পাগল সংঘ

ভলিউম ১১ – পাগল সংঘ – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

আহ, বন্ধ করো, অনুনয় করলো কিশোর, বন্ধ করো ওটা।

সুইভেল চেয়ারে এলিয়ে পড়েছে সে। খসখসে হয়ে উঠেছে কণ্ঠস্বর। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেছে মুখ। তার সব চেয়ে ঘনিষ্ঠ দুজন বন্ধুর সামনে অত্যাচার করা হচ্ছে তাকে, অথচ সেটা থামানোর কোনো চেষ্টা করছে না ওরা। বরং তার কষ্ট দেখে হাসছে মুসা আমান আর রবিন মিলফোর্ড।

ওদের গোপন হেডকোয়ার্টারে বসে আছে তিনজনেই। তাকিয়ে রয়েছে একটা টেলিভিশন সেটের দিকে। পর্দায়, রান্নাঘরের একটা বড় টেবিলের ওপর আসন মুড়ে বসে রয়েছে গোলগাল খুব মোটা একটা বাচ্চা। তার হাত মুচড়ে পেছন দিকে নিয়ে গেছে আট-নয় বছরের একটা ছেলে। এগারো বছরের আরেকটা ছেলে চিনামাটির বাটিতে কি যেন গুলছে। এই ছেলেটা লম্বা, পাতলা, মাথার চুল কামানো, ডিমের মতো চকচক করছে সাদা মাথার চামড়া, স্পষ্ট দেখা যায়। ওর হাবভাব দেখে ওই ডিমের মতো খুলির ভেতরে ডিমের কুসুম ছাড়া মগজ বলে আর কোনো পদার্থ আছে বলে মনে হয় না।

না না, প্লীত (প্লীজ), অস্বাভাবিক ভারি গলায় অনুনয় করলো বাচ্চা ছেলেটা, প্লীত, আমার বতন্ত (বসন্ত) দরকার নাই।

বন্ধ করো! আবার অনুরোধ করলো কিশোর। দোহাই তোমাদের, বন্ধ করো ওটা!

কিন্তু আমি তো দেখতে তাই (চাই), বাচ্চাটার অনুকরণে বললো মুসা হেসে, দেখতে তাই পেত পর্দন্ত কি কলে।

এসো মোটুরাম, জলহস্তীর বাচ্চা, হেসে বললো পর্দার একটা ছেলে, কাছে এসো। এই ছেলেটা নিগ্রো, গাট্টাগোট্টা শরীর, শজারুর কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে শক্ত চুল। বয়েস বারো। হাসিটা এতোই নিস্পাপ, দুনিয়ার কোনো খারাপ কাজ সে করতে পারে বলে মনে হয় না। তোমার আম্মু আর আবু যখন দেখবে তোমার শুটিবসন্ত হয়েছে, ভয়ে চোখ উল্টে দেবে। তোমার সাথে ছিলাম বলে সবাই ভাববে ছোঁয়াছে রোগটা আমাদের রক্তেও ঢুকেছে। তখন আর আমাদের ইস্কুলে যেতে হবে না।

হ্যাঁ, তার সুরে সুর মেলালো যেন বিশাল পা-ওয়ালা আরেকটা হেলে, সবাই তাই ভাববে।

পর্দায় মাথাকামানো ছেলেটার নাম মড়ার খুলি, তরল জিনিসটা গোলা শেষ করেছে সে। এগিয়ে গেল বাচ্চাটার দিকে।

দুহাতে চোখ ঢাকলো কিশোর পাশা। এরপর কি ঘটবে জানা আছে। পরিষ্কার মনে আছে তার, কান নাচাতে পারে ডিমের মতো মাথাওয়ালা ছেলেটা। এতো ঘন ঘন নাচায়, বড় বড় লতিদুটোকে তখন মনে হয় জেলি, কানের নিচে লেগে থেকে ঝুলছে।

অভিনেতা হিসে, এটা তার একমাত্র গুণ।

মুসা আর রবিনের হাসি কিশোরের গায়ে জ্বালা ধরালো।

কান নাচাতে নাচাতে গিয়ে একটা রঙ লাগানোর তুলি তুলে আনলো মড়ার খুলি। তারপর বাটি থেকে লাল রঙ তুলে তুলে লাগিয়ে দিতে লাগলো বাচ্চাটার গোলগাল মুখে। শরীর মুচড়ে সরে যাবার চেষ্টা করলো মোটুরাম, কিন্তু কাদলো না। আগের মতোই হাসি হাসি চেহারা।

কিন্তু কিশোরের মুখে হাসির চিহ্নই নেই। আঙুল ফাঁক করে তার ভেতর দিয়ে আবার তাকিয়েছে টিভির দিকে। বিশ্বাসই করতে পারছে না ওই বাচ্চাটাই ছিলো সে নিজে। বাদামী রঙের ফারমার ওভারঅল পরা গোলআলুর মতো মুখওয়ালা ওই বাচ্চাটা সে ছিলো একথা ভাবতেই ইচ্ছে করছে না। নাকে, গালে, সমানে রঙের ফোঁটা দিয়ে চলেছে মড়ার খুলি যে বাচ্চাটার, সে-ই কি আজকের তুখোড় গোয়েন্দা কিশোর পাশা, যার বুদ্ধি দেখে মাঝে মাঝে দুর্ধর্ষ পুলিশবাহিনীরও তাক লেগে যায়?

বিশ্বাস করতে না চাইলেও উপায় নেই, জানে কিশোর। একসময় মোটুরাম ছিলো তার উপাধি, ইংরেজি শব্দটার বাংলা করলে অবশ্য এই নামই দাঁড়ায়। আধ ঘন্টার একটা টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করতো সে। হবিটার বাংলা নাম করলে দাঁড়ায় পাগল সংঘ।

জীবনের ওই সময়টাকে ভুলে থাকার যথাসাধ্য চেষ্টা করে কিশোর। তিন বছর বয়েসে নিজের ইচ্ছেয় সে ওই ছবিতে অভিনয় করতে যায়নি। তবে বাবা-মাকেও দোষ দেয় না সে। তারা চেয়েছিলেন একদিন বড় অভিনেতা হবে তাঁদের ছেলে।

একজন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ছিলেন কিশোরের বাবার বন্ধু। প্রায়ই আসতেন তাদের বাড়িতে। এক রোববার বিকেলে খেলতে খেলতে বাচ্চা কিশোর এসে হাজির হলো তার সামনে।

বড় হয়ে খুব ভালো নাচতে পারবে তুমি, খোকা, হেসে বললেন পরিচালক।

না, ওই বয়েসেই অবিশ্বাস্য রকম ভারি গলায় দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলো কিশোর, আমি নাচবো না। আমি পুলিশ হবে। চোর-ডাকাত ধরবো। চোরেরা আমার ভয়ে কাঁপবে।

কিশোরের কথা শুনে দীর্ঘ এক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে রইলেন পরিচালক। তারপর তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, বয়েস কতো? ছেলেটার পাকা পাকা কথা গুনে তাজ্জব হয়ে গেছেন।

দুই বছর এগারো মাস, জবাব দিয়েছেন বাবা।

এরপর যাওয়ার আগে আর কিশোরের সম্পর্কে একটি কথাও বললেন না পরিচালক। তবে গাড়িতে ওঠার পর আরেকবার বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আপনমনেই বিড়বিড় করলেন, অসাধারণ প্রতিভা! কাজে লাগাতে পারলে…

কয়েকদিন পরেই এক আজব জায়গায় কিশোরকে নিয়ে গেলেন তার বাবা। স্ক্রীন টেস্ট নেয়া হলো তার। কয়েক মাসের মধ্যেই পাগল সংঘ-এর মোটুরাম হয়ে গেল কিশোর।

ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন পরিচালক। ছেলেটা সত্যিই অসাধারণ বুদ্ধিমান। আর অভিনয় যেন সে মায়ের পেট থেকেই শিখে এসেছে, একেবারে স্বাভাবিক, বাস্তব হাসি, কথাবার্তা। পরিচালক যা যা করতে বলেন, ঠিক তা-ই করে। সংলাপ মুখস্থ করায়ও জুড়ি নেই মোটুরামের। একবার বলে দিলেই যেন মগজে গেঁথে যায়, একটি শব্দও ভুল করে না।

শুধু কিশোরের জন্যেই সাংঘাতিক নাম করেছিলো পাগলসংঘ।

টিভিতে অনেক অভিনয় করেছে কিশোর। সিনেমাতেও করতো, যদি না তার বাবা-মা হঠাৎ মোটর দুর্ঘটনায় মারা যেতেন। হয়তো অভিনেতাই হতে হতো তাকে জীবনে।

বাবা-মা মারা যাওয়ার পর তাকে বাঁচালেন যেন নিঃসন্তান মেরিচাচী। নিজের কাছে নিয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আর ছবিতে অভিনয় করবি, কিশোর?

না, সরাসরি জবাব দিলো কিশোর।

ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠে, স্টুডিওতে গিয়ে ঘাড়ে, মুখে, গলায়, রঙ মাখতে তার আপত্তি নেই। ক্যামেরা আর উজ্জ্বল চোখ ধাধানো আলোর সামনে দাঁড়িয়ে ঘামতেও রাজি আছে সে। ক্যামেরার সামনে বসে জটিল ধাধা মেলাতে আর অ্যাডভেঞ্চারের বই পড়ার অভিনয় করতে খুব আগ্রহ তার। তোতলাতে পারে, জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলতে পারে, পরিচালক যা করতে বলেন সব পারে, পারে না শুধু তার সহ-অভিনেতাদের সহ্য করতে।

কিশোর বোঝে কোনটা অভিনয়, আর কোনটা নয়। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বড় হয়েও মাথামোটা হবার দলের যেন সেটুকু বোঝার বুদ্ধি নেই। ছবিতে যেমন তাকে খেপায়, হবির বাইরেও খেপায়। অভিনয় করতে করতে যেন ওদের ধারণা হয়ে গেছে এটাই স্বাভাবিক। তাই টিফিনের সময় স্টুডিওর ক্যাফেটেরিয়ায় বসেও তার আইসক্রীমে মরিচের গুঁড়ো ঢেলে দেয়। মেকাপ রুমে তার চেয়ারে আঠা মাখিয়ে রাখে। তার ফারমার ওভারঅলের বোতামগুলো কেটে রাখে। আর সব চেয়ে বেশিদুঃখ লাগে, যখন তাকে ওরা মোটুরাম বলে ডাকে। সব সময় ডাকে। ওদের গোবর পোরা। মাথাগুলোয় যেন কিছুতেই ঢুকতে চায় না বাস্তব জীবনে সে মোটেই মোটুরাম নয়কিশোর পাশা।

কাজেই মেরিচাচী যখন তাকে জিজ্ঞেস করলেন পাগল সংঘ ছবিতে আর অভিনয় করবে কিনা, একটা মুহূর্ত দেরি না করে জবাব দিয়ে দিয়েছে সে, না। তার মনে হলো যেন খাঁচায় বদ্ধ একগাদা খেপা বানরের মাঝখান থেকে তাকে মুক্তি দিতে এসেছেন চাচী। ওই মহিলাকে যে সে এতো ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, যা বলেন মুখ বুজে শোনে, এটা তার একটা বড় কারণ। তার মা-ও যেটা করেননি। তাই করেছেন ওই মহিলা, তাকে ওই বয়েসেই মতামতের স্বাধীনতা দিয়েছেন, যা পাওয়ার জন্যে সে আকুল হয়ে ছিলো।

কাজেই যেদিন তার কন্ট্রাক্টের সময়সীমা শেষ হলো, সেদিনই পাগল সংঘকে অকূল সাগরে ভাসিয়ে চলে এলো কিশোর। আর কোনোদিন যায়নি ওই ছবিতে অভিনয় করার জন্যে। তার বদলে মন দিলো পড়ালেখায়।

ভালোই কাটছিলো দিন। তারপর বহু বছর পরে হঠাৎ এলো একটা প্রচণ্ড আঘাত। ঝড়ের কবলে-পড়া গাছের মতো নাড়িয়ে দিলো যেন কিশোরকে। টিভির পুরনো অনুষ্ঠান দেখানোর তালিকায় নাম উঠলো পাগল সংঘের।

কিশোর জানতো না যে দেখানো হচ্ছে। জানলো প্রথম, যেদিন তার এক সহপাঠি তার অটোগ্রাফ চেয়ে বসলো। হাসিমুখে দিয়ে দিলো কিশোর, ভাবলো, সে গোয়েন্দা হিসেবে ভালো নাম কামিয়েছে বলেই বুঝি অটোগ্রাফ চেয়েছে ছেলেটা। কিন্তু নাম সই করার পর যখন নিচে লিখলো গোয়েন্দাপ্রধান তখন আপত্তি জানালো ছেলেটা। মাথা নেড়ে বললো, না না, ওটা নয়, মোটুাম সেখো।

চমকে গেল কিশোর।

তারপর গত তিনটে হপ্তা ধরে এই এক জ্বালাতন। ইস্কুলের এমন কোনো ছেলেমেয়ে নেই যারা পাগল সংঘ না দেখেছে। সবাই এখন তাকে মোটুরাম বলে খেপায়। যে মেয়েগুলোকে দেখতে পারে না সে, পাত্তা দেয় না, ওরা পেয়েছে ভারি মজা। কিশোরকে দেখলেই মুচকি হেসে বলে, না না, পীত, আমাকে ধেরে দাও, কাতুকুতু দিও না, প্রীত!

ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে কিশোরের দিবারাত্রি। তা-ও গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হওয়ায় কিছুটা রক্ষে। ইস্কুলে যেতে হয় না, সবার খেপানোও শুনতে হয় না। কিন্তু আজ কোনো কুক্ষণে যে হেডকোয়ার্টারে ঢুকে টেলিভিশন অন করেছিলো। আর করামাত্রই দেখলো পাগল সংঘ চলছে। বন্ধ করে দিয়েছিলো সে সঙ্গে সঙ্গে, জোর করে মুসা গিয়ে আবার খুলেছে।

পর্দার দিকে তাকিয়ে হাসে মুসা আর রনি। মুখ আর গলায় বসন্ত আঁকা শেষ করে এখন শরীরে আঁকার জন্যে মোটুরামের ওভারঅল খোলার চেষ্টা করছে মড়ার খুলি। এই সময় ঝটকা দিয়ে খুলে গেল রান্নাঘরের দরজা। ঘরে ঢুকলো নয় বছরের সুন্দরী একটা মেয়ে, পাগল সংঘে কিশোরের উদ্ধারকারিণী। ছবিতে ওর নাম বটি সুন্দরী।

ছেড়ে দাও ওকে, মড়ার খুলিকে ধমক দিয়ে বললো নেলি।

হা হা, থেরে দাও, হাসিমুখে বললো মোটুরাম। কিন্তু হাড়ার কোনো লক্ষণই নেই মড়ার খুলির। জোর করে নেলিকে নিয়ে গিয়ে আলমারিতে ভরে রাখতে চাইলো। নেলির পক্ষ নিলে নিগ্রো হেলেটা, ওর নাম জিকো, ছবির উপাধি শজারুকাঁটা। চুলের জন্যেই ওরকম নামকরণ। আরও ছেলে আছে। ওরা সবাই গেল মড়ার খুলির পক্ষে। নিমিষে মারপিট আর হৈ-চৈ করে এক এলাহি কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেললো। একজন তাক থেকে একটা কেক তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো নেলিকে সই করে। সে মাথা সরিয়ে নিতে সেটা এসে পড়লো মোটুরামের মুখে। দুঃখ পাওয়ার চেয়ে বরং খুশি হলো সে। বললো, হ্যাঁ, হুঁ এতা ভালো! বতন্তের তেয়ে অনেক ভালো। বলে নাকেমুখে লেগে থাকা মাখন মুছে নিয়ে খেতে শুরু করলো।

কিশোওর। এই কিশোর, কোথায় তুই?

মেরিচাচীর ডাক শোনা গেল বাইরে থেকে।

জলদি বেরিয়ে আয়, আবার বললেন তিনি।

এইই সুযোগ। আর দেরি করলো না কিশোর। লাফিয়ে উঠে গিয়ে বন্ধ করে দিলে টেলিভিশন। মোটামের হাসিখুসি আলুর মতো মুখ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় হাঁপ ছেড়ে বাচলো সে, অন্যদিকে মন খারাপ হয়ে গেল রবিন আর মুসার। ওদের দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু মেরিচাচীর নির্দেশ অমান্য করে এখানে বসে থাকার সাহস ওদের নেই।

জঞ্জালের ভেতর থেকে গোপন পথ দিয়ে বেরিয়ে এলো ওরা।

এই যে, এসেছিস, মেরিচাচী বললেন।

জ্যাকেট খুলতে খুলতে কিশোর জিজ্ঞেস করলো, কি কাজ করতে হবে, বলো?

কিন্তু কাজ করার জন্যে ডাকেননি মেরিচাচী। গেটের দিকে দেখালেন।

গুঙিয়ে উঠলো কিশোর। আবার! পাগল সংঘ টিভিতে দেখানোর পর থেকেই অনেক লোক আসে তার সঙ্গে দেখা করতে। খবরের কাগজের রিপোর্টারও থাকে তাদের মধ্যে। মোটুরামকে নিয়ে ফীচার স্টোরি করতে। হেডিং লেখেঃ মোটুম এখন কোথায়? কিংবা মোটুরামের কি হয়েছে?

ওকে যেতে বলল, লোকটাকে দেখিয়ে চাচীকে অনুরোধ করলো কিশোর। বলে দাও, আমি কথা বলতে চাই না।

অনেক বার বলেছি, যায় না। ও বলছে, কথাটা নাকি জরুরী। সহানুভূতির হাসি হাসলেন চাচী। কিশোরের কেমন লাগছে বুঝতে পারছেন। টেলিভিশনে সিরিয়ালটা দেখানোর পর থেকে যে লোকে তাকে বিরক্ত করছে, জানেন একথা। দেখছিস না, কি রকম বড় গাড়িতে চড়ে এসেছে। আমি বলায় বললো, যতোক্ষণ লাগে বসে থাকবে। তুই খেয়েদেয়ে জিরিয়ে নিয়ে যখন খুশি দেখা কর, ও বসে থাকবে। এরপর আর কি কলবো?

ঠিক আছে, কি আর করা! কপাল চাপড়ালো কিশোর। দেখি, খেদানো যায় কিনা।

বিরাট গাড়ি। ফরাসী সিত্রো। সামনের অংশটা দেখতে অনেকটা তিমির মাথার মতো। গাড়ি থেকে নেমে তিন গোয়েন্দার দিকে এগিয়ে আসা লোকটাও তার গাড়ির মতোই বড়, বিলাসী। প্রথমেই লোকটার দাঁত দৃষ্টি আকর্ষণ করলো কিশোরের। বড় বড় সাদা দাঁতগুলো লোকটার রোদে পোড়া চামড়ার পটভূমিতে যেন চাঁদের মতো ঝলমল করছে। যখনই হাসে তখনই চমকায়।

কিশোর পাশা, আরও চওড়া হাসি উপহার দিয়ে বললো লোকটা, আমার নাম হ্যারিস বেকার। মুভি স্টুডিওর বিজ্ঞাপন ম্যানেজার।

মুসা আর রবিনের মাঝখানে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিশোর। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে বেকারের দিকে।

তোমাকে একটা প্রস্তাব দিতে এসেছি, আশা করি পছন্দ হবে তোমার, এমনভাবে কথা বলে লোকটা মনে হয় তার কণ্ঠস্বরও হাসে। পাগল সংঘের সমস্ত অভিনেতাকে স্টুডিওতে আসার দাওয়াত করেছি। ওখানেই লাঞ্চ খাবে। লাঞ্চের পর…

থ্যাংক ইউ, আমার কোনো আগ্রহ নেই, বলে যাবার জন্যে ঘুরলো কিশোর।

পুরনো বন্ধুদের সাথে আবার দেখা হোক, এটা চাও না? বিশাল একটা থাবা কিশোরের কাঁধে ফেলে তাকে আটকালো বেকার। মড়ার খুলি, শিকারী কুকুর,

ভারিপদ, আর…।

না, থ্যাংক ইউ, বলে কাঁধ থেকে লোকটার হাত সরানোর চেষ্টা করলো কিশোর। কিন্তু লোকটার ভালুক-থাবা শক্ত হলো আরও। ওই বোকাগুলোর সঙ্গে জীবনে আর কোনোদিন দেখা করতে চাই না আমি…

আরও চওড়া হলো বেকারের হাসি। আমিও এটাই আশা করেছিলাম।

কি বললেন? কিশোর আশা করেনি লোকটা এরকম কথা কলবে।

তোমাকে অনেক বিরক্ত করেছে ওরা, তাই না? জ্বালাতন করেছে। মোটুরাম বলে খেপিয়েছে। ওদেরকে ঘৃণা তো করবেই।

মানুষকে ঘৃণা করি না আমি, শীতল গলায় বললো কিশোর। তবে ওদের পছন্দ করি না, এটা ঠিক। অপছন্দ আর ঘৃণাকে নিশ্চয় এক বলবেন না আপনি?

ওয়ান্ডারফুল! বেকারের রোদেপোড়া মুখে চাঁদের হাসি উজ্জল হলো আরও। চমৎকার গুছিয়ে কথা বলো তুমি। ওদের কাছে যাওয়ার একটা সুযোগ করে দিচ্ছি আমি তোমাকে। যাতে ওদের বুঝিয়ে দিতে পারো, সেই ছোটবেলা থেকেই ওদেরকে গাধা মনে করে এসেছো তুমি, এবং আসলেই ওরা গাধা। কি, সেটা প্রমাণ করতে চাও না?

কিভাবে? এই প্রথম আগ্রহ ঝিলিক দিলো কিশোরের চোখে।

কিশোরের কথার সরাসরি জবাব দিলো না বেকার। ঘুরিয়ে বললো, সারা দেশের লোকের সামনে প্রমাণ করবে ওরা বোকা। টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে সেকথা। দুটো কুইজ শো-এর বন্দোবস্ত করেছে টিভি। পাগল সংঘের সবাই একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা করবে। আমার বিশ্বাস, কিশোর, তুমিই জিতবে। তোমার ব্যাপারে শুনেছি আমি। ওগুলোর সবকটার মাথায় ঘোল ঢেলে দিতে পারবে।

কিশোরে মনের পর্দায় মড়ার খুলির ডিমের মতো মাথাটা ঝিলিক দিয়ে উঠলো। গাধাটার বোকার মতো হাসি যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে অযথাই হাত মুচড়ে দিচ্ছে মোটুরামের। তার টিফিন সঁটিয়ে, বাক্সে মরা ইঁদুর রেখে দিয়ে ফ্যাকফ্যাক করে হাসছে।

হারিস বেকারের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে এসব কথা ভাবছে কিশোর।

ফাস্ট প্রাইজটা তুমিই পাবে, কিশোর, আগুনে যেন ঘি ঢাললো অসাধারণ ধূর্ত লোকটা। আর পুরস্কারের অঙ্কটা জানো কতো? বিশ হাজার ডলার।

হলিউডের ভাইন স্ট্রীট গেটের সামনে লিমুজিনটাকে থামতেই হলো। শোফারকে চেনে ইউনিফর্ম পরা গার্ড, তবু থামালো। গাড়ির পেছন দিকে এসে পেহুনের সীটে বসা তিন কিশোরকে দেখলো, হাতে একটা লিস্ট। নাম-ঠিকানা মিলিয়ে নেয়ার জন্যে ওদের নাম জিজ্ঞেস করলো।

কিশোর পাশা, বললো কিশোর। মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, মোটুরাম শব্দটা শুধু উচ্চারণ করলেই গার্ডের সঙ্গে তর্ক বাধিয়ে দেবে।

কিন্তু তাকে রাগানোর মতো কিছুই বললো না গার্ড। লিস্ট দেখে পড়লো, কিশোর পাশা। পঁয়তাল্লিশ সাইজ রোড, রকি বীচ। ঠিক আছে?

ঠিক আছে, কিশোর বললো।

মাথা ঝাঁকিয়ে অন্য দুজনের দিকে তাকালো গার্ড।

আমি মুসা আমান।

রবিন মিলফোর্ড।

দুজনের নাম-ঠিকানা মিলিয়ে নিয়ে আবার মাথা ঝাঁকালো গার্ড। সামনের জানালার কাঁচে ওয়াইপারের নিচে একটা সাদা কার্ড লাগিয়ে দিলো সে। চিনতে পারলো কিশোর, স্টুডিওতে ঢোকার পাস।

হাত নেড়ে গার্ড বললো, নয় নম্বর স্টেজ।

ধীর গতিতে গাড়ি চালালো শোফার। পেরিয়ে এলো নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি। তারপর পুরনো স্যান ফ্রানসিসকো অপেরা হাউস। ওটার পর পিসার লীনিং টাওয়ার বা হেলানো স্তম্ভ-পৃথিবীর সপ্ত আশ্চর্যের একটা।

এসবই পরিচিত কিশোরের। যেন স্বপ্নের ভেতর থেকে বাস্তব হয়ে ফুটে বেরিয়ে আসহে ধীরে ধীরে বস্তুগুলো। গলা বাড়িয়ে তাজ্জব হয়ে বিল্ডিংগুলো দেখছে রবিন আর মুসা। কিন্তু কিশোর জানে, ওগুলো আসল নয় কোনোটাই। এমনকি বাড়িও নয়। ক্যানভাস আর প্লাস্টার দিয়ে তৈরি, আসল জিনিসের নকল, তাও শুধু সামনের অংশ। যে কোনোটার রজা খুলে ভেতরে তাকালে দেখা যাবে অন্য পাশে কিছু নেই, ফাঁকা।

লম্বা, কালো গাড়িটায় সীটে হেলান দিয়ে বসে আছে সে। বাইরে তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করছে না।

কিশোরকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিতে এই গাড়ি পাঠিয়েছে হ্যারিস বেকার। যে দুদিন কুইজ হবে, সেই দুদিনের জন্যে গাড়ি আর শোফার দিয়ে দেয়া হয়েছে কিশোরকে।

রাশেদ চাচা আর মেরিচাচীকেও লাঞ্চে দাওয়াত করেছিলো বেকার, কিন্তু তাঁরা আসতে রাজি হননি। বলে দিয়েছেন সময় নেই। কিশোরকে গোপনে বলেছেন মেরিচাচী, মাঝেসাঝে দুএকটা ছবি যে আমার ভাল্লাগে না, তা নয়। কিন্তু যখনই মনে হয় সব বানানো ব্যাপার, আর দেখতে ইচ্ছে করে না।

তার সাথে একমত হলেন রাশেদ পাশা।

তবে রবিন আর মুসা তা হতে পারলো না। ওরা স্টুডিওতে যাওয়ার কথা শুনেই লাফিয়ে উঠলো। আর খুশি হয়েই ওদেরকে সঙ্গী করে নিলো কিশোর।

স্টুডিও এলাকার ভেতরে ঘন্টায় পাঁচ মাইলের বেশি গতিতে গাড়ি চালানোর নিয়ম নেই। কাজেই শামুকের গতিতে অনেকক্ষণ লাগিয়ে এসে হঠাৎ থেমে গেল লিমুজিন। কিশোর ভাবলো, সাউন্ড স্টেজ-এর সামনেই বুঝি গাড়ি থেমেছে, যেখানে লাঞ্চ খাওয়া হবে। কিন্তু না, থেমেছে কতগুলো উত্তর আমেরিকান আদিবাসীদের কুটিরের সামনে। ওগুলোর সামনে দিয়ে হেঁটে গেল দুজন মধ্যযুগীয় রোমান সৈনিক, হাতে ঢাল, কাঁধে বর্শা।

শোফারের নাম অ্যালিউড হোফার, কিশোরদেরকে তা-ই বলেছে। তার পাশের জানালার কাচ নামিয়ে মুখ রে করলো বাইরে। একজন সৈনিককে জিজ্ঞেস করলো, এই যে ভাই, নয় নম্বর স্টেজ কোনটা বলতে পারেন?

কিশোরকে জিজ্ঞেস করলেই হতো, সে-ই বলতে পারতো। কিন্তু আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে গেল না। বললো না, ওই নয় নম্বর স্টেজেই পাগল সংঘের শুটিং হতো। দেরি হয় হোক, তাড়াতাড়ি গিয়ে মড়ার খুলি আর ডারিপদের সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর কোনো ইচ্ছেই তার নেই।

এই পথের শেষ মাথায়, হাতে তৈরি পুরনো আমলের একটা সিগারের মাথা দিয়ে পথ-নির্দেশ করলো সৈনিক।

গেলেই পেয়ে যাবেন, বললো দ্বিতীয় সৈনিক। অসুবিধে হবেনা।

ওদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার এগিয়ে চললো শোফার। পথের শেষ মাথায় দেখা গেল বিমান রাখার হ্যাঙারের মতো দেখতে সাদা একটা বিরাট বাড়ি। একপাশে বড় করে আঁকা রয়েছে ৯।

গাড়ি থেকে নেমে পেছনের দরজা খুলে ধরলো শোফার।

নেমে ওকে ধন্যবাদ জানালো কিশোর। আরেকবার তাকালো লম্বা, স্বাস্থ্যবান তরুণ লোকটার দিকে। দেখে বোঝার চেষ্টা করলো, চকচকে পালিশ করা জুতো পরা, কালো লম্বা চুল আর কালো চামড়ার এই অ্যালউড হোফার নামের মানুষটা কেমন হতে পারে।

নয় নম্বর স্টেজে ঢোকার দরজাটা বাড়িটার তুলনায় ছোট, ভারি। একপাশে লাগানো ধাতব খিল। ভারি রিঙ থেকে ঝুলছে একটা বড় তালা। মাথার ওপরের দুটো আলোর দিকে তাকালো কিশোর। তার জানা আছে, লাল আলোটা যদি জ্বলে, তাহলে খোলা যাবে না দরজা, অর্থাৎ খোলার নিয়ম নেই। ভেতরে কাজ চলছে।

কিন্তু লালটা জ্বলছে না এখন, জ্বলছে সবৃক্ট। তারমানে ঢোকা যায়। পাল্লা ঠেলে খুলে ভেতরে পা রাখলো কিশোর। পেহনে এলো মুসা আর রবিন।

সব পরিচিত এখানকার। কিশোরের মনে হলো, এই তো সেদিন এসেছিলো এখানে অভিনয় করতে। মাঝখানে এতগুলো বছর যে পেরিয়ে গেছে মনেই হলো না তার। ঠিক আগের মতোই এখনও রয়েহে রঙের তাজা গন্ধ, বড় বড় আর্ক ল্যাম্পের তাপ। আগের মতোই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো কতগুলো কণ্ঠ, এই যে মোটুরাম এসে গেছে! এই ডাকটা জীবনে আর শুনতে হবে কখনও ভাবেনি সে।

প্রেস ফটোগ্রাফাররা ঘিরে ধরলো তাকে। দুই-তিন মিনিট নীরবে ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে রইলো সে, ওদের ফ্যাশানের আলোর অত্যাচার সহ্য করলো। সহ্য করলো ওদের জ্বালা ধরানো কথাঃ হাসসা, মোটুরাম। এদিকে একটু তাকাও, মোটুরাম। আরেকবার, আরেকবার হাসো, মোটুরাম।

অবশেষে শেষ হলো ছবি তোলা। ওদেরকে ঠেলে হাসিমুখে এগিয়ে এলো হ্যারিস বেকার, তার ভালুক্সে থাবা ফেললো কিশোরের কাঁধে। কিশোর, এসো এসো, ওরা তোমার অপেক্ষা করছে। পাগল সংঘের অভিনেতারা।

বাড়িটার শেষ ধারে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত বিশাল এক রান্নাঘর। কিশোরের জানা আছে, এটা আসলে রান্নাঘর নয়। সাজানো হয়েছে। স্টোভটা বাতিল, অকেজো। সিঙ্কের ওপরের কল থেকে পানি পড়ে না। শুধু ঘরের মাঝখানে বড় টেবিলটা, যেটায় খাবার সাজাচ্ছে ওয়েইটাররা শুধু সেটাই আসল। অন্যখান থেকে এনে রাখা হয়েছে। ছবি তৈরির সেট সাজানোয় ব্যবহৃত হচ্ছে না এখন ওটা।

তিন গোয়েন্দাকে টেবিলের মাথার কাছে নিয়ে গেল বেকার। ওখানে কালো চুলওয়ালা খুব সুন্দরী এক তরুণীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে তিনজন তরুণ।

কিশোরকে এগোতে দেখে কথা বন্ধ করে মুখ তুলে তাকালো ওরা।

কিশোরও তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। অনেকগুলো বছর ধরে ওদের চেহারা তার মনের পর্দায় ছিলো উজ্জ্বল? মড়ার খুলি-ডিমের মতো সাদা চকচকে মাথা, মুখে বোকা হাসি, সোজা কথায় গর্দভ। ভারিপদের আপেলের মতো টকটকে গোল মুখ, অস্বাভাবিক বড় পায়ের পাতা, হাতের তালুও স্বাভাবিক নয়, রোগা, পাতলা শরীর। শিকারী কুকুরের মুখটা অনেকটা কুকুরের মুখের মতোই লম্বাটে, প্রায় সারাক্ষণ হাঁপায়, জিভ বেরিয়ে পড়ে মাঝে মাঝে, বিষণ্ণ চোখ দুটো দেখে মনে হয় এই বুঝি কেঁদে ফেললো। বটিসুন্দরীর সুন্দর চোখা চেহারা, কপালের ওপরের চুল সমান করে কাটা।

ওই চারজনই দাঁড়িয়ে আছে এখন, কিন্তু একেবারে অন্য মানুষ। কিশোরের মনের পর্দায় যে ছবি আঁকা রয়েছে তার সঙ্গে এখনকার ওদের কোনো মিল নেই।

সুদর্শন এক তরুণ, চামড়ার জ্যাকেট গায়ে, সোনালি চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে, কান দেখা যায় না। হাত তুলে হেসে বললো, এইই যে, তোমাকেও গলায় দড়ি দিয়ে টেনে এনেছে তাহলে।

মাথা ঝাঁকালো কিশোর। তাকালো ছেলেটার কাউবয় বুটের দিকে। ছয় ফুট লম্বা শরীরের তুলনায় জুতো ছোটই বলতে হবে, তারমানে সে ভারিপদ নয়। শিকারী কুকুরও নয় সে। তার পাশে দাঁড়ানো তরুণের মুখটা লম্বাটে, যদিও জিভ বের করে নেই, আর চোখেও নেই আগের বিষণ্ণতা

চামড়ার জ্যাকেট আর হাতে-তৈরি বুট পরা বুদ্ধিমান দেখতে হোকরাই তাহলে মড়ার খুলি?

অন্য দুই পাগলের দিকে তাকিয়েও মাথা ঝাঁকালো কিশোর। নীরবে দেখলো পা থেকে মাথা পর্যন্ত। ভারিপদ আর শিকারী কুকুরকে চিনে নিতে অসুবিধে হলো না।

শরীরের তুলনায় এখনও বড়ই রয়েছে ভারিপদের পায়ের পাতা আর হাতের তালু, শরীর আগের মতো রোগাটে না হলেও বেশ পাতলা। বেঁটে। তবে আপেলের মতো গোলগাল মুখটা বদলে অন্যরকম হয়ে গেছে। তার লাল লাল গাল আর হাসি হাসি চোখ দেখে রকি বীচ সুপারমার্কেটের সেলসম্যানগুলোর কথা মনে পড়ে গেল কিশোরের।

শিকারী কুকুরকে লাগছে তরুণ ব্যবসায়ীর মতো। তার বাদামী রঙের চুল ছোট করে হাঁটা। শার্টের গলার কাছ থেকে শুরু করে নিচ পর্যন্ত একটা বোতামও খোলা নেই। শার্টের কাপড়ও বেশ ঝলমলে, উজ্জ্বল রঙের। একে দেখে এখন বিশ্বাস করাই কঠিন একসময় সে ছিলো কাঁদো কাঁদো চেহারার, পাগল সংঘের বোকা শিকারী কুকুর।

সব শেষে সুন্দরী মেয়েটার দিকে ফিরলো কিশোর। চমৎকার ফন স্যুট পরা। পানের মতো মুখ, গভীর নীল চোখ, ভারি পাপড়ি। এই মেয়েটাই ছিলো তার উদ্ধারকারিণী বটিসুন্দরী, কিন্তু স্টুডিওর বাইরে দেখলে তাকে চিনতেই পারতো না। রাস্তায় দেখলে তো নয়ই। বয়েস কতোটা বদলে দেয় মানুষকে!

হাসলো মেয়েটা। তুমি আসায় খুব খুশি হয়েছি, কিশোর। তোমাকে শুধু কিশোর বলে ডাকলাম, কিন্তু মনে কররানি তো?

না, মোটুরাম বলে না ডাকায় খুশি হয়েহে কিশোর। আমাকে শুধু নেলি বলে ডাকবে।

আস্থা। ওদের সঙ্গে রবিন আর মুসার পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যে ফিরলো কিশোর। বেকার আর টিভি ক্যামেরার পাশে দাঁড়ানো আরেকজন লোকের সাথে কথা বলছে দুজনে। সাদা চুলওলা লোকটাকে চেনা চেনা লাগল কিশোরের। কিন্তু মনে করতে পারলো না, কে।

যাক, আমরা সবাই যখন এলাম, হাত বাড়িয়ে কিশোরের বাহু ধরে তাকে দলের ভেতরে টেনে নিলো মড়ার খুলি, একটা পরামর্শ আছে আমার। আমাদের প্রত্যেকের জন্যেই ব্যাপারটা জরুরী।

কিন্তু সবাই তো আসেনি এখনও, মনে করিয়ে দিলো নেলি। শজারুকাঁটা বাকি আছে।

ও আসবে না, জানালো ভারিপদ।

কেন? কিছুটা হতাশই মনে হলো নেলিকে।

হতাশ কিশোরও হয়েছে। পাগল সংঘের ওই একটিমাত্র ছেলেকে সে পছন্দ করতো, বটিসুন্দরীর চেয়েও বেশি। বাচ্চা পেয়ে তাকে কখনও খেপানোর চেষ্টা করেনি শজারু, কষ্ট দেয়নি।

কি জানি, কাঁধ ঝাঁকালো শিকারী কুকুর। হয়তো খুঁজে পায়নি। কিংবা আসতে রাজি না।

তারমানে বাকি সবাই আছি আমরা, মড়ার খুলি বললো। এবং এসেছি একটা উদ্দেশ্যে। চামড়ার জ্যাকেটের পকেট চাপড়ালো সে। টাকা। তাই না?

হ্যাঁ, দ্বিধা করে বললো শিকারী কুকুর। তার যেন সন্দেহ রয়েছে এ-ব্যাপারে।

হ্যাঁ, বললো ভারিপদ, তার সন্দেহ নেই, টাকার জন্যেই এসেছি আমরা।

নেলিও মাথা ঝাঁকালো।

তাই না? ঠিক বলিনি? কিশোরের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালো মড়ার খুলি।

দ্বিধা করছে কিশোর। বিশ হাজার ডলার জিতে নিতে পারলে খুবই খুশি হবে সে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিন গোয়েন্দার ফাণ্ডে জমা রাখবে ওই টাকা। গাড়ি কিনতে পারবে। মোটর সাইকেল কিনতে পারবে। গোয়েন্দাগিরির কাজে লাগে এরকম অনেক জিনিসই কেনা যাবে এতো টাকা পেলে। তবে শুধু টাকার জন্যে টিভির এই কুইজ শোতে যোগ দিতে আসেনি সে। বাচ্চা পেয়ে তাকে নিয়ে যারা মজা করেছে, নির্যাতন করেছে তার ওপর, ওদেরকে আচ্ছামতো একটা শিক্ষা দেয়াটাই তার প্রধান উদ্দেশ্য। শুধু টাকার লোভ দেখিয়ে তাকে এখানে কিছুতেই আনতে পারতো না হ্যারিস বেকার। তবে সেকথা তো আর বলা যায় না শত্রুদেরকে। মাথা ঝাঁকিয়ে শুধু বললো, হ্যাঁ।

গুড। এখানে একটা পুনর্মিলনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে, মড়ার খুলি বললো। লাঞ্চের পর আমরা সবাই বসে পুরনো দিনের কথা আলোচনা করবো, কিভাবে কি কি মজা করেছি আরা, এ সমস্ত। তাই তো?

আবার মাথা ঝাঁকালো কিশোর।

তোমাদের কাছে মজার হতে পারে, আমার কাছে ছিলো না, ভাবলো কিশোর। তবে কিছুই বললো না সে।

আর আমাদের ওই প্রিয় পরিচালক, বেকারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা চুলওয়ালা মানুষটাকে দেখালো মড়ার খুলি, আমাদের এই আলোচনা টেপ করে নেবেন। কুইজ শোর আগে টেলিভিশনে দেখানোর জন্যে।

কারে ওপর দিয়ে ফিরে তাকালো কিশোর। অবাক হয়ে ভাবলো, কেন প্রথমেই মানুষটার নাম মনে করতে পারেনি? নাম আর চেহারা তো সাধারণত সে ভোলে না। একটা কথা অবশ্য ঠিক, অনেক বদলে গেছেন রাফায়েল সাইনাস। পাগল সংঘের সবার চেয়েও বেশি বদলেছেন। লম্বা, ছিপহেপে একজন প্রাণবন্ত মানুষ, কথার চাবুক হেনে যিনি চোখের পলকে ঠাণ্ডা করে ফেলতেন দুর্দান্ত বেয়াড়া ছেলেগুলোকেও, সেই মানুষের এ-কি হাল হয়েছে! বৃদ্ধ, কুঁজো, বিধ্বস্ত!

বেশ, বলে যাচ্ছে মড়ার খুলি, এখন আমাদের ভেবে দেখতে হবে, কেন আমরা টেলিভিশনের সামনে যাবো শুধু শুধু? যদি কিছু না-ই দেয়? বসে যে আলোচনা করবো তার জন্যেও পয়সা দিতে হবে আমাদেরকে। ঠিক আছে?

এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকালো সে। সবাই মাথা ঝাঁকালো, কিশোর বাদে।

তুমি কি বলো? ভুরু কুঁচকে কিশোরকে জিজ্ঞেস করলো সে।

দ্বিধা করছে কিশোর। ভাবছে। মড়ার খুলির পরামর্শ মেনে নেয়ার অর্থ তাকে দলের নেতা হিসেবে স্বীকার করে নেয়, যেটা কিছুতেই করতে রাজি নয় কিশোর। কারণ ছোটবেলায় এ ছিলো দুষ্ট ছেলেদের সর্দার, মোটুরামকে কষ্ট দেয়ার বেশির ভাগ শয়তানী বুদ্ধিই তার মাথা থেকে বেরোতো।

কারো কর্তৃত্ব মানতে পারেনা কিশোর, এটা তার স্বভাববিরুদ্ধ। তবে একটা কথা এখন স্বীকার না করেও পারছে না, মড়ার খুলির কথায় যুক্তি আছে। টেলিভিশনে যদি তাদেরকে দর্শকদের সামনে হাজির করতে চায় টিভিওয়ালারা, তাহলে কেন পয়সা দেবে না? বিনে পয়সায় কেন কাজ হাসিল করবে?

মাথা ঝাঁকালো কিশোর।

মুখে আঙুল পুরে জোরে শিস দিয়ে উঠলো মড়ার খুলি। হাত নেড়ে ডাকলো, এই বেকার; এদিকে আসুন।

কিশোর ভেবেছিলো এই আচরণে নিশ্চয় মাইন্ড করবে বিজ্ঞাপন ম্যানেজার, মুখ কালো করে ফেলবে, কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে করলো না। বিন্দুমাত্র মলিন হলো চাঁদের উজ্জ্বলতা। এগিয়ে এলো। পোষা বৃদ্ধ কুকুরের মতো তার পিছে পিছে এলেন সাইনাস।

কি চাও? খুব ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করলো বেকার।

কাটা কাটা বাক্যে পরিষ্কার করে তাকে বললো মড়ার খুলি। আলোচনার জন্যে তাদের প্রত্যেককে একশো ডলার করে সম্মানী দিতে হবে। সেটা করমুক্ত হতে হবে, এবং নগদ।

একটুও মলিন হলো না চাঁদের ঔজ্জ্বল্য, তবে সামান্য একটু কোঁচকালো ভুরু দুটো। তা পারবে না। এমনিতেই লাঞ্চের জন্যে অনেক খরচ করে ফেলেছে স্টুডিও। তাছাড়া প্রত্যেকের জন্যেই একটা করে দামী সুভনিরের ব্যবস্থা করেছি নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে।

কি রে উপহার? জিজ্ঞেস করলো নেলি।

কতো দাম? জানতে চাইলো মড়ার খুলি।

এটা আমি এখন কলবো না, হেসে বললো বেকার, গোপন রাখব। সারপ্রাইজ দেয়ার জন্যে। তবে রেখেছি, এটা ধরে নাও, বলে রান্নাঘরের দরজার দিকে দেখালো সে। আর পেলে খুব খুশি হবে, তা-ও বাজি রেখে বলতে পারি। এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বললো, তবে, আলোচনার জন্যে একটা পয়সাও দিতে পারবো না, একথা আবারও বলে দিচ্ছে।

বেশ। টাকা না পেলে আমরাও আলোচনায় বসছি না।

ওদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করলো বেকার। কিন্তু কোনো কথা শুনতে রাজি নয় মড়ার খুলি। তার এক কথা, টাকা ছাড়া কিছু করবে না।

হাসি মুছলো না বেকারের মুখ থেকে, তবে তার কণ্ঠের মোলায়েম ভাবটাও আর রইলো না। দেখো, ব্ল্যাকমেল করছো তোমরা! ব্যাকমেল।

বেশ, করছি, হাসিটা ফিরিয়ে দিলো মড়ার খুলি। কিশোর দেখলে নেলি, ভারিপদ, এমনকি শিকারী কুকুরও হাসছে। তবে আলোচনায় বসাতে হলে টাকা আপনাকে দিতেই হবে।

সাথে সাথে কিছু বললো না বেকার। ভাবছে।

কিশোরও ভাবছে। অবাক হয়েছে সে। পাগল সংঘের যে চেহারা এতোদিন ছিলো তার মনের পর্দায়, সেটা দূর হয়ে গেল আজ। এরা সবাই আজ অন্য মানুষ। সবাই বড় হয়েছে, বুঝতে শিখেছে, স্বার্থ ছাড়া কথা বলে না। কঠোর বাস্তবকে বুঝতে শিখেছে, শিখেছে টাকার জন্যে কিভাবে লড়াই করতে হয়।

কিন্তু কথা হলো, একশো ডলারের জন্যেই যদি এভাবে লড়াই করে, বিশ হাজার ডলারের জন্যে কি করবে? হায়নার মতো কামড়া-কামড়ি শুরু করে দেবে না! ওদের কাছ থেকে টাকাটা বুদ্ধির জোরে ছিনিয়ে নিতে হলে কতোটা সর্তক হয়ে এগোতে হবে, বুঝতে পেরে কিছুটা দমেই গেল কিশোর। হারিস বেকারের কথা থেকে মনে হয়েছিলো, কিশোর আসবে, আর টাকাটা নিয়ে বাড়ি চলে যাবে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, মোটেও ওরকম সহজ নয় ব্যাপারটা।

পাগলদের ওপর আগের সেই ঘৃণাটা আর নেই এখন কিশোরের, এটা বুঝে আরও অবাক হলো। এই মুহূর্তে বিশ্বাসই করতে পারছে না এরাই কয়েক বছর আগে ছিলো একেকটা গর্দভ, বোকার হদ্দ,তাকে জ্বালিয়ে মেরেছে। প্রতিশোধের ইচ্ছেটা ধীরে ধীরে যতোই দূর হয়ে যাচ্ছে কিশোরের, বাড়ছে প্রতিযোগিতায় জেতার ইচ্ছে।

ওর স্বভাবই হলো, কোনো চ্যালেঞ্জ এলে সমস্ত শক্তি আর বুদ্ধি নিয়ে সেটার মুখোমুখি হওয়া। পিছিয়ে আসার ছেলে সে নয়। এখন তার মনে হচ্ছে, জীবনে

এতোবড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি সে খুব কমই হয়েছে।

লাঞ্চ টেবিলটা পরিষ্কার করে সরিয়ে নেয়া হলো। তার জায়গায় এনে অর্ধচন্দ্রের আকারে গোল করে রাখা হলো সুইভেল চেয়ার।

মাঝখানের চেয়ারটায় বসলো হ্যারিস বেকার, অনেকটা উপস্থাপকের ভূমিকা নেবে সে। কিংবা বলা যায় গৃহকর্তার। তার একপাশে নেলি, আরেক পাশে মড়ার খুলি। কিশোর বসেছে একমাথায়, শিকারী কুকুরের পাশে। অন্য মাথায় ভারিপদ।

জ্বলে উঠলো আর্কলাইট। কিশোরের মনে হলো, তার ওপর এসে পড়লো আধ ডজন খুদে সূর্যের রোদ। খুব কমই খেয়েছে সে। মাত্র একটুকরো মুরগীর মাংস আর একচামচ পট্যাটো সালাদ। নার্ভাস হয়ে গিয়েছে বলে খায়নি তা নয়। অন্য চিন্তায় ব্যস্ত তার মন, খাবারের কথা ভাবার সময় নেই যেন। ভ্রাম্যমাণ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে যখন শুটিঙের নির্দেশ দিলেন সাইনাস, তখনও গভীর চিন্তায় ডুবে রইলো সে। যে করেই হোক কুইজ শোতে জিততে হবে তাকে। প্রায় কথাই বলছে না কারো সাথে।

অন্যেরা সবাই গল্প করছে। কিন্তু কিশোর তাতে যোগ দিলো না। সে শুধু শুনছে। মড়ার খুলি, ভারিপদ, আর শিকারী কুকুরের ব্যাপারে অনেক কথাই জেনে ফেলেছে, ওদের আলোচনা থেকে। কিন্তু ওরা তার ব্যাপারে কিছুই জানতে পারেনি এখনও।

গুড ইভনিং, হাসি হাসি গলায় কললো বেকার। শো শুরু হলো।

নড়েচড়ে বেড়াতে লাগলো তিনটে টেলিভিশন ক্যামেরা। ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সাইনাস। নানারকম কাজ করতে হচ্ছে প্রায় একই সঙ্গে।

কয়েকজন পুরনো বন্ধুর সঙ্গে নতুন করে আবার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি আপনাদের, ক্যামেরার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো বেকার। কয়েক হপ্তা ধরেই এদের ছোটবেলার অভিনীত ছবি দেখছেন আপনারা। হাজার হাজার চিঠি লিখেছেন আমাদের কাছে। জানতে চেয়েছেন ওরা কে কোথায় কেমন আছে। আপনাদের অনুরোধেই আজ ওদেরকে আমাদের স্টুডিওতে হাজির করেছি।

এক মুহূর্ত থামলো বেকার। রোদেপোড়া মুখে বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিয়ে উঠলো তার দাঁতের সারি। পাগল সংঘের পাগল এরা সবাই।

বলে যেতে লাগলো সে, পাগলদের একজনকে, যাকে শজারুকাঁটা বলে চেনেন দর্শকরা, তাকে হাজির করতে পারেনি বলে কতোখানি দুঃখিত। দুঃখটা অবশ্যই হাসিমুখে প্রকাশ করলো সে। টেলিভিশনের ঘোষক তাদের অনুষ্ঠান যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে কয়েক মিনিট দর্শকরা দেখতে পাননি বলে যেমন দরাজ হাসি হেসে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করে অনেকটা সে-রকম ভাবে। শজারুকাঁটাকে খুঁজে রে করতে সাধ্যমতো চেষ্টা করা হয়েছে, কলহে বেকার, কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় ক্যালিফোর্নিয়ায় নেই সে। কোথায় গেছে খুঁজেও ব্বে করা যায়নি।

হয়তো জেলে গেছে, মড়ার খুলি বললো।

মৃদু হেসে তার কথা এড়িয়ে গেল বেকার। এক এক করে দর্শকদের সামনে নিজেদের পরিচয় দিতে অনুরোধ করলো পাগলদের।

নেলি বললে প্রথমে, আমি ছিলাম বটিসুন্দরী। কিন্তু সেটা অনেক দিন আগে। এখনও আমি শুধুই নেলি।

কি যে বলো, তার দিকে তাকিয়ে হাসলো বেকার। এতে বিনয়ের দরকার নেই। এখনও তুমি সুন্দরী, রং আগের চেয়ে বেশি। হরি মতো সুন্দর।

নেলি হাসলো না। এখন আর আগের মতো বোকামি করি না আমি। বরং বুদ্ধিমত্তার জন্যে প্রশংসাই পাই।

বেকারের ফিকফিক হাসিটা কেমন শূন্য শোনালো কিশোরের কানে। চেয়ারে হেলান দিলো সে। ক্যামেরার চোখ ছাড়িয়ে তাকালো ইলেকট্রিশিয়ানদের দিকে, যারা কিছু জটিল ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করছে। এদের মাঝেই রয়েছে রবিন আর মুস। কিশোর জানে, কোনো ক্যামেরাই এখনও তার দিকে তাকায়নি। কারণ নেলির পর পরিচয় দেয়ার পালা আসবে মড়ার খুলির। দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে, চোখ টিপলো সে।

ওদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে সে যা-ই বলুক, যাই করুক, ওরা যেন অবাক না হয়। রবিনের দৃষ্টিই বুঝিয়ে দিলো, সে ইশারাটা ধরতে পেরেছে।

সামান্য ডানে সরলো কিশোরের নজর। আরেকটা পরিচিত মুখ চোখে পড়লো। অ্যালউড হোফার। সাউন্ড স্টেজের ওপর দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে লম্বা দণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা আর্ক লাইটের দিকে। আলোগুলো এখন ব্যবহার হচ্ছে না।

আমি ছিলাম মাথা কামানো, পরিচয় দিচ্ছে মড়ার খুলি। বোকার ভাণকরতাম। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বেকারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, খুব একটা বদলেহি বলে কি মনে হয় আপনার?

প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হাসিমুখে পাল্টা প্রশ্ন করলো বেকার, তোমার নামই ছিলো মড়ার খুলি, তাই না?

হ্যাঁ। তবে আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, বোকর ভাণ করে থাকতাম বলেই আমি বোকা নই। আসলে ভালো অভিনেতা। বুদ্ধি বেশি।

তার পর পরিচয় দিলো শিকারী কুকুর, এবং তারও পরে ভারিপদ। এমন শুকনো গলায় নিজেদের উপাধি বললো, যেন বহুবার এক কথা বলতে বলতে বিরক্ত হয়ে গেছে।

শিকারী কুকুর।

ভারিপদ।

ভারিপদকে নাড়া দিয়ে কিছুটা ভেজানোর চেষ্টা করলো যেন বেকার, কেন, তোমাকে ভারিপদ বলা হতো কেন?

কারণ ওই নামেই আমাকে ডাকতো সবাই।

তাতো ডাকতো। কিন্তু কেন?

কারণ ক্রিষ্টে তাই লেখা ছিলো, ডাকতে বলা হয়েছে।

মুহূর্তের জন্যে বেকারের দাঁতের বা অর্ধেক নিভে গিয়ে আবার জ্বলে উঠলো। কিশোরের দিকে ফিরলো। তুমি কে?

হাসিটা ফিরিয়ে দিলো কিশোর। তোতলাতে লাগলো, কি-কি-কি-কি-কিশোর পাশা!

হ্যাঁ। এখন তা-ই। তখন কি ছিলে?

কি-কি-কি-কি-কিশোর পাশা। সব সময়ই আমি কি-কি-কি-কিশোর পাশা। কুঁচকে গেছে তার কপাল। একেবারে বুদ্ধ বনে গেছে যেন। গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে বহুবার দেখছে, বোকার ভাণ করে থাকলে অনেক ফল পাওয়া যায়।

বেকার যখন আবার জিজ্ঞেস করলো, পাগল সংঘে কিসের অভিনয় করতো, জবাবে কিশোর জানালো, বাবা-বাচ্চার। কথা আমার খুব বেশি ম-ম-ম-মনে থাকে না।

অবশেষে বেকারকেই কিশোরের পরিচয় করিয়ে দিতে হলো দর্শকদের কাছে। কিশোর পাশাই ছিলো মোটুরাম। অনেক দর্শকই স্বীকার করবেন, পাগল সংঘের প্রাণ ছিলো সে-ই। খুব বড় অভিনেতা।

পরিচয়ের পালা শেষ হলে বেকার জিজ্ঞেস করতে লাগলো, কে কি কাজ করছে এখন।

আমি রিসিপশনিস্ট, নেলি জানালো। স্যান ফ্রানসিসকোর এক অফিসে।

নিশ্চয় খুব ভালো রিসিপশনিস্ট তুমি। লোকে অফিসে ঢুকে ওরকম সুন্দর একটা মুখ দেখে নিশ্চয় খুশি হয়। অনেক মিষ্টি হাসি নিশ্চয় উপহার পাও তুমি।

না, মাথা নাড়লো নেলি। দাঁত তোলার আগে রোগীর মুখের অবস্থা দেখেছেন? ওরকম করে রাখেমুখ।

কথার খেই হারিয়ে ফেললো বেকার। শুরু করার আগেই কথা থামিয়ে দিলো মেয়েটা। অন্য ভাবে চেষ্টা করে দেখলো সে, অভিনয় তো ভালোই করতে। একেবারে ছেড়ে দিয়েছো নাকি?

আমি অভিনয় ছাড়িনি, বরং অভিনয়ই আমাকে ছেড়েছে। দশবহুর বয়েসের পর থেকে নতুন আর কোনো ছবিতে অভিনয়ের অনুরোধ আসেনি আমার কাছে।

তারমানে তোমার মা-বাবা চেয়েছেন ইস্কুলে গিয়ে লেখাপড়া শিখে তুমি সাধারণ জীবন যাপন করো…

আবার মাথা নাড়লো নেলি। না, তা তারা চায়নি। চাপ দিয়ে বার বার আমাকে ওরা অভিনয়ের দিকেই ঠেলে দিতে চেয়েছে। সাধারণ জীবন যাপন করার উপায় ছিলো না আমার।

কেন? সেকথা জিজ্ঞেস করার আগেই নেলি জবাব দিয়ে দিলো, লোকে আমাকে দেখলেই টিটকারি দিয়ে তো বটিসুন্দরী, বটিসুন্দরী। বহু বছর ওদের জ্বালায় রাস্তায় বেরোতে পারিনি আমি, ইস্কুলে তো আরও খারাপ অবস্থা। কি করতো, বলবো?

হাসিমুখে মাথা ঝাঁকালো বটে বেকার, কিন্তু তার চোখ দেখেই কিশোর বুঝলো, নেলি খুলে বলুক সেটা মোটেও চায় না সে।

নেলিও কললো না। বললো, যদি কখনও আমার বাচ্চা হয়, তাকে কর খোঁড়ার কাজ শিখতে বলবো রং, তবু অভিনেতা হতে দেবো না। কবর খোঁড়ার মাঝেও অন্তত কিছুটা শান্তি আর ভবিষ্যৎ আছে।

ভবিষ্যতের কথাই যখন বলছে, প্রসঙ্গ থেকে সরে যাওয়ার সুযোগটা হাতছাড়া করলো না বেকার, তখন তোমার নিজের কথাই বলো। কি করবে ভাবছো?

এই প্রথম তার দিকে তাকিয়ে হাসলো নেলি। টাকা জোগাড় করতে পারলে কলেজে ভর্তি হবো। এই সুন্দর চেহারা নিয়ে মহা অশান্তিতে আছি আমি। চেহারার চেয়ে মন আর মগজটা সন্দর হলে সেটা বরং আমার অনেক কাজে লাগবে।

তা লাগবে।

নেলির সঙ্গে আলোচনা শেষ করতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো বেকার। মড়ার খুলির দিকে ফিরলো। সে যদি ভেবে থাকে তার সাথে আলোচনাটা নেলির চেয়ে সহজ হবে, তাহলে ভুল করেছে। জানা গেল একটা মোটর গ্যারেজে মেকানিকের চাকরি

কিভাবে কি করে জানতে চেয়ে বেকার পড়লো বিপদে। মড়ার খুলি ঝাঁঝালো গলায় বললো, অন্যের গাড়ির নিচে সারাদিন চিত হয়ে পড়ে থাকি আমি। আমার নাকেমুখে টপ টপ করে ঝরে পড়ে পোড়া তেল। সারা গায়ে তেলকালি লেগে যায়। আঙুল, এমনকি নখের ভেতরে গ্রীজ ঢোকে। ওই আঙুল দিয়ে যখন র‍্যাঞ্চ ধরার চেষ্টা করি।

তাড়াতাড়ি অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল বেকার। আবার কি অভিনয়ের জগতে ফিরে আসতে চাও? তুমিই বললে তুমি খুব ভালো অভিনেতা।

অভিনয়? ফুহ! আপনি জানেন, এই শহরে কতোজন অভিনেতা না খেয়ে মরতে বসেছে?

জানে না বেকার। আর জানলেও সেটা নিয়ে আলোচনা করতে চায় না। আচ্ছা, তুমি কি কখনও নেলির মতো বিপদে পড়েছো? মানে, রাস্তায় জ্বালাতন করেছে লোকে?

ওরকম জ্বালায় পড়েনি একথা স্বীকার করতে বাধ্য হলো মড়ার খুলি। বললো, অভিনয় ছেড়ে দেয়ার পর আর মাথা কামালাম না। চুল গজিয়ে গেল। আমার বিখ্যাত কানদুটোও ঢেকে গেল চুলে। চেহারা এমন বদলে গেল, তখন হঠাৎ আমার নিজের মাও দেখলে চিনতে পারতো কিনা সন্দেহ। লোকে চিনতেও পারলো না, যন্ত্রণা থেকেও বাঁচলাম।

ভবিষ্যতে কি করার ইচ্ছে প্রশ্ন করে অহেতুক বিপদে পড়তে গেল না বেকার। ভারিপদের দিকে ফিরলো। সে জানালো, বেশির ভাগ সময়ই বেকার থেকেছে সে, কাজ পায়নি। তবে শিকারী কুকুর অবাক করলো বেকারকে। সে জানালো হাই স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে।

বেকারের প্রশ্ন ছাড়াই সে বলে গেল, আমি একদিক থেকে ভাগ্যবান। আমার বাবা উকিল। তিনি কখনোই আমাকে অভিনেতা বানাতে চাননি। তার এক শাসালো মক্কেলের চাপাচাপিতেই ছেলেকেলায় আমাকে অভিনয় করতে দিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর যখন বুঝলেন, এসব করে আমার ভবিষ্যৎই শুধু ঝরঝরে হবে, লাভ কিছু হবে না, আমাকে অভিনয়ের জগত থেকে ছাড়িয়ে এনে ইস্কুলে ভর্তি করে দিলেন।

বেকার জানতে চাইলো, অভিনয় ছেড়ে দেয়ার পর রাস্তায় বিপদে পড়েছে কিনা শিকারী কুকুর।

পড়েছি, জানালো সে, তবে বেশি দিন না। পাগল সংঘে আমি বোধহয় খুব একটা চোখে পড়ার মতো চরিত্র ছিলাম না। লোকে শীঘ্রি ভুলে গেল আমার কথা।

এরপর এলো কিশোরের জবাব দেয়ার পালা।

তুমি কি করছো? বেকার জিজ্ঞেস করলো।

শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো কিশোর, যেন প্রশ্নটা বুঝতে পারছি না। বোকার মতো কললো, কই, কিছুই তো করছি না। চুপচাপ বসে রয়েছি।

এখানে বসে থাকার কথা বলছি না। জীবনে কি করছো?

র-র-রকি বীচে বাস করছি।

ওখানে থেকে কি করো?

প্রশ্নটা যেন খুব অবাক করলো কিশোরকে। মাথা চুলকালো, চেয়ারে নড়েচড়ে বসলো। অবশেষে স্বীকার করলো বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঝে মাঝে স-স-স-সৈকতে সা-সঁ-আঁ তার কাটতে যায়।

ইস্কুলে যাও না? কোনো কিছুই যেন হ্যারিস বেকারে হাসিতে চির ধরাতে পারে। তবে গলায় সামান্য অধৈর্য ভাব ফুটলো।

গ-গ-গরমের ছুটিতে যাই না।

ভবিষ্যতে কিশোরের কি করার ইচ্ছে জিজ্ঞেস করে বিপদে পড়তে চাইলো না বেকার। আর কিছু আপাতত জিজ্ঞেস করলো না তাকে।

তবে এখনও নির্দিষ্ট সময় শেষ হতে বারো মিনিট বাকি। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসলো বেকার। এখন ওদের অতীত সম্পর্কে আমি কিছু জিজ্ঞেস করবো, ঘোষণা করলো সে। আমার বিশ্বাস, পাগল সংঘে অভিনয় করার সময়কার মজার কোনো ঘটনার কথা ওরা বলতে পারবে।

আবার নেলিকে দিয়ে শুরু হলো।

আমার শুধু মনে আছে নাপিতের কথা, নেলি বললো। এতো জোরে ব্রাশ ঘষতো আমার মাথায়, মনে হতো চামড়া ছিলে ফেলবে।

মড়ার খুলির মনে পড়লো সম্মানী দেয়ার দিনের কথা। প্রতি শুক্রবার রাতে পেতাম আমরা। চেক নয়, নগদ টাকা। বাদামী খামে ভরা থাকতো, লাল সুতো দিয়ে বাঁধা।

নিশ্চয়ই সেটা তোমার জন্যে খুব আনন্দের দিন ছিলো? বেকার বললো হেসে।

মোটেও না। আনন্দের ছিলো আমার বাবার জন্যে। সারা হপ্তায় ওই একবারই স্টুডিওতে আসতো, আমার কাছ থেকে খামটা কেড়ে নেয়ার জন্যে।

ভারিপদর মনে পড়লো বড় জুতোর কথা। এতে বড় জুতো পরতে দেয়া হতো আমাকে, ঢলঢল করতো। পায়ে আটকে রাখার জন্যে ভেতরে কাপড় পুরে দিতে ওরা। একজোড়া জুতো এখনও আছে, এখনও পায়ে ঢিলে হয়।

শিকারী কুকুরের মনে পড়লো, যেদিন স্টুডিওতে কোনো কাজ থাকতো না, সেদিন তার বাবা তাকে বেড়াতে নিয়ে যেতেন সৈকতে। কিংবা খেলতেন ছেলের সঙ্গে। তার যদি সেদিন কোনো কাজও থাকতো, সেটা করতেন না, ছুটি নিতেন। শেষের দিকে তো দিন গুনতে আরম্ভ করেছিলাম আমরা দুজনেই, কবে অভিনয়ের কন্ট্রাক্ট শেষ হবে, বললো সে।

কিশোর কিছুই মনে করতে পারলো না। বললো, আমি তখন খুব বা-বাবাবাচ্চা। তোতলাতে তোতলাতে আরও জানালো, তার স্মৃতিশক্তি খুবই দুর্বল, কিছুই মনে রাখতে পারে না। কয়েক হপ্তা আগে টিভিতে পাগল সংঘ দেখানোর আগে নাকি জানতোই না সে, কখনও তার নাম মোটুরাম ছিলো। তা-ও টেলিভিশনে সে দেখেনি। কে জানি একজন এসে-কে সেটাও মনে করতে পারছে না-তাকে বললো, তার নাম মো-মো-মো মোটুরাম।

শুনে নিশ্চয় অবাক লেগেছিলো তোমার, শূন্য হাসি হেসে বললো বেকার। হঠাৎ এক বিস্ময়কর তথ্য উদঘাটিত হওয়ায়?

বিস্ময়কর তথ্য উদ্ঘাটিত বলে একটা নাটকীয় আবহ আনতে চেয়েছিলো কোর, কিন্তু বলেই বুঝলো মস্ত ভুল করে ফেলছে। শুব্দগুলোর মানে যখন বোঝেতে পারলো সে অনেক চেষ্টার পর, তখন আর মাত্র তিন মিনিট বাকি আছে আলোচনা শেষ হতে।

উঠে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার দিকে তাকালো বেকার।

এখন সবাইকে একটা সারপ্রাইজ দেবো, চওড়া হাসি হাসলো সে। আমাদের এই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্যে পাগলদের সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। প্রত্যেককে একটা করে সুতনির উপহার দেবো, দেখে এই অনুষ্ঠানের কথা মনে করার জন্যে। অ্যানি, নিয়ে এসো প্লীজ।

মাথা সামান্য কাত করে তাকালো সে। রান্নাঘরের দরজা দিয়ে ঢুকলো একটা সুন্দরী মেয়ে, মাথায় লাল চুল, পরনে খাটো স্কার্ট। হাতে একটা চারকোণা বড় বাক্স, সোনালি কাগজে মোড়া।

বাক্সের ডালাতোলার আগে এক সেকেন্ড দ্বিধা করলো বেকার। তোমাদের প্রত্যেককে একটা করে খুব দামী উপহার দেয়া হবে, তার সব চেয়ে উষ্ণ আর চওড়া হাসিটা উপহার দিয়ে নিলো আগে সবাইকে। সারা জীবন ওটাকে রত্ন মনে করে রেখে দিতে পারবে তোমরা।

উপহারটা কী, বলার আগে আবার এক সেকেন্ডের জন্যে থামলো বেকার। তারপর বললো, রূপার একটা করে চমৎকার কাপ, তার ওপর তোমাদের নাম খোদাই করা, অবশ্যই পাগল সংঘের দেয়া নাম। যখনই দেখবে, মনে মনে হাসবে, আর মনে করবে একসময় কি প্রচণ্ড খ্যাতিই না পেয়েছিলো সিরিজটা।

বাক্সটা অ্যানির হাতে রেখেই ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিলো বেকার। প্রায় থাবা দিয়ে ছিনিয়ে নিলো বাক্সটা। এপাশ-ওপাশ নাড়া দিলো জোরে জোরে। হাত থেকে পড়ে গেল ওটা, মাটিতে পড়ে কাত হয়ে খোলা মুখ করে রইলো ক্যমেরার দিকে।

শূন্য বাক্স। দামী রূপার কাজ তো দূরের কথা, কোনো জিনিসই নেই বাক্সের ভেতরে।

বেকারের মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো কিশোর। লোকটার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার পর এই প্রথম দেখতে পেলো সে, তার মুখে হাসি নেই।

হাসছে না হ্যারিস বেকার।

শুরু হয়নি এখনও, রবিন বললো।

চ্যানেল ঠিক আছে তো? মুসার প্রশ্ন।

মাথা ঝাঁকালো রবিন। পৌনে পাঁচটায় দেখানোর কথা, খবরের আগে। কাগজে তো তাই লিখেছে। কিন্তু এখন তো দেখছি পুরনো এক ওয়েস্টান হবি।

রকি বীচে ফিরেই সোজা এসে হেডকোয়ার্টারে ঢুকেছে তিন গোয়েন্দা।

রকিং চেয়ারে বসে টেবিলে পা তুলে দিয়েছে মুসা। আমার মনে হয়, কাপগুলো হারানোতেই অনুষ্ঠানটা দেখাচ্ছে না। কি বলো, কিশোর?

কিশোর জবাব দিলো না। ডেস্কের ওপাশের চেয়ারে হেলান দিয়ে আনমনে চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। গভীর চিন্তায় ডুবে আছে।

টেলিভিশন অফ করে দিলো রবিন। পর্দা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল কালো হ্যাট পরা দুজন কাউবয়।

এখনও ওখানেই রয়েছে, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো কিশোর।

কারা? টুলে বসে দেয়ালে পিঠ দিয়ে আরাম করে বসলো রবিন।

কারা নয়, কি, শুধরে দিলো কিশোর। ওই কাপগুলো। এখনও ওখানেই আছে।

কোথায়? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

স্টেজ নাইন থেকে আমরা চলে আসার আগে আমাদের সবার দেহতল্লাশি করেছে ওরা, কিশোর কললো। তারপর গেটের কাছে আরেকবার খুঁজেছে গাড়ির ভেতর। পায়নি। যারাই চুরি করে থাকুক কাপগুলো, স্টুডিও থেকে সরাতে পারেনি। তারমানে এখনও ওখানেই আছে, সাউন্ড স্টেজের কোথাও, লুকানো।

এই সাউন্ড স্টেজটা আসলে কি জিনিস? জানতে চাইলো মুসা। ওরকম নাম কেন?

কারণ, বুঝিয়ে দিলো কিশোর, বহুদিন আগে যখন কথা বলা সিসটেম চালু হলো সিনেমায়, তখন তাদের সেটকে সাউন্ডপ্রুফ করার প্রয়োজন হতো পরিচালকদের। সাউন্ড স্টেজটা সে-কারণেই দরকার।

ও। তা কাপগুলোর কথা ঠিকই বলেছে। কিন্তু থাকলে আমাদের কি? তোমারটা নিশ্চয় পেতে চাও না? রূপার একটা কাপ দিয়ে কি আর হবে?

তাছাড়া ওটাতে যে নাম লেখা আছে, সেটা তুমি শোনা তো দূরের কথা, মুচকি হেসে বললো রবিন, দেখতেও চাও না।…কিশোর, সত্যিই তুমি ভালো অভিনেতা।

আজ বিকেলে বোকার অভিনয় যা করলে না! হ্যারিস বেকারকে বুদ্ধ বানিয়ে ছেড়ে। দিয়েছে।

ওকে হেনস্তা করার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিলো না। আসলে মড়ার খুলি আর শিকারী কুকুরকে বেকুব বানালাম।

কিভাবে? বুঝতে পারলো না মুসা।

তলোয়ার খেলার মতো। প্রতিপক্ষ যদি বোঝে তোমার তলোয়ারটা ভোতা, সামনে এগোতে আর দ্বিধা করবে না। তখন তার পেটে সহজেই তলোয়ার ঢোকাতে পারবে তুমি।

আরে বাবা একটু সহজ করে বলো না। দুই হাত তুলে নাচালো মুসা।

সহজ করেই তো বললাম। আমার শত্রুরা যদি ভেবে বসে আমি এতোই বোকা, নিজের নাম মনে রাখতে পারি না, তাহলে আমাকে পরাজিত করার জন্যে বেশি চেষ্টা করবে না। তখন ওদেরকে হারানো আমার জন্যে সহজ হয়ে যাবে।

বুঝলাম।

মাথ ঝাঁকালো রবিন। সে-ও এখন বুঝতে পেরেছে কিশোরের তখনকার ওই অত আচরণের কারণ।

যাই হোক, আগের কথার খেই ধরলো কিশোর, এই কাপ চুরির ব্যাপারটা পরিস্থিতি পালটে দিয়েছে অনেকখানি।

তারমানে, বলতে চাইছে, রবিন বললো, তদন্ত করার মতো একটা কেস পেয়ে গেছে?

কিন্তু বুঝতে পেরেছো? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

কারও কথারই জবাব দিলো না কিশোর। নীরবে হাত বাড়ালো টেলিফোনের দিকে। একটা কার্ড দেখে নম্বর ডায়াল করলো। ওপাশ থেকে সাডা এলে বললো, হলো, ইজি রাইড লিমে? আমি কিশোর পাশা বলছি। আপনাদের একজন ড্রাইভার, অ্যালউড হোপার, তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

কিছুক্ষণ নীরবতার প্র লাইনে এলো হোফার।

হ্যালো, মিস্টার হোফার, কিশোর কললো, আবার রিক্ত করছি। এই মাত্র স্টুডিও থেকে খবর দিলো, আবার যেতে হবে আমাদেরকে। হা হা, এক্ষুণি। যদি চলে আসেনহ্যাঁ, গেটের কাছেই থাকবো।…থ্যাংক ইউ।

আবার যাচ্ছি? উঠে দাঁড়ালো মুসা। কিশোরের ডেস্কে দুহাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু ঢুকবোকিভাবে? ওরা তো তোমাকে ডাকেনি।

না, ডাকেনি, বলতে বলতে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলো কিশোর। কিন্তু আমাকে ঢুকতে দেবে ওরা, কারণ স্টুডিও পাস আছে। লিমুজিনের জানালা থেকে খুলে রেখে দিয়েছিলাম, আমাদেরকে যখন নামিয়ে দিয়ে গেল। তখন অবশ্য ভাবিনি আমাদেরকে আবার ঢুকতে হবে। হোফার আবার ঢুকতে পারে এই ভয়ে খুলে রেখেছিলাম।

আবার কেন যাচ্ছে, জিজ্ঞেস করেও জবাব পেলো না রবিন। চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করলো। ইচ্ছে করে কিছু না বললে হাজার জিজ্ঞেস করেও কিশোরের কাছ থেকে জবাব পাওয়া যাবে না।

স্টুডিওর গেটে এসে পাস দেখাতেই কোনো প্রশ্ন না করে ওদেরকে ছেড়ে দিলো গার্ড। নয় নম্বর স্টুডিওর সামনে এসে থামলো গাড়ি নেই।

বড় জোর আধ ঘণ্টা লাগবে আমাদের, শোফারকে বললো কিশোর।

আচ্ছা, ঘাড় কাত করলো হোফার।

ছোট দরজাটার সামনে এসে দাঁড়ালো কিশোর। তালা লাগানো নেই। সব সময়ই খোলা থাকে এই স্টেজ, জানা আছে তার। কাজ করার জন্যে আবার সন্ধ্যা আটটার

সময় আসবে এখানে নাইট শিফটের কর্মীরা।

মস্ত ঘরটা এখন অন্ধকার। অনেক ওপরে রয়েছে ধাতব ব্যালকনি। ওখানে, গ্যানট্রিতে কয়েকটা ঝুলন্ত তারের খাঁচার ভেতরে জ্বলছে কয়েকটা বান্ধ।

কিশোরকে অনুসরণ করে রান্নাঘরে এসে ঢুকলো মুসা আর রবিন। টর্চ জ্বেলে দেয়ালগুলো পরীক্ষা করতে আরম্ভ করলো গোয়েন্দা প্রধান।

নরম সুরে নিজের সঙ্গেই কথা বলতে লাগলো সে, টেবিলটা ছিলো এখানে। লাঞ্চের পর নিয়ে যাওয়া হলো ওই দিকে, এখানে এনে পাতা হলো কতগুলো সুইভেল চেয়ার। আর তখন নিশ্চয় সোনালি বাস্কেট ছিলো সেটের বাইরে…।

সেটের দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে। এই দরজা দিয়েই বাক্স নিয়ে ঢুকেছিলো লাল চুল মেয়েটা। দরজা খুলে ওপাশে এলো কিশোর, সঙ্গে সঙ্গে এলো দুই সহকারী।

কয়েক ফুট দূরের একটা টেবিলে আলো ফেলে বললো সে, বাক্সটা হয়তো ওটার ওপরেই রাখা ছিলো। কিন্তু আমরা রান্নাঘরে থাকার সময় একবারও ভোলা হয়নি এই দরজা, শুধু বাক্স নিয়ে অ্যানি ঢোকার সময় ছাড়া। ওয়েইটার, ক্যামেরাম্যান সবাই রান্নাঘরে ঢুকেছে সেটের খোলা অংশ দিয়ে, আমরা যেদিক দিয়ে ঢুকেছি। তাছাড়া সারাক্ষণ লোক ছিলো ওখানে, কর্মীরা। সুতরাং, রবিন আর মুসার দিকে ঘুরলো সে, তোমাদের কি মনে হয়?

কাপগুলো যে-ই চুরি করুক, রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে লুকাতে পারেনি, মুসা বললো। তা করতে হলে ওগুলো নিয়ে সবার সামনে এই দরজা দিয়ে বেরোতে হতো, যেটা করা সত্ব ছিলো না।

হ্যাঁ। মাথা ঝাঁকালো কিশোর। ধরা যাক, আমি চোর। ক্যানভাসে তৈরি রান্নাঘরের দেয়াল ঘুরে খোলা জায়গায় চলে এলো সে, যেখানে লাঞ্চের সময় কর্মীরা দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি এখানে ছিলাম, এবং আমাকে ঘিরে ছিলো অনেক লোক। কিন্তু যদি বাক্সটা নিয়ে আমি ওদিকে ওই টেবিলের দিকে চলে যাই, আমাকে কেউ দেখবে। সামনের দিকে টর্চের আলো ফেললো সে। তারপর এগিয়ে গেল টেবিলটার দিকে।

রান্নাঘরের দরজা তখন লাগানো। কাজেই এখানে হুট করে কারও চলে আসার। ভানা ছিলো না। কাজেই বাক্স খুলে কাপগুলো বের করে আবার ওটা সোনালি কাগজে মুড়ে রাখার যথেষ্ট সময় আমি পেয়ে যেতাম। সঙ্গে করে একটা চটের বস্তাটস্তা কিছু নিয়ে এলে ওগুলো ভরে ফেলতে পারতাম। কিন্তু সবার চোখের ওপর দিয়ে ওটা বের করে নিয়ে যেতে পারতাম না, কাজেই…

কাজেই এখানেই কোথাও লুকিয়ে রাখতে হতো, কথাটা শেষ করে দিলো রবিন। ওর টর্চ বের করে জ্বাললো। আলো ফেলতে লাগলো কতগুলো তারের কুণ্ডলী, কিছু রঙের টিন, নানারকম মালপত্রের একটা দুই ফুট চওড়া, চার ফুট লম্বা স্তূপের ওপর। সব শেষে আলো ফেললো পাশের একটা ভারি কাঠের বাক্সের ওপর।

ওটার ওপর আলো ধরে রাখলো কিশোর। তার দুই সহকারী এগিয়ে গেল বাক্সের দিকে। ভেতরে ছুতোর মিস্ত্রীর কয়েকটা যন্ত্রপাতি ছাড়া আর কিছু নেই। মালপত্রের স্তূপ আর রঙের টিনের ভেতরেও কিছু পাওয়া গেল না।

ফিরে তাকালো রবিন আর মুসা। কিন্তু কিশোর ওদের দিকে তাকিয়ে নেই। সে গিয়ে দাঁড়িয়েছে একটা আর্ক লাইটের ধাতব স্ট্যান্ডের কাছে। হাত দিয়েই খোলালাগানো যায় এরকম বড় বড় গুলো পরীক্ষা করছে।

হঠাৎ স্থির হয়ে গেল সে। ঝট করে চোখ তুলে তাকালো কয়েক ফুট ওপরের কালো বড় বাক্সটার দিকে, যেটাতে রিফ্লেক্টর ভরা থাকে।

এই এদিকে এসো, সাহায্য করো আমাকে।

তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলো দুই সহকারী। ক্রুগুলো ঢিল করে বাক্সটা নিচে নামাতে সাহায্য করলো কিশোরকে। বারের হুড়কো খুলে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিলো গোয়েন্দাপ্রধান।

হঠাৎ যেন রাতের আকাশে সূর্য উঠলো। দপ করে জ্বলে উঠলো হাজার ভোল্টের অসংখ্য বাতি, অন্ধকারের চিহ্নমাত্র রইলো না সেটের কোথাও। আলোর বন্যায় ভেসে গেল সমস্ত রান্না।

আর্ক লাইটের আলোয় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। ধাতব দণ্ডটায় এখনও হাত রয়ে গেছে মুসা আর রবিনের। কিশোরের হাত রিফ্রেক্টর বক্সের ভেতরে।

যেখানে আহো, দাঁড়িয়ে থাকো, আদেশ দিলো একটা কণ্ঠ।

দাঁড়িয়ে রইলো হেলেরা। আলো জ্বালানোর মাস্টার কন্ট্রোল সুইচ বক্সের কাছ থেকে তাদের দিকে এগিয়ে এলেন পাগল সংঘের পরিচালক রাফায়েল সাইনাস। তাকিয়ে আছেন কিশোরের দিকে। বের করে আনার দরকার নেই আর। উজ্জ্বল আলোয় এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বাক্সের ভেতরে রিফ্রেক্টরের পাশে পাঁচটা রূপার কাপ।

তাহলে ওখানেই লুকিয়েছে, সাইনাস বললেন। বিকেলে দেখা গিয়েছিলো বিধ্বস্ত এক বৃদ্ধ, এখন অন্য রকম হয়ে গেছে কণ্ঠস্বর। বহু বছর আগের সেই ধার

আবার ফিরে এসেছে অনেকখানি।

দুহাজার ডলার খরচা হয়েছে স্টুডিওর ওগুলো কিনতে, বললেন পরিচালক। চুরি করেছে তোমরা। সবাই চলে যাওয়ার পর এখন এসেছে রে করে নিতে।

না, কিশোর বললো। আমরা লুকাইনি। খুঁজে ব্রে করেছি। এক এক করে বাক্সের ভেতর থেকে বের করে তুলে দিতে লাগলো পরিচালকের হাতে।

কে বিশ্বাস করবে তোমার কথা? পরিচালক বললেন। যে লুকিয়েছে, তারই শুধু এতো সহজে ওগুলো খুঁজে পাওয়ার কথা।

আমি চুরি করিনি! গলা সামান্য চড়ালো কিশোর। ভেবে বের করেছি কোথায় ওগুলো লুকিয়ে রাখতে পারে চোর। হেডকোয়ার্টারে বসে আলোচনা করেছি আমরা…

হেডকোয়ার্টার! তীক্ষ্ণ হলো পরিচালকের দৃষ্টি। কি বলতে চাইছো?

আমাদের অফিস। যখন কোনো কেস হাতে পাই, ওখানে বসে আলোচনা করি আমরা। গবেষণা করি।

কিসের কেস? সাইনাসও গলা চড়ালেন। এরপর হয়তো বলে বসবে, তোমরা পুলিশের লোক। গোয়েন্দা।

গোয়েন্দাই আমরা, তবে পুলিশের লোক নই। আম্র শব্বে গোয়েন্দা। পকেট থেকে কার্ড বের করে দিলো কিশোর।

শূন্য দৃষ্টিতে কাউটার দিকে তাকালেন পরিচালক। তাতে কিছু প্রমাণ হয় না, গলার স্বরে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না তার। যে কেউ ওরকম ছেপে নিতে পারে। যদি ছেপে নাও তুমি এই স্টুডিওর প্রেসিডেন্ট, তাহলেই কি প্রেসিডেন্ট হয়ে যাবে? এটা কোনো প্রমাণ না যে তুমি কাপ চুরি করোনি।

কিন্তু আমরা করিনি, জোর দিয়ে বললো রবিন। এখানে এসে পাওয়ার আগে জানতামই না কোথায় লুকানো আছে।

আমরা শুধু আন্দাজ করেছি,মুসা বললো, এখানেই কোথাও আছে।

তারপর কিশোর বুঝে ফেললো, রবিন কললো আবার, ওই রিফ্লেক্টর বক্সে রয়েহে ওগুলো।

আর এখানে সমস্ত স্ট্যান্ডের মধ্যে সব চেয়ে বেশি তুলে রাখা হয়েছে ওই বাটার স্ট্যান্ড, বললো কিশোর, সে-কারণেই অবাক লাগলো। অস্বাভাবিক। ভাকলাম, কেন তুলে রাখা হয়েছে? নিশ্চয় কোনো ব্যাপার আছে।

কিন্তু এতো কথা বলার পরেও বিশ্বাস করার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না পরিচালকের মাঝে।

চুপ করে এক মুহূর্ত ভাবলো কিশোর। তারপর জিজ্ঞেস করলো, আপনি নিশ্চয় মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারের নাম শুনেছেন? চিত্রপরিচালক?

তার নাম কে না শুনেছে, শ্রদ্ধার সঙ্গে বললেন সাইনাস। কেন, তিনি তোমাদের সাফাই দেকেন?

নিশ্চয় দেবেন। আপনি ফোন করেই দেখুন না।

হাসলেন সাইনাস। তোমাদের কপাল খারাপ, তিনি এখন নেই। বাইরে গেছেন একটা শুটিঙের কাজে। বেশ কিছুদিন আসবেন না।

আবার চুপ হয়ে গেল কিশোর। দমে গেছে রবিন আর মুসা। সাইনাসকে বোঝানোর আর কোনো উপায় নেই।

কিন্তু কিশোর দমলো না। আবার জিজ্ঞেস করলো, ভিকটর সাইমনের নাম শুনেছেন? রহস্য কাহিনী লেখক?

একের পর এক বিখ্যাত লোকদের নাম বলে যাচ্ছো। ব্যাপারটা কি? তিনিও কি সাফাই দেবেন নাকি?

কেন দেবেন না? দ্বিধা করলেন সাইনাস। তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। ফোন নম্বর জানি না।

আমি জানি, পরিচালকের হাত থেকে কার্ডটা নিয়ে তার উল্টো পিঠে ফোন নম্বর লিখে দিলো কিশোর।

আরেকবার দ্বিধা এলেন পরিলাচক। তারপর হেঁটে গেলেন স্টেজের দেয়ালে কানো টেলিফোনটার দিকে। তাকে ডায়াল করতে দেখলো তিন গোয়েন্দা। তবে এত দূর থেকে কথা শুনতে পেলো না। অনেক সময় ধরে কথা বললেন। তারপর রিসিভার রেখে দিলেন হাসিমুখে।

ফিরে এসে জানালেন, আমাকে চিনতে পেরেছেন তিনি। আমার নাম জানেন। আশ্চর্যই লেগেছে। তার একটা ছবির শুটিং হয়েছিল, আমাদের এই স্টুডিওতে। তখন নাকি আমার সাথে দেখা হয়েছিলো, অথচ আমি ভুলে বসে আছি। আবার হাসলেন তিনি। কলার সঙ্গে সঙ্গেই নিতে পারলেন।

আমাদের কথা কি বলেছেন? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

ও, তোমাদের কথা, জোর করে যেন অতীত থেকে নিজেকে বাস্তবে টেনে আনলেন সাইনাস। যা, তোমাদের কথা বলেছেন। তোমরা চোর নও। তোমরা ইচ্ছে করলে এখন বাড়ি যেতে পারো। কাপগুলো আমি জায়গামতো পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করছি।

তাঁকে ধন্যবাদ দিলো কিশোর।

আশ্চর্য, বিড়বিড় করলেন সাইনাস, কিশোরের কথা যেন শুনতেই পাননি, এই ফিল্ম ব্যবসা! এটা এমন এক জায়গা, এখানে চোখের আড়াল হলেই মানুষ মানুষকে দ্রুত ভুলে যায়। অথচ ভিক্টর সাইমন আমাকে ভোলেননি। আর কাণ্ড দেখো, আমি ভুলে বসে আছি। তিনি বললেন, তার ছবিটা পরিচালনার কথা নাকি প্রথমে আমারই ছিলো। পরে আরেকজনকে নেয়া হয়েছে, আমি সময় দিতে পারিনি বলে। আমার পরিচালিত সমস্ত ভালো হরি নাম মনে আছে তাঁর।

বেরোনোর জন্যে সহকারীদেরকে ইশারা করলো কিশোর। সাইনাসকে তার অতীতের মধ্যেই ডুবে থাকতে দিলো ওরা। এগোলো সাউন্ড স্টেজের প্রজার দিকে।

কি ভাবছো, কিশোর? রাস্তায় পা দিয়েই জিজ্ঞেস করলো মুসা।

জবাব দিলো না গোয়েন্দাপ্রধান। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে।

কে চুরি করেছে বলে মনে হয় তোমার? রবিনের প্রশ্ন। ওই আর্ক লাইট, ওদের কথা যেন কানেই ঢোকেনি কিশোরের, কেউ জানতো, ওগুলো ব্যবহার করা হবে না। থমকে দাঁড়ালো সে। পেছনে দাঁড়িয়ে গেল রবিন আর মুসা, বিশাল স্টেজ-বাড়িটার হায়ায়। বোধহয় সে-কারণেই সে ক্যামেরাগুলো চাল হওয়াতক অপেক্ষা করেছিলো…, ভ্রূকুটি করলো সে। কি জানি, এখনও শিওর হতে পারছি না।

মড়াটা? মুসা বললো। নাকি ভারিপদ?

শিওর না, একই কথা বললো কিশোর। বেশ কিছু রহস্য জট পাকিয়ে আছে এখনও।

যেমন? রবিন জানতে চাইলো।

এক নম্বর, একটা আঙুল তুললো কিশোর, আমাদের শোফার অ্যালউড হোফার।

তার আবার কি রহস্য? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

ওর স্মৃতিশক্তি, বুঝিয়ে দিলো কিশোর, এত কম লে? সকালে স্টুডিওর গেট গার্ড তাকে দেখেই চিনতে পারলো, তারমানে এখানে সে অনেকবার এসেছে। তার পরেও নয় নম্বর স্টেজ কোথায় জানার জন্যে অনন্যকে জিজ্ঞেস করতে হলো কেন?

পথের শেষ মাথায় পার্ক করা লিমুজিনের দিকে হাঁটতে আরম্ভ করলো আবার কিশোর। আমাদের সামনে সাউন্ড স্টেজটা না চেনার ভান করছে সে। কেন?

সে-ই কি কাপগুলো চুরি করেছে ভাবছো? রনি বললো।

আবার কুটি এলো কিশোর। এখনও জানি না। তবে, আমাদের আলোচনা অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার ঠিক আগে রান্নাঘরের পেছন ঘুরে ওকে হেঁটে যেতে দেখেছি আমি।

পরদিন সকালে নাস্তা সেরে মেরিচাচীকে বাসন-পেয়ালা ধুতে সাহায্য করলো কিছুক্ষণ কিশোর। তারপর বেরিয়ে এসে ঢুকলো তার ওয়ার্কশপে। কুইজ শোর অনুষ্ঠান রেকর্ড করতে টেলিভিশন স্টেশনে যাবার কথা দুটোর সময়।

বেশির ভাগ কুইজ শোতেই, জানে সে, যার যার নিজের বিষয় পছন্দ করে নিতে বলা হয়। ওয়ার্কবেঞ্চে বসে বসে ভাবতে লাগলো সে, ওদেরকে কি সেরকম কোনো সুযোগ দেয়া হবে? যদি হয়, তাহলে কোন্ বিষয় পছন্দ করবে সে? বিজ্ঞান। ইস্কুলে তার সব চেয়ে প্রিয় বিষয়।

আগের দিন বেকারকে শো-এর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলো নেলি। জবাব দেয়নি, বিজ্ঞাপন ম্যানেজার। শুধু বলেছে, সারপ্রাইজ দেয়ার জন্যে সেটা গোপন রাখতে হচ্ছে, সরি।

একটা টিনের ছাউনির নিচে রয়েছে এই ওয়ার্কবেঞ্চ। বেঞ্চটার একধারে পড়ে আছে কয়েকটা পুরনো ভাঙা ক্যারো। কিনে নিয়ে এসেছিলেন রাশেদ পাশা। ওগুলোর কোনোটার লেন্স, কোনোটার শাটার আর নানারকম পার্টস খুলে নিয়ে একটা বিশেষ ধরনের ক্যারো তৈরি করার ইচ্ছে কিশোরের। খুব ছোট জিনিস। জ্যাকেটের নিচে লুকিয়ে রেখে বোতরে ফুটো দিয়ে চোখ বের করেই যেটার সাহায্যে ছবি তোলা যাবে। পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে নতুন ধরনের কিছু তৈরি করে ফেলা তার হবি।

কয়েক মিনিট কাজ করার পরই হঠাৎ সোজা হয়ে মুখ তুললো সে, নামিয়ে রাখলো হাতের যন্ত্রপাতি। মাথার ওপরের লাল বাতিটা জ্বলছে-নিভছে। তারমানে ফোন বাজছে হেডকোয়ার্টারে।

দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে ট্রেলারে ঢুকে রিসিভার তুলে নিলো সে। হ্যালো, কিশোর পাশা কলছি।

হ্যালো, রাফায়েল সাইনাস বলছি। আমি ফোন করায় আশা করি কিছু মনে করোনি।

অবাক হয়ে ভাবলো কিশোর, কিভাবে খানিক পর পরই বদলে যায় সাইনাসের কণ্ঠস্বর। কাল রাতে কথা বলার সময় পুরনো কণ্ঠ ফিরে পেয়েছিলেন, এখন আবার মনে হচ্ছে পরাজিত, বিধ্বস্ত।

মোটেই না, জবাব দিলো কিশোর। বরং খুশি হয়েছি। জানতে ইচ্ছে করছে কাপ চোরকে ধরতে পেরেছেন কিনা।

না। পুরোপুরি পারিনি এখনও। সে-ব্যাপারেই তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছি। আবার পুরনো সুর খানিকটা ফিরে এলো। সাইনাসের কণ্ঠে। ফোনে এতো কথা গুছিয়ে বলা যাবে না। তুমি যদি দুপুরে একটু আগে আগে চলে আসে, তাহলে বলতে পারি।

আসবো। কটায় আসতে বলেন?

এই এগারোটা। রিসিপশন ডেস্কে আমার নাম বললেই হবে। একটু থামলেন। তোমার বন্ধুরাও আসছে?

না। একাই আসতে হবে আমাকে।

রিসিভার নামিয়ে রাখতে রাখতে খারাপই লাগলো কিশোরের, রবিন আর মুসাকে সঙ্গে নিতে পারছে না বলে। দুপুরে হলে পারতো, কিন্তু এগারোটায় নেয়া যাবে না। ওরা বাড়ি নেই। সৈকতে গেছে সাঁতার কাটতে। কিশোরকেও যেতে অনুরোধ করেছিলো। সে রাজি হয়নি। অনেক পথ সাইকেল চালিয়ে গিয়ে সাঁতার কেটে এসে ক্লান্ত হয়ে যাবে, শো-এর সময় অসুবিধে হবে।

রবিনের মাকে ফোন করলো সে। বলে দিলো, সে যথাসময়ে গাড়ি পাঠিয়ে দেবে, রবিন আর মুসাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। রবিনকে যেন বলে দেন তিনি। বিশেষ কারণে তাকে আগেই চলে যেতে হচ্ছে।

তারপর অ্যালউড হোফারকে ফোন করলো। ফোন ধরলো হোফারই। বললো তিরিশ মিনিটের মধ্যেই ইয়ার্ডে পৌঁছে যাবে।

গাঢ় রঙের স্যুট, সাদা শার্ট আর সুন্দর একটা টাই পরে এসে ইয়ার্ডের গেটে দাঁড়ালো কিশোর। গাড়ি এলো।

নীরবে চললো ওরা হলিউডের দিকে। একটা কথাও বললেন না হোফার। কিন্তু টেলিভিশন নেটওয়ার্ক অফিসের বিরাট বিন্ডিংটার সামনে গাড়ি রেখে যখন কিশোরের নামার জন্যে পেছনের দরজা খুলে দিলো সে, কিশোরের মনে হলো শোফার কিছু বলতে চায়। চত্বরে চুপ করে দাঁড়ালো সে, শোনার জন্যে।

কুইজ শের শুটিং দেখিনি কখনও, হোফার বললো। অনেক দর্শক উপস্থিত থাকে ওখানে, না?

হ্যাঁ, জবাব দিলো কিশোর। অন্তত শদুয়েক লোক তো থাকবেই।

দেখাটা নিশ্চয় খুব মজার, এক পা থেকে আরেক পায়ে শরীরের ভার সরালো হোফার। দ্বিধা করে বললো, বাড়তি টিকেট কি আছে আর?

আছে। চারটে টিকেট দিয়েছে বেকার, যদি পরিবারের কাউকে আনতে চায় কিশোর, সেজন্যে। রবিন আর মুসাকে দুটো দেয়ার পরেও আরও দুটো রয়ে গেছে তার কাছে, মেরিচাচী আর রাশেদ পাশার। তারা আসেননি। একটা রে করে দিলো সে।

অনেক ধন্যবাদ, বলে খুব আগ্ৰয়ে সঙ্গে টিকেটটা নিলো হোফার। আপনার বন্ধুদেরকে আগে নিয়ে আসি, তারপর শো দেখবে।

বাড়িটায় ঢুকলো কিশোর। মুখে চিন্তার ছাপ। ক্রমেই অবাক করছে তাকে অ্যালিউড হোফার। তার বয়েসী একজন লোক একদল, প্রাক্তন শিশু শিল্পীর বকবকানি শুনে কি মজা পাবে? কি জানি, কার যে কোন জিনিস কখন ভালো লাগবে, বলা যায় না। হোফরের ডানা আপাতত মন থেকে বিদায় করলো সে।

সোজা সাইনাসের অফিসে কিশোরকে পাঠিয়ে দিলো ডেস্কের রিসিপশনিস্ট। দরজার ওপরে লেখা রয়েছে গেস্ট ডিরেক্টরস। তাকে দেখে খুশি হলেন পরিচালক। ডেস্কে তাঁর মুখোমুখি বসলো কিশোর।

কাল রাতে ভিকটর সাইমন অনেক প্রশংসা করলেন তোমার,ঝলতে শুরু করলেন সাইনাস। যদি শুধু কিশোর বলে ডাকি তোমাকে কিছু মনে করবে?

আপনার বয়েসী অনেকেই আমাকে কিশোর বলে ডাকে, মনে করবো কেন?

গুড। সাইমন বললেন গোয়েন্দা হিসেবে তুমি নাকি অসাধারণ। অনেকগুলো জটিল রহস্যের সমাধান নাকি করেছে তুমি আর তোমার দুই বন্ধু মিলে।

মাথা ঝাঁকালে কিশোর।

সেজন্যেই আমার হঠাৎ মনে হলে, থেমে গেলেন পরিচালক। ওই কাপ চুরির ব্যাপারটা জানাজানি করতে চায় না স্টুডিও কর্তৃপক্ষ, সেজন্যেই পুলিশকে জানায়নি। আবার দ্বিধা করলেন তিনি। কাল রাতেই আমি ভেবেছি, এটা তোমাদের জন্যে একটা চমৎকার রহস্য হতে পারে। যদি চোটাকে ধরে দিতে পারে ছোটখাটো একটা পুরস্কারেরও ব্যবস্থা করতে পারি হয়তো।

তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে কিশোর বললো, পুরস্কারের চেয়ে কেসের ব্যাপারেই আমরা বেশি আগ্রহী।

গুড, সাদা পাতলা চুলে আঙুল চালালেন সাইনাস। কাউকে বলে দেবে না, শুধু এই বিশ্বাসের ওপর তোমাকে আমি বলছি, কিশোর, কাপগুলো কে চুরি করেছে, আমি জানি। যদিও এটা আমার সন্দেহ, তবে খুব জোরালো সন্দেহ।

চুপকরে অপেক্ষা করতে লাগলো কিশোর।

কাল রাতে সাউন্ড স্টেজ থেকে বেরোনোর সময় দেখলাম একটা লোক দৌড়ে যাচ্ছে দরজার দিকে। আমার পায়ের শব্দে চমকে গিয়ে নিশ্চয় দৌড় দিয়েছিলো। বাইরে তখন অন্ধকার, তবু কিছু কিছু দেখা যাচ্ছিলো। দেখলাম তরুণ বয়েসী একটা লোক ছুটে যাচ্ছে স্টুডিওর গেটের দিকে।

এবারও কিছু বললো না কিশোর।

ওর চেহারা দেখতে পাইনি, সাইনাস কললেন, তবে ওর চলাফেরাটা আমার কাছে বেশ পরিচিত লাগলো। পা নাড়ে অনেকটা চার্লি চ্যাপলিনের মতো। সেই ছেলেটা, যে চ্যাপলিনের অনুকরণ করতো, পাগল সংঘের ভারিপদ।

কাপগুলো রে করে নিতে এসেছিলো ভাবছেন? প্রথম প্রশ্নটা করলো কিশোর।

মাথা ঝাঁকালেন পরিচালক। তাছাড়া আর কি? আর তো কোনো কারণ থাকতে পারে না।

আর কোনো কারণের কথা কিশোরও ভাবতে পারলো না। কিন্তু তার দৌড়ে পালানোই প্রমাণ করে না যে ভারিপদই চোর।

তা করে না, তবে সন্দেহ করতে দোষ নেই, আবার আগের কণ্ঠস্বর পুরোপুরি ফিরে পেয়েছেন পরিচালক। সোজা হয়ে গেছে কাঁধ। একটা অনধিকার চর্চা করেছি। আমি জানি, আজ শনিবার, সাউন্ড স্টেজে শুটিং হবে না। কালও বন্ধ। সোমবারের আগে খুলছে না। এটা ভেবেই দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়ে এসেছি আমি।

পকেট থেকে একটা চাবি বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন তিনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ভারিপদই একাজ করেছে। আবার ফিরে যাবে স্টেজে, কাপগুলোর জন্যে। ও এখনও জানে না যে কাপগুলো যেখানে লুকিয়েছে সেখানে নেই।

ঠিক কাজই করেছেন আপনি, কিশোর বললো।

কর্তৃপক্ষ কড়া নির্দেশ দিয়ে দিয়েছে, ব্যাপারটা যাতে গোপন রাখা হয়। চাবিটা কিশোরের দিকে ঠেলে দিলেন তিনি। নাও। ভারিপদের ওপর চোখ রাখবে। হয়তো ওকে ফাঁদে ফেলার একটা বুদ্ধি বের করে ফেলতে পারবে। যা ভালো বোঝো করো। তো, এখন আমাকে তো মাপ করতে হয়। কিছু জরুরী কাজ সারার আছে।

চাবিটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো কিশোর।

সে বেরিয়ে আসার সময় আবার বললেন সাইনাস, ভারিপদর ওপর কড়া নজর রাখবে।

করিডরে বেরিয়ে ঘড়ি দেখলো কিশোর। শো শুরু হতে এখনও ঘন্টা দুই বাকি। লিফটে করে লবিতে নেমে এলো আবার সে। কোণের একটা সোফায় আরাম করে বসলো। রাস্তার দিকের দরজা খুলে লোক আসছে, যাচ্ছে। ঢুকে বেশির ভাগই এগিয়ে যাচ্ছে লিফটের দিকে, রিসিপশন ডেস্কের কাছে থামছে কেউ কেউ।

হঠাৎ সামনে ঢুকে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো কিশোর। যার ওপর চোখ রাখতে বলা হয়েছে তাকে, সে ঢুকলো। লিফটের দিকে হেঁটে চলে গেল ভারিপদ।

ভরিপদ উঠলো। বন্ধ হলো লিফটের দরজা। উঠে গিয়ে নির্দেশক বাতির দিকে তাকিয়ে রইলো কিশোর। কোন্ কোন্ তলায় থামছে লিফট, কতোক্ষণের জন্যে, বাতিই বলে দিচ্ছে পরিষ্কার।

কয়েকবার থামলো লিফট। বোঝার উপায় নেই, ভারিপদ নামলো কোন তলায়। ফিরে এসে আবার আগের জায়গায় বসলো কিশোর।

একটা কথা অবশ্য জেনেছে কিশোর, সতেরো তলায় কুইজ শো-এর শুটিং হওয়ার কথা, কিন্তু সেই তলায় থামেনি লিফট। স্টুডিওতে ঢোকেনি ভারিপদ, তারমানে এই বিল্ডিঙেই অন্য কারও সঙ্গে দেখা করতে গেছে সে। বলা যায় না, আবার ফিরে আসতে পারে লবিতে। কিশোর যেমন এসেছে।

যেখানে আছে সেখানেই বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো কিশোর। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। মিনিট পাচেক পরেই ফিরে এলো ভারিপদ। হেঁটে গেল তার সামনে দিয়ে। হাতে একটা খাম। বেরিয়ে গেল সে।

পিহু নিলো কিশোর। চতুরে বেরিয়ে দেখলো, একটা মোটর সাইকেলে উঠে স্টার্ট দিলো ভরিপদ। রওনা হলো ভাইন স্ট্রীট যেদিকে রয়েছে সেদিকে।

ট্যাক্সির আশায় এদিক ওদিক তাকালো কিশোর। কয়েক গজ দূরে একটা ট্যাক্সি থেকে নামছেন এক বৃদ্ধা মহিলা।

মহিলার ভাড়া মিটিয়ে দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো কিশোর, তারপর লাফ দিয়ে উঠে পড়লো পেহরে সীটে।

কোথায় যাবো? জিজ্ঞেস করলো ড্রাইভার।

সামনে ঝুঁকে আছে কিশোর, দ্রুত ভাবনা চলছে মাথায় ভারিপদ যদি স্টুডিওতে যায়ই, তাকে ওখানে অনুসরণ করে গিয়ে লাভ নেই। বরং তার আগেই গিয়ে যদি সাউড স্টেজের ভেতরে লুকিয়ে থাকতে পারে, তাহলে…

ড্রাইভারকে স্টুডিওর ঠিকানা বললো সে। মোটর সাইকেলটা এঞ্জিন খুব একটা জোরালো নয়, জোরে চালালে ওটার আগেই ভাইন স্ট্রীটে পৌঁছে যাবে ট্যাক্সি।

ঠিকই আন্দাজ করেছে সে। যাওয়ার পথে দ্বিতীয় ট্রাফিক সিগন্যালের কাছেই মোটর সাইকেলটাকে পেছনে ফেললো ট্যাক্সি। মাত্র দুই মাইল দূরে স্টুডিও, হলিউড বুলভারের পরেই।

স্টুডিওর গেটে নেমে ড্রাইভারের ভাড়া মিটিয়ে দিলো কিশোর। গার্ডকে পাস দেখাতেই পথ ছেড়ে দিলো। দ্রুত নয় নম্বর স্টেজের নির্জন বাড়িটার কাছে এসে দাঁড়ালো সে। চাবি দিয়ে তালা খুলে ভেতরে ঢুকলো।

পুরোপুরি অন্ধকার এখন বিশাল ঘরটা। সাথে টর্চ থাকলে ভালো হতো, তবে আফসোস করে নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই। যে কোনো মুহূর্তে এখানে পৌঁছে যেতে পারে ভারিপদ, যদি এখানেই আসার উদ্দেশ্য থাকে তার।

দরজাটা সামান্য ফাঁক করে রাখলো কিশোর, কিছুটা আলো যাতে আসতে পারে সেজন্যে। তবে খুব একটা সুবিধে হলো না। অনুমানে রান্নাঘরের দিকে এগোলো সে। বড় জোর মিটার দশেক এগিয়েছে, এই সময় দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ হলো। ফিরে তাকিয়ে দেখলো, ফাঁক বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো আলোই আসছে না এখন। বাইরে থেকে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।

অন্ধকারে যতোটা দ্রুত সত্ব, দরজার কাছে ফিরে এলো কিশোর। দরজায় ঠেলা দিলো। পালা খুললো না। আরো জোরে ধাক্কা লাগলো সে। অনড় রইলো পাল্লা। বাইরে খিল লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্ধকার, শব্দনিরোধক এই বাড়িতে আটকা পড়েছে সে। হাজার চিৎকার করলেও এখান থেকে বাইরে শব্দ যাবে না, সে-রকম করেই তৈরি করা হয়েছে এটা। সোমবার সকালের আগে স্টুডিওর কোনো কর্মীও ঢুকবে না এখানে।

এবং আর দেড় ঘন্টার মধ্যেই কুইজ শোর শুটিং শুরু হবে।

পুরো একটা মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে ভাবলো কিশোর। দ্রুত চলহে মগজ, তবে আতঙ্কে নয়। মনে মনে পরিকল্পনা তৈরি করফেমুক্তির।

প্রথমেই দরকার, আলো।

আগের দিন বিকেলের কথা মনে পড়লো তার। আর্ক লাইটগুলো জ্বলে ওঠার পর মাস্টার কন্ট্রোলের কাছ থেকে সরে আসতে দেখা গিয়েছিলো সাইনাসকে। কিশোররা যখন কাপগুলো খুঁজে পেয়েছে।

রান্নাঘরটা কোনদিকে আহে, অনুমান করে দেয়ালের ধার ঘেঁষে সেদিকে এগুলো সে। রান্নাঘরের সেটের শেষ মাথায়ই আছে মাস্টার কন্ট্রোল। অন্ধকারে হাতড়াতে লাগলো। মনে হলো, দীর্ঘ এক যুগ পর হাতে লাগলো ধাতব সুইচ বক্সটা। হুড়কো খুলে ডালা মেললো। ভেতরে আঙুল ঢোকাতেই হাতে লাগলো সুইচ হ্যান্ডেল। ধরে নামিয়ে দিলো নিচের দিকে।

আলোয় ভেসে গেল রান্নাঘর।

এখন দুই নম্বর কাজ, টেলিফোন।

মাত্র কয়েক মিটার দূরে রয়েছে ওটা। দেয়ালে ঝোলানো। এগিয়ে গিয়ে রিসিভার নামিয়ে কানে ঠেকালো সে।

মৃত। একেবারে ডেড হয়ে আছে টেলিফোন।

কিন্তু তাতেও নিরাশ হলো না গোয়েন্দাপ্রধান। সে আশাও করেনি টেলিফোনটা কাজ করবে। যে লোক তাকে এখানে আটকে রেখে গেছে, সে টেলিফোন চালু রেখে যাবে এতো বোকা নিয়ে নয়।

তিন নম্বর কাজ, ফোনটা ঠিক করা, সম্ভব হলে।

কোথায় লাইনটা কাটা হয়েছে, সহজেই খুঁজে পাওয়া গেল। মেঝের কাছাকাছি জায়গায়। তবে যে কেটেছে সে ভালোমতোই জানে কিভাবে কি করতে হবে। শুধু কেটেই ক্ষান্ত হয়নি, অনেকখানি জায়গার তার টেনে তুলে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে।

রান্নাঘরের পেছনে এখনও আছে হুতোর মিস্ত্রীর যন্ত্রপাতিগুলো। ভালো শক্ত একটা প্লয়ার্স পাওয়া গেল ওখানে। আর সাউন্ড স্টেজ-ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে যেখানে কারবার, সেখানে খানিকটা ভালো তার জোগাড় করাও এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। একটা স্পটলাইট থেকেই সেটুকু তার কেটে নিয়ে এলো সে।

দ্রুত হাত চালিয়ে ফোনের লাইনের সঙ্গে তারটা জোড়া দিয়ে ফেললো। রিসিভার তুলতে গিয়ে দুপ দুপ করছে বুক। কাজ হবে তো? বলা যায় না, বিন্ডিঙের বাইরেও কাটা হয়ে থাকতে পারে তার। তাহলে সর্বনাশ।

কিন্তু রিসিভার কানে ঠেকাতেই একটা মিষ্টি শব্দ কানে এলো তার। টেলিফোনে শব্দ সাধারণত বিরক্ত করে তাকে, কিন্তু এখন ডায়াল টোনের আওয়াজ শুনে মনে হলো জীবনে যতগুলো মধুরতম আওয়াজ শুনেহে এটা তার মধ্যে একটা।

স্টুডিওর সুইচবোর্ডে ফোন করে কাউকে আসতে বলতে পারে, নিশ্চয় বাড়তি চাবি আছে ওদের কাছে। কিন্তু ওরা এলে হাজারটা কৈফিয়ত দিতে হবে, প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। এখনই সব কিছু ফাঁস করে দিতে চায় না সে। নিজেদের মধ্যে, অর্থাৎ তিন গোয়েন্দার মধ্যেই আপাতত সীমাবদ্ধ রাখতে চায় ব্যাপারটা।

নিশ্চয় এতোক্ষণে সৈকত থেকে বাড়িতে চলে এসেছে মুসা। তাকেই ফোন করলো কিশোর। দ্বিতীয়বার রিং হতেই রিসিভার তুললো স্বয়ং মু। সংক্ষেপে তাকে বুঝিয়ে বললো কিশোর, কি ঘটেছে।

তারপর বললো, এখুনি অ্যালউড হোফারকে ফোন করে বলো তোমাকে এখানে নিয়ে আসতে। আমি দরজার নিচের দিকে একটা ফুটো করার চেষ্টা করছি, ওখান দিয়ে চাবি কে করে দেবো।

কিশোর রিসিভার রাখার পর আর একটা সেকেন্ড দেরি করলো না মুসা। হোফারকে ফোন করলো। তিরিশ মিনিটের মধ্যে ওদের বাড়িতে পৌঁছে গেল শোফার। রবিনকে ফোন করে আগেই আনিয়ে রেখেছে মুসা। তাড়াহুড়ো করে দুজনে উঠে বসলো গাড়িতে।

আর কিছু করার নেই দুজনের। এখন সব দায়দায়িত্ব ফোরের, লিজিন নিয়ে কতো তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারবে স্টুডিওতে। কিন্তু সে-ও যেন কিছু করতে পারছে না। শনিবারের হলিউডের রাস্তা, সাংঘাতিক ভিড়। যাই হোক, অবশেষে ভাইন স্ট্রীটে পৌঁছলো গাড়ি। দেখা গেল স্টুডিওর গেট।

গার্ড-বুদ থেকে বেরিয়ে এলো গার্ড, গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালো। হাত বাড়ালো, পাস দেখি?

পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো দুই সহকারী গোয়েন্দা। এই কথাটা তো একবারও মনে পড়েনি! পাস রয়েছে কিশোর পাশার কাছে।

বাটালির মাথায় হাতুড়ির শেষ আঘাতটা দিয়ে থামলো কিশোর। মেঝেতে নামিয়ে রাখলো যন্ত্র দুটো, তারপর পরিষ্কার করে ফেলতে লাগলো দরজার নিচ থেকে কাঠের কাটা চিলতেওলো। ওয়ে পড়ে চোখ রাখলো কাটা জায়গার কাছে, বাইরে তাকালো।

ঠিকই আছে। চাবি বের করে দেয়া যাবে। চতুর্থ কাজটাও সমাপ্ত। এখন মুসা এসে হাজির হলেই চাবিটা ঠেলে দেবে বাইরে।

ঘড়ি দেখলো কিশোর। দুটো বাজতে সতেরো মিনিট বাকি। এতো দেরি করছে কেন মুসা? এততক্ষণে পৌঁছে যাওয়ার কথা। শোফারের সঙ্গে কোনো গোলমাল হলো? নাকি অন্য কোনো কারণে আটকে গেছে?

অ্যালউড হোফারের রহস্যজনক আচরণের কথা পড়তেই অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করলো কিশোর।

গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে লিমুজিন।

পাস আছে আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করছে মুসা, কিন্তু ভুলে বাড়িতে ফেলে এসেছি। আমাদের চিনতে পারছেন না? গতকালও আমরা এসেছিলাম, পাগল সংঘের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্যে। আমাদের বন্ধু কিশোর পাশাকে তুলে নিতে এসেছি।

গম্ভীর মুখে মাথা নাড়লো গার্ড। আমি ওসব শুনতে চাই না। তাছাড়া আজকে বাইরের কারও আসারও কথা নয়, আমাকে ইনফর্ম রা হয়নি। পাস ছাড়া ঢুকতে দেবো না।

কি-কিন্তু, তোতলাতে শুরু করলো রবিন, আমরা…

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজা খুলে নেমে পড়লো হোফার। পেছনের রজা খুলে দিয়ে বললো, নামুন আপনারা।

ওরা নামতে আবার গার্ডের দিকে ফিরলো হোফার। এই গাড়িটা মিস্টার হ্যারিস বেকার ভাড়া নিয়েছেন, স্টুড়িওর বিজ্ঞাপন ম্যানেজার। তিনিই এদেরকে অনুমতি দিয়েছেন স্টুডিওটা ঘুরে দেখার জন্যে। আমাকে পাঠিয়েছেন দেখিয়ে নিয়ে যেতে।

কিন্তু মিস্টার বেকার তার অফিসে আছেন বলে তোর মনে হয় না…।

না, তিনি নেই। তাঁর সেক্রেটারি আমাদের কোম্পানিতে ফোন করেছিলো গাড়ি নিয়ে আসার জন্যে। দড়াম করে পেছনের ভোলা দরজাটা লাগিয়ে দিলো হোফার। তিনি কোথায় আছেন? দরজা লাগানোর সময় ফিসফিসিয়ে মুসাকে জিজ্ঞেস করলো সে।

নয় নম্বর। বাইরে তালা, ভেতরে আটকে আছে। দরজার নিচ দিয়ে চাবিটা রে করে দেবে বলেছে।

ফিরে এসে গার্ডের সামনে দাঁড়ালো হোফার। বললো, আমার যেতে তো কোনো বাধা নেই? আমি সেক্রিটারির কাছে যাচ্ছি। বলে আবার উঠে পড়লো গাড়িতে। তাকে আটকালো না গার্ড। হাত নেড়ে যাওয়ার ইশারা করলো।

গাড়িটাকে নয় নম্বর স্টেজের দিকে এগিয়ে যেতে দেখলো রবিন আর মুসা।

কিশোর ঠিকই আন্দাজ করেছে, রবিন ভাবলো, অ্যালউড হোফার লোকটা রহস্যময়।

তখনও দরজার নিচ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে কিশোর। আলো আসছিলো রজার নিচ দিয়ে, হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল সেটা।

মুসা? ডেকে জিজ্ঞেস করলো সে।

না, আমি অ্যালউড হোফার। চাবিটা দিন। দ্বিধা করলো কিশোর। এতোগুলো কাজ নির্বিঘ্নে সারার পর, এখন তীরে এসে তরী ডোবাতে চায় না ভুল লোকের হাতে চাবি দিয়ে। চাবিটা নিয়ে যে সরে পড়বে না হোর, তাকে সোমবার এখানে আটকে রেখে যাবে না তার বিশ্বাস কি? এমনও হতে পারে হোফারই তার পিছু নিয়ে এখানে এসেছিলো, তাকে আটকে রেখে গিয়েছিলো।

ঘড়ি দেখলো আবার কিশোর। দুটো বাজতে বারো মিনিট আছে আর। দ্বিধা করার সময় এখন নয়। ঝুঁকিটা নিতেই হবে। মনে মনে আশা করলো, হোফার যেন তার শক্ত না হয়।

দরজার নিচ দিয়ে চাবিটা ঠেলে দিলো, কিশোর। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।

খুলে গেল দরজা।

ফোঁস করে চেপে রাখা নিঃশ্বাস ছেড়ে উজ্জ্বল দিবালোকে বেরিয়ে এলো কিশোর।

বললো, থ্যাংক ইউ, মিস্টার হোফার।

জলদি চলুন, শোফার কললো। আপনার বন্ধুরা গেট দাঁড়িয়ে আছে। আশা করি দুটো নাগাদ পৌঁছে যেতে পারবো।

ঠিক দুটোয় পৌঁছতে পারলো না। এক মিনিট দেরি হয়ে গেল। গাড়ি থেকে নেমে টেলিভিশন নেটওয়ার্ক বিল্ডিংটার দিকে দৌড় দিলো কিশোর। দুর্টে এসে লিফটে উঠলো।

যে রুমে কুইজ শো শুটিঙের ব্যবস্থা হয়েছে, সেটার দরজা খোলা রয়েছে তখনও। একজন ইউনির্ফম পরা অ্যাটেনডেন্টকে বলতেই তাড়াতাড়ি কিশোরকে একটা ঘোরানো গলি পার করে স্টেজে পৌঁছে দিলো।

আদালতে জুরিরা যেরকম জায়গায় বসে, অনেকটা ওরকম একটা লম্বা কাঠের স্ট্যান্ডের কাছের চেয়ারে এনে কিশোরকে বসিয়ে দেয়া হলো। টাইয়ের সঙ্গে মাইক বেঁধে দেয়া হলো। বোকা বোকা ভঙ্গি করে ভারিপদের দিকে তাকালো সে, ওর চোখ দেখে বোঝার চেষ্টা করলো চমকে গেছে কিনা।

এসেছো,ভারিপদ বললো। দেরি করে ফেললে।

ভারিপদর মুখ দেখে কিছু বোঝা গেল না। একটুও অবাক মনে হলো না তাকে। দ্রুত অন্যদের মুখের ওপর চোখ বোলালো কিশোর। নেলিকেও অবাক লাগলো না। বরং কিশোর যে শেষ পর্যন্ত সময় মতো আসতে পেরেছে, তাতে যেন হাঁপ ছেড়েছে। এমনকি তাকে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ হাসিও উপহার দিলো।

শিকারী কুকুরকেও খুশি মনে হলো। খুশি মনে হলো হ্যারিস বেকারকে, যে এই শো- উদ্যোক্তা।

শুধু যে একটিমাত্র লোক তাকে দেখে সন্তুষ্ট হতে পারলো না, চোখাচোখি হতেও চোখ সরিয়ে নিলো আরেক দিকে, তার মাথাভর্তি লম্বা সোনালি চুল নেমে এসেছে করে ওপর।

মড়ার খুলি।

পাগল সংঘের প্রথম কুইজ শো শুরু হলো।

রসিকতা আর কিছু উষ্ণ হাসির মাধ্যমে দর্শকমণ্ডলীকে তাতিয়ে নিয়ে, কুইজের নিয়মকানুন কলতে শুরু করলো বেকার।

এক এক করে প্রশ্নের জবাব দেবে প্রতিযোগীরা। সঠিক জবাব দিতে পারলে পাঁচ নম্বর পাবে, প্রতি প্রশ্নের জন্যে। যদি কেউ কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে না পারে, এবং সেটা অন্য কেউ পেরে যায়, তাহলে যে দিতে পারবে সে পাবে পাঁচ। কিন্তু যদি অন্যের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে সেটা ভুল করে তাহলে নিজের নম্বর থেকে পাঁচ নম্বর কাটা যাবে।

প্রতিযোগীদের দিকে তাকিয়ে হাসলো বেকার। কাজেই, না জেনে অযথা নম্বর নষ্ট করো না, হুঁশিয়ার করলো সে।

ক্যামেরার দিকে তাকালে একবার বেকার, তারপর আবার ফিরলো স্টুডিওতে উপস্থিত দর্শকদের দিকে। কলতে লাগলো, কিছু কিছু কুইজ শোতে নিয়ম থাকে, প্রতিযোগী তার নিজের সাবজেক্ট পছন্দ করে নিতে পারবে। এই যেমন কোনো একটা নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর জবাব দিতে চায়ঃ ইতিহাস, খেলাধুলা, প্রাণীজগৎ কিংবা অন্য কিছু। কিন্তু এই প্রতিযোগিতায় তেমন কিছু থাকবে না, শুধু একটা বিষয়ের ওপর জবাব দিতে হবে, ঝিক করে উঠলো তার দাঁত। আর সেটা হলো, পাগল সংঘ।

উত্তেজিত ওজন শোনা গেল দর্শকদের মাঝে।

বেকার বললো, প্রতিটি প্রোগ্রামের শুরুতে পাগল সংঘ ছবির কিছু কিছু অংশ আমরা দেখাবো। মনিটরে আপনারও দেখতে পাবেন। স্টেজের এক কোণে রাখা দর্শকদের দিকে মুখ করে রাখা বড় একটা সিনেমা-পর্দা দেখালো সে। আর প্রতিযোগীরা দেখতে পাবে মাত্র একবার, এই যে এটাতে, আরেকটা পর্দা দেখালো সে। ওটা মুখ করে আছে পাগলরে দিকে।

মনে মনে বেশ উৎফুল হয়ে উঠেহেকিশোর। এইই ভালো হয়েছে। অন্য কোনো বিষয় পছন্দ করতে কলে, পছন্দ করতে গিয়ে বিপদেই পড়ে যেতে সে। কারণ কোনো বিষয়টা যে সে কম জানে নিজেরই জানা নেই। অসাধারণ স্মৃতিশক্তি তার। পর্দায় পাগল সংঘের ছবি দেখলে সব মনে থাকবে, সে নিশ্চিত, ভুল করবে না। একবার কেউ ভুল করলেই হয়, ভাবলো সে, সাথে সাথে সেটার জবাব দিয়ে নম্বরে এগিয়ে যাবে।

পাশে বসা প্রতিযোগীদের দিকে তাকালো সে। শুধুমড়ার খুলির মুখে হাসি।

তাহলে এবার শুরু করা যাক, বেকার বলছে। দেখি পাগলেরা কি করে। ইলেকট্রোনিক স্কোরবোর্ডের নিচের ডেস্কের ওপাশে সীটে গিয়ে বসলো সে।

শুরু হলো ছবি। পর্দার ওপর মনযোগ দিলো কিশোর।

গল্প নেই। টুকরো টুকরো অংশ তুলে এনে জোড়া দেয়া হয়েছে। লাফ দিয়ে একখান থেকে আরেকখানে চলে যাচ্ছে।

দেখা গেল, কেক বানানোর জন্যে ময়দা মাখাচ্ছে নেলি, তাতে বারুদ ঢেলে দিলো মাড়ার খুলি আর শিকারী কুকুর। ভারিপদর সাইকেলের চাকা থেকে বাতাস ছেড়ে দিহে শজারুকাঁটা। পাগলদেরই একজন মাঝবয়েসী লোক সেজে তার গাড়ি পাহারা দেয়ার জন্যে এক ডলার দিচ্ছে পাগলদের, গাড়িটাতে ভর্তি রয়েছে চোরাই রেডিও। মোটুরামকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়ে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে অন্য পাগলরা, বলছে একবাক্স চকলেট না পেলে ছাড়বে না। কান নাড়াতে নাড়াতে শজারুকাঁটার দিকে ছুটলো মড়ার খুলি। তাকে বাধ্য করলো ঘন হয়ে জন্মে থাকা বিহুটির মাঝখানে মাটি খুঁড়ে গুপ্তধন তুলতে। বিছুটি লেগে শজারুকাঁটার শরীর চুলকানো দেখে অন্য পাগলদের সে-কি হাসি। গাছ থেকে মোটুরামের বাঁধন খুলে তাকে নিয়ে পালালো নেলি…।

দুই মিনিট পরেই শেষ হয়ে গেল ছবি। আবার জ্বলে উঠলো স্টেজ আর অডিয়েন্সের ওপরের আলো। সারাক্ষণ হেসেছে দর্শকেরা, এখন জোর হাততালি দিয়ে ধীরে ধীরে শান্ত হলো। চেয়ারে বসা বেকারের ওপর স্থির হলো ক্যামেরার চোখ।

প্রথম প্রশ্ন করা হলো নেলিকে।

চওড়া হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলো বেকার, মোটরবাইকের চাকার বাতাস কে হেড়েছে?

কেউ না, জবাব দিলো নেলি। মোটরবাইক নয়, একটা সাধারণ সাইকেলের চাকা থেকে বাতাস ছেড়েছে শজারুকাঁটা।

হয়েছে। চিৎকার উঠলো দর্শকদের মাঝে।

স্কোরবোর্ডে নেলির নামের পাশে পাঁচ নম্বর লিখলো বেকার।

পরের প্রশ্ন মড়ার খুলিকে। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো সাইকেলের রঙ কি ছিলো।

একমুহূর্ত দ্বিধা করে জবাব দিলো সে, সবুজ।

আবার হাততালি দিলো দর্শকেরা।

এর পর শিকারী কুকুরের পালা। হ্যান্ডেলবারের কোন পাশে থ্রী-স্পীড গীয়ার?

দ্বিধা ভরে জবাব দিলো শিকারী কুকুর, ডান পাশে।

গুঞ্জন করে উঠলো দর্শকেরা। নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো কেউ কেউ।

চোখের পলকে হাত উঠে গেল কিশোরের। ভুল জবাব দিয়েছে বলে শিকারী কুকুরের দিকে চেয়ে দুঃখ প্রকাশ করলো বেকার। আরও দুজনে জবাব দিতে চেয়েছে, দুজনের দিকে তাকিয়েই হাসলো সে। কিশোরের দিকে ফিরে মাথা নাড়লো, বলো?

থ্রী-স্পীড গীয়ার ছিলো না ওটার, বোকা গলায় জবাব দিলো কিশোর। বোকার অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে।

রাইট।

হৈ হৈ করে উঠলো দর্শকেরা। কিশোরের নামের পাশে পাঁচ নম্বর যোগ হলো।

ভারিপদর পালা এলো।

সহজ প্রশ্ন। বটিসুন্দরীর ময়দায় কি ঢেলে দেয়া হয়েছিলো?

বারুদ।

ঠিক।

পাঁচ নম্বর এবং হালকা হাততালি পেলো ভারিপদ।

কিশোরকে চাঁদ দেখালো বেকার। সব চেয়ে কঠিন প্রশ্নটা করলো, গাছ থেকে মোটুরামকে মুক্ত করতে কটা গিট খুলতে হয়েছে বটিসুন্দরীকে?

কিশোর দেখলো, সে জবাব দেয়ার আগেই হাত উঠে গেহে নেলির। একবার ভাবলো, ভুল জবাব দিয়ে দেয় মেয়েটাকে পাঁচ নম্বর পাইয়ে। নাহ, মড়ার খুলি তাহলে পরের বারে তার চেয়ে এগিয়ে যাবে। চারটে গিগি-গিট, এমনভাবে বললো সে, যেন আন্দাজে ঠিক বলে ফেলেছে।

রাইট, বেকার মাথা ঝাঁকালো।

তুমুল হাততালি দিলো দর্শকরা। প্রথম রাউন্ড শেষ হলো। সবাই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, তবু ধীরে ধীরে পড়লো বেকার কে কতো নম্বর পেয়েছে। আসলে ক্যামেরায় বেশিক্ষণ চেহারা দেখাতে ভালো লাগছে তার।

দর্শকদের মাথার ওপর দিয়ে পেছনের কন্ট্রোলরুমের দিকে তাকালো কিশোর, যেখানে রয়েছেন রাফায়েল সাইনাস। মনিটরের পর্দার ওপর চোখ। খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাকে।

দর্শকদের পঞ্চম সারিতে বসেছে রবিন আর মুসা। পাশে অ্যালউড হোফার। তার কোলের ওপর রাখা একটা ক্লিপবোর্ড, হাতে কলম, কিছু টুকে নিচ্ছে ক্লিপবোর্ডে আটকানো কাগজে।

কিশোরের দিকে হাত নেড়ে তাকে উৎসাহ দিলো মুসা।

রবিনকে বার বার আড়চোখে ক্লিপবোর্ডের দিকে তাকাতে দেখে হেসে কাগজটা তার দিকে তুলে ধ্বলো হোফার। সে লিখেছেঃ

সাধারণ বাইসাইকেল
সবুজ
থ্রী-স্পীড গীয়ার নয়
বারুদ
চার

প্রতিযোগীরা জবাব দেয়ার আগেই আমি আন্দাজ করার চেষ্টা করেছি কি হবে, লেখার কারণ ব্যাখ্যা করলো হোফার। ভালোই পেরেছি দেখা যাচ্ছে। সবই ঠিক। প্রতিটি লেখার পাশে দেয়া টিক চিহ্নগুলো দেখালো সে।

দ্বিতীয় দফা প্রশ্ন শুরু হলো। নেলি আর মড়ার খুলির জবাব ঠিক হলো। আবারও ভুল করলো শিকারী কুকুর। কিশোরের আগে হাত তুলে ফেললো মড়ার খুলি, ফলে পাঁচটা নম্বর বাড়তি পেয়ে গেল ঠিক জবাব দিয়ে। ভারিপদও ভুল করলো, তবে এবারে আগে হাত তুলে ফেললো কিশোর। সে পেলো বাড়তি পাঁচ নম্বর।

প্রতি রাউন্ড প্রতিযোগিতার এই সময় নিয়ে নম্বর পড়ছে বেকার। পড়ার সময়ও সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকছে ক্যামেরার দিকে, হাসছে, রসিকতা কমছে দর্শকদের সঙ্গে তখনও ক্যামেরার দিকে চোখ।

পঞ্চম এবং শেষ রাউন্ডের শুরুতেও মড়ার খুলির চেয়ে পাঁচ নম্বর এগিয়ে রইলো কিশোর। নেলির চেয়ে দশবেশি। শিকারী কুকুর আর ভারিপদ প্রায় বাতিল হয়ে গেছে।

প্রশ্ন শুরু হলো। নেলিকে জিজ্ঞেস করলো বেকার, আগন্তুকের গাড়ির সন্দেহজনক ব্যাপারটা কি?

গাড়ি বোঝাই চোরাই রেডিও।

ঠিক। বটিসুন্দরী আরও পাঁচ নম্বর পেলো।

দর্শকদের হাততালি।

মড়ার খুলিও পাঁচ নম্বর পেলো।

শিকারী কুকুরকে একটা সহজ প্রশ্ন করা হলো এবারে। গাড়ির ওপর চোখ রাখার জন্যে কয় ডলার দেয়া হয়েছিলো?

এক ডলার।

ঠিক আছে।

মৃদু হাততালি।

এবারে এমনকি ভারিপদও সঠিক জবাব দিয়ে ফেললো। আগন্তুক সেজে আসা লোকটার নাম পাগল সংঘে কি ছিলো, জিজ্ঞেস করা হয়েছে তাকে। বলে দিলো, জনাব গণ্ডগোল।

এরপর কিশোরের পালা। প্রথম কুইজ শোর শেষ প্রশ্ন। জনাব গণ্ডগোল সেজেছিলো যে তার নাম কি?

প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি বেকারের। কারণ মনিটরে দেখানো ছবির সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই, ছবিতে কোথাও বলা হয়নি অভিনেতার নাম। বহু বহুর আগে অভিনয় করেহে কিশোর, তখন বয়েসও ছিলো তার খুবই কম, অভিনেতার নাম যদি মনে করতে না পারে তাকে দোষ দেয়া যাবে না, অথচ বেকারের এই ভুলের জন্যে পাঁচটা নম্বর হারাতে হবে তাকে।

জোরে জোরে হাত নাড়ছে নেলি আর মড়ার খুলি।

মাথা চুলকে মনে করার ভান করলো কিশোর। না জানার অভিনয় করে মড়ার খুলিকে বোকা বানাতে চাইছে। একটা মিউজিয়মে ডাকাতির তদন্ত করেছে তিন গোয়েন্দা, তখন পরিচয় হয়ে যায় ওই বয়স্ক অভিনেতার সঙ্গে, যে জনাব গণ্ডগোল সেজেছিলো পাগল সাথে। নামটা পরিষ্কার মনে আছে কিশোরের। কলবে কি বলবেনা ভাবতে ভাবতে বোকার হাসি হেসে বলেই ফেললো, ড্ডি-ড্ডি-ড্ডি-গার হ্যানসন।

রাইট।

উন্মাদ হয়ে গেল যেন দর্শকেরা। তুফুল হাততালি আর হৈ-হট্টগোল।

শো শেষ। মড়ার খুলির চেয়ে পাঁচ নর এগিয়ে রয়েছে কিশোর। সারি দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলো দর্শকেরা। পরদিন দুপুরে ঠিক দুটোয় আবার এখানে হাজির হওয়ার অনুরোধ জানালো প্রতিযোগীদেরকে বেকার।

নেলির মুখ কালো। বেরিয়ে গেল সে। সেদিকে তাকিয়ে দুঃখই হলো কিশোরের, মেয়েটার জন্যে কিছু করার ইচ্ছে হলো তার। কিন্তু কি করবে? সে হয়েছে তৃতীয়, দ্বিতীয় হলেও নাহয় কিছু করা যেতো। ইচ্ছে করে ভুল করে মড়ার খুলিকে জিতিয়ে দেয়ার কোনো ইচ্ছেই তার নেই। মড়ার খুলিকে হারাতে এখন তাকেই জিততে হবে।

প্রায় শূন্য হয়ে গেল অডিটোরিয়াম। দর্শকরা বেরিয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে থাকা দুই সহকারীর দিকে এগোলো কিশোর। স্টেজ পেরোনোর আগেই যেন স্প্রিঙের মতো ঝটকা দিয়ে হুটে এলো একটা হাত। খামছে ধরলো কিশোরের বাহু। কঠিন কণ্ঠে কললো, হুঁশিয়ার থেকো, মোটুরাম। তোমাকে আমি ভালো করেই চিনি। তোমার গোয়েন্দাবাহিনীর খবরও রাখি। বোকার ভান করে আমাকে ফাঁকি দিয়ে বিশ হাজার ডলার ছিনিয়ে নিতে আমি দেবো না তোমাকে কিছুতেই।

ফিরে তাকালে কিশোর। তার বাহুতে আরও শক্ত হলো মড়ার খুলির আঙুল। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, এখনও সময় আছে, কেটে পড়ো। আমার পথে কাঁটা হয়ো না, নইলে,কথাটা শেষ না করেই হঠাৎ হাত ছেড়ে দিয়ে গটমট করে হাঁটতে শুরু করলো সে।

ঘোরানো বারান্দায় কিশোকের জন্যে অপেক্ষা করছে মুসা আর রবিন। হোফার চলে গেছে গাড়ির কাছে।

মড়াটা কি বললো? জানতে চাইলো মুসা।

জবাব দিলো না গোয়েন্দাপ্রধান। রবিনকে কললো, রবিন, তুমি তো হোফারের পাশে বসেছিলে।

হ্যাঁ। তাতে কি?

ক্লিপবোর্ডে কি লিখছিলো?

তেমন কিছুনা। আগেই আন্দাজ করার চেষ্টা করেছে প্রশ্নের জবাব।

জবাবগুলো দেখেছো? ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো কিশোর। তার কণ্ঠস্বরেই বুঝে ফেললো রনি, কোনো একটা সুর পেয়ে গেছে গোয়েন্দাপ্রধান।

নিশ্চয়ই। সে নিজেই দেখিয়েছে। একটা বাদে সবগুলোর জবাব ঠিক হয়েছে।

কোনটা? আগ্রহে সামনে ঝুঁকে পড়লো কিশোর। ডিগার হ্যানসনের নাম? ওটা ভুল করেছে তো?

না, মাথা নাড়লো রবিন। জনাব গণ্ডগোলের গাড়িটা কেমন, সেটা ভুল করেছে। আর ডিগারহ্যানসনের নাম তো তুমি বলার অনেক আগেই লিখে রেখেছিলো।

রবিনের মুখের দিকে দীর্ঘ একমুহূর্ত তাকিয়ে থেকে মাথা ঝাঁকালো কিশোর। রবিন আর মুসা তাকে জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করলো, কিছু বুঝতে পেরেছে কিনা, কিন্তু সুযোগই দিলো না সে। হোফারের লেখার ব্যাপারে কেন আগ্রহী হয়েছে, সে-ব্যাপারে কিছুই বললো না ওদেরকে।

লিস্ট থেকে নেমে লবি পেরিয়ে বাইরে বেরোনোর পর আবার কথা বললো কিশোর। জবাবগুলো ঠিকমতো লিখতে পেরেছে তার কারণ, ছবিগুলো সে দেখেছিলো। বুদ্ধিমান লোক সে। কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না, চুপ হয়ে গেল সে।

কী? একইসাথে প্রশ্ন করলো দুই সহকারী।

বলো কিশোর, রকিন শুরু করলো, শেষ করলো মুসা, রহস্যটা কি?

রহস্যটা হলো, অনেক দূর থেকে যেন ভেসে এলো কিশোরের কণ্ঠ, পাগল সংঘের ব্যাপারে একজন সাধারণ শোফারের আগ্রহী হওয়ার কারণ কি?

যাদেরকে সন্দেহ করি, কিশোর কললো। এক নম্বর, একটা আঙুল তুললো সে, ভারিপদ।

হেডকোয়ার্টারে আলোচনায় বসেছে তিন গোয়েন্দা। টেলিভিশন স্টেশন থেকে ফিরে সোজা এসে ঢুকেছে এখানে।

ভারিপদ,আবার বললো কিশোর, তার সম্পর্কে কি কি জানি আমরা?

জবাব পেলো না সে। আশাও করেনি পাবে। আসলে মনে মনে না ভেবে জোরে জোরে ভাবছে। ধরে নিতে পারি কাপগুলো সে চুরি করেছিলো। চুরি অবশ্য অন্যেরাও করে থাকতে পারে। টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা। কিচেন সেটের কাছে অনেক লোক ছিলো, ওয়েইটার, ইলেকট্রিশিয়ান, ক্যামেরাম্যান। যে কেউই রান্নাঘরের পেছন দিয়ে ঘুরে গিয়ে কাপগুলো সরিয়ে থাকতে পারে। দুই-তিন মিনিটের জন্যে আমাদের কেউ ওখান থেকে সরে থাকলেও কারো নজরে পড়ার কথা ছিলো না।

মড়ার খুলি, সামনে ঝুঁকলো রকিং চেয়ারে বসা মুসা। ওই ব্যাটাকেই আমার সন্দেহ।

হাত তুললো কিশোর, বুঝিয়ে দিলো, রাখো, আগে আমার কথা শেষ করি। ভারিপদকে নিয়ে আলোচনা শেষ করি, তারপর অন্যদের কথা। রাফায়েল সাহ সন্দেহ আরিপদকে। রাতের বেলা ওকে নয় নম্বর স্টেজের কাছে ঘুরঘুর করতে দেখেছেন তিনি। তার ধারণা, চোরাই কাপগুলো বের করে নিতে এসেছিল ভারিপদ। তাঁর দেখে সরে পড়েছে। তাঁর অনুমান ছিলো, আবার গিয়ে ওখানে হানা দেবে সে। হয়তো ঠিকই আন্দাজ করেছেন। আজ সকালে, এগারোটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে মোটর সাইকেলে করে স্টুডিওর দিকে রওনা হয়েছিলো সে। আমি তার পিছু নিয়ে তার আগেই ওখানে পৌঁছুলাম। আমাকে স্টেজের ভেতরে ঢুকতে দেখে বোধহয় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলো ভারিপদ, বাইরে থেকে তালা আটকে দিয়েছিলো…

পরিষ্কার হচ্ছে, মাথা দোলালো রবিন।

হয়তো। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। হেঁড়া সূত্রের অনেকগুলো মাথা জোড়া দেয়া বাকি এখনও। কারণ, তার মনে হচ্ছে, যে-ই তাকে স্টেজের ভেতরে আটকেছে, মোটেই আতঙ্কিত হয়ে নয়, অন্য কোনো জোরালো কারণ ছিলো। তাকে কুইজ শো থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যে হতে পারে। আর কুইজ শোতে জেতার ব্যাপারে ভারিপদর কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। জিততে পারবে একথা নিশ্চয় ভাবেওনি সে।

কাকতালীয় ঘটনা ঘটেছে, এটাও বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর। মোটর সাইকেলে চড়ে ভারিপদর স্টুডিওতে যাবার ব্যাপারটা কাকতালীয় হতে পারে না।

দুই নম্বর সন্দেহ, দুটো আঙুল তুললো কিশোর।

মড়ার খুলি, বলে দিলো মুসা।

হ্যাঁ, মড়ার খুলি। ওই ব্যাটা যথেষ্ট সেয়ানা। লোভী। টাকার জন্যেই এই কুইজ শোর ধারণাটা হারিস বেকারের মাথায় ঢুকিয়েছে কিনা কে জানে? শুধু আলোচনার জন্যেই একশো ডলারের জন্যে কি-রকম চাপাচাপি করছিলো। বাজি জেতার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠছে। আমার অভিনয় বুঝে ফেলেছে সে, আমার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছে।

কি করে জানলে? রকিন জিজ্ঞেস করলো।

শো-এর শেষে আমাকে ধরেছিলো ব্যাটা, অন্যমনস্ক হয়ে গেল কিশোর। কোথায় যেন ছিলাম? ও, হ্যাঁ। সুতরাং মড়ার খুলি যদি আমাকে দেখেই থাকে নয় নম্বর স্টেজের দিকে যেতে, তাহলে কেন একজন বিপজ্জনক প্রতিযোগীকে সরিয়ে রাখার সুযোগটা গ্রহণ করবে না? এবং শেষ মুহূর্তে যখন শো-এর স্টেজে হাজির হয়ে গেলাম, আমাকে দেখে তার চমকে যাওয়াটাও স্বাভাবিক। তাকে দেখে যে অস্বস্তি বোধ করছিলো মড়ার খুলি, সেকথা ভাবলো কিশোর। কিন্তু তখন মুভি স্টুডিওতে কি করছিলো সে ভারিপদর সঙ্গে একই সময়ে?

কোনোভাবে চলে গিয়েছিলো আরকি, রবিন বললো, তাই না?

না, জোরে মাথা নাড়লো কিশোর। কাকতালীয় ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয় না আমার।

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ভালো সে। তারপর তিনটে আঙুল তুললো, সন্দেহ নম্বর তিন, আলউড হোফার।

উঁইঁ, এবার মাথা নাড়লো রবিন, আমার তা মনে হয় না। ওই লোকটার চোরের মতো স্বভাব নয়।

হয়তো। মনে মনে রবিনের সঙ্গে একমত হলেও মুখে বললো, তবে দেখে চোরের মতো না লাগলেও চোর হবে না এমন কোনো কথা নেই। আলোচনা প্রশ্ন আগে তাকে দেখেছি আমি। কাপ আর অব্যবহৃত আর্ক লাইটগুলো যেদিকে ছিলো সেদিকে গিয়েছিলো সে। পাগল সংঘের ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে সে। কুইজ শো দেখার জন্যে টিকেট চেয়ে নিয়েছে আমার কাছ থেকে। হাতে ক্লিপবোর্ড নিয়ে এসে বসেছে শো দেখতে, প্রশ্নের জবাব লিখেছে প্রতিযোগীরা জবাব দেয়ার আগেই। মনে থাকার কথা নয় এরকম একজন অভিনেতার নাম মনে রেখেছে। পাগল সংঘের ব্যাপারে এতো আগ্রহ, অথচ এটা আবার বুঝতে দিতে চায় না কাউকে। নয় নম্বর স্টেজ যে চেনে, সেটা জানতে দিতে চায়নি, থেমে গেল কিশোর। তাকালো দুই সহকারীর দিকে। আমার বিশ্বাস অনেক কিছুই জানে সে, যা হয়তো আমরা জানি না।

হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে লাফিয়ে উঠলো মুসা, ওরেব্বাবা, চারটে বেজে গেছে!

টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি ফুটলো কিশোরের চোখে। এখন পাগল সংঘ সিরিজের আরেকটা ছবি দেখানোর কথা। মোটুরামের দিকে তাকিয়ে আবার কষ্ট পাওয়ার পালা কিছুক্ষণ। তবে আগামী দিনের কুইজ শোর ব্যাপারে কিছু সাহায্যও করতে পারে ছবিটা। প্রতিযোগী হিসেবে হব্বি প্রতিটি দৃশ্য খুঁটিয়ে দেখা এখন তার হোমওয়ার্ক বলা চলে।

ও-কে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো কিশোর, রবিন, টিভিটা ছেড়ে দাও।

বিজ্ঞাপন দেখা গেল পর্দায়। সেটা শেষ হতেই মোটুরাম উদয় হলো, অনুরোধ করলো সে, নিয়ে তলো, প্রীত, নিয়ে তলো আমাকে!

অন্য পাগলরা সবাই মাথা নাড়লো। আইসক্রীম কিনতে শহরে যাচ্ছে ওরা। একটা বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ওদের নেই।

কিন্তু ওকে এখানে একা ফেলে যাই কি করে, নেলি বললো। বেচারা।

বেশ, তাহলে থাকো তুমি ওর সাথে,মড়ার খুলি বললো।

কিন্তু নেলি থাকতে চায় না। অবশেষে ঠিক হলো ওদের জন্যে অনেক আইসক্রীম নিয়ে আসা হবে।

আত্থা,মোটুরাম বললো, এনো তাহলে। অনেক, অনেক বেতি আইতক্রীম।

মড়ার খুলি আর শজারুকাঁটা রওনা হলো। পথে শজারুকে ফাঁকি দিয়ে আরেক দিকে চলে গেল মড়ার খুলি। কি আর করে বেচারা শজারু, মনের দুঃখে ফিরে এলো আবার।

এই ছবিটাতেই রয়েছে জনাব গণ্ডগোল আর তার গাড়িভর্তি চোরাই রেডিও। গাড়ি পাহারা দিতে রেখে গিয়েছিলো কয়েক পাগলকে। আর বিনিময়ে দিয়েছিলো একটা ডলার। সেই টাকা দিয়েই আইসক্রীম কিনে খাওয়ার কথা। পুরনো পিয়ার্সঅ্যারো কনভার্টিবল গাড়িটা ঘিরে দুষ্টুমি কহে পাহারাদাররা, একে অন্যের পিছে লাগছে, আর জনাব গণ্ডগোল গেছে ফোন করতে, এই সময় এলো পুলিশ। পাহারাদার পাগলদেরকেও থানায় ধরে নিয়ে গেল।

যাই হোক, ফিরে এসে রান্নাঘরে নিজেই আসক্রীম বানাতে কালো শজারুফাটা। তাকে সাহায্য করলো মোটুরাম। তাকে চিনি আনতে বললে আনে নুন, ময়দার কথা বললে আনে সুজি। ভালোই জমিয়েছে।

ওদিকে পুলিশের কাছ থেকে আবার গাড়িটা চুরি করে নিয়ে পালালো জনাব গণ্ডগোল। তাড়া কালো পুলিশ। ওদের গাড়িতে বসে আনন্দে চেঁচাতে লাগলো পাগলেরা।

উঠে গিয়ে টিভি বন্ধ করে দিলো কিশোর।

এতৃহে, এটা কি করলে? প্রতিবাদ জানালো মুসা। জনাব গণ্ডগোলকে ধরতে পারবো কিনা সেটাই দেখতে দিলে না।

ধরতে পারবে না, কিশোর কলো। একই অভিনেতাকে আরেকবার ব্যবহার করতে চেয়েছে পরিচালক। আরেকটা সিরিজে শজারুকাঁটাকে ভাড়া করে জনাব গণ্ডগোল, একটা কুকুর চুরি করার জন্যে। কাজেই কামনা করে তাকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতেই হয়েছে পরিচালককে।

রিসিভার তুলে একটা নম্বরে ডায়াল করলো সে। হালো, মিস্টার হোফার?…কিশোর পাশা-কাছি। এবার আসতে পারবেনইয়ার্ডে?…হ্যাঁ হ্যাঁ, যতো জলদি পারে।

আবার কোথায় যাচ্ছি? কিশোর রিসিভার রাখলে জিজ্ঞেস করলো রবিন।

কোথাও না, আনমনে বললো কিশোর। কাপওলো কে চুরি করেছে এটা জানতে হলে একজন বন্ধু দরকার আমাদের, যাতে কেউ সন্দেহ করবে না।

আর কোনো প্রশ্ন ব দিলো না সে। হেডকোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে এলো ওরা।

গেটের কাছে এসে থামলো লিমুজিন। নিলামে পুরনো মাল কিনতে গেছেন মেচিাচী আর রাশেদ চাচা। হোফারকে ঘরে ডেকে নিয়ে এলো কিশোর।

খোলামেলা সুর রান্নাঘরটায় কালো ওর। চুলায় কফির পানি চাপলো কিশোর। হোফারের জনে। তিন গোয়েন্দর জন্যে বের করলো সোডার বোতল।

কুইজ শো দিয়ে আলোচনা শুরু করলো কিশোর। গাড়িটা কান্ত্র তৈরি সেটা আমাকে বলেনি ওরা, বেঁচেছি। আমি জানি না এর জবাব।

জানেন না? অবাকই মনে হলো যেন হেফারকে। সব প্রশ্নের উত্তরই তো দেখলাম জানা আপনার।

যা, কিশোর কালো। তবে গাড়ির দৃশ্যটায় আমি ছিলাম না। মড়ার খুলি, শিকারী কুকুর আর অন্যেরা ছিলো। আমার মনে হয় গাড়িটা কার তৈরি সেটা মিস্টার সাইনাসকে জিজ্ঞেস করেছিলো মড়ার খুলি, সেজন্যেই বলতে পেরেছে ওটা পিয়ার্সঅ্যারো। কিন্তু ওই গাড়িটা তখন আমি দেখিইনি।

হ্যাঁ, তা ঠিক, শোফার বললো। আপনি ডাকার আগে এই ছবিটাই দেখছিলাম। হাসলো সে। আপনি আর শজারুকাঁটা ঘরে বসে আসক্রীম বানাচ্ছিলেন।

পানি ফুটেছে। কাপে ঢেলে তাতে কফি আর চিনি মিশিয়ে হোফারের দিকে ঠেলে দিলো কিশোর। জিজ্ঞেস করলো, পুরনো এই সিরিজটা বুঝি খুব পছন্দ আপনার?

শ্রাগ করলে হোফর। ঠিক পছন্দ করি বলা যাবে না। বেশি ভাড়ামি। তবে মাঝে মাঝে বেশ হাসায়।

ঠিকই বলেছেন, ভাড়ামি বেশি। তবে পরিচালওে উদ্দেশ্য ছিলো সেটাই, তাই না? আমাদেরকে বেশি বেশি পাগলামি করতে বলেছেন, ছবির নামের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্যে। মড়ার খুলিকে দিয়ে কান নাড়িয়েছে। কুকুরের মতো জিভ বের করে রাখতে বলেছেন শিকারী কুকুরকে। আমাকে বলেছেন জিভে জড়িয়ে কথা ঝলতে। ভারিপদর পায়ের পাতা এমনিতেই বড়, তার ওপর বড়দের জুতো পরিয়েছেন। শজারুকাঁটার চুল খাড়াই, স্পেশাল কিছু করতে হয়নি তার জন্যে। তবে তাকে সুর করে কথা বলতে বলা হয়েছে মামি বোঝানোর জন্যে।

এক মুহূর্ত থামলো কিশোর। তারপর শজারুকাঁটার স্বর অবিকল নকল করে একটা সংলাপ বললো।

হেসে উঠলো হোফর। দারুণ করতে পারেন তো!

টেবিলে দুই রেখে সামনে ঝুঁকলো কিশোর। এখন এসব শুনলে রাগ লাগে, এত্তে ন্যাকামি। তাই না? অন্তত আমার লাগে।

তা কিছু কিছু যে লাগেনা তা নয়,কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাটা নামিয়ে রাখলো থোফর। চলুন, যওয়া যাক। কোথায় কেন?

আপাতত কোথাও নয়। হাত ঝড়িয়ে দিলে কিশোর। নি, হাত মেলান।

হাঁ করে তাকিয়ে রইলো মুসা আর রবিন। কি কলহে কিশোর? কি সুতে চাইছে?

হাতটা বাড়িয়েই রাখলে কিশোর, যতক্ষণ না হোফার তার সঙ্গে হাত মেলালো। তারপর হাসি হাসি গলায় কালো গোয়েন্দাপ্রধান, তোমর সঙ্গে আবার দেখা হওয়ায় খুব খুশি হলাম, শজারু। তুমি করে বললাম, আশা করি কিন্তু মনে করোনি। আগেও তো তুমি করেই বলতাম।

১০

চিনেই ফেললে তাহলে, হেফার কললো। অন্য পাগলদের চেয়ে আমাকে নাকিই বলতে পারো, অন্তত মড়ার খুলির চেয়ে তো বটেই। আমার মা নাম সিনেমায় কক্ষণো ব্যবহার করিনি। তাছাড়া কথা বলতাম সুর করে। অভিনয় ছেড়ে দেয়ার পর চুল লম্বা করে ফেললাম, ফলে কাটার মতো আর দাঁড়িয়ে থাকলো না, অনেক নুয়ে পড়লো। আমার আসল গা এনে শজাগল বলে বুঝতে পারলো না কেউ। চিনতে পারলো না। কাজেই ইস্কুলে কোনো অসুবিধে হয়নি আমার।

তাকে আরেক কাপ কফি ঢেলে দিলো কিশোর। রবিন আর মুসা অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলে, হেফারের গল্প শোনার জন্যে।

অভিনয় করে যা আয় করেছিলাম, সব জমিয়ে রেখেছিলো আমার বাবা,ফোর বললো আবার। পড়ার খরচের অভাব হলো না। মাথাটাও মোটামুটি ভালো। ষোলো বছর বয়েসে ইস্কুল শেষ করে ভর্তি হলাম টীচার্স কলেজে। পাস করে এখন মন্টারি করছি।

টেবিলের ওপর দিয়ে ওপাশে বসা কিশোরের দিকে তাকালো সে। কাজটা আমার ভালো লাগে। ছাত্র সামলানো খুব কঠিন, তবে ওরা আমাকে বেশি বিরক্ত করে না। মানিয়ে ফেলেছি। ফলে অসুবিধে হচ্ছেনা।

তিক্ত হাসি হাসলো সে। যখন আবার পাগল সংঘ দেখাতে শুরু হলো, ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। যদি আমার ছাত্ররা জেনে যায় আমি শজারুকাঁটা, আমার জীবন অতিষ্ঠ কর দেবে তাহলে। বালি ভেঙাবে। মুখ ভেচে বে হয়রে কপাল, ঘরে এতে কাজ একা আমি কি করে সারবো! শজারুকাঁটার মতো সুর করে সংলাপ বললো সে। কিছুক্ষণ আগে এটাই বলেছিলো কিশোর। ওর জেনে গেলে ওই ইস্কুলে আর ঢুকতে পারবো না জীবনে।

হোফরের মনের কষ্ট বুঝতে পারছে কিশোর। গরমের ছুটির আগের তিনটে হণ্ডা তার ওপর দিয়ে যা গেছে, হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে যন্ত্রণা কাকে বলে।

ভয় পেয়েছি বটে, হোফার বলতে লাগলো, পুরনো দিনের কথা ভেবে আনন্দও পেয়েছি। অবাক হয়ে ভেবেছি অন্য পাগলদের কি হলো? ওরা কি করছে? দুই বছর ধরেই ইস্কুল ছুটির সময় ইজি-রাইড কোম্পানিতে পার্ট টাইম চাকরি করি, ছুটির সময় কিছু বাড়তি আয় হয়। অনেক রকমের লোক গাড়ি ভাড়া নেয়া। এদের মধ্যে স্টুডিওর লোকও আছে। কাজেই মাঝে স্টুডিওতেও নিয়ে যেতে হয় ওদেরকে। যখন শুনলাম পাগলদের আবার একখানে করা হচ্ছে, দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। আরেকজন ড্রাইভারের সঙ্গে ডিউটি বদল করে নিলাম, যাতে স্টুডিওতে ঢুকে পালদের দেখতে পারি।

স্টুডিওতে যখন যাও, কিশোর কললো, জায়গা তো তোমার চেনা। তাহলে নয় নম্বর স্টেজের কথা জিজ্ঞেস করছিলে কেন সেদিন?

অনেক বড় জায়গা, হোফার বললো। মস্ত এলাকা। সব জায়গা সবাই চেনে না। তাছাড়া সেই ছেলেবেলায় গিয়েছি নয় নম্বরে, তা-ও একা নয়, বাবা গাড়িতে করে পৌঁছে দিতো আমাকে। তারপর আর যাইনি। ভুলে গেছিলাম স্টেজটা কোনদিকে।

কফিতে চিনি মিশিয়ে আবার কিশোরের দিকে তাকালো হোফার। ভাবতে পারিনি আমাকে কেউ চিনে ফেলবে। অভিনয় ছাড়ার পর স্টুডিওর কেউ আর খোঁজ করেনি আমার, আমিও নিখোঁজ হয়ে থাকার চেষ্টা করেছি। ফলে বেকার আমাকে খুঁজে বের করতে পারেনি। জানেই না আমি কোথায় আছি, কেমন আছি।

চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রেখে বললো সে, তবে তুমি যে এতোটা চালক হয়ে গে, ভাবতে পারিনি।

চালাক না, সৌজন্য দেখিয়ে বললো কিশোর, আসলে লাকিলি চিনে ফেলেছি তোমাকে। যদিও মনে মনে খুব ভালো করেই জানে সে, বুদ্ধির জোরেই শজারুকাঁটাকে চিনতে পেরেছে। রবিনের দেয়া সূত্র থেকেই বুঝে ফেলেছে, হেফার আর কেউ নয়, শজারুকাঁটা। সেজানে না ওটা কি গাড়ি ছিলো। কিশোরও জানে না। ওরা দুজনই একমাত্র তখন অন্য জায়গায় ছিলো, যখন গাড়িটাকে নিয়ে যায় পুলিশ। হোফার জনাব গণ্ডগোলের আসল নাম জানে, তার কারণ হ্যানসনের সঙ্গে পরিচয়, হয়েছে কুকুর চুরি করার অভিনয়ের সময়। একসাথে কাজ করেছে কয়েক দিন। সব সূত্র খাপে খাপে জোড়া লাগিয়েই নিশ্চিত হয়েছে কিশোর, অ্যালউঙ হোফার শজারুকাঁটা ছাড়া আর কেউ নয়।

আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দেবে? অনুরোধ করলো কিশোর।

বলো।

সেদিন রান্নাঘরে যখন আলোচনার শুটিং হচ্ছিলো, তোমাকে পেছনের আর্কলাইটগুলো কানে যেতে দেখেছি। কেন গিয়েছিলে?

ও, সেটাও দেখে ফেলেছে, হাসলে হোফার। সিনেমার টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো নিয়ে সব সময়ই একটা কৌতূহল আছে আমার। এমনকি যখন শজারুকাঁটার অভিনয় করতাম, তখনও ছিলো। ফলে লাইট আর যন্ত্রপাতিগুলো দেখে আর লোভ সামলাতে পারিনি।

হুঁ, বুঝলাম, হাসছে কিশোর। একবার তো আমি সন্দেহই করে বসেছিলাম, তুমিই কাপগুলো চুরি করে রিফ্লেকটরের বাক্সে লুকিয়েছে।

না, আমি লুকাইনি, হোফার বললো। তা এখন কি করবে আমার পরিচয় সবাইকে বলে দেবে?

মোটেই না,দুই সহকারীর দিকে তাকালো কিশোর। এরাও কিছু বলবে না। কি বলো, মূস?

মাথা খারাপ? আমিও বলবো না, কিন বললো। আপনার পরিচয়…

কিশোর যখন তুমি করে বলছে, বাধা দিয়ে বললো হোফার, তোমরাও তুমি করেই বলতে পারো। আপনি আপনি করে বন্ধুত্ব হয় না।

থ্যাংক ইউ। তোমার পরিচয় কেউ জানবে না, অন্তত আমাদের মুখ থেকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো হোফরি। যাক, বাঁচালে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কিশোর বললো, তো, হোফার, আমাদের কিছু সাহায্যের প্রয়োজন যে?

নিশ্চয়ই করবো। কি করতে হবে?

চোরাই কাপগুলোর কথা খুলে বললো কিশোর। রাফায়েল সাইনাস যে তিন গোয়েন্দাকে তদন্তের ভার দিয়েছেন সেকথাও জানালো। পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে দেখিয়ে বললো, এই দেখো, আমরা সত্যিই গোয়েন্দা। কাপগুলো খুঁজে পেয়েছি বটে, কিন্তু সব রহস্যের মীমাংসা এখনও করতে পারিনি। না করে ছাড়বোও না।

মাথা ঝাঁকালো হোফার। তা তো বুঝলাম। কিন্তু আমি কিভাবে সাহায্য করবো?

আমাদের এখন দুজনকে বেশি সন্দেহ, জানালো কিশোর। মড়ার খুলি আর ভারিপদ। ধরা যাক, ওরা দুজনে মিলে ওই কাপ সরিয়েছে। একসাথে কাজ করছে। তাহলে অনেক প্রশ্নেরই জবাব মিলে যায়। আমি এখনও জানি না, তবে গল্পটা এভাবে হতে পারেঃ আজ দুপুরের মূভি স্টুডিওতে দুজনের দেখা করার কথা। চোরাই শুনে বক্স থেকে বের করে আনার জন্যে। সাউণ্ড স্টেজে বাইরে ভারিপদর জন্যে অপেক্ষা করছিলো মড়ার খুলি। এই সময় আমাকে ঢুকতে দেখলো সে। সঙ্গে সঙ্গে এটা মত করে ফেলল। কাপগুলোর চেয়ে বাজিতে বিশ হাজার ডলার জেতা তার জন্যে বেশি জরুরী। আমাকে সরিয়ে রাখতে পারলে একজন প্রতিযোগী কমে গেল। সুতরাং আমাকে আটকে ফেললো স্টেজের ভেতর। তারপর যখন ভারিপদ এলো, তাকে আমার কথা কিছুই বললো না সে, শুধু বললো দরজায় তালা দেয়া। খোলা যাবে না। অন্য সময় এসে কাপড়গুলো নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। তারপর দুজনে ফিরে গেল টেলিভিশন স্টেশনে, কুইজ শোতে যোগ দিতে।

এজন্যেই তোমাকে সময়মতো অজির হতে দেখেও অবাক হয়নি ভারিপদ, মুসা বললো।

হ্যাঁ, মাথা বাঁকালো রবিন। হবে কি? সে তো কিছু জানেই না। মড়ার খুলি জানে বলেই অবাক হয়েছে।

ঠিক,কলে হোফারের দিকে তাকালে কিশোর। এখানেই তোমার সাহায্য আমাদের দরকার।

গোয়েন্দা কাহিনী পড়তে ভালো লাগে আমার, মনে হয় গোয়েন্দাগিরি করতেও ভালোই লাগবে, হোফার কললো। কিন্তু এখনও বলেনি আমাকে কি করতে হবে।

ওদেরকে অনুসরণ করতে চাই, অবশেষে বললো কিশোর। দেখবো, দেখা করে কিনা। আজ আবার সাউন্ড স্টেজে যায় কিনা।

বেশ উঠে দাঁড়ালো হোফার। কোনখান থেকে ওরু করবো?

এটাই হলো আসল কথা, বসে থেকেই হোফারের দিকে তাকালো কিশোর। তোমার সাহায্যটা ওখান থেকেই শুরু মড়ার খুলি আর ভারিপদ কোথায় থাকে জানি না আমরা। ওদের ঠিকানা না পেলে কোনখান থেকে যে শুরু করবো, তা-ও বলতে পারবে না।

আমিও তো জানি না, মাথা নাড়লো হোফার। দুজনের কেউই আমাদের কোম্পানিতে কখনও গাড়ি ভাড়া নিতে আসেনি, কারণ ওদের নিজেদের বাহন আছে। মড়ার ধূলির আছে একটা ব্রিটিশ ঘাতখোলা স্পোর্টস কার। ভারিপদর আছে মোটর সাইকেল।

স্টুডিওর গেটের গার্ড জানতে পারে। মনে করিয়ে দিলো কিশোর, আমার ঠিকানা তো জানে। প্রথম দিন ঢোকার আগে একটা লিস্ট ছিলো ওর হাতে। নিশ্চয় মড়ার খুলি আর ভারিপদরও আছে। তবে মনে হয় জিজ্ঞেস করলেই দিয়ে দেবে।

দেবে কি? আমাকে আর মুসাকে তো ঢুকতেই দিলো না, রবিন কললো। ভীষণ

কড়া।

এক মুহূর্ত ভালো হোফার। চেষ্টা করে দেখতে পারি। গার্ডকে গিয়ে বলবে, আমাকে বলা হয়েছে সমস্ত পাগলকে এখানোতে, একটা বিশেষ মীটিঙের জন্যে। আমাকে চেনে সে।

ক্যাপ তুলে নিয়ে মাথায় দিলে সে। হয়তো কাজ হয়ে যাবে। এসো।

স্টুডিওর গেট থেকে খানিকটা দূরে তিন গোয়েন্দাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেল হোফার। অহেতুক দাঁড়িয়ে না থেকে হালকা নাস্তা করার জন্যে একটা স্ন্যাকবারে ঢুকলো ওরা। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। একটু পরেই হাসিমুখে ফিরে এলো ফোর। কাজ হয়ে গেছে।

একটা কাগজে সমস্ত পাগলদের ঠিকানা লিখে এনেছে সে, তার মধ্যে কিশোরের ঠিকানাও রয়েছে। হ্যামবার্গার চিবাতে চিবাতে ঠিকানাগুলো দেখলো কিশোর। নেলি থাকে সাম্ভ মনিকায়। শিকারী কুকুর থাকে বাবার সঙ্গে বেভারলি হিল-এ। মড়ার খুলি আর ভারিপদর অ্যাপার্টমেন্ট হলিউডে।

মড়ার খুলিকে দিয়েই শুরু করা যাক,কিশোর বলো। দাঁড়াও, বলতে বলতে পেট থেকে আরেকটা হ্যামবার্গার তুলে নিলো মুসা, আগে ডান হাতের কাজটা সেরে নিই।

হোফারও একটা স্যাণ্ডউইচ নিলো। খাওয়া শেষ হলে আবার বেরিয়ে পড়লো ওরা।

হলিউড বুলভার থেকে বেশি দূরে না মড়ার খুলির বাসা। বাড়িটার নাম ম্যাগনোলিয়া আর্মস, লা পামা স্ট্রীটে। মোটেলের মতো দেখতে লাগে অ্যাপার্টমেন্ট হাউসটাকে। খোলা চত্বরে, মুখোমুখি দুই সারি কাঠের কেবিন। এর পরে রয়েছে গাড়ি পাকার হাট জায়গা।

রাস্তায়ই গাড়ি রাখলো হোফার। চত্বরে ঢুকে পড়লো তিন গোয়েন্দা। অন্ধকার। কয়েকটা কেবিনের জানালায় আলো দেখা যাচ্ছে।

মড়ার ধূলির বাসার নম্বর ১০। চত্বরের শেষ ধারে পাওয়া গেল কেবিনটা, পর্দা টানা থাকা সত্ত্বেও ভেতর থেকে হালকা আলো আসতে দেখা গেল। বোধহয় বাড়িতেই রয়েছে মড়ার খুলি।

ঘাসে ঢাকা চত্বরের ওপর দিয়ে সেদিকে এগোলো তিনজনে। দশ নম্বরের দরজাটা মুখ করে রয়েছে বিরাট একটা ম্যাগনোলিয়ার ঝাড়ের দিকে। অন্ধকারে ওটার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে দরজার দিকে চোখ রাখলো তিন বন্ধু।

দরজার ওপরের অংশ কাঁচে তৈরি। পর্দা না লাগিয়ে খড়খড়ি লাগানো হয়েছে সেখানটায়। খড়খড়ির কয়েকটা পাত বেঁকে গেছে। কাঁচের গায়ে নাক ঠেকিয়ে ওই ফাঁক দিয়ে ভেতরে দেখা সম্ভব।

মুসা, তোমার কাজ, কিশোর বললো। তুমি বেশি লম্বা।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুসা। বিপজ্জনক কাজ করার জন্যে এরকম নির্দেশ অনেক পেয়েছে গোয়েন্দাপ্রধানের কাছ থেকে, অন্যান্য কেসে। তবে প্রতিবাদ কিংবা তর্ক করলো না। নিঃশব্দে উঠে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।

ম্যাগনোলিয়ার ঝাড় আর দরজায় মাঝে একচিলতে ঘাসে ঢাকা জমি। কয়েক পা এগিয়েই হুমড়ি খেয়ে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়লো মুসা। পারলে ঢুকে যেতে চায় মাটির ভেতরে।

মড়ার খুলির ঘরের দরজা খুলে যাচ্ছে।

ভেতরের আলোর পটভূমিকায় দেখা গেল চামড়ার জ্যাকেট পরা লম্বা শরীরটা।

যে কোনো মুহূর্তে তাকে দেখে ফেলতে পারে, মুসা ভাবলো। মাত্র কয়েক মিটার দূরে শুয়ে আছে সে।

বিকেলে কিভাবে কিশোরের হাত খামচে ধরেছিলো, মনে পড়লো তার। ওদেরকে এখন গোয়েন্দাগিরি করতে দেখলে ভীষণ খেপে যাবে সে। হয়তো বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।

পেহনের আলোকিত ঘরের দিকে ফিরে তাকালো মড়ার খুলি। ডাকলো, এই, এসে, লম্বা চুলে চিরুণি চালালো সে। যাবার সময় হয়েছে।

মুঠো শক্ত হয়ে গেছে কিশোরের। একা মড়ার খুলির সঙ্গে লাগতে যাওয়াই বিপজ্জনক, তার ওপর যদি তার সহকারী থেকে থাকে তাহলে তিনজনে মিলেও ওদের সঙ্গে পারবে না।

হোফার সাথে থাকলে ভালো হতো, ভাবলো সে। কিন্তু তাকে দেখাই যাচ্ছে না এখান থেকে। ডাকলেও নেবে না, অনেক দূরে রয়েছে।

নীল জিনস আর ডেনিম শার্ট পরা আরেকজন এসে দাঁড়ালো মড়ার খুরি পাশে। দরজার পাশে হাত বাড়ালো মড়ার খুলি। সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিলো কেবিনের। বেরিয়ে এসে বন্ধ করে দিলো দরজা। অন্ধকারে হাঁটতে শুরু করলো।

মাথা তুলতেই সাহস করছে না মুসা। ঘাসের ওপর মুখ চেপে অনড় পড়ে রয়েছে। তার মাথার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া পাগুলোও দেখতে পেলো না। তবে তার মনে হলো, বুঝি মাথা মাড়িয়েই এগিয়ে গেল।

আলো নেভানোর আগে দুজনের চেহারাই দেখতে পেয়েছে কিশোর। চিনতে পেরেছে মড়ার খুলির সঙ্গীকে।

বটিসুন্দরী, নেলি।

অন্ধকারে আবছা হতে হতে মিলিয়ে গেল মূর্তিদুটো। রাস্তার দিকে চলে গেছে দুজনে।

ঝড়ের কাছে আগের জায়গায় ফিরে এলো মুসা। দম নিতে নিতে কললো সে। আরেকটু হলেই মাথা থেতলে দিয়েছিলো! গটগট করে হেঁটে চলে গেল মাথার কাছ দিয়ে!

মুসার কথা শোনার সময় নেই কিশোরের। উঠে পড়েছে ইতিমধ্যেই। রওনা হয়ে গেল। তার পেছনে চললো রবিন আর মুসা।

কিছুদূর এগোতেই মড়ার খুলি আর নেলিকে দেখা গেল আবার। বিশ মিটার মতো দূরে। দ্রুতপায়ে চলেছে হলিউড বুলভারের দিকে। হোফারের লিমুজিনের নাক ওরা যেদিকে যাচ্ছে তার উল্টোদিকে মুখ করে আছে। ওদেরকে ধরতে হলে গাড়ি ঘোরাতে হবে তাকে, সরু রাস্তায় তাতে অনেক সময় লেগে যাবে। ততোক্ষণে হয়তো হারিয়ে যাবে দুজনে।

দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো কিশোর। মুসাকে বললো, তুমি হোফারকে গিয়ে বলো, গাড়ি ঘুরিয়ে রাখতে। রবিন, জলদি চলো, ওদের চোখের আড়াল করা চলবে না।

গাড়ির দিকে দৌড় দিলো মুসা। কিশোর আর রবিন চললো বুলভারের দিকে।

লা পামায় এই সময়টায় রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই। ফিরে তাকালেই দুই কিশোর যে ওদেরকে অনুসরণ করতে দেখে ফেলবে মড়ার খুলি। কাজেই দূরে দূরে রইলো কিশোর।

মিনিটখানেক পরেই পেছনে লিমুজিনের শব্দ শোনা গেল। হলিউড বুলভার আর পনেরো মিটার দূরে। সামনের ট্র্যাফিক লাইটের কাছে গিয়ে থামলো মড়ার খুলি আর নেলি। কিশোররাও থেমে গেল। গাড়ি আসার অপেক্ষা করছে।

পাশে এসে দাঁড়ালো গাড়ি। ওঠার জন্যে পেছনের দরজা খুললো কিশোর।

এই সময় দ্রুত, প্রায় একই সঙ্গে ঘটে গেল কয়েকটা ঘটনার।

হলিউড বুলভার পেরোতে লাগলো মড়ার খুলি আর নেলি।

লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো রবিন আর কিশোর।

বুলভারের মোড়ের কাছে উদয় হলো একটা হলুদ গাড়ি।

ঝাঁকি দিয়ে আগে বাড়লো লিমুজিন।

জানালা দিয়ে মাথা বের করে দিলো কিশোর, যাতে নজরে রাখতে পারে মড়ার খুলি আর নেলিকে।

কিন্তু রাখবে কি? দেখাই গেল না ওদের।

ছুটতে শুরু করলো হলুদ গাড়িটা।

পিছু নাও ওটার, হোফারকে কললো কিশোর।

পিছে ছুটতে গেল লিমুজিন। কিন্তু ওই মুহূর্তে ট্রাফিক লাইটের সবুজ আলো পাগল সংঘ নিভে লাল আলো জ্বলে উঠলো। সময়মতো ব্রেক কষলো হোফার। বাঁয়ে মোড় নিয়ে চলে যাচ্ছে হলুদ পাড়িটা। পলকের জন্যে কিশোরের চোখে পড়লো দুটো মুখ, মড়ার খুলি আর নেলি।

মাথা থেকে ক্যাপ খুলে নিয়ে নিরাশ ভঙ্গিতে সীটে হেলান দিলে হোফার। সবুজ আলো জ্বলার অপেক্ষা করছে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে কললো, বোধহয় হারালাম!

সেটা তোমাদের দোষে নয়, সান্ত্বনা দিলো তাকে কিশোর। ব্যাপারটা বুঝতে পারছে। লা পামা আর হলিউড বুলভারের এই মিলনস্থলে হলুদ গাড়িটাকে আসতে বলে দিয়েছিলো নিশ্চয় মড়ার খুলি। গাড়ি এলো। সবুজ আলো নেভার ঠিক আগের ক্ষণে লাফ দিয়ে তাতে উঠে বসেছে দুজনে।

তবে একেবারে বিফল হইনি, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো কিশোর।

নেলির কথা লহে? রকিন জিজ্ঞেস করলো।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো কিশোর। তবে তার চেয়েও জরুরী ব্যাপার হলো হলুদ গাড়িটা। ওটাকে আগেও দেখেছি। কার গাড়ি, জানি।

জানি? মুসার গলায় সন্দেহ।

কার? রবিনের প্রশ্ন

মুভি স্টুডিওর বিজ্ঞাপন ম্যানেজার, শান্তকঠে কালো গোয়েন্দাপ্রধান, হ্যারিস বেকার।

১১

পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলো কিশোর। রান্নাঘরে এসে নিজেই ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে নিয়ে নাস্তা সেরে চলে এলো তার ওয়ার্কশপে।

দিনটা মেঘলা। জোরে জোরে বাতাস বইছে। কাজ করার আগে একটা তারপুলিন দিয়ে ঘিরে নিতে হলো ওয়ার্কবেঞ্চের চারপাশ। নতুন জিনিসটা দিয়ে আপাতত কোনো কাজ হবে কিনা জানে না, তবু শুরু যখন করেছে শেষ করে ফেলা দরকার, এই ইচ্ছেতেই বসেছে। ক্যামেরাটার নাম দেবে সে গোয়েন্দা ক্যামেরা। সংক্ষেপে গা্যো। কাজ প্রাতে বসলো আরও একটা কারণে, এরকম কাজের সময় তার মাথা খোলে ভালো, চিন্তাশক্তি বাড়ে।

হাত জোড়া দিচ্ছে একের পর এক খুদে যন্ত্রপাতি, আর মগজ জোড়া দিচ্ছে রূপালি-কাপ-চুরি রহস্যের ছেঁড়া সূত্রগুলো।

বেশ কিছু সূত্র জোড়া দেয়া যাচ্ছে না। ভারিপদর কথাই ধরা যাক। টেলিভিশন  নেটওয়ার্ক বিল্ডিঙে ঢুকেই কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলো? নির্দিষ্ট সময়ের দুই ঘন্টা আগে এলো। লিফট করে উঠে গেল, কিন্তু সতেরো তলায় নয়। পাঁচ মিনিট পর নেমে এলে আবার লবিতে।

ওই পাঁচ মিনিট কিকরেছে সে? কারও অফিসে দেখা করেছে?

কার সঙ্গে?

আর হ্যারিস বেকারের ব্যাপারটাই বা কি? রাতের বেলা হলিউড বুলভারের মোড় থেকে নেলি আর মড়ার খুলিকে তুলে নেয়ার তার কি দরকার পড়লো?

দুজনকে হোটেলে ডিনার খাওয়াতে নিয়ে গেল? মনে হয় না। মড়ার খুলির সঙ্গে হ্যারিসের যা সম্পর্ক দেখা গেছে, তাতে খাওয়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা নয়। আর নিলোই যদি, সরাসরি ম্যাগনোলিয়া আর্মস থেকে ওদেরকে তুলে নিলো না কেন ব্যারিস?

হলিউড বুলভারের ঘটনাটা একটা স্পাই হরি কথা মনে করিয়ে দিলো কিশোরের। ঠিক এরকম ঘটনাই ঘটেছিলো ছবিটাতে। দুজন সন্দেহভাজনকে অনুসরণ করে চলেছিলো দুজন শাই, তারপর হঠাৎ করে একটা গাড়ি এসে সামনের দুজনকে তুলে নিয়ে গেল, যেন ছিনিয়ে নিয়ে গেল।

ঘন্টা তিনেকের মধ্যেই ক্যামেরাটা বানিয়ে ফেললো কিশোর। পকেট চিরুনির চেয়ে বেশি মোটা হবে না জিনিসটা। জ্যাকেটের ভাঁজের মধ্যেই জায়গা হয়ে গেল। লোকের চোখে পড়ার মতো ফুলেও থাকলো না। সামান্য একটু ঠেলে চোখটা বোতামের ফুটোর কাছে নিয়ে এলো সে। ঠিক এই সময় জ্বলে উঠলো মাথার ওপরের লাল আলো।

তিরিশ সেকেন্দ্রে মধ্যেই ট্রেলারে ঢুকে রিসিভার তুলে নিলো সে। কিশোর পাশা বলছি।

হালো! যাক, বাড়িতেই আছো, টেলিফোনেও গলার খুশি খুশি ভাবটা বোঝা যায়।

মিস্টার বেকার?

ধরে নাও আমি একজন বন্ধু, কললো হাসি হাসি কণ্ঠ। নেলির বন্ধু। সে কোনো দুর্ঘটনায় পড়ুক, এটা চাই না। তুমি চাও?

নিশ্চয়ই না। কিন্তু নেলি দুর্ঘটনায় পড়বে কেন? কোথায় আছে?

সেটা জানার দরকার নেই তোমার, মোটুরাম, হাসি বাড়লো কণ্ঠটার। আপাতত নিরাপদেই আছে। তবে বেশিক্ষণ থাকবে না, সেকথাই বলতে চাইছি তোমাকে। এক মুহূর্ত নীরবতা। যদি তুমি আজ ফাস্ট হও, মোটুরাম, নেলি মারা যাবে। মরবে হাসপাতালে গিয়ে, অনেক কষ্ট পেয়ে।

শুনুন…, কথা শেষ করতে পারলো না কিশোর। লাইন কেটে গেল ওপাশ থেকে।

রিসিভার নামিয়ে রেখে ডেস্কের পাশে এসে বসলো কিশোর। গতদিন পাগলদের বাসার যে লিস্টটা তাকে দিয়েছিলো হোফার, সেটা এখনও পকেটেই রয়েছে। বের করলো। রিসিভার তুলে নিয়ে সাম্ভা মনিকায় নেলির হোটেলের নম্বরে ফোন করলে।

সাড়া দিয়ে নেলির ঘরে লাইন দিলো ক্লার্ক। মিনিটখানেক পরে জানালো, ঘরে নেই।

হোটেল ছেড়ে চলে যায়নি তো?

না, খাতায়-কলমে চলে যায়নি। কিশোর বলার পর সম্রাটা ঢুকলো ক্লার্কের মাথায়। সারা সকাল ধরে নেলিকে দেখেনি। বাক্সেই রয়েছে তার ঘরের চাবি।

লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে রিসিভার রেখে দিলো কিশোর। কয়েক মিনিট চুপচাপ বসে বসে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো সে। তারপর আনমনে মাথা নাড়লো কয়েকবার। মৃদুস্বরে নিজেকেই বোঝালো, হারিস বেকার ফোন করেনি।

একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিত, বেকার তাকে মোটুরাম বলে ডাকবে না। ওই লোকটা এ-পর্যন্ত এনামে তাকে একবারও ডাকেনি। শুধু কিশোর বলে। তাহলে বেকার যদি না-ই হয়ে থাকে, তাহলে এমন কেউ, যে খুব ভালো অভিনেতা, কণ্ঠস্বর নকলে ওস্তাদ।

কে? মড়ার খুলি? কিন্তু মড়ার খুলি তো পাগলদের মধ্যে সব চেয়ে বাজে অভিনেতা ছিলো। কান নাড়ানো ছাড়া আর কিছুই পারতো না। অনেক সময় সংলাপ ভূলে বসে থাকতো। কথার সঙ্গে মুখ-হাত নাড়ানোরও মিল থাকতো না।

জঞ্জালের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ছে ঝড়ো হাওয়া, তীক্ষ্ণ শিস কাটতে কাটতে যেন মাথা কুটে মরছে ট্রেলারের ভেতরে ঢোকার জন্যে।

মড়ার খুলির একটা স্পোর্টসকার আছে, কথাটা মনে পড়তেই একটা বুদ্ধি এলো কিশোরের মাথায়। আবার রিসিভার তুলে হোফারকে ফোন করলো। মুসা আর রবিনকে

ওদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যতো তাড়াতাড়ি পারে ইয়ার্ডে চলে আসতে বললো।

রিসিভার রেখে দিয়ে আরও কয়েক মিনিট ডেস্কের কাছে বসে রইলো সে। প্ল্যান করছে মনে মনে। গোয়েন্দা ক্যামেরাটা এতো তাড়াতাড়িই কাজে লেগে যাবে ভাবেনি।

ট্রেলারের ভেতরেই একটা ছোট ডার্করুম আছে। সেখানে এসে ঢুকলো কিশোর। সাধারণ ক্যামেরার গোল ফিল্ম ভরা যাবে না তার ক্যামেরাটাতে। কারণ জিনিসটা চ্যাপ্টা। কাজেই ফিল্ম থেকে কেটে মাত্র একটা ছবি তোলা যায় এরকম একটা টুকরো ভরা যাবে। একবার তোলার পর আবার তুলতে হলে আবার ফি কেটে অতে হবে।

তবে তার অনুমান যদি ঠিক হয়, আর টাইমিং ঠিক থাকে, তাহলে একবারই যথেষ্ট।

ফিল্ম ভরে ক্যামেরাটা আবার জ্যাকেটের ভঁজে ভরলো কিশোর। বোতামের ফুটো দিয়ে বের করে দিলো ক্যারোর চোখ। ভালো করে না তাকালে চোখে পড়ে না। আর তাকালেও ছোট গোল লেসটাকে দেখে আরেকটা বোতাম বলেই ভুল হবে। শুধু জ্যাকেটের অন্যান্য বোতামের সঙ্গে এটার রঙ মেলে না, এই যা।

গেটে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না তাকে। পৌঁছে গেছে রবিন আর মুসা।

ব্যাপার কি? সে লিমুজিনের পেছনের সীটে উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো রবিন। কিন্তু পেলে?

হ্যাঁ। আর কিছু বললো না, শুধু হোফারকে লা পামা স্ট্রীটে যেতে বললো।

ম্যাগনোলিয়া আর্মরে কাছে এনে গাড়ি রাখলো হোফার।

তুমি যাও, মুসা, কিশোর কললো।

আবার। তা কোথায় যেতে হবে?

হাসলো কিশোর। মরতে নয় অবশ্যই। চট করে কার পার্কে গিয়ে শুধু দেখে এসো মড়ার খুরি স্পোর্টসকারটা আছে কিনা।

তিন মিনিটেই ফিরে এলো মুসা। জানালো, হ্যাঁ, আছে, লাল রঙের। ছোট।

সীটে বসেই একপাশে কাত হলো কিশোর। হাত তোলা, না নামানো?

নামানো। ক্যানভাসের হাত।

শুড, মাথা ঝাঁকালো কিশোর। দোয়া করি যেন নামানোই থাকে।

ঘড়ি দেখলো সে। সাড়ে বারোটা বাজেনি এখনও। কতোক্ষণ বসে থাকতে হয় কে জানে। কখন বেরোবে মড়ার খুলি, টেলিভিশন স্টেশনের দিকে রওনা হবে, ঠিক নেই। একেবারে অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার পথের কাছে প্রায় গেট আগলে রয়েছে লিমুজিন। বেরোতে গেলে কালো গাড়িটা মড়ার খুলির চোখে পড়বেই।

দশ মিটার দুরে একটা গলি এসে পড়েছে লা পাম স্ট্রীটে।

ওই মোড়টায় নিয়ে রাখতে পারবে? হোফারকে অনুরোধ করলো কিশোর।  পামার দিকে মুখ করে? তাহলে বেরিয়ে যেদিকেই যাক সে, তার পিছু নিতে পারবো আমরা সহজে।

আঁ, ঠিকই বলেছে।

গাড়িটাকে এগিয়ে নিয়ে গেল হোফার, তারপর পিছিয়ে এনে মোড়ের কাছে ঘাপটি মেরে মেরে বসে রইল লা পামার দিকে মুখ করে।

ক্যামেরাটা ঠিকঠাক আছে কিনা, দেখলো আরেকবার কিশোর।

একটা বাজলে পরে দেখা গেল মড়ার খুলি বেরোচ্ছে। বেরিয়ে কার পার্কের দিকে এগোলো। স্টার্ট দিলে হোফার। মড়ার খুলি লাল গাড়িটা লা পামায় বেরিয়ে ডানে মোড় নিয়ে হলিউড বুলভারের দিকে এগোনোর আগেই চলতে কালো লিমুজিন।

বুলভারে পড়ে আবার ডানে ঘুরলো স্পোর্টসকার। তারমানে টিভি স্টেশনেই চলেছে মর খুলি।

পেছনে চলে যাও, কিশোর বললো হোফারকে। তারপর যেই আমি বলবো যাও, অমনি জোরে ছুটে চলে আসবে তার পাশে। ওর যতো কাছাকাছি সম্ভব নিয়ে যাবে আমাকে।

পেছনের সীটে ডানপাশে বসেছে কিশোর। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে জানালার ভেতর দিয়ে, স্পোর্টসকার চালাচ্ছে মড়ার খুলি। লম্বা সোনালি চুল উড়ছে বাতাসে। সামনে ঝুঁকলো কিশোর। মাত্র একবার সুযোগ পাবে ক্যামেরা ব্যবহারের, আর একবারেই ছবিতে তুলে নিতে হবে। মিস করা চলবে না।

এবার আর লাল আলো বাধা দিলো না লিমুজিনকে। সবুজ আলো দেখে বেরিয়ে এলো দুটো গাড়িই। গতি বাড়াচ্ছে মড়ার খুলি। বাতাসে পেছনে প্রায় কাড়া হয়ে গেছে এফ তার চুল, ঝুলে ঝুলে গিয়ে বাড়ি মারছে কাধে। গাল, গলা, মাথার পেছনটা দেখা যায় এখন।

দেখতে দেখতে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলো কিশোর। কললো, যাও!

লাফ দিয়ে গতি বেড়ে গেল লিমুজিনের। চোখের পলকে চলে এলো স্পোর্টসকারের পাশাপাশি। সীটের পাশে হেলে পড়ে ফিরে তাকালো কিশোর। জানালার কাঁচে চেপে ধরলো জ্যাকেটের ভাঁজে লুকানো ক্যামেরার চোখ।

এখন ফিরে গাড়িটার দিকে মড়ার খুলি তাকালেই কিশোরের আশা শেষ। নষ্ট হয়ে যাবে ওর পরিকল্পনা।

এখনও সামনে তাকিয়ে রয়েছে মড়ার খুলি। ক্যামেরার বোতাম টিপে দিলো কিশোর। এই সময় লিমুজিনের দিকে ফিরলো মড়ার খুলি। ফিরুক। আর অসুবিধে নেই। কাজ যা করার করে ফেলেছে গোক্যা। মড়ার খুলি বুঝতে পারেনি যে তার ছবি তোলা হয়েছে।

হয়েছে, এবার পিছাতে পারো, হোফারকে কললো কিশোর।

লিমুজিনটা যখন পিছাচ্ছে, জ্যাকেটের ভাজ থেকে ক্যামেরাটা বের করে রবিনের হাতে দিলো সে। আমাকে টিভি স্টেশনে নামিয়ে দিয়েই হেডকোয়ার্টারে চলে যাবে তোমরা। ছবিটা ডেভলপ করে বড় করবে। কুইজ শো দেখতে পারবে না তোমরা। কিন্তু রেকর্ডিং শেষ হতে হতে বড় একটা ছবি চাই আমার। ছবিটা নিয়ে স্টেজে চলে আসবে, শো শেষ হওয়ার পর পরই যেন ঢুকতে পারো।

আচ্ছা, ক্যামেরাটা পকেটে ভরে রাখলো রবিন। কিন্তু ব্যাপারটা কি, কিশোর? মড়ায় খুলির ছবি নিলে কেন?

হেসে বললো কিশোর, ঝড়ো দিনে খোলা গাড়িতে তার একটা প্রোফাইল নিলাম। নিশ্চয় কারণটা বুঝতে পেরেছে?

না, স্বীকার করলো রনি, পারিনি।

আমি কিছুই বুঝিনি, মুসা ফললো।

একপাশ থেকে ছবি তুললাম, তার কারণ তার লম্বা সোনালি চুলগুলো দেখতে চাই, বুঝিয়ে দিলো কিশোর। একটা ব্যাপার নিশ্চয় লক্ষ্য করেছে, সব সময় আঁচড়ে ওগুলো সমান করে নামিয়ে রাখে সে। তবে আজকের ঝড়ো বাতাসকে ধন্যবাদ, ওর লুকিয়ে রাখা একটা অঙ্গের ছবি তুলতে পারলাম। এবার নিশ্চয় বুঝেছো?

না, জবাব দিলো রবিন।

কোন্ অঙ্গের কথা বলছো তুমি? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

ওর কান, বলে দিলে কিশোর। ওর বিখ্যাত কান, যে দুটো নড়াতে পারে।

১২

দুটো বাজতে আর এক মিনিট বাকি। কিশোর দেখলো, উদ্বিগ্ন হয়ে ঘড়ি দেখহে হারিস বেকার। এই নিয়ে তিনবার এরকম করলো সে।

আর মিনিটখানেক বাদেই শুরু হবে পাগলদের দ্বিতীয় কুইজ শো, অথচ হাজির রয়েছে মাত্র তিনজন। মড়ার খুলি, শিকারী কুকুর আর কিশোর। নেলি আর ভারিপদ আসেনি।

দর্শকমণ্ডলীর দিকে তাকালে কিশোর। শেষের সারিতে বসেছে আজ মুসা। সে-ও বেকারের মতোই উদ্বিগ্ন। কিশোরকে তার দিকে তাকাতে দেখে অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে শ্রাগ করলো। জবাবে কিশোরও শ্রাগ করলো। ভারিপদর জন্যে ভাবছে না সে, নেলির জন্যে চিন্তিত।

আরও পেছনে দৃষ্টি দিলো কিশোর। কন্ট্রোল বুদে জায়গামতোই রয়েছেন সাইনাস। পরনে সেই দোমড়ানো ধূসর স্যুট, এলোমেলো সাদা চুল, চোখের নিচে গাঢ় ছায়। অতি ক্লান্ত বিধ্বস্ত একজন মানুষ।

ঘোরানো গলিতে একটা নড়াচড়া চোখে পড়লো কিশোরের। স্টেজের দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে ভারিপদ। নিজের সীটে এসে বসলো।

ঠিক দুটো বাজে, কিন্তু নেলি এখনও অনুপস্থিত।

ভারিপদর দিকে ঝুঁকে নিচু গলায় বললো কিশোর, দেরি করে ফেলেছো।

হ্যাঁ, হাসলো ভারিপদ। পথে খারাপ হয়ে গেল মোটর সাইকেল। টাইয়ের সঙ্গে মাইক বাঁধলো সে। তবে না আসতে পারলেও কিছু হতো না। জেতার সম্ভাবনা একটুও নেই আমার। টাকাও পাবে না।

আবার বেকারের দিকে নজর দিলো কিশোর। ভারিপদ এসে বসার পর কিছুটা উজ্জ্বল হলো তার হাসি। কন্ট্রোল রুমকে তৈরি হওয়ার ইশারা করে দর্শকদের দিকে ফিরলো।

প্রিয় দর্শকমণ্ডলী, বলতে শুরু করলো সে, পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলো, আপনাদের জন্যে একটা দুঃসংবাদ আছে। আমাদের প্রতিযোগী নেলির কাছ থেকে একটু আগে একটা চিঠি পেয়েছি। চিঠিটা এসেছে আমার অফিসের ঠিকানায়। আপনাদেরকে পড়েই শোনাচ্ছি। হাতের কাগজটার দিকে তাকিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে একটা সেকেণ্ড রিতি দিয়ে, তারপর জোরে জোরে পড়তে লাগলো, ডিয়ার মিস্টার বেকার। আপনাদেরকে এভাবে বেকায়দায় ফেলার জন্যে আন্তরিক দুঃখিত। কিন্তু আমার ছবি পত্রিকায় ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই বিপদ, বহুবছর আগে যে যন্ত্রণায় পড়েছিলাম, রাস্তায় বোরোলেই আবার রিক্ত করছে লোকে। কুইজ শো জেতার কোনো সম্ভাবনা নেই আর আমারবুঝতে পেরেই ভাবলাম আর ক্যামেরার সামনে যাবে না। সান ফ্রান্সিসকোয় আমার বাড়িতে চলে যাচ্ছি। ওখানে অন্তত শান্তিতে থাকতে পারবো, লোকে বিরক্ত করবে না আমাকে। আপনি, এবং পাগলদের বার প্রতি রইলো আমার শুভেচ্ছা। আবার নাটকীয় ভঙ্গিতে বিরতি দিয়ে বেকার বললো, নিচে সই করেছে, বটিসুন্দরী।

গুঞ্জন উঠলো দর্শকদের মাঝে। বিরক্ত নয়, সহানুভূতি, বটিসুন্দরীর মর্যাতনা উপলব্ধি করতে পারছে ওরা।

নেলি, বেকার বললো ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে, আমাদের এই অনুষ্ঠান যদি এই মুহূর্তে দেখে থাকো তুমি, তাহলে বলছি তোমার এই সিদ্ধান্তের জন্যে আমরা খুব কষ্ট পেলাম। তোমাকে পেয়ে সত্যিই খুশি হয়েছিলাম আমরা। তোমাকে মিস করছি এ মুহূর্তে।

দর্শকরাও বেকারের সঙ্গে সায় দিয়ে গুঞ্জন করে উঠলো। নানারকম কথা বলতে লাগলো ওরা। হাত তুলে ওদেরকে শান্ত হতে অনুরোধ করলো বেকার, দয়া করে চুপ করুন আপনার। আমাদের শো শুরু হতে যাচ্ছে। পাগলদের দ্বিতীয় এবং ফাইন্যাল কুইজ শো।

নিভে গেল আলো। পর্দার দিকে তাকালো কিশোর। দুই মিনিটের টুকরো ছবি দেখানো আর হলো। ওতে পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে পারছে না সে, মাথায় ঘুরছে নানারকম চিন্তা। তবে যেটুকু পারলো, তাতেই পুরো দুটি রেকর্ড হয়ে গেল তার অসাধরণ স্মৃতিতে।

জনাব গণ্ডগোলের জন্যে একটা কুকুর চুরি করছে শজারুকাঁটা। ডোরাকাটা একটা স্ট্রর সাহায্যে স্ট্রবেরি মিল্ক শেক খাচ্ছে বটিসুন্দরী। ভুট্টা পোড়া দেয়ার জন্যে বনের ভেতর আগুন জ্বেলেছে মড়ার খুলি আর শিকারী কুকুর। একটা জলাশয়ে ডাইভ দিয়ে পড়ছে ভারিপদ। দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে বনে, তার মধ্যে আটকা পড়েছে মোটুরাম। চেককাটা একটা টেবিলক্লথ দিয়ে ভারিদ্র মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছে শিকারী কুকুর। আগুনের ভেতর থেকে মোটুরামকে উদ্ধার করে আনছে নেলি।

ছবি দেখছে আর ভাবছে কিশোর, নিশ্চয় ওই চিঠি নেলি লেখেনি। কারণ, কিছুতেই বটিসুন্দরী লিখে সই করবে না সে। কিশোর যেমন মোটুরামকে ঘৃণা করে, তেমনি নেলি ঘৃণা করে বটিসুন্দরীকে। তাছাড়া, সে বাড়িও যায়নি। হোটেলের ঘর হাড়েনি। অথচ সারা সকাল তাকে হোটেলে দেখা যায়নি, ছিলো না।

নিশ্চয় বিপদে পড়েছে নেলি। তাকে আটকে রাখা হয়েছে কোথাও। তারপর তার নাম সই করে দিয়ে একটা জাল চিঠি পাঠানো হয়েছে। যে এসব করেছে, সেই একই লোক হুমকি দিয়ে ফোন করেছে কিশোরকে।

দুই মিনিট পর ছবি শেষ হয়ে গেল। জ্বলে উঠলো আলো।

ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডের দিকে তাকালো কিশোর। পঁয়তাল্লিশ নম্বর পেয়েছে সে। মড়ার খুলি চল্লিশ। নেলি পঁয়তিরিশ। ভারিপদ আর শিকারী কুকুর আরও অনেক কম।

সুইভেল চেয়ার ঘুরিয়ে প্রতিযোগীদের মুখোমুখি হলো বেকার।

নেলি না থাকায় প্রথম জবাব দেয়ার পালা এলো মড়ার খুলির।

বলতো, বটিসন্দরী, যে স্ট দিয়ে মিল্ক শেক খাচ্ছিলো, ওটার বিশেষত্ব কি?

ডোরাকাটা, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো মড়ার খুলি। লাল, সাদা আর নীল।

হাততালি পড়লো। কিশোরের সমান নম্বর হয়ে গেল তার।

শিকারী কুকুরের পালা। কি ধরনের মিল্ক শেক খাচ্ছিলো?

দ্বিধা করলো শিকারী। মড়ার খুলির আগের মুহূর্তে কিশোরের হাত উঠে গেল।

চকলেট? জবাব নয়, যেন বেকারকে প্রশ্ন করলো শিকারী কুকুর।

না না না, চেঁচিয়ে উঠলো দর্শকরা। হলো না।

হলো না, যেন খুবই দুঃখিত হয়েছে এমন ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে কিশোরের দিকে ফিরলে বেকার। বলো?

দ্বিধা করার ভান করলো কিশোর। তার ভালো করেই জানা আছে জবাবটা কি। কিন্তু বললো, আমারও মনে হয় ওটা চকলেট।

আশা করেছিলো দর্শকরা, কিশোর পারবেই, কিন্তু তাদেরকে নিরাশ হতে হলো। খুব আফসোস করলো তারা। পাঁচ নম্বর হারালো সে। এরপর থেকে হারাতেই থাকলো। তার নিজের প্রশ্ন যখন এলো, জিজ্ঞেস করা হলো কি দিয়ে শিকারী কুকুরের মাথায় ব্যান্ডেজ বাধছিলো ভারিপদ, আবরও দ্বিধায় অভিনয় শুরু করলো সে।

টিসু পেপার? বলে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে বেকারের দিকে তাকালো।

জোর গুঞ্জন উঠলো দর্শকদের মাঝে। ওরা বিশ্বাসই করতে পারছে না যেন কিশোর ভুল করবে।

পঞ্চম এবং শেষ রাউণ্ডে দেখা গেল পঁয়ষট্টি নম্বর পেয়ে এগিয়ে রয়েছে মড়ার খুলি। শেষ জবাবটাও ঠিক ঠিক দিলো সে। শিকারী কুকুর আর ভারিপদ ভুল করলো। কিশোরের পালা এলো।

তোমাকে এবার খুব সহজ একটা প্রশ্ন করি, বেকার বললো। জনাব গণ্ডগোলের জন্যে কি চুরি করেছে শজারুকাঁটা?

জবাব দেয়ার আগে স্কোরবোর্ডের দিকে তাকালো কিশোর।

মাথা চুলকালো। নেরি চেয়ে ইতিমধ্যেই পাঁচ নম্বর কম পেয়েছে। আবারও ভুল জবাব দিলো, ইয়ে, একটা বেড়াল।

গুঙিয়ে উঠলো দর্শকরা। প্রশ্ন-পর্ব শেষ হলো।

অনেক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে প্রতিযোগীরা কে কতো নম্বর পেয়েছে, পড়তে লাগলো বেকার। মড়ার খুলি পেয়েছে সত্তর। নেলি পঁয়তিরিশে রয়েছে। তার চেয়েও পাঁচ নম্বর কম পেয়েছে কিশোর, অর্থাৎ তিরিশ। কাজেই নেলি দ্বিতীয় শোতে যোগ না দিয়েও দ্বিতীয় হয়ে আছে।

তিনটে ক্যামেরার চোখেই মড়ার খুলির দিকে ঘুরে গেল, যখন সে হাসিমুখে বিশ হাজার ডলারের চেকটা নেয়ার জন্যে হাত বাড়ালো। সেদিকে তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করলো না কিশোর। সে উৎকণ্ঠিত হয়ে তাকিয়ে রয়েছে দর্শকদের মাথার ওপর দিয়ে পেছনে, রবিনকে দেখার আশ্রয়।

অবশেষে ঘোরানো গলি দিয়ে রবিনকে ছুটে আস দেখা গেল। দর্শকদের সারির মাঝ দিয়ে প্রায় দৌড়ে এলো স্টেজের দিকে। তার পেছনে এলো মুসা। হাতের বড় ম্যানিলা খামটা কিশোরের হাতে তুলে দিলো রবিন। ফিসফিসিয়ে বললো, খুব পরিষ্কার উঠেছে।

রবিন আর মুসা ফিরে গেল সীটে। খামটা খুললো কিশোর। যা আশা করেছিলো, তার চেয়ে ভালো উঠেছে ছবিটা। মড়ার খুলির একটা চমৎকার হবি, বাতাসে চুল উড়ছে পেছনে।

তার বাঁ কানটা স্পষ্ট।

লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলম্যান, বেকার বলছে হাসি হাসি কণ্ঠে, এখন আমি পাগলদের সবাইকে একটা করে পুরস্কার দিতে চাই।

দর্শকদের গুঞ্জন স্তব্ধ হয়ে গেল। ছবিটা আবার খামে ভরে ক্যামেরার চোখের দিকে তাকাতে তৈরি হলো কিশোর।

অ্যানি, ডাকলো বেকার, পুরস্কারগুলো নিয়ে এসো।

আলোচনার দিন যে মেয়েটা কাপের বাক্স নিয়ে এসেছিলো, সে-ই এলো আরেকটা সোনালি কাগজে মোড়ানো বাক্স হাতে। একটা ভুরু উঠে গেল কিশোরের। এবার আর একা আসেনি মেয়েটা, সঙ্গে রয়েছে ইউনিফর্ম রা একজন গার্ড।

বাক্সটা খুললো বেকার। নাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে। সব শেষে বললো, …পাগলদেরকে একটা করে রূপার কাপ উপহার দেবো আমরা।

নানারকম কথা বলে আর শব্দ করে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলো দর্শকরা, পাগলরা যখন পুরস্কার নিতে এগোলো।

নেলির কাপটা ডাকযোগে তার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হবে, বেকার বললো। নেলি, তুমি যদি এ-অনুষ্ঠান দেখে থাকো, আবার ধন্যবাদ তোমাকে। উপস্থিত পাগলবৃন্দ, দর্শকমণ্ডলী, আর যারা আমাদের এই অনুষ্ঠান দেখেছেন, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ করছি আমাদের অনুষ্ঠান। গুড বাই।

ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো বেকার। পৃর্ণিমার চাঁদের মতো ঝলমল করছে তার হাসি। জোরে জোরে হাততালি দিচ্ছে দর্শকরা। শো শেষ।

থেমে গেল ক্যামেরার নড়াচড়া। নড়তে শুরু করেছে পাগলেরা। স্টেজের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে মড়ার খুলি। বেকার, শিকারী কুকুর, ভারিপদ, ক্যামেরাম্যান আর দর্শকদের কেউ কেউ তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে।

পেছনে দুই সহকারীকে নিয়ে ওই ভিড় ঠেলে ভেতর ঢুকলো কিশোর। চামড়ার অ্যাকেট পরা সোনালি-চুলোর মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। ছবিটা বের করে দেখিয়ে বললো, এই ছবিটা কি তোমার?

কেন? ছবির দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি ফুটলো মড়ার খুলির চোখে। কিন্তু অস্বীকার করতে পারলো না যে ছবিটা তার নয়। আশপাশের সকলে ঝুঁকে এলো ছবিটা দেখার জন্যে। হ্যাঁ, এটা আমারই হবি। কেন?

কারণ এখানে তোমার কান ঢাকা নেই, কিশোর বললো। পাশে দাঁড়ানো বেকারের দিকে তাকালো সে। বয়েস বাড়লে মানুষের চেহারা অনেক বদলে যায়, সন্দেহ নেই। শিকারী কুকুর, ভারিপদ, আমি, আমাদের সবার চেহারাই বদলেছে। পরিচয় না দিলে ছেলেবেলার সেসব ছবি দেখে লোকে এখন আমাদের চিনতে পারবে না। ঠিক?

ঠিক, শিকারী কুকুর বললো।

মাথা ঝাঁকালো বেকার।

কিন্তু কিছু কিছু জিনিস কখনও বদলায় না, বড় হলে আকারে বাড়ে এই যা, বললো কিশোর। তার মধ্যে একটা অঙ্গ হলো মানুষের কান। মড়ার খুলির কান ছিলো অস্বাভাবিক বড়, কানের লতি এতো ঝোলা, মনে হতো জেলি লেগে আছে, ঝাড় লাগলেই খসে পড়বে। কিন্তু ছবিতে যার কান দেখছেন, এইমাত্র যে বিশ হাজার ডলার পুরস্কার জিতলো, এর কান সম্পূর্ণ অন্যরকম। বয়েস বাড়লে কি কানের এরকম পরিবর্তন হয়?

থাবা দিয়ে কিশোরের হাত থেকে ছবিটা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করলো চামড়ার জ্যাকেট পরা তরুণ। খপ করে তার চেপে ধরে ঠেলে পিছনে সরিয়ে দিলো মুসা।

কি-ক্কি বলতে চাও তুমি? কিশোরের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালো মড়ার খুলি।

বলতে চাই, শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর, তুমি কোনোদিনই পাগল সংঘে অভিনয় করোনি। এই কুইজ শোতে অংশ নেয়ার কোনো অধিকার তোমার ছিলো না। আর মিস্টার বেকার নিশ্চয় আমার সঙ্গে একমত হবেন, এই পুরস্কার তোমার প্রাপ্য হতে পারে না, কারণ…

ছবিটা তুলে নাটকীয় ভঙ্গিতে নাচালো কিশোর। কারণ, তুমি আর যেই হও, পাগল সংঘের মড়ার খুলি হতেই পারো না।

১৩

টেলিভিশন নেটওয়ার্ক বিল্ডিঙের একটা বড় অফিসে জমায়েত হয়েছে অনেকে। নকল মড়ার খুলি, হ্যারিস বেকার, রাফায়েল সাইনাস, তিন গোয়েন্দা, শিকারী কুকুর, ভারিপদ, আর টেলিভিশন কোম্পানির একজন সিকিউরিটি গার্ড।

ডেস্কের ওপাশে বসেছে বেকার। তার সামনে রাখা কিশোরের তোলা ছবিটা। মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসেছে নকল মড়ার খুলি। আরও কতগুলো চেয়ার নিয়ে তার পেছনে গোল হয়ে ঘিরে বসেছে অন্যান্যরা।

ও-কে, পরাজিত ভঙ্গিতে অবশেষে বললো মড়ার খুলি, স্বীকার করছি, আমি আসল মড়ার খুলি নই। আরও স্বীকার করছি আমি একটা গাধা। গর্দভ না হলে মোটুরামকে আমার ছবি তোলার সুযোগ দিই? কিশোরের দিকে তাকালো সে। তোমাকে আগেই বলেছি, তুমি যে বেশি নও সেটা আমি বুঝেছি, যতোই বোকার অভিনয় করো না কেন। তবে যতোটা চাক মনে করে, তার চেয়ে যে অনেক বেশি, এটা বুঝতে পারিনি। চওড়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিরাশার ভঙ্গি করলো সে। হাত ওল্টালো। চেষ্টা করে দেখলাম, পারিনি। বিশ হাজার ডলার, কম কথা নয়। তবে প্রায় সেরে ফেলেছিলাম।

পকেট থেকে চেকটা বের করে দেখলো মড়ার খুলি। জ্বলে উঠলো একবার চোখের তারা। তারপর দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে মারলো বেকারের দিকে।

কাপটাও ফেরত দাও, হাত বাড়ালেন সাইনাস। কণ্ঠস্বরে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসছে আবার।

পকেট থেকে কাপটা বের করে আহাড় দিয়ে রাখলো টেবিলে।

এখন বলো তুমি কে? মোলায়েম গলায় জিজ্ঞেস করলো সিকিউরিটি গার্ড। তোমার আসল নাম কি?

সেটা জেনে কি লাভ? আবার কাঁধ ঝাঁকালো মড়ার খুলি। আমার নাম দিয়ে কার কি এসে যায়? এ-শহরে আরও হাজারটা অভিনেতার মতোই আমিও একজন, অভিনয় জেনেও যারা সুযোগ পায় না। যদিও অভিনয় ভালোই জানি আমি।

মনে মনে তার সাথে একমত না হয়ে পারলো না গোয়েন্দাপ্রধান। আসল মড়ার খুলির চেয়ে এ অনেক ভালো অভিনেতা।

দল পাকানো চেকটা চেপেচুপে সোজা করে পকেটে ভরে রাখলো বেকার। জিজ্ঞেস করলো, কে তোমাকে একাজ করতে বলেছে?

কেউ না। আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে আবার নকল মড়ার খুলির গলায়। আমাকে কেউ একাজ করতে বলেনি। টেলিভিশনে পাগল সংঘের ছবিগুলো দেখেছি। কাগজে পাগলদের সম্পর্কে পড়েছি। ইস্কুলে কিছুদিন আসল মড়ার খুলির সঙ্গে পড়েছিলাম। একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ উধাও হয়ে গেল সে, বোধহয় সহপাঠীদের টিটকারির জ্বালায়ই অনেক বছর হলো তার আর কোন খবর নেই। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, মারা গেছে সে। একেবারে বোকা ছিলো তো। গরুর গাড়ির চাকার নিচে পড়ে মরলেও অবাক হবো না।

ওর চেহারার সঙ্গে কিছু কিছু মিল আছে আমার। কান বাদে। ছবি দেখতে দেখতে একটা মতলব এলো মাথায়। নিজেকে মড়ার খুলি বলে চালিয়ে দর্শকদের কাছ থেকে বাবা আদায় করবো। প্রথমে ভেবেছিলাম পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেবো। তৈরিও করে ফেলেছিলাম, এই সময় খবর শুনলাম নেটওয়ার্ক একটা কুইজ শোর বন্দোবস্ত করেছে। লুফে নিলাম সুযোগটা। কেন নেবো না? বিশ হাজার ডলার কম কথা?

সবাই নীরব। বেকার হাসছে, তবে প্রাণ নেই হাসিটায়, কেমন যেন দ্বিধায় ভরা।

এখন আমাকে নিয়ে কি করতে চান? জিজ্ঞেস করলো নকল মড়ার খুলি।

পুলিশের হাতে তুলে দেবো, সিকিউরিটি কললো। জালিয়াতির অভিযোগে…

হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো বেকার। ওই কাজও করতে যেও না। নেটওয়ার্ক কিংবা মুভি স্টুডিও, কারোই সুনাম হবে না এতে। কল্পনা করতে পারো, খবরের কাগজওয়ালারা শুনতে পেলে কি তুমুল কাণ্ড শুরু করে দেবে? সিকিউরিটিকে একটা উজ্জ্বল হাসি উপহার দিলো সে। আসলে আমাদের এখনও কোনো ক্ষতি তো হয়নি। বিশ হাজার ডলারের চেকটা স্যান ফ্রান্সিকোয় নেলির কাছে পাঠিয়ে দেবো। খুশি হবে। আর একে…।

নকল মড়ার খুলির দিকে তাকিয়ে হাসলো সে। পুরো ব্যাপারটাকেই একটা রসিকতা মনে করি না কেন আমরা? সাইনাসের দিকে তাকালো বেকার। রাফায়েল, তুমি কি বলো?

ক্লান্ত চোখ নামিয়ে নিলেন বৃদ্ধ পরিচালক। সাদা, পাতলা চুলে আঙুল চালালেন। তা তো হতেই পারে। আমার আপত্তি নেই।

উঠে দাঁড়ালো কিশোর। তার ইশারায় রবিন আর মুসাও উঠলো।

আমরা কাগজওয়ালাদের কিছু বলবো না, কথা দিলো কিশোর। মীটিং শেষ হয়ে আসছে বঝেই যেন তাড়াতাডি, সবার আগে বেরিয়ে যেতে চায়, বাইরের কার পার্কে যেখানে লিমুজিন নিয়ে অপেক্ষা করছে হোফার। তাহলে, যদি অনুমতি দেন, মিস্টার বেকার, আমরা এখন যাই।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, উঠে দাঁড়ালো বিজ্ঞাপন ম্যানেজার। তোমাদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ হয়ে থাকলাম, কিশোর পাশা। হাসিটা ঠিকই রয়েছে মুখে, তবে কণ্ঠস্বরে কৃতজ্ঞতার ছিটেফোঁটাও নেই। বুদ্ধিমান ছেলে তুমি, দারুণ গোয়েন্দা। তোমার সাহায্য না পেলে একটা সাংঘাতিক ভুল হয়ে যেতো। ঠকানো হতো নেলিকে।

তাকে ধন্যবাদ দিয়ে দুই সহাকারীকে নিয়ে বেরিয়ে এলো কিশোর। পেছনে দরজাটা বন্ধ করে দেয়ার আগে চট করে ফিরে তাকালো একবার। চেয়ারে হেলান দিয়ে স্তস্তির হাসি হাসছে বেকার, হাসি ছড়িয়ে পড়েছে মড়ার খুলির মুখেও। চোখ নামিয়ে রেখেছেন সাইনাস, কোটে লেগে থাকা ময়লা নখ দিয়ে খুঁটে পরিষ্কারের চেষ্টা করছেন। ভুরু কুঁচকে জানালার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সিকিউরিটি ম্যান।

লিফট লোকে বোঝাই। নীরবে নেমে এলো তিন গোয়েন্দা। লবি থেকে বেরোনোর আগে কথা বলার সুযোগ পেলো না রবিন আর মুসা।

ওদেরকে এভাবে ছেড়ে দিলে? রাগ করে বললো মুসা। সে বিশ্বাস করতে পারছে। কোনো কেসে কিশোর কোনো অপরাধীকে ছেড়ে দেয়নি। অথচ আজ তা-ই করে এলো! মুসার ধারণা, হ্যারিস বেকার প্রথম থেকেই জানতো যে মড়ার খুলি নকল। সে জন্যেই লোকটা ধরা পড়ার পরও তাকে ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে।

হ্যাঁ, মুসার সঙ্গে সুর মেলালো রবিন, সে-ও রেগেছে, কেন ছাড়লে? আর নেলির ব্যাপারটাই বা কি? তুমিই আমাদেরকে কললে, সে স্যান ফ্রান্সিসকোয় যায়নি। কললে, ও বিপদের মধ্যে রয়েছে।

হ্যাঁ,রবিনের কথার পিঠে বললো মুসা। রেগেছে তো বটেই, অবাকও মনে হচ্ছে এখন তাকে। কি ভাবছো তুমি, কিশোর?

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে ফিরে তাকালো গোয়েন্দাপ্রধান। আমি ভাবছি নেলির কথা। আজ সকালে আমাকে হুমকি দিয়ে ফোনটা পাওয়ার পর থেকেই ভাবছি। ফোন পাওয়ার কথা আগেই দুই সহকারীকে বলেছে সে। ওর জন্যেই সমস্ত প্রশ্নের ভুল জবাব দিয়েছি আমি। যাতে নেলি জিততে পারে। এখনও ডাবছি তার কথাই। রবিনের দিকে তাকালো সে। ও বিপদেই রয়েছে। তাকে বাঁচাতে হবে আমাদের। এসো।

আর একটিও কথা না বলে তাড়াতাড়ি চত্বর পেরিয়ে এলো কিশোর। সঙ্গে সঙ্গে এলো রবিন আর মুসা।

গাড়িতে বসে ম্যাগাজিন পড়ছিলো হোফার। কিশোর পেছনের দরজায় হাত দিতেই ফিরে তাকালো। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যেতে হবে?

কোথাও না। গাড়ির পেছনের সীটে উঠে বসলো কিশোর। রবিন আর মুসাও উঠলো। জানালা দিয়ে হ্যারিস বেকারের হলুদ সিত্রো গাড়িটার দিকে তাকালো সে। আরেকটু বোধহয় পিছানো দরকার। তাহলে ওদের চোখে না পড়েও গাড়িটার ওপর চোখ রাখতে পারবো।

নিশ্চয়ই, জবাব দিলো হোফার।

এঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে কার পার্কের পেছন দিকে গাড়ি পিছিয়ে আনলো সে। ওরা এখানে আছে একথা জানা না থাকলে সহজে কারো চোখে পড়বে না লিমুজিনটা এখন, অন্তত হলুদ গাড়িটার কাছ থেকে। অথচ ওরা এখান থেকে স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে গাড়িটার তিমির মুখের মতো নাক।

হ্যারিস বেকারের পিছু নেবো নাকি? জিজ্ঞেস করলো হোফার।

তাকে নিরাশ করলো না কিশোর, আনমনে মাথা ঝাঁকালো। সীটে হেলান দিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে। রবিন বুঝতে পারছে, এখন ওভাবেই কিছুক্ষণ নীরব আর রহস্যময় হয়ে থাকতে চায় গোয়েন্দাপ্রধান, চায় না তাকে বিরক্ত করা হোক।

কিন্তু তাকে ওভাবে থাকতে দিলো না রবিন। বললো, এই, চুপ করে আছে কেন? ভেবেছো পার পেয়ে যাবে। তা হতে দিচ্ছি না। অফিসে ওরকম করলে কেন, জলদি বলো।

হ্যাঁ, রবিনের পক্ষ নিলো মুসা, জলদি বলো। কেন করলে?

বেশ। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো কিশোর। এক আঙুল তুললো, এক নম্বর, বেশ জোরেই বললো, যাতে হোফারও শুনতে পায়, নেলিকে শেষ কখন দেখেছি আমরা?

কাল রাতে, হলিউড বুলভারে, জবাব দিলো রনি। ওকে তুলে নিয়েছিলো বেকার।

সাথে ছিলো মড়ার খুলি, যোগ করলো কিশোর। তারপর আজ সকালে সে আমাকে ফোন করলো কিশোর। হ্যারিস বেকারের গলা নকল করে আমাকে শাসালো, যদি আমি ফাস্ট হই তাহলে নেলি দুর্ঘটনায় পতিত হবে। এ থেকে কি বোঝা যায়?

সে কোথাও আটকে রেখেছে নেলিকে, বললো রকিন। বন্দি করেছে। তবে সেটা নিশ্চয় তার ম্যাগনোলিয়া আর্মসের বাসায় নয়। এখানে অনেক লোকের বাস। চেঁচামেচি করে বা অন্য কোনোভাবে লোকের দৃষ্টি আর্কষণ করে ফেলবে তাহলে নেলি।

ঠিক, কিশোর বললো।

কিন্তু এখন তো কুইজ শো জিতেছে, মুসা বললো, আর জালিয়াত বলে চিহ্নিত হয়ে গেছে মড়ার খুলি, এখন আর নেলির কি বিপদ? ছেড়ে দেবেনা?।

না। কেন বাড়বে না বুঝিয়ে দিলো গোয়েন্দাপ্রধান, ওই অফিসে যা-ই বলে থাকুক, একা কাজ করছে না মড়ার খুলি। কেউ তাকে ধরে এনেছে ওই রোলে অভিনয় করার জন্যে। তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছে। পাগলদের ব্যাপারে সব মুখস্থ করিয়েছে। যেমন, তাকে বলা হয়েছে, অভিনয়ের সম্মানী হিসেবে শুক্রবারে নগদ টাকা দেয়া হতো আমাদেরকে। বাদামী খামে ভরে, লাল সুতোয় বেঁধে। তাকে বলে না দিলে ওরকম তথ্য হাজার চেষ্টা করেও নকল মড়ার খুলির জানার কথা নয়। তার জানার কথা নয় যে, জনাব গণ্ডগোলের গাড়িটা ছিলো একটা পিয়ার্স-অ্যারে কনভার্টিবল, টোয়েন্টি নাইন মডেলের। এসব কথা নিশ্চয় বলে দেয়া হয়েছে তাকে।

তারমানে তার সহযোগী আছে, বুঝতে পারলো রকিন।

আছে। আর সেই সহযোগীই নেলিকে কিডন্যাপ করতে তাকে সাহায্য করেছে। এখন ওকে কিছুতেই ছাড়বে না ওরা। কারণ নেলি জানে সেই সহযোগী লোকটি কে। জালিয়াতির চেয়ে কিডন্যাপিং অনেক বড় অপরাধ। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে যাবে।

হ্যারিস বেকার। মড়ার খুলিকে সে-ই হেড়ে দিয়েছে। শুরু থেকে সব শয়তানী সে-ই করে আসছে।

কিশোর, তাই? মুসা জিজ্ঞেস করলো। বেকারের বাড়িতে আটকে রাখেনি তো নেলিকে?

জবাব দিলো না কিশোর। চোখ তার হলুদ গাড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়া লোকটার দিকে। গাড়িতে উঠে বসলো সে। এঞ্জিন স্টার্ট দিলো। তারপর বেরিয়ে যেতে লাগলো পার্ক থেকে।

না, মুসার প্রশ্নের জবাবে বললো কিশোর, হ্যারিস বেকার নয়। সে বিজ্ঞাপনের লোক। কিসে কিসে স্টুডিওর ক্ষতি হবে ভালো করেই জানে। সে স্টুডিও আর নেটওয়ার্ককেই বাঁচাতে চেয়েছে। সে জানতো না যে মড়ার খুলি নকল। এমন এক লোক মড়ার ধূলির ওস্তাদী করেছে, ছব্বি প্রতিটি ইঞ্চি যার জানা। কোথায় কি আছে না আহে মুখস্থ। সেই লোকই নেলিকে কিডন্যাপ করতে সাহায্য করেছে মড়ার খুলিকে। এবং সেই লোকই এখন ওই হলুদ গাড়িটা চালাচ্ছে।

কে? দেখার জন্যে রবিন আর মুসাও সামনে ঝুঁকে পড়লো।

হোফার পিছু নিয়েছে। হলিউড বুলভারের কাছে মোড় নেয়ার সময় ক্ষণিকের জন্যে হলুদ গাড়ির গতি শ্লথ হলো। সেই সুযোগে ওটার একেবাবে কাছে চলে গেল মিজিন।

ধীরে সুস্থে বোমাটা ফাটালো গোয়েন্দাপ্রধান, রাফায়েল সাইনাস।

১৪

মোড় নিয়ে বেভারলি হিলের গিরিখাতগুলোর দিকে এগিয়ে চললো হলুদ গাড়িটা।

ধীরগতি, সাবধানী ড্রাইভার সাইনাস। বৃদ্ধ পরিচালকের সন্দেহ না জাগিয়েও তাঁর পিছে লেগে থাকতে অসুবিধে হলো না হোফারের।

এঁকেবেঁকে চলে গেছে পথ, ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে, তারপর একসময় ঢুকে গেল পাহাড়ের মধ্যে। বাড়িঘর এখন অনেক দূরে দূরে। আকারেও বড় এখন ওগুলো। বিরাট বিরাট এলাকা নিয়ে একেকটা বাড়ি, প্রাসাদের মতো, পাথরের দেয়ালে ঘেরা। ওগুলো সিনেমার লোকদের বাড়িঘর। তবে এখনকার নয়, আগের, যখন সিমেনা কোম্পানিগুলো হঠাৎ করে অনেক টাকা কামাতে শুরু করেছিলো। এই পথে যাতায়াতের জন্যে বিশেষ বাসের ব্যবস্থা আছে। বাস বোঝাই হয়ে আসে টুরিস্টরা। ওসব বাড়ির সামনে কিছুক্ষণের জন্যে থামে। আর বলে দেয় ড্রাইভাররা কোনটা কার বাড়ি, কোন পাথরের দেয়ালের আড়ালে আত্মগোপন করে থাকতো সিনেমা-দর্শকদের অতি-পরিচিত কোন প্রিয় মুখটি।

কিশোর জানে, এখন বেশির ভাগ বাড়িই আসল মালিকের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখন এগুলোর মালিক ব্যাংক, তেল কোম্পানি, আর আরব শেখের। সিনেমার লোকেরা সরে চলে গেছে বেভারলি হিলের ভেতরের চ্যাপ্টা অঞ্চল নামে পরিচিত এলাকায়।

গতি কমালো হোফার। মোড় নিয়ে একটা খোলা গেটের ভেতরে ঢুকছে হলুদ গাড়ি। মোড়ের কাছে এসে থেমে গেল সে।

এখন কি করবো? কিশোরের দিকে ফিরে তাকালো হোফার। ঢুকবো?

না, থ্যাংক ইউ। পেছনের দরজা খুলে রাস্তায় নামলো গোয়েন্দাপ্রধান। নিশ্চয় তাঁর বাড়িতে অনেক লোক। গার্ড, চাকর-বাকর, মালি। আমাদেরকে ঢুকতে দেখলে সর্তক হয়ে যাবে। তুমি এখানেই থাকো, আমরা যাই। নেলিকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে জানার চেষ্টা করবো।

ঠিক আছে। ম্যাগাজিন বের করলো হোফার। গুড লাক। সাহায্যের দরকার পড়লে ডেকো।

ওকে আরেকবার ধন্যবাদ জানিয়ে দেয়ালের ধার ঘেঁষে রওনা হলো কিশোর। সাথে চললো রবিন আর মুসা।

গেট খোলাই রয়েছে। বন্ধ করতে এলো না কোনো দারোয়ান। কাউকে চোখেও পড়লো না। সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বেকারের হলুদ গাড়িটা। কেমন যেন অবাস্তব লাগছে ওটা ওখানে। দক্ষিণাঞ্চলের এই পরিত্যক্ত প্রাসাদটায় আধুনিক সিত্রে বেমানান।

নীরব হয়ে আছে সব কিছু। প্রচুর পয়সা খরচ করে তৈরি হয়েছিলো এই প্রাসাদ, কিন্তু এখন মনে হয় এটাকে সংস্কারে পয়সাও আর নেই। এখানে ওখানে প্রাস্টার খসে পড়েছে, মেরামত করতে পারছে না। রঙ চটে গেছে, নুতন রঙ করা হয়নি। সিঁড়ির পাশে ঘাস গজিয়ে উঠেছে, সাফ করা হয়নি। আশপাশে ঝোপঝাড় বেড়ে উঠেছে বেয়াড়াভাবে।

গেটের ডান পাশ থেকে একসারি গাহ চলে গেছে বাড়িটার দিকে। ইশারায় সহকারীদেরকে কাছের গাছটা দেখালো কিশোর। গাছের গোড়ায় ঘাস এতো লম্বা হয়েছে, হমড়ি খেয়ে ওরা বসে পড়লে স্বচ্ছন্দে লুকিয়ে থাকতে পারবে। আড়ালে আড়ালে এগোতেও পারবে।

খাইছে! বিড়বিড় করলো মুসা। এখনও এখানে লোক থাকে? এ-তো ভূতের বাড়ি!

মাথা ঝাঁকালো কিশোর। আগে বাড়িটা কেমন ছিলো কল্পনা করার চেষ্টা করছেঃ ছিমছাম লন, রঙিন বাগান, উজ্জ্বল রঙের বীচ-চেয়ার, নতুন সাদা রঙ করা খিলান আর অসংখ্য স্তম্ভ, ঝকঝকে জানালা কাজ।

কিন্তু কতো আর বয়েস হয়েছে বাড়িটার? চোদ্দ-পনেরো বছর হবে। ক্ষতিটা বেশি করেছে প্রকৃতি। মাঝে মাঝেই কোনোরকম জানার না দিয়ে আচমকা ধেয়ে আসে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার বনা, লাভার মতো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামে গলিত কাদার ঢল। তার ওপর রয়েছে প্রচণ্ড কড়া রোদ, আর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের গাছপালা, বাগান আর বাড়িঘরের সাংঘাতিক ক্ষতি করে। যত্ন করতে না পারলে দ্রুত নষ্ট করে একেবারে ধ্বংস্তুপে পরিণত করে ফেলে। পাগল সংঘ যখন পরিচালনা করতেন সাইনাস, তখনও নিশ্চয় এটা ছিলো একটা জমকালো প্রাসাদ। এখন প্রায় শেষ অবস্থা।

আরেকটা ব্যাপারে নিশ্চিত হলো কিশোর, দারোয়ান-বেয়ারা-মালি বহুকাল আগে বিদায় হয়ে গেছে এখান থেকে। সাইনাস নিশ্চয় একেবারে একা থাকেন এখন, আর হয়তো কাল থেকে রয়েছে নেলি।

এসো, সহকারীদের কললো সে। লুকোচুরির আর দরকার নেই। সোজা গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিয়ে সাইনাসকে ডাকবো। কথা বের করে নেবো তার মুখ থেকে।

একমত হলো দুই সহকারী গোয়েন্দা। বৃদ্ধ সাইনাসের কাছ থেকে ভয়ের কিছু নেই।

ইলেকট্রিক কলিং বেল নিই। দরজার পাশে রাখা একটা পিতলের পুরানো আমলের ঘন্টা আর কাঠের হাতুড়ি রাখা। সেটা তুলে নিয়ে ঘন্টায় বাড়ি মারলো কিশোর। সাথে সাথে খুলে গেল দরজা। তাদের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন সাইনাস।

কিশোর পাশ তিনি বললেন, তোমরা আসবে জানতাম। পুরস্কার নিতে। কাপ-রহস্যের সমাধান করে দিলে দেবো বলেছিলাম যে। এসো, ভেতরে এসো।

ভেতরে ঢুকলো তিন গোয়েন্দা। পেছনে দরজা লাগিয়ে দিলেন সাইনাস। মস্ত একটা হলঘর, আবছা আলো। এতোবড় ঘরটায় আসবাব বলতে কিছু নেই, শুধু দুটো পুরনো ক্যানভাসে চেয়ার আর একটা নড়বড়ে ডেস্ক ছাড়া।

দেয়ালে চোখ পড়লো কিশোরের। ফ্রেমে বাঁধাই অসংখ্য ফটোগ্রাফ, সুদর্শন তরুণ আর সুন্দরী তরুণীদের। সিনেমা আর টেলিভিশনের কয়েকজন অভিনেতাকে চিনতে পারলো সে। তিরিশ-চল্লিশ বছর আগের বড় বড় অভিনেতা তারা।

ছবির দিকে কিশোরকে তাকিয়ে থাকতে দেখলেন সাইনাস। পিঠ সোজা করলেন। মুহূর্তে যেন অন্য মানুষ হয়ে গেলেন তিনি, একজন সফল মানুষ, ওই ছবিগুলোর মতোই। ওরা আমার পুরানো বন্ধু, বললেন তিনি। স্টুডিও আমাকে অপমান করে পাগল সংঘের মতো ছবি তৈরি করতে দেয়ার আগে, ওসব বড় বড় অভিনেতার ছবি পরিচালনা করেছি আমি। বললে বিশ্বাস করবে, এদের অনেকেই অভিনয় শিখেছে আমার কাছে? গলা চড়লো পরিচালকের, গমগম করে উঠলো হল জুড়ে, শিখিয়েছি কি করে কি করতে হয়। নরম কাদার মতো আঁচে ফেলে ওদের গড়েছি আমি। সৃষ্টি করেছি।

কেঁপে উঠলো রবিন। জানালার কাঁচ ভাঙা, সেগুলো দিয়ে বাতাস আসছে বটে, তবে কেঁপে ওঠার মতো শীত নয় ঘরে। তবু কেমন যেন গা ছমছমে একটা পরিবেশ, অনেকটা পুরনো, ভাঙা কবরখানার মতো, যেন অতীতের মানুষের ভূত হয়ে উঠে এসে ঘোরাফেরা করহে চারপাশে।

হ্যাঁ, আসল কথা বলি, সাইনাস বললেন, পুরস্কার। আমার কাছে নগদ টাকা নেই এখন, তবে বিজ্ঞাপন বিভাগ…।

বাধা দিয়ে কিশোর বললো, পুরস্কারের জন্যে আসিনি আমরা। গোয়েন্দাপ্রধানেরও যে অস্বস্তি লাগছে তারই মতো এটা বুঝতে পারলো রবিন কণ্ঠস্বর

নেই। নেলিকে নিয়ে যেতে এসেছি।

নেলি? মানে বটিসুন্দরী? মলিন জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢোকালেন সাইনাস। এখানে আছে কে বলে তোমাকে?

কাল রাতে হলিউড বুলভার থেকে তাকে তুলে নিতে দেখেছি আপনাকে, মুসা বললো। মড়ার খুলি আর নেলি আপনার গাড়িতে উঠছে…।

অসম্ভব, হাসার চেষ্টা করলেন পরিচালক। এখন কোনো গাড়িই নেই আমার। রোলস রয়েসটা গ্যারেজে। আর আমার…।

বাইরের গাড়িটা আমার বিশ্বাস, কিশোর বললো, হ্যারিস বেকারের। কিংবা বিজ্ঞাপন বিভাগের। কুইজ শো পরিচালনার সময়টাতে আপনাকে ব্যবহার করতে দিয়েছে। খানিক আগে আপনাকে চালিয়ে আনতে দেখলাম। কাল রাতে নেলি আর মড়ার খুলিকেও তুলে নিতে দেখেছি।

প্রতিবাদ তো করলেনই না, এবার আর হাসারও চেষ্টা করলেন না সাইনাস। ক্লান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে গিয়ে বসে পড়লেন একটা ক্যানভাসের চেয়ারে। বেরিয়ে এলো ক্ষোভ, একটা লিমুজিন পর্যন্ত ওরা ভাড়া করে দেয়নি আমাকে। কুইজ শো পরিচালনার জন্যে যতোটা কম টাকা দেয়া সম্ভব, দিয়ে কাজটা করিয়ে নিয়েছে ওরা। প্রায় ভিখিরির মতো হাত পেতে বেকারের কাছ থেকে গাড়িটা চেয়ে নিয়েছি কদিন ব্যবহারের জন্যে। কিংবা বলা যায় হুমকি দিয়ে নিয়েছি। যদি গাড়ি না দেয়, তাহলে কুইজ শো পরিচালনা করবো না বলে। পাগল সংঘের পরিচালককে বাদ দিয়ে… থেমে গেলেন আচমকা। হাঁটুর দিকে চোখ। সুতো-ওঠা প্যান্টের একটা সুতো টানছেন আনমনে। নেলিকে আমি কিডন্যাপ করিনি। তুমি ভুল করছে।

প্লীজ, মিস্টার সাইনাস, নরম গলায় অনুরোধ করলো কিশোর, যদি কিছু জানা থাকে আপনার, বলুন। আমরা জানি, নেলি ওই চিঠি বেকারকে লেখেনি। নিজের ইচ্ছেয় কুইজ শোতে অনুপস্থিত থাকেনি। এখন তাকে না পেলে পুলিশের কাছে যেতেই হবে আমাদের। পুলিশ এসে সারা বাড়ি খুঁজবে।

নেলি এখানে অবশ্যই আছে, মাথা তুললেন পরিচালক। আবার সেই আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠস্বর ফিরে এসেছে। আমার মেহমান হয়ে এখানে আছে সে। ওকে আমি বড় অভিনেত্রী বানাবো। ধনী, বিখ্যাত বানিয়ে ছাড়বে। উঠে দাঁড়িয়ে দেয়ালের হবিগুলোর দিকে হাত তুললেন তিনি। এই মানুষগুলোর মতো, যারা ওদের সবকিছুর জন্যে আমার কাছে ঋণী। সিনেমায় অভিনয় করিয়ে নেলিকে আমি…

চুপ করো বুড়ো ভাম। বেকুব কোথাকার।

দরজার কাছ থেকে ভেসে এলো কঠিন কষ্ঠ। ফিরে তাকালো তিন গোয়েন্দা। সোনালি চুলওয়ালা, চামড়ার জ্যাকেট রা তরুণ ঢুকে পড়েছে ভেতরে।

১৫

একদম চুপ! সাইনাসের দিকে তাকিয়ে আবার ধমক দিলো নকল মড়ার খুলি। তোমার সব কথাই শুনেছি। আমাকে এসবে ঢুকিয়েছো তুমি। কাপগুলো চুরি করিয়েছো। আমাকে দিয়ে। বলেছো আধা বখরা দেবে। পুরস্কার যাতে জিততে পারি তার জন্যে সব প্রশ্নের জবাব শিখিয়ে দিয়েছে। এখন আমি কি কচুটা পেয়েছি? কিছু না।

কিশোরের দিকে তাকালো মড়ার খুলি। সব কিছুর মূলে এই বুড়ো। হলিউডের এক থিয়েটারে কাজ করতাম আমি। স্টেজের পেছন দিয়ে ঢুকে আমার সঙ্গে দেখা করে বহুত ফোলালো, বললো, আমি নাকি খুব ভালো অভিনেতা। আমার অভিনয়ের তুলনা হয় না।

পকেটে হাত ঢোকানো রয়েছে সাইনাসের। বিসন্ন ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ, সত্যিই মিথ্যে কথা বলেছি। কোনোদিনই বড় অভিনেতা হতে পারবেনা তুমি, এমনকি আমার সাহায্য পেলেও না।

তার কথা যেন কানেই ঢুকলো না মড়ার খুলির। কিশোরের দিকে তাকিয়ে বললো, বেকারের অফিসে সব কথা খুলে বলতে পারিনি। অসুবিধে ছিলো। আমি জানি সাইনাস এখানে একটা ঘরে নেলিকে তালা আটকে রেখেছে। কিডন্যাপিঙের সাজা আমার জানা আছে। পুলিশকে হাজার বোঝালেও ওরা বুঝতে চাইবে না, বলবে আমিও এর সঙ্গে জড়িত। আসলেই তো তাই। এই বুড়োর কথায়ই কাল নেলিকে ফোন করে রাতে আমার বাসায় দেখা করতে বলেছি। বলেছি, হ্যারিস বেকার আমাদের দুজনের সঙ্গে কথা কলতে চায়। গোপনে। শুধু আমাদের দুজনের সঙ্গে, আর কারো সাথে না। এবং একথা যেন আমরা কাউকে না জানাই। বেকার আমাদেরকে হলিউড বুলভার থেকে তুলে নেবে।

মাথা ঝাঁকালো কিশোর। তার ধারণার সাথে মিলে যাচ্ছে মড়ার খুলির কথা। কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছে না, এতো কিছু করে বিনিময়ে কি পেতে চেয়েছিলো এই লোকটা?

আসলে নেলিকে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম, বলে গেল মড়ার খুলি। যাতে সে আমাকে টেক্কা দিয়ে বাজি জিততে না পারে। এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিলাম। নেলির কথা বলে তোমাকেও ঠেকাতে চেয়েছিলাম।

তো এখন কি চান? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।

চুক্তি, মড়ার খুলি বললো। তোমার সঙ্গে একটা চুক্তি করতে চাই। নেলির কাছে নিয়ে যাবো তোমাদেরকে। তারপর, হাসলো সে, তারপর আমরা সবাই মিলে তাকে উদ্ধার করবো। আমার পক্ষ হয়ে কথা বলবে তুমি। বলবে, তোমাদেরকে নিয়ে আমিই এসেছি তাকে রে করে নিয়ে যেতে। তোমার কথা বিশ্বাস করবে ও। কারণ পুরস্কারটা ইচ্ছে করেই তাকে জিতিয়ে দিয়েছো তুমি।

দুই সহকারীর দিকে তাকালো কিশোর। এই চুক্তি করার অধিকার তার নেই। সাইনাস আর মড়ার খুলির বিরুদ্ধে যদি কেস করে দেয় নেলি, পুলিশ জানবেই। পুলিশ তাকে জিজ্ঞেস করবে। তখন মিথ্যে কথা বলতে পারবে না সে।

অথচ এখন যত তাড়াতাড়ি পারা যায় নেলিকে মুক্ত করাও দরকার। তারপর পলিশের কাছে যাওয়া সেটা তার ব্যাপার।

মাথা ঝাঁকালো মুসা। আরও এক সেকেন্ড দ্বিধা করে রবিনও সায় দিলো।

বেশ, কিশোর বললো, আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করবো যে আপনি ওর কোনো ক্ষতি করতে চাননি। বলবো, আপনি এখানে এসেছেন ওকে মুক্ত করতে। এরপর যা করার নেলি করবে, আমি আর কিছু বলতে পারি না। ও কোথায়?

ওপরতলায়। এদিক দিয়ে এসো। একটা বেডরুমে ওকে তালা আটকে রেখেছে বুড়োটা। এক পা এগিয়েই থেমে গেল মড়ার খুলি।

জ্যাকেটের পকেট থেকে সাইনাসের ডান হাত বেরিয়ে এসেছে। সে হাতে উদ্যত একটা ছোট কালো পিস্তল। না, তোমরা যেতে পারবে না। নেলি এখানে আমার সাথে থাকবে।

দুপা ফাঁক করে দাঁড়িয়েছেন তিনি। মাথা উঁচু। রাফায়েল সাইনাসের সেই তখনকার চিত্রটা মনে পড়লো কিশোরের, পাগল সংঘ পরিচালনার সময় যেরকম আস্থার সাথে দাঁড়াতেন তিনি, তাকাতেন।

ওকে দিয়ে আমি একবার অভিনয় করিয়েছিলাম, ভারি গলায় বললেন পরিচালক, আরেকবার করাবো। ওর প্রতিভা আছে। ওকে দিয়ে হবে। হবেই। অনেক, অনেক বড় অভিনেত্রী আমি বানাবো ওকে। ছবি বানিয়ে অসকার জিতবো। আরেকবার বিখ্যাত হবে আমি।

সাইনাস আর তার মাঝের দূরত্বটা আন্দাজ করলে মুসা। ওর একটা বিশেষত্ব, ডাইভ দিয়ে উড়ে গিয়ে পড়া। মাথা নিচু করে এভাবে গিয়ে শত্রুর হাঁটুতে কিংবা পেটে পড়ে দুই বন্ধুকে নিয়ে কতোবার বেঁচে এসেছে। বেরিয়ে এসেছে বিপদ থেকে।

কিন্তু এবার সেটা করতে পারবে বলে মনে হলো না। দূরত্ব অনেক বেশি। আর দৌড়ে গিয়েও সুবিধে করতে পারবে না, সে গিয়ে পৌঁছানোর আগেই বুলেট এসে লাগবে তার গায়ে।

মুসার মনোভাব বুঝতে পেরে হাত তুলে তাকে সতর্ক করলো কিশোর। বললো, মিস্টার সাইনাস, আমি জানি গুলি করা আপনার উদেশ্য নয়। গুলি করতে পারবেন না। আপনি খুনী নন। একজন পরিচালক, অনেক বড় পরিচালক। আপনি…

এতো বিশ্বাস করো না, বাধা দিলো মড়ার খুলি। ও পাগল। যা খুশি করে বসতে পারে তোমার চেয়ে আমি ওকে ভালো চিনি। কুইজ শোর পুরস্কারে ভাগ পেলে কি করতো জানো? পার্টি দিতো। ওর মতো ফতুর হয়ে যাওয়া বেকুব বুড়োগুলো দাওয়াত করে আনতো। ওর মতোই ওরাও কোনোমতে ধুকে ধুকে টিকে আছে। জিপসি অর্কেস্ট্রাদলকে ভাড়া করতো, পত্রিকার রিপোর্টারদের খবর দিতো…

চুপ! ধমকে উঠলেন পরিচালক। বাঁ হাত তুললেন। একেবারে চুপ! এখন একসারিতে দাঁড়াও সবাই। মাথার ওপরে হাত তোলো।

সবার আগে আদেশ মানলো মড়ার খুলি। তার পেছনে লাইন দিয়ে দাঁড়ালো অন্য তিনজন।

এখন, সামরিক বাহিনীর কমান্ডারের মতো আদেশ দিলেন সাইনাস, আমি হাঁটো রুললেই ডানে ফিরে মার্চ করে হেঁটে যাবে সিঁড়ির দিকে। রেডি?

আবার আগে সাড়া দিলো মড়ার খুলি। মাথা ঝাঁকালো সে। তিন গোয়েন্দাও ঝাঁকালো।

লাইট! চিৎকার করে বললেন পরিচালক। ক্যামেরা। অ্যাকশন! মার্চ!

যেদিকে যেতে বলেছেন তিনি, সেটা হলের পেছন দিক। সিঁড়ি দেখতে পাচ্ছে কিশোর, নেমে যাওয়া সিঁড়ি। নিশ্চয় সিঁড়ির নিচে মাটির তলায় ঘর-টর কিছু আছে। ওখানে যদি আটকান ওদেরকে পরিচালক, যা ভুলো মন, হয়তো খাবার দিতেই ভুলে যাবেন। আশেপাশে কোনো বাড়িঘরও নেই যে চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে আসবে। বাঁচতে চাইলে এখনি কিছু করতে হবে।

ঠিক তার পেছনেই রয়েহে মুসা। কদম ছোট করে ফেললো কিশোর।

এই, এই কিন্তু করো না, আতঙ্কিত কষ্ঠে অনুরোধ করলো মড়ার খুলি। গুলিটা আমার গায়ে লাগবে।

খিলানের কাছে পৌঁছে সিঁড়িতে পা রাখলো কিশোর।

মার্চ। পেছন থেকে চিৎকার করছেন সাইনাস। মার্চ। মার্চ মার্চ…

হঠাৎ থেমে গেল কণ্ঠ। অস্ফুট একটা ভয়ার্ত শব্দ কানে এলো কিশোরের। একটা থাতব জিনিস খটাং করে পড়লো মেঝেতে। এসব পরিস্থিতির আগেও পড়েছে তিন গোয়েন্দা, কি করতে হয় জানে। চোখের পলকে লাইন ভেঙে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়লো ওরা।

প্রথমেই কিশোরে চোখে পড়লো পিস্তলটা পড়ে আছে দরজার কয়েক ফুট দূরে। তারপর দেখতে পেলো, যেন শূন্যে উঠে চার হাত-পা ছড়িয়ে সাঁতার কাটছেন সাইনাস। কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে ওপরে তুলে ফেলেছে দুটো শক্তিশালী হাত।

এমনভাবে ধরেছে হোফার, যাতে ব্যথা না পান বৃদ্ধ পরিচালক। তাঁকে নিয়ে গিয়ে একটা ক্যানভাসের চেয়ারে বসিয়ে দিলো সে। এখানে চুপ করে বসুন, মিস্টার সাইনাস। কিশোর, পিস্তলটা তুলে নাও। সেফটি ক্যাচ অন করে দিয়ে পকেটে ভরে রাখো।

যা বলা হলো করলো কিশোর। মড়ার খুলির দিকে তাকালো। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তরুণ অভিনেতা। মুখ সাদা। অল্প অল্প কাঁপছে।

থ্যাঙ্ক ইউ, হোফার, কিশোর বললো।

ওকে চোরের মতো ঢুকতে দেখলাম এখানে, মড়ার খুলিকে দেখিয়ে বললো হোফার। তখনই সন্দেহ হলো। ভাবলাম, কি করে দেখি তো।

ভালো করেছে। বলে মড়ার খুলির দিকে ফিরলো কিশোর। আসুন। নেলিকে কোথায় রেখেছে দেখান।

তখনও সুস্থির হতে পারেনি তরুণ অভিনেতা। তবে কিশোরের কথামতো এগিয়ে চললো দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ির ওপরে উঠে দেখা গেল লম্বা করিডর, ধুলোয় ঢাকা। ঘরের দরজার বাইরেই চাবিটা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো কিশোর।

তক্তা দিয়ে বন্ধ করে রাখা একটা জানালার পাশে ক্যানভাসের চেয়ারে বসে আছে নেলি। মুখে রুমাল গোজা। হাত বাঁধা চেয়ারের হাতলের সঙ্গে, পা বাধা পায়ার সঙ্গে।

তাকে ওই অবস্থায় দেখেই অস্ফুট শব্দ করে উঠলো মড়ার খুলি। আমি ভাবতেই পারিনি, সে বললো, এভাবে বেঁধে রাখবে। জানলে…জানলে কখনোই এখানে আনতে দিতাম না।

ওর কথা বিশ্বাস করলো কিশোর। গত কয়েক মিনিটে তার যা আচরণ দেখেছে, তাতে বুঝতে পেরেছে মড়ার খুলি কঠোরতা যা দেখিয়েছে আগে, সব মেকি, অভিনয়। আস্ত একটা ভীতু।

আবার দুর্বল ভঙ্গিতে দেয়ালে হেলান দিয়ে পঁড়িয়েছে মড়ার খুলি। তাকে দিয়ে কিছু হবে না। দ্রুত গিয়ে নেলির বাঁধন খুলে দিলো তিন গোয়েন্দা।

মাথা ঝাড়া দিয়ে যেন মাথার ভেতরটা পরিষ্কার করে নিতে চাইলো নেলি। হাতের বাঁধনের জায়গা ভললো। মুখের ওপর এসে পড়া চুলগুলো হাত দিয়ে ঢেলে সারালো পেছনে। পা টানটান করে, ঝাড়া দিয়ে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো।

উঠে দাঁড়াতে বেশ কষ্ট হলো তার। হাসলো। বেশ একটা মজার কাণ্ড হয়ে গেল, না? আমাদের সেই পুরনো পাগল সংঘ ছবির মতো। শুধু একটা ব্যাপার উষ্টো হয়েছে। ওখানে আমি তোমাকে বাঁচাতাম, কিশোর, আর এখানে তুমি আমাকে বাঁচালে।

১৬

পুরস্কারের টাকা পেয়ে এতো খুশি হয়েছে নেলি, কিশোর বললো, মিস্টার সাইনাস

বা মড়ার খুলি, কারো বিরুদ্ধেই অভিযোগ করেনি।

এখন সে কলেজে যেতে পারবে, রবিন বললো। যা সে চাইছিল। টাকার জন্যে পারছিলো না এতদিন।

সেপ্টেম্বরেই বার্কেলিতে ভর্তি হবে, মুসা জানালো।

প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে মুখ করে থাকা জানালার সারিওয়ালা, ভিকটর সাইমনের মস্ত লিভিং রুমে বসেছে তিন গোয়েন্দা। মিস্টার সাইমনের অনুরোধেই কপিচুরির কেসের গল্প বলতে ওরা এসেছে এখানে। তিনিই ফোন করেছিলেন হেডকোয়ার্টারে, সাইনাসের মুখে কাপ চুরি যাওয়ার খবর শুনে বেশ আগ্রহী হয়েছিলেন সব কথা জানার জন্যে।

টেবিলের পাশে রাখা একটা লম্বা বীচ-চেয়ারে আরাম করে বসেছেন বিখ্যাত রহস্য-কাহিনী লেখক। তাহলে আবার নিজের জায়গায় ফিরে গেহে নকল মড়ার খুলি? থিয়েটারে অভিনয় করতে?

গেছে, হাত নাড়লো কিশোর, তবে আমার মনে হয় না এবারেও সুবিধে করতে পারবে। বেঁচে থাকার জন্যে এখনও তাকে মোটর মেকানিকের কাজই করতে হবে।

এক মুহূর্ত থেমে বললো গোয়েন্দাপ্রধান, মজার ব্যাপার হলো, মড়ার খুলিকে দেখতে পারতাম না বলে তার ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্যেই ওই কুইজ শোতে অংশ নিয়েছিলাম। তাকে এতো বেশি ঘৃণা করতাম, চেয়েছিলাম যেভাইে হোক পরাজিত করবোই। কিন্তু পরে গিয়ে যে মড়ার খুলিকে দেখলাম, তাকে পছন্দই করে ফেললাম। নেলির কোনো ক্ষতি করতে চায়নি সে এ্যাপারে আমি নিশ্চিত। ও শুধু রাফায়েল সাইনাসের কথামতো নেচেছে টাকার লোভে সততটা, তার চেয়ে বেশি বড় অভিনেতা হওয়ার লোভে।

হুঁ, অভিনেতা হওয়ার লোভে কতো লোকে যে কতো কিছু করে বসে, ধীরে মাথা দোলালেন সাইমন। তা রাফায়েল সাইনাস কি করছেন এখন? সেই পুরানো ভাঙা প্রাসাদেই কি ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে অতীতের স্বপ্ন দেখছেন?

না, মুসা বললো। নেলিকে যখন আমরা নামিয়ে নিয়ে আসছিলাম, শুনলাম পাগলের মতো চিৎকার করছেনঃ চুপ, কোনো গোলমাল নয়! লাইট ক্যামেরা। অ্যাকশন! অনেক কষ্টে তাকে গাড়িতে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেছে অ্যালউড হোফার।

সমবেদনা দেখিয়ে মাথা ঝাঁকালেন লেখক। একসময় অনেক বড় পরিচালক ছিলেন তিনি। তাঁর তৈরি অনেক ছবি দেখেছি আমি, ভালো ভালো ছবি। এখনও কি হাসপাতালেই আছেন?

না, কিশোর জানালো, মোশন পিকচার অ্যাসোসিয়েশনের লোকেরা এসে গেছে। অকসর পাওয়া, অক্ষম সিনেমার লোকদের জন্যে একটা কলোনি বানিয়েছে ওরা, সেখানেই জায়গা দিয়েছে তাকে। আর কিছু না পান, পুরনো বন্ধুদের দেখা সাক্ষাৎ ওখানে পানে সাইনাস, কথা বলে মনের ভার কিছুটা হলেও হালকা করতে পরকে।

যা, তা পব্রকেন। তা হ্যারিস বেকার নিশ্চয় একেবারেই নিরপরাধ? সাইনাস আর মড়ার খুলির পরিকল্পনার কিছুই জানতো না?

না। ওই কুইজ শো-র ব্যবস্থা করে প্রমোশনের আশায় ছিলো বেকার। শো শেষ হলে সব জানার পর সেটা ফাঁস করে নিজের পায়ে কুড়াল মারতে চায়নি। তাই মড়ার খুলিকে ছেড়ে দিয়ে গোপন অতে চেয়েছে।

ভারিপদ আর শিকারী কুকুরের কি খবর?

অনেক দিন বেকার থাকার পর ভারিপদ একটা কাজ পেয়ে গেছে। একটা জুতোর কোম্পানি ওই কুইজ শো দেখে তাকে ডেকে নিয়ে গেছে, বিজ্ঞাপনের কাজ করার জন্যে। কাজটা পেয়ে খুব খুশি ডারিপদ। আর শিকারী কুকুর কলেজ শেষ করে আইন পড়বে। অসুবিধেয় পড়া, বেকার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের হয়ে আদালতে লড়াই করবে মুভি স্টুডিও আর টেলিভিশ্ন নেটওয়াকের বিরুদ্ধে। হুট করে যেন আর কাউকে বিদায় করে দিতে না পারে ওরা।

ভালো, খুব ভালো, মন্তব্য করলেন লেখক। রান্নাঘরের দিকে তাকালেন একবার। যেখানে হাড়ি-পাতিল নিয়ে খুটুর-খাটুর করছে তাঁর ভিয়েতনামি বাবুর্চি নিসান জাং কিম। তারপর আবার তিনগোয়েন্দার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, আর অলউড হোফার? তার পরিচয় গোপন আছে তো?

নিশ্চয়ই, মুসা বললো। ওর কথা কাউকে বলিনি আমরা। ছুটি শেষ হলে সেপ্টেম্বরে নিরাপদেই ইস্কুলে ফিরে যেতে পারবে।

ইস্কুলের কথায় আবার রান্নাঘরের দিকে তাকালেন সাইমন। কিমও ইস্কুলে যাবে।

ইস্কুলে যাবে? রবিন বললো। কি পড়বে?

রান্না। আপাতত ফরাসী রান্না। কোন্ কোন্ জিনিস খেলে শরীর-স্বাস্থ্য ভালো থাকে, সে-ভূত নেমেছে মাথা থেকে। নানারকম জটিল রান্নার দিকে ঝুঁকেছে আজকাল। এই যেমন, সাগরের শ্যাওলা দিয়ে মুখরোচক খাবার কি করে তৈরি করা যায়। অবশ্য হজম করতে কিছুটা কষ্টই হচ্ছে আমার। সামনে ঝুঁকলেন তিনি।

তোমরা কিন্তু দুপুরে না খেয়ে যেতে পারবে না। বিশেষ করে তুমি, মুসা।

ঝট করে পরস্পরের দিকে তাকালো রবিন আর কিশোর। এর আগের বার যখন এসেছিলো, ওদেরকে গিনিপিগ আর শামুক খাওয়ানোর জন্যে অনেক জোর-জবরদস্তি করেছিলো কিম। কাজেই এখানে দাওয়াত খাওয়ার কথা শুনলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে দুজনে।

কেন, বিশেষ করে আমাকে কেন? মুসাও অস্বস্তি বোধ করছে।

কারণ, তোমাকে খুব পছন্দ করে কিম, মুচকি হাসলেন লেখক। যা দেয় তা-ই মুখ বুজে খেয়ে ফেলো তো। বলে, রান্না করে যদি কাউকে মন মতো খাওয়াতেই না পারলাম তাহলে শান্তি কোথায়?

কেশে উঠলো মুসা। স্যার, একটা কথা বলি, কিছু মনে করবেন না। কি খাওয়াবে না খাওয়াবে সেটা আপনি বলে দেন না কেন? আপনি পছন্দ করে দিলেই তো সব ল্যাঠা চুকে যায়।

আমি জানতাম এক সময় না একসময় তোমরা একথা কলবে আমাকে। চেয়ারের পাশে রাখা লাঠিটা তুলে নিয়ে তাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন লেখক, পা এখনও পুরোপুরি ঠিক হয়নি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। ঝাল মাংসের পুর দেয়া হ্যামবার্গার খাওয়ার জন্যে আমার প্রাণটা কি কম আঁইঢাই করে? পারি না, বুঝলে, একদম পারি না। জোর করে কিছু বলতে গেলেই ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয় কিম।

ও-কি, কোথায় যাচ্ছেন? ভয় পেয়ে গেছে মুসা।

বলে আসি, অন্তত প্লেন হ্যামবার্গার যাতে দেয়, তবে বিনিময়ে তার কথা তোমাকে শুনতে হবে, মুসা।

রান্নাঘর থেকে হাসিমুখে ফিরে এলেন সাইমন। হ্যামবার্গার দেবে। আবার বসলেন চেয়ারে। নীরবে ভাবলেন কিছুক্ষণ। তারপর মুখ তুলে বললেন, তোমাদের কেসের গল্প সবটাই শুনলাম। একটা ব্যাপার পরিষ্কার হচ্ছেনা এখনও।

কী? সামনে ঝুঁকলো কিশোর।

সাইনাসকে সন্দেহ করলে কেন?

সন্দেহটা জাগিয়েছে ভারিপদ। প্রথমে করিনি, কিন্তু যতোই ভাবলাম, ততোই ধারণাটা দৃঢ় হতে লাগলো যে কেউ না কেউ তাকে মুভি স্টুডিওতে পাঠিয়েছে। কোনো কাজে। সেটা দুজন লোক হতে পারে। হ্যারিস বেকার, কিংবা রাফায়েল সাইনাস। হ্যারিস বেকারের, পাঠানোর কোনো কারণ নেই, সে বিজ্ঞাপন ম্যানেজার, চিঠি বা অন্য জিনিস আনা-নেয়ার জন্যে অফিসের লোকই আছে তার। বাকি থাকলেন সাইনাস। ভাবলাম, তিনিই বা কি আনতে পাঠাবেন? যতোই ভাবলাম, সন্দেহ ততোই বাড়তে লাগলো। তাছাড়া কিছুকিছু সূত্রও মিলে যেতে লাগলো তার আচরণের সঙ্গে।

হু্‌ বুঝেছি, মাথা ঝাঁকালেন প্রাক্তন গোয়েন্দা। তোমাকে যেমন আগে ডেকে এনেছে টিভি স্টেশনে, তেমনি ভারিপদকেও এনেছেন। তাকে একটা চিঠি দিয়ে অযথা পাঠিয়েছেন স্টুডিওর অফিসে, আর তোমাকে বলেছেন তাকে সন্দেহ করেন। লিফটে করে উঠে সাইনাসের অফিসেই ঢুকেছিলো ভারিপদ, খাম নিয়ে বেরিয়ে এসে স্টুডিওতে রওনা হলো। তুমি পিছু নিলে।

টেলিফোনের তার-টার ছিঁড়ে আগেই সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে রেখে এসেছিলেন সাইনাস। তুমি গিয়ে নয় নম্বর স্টেজে ঢুকতেই তালা লাগিয়ে দিলো মড়ার খুলি। তাকে ওকাজ করতে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন পরিচালক। তোমাকে আটকাতে চেয়েছিলেন, যাতে কুইজ শো-তে অংশ নিয়ে তুমি মড়ার খুলির পুরস্কার জেতায় বাধা হয়ে না দাঁড়াও।

হুঁ, সব বুঝলাম। বড় বেশি খুঁতখুঁতে মন তোমার, কিশোর পাশা, এটা ভাবতেও পারেননি বেচারা পরিচালক। রান্নাঘরের দিক থেকে আসা পায়ের শব্দ শুনে ঝট করে সোজা হলেন সাইমন। ফিসফিসিয়ে বললেন, ওই যে, আসছে।

টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে, খর দিলো কিম।

ভয়ে ভয়ে গিয়ে বসলো সবাই। তবে গন্ধ ভালোই আসছে। একটা প্লেটের ঢাকনা তুলে দেখালো কিম। ইয়া বড় বড় চারটে হ্যামবার্গার। ডেতরে গরুর মাংসের কিমা। আর পেঁয়াজের কুঁচি। লোভনীয় গন্ধ বেরোচ্ছে ওগুলো থেকে।

একটা নিয়ে কামড় বসালো মুসা।

ভালো না? জিজ্ঞেস করলো কিম।

চমৎকার। ফার্স্ট ক্লাস।

গুড। খুব খুশি হলো বাবুর্চি। বললো, এবার আমার একটা উপকার করতে হবে।

নিশ্চয়ই ক… বলেই মাঝপথে কামড় থামিয়ে কিমের দিকে তাকালো গোয়েন্দা-সহকারী। কি-ক্কি উপকার।

কিছু না, আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে হাত নাড়লো কিম। এই একটু চেখে দেখতে হবে আরকি। একটা প্রাচীন খাবারের উল্লেখ দেখলাম একটা চীনা খাবারের বইয়ে। লোভ সামলাতে না পেরে বেঁধেই ফেললো। আর কেউ তো খেতে জানে না, খেতে বললেও রাজি হয় না। তাই তোমাকে অনুরোধ করছি। দয়া করে যদি…।

তা জিনিসটা কি?

না, তেমন কিছু না। খুব ভালো খাবার বলেই মনে হয় আমার। তুমি যদি খেয়ে ভালো বলো, আমিও খাবোর হাজার হোক, প্রোটিন যখন বেশি…

অতো ভণিতা করছো কেন? দেখি, ঢাকনা তোলো।

ঢাকনা তুললো কিম। মাংস ভাজি। গন্ধটা বেশ চমৎকার।

হাসি ফুটলো মুসার মুখে। তা এর জন্যে এতে অনুরোধ? দাও দেখি, খাই। মাংসই তো, কি আর হবে খেলে?, শুয়োরটুয়োর না হলেই হলো। ওটা ভাই খেতে পারবো না, ধর্মে মানা।

না না শুয়োর না, শুয়োর না। এই নাও, প্লেটটা ঠেলে দিলো কিম।

একটুকরো মুখে দিয়ে দেখলো মুসা। চিবাতে চিবাতে মাথা নাড়লো, হুঁ, মন্দ। আরও কয়েক টকুরো খেয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তা কিসের মাংস এটা?

হাসলে কিম। প্লেটটা সরিয়ে নিলো মুসার সামনে থেকে। বললো, থাক, আর খেতে হবে না। বুঝেছি, রান্না ভালো হয়েছে।

কিসের মাংস? আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

তুমি খাবে?

না, আর দরকার নেই, হাত নাড়লো কিশোর। শুধু জিজ্ঞেস করছি, কিসের মাংস?

ইঁদুরের। একেবারে খাঁটি চীনা ইঁদুর। অনেক দেখেশুনে বেছে এনেছি, শান্তকণ্ঠে জানালো কিম।

সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল রবিনের। ওয়াক ওয়াক করতে করতে উঠে দৌড় দিলো বেসিনের দিকে।

বিকৃত হয়ে গেছে কিশোরে মুখ। রবিনের মতো বমি করতে না ছুটলেও মুখ দেখে বুঝতে অসুবিধে হলো না, পেট থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসা খাবার চাপতে কষ্ট হচ্ছে।

পাথরের মতো মুখ করে বসে রইলেন লেখক। কিমের এসব অত্যাচার গা-সওয়া হয়ে গেছে তার।

কয়েকটা সেকেণ্ড নিথর হয়ে রইলো মুসা। তারপর হাসি ফুটলো মুখে। যাকগে, যা খাওয়ার তো খেয়েই ফেলেছি। এখন আর বলে কি হবে? এর চেয়ে কতো খারাপ জিনিস খেয়েছি। আমাজানের জঙ্গলে সাপ, প্রশান্ত মহাসাগরের মরুদ্বীপে শুঁয়াপোকা…মরুকগে। তা ভাই, কিম, দয়া করে দুই বোতল কোকাকোলা এনে দাও তো দেখি। বলে আবার অর্ধেক খাওয়া হ্যামবার্গারটা তুলে নিলো সে। আর গোটা চারেক হ্যামবার্গার। একটা খেয়ে কি হয়?

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, ইঁদুরের মাংসের প্লেট হাতে রান্নাঘরের দিকে ছুটলো নিসান জাং কিম।

-: শেষ :-

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *