০১. বিকেলবেলা কাকাবাবু বাথরুমে

বিকেলবেলা কাকাবাবু বাথরুমে দাড়ি কামাচ্ছেন, সিঁড়ি দিয়ে লাফাতে লাফাতে হন্তদন্তভাবে উঠে এসে সন্তু ডাকল, কাকাবাবু, কাকাবাবু…

আজকাল কাকাবাবু রোজ দাড়ি কামান না। আগে প্রত্যেকদিন সকালে দাড়ি কামিয়ে নিতেন দাঁত মাজার সঙ্গে সঙ্গে। এখন যেদিন বাড়ি থেকে বেরোবার দরকার না থাকে, সেদিন দাড়ি কামানোও বাদ দিয়ে দেন।

কোথাও বেড়াতে গেলে পরপর তিন-চারদিনও মনে থাকে না। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজায়, তাতে হাত বুলিয়ে তিনি মুচকি মুচকি হাসেন।

গোঁফটা অবশ্য একরকমই আছে।

এখানেও তো বেড়াতেই এসেছেন, কোনও কাজ নেই। শুধুই বেড়ানো। তাই তিনদিন তিনি গালে ব্লেড ছোঁয়াননি। তা হলে, আজ বিকেলবেলা দাড়ি কামাতে শুরু করলেন কেন?

কারণ, আজ সন্ধেবেলা রাজবাহাদুর প্যালেসে গান-বাজনার আসর বসবে, সেখানে যেতে হবে। গানের আসরে দাড়ি কামিয়ে, ফিটফাট পোশাক পরে যেতে হয়। না হলে গায়ক বা গায়িকাদের মেজাজ খারাপ হয়ে যেতে পারে। তাঁরা ভাবেন, যে লোকটি দাড়ি না কামিয়ে, প্যান্টের উপর পাঞ্জাবি পরে এসেছে, সে তাঁদের প্রতি সম্মান জানাচ্ছে না।

সবেমাত্র আধখানা গাল কামানো হয়েছে, অন্য গালটায় ফেনা মাখানো। কাকাবাবু মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে সন্তু, হাঁপাচ্ছিস কেন? কী হয়েছে?

সন্তু নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, আজ আবার বাঘ বেরিয়েছে।

কাকাবাবু হেসে বললেন, আবার গুজব? তুই বাঘটা দেখেছিস, না ডাক শুনেছিস?

সন্তু বলল, না, আমি শুনিনি। কিন্তু লোকে বলছিল…।

কাকাবাবু বললেন, লোকে তো অনেক কথাই বলে। কোথায় শুনলি লোকের কথা?

সন্তু বলল, আমি আর জোজো ইকো পয়েন্টে গিয়েছিলাম। সেখানে অনেকেই বলল, বাঘের ডাক শুনেছে। সবাই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে গেল। দোকান টোকানও সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি।

কাকাবাবু বললেন, কালও তো কত লোক বাঘ আসছে, বাঘ আসছে বলে হল্লা তুলেছিল। আমাদের মান্টো সিংহ বলল, সে নিজের কানে বাঘের ডাক শুনেছে। অথচ আমরা কেন শুনলাম না বল তো? আমরা কি কানে কম শুনি?

সন্তু বলল, কাকাবাবু, ওখানে দুটো লোক জোর দিয়ে বলল, কাল রাত্তিরে নাকি বাঘটা বাজারের কাছে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করেছে। ওরাও ডাক শুনেছে।

কাকাবাবু বললেন, বাজারে? জঙ্গলে খাবারদাবার ফুরিয়ে গিয়েছে, তাই বাঘ শহরে এসেছে বাজার করতে। দাঁড়া, দাড়ি কামানোটা শেষ করে নিই। তারপর এসব গল্প শুনব।

একটু পরে মসৃণ গালে আফটার শেভ মাখতে মাখতে কাকাবাবু বেরিয়ে এলেন বাথরুম থেকে।

আগেরদিন সন্ধেবেলা পর্যন্ত খুব গরম ছিল। অক্টোবর মাস, কিন্তু এখনও এইসব জায়গায় শীত আসার নাম নেই। সারাদিন অসহ্য গরমের পর হঠাৎ ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি নেমেছিল সাড়ে ছটার সময়। আধঘণ্টা বৃষ্টির পর, যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল, তেমনই হঠাৎই থেমে গেল। তারপর বইতে শুরু করল ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়া।

কিন্তু তখনও ঘরের মধ্যে বসে থাকলে গরম লাগে, বাইরেটাই মনোরম। তাই কাকাবাবু কেয়ারটেকার মান্টো সিংহকে বলেছিলেন, সামনের চাতালে দু-একটা শতরঞ্চি পেতে দাও না, আমরা ওখানে বসে হাওয়া খাব।

বাংলোর ঠিক পাশেই মস্ত বড় খাদ। তার ওপাশে পাহাড়। সেই পাহাড়ের আড়াল থেকে একসময় চাঁদ উঠে আসে। দিনেরবেলা এমন কিছু মনে হয়, তবে রাত্তিরবেলা পাহাড়টাকে খুব রহস্যময় দেখায়। ওখানকার জঙ্গলে কোনও বাড়িঘর নেই। একটা ঝরনা আছে, খুব বড় নয়। তাই দিনেরবেলা সেটার আওয়াজ শোনা যায় না, শুধু চোখে দেখা যায়। আর রাত্তিরবেলা ঝরনাটা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু আওয়াজ বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

মান্টো সিংহ প্রথমে বাইরে শতরঞ্চি পেতে দিতে রাজি হয়নি।

সে বলেছিল,সাহাব, এখানে কেউ রাত্তিরে বাইরে বসে না। হঠাৎ শের এসে পড়তে পারে।

কথাটা শুনে কাকাবাবু হেসে উঠেছিলেন।

কাকাবাবু এখানে দুবার এসেছেন। মাণ্ডুতে কখনও বাঘের উপদ্রবের কথা শোনা যায়নি। উলটো দিকের পাহাড়ের জঙ্গলটাতেও তিনি জিপগাড়িতে ঘুরেছেন, কিছু হরিণ আর খরগোশ আর ময়ুর আছে বটে, বাঘের কোনও চিহ্ন নেই।

বাইরে এমন সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া, জ্যোৎস্না ফুটেছে, এই সময় ঘরের মধ্যে বসে থাকার কোনও মানে হয়?

কাকাবাবু জোর করেই শতরঞ্চি পাতিয়েছিলেন।

এই বাংলোর একটা ঘরে আরও একটি বাঙালি দম্পতি আছে, নির্মল রায় আর তাঁর স্ত্রী জয়ন্তী রায়। আর ওঁদের চার বছরের ছেলে টিটো। স্বামী আর স্ত্রী দুজনেই ইঞ্জিনিয়ার, দুজনেই বেশ ভাল গান করেন। ওঁরা এসেছেন ভিলাই থেকে, সন্তু-জোজোর সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছে।

ওঁরাও এসে বাইরের চাতালের সেই আড্ডায় যোগ দিয়েছিলেন। একটুক্ষণ গল্পের পরই শুরু হল গান। সন্তু ভাল মাউথঅর্গান বাজাতে পারে, কিন্তু গান গাইতে পারে না। জোজো বরং ভালই গান জানে। কিন্তু এমনিতে সে খুব বাক্যবীর হলেও গান গাইতে বললেই লজ্জা পায়। মাথা নুইয়ে ফেলে বলতে থাকে, না, না, আমি গাইতে পারি না!

নির্মল আর জয়ন্তী রায় পরপর চারখানা গান গেয়ে ফেললেন।

কাকাবাবু বললেন, বাঃ চমৎকার। আর-একটা হোক!

তখনই মান্টো সিংহ উত্তেজিতভাবে এসে বলেছিল, সাহাব, সাহাব, অন্দর মে চলা যাইয়ে! সত্যি আজ বাঘ বেরিয়েছে। একবার এই বাংলোর সামনে থেকে বাঘ একটা মেমসাহেবকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল!

কাকাবাবু তবু তাকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, যাঃ, এখানে বাঘ কোথা থেকে আসবে? এ তল্লাটে বাঘ আছে নাকি?

মান্টো সিংহ বলল, হাঁ সাব, আছে। জঙ্গল থাকলে বাঘ থাকবে না? মাঝে মাঝে এদিকে এসে পড়ে?

জয়ন্তী তাঁর ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ভয় পাওয়া গলায় বললেন, আঁ, বাঘ বেরিয়েছে? আর আমরা এমন খোলা জায়গায় বসে আছি? আমি বাবা ঘরে যাচ্ছি!

টিটো বলল, মা, বাঘ এসেছে? কোথায়, কোথায়?

জোজো তাকে বলল, তুমি ভয় পাচ্ছ নাকি টিটো? বাঘের সঙ্গে লড়াই করতে পারবে না?

টিটো বলল, লড়াই করব, আমার বন্দুক কোথায়? বন্দুক তো আনিনি!

জোজো বলল, কেন, খালি হাতে বুঝি বাঘ মারা যায় না? এই যে সন্তু, ও এক ঘুসিতে বাঘকে অজ্ঞান করে দিতে পারে। আর আমার আসল নাম কী জানো? ভোম্বল দাস। সিংহের মামা আমি ভোম্বল দাস/দেড়খানা বাঘ আমার এক এক গেরাস!

টিটো বলল, তার মানে কী? তার মানে কী?

জোজো একটা হাত তুলে বলল, ভাত খাওয়ার সময় এক গেরাস করে খেতে হয়? আমি এক গেরাসে দেড়খানা বাঘের মুড়ো খেয়ে ফেলতে পারি!

মান্টো সিংহ এর মধ্যে শতরঞ্চির এক কোনা ধরে টানতে শুরু করেছে। সে বলল, উঠুন, উঠুন, নইলে আমার নামে দোষ পড়বে!

সবাইকে এবার উঠতেই হল।

কাকাবাবু রাগ দেখালেন না বটে, কিন্তু তাঁর ভুরু কুঁচকে আছে। এবার সবাই মিলে বসলেন ডাইনিং রুমে।

বেশ বড় এই ঘরটা খানিকটা উঁচুতে। এর তিন দিকের দেওয়াল কাচের। বাইরের দিকটা সব দেখা যায়। কিন্তু এখন তো খাদের উলটো দিকের পাহাড়টার কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না। জ্যোৎস্নায় মনে হচ্ছে, কয়েকটা বড় বড় গাছ যেন লেগে আছে আকাশের গায়ে।

টিটোকে নিয়ে সন্তু আর জোজো কাচের দেওয়ালের কাছে কিছুক্ষণ বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল। তারপর টেবিলের কাছে ফিরে এসে জোজো বলল, কাকাবাবু, আপনি নিশ্চয়ই অনেক জায়গায় বাঘ দেখেছেন? একটা বাঘের গল্প বলুন!

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, বাঘ দেখেছি অনেক জায়গায়। এই মধ্যপ্রদেশে বেশ কয়েকটা রিজার্ভ ফরেস্ট আছে। সেসব জঙ্গলে গেলেই দেখা যেতে পারে বাঘ। কিন্তু আমরা হলাম সুন্দরবনের রয়াল বেঙ্গল টাইগারের দেশের মানুষ! ওদের মতো অত বড় হিংস্র বাঘ তো আর কোথাও নেই! রয়াল বেঙ্গল টাইগারের তুলনায় এখানকার বাঘেরা ছেলেমানুষ! এই বাঘেরাই মানুষ দেখলে ভয় পায়! আমি সুন্দরবনে বেশ কয়েকবার গিয়েছি, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বাঘ দেখতে পাইনি। লোকে বলে, সুন্দরবনের বাঘের সঙ্গে একবার যার চোখাচোখি হয়, সে আর প্রাণে বেঁচে ফিরে আসতে পারে না।

এইটুকু বলে কাকাবাবু থেমে যেতেই জয়ন্তী বললেন, ও মা, বাঘের গল্প হল কোথায়?

কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, আসল গল্প বলতে পারবে জোজো। ও নিশ্চয়ই নিজের চোখে অনেকবার বাঘ দেখেছে!

সন্তু বলল, জোজো, তুই তো রুদ্রপ্রয়াগে গিয়ে একটা চিতাবাঘ দেখেছিলি, তা জানি। তুই কখনও সুন্দরবনের বাঘ দেখেছিস?

জোজো বলল, পৃথিবীর সব দেশ থেকেই তো বাঘের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, তাই সেভ দ্য টাইগার, অর্থাৎ বাঘ বাঁচাও সমিতি নামে একটা সমিতি হয়েছে। সেই সমিতির প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন প্রিন্স আলফ্রেড, মানে সুইডেনের যুবরাজ। গত বছর তিনি কলকাতায় এসেছিলেন।

সন্তু বলল, তোর সঙ্গে বুঝি যুবরাজের আলাপ আছে?

জোজো বলল, আমার সঙ্গে থাকবে কী করে? তবে আমার বাবাকে চেনেন। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, সুইডেনের রাজকুমার ইংরেজি বলতে পারেন না। তিনি সুইস ভাষা ছাড়া আর কোনও ভাষা জানেন না।

সন্তু বলল, সুইডেনের ভাষা তো সুইস নয়। সুইডিশ!

জোজো সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুই ঠিক বলেছিস! সুইডিশ, সুইডিশ! কলকাতা শহরে আমার বাবা ছাড়া তো আর কেউ সুইডিশ ভাষা জানে না। তাই রাজকুমারকে কলকাতায় এলে বাবার সাহায্য নিতে হয়। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়ে বাবাকেই রাজকুমারের কথা বুঝিয়ে বলতে হয়।

সন্তু বলল, তুইও তখন সঙ্গে ছিলি নিশ্চয়ই? রাজকুমার কী বললেন। মুখ্যমন্ত্রীকে?

জোজো বলল, আমি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যাইনি। বাবার মুখে শুনেছি। রাজকুমার তোত বাঘ বাঁচাও সমিতির সভাপতি। তিনি রিপোর্ট পেয়েছেন যে, সুন্দরবনের সব বাঘ দিনদিন রোগা হয়ে যাচ্ছে। তারা ঠিকমতো খেতে পায় না। তাই তিনি নিজের চোখে রয়াল বেঙ্গল টাইগারের চেহারা দেখতে চান।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কোথায় রয়াল বেঙ্গল টাইগার দেখবেন? চিড়িয়াখানায়?

জোজো বলল, ধ্যাত! চিড়িয়াখানার বাঘরা তো গান্ডেপিন্ডে খায় আর পেট মোটা হয়। উনি আসল জঙ্গলের বাঘ দেখবেন ঠিক করেছেন।

সন্তু বলল, কাকাবাবু যে বলল, সুন্দরবনের জঙ্গলে বাঘ দেখা খুবই শক্ত। আর একবার চোখাচোখি হলে…

জোজো বলল, কাকাবাবু ঠিকই বলেছেন। সুন্দরবনের জঙ্গল তো আর অন্য জঙ্গলের মতো নয়। নামে সুন্দর, আসলে ভয়ংকর। ভিতরে গাড়ি চলে। পায়ে হেঁটে যেতে হয়। কখন যে বাঘ খুব কাছের ঝোপঝাড়ের মধ্যে এসে ঘাপটি মেরে বসে থাকে, তা বোঝার উপায় নেই। হঠাৎ পিছন থেকে লাফিয়ে পড়ে একজনকে টেনে নিয়ে যায়। কাগজে পড়িসনি, কদিন আগেই তো কয়েকজন লোক ওখানকার নদীর ধারে কাকড়া ধরছিল, হঠাৎ একটা বাঘ এসে বিশ্বনাথ বলে একটা ছেলেকে টেনে নিয়ে গেল!

সন্তু জিজ্ঞেস করল, রাজকুমার পায়ে হেঁটে যেতে রাজি হলেন?

জোজো বলল, পাগল নাকি? মানে, রাজকুমারের সাহস আছে, কিন্তু তিনি রাজি হলেও আমাদের গভর্নমেন্টের লোক মানবে কেন? যদি কোনও বিপদ হয়ে যায়! তা হলে ইন্ডিয়ার নামে কত বদনাম হয়ে যাবে।

নির্মল রায় বললেন, ঠিকই তো। সুইডেনের রাজকুমার, তার সবরকম দেখাশুনো করাই তো আমাদের উচিত।

টিটো বলল, সুন্দরবনের বাঘ বুঝি খুব জোরে লাফাতে পারে?

জোজো বলল, হ্যাঁ, একলাফে নদী পেরিয়ে যেতে পারে।

টিটো বলল, হনুমান আর বাঘ যদি একসঙ্গে লাফায়, তা হলে কে জিতবে?

জোজো বলল, বাঘ তো জিতবেই। কেন বলো তো? বাঘ তো আগেই হনুমানটাকে খেয়ে ফেলবে।

টিটো এখন হি হি করে খটখটিয়ে হেসে উঠল, যেরকম হাসি শুধু চার বছরের বাচ্চারাই হাসতে পারে।

জয়ন্তী রায় জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কী হল?

জোজো বলল, সুন্দরবনের সজনেখালিতে একটা ওয়াচ টাওয়ার আছে। তিনতলার সমান উঁচু। সেখানে উঠে বসে থাকলে অনেক জন্তু-জানোয়ার দেখা যায়, বাঘও আছে। সেই আমরা দল বেঁধে গিয়ে…।

জয়ন্তী বললেন, ওই ওয়াচটাওয়ারে আমরাও একবার গিয়ে বসে ছিলাম। তিন ঘণ্টা। কিছু দেখতে পাইনি, শুধু কয়েকটা হরিণ।

সন্তু বলল, হরিণ বুঝি কিছু না? জয়ন্তী বললেন, হরিণ তো অনেক দেখা যায়।

কাকাবাবু বললেন, জোজো, তুমি থামলে কেন?

জোজো বলল, রাজকুমারের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হল। সেই ওয়াচটাওয়ার দুদিন পাবলিকের জন্য বন্ধ! আমরা অনেক খাবারদাবার নিয়ে মোটা গদিপাতা বিছানায় গিয়ে বসলাম।

নির্মল রায় জিজ্ঞেস করলেন, আমরা মানে কজন?

জোজো বলল,রাজকুমার আলফ্রেড, তাঁর এক বন্ধু কিম, একজন সরকারি অফিসার, বাবা আর আমি।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তোকে সঙ্গে নেওয়া হল কেন?

জোজো বলল, আমার বাবাকে অনেক ওষুধ খেতে হয়। কিন্তু ওষুধ খেতে ভুলে যান ঠিক সময়। তাই আমাকে সঙ্গে যেতে হয়, ওষুধের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য।

কাকাবাবু বললেন, ঠিকই তো। সঙ্গে যাওয়াই ভাল।

জোজো বলল, ওয়াচটাওয়ারের সামনেটা মোটা জালে ঘেরা থাকে, যাতে বাঘ এসে আক্রমণ করতে না পারে। জালের বাইরে কিছুটা ফাঁকা জায়গা, আর কাছাকাছি ঝোপঝাড়। ফাঁকা জায়গাটায় একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হল একটা শুয়োরকে। শুয়োর বাঘের খুব প্রিয় খাদ্য। বেঁধে রাখলেই শুয়োর খুব চ্যাঁচায়। সেটাই তো বিজ্ঞাপন। ওই চাচানি শুনে বাঘ আসবেই। কিন্তু আমরা সকাল, দুপুর, বিকেল-সন্ধে পর্যন্ত বসে রইলাম। বাঘের দেখা নেই।

জয়ন্তী রায় বললেন, আগেই তো বলেছি, ওই টাওয়ারে বসে বাঘ দেখা যায় না। সুন্দরবনের বাঘ খুব চালাক।

জোজো বলল, আমরা কিন্তু বাঘ দেখেছি।

জয়ন্তী বললেন, তবে যে বললে সারাদিন বসে থেকেও…।

জোজো বলল, আপনি তো আমাকে পুরোটা বলতে দিচ্ছেন না।

নির্মল রায় বললেন, আঃ জয়ন্তী, ওকে বলতে দাও।

জোজো বলল, মুশকিল হচ্ছে কী, দিনেরবেলা তো বাঘ বেরোয় না সাধারণত। ওরা নিশাচর প্রাণী। রাত্তিরবেলা এসে শুয়োরটাকে ধরে নিয়ে গেলেও অন্ধকারে আমরা কিছু দেখতে পাব না। তাই শুয়োরটাকে খুলে নিয়ে আমরাও নেমে গেলাম গেস্ট হাউসে। সেখানে রাত্তিরে বেশ ভালই খাওয়া দাওয়া হল। তারপর আড্ডা।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কী খেলি রে জোজো?

জোজো বলল, টাটকা ইলিশ মাছের ঝোল, মুর্গ মুসল্লম, তার মানে মুর্গির পেট কেটে তার মধ্যে চাল আর ডিম ঢুকিয়ে সেলাই করে রান্না, আর কঁকড়ার ঝোল, চিংড়ির মালাইকারি।

কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, রাজকুমার খেলেন এত কিছু?

জোজো বলল, রাজকুমারের জন্যই তো কলকাতা থেকে স্পেশ্যাল কুক নিয়ে গিয়ে এত কিছু রান্না করা হয়েছিল। কিন্তু খেতে বসে তিনি বললেন, তিনি মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন, এখন শুধু নিরামিষ খান। তাই খেলেন শুধু ভাত-ডাল-বেগুনসেদ্ধ আর দই। তাঁর বন্ধুটা অবশ্য চেটেপুটে খেল সবই। ইলিশ খেয়ে বলতে লাগল, এরকম ভাল মাছ সে জীবনে খায়নি।

সন্তু বলল, পরদিন সকালে আবার গেলি?

জোজো বলল, সারারাত আমার ভাল করে ঘুমই হল না। মাঝে মাঝে জানলার দিকে চেয়ে দেখছি, কখন ভোর হয়। কিছুতেই ভোরের আলো ফুটছে না। একসময় আলো জ্বেলে দেখি, সাড়ে সাতটা বাজে। তবু রোদুর ওঠেনি কেন? জানলার কাছে গিয়ে দেখি, সারা আকাশ ঘন মেঘে কালো হয়ে আছে, আর একটু একটু বৃষ্টি পড়ছে। বাবা আগেই জেগে উঠেছিলেন, বাবা বললেন, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও সবাই। এইটাই ভাল সময়। এইরকম অন্ধকার থাকলে বাঘ বেরোতে পারে।

আমরা সবাই গিয়ে আবার ওয়াচটাওয়ারে উঠে বসলাম। শুয়োরটাকেও খুঁটিতে বেঁধে রাখা হল। তারপর অপেক্ষা। রাজকুমারের হাতে দূরবিন। কেউ কোনও কথা বলছে না। খুব বেশিক্ষণ না, ঘণ্টাখানেক মোটে কেটেছে।

জয়ন্তী উদগ্রীব হয়ে বললেন, দেখা গেল বাঘ?

জোজো বলল, দাঁড়ান, দাঁড়ান, বাঘ দেখা অত সহজ নাকি? এ কি সার্কাসের বাঘ যে, খেলা দেখাবে? খুব কাছেই একটা ময়ূর পাঁও পাঁও করে ডেকে উঠল। কয়েকটা বাঁদর কিচিরমিচির করতে করতে এক ডাল থেকে আর-এক ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে পালাল, তিনটে হরিণ ছুটে গেল খুব জোরে। এতেই বোঝা যায়, কাছাকাছি কোথাও বাঘ এসেছে। শুয়োরটাও ভয় পেয়ে দড়ি ঘেঁড়ার চেষ্টা করছে।

কাকাবাবু বললেন, এটা জোজো একদম ঠিক বলেছে। বাঘ বেরোলেই জঙ্গলের অন্য প্রাণীরা ভয় পেয়ে পালায়! জোজোর গল্প একেবারে নিখুঁত।

জোজো বলল, কয়েকটা ঝোপে কড়কড় শব্দ হল। মনে হল, ওইদিক দিয়ে বাঘটা আসছে। অবশ্য অন্য কোনও প্রাণীও হতে পারে। তারপর খুব কাছের একটা ঝোপ নড়ে উঠল। রাজকুমার দূরবিনে দেখে বললেন, একটু হলুদ হলুদ রং দেখা যাচ্ছে। খুব সম্ভবত একটা বাঘ এসেছে। বাবা বললেন, একটা মুশকিল হবে। বাঘটা দেখে নিচ্ছে শুয়োরটার কাছে কোনও ফাঁদ পাতা আছে কিনা। কিন্তু তারপর তো বাঘটা হেঁটে হেঁটে আসবে না, সেটা ওদের স্বভাব নয়। ও একক্লাফে এসে শুয়োরটাকে তুলে নিয়েই আর-একলাফে অদৃশ্য হয়ে যাবে। চোখের নিমেষে ঘটবে ঘটনাটা। ভাল করে দেখাই যাবে না। তা হলে কী করে বোঝা যাবে, বাঘটা রোগা না মোটা?

রাজকুমার বললেন, আমি কিন্তু বাঘটাকে ভাল করে দেখতে চাই, ক্যামেরায় ফোটোও তুলতে চাই!

সন্তু বলল, মেলোমশাই নিশ্চয়ই একটা কিছু উপায় বের করলেন?

জোজো বলল, হ্যাঁ। বাবা রাজকুমারের বন্ধুকে সুইডিশ ভাষায় কী যেন জিজ্ঞেস করলেন। সেও কী যেন উত্তর দিল। বাবা তখন বললেন, ঠিক আছে! আরও খানিক পরে বাঘটা ঝোপ থেকে একটু মাথা বের করতেই বাবা বললেন, এবার! রাজকুমারের বন্ধুটি চিৎকার করে বলে উঠল, স্ট্রাটাস, স্ট্রাটাস! আর বাবাও হাত তুলে খুব জোরে বললেন, তিষ্ঠ, তিষ্ঠ! ব্যস, বাঘটা লাফাতে যাচ্ছিল, কিন্তু সেখানেই থেকে গেল, শরীরটা অর্ধেক উঁচু, একেবারে নট নড়নচড়ন!

জোজো একটু চুপ করল। কাকাবাবু একটু একটু হাসছেন, আর সকলের চোখে মুখে দারুণ কৌতূহল!

সন্তু জিজ্ঞেস করল, ব্যাপারটা কী হল? বাঘটা লাফাতে পারল না?

জোজো বলল, লাফাবে কী করে? ছেলেবেলা স্ট্যাচু স্ট্যাচু খেলিসনি? কারও দিকে তাকিয়ে জোরে স্ট্যাচু বললে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে যায়। নড়াচড়া করে না, চোখের পলক পর্যন্ত ফেলে না। বাঘটারও সেই অবস্থা!

সন্তু বিরক্তভাবে বলল, আমরা ছেলেবেলায় স্ট্যাচু স্ট্যাচু খেলেছি ঠিকই, কিন্তু বাঘ কি খেলেছে? বাঘ কি স্ট্যাচু কথাটার মানে জানে?

জোজো হো হো করে হেসে উঠে বলল, দুর বোকারাম। খেলার কথা তো এমনিই বললাম, তাও বুঝলি না? বাঘের সঙ্গে কি খেলা করা যায়? তবু যে বাঘটা আর নড়তে চড়তে পারছে না, তার কারণ কী?

জয়ন্তী বললেন, আমরা কিন্তু কিছু বুঝতে পারছি না।

জোজো বলল, আমার বাবা যে বললেন, তিষ্ঠ! তার মানে কী? থামো! এই বনে বাবা বাঘটাকে হিপনোটাইজ করলেন, তারপর তো ওর আর নড়াচড়ার ক্ষমতাই রইল না। অবশ্য মাত্র দুমিনিট।

নির্মল রায় অবিশ্বাসের সুরে বললেন, বাঘকে হিপনোটাইজ করা যায়?

জোজো বলল, সবাই পারে না। এই অবস্থায় বাঘটার ফোটো তোলা হয়েছিল, কলকাতায় গেলে দেখাতে পারি। দিব্যি মোটাসোটা চেহারা।

জয়ন্তী রায় জিজ্ঞেস করলেন, তারপর দুমিনিট পরে কী করল বাঘটা?

এর পরের অংশটা আর শোনা গেল না। মান্টো সিংহ দৌড়ে এ-ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, সাহাব, অপলোগ শুনা?

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? কী শুনব?

মান্টো সিংহ বলল, বাঘটা ডাকল। দুবার। সে কাছেই এসে পড়েছে!

কাকাবাবু বললেন, কই, আমরা তো কিছু শুনিনি।

মান্টো সিংহ বলল, বহুত আদমি শুনেছে। দুবার ডেকেছে।

জয়ন্তী রায় বললেন, আমরা গল্প শুনছিলাম, তাই শুনতে পাইনি?

কাকাবাবু ছাড়া আর সবাই ছুটে গেল জানলার কাছে।

গেস্ট হাউসের দরজাটরজা সব বন্ধ, বাঘ এলেও ভিতরে ঢুকতে পারবে। কাচের দেওয়াল কি ভেঙে ফেলতে পারে? খুব পুরু কাচ, আর অনেকটা উঁচুতে। এত দূর বাঘ লাফাতে পারবে না।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও আর বাঘের ডাক শোনা গেল না। দেখা গেল। কিছু। গল্প আর জমল না।

আজ আবার সেই বাঘের কথা। সন্তুরা বাইরে থেকে শুনে এসেছে।

কাকাবাবুর তবু বিশ্বাস হচ্ছে না। শুধু মনে হচ্ছে, কেউ গুজব ছড়াচ্ছে। বাঘ অনেক সময় জঙ্গলের কাছাকাছি কোনও গ্রামে ঢুকে পড়ে। খিদের জ্বালায় গোরু-মোষ মারে। সামনে কোনও মানুষ পড়ে গেলে তাকেও মেরে দিতে পারে। কিন্তু এটা তো প্রায় একটা শহর। এখানে বাঘ আসবে কেন? বাঘের প্রাণের ভয় নেই?

কাকাবাবু সন্তুকে বললেন, দাঁড়া, কর্নেল সরকারকে ফোন করে দেখি, কী ব্যাপার। উনি নিশ্চয়ই জানবেন।

কর্নেল প্রিয়ব্রত সরকার আর্মিতে ছিলেন বেশ কিছুদিন। আগে আগে রিটায়ার করে এখানেই বাড়ি করে থেকে গিয়েছেন। বেশ জবরদস্ত চেহারা, তবে হাসিখুশি মানুষ। আজ রাজবাহাদুর প্যালেসে গান-বাজনার আসর বসার কথা। কর্নেল সরকারই সেই ব্যবস্থা করে কাকাবাবুদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

কর্নেল সরকার ফোন ধরার পর কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী সরকারসাহেব, গান-বাজনা কখন শুরু হবে? আপনি গাড়ি পাঠাবেন বলেছিলেন।

কর্নেল সরকার বললেন, রায়চৌধুরীমশাই, বাংলায় একটা কথা আছে জানেন তো? বর্ষাকালে কেন কোকিল ডাকে না? কারণ, তখন চতুর্দিকে ব্যাঙেরা ডাকাডাকি করে, তাই কোকিল চুপ করে থাকে। আজ এখানে সেই অবস্থা। বাঘ এসে যদি ডাকাডাকি করে, তা হলে গায়িকা গান করবেন কী করে? আজকের অনুষ্ঠান ক্যানসেড!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সত্যিই বাঘ ডাকাডাকি করছে? আপনি শুনেছেন নাকি?

কর্নেল বললেন, না, আমি শুনিনি। তবে অনেকেই আমাকে বলছে যে, কাল রাত থেকে নাকি বাঘের ডাক শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে!

কাকাবাবু বললেন, এখানে কি সত্যি বাঘ আসতে পারে? আগে কখনও এসেছে?

কর্নেল বললেন, বছর পাঁচেক আগে নাকি একটা বাঘ কোথা থেকে এসে ঢুকে পড়েছিল। একজন বৃদ্ধ লোককে মেরেও ছিল। তবে তখন আমি এখানে ছিলাম না। কতটা সত্যি তা বলতে পারব না। আজ আর কেউ ভয়ে বাইরে বেরোচ্ছে না। রাস্তা একেবারে শুনশান।

কাকাবাবু বললেন, আমরাও তা হলে সারা সন্ধে গেস্ট হাউসেই বসে থাকব?

কর্নেল বললেন, আমি আসছি আপনাদের ওখানে। যদি আপত্তি না থাকে, আপনাদের নিয়ে বেড়াতে বেরোব। ঘুরব অনেক জায়গায়। আর তার মধ্যে যদি হঠাৎ বাঘটার দেখা পাওয়া যায়, তা হলে বেশ মজাই হবে।