০১. সন্তুকে ছোট্ট একটা ধাক্কা

সন্তুকে ছোট্ট একটা ধাক্কা দিয়ে কাকাবাবু বললেন, এই, তুই ঘুমোচ্ছিস? দ্যাখ, দ্যাখ, আমরা এসে গেছি।

সন্তু চোখ মেলে তাকিয়ে একটুক্ষণ ভ্যাবাচ্যাক খেয়ে গেল। কয়েক মুহূর্তের জন্য তার মনেই পড়ল না, সে কোথায় রয়েছে। সে সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিল, একটা স্বপ্ন দেখছিল। সে যেন ফিরে গেছে আন্দামানে, সমুদ্রের ওপর দিয়ে যাচ্ছে একটা মোটর-বোটে, দু পাশে গাঢ় নীল জল, মাঝে-মাঝে ঢেউয়ের মাথায় লাফিয়ে উঠছে চড়াইপাখির মতন। উড়ুকু মাছ-পাশেই একটা বড় দ্বীপ, ঘন জঙ্গলে ভরা, মোটর-বোটের আওয়াজ শুনে সেই জঙ্গল ভেদ করে ছুটে এল জারোয়ারা, হাতে তাদের তীরধনুক…তারা সন্তুকে চিনতে পেরেছে, শুধু তাই নয়, তারা বাংলাও শিখে গেছে, তারা সবাই মিলে হাত তুলে ডাকছে, সন্তু, এসো, এসো, কোনও ভয় নেই, এখানে এসো…

দু হাতে চোখ ঘষে ভাল করে তাকিয়ে সন্তু আবার দেখল, কোথায় আন্দামানের সমুদ্র? সে বসে আছে একটা প্লেনে, জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে নীল আকাশ। পাশের সিটে বসে আছেন কাকাবাবু, তিনি কী যেন বলছেন, সন্তু ভাল শুনতে পাচ্ছে না।

কাকাবাবু এত কাছ থেকে কথা বলছেন, তবু সন্তু বুঝতে পারছে না কেন? প্লেন চলার শব্দও তার কানে আসছে না। তার কানের মধ্যে ঢুকে পড়েছে অনেকখানি বাতাস।

কাকাবাবু তার অবস্থাটা বুঝতে পেরে হেসে বুকে এসে সন্তুর নাকটা চেপে ধরলেন, তারপর তার মাথায় মারলেন একটা চাপড়। তাতে ভুস করে তার কান থেকে যেন খানিকটা হাওয়া বেরিয়ে গেল, অমনি সে শুনতে পেল প্লেনের গর্জন।

কাকাবাবু বললেন, সিট-বেল্ট বেঁধে নে। একটু বাদেই আমরা পৌঁছে যাব।

এতক্ষণে সন্তুর সব মনে পড়ে গেছে। সিট-বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে সে ঝুঁকে পড়ল জানলার কাচের ওপর। ইশ, কতটা সময় সে ঘুমিয়ে নষ্ট করেছে কে জানে! কিন্তু একটা সময় কিছুই দেখার ছিল না, শুধু মেঘ। আর মেঘ, ধপধপে সাদা দুধ-সমুদ্রের মতন মেঘ। সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যেন আপনাআপনি চোখ বুজে এসেছে।

প্লেনটা বিমানবন্দরের ওপর দিয়ে ঘুরছে, গতি কমে এসেছে, এক্ষুনি ল্যান্ড করবে। সন্তু আনন্দমেলায় একটা লেখাতে পড়েছিল যে, একবার এই নাইরোবি এয়ারপোর্টেই দুটো সিংহ এসে ঢুকে বসে ছিল। তা হলে কাছেই নিশ্চয়ই ঘন জঙ্গল আছে। কিন্তু সন্তু জানলা দিয়ে কোনও জঙ্গল দেখতে পেল না, শহরের উঁচু-উঁচু বাড়ি, আর শহরের বাইরে বিশাল ধু-ধু করা মাঠ চোখে পড়ে, তার মধ্যে-মধ্যে ছোটখাটো ঝোপঝাড়। তা হলে এখানে সিংহ এসেছিল। কোথা থেকে?

প্লেন যখন আকাশ দিয়ে চারশে-পাঁচশো মাইল স্পিড়ে যায়। তখন গতিবেগটা কিছুই বোঝা যায় না, কিন্তু নামবার সময় যখন স্পিড অনেক কমে আসে তখন মনে হয় কী প্ৰচণ্ড জোরে ছুটছে! মাটিতে নামার পর এক মিনিটে অনেকখানি দৌড়ে গিয়ে হঠাৎ প্লেনটা শান্তশিষ্ট হয়ে যায়।

সিট-বেল্ট খুলে সবাই যখন নামবার জন্য উঠে দাঁড়াল, তখন কাকাবাবু বললেন, তোর হ্যান্ডব্যাগ থেকে সোয়েটারটা বার করে নে, সন্তু। বাইরে বেরোলে শীত করবে।

আফ্রিকার নাম শুনলেই মনে হয় খুব গরম দেশ। তা ছাড়া এখন মে মাস। কিন্তু কাকাবাবু আগেই বলে রেখেছিলেন যে, কেনিয়া দেশটা ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা। গ্ৰীষ্মকালেও একটু বৃষ্টি হবার পরেই শীত করে।

সন্তুরা প্লেনে চেপেছে বম্বে থেকে। সেখানে অসহ্য গরম। মা যদিও সন্তুর সুটকেসে নতুন-বানানো একজোড়া প্যান্ট-কোট ভরে দিয়েছেন, কিন্তু বম্বেতে সেসব পরার প্রশ্নই ওঠে না। সন্তুর ধারণা ছিল, প্লেনে সবাই খুব সাজগোজ করে ওঠে, কিন্তু এই প্লেনে বিদেশিরা প্ৰায় সবাই পাতলা শার্ট গায়ে দিয়ে আছে, কেউ-কেউ পরে আছে স্রেফ গেঞ্জি। ভারতীয়রা যদিও অনেকেই বম্বে এয়ারপোর্টে সুন্ট-টাই পরে ঘেমেছে। কাকাবাবুর কথায় সন্তু অবশ্য এমনি প্যান্ট-শার্ট পরে এসেছে। একটা সোয়েটার রেখেছে সঙ্গের হ্যান্ডব্যাগে।

কাকাবাবু ক্রাচ বগলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। অন্য সবাই না নেমে গেলে তাঁর পক্ষে যাওয়ার অসুবিধে। পেছন থেকে একজন যাত্রী এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি যান। আপনার ব্যাগটা আমাকে দিন।

কাকাবাবু আপত্তি করার আগেই লোকটি কাকাবাবুর ব্যাগটি তুলে নিয়ে অন্য যাত্রীদের আটকে রাখল। এই সব অযাচিত সাহায্য কাকাবাবু পছন্দ করেন না। কিন্তু এখন কথা বাড়াতে গেলে অন্যদের আরও দেরি হয়ে যাবে। তিনি চুল্লিতে শুরু করলেন।

সন্তু লক্ষ করল, লোকটির নিজের ব্যাগ আর কাকাবাবুর ব্যাগটা অবিকল একরকম। দুটোই কালো রঙের, একই সাইজের। কাকাবাবুর ব্যাগে অবশ্য তাঁর নাম লেখা আছে। তবু সন্তুর সন্দেহ হল, লোকটি কাকাবাবুর ব্যাগটা বদলে নেবে না তো? লোকটি কাকাবাবুর ব্যাগটা বাঁ হাতে নিয়েছে, সে তীক্ষ্ণ নজর রাখল। সেদিকে।

লোকটি বেশ লম্বা, গায়ের রং ফর্সা, মাঝারি বয়েসি, একটা চকলেট রঙের সুট পরা। মাথার চুল এত বড় যে, ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে।

প্লেন থেকে নেমে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে তো চিনতে পারলুম না।

লোকটি বলল, আমাকে আপনি চিনবেন কী করে? তবে আপনাকে আমি চিনি। আমার নাম লোহিয়া, পি. আর. লোহিয়া, আমি এখানে ব্যবসা করি। আপনি বিশেষ কোনও কাজে এসেছেন নিশ্চয়ই?

কাকাবাবু বললেন, না, এমনিই বেড়াতে এসেছি।

লোকটি বলল, বেড়াবার পক্ষে বেশ ভাল জায়গা। তবে, আপনার মতন ব্যস্ত লোক তো কোথাও এমনি-এমনি বেড়াতে যায় না। আশা করি ওয়েদার ভাল পাবেন।

তারপর সন্তুর দিকে ফিরে বলল, নাউ, ইউ হোন্ড দ্য ব্যাগ।। আই মাস্ট হারি।

কাকাবাবু বললেন, ধন্যবাদ।

লোকটি বলল, হয়তো আবার দেখা হয়ে যাবে। ছোট জায়গা তো!

সন্তুর হাতে ব্যাগটা দিয়ে সে হনহন করে এগিয়ে ভিড়ে মিলে গেল।

সন্তু ব্যাগটা ভাল করে দেখল। কাকাবাবুর নাম লেখা আছে ঠিকই। নাঃ, শুধু শুধু সব লোককে সন্দেহ করা তার একটা বাতিক হয়ে যাচ্ছে। লোকটি ভদ্র এবং পরোপকারী।

কাস্টমস, চেকিং পার হতেই সন্তু দেখতে পেল দুজন ভদ্রলোক আর একজন ভদ্রমহিলা ওদেরই দিকে হাসি-হাসি মুখে তাকিয়ে হাত নাড়ছেন। তাদের একজনকেও সন্তু চেনে না। কাকাবাবুর মুখে সে শুনেছিল যে, এয়ারপোর্টে একজন লোক তাদের নিতে আসবে, সেই লোকটি কাকাবাবুর নাম লেখা একটা বোর্ড উঁচু করে ধরে থাকবে। সেইরকম অনেকেই নানান নাম লেখা বোর্ড হাতে তুলে আছে কিন্তু এই তিনজনের কাছে সে-রকম কিছু নেই।

গেটের কাছ থেকেই একজন জোরে বলে উঠল, কাকাবাবু, সন্তু, ওয়েলকাম টুনাইরোবি?

কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, কী ব্যাপার বল তো! আজিকাল বড় বেশি লোক আমাকে চিনে ফেলেছে! এখানে আমাকে কেউ কাকাবাবু বলে ডাকবে, ভাবতেই পারিনি!

সেই যুবকটি সন্তু আর কাকাবাবু দুজনেরই ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে বাংলায় বলল, আমাকে দিন। আমার নাম অমল, আর ওই যে আমার স্ত্রী মঞ্জু। আর ইনি মিঃ ধীরুভাই, ইনি আপনার এখানকার হোস্ট। ধীরুভাই আমাদের প্রতিবেশী, ওঁর মুখে যখন শুনলুম যে, আপনারা আসছেন, তখন আর এয়ারপোর্টে আসার লোভ সামলাতে পারলুম না। এখানে বাঙালি তো বিশেষ আসে না।

ধীরুভাই বেশ বয়স্ক মানুষ, মাথার চুল কাঁচাপাকা, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। প্যান্ট-শার্টের ওপর একটা জহরকোট পরে আছেন। তিনি কাকাবাবুর দিকে প্রথমে হাত তুলে নমস্কার করলেন। তারপর আবার কাকাবাবুর একটা হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, প্লেন একেবারে রাইট টাইমে এসেছে। আপনাদের কোনও কষ্ট হয়নি নিশ্চয়ই?

কাকাবাবু বললেন, কিছুমাত্র না।

বাইরে ওদের সঙ্গে দুখানা গাড়ি রয়েছে। দুটোই জাপানি গাড়ি। ঝকঝকে রোদ উঠেছে, আকাশে এক ছিটে মেঘ নেই, একটু ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, এখানে একটুও গরম নেই দেখছি।

অমল বলল, আপনাদের জন্য চমৎকার ওয়েদার ফিট করে রেখেছি, যাতে আপনাদের একটুও অসুবিধে না হয়।

গোলাপি রঙের শাড়ি পরা মঞ্জু বলল, আপনাদের জন্য তো হোটেল ঠিক করা আছে, কিন্তু আপনারা আমাদের বাড়িতে থাকবেন? তা হলে আমরা খুব খুশি হব। আমরা আপনাদের ডাল-ভাত-মাছের ঝোল খাওয়াতে পারব, হোটেলে সেসব পাবেন না।

ব্লু জিনস আর হলদে গেঞ্জি পরা অমল বলল, আপনারা এসেছেন, আমি অফিস থেকে ছুটি নেব। যেখানে যেতে চাইবেন আমি গাইড হয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে পারি।

কাকাবাবু বললেন, এঁরা যখন আমাকে নিয়ে এসেছেন, তখন আগে এঁদের হোটেলেই উঠি। পরে একসময় আপনাদের বাড়ি যাওয়া যাবে।

অমল দু হাত নেড়ে বলল, ওসব আপনি-টাপনি চলবে না। আমাদের তুমি বলবেন।

মঞ্জু বলল, আমরা দুজনেই আপনার খুব ভক্ত।

অমল তার স্ত্রীকে বলল, মঞ্জু, তুমি ক্যামেরা আনোনি? তা হলে সন্তু আর কাকাবাবুর পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের একটা ছবি তুলে রাখতুম।

মঞ্জু বলল, এত ব্যস্ত হচ্ছে কেন, পরে ছবি তোলবার অনেক সময় পাওয়া যাবে। ন্যাশনাল পার্কে গিয়ে…

অমল সন্তুর কাঁধে হাত রেখে বলল, কাকাবাবু তো হোটেলে যেতে চাইছেন। তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে? চলো না, অনেক গল্প শুনব তোমার কাছে।

সন্তু বলল, আমিও পরে যাব।

ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কাকাবাবু আর সন্তু উঠে পড়ল। ধীরুভাইয়ের গাড়িতে। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে অমল আবার সন্তুকে বলল, হোটেলে গিয়ে খানিকটা বিশ্রাম করে নাও, আমরা একটু পরে আসছি। তারপর বেড়াতে বেরোব। আজই তোমাকে সিংহ দেখাব।

নতুন দেশে এলে গলাটা কেমন শুকনো-শুকনো লাগে। অমল আর মজুর আপনি-আপন ভাব আর বাংলা কথা শুনে ভাল লাগল তবু কিছুটা।

এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে, অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে গাড়ি এসে ঢুকাল নাইরোবি শহরে। বেশ চওড়া-চওড়া রাস্তা, পরিচ্ছন্ন আর উঁচু-উঁচু বাড়ি। সন্তুর মনে হল, সিনেমায় দেখা বিলিতি-বিলিতি শহরের মতন অনেকটা। রাস্তায় আলো, মানুষজন যেমন আছে, তেমনি রয়েছে অনেক ভারতীয়, শাড়ি-পরা মহিলাদের দূর থেকেই চেনা যায়, আবার বেশ কিছু সাহেব-মেমও রয়েছে।

গাড়ি এসে থামল হিলটন হোটেলের সামনে। গাড়ি চালাচ্ছিল একজন সাদা পোশাক পরা ড্রাইভার, সে তাড়াতাড়ি আগে নেমে দরজা খুলে দিল কাকাবাবুদের জন্য।

ধীরুভাই বললেন, এই হোটেলে আমাদের একটা সুইট নেওয়া আছে পাকাপাকিভাবে। আমাদের কোম্পানির ডিরেক্টাররা এসে থাকেন। তা ছাড়া সারা বছরই কোনও না কোনও অতিথি আসে। পাঁচ নম্বর ফ্লোরে পাঁচ নম্বর সুইট। আপনাদের আশা করি কোনও অসুবিধে হবে না। হোটেলে কোনও কিছুর জন্যই আপনারা পয়সা খরচ করবেন না। এমনকী ট্যাক্সি বা সিনেমার টিকিট চাইলেও হোটেল থেকে ব্যবস্থা করে দেবে। আপনারা শুধু বিলে সই করবেন। তা ছাড়া, আমি তো আছিই। যে-কোনও সময় দরকার হলেই আমাকে ডেকে পাঠাবেন।

একটি বেলবয় এসে ওদের সুটকেস দুটো তুলে নিতেই ধীরুভাই তাকে বললেন, ফাইভ জিরো ফাইভ।

বেলবয়টি মাথা নেড়ে একগাল হেসে বলল, আই নো, আই নো?

ভেতরে কাউন্টারে এসে খানিকটা কথা বলে ধীরুভাই বিদায় নিলেন। কাকাবাবু আর সন্তু লিফটে উঠে এল পাঁচ তলায়।

হোটেলের ঘর আর সুইটের মধ্যে যে কী তফাত তা সন্তু জানত না। ঘর তো হচ্ছে এমনিই একটা শোবার ঘর, আর সুইট মানে হল, দরজা খুলে ঢোকার পর জুতোটুতো রাখার একটুখানি জায়গা, তারপর বসবার ঘর একটা, তাদের শোবার ঘর, পোশাক পালটাবার জন্য আর-একটা ছোট ঘর। বিরাট বাথরুম, বারান্দা সব মিলিয়ে যেন নিজস্ব একটা ফ্ল্যাটের মতন। টিভি, ফ্রিজ, কিছু ফল, কোন্ড ড্রিঙ্কস সবই সাজানো রয়েছে।

বেলবয়টি ওদের সুটকেস দুটো এনে গুছিয়ে রেখে, জানলার পর্দাগুলো খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, এখন কিছু চাই স্যার?

ছেলেটি প্রায় সন্তুরই বয়েসি। তার গায়ের রং কুচকুচে কালো, দাঁতগুলো ধপধপে সাদা। তার মুখখানা হাসি-হাসি, দেখতে বেশ ভাল লাগে।

সন্তু তাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী?

সে দু-তিনবার নাম বললেও সন্তু ঠিক বুঝতে পারল না। তারপর সে বানান করে বললে, মাইকেল।

কোথায় কবি মাইকেল আর কোথায় আফ্রিকার এক হোটেলের বেলবয়। দুজনের একই নাম। সন্তু অবাক হয়ে কাকাবাবুর দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, এখানে অনেকেই ক্রিশচান। আর ক্রিশচীনদের মধ্যে মাইকেল নাম খুব কমন। আজকাল শুধু মাইক বলে। ও প্রথমে ওর ডাকনামটাই বলছিল।

ছেলেটি মাথা নেড়ে বলল, ইয়েস, ইয়েস, মাইক, মাইক?

কাকাবাবু বললেন, না মাইক, এখন কিছু লাগবে না। দরকার হলে ডাকব।

সে কাকাবাবুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, টিপস, স্যার!

কাকাবাবু বললেন, আমার কাছে তোমাদের শিলিং নেই। পরে দেব।

মাইক তবু বলল, গিভূমি পাউন্ড, ডলার। নো ইন্ডিয়ান রুপিজ!

কাকাবাবু তাকে একটি ব্রিটিশ পাউন্ড দিলেন, সে থ্যাং ইউ স্যার বলে চলে গেল।।

কাকাবাবু বললেন, চালু ছেলে! এখানকার টাকা হল শিলিং, বুঝলি, আমাদের কিছু টাকা ভাঙিয়ে শিলিং করে রাখতে হবে, নইলে ঠকাবে।

সন্তু জানলার ধারে দাঁড়িয়ে বলল, খুব সুন্দর জায়গা। আমি ভেবেছিলুম, জঙ্গল-টঙ্গলের মধ্যে ছোটখাটো একটা শহর হবে।

কাকাবাবু বললেন, জঙ্গল আবার পাচ্ছিস কোথায়? এখানে সেরকম জঙ্গল তো নেই।

সন্তু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এখানে জঙ্গল নেই? তবে যে এখানে অনেক সিংহ আর অনেক জন্তু-জানোয়ার আছে শুনেছি।

কাকাবাবু বললেন, সিংহ তো জঙ্গলে থাকে না। সিংহ থাকে। মরুভূমিতে কিংবা শুকনো জায়গায়, যেখানে কিছু ঘাস-টাস জন্মায়, যেখানকার মাটির রং সিংহের গায়ের মতন।

সন্তু তবু যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। তার মুখের দিকে তাকিয়ে কাকাবাবু আবার বললেন, অনেক গল্পের বইটইতে ছবি আঁকা থাকে বটে যে, ঘন জঙ্গলের মধ্যে সিংহ হঠাৎ লাফিয়ে এসে মানুষকে আক্রমণ করছে? আসলে সিংহ ফাঁকা জায়গায় থাকতে ভালবাসে, আর চট করে মানুষকে আক্রমণও করে না। এখানে এসেছিস যখন, তখন তুই নিজের চোখেই সিংহ দেখতে পাবি, খুব কাছে গিয়ে দেখবি।

জামার বোতাম খুলতে খুলতে কাকাবাবু বললেন, যাই, স্নানটা সেরে নিই।

সন্তু তুই আগে যাবি নাকি?

সন্তু বলল, না, তুমি করে নাও!

বাথরুমের ভেতরটা একবার উঁকি মেরে আবার বেরিয়ে এসে কাকাবাবু বললেন, কী দারুণ জায়গায় আমাদের রেখেছে রে, সন্তু। এত ভাল হোটেলে আমরা আগে কখনও থেকেছি?

সন্তু হাসি মুখে দুদিকে মাথা নাড়ল।

আমরা এখানে বেশিদিন থাকব না, আর-একটা জায়গায় চলে যাব। সে-জায়গাটা নাকি আরও সুন্দর। ভুলাভাই তো সেই কথাই বলেছে। সেখানে তুই খানিকটা জঙ্গল পেতে পারিস। এবারে ডাকাত-গুণ্ডাদের পেছনে ছোটাছুটি করতে হবে না। কোনও রহস্যের সমাধান করতে হবে না। স্রেফ বেড়ানো আর বিশ্রাম। তোর খিদে পেয়েছে নাকি রে, সন্তু?

না, প্লেনে তো অনেক খাবার দিয়েছিল।

আমি প্লেনের খাবার একদম খেতে পারি না। দাঁড়া, স্নান-টান করে নিই, তারপর বেরিয়ে দেখব, এখানে কী কী নতুন খাবার পাওয়া যায়। জেব্রার মাংসের রোস্ট, ফ্লেমিংগোর কাটলেট, জিরাফের ঝোল, এইসব চেখে দেখতে হবে।

কাকাবাবু বাথরুমের দরজা বন্ধ করার পর সন্তু জানলার একটা কাচ খোলার চেষ্টা করতে লাগল। এয়ারকন্ডিশান্ড ঘর, এখানে বোধহয় কেউ জানিলা খোলে না, তাই জানলাটা একেবারে টাইট হয়ে আটকে আছে। কিন্তু টাটকা হাওয়ায় নিশ্বাস না নিলে সন্তুর ভাল লাগে না।

জানলাটা খুলতে না পেরে সে বারান্দার দরজাটা খুলতে গেল। তক্ষুনি ঝন ঝন করে বেজে উঠল টেলিফোন।

এখানকার টেলিফোনটাও অন্যরকম দেখতে। ঘন দুধের সরের মতন রং। হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি নাকি? রিসিভারটা বেশ ভারী।

রিসিভারটা তুলতেই চিবোনো-চিবোনো ইংরেজিতে খুব সরু গলায় একজন বলল, রায়চৌড্রি? রায়চৌড্রি? ইজ দ্যাট র্যাজা রায়চৌড্রি?

সন্তু বলল, রাজা রায়চৌধুরী বাথরুমে গেছেন। আপনি কে বলছেন?

কল হিম। কল হিম! দিস ইজ ভেরি ইম্পেটন্ট!

আপনি কে বলছেন?

ড্যাম ইট! কল র‍্যাজা রায়চৌড্রি!

সন্তু ভাবল রিসিভারটা রেখে দেবে। কোনও পাগল-টাগল নিশ্চয়ই। বিশেষ দরকার না হলে কাকাবাবু বাথরুমে ডাকাডাকি করা পছন্দ করেন না। এখানে সেরকম বিশেষ দরকার কী হতে পারে? তা ছাড়া লাকটা এরকম বিশ্ৰীভাবে কথা বলছে কেন?

সন্তু বলল, আপনি কে এবং কী দরকার আগে বলুন। নইলে মিঃ রায়চৌধুরীকে এখন ডাকা যাবে না।

তুমি কে? রায়চৌড্রির বেঁটে ভাইপোটা বুঝি?

এবার সন্তুর রাগ হয়ে গেল। সে বেঁটে? এখনই তার হাইট পাঁচ সাড়ে পাঁচ, তার ক্লাসের কেউ তার চেয়ে বেশি লম্বা নয়, আর একটা কোথাকার পাগল তাকে বললে বেঁটে?

সন্তু ফোনটা রেখে দিতে যাচ্ছিল, তক্ষুনি অন্য একটা গলা শোনা গেল। এই গলার আওয়াজটা গভীর। আগের পাগলাটিকে একটা ধমক দিয়ে সরিয়ে দিয়ে সেই গম্ভীর গলার লোকটি বলল, রাজা রায়চৌধুরী বাথরুমে? তা হলে শোনো, তাকে এক্ষুনি একটা জরুরি খবর দিয়ে দিতে হবে। কাল সকালেই বম্বের একটা ফ্লাইট আছে, তাতে চার-পাঁচটা সিট এখনও খালি আছে। তুমি এবং তোমার আংকল কাল সকালেই সেই প্লেনে চলে যাবে। এখান থেকে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কেন, আমাদের কালই চলে যেতে হবে কেন?

কারণ, এই দেশটা তোমাদের পক্ষে সেইফ নয়। রাজা রায়চৌধুরী যখন-তখন খুন হয়ে যেতে পারেন। আমি তোমাদের ভালর জন্যই এই কথা বলছি। আরও একটা কথা, আজ হোটেল থেকে বেরিও না, কাল সকালে সোজা এয়ারপোর্টে চলে যাবে। রাজা রায়চৌধুরীকে এক্ষুনি এই কথা জানিয়ে দাও!

এর পরেই লাইন কেটে গেল, সন্তু তবুও টেলিফোনটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল একটুক্ষণ। এই সব কথার মানে কী? হোটেলে পৌঁছবার পর আধ ঘণ্টাও কাটেনি, এর মধ্যেই কেউ টেলিফোনে তাদের ভয় দেখাচ্ছে? যারা টেলিফোন করল, তারা কি কাকাবাবুকে সত্যি চেনে? যদি চিনত তা হলে তারা ঠিকই জানত যে, এরকম বোকার মতন ভয় দেখিয়ে কাকাবাবুকে কোনও জায়গা থেকে সরানো যায় না।

সন্তুর ঠোঁটে একটা পাতলা হাসি ফুটে উঠল। একটু আগেই কাকাবাবু বললেন, এখানে ডাকাত-গুণ্ডাদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই, এখানে স্রেফ বেড়ানো আর বিশ্রামের জন্য আসা। এ-কথা বলার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই করা যেন হুমকি দিল, এই দেশে কাকাবাবু যখন-তখন খুন হতে পারেন! টেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, এরকম একটা কথা আছে না?