০৮. সন্তু ঘরের দরজা খুলে

সন্তু ঘরের দরজা খুলে প্রথমে কাকাবাবুকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। তারপর অরিজিৎ দেববর্মনকে বলল, আপনি একটু এখানে থাকবেন, আমি একটু বাইরেটা দেখে আসব?

অরিজিৎ দেববর্মন বললেন, ব্যস্ত হবার কিছু নেই। শিশিরবাবু ঠিক চামেলিকে ধরে নিয়ে আসবেন।

সন্তু তবু দরজার কাছে গিয়ে উকি মেরে বলল, উনি আমাদের কাছে ওঁর নাম বলেছিলেন ডলি। বললেন যে, আমার মাসতুতো বোন, আমাদের বাড়িতে অনেকবার গেছেন।

অরিজিৎবাবু বললেন, ওর যে কত নাম তার ঠিক নেই। ওর কাজই হল কলকাতা-আগরতলা প্লেনে উঠে অন্য যাত্রীদের হ্যান্ডব্যাগ চুরি করা। এই তো মাত্র কয়েকদিন আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে।

সন্তুর কেমন যেন অদ্ভুত লাগল। সে আগে কখনও কোনও মেয়ে-চোর দেখেনি। ডলি ওরফে চামেলির কথাবার্তাগুলো যেন তার প্রথম থেকেই কেমন অদ্ভুত লাগছিল, তা বলে ও যে চুরি করে, তা সে ধারণাই করতে পারেনি।

অরিজিৎবাবুর কথাই ঠিক হল। চামেলি ধরা পড়ে গেছে। সন্তু দেখল, শিশির দত্তগুপ্ত তার এক হাত চেপে ধরে টেনে নিয়ে আসছেন, আর সঙ্গে-সঙ্গে আসছে এক দঙ্গল লোক!

শিশিরবাবু ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়বার পরেও লোকগুলো দরজার কাছে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। শিশিরবাবু এক ধমক দিয়ে বললেন, এই যে ভাই, আপনারা সব যান তো! এখানে ভিড় করবেন না!

সন্তু গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

চামেলি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নকল কান্না নয়, জলের ধারা গড়াচ্ছে তার দুগাল বেয়ে।

শিশিরবাবু কড়া গলায় বললেন, কান্না থামাও! হঠাৎ এরকম নাটক শুরু করে দিলে কেন? এখানে এসেছিলে কী মতলবে?

কাঁদতে কাঁদতে চামেলি বলল, ওরা পাঠিয়েছিল। ওরা বলেছিল, এ কাজ ঠিকঠিক না করতে পারলে ওরা আমায় মেরে ফেলবে।

ওরা মানে কারা? তাদের নাম বলো।

নাম আমি জানি না। তাদের ভয়ংকর চেহারা, দেখলেই মনে হয় মানুষ খুন করতে পারে। তারা বলল, কাকাবাবুকে যে-কোনও উপায়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে গাড়িতে নিয়ে এসো। নইলে তুমি প্রাণে বাঁচবে না!

অরিজিৎবাবু বললেন, ভাগ্যিস আমরা ঠিক সময়ে এসে পড়েছিলাম। প্রায় তো নিয়েই যাচ্ছিল মেয়েটা!

শিশিরবাবু বললেন, না, না, এ মেয়েটা মিথ্যে কথা বলছে। এর মধ্যে অনেক ব্যাপার আছে। আমি বাইরে গিয়ে কোনও কালো আমবাসাডর দেখতে পাইনি। কাল রাত্তিরে দিল্লি থেকে খবর পাওয়ার পর আজ ভোর থেকেই আমি সার্কিট হাউসের বাইরে দুজন সাদা পোশাকের পুলিশ দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। তারা বলল, অন্তত এক ঘণ্টার মধ্যে ওরকম কোনও কালো গাড়ি এখানে আসেনি। চামেলিকে তারা ঢুকতে দেখেছে, চামেলি এসেছে সাইকেল রিকশা করে।

চামেলি তবু হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বলল, না, স্যার, বিশ্বাস করুন, আমি সত্যি কথা বলছি। কালো গাড়ি খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, একেবারে কাছে আসতে চায়নি।

শিশিরবাবু বললেন, কতটা দূরে গাড়িটা রেখেছিল?

প্রায় আধমাইল।

এত দূরে তুমি মিঃ রায়চৌধুরীকে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে?

না না, সাইকেল রিকশায়।

শিশিরবাবু সন্তুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমায় কী বলেছিল? সার্কিট হাউসের বাইরেই গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, না?

সন্তু আমতা-আমতা করে বলল, হ্যাঁ,…মানে, সেইরকমই বলেছিলেন।

কাকাবাবু ঘরে ঢোকার পর থেকেই চোখ বুজে আছেন। যেন তিনি কিছুই শুনছেন না; এ-সব ব্যাপারে তাঁর কোনও আগ্রহই নেই।

চামেলি আবার বলল, বিশ্বাস করুন, আমার কোনও দোষ নেই। ওরা আমায় ভয় দেখিয়ে সব করিয়েছে।

অরিজিৎবাবু বললেন, কাজ হাঁসিল তো তুমি করতে পারোনি। তবু তুমি পালাবার চেষ্টা করলে কেন? তোমার সেই ওরা না হয় তোমাকে খুন করবে বলে শাসিয়েছিল, তা বলে আমরা কি তোমায় খুন করতাম?

কী জানি স্যার, আপনাদের দেখেই আমার মাথাটা হঠাৎ কেমন গোলমাল হয়ে গেল।

তারপর সে হঠাৎ কাকাবাবুর পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, কাকাবাবু, আপনি আমায় মাপ করুন। আমি আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি…ছি ছি ছি ছি, আমি কী অন্যায় করেছি। আমার মাথার ঠিক ছিল না…বলুন, কাকাবাবু, আপনি আমায় ক্ষমা করবেন বলুন!

সন্তু একেবারে শিউরে উঠল। কাকাবাবুর একটা পা ভাঙা বলেই কেউ তাঁর পায়ে হাত দিলে তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হন। এমন কী কারুকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেও দেন না। নিশ্চয়ই কাকাবাবু এবার খুব রেগে উঠবেন।

কিন্তু কাকাবাবু চোখ মেলে খুব শান্তভাবে বললেন, একে ছেড়ে দিন! এই মেয়েটি এখানে রয়েছে কেন?

অরিজিৎবাবু ও শিশিরবাবু দুজনেই চমকে উঠলেন।

শিশিরবাবু বললেন, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি একে ছেড়ে দিতে বলছেন?

কাকাবাবু বললেন, অনেক বেলা হয়ে গেছে, মেয়েটি এখন বাড়ি যাক্‌।

শিশিরবাবু বললেন, এই মেয়েটি দাগি আসামি। ওকে জেরা করলে অনেক কিছু জানা যেতে পারে। আচ্ছা মিঃ রায়চৌধুরী, কারা আপনাকে ধরে নিয়ে যেতে চাইছিল, সে সম্পর্কে আপনার কোনও আইডিয়া আছে?

আগরতলায় আপনার কোনও শত্রু আছে?

কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, দারা-পুত্র-পরিবার তুমি কার কে তোমার? হায়, হায়, হায়, হায়! সময় চলিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়! হায়, হায়, হায়, হায়।

শিশিরবাবু আর অরিজিৎবাবু পরস্পরের মুখের দিকে তাকালেন। শিশিরবাবুর মুখখানা গোমড়া হয়ে গেল। অরিজিৎবাবু হাসবার চেষ্টা করে বললেন, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি আমাদের সঙ্গে ঠাট্টা করছেন। কিন্তু ব্যাপারটা তো খুব সিরিয়াস। দিল্লি থেকে যা খবর এসেছে…

কাকাবাবু বললেন, রামনরেশ ইয়াদব কভি নেই দিল্লি গিয়া!

সন্তু ফিসফিস করে শিশিরবাবুকে বলল, শুনুন, আমার কাকাবাবুর মাথায় কীরকম যেন গোলমাল হয়ে গেছে। ওঁর এক্ষুনি চিকিৎসা করা দরকার।

শিশিরবাবু বললেন, ইজ দ্যাট সো?

কাকাবাবু সন্তুর দিকে কটমট করে চেয়ে বললেন, এই খোকা, বড়দের সামনে ফিসফিস করে কানে কানে কথা বলতে নেই, জানো না? ব্যাড ম্যানার্স! যাও, তোমার দিদির সঙ্গে বাড়ি চলে যাও।

সন্তুর যেন চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসবে! কাকাবাবু তাকে আর একদম চিনতে পারছেন না।

এমন কী, চামেলি পর্যন্ত কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে আছে কাকাবাবুর দিকে।

অরিজিৎবাবু বললেন, তা হলে তো এঁর এক্ষুনি চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দরকার। ডক্টর প্রকাশ সরকারই বা কোথায় গেলেন?

শিশিরবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি চামেলিকে আমার অফিসে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সেখানে ওকে আপাতত আটকে রাখুক। মিঃ রায়চৌধুরীর চিকিৎসার ব্যবস্থা কি এখানে সুবিধে হবে, না হাসপাতালে পাঠাবেন?

অরিজিৎবাবু বললেন, এখানে নানা লোকের ভিড়। মহারাজার গেস্ট হাউস খালি আছে, আমি ভাবছিলাম মিঃ রায়চৌধুরীকে সেখানে রাখলে কেমন হয়। সেখানে চিকিৎসার কোনও অসুবিধে হবে না। একজন নার্স রেখে দিলেই হবে।

চামেলি বলে উঠল, আমায় নার্স রাখুন। আমি নার্সিং খুব ভাল জানি। আমি কাকাবাবুর সেবা করব?

অরিজিৎবাবু বললেন, এ মেয়ের আবদার তো কম নয়। একটু আগে এই মেয়েটা ভদ্রলোককে ডাকাতদের হাতে তুলে দিচ্ছিল, এখন আবার বলে কি না সেবা করব!

চামেলি বলল, একবার ভুল করেছি বলে বুঝি ক্ষমা করা যায় না? আমি কাছাকাছি থাকলে ওরা আর কাকাবাবুকে চুরি করে নিয়ে যেতে পারবে না।

শিশিরবাবু বললেন, এবার সত্যি করে বলো তো, ওরা মানে কারা?

আপনি আমায় ঠিক বাঁচিয়ে দেবেন বলুন? আমি ওদের মধ্যে একজনকে চিনি। সে হচ্ছে জগদীপ!

জগদীপ!

হ্যাঁ, জগদীপই তো একটা রিভলভার আমার কপালে ঠেকিয়ে বলল…

ওঃ, এই মেয়েটা কী অসহ্য মিথ্যেবাদী! জগদীপ গত ছমাস ধরে জেল খাটছে, আর সে কি না ওর কপালের সামনে রিভলভার তুলতে এসেছে?

হ্যাঁ, স্যার, সত্যি বলছি, জগদীপই আমায় ভয় দেখিয়েছে। জগদীপ জেল থেকে পালিয়ে গেছে, জানেন না?

একদম বাজে কথা!

ঠিক তখনই ঠকঠক করে শব্দ হল দরজায়।

সন্তু দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখল, একজন বেশ লম্বা আর বলিষ্ঠ লোক, সাদা ধুতি আর সাদা হাফশার্ট পরা, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। দেখলেই বোঝা যায় লোকটি পুলিশ। কেন যে এদের সাদা পোশাকের পুলিশ বলে, তা কে জানে। একবার তাকালেই তো পুলিশ বলে চেনা যায়।

লোকটি প্রথমে শিশিরবাবুর দিকে তাকিয়ে লম্বা স্যালুট দিল। তারপর অরিজিৎবাবুকে।

শিশিরবাবু ওকে দেখেই বললেন, এই তো ভজনলাল! তুমি বলো তো, জগদীপ এখন কোথায়? সে জেলে আছে না?

লোকটি বলল, হ্যাঁ স্যার!

সে কি জেল ভেঙে পালিয়েছে এর মধ্যে?

না স্যার!

শিশিরবাবু অন্যদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, দেখলেন, মেয়েটা কী রকম মিথ্যে কথা বলে?

চামেলি একটুও লজ্জা না পেয়ে বলল, তা হলে বোধহয় জগদীপ নয়। তা হলে বোধহয় ওর নাম রাজাধিপ।

শিশিরবাবু আর অরিজিৎবাবু দুজনেই দারুণ চমকে উঠলেন এই নামটা শুনে।

অরিজিৎবাবু অস্ফুট স্বরে বললেন, প্রিপস্টারাস! এ তো সাংঘাতিক মেয়ে।

শিশিরবাবু বললেন, একে আবার জেলে না দিয়ে উপায় নেই।

বাইরের সাদা পোশাকের পুলিশটি এবার গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, স্যার!

শিশিরবাবু বললেন, ও! কী ব্যাপার, ভজনলাল?

সেই লোকটি বলল, স্যার, গেটের কাছে একটা সাইকেল রিকশা একজন লোককে নিয়ে এসেছে। লোকটা অজ্ঞান!

শিশিরবাবুর সঙ্গে-সঙ্গে সন্তুও ছুটল গেটের দিকে।