০২. দাঁতটার কথা

কলকাতায় কিন্তু কাকাবাবু ঐ দাঁতটার কথা কিছুই বলেননি সন্তুকে। সন্তুও জানতই না যে, কাকাবাবু এবার বিলেত থেকে ঐ দাঁতটা নিয়ে এসেছেন। বিলেত থেকে সবাই কত ভাল-ভাল জিনিস আনে, আর কাকাবাবু এনেছেন একটা মরা মানুষের দাঁত!

আন্দামান অভিযানের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার পর পৃথিবীর নানান জায়গা থেকে এখন কাকাবাবুর ডাক আসে। জেনিভায় এক অ্যানথ্রাপলজিক্যাল কনফারেন্সে কাকাবাবু বক্তৃতা দিয়ে এলেন মাস ছয়েক আগে। তারপরই গিয়েছিলেন বিলেতে। তারপর কিছুদিন কাকাবাবু বইপত্রের মধ্যে ড়ুবে রইলেন একেবারে। তখনই সন্তুর মনে হয়েছিল, কাকাবাবু বোধহয় আবার নতুন কোনও রহস্যের সন্ধান পেয়েছেন।

একদিন হঠাৎ তিনি সন্তুকে ডেকে বলেছিলেন, কী রে, এভারেস্টে যাবি? আমি যাচ্ছি, যদি সঙ্গে যেতে চাস—

শুনেই সন্তুর বুকটা ধক করে উঠেছিল। এভারেস্ট!

প্ৰথমে সন্তু যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনি। এভারেস্টে যাওয়া কি যেমন-তেমন কথা?

সন্তু জিজ্ঞেস করেছিল, কাকাবাবু, তুমি, মানে ইয়ে, মানে তুমি সত্যিই এভারেস্টে যাচ্ছ?

একজন খোঁড়া মানুষ, যিনি ক্রাচে ভর না দিয়ে চলতে পারেন না, তাঁর মুখে এভারেস্ট যাওয়ার কথা শুনলে কি সহজে বিশ্বাস করা যায়? অথচ কাকাবাবু আজে-বাজে কথাও বলবেন না ঠিকই। তখন সন্তু ভেবেছিল, কাকাবাবু তাহলে এভারেস্টের চুড়ায় ওঠার কোনও অভিযাত্রী দলের সঙ্গে যাচ্ছেন নিশ্চয়ই। সন্তু তো। তবে যাবেই কাকাবাবুর সঙ্গে, এই সুযোগ কি সে ছাড়তে পারে?

নিউজিল্যান্ডের হিলারি। আর আমাদের দাৰ্জিলিংয়ের তেনজিং-এই দুজনই মানুষজাতির মধ্যে প্রথম পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু জায়গা এভারেস্টের চুড়ায় পা দেন। তারপর আমেরিকান, ফরাসি, জাপানি আরও কত জাতির লোক এভারেস্টে উঠেছেন। এমন-কী, আমাদের ভারতীয়দের মধ্যেও এক জন না দুজন উঠেছেন, কিন্তু কোনও বাঙালি তো এখনও সেখানে যেতে পারেনি! সন্তু উঠতে পারলে সারা পৃথিবীতে তার নাম ছড়িয়ে পড়বে। পৃথিবীর কোনও জাতেরই পনেরো বছরের কোনও ছেলে এভারেস্টে উঠতে পারেনি। আর কাকাবাবু যদি জেদ ধরেন, তা হলে তিনি উঠবেনই, সন্তুর এ-বিশ্বাস আছে। তা হলে কাকাবাবুও এক হিসেবে বিশ্বে প্রথম হবেন। কারণ, এক পা খোঁড়া, ক্রাচ বগলে নিয়ে এভারেস্টে চড়ার কথা কেউ আগে কল্পনা করারও সাহস পায়নি।

সন্তু অতি উৎসাহের সঙ্গে রাজি হয়েছিল তো বটেই, তার ওপর এভারেস্ট সম্পর্কে তার জ্ঞান দেখাবার জন্য বলেছিল, কাকাবাবু, এভারেস্ট তো আবিষ্কার করেছিলেন একজন বাঙালি, তাই না? সাহেবরা তাঁর নামটা দেয়নি–

কাকাবাবু একটু হেসে বলেছিলেন, এভারেস্ট আবার কেউ আবিষ্কার করবে কী? এটা কি একটা নতুন জিনিস? তবে, এটাই যে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পাহাড়-চুড়া, সেটা ঠিক করার ব্যাপারে একজন বাঙালির খানিকটা হাত ছিল বটে!

সন্তু বলেছিল, আমি তো সেই কথাই বলছি। তাঁর নাম রাধানাথ শিকদার। ঐ চুড়াটার নাম এভারেস্ট না হয়ে রাধানাথ হতে পারত।

কাকাবাবু বলেছিলেন, রাধানাথ শিকদার সার্ভে অফিসে কাজ করতেন। হিমালয়ের অনেক শৃঙ্গের তখন কোনও নামই ছিল না। মিঃ এভারেস্ট ছিলেন ঐ সার্ভে অফিসের বড় সাহেব। তাঁর নামেই ঐ শৃঙ্গের নাম রাখা হয়েছে।

সন্তু জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা কাকাবাবু, ঐ রাধানাথ শিকদার তো আর এভারেস্টের চুড়ায় ওঠেননি, তা হলে তিনি কী করে বুঝলেন যে ঐটাই সবচেয়ে বেশি উঁচু?

কাকাবাবু বলেছিলেন, পাহাড়ে না উঠেও পাহাড় মাপা যায়। ছোটখাটো পাহাড় মাপে সেগুলোর ছায়া দেখে। তা ছাড়াও যন্ত্রপাতির সাহায্য নিয়ে অনেক অঙ্ক কষতে হয়। রাধানাথ শিকদার অবশ্য এক সময় দেরাদুনে থাকতেন, তখন পাহাড়ে-পাহাড়ে ঘুরেছেন। কিন্তু তুই যাকে আবিষ্কার বললি, সেটা হয়েছিল এই কলকাতায়। অঙ্ক কষতে-কাষতে তিনি হঠাৎ একদিন দেখলেন যে, এই যে একটা নাম-না-জানা পাহাড়, তখন কাগজপত্রে এটার নাম ছিল পীক নাম্বার ফিফটিন, এটারই উচ্চতা উনত্রিশ হাজার ফুটের বেশি, এত উঁচু পাহাড় আর পৃথিবীতে নেই। তখনই তিনি ছুটে গিয়ে তাঁর নতুন বড় সাহেবকে খবর দিলেন। এভারেস্ট সাহেব অবশ্য তখন রিটায়ার করেছেন, তবু তাঁর নামেই শিখরটির নাম রাখা হল।

সেদিন এভারেস্ট সম্পর্কে আরও অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল। তারপর কদিন কাকাবাবু একেবারে চুপচাপ। যেন ব্যাপারটা তিনি ভুলেই গেছেন। হঠাৎ একদিন কাকাবাবু চলে গেলেন দাৰ্জিলিঙ। সন্তুকে সঙ্গে নিয়ে যাবার কথা কিছুই বললেন না। সেখান থেকে ফিরে গভর্নমেন্টের নেমন্তন্ন পেয়ে আবার চলে গেলেন জার্মানি। দেড়মাস বাদে যেদিন তিনি কলকাতায় ফিরলেন, তার পরদিনই সন্তুদের বাড়িতে এলেন তেনজিং। কী করে যেন কথাটা জানাজানি হয়ে গেল, সন্তুদের বাড়ির সামনে সেদিন সাঙ্ঘাতিক ভিড় জমে গিয়েছিল। তেনজিংকে একটু দেখবার জন্য, তাঁর সই নেবার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেল।

তেনজিংয়ের সঙ্গে কাকাবাবু নিজের ঘরে বসে কথা বললেন অনেকক্ষণ। তখন ঘরে আর কেউ ছিল না। সন্তু ঘুরঘুর করছিল কাকাবাবুর ঘরের কাছে, কিন্তু কোনও কথাই শুনতে পায়নি। তেনজিং বিদায় নেবার সময় বন্ধুর মতন কাকাবাবুর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বলেছিলেন, গুড লাক! আই উইশ ইউ সাকসেস, মিঃ রায়চৌধুরী! আপনি পারবেন, তখন সবাই বুঝে যাবে, আমার কথা ঠিক কি না! বয়েস হয়েছে, না হলে আপনার সঙ্গে আমিও যেতম।

ইস্কুলের বন্ধুদের কাছে সন্তু আগেই বলে ফেলেছিল যে, এবার সে কাকাবাবুর সঙ্গে এভারেস্ট অভিযানে যাবে। সবাই খুব হেসেছিল। বন্ধুদের এই একটা দোষ, কোনও কথাই ওরা আগে থেকে বিশ্বাস করে না। তেনজিং নোরিগে ওদের বাড়িতে আসবার পর সন্তু আবার বলেছিল, দেখলি তো? আমার কাকাবাবুর সঙ্গে কত লোকের চেনা। তেনজিং নিজে আমাদের সঙ্গে যেতে চেয়েছিলেন।

সন্তুদেরই ইস্কুলে পুজোর ছুটি শুরু যেদিন, সেদিনই কাকাবাবু বলেছিলেন, সন্তু, তৈরি হয়ে নাও, সামনের সোমবার আমরা বেরিয়ে পড়ছি।

সন্তুর ধারণা ছিল এভারেস্ট অভিযানে যেতে হলে বিরাট দলবল লাগে, অনেক জিনিসপত্র আর তাঁবু টাবু নিয়ে যেতে হয়। সেসব কিছুই নয়, কাকাবাবু শুধু সন্তুকে নিয়ে প্লেনে চেপে চলে এলেন নেপালে। কাঠমাণ্ডু শহরে ছদিন চুপচাপ সন্তু একটা হোটেলে বসে কাটাল। কাকাবাবু একাএক ঘোরাঘুরি করলেন নানা জায়গায়। সন্তু ভেবেছিল, কাকাবাবু নিশ্চয়ই নেপালে এসে দলবল জোগাড় করছেন।

তাও হল না। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই কাকাবাবু বললেন, বাক্স গুছিয়ে নে, এক ঘণ্টার মধ্যেই বেরুব।

কাকাবাবু এক-এক সময় খুব কম কথা বলেন। তখন তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করারও নিয়ম নেই। সন্তু চুপচাপ সব কথা শুনে যায় শুধু।

কাঠমাণ্ডুর হোটেল থেকে ট্যাক্সি নিয়ে এয়ারপোর্ট আসা হল। সন্তু ভাবল, আবার বুঝি কলকাতায় ফিরে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু এবার উঠল। ওরা একটা ছোট প্লেনে। মাত্র দশ-বারোজন যাত্রী। কিছুক্ষণ ওড়ার পরই সন্তু দেখতে পেল সব বরফের মুকুট পরা পাহাড়ের চুড়া।

প্লেনটা এসে নামল একটা খুব ছোট্ট জায়গায়। এরকম জায়গায় যে প্লেন নামতে পারে, তা বিশ্বাসই করা যায় না। জায়গাটার নাম সিয়াংবোচি। সেখান থেকে দুজন মাত্র মালবাহক সঙ্গে নিয়ে শুরু হল হাঁটা। সন্তুর তখনও সব ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য লাগছিল।

সন্তুর তখনও ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য লাগছিল। দুজন মাত্র লোক সঙ্গে নিয়ে এভারেস্টে ওঠা হবে? তাঁবু কোথায়? অন্য সব জিনিসপত্র কোথায়? পাহাড়ি রাস্তায় ক্ৰাচ বগলে নিয়ে কাকাবাবুকে হাঁটতে দেখে অন্যান্য যাত্রীরা অবাক হয়ে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। এরকম লোককে এত উঁচু পাহাড়ের রাস্তায় কেউ কোনওদিন দেখেনি। এ রাস্তায় অনেক বিদেশি দেখা যায়। সাহেব তো আছেই, কিছু কিছু মেমও কাঁধে ব্যাগ নিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘোরে। সিয়াংবোচিতে জাপানিরা একটা মস্ত বড় হোটেল বানিয়েছে।

কাকাবাবু কারুর দিকে ভুক্ষেপ করেন না। ক্রাচ। ঠকে ঠুকে ঠিক উঠে যান পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে। সন্তু হাঁপিয়ে যায়, কিন্তু কাকাবাবুর যেন দৈত্যের শরীর।

এইরকম একটি পাহাড়ি রাস্তায় এক দুর্ঘটনায় কাকাবাবুর একটা পা চিরকালের মতন পঙ্গু হয়ে গেছে। তবু পাহাড়কে ভয় পান না। কাকাবাবু।

ফুনটুংগা বলে একটা ছোট জায়গা পেরিয়ে এসে রাস্তার পাশে একটা বড় পাথরের ওপর বসে সন্তু আর কাকাবাবু কমললেবু, পাউরুটি আর ডিমসেদ্ধ খেয়ে নিচ্ছিল, এমন সময় কয়েকটি পাহাড়ি লোক ছুটতে-ভূটতে এসে বলে গেল, পালাও, পালাও, সাবধান, বুনো ভালুক বেরিয়েছে।

শুনেই সন্তু চমকে উঠেছিল। চারদিকে পাহাড় আর ফাঁকা রাস্তা, ওরা পালাবে কী করে? ফুনটুংগা ফিরে যেতে গেলে তো অনেক সময় লেগে যাবে। তাছাড়া কাকাবাবুতো পালাতেও পারবেন না।

কাকাবাবু, কিন্তু নিশ্চিন্তভাবে পাইপ ধরিয়ে বললেন, কমললেবুর খোসা রাস্তার ওপর ফেলেছিস কেন? সব খোসা এক জায়গায় সরিয়ে একটা কাগজের ঠোঙার মধ্যে রেখে দে। পাহাড় কখনও নোংরা করতে নেই।

রাস্তার এক পাশে জঙ্গল, এক পাশে খাদ, সেই খাদের নীচে দেখা যায় একটা রুপোর হারের মতন সরু নদী। সন্তু ভয়ে-ভয়ে জঙ্গলের দিকে তাকাল। সন্তুর মনে হল, হঠাৎ সেখান থেকে একটা ভালুক এক লাফে বেরিয়ে আসবে।

এর পরে দুজন সাহেবও ছুটতে ছুটতে নেমে এল ওপরের রাস্তা দিয়ে। তারাও কাকাবাবুকে দেখে ইংরেজিতে বলল, তোমরা এখানে বসে আছ কেন? নীচে নেমে যাও। এদিকে একটা বুনো ভালুক দেখা গেছে।

কাকাবাবু কোনও কথা বললেন না।

একটু বাদে আবার শোনা গেল অনেক মানুষের চিৎকার। সন্তু এবার ভাবল, নিশ্চয়ই ভালুকটা ওদের তাড়া করে আসছে।

লোকগুলো কাঁধে করে বয়ে আনছে। একজন আহত মানুষকে। তার গা থেকে তখনও রক্ত করেছিল। লোকটি সেই অবস্থাতেও জ্ঞান হারায়নি, আঁ আঁ আঁ শব্দ করছে।

কাকাবাবুকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হল না, সেই লোকগুলো নিজেরাই চিৎকার করে অনেক কথাই বলল, যাতে বোঝা গেল যে, বনের মধ্যে এই লোকটিকে ভালুক আক্রমণ করে ওর পেটের নাড়িষ্টুড়ি বার করে দিয়েছে। লোকটিকে ওরা নিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালে।

ওরা চলে যাবার পর সন্তু দেখল, রাস্তায় পড়ে আছে ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত। মানুষের রক্ত!

কাকাবাবু বললেন, পাহাড়ি ভালুকরা খুব হিংস্র হয়! এক হিসেবে বাঘ-সিংহের চেয়েও হিংস্র, এরা অকারণে মানুষ মারে।

সন্তু কী উত্তর দেবে? চোখের সামনেই তো সে দেখল যে, ভালুকে একটা লোকের পেট ফালাফালা করে দিয়েছে। হঠাৎ যদি ভালুকটা ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে? রিভলভার দিয়ে কি ভালুক মারা যায়? সন্তু সব শিকারের গল্পে পড়েছে যে, শিকারীদের হাতে থাকে রাইফেল।

গলা শুকিয়ে এসেছে, তবু সেই শুকনো গলাতেই সন্তু উত্তর দিয়েছিল, না।

কাকাবাবু বললেন, তুই এই পাথরটার আড়ালে গিয়ে বোস। আমাদের এই রাস্তা দিয়েই উঠতে হবে, বেশিক্ষণ তো সময় নষ্ট করলে চলবে না?

সন্তু এবার একটু সাহস করে বলল, কাকাবাবু, সবাই নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। আমরাও নীচের গ্রামটায় ফিরে গিয়ে আজকে থেকে গেলে পারি না? এমন-কী, সাহেবরাও নেমে যাচ্ছে।

কড়া গলায় বললেন, এমন-কী সাহেবরাও মানে? সাহেবরা কি আমাদের চেয়ে বেশি সাহসী নাকি?

সন্তু একটু থতমত খেয়ে বলল, না। মানে, ইয়ে—

কাকাবাবু একটুক্ষণ একদৃষ্টি চেয়ে রইলেন সন্তুর দিকে। তারপর আস্তে-আস্তে বললেন, কোথাও যাবার জন্য বেরিয়ে আমি কখনও পেছনে ফিরে যাই না। আমার সঙ্গে যেতে হলে এই কথাটা তোকে সব সময় মনে রাখতে হবে।

তারপর সন্তুকে দারুণভাবে চমকে দিয়ে কাকাবাবু রিভলভার উঁচিয়ে ডিসুম শব্দে গুলি করলেন।