একটি কবিতা লেখা

একটি কবিতা লেখা

প্ৰতিধ্বনি তুমি তো স্বর্গের দিকে গিয়েছিলে
কেন ফিরে এলে
?

একদিনে লিখিনি। ‘প্ৰতিধ্বনি’ শব্দটা অত্যন্ত দুর্বোধ্য ও অবাস্তব ভাবে মাথার মধ্যে কয়েকদিন ঘুরঘুর করতে থাকে। শেষ কবিতা লেখার দেড়মাস পর। কী সাধারণ কথা এই প্ৰতিধ্বনি, তবু তারও একটা দাবি টের পাই। অসহায়ের মতো আমি তাকে ফিরিয়ে দিতে চাই, তৎক্ষণাৎ কোনো কবিতা লিখতে আমার ইচ্ছে না। কিসের প্রতিধ্বনি তা জানি না। জীবন কাটছে কী রকম-অবিরল দুপুর, বিদেশের চিঠি, পয়সা নেই, সন্ধেবেলা থেকে মধ্যরাত্ৰি অসম্ভব চোখ বুজে ছোটাছুটি, অপরের কবিতায় ঈষা, পুলিশের প্রতি হাসােহাসি। প্রতিধ্বনিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম, অর্থাৎ খুব দূরে পাঠিয়েছিলাম, নিশ্চিত তা হলে স্বর্গে আমার ব্যক্তিগত দূত। প্রথম লাইনটা তৈরি হয়ে যায়। যেন প্রতিধ্বনিকে বলেছিলাম, তুমি স্বর্গে যাও, গিয়ে বলো, আমি আসছি।

বাঙ্গুর কলোনি দিয়ে দুপুরে হাঁটছিলুম। পাশের মাঠে ছেলেরা ক্রিকেট খেলছিল হয়তো, আমি দেখিনি। ‘কোনো কবিতা লিখছো, সুনীল?’ না, মাত্র একটি লাইন ভেবেছি। অত্যন্ত স্মার্ট ভঙ্গিতে নীরেনদা বললেন, ‘দাঁড়াও, ওই ছেলেটির একটা বল করা দেখি, তারপর তোমার–’ মাঠের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। একটা রোগা ছেলে বেজির মতো ছুটে এসে হলুদ বাড়ির দেওয়ালের দিকে বাতাপী লেবু ছুঁড়লো। ইল্বল কোথায়? আমি তারপর আর কিছু দেখতে পেলুম না। ‘বলো, তোমার লাইনটা।’ বলে আলতো ভাবে জিজ্ঞেস করি, ‘দিকে’র বদলে ‘পানে’ বসালে কেমন হয়? স্বর্গের পানে? ‘আমার মনে হয় তোমার ‘দিকে’ই বসানো উচিত, কেননা’,…আরও কিছু কথা হয়েছিল, কিন্তু ততক্ষণে আমি দ্বিতীয় লাইনটা পেয়ে গেছি। ‘কেন ফিরে এলে?’ যেহেতু না ফিরে উপায় নেই। যেহেতু আমার সময় পূর্ণ হয়নি। প্রতিধ্বনি এখনও পুণ্যগর্ভা হয়নি। পূর্ণ না পুণ্য? যাই হোক, ও দুটো একই। অর্থাৎ এবার কবিতাটা না লিখে আমার উপায় নেই।

বাড়ি ফিরতে অনেক বেলা হলো। স্নান করে খেয়ে টেবিলে বসবো ভেবেছিলাম। সিগারেট নেই। ভাতের পর সিগারেট না টেনে কবিতা লেখা? বাইরে সিগারেট কিনতে বেরিয়ে হাতের সামনে একটা বাস পেয়ে কলেজ স্ট্রট চলে যাই। বিকেল থেকে তারপর অন্ধকার। পরদিন সকালে প্ৰণবেন্দু ও উৎপল এলো। আমরা তিনজনে মিলে ছ’জন মানুষের গলার আওয়াজ শুনলুম। আর একটু থাকবেন? না। তুমি এখন বেরুবে? না। অলিন্দের কবিতাটা লেখা হয়ে গেছে? হ্যাঁ, হ্যাঁ, কালকেই কপি করে—, তখনও তৃতীয় লাইনটা পাইনি। দুপুরে দীর্ঘ মিছিলের পিছনে পিছনে মন্থর বাস।

আবার সকালে, চা খাওয়া হলো, প্রচুর সিগারেট হাতে, তন্নতন্ন করে কাগজ পড়াও শেষ হয়েছে। এবার–? এবার মুখোমুখি হতেই হবে। হাতের সামনে প্রথম সাদা কাগজে ঝাঁটু করে লাইন দুটো লিখে ফেললুম। লিখে অনেকক্ষণ বসে থাকি। তৃতীয় লাইন নেই। যে কোনো কবিতার তৃতীয় লাইনই বোধ হয় সব চেয়ে শক্ত। এভরি থার্ড থট ইজ মাই কিলার,–না, আমি তখন জ্বরের ঘোরের মতন। ঐ দুটি লাইন আবার লিখি :

প্ৰতিধ্বনি, তুমি তো স্বর্গের দিকে গিয়েছিলে
কেন ফিরে এলে

এবার প্রতিধ্বনির পর একটা কমা দিয়েছি, শেষে জিজ্ঞাসা দিইনি।

এই আমূল নশ্বর, শূন্যমাঘ, শরীরের কাছে—

একটু চেয়ার ছেড়ে উঠতেই ওই লাইনটা মনে পড়ে। ‘আমূল’ শব্দটা আমি পাই একটা মাখনের (খালি) টিনের প্রতি চোখ পড়তে। কিন্তু সেই সময় আমি পেচ্ছাপ করতে যাই। সুতরাং, ও শব্দটা বসাতে ইচ্ছে হলো পুরুষের দণ্ড অর্থে। শুধু শরীরই নশ্বর নয়, ও জিনিসটা আরও আগেই নশ্বর যে। শুন্যমাঘ’ শব্দটা কেন বসিয়েছি, ফ্র্যাঙ্কলি, জানি না।

পবন-পদবী তুমি, প্রতিধ্বনি, শরীর ও রাত্তিরের চোখ মারামারি
তোমার না দেখা ছিল ভালো

পবন-পদবী শব্দ দুটো কি খুব ভারী হয়ে গেল? হয়তো। লাইনটার গতি ঠিক রাখার জন্য অনায়াসেই হাওয়া বা বাতাস আরূঢ় বসাতে পারতুম। দুটি শব্দেরই শুরুতে ‘প’, সামান্য একটু ধ্বনি মাধুর্যের লোভে পড়লুম, বুড়ো বয়সে চুরি করে কণ্ডেন্সড় মিল্ক খাবার মতো, গোপন লোভে ও শব্দ দুটোই রাখা হলো। লিখতে লিখতে হঠাৎই অন্যমনস্ক ভাবে বুধবার রাত্রির কথা মনে পড়ে, অন্ধকার ময়দান, প্ৰমত্ত বান্ধবদল, ঠাণ্ডা লোহার রেলিংয়ে হেলান দেওয়া সেই কস্তাড়ুরে লাল রঙের শাড়ী পরা ধরা-মেয়ে, তার পাগলাটে হাসি, শরীরে অদ্ভুত গন্ধ। আমি রাত্রির থেকে চোখ ফিরিয়ে আবার কবিতায় আনতে চাই, তখনই উপরের লাইনটার শেষ অংশ মাথায় খেলে। পরের লাইনগুলি স্বাভাবিক ভাবেই আসে :

উত্তর সমুদ্র থেকে উড়ে এসেছিল সাদা হাঁস জ্যোৎ মাময়
তারা নয় বাদামী অসুখ
, নয়। বুকের ভিতরে রাখা মুখ
মুখের প্রথম গুরু চোখ তার অসম্ভব জোঙ্গুরিতে অর্ধেক স্তব্ধতা
জিতে এনে, রানীকে জানাতে চেয়েছিল, বহু রানী ও নারীর কাছে
শিখে এসে অপরূপ উরু ব্যবহার,–
মৃত্যু হাঁটু গেড়ে বসে সে সমস্ত নোট করে গেছে।

কারা বারবার ফিরে আসে? যেমন জ্যোৎস্নার হাঁস ও মাথাধরা ইত্যাদি। আমার মাথাধরার রং বাদামী। বুকের মধ্যে সবারই একটা গোপন মুখ রাখা আছে। আমি তার চোখ দেখতে পেলাম। চোখ অতিশয় বাচাল, যদি না সে অর্ধেক স্তব্ধতা জয় করে নিতে পারতো। এই সবই তো বলাই বাহুল্য। বস্তৃত, আমি নারী লিখতে গিয়ে ভুল করে রানী লিখে ফেলি। তারপর রানীকে কাটতে গিয়ে রাজ-রোষের ভয় হয়। রানী শব্দটা দেখতেও বেশ। রেখে দিই, মনে হয়, সব নারীই তো আসলে রানী। তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে, না, ঠিক নয়, সব নারী নয়। সুতরাং পরে দুটোকে আবার আলাদা করে সরিয়ে দিতে হয়। মৃত্যুর কথাটা অকারণ খেয়াল। লিখে ফেলেই খুব হাসি পায়। একলা বসে খুক খুক করে হাসি। মৃত্যু আজকাল হয়েছে অবিকল খবরের কাগজের রিপোর্টরের মতো। খাঁটি স্ক্যাণ্ডাল মঙ্গার একটি। যে-কোনো গুজব শুনেই এসে হাজির হয় যখন তখন, সর্দি-কাশি-মাথাধরা টিটেনাস–কিছু একটা হলেই খাটের পাশে এসে দাঁড়াবে। কি রকম হাঁটুগেড়ে বসে শর্টহ্যান্ডে নোট নিচ্ছে!

স্পেস! অর্থাৎ আবার বাড়ি থেকে বেরুতে হলো। পরের লাইনগুলি তখন ছায়ামূর্তির মতো আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে। মাঝরাত্রে জাগ্ৰত মানুষের ঘরের জানলার ঝিল্লিতে যেমন স্বপ্নেরা অপেক্ষা করে (এই উপমাটা আমার বারবার মাথায় আসে)। ডালহোঁসিতে তারাপদ হাত ধরে টেনে রেখেছে, ও ওর ভবিষ্যৎ জীবনের কিছু কথা জানাতে চায়, কিন্তু আমি তখন আমার গোপন। গত জীবন নিয়ে বিষম বিব্রত, হাত ছাড়িয়ে চলতি ট্রামে লাফিয়ে উঠলুম। সকালে প্রণব সেই দৃশ্য সহ্য করতে পারেনি, যখন হাসপাতালে ডাক্তার আমার ডান হাত থেকে এক সিরিজ রক্ত টেনে নিচ্ছিল। এক ঘণ্টা পর বাড়িতে, প্ৰথমেই মনে পড়ে, ‘তোমাকে বিদায় দিয়ে’;

তোমাকে বিদায় দিয়ে আমি পরশয্যায় ঘর্মাক্ত
স্তনের দুধের আঠা
, মাসের তিনদিন রক্ত, প্ৰতিশোধ, ঘুম অন্ধকারে
বিস্মৃতির পদশব্দ, বৃষ্টির মতন দ্রুত পৗঁইট, বহু বুকখোলা
হা-হা শব্দে, ভিজে
অতি ঐশ্বরিক কোনো প্ৰাণীর মতন লিপ্ত হয়েছিলাম, অয়ি প্ৰতিধ্বনি,
তুমি তো স্বর্গের দিকে—আত্মার সরল শব্দ, মেঘ, মায়া পাহাড়
পেরিয়ে
ঘাই হরিণীর ডাক যেমন সমুদ্র পাড়ে ফেরে…

‘ঘাই হরিণীর’,–শব্দটা জীবনানন্দের থেকে প্রত্যক্ষ হয়ে গেল, কিন্তু আর উপায় নেই, সময় নেই, অসম্ভব খিদে পেয়েছে। এ কবিতার হাত থেকে নিষ্কৃতি চাই। আজ বিকেলে কথা রাখতে হবে। কিন্তু উঠতে পারছিনা, মন বলছে, আর একটা লাইন বাকি আছে, শেষ লাইন। পরপর বিদ্যুতের মতো আঠারোটা লাইন মাথায় এলো, রেলগাড়ির কামরার মতো, একই রকম দেখতে অথচ এক নয়। খিদে-পেটে কী সমস্ত চমৎকার লাইন যে মাথায় আসে, অথচ খেয়ে উঠে তার একটাও মনে থাকে না। কিন্তু ওগুলো এ কবিতার লাইন নয়। একটা পুরোনো লাইনই বারবার দাবি জানাচ্ছে। হ্যাঁ নিশ্চিত, তুমিই এসো :

‘কেন ফিরে এলে?’ কেন ফিরে এলে?