[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

খুব কাছে, অনেক দূরে

খুব কাছে, অনেক দূরে

একটা সময় ছিল, যখন মাইলগুলো ছিল দারুণ লম্বা লম্বা। এখনকার কিলোমিটারের অন্তত পাঁচ ছ’গুণ তো হবেই। কুড়ি-পঁচিশ মাইল দূরত্ব তো বিরাট ধু-ধু করা ব্যাপার। এই তো কলকাতা থেকে যশোর এখনকার হিসেবে মাত্র একশো মাইল, যে-কোনো গাড়িতেই বড় জোর চার-পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। আর এক সময় কলকাতা থেকে সকালে বেরিয়ে যশোরে পৌঁছতুম মাঝ রাত্তিরে। সেখান থেকে স্টিমারে ফরিদপুরে আমাদের গ্রামে পৌঁছতে আরও একদিন প্রায়। আমাদের বাড়ি থেকে মামাদের বাড়ি ছিল পঞ্চাশ-ষাট মাইল দূরে। বছরে দুবারের বেশি সেখানে যাওয়া যেত না, ওই পঞ্চাশ-ষাট মাইল পার হতে লাগত পাক্কা দেড় দিন। সেটা অবশ্য নৌকো-পথে।

আর মুঙ্গের-ভাগলপুর এসব তো ছিল বহু দূরের দেশ, সেই পশ্চিমে, মিরাট-দেরাদুনের সঙ্গে বিশেষ তফাত নেই। সেখানে যারা যায়, তারা নির্বাসনেই যায়। কচিৎ তারা ফিরেও আসে।

সেই রকমই একবার শুনলুম, আমাদের ভাগলপুরের মাসীমা এবার পুজোতে আসছেন। আমার এই মাসিমার মুখও আমার ভালো মনে নেই, অনেক ছেলেবেলায় এঁকে দেখেছি, অবশ্য অন্যান্য মামা-মাসি ও মায়ের কাছে এঁর গল্প শুনি প্রায়ই। ভাগলপুরে আমার দুজন মাসতুতো ভাইও জন্মে গেছে এর মধ্যে। তাদের একেবারেই চিনি না। শুধু নাম জানি।

আমাদের মামাবাড়ির পুজোয় লোক আসত অনেক। দাদুশ্রেণি এবং মামাশ্রেণির অনেকেই চাকরি করতেন প্রবাসে, কেউ রেলে, কেউ কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউ সাহেব কোম্পানিতে। পুজোর সময় সবার দেশের বাড়িতে আসা চাই। কিন্তু বিবাহিতা মাসিমা যাঁরা দূরে চলে গেছেন, তাঁদের আর দেখতে পেতুম না বিশেষ। তার মধ্যে সেই সুদূর ভাগলপুর থেকে আমার নতুন দুটি ভাই সমেত এক মাসী আসছেন শুনেই বেশ একটা চনমনে আনন্দ হতে লাগল। সেই একটা বয়েসে যখন বিস্মিত হবার জন্য মন উন্মুখ হয়ে থাকে।

বাস-ট্রেন-স্টিমার ও নৌকো চেপে আসতে হবে ওঁদের, তিন-চার দিন তো লাগবেই। গরু আর শরৎচন্দ্র এই দুটি ব্যাপারেই শুধু ভাগলপুর আমাদের কাছে পরিচিত। আমাদের ধারণা, বেলুনের মতন বাঁটওয়ালা প্রচুর গরু সেখান ঘুরে বেড়ায়, রাস্তার পাশের নর্দমাতে প্রচুর দুধ গড়িয়ে যায়। আর শরৎচন্দ্র ওরফে শ্রীকান্তের বন্ধু ইন্দ্রনাথ নামে দুর্দান্ত একজন মানুষ ওখানে থাকে। মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ হত, আমাদের এখানে আকাশ যেমন নীল, ভাগলপুরের আকাশও কি সেরকম? সবাই যে বলে পশ্চিমের দেশগুলো খুব শুকনো খটখটে।

প্রবল বর্ষায় নদী-নালা-পুকুর-বিল সব অতিরিক্ত উচ্ছল। এরই মধ্যে মাঝে মাঝে নৌকো উলটে যাবার খবর আসে। বর্ষাকাল শেষ হয়ে গেলেও প্রায়ই চোরা ঝড়বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। নৌকো দুর্ঘটনার কথা শুনে বাড়ির সবাই ভয়ে কাঁটা। ভাগলপুরের মাসিরা আসবার পথে যদি দৈবাৎ এরকম কিছু হয়? অন্য কারুর সম্পর্কে এ ভয় নেই, নৌকো উলটোলে কিছু জিনিসপত্র নষ্ট হবে বড় জোর, প্রাণের কোনও ভয় নেই। আমরা তো ইচ্ছে করেই কতবার ডিঙি নৌকো উলটেছি। ভরা বর্ষার সময় বন্ধুর বাড়িতে যেতে হলে নৌকোর জন্যে বসে থাকিনি, প্যান্টুল আর গেঞ্জি খুলে বাঁ হাতে উঁচু করে ধরে ডান হাতে সাঁতরে চলে গেছি।

কিন্তু ভাগলপুরের মাসতুতো ভাইরা তো সাঁতার জানে না! ভাগলপুরের মেসো সারাজীবনই কাটিয়েছেন ওই দেশে, তিনি নাকি জলকে খুব ভয় পান।

সেইজন্য একখানার বদলে তিনখানা নৌকো পাঠানো হলো ওঁদের আনবার জন্য। মাইল সাতেক দূরে স্টিমার ঘাটা। তবে সাত মাইল তো যে-সে সাত মাইল নয়, তার মধ্যে অনেক হ্যাপা।

নৌকো একেবারে আমাদের বাড়ির দোরগোড়ায় আনবার ব্যবস্থা আছে। যদিও বাড়ির পাশে নদী নেই। সামনের দিকের বারোয়ারি দিঘিটি বিরাট, তার একটা দিক খুলে দিলে (স্থানীয় ভাষায় বান কাটা) একটা মাঝারি খালের সঙ্গে সংযোগ হয়। অর্থাৎ নদী থেকে নৌকো আসবে সেই খালে, তারপর খাল থেকে পুকুরে। বাড়ি পর্যন্ত মটোরেবল রোডের মতন নৌকো-পথ।

সারা বাড়ির তিরিশ-চল্লিশজন লোক পুকুরধারে দাঁড়িয়ে আছে অধীর প্রতীক্ষায়। এক সময় খাল দিয়ে তিনটি নৌকো ঢুকলো দিঘিতে। সবাই নিরাপদেই পৌঁছেছে। সামনের নৌকোটিতেই দাঁড়িয়ে আছেন ভাগলপুরের মেসো। ফর্সা, ছিপছিপে চেহারা, মাথায় কোঁকড়া চুল, হিটলারি গোঁফ, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, গায়ে গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি আর কোঁচানো ধুতি, কাঁধের ওপর পাট করা শাল। কেন জানি না, শরৎচন্দ্রেরই লেখা নতুনদা চরিত্রটা মনে পড়ল সেই মেসোকে দেখে।

প্রায় সেই রকমই একটা কাণ্ড করলেন তিনি। ঘাটে নৌকো লাগবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অতি উৎসাহে দিলেন একটি ছোট লাফ। লাফ দিলেই যে পায়ের তলা থেকে নৌকো সরে যায় সেটা তিনি জানতেন না, সুতরাং তাল সামলাতে না পেরে ঝপাং করে পড়লেন জলে। একেবারে তীরে এসে তরী ডোবার মতন ব্যাপার। তিরিশ-চল্লিশজন মানুষ একসঙ্গে ‘ই’ শব্দ করল।

ভাগলপুরের মেসো অবশ্য বেশ স্মার্টভাবেই জল থেকে উঠে এসে বললেন, ‘আরে, কিছু হয়নি! তোমাদের একটু চমকে দিলাম আর কি!’

আমাদের ওপর আগে থেকেই নির্দেশ ছিল যে অনেকদিন পরে মাসী-মেসো আসছেন, কথা বলার আগেই পায়ের ধুলো নিতে হবে। এখন যদিও ধুলো নেই, তবু ভাগলপুরের মেসোর ভিজে পায়ের ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়লুম। তিনি সস্নেহে আমার থুতনি ধরে নেড়ে দিয়ে তারপর নিজের হাতটায় চুমু খেয়ে বললেন, কেমন আছিস রে, বেটা?

এর আগে আমি কখনো কারুকে এরকম নিজের হাতে চুমু খেতে দেখিনি। তার চেয়েও আশ্চর্য হলুম বেটা কথাটা শুনে। আমাদের এখানে বেটা তো গালাগালের সময় বলে। তাও তো ছোটদেল বলে না কেউ। অবশ্য ভাইপোকে অনেকে ভাইয়ের ব্যাটা বলে বটে। কিন্তু সেটা ভালো খারাপ অর্থে, সে ব্যাপারে কখনও নিশ্চিত হতে পারিনি।

আমার মাসিকে প্রণাম করায় তিনি বললেন, ও মা, সুকুমার, তুই এত বড় হয়ে গেছিস? অ্যাঁ?

তখন পাশ থেকে আমার অন্য এক মামাতো ভাই বললো, আমার নাম সুকুমার!

তখন মাসি বললেন, ও, ভুল হয়েছে তো, তুই বুঝি তবে চণ্ডীচরণ? কী সুন্দর চেহারা ছিল তোর ছোটবেলায়।

চণ্ডীচরণ নামে অবশ্য কারুকে খুঁজে পাওয়া গেল না। তারপর প্রত্যেকদিন দেখেছি, আমার ভাগলপুরের মাসির নাম ভুলে যাওয়ার এক দুরন্ত প্রতিভা আছে। বাড়ির কোনও লোককেই উনি ঠিক নামে ডাকেন না। তবে চমৎকার মধুর স্বভাব তাঁর। কী করে সবাইকে খুশি রাখবেন এই নিয়ে তিনি নিরন্তর ব্যস্ত।

আমার মাসতুতো ভাই দুটির সঙ্গে কিন্তু ভাব জমল না প্রথম দিন। দুই ভাই সব সময় পাশাপাশি থাকে, খুব গম্ভীর, আমাদের দিকে আড়চোখে তাকায়। কিন্তু জিগ্যেস করলেও সহজে উত্তর দেয় না। তবে কি ওরা আমাদের গাঁইয়া ভাবছে? আমরা জানি কলকাতার ছেলেরা খুব কাইডিস মার্কা হয়। কিন্তু ওরা তো ভাগলপুরের ছেলে, ওদের কি অত যোগ্যতা আছে? অবশ্য, আমি লক্ষ করেছি, ওরা সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই চুল আঁচড়ায়। আমাদের তো চিরুনির সঙ্গে সম্পর্ক দিনে একবারই, দুপুরে স্নানের পর। তাও এক-একদিন বাদ যায়।

একদিন বাদে বুঝতে পারলুম ওদের আসল অসুবিধেটা। ওরা ভালো বাংলাই বলতে পারে না। আমরা বলি, উনি আমার মামা। ওরা বলে, উনি আমার মামা হচ্ছেন! তাই শুনে সুকুমাররা ফাজলামি করতে লাগল, ‘ও, উনি এখনো পুরোপুরি মামা হননি তাহলে, তৈরি হচ্ছেন?’

তা ছাড়া আমরা বাঙালরা সূর্যবংশীয় কিনা, তাই কথায় কথায় চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করি না। এরা আবার ঘোর চন্দ্রবংশীয়, এত যে চন্দ্রবিন্দু ছিল তা আমরা জানতুম না। আমরা দাঁতকে বলি দাত। হাঁসকে বসি হাস। আর এরা দাঁ-আঁ-আঁ-তঁ! হাঁ-আঁ-আঁ-স। এমনকি ভাতকেও বলে ভাঁ-ত, আর ঘি-কে বলে ঘি! আমরা ভাতের সঙ্গে ঘি খাই আর ওরা ভাঁতের সঙ্গে ঘি খেতেই চায় না। এ দেশের ঘি-তে নাকি ওদের গন্ধ লাগে!

দু’দিনের মধ্যেই অবশ্য এসব দূরত্ব ঘুচে যায়। পায়েসের মধ্যে কিসমিসের মতন ওরা বাড়ির একদঙ্গল ছেলেমেয়ের মধ্যে একটু আলাদা হয়ে থাকলেও মানিয়ে যায় চমৎকারভাবে। আমরা ওদের নিয়ে মজা করি, ওরাও আমাদের নিয়ে মজা করে। ভাগলপুরের ছেলেদের আর একটা চমৎকার গুণ আমাদের চোখে পড়ে। ওরা কক্ষনো কোনো ব্যাপারেই মা-বাবার কাছে নালিশ করতে যায় না। ওরা আমাদের চেয়েও বেশি হাসতে পারে।

ভাগলপুরের মাসি সম্পর্কে সবাই বলতে লাগল, ও একদম বদলায়নি, বিয়ের আগেও যেমন ছিল, এখনও তেমন, আর ভাগলপুরের মেসোকেও দেখা গেল দারুণ রগুড়ে লোক, উনি ‘নুচি’ আর ‘নেবু’ মার্কা কথা বলেন আর দিনে সাত-আট কাপ চা খান বটে, কিন্তু ওর কাছে অফুরন্ত গল্পের স্টক।

হুস করে কখন দিনগুলো কেটে যায় খেয়ালও থাকে না। এই পুজো পুজো বলে এতদিনের প্রতীক্ষা, হঠাৎ একদিন শুনতে পাই ঢাকে বিসর্জনের বাজনা বাজছে। কী যেন আছে এই বাজনার

মধ্যে, বুকটা ধড়াস ধড়াস করে, একটু একটু জ্বালা করে চোখের কোণাগুলো। এ তো শুধু বিসর্জন নয়, এ যে আত্মীয় বিচ্ছেদের সময়। বাইরের কোনও পৃথিবী সকলের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে, সবাইকে এবারে যে-যার জায়গায় ফিরে যেতেই হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *