০২. দুজন ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা

দুজন ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছেন কাকাবাবু, এমন সময় ঝনঝন করে বেজে উঠল টেলিফোন। এখন বম্বে থেকেও স্পষ্ট কথা শোনা যায়। কাকাবাবু ফোন তুলে বলেন, ইয়েস, রাজা রায়চৌধুরী স্পিকিং…কে, বলবস্তু রাও?…হ্যাঁ, কী ব্যাপার বলল…সেই মিউজিয়ামে ডাকাতির ব্যাপারটা…হ্যাঁ, কাগজে পড়েছি, জানি,…না, না, আমি যেতে পারব না, আরে চোর-ডাকাত ধরা কি আমার কাজ নাকি?…হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনছি, তোমার কথা শুনছি…মুখ্যমন্ত্রী অনুরোধ করেছেন? শোনো বলব, মুখ্যমন্ত্রীকে বুঝিয়ে বললো, আমার শরীর খারাপ, এখন আমার পক্ষে বম্বে যাওয়া সম্ভব নয়।.হা সত্যিই আমি ক্লান্ত, এখন কোথাও যাব না..

টেলিফোন রেখে দিয়ে কাকাবাবু বললেন, উফ, কিছুতেই ছাড়তে চায় না। চোর ধরতে আমাকে বম্বে দৌড়তে হবে। আমি কি গোয়েন্দা নাকি?

উপস্থিত দুজন ভদ্রলোকের মধ্যে একজন বললেন, কিন্তু মিঃ রায়চৌধুরী আমাদের বর্ধমানে একবার আপনাকে যেতেই হবে। বেশি তো দূরে নয়, আপনাকে গাড়িতে নিয়ে যাব, মহারাজার গেস্ট হাউসে থাকবেন, কোনও অসুবিধে হবে না, আগুন লাগার ব্যাপারটা আমরা কেউ কিছু বুঝতে পারছি না।

কাকাবাবু বললেন, আমাকে মাফ করতে হবে। এখন আমি কোথাও যেতে পারব না। এই তো দুদিন আগে মধ্যপ্রদেশ থেকে ফিরেছি, একটা নীলমূর্তির জন্য সেখানে পাহাড়ে-জঙ্গলে এত ছোটাছুটি করতে হয়েছে…এখন কিছুদিন আমি বিশ্রাম চাই।

অন্য ভদ্রলোকটি বললেন, বর্ধমানে তো আপনার বিশ্রামই হবে। গেস্ট হাউসে থাকবেন কেউ আপনাকে ডিসটার্ব করবে না, শুধু রাত্তিরে যদি আগুনটা জ্বলে…

কাকাবাবু হাত জোড় করে বললেন, আমাকে সত্যিই ক্ষমা করুন। আমার শরীর-মন খুবই ক্লান্ত, এখন আমি কিছুদিন একা থাকতে চাই।

এই সময় শৈবাল দত্ত দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, কাকাবাবু, কেমন আছেন?

কাকাবাবু খুব উৎসাহের সঙ্গে বললেন, আরে শৈবাল, এসো, এসো! কবে ফিরলে?

শৈবাল দত্ত এসে বসলেন কাকাবাবুর পাশের একটা চেয়ারে। ভদ্রলোক দুজন কাকাবাবুকে বর্ধমানে নিয়ে যাবার জন্য ঝুলোবুলি করলেন আরও কিছুক্ষণ। কাকাবাবু কিছুতেই যেতে রাজি হলেন না। নিরাশ হয়ে তাঁরা উঠতে বাধ্য হলেন।

ওঁরা বেরিয়ে যাবার পরই সন্তু এসে বলল, কাকাবাবু, এইমাত্র তোমার নামে একটা টেলিগ্রাম এসেছে।

হাত বাড়িয়ে কাকাবাবু টেলিগ্রামটা নিয়ে বললেন, কে পাঠিয়েছে? ও, নরেন্দ্র ভার্মা। সে আবার কী চায়?…ইয়োর প্রেজেন্স ইজ আর্জেন্টলি নিডেড ইন ডেহি। কাম বাই দা ইভনিং ফ্লাইট টু-ডে! টপ সিক্রেট?

কাগজটা মুড়ে গোল্লা পাকাতে পাকাতে কাকাবাবু বললেন, টপ সিক্রেটের নিকুচি করেছে। কিছু একটা হলেই আমাকে দিল্লি যেতে হবে? অসম্ভব, এখন অসম্ভব।

সন্তু বলল, দিল্লির থেকে বম্বে ভাল। আমি দিল্লিতে দুবার গেছি, বম্বে যাইনি।

কাকাবাবু ধমকের সুরে বললেন, অ্যাই, সামনেই তোর পরীক্ষা না? তোর এখন কোথাও যাওয়া চলবে না। আমিও যাব না। কী ব্যাপার বলে তো শৈবাল, সবাই মিলে আমাকে এত ডাকাডাকি শুরু করেছে কেন? হঠাৎ বিখ্যাত হয়ে গেলাম নাকি?

শৈবাল বললেন, আপনি বিখ্যাত তো বটেই। গত মাসেই টাইমস অব ইন্ডিয়ায় একটা বড় লেখা বেরিয়েছে আপনাকে নিয়ে!

নিশ্চয়ই অনেক কিছু বানিয়ে বানিয়ে লিখেছে! সন্তু, তুই টেলিগ্রাফ অফিসে গিয়ে একটা উত্তর পাঠিয়ে দিয়ে আয়।

কী লিখব? শুধু লিখে দিবি, কাউন্ট মি আউট। তার তলায় আমার নাম।

শৈবাল বললেন, টেলিগ্রাম না পাঠিয়ে দিল্লি থেকে উনি ফোন করলেই তো পারতেন। আপনিও ফোনে উত্তর দিতে পারতেন।

কাকাবাবু বললেন, নিশ্চয়ই ফোনে লাইন পায়নি। একটু আগে আমি বম্বে থেকে একটা কল পেলাম। বম্বে-দিল্লি এইসব লাইনই একসঙ্গে ভাল থাকবে, এরকম কখনও হয় আমাদের দেশে? যাকগে, ফোন করেনি ভালই হয়েছে, অনেকক্ষণ ধরে ঝুলোৰুলি করত! তোমার কথা বলো শৈবাল, কেমন বেড়িয়ে এলে? কোথায় যেন গিয়েছিলে, ময়ূরভঞ্জ?

শৈবাল বললেন, না, কেওনঝড়। আমার অফিসের এক কলিগের ওখানে একটা বাড়ি আছে। খুব নির্জন জায়গায় বাড়িটা, চুপচাপ বিশ্রাম নেবার পক্ষে চমৎকার। আমার বন্ধুর ঠাকুর্দা কেনঝড় নেটিভ স্টেটের দেওয়ান ছিলেন, এককালে ওই বাড়িটা রাজাদেরই ছিল। রাজারা ওখানে শিকার করতে যেতেন।

এখনও কিছু জন্তু-জানোয়ার আছে ওদিকে?

হরিণ তো আছেই। লেপার্ড দেখা যায় মাঝে-মাঝে। শেয়ালের ডাক শুনেছি খুব। আজকাল তো এদিকে শেয়ালের ডাক শোনাই যায় না। পাখি আছে অনেকরকম। কত জাতের যে পাখি, নামই জানি না।

বাঃ, শুনে তো বেশ লোভ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে ওখানে গিয়ে কাটিয়ে আসি কয়েকদিন। চোর-ডাকাত আর বদমাস লোকেদের পেছনে ছুটোছুটি করতে

আর ভাল লাগে না, তার চেয়ে পাখি দেখা অনেক ভাল।

আপনি যাবেন? যে-কোনও সময়ে ব্যবস্থা করে দিতে পারি। একটাই শুধু অসুবিধে, ওই বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি নেই। সন্ধেবেলা হ্যাজাক জ্বালতে হয়।

সেটা এমন-কিছু অসুবিধের ব্যাপার নয়। দেবলীনা কেমন আছে? ওকে। নিয়ে এলে না কেন? অনেকদিন দেখিনি ওকে।

একটু চুপ করে গিয়ে শৈবাল একটা সিগারেট ধরাবার সময় নিলেন। কাকাবাবু তাঁর সামনে অন্য কারও সিগারেট টানা পছন্দ করেন না আজকাল, কিন্তু শৈবালের মনে থাকে না সেকথা।

মুখ তুলে শৈবাল বললেন, খুকি এল না…মানে, ওর একটু শরীর খারাপ।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে দেবলীনার?

সেরকম কিছু হয়নি, এমনিতে ভালই আছে, তবে…কাকাবাবু, আপনার সঙ্গে একটা ব্যাপারে আলোচনা করতে চাই, আপনার হাতে কি একটু সময় আছে?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, অনেক সময় আছে। এখন তো কোনও কাজই নেই। দাঁড়াও, একটু কফি খাওয়া যাক।

সন্তু একটু আগেই চলে গেছে এ-ঘর থেকে। এখন সে বাইরে যাবার পোশাক পরে দরজার কাছে এসে উঁকি দিয়ে মুচকি হেসে বলল, কাকাবাবু, তোমার কাছে আবার একজন লোক এসেছে।

কাকাবাবু ভয় পাবার ভঙ্গি করে বললেন, আবার লোক? একটু নিরিবিলিতে গল্প করছি শৈবালের সঙ্গে। তুই কথা বলে দ্যাখ না লোকটি কী চায়?

সন্তু বলল, লোকটি তোমার জন্য কী যেন একটা জিনিস নিয়ে এসেছে। সেটা সে নিজে তোমার হাতে দেবে।

তা হলে ডেকে নিয়ে আয় লোকটাকে।

খাকি প্যান্ট-শার্ট পরা একজন লম্বা লোক ঢুকল, কোনও অফিসের দরোয়ান বলে মনে হয়। হাতে বেশ বড় একটা চৌকো কাগজের বাক্স, রঙিন কাগজ দিয়ে মোড়া। সে সোজা কাকাবাবুর দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল, আপ রাজা রায়চৌধুরী? ইয়ে আপকে লিয়ে যায়।

খুব সাবধানে জিনিসটি টেবিলের ওপর রেখে লোকটি কাকাবাবুকে দিয়ে সই কাবার জন্য একটা রসিদ বার করল বুক-পকেট থেকে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কিনে ভেজা?

লোকটি বলল, আর. কে. দত্তা সাহাব।

কাকাবাবু রসিদটা ভাল করে পড়ে দেখলেন, তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল, তবু তিনি সই করে ফিরিয়ে দিলেন সেটা। লোকটি সেলাম ঠুকে বেরিয়ে গেল।

কাকাবাবু বললেন, কে পাঠিয়েছে কিছুই বোঝা গেল না। আর. কে. দত্ত যে কে, তা তো মনে পড়ছে না আমার। কিন্তু আমারই নাম-ঠিকানা লেখা। যাকগে!

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, ওটা খুলে দেখবে না?

কাকাবাবু চওড়াভাবে হেসে বললেন, তোর বুঝি খুব কৌতূহল হচ্ছে? অনেক ডিটেকটিভ-গল্পের বইতে থাকে যে, কোনও রাজা-মহারাজার কে সম্ভ করে দেবার পর তিনি এরকম একটা বিরাট কিছু উপহার পাঠান। আমি তো কোনও রাজা-মহারাজার কেস করিনি। আজকাল সেরকম রাজা-মহারাজাই বা কোথায়? আর-একটা হয়, শত্রুপক্ষের কেউ এইরকম বেশ সুন্দর মোড়কে মুড়ে একটা টাইম বোমা পাঠিয়ে দেয়। খুলতে গেলেই মুখের উপর ফাটবে।

শৈবাল বললেন, আমারও বেশ কৌতূহল হচ্ছে। তবে, সত্যিই যদি টাইম বোমা হয়…আপনার শত্রুর তো অভাব নেই।

কাকাবাবু বললেন, আমার তো কেউ শত্রু আছে বলে মনে পড়ে না।

শৈবাল বললেন, ওই লোকটাকে তক্ষুনি ছেড়ে না দিয়ে ওকে একটু জেরা করে দেখলে হত!

কাকাবাবু বাক্সটা নিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখলেন, কোনও শব্দ হল না। তিনি সন্তু ও শৈবালের দিকে তাকিয়ে বললেন, জয় মা কালী বলে খুলে ফেলা যাক, কী বলল? টাইম বোমার অনেক দাম, আমাকে মারবার জন্য কেউ অত টাকা খরচ করবে না।

সুতোর বাঁধন টেনে ছিঁড়ে ফেললেন তিনি, তারপর বাক্সটার মুখ খুলে দেখলেন, ভেতরে অনেকটা তুলল। খুশি মনে কাকাবাবু বললেন, মনে হচ্ছে। কেউ একটা ঘড়ি বা দামি কাচের জিনিস পাঠিয়েছে।

তুলোটা তুলতে গিয়ে কাকাবাবু থেমে গেলেন। মুখের হাসিটা মুছে গেল, কুঁচকে গেল ভুরু। বাক্সটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, না রে, কোনও দামি জিনিস আমার ভাগ্যে নেই। যে পাঠিয়েছে, সে একটা ব্যাপার জানে না। আমার পা খোঁড়া কিন্তু আমার ঘ্রাণশক্তি সাঙ্ঘাতিক, অন্য অনেকের চেয়ে আমি চোখে বেশি দেখতে পাই, কানে বেশি শুনতে পাই। এমনকী, কেউ আমার সামনে মিথ্যে বললেও সেটা আমি ধরে ফেলতে পারি। এই বাক্সটায় আমি কোনও জ্যান্ত প্রাণীর গন্ধ পাচ্ছি।

সঙ্গে-সঙ্গে শৈবাল আর সন্তু খানিকটা ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল।

কাকাবাবু বললেন, সন্তু, চট করে রান্না ঘরে গিয়ে বউদির কাছ থেকে একটা সাঁড়াশি চেয়ে আন তো?

সন্তু দৌড়ে বেরিয়ে গেল।

শৈবাল বললেন, জ্যান্ত প্রাণী মানে…সাপ?

খুব সম্ভবত। যেমনভাবে প্যাক করা হয়েছে, অন্য কোনও প্রাণী বাঁচবে না।

কী ডেঞ্জারাস ব্যাপার! যদি হঠাৎ বেরিয়ে আসে?

সাধারণত সাপ তেড়ে এসে কাউকে কামড়ায় না। তবে তুলোর মধ্যে আমি হাত ঢোকালে বিপদের সম্ভাবনা ছিল।

শুধু সাঁড়াশি নয়, সন্তু একটা লাঠিও নিয়ে এসেছে।

কাকাবাবু সাঁড়াশি দিয়ে বাক্সটা চেপে ধরে, এক বগলে ক্রাচ নিয়ে চলে এলেন বারান্দায়। বাক্সটা মেঝেতে উলটে দিয়ে কয়েকবার ইকে-টুকে তুলে নিলেন।

তুলোর মধ্যে সত্যিই একটা কুণ্ডলি-পাকানো সাপ। সেটা বেঁচে আছে। ঠিকই, কিন্তু মানুষ দেখেও মাথা তুলল না, ফোঁস করল না, কয়েকবার চিড়িক-চিড়িক করে জিভ বার করল শুধু।

সন্তু দমাদম লাঠির বাড়ি মারতে লাগল সেটার ওপরে। কাকাবাবু হাত তুলে বাধা দিতে গিয়েও বললেন, এটা তো আগেই প্রায় আধমরা হয়ে আছে, মেরে ফেলাই ভাল।

রান্নাঘর থেকে আঁচলে হাত মুছতে-মুছতে ছুটে এসে সন্তুর মা বললেন, কী। সাঙ্ঘাতিক কথা! একটা জ্যান্ত সাপ পাঠিয়েছে? যদি সন্তু আগেই এটা খুলে ফেলত?

কাকাবাবু বললেন, যে পাঠিয়েছে, সে আমাদের ঠিক মারবার জন্য পাঠায়নি, ভয় দেখাবার জন্য পাঠিয়েছে। একেই তো সাপটা নির্জীব, তাতে ওর বিষ আছে কি না সন্দেহ!

মা চোখ কপালে তুলে বলবেন, সাপকে কখনও বিশ্বাস আছে? এইটুকু পুঁচকে সারেও দারুণ বিষ থাকে। কে এমন সাম্প্রতিক জিনিস পাঠাল?

কাকাবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সেইটাই তো কথা বউদি! সে কি আর নিজের পরিচয় জানাবে? বাজে একটা নাম লিখে দিয়েছে। কিন্তু সে তো একটা পাঠিয়েই থামবে না, আবার কিছু পাঠাবে! তার পেছনে আমাকে দৌড়তে হবে, তাকে ধরতে হবে, শাস্তি দিতে হবে। একের পর এক ঝামেলা।

মা বললেন, রাজা, তুমি চোর-ডাকাতদের পেছনে ছোটা ছেড়ে দাও এবার।

কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, তুমি ঠিক বলেছ বউদি! এসব এবার ছেড়ে দেব ভাবছি। কিন্তু আমি ছাড়তে চাইলেও যে ওরা ছাড়তে চায় না।

মা বললেন, কেউ এলে তুমি আর দেখা কোরো না। শুধু-শুধু শত্রু বাড়িয়ে চলেছ! এরপর হঠাৎ যে কোনদিন কী হয়ে যাবে..

সন্তু মরা সাপটাকে লাঠির ডগায় তুলে বলল, এবার এটাকে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। নইলে আবার বেঁচে উঠতে পারে।

শৈবাল বললেন, রাস্তায় ফেলে দাও বরং, গাড়ির চাকার তলায় একেবারে চেপ্টে যাবে।

মা বললেন, কী অলক্ষুণে ব্যাপার! বাক্সতে ভরে যে সাপ পাঠায়, সে কতখানি অমানুষ!

কাকাবাবু বললেন, বউদি, আমাদের দুকাপ কফি পাঠিয়ে দাও, শৈবালের সঙ্গে আমার একটা জরুরি কথা আছে। সন্তু, তুই পড়তে বোস গিয়ে।

সন্তু বলল, আমি টেলিগ্রামটা পাঠিয়ে দিয়ে আসছি!

কাকাবাবু আবার শৈবালকে নিয়ে ঘরে এসে বসলেন। শৈবাল আবার ফস করে জ্বাললেন একটা সিগারেট। তারপর এক হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললেন, আপনার এখানে এরকম প্রায়ই হয় বুঝি? বাক্সটা খুলেই যদি হাত ঢুকিয়ে দিতেন?

কাকাবাবু হাল্কাভাবে বললেন, চামড় লাইফ কাকে বলে জানো নিশ্চয়ই? আমার হচ্ছে সেইরকম, মৃত্যু সব সময় আমার কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়! যাকগে, আজকে এমন কিছু হয়নি। শোনো শৈবাল, তুমি কিন্তু আজ ঘন-ঘন সিগারেট খাচ্ছ?

শৈবাল লজ্জা পেয়ে বললেন, ওহ, আই অ্যাম সরি। কাকাবাবু, ফেলে দিচ্ছি!

শোনো, ওটা ধরিয়েছ যখন, শেষ করতে পারো। ব্যাপার কী জানো, আমি তো চুরুট খেতাম, এখন ছেড়ে দিয়েছি বটে, কিন্তু এখনও তামাকের ধোঁয়া নাকে এলে মনটা চনমন করে।

ঠিক আছে, আপনার সামনে আর কোনওদিন খাব না।

একটা কথা জিজ্ঞেস করব, শৈবাল? আজ তোমাকে একটু যেন নাভাস মনে হচ্ছে, সিগারেট ধরাবার সময় তোমার হাতটা একটু-একটু কাঁপছিল!

একটা ব্যাপার নিয়ে বেশ চিন্তিতই আছি, কাকাবাবু! আপনাকে সেটা বলতেই এসেছিলাম, কিন্তু অন্য লোকজন ছিল, তারপর এই ব্যাপারটা হল?

এবার বলো।

কফি এসে গেল, কফির কাপে প্রথমে দুজনে চুমুক দিলেন। তারপর শৈবাল আস্তে-আস্তে কেনঝড়ে দেবলীনার মাঝরাতে ঘুম ভেঙে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সব ঘটনাটা খুলে বললেন।

মন দিয়ে শুনলেন কাকাবাবু। একেবারে শেষের দিকে তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি গোঁফে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেড়ানোর ঘটনাটা খুব আশ্চর্যের কিছু নয়। এরকম আগে শুনেছি। কিন্তু আমি আশ্চর্য হচ্ছি, তোমার বর্ণনার একটা অংশ শুনে। তুমি যখন দেবলীনাকে টিলার উপর দেখতে পেলে, তখনই ঝড় উঠেছিল?

হ্যাঁ, খুব ঝড় উঠেছিল?

তোমার ঠিক মনে আছে? আগেই একটু-একটু ঝড় হচ্ছিল সেই সময় বাড়ল, না হঠাৎ ঝড় শুরু হয়ে গেল?

আচমকা ঝড় উঠে গেল।

তুমিও তো মাঝরাতে ঘুম ভেঙে বেরিয়ে পড়েছিলে, তাতে অনেক সময় মাথাটা ঠিক কাজ করে না। তোমারও ভুল হতে পারে। পরদিন সকালে তুমি ঝড়ের চিহ্ন কিছু দেখেছিলে?

সেটা ঠিক খেয়াল করিনি। পরের দিনই ফিরে আসার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলুম। কাকাবাবু, আপনি বলছেন, স্লিপ-ওয়াকিং আশ্চর্য কিছু নয়। আমিও তা জানি। কিন্তু দেবলীনাকে যখন ডালুম, ও আমাকে চিনতে পারল

কেন? যেন ভয় পেয়ে আমার হাত ছেড়ে ছুটে পালিয়ে গেল!

সেইসময় বোধহয় কোনও স্বপ্ন দেখছিল দেবলীনা। তুমি ওকে কোথায় খুঁজে পেলে?

ওর নিজের বিছানায়। আমি তো আগে সেই জঙ্গলের খানিকটা তন্ন-তন্ন করে খুঁজলুম। কোথাও ওকে না পেয়ে আমার তো পাগলের মতন অবস্থা। তখন ভাবলুম, বাড়ি ফিরে টর্চ আর রিভলভার নিয়ে আসি। ও দুটো নিয়ে নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর একবার ভাবলুম, ওর বন্ধু শর্মিলাকে ডাকি। সে ঘরে উঁকি মেরে দেখি, দুটি মেয়ে পাশাপাশি ঘুমোচ্ছে। আমি কাছে গিয়ে দেবলীনাকে ভাল করে দেখলুম। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ও যে উঠে বাইরে অতদূরে গিয়েছিল, তা যেন বিশ্বাসই করা যায় না।

তোমার নিজের চোখের ভুল হয়নি তো? তুমিই যদি স্লিপ-ওয়াকার হও? তুমিই স্বপ্নের মধ্যে হাঁটতে-হাঁটতে বাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে চলে গিয়েছিলে, দেবলীনা মোটে যায়ইনি!

না, কাকাবাবু, ব্যাপারটা অত সোজা নয়। খুকিও খালি পায়ে গিয়েছিল, আমি ঘুমন্ত খুকির পায়ে হাত দিয়ে দেখলুম, পায়ের তলা ভিজে-ভিজে, বেশ ধুলোবালিও লেগে আছে। ও বাইরে গিয়েছিল ঠিকই, আমি ভুল দেখিনি। পরদিন সকালে ওকে যেই জিজ্ঞেস করলুম, খুকি, তুই কাল রাত্তিরে বাইরে গিয়েছিলি? ও অবাক হয়ে বলল, কই, না তো? ওর মুখ দেখেই বুঝলুম, ওর কিছুই মনে নেই। আমি আর জেরা করলুম না।

দিনেরবেলা সেই জায়গাটা আবার গিয়ে দেখেছিলে?

না, আর দেখা হয়নি। সকাল দশটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়লুম।

তুমি যে বললে, দেবলীনার এখন শরীর খারাপ, ওর ঠিক কী হয়েছে?

সেরকম কিছু নয়। প্রায়ই খুব মনমরা হয়ে থাকে। একা-একা কী যেন ভাবে। জিজ্ঞেস করলে কিছু বলতে পারে না। আর-একটা অদ্ভুত ব্যাপার কী জানেন, ওকে আমি কোনওদিন গান গাইতে শুনিনি আগে। ওর গানের গলা নেই, আর একটু যখন ছোট ছিল, তখন কিছুদিন নাচ শিখেছিল। কিন্তু সেই রাতে ও জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ একটা গান গাইতে শুরু করেছিল। এখনও মাঝে-মাঝে সেই গানটা গায়।

কী গান সেটা?

কাকাবাবু, আমারও গানের গলা নেই, আমি গেয়ে শোনাতে পারব না। তবে অচেনা গান। এই কদিনেই বেশ রোগা হয়ে গেছে মেয়েটা। ডাক্তার দেখিয়েছি, আমার বন্ধু ডাক্তার, সে বলল, কিছু হয়নি। কথায় কথায় ওষুধ খাওয়াবার দরকার নেই।

তুমি গাড়ি এনেছ তো শৈবাল? চলো, তোমাদের বাড়িতে একটু ঘুরে আসি, দেবলীনার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে করছে।

এতক্ষণ বাদে শৈবালের মুখে খুশির ঝলক দেখা গেল। উচ্ছ্বসিতভাবে তিনি বললেন, ঠিক এইটাই আমি চাইছিলুম, কাকাবাবু। আপনি খুকির সঙ্গে কথা বললে অনেক কিছু বুঝতে পারবেন। আপনি ব্যস্ত মানুষ..

চলো চলল, বেরিয়ে পড়া যাক!

শৈবালের গাড়িটা পুরনো মরিস। ছোট গাড়ি, কিন্তু চলে দারুণ। বেলা এখন এগারোটা, আকাশে ঘন মেঘ। কয়েকদিন ধরেই মেঘ জমছে, কিন্তু বৃষ্টির দেখা নেই।

বাড়ির সামনে রাস্তার ঠিক উলটো দিকে দাঁড়িয়ে দুটো লোক গল্প করছে। আপন মনে। তাদের দিকে ইঙ্গিত করে কাকাবাবু বললেন, ওই যে লোক দুটিকে দেখছ শৈবাল, ওরা নিরীহ লোক হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে যে, ওরা আমাদের বাড়ির ওপর নজর রাখছে।

শৈবাল সেদিকে তাকিয়ে বললেন, দুটো লোকই বেশ গাট্টাগোট্টা জোয়ান। পুলিশের লোক বলে মনে হয়!

কাকাবাবু বললেন, পুলিশ আর গুণ্ডাদের চেহারায় খুব মিল থাকে। লোক দুটো একবারও মুখ তুলে এদিকে তাকাচ্ছে না, তাতেই সন্দেহ হচ্ছে। ওরা জেনে গেল যে সাপের কামড়ে আমি মরিনি। এবারে আর-একটা কিছু মতলব ভাঁজবে?

শৈবাল গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। তারপর জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখে নিয়ে বললেন, লোক দুটি সত্যিই কিন্তু এখন এই গাড়িটার দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে!

কাকাবাবু বললেন, ওরা অন্য গাড়িতে ফলো করে কি না, সেটা একটু লক্ষ রাখো। তোমার বাড়িটা চিনে না যায়। ওরা তোমার বাড়িতে গিয়ে হামলা করুক, আমি তা চাই না।

গাড়িটা হুশ করে খানিকটা ছুটেই ডান দিকে বেঁকল। তারপর নিউ আলিপুর ঘুরে, টালিগঞ্জের মোড় দিয়ে এসে আনোয়ার শা রোডে ঢুকল। এর মধ্যে কেউ কোনও কথা বলেননি।

শৈবাল এবার বললেন, আমি যেভাবে চালিয়েছি, কোনও গাড়ি আমার পেছন-পেছন আসতে পারবে না।

কাকাবাবু বললেন, এক-এক সময় কী হয় জানো তো? দুটো শত্রুপক্ষের লোক আমার ওপর নজর রাখে, তখন একজন অন্য জনকে সন্দেহ করে কিংবা পুলিশ ভেবে ভয়ও পেয়ে যায়। তখন বেশ মজার ব্যাপার হয়!

আপনি বলছেন মজার ব্যাপার? বাপরে বাপ, আমার যদি এরকম হত, সব সময় শত্রুপক্ষ নজর রাখছে জানতে পারলে তো আমি নাজেহাল হয়ে যেতাম! আপনি এত ধীরস্থির, হাসিখুশি থাকেন কী করে?

কী জানি, বোধহয় অভ্যাস হয়ে গেছে। আচ্ছা শৈবাল, তোমরা কেওনঝড়ের ঠিক কোথায় ছিলে? ওই নামে তো একটা শহরও আছে, তাই না?

হ্যাঁ, ছোট শহর। আপনি কখনও যাননি কেওনঝড়ে?

গিয়েছিলুম, অনেক আগে, প্রায় আঠারো কুড়ি বছর আগে। ভাল মনে নেই।

আমরা ছিলুম কেনঝড়ে শস্ত্র থেকে বেশ কয়েকমাইল দূরে। সেখানে লোকজন বিশেষ থাকে না, জঙ্গল-জঙ্গল জায়গা। ওদিকে গোনাসিকা নামে একটা পাহাড় আছে। আপনি বৈতরণী নদীর নাম শুনেছেন তো? লোকে বলে, বৈতরণী নদীর জন্ম ওই পাহাড় থেকে। আমি অবশ্য পাহাড়ের ওপরে উঠিনি। নদীর উৎসের জায়গাটা নাকি ঠিক একটা গোরুর নাকের মতন দেখতে?

বৈতরণী মানে স্বর্গে যাবার নদী। ভারতবর্ষের অনেক জায়গাতেই এই নামের নদী আছে। অবশ্য যে-কোনও সুন্দর জায়গাই তো স্বর্গ হতে পারে। তাই না?

গাড়িটা এসে থামল শৈবাল দত্তের বাড়ির সামনে। মাত্র বছর দুয়েক আগে তৈরি নতুন বাড়ি। বাড়ির প্রধান দরজার পাশে একটা চৌকো সাদা পাথরে বাড়ির নাম লেখা বৈতরণী।

কাকাবাবু অবাক হয়ে বললেন, একি, তোমার বাড়ির নাম বৈতরণী নাকি? আগে তো দেখিনি। অবশ্য তোমার বাড়িতে আমি মোটে একবারই এসেছি। সেসময় আবার লোডশেডিং ছিল। (লেখকের কলকাতার জঙ্গলে বইতে এই প্রসঙ্গ আছে।)

শৈবাল লাজুকভাবে বললেন, না, আগে আমার বাড়ির কোনও নামই ছিল না। এবার ফিরে এসে, কেন জানি না, ওই নামটা খুব পছন্দ হল। তাই নামটা বসিয়ে দিলুম। একটু আগে আপনি তো বললেন যে, যে-কোনও সুন্দর জায়গাই স্বর্গের মতন মনে হতে পারে। নিজের বাড়ির চেয়ে আর সুন্দর জায়গা কী হতে পারে, বলুন? সেই ছেলেবেলায় একটা কবিতা পড়েছিলুম। চড়ুইপাখি আর বাবুইপাখির ঝগড়া? চড়ইপাখি মানুষের বাড়ির এক কোণে বাসা বেঁধে থাকে, ঝড়-জলে কষ্ট পেতে হয় না। আর বাবুইপাখির নিজের তৈরি বাসা তালগাছ-টালগাছে ঝোলে, খুব বেশি ঝড়বৃষ্টি হলে খসে পড়ে যায়। সেইজন্যেই ওই কবিতাটিতে চড়ুইপাখি বলছে, আমি থাকি মহা সুখে অট্টালিকা পরে। আর বাবুইপাখি বলছে, নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা। আপনি পড়েননি?

হ্যাঁ, পড়েছি বটে।

আমার বাড়িটাও বাবুইয়ের বাসা বলতে পারেন। একেবারে নিজ হাতে গড়া। এবাড়ির নকশা, ব্লু-প্রিন্ট থেকে শুরু করে মিস্তিরি খাটিয়ে একটার পর একটা ইট গাঁথা, সবই আমি নিজে করেছি। কিন্তু বাড়িটা শেষ হবার আগেই দেবলীনার মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। দেবলীনাও এবাড়িটা তেমন পছন্দ করে না। এখন ভাবছি, কী করি এই বাড়িটা নিয়ে!

সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে শৈবাল চেঁচিয়ে ডাকলেন, খুকি, খুকি, নীচে নেমে আয়। দ্যাখ, কে এসেছেন!

দুতিনবার ডেকেও কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন একজন বয়স্কা বিধবা মহিলা।

শৈবাল ব্যস্তভাবে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, পিসিমা, খুকি কোথায়? বেরিয়ে গেছে নাকি?

পিসিমা বললেন, কই, না তো! আমাকে তো কিছু বলে যায়নি!

শৈবাল ভুরু কুঁচকে বললেন, তা হলে সাড়া দিচ্ছে না কেন? সদর-দরজাটা একেবারে হাট করে খোলা। রঘুটাই বা কোথায় গেল?

পিসিমা বলেন, এই মাত্র আমি রঘুকে একটু বাজারে পাঠালুম। এতক্ষণ দরজা বন্ধই ছিল।

কাকাবাবু বললেন, তুমি এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন, শৈবাল? দ্যাখো, দেবলীনা হয়তো বাথরুমে গেছে, কিংবা ঘুমিয়ে পড়েছে, তোমার ডাক শুনতে পায়নি।

শৈবাল বললেন, আপনি বসুন, কাকাবাবু, আমি ওপরে গিয়ে দেখছি! মেয়েটার ধরনধারণ দেখে আমার সত্যি চিন্তা হয়!

দুতিনটে সিঁড়ি লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে গেলেন শৈবাল। বারবার ডাকতে লাগলেন, খুকি, খুকি।

কাকাবাবু এগিয়ে গিয়ে বসবার ঘরের ভেজানো দরজাটা ঠেলে খুলে ফেললেন। সেখানে তিনি দেখতে পেলেন দেবলীনাকে। সে একটা খোলা জানলার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাইরে। লাল রঙের ফ্রক পরা, তার সারা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

কাকাবাবু নরম করে ডাকলেন,দেবলীনা!

দেবলীনা চমকে মুখ ফেরাল। কয়েক মুহূর্ত সে যেন চিনতে পারল না। কাকাবাবুকে।

কাকাবাবু আবার বললেন, কেমন আছিস রে, দেবলীনা?

দেবলীনা চোখ দুটো বিস্ফারিত করে বলল, কাকাবাবু? আমাকে ও ডাকছে, আমাকে ও ডাকছে! ওই যে, ওই যে…