১১. ক্রাচ দুটো কুড়িয়ে নিয়ে

ক্রাচ দুটো কুড়িয়ে নিয়ে কাকাবাবু জঙ্গলটা পেরিয়ে এলেন। কেউ তাঁকে তাড়া করল না। বড় রাস্তায় এসে তাঁকে অপেক্ষা করতে হল খানিকক্ষণ। এখান থেকে ট্যাক্সি পাওয়া সহজ নয়। দু-তিনটি প্রাইভেট গাড়িকে তিনি হাত দেখালেন, কেউ থামল না। তারপর এল একটা মিলিটারি কনভয়। কাকাবাবু একেবারে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে দুহাত তুলে রইলেন। সামনের গাড়িটা ব্রেক কষল। এক্কেবারে তাঁর খুব কাছে এসে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, কেয়া হুয়া?

কাকাবাবু বললেন, জঙ্গলের মধ্যে আমার গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছে। অনুগ্রহ করে কাছাকাছি কোনও বাস রাস্তা কিংবা ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে আমাকে পৌঁছে দেবেন?

ড্রাইভারের পাশে বসা একজন অফিসার জিজ্ঞেস করল, হু আর ইউ? এই জঙ্গলে কী করছিলে?

কাকাবাবু বললেন, আমি একজন সায়েন্টিস্ট। এই জঙ্গলে বুনো চা-গাছ পাওয়া যায় কিনা, তার খোঁজ করতে এসেছিলাম।

অফিসারই জিজ্ঞেস করলেন, জঙ্গলের মধ্যে চা-গাছ? এই ভোপালে?

কাকাবাবু বললেন, ইয়েস। ভারতের অনেক জঙ্গলে বুনো চা-গাছ পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলো খুঁজে বের করাই আমাদের কাজ।

কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। বছর দু-এক আগে এক বৈজ্ঞানিক বন্ধুর সঙ্গে তিনি চা-গাছের সন্ধানে মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। এতদিন সকলে জানত, চা-গাছ শুধু হয় বাংলা, অসম আর ত্রিপুরায়। সেখানে চাষ করতে হয়। কিন্তু এখন অন্য কোথাও কোথাও জংলি চা-গাছের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে।

কাকাবাবুর কথা শুনে কৌতূহলী হয়ে অফিসার তাঁকে গাড়িতে তুলে নিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন চা-গাছের কথা। বস্তার জেলার জঙ্গলে কয়েকটা বুনো চা-গাছ আবিষ্কার করা হয়েছিল। কাকাবাবু শোনালেন সেই কথা।

একটা মোড়ের মাথায় খালি ট্যাক্সি পাওয়া গেল। কাকাবাবু অফিসার ও ড্রাইভারকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে পড়লেন সেখানে।

এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলেন হোটেলে। রাতে পুলিশের কর্তা সুদর্শনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হল অনেকক্ষণ। কিন্তু কাকাবাবু তাঁকে আজ দুপুরের ঘটনা বিন্দুবিসর্গও জানালেন না। কাকাবাবু সুদর্শনকে যে কয়েকটা বিষয়ে খবরাখবর নিতে বলেছিলেন, তিনি তার কিছু কিছু সংগ্রহ করেছেন।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কিছুদিন আগে মান্ডি শহরে খুন হয়েছে রামকুমার পাধি। আবার সাড়ে পাঁচ বছর আগে এখানকার জেলে রামকুমার পাধি নামে একজন কুখ্যাত খুনি আত্মহত্যা করেছিল। এটা কী করে সম্ভব? কোন জন আসল?

সুদর্শন বললেন, আসল রামকুমার পাধিই খুন হয়েছে মান্ডিতে।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে জেলের মধ্যে যে আত্মহত্যা করেছিল, সে-ই সুরজকান্ত?

সুদর্শন বললেন, হ্যাঁ, তবে তার নাম ছিল সুরজকান্ত ওরফে ছোটেলাল। ছোটেলাল নামেও তাকে অনেকে চিনত। এই ছোটেলালের নামে ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে। সে ছিল একটা স্মাগলার দলের চাঁই। দুর্লভ সব মূর্তি, ছবি, পুরনো কালের মুদ্রা পাচার করাতেই সে ছিল এক্সপার্ট। আবার এই ছোটেলালই সুরজকান্ত নামে ইতিহাস বিষয়ে কিছু লেখা ছাপিয়ে ছিল কাগজে। সে নিজেই লিখত, না অন্য কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়ে ছাপাত, তা জানা যায় না।

ছোটেলাল আর সুরজকান্ত, এর মধ্যে কোনটা তার আসল নাম?

বাড়িতে তার নাম ছিল সুরজকান্ত।

তার বাড়ি কোথায় ছিল। জানতে পেরেছ?

হ্যাঁ। তাও জানা গিয়েছে। তার বাড়ি ছিল ইন্দোর শহরে।

তার বাড়িতে কে কে আছে?

মা নেই, বাবা আছেন। এক বোন আর এক বড় ভাই।

বড় ভাইয়ের নাম জানো?

জানি। জগমোহন। এরা পদবি ব্যবহার করে না। এই জগমোহন ছিল আর্মি অফিসার। লেফটেনান্ট কর্নেল হয়েছিল। কিছুদিন আগে রিটায়ার করেছে।

আর্মিতে তার সুনাম কেমন ছিল, তা কি জানা যেতে পারে?

তাও আমি খবর নিয়েছি রাজাদা। আর্মিতে জগমোহনের বেশ সুনামই ছিল। লোকের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করত। ভাল অফিসার। তবে খানিকটা রগচটা। আর-একটা কথা, রাজাদা, এই জগমোহন-সুরজকান্তর বাবা বিমলাপ্রসাদের নামে খুনের চার্জ ছিল। ভাল করে প্রমাণ হয়নি বলে মাত্র পাঁচ বছরের জেল খেটেছে। এদের অনেক টাকা। কী করে এত টাকার মালিক হল বিমলাপ্রসাদ, তা ঠিক জানা যায় না।

ইন্দোরে ওদের বাড়ির ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর জানো?

ঠিকানা জানি। ফোন নম্বর আপনাকে পরে জোগাড় করে দেব। আর কিছু?

সুরজকান্ত জেলের মধ্যে আত্মহত্যা করেছিল না তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল?

জেলের রেকর্ডে আত্মহত্যা বলেই লেখা আছে। ওরা তো আর অন্য কিছু বলে স্বীকার করবে না। তবে একটা কাজ করা যেতে পারে। সেই সময় ওই জেলের ইনচার্জ ছিলেন আবিদ খান। তিনি রিটায়ার করে এই শহরেই আছেন। আপনি তাঁর সঙ্গে দেখা করলে তিনি হয়তো আসল ঘটনাটা বলতে পারবেন। আন-অফিশিয়ালি।

কাকাবাবু বললেন, আমার পক্ষে ওই আবিদ খানের সঙ্গে দেখা করার একটা অসুবিধে আছে। সুদর্শন, তুমি আর-একটা উপকার করতে পারো? তুমি আবিদ খানকে অনুরোধ করতে পারো, এই হোটেলে আসবার জন্য?

সুদর্শন বললেন, সে ব্যবস্থা করা যেতেই পারে। আবিদ খান বেশমজলিশি মানুষ, গান-বাজনার আসরে প্রায়ই দেখা যায়। এখন রিটায়ার করেছেন, হাতে অনেক সময়। আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলে আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দিচ্ছি। রাজাদা, আপনার শরীর ভাল আছে তো?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, শরীর ঠিক আছে। শুধু একটু ঠান্ডা লেগেছে। খুব গরমে অনেক সময় ঠান্ডা লেগে যায়।

সুদর্শন বললেন, তা ঠিক। বুকে ঘাম বসে যায়। রাজাদা, আপনি কিন্তু আমাকে এখনও বলেননি যে, আপনি সুরজকান্ত আর তার ফ্যামিলি সম্পর্কে কেন এত ইন্টারেস্টেড?

কাকাবাবু বললেন, জানাব। সময় হলেই জানাব।