[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

০১. প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের ভিড়ে

প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের ভিড়ের মধ্যেও আমার ঠিক চোখে পড়ল, চারটি বাঙালি ছেলে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে হাত-পা নেড়ে গল্প করছে। আমার থেকে তারা অনেকখানি দূরে, তাদের কথা আমি শুনতে পাচ্ছি না, কিন্তু তারা যে বাঙালি তা চিনতে আমার একটুও ভুল হয় না। মনটা একটু চঞ্চল হয়ে উঠল।

বাঙালি দেখলেই যে ছুটে যেতে হবে তার কোনও মানে নেই। বাঙালিরা এমন কিছু দ্রষ্টব্য ব্যাপার নয়। মাত্র কিছুদিন আগেই তো বাংলার জনসমুদ্র ছেড়ে এসেছি, আবার কিছুদিন বাদেই সেখানে ফিরে যাব। তবু বিদেশে এসে অনবরত অপর ভাষায় কথা বলতে-বলতে এক সময় যেন মুখে ফেনা উঠে যায়। তখন ইচ্ছে করে দুটো বাংলা কথা কইতে, একটু বাংলায় হাসাহাসি করতে। কিন্তু সেধে কারুর সঙ্গে ভাব জমাতে আমি কখনোই পারি না। তা ছাড়া বিপদও আছে। লন্ডন শহরের বড় রাস্তায় হামেশাই বাঙালির দেখা পাওয়া যায়। একবার পিকাডেলি স্কোয়ারে একজন বাঙালি ভদ্রলোকের সঙ্গে ডেকে কথা বলতে গিয়েছিলুম, তিনি গম্ভীর দায়সারাভাবে দুটি একটি কথা বলে চলে গেলেন। হয়তো তিনি খুব বড় চাকরি করেন, আমার মতন এলেবেলে বাঙালিকে পাত্তা দিতে চাননি।

এটা অবশ্য লন্ডন নয়, আমস্টারডাম শহরের কেন্দ্রস্থল। জায়গাটার নাম ডাম-স্কোয়ার, একটা পরিত্যক্ত রাজপ্রাসাদের সামনে বিশাল চত্বর, দেশ-বিদেশের ভ্রমণকারীরা প্রায় সবাই বিকেলের দিকে এখানে এসে ভিড় জমায়। অনেকে অলসভাবে বসে থেকে পায়রাদের ছোলা খাওয়ায়। বড়-বড় হোটেলগুলো এ-পাড়াতেই। চত্বরটার চার পাশে বহু দোকান পর্যটকদের পকেট কাটবার জন্য হাজার রকম মনোহর দ্রব্য সাজিয়ে রেখেছে। এখানেই কাছাকাছি হল্যান্ডের অতি মূল্যবান হিরে এবং সুলভ রমণী পাওয়া যায়।

একটা সিগারেট ধরিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলুম। আমার তো কোথাও জরুরি যাওয়ার তাড়া নেই, খানিকটা সময় কাটানো নিয়ে কথা। রাত সাড়ে আটটা বাজে, আকাশে রোদ্দুরহীন দিনের আলো। পৃথিবীর বহুদেশের মানুষের মুখ আলাদাভাবে চেনা যায়, আর সব পোশাকের কী বিচিত্র রং! এত মানুষের ভিড়েও নিজেকে সব সময় একলা মনে হয়।

একটু বাদে বাঙালি ছেলে চারটির মধ্যে দুজন চলে গেল ডানপাশের রাস্তায়, আর দুজন এগিয়ে আসতে লাগল আমার দিকে। এসব দেশে অচেনা-মানুষের সঙ্গেও চোখাচোখি হয়ে গেলে হাসিমুখ করতে হয়। আমি তৈরি হয়ে রইলুম।

ছেলে দুটির সঙ্গে আমার চোখাচোখি হল না, ওরা আমার পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল। এক্ষেত্রে পিছু ডাকা চলে না। আমি আড়চোখে দেখতে লাগলুম ওদের। ওরা একটু দূরে গিয়েও থমকে গেল। তারপর পিছিয়ে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়াতেই আমি একগাল হেসে বললুম, কী খবর?

একটি ছেলে তার উত্তরে ইংরেজিতে জিগ্যেস করল, পাকিস্তানি?

আমি মাথা নাড়লুম দুদিকে।

অন্যজন জিগ্যেস করল, কামিংফ্রম বাংলাদেশ?

এবারও আমি দুদিকে মাথা নেড়ে বললুম, না, ভারত।

ছেলে দুটি বাঙালি নয়। বেশ খানিকটা নিরাশই হলুম বলতে গেলে।

ওদের একজন আবার ইংরেজিতে জিগ্যেস করল, নতুন এসেছেন মনে হচ্ছে। কী চাকরি নিয়ে এলেন?

আমি বললুম, আমাকে আবার কে চাকরি দেবে? আমি এমনি ভবঘুরে হয়ে এসেছি।

–কী রকম লাগছে আমাদের দেশ? হল্যান্ড বড় সুন্দর জায়গা কি না বলুন? আমরা অনেক দেশ দেখেছি, কিন্তু আমাদের হল্যান্ডের মতন এত ভালো আর কোথাও লাগে না।

আমাদের হল্যান্ড? এই বাঙালি-চেহারার ছেলে দুটি হল্যান্ডের নাগরিক? আমার চট করে মনে পড়ল, সুরিনামের অনেক লোক এখন হল্যান্ডে থাকে। সুরিনাম এক সময় ডাচ কলোনি ছিল, সেখানকার অনেকেই হল্যান্ডের নাগরিক হয়ে আছে, তারা ভারতীয় বংশোদ্ভূত, এখনও পুজো-আচ্চা করে, হিন্দি গান শোনে। এরা কি তবে সুরিনামিজ?

ওদের একজন বলল, আমরাও এক সময় ভারতীয় ছিলাম, মানে, আমাদের বাবা-মায়েরা। আমরা জন্মেছি ভারতে, তারপর পাকিস্তানে চলে যাই। এখন অবশ্য দশ বছর এ-দেশে আছি।

–তা হলে আপনারা পাকিস্তান থেকে এসেছেন! ‘আমাদের হল্যান্ড’ বললেন কেন?

একটি ছেলে অন্যজনের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ও এখানকার সিটিজেনশিপ পেয়ে গেছে। আমি এখনও পাইনি, তবে শিগগির পেয়ে যাব।

অন্য ছেলেটি হাসতে-হাসতে বলল, প্রথমে ছিলাম ভারতীয়, তারপর পাকিস্তানি, তারপর ডাচ। এক জীবনে তিনদেশের নাগরিক। চলুন না, কোথাও একটু বসে গল্প করা যাক? আমাদের আরও দুজন বন্ধু ছিল, এখনও গেলে তাদের ধরা যাবে। আপনার বিশেষ কোনও কাজ নেই তো? উঠেছেন কোথায়? আপনি হিন্দি জানেন?

যুবক দুটির বয়েস তিরিশ-বত্রিশের মতন। একজনের নাম আলম, আর একজনের নাম মুনাব্বর। দুজনেরই স্বাস্থ্য চমৎকার। ওদের সঙ্গে হাঁটতে লাগলুম চত্বরটার ডান পাশ দিয়ে। একটা রেস্তোরাঁর সামনে উঁকি দিয়ে আলম বলল, ওই তো ভেতরে শমীম আর ইমতিয়াজ রয়েছে। চলুন, এখানে বসা যাক। এটা আমাদের আড্ডাখানা।

আমি প্রথমে একটু ইতস্তত করলুম। এ তো আর কলকাতার চায়ের দোকান নয় যে চার আনা। পয়সা দিয়ে এক কাপ চা খেয়ে তিন ঘন্টা কাটিয়ে যাব। এখানে এক কাপ চায়ের দাম অন্তত চার টাকা, তা ছাড়া এ-পাড়ার দোকানে চা পাওয়া যায় কিনা তাও সন্দেহ। বিদেশে এলে কৃপণের মতন প্রতিটি পাই পয়সা হিসেব করে চলতে হয়। কিন্তু এতদূর এসে আর ফিরে যাওয়া যায় না।

শমীম আর ইমতিয়াজ আমাদের দেখে হইহই করে উঠল এবং হিন্দিতে স্বাগত জানাল। হিন্দি কিংবা উর্দুও হতে পারে। এদের মধ্যে ইমতিয়াজের বয়েস একটু বেশি, মাথায় টাক আর শমীমের চেহারা ক্রিকেট খেলোয়াড়ের মতন। আমার পরিচয় পেয়ে ওরা হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিয়ে বলল, বসুন, বসুন! আপনার কাছে দেশের খবর শোনা যাক। এখানকার কাগজে আমাদের দেশের কোনও খবর থাকে না।

দেশের খবর মানে কোন দেশ? পাকিস্তানের কতটুকু খবরই বা আমি জানি? ভারতের খবর জানতে কি এদের আগ্রহ হবে? এদের মধ্যে শমীম এসেছে জার্মানি থেকে বেড়াতে, ইমতিয়াজ তার দুলাভাই অর্থাৎ জামাইবাবু। চারজনেই কাজ করে জাহাজ কোম্পানিতে। গত আট বছরের মধ্যে কেউই পাকিস্তানে যায়নি।

আমাকে কিছু জিগ্যেস না করেই ওরা আমার জন্য একটা বিয়ারের অর্ডার দিল। মুনাব্বর কিছু নিল না, রোজার মাস, সে উপোস রেখেছে। শমীম তাকে উপরোধ করতে লাগল, আরে ব্রাদার, খাও এক ঢোঁক। এই দূর দেশে কে আর দেখছে তোমাকে।

মুনাব্বর বলল, না, ভাই, জোর কোরো না। অনেক দিনের অভ্যেস, রোজার সময় সারাদিন আমি কিছু খেতে পারি না।

আমি বললুম, এখানে রোজা রাখা তো মহা জ্বালা। রাত দশটা পর্যন্ত দিনের আলো থাকে।

মুনাব্বর বলল, শুধু কী তাই, রাত তিনটে থেকেই আকাশে দিনের আলো ফুটে বেরোয়, তার আগে জেগে উঠে নাস্তা সেরে নিতে হয়।

আলম বলল, এখন চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আঠারো-উনিশ ঘণ্টাই দিন বলতে পারেন। আবার শীতকালে মোটে পাঁচ-ছ’ঘণ্টা দিনের আলো থাকে।

শমীম বলল, বিয়ার খাচ্ছ না বটে, কিন্তু মুনাব্বর খাঁ, সিগারেট টানছ যে অনবরত? তাতে রোজা থাকে?

মুনাব্বর লাজুকভাবে হেসে বলল, বিদেশে অত নিয়ম মানলে চলে না। কী বলেন, নীললোহিতদাদা? হিন্দুস্তানে তো সবাই সবাইকে দাদা বলে, তাই না?

আমি বললুম, সারা ভারতবর্ষে বলে, বাঙালিরা বলে। কিন্তু আপনি তা জানলেন কী করে?

–আমি ঢাকায় ছিলাম যে। প্রায় সাত-আট বছর ছিলাম। সেভেন্টি ওয়ানের ওয়ারের সময় চলে আসি, কিছুদিন করাচিতে থেকে তারপর একেবারে এই দেশে। হিন্দুস্তানের ভরতপুরের নাম শুনেছেন? উত্তরপ্রদেশে, সেখানে আমার জন্ম, সেখান থেকে আমরা চলে যাই ঢাকায়।

আমি বললুম, আমার ঠিক আপনার উলটো। আমার জন্ম ঢাকায়, সেখান থেকে চলে আসি ভরতপুরে।

মুনাব্বর বিস্মিতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইল একটুক্ষণ। তারপর বলল, ঠিক বলছেন?

আমি বললুম, ঠিক ঢাকায় নয়, আমার জন্ম ফরিদপুরে। আর ভরতপুরের বদলে আমি চলে এসেছি কলকাতায়। কিন্তু একই তো ব্যাপার, তাই না?

ওরা চারজনে হোহো করে হেসে উঠল, মুনাব্বর বলল, তা ঠিক বলেছেন। তবে আমাকে আবার ঢাকা ছাড়তে হয়েছিল, আপনাকে তো আর কলকাতা ছাড়তে হয়নি এর পরে।

আমি বললুম, ভবিষ্যতের ইতিহাসের কথা কে বলতে পারে? হয়তো এরপর কলকাতায় এক সময় বিদেশি খেদাও আন্দোলন শুরু হবে, তখন আমাদের আবার পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে অন্য কোথাও। ধরা যাক, আন্দামানে।

শমীম বলল, ইতিহাসের মুখে মারো গোলি!

ইমতিয়াজ বলল, ইতিহাস আপনা-আপনি হয় না, কিছু বদমায়েশ লোক এইভাবে ইতিহাস তৈরি করে।

এত বিদেশিদের মধ্যে এই চারজন চেনামুখের যুবককে আমার খুব আপন মনে হয়। এরা বেশ অবলীলাক্রমে জোরে-জোরে হিন্দি-উর্দুতে কথা বলে যাচ্ছে। রেস্তোরাঁটি বেশ বড়, অনেকগুলো টেবিল, আমরা বসেছি মাঝখানের একটা বড় টেবিলে। এদের ব্যবহারে কোনও রকম আড়ষ্টতা নেই, আমাদের পানীয় অর্ডার দেওয়ার সময় এরা কথা বলছে বেশ চোস্ত ডাচ ভাষায়, তারপরই আবার আজ্ঞা শুরু করছে হিন্দি-উর্দুতে। আমি হিন্দি-উর্দু প্রায় কিছুই জানি না। কিন্তু ইংরিজির বদলে ভাঙা-ভাঙা ওই ভাষায় কথা বলতে বেশ ভালো লাগছে।

এর মধ্যে তিনবার বিয়ারের অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে। এ-দেশি বিয়ার খুব হালকা, সেরকম নেশা হয় না। একমাত্র আলমকেই দেখছি ভদকা চেয়ে নিয়ে মিশিয়ে নিচ্ছে ওর বিয়ারের সঙ্গে। আলম একটু বেশি হাসছে, বেশি জোরে কথা বলছে, জিভও একটু জড়িয়ে গেছে। সে সিগারেটও খায় সবচেয়ে বেশি। তিনটে পাঁচ মার্কা সিগারেটের একটা পুরো প্যাকেট এরই মধ্যে শেষ করে, অন্য একটা নতুন প্যাকেট খুলেছে। মুনাব্বর তাকে ভদকা নিতে বারণ করল দুবার, আলম শুনল না।

আমি পকেটে হাত দিয়ে গোপনে গিলডারের হিসেব করতে লাগলুম। এক রাউন্ডের অর্ডার আমার দেওয়া উচিত। স্টুয়ার্টের উদ্দেশ্যে আঙুল তুলতেই ইমতিয়াজ বলল, না, না, ওসব চলবে na। আপনি আমাদের অতিথি। আপনি বিদেশ ঘুরতে এসেছেন, অযথা পয়সা খরচ করবেন না। আপনি কোন হোটেলে উঠেছেন? হোটেলে পয়সা দেবেন কেন, আমার বাড়িতে চলে আসুন। দেশ থেকে অনেকেই এসে আমার ওখানে ওঠে। আমার তিনখানা ঘর আছে।

মুনাব্বর বলল, ও এখনও শাদি করেনি, আপনার কোনও অসুবিধে হবে না।

কথায়-কথায় জানতে পারলুম, শমীম বিয়ে করেছে নিজের দেশের মেয়েকে, মুনাব্বরের স্ত্রী ডাচ, আর আলম একটি ডাচ মেয়ের সঙ্গে লিভিং টুগেদার করে। এই লিভিং টুগেদার এখন এসব দেশে বেশ চালু হয়ে গেছে। হল্যান্ডে এসে কেউ কোনো ডাচ মেয়েকে বিয়ে করতে পারলেই তার নাগরিকত্ব পেতে আর কোনও অসুবিধে হয় না, তার কোনও সময় চাকরি না থাকলেও সে মোটা টাকা ভাতা পাবে।

ইমতিয়াজ বলল, এখানে ইণ্ডিয়ার লোকও বেশ কয়েকজন আছে। তাদের কারুর সঙ্গে আলাপ হয়েছে আপনার? আমি আলাপ করিয়ে দিতে পারি।

আমি বললুম, তাদের সঙ্গে আলাপ করবার জন্য আমি খুব ব্যস্ত নই। আপনাদের সঙ্গে গল্প করতেই তো আমার বেশ চমৎকার লাগছে।

আলম আমার পিঠে একটা চাপড় মেরে নেশাগ্রস্ত গলায় বলল, বুঝলেন নীললোহিতদাদা, এদেশে এসে বুঝলুম, ধর্মটর্মতে কিছছু আসে যায় না। গায়ের রঙে কিছু আসে যায় না। তুমিও মানুষ, আমিও মানুষ, খাটো, রোজগার করো, খাও-দাও, ফুর্তি করো। আয়ু ফুরিয়ে গেলে মরে যাও। ব্যস, সোজা কথা।

শমীম বলল, দুঃখের বিষয় এ কথাটা আমরা নিজের দেশে থাকার সময় বুঝতে পারি না। বুঝতে হল কিনা সাহেবদের দেশে এসে! দেশে থাকলে নীললোহিতের সঙ্গে এরকম আড্ডা মারতে পারতুম?

আমি বললুম, কেন, আমার তো মনে হচ্ছে, কলকাতারই কোনও দোকানে বসে আছি। আপনারা আমার কলকাতার বন্ধুদের মতন অনায়াসেই অমল, কমল, ফিরোজ, শামসের হতে পারতেন।

মুনাব্বর বলল, এটা আপনি ঠিক বললেন না, এটা আপনি একটু বেশি মিষ্টি করে বললেন। দেশে থাকলে আমাদের পেছনে স্পাই লেগে যেত।

কথা ঘোরাবার জন্য ইমতিয়াজ বলল, চলো এবার ওঠা যাক। ওহে মুনাব্বর, দেরি করে ফিরলে তোমার বিবি মাথায় কিল মারবে না?

মুনাব্বর বলল, আমার বিবি গেছে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। আজ রাতে ফিরবে না। বরং আলমের গার্লফ্রেন্ডই বকাবকি করবে। আলম কত বেশি খাচ্ছে দেখেছ?

আলম বলল, আরও খাব, লাগাও আর এক রাউন্ড।

ইমতিয়াজ বলল, না, আর না।

আলম বলল, আলবত আর এক রাউন্ড হবে। এই নীললোহিত আমাদের মেহমান।

ইমতিয়াজ বলল, ওনার জন্য আর একটা দেওয়া যেতে পারে, আমিও সঙ্গ দিতে পারি ওঁকে, কিন্তু তুমি আর না। সিগারেটের প্যাকেটটা আমাকে দাও, আর একটাও খাবেনা।

আলম বলল, ভয় পাচ্ছ কেন! মরি তো মরব, নিজের খুশিতে মরব। মুনাব্বর বলল, বুঝলেন নীললোহিতদাদা, এই আলমের হার্টে একটা জবর গোলমাল দেখা দিয়েছে। সামনের মাসে অপারেশন হবে, খুব বড় অপারেশন। সিগারেট আর মদ খাওয়া একেবারে নিষেধ, কিন্তু ও কিছুতে মানবে না।

হার্টের রুগি এত সিগারেট খাচ্ছে শুনে আমিও আঁতকে উঠলুম। আলমের চোখ দুটো লালচে হয়ে গেছে, মাথার চুল উশকোখুশকো। সিগারেট টানছে গাঁজার মতন।

আলম জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বুঝলেন দাদা, আমার এই অপারেশনে দু লক্ষ টাকা খরচ হবে। তাতেও বাঁচব কি মরব ঠিক নেই। দেশে থাকতে গরিবের ছেলে ছিলুম, এত টাকা দিয়ে অপারেশন হত আমার? এমনিই মরতুম না? জাহাজের চাকরি নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়েছিলুম, এদেশে আছি এখন, এখানকার সোসাইটি সব চিকিৎসার খরচ দেয়…সেইজন্যই

তো জীবন নিয়ে এত ফুটানি! দু-লাখ টাকার চিকিৎসা…হাঃ হাঃ হাঃহাঃ…

তারপরই সে আবার হাঁক দিল স্টুয়ার্টের উদ্দেশ্যে।

আমি জিগ্যেস করলুম, দু-লাখ টাকার চিকিৎসা?কী হয়েছে ওর হার্টে?

ইমতিয়াজ বলল, এমনিতেই এদেশে চিকিৎসার খুব খরচ। তা ছাড়া ওর হার্টের একটা ভালভ কাজ করছে না, সব টেকনিক্যাল ব্যাপার আমি বুঝি না, মোটমাট বেশ শক্ত অপারেশন। তবে ডাক্তার বলেছে, সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু এরকম ভাবে যদি অত্যাচার করে…

আলম বলল, জীবনটা কার, আমার না তোমাদের? আমার জীবন আমি ইচ্ছে মতন খরচ করব। অপারেশনের সময় যদি মরেই যাই, তা হলে তার আগে যে ক’টা দিন বাকি আছে একটু খুশি মতন কাটিয়ে যাব না?

মুনাব্বর আমাকে বলল, আপনি ওকে একটু বারণ করুন না। আমাদের কথা তো শোনেই না, আপনি নতুন লোক, যদি একটু পাত্তা…

মাত্র ঘণ্টা দু-এক আলমের সঙ্গে আমার আলাপ। আমার কথা ও শুনবে কেন? আলম বরং আমার পাশে উঠে এসে বলল, আমার সিগারেটের প্যাকেটটা কেড়ে নিয়েছে, আপনার থেকে দিন তো একটা। আপনার দেশের সিগারেট? চার্মিনার? দিন তো খেয়ে দেখি। আমি কয়েকটা বাংলা কথা জানি, বাংলা সিনেমা দেখেছি…হার্টের দরদ হলে আপনারা বলেন, মন খারাপ, তাই না?

মোট কথা প্রায় জোরজবরদস্তি করেই আলমকে নিয়ে আমরা উঠে পড়লুম একটু বাদেই।

সেই রাতে আমি আলমকে বহুক্ষণ স্বপ্নে দেখলুম।