[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

আন্দামান–সাতাশ বছর আগে, পরে

আন্দামান–সাতাশ বছর আগে, পরে

আমি প্রথমবার আন্দামানে যাই সাতাশ বছর আগে। তখন কেন্দ্রীয় প্রশাসন থেকে আন্দামানের দ্বীপগুলিতে ভ্রমণ-পার্টিকে উৎসাহ দেওয়া হত না, সে রকম কোনও ব্যবস্থাও ছিল না। মূল ভূখণ্ড থেকে আন্দামানে যেতে হলে সেখানকার প্রশাসনের কাছ থেকে অগ্রিম অনুমতি নিতে হত। আমি হঠাৎ একা সেখানে বেড়াতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আমার বন্ধুরা খুব অবাক হয়েছিল। অনেকেই প্রশ্ন করেছিল, কেন যাচ্ছ? মাউন্ট এভারেস্ট সম্পর্কে এই প্রশ্নের যে বিখ্যাত উত্তরটি আছে, আন্দামান সম্পর্কেও সেটা বলা যায়, Because, it is there!

ভ্রমণ আমার নেশা। আন্দামান যাবার আগে দুটি গোলার্ধের অনেক দেশই আমার দেখা হয়ে গেছে। আগে দেশ বিদেশে যাওয়া হত জাহাজে, সে-রকম জাহাজ-যাত্রার কত রকম চমৎকার বর্ণনা আমরা পড়েছি, তাতে অনেক রোমাঞ্চ ও প্রেমকাহিনী ছিল, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা অর্জনের সৌভাগ্য আমার হয়নি। বিমান যাত্রায় অনেক সময় বাঁচে বটে, কিন্তু তাতে রোমাঞ্চ নেই, আর প্রেমের তো প্রশ্নই ওঠে না।

আন্দামানের দিকেই আমার প্রথম জাহাজ ভ্রমণ। সময় লাগে মাত্র চারদিন। কিন্তু সেবারে বঙ্গোপসাগরে প্রবল ঝড় উঠেছিল, সেই ঝড়ে জাহাজ চালানো বিপজ্জনক বলে পুরো একদিন জাহাজটা থেমে ছিল মধ্য-সমুদ্রে। তার ফলে আমাকে অতিরিক্ত একদিন জাহাজের খাবার খেতে হয়েছিল। অধিকাংশ যাত্রীই ভুগছিল সমুদ্র-পীড়ায়। কিছু না খেয়েও তারা বমি করছিল অনবরত। একজন কেউ আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল, সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই দু-ঢোঁক ব্র্যান্ডি খেয়ে একটা কোনও জমজমাট রহস্য কাহিনী পাঠ করলে সি-সিকনেস হয় না। সত্যিই তাই, আমি ব্র্যান্ডি, আগাথা ক্রিস্টির বইয়ের সঙ্গে জাহাজের প্রত্যেক দিনের খাদ্যই উপভোগ করেছি। সেবারেই আমি ঝাঁক ঝাঁক উড়ুক্কু মাছ দেখি। চড়াইপাখির মতন ডানাওয়ালা মাছগুলো সমুদ্র থেকে লাফিয়ে উঠে কিছুক্ষণ হাওয়ায় ওড়াউড়ি করে আবার জলে ডুব দেয়। পরে আমি পোর্ট ব্লেয়ারের একটা হোটেলে সেই উড়ুক্কু মাছ ভাজাও খেয়েছি।

আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের প্রধান শহর পোর্ট ব্লেয়ারে তখন ভদ্রগোছের হোটেল ছিল মাত্র একটিই, সেটি সরকারি। তাতে আমি একটি ঘর পেয়েছিলাম অদ্ভুত শর্তে, দুপুরবেলা তিন ঘণ্টার জন্য প্রত্যেক দিন ঘর ছেড়ে দিতে হবে। সেই সময় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের পাইলট ও অন্যান্য কর্মীরা সব ঘরগুলো নিয়ে স্নান-খাওয়া করে বিশ্রাম নেয়, বিকেলে ফিরে যায়।

আন্দামানে আমার পরিচিত কেউ ছিল না, আমি ঘুরে বেড়িয়েছি আপন মনে, একলা একলা। বহু দেশ দেখার অভিজ্ঞতা সত্বেও আমার মনে হয়েছিল, এমন সুন্দর জায়গা আমি আগে দেখিনি। শহর ছাড়িয়ে একটু বাইরে গেলেই মনে হত, এখানকার প্রকৃতিতে রয়েছে আদিম, অস্পর্শিত, পবিত্রতার ছাপ। সমুদ্রের জল বেশি গাঢ় নীল, অরণ্য বেশি গাঢ় সবুজ। যখন তখন হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামে, আবার একটু পরেই আকাশ পরিষ্কার।

সুইডেনের স্টকহলম শহরের কাছেই সমুদ্রে হাজার হাজার দ্বীপে অনেক মানুষ থাকে, তারা প্রতিদিন শহরে চাকরিবাকরি বা ব্যাবসার প্রয়োজনে যাওয়া-আসা করে, কিন্তু আন্দামানের মাত্র কয়েকটি দ্বীপই মনুষ্যবাসের যোগ্য, অন্যগুলিতে পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। অনেক দ্বীপ শুধু নিবিড় অরণ্যে ছেয়ে আছে, মনে হয় সেখানে কখনও মানুষের পদচিহ্ন পড়েনি। একসময়, কয়েকটি দ্বীপে কিছু হরিণ ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, তার পর তাদের বিপুল বংশবৃদ্ধি হয়। কারণ বাঘ-সিংহের মতন কোনও হিংস্র জানোয়ার নেই। মায়া বন্দর নামে একটি চমৎকার জায়গায় যাওয়ার পথে আমি একসঙ্গে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশটি হরিণকে রাস্তা পার হতে দেখেছিলাম। ঘরের দেওয়ালে দেখেছি সবুজ রঙের টিকটিকি, একরকম কাঁকড়া এতই বড়ো যে–যেন ডাবের মতন, তারা নাকি সত্যিই গাছে উঠে ডাব পেড়ে খায়। তাদের নাম কোকোনাট থিফ ক্র্যাব। একরকমের চিংড়ির নাম টাইগার লবস্টার। সেগুলি প্রকাণ্ড তো বটেই, ওপরের খোসার রং হলদে-কালো ডোরাকাটা।

কয়েকটি দ্বীপের ধারে কাছে যাওয়াই ছিল বিপজ্জনক, সেগুলি জারোয়া নামে আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত, এই জারোয়ারা সভ্য মানুষদের সংস্পর্শেই আসতে চায় না। তাদের সঙ্গে থাকে বিষাক্ত তীর। ওঙ্গে নামে আর-একটি আদিবাসী সম্প্রদায় আছে, তারা হিংস্র নয়, অনেকটা সহজভাবে মিশে গেছে। আর আন্দামানিজ নামে আরও একটি সম্প্রদায়, যাদের সংখ্যাটি ছিল

সবচেয়ে বেশি, তারা এখন প্রায় নিঃশেষিত, এই তিন সম্প্রদায়ের মানুষেরই গায়ের রং কয়লার মতন কালো আর মাথার চুল কুঞ্চিত। অনেক দূরের একটি দ্বীপে সেন্টিনেলিজ নামে আর একটি সম্প্রদায় আছে শুনেছি, যারা লম্বা ও ফরসা, তারা ওখানে কী করে এল, তা একটা রহস্য। আমি তাদের দেখিনি।

শুধু প্রকৃতি দেখার জন্যই আমি আন্দামানে যাইনি। একটা অন্য উদ্দেশ্যও ছিল। তখন আমি স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র বিপ্লবীদের মধ্যে যাঁরা আন্দামানে জেল খেটেছেন, তাঁদের কয়েকজনকে নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা করেছিলাম। সে জন্য, আন্দামানের সেলুলার জেলটি স্বচক্ষে দেখার প্রয়োজন ছিল। সেটি দেখতে গিয়ে আমি হতবাক হয়ে গেছি। ভারতীয়দের শাস্তি দেবার জন্য কি বিশাল ও ভয়ংকর জেল বানিয়েছিল ইংরেজরা! সারা ভারতে এত বড়ো জেল আর আছে কি না আমি জানি না। এ জেলের বৈশিষ্ট্য হল, প্রতিটি বন্দির জন্যই একটি পৃথক সেল, অর্থাৎ সারাক্ষণই তাকে একলা থাকতে হবে। অন্যদের সঙ্গে কথা বলারও কোনও উপায় নেই। এইজন্যই এখানকার বেশ কয়েকজন বন্দি উন্মাদ হয়ে যায়, কেউ-কেউ আত্মহত্যা করে। আদিতে ছিল এই জেলের সাতটি উইং, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানি বোমায় অনেকটা ধ্বংস হয়ে যায়। এখন এর কিছুটা অংশ হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়, দর্শকদের জন্য যতখানি উন্মুক্ত রাখা হয়েছে, তাও বিশাল। সারা ভারতের বন্দিদের সুদীর্ঘ তালিকা দেখলে বোঝা যায়, স্বাধীনতার আহ্বানে হাজার-হাজার তরুণ এই সুদূর দ্বীপে আয়ুক্ষয় করেছে, অনেকে ফিরতেই পারেনি।

নেতাজি সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে কিছুদিনের জন্য দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এই দ্বীপে স্বাধীনতার পতাকা উড়েছিল। কলকাতা ও চেন্নাই বন্দর থেকে পোর্ট ব্লেয়ার প্রায় সম দূরত্বে। তাই দ্বীপগুলিতে বহিরাগতদের মধ্যে বাঙালি এবং তামিল ও তেলুগুদের সংখ্যাই বেশি। দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের জন্য অনেক পাঞ্জাবি এবং উত্তর ভারতের মানুষও আন্দামানে দেখা যায়। দেশ বিভাগের পর অনেক বাঙালি উদ্বাস্তুদের আন্দামানের বিভিন্ন দ্বীপে পাঠানো হয়েছিল বলে, বাঙালিরাই এখন এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। উদ্বাস্তুরা আন্দামানে গিয়ে খুব তাড়াতাড়ি স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে, সরকারের বোঝা হয়ে থাকেনি।

সাতাশ বছর পর দ্বিতীয়বার আন্দামানে গিয়েছি সম্প্রতি। প্রথম দিন পোর্ট ব্লেয়ার শহর দেখে দারুণ চমকে গিয়েছিলাম। সবকিছুই অচেনা মনে হয়েছিল। এত অল্প সময়ে কোনও জায়গার এতখানি পরিবর্তন অকল্পনীয়। বাড়ি, গাড়ি ও মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে বহুগুণ, অনেক বড়ো বড়ো হোটেল হয়েছে। অনেক দোকানপাট। ভারত সরকারের নীতির বদল হয়েছে, আগে বহিরাগতরা এখানকার জমি কিনতে পারত না। এখন আর সে বাধা নেই। ট্যুরিস্টও আসে অনেক। বেশ কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সি বা ট্যুর অপারেটররা এদের অফিস খুলেছে। ট্যুরিস্টদের মধ্যে অনেক বিদেশিও চোখে পড়ে।

পোর্ট ব্লেয়ার শহরটি আর আগের মতন নিরিবিলি নেই, এখন অনেক ভারতীয় শহরেরই মতন। কিন্তু শহরের বাইরে যে প্রকৃতির রূপ তা তো সহজে বদল করা যায় না। সমুদ্র সেরকমই আছে। দ্বীপগুলিতে জঙ্গল তেমনই নিবিড়। কল-কারখানা এখনো বিশেষ নেই। তাই বাতাস বিশুদ্ধ।

পোর্ট ব্লেয়ারে অবশ্য দ্রষ্টব্য সেলুলার জেল। দর্শকদের সুবিধের জন্য এখন অনেক রকম ব্যবস্থা করা হয়েছে, গাইডরা সঙ্গে নিয়ে সবকিছু দেখায় ও বিপ্লবীদের সম্পর্কে অনেক রোমাঞ্চকর কাহিনী শোনায়। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ভাষায় লাইট অ্যান্ড সাউন্ড-এর অনুষ্ঠান, তাতে স্বাধীনতা সংগ্রামের অতীত ইতিহাস জীবন্ত হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয়বার এসে এমন একটি অভিজ্ঞতা হল, যা সারাজীবন মধুর স্মৃতি হয়ে থাকবে। প্রথমবার একা-একা ঘুরে বেড়িয়েছি বিভিন্ন দ্বীপে, খুব বেশি যানবাহনের ব্যবস্থা ছিল না, নির্জন দ্বীপগুলিতে যাবার কোনও উপায় ছিল না। এখন অনেক জাহাজ, স্টিমার স্পিড বোট চলে। টুর অপরেটররা অনেক সুন্দর-সুন্দর বিচে নিয়ে যায়, এক-এক জায়গার বালির রং সাদা। আন্দামানের কোরাল রিফ বিশ্ববিখ্যাত। অগভীর সমুদ্রে, কোনও-দ্বীপের কাছাকাছি নৌকোয় বসে সেই সামুদ্রিক স্বপ্নপুরী স্পষ্ট দেখা যায়। অনেক নৌকো গ্লাস বটমড। এবারে আমার স্ত্রী স্বাতীও সঙ্গে গেছে, সে কখনও কোরাল রিফ দেখেনি, নৌকোয় বসেই পায়ের তলায় এই রঙিন জগৎ আর কত রকম নানা বর্ণের মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণীদের খেলা দেখে সে একেবারে অভিভূত। কিন্তু জায়গাটায় অনেক নৌকোর ভিড়, অনেকে বেলাভূমিতে পিকনিক করছে, তাতে মনে হয় আমরা যেন এমন রমণীয় স্থানের শান্তি ও পবিত্রতা নষ্ট করতে এসেছি।

আমাদের বিরক্তির কারণ বুঝে একজন টুর অপারেটর বলল, চলুন, আপনাদের এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি, যেখানে আর কেউ যায় না। তার স্পিড বোটে কিছুক্ষণ পর আমরা উপস্থিত হলাম অন্য একটি দ্বীপে। যেখানে বড়ো বড়ো গাছপালা ছাড়া আর কোনও চলন্ত প্রাণী নেই। চতুর্দিকে বিশুদ্ধ নিস্তব্ধতা। ছেলেটি বলল, এখানে কয়েক মাইল জুড়ে কোরাল রিফ আছে, আপনারা জলে নেমে দেখবেন? তার কাছে অক্সিজেন মাস্ক ও অন্যান্য ব্যবস্থা আছে। স্বাতী সাঁতার জানে না, তবু সে জলে নামবার জন্য প্রবল উৎসাহী। ঠিক মতন সেজেগুঁজে আমরা নেমে পড়লুম জলে। শুরু হল যাকে বলে Snorkelling–যেসব দৃশ্য আমরা ডিসকভারি চ্যানেলে অনেকবার দেখেছি, এখন আমরা নিজেরাই সশরীরে সেই দৃশ্যের মধ্যে উপস্থিত। এ যেন বিশ্বাসই করা যায় না। অনেক কোরাল জীবন্ত, একটু হাত ছোঁয়ালেই নড়ে যায় বুঝতে পারি। আর কী অপূর্ব বর্ণবাহার। সমুদ্রের নীচে এমন রঙের সম্ভার কী করে সম্ভব, তার ব্যাখ্যা খুঁজে পাই না। আর এখানকার মাছগুলিও যেন পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য ঘটিয়ে বহুরকম রঙে সেজে আছে। বড়ো বড়ো মাছ গায়ের পাশ দিয়ে চলে যায়, তারা ভয় পায় না। সমুদ্রের তলার জগৎ এখনও আমাদের অনেকটাই অচেনা। আর আমাদের জল ছেড়ে উঠতেই ইচ্ছে করে না। স্থলভূমিতে মানুষের হিংসা, লোভ, রক্তপাত, টাকাপয়সার ঝনঝনানি, এ-সব কিছুই আর মনে পড়ে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *