১৫. কালবৈশাখীর ঝড় বইছে

সন্তুর বুকের মধ্যে যেন কালবৈশাখীর ঝড় বইছে। এক্ষুনি একটা কিছু সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড ঘটবে। কাকাবাবু কি ঠাণ্ডা মাথায় একটা লোককে সত্যিই গুলি করে মেরে ফেলতে পারবেন? কাকাবাবু যে ভয় দেখাচ্ছেন, তা কি ওই কর্নেল নামে লোকটা বিশ্বাস করবে?

একবার সে চট করে প্রকাশ সরকারের দিকে তাকাল। প্রকাশ সরকারও সন্তুর মতন দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এখন সে একটু-একটু সরে যাবার চেষ্টা করছে পাশের বারান্দার দিকে। বারান্দার দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেছে প্রকাশ সরকারের। সন্তুর সঙ্গে চোখাচোখি হতে সে সন্তুকে ইশারা করল এদিকে সরে আসবার জন্য।

কর্নেল আর তার পেছনে তিনজন লোক একটু ঝুকে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন যে-কোনও সময় তারা বাঘের মতন কাকাবাবুর ওপরে ঝাপিয়ে পড়বে।

রাজকুমারের ঘাড়ে রিভলভারের নলটা ঠুসে ধরে কাকাবাবু বললেন, আমি শেষবার বলছি, আর এক পা-ও এগোবে না। আমি ঠিক তিন পর্যন্ত গুনব, তারপরই গুলি করব!

রাজকুমার বলল, ওর কথা গ্রাহ্য কোরো না কর্নেল। এগিয়ে এসে ওকে ধরো।

কাকাবাবু বললেন, এক!

কর্নেল তবু এক পা এগিয়ে এল।

কাকাবাবু বললেন, দুই।

রাজকুমার বলল, কর্নেল, তুমি শুধু-শুধু দেরি করছ কেন? ভয় পাচ্ছ নাকি? আমি তো বলছি, ভয় নেই?

কাকাবাবু বললেন, তোমরা আমায় চেনো না! আমি কখনও স্বেচ্ছায় ধরা। দিই না। আর আমার ওপর কেউ অত্যাচার করলে তার প্রতিশোধ আমি না নিয়ে ছাড়ি না। রাজকুমার, তুমি আমার গালে চড় মেরেছ, আমার হাতে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়েছ। এর শাস্তি তোমায় পেতেই হবে। শাস্তি আমি নিজের হাতে দিতে চাই না, পুলিশের হাতে তোমায় তুলে দেব। তোমার ভালর জন্যই বলছি, এই লোকগুলোকে চলে যেতে বললো। ওরা যদি আর এগিয়ে আসে, তা হলে তোমাকে আমি শেষ করে দিতে বাধ্য হব।

এবার কর্নেল বলল, শুনুন মোশাই। আপনি তো অনেক কথা বললেন, এবারে আমি একটা কথা বলি। আপনি যদি বাই চান্স রাজকুমারকে গুলি করেন, তা হলে তারপর আপনাকে তো মারবই, এই বাচ্চা ছোঁড়াটাকে আর ডাক্তারটাকেও গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেব! আমি মোশাই এক কথার মানুষ। রাজকুমারকে আপনি ছেড়ে দিন। তা হলে আপনাদেরও আমি মারব না। কাটানকুটিন হয়ে যাবে।

কাকাবাবু বললেন, আগে তোমরা সবাই ঘরের বাইরে চলে যাও হাতের অস্ত্র মাটিতে নামিয়ে রাখো, তারপর—।

রাজকুমার চেঁচিয়ে উঠল, খবদার, এর কথা বিশ্বাস করবে না। বলছি তো, এ লোকটা ফাঁকা আওয়াজ করছে। আমাকে মারবার হিম্মত ওর নেই! এরা মি ক্লাস ভদ্দরলোক, এরা গুলি করে মানুষ মারতে পারে না। তোরা সবাই। এক সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড় আমার ওপরে–।

সন্তু দেখল, কাকাবাবুর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে।

রাজকুমার নিজেকে ছাড়াবার জন্য শরীর মোচড়াতেই কাকাবাবু এক ধাক্কায় তাকে ফেলে দিলেন কর্নেল-এর পায়ের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে রিভলভারটা তুলে ঠেকালেন নিজের কপালে।

অন্যরা রাজকুমারকে ঝটপট তুলে দাঁড় করিয়ে দিল। একজনের হাত থেকে একটা রিভলভার নিয়ে রাজকুমার এদিকে ফিরতেই দেখল কাকাবাবু কটমট করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

কাকাবাবু বললেন, এবার? অন্য লোককে গুলি করতে পারি না বটে, কিন্তু নিজেকে গুলি করতে আমার একটুও হাত কাঁপবে না। আমাকে ধরবার চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই। আর আমি যদি এখন মরে যাই তা হলে, রাজকুমার, তোমার কী অবস্থা হবে বুঝতেই পারছ? যে তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে। সে তোমায় আর আস্ত রাখবে? জঙ্গলগড়ের চাবি আছে আমার মাথার মধ্যে। তোমার হাতে ধরা দেবার আগে আমি আমার এই মাথাটাই উড়িয়ে দেব। জঙ্গলগড়ের চাবি চিরকালের মতন হারিয়ে যাবে।

রাজকুমার ঝট করে মুখ ফিরিয়ে দেখল সন্তুকে।

কাকাবাবু বললেন, শোনো! আমি মরলে তোমার কোনও লাভ নেই, ক্ষতিই বেশি। আমারও আপাতত মরবার ইচ্ছে নেই। সুতরাং, এসো, একটা মাঝামাঝি রফা করা যাক। জঙ্গলগড়ের সন্ধান যদি আমি দিই, তা হলে তোমরা তার বদলে আমায় কত টাকা দেবে?

রাজকুমার বলল, টাকা? এর আগে তোমাকে দশ লাখ টাকা দেবার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল।

উঁহুঃ! অত কমে হবে না। তোমাকে যিনি পাঠিয়েছেন, তার সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই।

আমায় কেউ পাঠায়নি! কে পাঠাবে? জঙ্গলগড়ের যা কিছু সবই আমার পুরুষানুক্রমিক সম্পত্তি। এর ওপর সব দাবি আমার। যা কিছু বলার সব আমার সঙ্গেই বলতে হবে।

বেশ তো! ঠাণ্ডা মাথায় অনেক কিছু আলোচনা করা দরকার। তোমার এখানে চা কিংবা কফির কিছু ব্যবস্থা নেই? এখন সন্তু আর প্রকাশকে অন্য ঘরে পাঠিয়ে দাও। ওরা বিশ্রাম নিক।

রাজকুমার এবারে হা-হা করে হেসে উঠল। যেন কয়েক টুকরো হাসি সে ছুঁড়ে দিল কাকাবাবুর মুখের দিকে। তারপর বলল, রায়চৌধুরী, তুমি নিজেকে খুব চালাক ভাবো, তাই না? আর আমরা সব বোকা, কিছু বুঝি না?

লম্বা হাত বাড়িয়ে সে সন্তুর কাঁধটা ধরে এক ঝটকায় টেনে আনল নিজের কাছে। তারপর সন্তুর ডান দিকের কানের ফুটোর মধ্যে রিভলভারের নল ঠেকিয়ে বলল। নাউ হোয়াট? তুমি নিজে মরতে ভয় পাও না জানি, কিন্তু তোমার ভাইপোকে যদি মেরে ফেলি? এই জন্যই তুমি ওকে ঘরের বাইরে পাঠিয়ে দিতে চাইছিলে?

কাকাবাবু বললেন, আর, এসব নাটকের কী দরকার? বললুম তো তোমার সঙ্গে আমি আলোচনায় বসতে রাজি আছি। আমি কত কষ্ট করে জঙ্গলগড়ের সন্ধান বার করেছি, সে জন্য কিছু পাব না?

রাজকুমার বলল, তোমায় কিছু দেব না। তুমি আমাদের যথেষ্ট ভুগিয়েছ! এবারে তুমি এক্ষুনি জঙ্গলগড়ের সব সন্ধান দিয়ে দাও, নইলে এ ছেলেটাকে এক্ষুনি শেষ করব।

এর মধ্যে টকাং করে একটা শব্দ হল। প্রকাশ সরকার এই সব কথাবার্তার সুযোগে বারান্দার দরজার ছিটকিনিটা খুলে ফেলেছে।

কিছু একটা করবার জন্য কর্নেল-এর হাত নিশপিশ করছিল। এবারে সে লাফিয়ে গিয়ে তার রিভলভারের বাঁট দিয়ে খুব জোরে মারল প্রকাশ সরকারের মাথায়। প্রকাশ সরকার একটা অদ্ভুত আওয়াজ করে ঢলে পড়ে গেল।

সেদিকে একবার মাত্র তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল রাজকুমার। এমন একটা ভাব করল যেন কিছুই হয়নি।

কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, সময় নষ্ট করে লাভ নেই। এবার চটপট বলে ফেল। শোনো রায়চৌধুরী, আমরা রাজপরিবারের লোক। দরকার হলে দু-চারটে লোক মেরে ফেলতে আমাদের একটুও ভুরু কাঁপে না।

সন্তু বলল, আপনি আমায় মেরে ফেললেও কাকাবাবু কোনও অন্যায় মেনে নেবেন না!

রাজকুমার বলল, চোপ্!

কাকাবাবু বললেন, ওকে তুমি মিছিমিছি কষ্ট দিচ্ছ, রাজকুমার। তোমাদের এত সব চেষ্টাই পণ্ডশ্রম। জঙ্গলগড়ে আসলে কিছুই নেই। হয়তো কিছু ছিল এক সময় ঠিকই, কিন্তু আগেই কেউ তা সাফ করে নিয়ে গেছে!

সেটা আমরা বুঝব কিছু আছে কি নেই। আমরা সেখানে গিয়ে নিজের চোখে দেখতে চাই।

ওকে ছেড়ে না দিলে আমি কিছুই বলব না!

বলবে না? তবে দ্যাখো, আমি প্রথমে এক গুলিতে এর পা খোঁড়া করে দিচ্ছি। তারপর এক এক করে…

এমন সময় একটা লোক দৌড়ে এসে বলল, রাজকুমার! রাজকুমার! এক দল লোক আসছে এদিকে। বোধহয় মিলিটারি!

অমনি কর্নেল আর অন্যরা চঞ্চল হয়ে উঠল।

রাজকুমার জিজ্ঞেস করল, কটা গাড়ি?

লোকটি বলল, গাড়ি নেই, দৌড়ে দৌড়ে আসছে!

রাজকুমার কাকাবাবুর দিকে ফিরে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বলল, মিলিটারি এলেও তুমি নিস্তার পাবে না রায়চৌধুরী। আমরা তোমার ভাইপোকে নিয়ে চললুম। যদি একে প্রাণে বাঁচাতে চাও, তাহলে আমাদের কাছে তোমাকে নিজে থেকেই আসতে হবে। কর্নেল ওকে কভার করে থাকো!

সন্তুকে নিয়ে টানতে টানতে বেরিয়ে গেল রাজকুমার। কাকাবাবু কিছুই। করতে পারলেন না। অসহায়ভাবে বসে রইলেন।