বুদ্ধির ঝিলিক

ভলিউম ১১ – বুদ্ধির ঝিলিকতিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

?

?

স্কুল ছুটি হতেই কারমলের বাড়িতে রওনা হল তিন গোয়েন্দা। বোটানিক্যাল গার্ডেন আর একটা বড় পার্কের পাশে বাড়িটা। খানিক দূরে পাহাড়। সাইকেল, চালাতে চালাতে কিশোর বলল, কড়া নজর রাখবে। বলা যায় না, আমাদের ওপরও চোখ রাখতে পারে কেউ।

খাইছে! কিশোর, দেখ! হাত তুলে পাহাড়ের নিচে দেখাল মুসা।

পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে ওরা। নিচে, বাঁয়ে কারমলের বাড়ি, অনেকখানি জায়গা জুড়ে। বেড়া দেয়া। ভেতরে জঞ্জালের ছড়াছড়ি, পুরানো তক্তা আর আরও নানারকম বাতিল জিনিসের স্তূপ। আর আছে একগাদা বোতল। একপাশে পরিচ্ছন্ন একটা সাদা কটেজ। মাঝখানে পুরানো একটা দালান, দেয়াল ধসে পড়ে পড়ে এই অবস্থা। কিন্তু বাড়ির দিকে চোখ নেই ছেলেদের।

নিচে এক অদ্ভুত দৃশ্য! লোকের ছড়াছড়ি, পিপড়ের মত পিলপিল করছে। বাচ্চা, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ, পুরুষ, মহিলা সবাই পাগলের মত ছুটছে, হুমড়ি খেয়ে পড়ছে এখানে ওখানে, ঝোপঝাড় দলে মাটির সঙ্গে মেশাচ্ছে, জঞ্জাল আর বোতল ছড়িয়ে ফেলছে যেদিকে ইচ্ছে। বসন্তের এই সুন্দর বিকেলে খেপে গেছে যেন মানুষগুলো। চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করেছে।

গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে ওরাঃ ওটা আমার! এই আমি পেয়েছি! …এই, বোতল ছাড়!…ইত্যাদি।

দলবল নিয়ে এসেছেন ইয়ান ফ্লেচার, সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হতাশ চোখে তাকিয়ে রয়েছে ওদের দিকে এলসা, নরি আর উড। সাইকেল থেকে নেমে এগিয়ে গেল তিন গোয়েন্দা।

হায় হায়রে! সব সূত্র মুছে দিল, প্রায় কেঁদে ফেলল নরি।

সবখানে ভাঙা বোতল, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। এত কেন?

কারণ, কারমল বোতল সংগ্রহ করত, ঝাঁঝাল কণ্ঠে বলল উড। হাজার হাজার! আসল বোতলটা আর কোনদিনই খুঁজে পাব না আমরা।

কপালের ঘাম মুছতে মুছতে এগিয়ে এলেন ফ্লেচার। পেছন পেছন এল এক মোটালোক আর এক সাংঘাতিক রোগাটে মহিলা। এত পাতলা, মনে হয় বাতাসেই পড়ে যাবে।

সবগুলোকে ভাগান, অফিসার,মহিলা বলল।

বেআইনী ভাবে ঢুকেছে শয়তানগুলো, মোটা লোকটা বলল, সব কটাকে আরেস্ট করুন।

মাথা নাড়লেন চীফ। সবাইকে ঢোকার অনুমতি দিয়ে গেছেন আপনার মামা, মিস্টার এজটার। আর জোর করে ওদেরকে তাড়াতে হলে এখন মিলিটারি ডাকতে হবে। আমাদের পক্ষে সম্ভব না। বড় জোর বাড়িঘর বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারি।

মামাটা তো একটা বদ্ধ পাগল ছিল,মুখ ঝামটা দিল মহিলা, পাগলের কথা মানতে হবে নাকি? আসল মালিক আমরা।

কি যে বল, জেনি এজটার, বলে উঠল এলসা, মালিক তোমরা হতে যাবে কেন? তোমাদের সঙ্গে কি সম্পর্ক…।

রক্তের সম্পর্ক থাকলে কিছুটা আমাদের সঙ্গেই আছে, এলসা, জেনি বলল। তোমার তো তা-ও নেই। তোমাদের বুদ্ধিতেই আমাদের ঠকানোর মতলব করেছিল বুড়োটা। আসলে ওকে দেখাশোনা করার জন্যে আরও আগেই চলে আসা উচিত ছিল আমাদের।

যা। তোমাদেরকে দেখতে পারত না বলেই তো, বোনের সঙ্গে গলা মেলাল মোটা মাইক, ঘরে জায়গা দেয়নি। ওই কটেজে থাকতে দিয়েছে।

তোমাকে কটেজেও দিত না, উড বলল। দশ বছর ধরে খবর নেই, এখন এসেছ দরদ দেখাতে। বেআইনী ভাবে তোমরাই বরং ঢুকেছ।

এই, তুমি বলার কে! চেঁচিয়ে উঠল জেনি।

তুমিও হাত মিলিয়েছ এলসার সঙ্গে! গর্জে উঠল মাইক। তোমরা দুজনে মিলে আমাদের ঠকানোর মতলব করেছ। কিন্তু আমরা জানি, আসল উইল একটা আছে, তাতে নিশ্চয় নাম রয়েছে আমাদের।

আসল উইলে নরি আর এলসার নাম আছে। আর কারও না, উকিল বলল।

রাগে ঘোঘোৎ করে উঠল মাইক। সেকথা শুধু তুমি বলছ। উইলটা হারাল কি করে, অ্যাঁ? আমার তো মনে হচ্ছে, আসল উইলটা তুমিই গাপ করে দিয়েছ, আমাদের ধোকা দেয়ার জন্যে।

তাহলে তো ভালই হত, উকিল হাসল। তোমরা একটা কানাকড়িও পেতে, সব পেত নরি।

আমরাও কারমলের বংশধর! আবার চেঁচিয়ে উঠল জেনি। সম্পত্তির ভাগ আমরাও পাব। ক্যালিফোর্নিয়ার আইনে কিছুই পাবে না। যদি তোমাদের মামার ছেলে বা নাতি না থাকত, তাহলে পেতে।

জ্বলন্ত চোখে নরির দিকে তাকাল ভাইবোন। ছেলেটার চোখে ওদের দৃষ্টিরই প্রতিফলন দেখতে পেল।

দেখে নেব, কুৎসিত ভঙ্গিতে দাঁত খিচাল মাইক।

নিয়ো, এলসা বলল। দয়া করে এখন বেরোও আমার বাড়ি থেকে।

মুলোর মত লাল হয়ে গেল ভাইবোনের মুখ।

আমাদের জিনিস আমরা আদায় করে নেবই, মনে রেখ, দাঁতে দাঁত চেপে বলল জেনি। কি করে নিতে হয় তা-ও আমরা জানি।

গটমট করে চলে গেল দুজনে। ওদিকে লড়াই বাধিয়ে দিয়েছে দুই হোকরা। ভাইবোনের দিকে চেয়ে শাগ করে ছেলেদের লড়াই থামাতে এগিয়ে গেলেন চীফ।

ব্যাটারা একেবারেই ছোটলোক, ফস করে বলে ফেলল মুসা।

ঠিকই বলেছ, একমত, হল উকিল। কারমল এখন থাকলে ঝেটিয়ে বিদেয় করত। একটা পয়সাও পাবে না ব্যাটারা। যাকগে, এখন আমাদের কাজ সেরে ফেলা দরকার। বোতলটা খুঁজতে হবে…

ভেতরে যাওয়া দরকার আমাদের, বাধা দিয়ে বলল কিশোর।

জবাবের অপেক্ষা না করেই কটেজে ঢুকে পড়ল গোয়েন্দাপ্রধান। অন্যেরা অনুসরণ করল। পরিপাটি লিভিংরুমে চোখ বোলাচ্ছে কিশোর। ভোলা জানালা দিয়ে ফুরফুরে চমৎকার বাতাস আসছে।

মিস্টার কারমলের ঘরে বোতল খুঁজেছেন আপনারা? উকিল আর এলসার দিকে তাকাল কিশোর।

জবাবটা দিল নরি, খুঁজেছি। পাইনি। পাওয়ার কথাও না, আনমনে বলল কিশোর। আমার মনে হয় নেই।

পকেট থেকে ধাঁধার নকলটা বের করল সে। এখান থেকেই শুরু করার কথা বলেছেন কারমল, তাঁর বাড়ি থেকেই। কবিতার মত করে লিখেছেনঃ হোয়্যার দ্য ওয়াইল্ড ডগস লিভস। বিশেষ ধরনের কোড।

তারমানে, ধীরে ধীরে বলল রবিন, বটল আর স্টপারও কোন ধরনের কোড? আসল বোতল না হয়ে বোতলের মত দেখতে কোন জিনিসের কথা বুঝিয়ে থাকতে পারেন।

তেমন দেখতে কিছু নেই এখানে, এলসা বলল।

কিন্তু পানি আছে! আস্তে কথা যেন বলতেই পারে না নরি, চেঁচাল, বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশে, হাঁস পালে যে পুকুরে।

রবিন বলল, পরের লাইনটা বলছে, অ্যাবাভ দ্য অ্যাপলস অ্যাণ্ড পেয়ারস অল অ্যালোন। আপেল গাছের কথা বলছে হয়ত। পুকুরটার পাড়ে আছে ওরকম গাছ?

উত্তেজিত হয়ে উঠল উড। ঠিক বলেছ!

বেশ… শুরু করল কিশোর, শেষ করতে পারল না।

জানালার বাইরে থেকে শোনা গেল গা জ্বালানো খিকখিক হাসি। বলল, অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে, মাথামোটার দল! পায়ের শব্দ শোনা গেল।

জানালার কাছে দৌড়ে গেল মুসা। চেঁচিয়ে বলল, শুঁটকি টেরি!,

বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিকে ছুটে যাচ্ছে তালপাতার সেপাই এক তরুণ, তিন গোয়েন্দার চেয়ে কিছু বড়। ওদের চিরশত্রু টেরিয়ার ডয়েল।

নে ফেলেছে, গুঙিয়ে উঠল মুসা। আগেই ভাবা উচিত ছিল…

ভেব না,সান্ত্বনা দিল কিশোর, বেশি দূর এগোতে পারবে না। বিলাবং বলে হয়ত হাঁসের পুকুরটা বুঝিয়েছেন কারমল, আপলস অ্যাণ্ড পেয়ারসের মানে গাছ-ও হতে পারে। এত সহজ মনে হয় না। অন্য কোন মানে আছে।

এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকাল কিশোর। কেউ জবাব দিতে পারল। ভ্রূকুটি করল সে। কারমলের ব্যাপারে যত বেশি জানতে পারব, তার ধাঁধার সমাধান করা তত সহজ হবে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল উডের দিকে।

বেশ, শোন, উকিল বলল। উনিশশো, দুই সালে অস্ট্রেলিয়ায় জন্মেছিল, কারমল। তার বাবা ছিল একজন আসামী। তখন আসামীদেরকে সাজা দিয়ে, অস্ট্রেলিয়ায় পাঠাত ইংল্যাণ্ডের লোকেরা। বাপের চেয়ে কোন অংশে ভাল ছিল না কারমল, ছেলেবেলায়ই ভীষণ দুষ্ট ছিল। অল্প বয়েসেই বুশরেঞ্জার, মানে ডাকাত হয়ে গেল সে। ডাকাতি করে বড়লোক হল। তবে অপরাধী সে, আইনের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে হত। তরুণ বয়েসে চলে গেল ক্যানাডায়, আরও অনেক টাকা কামাল, বিয়ে করল অনেক বয়েসে, একটা ছেলে হল। বছর বিশেক আগে এসেছিল রকি বীচে, তারপর একাই বাস করেছে। অনেকটা সন্ন্যাসীর মত জীবন যাপন। তার ছেলে বছর পাঁচেক আগে যখন মোটর অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল, এলসার যাবার জায়গা রইল না। কাজেই তাকে নিজের কাছে নিয়ে এল বুড়ো। আলাদা কটেজ বানিয়ে দিল। দুনিয়ার সব মানুষকে সন্দেহ করত সে, কাউকে নিজের ঘরের ধারেকাছে ঘেঁষতে দিত না। অস্ট্রেলিয়া ছাড়া আর কোন দেশকে ভালবাসত না, বাপের মতই গোঁড়া ককনি ছিল বোধহয়। দুর্ধর্ষ এক মানুষ।

রবিন বলল, ধাঁধায় অস্ট্রেলিয়ান শব্দ ব্যবহার করেছেন কারমল। অ্যাপলস অ্যাণ্ড পেয়ারস বলে অস্ট্রেলিয়ান বা ক্যানাডিয়ান কিছু বোঝননি তো?

বলতে পারব না, বলে এলসার দিকে তাকাল উড।

এলসাও মাথা নাড়ল। বলল, বাড়ি চলে যাও এখন। গিয়ে ভালমত ভাব। দেরি হয়ে গেছে।

নিরাশ হয়েছে নরি। তার হিরোরা পরাজিত, ধাঁধার সমাধান করতে পারেনি। তিন গোয়েন্দাও অখুশি। দেখল, পরাজিত হয়ে আরও অনেকেই ফিরে যাচ্ছে। নীরবে সাইকেল চালাল ওরা রকি বীচের দিকে।

নীরবতা ভাঙল মুসা, কিশোর, ককনি কি?

লণ্ডনের ইষ্ট এতে যাদের বাড়ি তাদেরকে বলে ককনি। কেউ কেউ বলে, সেইন্ট মেরিলবাউ গির্জার ঘন্টার শব্দ যতদূর যায়, ততদূরের মধ্যে যাদের জন্ম তারা আসল ককনি। সে যাই হোক, ককনিদের কিছু কিছু শব্দের উচ্চারণ অদ্ভুত। হটকে বলে অট, ব্লেমকে বলে ব্লাইম, এরকম। অস্ট্রেলিয়ানরাও করে ওরকম।

কিশোর, রবিন বলল। উচ্চারণের ওপর ভিত্তি করে শব্দ বসানো হয়নি তো, ধাঁধায়? হয়ত…

সিটের ওপর হঠাৎ সোজা হয়ে গেল কিশোর। কেঁপে উঠে আরেকটু হলেই কাত হয়ে পড়ে গিয়েছিল সাইকেল। ককজি! চেঁচিয়ে উঠল সে। হয়ত…

কিশোর! বাধা দিল মুসা। স্যালভিজ ইয়ার্ডের কাছে চলে এসেছে ওরা। রাস্তার ধারে একটা পরিচিত গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, সেদিকে চোখ পড়েছে তার। শুঁটকি!

লাল গাড়িটা খালি মনে হল। ভাল করে তাকাতে চোখে পড়ল, সামান্য নড়ল একটা মাথা। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে টেরিয়ার। নিশ্চয় ওদের পিছু নিয়ে এসেছে।

জলদি, বলতে বলতে পকেট থেকে নকলটা বের করল কিশোর, এমন ভাব কর, যেন জরুরী কিছু জেনে ফেলেছি আমরা। তোমাদেরকে তদন্ত করতে পাঠাচ্ছি।

তাড়াহুড়ো করে চলে যাবে, যাতে তোমাদের পিছু নেয় সে। আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে, দেখতে যাচ্ছি ঠিক কিনা। শুঁটকি পিছু নিক, চাই না।

টোপ গিলল শুঁটকি। দ্রুত প্যাড়া করে একটা বাড়ির মোড়ে যাবার সময় স্পোর্টসকারের ইঞ্জিনের শব্দ শুনল রবিন আর মুসা।

ইয়ার্ডের গেট দিয়ে কিশোর ঢুকে যাওয়াতক অপেক্ষা করেছে টেরিয়ার, তারপর পিছু নিয়েছে রবিন আর মুসার।

তাকে পিছে পিছে টেনে নিয়ে চলল দুই সহকারী গোয়েন্দা। এমন ভাব করল, যেন কেউ পিছু নিয়েছে এটা বুঝতেই পারেনি। অহেতুক কয়েকটা আঁকাবাঁকা মোড় ঘুরে সময় নষ্ট করে শেষে বাড়ির পথ ধরল ওরা।

রবিনকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে অবাক হল শুঁটকি। তারপর মুসার পিছু নিল। খানিক পরে দেখল, মুসাও বাড়িতে ঢুকছে। ড্রাইভওয়েতে ঢুকে ফিরে তাকাল মুসা। হাহ হাহ করে হেসে শুঁটকির দিকে চেয়ে হাত নাড়ল রাগিয়ে দেয়ার জন্যে। গাড়ি ঘুরিয়ে ধুলোর ঝড় তুলে চলে গেল বঁটকি।

রাতে খাওয়ার পর কিশোরকে ফোন করল রবিন।

কি জানি কোথায় গেল, মেরিচাচী জবাব দিলেন। তাড়াহুড়ো করে খেয়েই বেরিয়ে গেল।…না, কোথায় গেছে বলে যায়নি।

অবাক হয়ে রবিন ভাবল, গেল কোথায় কিশোর?

পরদিন সকালে নাস্তার পরেও কিশোর ফোন করছে না দেখে রবিনকে ফোন করল মুসা।

আমাকেও তো করেনি, রবিন জানাল।

শেষে আর অপেক্ষা না করে স্যালভিজ ইয়ার্ডে চলল দুজনে। হেডকোয়ার্টারে কিশোরকে পাওয়া গেল না। তাই তাকে ঘরে খুঁজতে চলল।

বাড়ির সামনে পিকআপ ট্রাকটার ইঞ্জিন মেরামত করছেন রাশেদ পাশা। রবিনের প্রশ্নের জবাবে বললেন, কি জানি, কোথায় গেল। সেই ভোরে বেরিয়েছে। কি নাকি জরুরী কাজ। নাস্তাও করল না ভালমত।

চল, ইস্কুলেই দেখা হবে, রবিন বলল।

যদি আসে, হতাশ ভঙ্গিতে হাত নাড়ল মুসা।

স্কুলেও কিশোরের দেখা মিলল না। ক্লাসরুমে উদ্বিগ্ন হয়ে বসে বার বার একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে দুই গোয়েন্দা, এই সময় হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল কিশোর। চওড়া হাসি উপহার দিল দুই বন্ধুকে। দুপুরে টিফিনের আগে আর কথা বলার সুযোগ হল না। স্কুলের সাইন্স ক্লাবের প্রেসিডেন্ট সে, সুতরাং টিফিনের সময়ও বেশ খানিকটা সময় কাটাতে হল ক্লাবে জরুরী মীটিঙে। আবার ক্লাস শুরু হওয়ার ঘন্টা বাজলে তাড়াহুড়ো করে রবিন আর মুসাকে বলল, পেয়েছি। চাবিকাঠি। ছুটির পর হেডকোয়ার্টারে চলে এস।

শুক্রবারে একটা বাড়তি ক্লাস করতে হয় রবিন আর মুসাকে, কিশোরের সে ঝামেলা নেই। ফলে সে চলে গেল, দুই সহকারীকে বসেই থাকতে হল ক্লাসে। ছুটির পরে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে কৌতূহলে ফেটে পড়তে পড়তে ইয়ার্ডে এসে ঢুকল দুজনে। কিভাবে যে দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে ট্রেলারে ঢুকল, বলতে পারবে না। কিশোর বসে আছে তার জায়গায়।

রাইমিং ম্যাং ঘোষণ করল সে।

ডেস্কের উপর ছড়ানো কয়েক পাতা কাগজে গিজগিজ করে কি লেখা।

বাহ, ভারি সহজ করে বললে! নাক কুঁচকাল মুসা। একেবারে গ্রীক দিয়ে শুরু। তা স্ন্যাংটা কি?

কাল তোমাদের কথা থেকেই আইডিয়াটা পেয়েছি আমি, কিশোর বলল। সেটাই জানতে বেরিয়েছিলাম। দেখলাম, আমার ধারণাই ঠিক।

কিন্তু এই রাইমিং স্ল্যাং জিনিসটা কি? রবিনের প্রশ্ন।

এটা এক ধরনের অত্যাং। যে শব্দটা বলতে চাও, সেটা বলার দরকার নেই, অন্য আরেকটা শব্দ দিয়ে সেটা বোঝাতে পারবে। শব্দের মানে এক হওয়ারও দরকার নেই, ছন্দের মিল থাকলেই হল। কবিতার মত করেও বলতে পার। এই যেমন, স্নো বোঝনোর জন্যে তুমি বলতে পার, ফল অ্যাণ্ড থ্রো।

মারছেরে! গ্রীক না, একেবারে মঙ্গল গ্রহের ভাষা, আবার নাক কুঁচকাল মুসা। তারমানে বেসবল বোঝাতে হলে আমাকে বলতে হবে, থ্রো দ্য বল?

বলতেই হবে, এমন নয়, তবে ইচ্ছে করলে ওরকম করে বলে বোবঝাতে পার। তবে বেসবল বোঝতে হলে ম্যাঙে বল বলতে পারবে না, বলতে হবে অন্য কিছু। এই যেমন ডাউন দ্য ওয়াল, কিংবা শর্ট অ্যাণ্ড টল, অথবা আর কিছু।

বুঝেছি, রবিন বলল। কিন্তু এই স্ল্যাঙের সঙ্গে ককনি আর কারমলের সম্পর্কটা কোথায়? দাঁড়াও দাঁড়াও, ওর বাবা ছিল ককনি!

এবং অস্ট্রেলিয়ান। ককনিরা ওই স্ল্যাঙের আবিষ্কারক, সঙ্গে করে নিয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়ায়। অন্য লোককে বোকা বানাতে নিজেদের মধ্যে এখনও ওই স্ল্যাঙের মাধ্যমে কথা বলে ককনিরা।

কারমলের ধাঁধার মত করে, বলল মুসা।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। রকি বীচের পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম আমি প্রথমে। তারপর লস অ্যাঞ্জেলেসের লাইব্রেরিতে। রাইমিং স্ল্যাঙের ওপর যত বই পেয়েছি সব ঘেঁটেছি। ধাঁধার নকলটা টেনে নিল সে। প্রথমেই ধর, অ্যাপলস অ্যাণ্ড পেয়ারস। তারমানে, বুঝিয়েছে, স্টেয়ারস।

স্টেয়ারস? সিঁড়ি! হাঁ হয়ে গেছে মুসা। জিন্দেগিতেও কল্পনা করতে পারতাম আমি।

স্ল্যাঙের নিয়মকানুন না জানলে কেউই পারবে না, কিশোর বলল। ইউ অ্যাণ্ড মি মানে কাপ অভ টি। ককনিতে ট্রাবল অ্যান্ড স্ট্রাইফ বলে ওয়াইফ; মানে স্ত্রী বোঝায়। তেমনি, বেড, অর্থাৎ বিছানাকে বলে আক্কেল নেড। কি বুঝলে?…

বিমল হাসিতে দাঁত বেরিয়ে পড়ল কিশোরের।

সমাধান তাহলে করে ফেললাম? মুসার মুখেও হাসি।

না না, বেশ খুশি হয়েই যেন মাথা ঝাঁকাল কিলোর। এত সহজ না। শয়তানী বুদ্ধিতে ঠাসা ছিল কারমলের মগজ। সমাধান এখনও অনেক দেরি। তবে রাইমিং স্ল্যাং থেকে কিছু সূত্র পেলাম এই যা। বাকিগুলো সমাধান করতে হবে যেখানে আমাদের যেতে বলা হয়েছে সেখানে গিয়ে।

কেন রাইমে সব জবাব নেই? রবিন জিজ্ঞেস করল।

না, অস্বস্তি ফুটল কিশোরের কণ্ঠে। বলা যায় না, নতুন কোন কায়দা করে রাখতে পারে কারমল?

বুঝব কি করে তাহলে?

রাইমের সূত্র আমাদেরকে যেখানে টেনে নিয়ে যায়, সেখানে গিয়ে হয়ত নতুন সূত্র পাওয়া যাবে। ধর, সিঁড়িতে যেতে বলা হয়েছে। যখন ওই সিঁড়ি পাব, হয়ত ওটার কাছে ধাঁধার পরের সূত্র দ্য লেডি ফ্রম ব্রিস্টলের মানে পেয়ে যাব।

চল তাহলে। হোয়্যার দ্য ওয়াইল্ড ডগস লিভস-এর মানে জানি আমরা, কারমলের বাড়ি। তারপর আসছে বটল অ্যাণ্ড স্টপার। মানে কি?

খাইছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। সত্যিই তো। এর মানে তো জানি না।

মিটিমিটি হাসল কিশোর। এটার মানে সব বইতেই পেয়েছি। সহজ। দণ্ড পাওয়া সব অপরাধীই জানে…।

অপরাধী? চোখ বড় বড় হয়ে গেল রবিনের। বুঝেছি! স্টপার দিয়ে হবে কপার! কপ, অর্থাৎ পুলিশ!

ঠিক, বলল কিশোর। বুড়ো কারমলের বাড়ির কাছে গিয়ে একজন পুলিশ খুঁজব।। চল, চল, দেরি করছি কেন তাহলে? তর সইছে না আর মুসার।

সমস্ত নোট গুছিয়ে নিতে লাগল কিশোর। ওয়াকিটকি নিতে বলল সহকারীদের। বলা যায় না, দরকার হয়েও যেতে পারে।

সবে গিয়ে বেরোনোর জন্যে ট্র্যাপোর তুলেছে মুসা, এই সময় বাজল টেলিফোন। কিশোর ধরল। তিন গোয়েন্দা বলছি। সরি, এখন কথা বলার সময় নেই, বাইরে বেরোচ্ছি।

স্পীকারে ভেসে এল ভোতা একটা কণ্ঠ। না বেরোলেই ভাল করবে। সাবধান। অন্যের ব্যাপারে নাক না গলানোর পরামর্শ দিচ্ছি।

খুট করে কেটে গেল লাইন। তারপর নীরবতা। ঢোক গিলল রবিন। মহিলার গলা, কিশোর, তাই না? ঠিক বুঝলাম না। তবে মহিলাই হবে, কথায় ব্রিটিশ টান। জেনি এজটার?

তা কি করে হবে? মুসা বলল। ওই বেটির সঙ্গে কথাই হয়নি আমাদের। আমাদের ফোন নাম্বার পেল কিভাবে? কারমলরা নিশ্চয় বলেনি।

জেনি নাহলে আর কে?: চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। আমাদের অচেনা কেউ? অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে?

এলসা কারমল হয়ত বলতে পারবে, আশা করল রবিন।

অস্বস্তিভরে মাথা ঝাঁকাল অন্য দুজন।

বাইরে বেরিয়ে সাইকেলে চাপল ওরা। গেট দিয়ে বেরোনোর সময় একটা লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল রাস্তার ওপাশের একটা বড় ঝোপের ধারে। বিশালদেহী। গলায় লাল টাই, হাসছে মনে হল। তারপর হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। যেন ভোলবাজি, এই ছিল এই নেই। পরস্পরের দিকে তাকাল ছেলেরা।

স-সত্যিই ছিল? ভূতের ভয়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেছে মুসার। আমাদের ওপর নজর রাখছিল? রবিনের প্রশ্ন।

হয়ত, বলল কিশোর। না-ও হতে পারে। সাধারণ কেউ, হয়ত বেড়াতে বেরিয়েছে।

তাহলে গেল কোথায়? মুসা বলল।

গেছে ওদিকেই কোথাও। রোদ বেশি, ছায়াও বেশি। ছায়ায় হারিয়ে গেছে। বোধহয়। রাস্তার সামনে পেছনে দুদিকেই তাকাল। কেউ নেই। এস। ধাঁধার সমাধান করে রতগুলো বের করতে হবে আমাদের।

তা তো নিশ্চয়, মাথা দুলিয়ে বলল মুসা। তবে ডজনখানেক বটল অ্যাণ্ড স্টপার আমাদেরকে ঘিরে রাখলে এমন নিরাপদ বোধ করতাম আরকি।

হেসে উঠল রবিন আর কিশোর। কিন্তু অস্বস্তি তাড়াতে পারল না।

আগের দিনের চেয়ে বিচিত্র দৃশ্য কারমলের বাড়িতে। পুলিশের লোক দাঁড়িয়ে আছে হাত গুটিয়ে, কিছুই করার নেই ওদের। জিনিসপত্র ছড়াচ্ছে, লাথি মেরে বোতল ভাঙছে রত্নশিকারিরা। রেগে গেছে। যেন বুঝতে পারছে ঠকানো হয়েছে ওদেরকে।

কটেজের লিভিংরুমে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। ওদের জন্যে নরিকে ফলের রস আনতে বলল এলসা। ওদের দিকে চেয়ে হাসল রস উড।

বোকা বনে তো, উকিল বলল। সবাই বনেছে। যা রাগা রেগেছে না ওরা। – এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন আমরা ওদের পাওনা জিনিস কেড়ে নিয়েছি।

মুসা বলে ফেলল, কিশোর বোকা বনেনি।

বলেছিলাম না। চেঁচিয়ে উঠল নরি, ফিরে এসেছে। বলেছিলাম, বুঝে ফেলবে।

পাথরগুলো কোথায়, জেনেছ? উড জিজ্ঞেস করল।

না, জবাব দিল কিশোর। তবে ধাঁধার সমাধানের চাবিকাঠি বোধহয় পেয়েছি। খানিকটার সমাধান করেও ফেলেছি। মিসেস কামল, বিশেষ কোন পুলিশম্যানকে কি চিনতেন আপনার শ্বশুর?

পুলিশ, মাথা খারাপ। পুলিশকে দুচোখে দেখতে পারত না।

পুলিশ? উড বলল, কেন, বোতল, বিলাবং আর নাশপাতি গাছের সঙ্গে পুলিশ খাপ খাচ্ছে নাকি?

ফলের রস খেতে খেতে রাইমিং ম্যাঙের ব্যাপারটা জানাল কিশোর।

এরকম আশ্চর্য কথা কখনও শুনিনি, উকিল বলল। এলসা, তুমি শুনেছ?

। আমি অস্ট্রেলিয়ানও নই, ইংলিশও নই, এলসা বলল। তবে জেনি আর মাইক জানতে পারে, কারণ ওরা ইংরেজ।

সন্দেহ আছে, বলল কিশোর। ককনিদের সঙ্গে ওদের সম্পর্ক থাকার কথা নয়।

আগ্রহের সঙ্গে বলল নরি, মিস্টার সান আর দাদা মাঝে মাঝেই অদ্ভুত ভাষায় কথা বলত। কিশোর, সমাধান করে ফেলছি আমরা, তাই না?

তাই তো মনে হয়, বলে নকলটা বের করে মেলল কিশোর। দেখি আলোচনা করে। প্রথমে, হোয়্যার দ্য ওয়াইল্ড ডগস লিভস, দ্য বটল অ্যান্ড স্টপার; শোজ দ্য ওয়ে টু দ্য বিলাবং হোয়্যার দ্য ওয়াইল্ড ডগস লিভস রাইমিং স্ল্যাং নয়। এটা বোঝায় কারমলের বাড়ি। বই বলছে, বটল অ্যান্ড স্টপার মানে কপার, অর্থাৎ পুলিশ। বিলাবঙের মানে পুকুর কিংবা ডোবা কিংবা ঝর্না। তারমানে বলা হয়েছে, এখানে এসে একজন পুলিশম্যানকে খুঁজে বের করতে যে একটা বিশেষ জলাশয় চেনে।

চেঁচিয়ে বলল উকিল, সেই পুলিশম্যানকে নিশ্চয় চেনার কথা তোমার!

কিন্তু চিনি না। তুমিও জানো পুলিশ দেখতে পারত না কারমল।

আছে নিশ্চয় একজন, কিশোর বলল। থাক, সেটা পরে দেখা যাবে। পরের ধাঁধাটা দেখা যাক এবার। অ্যাবাভ দ্য অ্যাপলস অ্যাণ্ড পেয়ারস অল অ্যালোন; দ্য লেডি ফ্রম ব্রিস্টল রাইডস ফ্রম আ ফ্রেণ্ড। অ্যাপল অ্যাণ্ড পেয়ারস হল গিয়ে সিঁড়ি। তবে লেডি ফ্রম ব্রিস্টলের মানে কি জানি না আমরা এখনও। আর রাইডস ফ্রম আ ফ্রেণ্ডও রাইম মনে হচ্ছে না। এটা অন্য কোন ধরনের কোড।

তারমানে দাঁড়াল, রবিন বলল, বিশেষ জলাশয়টার কাছে কোন সিঁড়ি পাব আমরা। এবং তার ওপরে ব্রিস্টলের মহিলা কোন একটা সূত্র দেবে একজন বন্ধুকে।

নাহ, গুঙিয়ে উঠল মুসা, এখন আর সহজ লাগছে না।

ধাপে ধাপে, ধীরে ধীরে এগোতে হবে, বলল কিশোর। ফ্রেণ্ড বলেছেন বটে, কিন্তু বন্ধুর কথা হয়ত বোঝননি। সে পরে দেখা যাবে। পরের ধাঁধাটা বলছেঃ অ্যাট দ্য টেনথ বল অভ টোয়াইন, ইউ অ্যাণ্ড মি; সী আওয়ার; ও হ্যান্ডসাম মাগ অ্যাহেড। ভুরু কোঁচকাল সে। কঠিন হচ্ছে আস্তে আস্তে। ইউ অ্যাণ্ড মি-এর মানে, আ কাপ অভ টি, বা এক পেয়ালা চা। কিন্তু বল অভ টোয়াইনের মানে বুঝতে পারছি না। আর, সী আওয়ার হ্যাণ্ডসাম মাগ অ্যাহেডও রাইম নয়। এই তিনটের তো কিছু কিছু মানে করতে পেরেছি, চার নাম্বারটা একেবারে দুর্বোধ্য। ওয়ান ম্যানস ভিকটিম ইজ অ্যানাদারস ডারলিন, ফলো দ্য নোজ টু দ্য প্লেস। এটাতে রাইম আছে কিনা সেটাই বুঝতে পারছি না।

ইউ অ্যাণ্ড মি যদি এক কাপ অভ টি হয়, এলসা বলল, হ্যাণ্ডসাম মাগ বলে হয়ত বিশেষ কোন চায়ের পাত্রের কথা বুঝিয়েছে।

হ্যাঁ, তা হতে পারে, একমত হল কিশোর।

কিন্তু, রবিন প্রশ্ন তুলল, কারমল বলছেন, আওয়ার মাগ! দ্য মাগ কিংবা হিজ মাগ বলেননি। আর চতুর্থ ধাঁধায় তোমার নাক বা আমার নাক না বলে কেন দ্য নোজ বা নাকটি বললেন?

এখনও বুঝিনি, স্বীকার করল কিশোর। তবে আমি শিওর, কারণ একটা নিশ্চয় আছে, যাই হোক, পঞ্চম ধাঁধা বলছে, হোয়্যার মেন বাই দেয়ারট্রাবল অ্যাণ্ড স্ট্রাইফ, গেট আউট ইফ ইউ ক্যান। ট্রাবল অ্যান্ড স্ট্রাইফের মানে ওয়াইফ। কারমলের কথার মানে দাঁড়াচ্ছে, একজন স্ত্রী কিন। এর কোন অস্ট্রেলিয়ান মানে আছে, মিসেস কারমল? সেটেলাররা ইংল্যাণ্ড থেকে স্ত্রী কিনে নিয়ে যেত, না?

তা অনেকটা এরকমই, এলসা বলল। সেটেলারদের জন্যে জাহাজ বোঝাই করে মেয়েমানুষ পাঠানো হত। ওখান থেকে যার যার পছন্দমত স্ত্রী বাছাই করে মিত ওরা।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। হুঁ, খাপ খাবে মনে হচ্ছে। গেট আউট ইফ ইউ ক্যান বলে হয়ত বিয়ে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে আসতে বলেছে। যদিও মাথামুণ্ড কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এবার আসা যাক ছয় নম্বর ধাঁধায়। ইন দ্য পশ কুইনস ওল্ড নেড, বি ব্রাইট; অ্যাণ্ড নেচারাল অ্যাণ্ড দ্য প্রাইজ ইজ ইওরস। ওল্ড নেড মানে বিছানা। পশ হলোগে ফিটফাট। তারমানে পাথরগুলো পাওয়া যাবে ফিটফাট কোন রানীর বিছানায়।

আনমনে মাথা নেড়ে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল উকিল, কোন্ রানী? কিসের বিছানা? কোন্ মিউজিয়মে আছে?

থাকতে পারে। তবে শেষ ধাঁধা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় হয়নি। আগেরগুলোর সমাধান করতে না পারলে এটা বোঝা যাবে না।

এখন তাহলে প্রথম কাজ, রবিন বলল, বটল অ্যান্ড স্টপার খুঁজে বের করা, যে জানে জলাশয়টা কোথায়।

হতে পারে, ওই জায়গাটা পছন্দ ছিল কারমলের, অনুমান করল মুসা।  সাঁতার কাটতে যেতেন, কিংবা পানি আনতে, কিংবা মাছ ধরতে…

মাছ ধরতে! চেঁচিয়ে উঠল নরি। মা, আমাদের বাড়ির পাশের কাউন্টি পার্কে মাছ ধরতে যেত দাদা! ডেপুটি গ্যারেটকে নিয়ে যেত!

ডেপুটি শেরিফ! কথাটা ধরল রবিন। তারমানে পুলিশম্যান! কাউন্টি পুলিশম্যান!

তাই তো, উকিল বলল। পার্কের পুলিশ অফিসার। হঠাৎ ফিসফিসিয়ে মুসা বলল, কিশোর, রাস্তায়!

সবাই দেখল, গাছের নিচে পার্ক করা একটা নীল গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশালদেহী একজন লোক।

আরেকজন গুপ্তধন শিকারি হবে হয়ত,আন্দাজ করল উকিল।

হয়ত, কিশোরের কণ্ঠে অস্বস্তি। ইয়ার্ড থেকে বেরিয়েও লোকটাকে দেখেছে, সেকথা জানাল।

দরজার দিকে রওনা দিল উড। জিজ্ঞেস করা দরকার।

ছেলেরা দেখল, উকিল, রাস্তায় নামতেই গাড়িতে উঠে বসল লোকটা। চলে গেল। ফিরে এল উড।

ওই মজা দেখতেই.এসেছে, বলল সে। অনেক আসছে ওরকম।

উঠে দরজার দিকে চলল তিন গোয়েন্দা। পেছনে এল নরি। আমিও তোমাদের সঙ্গে কাজ করছি, মনে আছে?

তোমার কাজের দরকার নেই, নরম্যান, পেছন থেকে কড়া গলায় বলল তার মা।

হ্যাঁ, তোমার মা ঠিকই বলেছেন, মুসা বলল। তুমি এখনও নেহায়েতই শিশু।

শিশু! চিৎকার করে বলল নরি। ফিরিয়ে নাও বলছি! ফিরিয়ে নাও কথাটা!

আসলে, বোঝানোর চেষ্টা করল কিশোর, তুমি আমাদের সঙ্গে এলে কাজের চেয়ে বাধাই সৃষ্টি করবে বেশি, নিশ্চয় বুঝতে পারছ।

রাগে গাল ফুলিয়ে ফেলল নরি। আমি, আমি তোমাদের সবাইকে দেখিয়ে দেব দাঁড়াও…! বলতে বলতে ছুটে বেরিয়ে গেল সে।

বাইরে বেরিয়ে সাইকেলে চাপল গোয়েন্দারা। পকেটে চাপড় দিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিল কিশোর যে, ওয়াকিটকি আছে! বলল, চল।

রাস্তায় পড়ে, বাঁয়ে মোড় নিল ওরা, মুখ ঘোড়াল কাউন্টি পার্কের দিকে। জায়গাটা শহরের বাইরে। পথের ডানে গাছপালায় ছাওয়া প্রায় বুনো এলাকা। খানিক দূরে একটা বড় শপিং সেন্টার। বাঁয়ে গড়ে উঠেছে বোটানিক্যাল গার্ডেন, সুন্দর, দুর্লভ অনেক গাছও রয়েছে ওখানে। বাগানের পেছনে পাহাড়। কারমলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাগানের ভেতর দিয়ে একেবেঁকে চলে গেছে একটা পথ, উঠে গেছে পাহাড়ী আবাসিক এলাকায়।

পার্কে ঢুকে পড়ল তিন গোয়েন্দা। জোরে জোরে প্যাডাল ঘুরিয়ে উঠে চলল পাহাড়ী পথ বেয়ে। পেছনে একটা গাড়ি মোড় নেয়ার শব্দ হল, তারপর এগিয়ে। আসতে লাগল। পেছনে তাকিয়ে অস্ফুট শব্দ করে উঠল মুসা। গাড়িটা সোজা এগিয়ে আসছে, থামার বা পাশ কাটানোর কোন লক্ষণ নেই।

নাম, সরো রাস্তা থেকে! চেঁচিয়ে উঠেই নিজের সাইকেলের হ্যাণ্ডেল ঘুরিয়ে দিল মুসা। নেমে পড়ল পাশের খাদে। শাঁ করে ছুটে গেল একটা লাল স্পোর্টস কার, সময়মত সরতে না পেরে লেগে গেল রবিনের সাইকেলের সঙ্গে, ফেলে দিল ওটাকে। সাইকেল পড়ার আগেই লাফ দিয়ে খাদে পড়ল রবিন। গাড়িতে বসা হাসি হাসি মুখটার দিকে মুঠো চাল মুসা। চিৎকার করে বলল, শুঁটকি, রাখ, ধরতে পারলে মজা দেখার! বন্ধুদের দিকে ফিরে বলল, কাল সন্ধ্যায় ওকে বোকা বানানোর প্রতিশোধ নিল ব্যাটা।

ওটার শিক্ষা আর হবে না কোনদিন, আফসোসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল কিশোর। রবিনকে টেনে তোলার জন্যে হাত বাড়াল। সব গড়বড় করে দিতে পারে। নজর রাখতে হবে ওর ওপর। বিপদেও ফেলে দিতে পারে।

আর অল্প কিছুদূর উঠেই ডেপুটির অফিস চোখে পড়ল ওদের। কেউ নেই। বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঢুকে এদিক ওদিক তাকাল।

হাত তুলে দেখাল রবিন, ওই দেখ, কতগুলো গাছ। আর ওই যে পুকুর।

ঝড় বয়ে গেছে যেন পুকুর পাড়ের বাগানে। হাঁসের পুকুরের চারপাশে যত আপেল আর নাশপাতি গাছ আছে সবগুলোর সর্বনাশ করে ফেলা হয়েছে। ডালপালা একটারও নেই, সব ভাঙা। অসংখ্য হাঁস থাকার কথা পানিতে, অথচ আজ একটাও নেই।

শুধু গাছই নষ্ট করেনি, পুকুর পাড়ের মাটি খুঁড়ে ফেলা হয়েছে। ছোট-বড় অনেক গর্ত। ওখানে এসে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।

কে জানি আসছে, বলতে বলতে একটা ডাল তুলে নিল মুসা। গুপ্তধন খুঁজতেই আসছে বোধহয়…

এই, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক! ধমক দিয়ে বলল একটা কণ্ঠ।

পাই করে ঘুরল ওরা। হোটখাট একজন মানুষ জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। পরনে শেরিফের পোশাক। আবার বলল, অ্যারেস্ট করা হল তোমাদের।

শান্ত রইল কিশোর। আপনি কি ডেপুটি গ্যারেট?

হ্যাঁ, বলেই গর্জে উঠল শেরিফ, অনেক জ্বালাতন হয়েছে! মরা মানুষের ধাঁধা, যত্তসব! তোমাদেরকে অ্যারেস্ট করলাম।

কিন্তু, প্রতিবাদ জানাল রবিন, আমরা…

শান্তকণ্ঠে কিশোর বলল, ভাল করে খেয়াল করে দেখুন, ডেপুটি, পাতাগুলো কেমন শুকিয়ে আছে। আমরা আসার অনেক আগে ভাঙা হয়েছে এসব ডাল, সম্ভবত গতকাল। আমরা এইমাত্র এসেছি।

তোমরা, ডেপুটির কণ্ঠে সন্দেহ। কারমলের গুপ্তধনের জন্যে না এলে কিসের জন্যে এসেছ?

আমরা খুঁজতেই এসেছি…।

বলেছিলাম না! চেঁচিয়ে উঠল ডেপুটি। ঠিকই আন্দাজ করেছি আমি।

কিন্তু, দৃঢ়কণ্ঠে বলল কিশোর। এই পুকুর আর গাছপালার সঙ্গে গুপ্তধনের সম্পর্ক নেই। ভুল করে এগুলো নষ্ট করে দিয়ে গেছে লোকেরা। আমরা ওদের দলের কেউ নই। মিসেস কারমল আমাদের ভাড়া করেছেন তাঁদের জিনিস খুঁজে দিতে।

ভাড়া? সন্দেহ যায়নি শেরিফের।

আমরা গোয়েন্দা, জানাল মুসা।

চীফ ইয়ান ফ্লেচারের দেয়া সার্টিফিকেট বের করে দেখাল কিশোর। ইচ্ছে করলে ফোন করে তাঁর কাছ থেকে আমাদের কথা জেনে নিতে পারেন। মিসেস কারমলকেও ফোন করতে পারেন।

শাগ করল ডেপুটি। চীফের সই বলেই মনে হচ্ছে। তাহলে তোমরা তিন গোয়েন্দা? মাথা চুলাকাল সে। তোমাদের বিশ্বাস কারমল সত্যিই কিছু

লুকিয়েছে? ফালতু রসিকতা নয়?

না। আর আমরা আপনার সাহায্য চাই।

আমার সাহায্য? বলে কি! আমি কি সাহায্য করব?

বিলাবংটা কোথায় আমাদের বলবেন,মুসা বলল।

হাঁ হয়ে গেল ডেপুটি। বিলাবং! সেটা আবার কি জিনিস?

ডোবা, কিংবা ঝর্না, বলল কিশোর। কোন ধরনের জলাশয়। যেটাতে আপনি আর কারমল মাছ ধরতেন। পার্কে আছে ওরকম জায়গা?

আছে। পুরানো একটা দীঘি। আগে পর্বতের ওদিক থেকে পানি আনতে হত আমাদের। পরে ওয়াইনেজ ক্রিকে বাঁধ দিয়ে পানির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এখন আর পানির জন্যে ওখানেও যাওয়ার দরকার পড়ে না। মাঝে মাঝে মাছ ধরতে যায় লোকে, বিশেষ পাওয়া যায় না। বসন্তে ছাড়া অন্য সময় পানি খুব কম থাকে। পুরানো সব ফিডার ক্রিকগুলোকে সিমেন্টে বাঁধ দিয়ে মুখ আটকে দেয়া হয়েছে, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যে ওই মেইন ক্রিকটা বাদে। ওখানে একটা পুরানো হাউসবোট আছে, তাতে উঠেই ছিপ ফেলতাম আমরা।

কোনদিক যেতে হবে, বলবেন স্যার? অনুরোধ করল রবিন।

সহজ। ওই যে পথটা, ওটার পাশেই পড়বে। পার্কের মেইন বাস স্টপের কাছে গিয়ে নিচে তাকালেই দেখতে পাবে।

ডেপুটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে সাইকেলের দিকে দৌড় দিল তিন গোয়েন্দা। দ্রুত পেডাল ঘুরিয়ে চলল। খানিক পরেই দেখতে পেল বাধটা, ওদের ওপরে, ডান দিকে। বিশ ফুট চওড়া পানির ধারা বয়ে চলেছে সগর্জনে। উঠেই চলল ছেলেরা, বাঁধের পাশাপাশি এসে থামল। এখান থেকে একটা কাঁচা রাস্তা চলে গেছে ওয়াইনেজ ক্রিকে। মূল সড়কটা দীঘির পাশ দিয়ে গিয়ে পাক খেয়ে উঠে গেছে পর্বতের ওপরে।

কাঁচা রাস্তা ধরে কিছুদূর এগোতেই নজরে এল হাউসবোট। ধাড়ির পাড়ে বঁধা। ওখানে বাঁধের জলধারা তিরিশ ফুট চওড়া। তীব্র গতিতে ছুটছে বোটের পাশ দিয়ে।

যাক, সাইকেল কাত করে রাখতে রাখতে বলল রবিন, বটল অ্যাণ্ড স্টপার অবশেষে বিলাবং দেখাল আমাদের।

এখন অ্যাবাভ দ্য অ্যাপলস অ্যাণ্ড পেয়ারস অল অ্যালন খোঁজা দরকার, বলল মুসা। সিঁড়ি। আমার মনে হয় ওটাই।

খাড়া একটা কাঠের সিঁড়ি, বরং মই বলা ভাল, বোটের মেইন ডেক থেকে উঠে গেছে কেবিনের চ্যাপ্টা ছাতে। ছুটল মুসা। একটা তক্তা ফেলে বোটে ওঠার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওটা বেয়ে গিয়ে বোটে উঠল সে। তারপর সিঁড়িতে। রেলিঙে, ঘেরা ছাত। পুরানো কাঠের বাক্স, মাছের খাবারের টিন, আর আরও নানারকম জঞ্জাল পড়ে রয়েছে।

লেডি ফ্রম ব্রিস্টল খোঁজ, কিশোর বলল।

খুঁজতে শুরু করল ওরা। বাক্স উল্টে, মাছের টিন ঝাড়া দিয়ে, জঞ্জাল সরিয়ে,  যত রকমে খোঁজা সম্ভব কিছুই বাদ দিল না। কিন্তু কিছু পাওয়া গেল না। এমনকি আলগা কয়েকটা তক্তা সরিয়ে তার তলায়ও উঁকি দিল কিশোর।

নাহে, নিরাশ হয়ে মাথা নাড়ল মুসা, ব্রিস্টলের সঙ্গে রাইম মেলাতে পারছি না।  কিন্তু এখানেই থাকার কথা, জোর দিয়ে বলল কিশোর। আমি শিওর, ঠিক পথেই এগোচ্ছি। গ্যারেট একজন পুলিশম্যান, কারমলকে চিনত। গ্যারেটই এই বিলাবঙের খোঁজ দিয়েছে আমাদের। ভুল হতে পারে না।

তীরে দাঁড়িয়ে কিছু দেখার কথা বলেনি তো কারমল? রবিন প্রশ্ন তুলল।

রেলিঙের ছাতে দাঁড়িয়েই চারপাশে তাকাল ওরা। খাঁড়ির দুতীরেই বন। দূরে উঠে গেছে পর্বতের ঢাল। শুকনো, সিমেন্টে তৈরি একটা নালা ঢাল বেয়ে নেমে এসেছে। ব্রিস্টলের সঙ্গে ছন্দে মেলে, এরকম কিছু চোখে পড়ল না।

আচ্ছা, হুইসল না তো? বলে বোটের সামনের হুইলহাউসের ছাতে বসানো হোট একটা এয়ার-হর্ন দেখাল কিশোর।

হুইসল অবশ্য বলা যায়, ধীরে ধীরে বলল মুসা। তরে আসলে ওটা হর্ন। তাছাড়া ব্রিস্টল আর হুইসলের মধ্যে ঠিক ছন্দে মিলছে না। কোনদিকে নির্দেশ করছে ওটা, কিশোর?

ওপরে, রবিন বলল। আকাশের দিকে।

ঠিকই বলেছ, মুসা, একমত হল কিশোর। আসলে আমরা যা খুঁজছি সেটা ব্রিস্টলের সঙ্গে পুরোপুরি মিলতে হবে। আর এমন কিছুকে নির্দেশ করবে, যা থেকে বেরিয়ে আসবে রাইডস ফ্রম আ ফ্রেন্ড-এর সমাধানের সুর। হয়ত ভুল করেছি আমরা, ভূল জায়গায়…

সবাই শুনতে পেল শব্দটা। নিচে কোনখান থেকে এসেছে, ভারি একটা তক্তা মাটিতে পড়েছে বোধহয়।

রেলিঙের ধারে ছুটে গেল ছেলেরা। তীরে দাঁড়িয়ে আছে শুঁটকি টেরি। ওদের দেখে দাঁত বের করে হাসল।

আবার দেখা হয়ে গেল, একেবারে ঠিক সময়ে, বলে খিকখিক করে উঠল সে। সব শুনেছি, সিঁড়িটা কোথায় তা-ও জানি। ধাঁধার সমাধান এবার করেই ফেলব। হাসি। এই সুযোগে কিছুক্ষণ বেড়িয়ে আস তোমরা।

কিশোর! চিৎকার করে বলল রবিন। হাউসবোটটা খুলে দিয়েছে।

মাটিতে পড়ে আছে তক্তা, যেটা বেয়ে উঠেছে ওরা। যে দড়ি দিয়ে বোটটা বেঁধে রাখা হয়েছিল, ওটা খোলা, পানিতে পড়েছে। দুমদাম করে সিঁড়ি বেয়ে মেইন ডেকে এল ছেলেরা। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই তীর থেকে দশ বারো ফুট সরে চলে এসেছে বোট, গা ভাসিয়ে দিয়েছে স্রোতে।

মুঠো পাকিয়ে দেখাল মুসা। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, শুঁটকি, ধরতে পারলে…

যাও, বেড়িয়ে এস খোকাবাবুরা, চেঁচিয়ে বলল টেরিয়ার। ঘন্টাদুয়েকের মধ্যে তীরে উঠে আসতে পারবে। খুব সন্তুষ্ট দেখাচ্ছে তাকে। ঘুরে দৌড় দিল কাঁচা রাস্তার দিকে।

দাঁড়াও, ধরে নিই আগে! শাসিয়ে বলল মুসা। ঘাড় মটকে না দিয়েছি তো আমার নাম মুসা আমান নয়…।

সব্বেনাশ! আঁতকে উঠল রবিন। বাঁধ!

মুসা আর কিশোরও ফিরে তাকাল। ভেসে যাচ্ছে বোট, গতি বাড়ছে দ্রুত। বাড়ছে পানির গর্জন। বাঁধের ওপর দিয়ে গিয়ে জলপ্রপাতের মত নিচে আছড়ে পড়ছে বিশাল এই জলরাশি।

ভেসে চলেছে হাউসবোট।

ঝাঁপ দিয়ে পড়, চিৎকার করে বলল কিশোর। সাঁতরে উঠব।

নাআ! সময়মত নেতৃত্ব নিয়ে নিয়েছে মুসা। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক। দুজনেই।

জমে গেল যেন কিশোর আর রবিন।

স্রোত খুব বেশি, মুসা বলল। টেনে নিয়েই যাবে, বুঝতে পারছি। জরুরী কণ্ঠে নির্দেশ দিল, জলদি গিয়ে ওপরে ওঠ।

মুসাকে অনুসরণ করে ওপরের ডেকে উঠে এল দুজনে। ভয়ঙ্কর স্রোত। প্রতি মুহূর্তে এগিয়ে আসছে বাঁধটা।

বাক্স-টাক্স যা,আছে, সব জলদি ফেল পেছন দিকে, আবার বলল মুসা।

ফেলতে ফেলতে হাঁপিয়ে গেল ছেলেরা। সবে ফেলা শেষ করেছে, এই সময় আওয়াজ হল বোটের তলায়, ঘষা লেগেছে কোন কিছুর সঙ্গে। থেমে গেছে বোট। কিশোর বলল, আমরা…আমরা বাঁধের ওপর চলে এসেছি!

সামনে শুধুই শূন্যতা। অনেক নিচ থেকে কুয়াশা উঠছে, যেখানে পাথরের ওপর আছড়ে পড়ছে পানি। ঢোক গিলল রবিন, চেহারা ফ্যাকাসে। বাঁধের ওপর প্রায় ৰূলে থেকে দুলছে বোটটা, সেদিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল কিশোর।

জোরে কেঁপে উঠল একবার বোট, ঝটকা দিয়ে আগে বাড়ল, তারপর আবার থেমে গেল। দুই ধার দিয়ে বয়ে গিয়ে ঝরে পড়ছে পানি।

গুড। বাঁধের ওপর আটকা পড়েছি আমরা, শান্তকণ্ঠে বলল মুসা।

চোখ মেলল কিশোর। পা বাড়াতে গেল।

না না, নড়ো না! তাড়াতাড়ি বাধা দিল মুসা।

থেমে গেল আবার গোয়েন্দাপ্রধান।

পেছনটা আটকেছে, মুসা বলল। জিনিসপত্র ফেলে ভারি করে ফেলেছি। আমাদেরও ভার রয়েছে। নাহলে আটকাত না। নিঃশ্বাস ফেলতেও ভয় পাচ্ছে ছেলেরা। চারপাশে তাকাল। বাঁধের কিনারে আটকেছে বোট, তীর দুদিকেই দশ ফুট দূরে। ঠিক মাঝখানে রয়েছে ওরা।

কি করা এখন? রবিনের প্রশ্ন।

মাথা ঠাণ্ডা রেখেছে মুসা, ভেবে দেখল কি করা যায়। সাঁতার কেটে তীরে পৌঁছতে পারব না। লাফিয়েও পেরোতে পারব না এতদূর। মাথার ওপরে এমন কোন ডালও নেই যে ধরে বেয়ে বেয়ে চলে যাব। তাড়াহুড়ো করে কিছু করতে গেলে বোটটা যাবে পড়ে।

কি করা যায়, বল তো মুসা? গলা কাঁপছে কিশোরের।

নিচে দড়ি দেখতে পাচ্ছি, মুসা বলল। ওটার মাথায় ফাঁস বানিয়ে ব্যাসোর মত তীরে ছুঁড়ে মারা গেলে, কোন ভাঙা গাছের গুড়িতে আটকানো যাবে। তারপর ওই দড়ি ধরে ঝুলে ঝুলে পেরিয়ে যেতে পারব। রবিন, তোমার ওজন সব চেয়ে কম। যাও, দড়িটা নিয়ে এস।

মাথা ঝাঁকিয়ে দড়ির জন্যে রওনা হল রবিন। দুলে উঠল বোট, ঘ্যাঁস্‌স্‌ করে আওয়াজ হল নিচে, ঝটকা দিয়ে আগে বাড়ল খানিকটা।

ওদিক দিয়ে নয়! হুঁশিয়ার করল মুসা। পেছন দিয়ে যাও, রেলিঙের ওপর দিয়ে বেয়ে নামো। আমরা আরও পেছনে সরে ভার চাপাচ্ছি।

আরেকবার মাথা ঝাঁকিয়ে রেলিঙে উঠে পড়ল রবিন। রেলিঙ ধরে ঝুলে পড়ল। তারপর আলগোছে ছেড়ে দিল হাত। খুব আস্তেই পড়ল নিচের ডেকে। দড়ির বাণ্ডিল তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিল ওপরে।

দড়ি খুলে একমাথায় একটা ফাঁস বানিয়ে ফেলল মুসা। শরীর যথাসম্ভব কম নেড়ে, কম ঝাঁকিয়ে ফাঁসটা ছুঁড়ে মারল একটা গাছ সই করে। গাছের তিন ফুট দূরে পড়ল ফাঁসটা।

টেনে এনে আবার চেষ্টা করল সে। ভাঙা গাছের গোড়ায় পড়ল ফাঁসটা। ভীষণ দুলে উঠল বোট। টাল সামলাতে না পেরে পড়েই যাচ্ছিল কিশোর, কোনমতে রেলিঙ ধরে সামলাল। পানি যেদিক থেকে আসছে সেদিকে চোখ পড়তেই রক্ত সরে গেল মুখ থেকে। তোতলাতে শুরু করল, মু-মুসা, গাছ। এসে বাড়ি মারলে গেছি…।

ভেসে আসা বিশাল গুড়িটার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল মুসা, আস্তে মাথা ঝাঁকিয়ে খুলে ফেলতে লাগল বাণ্ডিলের বাকি দড়ি। তারপর সাবধানে নিশানা করে ছুঁড়ে মারল আবার ফাঁস। এইবার কাজ হল, ভাঙা গাছের কাণ্ড গলে আটকে গেল ফাঁস। দড়িটা টান টান করে এদিকের মাথা শক্ত করে বেঁধে ফেলল রেলিঙে। বলল, রবিন, তুমি আগে যাও।

সরে গিয়ে ওপরে হাত তুলে দড়িটা ধরল রবিন। ঝুলে ঝুলে এগোল। খুব তাড়াতাড়িই তীরের মাটিতে গিয়ে দাঁড়াল সে। তাড়াতাড়ি ফাঁসটা টেনে নামিয়ে দিল গাছের গোড়ার দিকে। যাতে আরও শক্ত হয়ে আটকে থাকে।

কিশোর, এবার তুমি যাও,মুসা বলল।

দ্বিধা করল কিশোর। দেখল, ছুটে আসছে গাছের গুঁড়িটা। একবার ঢোক গিলে, দড়ি ধরে ঝুলে পড়ল। ভাবছে, সময়মত পেরোতে পারবে তো? পারল। কিছুক্ষণ পরেই রবিনের পাশে এসে দাঁড়াল সে।

দুজনের ভার সরে যাওয়ায় অনেক হালকা হয়ে গেল বোটের পেছনটা। আটকা পড়া কুটোর মত দুলতে শুরু করল, এপাশ ওপাশ নড়ছে গলুই। গাছের গুঁড়িটাও প্রায় এসে গেছে। দেরি করল না আর মুসা। দড়ি ধরে ঝুলে পড়ে সড়সড় করে নেমে চলে এল অনেকখানি। তার পা-ও মাটি ছুঁল, গুড়িটাও এসে ধাক্কা মারল বোটটাকে।

ছেলেদের ভার সরে যাওয়ায় এমনিতেই সরি সরি করছিল বোট, ধাক্কা খেয়ে আর আটকে থাকতে পারল না। সড়াৎ করে পেরিয়ে গেল বাধের বাকি অংশ, হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে গেল দড়ি।

পাথরে বাড়ি খেয়ে বোট ভাঙার মড়মড় শব্দ কানে এল ছেলেদের, কাঁটা দিল গায়ে।

হউফ, করে মুখ দিয়ে বাতাস ছাড়ল রবিন।

এতক্ষণে রাগ দেখা দিল মুসার মুখে। শুঁটকি! মুঠো শক্ত হয়ে গেল তার। দাঁড়া, আগে ধরে নিই…।

শুঁটকি, ঘোর ভাঙল যেন কিশোরের, আমাদের আগে চলে গেছে। সে বলেছে, সিঁড়িটা কোথায় জানে। এস।

উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আবার গোয়েন্দাপ্রধানের চোখের তারা। বিপদ কেটে গেছে, তার মগজও চালু হয়ে গেছে পুরোদমে।

আশেপাশেই কোথাও আছে সিঁড়িটা, বলল সে। আলাদা আলাদা হয়ে খুঁজব আমরা। ওয়াকিটকিতে যোগাযোগ রাখব। কারও চোখে কোন সিঁড়ি পড়লেই অন্যকে জানাব।

ওয়াইনেক ক্রিকের ধার ধরে খুঁজতে শুরু করল ওরা। অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে খুঁজল, কিছুই চোখে পড়ল না।

ভুল হয়েছে কোথাও, ওয়াকিটকিতে বলল কিশোর। কি জানি! জবাব দিল মুসা।

কিশোর, রবিন বলল, প্রথম ধাঁধাটার সঠিক সমাধান হয়েছে তো? তুমি কি শিওর, বিলাবং মানে জলাশয়?

নিশ্চয়…, থেমে গেল কিশোর। দ্বিধায় পড়েছে। ডিকশনারিতে অবশ্য দেখিনি। অন্য কোন মানে থাকতেও পারে। কাছাকাছি টেলিফোন কোথায় বল তো?

ডেপুটির অফিসে, জবাব দিল মুসা। যাব নাকি? সাইকেলের কাছাকাছি রয়েছি আমি।

যাও। লাইব্রেরিয়ানকে ফোন করে জিজ্ঞেস কর, কি কি মানে হয়। কুইক।

মুসা গেছে অনেকক্ষণ হয়েছে। পশ্চিম দিগন্তে নেমে যাচ্ছে সূর্য। অন্ধকার হয়ে যাবে শিগগিরই, উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে কিশোর। ভাবছে, মুসাকে খুঁজতে যাবে কিনা,

এই সময় হঠাৎ ওয়াকিটকিতে শোনা গেল তার কণ্ঠ।

কিশোর? রবিন? আছ ওখানে?

আছি, সেকেণ্ড, জবাব দিল কিশোর। কি জানলে?

অনেক মানেই হয় বিলাবঙের। মূল জলধারা থেকে বেরোনো উপ-জলধারা, যেটা আর কোন জলধারার সঙ্গে মিশতে পারে না, কোথাও গিয়ে বুজে কিংবা মরে যায়, তাকে বলে বিলাবং।

নেই ওরকম, রবিন বলল। এখানে দেখিনি।

তাহলে আরেক রকমের কথা বলি। শুধু বর্ষাকালে পানি বহন করে এরকম জলধারাকেও বিলাবং বলে।

হ্যাঁ, হয়েছে, এইটাই! বলে উঠল কিশোর। সিমেন্টে তৈরি ওই নালাটা, পর্বতের ঢাল বেয়ে যেটা নেমে এসেছে বাঁধে। বৃষ্টি হলেই শুধু পানি বহন করে ওটা, এমনিতে থাকে শুকনো। মুসা, ওখানে মিলিত হব আমরা।

কয়েক মিনিট পর নালাটার মুখের কাছে এসে দাঁড়াল রবিন আর কিশোর। ওয়াইনেজ ক্রিক এখানে সব চেয়ে চওড়া। সিমেন্টে তৈরি নালাটা আঁকা হয়ে উঠে গেছে ঢাল বেয়ে, অদৃশ্য হয়ে গেছে ঝোপঝাড়ের আড়ালে। নালার দুপাড় ধরে ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে শুরু করল দুজনে।

কিছুই নেই, মাথা নাড়ল রবিন। সিঁড়ির চিহ্নও দেখছি না।

থাকতেই হবে। আমি এখন শিওর, বুড়ো কারমলের বিলাং এটাই। এস।

কমে আসছে দিনের আলো। আবার আগের জায়গায় নেমে আসতে শুরু করল দুজনে। খানিকটা নেমেছে, হঠাৎ ওয়াইনেজ ক্রিকের অন্য পাড় থেকে শোনা গেল মুসার চিৎকার। এই, পেয়েছি, কোথায় তোমরা?

প্রায় ছুটে নেমে এল দুজনে। হাত তুলে ঝর্নার ভাটির দিকে দেখাল মুসা, ওদের বাঁয়ে।

কই? রবিন জিজ্ঞেস করল। আমি তো কিছু দেখছি না।

এখান থেকে দেখা যাবে না, কিশোর বলল। চল ওখানে যাই। ঝোপঝাড়ের ভেতর ঢুকে পড়ল সে। ছুটতে শুরু করল। তার পিছে রবিন। কয়েক মিনিট পরেই সিঁড়িটা দেখল ওরাও। অনেক পুরানো, কাঠের তৈরি। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে আসা পড়ন্ত রোদে সোনালি দেখাচ্ছে। আশেপাশে ঝোপ গজিয়ে উঠেছে। পর্বতের গা থেকে অর্ধেক নেমে এসেছে সিঁড়ি, নিচের অংশ নেই।

পানির তোড়ে ভেঙে চলে গেছে, কিশোর আন্দাজ করল, কিংবা পুরানো হতে হতে আপনাআপনিই ভেঙে পড়েছে। সিঁড়ির অবস্থা খুব খারাপ।

আরেক দিক দিয়ে ঘুরে এসে ওদের পাশে দাঁড়াল মুসা। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মহা ধড়িবাজ ছিল কারমলটা। ক্রিক থেকে হাজার চেষ্টা করেও দেখা যাবে না। আমি পলকের জন্যে দেখেছি রাস্তার ওপর থেকে।

আশা করি, হেসে বলল কিশোর, তোমার মত ঈগল চোখ নেই শুঁটকির। এস।

পুরানো নড়বড়ে সিঁড়ি বেয়ে পর্বতের ওপরের একটা ভোলা চত্বরে উঠে এল ছেলেরা। বড় বড় ঘাস জন্মে রয়েছে, তৃণভূমিই বলা চলে জায়গাটাকে। অনেক দূর দিয়ে ওটার পাশ কাটিয়েছে পার্কের মেইন রোড। পঞ্চাশ গজমত দূরে একটা বাস স্টপেজ। চত্বরের মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে ব্রোঞ্জের একটা ছোট মূর্তি।

কিশোর! রবিন বলল, মূর্তিটা!

কাউবয়ের মূর্তি, দাঁড়িয়ে আছে গ্র্যানাইটের বেদির ওপর। গুলি ছোঁড়ার ভঙ্গিতে পিস্তল তুলে রেখেছে কাউবয়।

পিসটল, প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। দ্য লেডি ফ্রম ব্রিস্টল, অ্যাণ্ড অল আলোন, অর্থাৎ একা!

পিস্তলটা কোনদিক নির্দেশ করছে? নিজেকেই প্রশ্ন করল যেন কিশোর।

বেদিতে চড়ে কাউবয়ের হাতে গাল লাগিয়ে পিস্তল কোনদিকে নিশানা করছে দেখল মুসা। তারপর চোখ মিটমিট করতে করতে মাথা নাড়ল। না, তেমন কিছুই তো দেখলাম না।

রবিনও উঠে দেখল। বলল, শুধু গাছপালা।

বেদির দিকে তাকাল কিশোর। একবার চিমটি কাটল নিচের ঠোঁটে। মাথা দোলাল, হমম্। ঘোরানো যায় মূর্তিটা। ভূমিকম্প হলে ঝাঁকুনি লেগে ঘুরে যায়।

মানে? ভ্রূকুটি করল মুসা। ইদানীং তো ভূমিকম্প হয়নি।

মাথা নাড়ল কিশোর, না, ভুমিকম্পে নয়। পায়ের গোড়ায় তাজা চিহ্ন, পাথরের গুড়োও পড়ে আছে। ঘোরানো হয়েছে।

শুঁটকি! গুঙিয়ে উঠল মুসা।

তাছাড়া আর কে? গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর। এটাকে ঘুরিয়ে রেখে গেছে, যাতে আমরা বুঝতে না পারি কোনদিক নির্দেশ করছে।

তাহলে পরের ধাঁধার সমাধান কি করে করব? রবিন বলল।

শুঁটকির ঘাড় চেপে ধরে।

যাওয়ার জন্যে ঘুরল ওরা। গাছের তলায় গোধূলির ছায়া। সেখান থেকে বেরিয়ে পার্কের রাস্তার দিকে ছুটে গেল একটা ছায়ামূর্তি।

আমাদের ওপর চোখ রাখছিল! রবিন বলল।

ধর ব্যাটাকে, বলেই দৌড় দিল কিশোর।

গাছপালার ভেতর দিয়ে ছুটল ওরা। সামনে রাস্তায় গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ হল। ওরা রাস্তায় পৌঁছতে পৌঁছতে অনেক দূরে চলে গেল গাড়িটা।

গাড়িটা চিনেছ? কিশোরের প্রশ্ন।

না, মুসা বলল, তবে শুঁটকির নয় এটা ঠিক।

আবার তৃণভূমিতে ফিরে এল ওরা। সিঁড়ি বেয়ে ঢালে নেমে এল ওয়াইনেজ ক্রিকের কাছে। ঘনায়মান সাঝের ম্লান আলোয় সাইকেল চালাতে চালাতে রবিন বলল, কিশোর, নিশ্চয় সেই দৈত্যটা।

কিন্তু ছায়ামূর্তিটা তো ছোট দেখলাম। না রবিন, অন্য কেউ।

পথের পাশে গাছপালার আড়ালে ঘন ছায়া। সেদিকে তাকিয়ে অস্বস্তি লাগল মুসার। মনে পড়ল, টেলিফোনে হুঁশিয়ারির কথা।

শুঁটকিকে কোথায় খুঁজব? রবিন জানতে চাইল। আর ধরে জিজ্ঞেস করলেই কি বলবে নাকি আমাদেরকে?

না, বলবে না, একমত হল কিশোর। তবে উল্টোপাল্টা কথা শুরু করবে। আর বেশি কথা বলতে গিয়েই কিছু ভুল করে ফেলবে, সব সময় যা করে। চলো আগে ওর বাড়িতে দেখি। দেরি এমনিতেই হয়ে গেছে আমাদের, আর কয়েক মিনিটে কিছু হবে না।

বাড়িতে নেই শুঁটকি। তার মা বললেন, বাবার সঙ্গে নাকি কোথায় বেরিয়েছে।

এবার? রবিন বলল।

নজর রাখব ওর ওপর, বলল কিশোর। আমার মনে হয় না আজ রাতে আর গুপ্তধন খুঁজতে বেরোবে ও। রাইমিং স্ল্যাঙের কথা বলতে শুনেছে আমাদেরকে। বলা যায় না, বঁটকির পক্ষেও এখন ধাঁধার সমাধান করে ফেলা হয়ত সম্ভব।

কিশোর, মুসা প্রশ্ন তুলল। শুঁটকিকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতে পারব না আমরা। ওর গাড়ি আছে। আমাদের নেই।

দরকারও নেই। ভূত-থেকে-ভূতের সাহায্য নেব আমরা।

কয়েক ঘন্টা পর রিসিভার রেখে আপনমনেই বলল মুসা, যাক, ভূতকে টেলিফোন করা শেষ। পেছনে যে বাবা এসে দাঁড়িয়েছেন, খেয়াল করেনি।

কি বললে? জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার আমান। ভূতকে ফোন করেছ? তোমার শরীর ভাল তো?

অ্যাঁ… না না, ভূত নয়, ভূত-থেকে-ভূতে। কিশোরের আবিষ্কার। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের খবর পৌঁছে যাবে রকি বীচের সমস্ত ছেলেমেয়ের কাছে।

দীর্ঘ এক মুহূর্ত ছেলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমান। মাঝে মাঝেই দুর্বোধ্য কথাবার্তা বলে তিন গোয়েন্দা, জানা আছে তার। এ-নিয়ে আর চাপাচাপি করলেন না। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, কি জানি, হবে হয়ত।

হাসল মুসা। শুঁটকির ব্যবস্থা করা গেছে। তিন গোয়েন্দার সঙ্গে লাগতে আসার মজা হাড়ে হাড়ে টের পাবে এবার। শহরের কয়েকশো জোড়া চোখ এখন সর্বক্ষণ থাকবে তার ওপর। কোথায় যায়, কি করে, সব জেনে যাবে ওরা, ফোনে জানাবে তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টারে।

পরদিন খুব ভোরে উঠল মুসা। কিশোরকে ফোন করল নাস্তার আগেই। ভূতের খবর আছে?

দুটো, জবাব দিল কিশোর। একটা ভুল গাড়ির খবর দিয়েছে। আরেকটা ঠিকই দিয়েছে, বলেছে শুঁটকির লাল গাড়িটা ওদের বাড়ির ড্রাইভওয়েতেই রয়েছে।

তারমানে বাড়িতেই আছে। ঠিক আছে, নাস্তা সেরেই চলে আসছি।

খুব তাড়াহুড়া, তাই বেশি খেতে পারল না মুসা, গোটা তিনেক ডিম আর ছটা মোটা মোটা পাউরুটির টুকরো দিয়ে শেষ করতে হল। ইতিমধ্যে টেবিলে হাজির হয়ে গেল দুধ, ঢক ঢক করে গিলে নিল বড় এক গেলাস।

হেডকোয়ার্টারে ঢুকে মুসা দেখল, কিশোর একা বসে আছে।

রবিন আটকে গেছে, মায়ের কিছু কাজ করে দিতে হবে, কিশোর জানাল। ধাঁধাগুলো নিয়ে আরও মাথা ঘামিয়েছি। কারমলের শব্দ ব্যবহার অবাক করেছে আমাকে। কখনও কখনও বেশ অদ্ভুত। এই যেমন বলছে, দ্য লেডি ফ্রম ব্রিস্টল রাইডস ফ্রম আ ফ্রেণ্ড।

তাতে কি?

বন্ধুর কাছ থেকে এসেছে বলাটা কেমন যেন অদ্ভুত। কারণ পিস্তল নির্দেশ করেছে কোন কিছু, তারমানে পিস্তলের তরফ থেকে কিংবা দিক থেকে হচ্ছে বলা যায়। তাহলে তো বলার কথা রাইডস টু আ ফ্রেণ্ড।

কি জানি, মাথা চুলকাল মুসা।

তারপরে, তিন নাম্বার ধাঁধায় বুড়ো লিখেছে আওয়ার হ্যাণ্ডসাম মাগ, চার নাম্বারে ফলো দ্য নোজ, আর পাঁচ নাম্বারে বাই আ ওয়াইফ।

তারমানে তুমি বলতে চাইছ, বলা উচিত ছিল ফলো ইওর নোজ, সি মাই মাগ কিংবা দ্য মাগ? এবং হু ইজ আ ওয়াইফ?

জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। হা হা, বুঝেছ। ওরকম করেই কি : বলা উচিত ছিল না? ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলে আরও জটিল করে দিয়েছে ধাঁধাগুলো।

জটিল করার জন্যেই তো করেছে কুটিল বুড়োটা, মুখ বাকাল মুসা।

উজ্জ্বল হল কিশোরের চোখ। তারমানে গুপ্তধন সত্যি সত্যি আছে। সেকারণেই জটিল করেছে, যাতে সহজে পাওয়া না যায়।

এবং সে সফল,মুসা বলল। আমাদের এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুঁটকিকে। খুঁজে বের করতে হবে…

কিশোর! মুসা! মৃদু ডাক শোনা গেল।

রবিন মনে হচ্ছে?

সর্ব-দর্শনে গিয়ে চোখ রাখল কিশোর। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পেরিস্কোপের চোখে রবিনকে দেখতে পেল। ওয়ার্কশপের দিকেই আসছে। সঙ্গে আরেকজন। বাইরে চলো। দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরোনো ঠিক হবে না। চার নাম্বার দিয়ে যাব।

চার নাম্বার দরজাটা ট্রেলারের পেছনে। একটা স্লাইডিং ডোর। খুললেই চোখে পড়বে জঞ্জালের গাদা, মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সরু করিডর। সেটা দিয়ে বাইরে বেরোল দুজনে, ঘুরে চলে এল ওয়ার্কশপে। রবিনের সঙ্গে রয়েছে জেনি এজটার।

কি ব্যাপার…? বলতে গিয়ে বাধা পেয়ে থেমে গেল মুসা।

যাক, বলে উঠল একটা কণ্ঠ, কথায় কড়া ব্রিটিশ টান, সবাই আমরা এখানে।

পাঁই করে ঘুরল কিশোর আর মুসা। ওয়ার্কশপের দরজায় দেখা দিল মাইক এজটার। বুড়ো কারমলের হোঁকা ভাগ্নের হাতে একটা কালো ওয়াকিং স্টিক।

এখানে কি আপনার? গরম হয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।

হিইছিছিছি, লাল হয়ে গেল মাইকের গোল আলুর মত মুখ। আমেরিকান ছেলেগুলো একেবারেই বেয়াদপ, আদব কায়দা কিচ্ছু শেখে না। কথা বলতে এসেছি, বুঝেছ? আর কিছু না। তাই না, জেনি?

আপাতত, মুখ গোমড়া করে বলল রোগাটে মহিলা।

কিভাবে কথা বলছ? বোনকে তিরস্কার করল মাইক। হুঁশিয়ার হয়ে যাবে তো ওরা। দ্রভাবে ওদেরকে বোঝানো দরকার…

হুঁশিয়ার আমরা ইতিমধ্যেই হয়ে গেছি, কিশোর বলল, কাল থেকেই। ফোনে হুঁশিয়ার করার পর থেকে।

ফোনে হুঁশিয়ার! ভুরু কোঁচকাল জেনি। কি বলছ? শাসিয়েছে নাকি কেউ? বুঝেছি। উকিল ব্যাটাকে গিয়ে ধমক লাগাও।

আমরা আপনাদেরও বন্ধু নই, বলেই ফেলল মুসা।

নও, জেনি বলল। কিন্তু হতে অসুবিধে কি? আমাদের ওপর ভুল ধারণা হয়েছে তোমাদের। এর জন্যে দায়ী এলসা আর উড।

আমাদের মা, মানে বুড়ো কারমলের বোন অনেকদিন শেয়ারে ব্যবসা করেছে, মাইক বলল। রাগ ফুটল চেহারায়। কিন্তু বুড়ো তাকে ঠকিয়েছে। আমাদের ভাগ এখন আমরা ফেরত চাই। …

ভুল লোকের সঙ্গে কাজ করছ তোমরা, ভাইয়ের কথার পিঠে বলল জেনি। আমাদের সঙ্গে চলে এস। ভাল টাকা দেব।

দেখুন, রেগে গিয়ে কিছু বলতে চাইল রবিন। বাধা দিয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠল কিশোর, কত ভাল দেবেন?

অনেক, তাড়াতাড়ি বলল জেনি। যা পাওয়া যাবে তার দশ পার্সেন্ট। অনেক, অনেক টাকা হবে তাতে, বুঝেছ।

হুম। বিড়বিড় করল কিশোর, সত্যিই অনেক।

অবাক হয়ে গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে তাকিয়ে আছে দুই সহকারী।

কাউকে বলবে না। খুঁজে পেলে আমাদেরকে দিয়ে দেবে, জেনি বলল, ধরেই নিয়েছে ছেলেরা রাজি।

কাউকে বলব না মানে? তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল হঠাৎ কিশোরের কণ্ঠ। চুরি। করবেন নাকি?

না না, ইয়ে মানে…

আর মানে মানে করতে হবে না। কোর্টে গিয়ে তো আদায় করতে পারবেন, চুরি করতে চান।

কালো হয়ে গেল মাইকের মুখ। বিড়বিড় করে কি বলল জেনি, বোঝা গেল। শাসানির ভঙ্গিতে হাতের লাঠিটা নাড়ল তার ভাই।

বেশ, তাহলে যা যা জেনেছ, শুধু তাই বল, জেনি বলল। আমরা বুঝতে পারছি, সঠিক পথে এগোচ্ছ তোমরা। রাইমিং স্ল্যাঙের ব্যাপারে জানি। ক্রিকে গিয়েছিলে কাল, জানি। রোগাটে ঢেঙ্গা ছেলেটাকেও কাল দেখেছি ওখানে। যা যা

জানো বলে ফেল।

অ, আপনিই তাহলে কাল গুপ্তচরগিরি করছিলেন আমাদের ওপর, রবিন ধরল। মূর্তিটার কাছে।

মূর্তি? মাইক জিজ্ঞেস করল, কিসের মূর্তি?

কিশোর বলল, বোটানিক্যাল গার্ডেনে একটা মূর্তির কাছে ঢেঙ্গা ছেলেটাকে দেখেছিলেন তো? কি করেছে দেখেননি?

মূর্তি-টুর্তি দেখিনি আমরা জেনি বলল। তবে তোমাদেরকে ক্রিকের কাছে দেখেছি। রোগাটে ছেলেটার পিছু নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদেরকে ফাঁকি দিয়ে উধাও হয়ে গেল। তোমরা…

রাইমিং স্ল্যাঙের কথা কি করে জানলেন? আর কিভাবেই বা জানলেন আমরা মিসেস কারমলের হয়ে কাজ করছি?

হেসে উঠল মাইক। নরি ছেলেটা আস্ত বোকা। আমাদের ওপর এত রেগে গিয়েছিল, আমরা যে ভুল করছি প্রমাণ করতে গিয়ে ফাঁস করে দিয়েছে সব।

বুড়োটা যে মহা শয়তান ছিল, এই স্ল্যাংই তার প্রমাণ, জেনি বলল। আমরা…

এই জেনি, চুপ কর, হঠাৎ গর্জে উঠল মাইক। অনেক হয়েছে। আমি প্রশ্ন করছি। এই ছেলেরা, যা যা জানো ঝটপট বলে ফেল।

না, মিস্টার, কিশোর মাথা নাড়ল, কিছুই বলছি না আমরা আপনাদের।

তাহলে যাতে আর কাউকেই না বলতে পার সেই ব্যবস্থা করছি, হাতের লাঠিটা তুলে এগিয়ে এল মাইক। তার কুতকুতে চোখের তারা জ্বলছে। কিছু। সময়ের জন্যে আটকে রাখব তোমাদেরকে। আমরা মাল নিয়ে চলে যাওয়ার আগে ছুটতে পারবে না।

মাইক আর জেনি আরেক কদম এগোল। পিছিয়ে গেল ছেলেরা।

এই, কি হচ্ছে কি এখানে? পেছনে ধমক শোনা গেল।

ঘুরে তাকাল মাইক, হাতের লাঠি নেড়ে বলল, সরুন, সরে যান বলছি!

টকটকে লাল হয়ে গেল মেরিচাচীর মুখ। একটানে মাইকের লাঠি কেড়ে নিয়ে ধা করে বসিয়ে দিলেন তার মাথায়। গেছিরে! বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে পিছিয়ে গেল মাইক। লাফ দিয়ে এসে ভাইয়ের জায়গা দখল করল জেনি। লাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন মেরিচাচী। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালেন। মারবে নাকি? এস দেখি কে কাকে মারে! মেরিচাচীর উগ্রমূর্তি দেখে আর এগোতে সাহস করল না জেনি। যাও, বেরোও! ভাল চাও তো এক্ষুনি বেরোও!

হৈ-চৈ শুনে সেখানে এসে দাঁড়ালেন রাশেদ পাশা। তার কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিল বোরিসের কৌতূহলী মুখ।

আর কক্ষনও যেন এখানে না দেখি! আবার ধমক লাগালেন মেরিচাচী। বিশালদেহী বোরিসের দিকে তাকিয়ে চুপসে গেছে মাইক। বোনের দিকে চেয়ে মাথা ঝাঁকাল। মার খাওয়া কুকুরের মত লেজ গুটিয়ে যেন মেরিচাচীর পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। ছেলেদের হো হো হাসি পিত্তি জ্বালিয়ে দিল তাদের। কিন্তু সাহস করে আর কিছু বলতেও পারল না।

কড়া চোখে ছেলেদের দিকে তাকালেন মেরিচাচী। কি ব্যাপার? কি হয়েছে? বেতমিজগুলো এরকম ব্যবহার করল কেন?

খুলে বলল সব কিশোর। এটাররা কে, তা-ও জানাল।

নাক সিঁটকালেন মেরিচাচী। সব পাগল! বদ্ধ উন্মাদ একেকটা! কে কবে শুনেছে এমন পাগলামির কথা? মরার আগে গুপ্তধন লুকিয়ে উইল করা…ওই ধাড়ি শকুনটা ছিল আরেক পাগল। যাকগে, তোদের ভয় পাবার আর কিছু নেই। জেনি আর মাইক তোদেরকে আর বিরক্ত করতে সাহস করবে না।

মুচকি হেসে, বোরিসকে নিয়ে চলে গেলেন রাশেদ পাশা। মেরিচাচীও চলে গেলেন অফিসের দিকে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হা-হা হাসিতে ফেটে পড়ল ছেলেরা।

আচমকা জ্বলতে নিভতে শুরু করল ওয়ার্কশপের দেয়ালে লাগানো লাল আলো। সঙ্কেত। তারমানে হেডকোয়ার্টারে টেলিফোন বাজছে। হুড়াহুড়ি করে দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে ট্রেলারে ঢুকল ওরা। ছো দিয়ে রিসিভার তুলে নিল কিশোর। চুপচাপ ওপাশের কথা শুনে বলল, অনেক ধন্যবাদ। কেটে দিল লাইন। বন্ধুদের দিকে ফিরে বলল, শুঁটকিকে দেখা গেছে, বাস ডিপোর কাছে। আবার হুড়াহুড়ি করে বেরোনোর পালা। সাইকেল নিয়ে ছুটতে হবে ডিপোতে।

কিশোর বলল, আমাদেরকে অনুসরণ করা হচ্ছে।

বাস ডিপো থেকে মুকখানেক দূরে রয়েছে ওরা। ট্রাফিক লাইটের কারণে বাধ্য না হলে থামত না, পেছনেও তাকাত না কিশোর, দেখতও না।

কই? রবিন বলল। আমি তো কিছু দেখছি না।

একটা গাড়ির পেছনে বসে পড়েছে। সাইকেল নিয়ে আসছিল। অদ্ভুত পোশাক আর হ্যাট পরেছে। পাশের গলিতে ঢুকে পড়বে।

আলো জ্বলতেই আবার সাইকেল চালাল ওরা। ডানে মোড় নিয়ে ঢুকে পড়ল একটা গলিতে। বড় বড় কয়েকটা ডাস্টবিন দেখে তার আড়ালে লুকিয়ে পড়তে ইশারা করল কিশোর।

সাইকেল চালিয়ে আসছে অদ্ভুত পোশাক পরা লোকটা। মুখ দেখা যাচ্ছে না। খাট শরীর, কুঁকে রয়েছে হ্যাণ্ডেলের ওপর, কুঁজো মানুষের মত ঠেলে বেরিয়ে আছে পিঠ। ঢোল, কালো কোট গায়ে, মাথায় বিচিত্র কানাওয়ালা হ্যাট।

ফিসফিসিয়ে মুসা বলল, একেবারে দেখি শার্লক হোমস সেজেছে।

ভাড়! বলল রবিন। আরি! উঠে দাঁড়াল কিশোর। নরি কারমল। তুমি এখানে কি করছ?

এতই চমকে গেল নরি, হাত কেঁপে সাইকেলের হ্যান্ডেল ঘুরে গিয়ে লাগল দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়ির ওপর, কোটের সঙ্গে সাইকেল জট পাকিয়ে হুড়ুম করে পড়ল মাটিতে। হঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল আবার, লাথি দিয়ে ঠিক করল কোটের স্কুল। বলল, আমি তোমাদের সাহায্য করতে এসেছি। যা খুশি বল, কিছু মনে করব না।

হেসে ফেলল মুসা। এই পোশাক পরে?

গোয়েন্দারা তো এরকমই পরে? চেঁচিয়ে উঠল নরি।

আমাদের খুঁজে পেলে কি করে? কিশোর জিজ্ঞেস করল।

পিছু নিয়েছিলাম, গর্বের হাসি ফুটল নরির মুখে। খুব সকালে উঠে গিয়ে বসে ছিলাম স্যালভিজ ইয়ার্ডের কাছে। ইহ, এজটারদের যা খেপতে দেখলাম না। তোমরা এখানে কেন? সূত্রও পেয়েছ?

সে দেখতেই পাবে, কিশোর বলল। এই, রবিন আর মুসাকে বলল, চলো, যাই। সাইকেলে চেপে আবার গলির মুখের দিকে রওনা হল সে।

এই, যাচ্ছি কোথায়? পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলল নরি। জোরে জোরে পেডাল ঘুরিয়ে কিশোরের পাশে চলে এল।

তোমাকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।

না না, আমি যেতে চাই না…

ঘ্যাঁচ করে একটা গাড়ি এসে থামল পথের পাশে। দরজা খুলে প্রায় লাফিয়ে বেরিয়ে এল রস উড। এই যে, পাওয়া গেছে, এখানে। তোমার মা খুব রাগ করেছে। তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে হাসল সে। না পেয়ে এলসা ঠিকই আন্দাজ করে ফেলেছে, কোথায় গেছে। কিশোর, তোমার চাচীকে কোথায় যাচ্ছি বলে এসে ভাল করেছ। নইলে খুঁজে পেতাম না।

আমি বাড়ি যাব না! চিৎকার করে বলল নরি। আমি থাকব! কাজ করব ওদের সঙ্গে।

নরি, ঝোনোর চেষ্টা করল কিশোর। এজটাররা জেনে গেছে আমরা তোমাদের কাজ করছি। রাইমিং স্ল্যাঙের কথাও জেনেছে। কি করে জানল? তুমি বলেছ। গোয়েন্দাদের পয়লা পাঠ, কক্ষনও অযথা কথা বলা উচিত নয়। মস্ত ভুল করেছ তুমি।

মাপ চাই, কিশোর, সত্যি অন্যায় হয়ে গেছে। আমার মায়ের নামে খারাপ কথা বলছিল, তাই খুব রেগে গিয়েছিলাম। আর ভুল করব না। কসম!

সরি, নরি, কিশোর বলল। তুমি থেকে কোন উপকার করতে পারবে না, অসুবিধেই করবে। মিস্টার উডের সঙ্গে চলে যাও।

কালো মেঘ জমল নরির মুখে, দেখে মনে হচ্ছে যে-কোন মুহূর্তে বর্ষণ শুরু হতে পারে। সাইকেলটা ঠেলে নিয়ে গেল গাড়ির কাছে। ওটা তুলতে তুলতে উকিল জিজ্ঞেস করল, তোমাদের কিছু অগ্রগতি হয়েছে?

নিশ্চয় হয়েছে, মুসা জবাব দিল। দ্বিতীয় ধাঁধাটার সমাধানও খুব তাড়াতাড়ি করে ফেলব।

গুড। কোর্টে উইলটা নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছি আমি। এখন যত তাড়াতাড়ি পাথরগুলো বের করতে পার, ভাল। তোমাদের কপাল ভাল, বেশির ভাগ লোকই গুপ্তধন খোঁজা বাদ দিয়েছে। যোগাযোগ রাখবে।

রাখব, রবিন বলল।

গাড়ি নিয়ে চলে গেল উকিল। যতক্ষণ তিন গোয়েন্দাকে দেখা গেল, পেছনে। ফিরে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল নরি।

বাস ডিপোতে পৌঁছে ছেলেটার দেখা পেল ওরা, যে শুঁটকির খবর দিয়েছিল।  ওর নাম ডিক ব্রাউন। ডিপোর পাশের একটা বাড়ির দরজায় তিন গোয়েন্দার সঙ্গে দেখা করল সে, যাতে শুঁটকি ওদের দেখে না ফেলে।

ডিক বলল, সারা সকাল বাসে করে ঘুরেছে টেরি, ডিপো ম্যানেজার বলেছে আমাকে। দুটো রুট ঘুরে এসেছে ইতিমধ্যেই, তৃতীয় আরেকটায় যাবার জন্যে বাসে চড়েছে।

যেন তার কথার প্রমাণ দিতেই ডিপো থেকে বেরিয়ে এল একটা বাস, ছেলেদের সামনে দিয়ে চলে গেল। দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে গেল ওরা। সামনের একটা সিটে বসেছে টেরি, চেহারা থমথমে। খুব চিন্তিত মনে হল, মুসা বলল।

যা খুঁজছে পাচ্ছে না বোধহয়, বলল ডিক। যে দুটো বাসে করে ঘুরে এসেছে, দুটোরই ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলেছি আমি। দুজনকেই নাকি জিজ্ঞেস করেছে সে, ফ্রেণ্ড-এর সঙ্গে ছন্দের মিল আছে, এরকম কিছু আছে কিনা পথে। ড্রাইভাররা কিছু বলতে পারেনি। হাসল ছেলেটা। যাওয়ার মময় হল আমার। তোমাদের দৌলতে অনেক মজা পেলাম। ধন্যবাদ।

তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ, ডিক, কিশোর বলল। যদি পুরস্কার পাই, তোমাকেও ভাগ দেব।

ডিক চলে গেছে। উজ্জ্বল রোদে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবছে মুসা, কিসের সঙ্গে ছন্দ মেলে ফ্রেণ্ড-এর?

কিশোর, রবিন বলল, পিস্তল এমন কি নির্দেশ করেছে, যে-জন্যে বাস ডিপোতে আসতে হয়েছে শুঁটকিকে?

হতে পারে কাউন্টি পার্ক বাস স্টপেজের দিকে নির্দেশ করেছিল পিস্তল, কিশোর বলল। মূর্তির কাছেই ওটা। ধাঁধায় রাইড শব্দটাও রয়েছে। শুঁটকি হয়ত মনে করেছে বাসে চড়তে বলা হয়েছে।

কিন্তু তাহলে এখানে কেন এল? পার্কের স্টপেজ থেকে কেন চড়ল না?

আর এত ঘোরাঘুরি করছে কেন? ওদের আলোচনায় যোগ দিল মুসা।

হুম, ঠিকই বলেছ, কিশোর বলল। চলো তো, রুটের নকশাগুলো দেখি। প্রশ্নের জবাব মিলতেও পারে।

ডিপোর ভেতরে ঢুকে, নকশা দেখায় মন দিল ওরা।

এই দেখ, বলল কিশোর। তিনটে রুট দিয়ে বাস যায় পার্কের মেইন স্টপেজে।

তারমানে কোন রুটের কথা বলেছে কারমল, রবিন বলল, শুঁটকি জানে না।

আমরাও জানি না, নিরাশ ভঙ্গিতে হাত নাড়ল মুসা।

ভুরু কোঁচকাল কিশোর। বিশেষ কোন রুটের কথা বলেছে, যেটা ধাঁধা সমাধানে সাহায্য করবে। দেখি তো আরেকবার ধাঁধাগুলো, পকেট থেকে নকলটা বের করল সে। পড়ল, অ্যাবাভ দ্য অ্যাপলস অ্যাণ্ড পেয়ারস অল অ্যালোন; দ্য লেডি ফ্রম আ ব্রিস্টল রাইডস ফ্রম ফ্রেণ্ড।

কোন রুটের নাম্বার ফ্রেণ্ডের সঙ্গে ছন্দ মেলায় না তো? মুসা বলল।

শব্দটার উচ্চারণ ফ্রেন হলে টেন-এর সঙ্গে মিলত। কিন্তু ডি-টা বাদ দিই কি করে? কিশোর, বইতে কি রাইড ফ্রম আ ফ্রেণ্ড-এর কোন মানেই লেখা নেই?

না, আমি অন্তত পাইনি। যতদূর মনে হচ্ছে বাসের কথাই বলেছে কামল। সেই বাসে চড়ে হয়ত কোন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যেত। হয়ত এটা স্ল্যাং নয়, যা বলেছে তা-ই বুঝিয়েছে। কার সঙ্গে দেখা করতে যেত, সেটা জানতে পারলে…

থেমে গেল কিশোর। চোখ মিটমিট করল কয়েকবার। জেনি এজটার এসে দাঁড়িয়েছে কাছে। চোখের তারায় ভয় ফুটেছে। ঠিকই বলেছ তুমি, ইয়াং ম্যান। মনে হয় বুঝতে পারছি কোন বন্ধুর কথা বলেছে।

মুসা বলল, কিশোর, ওর কথা বিশ্বাস কোরো না। ভাওতা দিয়ে…

না না, ভাঁওতা দিচ্ছি না, তাড়াতাড়ি বলল জেনি। তোমাদেরও দোষ নেই। সন্দেহ করার মত কাজই করেছি আমরা। আমাকে বাধ্য করেছিল মাইক। ভয়ানক লোক। সাঙঘাতিক ভয় করি ওকে। তবে এবার ওকে থামানোর সময় হয়েছে, ওর ভালর জন্যেই।

থামাবেন? কিশোর বলল।

কাউকে দিয়ে বাঁধার সমাধান করিয়ে, যাতে সত্যিকারের স্বত্তাধিকারীরা রহগুলো পায়। জানো, স্যালভিজ ইয়ার্ডে আবার গিয়েছিলাম আমি, তোমাদের কাছে, তোমার চাচীর কাছে মাপ চাইতে! আর আমি সাহায্য করছি না মাইককে, যতই ভয় দেখাক।

খাইছে, মুসা বলল, আপনাকে মারধোর করেছে নাকি?

ওর পক্ষে সব সম্ভব, কেঁপে উঠল জেনি। সেজন্যেই তোমাদের সাহায্য করতে এসেছি, ওকে ঠেকানোর জন্যে। আমাকে সাহায্য করবে? কারমলের বন্ধুর আসল ঠিকানা আমি জানি না, তবে মেরে তার কাছে নিয়ে যেতে পারব।

ভ্রূকুটি করল কিশোর। লোকটি কে, মিস এজটার?।

বলছি…তুমি কিশোর, তাই না? আর তুমি রবিন, তুমি মুসা।

মাথা ঝাঁকাল তিনজনেই। সন্দেহ যাচ্ছে না।

হাসল জেনি। গুড। আমার মামা প্রায়ই গিয়ে দাবা খেলত মিস্টার মারফি নামে একটা লোকের সঙ্গে।

তার কাছে বাসে করে যেতেন কারমল? মুসা জানতে চাইল।

হ্যাঁ। তবে বলতে পারব না কোন রুটের কোন বাসে করে যেত। থাকে কোথায়? রবিন জিজ্ঞেস করল।

বললাম না, ঠিকানা জানি না। তবে মামার বাড়ির পাশে পার্কের ধারে একটা বাড়ি আছে মারফির।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। তিনটে বাস রুটই গেছে ওই এলাকার ভেতর দিয়ে। বলল, মিস্টার মারফির কথাই হয়ত বলেছেন কারমল। চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। তা যাব কিভাবে?

জেনি বলল, অনেক দূর, সাইকেলে করে যেতে অসুবিধে হবে। আমাকে যদি বিশ্বাস কর, আমার গাড়িতে করে নিয়ে যেতে পারি।

বেশ… দ্বিধা যাচ্ছে না কিশোরের।

বাড়িটা কোথায় বলে দিতে পারি তোমাদের, দ্বিধা দেখে বলল জেনি। তোমাদের সঙ্গে বাসে যেতেও আমার আপত্তি নেই। হাসল সে।

পরস্পরের দিকে তাকাল ছেলেরা। গাড়িতে গেলে অবশ্যই সময় বাঁচবে,মুসা বলল।

সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল কিশোর। সময়ের দাম আছে। ঠিক আছে, মিস এজটার, গাড়িতেই যাব।

গুড, জেনি বলল, ডিপোর পার্কিং লটে গাড়ি রেখেছি। তোমাদের সাইকেল ওখানেই রেখে নাও।

গাড়িতে আর কেউ নেই, ওঠার আগে এ-ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিল ছেলেরা। সতর্ক থাকল। বোটানিক্যাল গার্ডেন ছাড়িয়ে এল গাড়ি, পাহাড়ের ঢালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কতগুলো ছোট ছো। কটেজের দিকে এগোল। কিছুক্ষণ পর সরু একটা রাস্তা দেখিয়ে জেনি বলল, ওপথেই যেতে হবে।

বসন্তের চমৎকার রোদ। পাহাড়ের দৃশ্য দেখতে দেখতে আনমনা হয়ে পড়ল কিশোর আর মুসা, সতর্কতা চলে গেল। আরাম করে হেলান দিয়ে বসল ওরা।

পুরানো একটা কটেজের সামনে গাড়ি থামাল জেনি। বলল, এটাই।

বেরিয়ে এল ছেলেরা। মুগ্ধ হয়ে দেখছে। সুন্দর জায়গা। পাখির গানে মুখরিত।

সন্দেহ কিছুটা থেকেই গেল রবিনের, সাবধানে ডাকল, মিস্টার মারফি? মিস্টার মারফি আছেন? মিস্টার কারমলের কথা আলোচনা করতে এসেছিলাম,

যদি…

কাঁপা কাঁপা বৃদ্ধ-কণ্ঠ ভেসে এল কটেজের ভেতর থেকে, কে? কারমলের কথা বলছ? দাবা খেলতে আসত, কক্ষনও পারত না আমার সঙ্গে। সব সময় হারত। এস, ভেতরে এস।

আর দ্বিধা রইল না। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে কিশোর বলল, স্যার, কারমল এখানে বাসে করে আসতেন, তাই না? কখনও কি বাস আর আ বল অভ টোয়াইন সম্পর্কে কিছু বলেছেন?

ওপাশের দেয়াল ঘেঁষে কুককেসের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন একজন বৃদ্ধ, ছেলেদের দিকে পেছন করে। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালেন।

হাল্লো, গর্দভের দল!

এ-কি! কোথায় বৃদ্ধ মিস্টার মারফি! বুড়োর ছদ্মবেশ পরে রয়েছে মাইক এজটার, হাতে সেই ওয়াকিং স্টিক, মুখে কুৎসিত হাসি। ওদের পেছনে সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিল জেনি এজটার।

১০

খেঁকিয়ে উঠল জেনি, মনে করেছ এত সহজে হাল ছেড়ে দেব?

এতই চমকে গেছে, কথা হারিয়ে ফেলেছে রবিন আর মুসা। রাগে কাঁপছে কিশোর। তবে জিভ সংযত রাখল। দেখতে চাইছে, কি ঘটে।

ভালই অভিনয় করেছ, জেনি, বোঝা যাচ্ছে, বোনকে বলে, ছেলেদের দিকে চেয়ে দাঁত খিচাল মাইক।

তুমিও কম করনি, হেসে উঠল জেনি। তবে ছেলেগুলো বেশি সৎ, আর আগ্রহী। যে কেউ ঠকাতে পারবে এখন ওদের।

মিস্টার মারফির বুদ্ধিটা ভালই হয়েছে, কি বল? হাহ্ হাহ্, নিজের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে হাত কচলাল মাইক।

তুমি, তুমি…! রাগে কথা আটকে গেল মুসার মুখে।

থাম, খাম, মেজাজ ঠাণ্ডা কর, হাত তুলল মাইক। ভাল একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম, পাত্তা দাওনি। এখন আর তোমাদেরকে দরকার নেই আমাদের, অন্য লোক পেয়েছি। বল অভ টোয়াইন বলতে কি বুঝিয়েছে, তা-ও জানি। আমরা : কাজ করি গিয়ে, এই ঘরে তোমরা বিশ্রাম নাও। তবে অবশ্যই দরজায় তালা লাগানো থাকবে। মেয়েমানুষের মত হি-হি করে হাসল সে। নিরাপদেই থাকবে। কাছাকাছি আর কোন কটেজ নেই, চেঁচিয়ে সুবিধে করতে পারবে না, কারও কানে যাবে না চিৎকার। এক মাসের জন্যে ভাড়া নিয়েছি এটা, কাজেই ততদিন বাড়িওয়ালাও আসবে না। একমাস অবশ্য থাকছি না আমরা এখানে…।

ব্যস ব্যস, আর বলার দরকার নেই, বাধা দিল জেনি। ওদের ঘরে নিয়ে যাই।

লাঠি তুলে ইশারা করল মাইক, ভেড়ার পালকে যেমন চলার নির্দেশ দেয় রাখাল।

যার যেদিকে খুশি, হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।

ইঙ্গিত বুঝতে পেরেছে, চোখের পলকে ঘুরে, দুদিকে দৌড় দিল রবিন আর মুসা। কিশোর ঘুরল আরেক দিকে। ছোটাছুটি শুরু করল। ধরার জন্যে হাত বাড়াল ভাইবোন। কিন্তু ছুঁতেও পারল না। ওদেরকে হতবাক করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল তিন কিশোর, একজন সামনের দরজা খুলে, একজন পেছনের দরজা, আর আরেকজন জানালা দিয়ে।

সরু পথ ধরে আগে আগে ছুটল মুসা। ছুটতে ছুটতে তাকাচ্ছে এদিক ওদিক, লুকানোর মত জায়গা খুঁজছে, অন্তত একটা ঘন ঝোপ পেলেও হয়। কিন্তু পথের দুপাশে এখানে খোলা অঞ্চল।

পেছনে টায়ারের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শোনা গেল। পেছনে তাকিয়ে ঢোক গিলল রবিন। বলল, ব্যাটারা আসছে আমাদের ধরতে।

নেমে পড়ো রাস্তা থেকে, নির্দেশ দিল মুসা।

লাফিয়ে পথের পাশের খাদে পড়ল তিনজনে। সেখান থেকে উঠে দৌড় দিল মাঠের ওপর দিয়ে। পেছনে আবার টায়ারের আর্তনাদ, ধাতব বস্তু আছড়ে পড়ার শব্দ। ছেলেরা ভাবল, খাদ পেরিয়ে মাঠের ওপর দিয়েই ওদের তাড়া করতে আসছে গাড়ি। কিন্তু ফিরে তাকিয়ে দেখল সম্পূর্ণ অন্য দৃশ্য।

খাদে কাত হয়ে পড়ে আছে গাড়িটা। জানালার কাঁচ চুরচুর। একটা চাকা ফেটে গেছে। হামাগুড়ি দিয়ে কোনমতে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ছুটন্তু আরেকটা নীল গাড়ির দিকে তুলে লাঠি নাচাচ্ছে মাইক।

খাইছে! হল কি? অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মুসা।

খোঁড়াতে খোঁড়াতে আবার গাড়ির কাছে গিয়ে বোনকে বের করার চেষ্টা চালাল মাইক।

দ্রুত মোড়ের ওপাশে হারিয়ে গেল নীল গাড়িটা। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কিশোর বলল, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। গাড়িটা চেনা চেনা লাগল।

ভেতরে কে ছিল দেখেছ?।

দুজন মনে হল, বলল রবিন। ড্রাইভার বেশ বড়সড় মানুষ…বিশালদেহী।

আবার সেই দৈত্য! মুসা বলল।

হয়ত, চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর। কিংবা বেপরোয়া কোন ড্রাইভার।

যে-ই হোক, আমাদের বড় উপকার করেছে।

আশ্চর্য! বিড়বিড় করল রবিন। যাকে চিনিই না, কেন যেচে পড়ে উপকার করতে এল আমাদের, যদি বেপরোয়া ড্রাইভার না হয়ে থাকে?

এ, দেখ, হেসে উঠল মুসা।

খোঁড়াচ্ছে ভাইবোন দুজনেই, রওনা দিয়েছে কটেজের দিকে। এদিকেই তাকিয়ে আছে মাইক, হাতের লাঠি নাচাচ্ছে ছেলেদের দিকে।

রবিন আর কিশোরও হাসল। তারপর শহরে রওনা হল ওরা। মাঝে মাঝে পেছনে ফিরে দেখে নেয়, এজটাররা পিছু নিল কিনা। কিন্তু মোটা মাইক আর তার রোগাটে বোনের ছায়াও দেখা গেল না আর।

লাথি মেরে রাস্তার একটা পাথর সরাল কিশোর। আমি একটা আস্ত গর্দভ! নইলে জেনির মত একটা মেয়েমানুষ এভাবে বোকা বানায়। দশ বছর ধরে এখানে আসে না ওরা, একথাটা মনেও হল না একবার। শেষ জীবনে কারমল কি করেছে।

করেছে জানার কথা নয় জেনি আর মাইকের। ভুল করা একদম সহ্য করতে পারে না সে। অথচ এই কেসটায় একের পর এক ভুল করে চলেছে। মনে মনে কষে কয়েক ডজন লাথি মারল নিজেকে।

আস্ত শয়তান,মুসা বলল। কি রকম বানিয়ে বানিয়ে বলল, বিশ্বাস না করে উপায় ছিল? কটেজটাও নিয়েছে কারমলের বাড়ির পাশে। ওদেরও কপাল ভাল বলতে হবে, একেবারে জায়গামত ভাড়া পেয়েছে।

তবে এবার খারাপ হতে শুরু করেছে, হাসি ফুটল কিশোরের ঠোঁটে। গাড়ি ভেঙেছে। কোম্পানি পুরো ক্ষতিপূরণ আদায় করে ছাড়বে। দিতে না পারলে দেবে ওদের নামে কেস করে। কারমলের বন্ধুকে খুঁজে বের করাও ওদের কম্মো নয়।

কেন?

কারণ, কারমলের বন্ধুদের কথা জানার কথা শুধু এলসা আর উডের। ওরা কিছুতেই বলবে না ভাইবোনকে।

কিন্তু আমাদের বলবে! বলে উঠল রবিন?

ঠিক! তুড়ি বাজাল কিশোর। চলো, ওদের সঙ্গেই কথা বলি। বাস স্টপ খোঁজ।

বেশিদূর আর এগোতে হল না, মেইন রোডে এসে উঠল ওরা। বাস কোথায় থামে দেখল। কিন্তু বাস আসার আগেই এল একটা গাড়ি, স্টেশন ওয়াগন, চালাচ্ছেন এক মহিলা, ওদেরই এক সহপাঠীর মা। ছেলেদেরকে বাস স্টপেজে দেখে থেমে জিজ্ঞেস করলেন কোথায় যাবে।

লিফট পেয়ে গেল ওরা।

ফারমলের বাড়িতে কটেজেই পাওয়া গেল এলসাকে। একা।

নরি বোধহয় পেছনের বাগানে, এলসা বলল। ওকে নামিয়ে দিয়ে উড গেছে লস অ্যাঞ্জেলেসে। আমি খেতে বসতে যাচ্ছিলাম। তোমরাও বসে যাও না? খেতে খেতে সব কথা বলবে আমাকে।

স্যাণ্ডউইচ চিবুতে চিবুতে কি ঘটেছে বলল রবিন।

ভীষণ রেগে গেল এলসা। এমন শয়তান লোক জীবনে দেখিনি। বিশ্বাস করাই ভুল হয়েছে তোমাদের।

এই শেষ, মুসা বলল, আর না।

আচ্ছা, এবার ধাঁধার কথা বলি, কিশোর বলল। বাসে চড়ে বন্ধুর কাছে যাবার কথা বলেছেন কারমল। কার কথা বলেছেন, আন্দাজ করতে পারেন?.

ভেবে বলল এলসা, তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু দুজনই আছে। ড্যাম সান, আর ডোরা কেমপার। ভোরা কাছেই থাকে, হেঁটেই যাওয়া যায়। বাসে করে যেতে হলে সানের কথাই বলেছে। হপ্তায় দুএকবার যেত ওখানে। বাড়ির সামনে থেকেই বাস ধরত।

তাহলে তিনিই হবেন, কিশোর বলল। উইলে সাক্ষীও তো হয়েছেন ড্যাম সান। ভুলে গিয়েছিলাম। কোথায় থাকেন তিনি?

কাউন্টি পার্কের মাইল দুয়েক দূরে। পথের পাশের একটা ছাউনিতে। মেইন রোড থেকে দেখা যায় না। তবে সাইনপোস্ট লাগানো রয়েছে পথের মোড়ে, বাস থেকেই দেখবে। আট নাম্বার বাস যায়।

আর দেরি করল না ছেলেরা। খাওয়া শেষ। তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে রাস্তা পেরিয়েই থমকে দাঁড়াল কিশোর।

কি হল? রবিন বলল।

উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে কিশোরের চোখের তারা। বাসের সূত্রের মানে বুঝে গেছি! আর বাসে কি খুঁজতে হবে, তা-ও!

১১

খাইছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। কী, কিশোর?

শোন, পকেট থেকে নকলটা বের করল কিশোর। তিন নাম্বার ধাঁধায় বলছেঃ অ্যাট দ্য টেনথ বল অভ টোয়াইন, ইউ অ্যাণ্ড মি; সী আওয়ার হ্যাণ্ডসাম মাগ অ্যাহেড। হাসল সে। বাস থেকে অনেক কিছু দেখা যায়। তার মধ্যে।

একটার ছন্দ মিলে যায় বল অভ টোয়াইনের সঙ্গে। এবং সেটা বাস থেকেই দেখা যাবে বলেছে কারমল।

মাথা নাড়ল মুসা, সানের ছাউনি নয়। ওটা বাস থেকে দেখা যাবে না…

কিন্তু সাইনপোস্ট দেখা যাবে! উত্তেজিত হয়ে উঠল রবিন। টোয়াইনের সঙ্গে সাইনের ছন্দও মেলে।

হ্যাঁ, কিশোর বলল। টেনথ বল অভ টোয়াইন মানে, দশ নাম্বার সাইন। প্রথম থেকে এক দুই করে গুনে যেতে হবে।

বাস এল। উঠে বসল ছেলেরা। বোটানিক্যাল গার্ডেন আর শপিং সেন্টারের পাশ কাটিয়ে এল, এগিয়ে চলল পাহাড়ের দিকে।

আট নাম্বার সাইনটা গোনার পর মাথা নাড়ল রবিন, কিশোর, কোথায় বুঝি একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে।

আট নাম্বার সাইনটা সানের বাড়ির কাছে। বাস থামল ওখানে।

হ্যাঁ, কিশোরও রবিনের সঙ্গে একমত। গম্ভীর। ভুলটা কি? মুসার প্রশ্ন। দশ নাম্বারে তো এখনও যাইইনি।

সেটাই ভুল। কারমল যেখানে নামত, সেটা ছাড়িয়ে যাবার কথা নিশ্চয় বলবে, জবাব দিল রবিন।

ভাড়া? নিজেদের আলোচনায় এতই মগ্ন ছিল ছেলেরা, বাস ড্রাইভার এসে দাঁড়িয়েছে, বলতেই পারবে না।

দিলাম তো একবার, মুসা বলল।

এখানে নামলে আর লাগবে না। কিন্তু সামনে গেলে আরও দশ সেন্ট করে দিতে হবে।

তাহলে নেমেই যাচ্ছি, উঠে দাঁড়াতে গেল মুসা।, রাখ, বাধা দিল কিশোর। দশ নাম্বার সাইনটা গিয়ে দেখেই আসি না। কারমলের কোন ব্যাপারেই শিওর হওয়া যাচ্ছে না, অসম্ভব চালাক। পকেট থেকে পয়সা বের করে ড্রাইভারের হাতে ফেলল সে।

আবার চলল বাস। দেখা গেল দশ নাম্বার সাইন। ফ্রিওয়ে থেকে ঢোকার আরেকটা পথ, সাইনবোর্ডে লেখাঃ ডু নট এনটার। আনমনে মাথা নেড়ে বাস থামানোর শেকল ধরতে গেল কিশোর, থামানোর ইঙ্গিত দেবে, নেমে যাবে ওরা।।

কিশোর! তার হাতে হাত রাখল মুসা, টেনো না!

হাত তুলে দেখাল সে। ফ্রিওয়ের প্রবেশমুখের কাছে দাঁড়িয়ে আছে চকচকে একটা গাড়ি। গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে জেনি আর মাইক। কোন ব্যাপারে ভীষণ তর্ক জুড়েছে। ওদের অলক্ষ্যে পেরিয়ে যাবার সময় ছেলেরা দেখল, জোরে সাইনপোস্টে লাথি মেরে নিজের আঙুলই ব্যথা পেয়ে সেটা চেপে ধরল মাইক।

সর্বনাশ! গুঙিয়ে উঠল রবিন। হাল ছাড়েনি ব্যাটারা!

মুসা হাসল। কিন্তু আসল সাইনটাও পায়নি।

তবে বুঝে ফেলেছে, কিশোর বলল, সাইনের কথাই বলেছে বুড়ো! পরের স্টপেজে নেমে যাব আমরা। এরপর জলদি কাজ সারতে হবে।

বাস থামলে নেমে পড়ল ওরা। ওটা চলে যেতে দেখে অস্বস্তিতে কাঁধ ঝাঁকাল মুসা। এবার কি করব?

ভাবব, বলল কিশোর। সানের ছাউনির পরে আরও দুটো সাইন পেরিয়ে এসেছি। তারমানে এসব সাইনপোস্টে কিছু নেই। কারমল লিখেছে রাইডস ফ্রম আ ফ্রেণ্ড। ফ্রম লিখল কেন? এখন বুঝেছি। আসলে কারমল বোঝাতে চেয়েছে, সানের বাড়ি থেকে রওনা হওয়ার পর দশ নাম্বার সাইন।

নিশ্চয়ই! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। রাস্তার অন্য পাশের সাইন। পরের বাসেই ফিরে যাব।

বাস এল। আবার বাড়তি ভাড়া দিতে হল, উচু এলাকায় ওঠার কারণে এই বিশেষ ভাড়া।

ব্যাটারা খামোকা পয়সা নেয়, নালিশের সুরে বলল রবিন।

যেখানে যা নিয়ম, কিশোর বলল। যাক ওসব কথা। এখন সাইনের ওপর নজর দাও।

ফ্রিওয়ের প্রবেশমুখের কাছে এসে জেনি আর মাইককে দেখা গেল না। নেই ওরা। আবার সাইন গোনায় মন দিল তিন গোয়েন্দা।

আট নাম্বার সাইন এল। কাউন্টি পার্কের মেইন বাস স্টপের কাছেই ওটা। নয় নাম্বারটাতে লেখা রয়েছেঃ শ্লো। পাহাড়ের গায়ে বসানো সাইনপোস্টের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা বেঁকে চলে গেছে বাঁধের দিকে।

মনে হচ্ছে পার্ক আর বোটানিক্যাল গার্ডেনের মধ্যেই যত ব্যাপার, মুসা বলল।

হ্যাঁ, বলল কিশোর, সে-রকই লাগছে।

পরের সাইনটা আসার অপেক্ষায় অধীর হয়ে রইল ওরা।

দূর থেকে বলে উঠল মুসা, খাইছে!

রবিন বলল, হায় হায়!

আমি…আমি…, চুপ হয়ে গেল কিশোর।

কাউন্টির সীমানা শেষ ওখানে, শহর শুরু, আর তা-ই লেখা রয়েছে ওখানকার ইনেঃ ওয়েলকাম টু রকি বীচ।

কিশোর, কারমল মোটেও ওটার কথা বলেনি, জোরে হাত নাড়ল রবিন, যেন বাতাসে খাবলা মারল। না! ধীরে ধীরে বলল কিশোর, আবারও ভুল করেছি আমরা!

আমরা একাই নই, কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে ফেলল মুসা। ওই দেখ।

বাইরে তাকিয়ে পরিচিত একটা লাল গাড়ি নজরে পড়ল। সাইনের পাশের মাটি খুঁড়ছে শুঁটকি টেরি, উন্মাদ হয়ে গেছে যেন। হতাশা আর পরিশ্রমে লাল মুখ। অনেকক্ষণ ধরে খুঁড়ছে বোঝা যায়। বাসটা ওর পাশ কাটানোর আগেই রাগ করে ছুঁড়ে ফেলে দিল হাতের শাবলটা!

যাক, শুঁটকিও পায়নি, শিওর হওয়া গেল, রবিন বলল। পায়নি, তবে আমাদের ঘাড়ের কাছেই হুমড়ি খেয়ে আছে, কিশোর বলল। সে আর এজটাররা। সময় খুব কম আমাদের হাতে।

কিন্তু করবটা কি? ভুলটা কোথায় করলাম?

জানি না। সাইন খোঁজা বাদ দিয়ে গিয়ে সানের সঙ্গে দেখা করা দরকার, বলতে বলতেই হাত বাড়িয়ে শেকল ধরে হ্যাঁচকা টান মারল কিশোর।

আধ ঘন্টা পর, ড্যাম সানের ছাউনির রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল তিন গোয়েন্দা। দেখা গেল ছাউনি। পুরানো, রঙ নেই। সামনে বেশ বড়সড় একটা কাঁচা চত্বর, ধুলোয় ঢাকা।

চলতে চলতে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল মুসা, মাথা নোয়াও!

মত্ত এক পাখির মত শাঁ করে ওদের মাথার সমান্তরালে ছুটে এল বিচিত্র জিনিসটা।

১২

ওদের মাথার ওপরে এসে আচমকা আবার উঠতে শুরু করল জিনিসটা। বেশ চওড়া এক চক্কর নিয়ে ঘুরে আবার রওনা হয়ে গেল যেদিক থেকে এসেছিল

সেদিকে। অদৃশ্য হয়ে গেল ছাউনির আড়ালে।

ও-ওটা কি?…ভূ-ভূ… তোতলাতে লাগল মুসা।

অট্টহাসি শোনা গেল ছাউনির পেছন থেকে। বেরিয়ে এল এক বুড়ো, ছোটখাট শরীর, মাথায় কুঁচকানো তারের মত ধূসর রঙের চুল। গায়ে বুশজ্যাকেট, পরনে মোটা কাপড়ের প্যান্ট, পায়ে মাইনারস বুট। হাতে ইংরেজি ভি অক্ষরের মত দেখতে বিচিত্র একটা জিনিস, এটাই উড়ে এসেছিল ছেলেদের দিকে।

খুব ঘাবড়ে দিয়েছি, না? ফ্যাকফ্যাক করে হাসল বুড়ো। হাতের জিনিসটা নাচাল। এটা দিয়ে পঞ্চাশ ফুট দূর থেকে ক্যাঙারু ফেলে দিতে পারি।

বুমেরাঙ! বিড়বিড় করল রবিন।

আমাদের গায়ে লাগতে পারত! কড়া গলায় বলল মুসা।

নেচে উঠল বুড়োর নীল চোখের তারা। লাগানোর জন্যে তো মারিনি। তাহলে বাঁচতে পারত না। আমার সময়ে কুইনসল্যাণ্ডে সবচে ভাল বুমেরাঙ ছুঁড়তে পারতাম আমি।

সব সময়ই কি আপনার হাতে ফেরত যায়? জানতে চাইল রবিন।

ছুঁড়তে জানলে সব সময়ই আসবে।

যদি নিশানা ব্যর্থ হয়, তাহলেই শুধু আসবে, তাই না মিস্টার সান? কিশোর বলল।

হ্যাঁ। চালাক ছেলে। তা, এখানে কি চাই?

কি জন্যে এসেছে বলতে শুরু করল রবিন আর মুসা।

বাধা দিয়ে সান বলল, জানি, আর বলতে হবে না। তোমরাই উড আর এলসাকে সাহায্য করছ। আমার কাছে কি চাই? আমি তো জানি না ওগুলো কোথায় আছে। আর জানলেও বলতাম না।

তা না জানুন, দুএকটা ধাঁধার সমাধানে তো অন্তত সাহায্য করতে পারবেন?

কেন করব, বল? ডেন যদি চাইত,গ্রহগুলো তার ছেলের বৌ পাক, তাহলে তো দিয়েই যেতে পারত। দিল না কেন? ইচ্ছে নেই বলে। নতুন একটা উইল করল, আমাকে সাক্ষী রাখল। অনুরোধ জানিয়ে রাখল, যদি হঠাৎ সে মরে যায় তাহলে ওটা যেন পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করি…।

হঠাৎ মরে যাবেন আশা করছিলেন নাকি? ফস করে জিজ্ঞেস করে বসল রবিন।

কি জানি। তবে হার্ট খারাপ ছিল, প্রচুর ওষুধ খাচ্ছিল। কারণও আছে। সারাজীবন ওটাকে কম খাটায়নি তো। খাঁটিয়েছি আমরা সবাই। বুশরেঞ্জার, মাইনার, প্রসপেক্টর, কি কাজ করিনি…

আপনার কি মনে হয়? জানতে চাইল রবিন। কারমল ধাপ্পা দিয়েছেন?

রসিকতা সে পছন্দ করত। চোখ সরু সরু হয়ে এল বুড়োর। ওর মনে কি ছিল, আমি বলতে পারব না।

আপনিও গুপ্তধন চান? মুসা বলল। রাইমিং স্ল্যাং আপনি ভাল জানেন।

দেখ ছোকরা, মুখ সামলে কথা বল! রেগে গেল সান। ও আমার বন্ধ ছিল। ওর জিনিস মরে গেলেও নিতে যাব না আমি। তাছাড়া, ম্যাং জানি বটে, কিন্তু উইলের সমস্ত রাইম আমিও জানি না।

নিশ্চয় মূল্যবান কিছু জানেন আপনি, স্বর নরম করে বলল কিশোর। কারমল নিয়মিত আসতেন আপনার কাছে। তিনি…

দেখ, আমি এলসাকে সাহায্য করব না!

দেখুন, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর, কারমল নিশ্চয় চেয়েছেন আপনি সাহায্য করবেন, যে ধাঁধার জবাব জানতে আসবে তাকেই। মাথা খাঁটিয়ে বের করার কথা বলেছেন আপনার বন্ধু। এলসা যদি মাথা খাঁটিয়েই নিতে চায়, অসুবিধে কি? উত্তরাধিকার সূত্রে তো আর পাচ্ছে না।

তা ঠিকই বলেছ, নরম হল বুড়ো বেশ, বল কি জানতে চাও।

ধাঁধার জবাব খুঁজতে খুঁজতে আপনার কাছে পৌঁছেছি, কিশোর বলল। আমাদের মনে হয়েছে, বল অভ টোয়াইন মানে রোড সাইন। আপনি কি বলেন?

ছন্দ তো মেলে। তবে বল অভ টোয়াইনের রাইমার স্ল্যাং সাইন কিনা বলতে পারব না। হাসি দেখা গেল বুড়োর নীল চোখের তারায়। নিজে নিজেই বানিয়ে থাকতে পারে। পঞ্চাশ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার কোন দুর্গম অঞ্চলে কিছু শুনে এসে সেটা দিয়েই বানিয়েছে কিনা কে জানে। ওর পক্ষে সম্ভব।

কারমল ইঙ্গিত দিয়েছেন, বাসে চড়ে সাইন শুনতে শুনতে যাবার। তার বাড়ি আর আপনার বাড়ির মাঝের পথে। নিশ্চয় দশ নাম্বার সাইনটা কোন সূত্র।

তাহলে ওখানে গিয়ে না খুঁজে আমাকে কেন বিরক্ত করছ? খুঁজেছি, মুসা বলল। পাইনি।

তাই নাকি? শয়তানী বুদ্ধিতে মগজ বোঝাই ছিল ওটার, আবার ফ্যাকফ্যাক করে হাসল বুড়ো।

তা ছিল, মানতে বাধ্য হল কিশোর। কিন্তু বাস রুটে কিছু একটা রয়েছে, যেটা শুধু আপনি জানেন, মিস্টার সান।

জানি? কি সেটা? নেচে উঠল আবার বুড়োর চোখের তারা।

সেটা আপনি জানেন।

চালাক ছেলে, মাথা ঝাঁকাল সান। হ্যাঁ, বাসে চড়ে আসার মধ্যেও তার বিশেষত্ব ছিল। ওকে চিনলে, ওর কাজকর্মে আর কেউ অবাক হবে না।

কি করতেন? জানতে চাইল রবিন।

হাসল সান। সাঙ্ঘাতিক কিপটে ছিল তো, কায়দা করে বাসের পয়সাবাঁচাত। শহরে যাবার পথে আমার বাড়ির কাছের স্টপেজটাই হায়ার জোন-এর শেষ স্টপেজ, উচ্চতার জন্যে বেশি পয়সা দিতে হয়। এর পরেরটা থেকে আর দিতে হয় না। তাই ওখানে হেঁটে চলে যেত সে, তাতে সাত সেন্ট বাঁচত।

স্তব্ধ হয়ে গেল তিন কিশোর। সবার আগে কথা ফুটল মুসার, তারমানে আপনার দোরগোড়া থেকে নয়, সাইন গুনতে হবে পরেরটা থেকে?

যা, কুটিল হাসিতে নেচে উঠল বুড়োর চোখ। তাই বুঝিয়েছে।

আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না তিন গোয়েন্দা। ঘুরে দৌড় দিল বাস ধরার জন্যে। পেছনে শোনা গেল সানের অট্টহাসি।

আগেই আন্দাজ করা উচিত চিল, কিশোর বলল। এখানে উঠলে পয়সা বেশি দিতে হয়।

এক কাজ করলে কেমন হয়? মুসা বলল। কারমলের মত আমরাও এক স্টপেজ হেঁটেই যাই। পয়সা বাঁচবে, হয়ত কিছু চোখেও পড়তে পারে।

উত্তম প্রস্তাব, রবিন বলল।

সুতরাং এক স্টপেজ হেটে এসে বাসে উঠল ওরা। পথে নতুন কিছু অবশ্য চোখে পড়ল না।

প্রথমবার দশ নাম্বার সাইন যেটাকে ধরেছিল, সেটার কাছে এসে গর্ত দেখল অনেকগুলো, তবে শুঁটকিকে আর দেখা গেল না। বোটানিক্যাল গার্ডেন পেরোল..ডেপুটির অফিস গেল…অনেক পরে পার্ক রোড যেখানে কারমলের বাড়ির রাস্তার সঙ্গে মিশেছে, সেখানে এসে দেখল পরের লাইনটা। লেখা রয়েছেঃ টার্ন লেফট হিয়ার ফর ফেয়ারভিউ শপিং মল। অর্থাৎ বাঁয়ে ঘুরলে ফেয়ারভিউ শপিং মল পাওয়া যাবে।

লাভটা কি হল? হতাশ হয়ে হাত ওন্টাল মুসা। যে গোলকধাঁধা সেই গোলকধাঁধা। বাজারে খোঁজা সম্ভব নাকি? কজায়গায় খুঁজব?

আমি শিওর, এটাই সঠিক সাইন, জোর দিয়ে বলল কিশোর। এখান থেকেই পরের সূত্র খুঁজে বের করতে হবে।

বাস থেকে নেমে শপিং সেন্টারের দিকে হাঁটতে শুরু করল ওরা। বিরাট এলাকা নিয়ে মস্ত সুপারমার্কেট করা হয়েছে। নানারকম দোকান ছাড়াও রয়েছে রেস্টুরেন্ট, স্ন্যাক-বার। সেদিকে চেয়ে দমে গেল তিন গোয়েন্দা।

১৩

পকেট থেকে নকলটা বের করল গোয়েন্দাপ্রধান। আপনমনেই বলল, টেনথ বল অভ টোয়াইন আমাদেরকে নিয়ে এসেছে শপিং সেন্টারে। তারপরে? ইউ অ্যাণ্ড মি; সী আওয়ার হ্যান্ডসাম মাগ অ্যাহেড।

রবিন বলল, ইউ অ্যাণ্ড মি হল আ কাপ অভ টী।

মরেছে, সেন্টারে গিজগিজ করছে লোক, সেদিকে তাকিয়ে বলল মুসা। এক কাপ চা নিয়ে ওখানে কেউ বসে আছে নাকি আমাদের জন্যে।

বসে হয়ত নেই, কিশোর বলল। তবে চা কোথায় পাওয়া যাবে, তা জানি। ওই দেব।

একটা পনিরের দোকান আর একটা কার্পেটের দোকানের মাঝের দোকানটা চায়ের নাম লেখা রয়েছে দ্য স্ট্যাটফোর্ড টী শপ্পে। নামটার মতই অক্ষরও ইংরেজি পুরানো ধাচে লেখা। জানালার ওপাশে দেখা যাচ্ছে কেকের সারি।

ছোট রেস্টুরেন্ট, রবিন বলল।

হ্যাঁ, বলল কিশোর। আর আমরা কারমলের বাড়ি থেকে মাত্র এক ব্লক দূরে রয়েছি। নিশ্চয় এখানে চা খেতে আসত সে।

ভেতরে ঢুকল ছেলেরা। ছোট ছোট একসারি ঘর রয়েছে, নিচু ছাত। একেবারে খাঁটি ইংলিশ টী শপ। স্ট্যান্ডে দাঁড় করানো রয়েছে স্টাফ করা মাছ, দেয়ালে শোভা পাচ্ছে জজানোয়ারের মাথা, রকি বীচের প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি। ছোট ছোট টেবিলগুলোকে ঘিড়ে ভিড় করে বসেছে লোকে, চা কেক খাচ্ছে। এ

ছেলেদের দিকে এগিয়ে এল এক সুন্দরী ওয়েইট্রেস। হেসে জিজ্ঞেস করল কিছু লাগবে কিনা।

কটা কথা জানতে এসেছিলাম, সৌজন্য দেখিয়ে খুব ভদ্রভাবে বলল কিশোর। মিস্টার কারমল কি প্রায়ই আসতেন এখান?

আসতেন। হপ্তায় অন্তত তিন-চার দিন।

যা, আমারও তাই ধারণা ছিল। নিশ্চয় নির্দিষ্ট একটা মগে চা খেতেন। ওটা দেখতে পারি?

মগ? অবাক হল ওয়েইট্রেস। কোন মগ তো ছিল না। তাছাড়া মগ ব্যবহার করি না আমরা, কাপে চা দিই…

ছিল না? তাহলে…তাহলে…

রবিন বলল, এখানে কখন আসতেন তিনি, কি কি করতেন, কি খেতেন বলতে পারবেন?

নিশ্চয় পারব। বিকেলের দিকেই আসতেন, ঠিক এই সময়। দুতিন কাপ ওললাং আর একটা নরম রোল খেয়ে চলে যেতেন।

ওলোংটা কি জিনিস? মুসা জানতে চাইল।

চীনা চা। ভাল তৈরি হয় আমাদের এখানে, লোকে খায়ও প্রচুর।

মিস্টার কারমল কোন নির্দিষ্ট চেয়ারে বসতেন? রবিন জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ, এসেই ছয় নাম্বার টেবিলটার খোঁজ করতেন। ওটা খালি না থাকলে অন্য টেবিলে বসতেন।

টেবিলটা দেখতে পারি? কিশোর বলল।

তা পার। খালিই আছে এখন।

ওয়েইট্রেসের পিছু পিছু কোণের একটা টেবিলের কাছে চলে এল ছেলেরা। টেবিলের পাশে দেয়ালে বসানো একটা দানবীয় তলোয়ার মাহ৷ চেয়ারে বসল মুসা। খাইছে! এখানে বসে উল্টোদিকের দেয়াল ছাড়া তো আর কিছুই দেখা যায় না।

রবিন বসল আরেকটা চেয়ারে। শুধু সামনের দেয়াল দেখা যায়, কিশোর। একটা হরিণের মাথা, বড় একটা আয়না আর গোটা দুই ছবি, ব্যস। মগটগ নেই।

কিশোর, প্রায় চিৎকার করে উঠল মুসা। হরিণটার নাক আছে! পরের ধাঁধায় নাকের কথা বলা হয়েছে না?

নকল বের করে পড়ল কিশোর, ওয়ান ম্যানস ভিকটিম ইজ অ্যানাদারস ডারলিন, ফলো দ্য নোজ টু দ্য প্রেস। মানে হল, একজনের শিকার আরেকজনের প্রিয়, নাক অনুসরণ করে জায়গামত যাও। বেশ। হরিণটা অবশ্যই একজনের শিকার। হরিণ ইংরেজি ডিয়ার, প্রিয় ইংরেজিও ডিয়ার, দুটো শব্দের বানান আলাদা হলেও উচ্চারণ এক। প্রিয়, অর্থাৎ ডিয়ারের প্রতিশব্দ ডারলিং। আবার ডারলিংকে অনেকে উচ্চারণ করে ডারলিন।

করে, রবিন বলল। কিন্তু হরিণের নাক তো এই টেবিল ছাড়া আর কোনদিকে নির্দেশ করছে না।

আশা ছাড়তে পারল না কিশোর। ওই ছবিগুলোতে কিছু নেই তো?

এগিয়ে গিয়ে দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলো কাছে থেকে দেখল তিনজনে। একটাতে রয়েছে রকি বীচের একটা হোটেল, যেটা বহু বছর আগেই ভেঙে ফেলা হয়েছে। আরেকটাতে আগের বছরের ফিয়েস্টা ডেপরেডের দৃশ্য।

টেবিলে কিছু লুকানো নেই তো? রবিন বলল।

টেবিলের ওপরে নিচে তন্ন তন্ন করে দেখা হল। কিছু পাওয়া গেল না। ঘড়ি দেখল ওয়েইট্রেস। দেখ, এখন আমরা খুব ব্যস্ত।

বেরিয়ে যেতে বলা হচ্ছে, বুঝল ছেলেরা। খুবই নিরাশ হয়ে বেরিয়ে এল চা দোকান থেকে। দেরি হয়ে গেছে অনেক, ডিনারের সময় প্রায় হয়ে এসেছে।

ক্ষুধায় মারা যাচ্ছি, ঘোষণা করল মুসা। অযথা এসব খেখুজি বাদ দিয়ে চ বাড়ি চলে যাই। সাইকেলগুলোও নিতে হবে।…

হ্যাঁ, তাই চলে, এভাবে বিফল হয়ে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। তবে চলো আগে এলসার সঙ্গে দেখা করে যাই। চা দোকানের ব্যাপারে হয়ত কোন তথ্য দিতে পারবে।

জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছেলেদের কথা শুনল এলসা। কি জানি। ওই দোকানের কথা আমি কিছু জানি না।

ওলোঙের কোন বিশেষ মানে হয়? রবিন জানতে চাইল।

কি? অন্যমনস্ক মনে হল এলসাকে। আঁ…আসলে কোন কথায়ই মন দিতে পারছি না। সেই দুপুরের পর থেকে আর নরির খবর নেই।…কি যেন বলছিলে, ওললাং? এক জাতের চা, কারমলের খুব প্রিয় ছিল…ওফ, বাঁচা গেল! ওই যে নরি আসছে, সঙ্গে রস!

তাড়াতাড়ি দরজার দিকে এগোল এলসা। ঘরে ঢুকল নরি আর উড। বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ছেলেটাকে।

এদিকেই আসছিলাম, উড জানাল। শপিং সেন্টারে ঘুরঘুর করতে দেখলাম ওকে।

ভুরু কেঁচকাল মুসা। নিশ্চয় আবার আমাদের পিছু নিয়েছিল। রাস্তার ইটকেও বিশ্বাস কোরো না তোমরা চেঁচিয়ে উঠল নরি। আমি…

কর, নরি! ধমক দিল এলসা। সকালেই তোমাকে মানা করেছি, একা। একা বাড়ি থেকে না বেরোতে।

থাক, হয়েছে, হাত তুলল উড। ছেলেরা, এবার বল তো কতখানি এগোলে।

ঘরের ভেতরে পায়চারি করতে করতে ছেলেদের কথা শুনল সে। বলল, চা। দোকানে মগ নেই, তোমরা শিওর?।

শিওর, কিশোর বলল। তার ঘরে নেই তো?

থমকে দাঁড়াল উড। তারপর কি মনে করে ছুটল কারমলের ঘরের দিকে। পিছু নিল অন্যেরা। ধুলোয় ঢাকা ঘরটায় গরুখোঁজা করা হল। মগ একটা পাওয়া গেল বটে, ধূসর রঙের সাধারণ মগ, কোন চিহ্নটিহ্ন নেই।

নাহ, এটা না, মাথা নাড়ল কিশোর।

মগটা রাগ করে ছুঁড়ে ফেলে দিল উড। ইস, এগোনোই যাচ্ছে না, মুঠো করে ফেলল হাত। অথচ তাড়াতাড়ি করা দরকার। এজটাররা আর ডয়েলদের ওই ছেলেটা যেভাবে উঠে পড়ে লেগেছে, আমাদের আগেই না পেয়ে যায়!

মা, নরি বলল, দাদা…।

তাকে থামিয়ে দিল তার মা। তোমার গোসলের সময় হয়েছে। যাও।

তার কথা শুনল না দেখে রাগ করে দুপদাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল নরি।

ধুলোয় ঢাকা ঘরটাতেই পায়চারি শুরু করল আবার উকিল। মাগ-এর সঙ্গে  ছন্দ মেলে এরকম আর কি কি শব্দ আছে?

চা দোকানে ওরকম তো কিছু চোখে পড়ল না, কিশোর বলল। মাগের সঙ্গে মেলে বাগ, হাগ, লাগ, রাগ…

কি হয়, সেটা তুমি মিলিয়ে নিয়ো, আচমকা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল উডের কণ্ঠ। জলদি সমাধানের চেষ্টা কর। নইলে অন্য গোয়েন্দা ভাড়া করতে হবে আমাকে।

মনমরা হয়ে কারমলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। বাস ধরে ডিপোতে ফিরে যেতে হবে। স্টপেজের দিকে এগোতে এগোতে চমকে উঠল রবিন। এই, দেখ, সেই গাড়িটা!

পরিচিত নীল গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে পথের ধারে। পেছনে গাছের ছায়ায় নড়ছে দানবীয় ছায়া।

এই নিয়ে তিনবার দেখা হল, ফিসফিস করে বলল কিশোর। আর কাকতালীয় বলা যাবে না। নিশ্চয় আমাদের ওপর নজর রাখছে, কিংবা…

কিশোর,মুসা বলল, আরেকজন!

হোট আরেকটা ছায়ামূর্তি যোগ দিল বড়টার সঙ্গে।

চলো, শুনি, ওরা কি বলে, কিশোর বলল। এমন ভাব দেখাবে, কিছু দেখিনি আমরা। খানিক দূর গিয়ে ঘুরে আবার ফিরে আসব।

খানিক দূর এগিয়ে, রাস্তা থেকে নেমে গাছপালার ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা। ঘুরে ফিরে এল গাড়িটার কাছাকাছি। আস্তে মাথা তুলল মুসা। ফিসফিসিয়ে বলল, দৈত্যটা আবার একা হয়ে গেছে।

পেছনে মট করে একটা কুটো ভাঙল। ঝট করে মাথা ঘোরাল ছেলেরা। জ্বলন্ত চোখে তাদের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে হালকা-পাতলা একজন মানুষ। টুপির কানা সামনের দিকে নামানো। কালো জ্যাকেটের বুক খোলা। ভেতরে হোলস্টারে পিস্তল দেখা যাচ্ছে। কঠিন গলায় ধমক দিল, এখানে কি?

আরেক ধার থেকে উদয় হল দৈত্যটা। ছয় ফুট নয় ইঞ্চির কম হবে না লম্বায়, ভোতা নাক, ছড়ানো বড় বড় কান, অস্বাভাবিক লম্বা হাত।

আমাদের ওপর চোখ রাখছিলেন কেন? বেপরোয়া হয়ে গেল মুসা। কে বলল চোখ রাখছি? কর্কশ কন্ঠে বলল পাতলা লোকটা।

তাহলে কি করছেন? পাল্টা প্রশ্ন করল রবিন।

নিজের চরকায় তেল দাও গিয়ে, থোকা। যাও, ভাগ।

এত সহজে ছাড়া পাবে ভাবেনি ছেলেরা, দৌড় দিল গাছপালার ভেতর দিয়ে। বাস আসার শব্দ শুনল। স্টপেজে এসে বাসটা ধরল ওরা। শহরমুখো অর্ধেক রাস্তা যাবার আগে কথা বেরোল না কারও মুখ দিয়ে।

রবিন বলল, লোকগুলো কে?

কি জানি, হাত নাড়ল কিশোর। ছোটটার কাছে তো পিস্তল দেখলাম। গোয়েন্দা হতে পারে। চোর-ডাকাতও হতে পারে।

গোয়েন্দা? এজটাররা ভাড়া করেনি তো?

করতে পারে! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখন সী আওয়ার হ্যাণ্ডসাম মাগের মানে বের করতে হবে আমাদের।

গুঙিয়ে উঠল মুসা। মাগের সঙ্গে থাগ, অর্থাৎ ঠগেরও ছন্দ মেলে। ওই দৈত্যের মত ঠগের কাছাকাছি মগ খুঁজতে গিয়ে আর বিপদে পড়তে চাই না।

১৪

বাবা, মাগ মানে কি? জিজ্ঞেস করল মুসা।

পরদিন সকালে, খবরের কাগজ পড়ছিলেন মিস্টার আমান। কাগজটা নামিয়ে বললেন, মাগ মানে মগ। কাগজ আবার তুলতে তুলতে বললেন, অবশ্য যদি সেকেণ্ড-রেট কোন লোকের কথা না বল…

মানে?

রাস্তায় ধরে পথিককে পিটিয়ে যে জিনিসপত্র কেড়ে নেয় তাকেও বলে মাগ।

নাহ।

মাগ শট বলে-আরেকটা শব্দ আছে, বললেন তিনি। পুলিশের ভোলা ছবি, চোর-ডাকাতের ক্লোজ আপ তাছাড়া আয়না…

মাগ শট? আয়না! চোখ বড় বড় হয়ে গেল গোয়েন্দা সহকারীর। সজোরে চাপড় মারল উরুতে। তাই হবে!

কি হবে? কাগজের ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার আমান। জবাব না পেয়ে কাগজ নামিয়ে দেখলেন, রিসিভার তুলে ততক্ষণে ডায়াল শুরু করে দিয়েছে মুসা।

হেডকোয়ার্টারে কিশোরকে পেল না মুসা। ঘরে রয়েছে গোয়েন্দাপ্রধান। তাকে ওখানে ধরল সে। চেঁচিয়ে বলল, সুখবর আছে! রবিনকে আসতে বল!

রিসিভার নামিয়ে দরজার দিকে দৌড় দিল মুসা।

কয়েক মিনিট পর হেডকোয়ার্টারে ঢুকে দেখল, কিশোর বসে আছে। রবিন এসে পৌঁছায়নি।

এসে যাবে, কিশোর বলল। তা কি সুখবর?

সী আওয়ার হাওসাম মাগ অ্যাহেড-এর জবাব, হেসে নাটকীয় ভঙ্গিতে চেয়ারে হেলান দিল মুসা। জানি এখন।

কী?

মুসা জবাব দেয়ার আগেই টেলিফোন বাজল। রিসিভার তুলে নিল কিশোর। এলসা করেছে। নরি আবার হারিয়েছে, বলল উল্কণ্ঠিত মা। আজ সকালে উঠে বলল, মাগের মানে জানে। আমার মনে হয় চায়ের দোকানটাতে গিয়েছে সে। অনেকক্ষণ হল, এখনও ফিরছে না, ভয় লাগছে আমার। বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করছে কিছু আজব লোক। এজটারদের গাড়ি দেখেছি বলেও মনে হল।

আজব মানুষগুলোর একজন কি দৈত্য?

হ্যাঁ। আগেও দেখেছি তাকে। রসকে ফোন করেছিলাম, পাইনি।

এক্ষনি শপিং সেন্টারে যাচ্ছি আমরা, কথা দিল কিশোর। আগের মানে কি, বলেছে কিছু নরি?

না। প্লীজ, তাড়াতাড়ি কর, কিশোর।

করবে, বলে রিসিভারও রাখল কিশোর, রবিনও ঢুকল ট্রেলারে। কি হয়েছে জানানো হল তাকে। গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর, নরির যদি কিছু ঘটে যায়, তাহলে কারমলের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে যাবে এজটাররা।

কিন্তু মুসা কি যেন জানাবে বললে? রবিন জিজ্ঞেস করল।

সেটার দিকেই তো তাকিয়ে আছি এখন, হেসে বলল মুসা।

কোথায়? চারপাশে খুঁজল রবিন, কিশোরও খুঁজছে।

তোমাদের দুজনের সামনেই!

ভ্রূকুটি করল গোয়েন্দাপ্রধান। ঠাট্টার সময় নয় এটা, সেকেণ্ড।

কই, রবিন বলল, শুধু তো দেখছি ডেস্ক, দেয়াল, পুরানো আয়না, শেকসপীয়ারের মূর্তি…

বুঝেছি! নাকমুখ এমনভাবে কুঁচকে ফেলল কিশোর, যেন নিমের তেতো খেয়েছে। কেউ তার ওপর টেক্কা দিক এটা সইতে পারে না সে। আওয়ার হ্যাণ্ডসাম মাগ। কারমলের আরেকটা শয়তানী।

কই? আবার বলল রবিন। দেখছি না তো কিছু।

আয়না, রবিন, কিশোর বলল। আমরা আমাদের চেহারা দেখতে পাচ্ছি। মাগ হল চেহারার স্ল্যাং। চা দোকানের দেয়ালেও একটা বড় আয়না লাগানো আছে। সী আওয়ার হ্যান্ডসাম মাগ অ্যাহেড বলে আয়নার ভেতর দেখতে বলা হয়েছে।

চলো, জলদি, মুসা তাগাদা দিল।

ট্রেলার থেকে বেরিয়ে সাইকেলে চাপল ওরা। রওনা হল কারমলের প্রিয় চায়ের দোকানে। পৌঁছে দেখল ভোলাই আছে, তবে ভিড় কম, অল্প কয়েকজন। খরিদ্দার, দুপুরের আগে বাড়বে না। নরি নেই ওখানে। আগের দিনের ওয়েটসকেও দেখতে পেল ওরা। প্রশ্নের জবাবে বলল, যা, ওই বয়েসের একটা ছেলেকে দেখেছি। ঘন্টাখানেক আগে এসে বসেছিল ছয় নাম্বার টেবিলে, কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে গেছে।

আর কাউকে দেখেছেন? কিশোর জিজ্ঞেস করল।

মোটা এক লোক, আর রোগাটে এক মহিলা। ছেলেটা আসার আগে এসেছিল, মিস্টার কারমলের কথা জিজ্ঞেস করল, আমি বললাম ছয় নাম্বার টেবিলে বসতে। ওরাও বসল। তবে ছেলেটার মত সন্তুষ্ট মনে হয়নি ওদেরকে।

থ্যাঙ্ক ইউ, মিস, বলে বন্ধুদের দিকে ঘুরল কিশোর।

কি মনে হয়, এজটাররা নরিকে ধরে নিয়ে গেছে? রবিন বলল।

তার পিছুও নিয়ে থাকতে পারে।

মাগের জবাব নিশ্চয় পেয়ে গেছে নরি, নইলে সন্তুষ্ট মনে হত না, মুসা বলল। তাকে খুঁজে বের করতে হলে এখন তাড়াতাড়ি পরের ধাঁধাটার জবাব জানতে হবে আমাদের।

ছয় নাম্বার টেবিলের পাশে গিয়ে বসল কিশোর। আয়নার ভেতরে তাকাল। তার কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিল মুসা আর রবিন।

নিজের চেহারা দেখতে পাচ্ছি, কিশোর বলল। আর, টেবিল, তলোয়ার মাছ, দেয়ালে ঝোলানো পুরানো একটা খাদ্য তালিকা, দুটো ছবি…এই তো।

পরের ধাঁধাটা পড়ে দেখ, কিশোর, পরামর্শ দিল রবিন।

নকলটা বের করে পড়ল কিশোর, ওয়ান ম্যানস ভিকটিম ইজ অ্যানাদারস ডারলিন, ফলো দ্য নোজ টু দ্য প্রেস।

রবিন বলল, বিশেষ কোন চেহারার কথা বোঝায়নি কারমল। সে জানত না কখন কোন মুখটা উঁকি দেবে আয়নার ভেতর।

মুসা বলল, ছবি দুটোও বন্দরের। শিকার কিংবা প্রিয় কিছুই নেই ওগুলোতে। আর নাকও তো আমাদের তিনটে ছাড়া আর কারও দেখছি না।

পুরানো খাদ্য তালিকাটার ব্যাপারে কি মনে হয়? রবিনের প্রশ্ন।

না, জোরে জোরে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। মনে হয় বুঝতে পারছি। শিওর হওয়া দরকার। এস।

ওয়েট্রেসের কাছে গিয়ে পাবলিক টেলিফোন কোথায় জিজ্ঞেস করল কিশোর।

আমাদের এখানে নেই, ওয়েট্রেস বলল। রাস্তার ওপারে পেট্রল পাম্পটায় গিয়ে দেখতে পার।

পেট্রল পাম্পটা বন্ধ। তবে বুদটা দেখা গেল, বাইরে। ডিরেক্টরিতে ড্যাম সানের নাম্বার খুঁজে বের করে তাকে ফোন করল।

আবার তুমি, খসখসে কণ্ঠে বলল বুড়ো।

স্যার, নরম গলায় বলল কিশোর। আপনি বলেছেন, মিস্টার কারমলের সব স্ল্যাঙের মানে আপনি জানেন না। কিন্তু আমি যদি ব্ল্যাঙের শব্দটা কি হবে আপনাকে বলে দিই, কি শব্দ দিয়ে সেটা বোঝানো হয় তা তো বলতে পারবেন?

মানে?

মানে মারলিন বলে ডারলিন বোঝানো হয়। কিন্তু উল্টোটা বলেছেন মিস্টার কারমল। ডারিন বলেছেন মারলিন বুঝে নেয়ার জন্য। রাইমিং স্ল্যাং যদিও হয় না এটা,তাই না?

ফিকফিক করে হাসল বুড়ো। তুমিও তাহলে বুঝে ফেলেছ। চালাক ছেলে।

আমিও মানে! সতর্ক হয়ে গেল কিশোর। আরও কেউ বুঝেছে নাকি?

হ্যাঁ, কারমলের নাতি। খুব চালাক। দাদার চেয়ে কম ধড়িবাজ না।

বুড়োকে ধন্যবাদ দিয়ে রিসিভার রেখে দিল কিশোর। ফিরে চলল চায়ের দোকানে। সঙ্গে চলল দুই সহকারী।

মারলিন মানে কি, কিশোর? মুসা বলল।

বড় জাতের মাছ, তলোয়ার মাছেরই প্রজাতি।

খাইছে! নাক আছে নাকি ওগুলোর?

আবার চায়ের দোকানে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। সোজা এগিয়ে গেল দেয়ালের মাছটার কাছে। কিছুটা অবাক হয়েই ওদের দিকে তাকিয়ে রইল ওয়েইট্রেস।

মাছের নাক একটা ছুবির দিকে, রবিন বলল।

সামনের দেয়ালে ঝোলানো ফ্রেমে বাঁধাই ছবিটার কাছে এসে দাঁড়াল ওরা।

আরি, মুসা বলল, রকি বীচ টাউন হলের ছবি দেখি।

ফলো দ্য নোজ টু দ্য প্লেস, বিড়বিড় করল কিশোর। নাক অনুসরণ করে ওই জায়গা, মানে ওই টাউন হলে যেতে বলছে!

হোয়্যার, বুঝে ফেলল রবিন, মেন বাই দেয়ার ট্রাবল অ্যাণ্ড স্ট্রাইফ। দ্য ম্যারিজ লাইসেন্স ব্যুরো। বিয়ের ব্যাপার-স্যাপার। বাই বলেছে সে-কারণেই।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। নরি নিশ্চয় ওখানে চলে গেছে। ওর মাকে জানানো দরকার।

আবার পেট্রল পাম্পে এল ফোন করার জন্যে। ডায়াল করছে কিশোর, হঠাৎ কান খাড়া করে ফেলল মুসা। এই শোন শোন! শুনছ?

ডায়াল থামিয়ে কিশোরও কান পাতল। তিনজনেই শুনতে পেল বিচিত্র শব্দ। ধাতব কিছুর ওপর দিয়ে হিঁচড়ে নেয়া হচ্ছে ভারি কিছু।

কী…? বুঝতে পারছে না মুসা।

ওই ঘরের ভেতরে, পেট্রল পাম্পের অফিসটা দেখাল রবিন।

অফিসের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে আছে তিনজনে। এই সময় শোনা গেল চাপা মৃদু চিত্তার, বাঁচাও! বাঁচাও!

১৫

বন্ধ ঘরের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল মুসা। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

বাঁচাও, বাঁচাও! শোনা গেল আবার।

অফিসের পেছন থেকে আসছে! বলে উঠল রবিন।

পেছনে তিনটে পার্ক করা কার আর একটা ভ্যান দেখা গেল। আবার শোনা গেল হিচড়ানোর আওয়াজ।

মনে হচ্ছে ভ্যানের ভেতরে, মুসা অনুমান করল।

বাঁচাও! শোনা গেল আবার চাপা চিৎকার। নরি! কিশোর বলল। ভ্যানটা খুলতে হবে!

দরজায় তালা নেই। টেনে খুলতেই দেখা গেল, মেকানিকরা মাটিতে যে ক্যানভাস বিছিয়ে কাজ করে, তার একটা বড় বাণ্ডিল। নড়ে উঠল বাণ্ডিলটা, ভ্যানের ছাত থেকে ঝুলে থাকা ভারি একটা পুলিতে বাড়ি লাগল, ওটা ঘষা লাগল ধাতব দেয়ালে। হিচড়ানোর মত আওয়াজ করছে ওটাই।

ক্যানভাসের বাণ্ডিল নিয়ে টানাটানি শুরু করল ছেলেরা। ভেতর থেকে বেরোল নরি। হাত-পা বাঁধা। বাঁধনমুক্ত হয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে কন্সল সে, চেহারা ফ্যাকাসে। তবে সাহস হারায়নি।

কি হয়েছিল, নরি? রবিন জিজ্ঞেস করল।

আমার মনে পড়ে গিয়েছিল, দাদা বলত, কিছু লোকের মাগ কুৎসিত, আর কিছু লোকের সুন্দর। আয়নার কথা আন্দাজ করলাম, গর্বের সঙ্গে বলল নরি। মাছটা দেখলাম, বুঝলাম মারলিনের কথা বলেছে। কারণ, প্রায়ই ওই মাছের গল্প করত সে। দেখলাম, ওটার নাক একটা ছবির দিকে। টাউন হলের ছবি। মিস্টার সানকে ফোন করে জেনে নিলাম আমার অনুমান ঠিক কিনা। আমিও রিসিভার রাখলাম, এই সময় পেছন থেকে হঠাৎ আমার মাথায় একটা ব্যাগ ঢুকিয়ে দিল লোকটা। চেহারা দেখিনি। তারপর হাত-পা বেঁধে গাড়িতে ফেলে রেখে চলে গেল। তোমাদের সাড়া পেয়েই চেঁচাতে শুরু করলাম।

ভাল করেছ,মুসা বলল।

এজারদের আর টেরিকে ঘুরঘুর করতে দেখেছি শপিং সেন্টারে। বোধহয় ফোনে বেশি জোরে কথা বলে ফেলেছিলাম, ওরা পেছন থেকে শুনেছে আমার কথা। এত কষ্ট সব মাঠে মারা গেল আমার,হতাশ দেখাল নরিকে।

ধাঁধার চমৎকার সমাধান করেছ, তুমি, প্রশংসা করল কিশোর। আর খুব সাহস তোমার। ভুল আমরা সবাই করি, বুঝলে। এতে এত দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। তবে ভবিষ্যতে আরও হুঁশিয়ার হয়ে কাজ করবে।

এখন তো তাহলে তোমাদের সঙ্গে কাজ করতে পারি? অনুরোধ করল নরি। প্লীজ! তোমাদের সব কথা মেনে চলব। যা করতে বলবে তাই করব। বিপদে ফেলব না।

কিন্তু…

অসুবিধে কি? মুসা বলল। ছেলেটা প্রমাণ করে দিয়েছে, তার সাহস আছে। তাছাড়া বুদ্ধিও কম নয়, একটা ধাঁধার সমাধান তো আমাদের আগেই করে ফেলল।

নেয়া যায়, রবিনও নরির পক্ষ নিল।

বেশ, অবশেষে রাজি হল কিশোর। নিতে পারি, যদি তোমার মা অনুমতি দেন।

নরি ভাল আছে শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল তার মা। কিন্তু কিশোর যখন বলল, ছেলেকে সঙ্গে নেবে কিনা, দ্বিধা করল এলসা।

বুদ্ধিশুদ্ধি বেশ ভালই আছে আপনার ছেলের, কিশোর বলল। তাছাড়া বাড়িতে রেখেও নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন না। যখন তখন আপনাকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে বরং বিপদেই পড়ছে।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। ঠিক আছে। যাক। তবে ওর ওপর কড়া নজর রাখবে, প্লীজ।

সুখবরটা নরিকে শোনাল কিশোর।

চায়ের দোকানের কাছে পার্ক করে রাখা সাইকেলগুলো নিয়ে রকি বীচে চলল ওরা। রোববারের জনবিরল পথ। কোর্টহাউস আর টাউনহলের কাছে লোকজন বিশেষ নেই, দুচারজনকে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেল। রোববারে বিক্রি বন্ধ, কিন্তু তবু টুরিস্ট আকর্ষণের জন্যে দোকানপাটগুলো খুলে রাখা হয়েছে।

ম্যারিজ লাইসেন্স ব্যুরোর ছোট ঘরটা টাউন হলের দোতলায়, বাঁয়ে, পেছনে একেবারে শেষ মাথায়। শূন্য ঘরটায় ঢুকল ছেলেরা। নকল বের করে পড়ল কিশোর, হোয়্যার মেন বাই দেয়ার ট্রাবল অ্যাণ্ড স্ট্রাইফ, গেট আউট ইফ ইউ ক্যান।

নীরব ঘরটায় চোখ বোলাল ওরা। ডানে বিজনেস উইনডোগুলো বন্ধ। বাঁয়ে দেয়ালের সমান্তরালে লম্বা উঁচু একটা রাইটিং কাউন্টার। সামনের দিকে গরাদওয়ালা দুটো জানালার নিচে একটা কাঠের বেঞ্চ। নানারকম নোটিশ, আর গভর্নর এবং মেয়রের ছবি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে দেয়ালে।

এখানেই তাহলে স্ত্রী কেনে লোকে, মুসা বলল। মানে বিয়ের লাইসেন্স জোগাড় করে। কথা হল, গেট আউট ইফ ইউ ক্যান দিয়ে কি বুঝিয়েছে?

আবার উল্টো কথা বলেনি তো? রবিন বলল।

বোঝা যাবে, কিশোর বলল। আগে পরের ধাঁধাটা পড়ে দেখি কিছু বোঝা যায় কিনা। ইন দ্য পশ কুইনস ও নেড, বি ব্রাইট অ্যাণ্ড নেচারাল, অ্যাণ্ড দ্য প্রাইজ ইজ ইওরস। এ-ঘরের কোন জিনিস হয়ত কোন রানী কিংবা বিছানা দেখাবে আমাদের।

কোথায়? নরি বলল।.ওরকম কিছু তো দেখছি না।

না, ধীরে ধীরে বলল কিশোর, পশ কুইনস ও নেড এঘরে থাকবেই এমন কোন কথা নেই। গেট আউট ইফ ইউ ক্যান দিয়ে কি বোঝায়, বোঝার চেষ্টা করে দেখি। গেট আউটের মানে এসকেপ বা পালানো হয়।

তবে কি ফায়ার এসকেপ? কিন্তু ঘরটা দোতলায়। কাছাকাছি কোন ফায়ার এসকেপ নেই। এসকেপ যদি হয় তাহলে তো রাইম হল না, রবিন বলল।

হলে নেই, মানে হলেই হল, বলল মুসা। জানালা? ওটা দিয়েও পালানো যায়। তবে এখানকারগুলো দিয়ে বেরোনো খুব মুশকিল।

তবু জানালার কাছে এসে বাইরে তাকাল ওরা। বাড়ন্ত ঝোপ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না।

ক্যান-এর সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে শব্দ বল তো,কিশোর বলল।

ব্যান, ফ্যান, ম্যান, প্যান, র‍্যান, ট্যান, গড়গড় করে বলে গেল রবিন।

এই, দেয়ালটা ট্যান কালারের, নরি বলল।

তাতে কোন সুবিধে হচ্ছে না ধাঁধা সমাধানের, বলল কিশোর। তবে এখানে। ম্যান আছে, দুজন, গর্ভনর আর মেয়র।

নোটিশে কোন ব্যান-এর ঘোবণা নেই তো? রবিনের প্রশ্ন।

নোটিশগুলো পড়তে ছুটল সবাই। বেশ কিছু নতুন নিয়ম জারি করা হয়েছে, নিষিদ্ধ করা হয়েছে কিছু কিছু ব্যাপার, তবে ওগুলো থেকে ধাঁধার সমাধান হবে না।

অবশেষে কিশোর ঘোষণা করল, আমার মনে হয় না এটা রাইমিং স্ন্যাং।

কারমলের আরেক শয়তানী বুদ্ধি! গো গোঁ করে বলল মুসা।

এখান থেকে বেরোনোর কথাই বলা হয়েছে মনে হয়।

কিভাবে? জিজ্ঞেস করল রবিন। জানালা আটকানো। ফায়ার এসকেপ  নেই। দরজা মাত্র একটা, যেটা দিয়ে ঢুকলাম। তাতে স্পেশাল কিছু নেই।

এই দেখ!দরজার কাছের মেঝে দেখিয়ে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল কিশোর। মেঝে কেমন ক্ষয়ে গিয়েছে দেখছ লোক যাতায়াতের ফলে?

শ্রাগ করল রবিন। তাতে কি? এটা স্বাভাবিক।

কিন্তু বেঞ্চের কাছের মেঝে দেখ।

সবাই দেখল। ক্ষয়া একটা সরু পথ যেন গিয়ে ঠেকেছে পাশের দেয়ালে।

গোপন দরজা! একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল রবিন আর মুসা।

দেয়ালের কাছে দৌড়ে এল ছেলেরা। খুঁজতে শুরু করল। কিন্তু দেয়ালের অন্যান্য জায়গার মতই এখানেও মসৃণ, প্লাস্টারের ওপর রঙ করা, সামান্যতম চিড় ধরেনি কোথাও। আশা আবার নিভে গেল ওদের।

শূন্য দেয়াল, কেঁদে ফেলবে যেন রবিন, আর কিছু নেই!

আরও ভালমত দেখে মুসা বলল, মনে হয় দরজা-টরজা ছিল এককালে। রঙ দেখ। আশেপাশের দেয়ালের চেয়ে হালকা। নিশ্চয় গত দুতিন মাসের মধ্যে বন্ধ করা হয়েছে দরজাটা, কিংবা এখানে নতুন করে রঙ লাগানো হয়েছে। এখানে দরজা থাকলে বেরোনো মোটেই কঠিন হত না।

দেয়াল গেঁথে বোজানো হয়েছে? বিড়বিড় করল কিশোর। মুসার দিকে তাকিয়ে চোখ মিটমিট করতে করতে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, বাইরের রাস্তাটা কোন রাস্তা? এটা দিয়ে বেরোলে যেটাতে পড়া যাবে?

রাস্তা? অবাক হল রবিন। কেন স্যালসিপুয়েডস স্ট্রীট, তাই তো হবার কথা। কিন্তু…

কথা শেষ হল না তার। ঝড়ের গতিতে খোলা দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। কিশোর।

১৬

সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে ঘুরে টাউন হলের একপাশে চলে এল কিশোর। পেছনে ছুটছে তার সহকারীরা। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে সবাই, চোখ উজ্জ্বল। থমকে দাঁড়াল গোয়েন্দাপ্রধান। দেয়ালে একটা খিলানমত দেখা গেল, দরজা ছিল এককালে বোঝা যায়, ম্যারিজ লাইসেন্স ব্যুরো থেকে বেরোনোর।

কি করব এখন, কিশোর? হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল মুসা।

দরজার ইট নতুন, আনমনে বুলল কিশোর। তারমানে মুসার কথাই ঠিক,, কয়েক মাস আগে বন্ধ হয়েছে। তারমানে কয়েক মাস আগে এলেও ওই পথে আমরা বেরোতে পারতাম। বোঝা যাচ্ছে, কারমল যখন শেষ দেখেছে এই দরজাটা, তখনও এটা ভোলা ছিল।

কিন্তু,নরি বলল, ধাঁধার সঙ্গে মিলটা কোথায়? স্যালিসপুয়েডস…

কিশোর! বড় বড় হয়ে গেল রবিনের চোখ। স্যালিসপুয়েডস স্প্যানিশ শব্দ, মনে পড়েছে। এর ইংরেজি মানে করলে দাঁড়ায়ঃ গেট আউট ইউ ক্যান!

তারমানে স্যালিসপুয়েডস স্ট্রীটে বেরিয়ে পশ কুইনস ওন্ড নেডের খোঁজ করতে বলছে, কিশোর বলল।

বন্ধ করে দেয়া দরজার আশেপাশে ঘন ঝোপঝাড় জন্মে আছে। বিল্ডিঙের পেছনে গাছও আছে বেশ কিছু। সরু একটা পথ দরজার গোড়া থেকে লন পেবিয়ে গিয়ে উঠেছে স্যালিসপুয়েডস স্ত্রীটে। বন্ধ করে দেয়া দরজাটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ছেলেরা, কোন গোপন সূত্র লুকিয়ে রেখেছে কিনা বোঝার চেষ্টা করল। কিছু না পেয়ে, সরু পথ ধরে দ্রুত পা চালাল বড় রাস্তার দিকে।

খোলা জায়গায়, দুপুরের রোদে বেরিয়ে থমকে দাঁড়াল ওরা। ঠিক ওপাশেই চেম্বার অভ কমার্সের অফিস। ডিসপ্লে উইণ্ডোতে বড় বড় অক্ষরে লেখাঃ

সী আ লিজেণ্ড অভ দ্য সী৷৷
এস, এস, কুইন অভ দ্য সাউথ
ফুললি রিস্টোরড টু
ইটস অরিজিন্যাল গ্লোরি
নাউ ওপেন
স্যুভনির রিফ্রেশমেন্টস
রকি বীচ হারবার হোয়ার্ফ

দ্য কুইন! মানে রানী! টুরিস্টদের জন্যে নতুন আকর্ষণ! মুসা বলল।

তাই? নরি জানতে চাইল।

হ্যাঁ, বলল কিশোর। নিশ্চয় এটা পশ কুইন। আর সমুদ্রগামী জাহাজে বিছানা থাকবেই।

তারমানে এরপর আমাদেরকে যেতে হবে কুইন জাহাজে? মুসা জিজ্ঞেস করল।

বিছানা খোঁজার জন্যে, বলল রবিন।

দাদার জিনিস পেয়ে গেছি! দাদার জিনিস পেয়ে গেছি! হাততালি দিয়ে সুর করে গেয়ে প্রায় নাচতে আরম্ভ করল নরি।

নীরবে দাঁত বের করে হাসল কিশোর। ঘুরে রওনা হল টাউন হলের পার্কিং লটের দিকে, যেখানে ওদের সাইকেলগুলো রেখেছে। থেমে গেল আচমকা যেন হোঁচট খেয়ে।

ঝোপের ভেতর দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে কে যেন। লনে বেরোল। টেরিয়ার ডয়েল!

ধর, ধর ব্যাটাকে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। নিশ্চয় আমাদের কথা শুনে ফেলেছে!

শুঁটকি কোথাকার, শুঁটকি! আজ ভর্তা বানিয়ে খাব! মুসার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে চেঁচিয়ে বলল রবিন।

বিল্ডিং ঘুরে পার্কিং লটে পৌঁছার আগেই টেরিয়ারকে হারিয়ে ফেলল ওরা। যখন পৌঁছল, দেরি হয়ে গেছে। গাড়ি বের করে ফেলেছে টেরিয়ার। গর্জন করতে করতে ওদের দিকে ছুটে এল গাড়িটা। লাফ দিয়ে সরে গেল ওরা। পেছনে তাকিয়ে বুড়ো আঙুল দেখাল শুঁটকি, দাঁত বেরিয়ে পড়েছে হাসিতে।

জলদি! সাইকেল! ছুটতে শুরু করল আবার কিশোর।

কিন্তু…কিন্তু…, চেঁচিয়ে বলল নরি, সাইকেল নিয়ে গাড়ি ধরতে পারব না! জিনিসগুলো নিয়েই যাবে!

এত সহজ না। আগে আসল বিছানাটা খুঁজে বের করতে হবে তো। চলো চলো, জলদি চলো।

আরি, সাইকেল কোথায়! চোখ কপালে উঠে গেল মুসার। বোকা হয়ে পার্কিং লটের দিকে তাকিয়ে রইল ছেলেরা। নিশ্চয় শুঁটকি সরিয়েছে, রবিন বলল। দাঁড়াও, হাত তুলে দেখাল কিশোর, ওই যে।

পার্কিং লটের একপ্রান্তে হালকা ঝোপের মধ্যে ভরে রাখা হয়েছে সাইকেলগুলো। লুকানো যায়নি ভালমত, বেশির ভাগই বেরিয়ে আছে। দৌড় দিল আবার ওরা। এই সময় নরির জুতোর ফিতে গেল খুলে। সঙ্গে সঙ্গে বাঁধতে বসে গেল সে। ঝোপ থেকে সাইকেল বের করে জলদি করার জন্য তাগাদা দিতে লাগল ওকে তিন গোয়েন্দা।

আরে, এই নরি, জলদি কর না, অস্থির হয়ে উঠেছে মুসা। দেরি করলে…

কথা শেষ হল না তার। সামনে এসে দাঁড়াল দুজন লোক। একজন সেই দৈত্য, আরেকজন তার পিত্তলধারী খুদে সঙ্গী।

খপ করে মুসার হাত চেপে ধরল দানবটা। আরেক হাতে কিশোরকে। রবিনকে ধরল খাটো লোকটা। অনেক চেষ্টা করেও তিনজনের একজনও ছুটতে পারল না। একটা গাড়ির দিকে তিন গোয়েন্দাকে টেনে নিয়ে চলল লোকগুলো।

ঝোপের কাছে সাইকেল সরিয়ে আনার কারণটা এতক্ষণে বুঝতে পারল ছেলেরা। ওদেরকে ধরার জন্যে।

১৭

চুপচাপ থাক, তাহলে জখম হবে না, ড্রাইভারের সিট থেকে বলল খাটো লোকটা।

পেছনের সিটে গাদাগাদি করে বসেছে চারজনে, দৈত্যটার একপাশে মুসা, আরেক পাশে রবিন আর কিশোর। পেছনের জানালার পর্দা টেনে দেয়া হয়েছে।

আরেকটা ছেলে কোথায়, মিস্টার হিউগ? দানবটা জিজ্ঞেস করল।

পার্টি তো বলল শুধু এই তিনজনের কথাই, খাটো লোকটা জবাব দিল। এদেরকে চুপ করিয়ে রাখ, বিগ, অন্য কাউকে নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। আরও ছেলে থাকলে থাকুক গে।

ঠিক আছে, বিগ জবাব দিল।

চুপ করে রইল ছেলেরা। গাড়ি চালাচ্ছে হিউগ, খুব সাবধানে, গতি বাড়াচ্ছে, অযথা পুলিশের চোখে পড়ার ইচ্ছে নেই। রকি বীচের অলিতে গলিতে ঘুরছে। গাড়ি। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে ছেলেরা, ভয় কাটছে। ওদেরকে মারার জন্যে ধরেনি হিউগ আর বিগ, এটা বুঝে গেছে। অবশেষে জিজ্ঞেসই করে ফেলল কিশোর, আমাদের ধরেছেন কেন?

হেসে উঠল হিউগ। এমনি।

না, জানতে চাইছি, কার হুকুমে ধরেছেন?

সেটা কেন বলব? একজন বন্ধুকে সাহায্য করছি, ব্যস।

বিগ বলে উঠল, ঠিক পথেই তো যাচ্ছিলেন, মিস্টার হিউগ, আবার ঘুরছেন…

চুপ, ধমক লাগাল খাটো।  আবার নীরবতা। কয়েকটা বুক পেরোল গাড়ি। তারপর রকি বীচের পশ্চিম অংশের একটা বাড়ির ড্রাইভওয়েতে ঢুকল। বেশ বড় একটা বাড়ির পেছনের ছোট একটা কটেজের সামনে এসে থামল। বড় বাড়িটার জন্যে রাস্তা থেকে কটেজ দেখা যায় না।

বেরোও,আদেশ দিল হিউগ।

কটেজের পেছনে ছোট একটা ঘরে এনে ঢোকানো হল ছেলেদের। ঘরে তনটে ছোট খাঁটিয়া। একমাত্র জানালাটায় ভারি পাল্লা লাগানো। দরজা দুটো, একটা ঘরে ঢোকার জন্যে, আরেকটা লাগোয়া বাথরুমের। ঢোকার দরজাটার পাল্লা ধাতব। বাথরুমটা ছোট, জানালা নেই।

ও-কে, হিউগ বলল, এখন…,

বাধা দিয়ে কিশোর বলল, কোন বন্ধুর কথায় ধরেছেন, বললেন তো না। আচ্ছা, যার কথায়ই ধরে থাকেন, তার চেয়ে বেশি টাকে দেবেন আপনাদেরকে মিসেস এলসা কারমল…।

তোমাদেরকে কিছু সময়ের জন্যে সরিয়ে রাখতে বলা হয়েছে, কিশোরের কথায় কান না দিয়ে বলল হিউগ।

কিন্তু একথা বলে কিডন্যাপিঙের দায় এড়াতে পারবেন না, রবিন বলল।

এই ছেলে, গর্জে উঠল দৈত্য, কিডন্যাপার কাদেরকে বলছ?

ভুরু কোঁচকাল হিউগ। আমরা কিডন্যাপার নই।

যেভাবেই বলুন, কিশোর বলল, আপনারা…

হয়েছে, থাম, খেকিয়ে উঠল হিউগ। দেখ, তোমাদের বিরুদ্ধে কোন ক্ষোভ বা রাগ নেই আমাদের। বুঝেছ? শুধু নিজেদের স্বার্থ দেখছি আমরা, ব্যস।

কি স্বার্থ? মুসা জানতে চাইল।

অবশ্যই টাকা, আর কি থাকতে পারে? অনেক টাকা পাই আমরা পার্টির কাছে। দিতে পারে না। অনেক দিন হল। কত আর অপেক্ষা করা যায়।

হেসে উঠল বিগ। বিশাল এক ভালুক যেন মাথা নাড়ল। খেলতে বসে যারা ঠিকমত তাস খেলতে জানে না, তাদের না খেলাই উচিত, তাই না, বস?

চুপ! ধমক দিল হিউগ। বেশি কথা বল তুমি। ঢোক গিলল রবিন। আপনারা আপনারা জুয়াড়ী?

মোটেই না, থোকা, হিউগ বলল। জুয়াড়ী হল তারা, যারা খেলে। আমরা ব্যবসায়ী। লোকে জুয়া খেলতে চায়, আমরা তাদের জায়গা দিই, খেলার সুযোগ করে দিই। আমরা নিজেরা কক্ষনও খেলি না।

মিস্টার হিউগ, কিশোর বলল। আপনার বন্ধু যে-ই হোক, আমি বাজি রেখে বলতে পারি, আমাদেরকে ছেড়ে দিলে তার চেয়ে বেশি টাকা দেবে আপনাকে মিসেস কারমল। সে না দিলে আমার চাচা দেবে…

দেখ, থোকা, প্রথমেই বলেছি আমরা কিডন্যাপার নই। তোমাদেরকে জিম্মি রেখে তোমাদের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা চাওয়ার জন্যে ধরে আনিনি। পার্টির কাছে যে টাকা পাই, সেটাই শুধু আদায় করে নিতে চাই, ব্যস। তোমাদের কাছ থেকে একটা কানাকড়িও নেব না, বেশি নেবারও ইচ্ছে নেই। চুপ কর এখন। বড় বেশি কথা বলছ। দৈত্যের দিকে চেয়ে ইশারা করল বিগ!

দরজার দিকে ঘুরল বিগ। কি মনে হতে ফিরে চেয়ে বলল, তোমরা এখানে ভালই থাকবে।

হ্যাঁ, হিউগ বলল, বিছানা আছে, টয়লেট আছে। ওই আলমারিতে খাবার আছে। জগ ভর্তি পানি আছে। একেবারে নিজের বাড়ির মত লাগবে তোমাদের। খাও-দাও, আলাপ কর, বিশ্রাম নাও। শুধু বেরোতে পারবে না।

বেরিয়ে গেল দুজনে। দরজায় তালা লাগানোর শব্দ শুনতে পেল ছেলেরা। তালা লাগিয়ে, দরজার ভারি দণ্ডটা আড়াআড়ি লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল ওরা। বন্দি হল তিন গোয়েন্দা।

সামনের দরজা বন্ধ করার আওয়াজ শোনা গেল। তবে গাড়ির ইঞ্জিন চালু হল। বাইরের ঘরে কে যেন নড়াচড়া করছে। ভারি মানুষ বসায় মড়মড় করে উঠল একটা কাঠের চেয়ার। তারপর শোনা গেল ভারি নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ, ভালুকের দীর্ঘশ্বাসের মত।

বিগ এখনও রয়েছে, ফিসফিসিয়ে বলল মুসা।

নিচু গলায় কিশোর বলল, বেরোনোর পথ খুঁজে বের করতে হবে আগে। তারপর দৈত্যটাকে ফাঁকি দেয়ার কথা ভাবব।

দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল মুসা। জানালা পরীক্ষা করতে লাগল রবিন। কিশোর গিয়ে ঢুকল জানালাবিহীন বাথরুমটায়।

সবার আগে পরাজয় মেনে নিল মুসা।

দরজায় ডাবুল তালা, জানাল সে। ইস্পাতের পান্না, কাজেই তক্তা খুলে যে ফোকর করব তারও উপায় নেই। কব্জাগুলো বাইরের দিকে।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। ভেন্টিলেটরের ফোকরও নেই।

জানালার পালার কজাও বাইরের দিকে, রবিন বলল। বাইরে থেকে লোহার চ্যাপ্টা ডাণ্ডা লাগানো, খোলা যাবে না।

মেঝে দেখা বাকি এখনও, মুসা বলল। দেখতে বেশিক্ষণ লাগল না।

নাহ্, মাথা নেড়ে বলল সে, পুরো ঘরটা কংক্রিটের একটা বাক্স। দেয়ালে কোন ফোকরই নেই। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। কিশোর, বেরোতে পারব না। এসব পরিশ্রম না করে এস শুয়ে থাকি। এবং তা-ই করল সে।

ওরা পেশাদার লোক, কিশোর বলল, ফাঁক রাখবে কেন? মুসার পাশের বিছানাটায় শুতে শুতে রবিন বলল, চমৎকার এই রত্নশিকারের এটাই সমাপ্তি। আমাদেরকে আটকে রাখার আদেশ যে দিয়েছে, সে নিশ্চয় এখন রওনা হয়ে গেছে কুইন অভ দ্য সাউথ-এর উদ্দেশে।

ওয়াকিটকিগুলো আনার কথাও মনে হল না আজ।ক্ষোভে দুঃখে মাথার চুল -ছিড়তে ইচ্ছে করছে কিশোরের।

আনলে কি হত? রবিন বলল। তিনজনকেই তো ধরেছে।

নরির কাছে রাখতে পারতাম একটা।

নরি! লাফিয়ে উঠে বসল মুসা। হয়ত আমাদের ধরা পড়তে দেখেছে। তাহলে নিশ্চয় পুলিশে খবর দেবে।

হয়ত ইতিমধ্যে খুঁজতে আরম্ভ করেছে আমাদেরকে, আশা করল রবিন।

এত আশা কোরো না, সাবধান করল কিশোর। নরি না-ও দেখে থাকতে পারে। ও তখন ফিতে বাঁধায় ব্যস্ত। আর যদি দেখেও, অত দূর থেকে গাড়ির নাম্বার নিশ্চয় দেখতে পায়নি। শুধু বলতে পারবে, নীল গাড়ি দেখেছে। আর নীল গাড়ি রকি বীচে শরটা আছে। হতাশ ভঙ্গিতে ধপ করে খাঁটিয়ায় বসে পড়ল সে।

এমনও হতে পারে, জাহাজে চলে গেছে নরি, রবিন বলল। পরের ধাঁধাটার সমাধান করতে ব্যস্ত। বুদ্ধি আছে ছেলেটার। ওল্ড নেড় বের করেও ফেলতে পারে।

বিপদৈও পড়তে পারে! মনে করিয়ে দিল কিশোর। এজটাররা খুবই বিপজ্জনক ওর জন্যে।

তাহলে নরির আশাও নেই! ধীরে ধীরে আবার শুয়ে পড়ল মুসা। কিশোরও শুয়ে পড়ল। আর কিছু করার নেই। শুধু প্রার্থনা করা ছাড়া-নরি ভাল থাকুক, কিছু একটা করুক ওদের জন্যে।

ঘন্টার পর ঘন্টা পেরোল। জানালার পাল্লার ফাঁক দিয়ে এসে পড়া রোদের রশ্মি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হল। ইতিমধ্যে একবার হিউগের সাড়া পেয়েছে ছেলেরা বিগের সঙ্গে কথা বলে আবার চলে গেছে। খিদে লাগল মুসার। আলমারি থেকে খাবার বের করে খেতে শুরু করল। অন্যদের খিদে নেই, তবু খানিকটা রুটি আর পনির নিয়ে চিবাতে লাগল। গায়ের বল ঠিক রাখতে হবে।

খাওয়ার পর চিত হয়ে শুয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে লাগল কিশোর, একটা ব্যাপার সত্যি অদ্ভুত।

কী? জিজ্ঞেস করল মুসা।

আমাদের কথা জানল কি করে হিউগ আর বিগ? চোখ রাখল কেন দিনের পর দিন? তখন থামানোর চেষ্টা করল না কেন? একবার এমনকি আমাদের সাহায্যও করেছে, এজটারদের গাড়ি খাদে ঠেলে ফেলে। ভাবটা এমন, আমাদের দিয়ে পাথরগুলো বের করিয়ে নিতে চাইছিল। তারপর সময় বুঝে ধরেছে। ঠিক সময়টা কি করে বুঝল? কে বলেছে ওদেরকে? কে চায় ওই পাথর?

এজটাররা? মুসা বলল।

ওরা তো চায়ই। কিন্তু ওরা এসেছে দিন কয়েক আগে, জুয়ায় হেরে হিউগের কাছে অনেক দিন ধরে ঋণী থাকার কথা নয় ওদের।

এমন কেউ, যাকে চিনি না আমরা, রবিন বলল। হতে পারে, আবার ভাবনায় ডুবে গেল কিশোর।

রোদ আসা বন্ধ হয়ে গেল। কমে আসছে বদ্ধ ঘরের আলো। সারা বিকেলটাই আটকে রয়েছে ওরা। অন্য ঘরে নাক ডাকাতে শুরু করেছে বিগ। এইবার বুঝি সত্যিই পরাজিত হল ওরা। এত কষ্ট করে ধাঁধার সমাধান করে দিল, এখন গুপ্তধনগুলো বের করে নেবে অন্য লোক। ওদেরকে ঠকিয়েছে কেউ!

বদ্ধ ঘরের নীরবতায় শুয়ে শুয়ে ওদেরও তন্দ্রা নামল চোখে। কি করারই বা আছে আর?

হঠাৎ ধড়মড়িয়ে উঠে বসল মুসা। কিসের শব্দ!

কান পাতল তিনজনেই। বাড়ি কাঁপিয়ে নাক ডাকাচ্ছে বিগ। কিন্তু সে-শব্দ নয়। টোকার আওয়াজ!

জানালায়! ফিসফিস করে বলল রবিন।

আবার হল টোকার শব্দ। তারপর ফিসফিসিয়ে কথা, তোমরা ওখানে? কিশোর? মুসা?

হ্যাঁ, জানালায় মুখ লাগিয়ে জবাব দিল মুসা।

মৃদু মচমচ করে উঠল জানালা। পাল্লার বাইরে দণ্ড খোলার চেষ্টা করছে কেউ, জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে, বোধহয় উত্তেজনা আর পরিশ্রমে। অবশেষে খুলে গেল পাল্লা। হাঁ হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা।

নরি! প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল ওরা। তবে কণ্ঠস্বর নামিয়েই বলল।

শশশ! হাসল ছেলেটা। আস্তে। ভালুকটা দরজা জুড়ে চেয়ার ফেলে ঘুমোচ্ছে। যে-কোন সময় জেগে যেতে পারে। তাড়াতাড়ি কর।

সেকথা আর দ্বিতীয়বার বলতে হল না ওদেরকে। জানালা গলে বেরিয়ে পড়ল। সন্ধ্যার ছায়া নামছে তখন। নিঃশব্দে বাড়ির পাশ ঘুরে এসে দ্রুতপায়ে রাস্তার দিকে এগোল ওরা।

কি করে খুঁজে পেলে আমাদের, নরি? কিশোর জানতে চাইল।

রাস্তায় পৌঁছে গেছে ওরা। নরি জানাল, তোমাদেরকে ধরে নিয়ে গেলে দৌড়ে গিয়ে আমি মিস্টার উডকে ফোন করলাম। কিন্তু বাড়িতে কিংবা অফিসে কোথাও পাওয়া গেল না তাকে। আমার মাকে কিংবা তোমাদের বাড়ির লোককে ঘাবড়ে দিতে চাইনি। তবু অনেক ভেবেচিন্তে শেষে তোমার চাচাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম, এই সময় বুদ্ধিটা এল মাথায়।

কি বুদ্ধি? হাঁপাচ্ছে কিশোর, প্রায় দৌড়ে চলছে এখন ওরা।

ভূত-থেকে-ভূতে।

ক্ষণিকের জন্যে দাঁড়িয়ে গেল মুসা। আবার চলতে চলতে বলল, তুমি…তুমি আমাদের ভূত

তোমাদের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগেই এর কথা শুনেছি আমি। সুযোগ পেয়েই আর দেরি না করে কাজে লাগলাম। সাময়িক হেডকোয়ার্টার হিসেবে বেছে নিলাম একটা ফোন বুদ। অবশেষে কয়েকটা ছেলে খুঁজে পেল গাড়িটা। –

আশ্চর্য! গাড়িটার নাম্বারও তো জানো না তুমি!

জানি, গর্বের হাসি হাসল নরি। আমাদের বাড়ির সামনে কয়েকবার দেখেছি ওদের। এত বেশি, শেষে সন্দেহ হয়ে গেছে আমার। আজ সকালেই লিখে নিয়েছি ওদের নাম্বারটা। আসলে গোয়েন্দারা…।

কথা শেষ হল না। পেছনে শোনা গেল জোর গর্জন, প্রচণ্ড ধুড়ুম ধুড়ুম।

দৈত্যটা বেরিয়ে পড়েছে! চেঁচিয়ে বলল নরি। দরজার সামনে ময়লা ফেলার টিন বসিয়ে রেখে এসেছিলাম। দৌড় দাও জলদি!

ছুটতে ছুটতে বুক পেরোল ওরা, আরেকটা রাস্তা পেরিয়ে মোড় ঘুরে ছুটে চলল প্রাণপণে।

আরও জোরে! মুখ দিয়ে বাতাস ছাড়তে ছাড়তে বলল রবিন। গাড়ি নিয়ে আসবে।

পারবে না, এতই হাঁপাচ্ছে, ঠিকমত কথা বলতে পারছে না নরি। পকেট থেকে কালো একটা জিনিস বের করে দেখাল। ডিসট্রিবিউটর ক্যাপটা খুলে নিয়ে এসেছি।

থেমে গেল ওরা। রবিন, মুসা আর কিশোর হাসতে শুরু করল পাগলের মত। মনের পর্দায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ওরা, গাড়িটা স্টার্ট না নেয়ায় রেগে গিয়ে কি করছে বিগ। পাশ দিয়ে যাবার সময় অবাক চোখে ওদের দিকে তাকাল পথিক, পরোয়াই করল না ওরা।

চমৎকার, নরি, দারুণ দেখিয়েছ তুমি! হাসতে হাসতে বলল কিশোর। অবশেষে হাসি থামল। বলল, আশা করি দেরি হয়ে যায়নি।

হঠাৎ সকলের হাসি বন্ধ হয়ে গেল।

কিশোর বলল, চলো, সাইকেল নিয়ে ওল্ড নেড খুঁজতে যাই।

১৮

টাউন হলের সামনেই রয়েছে সাইকেলগুলো। তাড়াতাড়ি বন্দরে রওনা হল ওরা। বন্দরের এক কোণে ঘাটে বাঁধা রয়েছে বিশাল এক সমুদ্রগামী জাহাজ। কয়েকটা আলো দেখা যাচ্ছে ওটাতে। ছেলেরা পৌঁছে দেখল, সারি দিয়ে লোক নেমে আসছে ওটা থেকে।

শুঁটকি আর এজটারের খেয়াল রেখ, সাবধান করে দিল কিশোর।

লোকের মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে ভিড় ঠেলে চওড়া টুরিস্ট গ্যাং্যাঙ্কের সামনে টিকেট বুদের দিকে এগোল ওরা। টেরিয়ার বা এজটারদের চেহারা চোখে পড়ল না।

।টিকেট বুদের কাছে পথ আটকাল অ্যাটেনডেন্ট। সরি, আজকের মত বন্ধ হয়ে গেছে। আর ওঠা যাবে না।

কিন্তু আমাদের এখুনি ওঠা দরকার, চেঁচিয়ে বলল নরি।

কোন উপায় নেই, থোকা, বলে ঘুরে দাঁড়াল অ্যাটেনডেন্ট। দেখতে চাইলে আবার আগামী হপ্তার শেষে।

হতাশ চোখে অ্যাটেনডেন্টের চলে যাওয়া দেখছে ওরা। ঘাটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে, টুরিস্টদের শেষ দলটা তখন নেমে আসছে জাহাজ থেকে।

পরের হপ্তা! মাথা নাড়ল রবিন হতাশ ভঙ্গিতে। রোজ দেখানোর বন্দোবস্ত করে না কেন?

দর্শক হয় না হয়ত, আন্দাজ করল কিশোর।

হঠাৎ হাত তুলে দেখাল মুসা, এই দেখ, জাহাজের ওপর!

একেবারে ওপরের ডেকে দেখা যাচ্ছে একটা লম্বা মূর্তি। ঝিক করে উঠল দাঁত। নাকটা যেন সরাসরি ওদেরই দিকে ঠেলে দিল দূরের মূর্তিটা।…

শুঁটকি, গুঙিয়ে উঠল মুসা।

দ্রুত চারদিকে চোখ বোলাচ্ছে কিশোর। ঘাটের ডানে চওড়া একটা গেট খোলা এখনও, মাল আনা নেয়ার কাজে ব্যবহার হয় ওটা। চট করে একবার অ্যাটেনডেন্টের দিকে তাকাল সে, টুরিস্টদের শেষ দলটাকে প্রায় খেদিয়ে নিয়ে চলেছে গেটের দিকে।

এই, কুইক, সঙ্গীদের বলল গোয়েন্দাপ্রধান।

চওড়া গেটটা দিয়ে ঢুকে পড়ল ওরা, দৌড় দিল গ্যাংপ্লাঙ্কের দিকে। সবার আগে রয়েছে মুসা। ধাক্কা খেল গ্যাংব্ল্যাঙ্ক দিয়ে নেমে আসা লম্বা একজন মানুষের সঙ্গে। আউফ করে উঠল। পড়েই যাচ্ছিল, ধরে ফেললেন তাকে জাহাজের ক্যাপ্টেনের পোশাক পরা লোকটা।

কি ব্যাপার, থোকা? ভারি কণ্ঠে বললেন ক্যাপ্টেন। তাড়াহুড়ো করে লাভ হবে না। প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে গেছে।

জানি, স্যার, এগিয়ে গেল কিশোর, কিন্তু আমরা…

জানো? তাহলে চলে যাবার অনুরোধ করব আমি তোমাদেরকে।

পেছনে তাকিয়ে কিশোর দেখল, কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে আছে কয়েকজন অ্যাটেনডেন্ট, সে তাকাতেই বেরিয়ে যাবার ইশারা করল একজন।

ক্যাপ্টেন, মরিয়া হয়ে বলল কিশোর, আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারি?

দেখ, হাসলেন লম্বা মানুষটা, আমি আসল ক্যাপ্টেন নই। একজিবিশন ম্যানেজার। তবে ক্যাপ্টেন ডাকতে পার, আপত্তি নেই। জাহাজ দেখতে আসা যে কারও সাথে আলাপ করতে দ্বিধা নেই আমার, কিন্তু এখন…

আমরা দর্শক নই, চেঁচিয়ে উঠল নরি। আমরা স্যার গোয়েন্দা। এখন একটা কেসে কাজ করছি। কিশোর, কার্ড দেখিয়ে দাও।

কার্ড বের করে দেখাল কিশোর। আমরা জেনেছি আপনার জাহাজে কিছু জিনিস লুকানো আছে।

কার্ডটা পড়ে মুখ তুললেন ক্যাপ্টেন। লুকানো? অনেক টাকার মূল্যবান পাথর, স্যার, মুসা বলল। রত্ন।

রত্ন, না? এটাই তাহলে ব্যাখ্যা!

অধৈর্য হয়ে এগিয়ে এল কয়েকজন অ্যাটেনডেন্ট। হাত নেড়ে তাদেরকে সরে যাবার ইঙ্গিত করলেন ক্যাপ্টেন। ছেলেদের দিকে ফিরলেন আবার। জাহাজের কেবিনের অনেকগুলো বেড় আজ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আমরা ভেবেছি মজা করার জন্যে করেছে কেউ।

মা, স্যার, কিশোর বলল, মজা করার জন্যে নয়। রত খুঁজেছে। বিছানার ভেতর কিংবা আশেপাশে লুকানো রয়েছে পাথরগুলো। সংক্ষেপে জানাল ডেন কারমলের আজব উইলের কথা। ধাঁধাগুলোর সমাধান আমরা করে ফেলেছি। এখন সঠিক বিছানাটা শুধু পেলেই হল। দেরি হয়ে না গিয়ে থাকলেই হয়।

বোধহয় হয়ে গেছে। অনেকগুলো বিছানা সরানো হয়েছে। কিন্তু যদি পাথরগুলো এখনও পেয়ে না গিয়ে থাকে, তুমি কি করে পাবে? ঠিক বিছানাটা বের করবে কিভাবে? পাঁচশো বিছানা আছে জাহাজে।

ঢোঁক গিলল কিশোর। দমে গেল অন্যেরা।

পাঁ-পাঁচশো? তোতলাল রবিন।

কোন কোন কেবিনে দুতিনটে করেও আছে। মোট পাচশো।

বিশেষ কোন বিছানা আছে? মুসা জিজ্ঞেস করল। কোন রানী-টানীর জন্যে। সংরক্ষিত?

না, ওরকম কিছু নেই। কুইন-সাইজ বেড যেগুলোকে বলে সেরকম কিছু? রবিন প্রশ্ন করল।

না। ওরকম বিছানা জনপ্রিয় হওয়ার আগেই জাহাজটার সাগরে চলার দিন ফুরিয়ে গেছে।

আস্তে মাথা দোলাল কিশোর। বিছানাটা পাবার নিশ্চয় কোন উপায় আছে। ক্যাপ্টেন, জাহাজটা কি অস্ট্রেলিয়ায় গেছে কখনও?

বহুবার। লণ্ডন-অস্ট্রেলিয়া-ক্যানাডা রুটে যাতায়াত করত নিয়মিত। কারমল ওতে করেই অস্ট্রেলিয়া গিয়ে! ভাবছ নাকি?

প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কিশোর বলল, ওল্ড নেড বোধহয় কেউ একজন একলা ব্যবহার করত। পুরানো প্যাসেঞ্জারদের লিস্ট আছে।

আছে, তবে লণ্ডনে। এই ধাঁধা তোমাদেরকে সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে তো?

করতেও পারে, গোঁ গোঁ করে বলল মুসা। কারমলের কথা কিছু বলা যায় না।

পাওয়ার উপায় একটা নিশ্চয় আছে, কিশোর বলল। ইস, হাতে যদি খালি সময় থাকত! তবে আমার বিশ্বাস এখনও খুঁজে পায়নি কেউ। তাহলে শুঁটকি জাহাজে থাকত না। তবে সে বা অন্য কেউ পেয়ে যেতে পারে যে-কোন মুহূর্তে।

শুঁটকি? ভুরু কোঁচকালেন ক্যাপ্টেন। তারমানে জাহাজে রয়েছে এখনও একজন? বেশ, দেখছি।

গ্যাংওয়ে ধরে এগোলেন ক্যাপ্টেন। ছেলেরা চলল তার সঙ্গে সঙ্গে। কিশোর কি যেন ভাবছে। হঠাৎ বলে উঠল, মনে হয় বুঝতে পেরেছি…, কথা শেষ হল না তার। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে একটা লাইফবোটের দিকে। সাবধান!

অনেক ওপরে জাহাজের একটা লাইফবোট খসে গেছে ওটার ব্র্যাকেট থেকে, দোল খেয়ে নেমে এসে বাড়ি মারল জাহাজের গায়ে, হুড়মুড় করে ঝরে পড়ল কতগুলো দাড়, পিপে, বাক্স আর আরও কিছু ভারি মালপত্র। ছুটে এল ক্যাপ্টেন আর ছেলেদেরকে লক্ষ্য করে।

সর! বলেই ধাক্কা দিয়ে মুসাকে সরিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন। খপ করে নরির হাত চেপে ধরে তাকে টেনে নিয়ে সরে গেলেন একপাশে।

গ্যাংওয়ের নিচে ডাইভ দিয়ে পড়ল রবিন। কিশোরও অনেক দূরে সরে গেছে। নরিকে ফেলে দিয়ে তার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে তাকে গা দিয়ে আড়াল করলেন ক্যাপ্টেন।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কেউ নড়ল না। তারপর, আবার একে একে উঠে দাঁড়াতে লাগল সবাই। অ্যাটেনডেন্টরা দৌড়ে এল। দোল খাচ্ছে এখনও লাইফবোটটা, সেদিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল ক্যাপ্টেনের চেহারা। অ্যাটেডেন্টদের আদেশ দিলেন, জলদি গিয়ে জায়গামত আটকাও ওটাকে। ছেলেদের দিকে ফিরে বললেন, সরে থাকবে। ব্যাপারটা দুর্ঘটনা না-ও হতে পারে। হবার কথা নয়। খুব ভাল মত দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয় ওটা, নিয়মিত চেক করা হয়।

শুঁটকির কাজ! জ্বলে উঠল রবিন।

আমার মনে হয় না, কিশোর বলল। মারা যেতে পারতাম আমরা। তারমানে খুন। শুঁটকি এতটা এগোবে বিশ্বাস হয় না।

চল না তাহলে গিয়ে দেখি কে! বলেই গ্যাংওয়ে ধরে উঠতে শুরু করল নরি।

থাম! হাঁক দিয়ে বললেন ক্যাপ্টেন। সরি, বয়েজ, জাহাজে এখন আর উঠতে দিতে পারি না তোমাদেরকে। সাঙ্ঘাতিক, বিপজ্জনক। কাজটা এখন পুলিশের এক্তিয়ারে চলে গেল।

হ্যাঁ, স্যার, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর, আপনি ঠিকই বলেছেন। পুলিশ চীফ ইয়ান ফ্লেচারকে ফোন করুন। রবিন, তাঁকে বুঝিয়ে বলবে কি হয়েছে। মুসা, তুমি এখানেই থাক নরিকে নিয়ে, পুলিশ না আসা পর্যন্ত।

গোয়েন্দাপ্রধানের মতলব বুঝতে না পেরে তার দিকে তাকিয়ে রইল রবিন আর মুসা।

তুমি কি করবে, কিশোর? রবিন-জিজ্ঞেস করল। আমি ওল্ড নেডকে খুঁজে বের করতে যাচ্ছি। আশা করি পারব। এক ঘন্টার মধ্যে যদি না ফিরি চীফকে বলবে জাহাজে খোঁজা শুরু করতে।

কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দৌড় দিল কিশোর জুটে বেরিয়ে গেল গেটের বাইরে, সাইকেলে চেপে চলে গেল।

১৯

এক ঘন্টা পরে। ঘাটে ফ্লাডলাইটের উজ্জ্বল আলোর নিচে দাঁড়িয়ে আছে রবিন, মুসা, নরি, সঙ্গে চীফ ইয়ান ফ্লেচার আর ক্যাপ্টেন। পাশে অন্ধকারে মাথা ভুলে রেখেছে বিশাল জাহাজটা। ঘড়ি দেখলেন ক্যাপ্টেন। আটটা প্রায় বাজে, চীফ, বললেন তিনি। এক ঘন্টা হয়ে গেল। আমার মনে হয় আর অপেক্ষা করা ঠিক না।

জাহাজে ইতিমধ্যে কি ক্ষতি হয়ে গেছে কে জানে।

সঠিক বিছানাটা যদি পেয়ে যেত, চীফ বললেন, তাহলে ঝামেলা আর সময় দুটোই বাঁচত।কিশোরের ওপর ভরসা রাখা যায়। দেখি, আরও পনেরো মিনিট অপেক্ষা করে।

সে আসবেই, রবিন আর মুসা একসঙ্গে বলল।

হাসলেন চীফ। আমিও জানি, সে আসবে।

ওই যে! চেঁচিয়ে উঠল নরি। বোধহয় এল!

পায়ের শব্দ ছুটে আসছে। কিশোরের সঙ্গে দেখা করার জন্যে দৌড় দিল রবিন আর মুসা। কয়েক কদম এগিয়েই থেমে গেল। কিশোর নয়, রস উড, গেট পেরিয়ে এগিয়ে এল দলটার কাছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

আছ এখানেই, নরির দিকে তাকিয়ে বলল উকিল। তোমার মা বলল, টাউন হলে গেছ। ওখানে গিয়ে তোমাদের না দেখে তো ঘাবড়েই গিয়েছিলাম। পুলিশকে। ফোন করলাম। থানা থেকে জানাল, চীফ ফ্লেচার এখানে আছেন।

শেষ প্রশ্নটার জবাব খুঁজছি আমরা এখন, মিস্টার উড, রবিন বলল। কিন্তু

কে জানি জাহাজে উঠে বসে আছে। পাথরগুলো পেয়েই গেল কিনা!

দেরি করছি কেন তাহলে? উডের তর সইছে না।

কিশোরের জন্যে অপেক্ষা করছি, মুসা বলল। সঠিক ঘরটা খুঁজে বের করার বুদ্ধি করেছে। দেরি করছে কেন বুঝতে পারছি না।

যদি ভাগ হয়ে খুঁজতে থাকি আমরা, উড বলল, আমি শিওর, তাহলে…

তাতে অনেক সময় দরকার, বলে উঠল একটা কণ্ঠ। আর ভাগ্য খুব ভাল হওয়া চাই।

কিশোর! চেঁচিয়ে উঠল নরি।

গেট পেরিয়ে এল কিশোর। তাকাল উকিলের দিকে। আপনি এখানে কিভাবে এলেন, স্যার?

তোমাদের খুঁজতে খুঁজতে। যাকগে, এখন ওসব কথা বলে সময় নষ্ট করে – লাভ নেই। কোন ঘরটা, বুঝেছ?

খুশিমনে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। কারমল কুইনে করে পাড়ি জমিয়েছিল কিনা বোঝার খুব সহজ একটা উপায় আছে। কোন কেবিনে করে গিয়েছিল, সেটাও জানা যাবে তার সঙ্গে যে গিয়েছিল তাকে জিজ্ঞেস করলে। মাত্র দুজনের যে-কোন একজন হতে পারে, ড্যাম সান, আর ডোরা কেমপার।

জানে? রবিনের প্রশ্ন।

মিসেস কেমপার জানে। কারমলের সঙ্গে একই জাহাজে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিল তিরিশ বছর আগে। তাকে সাক্ষী বানিয়েছেই কারমল, গুপ্তধন শিকারিদের কাছে তাকে পরিচিত করার জন্যে, যাতে মহিলার সাহায্য নেয়া যায়। যাই হোক, হাসল সে, জবাবটা আমি পেয়েছি।

চলো তাহলে জাহাজে,ক্যাপ্টেন বললেন।

পথ দেখিয়ে মেইন ডেক, অর্থাৎ এ-ডেকে সবাইকে নিয়ে এলেন ক্যাপ্টেন। বিশাল জাহাজটায় মাত্র অল্প কয়েকটা আলো জ্বলছে। আবছা হতে হতে দূরে মিলিয়ে গেছে স্নান আলোকিত প্যাসেজগুলো। এ-ডেকের ওপরের টপডেকগুলো অন্ধকারে দেখা যায় না। গ্যাংওয়ে আর অন্যান্য প্রধান প্রবেশপথগুলোতে পুলিশ পাহারা রেখেছেন চীফ। প্রথম শ্রেণীর যাত্রী-সমাবেশের জায়গাটা মস্ত, বিলাসবহুল। একটা টেবিলে রাখা টুরিস্ট ব্রশিউয়ারের স্তূপ থেকে একটা পুস্তিকা তুলে নিল। কিশোর। ওটাতে ছাপা ডেকের নকশা মন দিয়ে দেখতে লাগল।

কোন ঘরটা, কিশোর? চীফ জিজ্ঞেস করলেন।

এই যে, বাইশ নাম্বার কেবিন, ডি ডেকে। মিসেস কেমপার উঠেছিল পাশের কেবিনটায়, একুশ নাম্বার। শিওর কিনা আমি সন্দেহ প্রকাশ করায় হেসে উঠল। বলল, ওগুলোর কথা জীবনে তুলবে না, কারণ ওগুলো জাহাজের সব চেয়ে জঘন্যতম কেবিন। হতচ্ছাড়া গলুইয়ের ঠিক নিচে, বলেছে মহিলা। তার ধারণা, নিচের দিকে বাংকে ঘুমাত কামল। তবে আমার মনে হয় না ওই বিছানায় পাথরগুলো আছে। নকশাটা পকেটে ভরে ধাঁধার নকলটা বের করল সে। শেষ ধাঁধাটা বলছে, ইন দ্য পশ কুইনস ওল্ড নেড, বি ব্রাইট; অ্যাণ্ড নেচারাল অ্যাণ্ড প্রাইজ ইজ ইওরস। বিছানা প্রসঙ্গে যখন নেচারাল বলছে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস বিছানায় শোবার কথা বলা হয়েছে। আর ব্রাইট বলে একটা শব্দ দিয়েই দুটো মানে বুঝিয়েছে। তারমানে মাথা খাটাও এবং উজ্জ্বল কিছু খোঁজ কর।

কিশোরভাই, চেঁচিয়ে উঠল নরি, কি সেটা?

বিছানায় শুলে হয়ত লাইট-টাইট কিছু চোখে পড়বে।

চলো, ক্যাপ্টেন বললেন, সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে। এলিভেটর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়েও থেমে গেল মুসা। একপাশে মাথা কাত করে কি যেন শুনল। কিশের শব্দ যেন শুনলাম।

কান পাতল সবাই। আর শোনা গেল না।

ডি ডেক সব চেয়ে নিচের ডেক, ক্যাপ্টেন বললেন। আলো খুব সামান্য। সাবধানে পা ফেলবে।

নিচে নেমেই চলেছে ওরা। শেষ হওয়ার আর নাম নেই। প্রতিটি ডেক পর পর সিঁড়ি আরও সরু হয়ে আসছে। অবশেষে ডি ডেকে নেমে মোড় নিল ওরা, টুরিস্ট ক্লাস কেবিন এরিয়ার দিকে। পানিরোধক একটা দরজা পেরিয়ে ঢুকল আরেক জায়গায়, ছোট ছোট কিছু কেবিন আছে ওখানে। এই সময় সামনে আবার শুনল শব্দ। চাপা, ভোতা, ঘষার আওয়াজ।

এইবার ঠিক শুনেছি! ঘোষণা করল মুসা। তবে এটা আগের শব্দটার মত নয়।

ইঁদুর-টিদুর হবে, চীফ বললেন। সব জাহাজেই থাকে।

সব জাহাজে থাকলেও আমাদের এটার কেবিনে নেই, ক্যাপ্টেন বললেন। তাছাড়া এত জোরে আওয়াজ করতে পারে না ইঁদুর।

সাবধানে, ম্লান আলোকিত বারান্দা ধরে সামনে এগোল ওরা। শব্দটা এখন আরও স্পষ্ট। কাছেরই একটা ছোট কেবিন থেকে আসছে। বাথরুমের ভেতর থেকে।

তোমরা সরে দাঁড়াও, ছেলেদের বলে গিয়ে দরজা খুললেন চীফ।

শুঁটকি! একসাথে চেঁচিয়ে উঠল ছেলেরা।

হাত-পা বেঁধে, মুখে কাপড় গুঁজে ময়দার বস্তার মত ফেলে রাখা হয়েছে টেরিয়ারকে। কথা বলার চেষ্টায় গোঁ গোঁ করে উঠল। চোখ প্রায় উল্টে যাওয়ার জোগাড়। দুজন পুলিশ গিয়ে তাকে বের করে বাঁধনমুক্ত করল।

দুর্বল ভঙ্গিতে প্রায় টলতে টলতে গিয়ে একটা বাংকে ধপ করে বসে পড়ল দুষ্ট ছেলেটা। কয়েক ঘন্টা ধরে আটকে আছি এখানে…সবে কেবিনটায় খুঁজতে শুরু করেছি, কে যেন পেছন থেকে এসে বাড়ি মারল মাথায়।

মিথ্যে কথা, প্রতিবাদ করল রবিন। এই তো ঘন্টাখানেক আগেই তোমাকে ওপরের ডেকে দেখেছি।

আমি নই। হয়ত আমার মত অন্য কাউকে দেখেছ, বলল টেরি। এমন ভাবে কেঁপে উঠল যেন খুব শীত করছে। হাত-পা বেঁধে, মুখে কাপড় খুঁজে আমাকে বাথরুমে ভরে রাখল। আমি তো ভেবেছি জিন্দেগীতে আর বেরোতে পারব না! –

উচিত শিক্ষা হয়েছে তোমার, মুসা বলল। টকিগিরি করার শাস্তি।

একজন, নাকি দুজন এসেছিল? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

মাথা নাড়ল টেরি। জানি না। দেখিইনি কাউকে। বাড়ি মেরে আরেকটু হ মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল, গোলআলুর মত ফুলে থাকা জায়গাটায় আঙুল ছোঁয়ালো সে।

হঠাৎ, জাহাজের সামনের দিকে কোথাও জোরে শব্দ হল, ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল বোধহয় আয়না বা কাচের কিছু।

ভুরু কুঁচকে ফেললেন ক্যাপ্টেন। বাইশ নাম্বারের কাছে মনে হল!

জলদি চলুন, চিষ্কার করে বলল কিশোর।

টেরি নড়ল না। আমি আর যাচ্ছি না বাবা, বড় বাঁচা বেঁচেছি। গুপ্তধনের দরকার নেই আমার। তোমরা গিয়ে নাওগে।

টেরির কাছে একজন লোক রেখে অন্যদেরকে নিয়ে দৌড় দিলেন চীফ। সরু বারান্দা ধরে ছুটল সবাই ক্যাপ্টেনের পিছু পিছু। শেষ একটা মোড় ঘুরে ক্যাপ্টেন দেখালেন, ওই যে সামনে, বাইশ।

খাইছে! দেখ! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

বাইশ নাম্বার কেবিন থেকে বেরিয়ে আসছে জেনি এজটার, পেছনে তার মোটা ভাই মাইক। দলটাকে দেখে ঘুরে উল্টোদিকে দিল দৌড়। মাইকের হাতে হোট কালো একটা বাক্স, আঁকড়ে ধরে রেখেছে।

দাঁড়াও! বললেন চীফ। পুলিশ!

থামল তো না-ই, ছোটার গতি আরও বাড়িয়ে দিল ভাইবোন। আগে আগে রয়েছে রোগাটে বোন, পেছনে ছুটন্ত ভাইয়ের শরীরের মাংস হাস্যকর ভঙ্গিতে দুলছে। নাচতে নাচতে চলেছে যেন একটা জেলির পিণ্ড! দুপদাপ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। পেছনে তেড়ে গেল গোয়েন্দারা। বি-ডেকে টুরিস্ট লাউঞ্জের একটা। দরজা দিয়ে ঢুকে গেল দুজনে।

বেরোনোর পথ বাঁ-দিকে, হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন ক্যাপ্টেন। ওদেরকে সামনে থেকে ধরব!

করিডর ধরে তাঁর সঙ্গে ছুটল মুসা। অন্যেরা দাঁড়িয়ে গেল আরেকটা দরজা আটকে, যাতে এদিক দিয়ে আবার বেরিয়ে আসতে না পারে ভাইবোন। মুসা আর ক্যাপ্টেনকে দেখতে পেল দুজনে। চোখের পলকে পথ বদল করল জেনি, দৌড় দিল রাইটিং রুমের দরজার দিকে। হাঁপিয়ে পড়েছে মোটা মাইক। বোনকে অনুসরণ করে তীক্ষ্ণ মোড় নিতে গিয়ে পা পিছলাল। প্রায় জাহাজ কাঁপিয়ে ধুড়ুম করে পড়ল আছাড় খেয়ে। শোল মাছের মত পিছলে গিয়ে বাড়ি খেল তিনটে টেবিল আর দেয়ালের সঙ্গে। হাত থেকে উড়ে চলে গেল কালো বাক্সটা। উঠে যে তুলবে সেশক্তি নেই। জিভ বের করে হাঁপাচ্ছে।

ভাইয়ের দুরবস্থা দেখে থেমে গেল জেনি। গাল দিয়ে উঠল, মোটকা গাধা কোথাকার!

ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করছে মাইক। তাকে উঠতে সাহায্য করলেন চীফ। জেনিকে ধরে রাখল একজন পুলিশ। কালো বাক্সটা তুলে নিল কিশোর।

নিশ্চয় আড়িপেতে আমাদের কথা শুনেছে ওরা। তখনই কোনভাবে শব্দ করে –

ফেলেছিল, মুসা শুনেছে, বলল সে। কেবিনের নাম্বার শুনেই আর দেরি করেনি, ছুটে চলে গেছে। বাক্সটা কোথায় পাওয়া গেছে, মিস এজটার? বাইশ নাম্বার কেবিনে নিশ্চয়?

কালো হয়ে গেছে জেনির মুখ। মাথা ঝাঁকাল। সিলিঙে।

খোল বাক্সটা, কিশোর, তর সইছে না রবিনের।

বাক্সটা খুলল কিশোর। সবাই তাকিয়ে রইল চকচকে পাথরগুলোর দিকে। তারপর সামনে ঝুঁকলেন চীফ। সবুজ একটা পাথর তুলে হাতে নিয়ে দেখলেন। এটা রত্ন নয়, কাচ! একটার সঙ্গে আরেকটা ঘষা দিয়ে দেখে বললেন, সব কাচ এগুলো।

ওগুলোর নিচে একটা খাম রয়েছে। সেটা থেকে বেরোেল একটা চিঠি। তাতে লেখাঃ

সমস্ত আগ্রহী গুপ্তধন শিকারিদের বলছি, তোমাদের বোঝা উচিত ছিল, একজন সুস্থ মানুষ তার টাকা খুব ভেবেচিন্তে খরচ করে। আমিও করেছি। একদল বোকা গাধা আমার গুপ্তধনের পেছনে কিভাবে পাগলের মত ছুটছে কল্পনা করে হাসি ঠেকিয়ে রাখতে পারছি না আমি। বোকাদের জন্যেই রেখে গেলাম এই কাচের টুকরোগুলো, বোকামির পুরস্কার।–ডেন।

স্তব্ধ হয়ে গেছে সবাই। মানে…এ-সবই…, কথা আটকে যাচ্ছে নরির, ফাঁকিবাজি!

মিনমিন করে বলল কিশোর, অথচ আমি শিওর ছিলাম… কেউ তাকে বোকা গাধা বললে খুব খারাপ লাগে তার।

আক্কেল হয়েছে, মুসা বলল, কয়রা আরও লোভ।

নিশ্চয় আরও আছে! জেনির দিক ঘুরল উড। সিলিঙে আর কি পেয়েছ।

আর? রাগ করে বলল মাইক, অনেকগুলো মণিমুক্তো। বস্তা বস্তা পড়ে আছে, নিয়ে এসোগে।

নিশ্চয় কিছু আছে আরও, উকিল বলল। গিয়ে দেখা দরকার।

দল বেঁধে আবার নিচের ডেকে চলল সবাই। জেনি আর মাইকও চলল পুলিশ প্রহরায়। কেবিনে ঢুকতেই চোখে পড়ল ছাতের কালো ফোকর। পাশে ইলেকট্রিকের হেঁড়া তার ঝুলছে। সেগুলো সাবধানে এড়িয়ে খোপের ভেতরে হাত দিল মুসা। হাত ঘুরিয়ে চারপাশে দেখল, মাথা নাড়তে গিয়েও থেমে গেল। দুআঙুলে ধরে বের করে আনল একটা খাম।

তার হাত থেকে ছোঁ মেরে খামটা নিয়ে খুলল উড। চেঁচিয়ে বলল, এটাই আসল উইল! যেটাতে নরি আর এলসাকে সব সম্পত্তি দিয়ে গেছে কারমল। হেসে উঠল সে।

অসম্ভব! কিশোর বলল।

কেন? তীক্ষ্ণ হল উডের কণ্ঠ।

আপনার অফিস থেকে যেটা চুরি গেছে, সেটা যদি এটা হয়, তাহলে এখানে লুকাল এনে কে?

হয়ত কারমলই। ও চেয়েছিল এটা যাতে কেউ নষ্ট করতে না পারে, উকিল বলল। কারমল জানত, উইলটা নষ্ট করে তার সম্পত্তি হাত করার চেষ্টা করবে এজটাররা! পরাজিত ভাইবোনের দিকে খুশি খুশি দৃষ্টিতে তাকাল সে।

কিন্তু, যুক্তি দেখাল কিশোর, উইলটা না পেলেও তো নরিই পাবে সব সম্পত্তি। এজটাররা নয়।

পাগল ছিল তো, ভাবনার ঠিকঠিকানা ছিল না। যা মনে হয়েছে করেছে, ত্যাগ করল উড। যাই হোক, এটা পাওয়ায় ভাল হয়েছে। সম্পত্তি পেতে আর। কোন ঝামেলা হবে না এলসা আর নরির।

হ্যাঁ, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। কিন্তু এভাবে ফাঁকি দিল…

আমি বিশ্বাস করি না! চেঁচিয়ে উঠল নরি। চিঠিটা নকল, দাদা লেখেনি! আমি বিশ্বাস করি না!

২০

শয়তান! বিড়বিড় করল জেনি। আস্ত শয়তান! শয়তানের আবার রসিকতা!

তার দিকে ফিরে কঠোর গলায় চীফ বললেন, আপনি আর আপনার ভাইয়ের জন্যে এটা শয়তানী হতে পারে, ম্যাডাম, তবে অনেকের জন্যে সত্যি রসিকতা। ক্যাপ্টেন, শো-এর সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও এদের জাহাজে থাকার পারমিশন আছে? কিংবা জাহাজের ক্ষতি করার অধিকার?

নিশ্চয় না! কড়া গলায় বললেন ক্যাপ্টেন। তার ছিঁড়েছে, আরও ক্ষতি করেছে।

তারমানে ওরা অপরাধী। জোরাল প্রতিবাদ জানাল মাইক, আপনি আমাদেরকে হয়রানি…

অপরাধ তো আরও আছে আপনাদের, মিস্টার এজটার, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। লাইফবোটটা খুলে দিয়ে আরেকটু হলেই প্রায় মেরে ফেলেছিলেন।

গম্ভীর হয়ে বললেন চীফ, খুব খারাপ করেছে। মস্ত অপরাধ।

ইডিয়ট! মাইকের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল জেনি, মানা করেছিলাম তখনই, শোননি। এখন দেখ কি বিপদে পড়েছি!

চুপ! ধমক লাগাল মাইক। বোকা ছেলেটা বলল, আর ওমনি…

অকে কথা শেষ করতে দিল না জেনি, চীফের দিকে চেয়ে বলল, সব ওর বুদ্ধিতে হয়েছে, বুঝেছেন। লাইফবোট, চুরি, যত যা ঘটেছে সব। সব ওর পাগলামী বুদ্ধিতে।

হেসে ফেলল কিশোর। ভাইয়ের বিরুদ্ধেই শেষে? হাহ হাহ। আর কি শয়তানি করেছেন? সকালে নরিকেও ভ্যানে আটকেছিলেন আপনারাই।

কীই! পেঁচার তীক্ষ্ণ চিক্কার রেরোল জেনির কণ্ঠে। আমরা কক্ষনও…

নিয়ে যাও, বিরক্ত হয়ে সহকারীদের আদেশ দিলেন চীফ।

দুজন পুলিশ ধরল ভাইবোনকে। ঝাড়া দিয়ে হাত দুটিয়ে নিয়ে বোনকে ঘুসি মারার চেষ্টা করল মাইক। কিন্তু ধরে রাখা হল তাকে।

কাছে এসেই দেখ না খালি, কোলাব্যাঙ! পেঁচার মতই বড় বড় নখ দেখাল। জেনি। নাগালে পেলেই খামচি মারবে।

চুপ, পেঁচি কোথাকার! ঘুসি মেরে একেবারে নাক ভোঁতা করে দেব!

ভাইবোনের ঝগড়া দেখে হাসতে শুরু করল মুসা। ওদের সরিয়ে নিয়ে গেল পুলিশেরা। আরও কিছুক্ষণ প্যাসেজে শোনা গেল ওদের উত্তেজিত চিৎকার, ঝগড়া। মাথা নাড়তে নাড়তে মুচকি হাসলেন চীফ। বললেন, চলো, যাই।

ক্যাপ্টেন আর চীফ আগে আগে বেরোলেন। পেছনে নরি আর উড। উইলটা উডের হাতে। মুসা আর রবিনও যাবার জন্যে, পা বাড়াল, ইশারায় নিষেধ করল কিশোর।

অবাক হল দুই সহকারী। মুসা বলল, কি ব্যাপার?

জবাব না দিয়ে ডেকের প্লেনটা আবার দেখতে লাগল কিশোর। সন্তুষ্ট হয়ে বিচিত্র একটা শব্দ করল মুখ দিয়ে, তারপর বলল, আমার মনে হয় না এটা রসিকতা। এটা ওর শেষ চাতুরি।

কিন্তু আর কোন ধাঁধা নেই, মুসা বলল। শেষটারও সমাধান করে ফেলেছি আমরা।

না। আরেকটা ধাঁধা রয়েছে। খুব চালাকি করে লুকিয়ে রাখা হয়েছে ওটা। নকলটা বের করল কিশোর। এমনভাবে লিখেছে, যেন এটা ধাঁধার অংশ নয়, একটা কথার কথাঃ হুড হ্যাভ থট দ্য ওল্ড ম্যান হ্যাড সো মাচ মানি ইন হিম? রোল দ্য ডাইস অ্যাণ্ড দ্য সোয়াগ ইজ ইওরস!

এটা আর কি ধাঁধা হল? রবিন বলল। মানে তো সহজ! কে ভাবতে পেরেছিল, বুড়ো লোকটার এত টাকা? পাশা গড়িয়ে দাও, লুটের মাল তোমার হয়ে যাবে।

আমিও তাই ভেবেছিলাম, কিন্তু এখন অন্য কথা ভাবছি। প্রথম বাক্যটা আর কোথায় আছে, বল তো? পরিচিত মনে হয় না?

গালে আঙুল দিয়ে কয়েক সেকেণ্ড ভাবল রবিন। তারপর বলল, নাটকে। সেকসপীয়ারের ম্যাকবেথ নাটকে ঠিক এরকম একটা কথা আছে, শুধু ওখানে মানির জায়গায় রয়েছে ব্লাড়। বাক্যটা এরকমঃ ই উড হ্যাভ থট দ্য ওল্ড ম্যান টু হ্যাভ হ্যাড সো মাচ রাড ইন হিম?।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিলোর। কাকতালীয় হতে পারে না। বুঝেশুনেই লিখেছে কারমল।

ম্যাকবেথ খুব পছন্দ করত বোধহয়, মুসা বলল। কিন্তু একথাটাকে ধাঁধা মনে হচ্ছে কেন?

নইলে এরকম একটা অদ্ভুত বাক্য উইলে থাকত না। চিঠিতে লিখেছে বটে, কিন্তু ওর মত কৃপণের সব টাকা খরচ করার কথা নয়। তাছাড়া জুয়া খেলার কথা উল্লেখ করেছে।

জুয়া? রবিন বলল। এর সঙ্গে ধাঁধার কি সম্পর্ক?

ওই যে বলেছে, পাশা গড়িয়ে দাও। রোল দ্য ডাইস কেন বলল?

আল্লাহই জানে! মুসা বলল।

আমি বুঝতে পারছি। পাশা দিয়ে জুয়া খেলার সময় নেচারাল বলে খেলোয়াড়েরা। এর মানে কি?

চোখ বড় বড় হয়ে গেল রবিনের। সাত! তারমানে কারমল বলছে, সতি নাম্বার আরেকটা ধাঁধা রয়েছে।

খাইছে! বলে উঠল মুসা।কোনটা? ওই অদ্ভুত বাক্যটা? হুড হ্যাভ…

হাত নেড়ে তাকে চুপ করতে ইশারা করল কিশোর। কান পেতে কি যেন শুনল। তারপর গলা চড়িয়ে বলল, মনে হয় ওই বাক্যটাই। কিন্তু মানে বুঝতে পারছি না। আমার বুদ্ধিতে কুলাবে না। চলো অন্যদের গিয়ে সব খুলে বলি। দেখি কে কি বলে।

আমরা চেষ্টা করে দেখি না কেন? মুসা বলল। এজটাররাও নেই, শুঁটকিও নেই, কেউ আর জ্বালাতে আসবে না।

না, জোরে জোরে বলল কিশোর, আমরা পারব না। সাহায্য দরকার। এস।

কেবিন থেকে বেরিয়ে সিঁড়িব কাছে এসে দাঁড়াল ওরা। চলে এল প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের সমাবেশ যেখানে হত সেখানটায়। ঢুকে গেল বিশাল জাহাজটার নীরব, অন্ধকার ডেকে।

হয়েছে, থাম, ফিসফিসিয়ে বলল কিশোর। যথেষ্ট দূরে চলে এসেছি।

কি হয়েছে, কিশোর? বুঝতে পারছে না মুসা। আবোল-তাবোল কথা বলছ কেন?

করছিটা কি আমরা? রবিনও অবাক হয়েছে।

আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষা করব আমরা, কিশোর বলল। তারপর যাব সেখানে, যেখানে রত্নগুলো রয়েছে।

কোথায়, জানো? কিশোর বলছে দেখে রবিনও ফিসফিসিয়ে বলল। বুঝতে পারছে, গোয়েন্দাপ্রধানের মনে কোন মতলব আছে।

কিন্তু মুসা বুঝতে না পেরে জোরেই জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

চট করে একবার চোখ বুলিয়ে নিল কিশোর, কিন্তু অন্ধকার ডেকে কোন নড়াচড়া চোখে পড়ল না। বলল, ডেকের নকশায় দেখলাম, ছোট একটা লাউঞ্জ আছে কুইন জাহাজে, ওটার নাম ম্যাকবেথ রুম। রতগুলো ওখানেই আছে।

খাইছে! আমরা পারব না বলেছিলে কেন তাহলে?

বুঝতে পারবে একটু পরেই, হাতঘড়ি দেখল কিশোর। হয়েছে। চলো এবার যাই। শব্দ করবে না। আমার পেছনে থাকবে, যা যা করতে বলব, করবে।

বেড়ালের মত নিঃশব্দে আবার সমাবেশের জায়গাটায় বেরিয়ে এল গোয়েন্দাপ্রধান। কার্পেট বিছানো চওড়া সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল বি-ডেকে। নীরবে অনুসরণ করছে দুই সহকারী। বি-ডেকে নেমে স্নান আলোকিত বারান্দা ধরে হেঁটে চলল। একটা দরজার পাশের ছায়ায় এসে দাঁড়িয়ে গেল। দরজার পাল্লার গায়ে গোল জানালা।

ম্যাকবেথ রুমের একপাশের দরজা এটা, বলল কিশোর। সারভিস ডোর।

কি করব এখন? মুসা জানতে চাইল।

অপেক্ষা। এবং নজরে রাখব।

ওর কথা শেষ হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই টর্চ জ্বলে উঠল ঘরের ভেতর। একই জায়গায় থেকে আলোর রশ্মি ঘুরতে শুরু করল সারা ঘরে। আলোয় ফুটে উঠতে থাকল কতগুলো টেবিল, আর্মচেয়ার, মরচে পড়া একটা বার, দেয়ালে সাজানো প্রাচীন হেলমেট, বৰ্ম, বেদীতে বসানো স্কটিশ যোদ্ধাদের দাড়িওয়ালা আবক্ষ মূর্তি।

ঘরের মধ্যে ঘোরাফেরা শুরু করল টর্চধারী।

প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে ছেলেরা। গাঢ় রঙের কটটেল লাউঞ্জের ওপর আলো পড়ল। টর্চ ধরে থাকা হাতটা ছাড়া টর্চধারীর শরীরের আর কোন অংশ চোখে পড়ছে না। শুধু কালো একটা মূর্তি দ্রুত সরে যাচ্ছে এখান থেকে ওখানে, প্রতিটি টেবিলের সামনে দাঁড়াচ্ছে, বারের নিচে, বর্ম আর হেলমেটগুলোর ভেতর খুঁজছে। টান দিয়ে দিয়ে খুলে নিচ্ছে দেয়ালের জিনিস, তুলে নিচ্ছে টেবিলে রাখা জিনিস, টর্চের কাছে এনে পরীক্ষা করছে, তারপর ছুঁড়ে ফেলছে।

আলো ঘুরতে শুরু করল মূর্তিগুলোর ওপর। চাপ দাড়িওয়ালা একটা ব্রোঞ্জের মূর্তির ওপর এসে থামল। ওটার মাথায় একটা রাজকীয় মুকুট। অস্ফুট শব্দ করে দ্রুত মূর্তির কাছে গিয়ে দাঁড়াল লোকটা। তুলে নিল। হাতে নিয়ে ওজন আন্দাজ  দেখল, একটা কেবিনে প্রায় দৌড়ে এসে ওই একটা। মুহূর্তে ঢুকে করে সন্তুষ্ট হয়ে আবার শব্দ করল সে, আনন্দ ধ্বনি।

রবিনের কাঁধ খামচে ধরল কিশোরের আঙুল। আরেকটু জোরে দিলেই আউউ করে উঠত রবিন। ফিসফিসিয়ে গোয়েন্দাপ্রধান তার কানে কানে বলল, ভেতরটা বোধহয় ফোপড়া! মনে হয় পেয়েছে!

একটা টেবিলে টর্চটা শুইয়ে রেখে আলোর সামনে ধরে [র্তির ফোকরে হাত ঢুকিয়ে দিল লোকটা। চামড়ার একটা বড় বটুয়া বের করল ভেতর থেকে। মূর্তিটা ছুঁড়ে ফেলে খুলল বটুয়াটা। হেসে উঠল একা একাই। বটুয়া হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল ম্যাকবেথ রুমের মেইন ডোর দিয়ে।

এস, কিশোর বলল, পিছু নিতে হবে। শব্দ করবে না, খবরদার।

বি-ডেকের প্যাসেজের একটা মোড়ে এসে থেমে মুখ বের করে উঁকি দিল ওরা। স্নান আলোয় দেখল দ্রুত চলে যাচ্ছে লোকটা। মুহূর্তে ঢুকে গেল পাশের আরেকটা সরু প্যাসেজে। প্রায় দৌড়ে এসে ওই প্যাসেজের মাথায় দাঁড়িয়ে ছেলেরা দেখল, একটা কেবিনে ঢুকে যাচ্ছে সে।

কেবিনের বাথরুমে ঢুকতে দেখা গেল লোকটাকে। যখন আবার বেরিয়ে এল, তার হাতে বটুয়াটা নেই। রবিন আর মুসার কাঁধে টোকা দিয়ে ওদের দৃষ্টি তার দিকে ফেরাল কিশোর। চোখের ইশারায় পাশের আরেকটা কেবিন দেখাল।

কেবিনটাতে ঢুকে পড়ল ওরা। সময়মত ঢুকেছে। লোকটা বেরিয়ে প্যাসেজ ধরে হেঁটে গিয়ে মূল প্যাসেজে উঠল। পিছু নিতে চাইল আবার মুসা, তাকে থামাল কিশোর। না, চলে যাক। ব্যাগটা খুঁজে বের করব, চলো।

প্রথম কেবিনটায় ঢুকে বাথরুম খুলল কিশোর। পকেট থেকে পেন্সিল টর্চ বের করে আলো ফেলল ভেতরে। দেয়ালের ওপর দিকে হাওয়া বেরোনোর পথ আছে, ভেন্টিলেটর, তাতে দেখা গেল বটুয়ার একটা কোণ বেরিয়ে আছে। চোখ চকচক করে উঠল কিশোরের, কিন্তু বটুয়াটা নিল না, বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিল আবার।

নিশ্চয় পাথরগুলো আছে, মুসা বলল। নেবে না?

চোরটার পিছু নেবে না? বলল রবিন। চোরই তো বলা যায় তাকে, নাকি?

নিঃসন্দেহে, জবাব দিল কিশোর। তবে বেশিদূর যায়নি। আর ওটা ছোঁয়া আমাদের উচিত হবে না। চোরটা যে ওটা ধরেছিল প্রমাণ নষ্ট হয়ে যাবে তাহলে।

ফাঁদ পেতেছিলে তুমি, তাই না, কিশোর? বুঝে ফেলল রবিন। তুমি জানতে, ম্যাকবেথ রুম থেকে পাথরগুলো চুরি করবে কেউ। কিভাবে জানলে?

কারণ আমি বুঝতে পেরেছি, নকল পাথরগুলোর সঙ্গে যে উইলটা পাওয়া গেছে ওটাও মেকি। কারমল কখনই ওটা ওখানে রাখেনি। তারমানে এজটারদের আগেই কেউ পাথরগুলো পেয়েছিল, আবার রেখে দিয়েছে ওখানে।

রেখে দিয়েছে? অবাক হল মুসা। কেন?

যাতে আমরা সন্দেহ না করি। চোরটাকে আসল পাথরের সন্ধান করে দিই। তখনই আমি বুঝতে পেরেছি, সব সময় আমাদের ওপর যে চোখ রেখেছে, বিগ আর হিউগের কাছে যে টাকা ধারে, ওই লোকেরই কাজ এটা। আমাদের ওপর তখনও চোখ রেখেছে। কাজেই ফাঁদ পাতলাম।

সাত নাম্বার ধাঁধার কথা জোরে জোরে বললাম, যাতে সে শুনতে পায়। তারপর মানে না বোঝার ভান করলাম। ম্যাকবেথ রুমের কথা চোরটার অজানা থাকার কথা নয়। তাছাড়া নকশাতেও রয়েছে ওটা। একটা নকশা নিয়ে চোখ বুলিয়ে নিলেই হল। বুঝেছি, আমরা জাহাজ থেকে নেমে গেছি বুঝলেই গিয়ে রহগুলো খুঁজে বের করবে সে।

এবং তা-ই করেছে!

হ্যাঁ, হাসল কিশোর। এখন গিয়ে চীফকে পাথরগুলোর কথা জানানো দরকার। ব্যাগ, আর ব্যাগের ওপরের ছাপ…

সেই সুযোগ আর পাবে না তোমরা!

চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরল তিনজনে। খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে উকিল রস উড। হাতে উদ্যত পিস্তল।

২১

ফিরে এসে কাজটা খুব খারাপ করে ফেলেছি, তাই না? গম্ভীর হয়ে বলল উড।

গোড়া থেকেই ওগুলো চুরির মতলব ছিল আপনার! গরম হয়ে বলল রবিন।

এগিয়ে এল উড। রাগত হাসল। টাকা আমার ভীষণ দরকার, অথচ ওই বুড়ো ডাকাতটা তার খেপাটে উইল বানিয়ে আমাকে আটকে দিল। আমি.এলসাকে বিয়ে করি, এটা তার মোটেও পছন্দ ছিল না। তার ভয় ছিল, এলসাকে বিয়ে করে আমি সব টাকা মেরে দেব।

আমাদেরকে ব্যবহার করেছেন আপনি, ধীরে ধীরে বলল কিশোর। সে জন্যেই বয়স্ক কোন গোয়েন্দা সংস্থাকে ভাড়া করার চেয়ে আমাদেরকে করা ভাল মনে করেছেন। ভেবেছেন, কম বয়েসীদের ফাঁকি দেয়া সহজ।

ভুলই ভেবেছি, স্বীকার করল উড। অনেক বয়স্ক লোকের চেয়ে অনেক বেশি চালাক তোমরা।

পিস্তল নাচাল সে। ভয় পেলেও সেটা উডকে বুঝতে দিল না ছেলেরা। দাঁড়িয়ে রইল যেখানে ছিল।

কেউ চুরি করার আগেই কেন ওগুলো হাতিয়ে নিলেন, বুঝতে পারছি, রবিন বলল। কিন্তু আপনি চুরি করতে গেলেন কেন? মিস কারমলকে বিয়ে করলে এমনিতেই তো মালিক হয়ে যেতেন।

একেবারে নিশ্চিত হয়ে নিলেন, না? যোগ করল কিশোর। দলিলের একটা নকল কপিও রেখে দিয়েছেন কাঁচের টুকরোগুলোর সঙ্গে।

চালাক ছেলে! উড বলল। পাথরগুলোর মালিক হয়ত হতে পারতাম এলসাকে বিয়ে করে, তবে আংশিক। আর আংশিক জিনিসে আমার চলবে না। তাছাড়া বিক্রি করতে গেলে তার নানারকম প্রশ্নের জবাব দিতে হত। কে যায় অত ঝামেলা করতে।

জিনিসগুলো কেন আপনার দরকার জানি আমরা, মুসা বলল।

কারণ জুয়া খেলে হেরেছেন, টাকা পায় আপনার কাছে হিউগ আর বিগ, তিক্তকণ্ঠে বলল রবিন। টাকার জন্যে চাপ দিচ্ছে এখন।

আর এলসা যদি শোনেন আপনি জুয়াড়ী, অনেক টাকা ধার রয়েছে আপনার, কিশোর বলল, আপনার ওপরে খারাপ ধারণা হয়ে যাবে তার।

ও, অনেক কিছু জানো তোমরা। বেশি জানো, কপাল খারাপ আরকি তোমাদের, উড বলল। তবে বলেছ ঠিকই, ধারণা খারাপ হয়ে যাবে, বিশ্বাসও রাখতে পারবে না আর। বড় কথা হল, সবগুলোই যখন মেরে দিতে পারি, কোনরকম ঝামেলা ছাড়া, কেন ভাগাভাগি করতে যাব নরি আর এলসার সঙ্গে? কেউ কিছু জানবে না এখন। পাথরও হজম করব, এলসাকে বিয়ে করে আরামে ভোগ করব কারমলের সয়সম্পত্তি।

ছেলেদের দিকে পিস্তল উদ্যত রেখেই জোরে জোরে হাসল উড। তার কাঁধের ওপর দিয়ে কেবিনের দরজার দিকে তাকাল কিশোর। বলল, না, তা পারছেন না। মিস করমল যখনই জানবেন, তাঁকে ঠকাতে চেয়েছেন আপনি, কখনই আর বিয়ে করবেন না আপনাকে।

শয়তানি হাসি ফুটল উডের ঠোঁটে। কিন্তু জানতে তো পারছে না। রত্নগুলোর কথা জানো শুধু তোমরা তিনজন, তোমরা তো গিয়ে বলতে পারছ না।

আমরা হয়ত পারব না, কিশোর বলল। কিন্তু তিনি জেনে যাবেনই। তাই, নরি? জলদি গিয়ে চীফকে জানাও যা যা শুনেছ।

কিশোরের দিকে তাকিয়ে থেকেই হো হো করে হেসে উঠল উড। মাথা নাড়ল। পুরানো কৌশল, কিশোর ওতে পা দিচ্ছি না আমি।

নরি, জলদি কর! মুসা তাগাদা দিল। ভ্রূকুটি করল উড। চুপ! ঘুরছি না আমি।

আহ, দাঁড়িয়ে আছ কেন? আতঙ্ক জাগল কিশোরের কণ্ঠে। জলদি কর, ছেলে, দৌড়ও!

কিশোরের কণ্ঠস্বর উডকে অবাক করল। সরু হয়ে এল চোখের পাতা। তারপর কানে এল পেছনের শব্দ। ঘুরল অবশেষে। তবে দেরি করে ফেলেছে। প্যাসেজে ছুটতে শুরু করেছে ততক্ষণে নরি।

যাক, পেরেছে! খুশি হয়ে বলল মুসা।

প্যাসেজের দিকে তাকিয়ে গাল দিয়ে উঠল উড। তারপর ধীরে ধীরে ফিরল আবার তিন গোয়েন্দার দিকে।

লোভ আপনার সর্বনাশ করে দিয়েছে, মিস্টার উড, কিশোর বলল। সবই, খোয়ালেন। আমাদের মুখ বন্ধ করে দিলেও এখন আর লাভ হচ্ছে না আপনার।

মাথা ঝাঁকাল উকিল। হ্যাঁ, খুব চালাকির সঙ্গে করেছ কাজটা। বোকা বানাতে চেয়েছিলে আমাকে, বানিয়েছ। এমন কাঁচা ভাবে কথা বলার চেষ্টা করেছ, আমি বুঝতেই পারিনি সত্যি সত্যি নরির সঙ্গে বলেছ। যাকগে, যা হবার হয়েছে, কি আর করা।

তারমানে এখন আর আমরা আপনার জন্যে বিপদের কারণ নই।

না। তবে এখন আমাকে সাহায্য করতে যাচ্ছ তোমরা। এ-ধরনের পরিস্থিতি ঘটলে কি করব, আগেই ভেবে রেখেছি আমি। মুসা, বাথরুম থেকে রত্নগুলো বের করে আন! মুসার পেট বরাবর পিস্তল ধরল উড। কোন চালাকির চেষ্টা নয়। এখন আমি বেপরোয়া।

ঢোক গিলল মুসা। যা করতে বলা হল করল। বাথরুম থেকে বটুয়াটা বের করে এনে উডের হাতে তুলে দিল।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল উড। পালিয়েই যেতে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত। আর কিছু করার নেই। যাকগে, অসুবিধে নেই। মেকসিকো অনেক নিরাপদ জায়গা। আর এসব দামি জিনিস কেনার লোক অনেক আছে ওখানে। পিস্তল নাড়ল সে। হাঁটো। আমার সামনে থাকবে।

উডের নির্দেশ মত ম্লান আলোকিত প্যাসেজ ধরে এগিয়ে চলল ছেলেরা। চীফ আর তার লোকজনের গলা কানে আসছে, খানিক আগে যে কেবিনটায় ছিল ওরা সেদিক থেকে। কান পেতে শুনল উড। তারপর একটা সিঁড়ি দিয়ে ছেলেদেরকে নামিয়ে নিয়ে এল জাহাজের একেবারে পেটের ভেতর। জরুরী হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে ওপরে। ছেলেদের না পেয়ে নানারকম নির্দেশ দিতে আরম্ভ করেছেন ফ্লেচার।

একটা প্যাসেজকে আড়াআড়ি কেটে সি-ডেকে চলে গেছে আরেকটা প্যাসেজ। রবিন আর কিশোরকে ইশারা করল উড, তোমরা দুজন ওদিকে। যাও?

কিন্তু… প্রতিবাদ করতে গিয়ে বাধা পেল রবিন। ধমকে উঠল উড, যা বলছি কর! মুসা যাচ্ছে আমার সাথে। বন্ধুকে জীবিত দেখতে চাইলে সোজা করিডর ধরে চলে যাও। পেছনে তাকাবে না।

নির্দেশ মানতে বাধ্য হল রবিন আর কিশোর। প্যাসেজের শেষ মাথায় পৌঁছার আগে ফিরে তাকানোর সাহস করল না।

মুসাকে নিয়ে চলে গেছে উড।

চেঁচাতে শুরু করল দুই কিশোর। প্যাসেজ ধরে ছুট চীফ আর তার দলের কাছে। অবশেষে তাদের ডাক শুনতে পেলেন চীফ। বি-ডেকের একটা খোলা জায়গায় মিলিত হল ওরা।

উড় কোথায়? জানতে চাইলেন চীফ।

কি হয়েছে, দ্রুত তাকে জানাল কিশোর আর রবিন।

একবার মেকসিকোতে চলে গেলে আর তাকে ধরা যাবে না, চীফ বললেন। তবে জাহাজ থেকেই বেরোতে দিচ্ছি না। গ্যাংপ্ল্যাঙ্কে পাহারা দিচ্ছে পুলিশ।

ভুরু কোঁচকাল কিশোর। জাহাজ থেকে নামার কি ওই একটাই পথ?

আমি তো তা-ই জানি।

চীফ! হঠাৎ সতর্ক হয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন। আরেকটা পথ আছে! পেছনে, মাল খালাস হত যেদিক দিয়ে।

খোলা নাকি?

থাকার তো কথা নয়। কিন্তু…

জলদি করুন, স্যার, চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। ওদিকেই যাবে!

দলটাকে নিয়ে সেদিকে ছুটলেন ক্যাপ্টেন। দেখা গেল, তালা ভেঙে দরজা খোলা হয়েছে। ওটা পেরোতেই চোখে পড়ল, মাল তোলা আর নামানোর সরু গ্যাংপ্যাক ধরে নেমে যাচ্ছে উড। মাথায় পিস্তল ধরে আগে আগে চলতে বাধ্য করছে মুসাকে।

শব্দ শুনে ফিরে তাকাল উকিল। ধমক দিয়ে বলল, খবরদার, কেউ এগোবে না!

উড চীফ বললেন। পালাতে পারবে না! অযথা…

ছেলেটাকে মারতে না চাইলে সরুন…।

শেষ হল না কথা। মুহূর্তের জন্যে অমনোযোগী হয়েছিল উড, সুযোগটার সদ্ব্যবহার করল মুসা। ঝপ করে বসে পড়ে উডের হাঁটুর পেছনে জড়িয়ে ধরে মারল হ্যাঁচকা টান। চিত করে ফেলল তাকে গ্যাং্যাঙ্কে। হাত থেকে খসে পড়ল বটুয়া আর পিস্তল। ঢাল পথে স্থির থাকতে পারল না উড, হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে গড়িয়ে পড়তে লাগল গ্যাংপ্যাঙ্ক ধরে।।

তাকে ধরে থামাতে গিয়ে মুসাও গড়াতে শুরু করল। তবে উকিলের পা ছাড়ল। উডের আরেকটা পা রেলিঙের ফাঁকে ঢুকে আটকে গেল, মট করে শব্দ হল হাড় ভাঙার। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল উড, বাবারে গেছি! মরে গেছিরে বাবা! আমার পা…।

হুড়মুড় করে নেমে এল কয়েকজন পুলিশ। দুজনকে ধরে তুলল। মুসা হাঁপাচ্ছে জোরে জোরে। উকিল সোজা থাকতে পারছে না একপায়ে ভর দিয়ে,

আরেকটা পা সোজাই করতে পারছে না। সত্যিই ভেঙেছে।

যাক, ছেড়ে দিলেও এখন বেশ কিছুদিন আর চুরি করতে পারবে না, চীফ বললেন। উচিত শিক্ষা হয়েছে। কিশোরের দিকে ফিরে বললেন, ওভাবে ওকে ধরার চেষ্টা করা মোটেই উচিত হয়নি তোমার। ভাগ্যিস নরি গিয়েছিল, নইলে তো মরেছিলে। তোমার সন্দেহের কথা আমাকে বললেই পারতে।

প্রমাণ তো ছিল না, স্যার, নিজের পক্ষে সাফাই গাইল কিশোর। একটা নকল দলিল রেখে দেয়া ছাড়া আর কিছুই করেনি তখনও। আমি সেটা সন্দেহ করেছি বটে, প্রমাণ করতে পারতাম না। ওকে ওভাবে ফাঁদে না ফেললে রত্নগুলো মারত, মিসেস কারমলকে বিয়ে করে তার সম্পত্তিরও বারোটা বাজাত।

প্রমাণ করার দরকার ছিল না, চীফ বললেন। তোমার সন্দেহের কথা আমাকে বললেই হুঁশিয়ার হতে পারতাম। যাকগে, ভালয় ভালয় সব মিটে গেছে…

আরি, সর্বনাশ! চেঁচিয়ে উঠল নরি। পাথরগুলো পানিতে…

না, পড়েনি, হাসল মুসা। হাত উঁচু করে বটুয়া দেখাল। খুলে উপুড় করে ধরল ডেকের ওপর। ঝরঝর করে ঝরে পড়ল লাল, হলুদ, নীল আর সবুজ রঙের কতগুলো পাথর, ছোটখাট একটা স্তূপ হয়ে গেল। জাহাজের ম্লান আলোয় ঝলমল করে উঠল, ছড়াতে লাগল ঠাণ্ডা রঙিন দ্যুতি।

২২

কয়েক দিন পর। কেসের রিপোর্ট নিয়ে চিত্রপরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফারের অফিসে হাজির হল তিন গোয়েন্দা। খাড়া-পিঠ ডেস্ক-চেয়ারে বসে সামনে পেছনে দোল খেতে খেতে মন দিয়ে ছেলেদের কথা শুনলেন তিনি।

তাহলে গোড়া থেকেই কারমলের রসের পেছনে লেগে ছিল উড, বললেন পরিচালক।

হ্যাঁ, স্যার, কিশোর বলল।

বেঈমান!

কারমল তাকে দেখতে পারত না, সন্দেহ করত, মুসা বলল, এলসাকে বলেছিলও সেকথা। কিন্তু এলসা বুড়োর কথায় কান দেয়নি।

হুঁ, মাথা দোলালেন পরিচালক। মনের ব্যাপারে মানুষ অন্ধই হয়। তা সে জন্যেই বুঝি এই আজব উইল বানিয়েছিল কারমল, উডের হাত থেকে তার কষ্টে অর্জিত টাকা বাঁচানোর জন্যে?

সেটা একটা কারণ, কিশোর বলল। কারমল ভেবেছিল, ধাঁধার ব্যবস্থা করলে, গুপ্তধন শিকারে জড়িত হয়ে পড়বে উড, বিয়েটা করতে দেরি হবে। হয়ত রত্ন খুঁজতে গিয়ে তার আসল রূপ এলসার কাছে ফাঁস করে দিতে পারে। আর তা-ই করেছে উড। ড্যাম সানকে সব কথা বলেছে কারমল। উডের মত একটা বাজে লোকের সঙ্গে মিশছে বলে পুত্রবধুর ওপরও বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল সে। সান অন্তত তা-ই বলেছে।

উড বুঝতে পারেনি, হেসে বলল মুসা। কি-রকম ধূর্ত লোকের পাল্লায় পড়েছে সে। প্রথমে তার অফিস থেকে কারমলের আগের উইলটা হারাল, তারপর কারমলের মৃত্যুর পর পত্রিকায় বেরিয়ে গেল আজব উইলের খবর। স্তব্ধ করে দিয়েছিল বেচারা উকিলকে।

তারমানে কি উড প্রথম উইলটা নষ্ট করেনি? পরিচালক জিজ্ঞেস করলেন।

না। কারমল করেছে। উডের অফিস থেকে চুরি করেছিল ওটা, জবাব দিল কিশোর।

পরের উইলটা উডকে দিয়ে করালে, আর তার কাছে থাকলে শিওর ওটা নষ্ট করে ফেলত, রবিন বলল, সে-কারণেই ওটা তার কাছে রাখেনি কারমল। তাকে জানায়ওনি কিছু। রেখেছিল ড্যাম সানের কাছে। অনুরোধ করে গিয়েছিল, তার মৃত্যুর পর যেন পত্রিকায় ছেপে দেয়।

কিশোর বলল, ওই উইলের খবর শুনে তো মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা হল উডের। টাকার জন্যে মাথা তখন তার এমনিতেই গরম। তার ভয় ছিল, অন্য কেউ রত্নগুলো খুঁজে বের করে ফেলবে। সুতরাং আমাদের ভাড়া করল।

তার ধারণা ছিল, রবিন বলল, রতুগুলো পাওয়ার পর আমরা যদি গোলমাল করিই, সহজেই সরিয়ে দেবে আমাদেরকে।

তারমানে তোমাদের ভাড়া করেই ভুলটা করেছে, মিটিমিটি হাসছেন

পরিচালক।

আসলে নিজেকেই পরাজিত করেছে সে, কিশোর বলল। মরেছে তার লোভের জন্য।

ওকে সন্দেহ করলে কেন? পরিচালক জিজ্ঞেস করলেন।

লম্বা দম নিল কিশোর। প্রথম সন্দেহ হল হিউগ আর বিগের কথা শোনার পর। ওরা বলল, একজনের কাছে টাকা পায় ওরা, সেই লোকই ওদেরকে বলেছে আমাদের আটকাতে। রত্নগুলো চায় সেই জুয়াড়ী লোকটা। হিউগ আর বিগ আমাদের ওপর যেমন রাখত, মিসেস কারমলের বাড়ির ওপরও নজর রাখত। বুঝলাম, জুয়াড়ীকে ওখানেই পাওয়া যাবে। আর ওখানে তখন পুরুষ তোক বলতে একমাত্র রস উড।

কাজেই, জাহাজে ওঠার আগে থেকেই আমার সন্দেহ ছিল জুয়াড়ী লোকটা রস উড। তারপর এমন একটা ঘটনা ঘটল, একেবারে শিওর হয়ে গেলাম যে সে-ই সেই লোক। কেবিনের সিলিঙে কাঁচের টুকরোর সঙ্গে পাওয়া গেল নকল উইল।

কিন্তু কি করে বুঝলে নকল? আর উডই যে ওই কাজ করেছে সেটা?

কারণ ভোরা কেমপার আমাকে বলেছে, আগের উইলটা কারমল নষ্ট করে ফেলেছে। দ্বিতীয় উইলটায় সাক্ষী দিতে ডাকার আগেই সেকথা সান আর ডোরা কেমপারকে বলেছিল কারমল। বলেছিল, চুরি করে এনে ওটা পুড়িয়ে ফেলেছে। জানিয়ে রেখেছিল এই কারণে, যদি প্রথম উইলটা আবার উদয় হয় কখনও, সেটা যে জাল ওরা যেন বলতে পারে কোর্টে। কারমলের সন্দেহ ছিল, একটা জাল দলিল তৈরি করবেই উড। তার সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হয়েছে।

আমি এসব কথা শুনে এসেছি আগেই। কাজেই জাল দলিলটা যখন সত্যি বেরোল, বুঝে ফেললাম কার কাজ। কেন রাখা হয়েছে তা-ও বুঝলাম।

বলে যাও, পরিচালক বললেন।

হ্যাঁ, খুলেই বল সব,মুসা অনুরোধ করল। একবার শুনেছি, কিন্তু ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি ঠিকমত। দেখা যাক এখন বুঝি কিনা।

বেশ, কিশোর বলল, বলছি। কিন্তু এতে না বোঝার তো কিছু নেই। কারমলের মৃত্যুর পর কে লাভবান বেশি হবে এটা তো জানা কথা। জাল দলিলটা যদি না বেরোয়, তাহলে দাদার স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তির মালিক হবে নরি, কারণ সে-ই একমাত্র উত্তরাধিকারী। তার অমতে তার জিনিস কেউ ছুঁতে পারবে না, এমনকি তার মায়েরও সে-অধিকার নেই।

কাজেই জাল দলিলটা এল, নরি আর তার মায়ের নামে। নরি পাবে শুধু অর্ধেক, পুরোটা নয়। তার মা পাবে বাকি অর্ধেক। উড তাকে বিয়ে করলে সহজেই স্ত্রীর সম্পত্তির অর্ধেকের মালিক হয়ে যাবে, কারণ ক্যালিফোর্নিয়ার আইনে স্ত্রীর সম্পত্তির অর্ধেকের মালিক হয় স্বামী।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালেন পরিচালক।

ছেলের জিনিস মা চুরি করবে না, বলে গেল কিশোর, এটা শিওর। কাজেই সন্দেহ করার মত আর একজনই রইল, রস উড। আন্দাজ করলাম, সারাটা বিকেল জাহাজে পাথরগুলো খুঁজেছে সে। তার পেছনে কেউ লাগবে এ-ভয় ছিল না। হিউগ আর বিগকে বলে দিয়েছিল আমাদের আটকাতে। নরি হোক ছোঁক করছিল বলে তাকে নিজের হাতে বন্দি করে ভরে রেখেছিল ভ্যানে, আমরা যে তাকে ছেড়ে দিয়েছি, জানত না। নকল পাথরগুলো পেল, তবে আমার মতই সে-ও কারমলের চিঠি বিশ্বাস করেনি। বুঝতে পেরেছে, মিথ্যে কথা বলছে কারমল। জাল দলিলটা তখনই রেখে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে গেল যে, যদি রহগুলো না-ও পায়, এলসার সম্পত্তির ভাগীদার সে হবেই। তারপরে অবশ্যই হিউগকে বলত আমাদের ছেড়ে দিতে, এবং আমাদের মাধ্যমে রহগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করত। কিন্তু আমাদেরকে ছাড়া পেয়ে যেতে দেখে অন্য বুদ্ধি এল তার মাথায়।

আমি যখন শিওর হয়ে গেলাম, তাকে ধরার জন্যে ফাঁদ পাতলাম। সেই কেবিনেই রয়ে গেলাম অন্যেরা বেরিয়ে যাওয়ার পরেও। ব্যাপারটা উডের চোখ এড়াল না। বাইরে বেরিয়ে আড়ি পাতল সে। আমিও তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে সব কথা বললাম। তারপর কায়দা করে তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেলাম ম্যাকবেথ রুমে, একেবারে আমার ফাঁদের মধ্যে।

ফাঁদটা অবশ্য তোমাদেরকেও বিপদে ফেলে দিয়েছিল, পরিচালক বললেন। মরেছিলে আরেকটু হলেই। যাক, ভালয় ভালয় সব শেষ হয়েছে।

হ্যাঁ, স্যার, হাসল কিশোর।

হিসেব করে অনেক কিছু বের করেছ, ঠিক, তবে কিছু কিছু ব্যাপারে আন্দাজেও ঢিল ছুঁড়েছ, তাই না? এই যেমন, মাইক এজটারকে বোট খুলে দেয়ার কথাটা বলা।

না, জোর দিয়ে বলল কিশোর, সেটাও অনুমান নয়। বুঝলাম, লাইফবোট যে খুলে দিয়েছে সে চায় না আমরা জাহাজে উঠি। তারমানে সে জানে না বাইশ নাম্বার কেবিনের পাথরগুলো নকল। উড জানে, শুঁটকি বলি, ওই অকাজ করার মত একমাত্র বাকি থাকে এজটাররাই।

এক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। চোখে বিস্ময়, চাপা দেয়ার কোন চেষ্টা করলেন না। ধীরে ধীরে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল ঠোঁটে। বললেন, হ্যাঁ, এবার বল আসামীদের কথা। কার কি শাস্তি হয়েছে? উড তো জেলে যাবেই, তার কথা বাদ। বাকিদের?

হিউগ আর বিগ উধাও, রবিন জানাল। পুলিশ খুঁজছে ওদের। ইচ্ছে করলে মাইক আর জেনিকে জরিমানা করতে পারতেন বিচারক, জেলও দিতে পারতেন। কিন্তু রত্ন না পেয়ে মানসিক শান্তি অনেক হয়েছে ওদের। সেকথা বিবেচনা করে ওদেরকে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিজ্ঞ বিচারক, তবে আমেরিকায় থাকতে পারবে না ওরা। সেই দিনই দেশের জাহাজের টিকেট কেটেছেভাইবোন।

হ্যাঁ, রত্ন না পাওয়ার ব্যথা কোনদিন ভুলতে পারবে না ওরা, এটাই বড় শাস্তি, পরিচালক বললেন। টেরিয়ারের কি খবর?

বাথরুমে আটকে থেকেই আকেল হয়ে গেছে ওর। আর বাড়াবাড়ি করছে। না। ঝিম মেরে গেছে একেবারে।

দেখ কতদিন ভাল থাকে। যাকগে, চমৎকার কাজ দেখিয়েছ তোমরা। আমার কগ্রাচুলেশন রইল।

থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার। তবে কাজ মোটেও ভাল দেখাইনি। গর্দভের মত কাজ করেছি, কিশোর বলল।

মানে? ভুরু কোঁচকালেন পরিচালক।

প্রথম পাঁচটা ধাঁধার একটারও সমাধান করার দরকার ছিল না। ছয় নাম্বারটা থেকে শুরু করলেই বের করে ফেলা যেত পাথরগুলো।

কি করে? সোজা হয়ে বসলেন মিস্টার ক্রিস্টোফার।

কইনের আগে পশ শব্দটা ব্যবহার করেছে কারমল। আমি জানতাম, এর মানে ফিটফাট। ধরে নিয়েছিলাম জাহাজের সব চেয়ে ভাল কেবিন, মানে ফার্স্ট ক্লাসের কথা বলছে। কাজেই ওটা নিয়ে আর মাথা ঘামাইনি, দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিশোর। তারপর সেদিন ক্যাপ্টেনের কাছে শুনলাম, শব্দটার অন্য মানেও আছে। শব্দটা ইংরেজ নাবিকদের আবিষ্কার, জাহাজে করে যারা ভারতবর্ষে যেত আর আসত। ওদিকে যাওয়ার সময় সব চেয়ে আরাম হত জাহাজের পোর্ট সাইড অর্থাৎ বা দিকের কেবিনগুলোয়, রোদ বাতাস কোনটাই তেমন বিরক্ত করত না। আবার ইংল্যাণ্ডে ফেরার পথে ভাল হত স্টারবোর্ড সাইড অর্থাৎ ডানপাশের গুলো। স্টীমশিপের যাত্রীদের মাঝে একটা কথা প্রচলিত ছিল তখনঃ যদি আরামে যেতে চাও, যাওয়ার সময় বামে, আর ফেরার সময় ডানে উঠবে। সংক্ষেপে ইংরেজিতে বলত—পোর্ট আউট, স্টারবোর্ড হোম। পরে আরও সংক্ষেপ করে ফেলা হল, চারটে শব্দের শুধু প্রথম চারটে অক্ষর এক করে, মানে পি.ও. এস, এইচ. দিয়ে হয়ে গেল পশ।

কিশোর থামতে রবিন বলল, যেহেতু কুইন জাহাজটা লণ্ডন-অস্ট্রেলিয়া যাবার পথে ইনডিয়া হয়ে যেত, পশের আরাম ওটাতেও ছিল। কারমল জানত সেটা। খুব শর্টকাট একটা সূত্র দিয়েছিলঃ পশ কুইন।

এবং গর্দভের মত আমি সেটা মিস করেছি, মুখ কালো করে বলল কিশোর।

তুমি একা নও। সবাই-ই করেছে, পরিচালক বললেন।

সান্ত্বনা দিচ্ছেন, স্যার।

মোটেই না। সবগুলো ধাঁধার সমাধান করতে গিয়ে অনেক বিপদ আর বাধার মুখোমুখি তোমরা হয়েছ, মেধা আর অসামান্য সাহসের জোরে সেগুলো প্রতিহত করেছ, তোমাদের দক্ষতা তাতে আরও বেশি প্রমাণিত হয়েছে। শুধু চমৎকার আর বলব না, বলব প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করেছ তোমরা, মাই বয়েজ।

হাসিতে উত্মসিত হল তিন গোয়েন্দর মুখ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *