১৩. কাকাবাবু হাঁটতে পারেন না

কাকাবাবু হাঁটতে পারেন না জেনেও দুজন লোক দুদিক থেকে কাকাবাবুর হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে চলল। কাকাবাবুর খুবই ব্যথা লাগছে নিশ্চয়ই। কিন্তু কিছুই বলছেন না। সন্তুও যে কিছু করবে তার উপায় নেই। আর দুজন লোক তার জামার কলার ও চুলের মুঠি ধরে আছে। তার নড়বার উপায় নেই।

মুখখাশধারীরা দোতলায় একটা হলঘরে নিয়ে এল ওদের। হলঘরটায় একটি মাত্র চেয়ার ছাড়া আর কোনও আসবাব নেই। কাকাবাবুকে এনে বসিয়ে দেওয়া হল সেই চেয়ারে। হাত বাঁধা অবস্থায় সন্তুকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হল তাঁর পায়ের কাছে।

বাকি লোকগুলো ওদের ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল।

ঘরে শুধু টিমটিম করে একটা কম-পাওয়ারের আলো জ্বলছে। মনে হয়, এ বাড়িতে অন্য সময় কোনও মানুষজন থাকে না।

নস্যিরঙের সুট পরা লোকটি ঘরে ঢুকল সবার শেষে। হুকুমের সুরে বলল, সরো! সরে যাও, সামনে থেকে!

অমনি অন্যরা সরে গিয়ে সামনে জায়গা করে দিল।

লোকটি কাকাবাবুর একেবারে মুখখামুখি দাঁড়াল কোমরে দুহাত দিয়ে। ঠিক সিনেমার ভিলেনের মতন। চোখ থেকে এখনও কালো চশমাটা খোলেনি। একটুক্ষণ কাকাবাবুর দিকে চেয়ে থেকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে শুরু করল, রাজা রায়চৌধুরী, তুমি আমার সামনে ভড়ং করে থেকো না। তাতে কোনও লাভ হবে না। শোনো, তোমার সঙ্গে আমার কোনও শত্রুতা নেই। আমি যা চাই, তুমি যদি ভালয় ভালয়

কাকাবাবু মাঝখানে বাধা দিয়ে বললেন, ডাবের জল! আমি একটু ডাবের জল খাব।

লম্বা লোকটি হকচকিয়ে গিয়ে বলল, ডাবের জল?

পাশ থেকে তার এক অনুচর বলল, এদিকে তো ডাব পাওয়া যায় না।

লম্বা লোকটি ধমক দিয়ে বলল, চুপ করো! ডাবের জল কেন, এখন কোনও জলই ওকে দেওয়া হবে না।

কাকাবাবু বললেন, জল দেবে না তাহলে জলপাই দাও? এখানে ডাব পাওয়া যায় না, কিন্তু জলপাই তো পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে একটু নুন দিও!

লম্বা লোকটি ফস্ করে একটা সিগারেট ধরাল। রাগে তার হাত কাঁপছে। দাঁতে দাঁত ঘষে সে বলল, তোমার সঙ্গে মশকরা করবার জন্য আমি রাতদুপুরে ধরে এনেছি? আমার কথার সোজাসুজি উত্তর দাও, আমি তোমাদের ছেড়ে দেব। নইলে

কাকাবাবু বললেন, তুমি কে বাপু? নইলে বলে থেমে রইলে? কালো চশমায় চক্ষু ঢাকা, গোঁফখানি তো ফড়িং-পাখা।

লোকটি এগিয়ে এসে কাকাবাবুর বাঁ হাতখানা তুলে তার তালুতে জ্বলন্ত সিগারেটটা চেপে ধরল।

কাকাবাবুর হাত অসাড়, তাই তিনি কোনও ব্যথা পেলেন না, মুখে টু শব্দও করলেন না। কিন্তু সন্তু ওই কাণ্ড দেখে শিউরে উঠল।

তখন মুখখাশধারীদের পেছন থেকে ঠেলে সামনে এসে প্রকাশ সরকার বলল, দেখুন, রাজকুমার, আমি একজন ডাক্তার। আমি ওর সঙ্গে ছিলাম। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি, ওঁর মাথায় সত্যিই গোলমাল হয়েছে। উনি কিছুই মনে করতে পারছেন না। ওঁর ওপর অত্যাচার করে কোনও লাভ হবে না।

তাহলে তোমার মতে কী করা উচিত এখন?।

এখন ওঁর চিকিৎসা করানো উচিত। পর পর কয়েকদিন টানা ঘুমোল উনি একটু সুস্থ হতে পারেন।

সে সময় আমার নেই।

কিন্তু অত্যাচার করলে ফল খারাপ হবে।

নার্স সুনীতি দত্ত বললেন, দেখুন, আমিও তো আজ সারাদিন ধরে ওঁকে ওয়াচ করেছি। উনি সত্যিই এখন মানসিক রুগি। নিজের ভাইপোকেও চিনতে পারেন না। দিল্লি থেকে ওঁর এক বন্ধু এসেছিলেন, তাঁকেও কী সব গালমন্দ করলেন।

লম্বা লোকটি আরও রেগে গিয়ে বলল, মাথা খারাপ হয়েছে? বললেই হল? জানো, জঙ্গলগড়ের চাবি কোথায় আছে? আর কোথাও নেই, আছে ওর মাথার মধ্যে! কর্নেল?

মুখোশধারীদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে বলল, স্যার?

শোনো, যে করেই হোক ওর কাছ থেকে কথা বার করতে হবে।

যে-লোকটিকে কর্নেল বলে ডাকা হল, তার অবশ্য মিলিটারিদের মতন পোশাকও নয়, তার মিলিটারি গোঁফও নেই। এমনই সাধারণ চেহারার একটা লোক।

সে বলল, স্যার, জঙ্গলগড় জায়গাটা আসলে কোথায়? আমরা তো এদিকে জঙ্গলগড় বলে কোনও কিছুর নাম শুনিনি।

লম্বা লোকটি ভেংচি কেটে বলল, সেকথা আমি তোমায় বলে দি, আর তুমি তারপর আমার পেছন থেকে ছুরি মারো, তাই না? তখন নিজেই তার লোভে পাগল হয়ে উঠবে। শোনো, জঙ্গলগড়ের ভেতরের জিনিসের ওপর একমাত্র আমারই বংশগত অধিকার আছে। আর কারুর নেই। এই লোকটা বাগড়া না দিলে এতদিনে আমি সব-কিছু পেয়ে যেতাম।

কাকাবাবু হেসে বললেন, জঙ্গলগড় নয়, জঙ্গলগড় নয়, বোম্বাগড়! এতক্ষণে চিনলাম, তুমি হলে বোম্বাগড়ের রাজা। আর তুমি খাও আমসত্ত্ব ভাজা।

লম্বা লোকটি ঝট করে কাকাবাবুর দিকে ফিরে বলল, আর তুমি কী খাও, তা মনে আছে? তুমি ছাগলের মতন কাগজ খাও! তুমি আমাদের ম্যাপটা খেয়ে ফেলেছিলে।।

কর্নেল নামের লোকটা বলল, ম্যাপ খেয়ে ফেলেছিল?

হ্যাঁ। বলতে গেলে আমারই চোখের সামনে। অ্যাত্ত বড় একটা তুলোট কাগজের ম্যাপ। আমি সেটা গায়েব করার আগেই ও সেটা কুচিকুচি করে ছিড়ে মুখে পুরে দিল। ম্যাপটা আগেই ও মুখস্থ করে ফেলেছিল। এখন ও ছাড়া আর কেউ সে পথের হদিস দিতে পারবে না।

হয়তো এই বুড়োটা সেই ম্যাপ আবার অন্য কোনও জায়গায় এঁকে রেখেছে।

না! ও অতি শয়তান। সে সুযোগ ও দেবার পাত্র নয়। ওরা আগরতলায় চলে আসবার পর আমার ললাকেরা ওদের কলকাতার বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছে। সেখানে কিছু নেই। দিল্লিতেও পাঠায়নি, সেখানেও আমাদের লোক রেখেছি। সুতরাং ম্যাপটা ওকে দিয়েই আঁকাতে হবে। কিংবা ও নিজেই যদি গাইড হয়ে আমাদের পথের সন্ধান দিতে রাজি হয়–

তারপর সে কাকাবাবুকে উদ্দেশ্য করে বলল, কী রায়চৌধুরী, রাজি?

কাকাবাবু বললেন, এক থালা শুপারি, গুনতে নারে ব্যাপারি, বলো তো কী? কিংবা এইটা পারবে? চক্ষু আছে মাথা নাই, রস খাব, পয়সা কোথা পাই?

কালো-চশমা হুংকার দিয়ে বলল, কর্নেল! তোমার ছুরিটা বার করো।

কর্নেল সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে একটা ফোল্ডিং ছুরি বার করল। তার স্প্রিং টিপতেই চকচকে ফলাটা বেরিয়ে এল।

কালো-চশমা বলল, ওই ছুরি দিয়ে ওর বুক চিরে দাও, দেখি তাতে ওর মুখ খোলে কি না।

কাকাবাবুর জামার বোতামগুলো খুলে বুকটা ফাঁক করে ফেলল কর্নেল। ছুরিটা খুব আস্তে আস্তে নিয়ে গিয়ে বুকে ঠেকাল।

সন্তু সেই সময় ছটফট করে উঠতেই লম্বা লোকটির ইশারায় দুজনে গিয়ে চেপে ধরে রইল তাকে।

কর্নেল জিজ্ঞেস করল, কতটা ঢোকাব ছুরি?

রক্ত বার করো!

কর্নেল হালকাভাবে একটা টান দিতেই লম্বা রেখায় রক্ত ফুটে উঠল কাকাবাবুর বুকে।

কাকাবাবু যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। অবাক হয়ে দেখছেন এই সব কাণ্ডকারখানা। তাঁর মুখে কোনওরকম যন্ত্রণার চিহ্নই নেই।

প্রকাশ সরকার আবার এগিয়ে এসে ব্যাকুলভাবে বলল, আমি ডাক্তার, আমার কথাটা শুনুন। এভাবে কথা আদায় করা যাবে না। ওঁর মাথায় কিছুই। ঢুকছে না।

লম্বা লোকটি বলল, হুঁ, তোমার যে দেখছি খুব দরদ। আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমিও থাকো এখানে। কী করে পাগল জব্দ করতে হয় আমি জানি। কর্নেল, উঠে এসো। এই তিনটেকে এখানেই আটকে রেখে দাও। এদের খাবার দেবে না, জল দেবে না, এমন কী ডাকলে সাড়াও দেবে না। শুধু বাইরে থেকে পাহারা দেবে। দেখি কতক্ষণ লাগে শিরদাঁড়া ভাঙতে!

সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল একে একে। কালো-চশমা পরা লোকটা দরজার কাছ থেকেও ফিরে এল আবার।

কাকাবাবুর মুখের কাছে মুখ এনে চরম বিদ্রুপের সুরে বলল, রায়চৌধুরী, আমি বাজি ফেলতে পারি, তুমি চব্বিশ ঘণ্টাও তোমার জেদ বজায় রাখতে পারবে না। আর যদি সত্যিই তুমি পাগল হয়ে থাকে, তবে সেই দোষে এই দুজনও খিদেতেষ্টায় ছটফট করে মরবে! আমার কোনও দয়ামায়া নেই।

কাকাবাবুর নড়বড়ে অবশ হাত দুটি এবারে বিদ্যুতের মতন উঠে এল ওপরে! তিনি বজ্রমুষ্টিতে লম্বা লোকটির গলা চেপে ধরে প্রকাশ সরকারকে বললেন, শিগগির দরজাটা বন্ধ করে দাও ভেতর থেকে।