এক বিশ্বব্যাপী একাকিত্বের মধ্যে

এক বিশ্বব্যাপী একাকিত্বের মধ্যে

একজন মানুষ খোলা আকাশের নীচে
মঞ্চে ওঠার আগে
সিঁড়িতে থমকে দাঁড়িয়ে আপন মনে
বললো,
জিততে হবে, জয়টাই বড় কথা,
আর কিছুই কিছু না
তারপর বিজয়ীর ভূমিকায় অভিনেতার মতন
কাঁধের কার্নিস উঁচু করে
হাতে অদৃশ্য অস্ত্র, চোখে সেই অস্ত্রের রশ্মি
উঠতে লাগলো ওপরে
যদিও তলপেটে ক্ষণিকের জন্য একটা প্রজাপতি
হাঁটুতে দুএক টুকরো ভয়, ওষ্ঠে অভ্যেসমন অহংকার
জন-উপসাগরের সামনে দাঁড়িয়ে
আবার বিড়বিড় করলো সেই বীজ মন্ত্র
জয়ী হতে হবে
আর কিছুই কিছু না
তারপর দুকূলপ্লাবী অবিশ্বাস ও দখিনা বাতাসের মতন আশ্বাস
নিয়ে
কালো কালো অসংখ্য মাথাগুলির দিকে তাকিয়ে
সে উঁচিয়ে ধরলো তার তৃতীয় পা
কিছুটা দূরে একটি শিশু পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে
হিসি করছে
কেউ দেখছে না তাকে
কেউ জানে না, তাকে কক্ষনো জয় করা যাবে না
সে অপরাজেয়

একটা আয়নার মধ্যে একটি মেয়ের মুখ
কিন্তু যে সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার নয়
চুড়ো চুল বাঁধা ও ধারালো অলংকার পরা
রমণীটি আর্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠলো
এ কী? এ কে?
ওটা একটা পাঁজির বিজ্ঞাপনের জাদু দর্পণ
কাঞ্জিভরম শাড়ি পরা যুবতীটি দেখলো এক
পাগলিনীকে বাথরুমে অন্য কারণে গিয়ে
একজন হু হু করে কাঁদলো
যে কখনো ভালোবাসে নি, সে কাতর হলো
ভালোবাসায়
একজন যোদ্ধা দেখতে পেল ভূমি ভর্তি ইদুরের গর্ত
একজন মহিলা বিচারক সহসা বন্দি হলো
গুপ্ত করে বিছানায়
কঠিন গারদে
এমনকি দুএকটি চন্দ্র তারকা হয়ে গেল
আধখানা নোখের যোগ্য
কোনো ষড়ৈশ্বর্যশালিনীর শিকলের ঝন ঝন শব্দ থেকে
ঝরে পড়লো
মর্চে পড়া অশ্রু
একটি স্তনবৃন্তের কম্পন যেন তার।
আলাদা ইচ্ছে-অনিচ্ছের জীবন
যদিও মায়া আয়নায় এসব কিছুই নেই, সবই অলীক
শুধু রাত্রি-জাগা দুঃস্বপ্ন
সেই রাত্রির জানলার ওপাশে যে রাস্তা।
তার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আছে।
একটি ন্যাংটো বাচ্চা
সে-ই চোখ টানছে!

আসলে, পরেশের দাড়ি-না কামানো থুতনিতে
ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে
একটা ঠোক্করই যথেষ্ট
তবে, গোরস্তানের পাশের থানায় গিয়ে
আগে জিজ্ঞেস করতে হবে
পায়ের নোখ ও ধুলো বিষয়ক খবরাখবর
পরেশ হঠাৎ ইসমাইল হয়ে যায় নি তো,
ছোটে মিঞা কিংবা ছোটে লাল
কি ইদানীং
বড়ে মিঞা কিংবা বড়ে লাল
পরেশের নাম হাবুল হওয়াও অস্বাভাবিক নয়
যার বুড়ো আঙুল অন্যের থুতনি ভোঁতা করার মতন
কিছু গুরুত্বর দায়িত্ব নিয়েছে
তার নামও শুধু বুড়ো হলে।
আপত্তির কিছু নেই
রেল লাইনের পাশে একটা আলাদা জগৎ
যেখানে হাবুল খুঁজছে পরেশকে, কখনো
হাবুল শুয়ে থাকছে পিঠ উল্টে কখনো পরেশ ঢুকে যাচ্ছে।
শুকিয়ে যাওয়া খালের খুব নিচু গর্তে
আর ইসমাইলের হাঁ করা মুখের মধ্যে বুলেট
শিশির মাখা ঘাসের ওপর দিয়ে আস্তে আস্তে
এগিয়ে যাচ্ছে একটি বহুরূপী
গিরগিটি

সে জানে, আবার পরেশ আসবে, আবার
ও হাবুল-ইসমাইল বুড়োদের খেলা
শুরু হবে একটু পরেই
ওদের কেউ সুতো ধরে টানছে, কত রঙের সুতো
মধ্য রাত্রির নিশুতি মাঠে ঐ সব খেলার মধ্যে হঠাৎ
থেমে গেল ট্রেন
ইঞ্জিনের জোরালো আলোয় ফ্রেমে বাঁধানো ছবির মতন
ফুটে উঠলো
ন্যাড়া মাথা একটি নেংটি বাচ্চা
তার ঠোঁটে পুঁচকে পুঁচকে হাসি…

মৌমাছিরা মধু জমায় মানুষের জন্য
হাঁস-মুর্গীরা ডিম পাড়ে মানুষের জন্য
স্বয়ং ব্রহ্মাও পাঁঠা-গরু-ছাগলদের কোনো
সান্ত্বনা দিতে পারেন নি
পুকুরে শালুক ফুটছে মানুষের জন্য
পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসছে নদী মানুষের জন্য
ধুলোর মধ্যে খসে পড়া বীজ একদিন মহীরুহ হচ্ছে
মানুষের জন্য
মরুভূমি কাছে এগিয়ে আসছে মানুষের জন্য
বিন্নি ঘাস ও তলতা বাঁশ বুক পেতে দিচ্ছে।
মানুষের জন্য
ধরিত্রী স্বেচ্ছায় ফালা ফালা হচ্ছেন মানুষের জন্য
তবু একটি তীক্ষ্ণ স্বর, সব কিছু ঢেকে দেয়
একটি শিশুর কান্না
একটি কালো রঙের ব্রজের দুলাল যেন
তার ফোলা পেট থেকে ঠিকরে আসছে নাভি
পা দুটি ধনুকের জ্যা-এর মতন
বাঁকা
তার বুকে এক আকাশ জোড়া তৃষ্ণা
এক বসুন্ধরা জোড়া খিদে
তার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে হাউই…

যারা ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান গড়েছিল
যারা সমুদ্রের বুকে নির্মাণ করেছিল সন্ত মিশেলের টিলা
যারা শূন্যের পটভূমিকায় সাজিয়েছে তাজমহল
যারা সোনালি সেতু দিয়ে ছুঁয়েছিল দূরতর দ্বীপ
যারা হারমিটেজ সংগ্রহশালায় জাজ্বল্যমান করেছে
মানুষের
হৃদয় ও মনীষার শ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলি
যারা বাষ্পকে করেছে ভৃত্য, বিদ্যুতকে আলাদীনের প্রদীপের
দৈত্য
যারা চাঁদের বুকে পা দিয়ে টেলিফোনে বার্তা পাঠিয়েছিল
পৃথিবীকে
যারা ভাঙতে চেয়েছিল দেশ সীমার দেয়াল
তারা নিজের সন্তানদের আদর করতে করতে কোন ছবি দেখেছিল
আগামী কালের
গ্যালিলিও কি মাটিতে পা ঠুকতে ঠুকতে ভেবেছিলেন
তাঁর উত্তর পুরুষেরা
রাজনীতির পাশা খেলোয়াড়দের ক্রীতদাস হবে
লুই পাস্তুর কি জানতেন পাগলা কুকুরে কামড়ানো
যে কিশোরটিকে তিনি বাঁচালেন
তাঁর জীবন-মরণ বাজি ধরা চেষ্টায়
সে অকারণে এক মুহূর্তে মরে যাবে একটি সৈনিকের
গুলির ফুৎকারে
সহস্র সূর্যের দীপ্তিতেও কি ওপেনহাইমার
দেখতে পান নি
সেই টলটলে পায়ে
হেঁটে যাওয়া শিশুটিকে…
সমস্ত আগুন নিভে যাওয়ার পর আকাশ ছেয়ে আছে
ছাই রঙের অন্ধকারে
যেখানে প্রাসাদমালা ছিল সেখানে
একটি বিরাট দগদগে ঘা
যেখানে নদী ছিল সেখানে নদী নেই
যেখানে পাহাড় ছিল সেখানে নেই এক টুকরো পাথর
যেখানে ভালোবাসা ছিল, সেখানে দীর্ঘশ্বাসও শোনা যায় না
যারা জয় চেয়েছিল, তাদের কঙ্কালও মাটি পায় নি
যারা রূপ চেয়েছিল, যারা স্বপ্নে সৌধ গড়েছিল
যারা লড়েছিল মানুষে মানুষে সাম্যের জন্য,
যারা আরাধনা করেছিল অমরত্বের
যারা প্রতিদিন জল দিয়ে, স্নেহ-মমতায় বানিয়েছিল
ছোট ছোট সাংসারিক উদ্যান
তারা আজ কেউ নেই
পরাক্রমের প্রতিদ্বন্দ্বীরা একই সঙ্গে গুঁড়ো হয়ে গেছে
চরাচর জুড়ে এক নিবাত নিষ্কম্প নিস্তব্ধতা
তার মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি শিশু
সমস্ত ঘৃণা ও অবিশ্বাসের গরল মন্থন করে
সে ঠিক উঠে এসেছে আবার
এক বিশ্বব্যাপী একাকিত্বের মধ্যে সে হাঁটছে
আস্তে আস্তে পা ফেলে
তার শীত করছে
শুধু তার জন্যই আবার জাগতে হবে সূর্যকে।