০৬. রঙ্গতে পৌঁছনো গেল

আধা ঘণ্টার মধ্যেই রঙ্গতে পৌঁছনো গেল। দাশগুপ্ত বলেছিল, রঙ্গত বেশ জড় জায়গা। আসলে একটা ছোট গ্রামের চেয়েও ছোট। কয়েকটা দোকান, দু-তিনটে হোটেল আর কিছু বাড়িঘর। যে-কোনও বাড়ির পেছনেই নিবিড় বন।

রঙ্গতের ডাকবাংলো একটা উঁচু পাহাড়ের ওপরে। রাস্তাটা এমন খাড়া যে, জিপটা ওঠবার সময় রীতিমতন গোঁগোঁ শব্দ করছে। যে-দিকে তাকানো যায়, শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল।

বাংলোটা অবশ্য বেশ সুন্দর। দোতলা বাড়ি, বড় বড় কাচের জানলা, সামনে সুন্দর ছোট্ট একটা ফুলের বাগান। দোতলার জানলার সামনে দাঁড়ালে বহু দূর পর্যন্ত পাহাড় আর বন দেখা যায়-এখান থেকে আর সমুদ্র দেখা যায় না। এখানকার জঙ্গল এত ঘন যে আফ্রিকার কথা মনে পড়ে যায়-গল্পের বইতে যে-রকম জঙ্গলের কথা আমরা পড়েছি।

রান্না তৈরিই ছিল। ভাত, বড় বড় চিংড়ি মাছ ভাজা আর হরিণের মাংস। বাংলোর চৌকিদার খুব দুঃখ করে বলল, সে কিছুতেই পাঠার মাংস জোগাড় করতে পারেনি, তাই বাধ্য হয়ে হরিণের মাংস রোধেছে। সন্তু তো অবাক! পাঠার মাংস তো সে কতই খেয়েছে-কিন্তু হরিণের মাংস খাওয়াই দরুণ ব্যাপার। এখানে হরিণের মাংস খুবই শস্তা, এমন-কী, এক-একদিন বিনা পয়সাতেও পাওয়া যায়। মাছ তো শস্তাই। এখানে সবচেয়ে দামি জিনিস তরকারি। অনেক লোক তিন-চার বছরের মধ্যে ফুলকপি চোখেই দেখেননি।

কাকাবাবু দারুণ গম্ভীর, কারুর সঙ্গে কোনও কথা বলছেন না। সন্তু কাকাবাবুর এই স্বভাবটা জানে। অনেক লোক শুধু নিজের বাড়ির লোকজন কিংবা টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা করেন। কিন্তু কাকাবাবু এমন সব জিনিস নিয়ে চিন্তা করেন, যার সঙ্গে তাঁর নিজের কোনও সম্পর্কই নেই। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে বৈজ্ঞানিকরা এসে আন্দামানে নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে, এজন্য কাকাবাবুর রাত্তিরে ঘুম হবে না কেন? কত লোক তো তবুও ঘুমোয়!

সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত সন্তু শুনতে পেল, কাকাবাবু এক-একা বারান্দায় পায়চারি করছেন। বরাদ্দাটা কাঠের। সেখানে কাকাবাবুর ক্রাচের শব্দ হচ্ছে ঠক্‌ ঠক্‌ ঠক্‌।

সকালবেলা দাশগুপ্ত বলল, স্যার, জিপ রেডি! কখন বেরুবেন?

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাব?

যেখানে আপনার খুশি। এখানে কত বেড়াবার জায়গা আছে! চিত্রকূট যাবেন?

আমি এখানে বেড়াতে আসিনি, দাশগুপ্ত!

চিত্ৰকূট নামটা শুনে সন্তুর খুব কৌতূহল হল। চিত্ৰকূট নামটা তো রামায়ণ বইতে আছে। এখানেও একটা চিত্ৰকূট আছে নাকি? জায়গাটা কেমন?

দাশগুপ্ত এক গাল হেসে বলল, স্যার, কাজ তো আছেই! তবু এত দূর এসে একটু বেড়াবেন না? এখানে ভাল-ভাল জায়গা আছে। মায়াবন্দর যাবেন? চমৎকার জায়গা! আর যদি ডিগলিপুর যেতে চান, তাও ব্যবস্থা করা যায়। হরিণের পাল আর কুমির দেখতে হলে ডিগলিপুর যেতে হয়! যাবেন? সন্তুর কাছে মায়াবন্দর নামটাও খুব সুন্দর লাগল। সত্যিই এ-রকম নামের কোনও জায়গা আছে? জায়গাটা কি যখন-তখন বদলে যায়?

কাকাবাবু কড়া সুরে বললেন, আমি কোথাও যেতে চাই না। আমি আজই ফিরে যেতে চাই।

দাশগুপ্ত হতাশভাবে বলল, আজই ফিরে যাবেন? একটা দিন থেকে গেলে হয় না?

না! শুধু শুধু সময় নষ্ট হচ্ছে। এখানে আমাকে এনেছ কেন? আমি কি জায়গা দেখতে এসেছি? আজই ফিরে গিয়ে এসপি-র সঙ্গে দেখা করে অনুমতি নিয়ে নাও, যাতে আমি যে-কোনও জায়গায় যেতে পারি। এস পি যদি অনুমতি না দেন, তাহলে আমাকে দিল্লিতে টেলিগ্রাম পাঠাতে হবে?

দাশগুপ্তর নিজেরই আসলে খুব বেড়াবার ইচ্ছে। বোঝা যায়, লোকটি আসলে খুব বেড়াতে ভালবাসে। তার মুখ দেখলে আরও বোঝা যায়, কাকাবাবুর কথা তার একটুও পছন্দ হয়নি। কাকাবাবুর দিল্লিতে টেলিগ্রাম পাঠাবার কথা শুনে সে আরও ভয় পেয়েছে।

সকালবেলায় চা-জলখাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়া হল। আবার জিপে করে সেই বন্দর পর্যন্ত যাওয়া। কাকাবাবু আগাগোড়া মুখ বুজে রইলেন। জেটিতে গিয়ে মোটরবোটে ওঠার সময় শুধু বোট-চালককে একবার প্রশ্ন করলেন, ভাল করে তেল ভরে নেওয়া হয়েছে তো? আবার কোথাও এটা থেমে যাবে না?

এই প্ৰথম শঙ্করনারায়ণকে হাসতে দেখল। সন্তু। সে বলল, না, স্যার, থামবে না। আশা করছি, ঘণ্টা চারেকের মধ্যে পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছে যাব।

ঠিক আছে, চলো।

আশ্চর্যের ব্যাপার, মোটরবোটটা ছাড়বার পরই কাকাবাবু চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়লেন। আসবার সময় তিনি চারদিক দেখতে-দেখতে আসছিলেন, কিন্তু এখন আর তাঁর কোনও আগ্রহই নেই।

সন্তু কিন্তু খুব আগ্রহের সঙ্গে চোখ মেলে রইল। এবার আর তার পেট ব্যথা হচ্ছে না কিংবা বমিও পাচ্ছে না। আসবার সময় সে শুধু ডান দিকটা দেখেছিল, এবার বসল। বাঁদিকে। যদি আবার কুমির কিংবা হাঙর দেখা যায়।

ঘণ্টা দেড়েক পরে ওরা সেই জায়গাটায় এসে গেল, যেখানে জারোয়ারা থাকে। সেই বালির চড়াটাও দেখা গেল, যেটার নাম দাশগুপ্ত বলেছিল সোনা-বেলা। এখানকার বালিতে নাকি সোনা মিশে আছে।

ভুল হচ্ছে কিনা মিলিয়ে দেখবার জন্য সন্তু দাশগুপ্তকে জিজ্ঞেস করল, এইটা সেই জায়গা নয়? যেখানে কয়েকটা ছেলে নেমেছিল, আর জারোয়ারা হঠাৎ এসে আক্রমণ করল?

দাশগুপ্ত বলল, হ্যাঁ, ঠিক চিনেছ!

তারপর দাশগুপ্ত ফিসফিস করে বলল, তোমাকে তখন আমি ঘটনাটা ধললাম, আর তোমার কাকাবাবু বিশ্বাস করলেন না। উনি ভাবলেন আমি বানিয়ে বলেছি! আমি কিন্তু ঠিকই বলেছিলাম। জারোয়ারা এমন হিংস্ৰ-

কাকাবাবু এই সময় চোখ মেলে বললেন, আমি এখনও তোমার কথা বিশ্বাস করি না?

তার মানে কাকাবাবু সব শুনছিলেন? সজাগই ছিলেন উনি!

কাকাবাবু উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হুকুমের সুরে বললেন, বোট ঘোরাও! আমি ওই বালির চরে নামব!

দাশগুপ্ত বলল, সে কী? অসম্ভব! আপনাকে কিছুতেই নামতে দেব না, স্যার! আপনাকে বললাম না, অর্ডার ছাড়া এখানে নামা যায় না। আপনি কি প্রাণটা খোয়াতে চান?

কাকাবাবু হঠাৎ এবার কোটের পকেট থেকে তাঁর রিভলভারটা বার করলেন। তারপর সেটা উঁচু করে তুলে বললেন, আমি যা বলছি, তাই শুনতে হবে! বোট ঘোরাও!

কাকাবাবু খটু খটু করে এসে শঙ্করনারায়ণের ঘাড়ের কাছে রিভলভারটা চেপে ধরে বললেন, শঙ্করনারায়ণ, তুমি খুব ভাল ছেলে, আমার কথা শুনে চলো! নইলে, তোমাকে আহত করে আমি নিজেই বোট ঘোরাব।

শঙ্করনারায়ণ একটাও কথা উচ্চারণ না করে খাঁড়ির ডান দিকে মোটরবোট ঘোরাল।

সেটা বালির চরে এসে থামবার পর কাকাবাবু নিজের ক্রচ নিয়ে অতি কষ্টে নামলেন। হাতব্যাগটাও নিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, তোমরা সবাই ফিরে যাও! আমার জন্য চিন্তা করতে হবে না।

দাশগুপ্ত হাত জোড় করে কাদো-কাঁদো গলায় বলল, স্যার, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? আপনি কেন এখানে যাচ্ছেন? আপনার রহস্য সমাধান করার জন্য এ ছাড়া আর কোনও জায়গা কি নেই?

কাকাবাবু বললেন, তার কারণ, অন্য সব জায়গায় গভর্নমেন্টের লোকেরা কখনও-না-কখনও যায়। সেখানে অদ্ভুত কিছু থাকলে এতদিনে জানা যেত! শুধু এই জায়গাটাতেই আর কেউ আসে না। সুতরাং কিছু রহস্য থাকলে এখানেই আছে। তোমরা ফিরে যাও। এস পি-কে বলে কালকে কিছু লোকজন নিয়ে আবার ফিরে এসো আমার জন্য।

তিনি এবার সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, সন্তু, তুমিও যাও, পোর্ট ব্লেয়ারে আমার জন্য অপেক্ষা করো।

দাশগুপ্ত বলল, ওরে বাবা, যে-কোনও মুহূর্তে জারোয়ারা তীর মারতে পারে।

কাকাবাবু রিভলভারটা উঁচু করে বললেন, তোমাদের আর তো থাকবার দরকার নেই। তোমরা যাও

সঙ্গে-সঙ্গে মোটরবোটটা চলতে শুরু করল।

কিন্তু সন্তু কিছুতেই কাকাবাবুকে ছেড়ে যাবে না। সে মোটরবোট থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে।

বোটের চালক শঙ্করনারায়ণ আর একটুও দেরি করল না। সে বোটটা চালিয়ে দিল গভীর সমুদ্রের দিকে।

দাশগুপ্ত পাগলের মতন লাফাতে লাগল। সে হাত-পা ছুড়তে লাগল। এ কি? এ কি? আমরা ওদের ফেলে চলে যাব নাকি? আমার তাহলে চাকরি যাবে! পাইলট, কোথায় চলে যাচ্ছ?

শঙ্করনারায়ণ গম্ভীরভাবে বলল, বসে পড়ুন! বসে পড়ুন! গায়ে তীর লগতে পারে!

অ্যা?

দাশগুপ্ত ধপাস করে বোটের মধ্যে শুয়ে পড়ল। শঙ্করনারায়ণ বলল, সবাই মিলে একসঙ্গে মরে যাওয়ার কোনও মানে আছে? আমরা ওখানে আর একটুক্ষণ থাকলেই জারোয়ারা তীর মারত!

কিন্তু ওদের কী হবে?

মিঃ রায়চৌধুরীর কাছে রিভলভার আছে। তিনি গুলি ছুঁড়ে ভয় দেখিয়ে জারোয়াদের আটকাবার চেষ্টা করতে পারেন। পারবেন। কিনা জানি না! আমাদের উচিত পুলিশের এস পি সাহেবকে সব কিছু জানানো। তারপর পুলিশ নিয়ে এসে যদি ওঁদের বাঁচানো যায়-

মোটরবোটটা অনেক দূর চলে এসেছে। এখন দ্বীপের সেই জায়গাটা দেখা যায় না। শুধু দেখা যায় জঙ্গল। ওর মধ্যে বিষাক্ত তীর নিয়ে লুকিয়ে আছে জারোয়ারা। ওখানে বাইরের লোক যে একবার গেছে সে আর ফেরেনি।

দাশগুপ্ত ফোঁস ফোঁস করে দুটো দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর তার এমনই দুঃখ হল যে, চোখের ওপর হাত চাপা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।