০৫. কাকাবাবুর জ্ঞান ফিরলে

কাকাবাবুর জ্ঞান ফিরলেও ঘোর কাটতে খানিকটা সময় লাগল।

প্রথমে তিনি ভাবলেন, এটা হোটেলের ঘর, না কোন ঘর? খাটটা অনেক বড়। হোটেলের ঘরের দেওয়ালে গঙ্গার একটা বাঁধানো ছবি ছিল। এ ঘরের কোনও দেওয়ালে কোনও ছবি নেই।

তারপর তিনি দেখলেন, তিনি তার ডোরাকাটা স্লিপিং সুটটাই পরে আছেন। এই পোশাক পরে তো তিনি বাইরে যান না। তা হলে এই একটা অন্য ঘরে এলেন কী করে?

তারপর তার মনে পড়ল, মাঝরাত্তিরে কীসের যেন ধোঁয়ায় তার দম আটকে আসছিল, মাথা ঘুরছিল। তখন কয়েকজন লোক তাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল। অন্ধকারে তাদের মুখ দেখতে পাননি ভালো করে।

এবার তিনি উঠে বসলেন। খাটের পাশেই একটা ছোট শ্বেতপাথরের টেবিল। তার উপর পরিপাটি করে সাজানো রয়েছে একটি দামি ড্রেসিং গাউন।

পাশের একটা থালায় অনেক রকম ফল। একটা বড় গেলাস ভরতি কীসের যেন শরবত। আর-একটা জলের জাগ।

খাটের পাশেই রয়েছে একজোড়া নতুন চটি। কাকাবাবু ভাবলেন, এ যে রাজকীয় ব্যবস্থা দেখছি। আগে অনেকবার, অনেক জায়গায় তাকে আটকে রাখা হয়েছে, কিন্তু কোথাও এত খাতির পাননি।

খাট থেকে নেমে ড্রেসিং গাউন পরে দেখলেন। বেশ ফিট করেছে। চটি জোড়াও তাই।

ড্রেসিং গাউনটা পরতে গিয়ে তার স্লিপিং সুটের একটা পকেট ভারী ভারী লাগল। সেখানে হাত দিয়ে একেবারে তাজ্জব হয়ে গেলেন।

তার রিভলভার। পকেটেই ছিল, ওরা কেড়ে নেয়নি? এ আবার কেমন বন্দি করে রাখা? তিনি যেন কারও বাড়িতে অতিথি। তা হলে জোর করে ধরে আনল কেন?

তেষ্টা পেয়েছে, কাকাবাবু শরবতের বদলে খানিকটা জল খেলেন। তারপর গেলেন বাথরুমে।

জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখা যায়।

বাইরে রীতিমতো ঝোপ-জঙ্গল। এখানে-সেখানে ভাঙা দেওয়াল। হাত-পা ভাঙা মূর্তি, আধখানা দরজা। বোঝা যায়, এটা একটা খুব পুরনো আমলের বাড়ি, প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মুখে, শুধু বোধহয় দু-একটা ঘর আর বাথরুম সারিয়ে নেওয়া হয়েছে।

শহরের কাছাকাছি নয় বোধহয়।

তিনি বাথরুম থেকে বেরোতেই একজন বুড়ো লোক এসে জিজ্ঞেস করল, স্যার আপনি কী খাবেন? চা না কফি?

কাকাবাবু বললেন, আগে চা-ই নিয়ে এসো। পরে কফি খাব।

লোকটি বলল, তখন কি কফির সঙ্গে ডিমের পোচ দেব? না অমলেট, হাফ বয়েল? টোস্ট খাবেন, না পরোটা?

কাকাবাবু হেসে ফেললেন। এ যে ফাইভ স্টার হোটেলের মতো ব্যাপার!

তিনি বললেন, সে পরে দেখা যাবে, এখন শুধু চা নিয়ে এসো।

একটু পরেই লোকটি ঠিক বড় হোটেলের মতোই ট্রে-তে সাজিয়ে পোর্সেলিনের পটে চা, খুব দামি সোনালি বর্ডার দেওয়া কাপ-প্লেট আর দুধ, চিনি আলাদা করে নিয়ে এল।

হোটেলের বেয়ারাদের টিক্স দিতে হয়। কাকাবাবুর কাছে পয়সাটয়সা কিছু নেই।

চায়ে চুমুক দিয়ে তিনি ভাবলেন, সন্তু আর জোজো এখন কী করছে? সকালে উঠে ওরা তাকে দেখতে না পেয়ে কী করবে?

তবে তিনি জানেন, সন্তু সহজে ঘাবড়াবার ছেলে নয়। এরকম অভিজ্ঞতা তার আগেও হয়েছে অনেকবার।

তিনি যদি এখান থেকে চলে যেতে চান, কেউ কি বাধা দেবে? তার সঙ্গে রিভলভারটা আছে, তাঁকে কে আটকাবে?

মুশকিল হচ্ছে, তার ক্রাচ দুটো নেই। এই অবস্থায় তিনি হাঁটবেন কী করে? এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে হয়। সেটা একটা বিশ্রী ব্যাপার।

তবু তিনি চা শেষ করে ঘরের বাইরে এলেন।

একটা বারান্দা, সেটার বেশ করুণ অবস্থা। একটা দিক একেবারে ভেঙে পড়েছে। বাড়িটা অন্তত দেড়শো-দুশো বছরের পুরনো। নিশ্চয়ই নবাবি আমলের বাড়ি।

বারান্দা দিয়ে একটু এগোতেই পাশের আর-একটা ঘর দেখা গেল। দরজা খোলা। সেখানে হুইল চেয়ারে বসে আছেন আমির আলি। একজন লোক তার পিঠ ম্যাসাজ করে দিচ্ছে।

তিনি বললেন, গুড মর্নিং রায়চৌধুরীসাহেব। রাত্তিরে ভাল ঘুম হয়েছিল তো? কোনও অসুবিধে হয়নি?

কাকাবাবু বললেন, না, অসুবিধে আর কী হবে? ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে দিলে চমৎকার ঘুম হয়। আপনি ভাল আছেন তো?

আমির আলি একটু লজ্জিতভাবে বললেন, আপনাকে ওরকমভাবে নিয়ে আসাটা ঠিক হয়নি। ছেলে-ছোকরাদের ব্যাপার। মাথা গরম করে ফেলে!

কাকাবাবু বললেন, আপনি আমাকে খবর দিলেই তো আমি চলে আসতাম। এরকম ধরেটরে আনার দরকার ছিল না!

আমির আলি হাতের ইঙ্গিতে অন্য লোকটিকে চলে যেতে বললেন।

তারপর অন্য একটা চেয়ার দেখিয়ে বললেন, বসুন রায়চৌধুরীবাবু। আমার ছেলে আপনাকে এই জায়গাটা ছেড়ে চলে যেতে বলেছিল। সেটা শুনলেই ভাল করতেন। তা হলে আর কোনও গন্ডগোল হত না।

কাকাবাবু বললেন, এটা আপনার ছেলের আবদার। সে তো বেশ বড় হয়ে গিয়েছে। এরকম বাজে আবদার করে কেন? আমার যতদিন ইচ্ছে এখানে থাকব, তাতে সে বাধা দেওয়ার কে?

আমির আলি বললেন, বাজে আবদার নয়। আমরা এখানে এমন একটা কাজ করতে যাচ্ছি, যার মধ্যে আপনার জড়িয়ে পড়া উচিত নয়। আপনি নাকি অন্যদের ব্যাপারে নাক গলান? বেশ কয়েকজন আমাদের একথা বলেছে।

কাকাবাবু বললেন, আমার নাকটা এমন কিছু লম্বা নয় যে, সব ব্যাপারে গলাতে যাব। তবে আমার নাক বাজে গন্ধ সহ্য করতে পারে না। আপনারা যে কাজটা করতে যাচ্ছেন, সেটা কী? মানুষ খুন?

আমির আলি শান্তভাবে বললেন, জি হ। আপনি এর মধ্যেই জেনে ফেললেন কী করে?

আপনার ছেলেই আমাকে সেকথা বলেছে। আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, আপনার মতো একজন ভদ্রলোক, মানী লোক, কী করে মানুষ। খুন করার মতো অমানবিক কাজ সমর্থন করছেন?

সেটা আপনাকে বুঝতেও হবে না। কিন্তু আপনি কি পুলিশ? খুনের তদন্ত করা আপনার কাজ?

না। সেটা আমার কাজ নয়। আমি পুলিশও নই। কিন্তু কোথাও কেউ খুন হচ্ছে, সেটা জানতে পারলে তা আটকানোর চেষ্টা করা তো যে-কোনও মানুষেরই কর্তব্য।

যাকে খুন করা হবে, সেটা মানুষ নয়। নরকের পোকা!

আমার মতে সব মানুষই সমান। সব মানুষেরই বেঁচে থাকার অধিকার। আছে। কেউ যদি কোনও অন্যায় করে, আইন অনুযায়ী তার শাস্তি হবে। অন্য কেউ তাকে মারতে পারবে না, সভ্য সমাজে সে অধিকার নেই।

এটা একটা পারিবারিক ব্যাপার। আমাদের পরিবারের কাউকে যদি একজন খুন করে, তা হলে তাকে কিংবা সেই পরিবারের একজনকে খুন করতে না পারলে শান্তি হয় না। একে বলে রক্ত-ঋণ। আমরা এক পূর্বপুরুষের রক্ত-ঋণ শোধ করব।

সে তো আরব দেশে এরকম প্রথা ছিল শুনেছি।

মনে করুন, আমরাও আরবেরই লোক। অন্তত কোনও এক সময় ছিলাম।

কিন্তু এটা স্বাধীন ভারত। এখানে রক্ত-ঋণটিন চলে না। এখানে যেকোনও কারণেই হোক, কোনও মানুষকে খুন করলে আপনাদের শাস্তি পেতেই হবে! যে খুন করবে, তার ফাঁসিও হতে পারে।

আমির আলি একটা হাত তুলে বললেন, এ কী! আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন?

কাকাবাবু বললেন, খুনটুনের কথা শুনেও উত্তেজিত হব না? আপনি এত ঠান্ডা মাথায় এসব বলছেন কী করে, তাতেই আশ্চর্য হচ্ছি।

আমির আলি বললেন, শুনুন, আমাদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। খুনটা হবে অনেকের চোখের সামনে। তবু কেউ আমাদের দোষী করবে। কার খুনের বদলা নেওয়া হচ্ছে শুনলে আপনারও সমর্থন করা উচিত।

কাকাবাবু বললেন, কোনও কারণেই আমি মানুষ খুন সমর্থন করতে পারব না। তবু শুনি, আপনারা কার খুনের বদলা নিতে চান?

এই বাড়িটার নাম পান্নামহল। এখন প্রায় সবই ভেঙেচুরে গিয়েছে। এ বাড়ি কার ছিল জানেন? আমিনা বেগমের।

কোন আমিনা বেগম?

সিরাজদ্দৌল্লার জননী!

এটা অত দিনের পুরনো বাড়ি?

হ্যাঁ। এ বাড়ি আমাদের। আমরা সিরাজের বংশধর।

কাকাবাবু এবার হেসে ফেলে বললেন, কী যে বলেন? সিরাজের কোনও ছেলে ছিল নাকি?

আমির আলির মুখে হাসি নেই। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। তিনি জোর দিয়ে বললেন, ছেলে ছিল না, কিন্তু মেয়ে ছিল! এখনকার বিজ্ঞান বলে, শুধু ছেলেদের কেন, মেয়েদেরও একই বংশ। একই জিন রক্তে প্রবাহিত হয়। আপনার পিছনের দেওয়ালে একটা ছবি আছে। দেখুন তো কার ছবি?

কাকাবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বললেন, ও তো সিরাজের ছবি। নবাব সিরাজদ্দৌল্লার ওই একটা ছবিই তো দেখা যায় সব বইয়ে। মাথায় পালক গোঁজা শিরস্ত্রাণ।

আমির আলি বললেন, এবার বলুন তো, আমার ছোট ছেলে সেলিমের সঙ্গে ওই ছবির হুবহু মিল নেই?

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, ওইরকম সাজলে গুজলে হয়তো একরকম দেখাতেও পারে। কিন্তু তাতে কী হল, একটা ছবির সঙ্গে একজন মানুষের খানিকটা মিল থাকলেও থাকতে পারে।

আমির আলি কঠোরভাবে বললেন, আমার ছোট ছেলে সেলিম নবাব সিরাজের শেষতম বংশধর। ওর মধ্যে আবার সিরাজ ফিরে এসেছেন।

কাকাবাবু বললেন, এ আপনি কী বলছেন, আলিসাহেব? নবাব সিরাজের মৃত্যু হয়েছে আড়াইশো বছর আগে। এতদিনে বংশটংশের কোনও চিহ্ন থাকে?

আমির আলি বললেন, কেন থাকবে না। ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের একই বংশ নেই? রানির ছেলেও একই বংশ। আমার কাছে ডেফিনিট প্রমাণ আছে। দশ বছর আগে আমি একটা পুরনো খাতা আবিষ্কার করেছি। তাতে আমাদের বংশতালিকা দেওয়া আছে। তার থেকেই জানা যায়, আমরা সিরাজ ও লুতফা বেগমের বংশধর।

কাকাবাবু বললেন, সেই জন্যই আপনি এখানকার বাড়ির নাম রেখেছেন চেহেল সুতুন? নবাব আলিবর্দির বাড়ির ওই নাম ছিল। নামটা দেখেই আমার খটকা লেগেছিল।

আমির আলি বললেন, হ্যাঁ, আলিবর্দিও আমাদের পূর্বপুরুষ। আমরাই বাংলা-বিহার-ওড়িশার মালিক।

কাকাবাবু বললেন, কিন্তু এখন তো স্বাধীন দেশ। এখন তো কেউ কোনও রাজ্যের মালিক নয়। এখন গণতন্ত্র। যারা নির্বাচনে জেতে, তারা দেশ চালায়। নবাব-বাদশা, রাজা-মহারাজদের দিন কবে শেষ হয়ে গিয়েছে!

আমির আলি বললেন, রাজত্ব শেষ হলেও টাইটল তো আছে। গায়ত্রী দেবী জয়পুরের মহারানি। আসল মহারানি এখন না হলেও সকলে তো মহারানিই বলে। যেমন পটৌডির নবাব, কুচবিহারের রাজা, ত্রিপুরার মহারানি, মাণ্ডির রাজা …। সেইরকম, আমার ছেলে সেলিমও হবে বাংলার নবাব!

কাকাবাবু হালকাভাবে বললেন, নতুন করে বাংলার নবাব। বেশ তো! তার জন্য গভর্নমেন্টকে চিঠি লিখুন। সরকার যদি মেনে নেয়, তা হলে আমাদেরও মেনে নিতে আপত্তি নেই। কিন্তু এর মধ্যে খুনটুনের কথা আসছে কোথা থেকে?

আমির আলি বললেন, আমার ছেলে সেলিম সিরাজের যোগ্য উত্তরাধিকারী। তাকে সেই যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। সিরাজকে যারা মেরেছে, তাদের অন্তত একজনকে খুন করে প্রতিশোধ না নিলে রক্ত-ঋণ শোধ হবে না!

এ কী অদ্ভুত কথা! সিরাজ খুন হয়েছিল আড়াইশো বছর আগে। তার খুনিদের এখন পাবেন কোথায়?

তাদের বংশধর কেউ না-কেউ আছে। সেই জন্যই আমরা প্রতি বছর এসে খোঁজ করি।

সিরাজের হত্যার জন্য আসল দায়ী তো ইংরেজরা। তারা এদেশ ছেড়ে চলে গিয়েছে, তাদের সঙ্গে আমাদের আর কোনও সম্পর্ক নেই। মিরজাফররা তো ছিল ইংরেজদের হাতের পুতুল।

তবু তাদের বংশধরদের রক্তে রয়ে গেছে সেই পাপ। আমরা মিরজাফর বা মিরনের কোনও সরাসরি বংশধরকে খুঁজছিলাম। এদের অনেকেই বিদেশে চলে গিয়েছে। শেষপর্যন্ত এবারেই একজনকে পেয়েছি। একেবারে আসল লোক। তাকে মারলেই আমাদের সত্যিকারের পুণ্য হবে।

সে কে?

দেখতে পাবেন, দেখতে পাবেন। আপনার সামনেই তাকে খতম করা হবে?

এইসময় ঘরে ঢুকল সেলিম। সে প্রায় ছবির নবাবের মতোই সাজ করেছে। মাথায় পালকের মুকুট। কোমরে তলোয়ার। এখন এরকম পোশাক দেখলে যাত্রাদলের নবাব মনে হয়। তার এক হাতে একটা চাবুক।

গম্ভীরভাবে সে বলল, আব্বাজান, এই লোকটির সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। হয়তো তোমার পছন্দ হবে না। তুমি একটু অন্য ঘরে যাবে?

আমির আলি বললেন, কী বলবি, বল না আমার সামনেই।

সেলিম কাকাবাবুর দিকে ফিরে কটমট করে চেয়ে রইল।

কাকাবাবু বললেন, সেলিমসাহেব, আপনি আমাকে পরদিন সকাল পর্যন্ত সময় দিয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই মাঝরাত্রে আমাকে অজ্ঞান করে ধরে আনলেন। আমি আশা করেছিলাম, আপনি ভদ্রলোকের মতো কথা রাখবেন। সেই জন্যই আমি রাত্তিরবেলা সাবধান হইনি।

সেলিম রুক্ষ স্বরে বলল, ভদ্রলোক? আমি ভদ্রলোক নই, আমি নবাব। আমি যখন-তখন ইচ্ছেমতো মত বদল করতে পারি। আমার মনে পড়ল, আমার কাছে আপনার ক্ষমা চাওয়া বাকি আছে। আপনি চেয়ার থেকে নেমে মাটিতে নিলডাউন হয়ে বসুন, তারপর হাতজোড় করে আমার কাছে ক্ষমা চান।

কাকাবাবু দারুণ অবাক হয়ে যেন আকাশ থেকে পড়লেন। ভুরু তুলে বললেন, আমি ক্ষমা চাইব? কেন? আমি আবার কী দোষ করলাম? লোকে তো বলছে, আপনি ঘোড়া চালিয়ে আমার গায়ে এসে পড়ছিলেন, আপনারই ক্ষমা চাওয়া উচিত।

সেলিম বলল, নবাব কখনও সাধারণ মানুষের কাছে ক্ষমা চায় না। আপনি গুলি চালালেন, তাই ঘোড়াটা খেপে গেল।

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, ঘোড়াটা হুড়মুড় করে আমার গায়ে এসে পড়বে, আমার হাত-পা ভাঙবে, আমি থামাবার চেষ্টা করব না? এরকম অদ্ভুত কথা কখনও শুনিনি!

সেলিম বলল, ঘোড়াটা হঠাৎ খেপে গেল বলেই আমি ঘোড়া থেকে পড়ে গেলাম। নবাব বংশের কেউ কখনও সাধারণ মানুষদের সামনে ঘোড়া থেকে পড়ে যায় না!

কাকাবাবু হাসি চেপে বললেন, আপনি ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েছেন, তার কারণ আপনি ভাল করে শেখেননি। নবাব বংশের লোক হলেও ঘোড়া চালানো শিখতে হয়।

সেলিম একটু এগিয়ে এসে হাতের চাবুকটা দুলিয়ে বলল, মাটিতে নেমে বসুন, ক্ষমা চান। না হলে চাবুক খেতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, যে-নবাব সাধারণ মানুষকে বিনা দোষে চাবুক মারে, তার নবাবি বেশিদিন টেকে না। আপনি নিজেকে নবাব ভাবুন আর নাই-ই ভাবুন, এই অপরাধে পুলিশ আপনাকে গ্রেফতার করতে পারে।

সেলিম রক্তচক্ষে বলল, ওসব বাজে কথা শুনতে চাই না। নামুন মাটিতে!

কাকাবাবু বললেন, না।

সেলিম এবার সত্যি সত্যি এক ঘা চাবুক কষাল কাকাবাবুর গায়ে!

কাকাবাবু এবার পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে আদেশের সুরে বললেন, চাবুকটা ফেলে দিন! নইলে আমি গুলি করব!

সেলিম হা-হা করে হেসে উঠল।

তারপর সে আবার চাবুক তুলতেই তিনি বাধ্য হয়ে গুলি চালালেন।

তখন একটা আশ্চর্য ব্যাপার হল।

কাকাবাবু ওকে মারবার জন্য নয়, শুধু চাবুকটা ফেলে দেওয়ার জন্য ওর হাতের মুঠোয় টিপ করে গুলি চালিয়েছিলেন। গুলিটা ঠিক জায়গায় লাগল বটে, কিন্তু সেলিমের কিছুই হল না। বুলেটটা ঠক করে পড়ে গেল মাটিতে।

সেলিম আবার হেসে উঠে বলল, গোলা গা ডালা! গুলিতে আমার কিছুই হয় না।

কাকাবাবু একটুর জন্য হকচকিয়ে গিয়েও রিভলভারের ব্যারেলটা খুলে দেখে আসল ব্যাপারটা বুঝে গেলেন। আগের দিন আমির আলির বাড়িতে তার রিভলভারটা জমা রাখতে হয়েছিল। সেই সময় আসল গুলিগুলো সরিয়ে খেলনা গুলি ভরে দিয়েছে। তাই রিভলভারটা কেড়ে নেয়নি!

সেলিম আবার চাবুক তুলতেই কাকাবাবু শান্তভাবে বললেন, আমাকে ওভাবে মারতে যাবেন না সেলিম! আমার একটা শপথ আছে, কেউ যদি আমার গায়ে হাত তোলে, কিংবা কোনও কিছু দিয়ে আঘাত করে, তা হলে আমি কোনও না-কোনও সময় গুনে গুনে সেই আঘাত ফিরিয়ে দেব।

এবার আমির আলিও হেসে ফেললেন।

তিনি বললেন, এ আপনি কী বলছেন, রায়চৌধুরীবাবু! আপনি আর প্রতিশোধ নেবেন কী করে? সে সুযোগ তো আর পাবেন না। আপনাকে আমরা মেরে ফেলতে চাইনি। আজ রাত্তিরে আমাদের কাজ মিটে গেলে আপনাকে আবার অজ্ঞান করে কোথাও রেখে দিয়ে আসব। তারপর জীবনে আর আমাদের দেখা পাবেন না।

কাকাবাবু বললেন, আগেও অনেকেই এই কথা বলেছে। কিন্তু আমি ঠিক বেঁচে ফিরে আসি। কাউকে বিনা কারণে আঘাত করলে উলটে নিজেকেও একসময় সেই আঘাত পেতে হয়, এটা মনে রাখা ভাল।

সেলিম আবার চাবুক কষাল, কাকাবাবু গুনলেন, দুই। আবার চাবুক, আবার গুনলেন, তিন।

এবার আমির আলি হাত তুলে বললেন, ব্যস, ব্যস! আর দরকার নেই। রায়চৌধুরীবাবু, আপনি তো আচ্ছা গোঁয়ার! একবার মাপ চেয়ে নিলেই তো পারতেন, তা হলে আর মার খেতে হত না!

কাকাবাবু বললেন, আমার কাছেই ওঁকে মাপ চাইতে হবে, অবশ্যই!

সেলিম একটা ঘৃণার শব্দ করল, তারপর চেঁচিয়ে ডাকল, কাসেম। কাসেম!

একজন বন্দুকধারী লোক ঢুকে এল ঘরে।

সেলিম তাকে বলল, এই লোকটাকে অন্য ঘরে রেখে দে। দুপুরে কিছু খেতে দিবি না।

কাসেমের প্রায় দৈত্যের মতো চেহারা। সে কাকাবাবুর একটা হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিতেই কাকাবাবু আর বাধা দিলেন না।

কাসেম তাঁকে টানতে টানতে পাশের ঘরে নিয়ে এসে ধাক্কা মেরে ভিতরে ফেলে দিল।

বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

 

সারাদিন কাকাবাবু বন্দি হয়ে রইলেন সেই ঘরে।

বাথরুমের জানলার গরাদ অনেক পুরনো, ভেঙে ফেলা এমন কিছু শক্ত নয়। কিন্তু তিনি সে চেষ্টা করলেন না। খোঁড়া পায়ে দোতলা থেকে লাফিয়ে নামবেন কী করে? ক্রাচ দুটো নেই। রিভলভারটাও অকেজো। এই অবস্থায় পালাবার চেষ্টা করারও কোনও মানে হয় না।

তিনি ঠিক করলেন, দেখাই যাক না, কী হয়!

সকালে কফির সঙ্গে ডিম আর কত কী দেবে বলেছিল, সেসব আর এল না। দুপুরে খাবার দিল না কিছু। তবে একটা থালায় যে অনেকরকম ফল ছিল, কমলালেবু, কলা, আপেল, সেটা সরিয়ে নেয়নি। মাঝে মাঝেই একটা করে ফল খেতে লাগলেন। একটা দিন শুধু ফল খেয়ে দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায়।

দুপুরের দিকে তিনি খানিকটা ঘুমিয়েও নিলেন।

জেগে উঠে জানলা দিয়ে দেখলেন, বাইরের আকাশ আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে আসছে। সারা বাড়িতে কোনও সাড়াশব্দ নেই। বাইরেও আর কিছু দেখা যাচ্ছে না।

সন্ধের একটু পরে দরজা খুলে গেল।

সেই বন্ধুকধারী কাসেম এসে বলল, চলো!

কাকাবাবু বাইরে আসতেই কাসেম তার হাত ধরতে গেল।

তিনি বললেন, হাত ধরতে হবে না। আমি এমনিই যাচ্ছি।

লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে যেতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার এই রাইফেলটা কি অটোমেটিক নাকি?

কাসেম বলল, চুপ!

কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে এরা কত টাকা মাইনে দেয়?

সে আবার বলল, চুপ!

কাকাবাবু বললেন, ও, মাইনের কথা জিজ্ঞেস করতে নেই, তাই না? বাড়িতে তোমার বউ, ছেলেমেয়ে আছে?

সে বলল, আছে!

এবার সিঁড়ি দিয়ে নামতে হবে। কাকাবাবু আগেই দেখে নিলেন, পাশের ঘরটায় আমির আলি কিংবা কেউ নেই।

কাসেম রাইফেলটা কাকাবাবুর দিকে তাক করে বলল, আস্তে আস্তে নামো। এদিক-ওদিক যাওয়ার চেষ্টা করবে না।

কাকাবাবু বললেন, পাগল নাকি! আমি এই খোঁড়া পায়ে দৌড়ে পালাতে পারব? আমার কোনও ক্ষমতাই নেই। আমাকে কেন ধরে রেখেছে, তাও জানি না। তুমি কিছু জানো?

সে বলল, না।

কাকাবাবু বললেন, তুমি হুকুম তামিল করছ মাত্র। ওরা যদি তোমায় হুকুম করে আমায় গুলি করে মেরে ফেলতে, তাও করবে নিশ্চয়ই?

কাসেম এবার কাকাবাবুর মুখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে। বলল, ওসব বাজে কথা বন্ধ করো!

বাড়ির বাইরে এসে খানিকটা জংলা জায়গা পার হতেই দেখা গেল অনেকটা ফাঁকা মাঠ, পাশে একটা পুকুর।

সেখানে দুদিকের দুটো খুঁটিতে দাউদাউ করে মশাল জ্বলছে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে দশ-বারোজন লোক। তাদের পাশে হুইল চেয়ারে বসে আছেন আমির আলি।

ফুটবলের একটা গোলপোস্ট রয়েছে একধারে। তার মাঝখানে গোলকিপারের মতো একজন মানুষ, কিন্তু তার দুটো হাত দুদিকের খুঁটির সঙ্গে বাঁধা। তার সামনাসামনি খানিকটা দূরে নবাব সিরাজদ্দৌল্লার মতন সেজে দাঁড়িয়ে আছে সেলিম, তার হাতে এখন খোলা তলোয়ার।

দৃশ্যটা প্রায় একটা বধ্যভূমির মতো। একটা-দুটো ক্যামেরা থাকলেই মনে হতে পারত, এসব কিছুই সত্যি নয়। সিনেমা তোলার জন্য সাজানো হয়েছে।

আসলে তো সত্যিই। এখানে সবাইকে দেখিয়ে সেলিম ওই হাত-বাঁধা লোকটিকে খুন করবে।

কাকাবাবু আগে সবদিক ভাল করে দেখে নিলেন।

যে দশ-বারোজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মধ্যে কয়েকজনের চেনা মুখ। যে লোকটি হাজারদুয়ারির সিঁড়িতে সই চাইতে এসে ধাক্কা মেরেছিল। যে লোকটি গঙ্গার ধারে এসে দেশলাই চেয়েছিল। এবং হোটেলের মালিক কান্তবাবু। আর যাদের কাকাবাবু চেনেন না, তাদেরও মুখ দেখে মনে হয়, এখানকার বিশিষ্ট ব্যক্তি। আমির আলি এ শহরের অনেককেই নিজেদের দলে টেনেছেন।

বন্ধুকধারী কাসেম ছাড়াও রয়েছে আর তিনজন পাহারাদার। তাদের কোমরে ঝুলছে তলোয়ার। বন্দুক নেই।

হাত-পা বাঁধা লোকটাকে তিনি চেনেন না।

কাকাবাবু প্রথমটায় একটু দমে গেলেন। তার চোখের সামনে একজন মানুষকে খুন করা হবে। তিনি আটকাবেন কী করে? তার রিভলভারটাও অকেজো। এত মানুষের সঙ্গে তিনি একা তো লড়তে পারবেন না।

কাসেম তাকে একপাশে বসিয়ে দিল।

এবার সেলিম বক্তৃতার ভঙ্গিতে বলল, ফ্রেন্ডস অ্যান্ড কান্ট্রিমেন, এই যে লোকটাকে দেখছেন, এর পূর্বপুরুষের নাম মহম্মদি বেগ। আপনারা জানেন, সে কে?

হাত-পা বাঁধা লোকটি চেঁচিয়ে বলল, না, না, না!

সেলিম আবার বলল, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌল্লা আমার পূর্বপুরুষ। সেই মহান নবাবকে এই শয়তান মহম্মদি বেগ কী জঘন্যভাবে খুন করেছে তাও আপনারা জানেন। সেই বংশের সবাই শয়তান। এই শয়তানটাকে খুন করে আজ আমি আমাদের বংশের রক্তের ঋণ শোধ করব।

হাতবাঁধা লোকটি আবার চেঁচিয়ে বলল, আপনারা ভুল করছেন। ভুল করে আমাকে ধরে এনেছেন। মহম্মদি বেগ কে তা আমি চিনিইনা। কোনওদিন নাম শুনিনি। সে আমার পূর্বপুরুষ কী করে হবে? আমি মুসলমানও নই, আর্মেনিয়ান। আমার নাম ফিরোজ অ্যারাটুন শাহ?

সেলিম বলল, তোর মা মুসলমান ছিল। তোর সম্পর্কে সব খবর আমরা জানি। তুই হাজারদুয়ারি থেকে মহম্মদি বেগের ছুরিটা চুরি করেই আরও ফেঁসে গিয়েছিস।

ফিরোজ বলল, আমি তো ছুরি চুরি করিনি। আমি জীবনে কখনও চুরিজোচ্চুরি করিনি।

সেলিম বলল, আলবাত চুরি করেছিস! কেন চুরি করেছিস, তাও বলে দিচ্ছি! লোকে যখন মিউজিয়াম দেখতে যায়, কাচের বাক্সটার মধ্যে ওই ছুরিটার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। তখন কেউ না কেউ মহম্মদি বেগের কুকীর্তির কথা শুনিয়ে দেয়। তখন প্রত্যেকে ঘেন্নায় মুখ কুঁচকোয়। ছুরিটা না দেখলে লোকে ওই লোকটার নামটা ভুলেই যেত! তাই তুই ছুরিটা সরিয়েছিস!

ফিরোজ বলল, ভুল! সব ভুল! আমি ওসব কিছুই জানি না। ছুরিটা অন্যরা চুরি করে আমার কাছে বিক্রি করেছে। আমি নানা দেশের ছুরি সংগ্রহ করি। আমার কাছে অন্তত দুশো রকমের ছুরি আছে। সেগুলো আমি সাজিয়ে রাখি আমার লন্ডনের বাড়িতে।

সেলিম বলল, অনেক কথা হয়েছে। আমরা সব জানি। এ সবই তোর মিথ্যে কথা। তোকে আর সময় দেওয়া হবে না।

ফিরোজ কাঁদোকঁদো হয়ে বলল, আমায় মারবেন না। আমিনবাব সিরাজকে শ্রদ্ধা করি। বিশ্বাস করুন, আমি মহম্মদি বেগের বংশের কেউ নই!

সেলিম তবু সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, এখন দেখুন, এই শয়তানটার শাস্তি। ওকে আমি টুকরো টুকরো করে কাটব।

তলোয়ার তুলে সে এক পা এক পা করে এগোতেই কাকাবাবু চেঁচিয়ে বললেন, এ কী করছেন? এ লোকটির পরিচয় এখনও ঠিকমতো প্রমাণ হল না। যদি ও ওই বংশের কেউ না হয়!

সেলিম মুখ ফিরিয়ে ঘৃণার সঙ্গে বলল, ইউ শাট আপ!

কাকাবাবু তখন স্প্রিং-এর মতো লাফিয়ে গিয়ে একজন প্রহরীর কোমর থেকে তলোয়ারটা এক টানে খুলে নিলেন।

তাঁর মতো একজন খোঁড়া লোক যে এমনভাবে লাফাতে পারেন, তা প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়। প্রহরীটি বাধা দেওয়ারও সময় পেল না।

কাকাবাবু ফিরোজকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বললেন, একজন নিরস্ত্র লোককে হাত-পা বেঁধে এইভাবে খুন করা হবে, আর সকলে তাই দাঁড়িয়ে দেখবে? ছিঃ!

সেলিম বলল, সরে যাও, নইলে তুমি আগে মরবে!

কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে। লড়ে যান আমার সঙ্গে। তারপর ওকে মারবেন!

সেলিম নাক কুঁচকে বলল, আমি কোনও খোঁড়া লোকের সঙ্গে লড়ি না। হঠ যাও! যদি মরতে না চাও …

কাকাবাবু বললেন, আমাকে না মেরে ওকে মারতে পারবেন না! খোঁড়া হয়েছি বটে, কিন্তু এ লড়াইয়ের জন্য আমার দুটো হাত আর একটা পা-ই যথেষ্ট!

তিনি উলটো দিকে চট করে ঘুরে তলোয়ার চালিয়ে ফিরোজের দুহাতের দড়ি কেটে দিলেন।

আবার সামনে ফিরে বললেন, কই, আসুন!

সেলিম বলল, তোমাকে এখনই মেরে ফেলার ইচ্ছে আমার ছিল না। তুমি নিজেই যখন মরতে চাও … কাসেম, এ লোকটাকে গুলি করে শেষ করে দে!

কাসেম রাইফেলটা তুলে তাক করতে লাগল।

কাকাবাবু বললেন, ছিঃ! আমার সঙ্গে তলোয়ারের লড়াই করার সাহসও তোমার নেই! তুমি আবার নবাব সাজতে চাইছ?

সেলিম পাগলের মতন চিৎকার করে বলল, কাসেম, কাসেম, দেরি করছিস কেন?

আর তখনই একটা সিনেমার মতো কাণ্ড হল। হঠাৎ শোনা গেল কপাকপ কপাকপ করে ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ। ছুটে আসছে সেই সাদা ঘোড়া। সেটা খুব জোরে আসছে কাকাবাবু আর কাসেমের দিকে। ঘোড়াটার পিঠে সন্তু আর জোজো।

সেলিম অবাক হয়ে বলল, আমার দুলদুল, ও চুরি করেছে। ধর, ওকে

ধর!

কাসেম বন্দুকের নল ঘোরাল ঘোড়াটার দিকে।

সেলিম আবার আর্ত গলায় চেঁচিয়ে বলল, এই, এই, আমার দুলদুলের গায়ে যেন গুলি না লাগে!

কাসেম বুদ্ধি করে বন্দুকের নলটা উঁচু করে আকাশে গুলি ছুড়ল। সেই আওয়াজে ঘোড়াটা থমকে গেল, সামনের দুপা উঁচু করে ডেকে উঠল।

কিন্তু সন্তু আর জোজো পড়ে গেল না।

সন্তু বলল, শক্ত করে ধরে থাক।

ঘোড়াটা আবার সামনের পা মাটিতে নামাতেই সন্তু এবার আরও জোরে চার্জ করল। একটা খুঁটি থেকে তুলে নিল একটা মশাল। রে রে রে রে চিৎকার করে সে তেড়ে এল কাসেমের দিকে।

এবার কী করবে, তা কাসেমের বুদ্ধিতে কুলোল না, সে ভয় পেয়ে পালাতে গেল। ঘোড়াটা এসে পড়ল তার পিঠের উপর।

সে মাটিতে পড়ে যেতেই কাকাবাবু তার রাইফেলটা কেড়ে নিলেন।

সঙ্গে সঙ্গে সেটা সেলিমের বুকে ঠেকিয়ে বললেন, এবার তোমার পাগলামির শেষ! তলোয়ারটা ফেলে দাও!

সেলিম তবু তলোয়ারটা নিয়ে কটমট করে তাকিয়ে রইল।

কাকাবাবু বললেন, একটু আগে তুমি আমায় মারতে বলেছিলে। এখন আমি তোমাকে অনায়াসে মেরে ফেলতে পারি। যদি এখনও বাঁচতে চাও, হাতের অস্ত্র ফেলে দাও।

এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন আমির আলি। এবার ভাঙাভাঙা গলায় বললেন, ওরে সেলিম, তলোয়ারটা ফেলে দে! আর আশা নেই।

কাকাবাবু অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, যার কাছে যা অস্ত্র আছে, সব নামিয়ে রাখো পায়ের কাছে। কেউ এদিক-ওদিক করার চেষ্টা করলেই আগে এই সেলিম মরবে!

সন্তু আর জোজো ঘোড়া থেকে নেমে ছুটে এল কাকাবাবুর কাছে।

কাকাবাবু বললেন, শাবাস সন্তু আর জোজো। দ্যাখ, কার কাছে কী অস্ত্র আছে, সব এক জায়গায় জড়ো কর। কেউ যেন এখান থেকে না পালায়!

সন্তু আর জোজো প্রত্যেককে সার্চ করতে লাগল। দেখা গেল, যাদের মনে হয়েছিল বিশিষ্ট ভদ্রলোক, তাদেরও কারও কারও কাছে রয়েছে ছুরি। কান্তবাবুর কোমরে একটা ভোজালি।

সন্তু তাঁকে বলল, পুলিশ আপনাকে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিল?

জোজো বলল, এবার আর সহজে ছাড়বে না। আপনার হোটেল লাটে উঠে যাবে!

কাকাবাবু সেলিমকে বললেন, তুমি এবার হাঁটু গেড়ে বসো। তোমাকে চাবুক মারা হবে। তিন ঘা। তারপর তোমাকে পুলিশের হাতে তুলে দেব!

সেলিম এবার সত্যিকারের পাগলের মতো বিকট গলায় চিৎকার করে বলল, ওরে রায়চৌধুরী, তুই আমার কিছুই করতে পারবি না। পুলিশ আমায় ছুঁতে পারবে না। আমি আবার তোকে ধরব। আর ওই মহম্মদি বেগের আওলাদটাকে কুচিকুচি করে কাটব! আমি বাংলার নবাব!

ফিরোজ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। মনে হচ্ছিল যেন, সে ভয়ে চুপসে গেছে। এবার সে অন্য মূর্তি ধরল।

মাটি থেকে একটা তলোয়ার টপ করে তুলে নিয়ে সেও কর্কশ গলায় বলল, সে সুযোগ তোকে আর দেব না সেলিম! আমি সত্যিই মহম্মদি বেগের বংশধর। তিনি ছিলেন একজন বীরপুরুষ। অত্যাচারী সিরাজের গায়ে কেউ হাত তোলার সাহস করেনি, তিনিই শুধু ভয় পাননি। সিরাজ মহম্মদি বেগকে একদিন বলেছিল, রাস্তার কুকুর। তার শোধ তিনি নিয়েছেন। আজও সে অপমান আমরা ভুলিনি। আজ সিরাজের বংশধরকে আমি শেষ করে দেব?

তলোয়ারটা নিয়ে সে ছুটে এল সেলিমের দিকে। তার চোখ-মুখ সাংঘাতিক হিংস্র।

কাকাবাবু একটু পিছিয়ে গিয়ে গুলি চালালেন তার দিকে। সে সেলিমের খুব কাছে গিয়েও দড়াম করে পড়ে গেল মাটিতে। রক্তের ধারা গড়িয়ে এল।

এই ঘটনায় হঠাৎ আবার বদলে গেল সেলিম। একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেল মুখ। সে কাপাকাপা গলায় বলল, আব্বাজান, এই লোকটা আমাকে মারতে এসেছিল। সত্যি সত্যিই মেরে ফেলত? আর এই রায়চৌধুরীটা, ও আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দেবে?

এখন তার গলায় আর একটুও অহংকারের ভাব নেই।

আমির আলি কোনও কথা বললেন না।

জোজো শুকনো গলায় বলল, কাকাবাবু, শেষ পর্যন্ত আপনিই ও লোকটাকে মেরে ফেললেন?

কাকাবাবু দুদিকে মাথা নাড়লেন।

তারপর বললেন, আমার টিপ এখনও খারাপ হয়নি। আমার গুলি ওর হাতের চামড়া ঘেঁষে গিয়েছে, লাগেনি। ও ভয়ের চোটে ওরকমভাবে পড়ে আছে।

জোজো বলল, অনেক রক্ত গড়াচ্ছে যে!

কাকাবাবু বললেন, ওর হাতে তলোয়ার ছিল, তাতেই বোধহয় খোঁচাটোচা লেগেছে! ওকে উলটে দিয়ে দ্যাখ তো?

সন্তু আর জোজো গিয়ে ফিরোজকে উলটে দিতেই দেখা গেল, সে চোখ। পিটপিট করছে। তার থুতনিটা কেটে গিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে সেখান থেকে, গুলিটুলি সত্যিই লাগেনি।

কাকাবাবু বললেন, এ লোকটাও তো দেখছি খানিকটা পাগল। জানিস তো, যাদের মধ্যে পাগলামি থাকে, তারা আসলে ভিতু হয়। এমনিতে দাত কিড়মিড় করে সাহস দেখায়, কিন্তু একটা হঠাৎ ধাক্কা খেলে ভয়ে কাঁপে। সেলিমকে দ্যাখ না, অত চ্যাঁচামেচি করছিল, এখন মনে হচ্ছে, ওর মেরুদণ্ড বলে কিছু নেই!

রাইফেলটা তুলে সবাইকে তিনি বললেন, যে যেখানে আছ, সেখানেই থাকো। কেউ নড়বে না। সবাইকে থানায় যেতে হবে।

বলতে বলতেই তিনি দেখলেন, দেশলাই-চাওয়া লোকটি দৌড় মারবার চেষ্টা করছে।

কাকাবাবু গুলি চালালেন তার পা লক্ষ্য করে। একটা গুলি তার পায়ে লেগেছে। সে চিৎকার করে কেঁদে উঠল।

কাকাবাবু তার দিকে আর মনোযোগ না দিয়ে সন্তুকে বললেন, থানায় খবর দিতে হবে। এখানে কারও কাছে মোবাইল ফোন নেই?

জোজো বলল, হোটেলওয়ালা কান্তবাবুর কাছে একটা দেখেছি।

কাকাবাবু বললেন, সেটা নিয়ে এসো। নম্বরটাও জেনে নিয়ে ওর কাছে।

জোজো ছুটে গেল।

কাকাবাবু সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই একেবারে ঠিক সময় এসে হাজির হলি কী করে রে?

সন্তু বলল, সেটা বেশ মজার ব্যাপার। আমি বেশি কিছু না ভেবেই সেলিমসাহেবের ঘোড়াটা চুরি করেছিলাম। খানিকক্ষণ ঘোড়া ছোটালাম গঙ্গার ধারে। এক-একবার দেখি কী, ঘোড়াটার রাশ আলগা করলেই সেটা নিজে নিজে একদিকে যাচ্ছে। বাঁক নিচ্ছে। তখন আমার মনে পড়ল, কোথায় যেন পড়েছি, ঘোড়ার পিঠে যদি অন্য কেউ চাপে, আর সে যদি জোর না করে, তা হলে ঘোড়া তার মনিব যেখানে আছে, সেখানে চলে যায়। তাই আমি ভাবলাম, দেখা যাক তো, ওর মনিব কোথায় আছে। এখানে এসে পৌঁছোলাম খানিকটা আগে। গাছের আড়ালে অপেক্ষা করছিলাম। এখানকার কাণ্ডকারখানা দেখে বুঝতে পারছিলাম না, কী করা যায়। যখন দেখলাম, একটা লোক তোমাকে বন্দুক উঁচিয়ে গুলি করতে যাচ্ছে, তখন আর কোনও কিছু চিন্তা না করে এদিকে ছুটিয়ে দিলাম ঘোড়া।

কাকাবাবু বললেন, একেবারে ঠিক ঠিক সময়ে এসে গিয়েছিস। সত্যি কথা কী জানিস সন্তু, এবারে আমি একটুখানি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমি নিজেও বাঁচব না। ওই ফিরোজকেও বাঁচাতে পারব না। তরোয়াল দিয়ে কি রাইফেলের গুলি আটকানো যায়!

জোজো মোবাইল ফোনটা নিয়ে এসে বলল, কাকাবাবু, হোটেলওয়ালা একটা নম্বর বলেছে থানার। ঠিক কিনা কে জানে। চেষ্টা করে দেখব?

কাকাবাবু উত্তর দেওয়ার আগেই আমির আলি জিজ্ঞেস করলেন, রায়চৌধুরীবাবু, আমি একটা কথা বলতে পারি?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, বলুন!

আমির আলি বললেন, আপনি কি সত্যি সত্যি আমাদের থানায় নিয়ে যাবেন?

কাকাবাবু বললেন, এর মধ্যে মিথ্যেমিথ্যির কী আছে? মানুষকে খুন করা দারুণ অপরাধ। খুনের চেষ্টাও অপরাধ। আপনার ছেলে সেলিম আর ফিরোজ, ওরা দুজনেই খুন করতে গিয়েছিল। ওদের তো শাস্তি পেতেই হবে। আর আপনারা, খুনের ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যও অপরাধী, আইনের চোখে। এখন আইনই আপনাদের শাস্তি দেবে!

আমির আলির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এল।

ধরা গলায় তিনি বললেন, আমাদের বনেদি, খানদানি বংশ। সাধারণ অপরাধীদের মতো আমাদের থানায় আটকে রাখবে, এর চেয়ে আমার মরে যাওয়াও ভাল ছিল।

কাকাবাবু ধমকের সুরে বললেন, আমির আলি সাহেব, আপনাদের ভাল বংশ, অনেক টাকা, ব্যবহারও ভদ্র। তবু আপনি এরকম একটা খুনকে সমর্থন করেছিলেন? আপনার ছেলের পাগলামির রোগ, ওর চিকিৎসা করা উচিত ছিল। তার বদলে আপনি ওকে প্রশ্রয় দিয়ে ওরই ক্ষতি করেছেন। এ যুগে কেউ রাজা কিংবা নবাব হতে চায়, সেটা কি সম্ভব? আড়াইশো বছর আগের ঘটনা নিয়ে কেউ প্রতিশোধ নিতে চায়? এটা পাগলামি ছাড়া আর কী? ওর সঙ্গে সঙ্গে আপনিও পাগল হয়েছিলেন?

আমির আলি বললেন, হয়তো তাই। আমারও মাথার ঠিক ছিল না। এখানকার অনেক লোক একটা কথা বলেছিল, আপনি যেখানে থাকবেন, সেখানেই একটা কিছু গন্ডগোল হবে!

কাকাবাবু জোর দিয়ে বললেন, না, মোটেই তারা ঠিক কথা বলেনি। যদি অন্যায়, অপরাধ কিছু না ঘটে, সেখানে তো আমি গন্ডগোল করি না। চুপচাপ থাকি। কিন্তু চোখের সামনে যদি কিছু অন্যায় ঘটতে দেখতে পাই, তখন তো বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবই। আপনি তো রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন, এটা জানেন না, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, এরা দুজনেই সমান অপরাধী। আমি অন্যায় সহ্য করতে পারি না।

আমির আলি বললেন, তাও ঠিক। একটা অনুরোধ করব আপনাকে? আমাকে থানায় দেওয়ার বদলে আপনি এখানেই আমাকে একটু গুলি চালিয়ে মেরে ফেলুন। আমি হার্টের রুগি, আমি এখন মরে গেলেও ক্ষতি নেই। তার বদলে আপনি আমার ছেলে সেলিমকে ছেড়ে দিন।

কাকাবাবু বললেন, আপনি জানেন না। অনেকেই জানে না, আজ পর্যন্ত আমি একজন মানুষকেও মারিনি। চরম বিপদের মধ্যে পড়েও আমি কাউকে একেবারে মেরে ফেলার কথা ভাবতে পারি না। আপনার ছেলের প্রাপ্য আছে, তিন ঘা চাবুক। আর জেলখাটার শাস্তি। আপনি আমাকে এখনই কথা দিন যে, কোনও এক সময় আপনি নিজেই ওকে তিন ঘা চাবুক মারবেন, তা হলে আমি আর নিজের হাতে সেই শাস্তি দেব না। আর জেলখাটার ব্যাপারটা … কী করা যায় বল তো সন্তু?

সন্তু বলল, সেলিম আর ফিরোজ যদি দুজনে দুজনের কাছে ক্ষমা চায়, তা হলে ওদের ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। তাই না রে জোজো?

জোজো বলল, ওরা হাতে হাত মিলিয়ে ভেউভেউ করে কাঁদুক!

কাকাবাবু এবার হেসে বললেন, ভেউভেউ শব্দ করে সকলেই তো কঁদে না। তবে হাতে হাত মেলাবার ব্যাপারটা চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।

আমির আলি সাহেব, আপনিই দেখুন, যদি ব্যবস্থা করতে পারেন।

সেলিম আর ফিরোজ একটু দূরে দূরে মাটিতে এলিয়ে শুয়ে আছে।

আমির আলি সাহেব তাদের কাছে গিয়ে কী যেন বললেন। তারপর মুখ ফিরিয়ে জানালেন, না, ওরা রাজি নয়, আমার কথা শুনবে না।

কাকাবাবু, সন্তু আর জোজো ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।

কাকাবাবু কড়া গলায় বললেন, সেলিম, তুমি আমার প্রস্তাবে রাজি হলে। এবারে তোমাকে গুনে গুনে তিন ঘা চাবুক খেতে হবে। তারপর তোমাকে পুলিশের হাতে তুলে দেব। সেখানে তুমি ছিচকে চোর আর পকেটমারদের সঙ্গে জেলে থাকবে! পুলিশ যাতে তোমাকে কিছুতেই ছেড়ে না দেয়, তা আমি দেখব। সে ক্ষমতা আমার আছে।

সেলিম এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

কাকাবাবু বললেন, এখন কাঁদলেও ক্ষমা পাবে না।

অন্য লোকটার দিকে ফিরে তিনি বললেন, ফিরোজ, তোমাকে আমি নির্দোষ ভেবে প্রাণ বাঁচাতে চেয়েছিলাম। এখন দেখছি, তুমিও একজন খুনি! তা হলে জেলেই কাটাও বাকি জীবন।

ফিরোজ গড়িয়ে এসে কাকাবাবুর পা ধরে বলল, আমায় ক্ষমা করুন। আমি বাঁচতে চাই।

কাকাবাবু পা সরিয়ে নিয়ে বললেন, আমার কাছে ক্ষমা চাইবার দরকার নেই। দুজনে দুজনের নামে ক্ষমা চাও।

সেলিম আর ফিরোজ উঠে বসে প্রথমে পরস্পরের হাত ধরল, তারপর দুজনে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হল।

কাকাবাবু বললেন, ব্যস, ব্যস, মুখে আর কিছু বলবার দরকার নেই।

অন্য পাশে ফিরে তিনি বললেন, আমির আলি সাহেব, আপনারা এখানে একটা খুনের দৃশ্য দেখতে এসেছিলেন। তার বদলে, দুজন মানুষের ক্ষমা করার দৃশ্য অনেক সুন্দর নয়? আমি এমন চমৎকার দৃশ্য বহুদিন দেখিনি!

মেঘ সরে গিয়ে এখন জ্যোৎস্না ফুটেছে আকাশে। তার মধ্যে আস্তে আস্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে দুলদুল ঘোড়াটা।

কাকাবাবু বললেন, দ্যাখ, দ্যাখ সন্তু, কী সুন্দর দেখাচ্ছে ওই সাদা ঘোড়াটাকে। ও যেন পৃথিবীতে হিংসে, রাগ, খুনোখুনির ব্যাপার কিছুই জানে না!