০২. ডাকবাংলোটা একটা টিলার ওপরে

ডাকবাংলোটা একটা টিলার ওপরে।

বারান্দায় বসলেই সামনের দিকে পাহাড়ের ঢেউ দেখা যায়। একটার পর একটা পাহাড়, সবই গভীর জঙ্গলে ঢাকা। চতুর্দিকে শুধু সবুজ। মাঝে-মাঝে মেঘ এসে সব কিছু ঢেকে দেয়, একঝাঁক বৃষ্টি হওয়ার পরই আবার আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়।

পুরনো আমলের বাংলো। মস্ত বড় বড় ঘর। প্রায় পুরো বাড়িটাকে ঘিরে বিশাল চওড়া বারান্দা।

সন্তু আর কাকাবাবুকে দেওয়া হয়েছে একটা ঘর। আর-একখানা ঘরে রয়েছেন একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক। তা ছাড়া আর কোনও লোক নেই। বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির মুখে রবীন্দ্রনাথের মতন দাড়ি, সবই সাদা নয় অবশ্য, কাঁচাপাকা। তিনি বারান্দার এককোণে একটা চেয়ার নিয়ে পাহাড়ের দিকে চেয়ে বসে থাকেন একা-একা। অন্য কারও সঙ্গে আলাপ করেন না। কাকাবাবুরা দু দিন আগে এসেছেন। এর মধ্যে বৃদ্ধ লোকটির সঙ্গে একবার চোখাচোখি হতে শুধু নমস্কার-বিনিময় হয়েছে, আর কোনও কথা হয়নি।

জঙ্গল থেকে ফিরে কাকাবাবু আর সন্তু বারান্দাতেই বসলেন অম্বরকে নিয়ে। বেয়ারাকে বলা হল চা দিতে। অম্বর অনেক জঙ্গলের গল্প শোনাতে লাগল।

একটু বাদেই বেয়ারা চা নিয়ে এল। এখানকার বেয়ারারা খুব কেতাদুরস্ত। হেলাফেলা করে চা দেয় না। বড় ট্রের ওপর সুন্দর ছবি আঁকা পোর্সলিনের টি-পট। কাপগুলোও বেশ ভাল দেখতে, কোনওটাই চলটা-ওটা কিংবা কানাভাঙা নয়। একটা প্লেটে আলাদা করে বিস্কুট আর কাজুবাদাম।

বেয়ারাটি জিজ্ঞেস করল, চা আমি কাপে ঢেলে দেব, সার?

অম্বর বলল, না, আমি ঢেলে দিচ্ছি, তুমি আর-একটু চিনি নিয়ে এসো। আমি চিনি বেশি খাই।

কাপে চা ঢালতে-ঢালতে অম্বর বারান্দার কোণের বৃদ্ধটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, উনি ওখানে একা বসে আছেন কেন?

কাকাবাবু বললেন, তা তো জানি না! উনি একা থাকতেই ভালবাসেন বোধ হয়! দু দিন ধরে এইরকমই তো দেখছি!

অম্বর বলল, এইরকম একটা সুন্দর জায়গায় বিকেলবেলা কেউ একা বসে থাকবে, এর কোনও মানে হয়?

চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে, অম্বর সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে ডেকে বলল, নমস্কার সার! আমার নাম পীতাম্বর পাহাড়ী! আপনাকে তো চিনলাম না?

বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। কয়েক মুহূর্ত স্থিরভাবে চেয়ে রইলেন অম্বরের দিকে। তারপর বেশ চিবিয়ে-চিবিয়ে ইংরেজিতে বললেন, আমিও আপনাকে চিনি না। চিনতেই যে হবে, তার কোনও মানে নেই।

অম্বর একগাল হেসে বলল, না, কোনও মানে নেই। আমি এখানে প্রায় বছরখানেক আছি তো। ছোট জায়গা, সবাই সবাইকে চেনে। এখানে যেসব সরকারি অফিসার আসেন, তাঁদেরও আমি চিনি। বর্ষার সময় এখানে কেউ বেড়াতে আসে না। তাই আমি ভেবেছিলুম, আপনি বুঝি কোনও সরকারি কাজে এসেছেন।

বৃদ্ধ লোকটি বললেন, না, আমি বেড়াতেই এসেছি!

অম্বর বলল, ভাল কথা। আসুন না, আলাপ-পরিচয় করা যাক। আপনি আমাদের সঙ্গে চা খাবেন?

বৃদ্ধ লোকটি একবার কাকাবাবুদের টেবিলের দিকে তাকালেন। একটু দোনামনা করলেন মনে হল। তারপর বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ! এক কাপ চা খেলে অবশ্য মন্দ হয় না!

তিনি উঠে এলেন কাকাবাবুদের টেবিলের দিকে।

সন্তু উঠে দাঁড়িয়ে সেই বৃদ্ধ লোকটির জন্য একটি চেয়ার টেনে দিল।

কাকাবাবু বললেন, আপনাকে বোধ হয় বিরক্ত করা হল।

বৃদ্ধটি চেয়ারে বসে বললেন, না, না, তা নয়। আপনাদের তো দেখছি দু দিন ধরে। আসল ব্যাপার কী জানেন, আমি নিজে থেকে কারুর সঙ্গে আলাপ করতে পারি না। এইটা আমার দোষ। সারা জীবন যে-চাকরি করেছি, তাতে তো লোকজনের সঙ্গে মেলামেশার বিশেষ সুযোগ ছিল না। এখন রিটায়ার করেছি বটে, তবু সেই স্বভাবটা রয়ে গেছে।

বৃদ্ধের হাতে একটা চায়ের কাপ তুলে দিয়ে অম্বর জিজ্ঞেস করল, আপনি কী কাজ করতেন?

বৃদ্ধটি ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, কাঁধে একটা মুগার চাদর। এক হাতে একটা রুপোবাঁধানো বেতের লাঠি।

চায়ের কাপে ঠোঁট ঠেকিয়ে বড় একটা চুমুক দিলেন তিনি। তারপর মুখ তুলে বললেন, আমি হাইকোর্টের জজ ছিলাম।

অম্বর হি-হি-হি-হি করে হেসে উঠল।

কাকাবাবু বেশ রাগ রাগ চোখ করে অম্বরের দিকে তাকালেন। একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোকের কথার ওপরে হেসে ওঠা অত্যন্ত অসভ্যতা।

অম্বর হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, হাইকোর্টের জজ হলে বুঝি লোকজনের সঙ্গে মেশা যায় না?

বৃদ্ধ ভদ্রলোক গম্ভীরভাবে বললেন, না!

কাকাবাবু বললেন, তা তো বটেই। বিচারকদের কত লোককে শাস্তি দিতে হয়। সেই লোকদের সঙ্গে যদি রাস্তাঘাটে দেখা হয়ে যায়, তারা অপমান করতে পারে, মেরেও বসতে পারে।

বিচারক বললেন, যতদিন চাকরি করেছি, তখন সব সময় আমার সঙ্গে পুলিশ থাকত। দু বছর আগে রিটায়ার করেছি। এখন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াই। আমার বউ ছেলেমেয়ে কেউ নেই। তাই একা-একা থাকি।

অম্বর বলল, এখন আপনি রিটায়ার করেছেন বটে। কিন্তু ধরুন আপনি যাদের শাস্তি দিয়েছেন, জেল খাটিয়েছেন, ভুল করেও তো কেউ-কেউ শাস্তি পায়, সেরকম কারুর সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যায়? সে যদি প্রতিশোধ নিতে চায় :

বিচারক কোনও উত্তর না দিয়ে অম্বরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

এই সময় একটা জিপ এসে থামল বাংলোর সামনে। তার থেকে দুজন লোক নেমে গুড ইভনিং, গুড ইভনিং বলতে বলতে উঠে এল সিঁড়ি দিয়ে। দুজনেই সুট পরা, এবং মুখে ইংরেজি বললেও নমস্কারের ভঙ্গিতে হাতজোড় করে আছে।

কাকাবাবু বললেন, আমাদের চা খাওয়া শেষ। আপনারা চা খাবেন? দিতে বলব?

লোক দুটি চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। তাদের একজন বলল, না, না, দরকার নেই। আমরা এইমাত্র চা খেয়ে এসেছি।

কাকাবাবু অন্যদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। লোক দুটির নাম কুমার সিং আর ভুবন দাস। দুজনেরই বয়েস চল্লিশের কাছাকাছি।

জজসাহেব নিজের নাম বললেন, পি কে দত্ত। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনারা নিশ্চয়ই কাজের কথা বলবেন। আমি এবার যাই।

কাকাবাবু যদিও বললেন যে, না, না, কাজের কথা কিছু নেই, তবু জজসাহেব আর বসলেন না। বারান্দার একেবারে শেষ প্রান্তে হেঁটে গিয়ে এঁদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে, পাহাড়ের দিকে মুখ করে বসলেন।

অম্বর জিজ্ঞেস করল, আপনারা পাখি দেখতে কখন যাচ্ছেন?

কুমার সিং বলল, আর একটু পরেই। সন্ধে নামবার ঠিক সঙ্গে-সঙ্গে। বৃষ্টি হলে তো কিছু দেখা যাবে না। মেঘ জমছে, বেশি রাত্তিরের দিকে আবার বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে।

অম্বর বলল, আমার কয়েকটা টর্চের ব্যাটারি কিনতে হবে। আমি একটু বাজারের দিকটা ঘুরে তারপর আপনাদের সঙ্গে ওখানে যোগ দেব। ব্যাপারটা আমারও দেখা হয়নি।

কথাটা কুমার সিং-এর তেমন পছন্দ হল না। সে বলল, ওখানে খুব বেশি ভিড় হলে মুশকিল হবে!

অম্বর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি এখানেই থাকি। আমি তো ইচ্ছেমতন যে-কোনও জায়গায় যেতে পারি, তাই না?

তারপর সে বলল, চলি কাকাবাবু! চলি সন্তু, একটু পরে দেখা হবে!

অম্বর বেরিয়ে যেতেই ভুবন দাস জিজ্ঞেস করল, লোকটা এখানেই থাকে বলল। আগে তো দেখিনি। কী করে?

কাকাবাবু বললেন, আজই আলাপ হল আমাদের সঙ্গে। ও বলল, ও সাপ ধরার ব্যবসা করে।

ভুবন দাস বলল, সাপ ধরার ব্যবসা মানে? সাপুড়ে?

কাকাবাবু বললেন, না, না। সাপ ধরে সাপের বিষ বের করে। সেই বিষ বিক্রি হয়।

কুমার সিং বলল, সাপের বিষ বের করা সোজা নাকি? সাপুড়েরা ছাড়া অন্য কেউ পারে না। এখানে একটা লোক সাপ ধরে বেড়াচ্ছে, অথচ আমরা সে-খবর আগে শুনিনি, এ কি হতে পারে?

ভুবন দাস বলল, আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। কাকাবাবু বললেন, ও একা-একা জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়, এ-কথা ঠিক। ওর পকেটে সব সময় নুন থাকে।

কুমার সিং আর ভুবন দাস দুজনেই বেশ অবাক হয়ে গেল। একজন জিজ্ঞেস করল, নুন? তার মানে? পকেটে নুন রাখে কেন?

কাকাবাবু একপলক সন্তুর মুখের দিকে তাকালেন। তারপর হাসতে শুরু করলেন। হাসতে-হাসতে বললেন, তার আমি কী জানি! ও নুন রাখে, আমাদের দেখাল।

ভুবন দাস বলল, নিশ্চয়ই অন্য কোনও মতলব আছে!

প্রসঙ্গটা পালটাবার জন্য কাকাবাবু বললেন, তা হলে আমি একটু তৈরি হয়ে নিই বেরোবার আগে? ওখানে কতক্ষণ লাগবে তা তো জানি না, আমরা কি রাত্তিরের খাবারটা খেয়ে নিয়ে যাব, না, ফিরে এসে খাব?

কুমার সিং বলল, না, না, আমরা এখানে বারণ করে দিয়ে যাচ্ছি। ফিরতে রাত হবে। আপনাদের জন্য বাইরে এক জায়গায় খাবার ব্যবস্থা হয়েছে। আপনাকে সার একটু কষ্ট করে তখন খানিকটা হেঁটে যেতে হবে। সবটা গাড়ি যায় না।

কাকাবাবু বললেন, সে ঠিক আছে। আজ তো পাহাড়ের অনেকটা নীচে নেমে গিয়ে জঙ্গল দেখতে গিয়েছিলাম। খুব একটা অসুবিধে হয়নি।

কাকাবাবু নিজের ঘরে চলে গেলেন। কুমার সিং আর ভুবন দাস এবার দুটো সিগারেট ধরাল। ওরা কাকাবাবুকে খুব সমীহ করে। ওঁর সামনে সিগারেট খায় না।

কুমার সিং সন্তুকে জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগছে, মিঃ সন্তু? সন্তু বলল, খুব ভাল। জায়গাটা দারুণ! খাওয়া-দাওয়ার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো এখানে?

অসুবিধে? বড্ড বেশি-বেশি খাচ্ছি। এখানকার রান্না চমৎকার। আজ দুপুরে মাছ আর মাংস দুরকম হয়েছিল।

আমাদের বলা আছে। যখন যা ইচ্ছে হয় চাইবেন। কোনওরকম লজ্জা করবেন না মিঃ সন্তু। গাড়ির দরকার হলেও খবর দেবেন বেয়ারাকে, গাড়ি এসে যাবে।

পাহাড়ে এসে আমার পায়ে হেঁটে ঘুরতেই ভাল লাগে।

মিঃ রায়চৌধুরীর তো একটা পা খারাপ, ওঁর কষ্ট হবে।

এরা সন্তুকে আপনি আপনি বলে আর মিঃ সন্তু বলে ডাকে, এতে সন্তুর একটু হাসি পায়। কিন্তু সে আপত্তি করেনি। এরা প্রথম থেকেই যত্ন করছে খুব।

কুমার সিং-এর মুখে মস্তবড় গোঁফ, কিন্তু দাড়ি নেই। চেহারা দেখলে মনে হয় মিলিটারির লোক। এ শিখ নয়, মাথায় পাগড়ি নেই, বাংলা বলে ভালই, তবে উচ্চারণে কিছুটা টান আছে। ভুবন দাসের ছোটখাটো, চেহারা, দেখে বাঙালি বলেই মনে হয়, তবে এরও বাংলা উচ্চারণ একটু অন্যরকম। বোধ হয় অনেকদিন এখানে থাকতে-থাকতে উচ্চারণটা বদলে গেছে।

এরা দুজনেই এই হাফলঙে কাঠের ব্যবসা করে।

একটু বাদে সন্তুও ঘরে গিয়ে জামা-প্যান্ট বদলে এল।

সন্ধের পর বেশ শীত পড়ে, গরম জামা সঙ্গে রাখা দরকার।

প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছে, তবে এখনও পুরোপুরি অন্ধকার নামেনি।

কাকাবাবু একটা ওভারকোট গায়ে দিয়ে বেরিয়ে এসে বললেন, ফ্লাস্কে করে চা নিয়ে যেতে হবে। শীতের মধ্যে আমার বারবার চা-তেষ্টা পায়।

বেয়ারাকে বলা হল চা বানিয়ে দিতে।

ততক্ষণ ওরা বাংলোর সামনের বাগানে এসে দাঁড়াল। আকাশের একদিকে বেশ জমাট মেঘ। শেষ সূর্যের আলোতে সামনের একটা পাহাড়ের চূড়া একেবারে লাল হয়ে আছে।

কাকাবাবু কুমার সিং-কে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা তো কাঠের ব্যবসা করেন, এজন্য কি আপনাদের জঙ্গলে যেতে হয়? নাকি অন্য লোকজন যায়, আপনারা শহরে বসে ব্যবসাটা চালান।

কুমার সিং বলল, না, না, আমাদের দুজনকেই রেগুলার জঙ্গলে যেতে হয়। গাছ চিনিয়ে দিতে হয়। অনেক সময় রাত্তিরেও জঙ্গলে থেকে যাই।

কাকাবাবু বললেন, কোথায় থাকেন? জঙ্গলের মধ্যে আপনাদের ঘরটর করা আছে?

কুমার সিং বলল, না, সেরকম কিছু নেই। গাড়িতেই শুয়ে থাকি। ট্রাকের ওপর বিছানা পেতে দিব্যি ঘুমনো যায়।

সন্তু বলল, বাঃ, বেশ তো! আমারও ইচ্ছে করে ওইরকমভাবে জঙ্গলের মধ্যে রাত কাটাতে।

কুমার সিং বলল, এখানে বেশ কিছুদিন থাকুন। একদিন নিয়ে যাব আমাদের সঙ্গে, মিঃ সন্তু। তবে জঙ্গলে কিন্তু মাঝে-মাঝে বাঘ আসে, ভয় পাবেন না তো?

সন্তু বলল, আপনারা দেখেছেন বাঘ?

কুমার সিং বলল, অনেকবার। আমাদের সঙ্গে অবশ্য বন্দুক থাকে। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, বাঘ, মানে লেপার্ড?

কুমার সিং বলল, না, না, লেপার্ডের মতন ছোট জানোয়ার নয়, আসল বাঘ। টাইগার। এখানকার জঙ্গলে অনেক টাইগার আছে। আপনারা আজ দুপুরবেলা খালি হাতে জঙ্গলে গিয়ে ভাল করেননি।

কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, এই জঙ্গলে ভাল্লুক-টাল্লুকও আছে। নাকি?

কুমার সিং বলল, ভাল্লুক? না, না, এদিকে ভাল্লুক দেখতে পাওয়া যায়। ভাল্লুক খুব আছে অরুণাচলের জঙ্গলে। এখানে নেই।

কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

জজসাহেব এখনও ঠায় বসে আছেন বারান্দার একটা চেয়ারে। একটুও নড়ছেন না। ঠিক যেন ধ্যানমগ্ন।

কাকাবাবু কুমার সিং-কে বললেন, বিচারকমশাইকে ডাকব নাকি আমাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য?

ভুবন দাস বলল, থাক না, কী দরকার। বেশি ভিড় বাড়লে হয়তো কিছুই দেখা যাবে না।

সন্তু বলল, উনি কোথাও যেতে চান বলেও তো মনে হয় না। এর মধ্যে চা এসে গেল, সবাই উঠে পড়ল গাড়িতে।

বাংলোটা টিলার ওপর। এখান থেকে যেতে হবে জাটিংগা, নেমে যেতে হবে নীচের দিকে। বর্ষার জন্য রাস্তা তেমন ভাল নয়। জিপটা লাফাচ্ছে অনবরত। অন্ধকার নেমে এসেছে।

পাহাড় ঘুরে-ঘুরে নামতে লাগল গাড়ি। এক সময় আসল রাস্তাটা ছেড়ে একটা সরু রাস্তা ধরল। সে রাস্তাটাও ঢালু, তাই জিপের স্টার্ট বন্ধ করে দেওয়া হলেও গড়িয়ে-গড়িয়ে নামতে লাগল, শুধু জ্বালা রইল হেড লাইট।

কুমার সিং ফিসফিস করে বলল, যাতে গাড়ির আওয়াজ না হয় সেইজন্য, স্টার্ট বন্ধ করে দিয়েছি। এর পর সার, কেউ আর জোরে-জোরে কথা বলবেন না!

একটা ফ্রি ক্রিং শব্দ শোনা গেল তখুনি। হেড লাইটের আলোয় দেখা গেল সামনে-সামনে একটা সাইকেল যাচ্ছে। তাতে বসে আছে পীতাম্বর পাহাড়ী।

জিপটাকে জায়গা দেওয়ার জন্য সাইকেলটা থামল। তারপর অম্বর হাত তুলে চেঁচিয়ে বলল, এই যে, কাকাবাবু, সন্তু, আমি এসে গেছি! কুমার সিং বলল, এই রে, লোকটা খুব জ্বালাবে দেখছি!

আর একটু যাওয়ার পর জিপটাকে থামিয়ে দেওয়া হল একটা গাছের নীচে। ভুবন দাস নিজে আগে নেমে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, মিঃ রায়চৌধুরী, সাবধানে নামবেন। এই জায়গাটা এবড়ো-খেবড়ো, আমার হাত ধরুন।

কাকাবাবু একটা টর্চ জ্বেলে বললেন, না, ঠিক আছে, আমি দেখতে পাচ্ছি।

ভুবন দাস বলল, আপনাকে তো দু হাতে ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে হবে, আমি আলো দেখাচ্ছি। আপনি আমার সঙ্গে-সঙ্গে আসুন।

খুব যত্ন করে সে কাকাবাবুকে জিপ থেকে নামিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলল।

মিনিট-পাঁচেক হাঁটার পর ওরা পৌঁছল একটা সমতল জায়গায়। চারপাশে গাছপালা থাকলেও মাঝখানে কিছুটা ফাঁকা। সেখানে কেউ একটা মশাল। জ্বেলে মাটিতে পুঁতে রেখেছে। মনে হয়, কেরোসিন তেলে ডোবানো কাঠ ও ন্যাকড়া-ট্যাকড়া দিয়ে তৈরি হয়েছে মশালটা, বেশ জোর আলো, ধোঁয়াও বেরোচ্ছে গলগল করে।

মশালটাকে ঠিক মাঝখানে রেখে, বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে দু দিকে মাটির ওপর বসে আছে তিন-চারজন মানুষ। তাদের মধ্যে একজন সাহেব।

কাকাবাবু এক জায়গায় বসে পড়লেন। কাছেই সাহেবটি। তার বয়েস পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি না, মাথার চুল লালচে রঙের। এখন বাতাসে বেশ শীত-শীত ভাব, তবু সে একটা পাতলা গেঞ্জি ও জিক্স-এর প্যান্ট পরে আছে।

কাকাবাবুকে দেখে সে হাতজোড় করে নমস্কার করল, তারপর ইংরেজিতে বলল, আমার নাম কার্ল জরগেন, আমি হাইডেলবার্গ শহর থেকে আসছি।

কাকাবাবু হাসিমুখে ছেলেটির মুখের দিকে তাকালেন। ছেলেটির চোখের রং নীল। মুখখানা শান্ত ধরনের। সে জাতে জার্মান, বেশ রোগা-পাতলা চেহারা। চোখের দৃষ্টিতে খানিকটা লাজুকলাজুক ভাব।

কাকাবাবু ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি সেই অতদূর জার্মানি থেকে এসেছ? এই জায়গাটার নাম তো বাইরের বেশি লোক জানে না। তুমি কী করে জানলে যে, এখানে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে?

কার্ল আস্তে-আস্তে বলল, এই জাটিংগার পাখিদের কথা আমি প্রথম পড়ি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায়। তারপর আমাদের দেশের পত্রপত্রিকাতেও কিছু খবর বেরিয়েছে। পাখিদের জীবনযাত্রা ও ব্যবহার সম্পর্কে আমার বিশেষ কৌতূহল আছে। এটাই আমার গবেষণার বিষয়। সেইজন্যই আমি এখানে সতিই কী ঘটে তা দেখতে এসেছি।

কাকাবাবু বললেন, তুমি তা হলে একজন অরনিথোলজিস্ট? এখানে উঠেছ। কোথায়?

কার্ল বলল, রেলস্টেশনের পাশে একটা হোটেলে। আটদিন ধরে আমি এখানে আছি।

কুমার সিং বলল, স্টেশনের কাছে তো কোনও হোটেল নেই! মানে, ছোটখাটো আছে বোধ হয়, কিন্তু বিদেশিদের থাকার মতন..

কাকাবাবু বললেন, এরা অনেক কষ্ট করেও থাকতে পারে। আচ্ছা কার্ল, তোমার মুখ থেকেই শুনি, তুমি এখানে কী দেখেছ এ পর্যন্ত? আমরা পরশু এসে পৌঁছেছি, কিন্তু সেদিন খুব ক্লান্ত ছিলাম, তাই এখানে আর আসিনি। কাল সন্ধে থেকেই বৃষ্টি পড়ল, এরা সবাই বলল, বৃষ্টির দিনে কিছু দেখা যায় না। তুমি কি একদিনও কিছু দেখেছ?

কার্ল বলল, আমি এখানে প্রত্যেকদিন এসে বসে থাকি। বৃষ্টি না থাকলেও এক-একদিন কিছুই ঘটে না। শুধু একদিনই সেই আশ্চর্য ব্যাপারটা দেখেছিলাম!

কাকাবাবু বললেন, কী সেই আশ্চর্য ব্যাপার?

কার্ল হেসে বলল, আজ বৃষ্টি নেই। একটু পরে হয়তো আপনি নিজেই সেটা দেখতে পাবেন।

মশালটা এখনও দাউদাউ করে জ্বলছে। আর-একজন কে যেন একটু দূরে আর-একটা মশাল পুঁতে দিল। কাকাবাবুরা বসে আছেন সেই মশাল থেকে বেশ খানিকটা দূরে, অন্ধকারে তাঁদের দেখা যাচ্ছে না। কাকাবাবু ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে চুমুক দিতে লাগলেন।

কথা বলছে না কেউ। কেটে গেল পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, পনেরো মিনিট।

অম্বর হঠাৎ বলে উঠল, এ যে দেখছি ধৈর্যের পরীক্ষা! কুমার সিং বলল, চুপ, চুপ!

অম্বর তাকে গ্রাহ্য না করে বলল, আকাশে কোনও পাখি দেখা যাচ্ছে না। কাছাকাছি কোনও বড় গাছও নেই।

কাকাবাবু তার দিকে চেয়ে শুধু দু বার মাথা নাড়লেন। অর্থাৎ তিনি বুঝিয়ে দিলেন, তিনিও এখন কোনও কথা বলতে চান না।

অম্বর চুপ করে থাকার পাত্র নয়। সে এবার সন্তুর দিকে ফিরে বলল, রাত্তিরে কি কোনও পাখি ওড়ে?

সন্তু ফিসফিস করে বলল, প্যাঁচা, বাদুড়, বুনো হাঁস।

ঠিক তক্ষুনি ঝটাপটঝটাপট ও ধপাস করে শব্দ হল।

কোনও মশালের ঠিক ওপরে নয়, একটু দূরে একটা পাখি এসে পড়েছে। ছোটখাটো পাখি নয়, প্রায় হাঁসের মতন। পাখিটা পড়েছিল মুখ থুবড়ে, সোজা হয়ে দাঁড়াল। এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল।

কিন্তু পাখিটাকে ভাল করে দেখার আগেই পেছনের অন্ধকার থেকে দু-তিনজন লোক ছুটে এল। তাদের হাতে লাঠি। তাদের একজন পাখিটাকে জাপটে ধরেই আবার দৌড়ে মিলিয়ে গেল অন্ধকারের মধ্যে।

কার্ল দারুণ বিরক্তভাবে বলল, ওঃ গড! আবার সেই ব্যাপার!

কাকাবাবু অবাক হয়ে বললেন, কী হল? ওই লোকগুলো এল কোথা থেকে?

কার্ল বলল, এই লোকগুলো লুকিয়ে থাকে। আমাদের ভাল করে দেখতেই দেয় না। ওরা পাখিগুলো ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে মাংস খায়। মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি এটা আটকাতে পারেন না?

কাকাবাবু তাকালেন কুমার সিং-এর দিকে।

কুমার সিং বলল, গ্রামের লোকদের আমরা আটকাব কী করে? পাখি তো কারও সম্পত্তি নয়। যে আগে ধরতে পারবে তার?

কার্ল বলল, আগুনের কাছাকাছি এসে পাখিগুলো কী করে সেটা আমি দেখতে চাই। এরা কিছুতেই দেখতে দেবে না!

অম্বর বলল, সত্যিই তা হলে পাখি পড়ে এখানে? আমি আগে বিশ্বাস করিনি। এখানকার লোকেরা পাখি শিকার করে খায়। ওরা ছাড়বে কেন?

আবার একটা পাখি এসে পড়ল। এবার প্রায় মশালের ওপরে। কিন্তু পাখিটা কঁক করে একটা শব্দ করে আগুন থেকে দূরে সরে গেল। একবার লাফাবার চেষ্টা করেও পারল না।

এবারও অন্ধকার থেকে ছুটে এল কয়েকটা লোক। একজন পাখিটাকে ধরার আগেই অন্য একজন পাখিটার গায়ে একটা লাঠির ঘা মেরে কী যেন বলে উঠল চেঁচিয়ে। অর্থাৎ, সে পাখিটাকে আগে ছুঁয়ে দিয়েছে। এটার ওপর তারই অধিকার।

কার্ল আবার বলে উঠল, আমাদের দেশ হলে এই লোকগুলোকে পুলিশ দিয়ে আটকে রাখা যেত। এরা পাখিগুলোকে ধরে-ধরে খেয়ে ফেললে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হবে কী করে?

অম্বর বলল, আমারই তো একটা ধরতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে, এই পাখির মাংস বেশ টেস্টফুল হবে!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, অন্য সময় এই ধরনের পাখি এখানে দেখতে পাওয়া যায় না?

অম্বর বলল, না, আমি দেখিনি।

কার্ল বলল, পাখিগুলো কোথা থেকে আসে, তা কেউ বলতে পারে না। রাত্রে মশাল জ্বাললে এখানে এসে ধূপ-ধপ করে পড়ে।

কাকাবাবু বললেন, এরা আগুন দেখে আত্মহত্যা করতে আসে?

কার্ল বলল, আগুন দেখলে অনেক পোকা আসে। কিন্তু পাখিরা মরতে আসে, এমন শোনা যায়নি। তার চেয়েও আশ্চর্যের কথা, শুধু এই জায়গাটাতে আগুন জ্বাললেই পাখিগুলো আসে। এখান থেকে আধ মাইল দূরে গিয়ে আগুন জ্বালুন, একটাও পাখি পড়বে না।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক এক জায়গাটাতেই আলো দেখে ওদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়, নাকি?

কার্ল বলল, শুধু এই জায়গার আলো ওদের চোখ ধাঁধাবে কেন? অন্য জায়গায় আলো জ্বললে তো ওদের কোনও অসুবিধে হয় না। ছোটখাটো পাখিও নয়, বড় পাখি, অনেকটা উঁচু দিয়ে উড়তে পারে, ওরা ইচ্ছে করে আগুনের কাছে আসবে কেন?

কাকাবাবু বললেন, প্রকৃতির মধ্যে যে কতরকম বিস্ময়ই আছে! এখনও আমরা অনেক রহস্যই বুঝতে পারি না। মেক্সিকোর উপসাগরে একসময় হাজার-হাজার তিমি মাছ ডাঙায় উঠে আত্মহত্যা করতে এসেছিল। একসঙ্গে অত তিমি মাছের আত্মহত্যা করার ইচ্ছে হয়েছিল কেন, কে জানে!

কার্ল বলল, সমুদ্র দিয়ে আজকাল সব সময় বড় বড় পেট্রোলের ট্যাঙ্কার যায়। সেইসব জাহাজ থেকে অনেক সময় পেট্রোল জলে পড়ে যায়। সমুদ্রের জলে পেট্রোল ভাসলে শুধু তিমি মাছ নয়, সবরকম জলজ প্রাণীর খুব কষ্ট হয়। তারা নিশ্বাসের অক্সিজেন পায় না। মানুষের এই অত্যাচারের বিরুদ্ধেই বোধ হয় তিমি মাছেরা প্রতিবাদ জানাতে চায়।

আবার শূন্যে ডানা ঝটপট ঝটপট শব্দ হল। আর-একটা পাখি পড়ছে। সেটা মাটি ছোঁয়ার আগেই কার্ল বিদ্যুৎগতিতে ছুটে গেল। লুফে নিল পাখিটাকে।

অন্ধকার থেকে তিন-চারজন লোকও ছুটে এসেছে। তারা লাঠি দিয়ে পাখিটাকে মারবার চেষ্টা করল। কার্ল ততক্ষণে পাখিটা তার জামার মধ্যে ঢুকিয়ে দু হাত দিয়ে আড়াল করেছে। একটা লাঠির ঘা পড়ল তার পিঠে।

কার্ল লোকগুলোকে বলল, আমায় মারছ কেন ভাই? আমার মাংস তো তোমরা পুড়িয়ে খেতে পারবে না।

কার্ল দৌড়ে চলে এল কাকাবাবুর কাছে, লোকগুলোও তাড়া করে এল তাকে।

কার্ল ব্যাকুলভাবে বলল, মিঃ রায়চৌধুরী, আমাকে হেল্প করুন।

কাকাবাবু সেই পাহাড়ি লোকদের ভাষা জানেন না। তিনি কুমার সিংকে বললেন, আপনি এদের বলুন, এই সাহেব এই পাখিটাকে আগে ধরেছে। এটার ওপর সাহেবেরই অধিকার। ওটা কেড়ে নিতে চাইছে কেন? তা হলে কিন্তু আমিও বাধা দেব।

কুমার সিং লোকগুলোকে ধমকে তাড়িয়ে দিল।

এদিকটায় অন্ধকার বলেই পাখিটা দারুণ ছটফট করছে।

কার্ল কাকাবাবুকে বলল, আপনি এই পাখিটাকে জোরে চেপে ধরুন তো।

কাকাবাবুর হাতে পাখিটা দিয়ে সে পকেট হাতড়াতে লাগল। সন্তু আর কুমার সিং দুখানা টর্চ জ্বালল, তবু পাখিটাকে ভাল করে দেখা যাচ্ছে না, সে এমনই ছটফট করছে।

কার্ল পকেট থেকে একটা ছোট্ট তামার চাকতি বের করল, তাতে রাবার ব্যান্ড লাগান। সে পাখিটার একটা পা ধরে তাতে চাকতি আটকে দিল। তারপর কাকাবাবুর হাত থেকে পাখিটা নিয়ে সে পেছনদিকে খানিকটা ছুটে গিয়ে তাকে জোরে ছুঁড়ে উড়িয়ে দিল আকাশে।

নিজের জায়গায় আবার ফিরে এসে কার্ল কাকাবাবুকে বলল, আমি দেখতে। চাই এই পাখিটাই আবার ফিরে আসে কি না?

কাকাবাবু বললেন, এটা একটা ভাল এক্সপেরিমেন্ট।

অম্বর বলল, এর পরের পাখিটাকে আমি ধরব। এখানকার লোকের কি বিশ্বাস জানেন? একদিন এখানে একটা সোনার পাখি পড়বে।

কাকাবাবু হেসে বললেন, সোনার পাখি?

অম্বর বলল, গ্রামের আদিবাসীরা সেই কথা বলাবলি করে। এখানে তো এই জাতের পাখি নেই। এগুলো আকাশ থেকে পড়ে। আকাশ থেকেই যখন পড়ছে তখন একদিন না একদিন স্বর্গ থেকে একটা সোনার পাখিও নেমে আসবে নিশ্চয়ই!

কুমার সিং নাক দিয়ে একটা শব্দ করে বলল, হুঁ। যতসব বাজে কথা!

অম্বর তবু ইয়ার্কির সুরে বলল, কে বলতে পারে, হয়তো এর পরেরটাই। সোনার পাখি হবে?

কিন্তু অম্বরের আশা পূর্ণ হল না।

হঠাৎ ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি নেমে গেল। প্রায় হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি যাকে বলে। কাকাবাবু আর সন্তু দুজনেই রেইন কোট এনেছে, গায়ে দিয়ে নিল তাড়াতাড়ি।

কার্ল বলল, আকাশ মেঘে ছেয়ে গেছে, আর আশা নেই। জাটিংগার পাখিরা একটু বৃষ্টি হলে আর আসে না।

কাকাবাবু বললেন, বৃষ্টিতে মশালের আগুন দেখা যায় না।

বৃষ্টির ফোঁটা মশালের আগুনের ওপর পড়ছে আর ছ্যাঁক-ছ্যাঁক শব্দ হচ্ছে। একটুক্ষণের মধ্যেই দুটো মশালই নিভে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক।

কার্ল বলল, আগের দিন গ্রামের লোকদের সামনে আমি পাখি ধরতে সাহস করিনি। আজ আপনারা ছিলেন বলেই আমি এক্সপেরিমেন্টটা করতে পারলাম। কাল দেখতে হবে ওই পাখিটা ফিরে আসে কি না। আপনারা কাল আসবেন।

কাকাবাবু বললেন, নিশ্চয়ই আসব!

কুমার সিং বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কাল আমরা সবাই আবার আসব।

কাকাবাবু বললেন, ক্যামেরায় ছবি তুললে হত। সন্তু, তুই ক্যামেরাটা আনতে ভুলে গেছিস আজ।

সন্তু লজ্জা পেয়ে বলল, একদম মনেই পড়েনি।

কুমার সিং বলল, আমি মনে করিয়ে দেব। আমারও ক্যামেরা আছে।

তারপর কুমার সিং কাকাবাবুকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বলল, সার, আজ তো আর এখানে বসে থেকে লাভ নেই। চলুন, এবারে আমরা খেতে যাই। খানিকটা দূরে যেতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, যাওয়া যাক। আচ্ছা, ওই জার্মান ছেলেটিকে সঙ্গে নিতে পারি না? ওকে আমার বেশ ভাল লেগেছে। ওর কাছ থেকে এই পাখিদের বিষয়ে আরও অনেক কিছু জানা যেত।

কুমার সিং বলল, সেটা আমাদের মালিক ঠিক পছন্দ করবেন না।

কাকাবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মালিক? মালিক আবার কে?

কুমার সিং একটু থতমত খেয়ে বলল, মালিক মানে আমাদের এক বন্ধু। তার নাম মালিক। এখানকার একজন বড় ব্যবসায়ী। সে আপনাকে আর মিস্টার সন্তুকে নেমন্তন্ন করেছে নিজের বাড়িতে। সেখানে অন্য তোক নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। তা ছাড়া এই জামান সাহেবের সঙ্গে তো আপনার কালকে দেখা হবেই।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, তা হলে চলুন।

কাকাবাবু কার্লের কাছে বিদায় নিলেন। অম্বরকে কিছু বলার আগেই সে বলল, আপনারা এখন কোথায় যাচ্ছেন? আমি যেতে পারি আপনাদের সঙ্গে?

কুমার সিং বলল, আমরা অনেক দূরে যাব। আমাদের নেমন্তন্ন আছে।

কাকাবাবুরা এসে আবার জিপে উঠলেন। এবারে জিপটা উঠতে লাগল ওপরের দিকে। খাড়া রাস্তা। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। চতুর্দিকে অন্ধকার। জঙ্গল থেকে একটা সোঁদা-সোঁদা গন্ধ আসছে।

কাকাবাবু সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, কীরকম দেখলি? কিছু বুঝতে পারলি?

সন্তু বলল, রাত্তিরবেলা অত বড়-বড় পাখি আকাশ থেকে পড়ছে, এটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। তুমি কিছু কারণ খুঁজে পেলে?

কাকাবাবু বললেন, আরও কয়েকটা দিন দেখতে হবে। এখনও কিছু ধরা যাচ্ছে না।

মিনিট পনেরো চলার পর জিপটা থামল। কুমার সিং বলল, আর গাড়ি যাবে না। এখান থেকে একটু হাঁটতে হবে। বেশি না, মিনিট পাঁচেক। আমাদের বন্ধুর বাড়িটা একটা পাহাড়ের একেবারে চূড়ায়। গেলে দেখবেন খুব সুন্দর লাগবে।

কাকাবাবুরা গাড়ি থেকে নামলেন। ভুবন দাস টর্চ জ্বেলে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। গাড়ির ড্রাইভারও এবার আসছে সঙ্গে। কাকাবাবু একবার হোঁচট খেতেই কুমার সিং তাকে ধরে ফেলে বলল, ইস, লাগল নাকি? কাকাবাবু বললেন, না, কিছু হয়নি!

ভুবন দাস বলল, ডান পাশটা সাবধান। ওদিকে খাদ। আপনি সার, বাঁ দিক ঘেঁষে চলুন।

সন্তুর হাতেও একটা টর্চ। সে ডান দিকে আলো ফেলে বলল, ওরে বাবা, বেশ গভীর খাদ, তলা দেখা যাচ্ছে না।

কুমার সিং বলল, হ্যাঁ। এই খাদটা খুব গভীর।

একপাশে খাড়া পাহাড়, আর একদিকে খাদ, মাঝখানে সরু পথ। এদের পায়ের আওয়াজ ছাড়া আর কোথাও কোনও শব্দ নেই। খানিকক্ষণ হাঁটার পর। মনে হল, ওপর থেকে কোনও বড় জন্তু বা পাথর গড়িয়ে পড়ল নীচের রাস্তায়। ধুপ করে আওয়াজ হল।

কাকাবাবু বললেন, ওটা কী? কুমার সিং বলল, ও কিছু না। ব্যস, আর যেতে হবে না। এইখানেই! কুমার সিং পেছন ফিরে কাকাবাবুর মুখখামুখি দাঁড়াল। ভূবন দাসের টর্চের আলোয় দেখা গেল কুমার সিং-এর হাতে একটা রিভলভার চকচক করছে।

ভুবন দাস কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কুমার, এখন থাক।

কুমার সিং কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে বলল, শাট আপ! রায়চৌধুরী, এবার তোমার খেলা শেষ!

কাকাবাবু দারুণ অবাক হয়ে বললেন, এ কী ব্যাপার? আমার সঙ্গে মজা করছেন নাকি? আমার দিকে ওরকম রিভলভার খেলাচ্ছলেও তুলতে নেই। আমি পছন্দ করি না।

কুমার সিং অন্য হাতে কাকাবাবুর মুখে একটা খুঁসি চালাতে কাকাবাবু সেই

উদ্যত মুষ্টিটাকে ধরে ফেলার চেষ্টা করেও পারলেন না।

পেছন থেকে কে যেন হ্যাঁচকা টানে কাকাবাবুর ক্রাচ দুটো কেড়ে নিল। কাকাবাবু টাল সামলাতে পারলেন না। হাত দুটো ব্যবহার করার আগেই কেউ তাঁর হাত দুটো পেছনে মুড়ে নিয়ে শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল। সেই সঙ্গে-সঙ্গেই আর-একজন একটা গামছাজাতীয় জিনিস দিয়ে বেঁধে ফেলল তাঁর মুখ। কাকাবাবু কোনওরকম বাধা দেওয়ার সুযোেগই পেলেন না।

কুমার সিং কাকাবাবুর কোমরে খুব জোরে একটা লাথি কষিয়ে বলল, যা, এবার পাতালে যা!

কাকাবাবু ছিটকে পড়ে গেলেন খাদের দিকে।