ্য হত। প্রেম-ট্রেম হত গোপনে। প্রেম নয়, শুধু একসঙ্গে একটি সন্ধে কাটাবার জন্য কোনও বাঙালি মেয়েকে প্রস্তাব জানানো ছিল অকল্পনীয়।

আমি বললাম, ঠিক আছে। আজ তো মঙ্গলবার, তুমি এই শুক্রবার আসতে পারবে? মার্গারিট সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, এখানকার অন্য মেয়েদের বেলায় এ ভুল আর কোরো না। কিন্তু আমি এদেশের মেয়ে নই। কোনওদিন আমেরিকান হতেও চাই না। আজ সন্ধেবেলা লাইব্রেরিতে বসে পড়াশুনো করার চেয়ে তোমার সঙ্গে আড্ডা দিতে বেশি ইচ্ছে করছে।

বেশ শীত পড়েছে, এবার যে-কোনওদিন তুষারপাত শুরু হবে, আমার দিশি সোয়েটারে ঠিক ঠান্ডা আটকানো যাচ্ছে না। মার্গারিট গায়ে দিয়ে আছে একটা পার্কা, মাথাটা আধা-ঘোমটার মতন ঢাকা। নদীর ধার দিয়ে, একটা সেতু পেরিয়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম বাড়ির দিকে। মার্গারিট বেশ জোরে জোরে আপোলিনেয়ারের কবিতাটা আবৃত্তি করতে লাগল। আমি বললাম, মূল ফরাসি তো আমি বুঝব না। ইংরিজি অনুবাদ করে শোনাও!

মার্গারিট প্রায় ধমকের সুরে বলল, গিয়ম আপোলিনেয়ারের ‘লা সাঁজো দু মাল এইমে’’ একটা বিশ্ববিখ্যাত কবিতা, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমের কয়েকটি কবিতার মধ্যে একটা, সেই কবিতার রস কি ইংরাজির মতন একটা কেজো ভাষায় পাওয়া যায়? শব্দের ঝঙ্কারই তো আসল! আমি তোমাকে একটু একটু ইংরিজি বুঝিয়ে দিচ্ছি….

কবিতাটি বেশ দীর্ঘ। এর মধ্যে বহুরকম রেফারেন্স রয়েছে। শকুন্তলার উল্লেখ আছে একটি স্তবকে মাত্র একবার। আর ফরাসি ভাষায় শকুন্তলাকে বলে ‘সাঁকোনতাল’। আসলে স্তবকটিতে দুষ্মন্তের কথাই বলা হয়েছে, কারণ পুরো কবিতাটাই এক ভগ্নহৃদয় পুরুষের উক্তি, কিন্তু দুষ্মন্তের মতন খটোমটো শব্দ এড়িয়ে গিয়ে কবি তাকে বলেছেন শকুন্তলার স্বামী।

‘লোপো রইয়্যাল দ্য সাকোনতাল
লা দ্য ভ্যাঁকর সা রেজুই
কাঁ ইল লা র‍্যাঁক্রভা প্লু পাল …’

শুনতে-শুনতে আমি ভাবছিলাম, অধিকাংশ ফরাসি পাঠক কি এই ‘সা।কোনতাল’-এর অর্থ বুঝবে? মার্গারিট ফরাসি সাহিত্য নিয়ে পি এইচ ডি করছে, সে শুধু জানে এটা একটা ভারতীয় নাম, অন্তর্নিহিত বিরহ-উপাখ্যানটি তারও অজানা। কবিতার সব পাঠক তো পি এইচ ডি করে না। এক সময় জার্মানির কবি-সম্রাট গ্যেটে কালিদাসের শকুন্তলা নাটকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন, সেই সুবাদে ইউরোপীয় কবিরা আশ্ৰম-দুহিতা শকুন্তলার কথা জেনে থাকতে পারে, কিন্তু সাধারণ পাঠকদের অবহিত হওয়ার কথা নয়। তবু আপোলিনেয়ার কেন এই স্তবকটি লিখেছিলেন তা বোঝা যায়। কবিরা মাঝে মাঝে পাঠকদের সঙ্গে একটা দুর্বোধ্যতার আড়াল সৃষ্টি করতে ভালোবাসেন। কিন্তু সেই আড়ালটিও শিল্প হয়ে ওঠা চাই, নিরেট দেওয়াল হলে সবটাই ব্যর্থ, বরং একটা রহস্যময় যবনিকা, পাঠক অনুমান করতে পারে ওপারে কিছু আছে, কিন্তু ছুঁতে পারে না। কবিরা এমনও আশা করে, ভবিষ্যতের কোনও পাঠক বা পাঠিকা ঠিক বুঝে নেবে।

সেই কবে মারা গেছেন অ্যাপোলিনেয়ার। প্রথম মহাযুদ্ধে তাঁর মাথায় একটা গোলার টুকরো লেগেছিল। মস্ত বড় একটা ব্যান্ডেজ মাথায় বেঁধে তিনি দাপিয়ে বেড়াতেন প্যারিসের পথ। যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই তিনি চলে গেলেন। তাঁর মৃত্যুর পঁয়তাল্লিশ বছর পরে বহু দূরের এক জায়গায় তাঁর ওই কবিতা এক যুবতী পাঠ করে শোনাচ্ছে শকুন্তলার দেশের একজন মানুষকে।

আমার অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছেই মার্গারিট বলল, এবার শকুন্তলার কাহিনি শোনাও।

আমি বললাম, আগে চা-টা বানাই। তোমার নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে?

মার্গারিট বলল, না, না, ওসব কিছু চাই না। আমি শকুন্তলার জীবনের কথা জানতে চাই।

আমি কালিদাসের নাটকের আখ্যান শুরু করলাম বটে, কিন্তু একটানা বলে যাওয়া খুব মুশকিল হয়ে পড়ল। মার্গারিট যেমন ছটফটে, তেমন কোমল। আমি যখন বললাম যে, শকুন্তলার মা মেনকা ওই মেয়ের জন্ম দেওয়ার পরই তাকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল, একটি পাখি অর্থাৎ শকুন্ত ডানা মেলে ওর মুখের ওপর পড়া রোদ আড়াল করে, তখন মার্গারিট সজল চোখে জিগ্যেস করে, কেন, কেন ওইটুকু বাচ্চাকে ফেলে রেখে গেল কেন? কোনও মা কি এত নিষ্ঠুর হতে পারে? আশ্রম ছেড়ে শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রার দৃশ্যে সে ফোঁপাতে থাকে। রাজসভায় দুষ্মন্ত যখন কটু ভাষায় শকুন্তলাকে প্রত্যাখ্যান করেন, তখন মার্গারিট চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বলে, থামো, থামো, মেয়েটি এবার আত্মঘাতিনী হবে নাকি? ওঃ, না, না!

সমস্ত কাহিনিটি শোনার পর মার্গারিট কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। আমি একটা সিগারেট ধরালাম। মার্গারিট জল মুছে আমার হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে বলল, এর আগে আমি কোনও ভারতীয় লেখককে দেখিনি। ভারত শব্দটা শুনলেই আমি যেন দু-তিন হাজার বছর আগেকার অতীত ইতিহাস দেখতে পাই। এখানকার দু-তিনটি ভারতীয় ছাত্রের সঙ্গে আমার সামান্য আলাপ হয়েছিল, কিন্তু তারা কেউ কবি নয়, সাহিত্যের ধার ধারে না। যারা কবিতা ভালোবাসে না, তাদের সঙ্গে আমার একটুও মিশতে ইচ্ছে করে না।

একটু থেমে ফিক করে লাজুকভাবে হেসে বলল, তোমাকে এবার একটা সত্যি কথা জানাব? প্রথম দিন তোমার এখানে আমার বইটা আমি ইচ্ছে করে ফেলে গিয়েছিলাম, যাতে ওই ছুতোয় তোমার এখানে আবার আসতে পারি!

আমি বললাম, তা হলে আমিও একটা সত্যি কথা বলি? তুমি নিশ্চয়ই ভেবেছ, আজ লাইব্রেরির সিঁড়িতে তোমার সঙ্গে আমার হঠাৎ দেখা হয়েছে! আসলে, গত চার-পাঁচদিন ধরে আমি লাইব্রেরির সামনে ঘোরাঘুরি করছি, যদি তোমার দেখা পেয়ে যাই এই জন্য। এরপর দু’জনেই হাসতে লাগলাম একসঙ্গে।