০২. জোজোর কথা পুরোপুরি অবিশ্বাস করা যায় না

জোজোর কথা পুরোপুরি অবিশ্বাস করা যায় না কখনও। কতটুকু যে সত্যি আর কতটা গুল, সেটাই ধরা মুশকিল।

দুদিন বাদে কাগজে একটা খবর বেরোল। আফ্রিকার একটি রাজ্যের প্রেসিডেন্টের ভাই কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেল থেকে উধাও হয়ে গেছেন। তিনি দার্জিলিং যাওয়ার পথে কলকাতায় ছিলেন। হোটেলের ঘরে তাঁর সব জিনিসপত্র পড়ে আছে। কিন্তু গত চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তাঁর কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর সঙ্গে দুজন সেক্রেটারি এসেছে, তারা কিছুই বলতে পারছে না।

তা হলে আফ্রিকার কোনও রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট না থোক, প্রেসিডেন্টের ভাই একজন এসেছিলেন ঠিকই। জোজো কোনওক্রমে সেটা জানতে পেরেছিল। হয়তো সেই প্রেসিডেন্টের ভাই জোজোর বাবার সঙ্গে দেখা করতেও গিয়েছিলেন। কিন্তু জোজোদের বাড়িতে তো তিনি ছিলেন না, ছিলেন গ্র্যান্ড হোটেলে। কাগজে লিখেছে, প্রেসিডেন্টের ভাই সাইমন বুবুম্বা খুব পণ্ডিত লোক, অক্সফোর্ডে লেখাপড়া করেছেন, তিনি কি কাঁচা কাঁচা রজনীগন্ধা চিবিয়ে খান?

কলেজের গেটের কাছে জোজোর সঙ্গে দেখা হতেই সে ফিসফিস করে বলল, তোকে বলেছিলুম না, আমার পেছনে স্পাই ঘুরছে? দেখলি তো, প্রেসিডেন্টকে গুম করে দিল?

সন্তু বলল, উনি তো প্রেসিডেন্ট নন, প্রেসিডেন্টের ভাই!

জোজো বলল, পরের বছর উনিই প্রেসিডেন্ট হবেন। সব ঠিকঠাক হয়ে আছে।

সন্তু বলল, উনি কি তোদের বাড়িতে থাকতেন? কাগজে যে লিখেছে, গ্র্যান্ড হোটেলে উঠেছিলেন। হোটেলে থাকলে তো সবাই জানতে পারে।

জোজো গম্ভীরভাবে বলল, কাগজে অনেক ভুল লেখে। কাকাবাবুকে তুই একটু বল না। উনি চেষ্টা করলে হয়তো বুবুম্বাকে খুঁজে বার করতে পারবেন।

কাকাবাবু এখন খুব ব্যস্ত। কী নিয়ে যেন খুব পড়াশোনা করছেন সারাদিন। তোর বাবা তো জ্যোতিষী। তিনি গুনেটুনে বলে দিতে পারেন না, ওঁকে কোথায় ধরে রাখা হয়েছে?

বাবা তো এখানে নেই। কাল রাত্তিরের প্লেনেই চলে গেলেন আমেরিকা। প্রেসিডেন্ট বুশ ডেকে পাঠিয়েছেন। খুব আর্জেন্ট!

কেন, প্রেসিডেন্ট বুশ তোর বাবাকে ডেকে পাঠালেন কেন?

খুব গোপন ব্যাপার! আমেরিকায় এ বছর ইলেকশান হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট বুশ ভয় পেয়ে গেছেন, দ্বিতীয়বার জিততে পারবেন না। সেইজন্য বাবাকে দিয়ে একটা মাদুলি তৈরি করতে চান। অষ্টবর্জ মাদুলি! সেই মাদুলি ধারণ করলে যে-কোনও ইলেকশান একেবারে ফুঃ! তুড়ি মেরে বেরিয়ে যাবে!

আমাদের দেশের নেতারা ভোটের সময় তোর বাবার কাছ থেকে ওই মাদুলি ধারণ করতে যায় কেউ?

ওই মাদুলির কত খরচ জানিস? নিরানব্বই লাখ টাকা। দশ দিন যজ্ঞ করতে হবে, তিন কেজি প্ল্যাটিনাম লাগবে… অত টাকা দেওয়ার হিম্মত আর কার আছে?

আচ্ছা, জোজো, তুই তোর বাবার কাছ থেকে জ্যোতিষ বিদ্যেটা শিখে নিস কেন? তা হলে আর তোকে চাকরি করতে হবে না।

সব শেখা হয়ে গেছে। গুলে খেয়েছি। তুই কী জানতে চাস বল না! তোর পাস্ট, প্রেজেন্ট, ফিউচার সব বলে দিতে পারি।

মাফ করো ভাই, জোজো। আমি জ্যোতিষে—হাত দেখা-টেখায় বিশ্বাস করি না। আমাদের বাড়িতে কেউ ওসব নিয়ে মাথা ঘামায় না।

এই সময় ওদের ক্লাসের আরও তিন চারটি ছেলে এসে পড়ায় এ-কথা বন্ধ হয়ে গেল। ওরা ঢুকে গেল ক্লাসে।

কলেজে সন্তু চুপচাপ থাকে। তার বয়েসী ছাত্রদের তুলনায় সন্তু বেশ বিখ্যাত। সে কাকাবাবুর সঙ্গে অনেক দুর্দান্ত অ্যাডভেঞ্চারে গেছে, খবরের কাগজে সেসব বেরিয়েছে। কিন্তু সন্তু সেসব নিয়ে কলেজে কোনও আলোচনা করতে চায় না। অবশ্য তার ভালনাম সুনন্দ, সেই নামেই সমস্ত ছেলেরা তাকে চেনে, তার ডাকনামটা জানে না অনেকেই।

জোজো সব সময় জমিয়ে রাখে। তার গল্পের শেষ নেই। কামস্কাটকা, পাপুয়া নিউগিনি, আদ্দিস আবাবা এই সব কত জায়গা সে ঘুরে এসেছে বাবার সঙ্গে। একবার প্লেন ক্র্যাশ হয়ে পড়ে গিয়েছিল ভূমধ্যসাগরে, সেখান থেকে আশ্চর্যভাবে রক্ষা পেয়েছে। আর একবার উগান্ডার জঙ্গলে মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিল সিংহর কবলে, শুধু টর্চ জ্বেলে-জ্বেলে সিংহ দুটোর চোখ ধাঁধিয়ে কাবু করে দেয়।

ক্লাস চলছে। সবাই মন দিয়ে শুনছে সারের লেকচার। জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে ডেস্কের ওপর। জোজো খাতা খুলে হিজিবিজি ছবি আঁকছিল, হঠাৎ এক সময় এক টুকরো পাথর পকেট থেকে বার করে রাখল টেবিলের ওপর। দেখলে মনে হয় সাধারণ একটা কালচে রঙের পাথরের টুকরো।

জোজোর একপাশে বসেছে সন্তু, অন্যপাশে অভিজিৎ। সন্তু কোনও কৌতূহল দেখাল না, সে লেকচার শুনে শুনে নোট নিচ্ছে। অভিজিৎ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ওটা কী রে?

জোজো বলল, দেখতেই তো পাচ্ছিস, একটা পাথব।

অভিজিৎ জিজ্ঞেস করল, পাথর তো বুঝলাম, এটা তুই পকেটে রাখিস কেন?

জোজো বলল, এটা আমি সব সময় পকেটে রাখি। এর কত দাম, তা শুনলে তুই অজ্ঞান হয়ে যাবি। তবে, মাঝে মাঝে পকেট থেকে বার করে রোদ খাওয়াতে হয়।

পাথরকে রোদ খাওয়াতে হয়?

হ্যাঁ। নইলে এ পাথর নরম তুলতুলে হয়ে যাবে!

অভিজিৎ হি-হি করে জোরে হেসে উঠল।

প্রোফেসর পড়া থামিয়ে এদিকে তাকালেন। প্রোফেসর জি সি বি গম্ভীর ধরনের মানুষ, কখনও হাসেন না, সবাই তাঁকে সমীহ করে। জোজো আর অভিজিৎ মাথা নিচু করে লেখায় মন দিল।

একটু পরে জোজো আবার ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, এই অভিজিৎ, বোকার মতন হাসলি কেন রে?

অভিজিৎ বলল, পাথর নরম হয়ে যায়, তাই শুনে হাসি পেয়ে গেল!

জোজো অবজ্ঞার সুরে বলল, নরম পাথর বুঝি হয় না? জানিস না কিচ্ছু! এই পাথরটা…এই পাথরটা চাঁদ থেকে আনা হয়েছে। এটা একটা চাঁদের টুকরো। সারাদিন রোদুর খেলে রাত্তিরবেলা চকচক করে।

অভিজিৎ বলল, এটা চাঁদের পাথর?

জোজো বলল, না হলে কি এমনই পকেটে নিয়ে ঘুরছি?

অভিজিৎ সঙ্গে-সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সার, সার, রজত একটা চাঁদের পাথর নিয়ে এসেছে!

সারা ক্লাসে অমনই হইচই পড়ে গেল।

জি সি বি পড়া থামিয়ে অবাক হয়ে তাকালেন।

অভিজিৎ পাথরটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, দিস ইজ আ মুন স্টোন সার!

জোজো তার ইংরিজি শুদ্ধ করে দিয়ে বলল, মুন স্টোন নয়, সে তো অন্য জিনিস, লোকে আংটিতে পরে। দিস ইজ আ পিস অফ স্টোন ফ্রম দা মুন।

সন্তু আগাগোড়া চুপ করে আছে, একটাও কথা বলেনি। মিটিমিটি হাসছে। শুধু। জোজোর কাণ্ডকারখানা দেখে সে আর অবাক হয় না।

জি সি বি এগিয়ে এসে পাথরটা নিজের হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে বললেন, এটা সত্যিই চাঁদের টুকরো? তুমি এটা পেলে কী করে?

জোজো বলল, আমাকে নীল আর্মস্ট্রং দিয়েছেন। প্রথম মানুষ যিনি চাঁদে পা দিয়েছিলেন, সেই নীল আর্মস্ট্রং। উনি পকেটে ভরে অনেক টুকরো নিয়ে এসেছিলেন তো?

অধ্যাপক একেবারে অভিভূত হয়ে গিয়ে বললেন, নীল আর্মস্ট্রং! তিনি তোমাকে দিলেন, মানে, তোমার সঙ্গে তাঁর কোথায় দেখা হল?

জোজো বলল, কলকাতায়। উনি তো এখানে অনেকবার এসেছেন। আমায় খুব ভালবাসেন। নীল সাহেব আমার ছোট কাকার সঙ্গে হাভার্ডে পড়েছেন যে এক ক্লাসে। দুজনে পাশাপাশি বসতেন। আমাদের বাড়িতে এসে উনি ডাল-ভাত খান। ঝিঙে-পোস্ত ওঁর খুব পছন্দ!

ক্লাসের অনেক ছেলে হাসতে শুরু করেছে। কিন্তু জি সি বি মুখ্যভাবে পাথরটা দেখতে লাগলেন। আপন মনে বললেন, এ ঘটনা তো কাগজে বেরনো উচিত। চাঁদের পাথর, দারুণ দামি জিনিস। হাতে ধরাটাও একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। আচ্ছা রজত, নীল আর্মস্ট্রং তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করেননি তো? একটা যে-কোনও পাথর দিয়েই যদি বলা যায় চাঁদের পাথর..

জোজো বলল, সার, আমার ছোটকাকা একজন সায়েন্টিস্ট। মাইক্রো কারবন টেস্ট করে দেখে নিয়েছেন।

জি সি বি আর কোনও কথা খুঁজে না পেয়ে বললেন, ফ্যান্টাস্টিক!

এই সময় ঘন্টা পড়ে গেল। ক্লাস শেষ। জোজো সারের হাত থেকে পাথরটা নিয়ে অবহেলার সঙ্গে পকেটে ভরে ফেলল। তারপর বীরদর্পে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে-যেতে বলল, বাড়ি যাই। আজ বিকেলে আমাদের বাড়িতে অমিতাভ বচ্চন আসবে চা খেতে। বেচারিকে ছদ্মবেশে আসতে হয়, নইলে বাড়ির সামনে বড্ড ভিড় হয়ে যায়।

কলেজের বাইরে এসে সন্তু আর জোজোকে খুঁজে পেল না। সে আগেই কোনও বাসে উঠে পড়েছে।

জোজোর স্বভাব জানে সন্তু। কাল যদি জোজোকে ওই চাঁদের পাথরটার কথা জিজ্ঞেস করা হয়, ও হেসে উড়িয়ে দেবে। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলবে, সেটা রেখে দিয়েছি ছাদের এক কোনায়। আজ একটা অন্য জিনিস দেখবি?

তারপরই জোজো আর-একখানা চমক দেবে।

বাড়ি ফিরে সন্তু জলখাবার খেয়ে নিল। তারপর জামা-প্যান্ট বদলে গেল সাঁতারের ক্লাবে। গরমকালে প্রত্যেকদিন সন্তুর সাঁতার কাটা অভ্যেস। সকালবেলা সময় পায় না, তাই বিকেলের দিকে যায়।

সাঁতারের ক্লাব পর্যন্ত পৌঁছতে পারল না সন্তু। সামনের রাস্তায় দারুণ ভিড়। হাজার-হাজার ছেলেমেয়ে একখানা গাড়ি ঘিরে চ্যাঁচামেচি করছে। এক গাড়ি পুলিশও এসে গেল। কী ব্যাপার, অ্যাকসিডেন্ট নাকি?

অন্যদের কথাবার্তা শুমে সন্তু বুঝল, সেরকম, কিছু নয়। বিখ্যাত সিনেমাস্টার অমিতাভ বচ্চন এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি করে যাচ্ছিলেন, কিছু লোক তাঁকে চিনে ফেলেছে। সবাই চায় ওঁর অটোগ্রাফ নিতে, কেউ-কেউ ওঁর গলায় শোলে ফিল্মের দু চারটে ডায়ালগ শুনতে চায়।

সন্তু মনে-মনে হাসল।

জোজো অনেক রকম খবর রাখে। কোথা থেকে জেনেছে যে অমিতাভ বচ্চন এখন কলকাতায়। তা হলে জোজোদের বাড়িতে ওঁর চা খেতে যাওয়াটা পুরোপুরি অবিশ্বাস করা যায় না।

অমিতাভ বচ্চন ছদ্মবেশ ধরতে ভুলে গেলেন কেন?

এতসব ঝঞ্ঝাট দেখে সাঁতার না কেটেই ফিরে এল সন্তু।

পরদিন সকালে খবরের কাগজ পড়তে গিয়েই সন্তুর চক্ষু স্থির। প্রথম পাতাতেই বড় বক্স করে ছাপা হয়েছে, চাঁদের পাথর চুরি!

কলকাতার মিউজিয়ামে এক টুকরো চাঁদের পাথর রাখা ছিল, সেটা গতকাল চুরি হয়ে গেছে। এই পাথরটা মার্কিন সরকার দিয়েছিল। এ-পর্যন্ত আমেরিকানরাই শুধু চাঁদে নেমেছে। তারা যে পাথর কুড়িয়ে এনেছে, তার কিছু-কিছু দেওয়া হয়েছে অন্য কয়েকটা দেশকে। আমাদের দেশ পেয়েছে পাঁচটা টুকরো। সেগুলো দিল্লি, বোম্বে, মাদ্রাজ, ব্যাঙ্গালোর আর কলকাতার মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে। একমাস বাদে আবার পাথরগুলো আমেরিকায় ফেরত চলে যাবে। তার মধ্যে কলকাতারটা চুরি হয়ে গেছে খুবই রহস্যময়ভাবে। রাখা হয়েছিল খুবই সাবধানে। বুলেট প্রুফ কাচের বাক্স, সবাই দূর থেকে দেখবে। কেউ কাচের বাক্সটার গায়ে হাত দিলেই অ্যালার্ম বেজে উঠবে। রাত্তিরে মিউজিয়াম ভালভাবে পাহারা দেওয়া হয়। কেউ কিছু টের পায়নি, কিন্তু গতকাল সকালে দেখা গেছে সেই কাচের বাক্সটা খোলা। পাথরটা উধাও হয়ে গেছে!

সন্তুর বুকের ভেতরটা ধক ধক করতে লাগল। জোজোটা কোনও পাগলামি করেনি তো? এটা যদি জোজোর কীর্তি হয়, তা হলে ওকে খুব সহজেই পুলিশে ধরে ফেলবে। কাল কলেজে ক্লাসসুষ্টু ছেলেমেয়েরা জোজোর কাছে চাঁদের পাথর দেখেছে। অধ্যাপক জি সি বি দেখেছেন। কেউ না কেউ পুলিশকে বলে দেবেই।

চাঁদের পাথর অতি দুর্লভ জিনিস। নীল আর্মস্ট্রং পকেট থেকে লজেন্স বার করার মতন একটা ওই পাথর জোজোকে দিয়ে যাবেন, এ কি হতে পারে? সব কটা টুকরোই মার্কিন গভর্নমেন্টের সম্পত্তি!

চুরির কথা জানা গেছে কাল সকালে। আর দুপুরবেলাতেই জোজো একটা পাথর দেখিয়েছে। এটা কি কাকতালীয়? না কি, জোজো বারফট্টাই দেখাতে গিয়ে সত্যিই এরকম কাণ্ড করেছে!

ছি ছি, পুলিশ যদি এখন জোজোকে ধরে তা হলে কী হবে? জোজো কতটা সত্যি বলে আর কতটা বানায়, তা যে ধরাই যায় না। ওটা সত্যি যদি চাঁদের পাথর হয়, তা হলে জোজোর ওপর সন্দেহ তো পড়বেই!

খবরের কাগজখানা হাতে করে সন্তু কাকাবাবুর ঘরে চলে এল।

কাকাবাবু একটা পাতলা সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামা পরে ইজি চেয়ারে বসে একটা বই পড়ছেন। সামনে একটা ছোট্ট টুলের ওপর পা-দুখানা ভোলা।

সন্তু পাশে গিয়ে বলল, কাকাবাবু, এই খবরটা পড়েছ?

কাকাবাবু এক ঝলক চোখ বুলিয়ে বললেন, হ্যাঁ দেখেছি। কিন্তু তোর এব্যাপারে এত আগ্রহ হল কেন? তুই ডিটেকটিভ হতে চাস নাকি?

সন্তু বলল, না, তা নয়, তবে আমি ভাবছি, হঠাৎ কেউ এই পাথরটা চুরি করতে গেল কেন?

কাকাবাবু বললেন, যেসব জিনিস খুব সাবধানে, পাহারা দিয়ে রাখা হয়, সেসব জিনিসের ওপরেই চোরেদের লোভ বেশি হয়। কেউ-কেউ বেশি দুঃসাহস দেখাবার জন্য সেগুলো চুরি করতে যায়।

চাঁদের পাথরের দামও নিশ্চয়ই অনেক?

তা তো হবেই। যে-জিনিস কম পাওয়া যায়, তারই দাম বেশি হয়। ইস্পাত কিংবা লোহার তুলনায় সোনা অনেক কম আছে, সোনা সেইজন্য। দামি। পৃথিবীতে হিরে-চুনি-পান্নার মতন মূল্যবান পাথরের তুলনাতেও চাঁদের পাথর আর কতটা? চাঁদের ভারসাম্য যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য বেশি বড় বড় পাথর ভেঙে আনা হয়নি! কয়েকটা বড় বড় পাথর সরে গেলে চাঁদটা যদি আঁকাবাঁকা ভাবে ঘুরতে শুরু করে তা হলে কী হবে বল তো?

তা হলে পৃথিবীতে সমুদ্র, নদীগুলোতে জোয়ার-ভাটা সব উলটোপালটা হয়ে যাবে।

ঠিক বলেছিস। ভাব দেখি, চাঁদটা পৃথিবীর একটু কাছে চলে এল, অমনই সমুদ্রের জল লাফিয়ে উঠতে শুরু করল! জলস্তম্ভ হয়ে কত দেশ ভেসে যাবে। সেইজন্যই চাঁদের অভিযাত্রীরা খুব হিসেব করে ছোট-ছোট কিছু টুকরো নিয়ে এসেছে। এগুলো একেবারে অমূল্য। বৈজ্ঞানিকদের কাছে চাঁদকে ভাল করে জানার অনেক সুযোগ এনে দিয়েছে। আবার এক হিসেবে এই পাথরগুলোর কোনও দামই নেই।

কেন?

কেউ এই পাথর তো অন্য কাউকে বিক্রি করতে পারবে না! এ-পর্যন্ত চাঁদ থেকে যত পাথর আনা হয়েছে, সবই সরকারি সম্পত্তি। কেউ নিজের কাছে রাখতে পারবে না। বিক্রি করা না গেলে আর দাম কিসের?

সন্তু হঠাৎ চুপ করে গেল। তার মনের মধ্যে খুব অস্বস্তি হচ্ছে। জোজো মিথ্যে কথা বলেছে, না সত্যি কথা বলেছে? যদি পুরোটাই মিথ্যে কথা বলে থাকে, তা হলেও বোধ হয় পুলিশ ওকে ছাড়বে না!

আমতা-আমতা করে সন্তু বলল, কাকাবাবু, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

কাকাবাবু খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, কী রে, তোর কী হয়েছে? কী জিজ্ঞেস করবি? তার জন্য ঘাড় চুলকোচ্ছিস কেন?

সন্তু বলল, আমার বন্ধু জোজোকে তো তুমি চেনো?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, চিনব না কেন? সেই যে আমাদের সঙ্গে একবার মধ্যপ্রদেশে গেল, যেবারে আদিবাসীদের গ্রাম থেকে আমরা একটা অপূর্ব সুন্দর নীল মূর্তি উদ্ধার করলাম!

জোজো কাল আমাদের একটা চাঁদের পাথর দেখিয়েছে!

তাই নাকি? কী করে বুঝলি সেটা চাঁদের পাথর?

জোজো বলল, ওটা নীল আর্মস্ট্রং নিজে ওকে দিয়েছেন।

কাকাবাবু হা-হা করে খুব জোরে হেসে উঠলেন। দু-তিনবার নীল আর্মস্ট্রং-এর নাম উচ্চারণ করে বললেন, নীল আর্মস্ট্রং যাকে তাকে চাঁদের পাথর বিলি করে বেড়ায়, এমন তো শুনিনি! আমি সেবারেই লক্ষ করেছি, তোর ওই বন্ধুটির কল্পনাশক্তি খুব প্রবল!

জোজো তা হলে মিথ্যে কথা বলেছে?

উচ্চ কল্পনাশক্তি আর মিথ্যে কথা ঠিক এক নয়। মিথ্যে অনেক রকম। পয়লা এপ্রিল কেউ যদি এপ্রিল ফুল করার জন্য কিছু বলে, তাকে ঠিক মিথ্যে বলা যায় না। অনেকে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে। যাকে আমরা বলতুম গুল মারা। তোরাও কি তাই বলিস?

হ্যাঁ।

গুলবাজরা খুব মজার নোক হয়, সাধারণ মিথ্যুকদের সঙ্গে তাদের তফাত আছে।

মিউজিয়াম থেকে কাল সকালে চাঁদের পাথরটা চুরি গেছে। আর দুপুরবেলা জোজো আমাদের চাঁদের পাথর বলে একটা পাথর দেখাল। এটা জানতে পারলে পুলিশ ওকে সন্দেহ করবে না?

তা করতে পারে অবশ্য। পুলিশ তো আর আসল চোরকে সহজে ধরতে পারবে না, ওকে নিয়েই টানাটানি করবে।

জোজোর বাবা এখন ইণ্ডিয়াতে নেই। পুলিশ যদি জোজোকে জেলে ভরে দেয়—

তুই এক কাজ কর, সন্তু। জোজোকে গিয়ে বল, ওটা নিয়ে এক্ষুনি এখানে চলে আসতে। আমি পাথরটা একবার দেখতে চাই।

ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠে ক্রাচ দুটো বগলে নিয়ে কাকাবাবু বাথরুমে চলে গেলেন।

এই ঘরেই টেলিফোন। সন্তু চট করে জোজোদের বাড়ির নম্বর ঘোরাল। জোজোই ওদিক থেকে প্রথম হ্যালো বলল।

সন্তু উত্তেজিতভাবে জিজ্ঞেস করল, এই জোজো, আজকের খবরের কাগজ পড়েছিস?

জোজো বলল, না। কেন? সক্কালবেলাতেই ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ বাবাকে ফোন করেছিলেন একটা ব্যাপার জানতে। বাবা তো কলকাতায় নেই। কুইন তখন আমায় বললেন, মাস্টার জোজো, তুমি তো তোমার বাবার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছ। তুমি এটা বলতে পারবে না? আমি যত বলি, ইয়োর ম্যাজেস্টি, আমি অতটা শিখিনি, তবু তিনি বলতে লাগলেন, তুমি একবার পুজোয় বসে চেষ্টা করে দ্যাখো না!

ইংল্যান্ডের রানি তোর কাছে কী জানতে চাইলেন? সেটা টপ সিক্রেট। তোকে বলা যাবে না। এই সন্তু; টেলিফোনটা বেশিক্ষণ আটকে রাখিস না। একটু বাদেই নরওয়ের রাজার ফোন করার কথা আছে। ওঁর জিনিসটা অবশ্য আমি রেডি করে রেখেছি।

ওসব রাজারানির কথা ছাড় তো, জোজো। আজকের কাগজ পড়ে দ্যাখ। সব কাগজেই ফার্স্ট পেজে বেরিয়েছে।

কী বেরিয়েছে তাই বল না! এখানে কাগজ নেই হাতের কাছে।

কলকাতার মিউজিয়াম থেকে চাঁদের পাথর কাল সকালে চুরি গেছে।

জোজো একটুক্ষণ থমকে গেল যেন। তারপর নীরস গলায় বলল, ও, চুরি গেছে। সেই খবরের জন্য তুই এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? আমিই বা কী করব?

তুই কাল যেটা দেখালি, সেটা সত্যিই চাঁদের পাথর?

রজত ভট্টাচারিয়া কখনও এলেবেলে কথা বলে না।

যদি এলেবেলে কথা না হয়, তা হলে, তা হলে, ওই পাথর কলকাতা শহরে, শুধু কলকাতা কেন ইণ্ডিয়াতেই আর কারও কাছে নেই। এর মানে বুঝতে পারছিস না?

না। পারছি না।

পুলিশ তোকে সন্দেহ করবেই।

সন্দেহ করলেই হল? কোথাকার কী চুরি গেছে, তার জন্য আমি দায়ী হব কেন?

তোকে যে ওই পাথরটা নীল আর্মস্ট্রং দিয়েছেন তার কোনও প্রমাণ আছে?

প্রমাণ, মানে, প্রমাণ আবার কী? কেউ যদি কাউকে কোনও জিনিস দেয়, তার সঙ্গে কি কোনও প্রমাণের সার্টিফিকেট লিখে দেয়? তুই যে সেবারে ইজিপ্টে গেলি, সেখান থেকে আমাকে একটা পিরামিডের পাথরের মূর্তি এনে দিলি, সেটার কি কোনও প্রমাণ রাখতে হয়েছে?

সেটা তো একটা সাধারণ জিনিস। তার সঙ্গে কি এটার তুলনা হয়? তুই এক কাজ কর জোজো, পাথরটা নিয়ে চট করে আমাদের এখানে চলে আয়। কাকাবাবু পাথরটা দেখতে চেয়েছেন।

বিকেলের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করব। এখন তো পারব না। নরওয়ের রাজার জরুরি কাজ আছে।

দূর ছাই তোর নরওয়ে-ফরওয়ে! শোন জোজো, তোর কাছে যে-কোনও সময় পুলিশ যেতে পারে। কাকাবাবু তোকে সাহায্য করতে চেয়েছেন। কাকাবাবুর কাছে থাকলে তুই বেঁচে যাবি। এখন তোর যা ইচ্ছে কর!

রাগ করে সন্তু টেলিফোনটা রেখে দিল।

একতলা থেকে মা চা-জলখাবারের জন্য ডাকছেন, তাই নেমে যেতে হল একতলায়। মনে-মনে সে গুমরোচ্ছে। জোজোটা এক-এক সময় সীমা ছাড়িয়ে যায়! সন্তু যেন কল্পনায় দেখতে পেল পুলিশ জোজোদের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। তারপর হাতে হাতকড়া দিয়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে জোজোকে। তারপর থানায় নিয়ে গিয়ে ওর আঙুলের ডগায় আলপিন ফুটিয়ে-ফুটিয়ে তিন-চারজন পুলিশ অফিসার জেরা করছে, বল, ছোকরা, তুই এই চাঁদের পাথর কোথায় পেয়েছিস? পরশু রাতে মিউজিয়ামের কাছে কেন গিয়েছিলি?

ঠিক সতেরো মিনিটের মধ্যে সাঁ সাঁ করে সাইকেল চালিয়ে জোজো এসে উপস্থিত হল। সাদা প্যান্ট আর নীল রঙের একটা গেঞ্জি পরা। চেহারা দেখলে মনে হয়, কী সরল, যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না!

ভেতরে ঢুকেই সন্তুর মাকে দেখেই একগাল হেসে বলল, মাসিমা, এই সাতসকালে কেন ছুটে এলুম জানেন? অন্য একটা কাজে সন্তু টেলিফোন করেছিল, সেই টেলিফোনেই গন্ধ পেলুম এখানে আজ লুচি ভাজা হচ্ছে। সেইসঙ্গে আলুর দম! আমি লুচি-আলুর দম যা ভালবাসি!

মা অবাক হয়ে বললেন, শোনো কথা! টেলিফোনে বুঝি গন্ধ পাওয়া যায়? তাও টেলিফোনটা দোতলায় আর রান্নাঘর একতলায়।

সন্তু অস্থিরভাবে বলল, ওঃ, মা! একতলা-দোতলায় কিছু আসে-যায় না। টেলিফোনে গন্ধ পাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। জোজোটা আন্দাজে ঢিল মেরেছে।

জোজো বলল, অন্য কেউ না পেলেও রজত ভট্টাচারিয়া টেলিফোনেও গন্ধ পায়। একবার আফ্রিকা থেকে একজন ফোন করেছিল।

সন্তু বাধা দিয়ে বলল, তুই সেই ফোনেই সিংহের গন্ধ পেয়েছিলি? আমাদের বাড়িতে সব ছুটির দিনই লুচি হয়। একদম বাঁধা। একঘেয়ে। তুই আগেও এসে খেয়েছিস!

জোজো অবজ্ঞার ভঙ্গিতে বলল, প্রত্যেক ছুটির দিন আলুর দম হয়?

মা বললেন, এটা ও বলল কী করে?

এইটাই জোজোর জয়। ও আন্দাজে ঢিল মারলেও খানিকটা মিলিয়ে দেয়। সন্তুদের বাড়িতে লুচির সঙ্গে থাকে সাধারণত বেগুন ভাজা কিংবা ডিমের তরকারি। আজই স্পেশাল আলুর দম হয়েছে। জোজো বোধ হয় ভেতরে এসেই গন্ধ পেয়েছে।