[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

০২. সে নদীর উৎস কোনখানে

সে নদীর উৎস কোনখানে, আর কোথায় বা গিয়ে শেষ হয়েছে, তা কিছুই জানা ছিল না। আমরা শুধু জানতাম, আমাদের গ্রামের নদীর নাম আড়িয়াল খাঁ। ঠিক গ্রামের পাশেই নদী নয়, ছ-সাত মাইল দূরে। শীতকালে হেঁটে যেতে হয়, আর বর্ষাকালে নৌকোয়।

আমাদের গ্রামের সীমানা তা বলে শুকনো নয়। ইস্কুল যাওয়ার সময় একটা বেশ চওড়া খাল পেরিয়ে যেতে হত, সেটাকেই আমরা নদী বলেই মনে করতাম ছোটবেলায়। তখন নদী আর খালের তফাত জানা ছিল না ঠিক। বর্ষকালে জল, জল, চতুর্দিকেই জল, মাঝে-মাঝে দ্বীপের মতো গ্রাম। কোনটা ধানের খেত ছিল আর কোনটা খেলার মাঠ, কিছুই বোঝা যেত না। বন্যা নয়, প্রতি বছরই এরকম।

আমাদের গ্রামের নাম মাইজ পাড়া। সব নামেরই একটা অর্থ থাকে। মাইজ পাড়া, অর্থাৎ মাঝের পাড়া। বাঙাল ভাষায় মেজো ভাইকে বলে মাইজা ভাই, মেজো ছেলে–মাইজা পোলা। শুধু মাইজ পাড়া নয়, আমাদের গ্রামের সঠিক নাম পূর্ব মাইজ পাড়া। মাঝখানের আবার পূর্বদিক কী করে হয়? বাচ্চা বয়সে এসব চিন্তা করিনি। পশ্চিম মাইজ পাড়া নামেও আর একটা গ্রাম ছিল।

নদীর নামটা শুনে সবসময় গা ছমছম করত। আড়িয়াল খাঁ! কোনও ডাকাতের নাম নাকি? কিন্তু কোনও ডাকাতের যতই নামডাক হোক, তার নামে কেউ নদীর নাম রাখে না। পরে জেনেছিলাম, আড়িয়াল খাঁ ছিল কোনও এক ফকিরের নাম। কিন্তু এযাবৎ আর কোনও মুসলমানের নাম আড়িয়াল হয় বলে শুনিনি। ডাকাতের নামে নদীর নাম হয় না বটে, তবে কুমিল্লা জেলায় একটা নদীর নাম ডাকাতিয়া!

আড়িয়াল খাঁ নদীটাকে আমরা দেখতে যেতাম মাদারিপুর শহরের কাছে। যদিও পায়ে হাঁটার রাস্তা ছিল এবং খালপথে নৌকোয় যাওয়া যেত। কিন্তু আমরা যেতাম অন্যভাবে। শীতকালে জল সরে গিয়ে জেগে উঠত ভূমি, তখন ধানখেত, পাটখেত দেখা যেত স্পষ্ট, আমরা বাঁধা পথ ছেড়ে হাঁটা দিতাম মাঠের মাঝখান দিয়ে। হাঁটা দিতাম বা হাঁটা দেওয়াও বাঙাল কথা, এখন লিখতে গেলে লিখি, হাঁটতে শুরু করতাম। বা, করতুম! যেতে হত ধুয়াসার নামে একটি গ্রামের পাশ দিয়ে। এই গ্রামটি আমাদের গ্রামের চেয়েও বর্ধিষ্ণু। ছবির মতো সুসজ্জিত। একটি বাড়ির সামনের দিঘিতে চওড়া লাল রঙের সিঁড়িওয়ালা বাঁধানো ঘাট, দুপাশে বসবার ব্যবস্থা। দেখলেই মনে হয় দুপুরের রোদ পড়ে গেলে ওখানে কারা যেন বসে খুব গল্পগুজব করে। সেই ঘাটে নেমে আমরা স্বচ্ছ জলে পা ডুবিয়ে একটু আরাম করে নিতাম।

একদিন ওই বাড়ির এক মহিলাকে দেখে বলেছিলাম, এক গ্লাস জল দেবেন! যত অসুবিধাই থাকুক, জল চাইলে কেউ প্রত্যাখ্যান করে না। সেই মহিলাটি, যাকে দেখলেই ছোট মাসি বলে ডাকতে ইচ্ছে করে, তিনি দোরগোড়ায় নিয়ে গিয়ে শুধু জল নয়, একটা কাঁসার রেকাবিতে চারটি তক্তি এনে দিলেন। ‘তক্তি’ শব্দটা পূর্ববঙ্গে বলে, মূল বাংলাভাষায় চালু নেই। কী করে বোঝাব? ক্ষীর আর নারকোল দিয়ে তৈরি চারকোনা পাতলা-পাতলা মিষ্টি। নাড়ু তো গোল হয়। চারকোনা মিষ্টির কী নাম হয়? বাঙাল ভাষার কিছু-কিছু শব্দ মূল বাংলা সাহিত্যের ভাষায় স্থান পাওয়া উচিত। যেমন খালি গা-কে ওদিকে বলে উদলা, বেশ মিষ্টি শোনায় না?

অপ্রত্যাশিতভাবে জলের সঙ্গে সেই মিষ্টি খেতে পেয়েছিলাম বলে মনে-মনে আমরা সেই বাড়িটার নাম দিয়েছিলাম তক্তিবাড়ি’। অন্য যে কোনও বাড়িতেই পথিকরা জল চাইলে কেউ শুধু জল দিত না, অন্তত দুটো বাতাসা এনে দিত। একটু মিষ্টি মুখ না করে জল খেতে নেই, এই ছিল প্রথা। আমাদের বাড়িতে সারা বছর বাতাসা থাকত। আমাদের নিত্য জলখাবার ছিল বাতাসা আর মুড়ি। কোনও কোনও দিন চিঁড়ের মোয়া!

বর্ষার দিনেও আমরা খালপথে না গিয়ে নৌকো চালিয়ে দিতাম ধানখেতের ওপর দিয়ে। সব ধানখেতেই এক বুকের বেশি জল, শুধু ধানের ডগাগুলো উঠে থাকে। জল যত বাড়ে ধানগাছ তত লম্বা হয়। প্রকৃতির একটা নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা আছে। ধানের খেত একেবারে জলে ডুবে গেলে, যতক্ষণ ডগাগুলো ওপরে উঠে থাকে, ততক্ষণ ধানগাছ মরে না। ধানও পচে না। পশ্চিমবাংলায় খেতগুলো এমনভাবে জলে ডুবে যায় না, তাই ধান কিংবা পাটগাছগুলো তত লম্বাও হয় না। পাটগাছ লম্বা হলেই বেশি লাভ, বেশি পাট পাওয়া যায়, পাটকাঠি বা প্যাঁকাটিও বেশি লম্বা হয়, সেগুলি জ্বালানি হিসেবে কাজে লাগে। আর ধানগাছ বেশি লম্বা হলে খড় পাওয়া যায় বেশি।

সেই জলে ডোবা ধানখেতের ওপর দিয়ে দিব্যি নৌকো চলে। খালের ওপর দিয়ে যাওয়ার চেয়ে এই নৌকোযাত্রার রোমাঞ্চ অনেক বেশি। দেখা যায় অনেক ছোট-ছোট মাছ। ইচ্ছে করলে ধানের ডগা থেকে খপ খপ করে ধরা যায় সবুজ ঘাসফড়িং (ওদিকে এই সবুজ ঘাসফড়িং-এর নাম কয়া), মাঝে-মাঝে ফুটে থাকে শালুক ফুল (ওদিকে শালুকের নাম শাপলা)। মামাবাড়ির মাঝি নাদের আলি শেষ পর্যন্ত কথা রাখেনি, সে আমায় নিয়ে যায়নি তিন প্রহরের বিলে। তার বর্ণিত পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমরের খেলা দেখা হয়নি আমার। কিন্তু ধানখেতের ওপর দিয়ে নৌকোয় যেতে যেতে আমি কয়েকবার দেখেছি। শালুক ফুল জড়িয়ে আছে হলদে-কালো ঢোঁড়া সাপ আর ওপরে ফরফর করছে একরাশ ফড়িং।

ধানখেতের ওপর দিয়ে কোনাকুনি গেলে পথ অনেক সংক্ষিপ্ত হয়। তারপর মাদারিপুর শহর। সে শহর দেখে এমন কিছু মোহিত হওয়ার মতো নয়। মফসসল শহর যেমন হয়। বাল্য বয়সেই আমি কলকাতা দেখেছি অনেকবার। গ্রামের অন্যান্য ছেলেদের তুলনায় আমি ছিলাম ক্যালকেশিয়ান। আমি চাঁদকে চাদ না বলে চাঁদই বলতে পারতাম। ওরা বলত হাসি, আমার উচ্চারণ হাঁসি। ওদিকে চন্দ্রবিন্দু একেবারে বরবাদ, কলকাতায় বেশি-বেশি।

আমাদের প্রধান দ্রষ্টব্য ছিল আড়িয়াল খাঁ নদী। কেউ বলত আড়িয়েল, কেউ বলত আড়িয়াল। এপার থেকে ওপার দেখা যেতে না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? তবে শীত আর বর্ষায় তফাত ছিল অনেকখানি। বর্ষাকালেই ফুটে উঠত তার প্রকৃত রুদ্র রূপ। প্রচণ্ড জলের প্রবাহের মধ্যে যেন শোনা যেত একটা গর্জন! মাঝে-মাঝে ঝপাস-ঝপাস করে ভেঙে পড়ত পরের মাটি। একটু আধটু মাটি নয়, অনেকখানি। একটু আগে দেখলাম, নদীর ধারে একটা আমগাছ, হঠাৎ লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগল ঢেউ। ওই আমগাছটার ওপর নদীর খুব লোভ হয়েছে। এরপর ওই আমগাছটাকে বাঁচাবার সাধ্য কারওর নেই। ঠিক যেন অতিকায় এক জলজ প্রাণীর মতো ঢেউ সেই গাছটাকে টেনে নিয়ে গেল, নদীতে ওলটপালট খেতে-খেতে সেই গাছটা চলে গেল কোথায়? সঙ্গে চলে গেল কয়েকটা পাখির বাসা। পাখিরা করুণভাবে ডেকে-ডেকে ঘুরতে লাগল জলের ওপর। হয়তো সেই গাছের বাসায় তাদের ছানা-পোনারা রয়ে গিয়েছিল।

সেই নদী সম্পর্কে আমার মনে ভয় ও সমীহ ছিল দুটি কারণে।

আমি বাচ্চা বয়স থেকেই সাঁতার জানি, জলকে ভয় পাই না, জল আমায় টানে। কোনও নদী দেখে ভালো লাগলেই নেমে পড়ি। পৃথিবীর বহু দেশের নদীর জলে মিশে আছে আমার শরীরের উত্তাপ। নদীর সঙ্গে প্রকৃত ভালোবাসা হয় অবগাহনে।

কিন্তু আমাদের আড়িয়াল খাঁ নদীতে সাঁতার কাটতে আমার ভয় লাগত। কোনওদিন সাঁতার দেওয়ার চেষ্টাও করিনি, কিন্তু একবার আমাদের নৌকো উলটে গেল। নৌকো চালাচ্ছিল আমার ছোট কাকা। আমার চেয়ে বয়সে চার-পাঁচ বছরের বড়, অর্থাৎ তখনও বেশ কিশোরই। যত না ভালো নৌকো চালাত, তার থেকে কেরানি দেখাত বেশি। তাই একবার নৌকোটা উলটেই গেল। আমি ভয়ে আঁকুপাঁকু করতে লাগলাম, যদিও পার থেকে বেশি দূরে নয়। অনায়াসে সাঁতরে পৌঁছনো যায়, তবু আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, জলের তলা থেকে কোনও রহস্যময় প্রাণী আমার পা ধরে টেনে পাতালে নিয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত যে বেঁচে গিয়েছিলাম, তা বলাই বাহুল্য, অন্যদের সাহায্য ছাড়াই। কিন্তু আমার ভেতরের ভয়টা কেউ দেখতে পায়নি।

আর একবার আমরা তিন বন্ধু নদীর পাড়ে বসে গল্প করছি। বেশ উঁচু পাড়। আমরা চিনেবাদামের খোসা ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলছি জলে। হয়তো সেইটাই অন্যায় হয়েছিল। ফকিরের নামে নদী, তার গায়ে আজেবাজে জিনিস ছুঁড়ে ফেলা মোটেই উচিত নয়, নদীর রাগ হতেই পারে।

গল্পে-গল্পে আমরা তন্ময় হয়ে গেছি, হঠাৎ খেয়াল হল পেছনে কারা যেন খুব চেঁচামেচি করছে। ভয়ের স্বর। আমরা কারণটা বুঝতে পারলাম না। আমরা বসেই আছি। চিৎকারটা বাড়ছে, হঠাৎ আমার সেই ছোট কাকা দৌড়ে এসে আমার কাঁধটা খামচে ধরল, তারপর আমাকে প্রায় শূন্যে উড়িয়ে নিয়ে চলে এল বাজারের দিকে। বন্ধুরাও সঙ্গে-সঙ্গে ছুটছে। আসতে-আসতে দেখি আমরা যেখানে বসেছিলাম তার খানিকটা পেছনে মাটি এক জায়গায় কেটে হাঁ হয়ে গেছে, প্রায় একহাত ফাঁক, ভূমিকম্পে যেরকম ফাটল ধরে, অর্থাৎ একটা সাঙ্তিক ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছিল। আর একটুক্ষণ বসে থাকলে অনেকখানি জমি আমাদের সঙ্গে নিয়ে নদীতে তলিয়ে যেত। ওই অবস্থায় প্রাণ বাঁচানো খুব কঠিন। আমরা দেখলাম, আমাদের চোখের সামনে সেই জায়গাটা প্রবল শব্দে ধসে গেল। নদীর পাড় থেকে অতখানি দূরে যে ফাটল ধরে তা আমরা জানতামই না। আমাদের ধারণা ছিল, নদীর ধারের মাটি ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে। নদী একটু একটু এগোয়। সাধারণ নদীতে সেরকম হয়, কিন্তু আমাদের আড়িয়াল খাঁ-এর তেজ যেন অসাধারণ।

এতক্ষণ এই নদীর শোভার কথা কিছু বলিনি। সুন্দর, কবিত্বময় কোনও দৃশ্যের কথা মনেও নেই। যে বিশেষ দৃশ্যটির স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বল করে, সেটিও সুন্দর বটে, কিন্তু হৃদয়ের চেয়ে উদরের সম্পর্কই তার সঙ্গে বেশি।

আড়িয়াল খাঁ-র ইলিশ বিখ্যাত ছিল। পদ্মার ইলিশের মতোই। পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশের অধিকাংশ নদীরই পদ্মা কিংবা মেঘনার সঙ্গে লতায়-পাতায় সম্পর্ক আছে। আড়িয়াল খাঁ পদ্মার দিকে। পাড়ে দাঁড়ালেই দেখা যায় অনেকগুলি জেলেনৌকোয় ইলিশ মাছ ধরা চলছে। একেকবার জাল উঠছে, তাতে ঝকঝক করছে ইলিশ।

আমরা দু-একবার আমাদের নৌকো নিয়ে মাঝনদীতে ইলিশ মাছ ধরা দেখতে গেছি। ইলিশ মাছ কখনও পাড়ের কাছে আসে না। মাঝনদী দিয়ে ঝাঁক বেঁধে যায়। একেকবার টানা জালে চার-পাঁচটা ওঠে। দুপুরের রোদ্দুরে মনে হয় যেন একেবারে রুপোর শরীর। দু-একবার লাফিয়েই নিথর হয়ে যায় ইলিশ। অর্থাৎ জ্যান্ত ইলিশ আমি দেখেছি বলে দাবি করতে পারি। রোদ্দুরের স্পর্শে ইলিশ বাঁচে না, তবে রাত্তিরবেলা জ্যোৎস্নার আলোয় ইলিশ মাছ ধরা পড়লে আরও বেশিক্ষণ বেঁচে থাকে কিনা আমি জানি না।

আমাদের সেই গ্রামের বাড়িও আর নেই। সেই নদীও আমাদের নেই, শুধু মনের মধ্যে ছবি আছে।

পাকিস্তানি আমলে একবারও আর ওদিকে যাইনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় গেছি বহুবার। মাদারিপুরে অবশ্য যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ঢাকার বন্ধুদের কাছে যখন আমার বাল্যকালের গল্প করি, তখন বুঝতে পারি, ওরা অনেকেই আড়িয়াল খাঁ নদীর নাম শোনেনি। দু একজন নাম শুনলেও চোখে দেখেনি। বাংলাদেশে কত বড়-বড় নদী আছে, সেই তুলনায় এই নদীটা কিছুই না। আমাদের কলকাতাতে কজন কেলেঘাই নদীর নাম শুনেছে বা দেখেছে? আড়িয়াল খাঁ অনেকটা কেলেঘাইয়েরই মতো।

ঢাকায় একবার শুধু একজন বলেছিল, তুমি আড়িয়াল খাঁ নদীর কথা এত বলো। সে নদী আমি গত বছর দেখেছি। ওরকম, দুর্দান্ত কিছুই না। বেশি চওড়াও নয়। মাঝখানে চরা পড়ে গেছে, কেমন যেন মরা-মরা ভাব। তুমি এখন দেখলে চিনতেই পারবে না।

আমি আর দেখতেও চাই না। বাল্যকালের দেখা ছবিটাই থেকে যাক মনের মধ্যে।