০২. তেজপুর শহরের একটু বাইরে

তেজপুর শহরের একটু বাইরে, ছোট্ট একটা টিলার ওপর সুন্দর সাদা রঙের একটি দোতলা বাড়ি। সামনে গোলাপ ফুলের বাগান, কিন্তু পাঁচিল-টাচিল নেই। বারান্দায় বসলে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়।

বাগানেই বেতের টেবিল ও কয়েকখানা চেয়ার পেতে চায়ের ব্যবস্থা হয়েছে। সকালবেলায় রোদুর মিঠে লাগছে খুব। টেবিলের ওপর অনেক রকমের খাবার, মাশরুম দিয়ে ওমলেট, ফুলকপির শিঙাড়া, মাছের ডিমের চপ, কাজুবাদাম, কেক-পেস্ট্রি। চায়ের পেয়ালাগুলো ভারি সুন্দর।

এ-বাড়ির মালিকের নাম দেবেন্দ্র বড়ঠাকুর। চমৎকার চেহারা, ফরসা, লম্বা, টানা-টানা চোখ, ধারালো নাক, মাথাভর্তি কোঁকড়া কোঁকড়া কালো চুল। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। ইনি অসমের বন বিভাগের সবচেয়ে বড় কর্তা, যাকে বলে চিফ কনজারভেটার অব ফরেস্ট। চাকরির জন্য ওঁকে থাকতে হয় গুয়াহাটি শহরে, তেজপুরে তাঁর নিজের বাড়ি।

দেবেন্দ্র বড়ঠাকুর সন্তু আর জোজোকে বারবার বলতে লাগলেন, কই, তোমরা খাও, আরও নাও, লজ্জা পাচ্ছো নাকি?

জোজোর অবশ্য লজ্জা-টজ্জা নেই। সে সবগুলো পদই দুটো-একটা করে চেয়ে নিয়েছে, আবার নিল। সন্তু বেশি খেতে পারছে না।

কাকাবাবু চা ছাড়া কিছু খাননি। তাঁর সারা মুখে ব্যথা। মুখের চেহারাটাও বিচ্ছিরি হয়ে গেছে। মুখের বাঁ পাশটাতে কাটাকুটি দাগ, তার ওপর আবার মারকিউরিওক্রোম ওষুধ লাগানো। রাজ সিং বসে আছেন একধারে চুপ করে।

খাওয়াদাওয়ার পাট চুকলে দেবেন্দ্র বড়ঠাকুর কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, এইবার বলুন, মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনার হঠাৎ অসমের এই অঞ্চলটায় আসবার উদ্দেশ্য কী?

কাকাবাবু মুখে হাসি মাখিয়ে বললেন, সেরকম উদ্দেশ্য তো বিশেষ কিছু নেই। এমনই বেড়াতে এসেছি, জঙ্গলে-জঙ্গলে ঘুরব!

দেবেন্দ্র বড়ঠাকুর দুদিকে মাথা নেড়ে বললেন, উঁহুঃ! আপনি একথা বললেও তো বিশ্বাস করতে পারি না। আপনি কত রকম সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড করেছেন, তা কি আমরা জানি না? আপনাদের বাংলায় একটা কথা আছে না, চেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে?

কাকাবাবু বললেন, আজকাল ওকথার কেউ মানেই বোঝে না। তিনি সন্তুর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, সন্তু, তুই চেঁকি কাকে বলে জানিস?

সন্তু বলল, ছবি দেখেছি। একটা মস্ত বড় কাঠের জিনিস। গ্রামের মেয়েরা সেই চেঁকিতে পাড় দিয়ে ধান থেকে চাল বানাত।

বড়ঠাকুর বললেন, তা ঠিক, এখন আর চেঁকি দেখাই যায় না। মেশিনে সব হয়। আমাদের এখানে গ্রামের দিকে কিছু-কিছু চেঁকি এখনও আছে। চেঁকিছাঁটা চালের ভাতের অন্যরকম স্বাদ।

কাকাবাবু বললেন, ছবি দেখে চেঁকি চিনতে হয়। এর পর ছেলেমেয়েরা বাঘ-ভালুক-গণ্ডার এসবও ছবি দেখেই চিনবে। সব তো মেরে-মেরে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে।

বড়ঠাকুর আগের কথায় ফিরে গিয়ে কাকাবাবুকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, তেজপুরে কি কোনও উল্কা পড়েছে? কিংবা জঙ্গলের মধ্যে অন্য গ্রহের প্রাণী নেমেছে? নইলে আপনি হঠাৎ এদিকে এসেছেন, নিশ্চয়ই কোনও রহস্যের সন্ধানে!

কাকাবাবু বললেন, না, না, আমি জঙ্গল ভালবাসি, জঙ্গল দেখতে এসেছি। অসমের জঙ্গল অতি অপূর্ব।

বড়ঠাকুর বললেন, জঙ্গল দেখতে চান, সব ব্যবস্থা করে দেওয়া যাবে। কাজিরাঙা, মানস ফরেস্ট, ওরাং, এ ছাড়া আরও কত জঙ্গল ছড়িয়ে আছে। কিন্তু রায়চৌধুরী সাহেব, আপনি কাল একটা অন্যায় করেছেন!

কী অন্যায় করেছি?

এইসব সংরক্ষিত অরণ্যে আমরা রাত্তিরে কাউকে যেতে দিই না। জঙ্গল দেখতে হয় খুব ভোরবেলা। হাতির পিঠে চেপে ঘুরবেন, খুব ভাল দেখা যাবে। কিন্তু আপনি রাত্তিরবেলা গিয়েছিলেন, তারপর জিপ থেকে নেমে পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন, এটা অন্যায়, খুব অন্যায়। সেজন্য আমি আমার ডি এফ ও রাজ সিংকে বকুনি দিয়েছি। যদি কোনও জন্তু-জানোয়ার হঠাৎ আপনাকে আক্রমণ করত, তা হলে বদনামের ভাগি হতে হত আমাদের। আপনি বিখ্যাত লোক

বড়ঠাকুরমশাই, আমায় তো কোনও জানোয়ার আক্রমণ করেনি। আমায় যারা মারতে গিয়েছিল, তারা মানুষ। তাদের হাতে বন্দুক আছে।

মানুষ?

মানুষ ছাড়া কে আর বন্দুকের গুলি চালাবে?

ব্যাপারটা ঠিক কী হয়েছিল, আর-এক বার খুলে বলুন তো?

আমরা কাল মিহিমুখ থেকে জিপ নিয়ে বেরিয়েছিলাম। হারমোতিতে রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার, সেখানে তো অনেক লোকই যায়। আমরা আরও গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেলাম। সোহোলা ছাড়িয়ে তিন-চার কিলোমিটার দূরে একটা ঝিল, সেখানে নিরিবিলিতে কিছুক্ষণ কাটাতে চেয়েছিলাম।

বেশ তো, কিন্তু আপনি জিপ থেকে নামতে গেলেন কেন?

বন্যপ্রাণীরা যখন জলপান করতে আসে, সেই দৃশ্যটা ভারী সুন্দর। দল বেঁধে গেলে সেটা দেখা যায় না। তাই আমি একলা চুপিচুপি গিয়ে জলের ধারে বসে ছিলাম। হঠাৎ কে যেন আমার দিকে গুলি চালিয়ে দিল। টিপ ভাল নয়, আমার গায়ে লাগাতে পারেনি। শব্দ শুনেই আমি ঝপ করে শুয়ে পড়েছিলাম মাটিতে, গোলাগুলি চললে সেটাই নিয়ম। কিন্তু মুশকিল হল কী, যেখানে আমি পড়লাম, সেখানে ছিল কাঁটাগাছের ঝোপ, তাও কাঁটাগুলো আবার বিষাক্ত। আমার গালফাল তো কেটে গেলই, জ্বালাও করতে লাগল দারুণ। সামলে নিতে আমার কিছুটা সময় লাগল, তাই পালটা গুলি যখন ছুঁড়তে গেলাম, তখন আততায়ী অনেকটা দূরে পালিয়ে গেছে।

হঠাৎ কে আপনাকে মারবার চেষ্টা করবে?

সেটাই তো বড় প্রশ্ন। আপনারা রাত্তিরবেলা ভ্রমণকারীদের জঙ্গলে যেতে দেন না। নিজেরাও যান না। সেই সুযোগে চোর ডাকাত চোরাচালানদার পোচাররা যা খুশি করে বেড়ায়!

মিঃ রায়চৌধুরী, আমরা যথাসাধ্য জঙ্গল পাহারা দিই, তা সত্ত্বেও কিছু দুষ্ট লোক, কিছু গাছ-চোর, কিছু পোচার ঢুকে পড়ে ঠিকই, সব আটকানো যায় না স্বীকার করছি। আচ্ছা পোচার কথাটাকে আপনাদের বাংলায় কী বলে?

কাকাবাবু একটু চিন্তা করে কিছু খুঁজে পেলেন না। সন্তু আর জোজোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, পোচারের বাংলা কী হবে?

জোজো বলল, যারা লুকিয়ে লুকিয়ে বেআইনি ভাবে জন্তু-জানোয়ার শিকার করে, বাইরে বিক্রি করে।

কাকাবাবু বললেন, এককথায় বলতে হবে।

জোজো বলল, বেআইনি পশু-হত্যাকারী।

সন্তু বলল, চোরাশিকারি হতে পারে না?

বড়ঠাকুর বললেন, চোরাশিকারি, হ্যাঁ, এটাই শুনতে ভাল, চোরাশিকারি! হ্যাঁ। মিস্টার রায়চৌধুরী, যা বলছিলাম! এই গাছ-চোর কিংবা চোরাশিকারি তো কখনও মানুষ মারে না! সেরকম কোনও দৃষ্টান্ত নেই। কখনও ফরেস্ট গার্ডদের সামনাসামনি পড়ে গেলেও এরা পালাবার চেষ্টা করে। আপনাকে দেখামাত্র এরা গুলি চালাবে কেন? অন্ধকারে লুকিয়ে পড়তে পারত!

কাকাবাবু বললেন, আমার কোনও পুরনো শত্রু ঠিক সেই সময় জঙ্গলের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে ছিল, একথা তো বিশ্বাস করা যায় না! একজন কেউ গুলি করে আমাকে মারতে চেয়েছিল ঠিকই।

বড়ঠাকুর বললেন, ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। বেশ রহস্যজনক লাগছে।

রাজ সিং এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এবার বললেন, আচ্ছা রায়চৌধুরীবাবু, সোহোলার ওদিকটায় যে একটা ঝিল আছে, সেটার কথা কি আপনি আগে থেকেই জানতেন? প্রথম থেকেই জিপটা ওদিকে নিয়ে যেতে বললেন, এই জঙ্গলে আগে খুব ঘুরেছেন বুঝি?

কাকাবাবু বললেন, না, এখানে আগে আসিনি। কিন্তু কোনও নতুন জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে আমি সেই জায়গাটা সম্পর্কে পড়াশোনা করি, খোঁজখবর নিই। আমার কাছে খুব বড় একটা ম্যাপের বই আছে, তাতে এ-দেশের সব জঙ্গলের ম্যাপ আছে, কোথায় কোন ভাঙা দুর্গ বা কটা জলাশয়, সেসব দেখানো রয়েছে।

বড়ঠাকুর বললেন, ফরেস্ট অ্যাটলাস অব ইন্ডিয়া বইটা তো? খুবই মূল্যবান বই। যাই হোক, আপনার গায়ে যে গুলি লাগেনি, এটাই খুব ভাগ্যের কথা। আপনি আমাদের রাজ্যে অতিথি। আপনার জন্য গাড়ি থাকবে, সব জঙ্গলের বাংলোর ঘর বুক করা থাকবে। আমি আপনার সঙ্গে থাকতে পারলে খুশি হতাম, কিন্তু আমাকে ফিরতে হবে গুয়াহাটি। রাজ সিং তো রইলেনই, এ ছাড়া শচীন সইকিয়া আর তপন রায় বর্মণ নামে দুজন অফিসারের ওপর ভার দিয়ে যাচ্ছি। আপনাদের যখন যা লাগবে, ওঁরা ব্যবস্থা করে দেবেন।

কাকাবাবু উঠে দাঁড়াতেই বড়ঠাকুর করমর্দনের জন্য হাত বাড়ালেন তাঁর দিকে। কাকাবাবু তাঁর হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বললেন, সিনাকি হৈ ভাল্‌ লাগিল্‌।

বড়ঠাকুর অবাক হয়ে বললেন, আপনি অসমিয়া ভাষা জানেন নাকি?

কাকাবাবু হেসে বললেন, একটু-একটু জানি। কতবার আপনাদের এখানে এসেছি।

বড়ঠাকুর সবাইকে বাগানের গেটের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, আমার অনুরোধ, আপনারা ভোরের দিকেই জঙ্গল দেখতে যাবেন। তখন কত ফুল, কত পাখি দেখা যায়। রাত্তিরেরও একটা আলাদা রূপ আছে, তা মানি। রাত্তিরে যদি যেতেই চান, তা হলে সঙ্গে অন্তত চারজন আমর্ড গার্ড থাকবে। তারা আপনাদের পাহারা দেবে।

কাকাবাবু বললেন, আমর্ড গার্ড আমি নিতে চাই না। সর্ষের মধ্যে ভূত, এই কথাটা আপনি জানেন?

বড়ঠাকুর বললেন, ভূত? না, জানি না তো?

কাকাবাবু বললেন, পুলিশ কিংবা আমর্ড গার্ডদের মধ্যে দু-একজন হচ্ছে সেই ভূত। এদের সঙ্গে গাছ-চোর কিংবা চোরাশিকারিদের গোপন যোগাযোগ থাকে। এরা আগে থেকে সব খবর দিয়ে দেয়। সেইজন্যই আমি কাল রাতে সঙ্গে কোনও পাহারাদার নিইনি, এমনকী জিপের ড্রাইভারও ছিল না।

বড়ঠাকুর বললেন, ও, এই ভূত? তা আপনার কথাটা একেবারে অস্বীকার করতে পারি না। বিশ্বাসঘাতকরা কোথায় নেই বলুন? যাই হোক, সাবধানে থাকবেন!

আজ ওদের জন্য একটি স্টেশন ওয়াগন মজুত রয়েছে। সারাদিন ইচ্ছেমতন ঘোরা যাবে। রাজ সিং সঙ্গে আসতে পারবেন না, তাঁর অফিসের কাজ আছে। তখনই ডাকবাংলোয় ফিরতে না চেয়ে কাকাবাবু বললেন, চল, দু-একটা পুরনো জায়গা দেখে আসি।

গাড়ির ড্রাইভারকে তিনি বললেন, ময় বামুনি পাহাড় লৈ যাব বিসারু।

গাড়ি চলতে শুরু করলে সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, তুমি বড়ঠাকুরকে অসমিয়া ভাষায় যে-কথাটা বললে, তার মানে কী?

কাকাবাবু বললেন, বুঝলি না? সিনাকি হৈ ভাল লাগি! সিনাকি মানে চেনা। পরিচিত হওয়া। আপনার সঙ্গে চেনা হয়ে ভাল লাগল! একটু-আধটু উচ্চারণের তফাত, নইলে অসমিয়া ভাষা আমাদের পক্ষে বেশ সোজা। মনে রাখবি। এখানে ময় মানে আমি। যেমন হিন্দিতে বলে ম্যায়!

জোজো বলল, বাংলাতেও অনেক গ্রামের লোক বলে মুই।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক। আর আমি মানে অসমিয়াতে আমরা।

সন্তু বলল, তেজপুর নামটা বেশ ভাল।

কাকাবাবু বললেন, শহরটাও সুন্দর। পরিষ্কার, ছিমছাম। জানিস, এই তেজপুরের আগে অনেক নাম ছিল। দেবীকূট, ঊষাবন, কোটিবর্ষা, বনপুর, শোণিতপুর।

জোজো বলল, এর মধ্যে ঊষাবন নামটাই আমার বেশি ভাল লাগছে।

কাকাবাবু বললেন, এককালে ঊষা নামে এখানে এক রাজকন্যা ছিল। অপরূপ সুন্দরী। অনিরুদ্ধ এসে তাকে এখান থেকে হরণ করে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে।

সন্তু জোজোকে জিজ্ঞেস করল, অনিরুদ্ধ কে বল তো?

জোজোর চেয়ে সন্তু রামায়ণ-মহাভারত অনেক ভাল করে পড়েছে। জোজো কিছু না জানলেও হার স্বীকার করে না। সে বলল, আর-একটা কোনও রাজাটাজা হবে। দ্বারভাঙ্গার রাজা।

সন্তু বলল, মোটেই না। অনিরুদ্ধ হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের এক ছেলে। শ্রীকৃষ্ণের রাজধানী ছিল দ্বারকায়। সেই গুজরাতে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, জোজো, তুমি হঠাৎ অনিরুদ্ধকে দ্বারভাঙ্গার রাজা বললে কেন?

জোজো বলল, অনিরুদ্ধ মানে যাকে রুদ্ধ করে রাখা যায় না। আর দ্বারভাঙ্গা মানে যেখানে দরজা ভেঙে গেছে। দরজা ভেঙে বেরিয়ে এসেছিল অনিরুদ্ধ।

কাকাবাবু বললেন, একেই বলে উপস্থিত বুদ্ধি। এই অনিরুদ্ধ অত দূরের দ্বারকা থেকে এখানে এসেছিল বিয়ে করতে? শখ তো কম নয়!

একটু পরেই গাড়িটা গিয়ে পৌঁছল বামুনি পাহাড়ে। সেখানে আসলে দেখবার কিছু নেই। শুধু কয়েকটা মন্দিরের ধ্বংসস্থূপ। তবে এমনিই পাহাড়ের ওপর বসে থাকতে ভাল লাগে।

কাকাবাবু কয়েক টুকরো পুরনো পাথর নিয়ে দেখতে লাগলেন মনোযোগ দিয়ে। সন্তু আর জোজো ছুটোছুটি লাগিয়ে দিল। আকাশ আজ ঝকঝকে নীল, মাঝে-মাঝেই ঝাঁক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে।

একটু বাদে একটা জিপ গাড়ি উঠে এল সেখানে। কাকাবাবু সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। ড্রাইভারের পাশ থেকে একজন লোক নেমে এগিয়ে আসতে-আসতে হাত জোড় করে বলল, নমস্কার, কাকাবাবু!

কাকাবাবু লোকটিকে একেবারেই চেনেন না। বত্রিশ-তেত্রিশ বছর বয়েস, প্যান্টের ওপর পরে আছে একটা গাঢ় লাল রঙের ফুলহাতা সোয়েটার।

কাছে এসে সে বলল, আমার নাম তপন রায় বর্মণ। ফরেস্ট অফিসে কাজ করি। বড়ঠাকুর সাহেব বললেন আপনাদের কথা, তাই ভাবলাম দেখা করে আসি।

কাকাবাবুও নমস্কার জানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী করে জানলেন যে আমরা এখানে এসেছি?

তপন রায় বর্মণ বলল, তেজপুরে বেড়াতে এসে সকলেই এখানে একবার আসে। তাই চান্স নিলাম।

সন্তু ও জোজোকে ডেকে কাকাবাবু ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন।

তপন বলল, আপনারা যদি পুরনো জঙ্গল দেখতে চান, তা হলে আর-একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পারি। দা পাৰ্বতীয়া। সেখানে বহুকালের প্রাচীন পাথরের দরজা রয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, আজকের দিনটা এত সুন্দর, বেড়াবার মতনই দিন। চলুন, ঘুরে আসা যাক।

তপন বলল, আপনি আমাকে শুধু নাম ধরে ডাকবেন, তুমি বলবেন। আমিও আপনাকে কাকাবাবু বলব, মিস্টার কিংবা বাবুটাবু আমার বলতে ভাল লাগে না।

সন্তু আর জোজোর দিকে ফিরে বলল, তোমরাও আমাকে তপনদা বলবে।

তপন নিজের জিপগাড়িটা ছেড়ে দিয়ে কাকাবাবুদের স্টেশন ওয়াগনে চড়ে বসল।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, আজও কি আমরা রাত্তিরে জঙ্গলে যাব?

কাকাবাবু বললেন, নাঃ! আজ রাতটা আমি ভাল করে ঘুমোব। কাল সকালে কী করা যায়, পরে ভেবে দেখা যাবে!

জোজো বলল, কাল সকালে হাতির পিঠে চেপে ঘুরলে হয় না? আমার তো মাহুত লাগবে না, আমি নিজেই হাতি চালাতে জানি। সন্তু বলল, তুই কোথায় হাতি চালানো শিখলি রে?

জোজো গম্ভীরভাবে বলল, আফ্রিকায়। সেখানে আমার নিজস্ব পোষা হাতি ছিল।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, কাল সকালে তোমার হাতি চালানো দেখব।

রাস্তাটা সারানো হচ্ছে বলে গাড়ি চলছে আস্তে-আস্তে। পেছন থেকে আর-একটা গাড়ির খুব তাড়া আছে মনে হয়, হর্ন দিচ্ছে বারবার। কিন্তু সে-গাড়িকে এগিয়ে যেতে দেওয়ার উপায় নেই। পেছনের লাল রঙের গাড়িটা অনবরত হর্ন দিতে লাগল।

কাকাবাবু দু হাতে কান চাপা দিয়ে বললেন, উঃ, এত হর্ন দেয় কেন?

খানিক বাদে পেছনের গাড়িটা পাশের মাঠে নেমে পড়ে ধুলো উড়িয়ে কোনওরকমে সামনে চলে এল, তারপর রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল আড়াআড়িভাবে। সেই গাড়ির সামনের সিট থেকে নেমে এল একজন লোক। তাকে দেখেই চমকে উঠতে হয়। ছ ফুটের বেশি লম্বা, তেমনই চওড়া, মনে হয় যেন পাহাড়ের মতন মানুষ। তার দু দিকের মোটা জুলপি জুড়ে আছে গালের অনেকখানি, গোঁফ নেই।

সে-লোকটি গটমটিয়ে এসে এ-গাড়ির ড্রাইভারের কলার চেপে ধরে একটা গালাগালি দিয়ে বলল, এই, তুই আমার রাস্তা আটকে ছিলি কেন রে? হর্ন দিচ্ছি, শুনতে পাচ্ছিস না? কানে কালা?

কাকাবাবু তপন রায় বর্মণের দিকে তাকালেন। তার মুখোনি শুকিয়ে গেছে, লোকটিকে দেখে ভয় পেয়েছে। সে মিনমিন করে বলল, রাস্তা যে ভাঙা, জায়গা ছিল না!

ড্রাইভারও কোনও প্রতিবাদ করছে না। লোকটি আবার একটা গালাগাল দিতেই কাকাবাবু শান্ত, দৃঢ় গলায় বললেন, ওর কলার ছেড়ে দিন। ভদ্রভাবে কথা বলুন!

লোকটি কৌতূহলীভাবে কাকাবাবুর দিকে তাকাল। কুটিলভাবে ভুরু কুঁচকে বলল, এ আবার কে? নতুন লোক দেখছি!

তপন তাড়াতাড়ি বলল, আজ্ঞে, ইনি আমাদের কনজারভেটর সাহেবের অতিথি। কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছেন। এঁর নাম রাজা রায়চৌধুরী।

লোকটি ড্রাইভারের কলার ছেড়ে দিয়ে বলল, রাজা রায়চৌধুরী! তাই নাকি? ইনিই সেই? নমস্কার, নমস্কার! ও, সেইজন্যই আমার গাড়িকে আগে যেতে দেয়নি? আমি ভাবলাম, কার এমন সাহস যে, আমার গাড়িকে জায়গা ছাড়বে না? আমার গাড়ির নাম্বার দেখেছেন? ৫৫৫৫। সবাই এ-গাড়ি চেনে!

কাকাবাবু কোনও কথা না বলে লোকটির মুখের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলেন।

লোকটি বলল, রাজা রায়চৌধুরী, আপনার নাম আমি শুনেছি। আপনি বেড়াতে এসেছেন, একদিন আমার বাড়িতে চা খেতে আসুন। আপনারা সবাই আসুন, আজই সন্ধেবেলা। তপনবাবু, তুমি এদের নিয়ে আসবে। আচ্ছা, তখন কথা হবে। চলি!

লোকটি আবার ফিরে গেল নিজের গাড়িতে। সেটা হুশ করে অনেক জোরে বেরিয়ে গেল।

কাকাবাবু তপনকে জিজ্ঞেস করলেন, লোকটা কে?

তপন বলল, ওর নাম হিম্মত রাও। খুব বড় ব্যবসাদার। কাঠের ব্যবসা, পেট্রল পাম্প, অনেক কিছু আছে।

কাকাবাবু বললেন, হোক না বড় ব্যবসাদার। তোমরা ওকে ভয় পাও কেন?

তপন বলল, ওর অনেক টাকা। অনেক দলবল। সবাই ওকে ভয় পায়, এমনকী, পুলিশও ভয় পায়। ওর সঙ্গে কারও ঝগড়া হলে তারপর আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। বোধ হয় খুন করে জঙ্গলে কোথাও ফেলে দিয়ে আসে। কিন্তু ওর বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

কাকাবাবু বললেন, ও আমাকে চিনল কী করে?

তপন বলল, আপনি বিখ্যাত লোক, আপনাকে অনেকেই চেনে।

কাকাবাবু বললেন, উঁহুঃ! একজন কাঠের ব্যবসাদার কী কারণে আমাকে চিনবে? তুমি ওর কাছে আমার নাম বলতে গেলে কেন? এর পর থেকে যার-তার কাছে আমার নাম বলবে না, পরিচয়ও দেবে না।

তপন বলল, হিম্মত রাও আপনাকে চা খাওয়ার নেমন্তন্ন করল–

পেছন থেকে সন্তু বলল, আমরা মোটেই যাব না। লোকটা অভদ্র! কেন ওকে সবাই আগে যেতে দেবে? ও কি লাটসাহেব নাকি?

জোজো বলল, ইস্কাবনের গোলাম!

সন্তু বলল, অনেকটা। একটা জিনিস লক্ষ করেছিস, জোজো? ওর গলায় সোনার হারের সঙ্গে যে লকেট, তাতে একটা হনুমানের ছবি!

জোজো বলল, এইসব লোককে জব্দ করা খুব সহজ। কোনও রকমে ওর ডান হাঁটুতে একটা আলপিন ফুটিয়ে দিতে পারলেই বাপ রে, মা রে বলে চ্যাঁচাবে!

কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? সামান্য একটা আলপিনে অত বড় চেহারার মানুষ কাবু হয়ে যাবে?

জোজো বলল, হ্যাঁ, কাকাবাবু, যেসব লোক খুব লম্বা আর মোটা হয়, তাদের হাঁটুতে জল জমে থাকে। একটা আলপিন ফোটালেই সেই জল তিরতির করে বেরিয়ে আসবে, আর তখন এত ব্যথা হবে… সেইজন্যই তো আমি নিজের কাছে সবসময় কয়েকটা সেফটিপিন রাখি!

তপন অবাক হয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল জোজোর দিকে।

দা পাৰ্বতীয়া দেখে ফেরার পথে আর-একটি ঘটনা ঘটল।

একটা জংলা জায়গার সরু পথ থেকে একটা সাইকেল উঠে এল বড় রাস্তায়। সেটা চালাচ্ছে একজন খাকি প্যান্ট আর সবুজ চাদর জড়ানো লোক, মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। তার সাইকেলের দু পাশে দুটো বোঝা চাপানো আছে।

এই গাড়ির ড্রাইভার তপনকে বলল, সার, ওই দেখুন জলিল!

তপন বলল, ব্যাটা আবার বেরিয়েছে? ধরো তো, ধরো ওকে!

স্টেশন ওয়াগনটা স্পিড বাড়িয়ে কাছে আসতেই সাইকেল আরোহী ড্রাইভারকে দেখে চমকে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গে সে সাইকেল ঘুরিয়ে নেমে পড়ল মাঠের মধ্যে। এ-গাড়িটাও তাড়া করল তাকে। এবড়োখেবড়ো মাঠ, সদ্য ধান কাটা হয়ে গেছে, ধানগাছের গোড়াগুলো উঁচু হয়ে আছে। সেই লোকটি তারই মধ্যে এঁকেবেঁকে সাইকেল নিয়ে পালাতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ল একজায়গায়। তারপর সাইকেল ফেলেই সে দৌড় লাগাল। তপনও তড়াক করে লাফিয়ে নেমে ছুটে গেল তার পিছু-পিছু। তপনও বেশ জোরে দৌড়োয়, কিন্তু জলিল অনেক ক্ষিপ্র।

এবার সন্তু আর জোজোও নেমে পড়ল। শুরু হয়ে গেল মাঠের মধ্যে চোর-চোর খেলা। কাকাবাবু সেই খেলা দেখে মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। জলিল ওদের তিনজনকেই নাস্তানাবুদ করে দিল। কাকাবাবু গাড়ির ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন, বলো তো, শেষপর্যন্ত লোকটা পালাবে, না, ধরা পড়বে?

ড্রাইভার বলল, এ-লোকটা মহা ধড়িবাজ, এর আগে দুবার পালিয়েছে!

কাকাবাবু বললেন, এবার ঠিক ধরা পড়ে যাবে। ওই যে নীল কোট পরা ছেলেটি, শেষপর্যন্ত ও-ই ধরে ফেলবে!

তপন আর সন্তু-জোজো তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে জলিলকে। এবার আর তার নিস্তার নেই। তপন দু হাত তুলেছে ওকে ধরার জন্য, তবু জলিল সুড়ত করে গলে গেল। ক্রিকেট-মাঠে ভাল ফিল্ডার যেমন ডাইভ দিয়ে শুয়ে পড়ে ক্যাচ ধরে, সন্তু সেইভাবে এক লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে চেপে ধরল জলিলের একটা পা। সে আর ছাড়াতে পারল না।

জলিলকে টানতে-টানতে নিয়ে আসা হল তার গাড়ির কাছে। তপন ওর সাইকেলটাকেও নিয়ে এল। সাইকেলটার দু পাশে কাপড় দিয়ে ঢাকা দুটো খাঁচা। তার মধ্যে দশ বারোটা পাখি। সবসুন্ধু তোলা হল গাড়ির পেছনে।

জোজো বলল, দেখলেন তো কাকাবাবু। আমি এমন প্যাঁচ কষে ওকে। সন্তুর দিকে ঠেলে দিলাম, তাই তো সন্তু ওকে ধরতে পারল!

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, দেখলাম তো! কিন্তু ওকে ধরা হল কেন?

তপন বলল, দেখছেন না, কত ভাল-ভাল পাখি ধরেছে। এগুলো বর্মা বর্ডার দিয়ে বিদেশে চালান যায়। এইসব পাখি ধরাই বেআইনি। এর আগে দু বার আমাদের হাত ছাড়িয়ে পালিয়েছে!

সন্তু কোটের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে জিজ্ঞেস করল, এগুলো কী পাখি?

তপন বলল, বেশির ভাগই ময়না। বিদেশে অনেক দামে বিক্রি হয়। কথা শেখালে মানুষের মতন কথা বলতে পারে। দুটো সবুজ ঘুঘু পাখি, এরও খুব দাম, আর তিনটে হর্ন বিল—

জলিলের মুখে একটা একরোখা ভাব। যেন সে একটুও ভয় পায়নি। ট্যাঁক থেকে একটা টিনের কৌটো বের করে তার থেকে একটা বিড়ি ধরাল।

কাকাবাবু বললেন, ওকে নিয়ে এখন কী করবে?

তপন বলল, থানায় জমা দেব।

কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, তারপর ওর কী শাস্তি হবে?

তপন বলল, সেই তো মুশকিল! এদের পেছনে বড়-বড় লোক থাকে। কোর্টে কেস উঠলে কোথা থেকে একজন উকিল এসে জামিনে ছাড়িয়ে নিয়ে। যায়। অনেকদিন কেস চলে। তারপর সামান্য কিছু টাকা জরিমানা হয়, সে-টাকাটাও উকিল দিয়ে দেয়।

কাকাবাবু বললেন, হুঁঃ! তা হলে আর ওকে থানায় নিয়ে গিয়ে লাভ কী? ওকে বরং ওর বাড়িতে পৌঁছে দাও!

তপন চোখ বড় বড় করে কাকাবাবুর দিকে চেয়ে রইল।

কাকাবাবু বললেন, বেচারা কত কষ্ট করে পাখিগুলো ধরেছে, তারপর মাঠে এত দৌড়োদৌড়ি করল, অনেক পরিশ্রম গেছে। বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম নিক। কী বলল হে জলিল, সেটাই ভাল না? তোমার বাড়িতে গেলে আমাদের পানিটানি খাওয়াবে তো?

জলিল বলল, আমি এখন বাড়ি যাব না!

কাকাবাবু বললেন, সে কী, তোমাকে গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে, তুমি যাবে না?

জলিল দৃঢ়ভাবে বলল, না!

তপন বলল, ওর বাড়ি আমাদের চেনাতে চায় না।

ড্রাইভার বলল, যতদূর মনে হয়, জামগুঁড়ি গ্রামের কাছাকাছি ওর বাড়ি। ওখানকার হাটে আমি ওকে দু-এক বার দেখেছি।

কাকাবাবু বললেন, ব্যস, তা হলে আর কী! ওই গ্রামে গেলেই ওর বাড়ির খোঁজ পাওয়া যাবে। সন্তু, জোজো, ওকে ভাল করে ধরে রাখিস, যেন লাফিয়ে হঠাৎ পালিয়ে না যায়। ওর বাড়িতে আমরা যাবই!

জামগুঁড়ি গ্রামে দু-এক জন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল যে, জলিলের বাড়ি পাশের গ্রাম সানকিভাটায়। সে-গ্রামের এক প্রান্তে একটি সুপুরিগাছ-ঘেরা মাটির বাড়ি, পাশে একটা ছোট্ট পুকুর।

কাকাবাবু সে বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে চারদিকটা দেখলেন। এক পাশে রান্নাঘর। অন্য দিকে গোয়ালঘর, একটা ছোটমতন ধানের গোলা, বাড়ির পেছনে বাগান। ওদের শোওয়ার ঘরের বারান্দায় বাড়ির মেয়েরা ভয়চকিত মুখে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে।

কাকাবাবু সেদিকে এগিয়ে গিয়ে একটি দশ-এগারো বছরের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, জলিল তোমার কে হয়? আব্বাজান? পাখিগুলো কোথায় রাখে বলো তো মা, ভয় নেই, তোমার বাবাকে কেউ কিছু বলবে না, মারবেও না।

মেয়েটি চোখে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কাকাবাবু তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, কাঁদছ কেন? কোনও ভয় নেই। পাখিগুলো কোথায় দেখিয়ে দাও, তোমার বাবা ছাড়া পেয়ে যাবে।

মেয়েটি তবু কোনও কথা না বলে কেঁদেই চলল।

কাকাবাবু বললেন, তুমি দেখিয়ে দিলে না তো? তা হলে আমরাই খুঁজে নিচ্ছি। পাখি খোঁজা খুব সহজ।

কাকাবাবু কোটের পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে শূন্যের দিকে একবার ফায়ার করলেন। সঙ্গে-সঙ্গে বাড়ির ভেতরে খাঁচার পাখিগুলো ডেকে উঠল, আশপাশের গাছ থেকে অনেক কাক ভয় পেয়ে কাকা করে উড়ে গেল, আর গোয়ালঘরের মধ্য থেকে অনেক পাখির কিচিরমিচির শোনা গেল।

তপন, সন্তু-জোজো ছুটে গেল গোয়ালঘরে। সেখানে একটি মাত্র গরু, তার পেছনে একটা চটের পরদা টাঙানো। সেই পরদার পেছনে মাটিতে খানিকটা গর্ত খুঁড়ে রাখা আছে অন্তত কুড়িটা বাঁশের খাঁচা। তার মধ্যে গাদাগাদি করে রাখা আছে পাখি, শ পাঁচেক তো হবেই। ময়না, তিতির, ঘুঘু, ধনেশ, আরও নানা জাতের পাখি।

ওরা তিনজন খাঁচাগুলো নিয়ে আসতে লাগল উঠোনে। জলিল কোমরে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে জ্বলজ্বলে চোখে। কাকাবাবু মেয়েটির কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী? ফিরোজা? বাঃ, কী সুন্দর নাম।

তপন বলল, বিগ ক্যাচ! একসঙ্গে এত পাখি, দুর্লভ সব পাখি।

কাকাবাবু বললেন, জলিলকে মোটে দশ বারোটা পাখিসমেত থানায় নিয়ে গেলে কী লাভ হত! বড়জোর একশো-দুশো টাকা ফাইন হত। বিদেশে একসঙ্গে অনেক পাখি চালান যায়, মোটা টাকার কারবার।

তপন বলল, এইসব খাঁচা আটক করে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমাদের গাড়িতে তো ধরবে না। আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি, আমাদের ড্রাইভার কাছাকাছি থানা থেকে আর-একটা গাড়ি নিয়ে আসুক। ততক্ষণ আমাদের এখানেই অপেক্ষা করতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও, ব্যস্ত হয়ো না। এই পাখিগুলো যে তোমরা আটক করবে, তারপর থানায় নিয়ে গিয়ে কী হবে? পাখিগুলোকে কি থানার লোকেরা দানাপানি খাওয়াবে?

তপন বলল, ম্যাজিস্ট্রেটের অর্ডার নিতে হবে। তারপর গুয়াহাটির চিড়িয়াখানায় পাঠিয়ে দিলে ওরা যা তোক ব্যবস্থা করবে।

কাকাবাবু বললেন, গভর্নমেন্টের তো আঠারো মাসে বছর। এগুলো নিয়ে গিয়ে থানায় রাখবে। ম্যাজিস্ট্রেটের অর্ডার পেতে কতদিন লাগবে কে জানে! তারপর গুয়াহাটি চিড়িয়াখানায় পাঠাতে পাঠাতে অর্ধেক পাখি মরে যাবে না? ঠিক করে বলো!

তপন মাথা চুলকোতে-চুলকোতে বলল, তা হয় সার, অনেক সময় দেরি হয়ে যায়!

কাকাবাবু এবার কড়াভাবে বললেন, বিদেশে পাখি চালান দেওয়া যেমন অন্যায়, তেমনই তোমাদের অযত্নে পাখিগুলো মেরে ফেলা আরও বেশি অন্যায়। সব পাখি এখান থেকেই ছেড়ে দাও!

তপন বলল, সে কী বলছেন সার? তা হলে যে জলিলের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ থাকবে না!

কাকাবাবু বললেন, পাখিগুলোকে বাঁচানোই তো বড় কথা, তাই না? নাও, নাও, শুরু করো, খাঁচাগুলোর দরজা খুলে দাও!

সন্তু আর জোজো মহা উৎসাহে এই কাজে লেগে গেল। এক-একটা খাঁচা খোলা হয় আর ফরফর করে উড়তে থাকে পাখি। সব পাখি তখুনি উড়ান দিয়ে মিলিয়ে যায় না। হঠাৎ মুক্তি পেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিছু পাখি উঠোনে হেঁটে বেড়ায়, কিছু পাখি সুপুরি গাছগুলোতে বসে ডাকতে শুরু করল। ছোট পাখিগুলো একসঙ্গে ঝাঁক বেঁধে উড়তে লাগল মাথার ওপরে।

কাকাবাবু মুগ্ধভাবে এই পাখি ওড়ার দৃশ্য দেখতে লাগলেন। তাঁর মুখ দেখে মনে হয়, এমন সুন্দর দৃশ্য যেন তিনি বহুদিন দেখেননি।

তিনি ফিরোজাকে বললেন, তুমিও পাখি ওড়াবে? যাও না!

ফিরোজা এবার দৌড়ে গিয়ে সন্তুদের পাশে গিয়ে হাত লাগাল।

সমস্ত পাখি মুক্তি পাওয়ার পর কাকাবাবু আবার ফিরোজাকে ডেকে বললেন, আমার খুব তেষ্টা পেয়েছে, তুমি আমাকে একটু পানি খাওয়াবে?

ফিরোজা ঘরের মধ্যে গিয়ে একটা ঝকঝকে পেতলের ঘটি ভর্তি জল আর একটা কাচের গেলাস নিয়ে এল। কাকাবাবুর পর সন্তু-জোজোরাও সেই জল খেল।

কাকাবাবু ফিরোজাকে বললেন, পাখিগুলো ছাড়া পেয়ে গেল, তাই তোমার বাবাকেও কেউ ধরে নিয়ে যাবে না। এবার থেকে তোমার বাবা পাখি ধরে আনলে তোমরা নিজেরাই খাঁচা খুলে ছেড়ে দেবে, কেমন? তোমার মাকে, অন্যদেরও সেই কথা বোলো। মনে থাকবে তো?