ফেরা
1 of 2

ফেরা

ফেরা

এক একটি খণ্ড দৃশ্যে জীবনকে উপভোগ করার জন্য এই জীবনমালা। যেমন পুষ্পবতী। বাসে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করছে স্বামীর ফেরার আশায়। বিকেল হয়ে গেল, ফিরছে না। কেউ কোনো খবরও দিয়ে যায়নি। কেউ বলেনি তিতলিপুরের বাসে উঠে যেতে দেখলাম। যেমন সেই লোকটা, কী যেন নাম! পঞ্চায়েতের বাবু। বগলে ছাতা, সে ঘুরে ফিরে চলে আসে, চশমার আড়ালে পুষ্পবতীকে খোঁজে। নানা ধান্দার খবর দিয়ে যায়। আর বিপ্রদাস তাকে দেখলেই কেন যে খেপে যায়। লোকটাকে দেখলে পুষ্পবতীর মানুষটা আড়ালে থু থু ফেলে। গরমেন্টের লোক, দালাল, শালাকে সুযোগ মতো হাতে পাই—পোঁদে বাঁশ ঢুকিয়ে ছাড়ব। থু থু! লোকটা নেমকহারাম। পঞ্চায়েতের বাবু, প্রভাবশালী মানুষ। জ্যাংরার মোড়ে পেল্লাই বাঁশের আড়ত, সেখানে বাঁশ কেনাবেচা চলে, পেল্লাই সব ফ্ল্যাট বাড়ি উঠছে–বাঁশের ঝাড় সাফ হয়ে যাচ্ছে।

পাজামা পাঞ্জাবি গায়, কখনো তিনি ভোটের বাবুও হয়ে যান—কখনো একা হাঁটেন না, সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে হাঁটেন—বিপ্রদাস আছে। বিপ্রদাস।

কেউ সাড়া দেয় না।

পুষ্পবতী লোকটাকে কেন যে ভয় পায়। কাজের ধান্দায় মানুষটা কোন সকালে বের হয়ে গেছে, অনু বাসে উঠে স্কুলে গেছে—বাড়িটা ফাঁকা। লোকজন নিয়ে হারুবাবু তার উঠোনে, বসতে বলতে হয়, না হলে যে বাড়িঘরের মান থাকে না। পুষ্পবতী মাথায় ঘোমটা টেনে থামের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ায়।

বিপ্রদাস কি বাড়ি নেই।

আজ্ঞে কাজে বের হয়েছেন।

ও কী স্থির করল, কিছু তো জানাল না।

জমিন আর মেয়েমানুষ নাহলি পুরুষের জীবন চলে না, এইসব অঞ্চলে বাঁশের খোঁজে এলে হারুবাবু টের পান। বিপ্রদাসের বাঁশবাগানটি তার নজরে পড়েছে। এত দারিদ্র্য তবু কেউ একটি বাঁশে হাত দিতে পারছে না।

হারুবাবু বললেন, ওকে বলবে আড়তে যেন দেখা করে। ও কীসের আশায় যে বাঁশবাগান আগলাচ্ছে বুঝি না। আরে সময় থাকতে বিক্রি করে দে। বাঘা সরকারের থাবা ঝুলছে—ও কি কিছু টের পায় না।

বারান্দায় পুষ্পবতী আসন পেতে দেয়।

হারুবাবু তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে আর এগোয় না। শোনো বউ মা, কিছু থাকবে না। বাঁশের দর চড়ছে, এই বেলায় বাঁশ বিক্রি না করলে বিপ্রদাসের কপালে দুঃখ আছে বলে দিও। আমরা বসব না। বিপ্রদাস কোনো নোটিশ পায়নি?

আজ্ঞে না। নোটিশ নিয়ে বহু কথা ওড়াউড়ি হয়। আজ্ঞে না বলে সে বোধহয় ঠিক কাজ করেনি।

আরে আজ্ঞে না বললেই হল। সরকারের নোটিশ ফিরিয়ে দিলেই হল! সাধ্য আছে, ফিরিয়ে দেবে, সরকারের লোক এসে ফিরে গেলে কী হয় জান না!

পুষ্পবতী থামের আড়ালেই দাঁড়িয়ে থাকে—সে আর কথা বলে না। কারণ সে তো ঠিক জানেও না, মানুষটা নোটিশ পেয়েছে না পায়নি। তবে মাসখানেক ধরে গুম মেরে আছে।

শোনে বউ মা, দুবার ফিরিয়ে দেবে, টাকা দিলে নোটিশ না ধরিয়ে দিয়েও যেতে পারে গরমেন্টের লোক। তবে কথা একখানা-রেহাই নেই। সই করে নিলে সরকারের ক্ষতিপূরণ সহজেই পেয়ে যাবে। দু-হাজার টাকা কাঠা, বাপের জন্মে শুনেছ, জমির দাম এত মাঙ্গা হয়। নোটিশ না নিলে, দেয়ালে সেঁটে দিয়ে যাবে— তখন তোমার জমিও যাবে, টাকাও যাবে।

পুষ্পবতী কী যে বলে!

নীলু কি এদিকটায় এসেছিল।

পুষ্পবতী নীলুকে ঠিক চেনে না। তবে শুনেছে, কে একজন মাঠচাষিদের উসকাচ্ছে। রোগাপটকা মানুষটার খুবই তেজ। বিপ্রদাসই খবর দিয়েছে। জমি বাঁচাও কমিটি গড়েছে নীলু দত্ত।

হারু হাজরা বলল, বিপ্রদাসকে বলল, নীলুর সঙ্গে যেন ঘোরাঘুরি না করে। সব খবরই পাই। যত সব চ্যাংরামি। আরে বুঝিস না সরকার ময়দানের ঘোড়া ছেড়ে দিয়েছে। নীলুর সাধ্য কী জমি বাঁচাও আন্দোলন করে চাষের জমি রক্ষা করে। বাধা দিতে গেলে জমিও যাবে, মানুষও যাবে।

পুষ্পবতী ভাবল, মানুষটা যে সারাদিনই প্রায় বিবাগি হয়ে থাকে, নীলু দত্তের পাল্লায় পড়ে না কাজে কামের ধান্দায়—সে কিছুই জানে না। চাপা স্বভাবের মানুষ হলে যা হয়।

সে চোখের আড়ালে দাঁড়িয়ে শুধু শুনছে।

শোনো বউ মা, বাঁশের বাগানটিও কম মূল্য ধরবে না। সরকার জমি দখল করার আগে, পোক্ত বাঁশগুলি বেচে দাও। ওকে তুমি বোঝাও। এলাকার বাঁশের সুনাম আছে বলেই না বিপ্রদাসের বাবা সুরদাস তাঁর উরাট এলাকাতে বাঁশের ঝাড় বসিয়ে দিল। নারকেল গাছ, তালগাছ, লিচু, আম যা আছে বেচে দাও। সরকারের দখলে চলে গেলে সব যাবে বলে গেলাম। কেউ রক্ষা করতে পারবে না।

সব তো যাবেই। ময়দানের ঘোড়া ছুটিয়ে দিলে মানুষ তো মানুষ। পাখি প্রজাপতিও দেশ ছাড়া হবে। এই জমি মাটি যে আত্মার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কে বোঝে। পৈতৃক ভিটা, বাবা ঠাকুরদার জমি, কত গাছপালা, কত পাখি উড়ে আসে, সামনের সড়ক পার হলে যতদূর চোখ যায় ধানের জমি, ফুলের চাষও আছে, কেউ কেউ ফুল চাষ করে—তাদের জমি নেই, পৈতৃক ভিটা সম্বল—আর আছে ভিটা সংলগ্ন দুখানা বাঁশ ঝাড়।

পুষ্পবতী বারান্দায় থামে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে—কেমন একা হয়ে যাচ্ছে।

সে হঠাৎ লাফিয়ে উঠল, ভবা গেল কোথায়!

ভবা, ভবারে।

আর তখনই মনে পড়ে গেল, সকাল বেলায় ভাদুর মা এসে ভবার হাত ধরে নিয়ে গেছে।

বউ মা ছেলে যে ছাড়ছে না।

এই, কী হচ্ছে। পিসিকে দেখলেই তোর কী হয়।

ভবা খিল খিল করে হাসে। আর পিসির পেছনে দৌড়ায়।

ঠিক আছে বউ মা, তুমি যাও, আমি তাকে দিয়ে যাব। ভবার কোনো দৌরাত্ম্য নেই, বারান্দায় এক বাটি মুড়ি মোয়া দিয়ে বসিয়ে দিলেই খুঁটে খুঁটে খাবে। এত গাছপালা জঙ্গল, ভবার কি তোমার কোনো অভাব আছে।

তা ঠিক—

এই এক আশ্চর্য পৃথিবী, যে বাঁচে, যে থাকে সেই জানে কী মজা আছে এই বেঁচে থাকার।

হারু হাজরা কেমন তরাসে ফেলে দিয়ে গেল তাকে—একে চৈত্র-মাস।

জল নেই।

ঝিল্লি দেখা যায় প্রান্তরে।

খাল বিল পার হয়ে তাড়িপোতার অন্নপূর্ণার মন্দিরের ত্রিশূলটিও দেখা যায়। সকাল হলে পুষ্পবতী প্রথমেই সেই দূরবর্তী ত্রিশূলটির শরণাপন্ন হয়। ভবার বাবা, ভবারে ভালো রেখো ঠাকুর—মেয়েটা ফ্রক পরে স্কুলে গেছে, স্কুলে গেলেও চিন্তা। যা দিনকাল—মানুষ মানুষকে সুযোগ পেলেই কামড়ে দেয়। রাস্তায় মেয়েটাকে বাস থেকে কেউ যদি জোর করে নামিয়ে দেয়, হারু হাজরা চলে যাবার পরই এসব চিন্তা মাথায় আসে। জমিদারদের কাল কবেই গেছে—ঠাকুরদার মুখে জমিদারদের জবরদস্তির মেলা খবর সে রাখে, এখন পলিটিকসের বাবুরা জমিদার। বাড়িতে এসে না হলে হারু হাজরা হুমকি দিতে পারে—নীলু দত্ত কি তোর ব্যাটা নাক কামড়ে দিয়েছে। নীলু দত্তের সঙ্গে মিশলে কি পুতনা রাক্ষসি তারে গিলে খাবে। এত রোয়াবি, ছিলি তো যোগলের ব্যাটা—পলিটিকস করে বাবু হয়ে গেলি!

পলিটিকসের বাক্স, বিপ্রদাসের কথাবার্তায় লোকটার প্রতি অতি বিষম উক্তি শুনে শুনে পুষ্পবতীও বোঝে পলিটিকসের বাক্সে কী থাকে—বড়ো বড়ো কথা বলে জাগয়া দখলের কথা থাকে, এলাকা দখলের কথা থাকে, পলিটিকস থাকলেও মানুষ বাঁচে, পলিটিকস না থাকলেও মানুষ বাঁচে। মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির অনিষ্টকারীদের পুষ্পবতী দু-চক্ষে দেখতে পারে না।

বিপ্রদাসের মুখেই শোনা।

বুঝলি পুষ্প, আমরা এই ধূর্ত লোকগুলোর পণ্য।

পণ্য।

পণ্য বুঝিস না, আমাদের বেচাকেনা করে বাবুরা। আমাদের লোভ দেখিয়ে ফুলটুসি বানায়। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম হয়। ভাগের ভাগ বাবুরাই খায়। আমরা খাই উচ্ছিষ্ট।

এটা ঝোঝে পুষ্পবতী, মানুষটার মাথা গরমের কারণও বোঝে। উচ্ছেদ। এই একটি কথাই এলাকার মানুষজনের ঘিলু গলিয়ে দিচ্ছে। বিপ্রদাস বাড়ি থাকলে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে। উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিমে যতদূর চোখ যায়, যত বসত আছে সব উড়বে বাতাসে। হাওয়ায় পাতা উড়ে যাবার মতো উড়ে যাবে সব। যত এইসব বিপ্রদাস ভাবে, তত চণ্ড ক্রোধ তাকে পাগল করে দেয়।

বিপ্রদাস বাঁশঝাড়ের তলায় কখনো বসে থাকে, কখনো বাপঠাকুরদার লাগানো আম জাম গাছের দিকে তাকিয়ে বসে থাকেকেমন এক ঘোর সষ্টি হয় ভিটে মাটির জন্য। শুধু নীলুদাই তাদের বল ভরসা। মানুষটা কাগজে উচ্ছেদকারীদের হয়ে খবর ছাপছে। বলে গেছে, শোনো বিপ্রদাস, এই জলাভূমি টাউন হলে সব হবে। নীলুদা মউজা দাগ নম্বর দেখিয়ে তাকে বুঝিয়েছে, সোজা না, সড়ক যাবে লম্বা সড়ক, জল জঙ্গল থাকবে না, সরকার কেনা-বেচায় মেতেছে।

ভাদুই ঠিক বলে, কার জমি কে বেচে। আমরা দাদা বলির পাঠা। মালা গলায় পরিয়ে সাজিয়ে দেবে—কিছুই চিহ্ন থাকবে না, যাদের যূপকাষ্ঠে ফেলে ঘ্যাচাং।

এইসব ভাবলেই বিপ্রদাসের শরীর নিথর হয়ে আসে। তার কিছু ভালো লাগে। চৈত্র মাস। চাষ আবাদের জমি পার হয়ে জলাভূমি শুকিয়ে কাঠ।

জল নেই। সেই কবে শীতে বৃষ্টিপাত, তারপর আর মেঘের দেখা নেই। আকাশ তামার বাসনের মতো চকচকে হয়ে আছে। দিন যায়, মাস যায় আকাশ আর ঘোলা হয়ে ওঠে না। মাঠ খাঁ খাঁ করছে। কিছু শকুন উড়ছিল। দূরে অদূরে বাঁশের জঙ্গল—নিশিতে থেকে বিশ্রী শব্দ ওঠে। কে যেন হেঁকে যায়। তোমার সব হে বিপ্রদাস। তুমি অবেলাতেই রওনা হয়ে যাও, আশায় আশায় বসে থেকো না।

আসলে তার কী মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

দু-দিকের মাঠ ফেলে ছাল চামড়া ওঠানো পাকা সড়ক আটখরার দিকে চলে গেছে। সেখানে গেলেই শহর, সেখানে স্কুল সিনেমা ভি আই পি রাস্তাটা অজগরের মতো চারপাশের বৈভব যেন নিচ্ছে। সেখানে এই সড়ক ধরে বাস যায়, সাইকেল যায়। বাঁশবোঝাই হয়ে যায় গোরুর গাড়ি। মানুষজন নামে ওঠে। রাস্তার পাশে কোথাও টালির কারখানা। আবার দূরে গেলে মাছের ভেড়ি, আরও দূরে গেলে ইটের ভাঁটা। ভাঁটাগুলির পাশ দিয়ে পাকা রাস্তার মেলা ডালপালা বের হয়ে গেছে। কোনওটা হাসনাবাদ যায় কোনওটা বারাসতের দিকে—আবার বসিরহাটের রাস্তাও তার চেনা। কিংবা সাইকেলে কিছুটা গেলেই হাসনাবাদ যাবার রেলে উঠে পড়া যায়।

এইসব রাস্তার বিপ্রদাসকে যাওয়া আসা করতেই হয়—সেই জনম ইস্তক সে রাস্তার দোকানপাট, মানুষজন, গাছপালা পার হয়ে সুমার প্রকৃতির বনজঙ্গলে, যত রকমের গরিব পুরুষের বসতি দেখে দেখে বড়ো হয়েছে। কেউ ফিরি করে, কেউ মাছ ধরে, কেউ ফুরনে প্লাম্বার মিস্ত্রি, ইটভাঁটাতেও কাজের মানুষ মেলা—যতদূর চোখ যায়, সবার মধ্যেই আছে প্রিয়জন, প্রিয় ভূমি, গেরস্থ মানুষও মেলা, ইটের কোঠাবাড়ি, টালির ঘর, ছনে ছাওয়া বাহারি ঘর, হাল গোরু গোয়ালে-কুকুর বেড়ালও চেনা যায় তারুলিয়ার ঘোষবাড়িতে গেলে—একটি মহাবিশ্ব নিয়ে যে তার বাস। উচ্ছেদ করলেই হল—যত ভাবে তার মাথা গরম।

সেই সে বছর তার লায়েক পুত্রটির মৃত্যুদৃশ্যও চোখে ভেসে ওঠে। স্মৃতির শেষ নেই–গাছপালায় তার সব স্মৃতি মাখামাখি হয়ে আছে। সে গাছ বেচে না, বাঁশ সহজে বেচে না, পাকা বাঁশঝাড়ের পুষ্টি হবে ভেবেই বেচে তার আটান্ন শতক জমির মধ্যে কী নেই—একটা সফেদা গাছ পর্যন্ত আছে। লিচ গাছটায় ঝেপে লিচ হয়, লাল হয়ে থাকে গাছের ডালপাতা। ফুলের গন্ধেই সে টের পায় কোন গাছের কোন ফুল। আমের মুকুলের গন্ধ উঠলে আধা আধা হয়ে যায় পাতা ডাল। কত কিছুর যে স্মৃতি—সে ভেবে ভেবে শেষ করতে পারে না। যেন এক জন্ম এবং জন্মান্তরের অস্তিত্ব গাছপালার মধ্যে এবং আটান্ন শতক জমিতে লেপ্টে আছে।

সে ডাকল, বউ এক গ্লাস জল দে।

মানুষটা তার এই রকমের—বের হলে বাড়ি ফিরতে চায় না।

বাড়ি থাকলে বের হতে চায় না।

তার শুধু অপেক্ষা।

এই অপেক্ষাও যে ঘরবাড়ি গাছপালায় জড়িয়ে থাকে।

পুস্পবতী এক গ্লাস জল দিয়ে বলল, কাল খেতি ঘুরে গেছে। বলল, দাদা বাড়ি নেই।

খেতি তার বাড়ির লাউ, কুমড়ো, সিমের মাচান করলে সিম, পালং শাক, ঢেরস, ঝিঙে, যে দিনকার যা কিনে নিয়ে যায়। আমের দিনে আম, লিচুর দিনে লিচু, কাঁঠাল গাছ দুটোও কম যায় না। উঁচর থেকে বিক্রি শুরু। পাকা কাঁঠালে শেষ। চৈত্র মাস। বৃষ্টি নেই, লাউ-এর মাচানে ফুটো লাউ ঝুলছে, খেতি তারই লোভে ঘুরছে, সে বোঝে। একেবারে কচি, আরে বাড়তে দে।

আসলে খেতি যেন তার চেয়ে বেশি টের পায়। বাড়িটায় সে সওদা করতে আসে। বিপ্রদাস বসে থাকে না। সারাদিন কোদাল মেরে জমি সরেস করে রাখে। জায়গায় জায়গায় সিম, লাউ-এর বিচি লাগিয়ে রাখে। যেদিনকার যা। খেতি জানে কোথাও কিছু না পেলেও বিপ্রদার জমিতে কিছু না কিছু ফলন থাকে। ওই তো মোচা ঝুলছে।

ওই তো লেবু গাছের, লেবুর ফলন—দিন দাদা।

তারপর দামদর হয়।

খেতি মাথার ঝাঁকা নামিয়ে বসে। তারপর ফাঁকা ঝাঁকা দেখিয়ে বলবে, আপনারা আছেন বলে আমরাও বাঁচি। দাদা আপনার গন্ধরাজ লেবুর বড় সুখ্যাতি।

বাড়ি এবং জমির এখানে সেখানে কত রকমের যে জীবনের উৎস। কাঁচালংকার গাছও আছে। বারোমাসই লংকার ফলন হয়। আট-দশটা গাছ কি বাড়ন্ত, ফুল ফুটছে তারপর লংকা, তারপর এই ধানি লংকার বাজারও খুব ভালো–সপ্তাহের এক দু-দিন। এই বাড়িটায় তার কিছু না কিছু সওদা হয়ে যায়।

সে বলে, তোমার ঘরে লক্ষ্মী বাঁধা। যাতে হাত দেও তাতেই সোনা ফলে। বউদি যে তোমার অন্নপূর্ণা দাদা।

এইসব সোহাগি কথায় পুষ্পবতীও গলে যায়। কিছু না কিছু খেতিকে খেতে দেয়। যখন যা হয়, কখনো মুড়ি, না হয় রুটি, আলুর হেঁচকি। খেতে পেলে সে আরও সোহাগি হয়ে যায়। তবে সে দাদাকে ঠকায় না, ন্যায্য দাম দেয়। পুষ্পবতী আজও বারান্দার খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই মানুষটা কোন সকালে বের হয়েছে ফেরার নাম নেই। ঘুরে আসছি বলে বের হল।

কিন্তু ফিরছে না।

সকাল গেল, দুপুর গেল ফিরে এল না।

এই এক বাতিক। বের হলে আর ফিরতে চায় না।

কোথায় যে গেল মানুষটা! বলেও গেল না। তবে এমন যে হয় না, কতবারই দেখেছে, অনেক রাত হয়ে গেছে ফিরতে। তবে কেউ না কেউ খবর দিয়ে গেছে, কাকা হাসনাবাদের রেলে উঠে গেল। খবরটা দিতে বলল। চিন্তা করবে না কাকি। রাত হবে ফিরতে।

মানুষটার বাঁধা মাইনের কোনো কাজ নেই। রাস্তার মোড়ের হাসুর চায়ের দোকানেও মাঝে মাঝে বসে থাকে। রোজগারের ধান্দায় মানুষজনের সঙ্গে মিশে থাকতে ভালোবাসে। বাড়িতে ফিরলেই মাথা গরম করে ফেলে।

তখন পুষ্পবতীর ভয় হয়।

আরে ছ্যাঁচড়া জীবন আমার। বউ তুমি বোঝ না। মানুষটার মাথা গরম হলে জীবন সম্পর্কে ধিক্কারেরও শেষ নেই। গাছের ফলন, মাচানের ফলন কিংবা চাষের ফলনে তার যে জীবন নির্বাহ হয় না।

সে জীবন নির্বাহের জন্য ঠেকও খাটে।

কখনো মাছের ভেড়িতে, কখনো বাঁশের জঙ্গলে অথবা ইটের গাড়িতে উঠে তেঘরিয়া, বাগুইআটি, জ্যাংরা যেখানে যখন সুবিধা পায়, চুন সুরকি বালি ফেলে দিয়ে আসে।

কোথায় যে গেল!

কত কাজ। অনুর স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়ে গেল। ভবা ফড়িং-এর পেছনে ধাওয়া করছে। সে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। কাউকে দেখলেই এই মলয়।

আমায় ডাকছেন কাকি?

তোর কাকাকে দেখেছিস।

না কাকি।

কোথায় যে গেল। কিছু বলেও গেল না।

কেমন তরাসে পড়ে যাচ্ছে পুষ্পবতী। তরাস থেকে আত্মরক্ষার জন্য ছুটে গিয়ে ভবাকে কোলে নিয়ে বাড়ি থেকে নেমে গেল। ভবা কোলে থাকলে সে সাহস পায়। কেউ তার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না, সে সহজেই দরজায় শেকল তুলে এ-বাড়ি সে-বাড়ি যেতে পারে। মানুষের সঙ্গে কথা বললেও সে জোর পায়। রাস্তার। দাঁড়িয়ে অচেনা লোকের সঙ্গে কথাও বলতে পারে। এবং এভাবে সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখতে পায়, মানুষটা ফিরছে। এই ফেরা যে জীবনে কত মাধুর্য তৈরি করে পুষ্পবতীকে না দেখলে বোঝা কঠিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *