ওয়ার্নিং বেল

ভলিউম ১৮ওয়ার্নিং বেলতিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

এটা একটা পাজল হলো? ঠোঁট বাঁকাল কিশোর পাশা। দশ বছরের ছেলেও বাঁ হাতে সেরে দিতে পারে!

কিন্তু মুসার তা মনে হলো না। তার বয়েস দশ বছরের অনেক বেশি। বাঁ হাত তো দূরের কথা ডান হাতেও সে পারবে না। ড্যাগউডস ওয়াইফ অর্থাৎ ড্যাগউডের স্ত্রীর মানেই তো করতে পারছে না, যদিও ড্যাগউড নামটা পরিচিত লাগছে ওর কাছে।

ডেস্কে পা তুলে দিয়ে আরাম করে বসেছে রবিন। পেন্সিল আর ক্রসওয়ার্ড পাজলের একটা কপি নিয়ে ব্যস্ত। মুসার যতটা লাগছে তার কাছে ততটা কঠিন মনে না হলেও একেবারে সহজও লাগছে না।

হেডকোয়ার্টারে রয়েছে তিনজনে। হাতে কেস নেই। আকাশ খারাপ বলে বেরোতেও পারছে না। নইলে সাঁতার কাটতে যাওয়া যেত। তিন দিন ধরেই আবহাওয়ার ঘোষণা দিয়ে চলেছে টিভিঃ আকাশ মেঘলা থাকবে, যখন-তখন বৃষ্টি নামতে পারে, হালকা ঝড় হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।

কিশোর বহুবার দেখেছে, বৃষ্টির সময় যখন ঘরে আটকে থাকে, তখন কেবল গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ে, আর যেই সে বেরোল অমনি ঝুপঝুপ করে নামে।

এটা কোন ব্যাপারই না, বলে তার সামনে রাখা পুস্তিকাটা টেনে নিল। ধাঁধার আরেকটা কপি। পেছনে নির্দেশনা লেখা রয়েছে। সেটাই পড়ল, হাই স্কুলের ছাত্রদের জন্যে এই ধাঁধার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাদের বয়েস চোদ্দ থেকে আঠারোর মধ্যে। প্রবেশ মূল্য লাগবে না। মুখ তুলে মুসার দিকে তাকাল সে। পেলে কোথায় এটা?

সুপারমার্কেটে বিলি করছিল। অনেকটা জোর করেই তিনটে কপি গছিয়ে দিল আমার হাতে। যেন জানতই, আমরা তিনজন।

তাই নাকি! ইনটারেসটিং! আবার পড়তে লাগল কিশোর, পুরস্কার; উত্তর মেকসিকোর এক র‍্যাঞ্চে দুই হপ্তার চমৎকার একটা ছুটি কাটানো। প্রধান প্রধান আকর্ষণের মধ্যে থাকবে ঘোড়ায় চড়া, লেকে মাছ ধরা, ক্যাম্পিং, মুখরোচক মেকসিকান খাবার…

খাইছে, আর পড়ো না, এখনই জিভে পানি এসে যাচ্ছে! এই কিশোর, তোমার জন্যে তো ওটা কিছু না। করে ফেল না সমাধান। আমি শিওর ফার্স্ট প্রাইজটা তুমিই পাবে।

ভুরু নাচাল রবিন। ও পারলে তো ও যাবে। আমরা যাব কি করে?

ও সমাধান করলেই আমরাও দেখে দেখে বসিয়ে নেব। হয়ে যাবে।

কি জানি! হাত ওল্টাল রবিন। সবাইকে যেতে দিলে হয়। আমার বিশ্বাস, অনেকেই পারবে।

তোমার বিশ্বাস ভুল…

হাত তুলে বাধা দিল কিশোর, খালি তর্ক!

ট্রেলারের ছাতে বড় বড় ফোঁটা পড়ার আওয়াজ হলো।

মুখ বাঁকিয়ে মুসা বলল, মেকসিকোতে নিশ্চয় এরকম পচা আবহাওয়া নয়।

পুস্তিকার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। মুসার কথা কিংবা বৃষ্টির শব্দ ওর কানে ঢুকছে বলে মনে হলো না। পড়ল, লিখে জবাব দিলে চলবে না। টেপে রেকর্ড করে দিতে হবে। প্রথমে… থেমে গেল সে। দ্রুত চোখ বোলাল পাতার বাকি অংশটায়। তাজ্জব ব্যাপার!

কি? জানতে চাইল রবিন, এতে আবার অবাকের কি দেখলে?

পুস্তিকা ছাপাতে পয়সা লাগে, আনমনে বলল কিশোর, যেন নিজেকেই বলছে। আর মেকসিকোতে ছুটি কাটাতে যেতেও পয়সা লাগে। এরকম একটা প্রতিযোগিতার জন্যে কার এত টাকা খরচ করার ইচ্ছে হলো?

কোন ধরনের বিজ্ঞাপন হবে হয়তো, রবিন অনুমান করল। গানের কোম্পানিতে কাজ করে করে ব্যবসায়িক দিকটাই এখন বেশি নজরে পড়ে তার। আসলে ওরা চায় যাতে ধাঁধার জবাব দেয়ার জন্যে তুমি একটা টেপরেকর্ডার কিনতে বাধ্য হও। আর একটা ব্ল্যাংক ক্যাসেট।

মাথা আঁকাল কিশোর। কি জানি। তাহলে কোন্ স্টোর হতে কিনতে হবে সেটা বলল না কেন? কোন্ কোম্পানির জিনিস কিনতে হবে তা-ও বলেনি।

সুপারমার্কেটে লিফলেট বিলি করছিল যখন, মুসা বলল, হয়তো ওখানকারই কোন দোকানের হবে।

মাথা নাড়ল কিশোর। কোন কিছুই ভাল করে দেখ না তুমি। সুপারমার্কেটে ইলেক্ট্রনিকের দোকান কোথায়?

আবার পুস্তিকাটার দিকে তাকাল সে। বেড়াতে তার খারাপ লাগে না, তবে তার চেয়েও বেশি আকর্ষণ রহস্যের প্রতি। ধাঁধা পেলে তার জবাব না পাওয়া পর্যন্ত স্বস্তি নেই। কেবলই খচখচ করতে থাকল মনে, কে এত টাকা খরচ করছে? কেন?

অনেক লিফলেট হয়তো বিলি করেছে, কিশোর বলল। আর জবাব এতই সহজ অনেকেই সমাধান করে ফেলতে পারবে। সুতরাং অনেকেই মেকসিকো যাওয়ার সুযোগও পাবে। অন্তত আমরা তিনজন তো পাবই।

অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল রবিন। তার মানে তুমি এর জবাব দিচ্ছ!

কেন নয়? ভ্রূকুটি করল কিশোর। ড্রয়ার থেকে একটা টেপরেকর্ডার বের করল। একটা ব্ল্যাংক ক্যাসেট বের করে তাতে ঢোকাল। তারপর রেকর্ড করার বোতামটা টিপে দিয়ে বলতে শুরু করল সমাধান।

ঘণ্টাখানেক পর তিনটে ক্যাসেটে তিনজনের শুদ্ধ সমাধান রেকর্ড করে নিয়ে তিনটে খামে ভরে সান্তা মনিকার ঠিকানা লিখল, যে ঠিকানায় জবাব পাঠাতে বলা হয়েছে পুস্তিকায়। এক কোণে নিজেদের নাম-ঠিকানাও লিখল।

ট্রেলারের হাতে বৃষ্টির শব্দ থেমে গেছে।

জলদি চলো, তাগাদা দিল রবিন। পোস্ট করে দিয়ে আসি, আবার বৃষ্টি নামার আগেই।

পরদিন আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। আবার দেখা দিল ক্যালিফোর্নিয়ার স্বাভাবিক সূর্য। পরের তিনটে হপ্তা যার যার কাজে ব্যস্ত রইল তিন গোয়েন্দা।

রবিন তার চাকরিতে বাড়তি কাজ করল। দিনে বারো ঘণ্টা করে খাটতে হলো তাকে।

মুসা বাড়ির কাজ করল কিছু কিছু। তবে বেশির ভাগ সময়ই সাঁতার কাটল আর ফারিহার সঙ্গে আড্ডা মেরে বেড়াল। সেই সাথে চলল কারাতের প্র্যাকটিস।

আর কিশোর রইল স্যালভিজ ইয়ার্ডের কাজে ব্যস্ত। দিনে দশ-বারো ঘণ্টা খাটুনি।

একদিন বিকেলে ওয়ার্কশপে একটা নতুন ধরনের সিকিউরিটি ডিভাইস নিয়ে কাজ করছে সে, একটা তালা, ভয়েস অপারেটেড, সাঙ্কেতিক কথা বললে খুলবে। মুসাও আছে ইয়ার্ডে। ওয়ার্কশপের বাইরে ওর গাড়ি মেরামত করছে।

হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর, কুকুর হইতে সাবধান!

চমকে গেল মুসা। কি বললে?

কিছু না। বললাম, কুকুর হইতে সাবধান।

তালা খোলার কোডওয়ার্ড এটা। কিন্তু মুসা বুঝতে পারল না। কি যে বলো বলো! এখানে কুকুর দেখলে কোথায়?

জবাব দিতে যাচ্ছিল কিশোর, এই সময় টেলিফোন বাজল। ফিরেও তাকাল না। জানে, রবিন রয়েছে হেডকোয়ার্টারের ভেতরে। আরেকটা এক্সটেনশন সেট রয়েছে এখানে। রক কনসার্টের জন্যে লিফলেট তৈরি করছে রবিন। হতে পারে তার কোন বান্ধবী ফোন করেছে, কিংবা পরিচিত অন্য কেউ।

কয়েকবার বেজেই থেমে গেল রিঙ। মুসা আবার কাজে মন দিল।

খানিক পরেই বেরিয়ে এল রবিন। কিশোর, মেরিচাচী ফোন করেছেন।

আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়? কিছুটা অবাকই হলো কিশোর। আবার কাজ নয় তো? ইদানীং মেরিচাচীও কিশোরের বিশেষ ব্যবস্থায় যোগ দিতে আরম্ভ করেছেন। বুঝে গেছেন, অহেতুক অফিস থেকে বেরিয়ে কষ্ট করে হেঁটে না এসে ফোন করলেই হয়ে যায়। হেঁটে আসার আরেকটা কারণ অবশ্য ছিল, পয়সা বাঁচানো। বকেটকে ঠিক করেছে কিশোর। আবার কোন কাজ দেবে নাকি?

কে জানি এসেছে, তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়।

কে?

মিস্টার ডজ, হাসল রবিন। ওই ধাঁধা প্রতিযোগিতা যেটায় দিয়েছিলে তার ব্যাপারে কিছু বলবে।

তাই? কৌতূহলী হলো গোয়েন্দাপ্রধান। প্রতিযোগিতার কথা ভোলেনি। তবে কাজ নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল, ও ব্যাপারে খোঁজ নিতে পারেনি আর। এখন সুযোগ এসেছে। হয়তো জানতে পারবে এত টাকা খরচ করে মেকসিকোতে পাঠাতে কার এমন দায় পড়েছে।

ওরা ঠিক করল, তিনজনেই যাবে মিস্টার ডজের সঙ্গে দেখা করতে। বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে, এই সময় বারান্দায় বেরিয়ে এলেন একজন মানুষ। লম্বা, ছিপছিপে। পরনে জিনস, মাথায় একটা দামি স্টেটসন হ্যাট সামান্য কাত করে বসানো।

তিন গোয়েন্দাকে এগোতে দেখে হাত তুলে নাড়লেন। হাই, আমি ডজ মরিস। ওরা কাছে গেলে একে একে তাকালেন সবার মুখের দিকে। তারপর বললেন, কার কি নাম? না না, রাখ, দেখি আমিই আন্দাজ করতে পারি কিনা? মুসার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। দেখি, কণ্ঠস্বর শোনাও তো তোমার?

আমি মেকসিকো যাব! বলল মুসা। কি জানি কেন ডজকে পছন্দ করতে পারছে না। পিজা খাব!

রবিনের দিকে তাকালেন ডজ। তোমার?

আমার যেতে বড়ই অসুবিধে। অফিসে অনেক কাজ।

মাথা ঝাঁকালেন ডজ। জোর করেই যেন হাসলেন। তারপর তাকালেন কিশোরের দিকে।

কিশোরও তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। লোকটার ব্যাপারে তার প্রথম ধারণাঃ একটু যেন অস্বাভাবিক। হাসি, ভাবভঙ্গি সবই কেমন যেন মেকি মেকি।

এবার তোমার গলা শোনাও? কিশোরকে বললেন ডজ।

মেকসিকো যেতে চাই, কিশোর বলল।

চকচক করে উঠল ডজের চোখ। উত্তেজনা ফুটল চেহারায়। এগিয়ে এসে হাত মেলালেন কিশোরের সঙ্গে।

ডজ বললেন, ধাঁধা প্রতিযোগিতায় তুমিই জিতেছ। আমার র‍্যাঞ্চেও যেতে পারবে তুমি।

কিশোর ভাবছে মেকসিকান র‍্যাঞ্চে যাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে আছে একথাটা সহজে বুঝতে দেয়া চলবে না লোকটাকে। তার আগে কিছু প্রশ্নের জবাব জানা সরকার। বলল সেকথা।

কি জানতে চাও? বলে ফেল।

আর কজন জিতেছে এই পুরস্কার?

শুধু তুমি। একলা।

তারমানে শুধু আমিই ঠিক জবাব দিয়েছি?

দ্বিধা করলেন ডজ। হ্যাঁ।

চিন্তিত ভঙ্গিতে লোকটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। বুঝতে পারছে। মিথ্যে কথা বলছেন ডজ। ওর মত একই জবাব পাঠিয়েছে মুসা আর রবিন। তাহলে শুধু তাকেই বিজয়ী ঘোষণা করছেন কেন তিনি?

টাকা আসছে কোত্থেকে? জানতে চাইল সে। এসবের খরচ দেবে কে?

আমি!

কেন?

বিজ্ঞাপনের জন্যে। আমার র‍্যাঞ্চের বিজ্ঞাপন। হ্যাটটা খুলে নিয়ে আবার মাথায় পরলেন ডজ। আত্মবিশ্বাসে ভরা কণ্ঠ। আমার জায়গাটাকে আমি একটা সামার ক্যাম্প বানাতে চাই, যাতে তোমাদের মত সৌখিন টুরিস্টরা গিয়ে বাস করতে পারে। আর এই প্রতিযোগিতাটা সম্পর্কে সানডে পেপারে ভাল একটা আর্টিকেল ছাপতে চাই।

এতক্ষণে বিশ্বাস করার মত একটা যুক্তি শুনল কিশোর। তবে পুরোপুরি নয়।

আরেকটা প্রশ্ন করতে যাবে, এই সময় নীল রঙের একটা শেভ্রলে গাড়ি দেখল ইয়ার্ডের গেটে। কিশোর মনে করল ঢুকবে, কিন্তু ঢুকল না ওটা। মুহূর্তের জন্যে গতি কমিয়েই আবার বাড়িয়ে চলে গেল। উইন্ডশিল্ডে রোদ পড়েছিল বলে ড্রাইভারকে ভালমত দেখতে পায়নি সে। মনে হলো, একজন মহিলা। সোনালি চুল, চোখে কালো কাচের চশমা। গত দশ-পনেরো দিনে ওই গাড়িটাকে আরও কয়েকবার দেখেছে সে।

আবার ডজের দিকে ফিরল সে। ঠিক আছে, আপনার পুরস্কার আমি গ্রহণ করলাম। কিন্তু একটা কথা। আমার এই দুই বন্ধুকে সাথে নিতে পারব?

ভ্রূকুটি করলেন ডজ। তার মানে ওদের খরচও আমাকে দিতে বলছ?

বলছি, দৃঢ়কণ্ঠে বলল কিশোর।

মাথা থেকে হ্যাটটা খুলে নিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে কানা মোচড়াতে শুরু করলেন ডজ। পায়ের ওপর শরীরের ভার বদল করলেন। তাকিয়ে রয়েছেন জুতোর দিকে। তারপর মুখ তুলে হাসলেন। বেশ, যাবে ওরাও।

খটকা লাগল কিশোরের। এত সহজে রাজি হয়ে গেলেন ভদ্রলোক! যেন তৈরি হয়েই এসেছেন, কিশোরকে নিতে হলে তার দুই সহকারীকেও নিতে হবে। মুসার কথা মনে পড়লঃ অনেকটা জোর করেই তিনটে কপি গছিয়ে দিল আমার হাতে! ব্যাপার কি!

দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার একটা ম্যাপ দিলেন ওদেরকে ডজ। তার র ্যাঞ্চের কাছাকাছি শহর লারেটোতে কি করে যেতে হবে বলে দিলেন। ছশো ডলার কিশোরের হাতে দিলেন, ওদের রাহা খরচের জন্যে। নিজের ফোন নম্বর দিলেন যাতে সীমান্ত পার হয়েই তাকে ফোন করে জানাতে পারে। ওদেরকে তখন লারেটো থেকে তুলে নিতে পারবেন।

গাড়িতে গিয়ে উঠলেন ডজ। মেকসিকোর নম্বর প্লেট লাগানো। গাড়িটা চেনা চেনা লাগল মুসার। আগেও যেন কয়েকবার দেখেছে। কোথায়? মনে পড়ে গেল। সুপারমার্কেটে একবার। আর একবার দেখেছে ইয়ার্ডের গেটে। সেকথা বলল কিশোরকে।

পরদিন সকালে অন্যান্য দিনের মতই ইয়ার্ডের ডাকবাক্স খুলল কিশোর। চিঠিপত্র কি এসেছে বের করতে গিয়ে দেখল একটা ম্যানিলা খামও রয়েছে। ভেতরে শক্ত চারকোণা একটা জিনিস। ঠিকানায় তার নাম লেখা। ডাক টিকেট নেই। তার মানে ডাকে আসেনি খামটা, কেউ এসে ঢুকিয়ে রেখে গেছে।

হেডকোয়ার্টারে এনে খামটা খুলল সে। একটা ক্যাসেট। আর কিছু নেই। লেবেলে এমন কিছুই লেখা নেই যা দিয়ে বোঝা যায় কি রেকর্ড করা রয়েছে টেপে।

একটা টেপ রেকর্ডারে ভরে বোতাম টিপল সে। নীরবে ঘুরতে লাগল টেপ। অনেক পরে কথা বলে উঠল একটা শান্ত কণ্ঠঃ মেকসিকোতে এসো না, প্লীজ! মারাত্মক বিপদে পড়বে তাহলে! ক্যালিফোর্নিয়াতেই থাকো…

হঠাৎ করেই নীরব হয়ে গেল কণ্ঠটা।

পুরো টেপটা চালিয়ে দেখল কিশোর। আর কোন কথা নেই।

চেয়ারে হেলান দিল সে। মেসেজটা ভাবনায় ফেলে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। তবে আরেকটা ব্যাপার খচখচ করছে ওর মনে। কণ্ঠস্বর চেনা চেনা লাগল। আগে শুনেছে। কোথায়, মনে করতে পারল না।

কয়েক মিনিট পরে মুসা এসে হাজির। ওকে টেপটার কথা বলল কিশোর। আবার চালিয়ে দিল ওটা।

কিশোরকে অবাক করে দিয়ে হাসতে লাগল মুসা। কেউ মজা করেছে তোমার সঙ্গে। রসিকতা।

রসিকতা?

হ্যাঁ। কেন, নিজের কণ্ঠস্বর চিনতে পারছ না?

নিজের কণ্ঠস্বর? অবাক হলো কিশোর।

হ্যাঁ, অবিকল তোমার নিজের কণ্ঠ। নকল করেছে কেউ। তুমি যেভাবে অন্যেরটা নকল করো। এ এক মস্ত রসিকতা।

আমার কণ্ঠ!

ইচ্ছে হলে বাজি ধরতে পারো। আমার গাড়িটা ধরতে রাজি আছি আমি।

জানালার কাছে বসেছে কিশোর। পুরানো বাসটা যেন গড়াতে গড়াতে চলেছে মেকসিকোর ভেতর দিয়ে। বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে।

প্রথমে ভেবেছিল, মুসার গাড়িতে করেই আসবে। কিন্তু পরে বাদ দিতে হলো ইচ্ছেটা, যখন শুনল মেকসিকোতে পেট্রল পাওয়া কঠিন।

নতুন একটা টী-শার্ট পরেছে সে। তাতে বড় বড় করে স্প্যানিশে লেখা রয়েছেঃ হ্যালো, আয়্যাম ফ্রেন্ডলি। সে আশা করছে এতে লোকে তার প্রতি আগ্রহ দেখাবে, স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলবে, যে ভাষাটা মোটামুটি বুঝতে পারে সে। বলতেও পারে কিছু কিছু।

শক্ত প্রাস্টিকের সীট। শরীর বাঁকিয়ে পেছনে ঘুরে তাকাল সে। অন্য দুজন কি করছে দেখার জন্যে। মেকসিকোর ইতিহাসের ওপর একটা বই পড়ছে রবিন। ওর পাশে বসে আছে অল্প বয়েসী একটা সুন্দরী মেকসিকান মেয়ে। বার বার রবিনের দিকে তাকাচ্ছে। একা চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছে মনে হয়। সে চাইছে রবিন পড়া থামিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলুক।

দুটো সীটের মাঝখানে ফাঁক খুব কম। মুসার লম্বা পা ঠিকমত জায়গা হয় না। কোনমতে গুটিয়ে নিয়ে বসেছে, তাতে বেশ অস্বস্তিই লাগার কথা। কিন্তু কেয়ার করছে না যেন সে। ঘুমিয়ে পড়েছে।

ওরা দুজনেও টী-শার্ট পরেছে। মাগনা পেয়েছে রবিন। রক গ্রুপকে এই শার্টই সরবরাহ করেছে ওর কোম্পানি। রবিনেরটায় লেখা দ্য সারভাইভারস ও মুসারটায় লেখা ওয়াইল্ড ওয়েস্ট।

রবিনের পেছনে বসা মাঝারি বয়সের এক মহিলা। বাসের অন্য সব মেকসিকান মহিলা যাত্রীর সঙ্গে কোন তফাৎ নেই ওর। বাদামী চামড়া। সুতীর ব্লাউজ গায়ে দিয়েছে, উলের স্কার্ট। লাল একটা শাল দিয়ে মাথা ঢেকেছে, দুই পাশ ছড়িয়ে আছে দুই কাঁধে। কালো চুলের লম্বা লম্বা দুটো বেণি। সান্তা মনিকায় বাসে ওঠার সময়ই মহিলাকে দেখেছে কিশোর। এর পর দুবার বাস বদল করতে হয়েছে। মহিলা রয়েছে ওদের সঙ্গেই।

অবশেষে বই রেখে পাশের মেয়েটার সঙ্গে কথা আরম্ভ করল রবিন। ইংরেজি জানে মেয়েটা। ফলে কথা বলা সহজ হলো। আমি স্প্যানিশ ভাল বলতে পারি না, বলল সে। এই বুয়েনাস ডায়াস-টায়াস জাতীয় দুএকটা শব্দ।

মেকসিকো কেমন লাগছে? জিজ্ঞেস করল মেয়েটা।

মনে হয় ভালই হবে। আগেও যে এখানে এসেছে, সে কথা বলল না রবিন।

এরকম মনে হওয়ার কারণ?

ইয়ে… বলতে গিয়ে থেমে গেল রবিন। ভেবে নিয়ে বলল, আমেরিকায় প্রায়ই মেকসিকান স্ট্রীট মিউজিকের সুনাম শুনি। খুবই নাকি ভাল।

শুধু মিউজিকের জন্যেই? হাসল মেয়েটা। আর কিছু না?

আরও অনেক কিছু। বলবে কিনা দ্বিধা করছে রবিন। এই যেমন, মরুভূমি। চলতে চলতে হঠাৎ থেমে যাচ্ছে বাস। লোকজন নামছে। তারপর যেন নির্জন অঞ্চলে হঠাৎ করেই গায়েব হয়ে যাচ্ছে। একেবারে নো ম্যানস ল্যান্ডের মাঝে। অবাক লাগে। এই মরুভূমির মাঝে কোথায় যায়?

যার যার খামারে। কাউকে কাউকে পাঁচ মাইল কিংবা তারও বেশি হাঁটতে হয় বাস থেকে নামার পর।

এতো! অথচ দেখে মনে হয় যেন এই মিনিট পাঁচেকের পথ হাঁটতে যাচ্ছে। হাসিমুখে নামছে বাস থেকে। দিব্যি চলে যাচ্ছে, যেন কিছুই না।

আসলে তা নয়। মরুভূমির ভেতরে হাঁটাটা সত্যিই কঠিন। তবে আমেরিকানদের মত মুখ গোমড়া করে রাখে না মেকসিকানরা। হাসিখুশি থাকতেই পছন্দ করে।

ছোট একটা শহরে ঢুকে একটা দোল দিয়ে থেমে গেল বাস। ম্যাপ দেখল কিশোর। তারপর ফিরে তাকিয়ে মুসা আর রবিনকে ইশারা করল। আবার বাস বদলাতে হবে।

মেকসিকান মেয়েটাকে গুড বাই জানিয়ে র্যাক থেকে ব্যাগ নামাল রবিন।

ব্যস্ত রাস্তার ছোট একটা কাফের সামনে বাস স্টেশন। বেরিয়েই কাফেটাতে ঢুকে পড়ল তিন গোয়েন্দা।

আমার যা খিদে পেয়েছে না! একটা টেবিলে বসতে বসতে মুসা বলল।

সে আর রবিন খাবারের তালিকা ভাল করে দেখেশুনে অর্ডার দিল বীফ বুরিটুস উইথ রাইস অ্যান্ড বীন। এই খাবারগুলো তেমন ভাল লাগে না কিশোরের। সে অর্ডার দিল দুটো চিকেন টাকোর। কিন্তু খাওয়ার পর বুঝতে পারল ভুলটা কি করেছে।

বাপরে বাপ! কাফে থেকে বেরোনোর সময় বলল কিশোর, আগুন লাগিয়ে দিয়েছে জিভে। এত্তো ঝাল! মরিচ গুলে দিয়েছে!

বাসের দিকে এগোচ্ছে, হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়াল চামড়ার ছেড়া জ্যাকেট পরা এক লোক। লম্বা, ভারি শরীর, বয়েস বিশ হবে। কিশোরের বুকে ধাক্কা দিয়ে কর্কশ কণ্ঠে স্প্যানিশে বলল, যাচ্ছ কোথায়? বাসে জায়গা নেই।

অবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল তিন গোয়েন্দা। লোকটাকে আগেই দেখেছে। তখন তো বেশ আন্তরিক মনে হয়েছিল। এখন এরকম আচরণ করছে। কেন?

কিশোর দেখতে পাচ্ছে, বাসের অর্ধেক সীটই খালি। ভদ্র ভাবে সেকথা বলল লোকটাকে।

একটুও নরম হলো না লোকটা। বরং আরও জোরে ধাক্কা লাগাল, না, হবে না। বাসে উঠতে পারবে না। চলে যাও এখান থেকে। আমেরিকায় ফিরে যাও, তিনজনেই। তোমাদেরকে এখানে চাই না আমরা।

কিন্তু আমরা যাচ্ছি না, দৃঢ় কণ্ঠে বলল কিশোর। আমি ওই বাসে উঠবই। দয়া করে সামনে থেকে সরুন।

সরা তো দূরের কথা, কিশোরের কাঁধ খামচে ধরল লোকটা। ভাল চাইলে, কেটে পড়। নইলে বিপদ হবে বলে দিলাম।

কয়েক হপ্তা ধরে জুডোর প্র্যাকটিস বেশ জোরেশোরে চালিয়েছে কিশোর। অনেক দক্ষ হয়ে উঠেছে। কিন্তু তবু মনে হলো, বিশালদেহী এই মেকসিকানটার সঙ্গে জুডো খাটিয়েও পেরে উঠবে না। সে কিছু করার আগেই এক ঘুসিতে তার দাঁত ভেঙে দেবে লোকটা। এক ঝাড়া দিয়ে দ্রুত পিছিয়ে এল কিশোর, লোকটা ঘুসি মারলেও যাতে তার মুখে লাগাতে না পারে।

চুপ করে সব দেখছিল এতক্ষণ মুসা। চট করে এখন পাশে চলে এল কিশোরের। কি, হচ্ছেটা কি? লোকটা যে ওদেরকে বাসে উঠতে দিতে চায় না একথা মুসাকে বলল কিশোর।

কেন?

কি জানি। হয়তো আমেরিকানদের পছন্দ করে না।

ও, তাই। কিন্তু আমরা যে সব বলে ঠিক করেছি। বলে দাও ওকে।

ঘুসি মেরে বসল লোকটা। লাগলে চিত হয়ে যেত মুসা। কিন্তু চোখের পলকে সরে গেল সে। পরক্ষণেই আঘাত হানল, কাঁধের সামান্য নিচে, কারাতের শুটোউচি। আরেকটা ঘুসি মারার জন্যে তৈরি হচ্ছিল লোকটা, তার আগেই অবশ হয়ে গেল তার কাঁধের কাছটা। প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়া মানুষের মত ঝুলে পড়ল তার হাত চেপে ধরল আহত স্থান। মুসার মুখের দিকে তাকাল।

অপেক্ষা করছে মুসা। সামান্য বাঁকা করে রেখেছে পা। দুই হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়েছে, হাতের আঙুল একদম সোজা।

অবাক হয়ে গেছে মেকসিকান লোকটা। আহত জায়গায় হাত চেপেই রেখেছে। তারপর কয়েক ডলা দিয়ে যেন সেখানে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালাল।

ডান হাতটা উঁচু করল মুসা। লোকটা আগে বাড়লেই কারাতের কোপ মারবে।

মাথা নাড়ল লোকটা। বিড়বিড় করে বলল, অনেক হয়েছে। ঘাড় মটকে আর মারা পড়তে চাই না! বাপরে বাপ! দশ লাখ পেসো দিলেও না!

মাথা নাড়তে নাড়তেই সরে পড়ল সে।

হেঁচকি উঠল কিশোরের। হেসে ফেলল রবিন আর মুসা। লাল হয়ে গেল কিশোরের গাল।

কী? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল রবিন, চিকেন টাকো পেটেও আগুন লাগিয়েছে? খাও আরও।

এই চলো, তাগাদা দিল মুসা। আমাদের বাস রেডি।

বাসে উঠল তিন গোয়েন্দা। কাফেতে সেই লাল শাল পরা মহিলাকে দেখা যায়নি। বাসে উঠে দেখা গেল পেছনের সীটে বসে আছে।

পার্স থেকে কয়েকটা নোট বের করে জানালা দিয়ে বাড়িয়ে দিল। বাদামী একটা হাত দেখতে পেল তিন গোয়েন্দা। পলকের জন্যে চোখে পড়ল পুরানো চামড়ার জ্যাকেটের হাতা।

ওরা সীটে বসতে না বসতেই চলতে শুরু করল বাস।

দীর্ঘ যাত্রার এটাই শেষ পর্যায়। একসময় ঢুলতে শুরু করল তিন গোয়েন্দা। অস্বস্তিকর তন্দ্রা। সারাটা রাতই কাটল প্রায় এই অবস্থায়। জায়গায় জায়গায় পথ ভীষণ খারাপ। ঘুমানো অসম্ভব।

সকাল নটার দিকে লারেটোতে পৌঁছল বাস। গাছে ঘেরা একটা ছোট চত্বরে একসারি বেঞ্চ রাখা, ওটাই বাস স্টেশন।

সীমান্ত পার হয়েই ডজকে ফোন করেছিল কিশোর। বাস থেকে নেমে দেখল, তিনি দাঁড়িয়ে আছেন জীপ নিয়ে। ওদেরকে দেখে খুশি হয়েছেন, তবে বেশ অস্থির। অবাকই লাগল তিন গোয়েন্দার। ওরা গাড়িতে ব্যাগ তোলার সময় বারবার বলতে লাগলেন, র‍্যাঞ্চে পৌঁছতে দেরি হবে না। কিশোরের মনে হলো, ওদেরকে নয়, নিজেকেই বোঝাচ্ছেন যেন।

চত্বর থেকে বেরিয়েই পেছনে তাকাল কিশোর। আছে। একটা সাইডওয়াকের ওপর দাঁড়িয়ে জীপটার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে লাল শাল পরা মহিলা। ওর উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল কিশোর। তবে মহিলা তার জবাব দিল না।

তাতে কিছু মনে করল না কিশোর। এটাই বরং স্বাভাবিক। কয়েক হাজার পেসো খরচ করেছে মহিলা, সেই মেকসিকান লোকটাকে দিয়েছে ওদেরকে ঠেকানোর জন্যে। পুরো টাকাটাই জলে গেছে। ঠিকই লারেটোতে পৌঁছেছে তিন গোয়েন্দা।

র‍্যাঞ্চে পৌঁছতে দুই ঘণ্টা লাগল।

এঁকেবেঁকে, কখনও ঘুরে ঘুরে চলে গেছে পাহাড়ী পথ। পাহাড়ের ঢাল বনে ছাওয়া। সামনে, দূরে একসারি উঁচু পর্বত। ডজ জানালেন, ওটাই সিয়েরা মাদ্রে।

টেলিভিশনে দেখা পুরানো একটা সিনেমার কথা মনে পড়ল রবিনের। হেসে জিজ্ঞেস করল সে, ওই সিয়েরা মাদ্রে পর্বতেই হামফ্রে বোগার্ট আর তার সাথীরা গুপ্তধন খুঁজতে গিয়েছিল, তাই না?

রবিনের কথায় কেন যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন ডজ। মাথা নেড়ে বললেন, দ্য ট্রেজার অভ সিয়েরা মাদ্রে শুধুই একটা ছবি। সত্যি নয়। ওই পর্বতে গুপ্তধন নেই।

চট করে পেছনের সীটে বসা মুসার দিকে তাকাল রবিন।

এর খানিক পরেই র‍্যাঞ্চে পৌঁছল ওরা। কাঠের তৈরি লম্বা, নিচু একটা বাড়ি। চারপাশের খোলা প্রান্তর ঢালু হয়ে নেমে গেছে একটা লেকের ধারে। মাঠে কয়েকটা ঘোড়া চরছে, এছাড়া জীবনের আর কোন চিহ্নই নেই কোথাও।

লেকের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা। দুই-তিন মাইল লম্বা আর আধমাইল মত চওড়া হবে লেকটা, আন্দাজ করল সে। ভাবল, মাছ ধরার চমৎকার জায়গা। সাথে করে ছিপ নিয়ে আসায় ভালই হয়েছে। লেকের অন্যপাশে আর কোন বাড়ি-ঘর নেই। কেবল গাছের জটলা। তবে গাছপালার ওপাশে পুরানো একটা বাড়ির টাওয়ার চোখে পড়ছে। গির্জা হতে পারে, কিংবা দুর্গ। হয়তো মানুষ বাস করে ওখানে।

ডজের পিছু পিছু বারান্দায় উঠল ওরা। বড় একটা ঘরে ঢুকল। ফায়ারপ্লেস আছে। আরাম করে বসার জন্যে আছে অনেকগুলো চেয়ার।

খিদে পেয়েছে নিশ্চয়? জিজ্ঞেস করলেন ডজ।

একেবারে মনের কথাটা বলে ফেলেছেন, মুসা বলল।

হাত তালি দিল ডজ। সঙ্গে সঙ্গে এসে ঢুকল একজন মেকসিকান লোক।

ওর নাম পিরেটো, ডজ জানালেন। আমার বাবুর্চি। তিন গোয়েন্দার নাম ধরে ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কোন প্রয়োজনই বোধ করলেন না যেন।

পিরেটোর বয়স পঞ্চাশের মত। গাট্টাগোট্টা শরীর। বাদামী মুখের চামড়ায় অসংখ্য ভাঁজ, লম্বা কালো চুল। গায়ে ডেনিম শার্ট, পরনে জিনস, পায়ে কাউবয় বুট। বাবুর্চি না হয়ে র‍্যাঞ্চ হ্যান্ড বা রাখাল হলেই যেন বেশি মানাত তাকে, ভাবল কিশোর।

দ্রুত স্প্যানিশ ভাষায় লোকটাকে নির্দেশ দিতে লাগলেন ডজ। নাস্তা আর এক্ষুণি শব্দ দুটো বুঝতে পারল কিশোর।

মাথা ঝাঁকাল পিরেটো। চোখের মণি বাদামী, তবে এতটাই গাঢ়, প্রায় কালোই মনে হয়। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করল রবিন, কথা বলার সময় ডজের দিকে সরাসরি তাকায় না। কেমন যেন একটা এড়িয়ে চলার প্রবণতা। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রক গায়কের মাঝে যেমন থাকে অনেকটা তেমনি।

ভাল বাবুর্চি পিরেটো। মুসা আর কিশোর শুয়োরের মাংস খায় না, জেনে গেছে। তাই গরুর মাংস ভাজা করে আনল। সেই সঙ্গে প্রচুর ডিম আর গরম গরম রোল।

লম্বা টেবিলটার মাথায় তিন গোয়েন্দার সঙ্গে বসলেন ডজ, তবে খেলেন না কিছু। কাঁটা চামচ দিয়ে একটা রোলকে খোঁচাতে থাকলেন নার্ভাস ভঙ্গিতে। তিন গোয়েন্দার খাওয়া শেষের অপেক্ষা করছেন, যেন কিছু বলার জন্যেই। কিছু একটা ভাবিয়ে তুলেছে মনে হয় তাকে।

পেট ভরল? মুসাকে শেষ টুকরোটা মুখে পুরতে দেখে বললেন তিনি।

বোঝাই হয়ে গেছে। দারুণ লাগল।

উঠে দাঁড়ালেন ডজ। এসো তোমাদেরকে র‍্যাঞ্চটা দেখাব।

বাইরে বেরিয়ে দ্রুত একটা বেড়ার কাছে নিয়ে এলেন ওদেরকে। অনেকখানি জায়গা ঘিরে বেড়া দেয়া হয়েছে। মাঠের এক ধারে ছোট একটা কাঠের ছাউনি।

এসো, আমার বারো দেখাব। ওদের মতামতের অপেক্ষা না করেই ছাউনিটার দিকে এগিয়ে গেলেন ডজ। ওটার কাছে পৌঁছার আগেই ছাউনি থেকে বেরিয়ে এল একটা গাধা, মেকসিকানরা বলে বারো। বেরিয়েই ওদেরকে দেখে থমকে গেল, তারপর যেন লজ্জা পেয়েই ওদের কাছ থেকে সরে গেল।

মেরুদন্ডের ওপর দিয়ে কালো একটা দাগ গিয়ে কাঁধের কাছটায় ছড়িয়ে পড়েছে জানোয়ারটার। চামড়াটাকে প্রায় সাদাই বলা চলে। বড় বড় কান, লম্বা লেজের মাথায় চুলের ঘন গোছা। সামনের একপায়ে দড়ি বাঁধা। সেটা ছুটিয়ে পালানোর চেষ্টা করল।

যে-কোন পোষা জানোয়ার মুসার পছন্দ। গাধাটাকে আদর করার জন্যে এগোতে গেল সে। থামিয়ে দিলেন ডজ। ছুঁয়ো না। বয়স একেবারেই কম, বড়জোর দুবছর। পোষ মানেনি এখনও।

কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে মাটিতে পা ঠুকছে গাধাটা। এলোপাতাড়ি কয়েকবার পেছনের পা ছুঁড়ে যেন বুঝিয়ে দিতে চাইল কাছে গেলে ভাল হবে না।

অনেক বুনো গাধা আছে এখানকার পাহাড়ে, ডজ জানালেন। মাস দুই আগে আমার মাঠে ঢুকে পড়েছিল ওটা। ধরে ফেললাম। ওর নাম রেখেছি শারি। মুসার দিকে তাকালেন তিনি। নাম ধরে ডেকে দেখ। বলো, এদিকে এসো, শারি। দেখ কি করে।

ব্যাপারটা কি? ওদেরকে শিশু মনে করছেন নাকি ডজ? এমন ভাবে কথা বলছেন! তবে যেহেতু জানোয়ারটাকে ভাল লেগেছে তার, ডজের কথামত ডাক দিয়ে বলল, এখানে এসো, শারি। এসো।

লম্বা কানদুটোকে পেছন দিকে শুইয়ে ফেলল শারি। প্রায় ঘাড় ছুঁয়েছে কানের ডগা। ঘোড়ার স্বভাব জানা আছে মুসার। তা থেকেই আন্দাজ করল, সতর্ক হয়ে উঠেছে গাধাটা কিংবা রেগে গেছে। আরেকবার ডাকল নাম ধরে। কাছে তো এলই না, আরেকটু সরে গেল ওটা, দড়ি লম্বা হলে আরও সরত।

তুমি ডাকো, রবিনকে বললেন ডজ।

কি হবে ডেকে? এসব ছেলেমানুষী ভাল লাগছে না রবিনের। বললে আরও সরে যেতে চাইবে।

তা ঠিক। হাসলেন ডজ। কিশোরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ডাকবে?

শারির আসা-যাওয়া নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই কিশোরের। এলেই বা কি, না এলেই কি? কিন্তু যে ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন ডজ, কৌতূহল হল তার।

বিরক্তি চেপে জোরে ডাক দিল কিশোর, এদিকে আয়, শারি।

অদ্ভুত কান্ড করল শারি। ঝটকা দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল এদিকে। সরাসরি কিশোরের দিকে। একবার কেঁপে উঠল কানের ডগা। সামনের দিকে বাড়িয়ে দিল।

খাইছে! কান্ডটা কি হলো?

আবার! ফিসফিসিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন ডজ। আবার ডাকো!

আগ্রহী হয়ে উঠেছে কিশোর। আবার ডাক দিল, এদিকে আয়, শারি!

দড়ি বাঁধা পা দিয়ে বাতাসে লাথি মারল শারি, দড়িটা খুলে ফেলার চেষ্টা করল। তারপর দৌড়ে এল কিশোরের দিকে। ফুটখানেক দূরে এসে দাঁড়িয়ে গেল। গলা লম্বা করে নাক দিয়ে আলতো গুতো দিল ওর বুকে।

তোমার প্রেমে পড়ে গেছে! মেয়ে, গাধা তো! হেসে কিশোরের কাঁধে চাপড় মারল রবিন। কেমন লাগছে, কিশোর? মাত্র তিনটে শব্দ ব্যবহার করলে। আর জলজ্যান্ত একটা গাধাকে পটিয়ে ফেললে।

পিছিয়ে গেল কিশোর। গাধাটার এই আচরণ অবাক করেছে ওকে। রবিনের কথায় লজ্জা পেয়েছে।

আদর করো ওকে! কিশোরের হাত চেপে ধরল ডজ, যাতে সরে যেতে না পারে। দেখ, কি করে?

প্রচন্ড কৌতূহল চাপতে পারল না কিশোর। আস্তে করে হাত বুলিয়ে দিল শারির মাথায়। ঝট করে কান সোজা করে ফেলল গাধাটা। আবার কিশোরের বুকে নাক ঘষল।

চওড়া হাসি ছড়িয়ে পড়েছে ডজের মুখে। যেন এইমাত্র বিরাট অঙ্কের একটা বাজি জিতে গেছেন, এমনি ভাবভঙ্গি। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কিশোরকে অবাক করে দিয়ে বললেন, নাহ, আর কোন সন্দেহ নেই আমার! আমি এখন শিওর, ও তোমাকে পিঠে চড়তে দেবে। যাও। ওঠো। বয়েস কম হলে কি হবে, যা শক্তি আছে তোমার মত একজন মানুষকে সহজেই বইতে পারবে। সাধে কি আর বলে ভারবাহী গাধা। এমন ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেন তিনি, যেন মস্ত এক দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পেয়েছেন।

দ্বিধা করছে কিশোর। গাধার পিঠে চড়ার আগ্রহ নেই। কিন্তু ডজের অতি আগ্রহ অসংখ্য প্রশ্নের ভিড় জমিয়েছে ওর মনে। কিছু একটা ব্যাপার নিশ্চয় রয়েছে এসবের পেছনে। গোয়েন্দা হিসেবে এখন তার উচিত সমস্ত সূত্র খতিয়ে দেখা।

ডান পা তুলে দিয়ে লাফিয়ে গাধার পিঠে চড়ে বসল সে। ঘাড় বাঁকা করে বড় বড় কোমল চোখ মেলে ওকে দেখার চেষ্টা করল শারি। টান টান হয়ে গেছে কান, খাড়া হয়ে আছে মাথার ওপর। সওয়ারি হিসেবে কিশোরকে নিতে মনে হয় আপত্তি নেই তার।

হ্যাঁ, এবার চলতে বলো। ফিসফিস করে শিখিয়ে দিলেন ডজ। গলায় উত্তেজনা।

হঠাৎই কথাটা মনে পড়ে গেল কিশোরের। প্রকাশ করল না সেটা। চলতে বলল গাধাটাকে।

টলমল পায়ে আগে বাড়ল ওটা। জিন, লাগাম কিছুই নেই। শারির গলা জড়িয়ে ধরে রাখতে হলো কিশোরকে, যাতে পড়ে না যায়। একটা সূত্র ধরিয়ে দিয়েছেন তাকে ডজ। মেকসিকোতে তো বটেই, আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলেও কাউবয়রা ঘোড়া চালানোর সময় কিছু বিকৃত শব্দ ব্যবহার করে, যেমন, চলতে বললে বলে গিডিআপ, আর থামতে বললে হুয়া। সেটাই পরখ করে দেখার ইচ্ছে হলো তার। কয়েক কদম এগোতেই বলল সে, হয়া, শারি, হয়া!

সঙ্গে সঙ্গে আদেশ পালন করল গাধাটা। থেমে গেল।

বাহ! এগিয়ে এলেন ডজ। কিশোরকে গাধার পিঠ থেকে নামতে সাহায্য করলেন। চমৎকার শিখে ফেলেছ তো তুমি। গাধাটাকেও পোষ মানিয়ে ফেলেছ।

হ্যাঁ, মুসা বলল। মানুষ, জানোয়ার সব কিছুকেই পোষ মানাতে ওস্তাদ কিশোর পাশা। ও যে কোন কাজটা পারে না, সেটাই বুঝি না মাঝে মাঝে।

মজার কান্ড করল, ডজের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর। ভুল করে হয়তো আমাকে অন্য কেউ ভেবেছে শারি, যার কথা সে শোনে।

তা কি করে হয়? মাথা নাড়লেন ডজ। এখানে যখন এসে ঢুকল, পুরোপুরি বুনো ছিল শারি। সারা জীবনে কেবল দুজন লোককে দেখেছে। আমাকে, আর পিরেটোকে।

কিন্তু আপনাদের দুজনের কারও মতই দেখতে নই আমি। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল গোয়েন্দাপ্রধান। জটিল কোন ভাবনা মাথায় ঢুকলেই মাঝে মাঝে এই কাজটি করে সে। তার ধারণা এতে তার ভাবনার একাগ্রতা আসে।

আধঘণ্টা পরে যখন বিশাল ঘরটায় এসে বসল, তখনও চিমটি কাটা বন্ধ হলো না তার। রবিন আর মুসাও বসেছে ওর সঙ্গে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল সে, মাঠের ধারের ছাউনিটার দিকে। বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে আছে সাদা গাধাটা। এদিকেই তাকিয়ে রয়েছে জানোয়ারটাও। আস্তে করে ডাক দিচ্ছে, যেন চাইছে কিশোর গিয়ে আবার তাকে আদর করুক।

শারি! ছিপটা জোড়া লাগাতে লাগাতে আচমকা চিৎকার করে উঠল মুসা। ঠিক, মনে পড়েছে। শারি হলো গিয়ে ড্যাগউডের স্ত্রীর নাম! যে ধাঁধাটার সমাধান করেছিলে সেদিন, তাতে একটা জবাব ছিল, শারি।

তা ছিল, সায় দিয়ে বলল কিশোর। তবে শুধু শারিই নয়। আরও কিছু জবাব ছিল ওটাতে। আরও সূত্র।

আর কি সূত্র? ব্যাগ খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল রবিন। কাপড় বের করে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে লাগল ওয়ারড্রোবের ড্রয়ারে। ওই গাধাটা কেন তোমার প্রেমে পড়ল, সেই সূত্র?

রসিকতাটা এড়িয়ে গিয়ে কিশোর বলল, গাধাটাকে বলার জন্যে আমাদেরকে যেসব শব্দ বলেছে, ক্রসওয়ার্ড পাজলের উত্তরগুলোই হলো সেসব শব্দ।

তাই? মুসার প্রশ্ন। আর কোনটা?

দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ মুদল কিশোর। ধীরে ধীরে বলতে লাগল, কাম। হিয়ার। গিডি আপ। উওউ। দুর্ভাগ্য কিংবা দুঃখ বোঝাতে ব্যবহার হয় এই উওউ শব্দটা। আর, হুয়া শারি, মানে হলো, থাম। শারি! এবং প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গাধাটা।

নিজের বাংকে গিয়ে বসে পড়ল রবিন। চিন্তিত ভঙ্গিতে ভ্রূকুটি করল একবার। বলল, কিশোর, তুমি কিছু একটা ভাবছ।

নীরবে রবিনের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। জবাব দিল না।

আবার বলল রবিন, মুসাও তো ওই শব্দগুলোই ব্যবহার করেছিল। শারি তো ওর কথা শোনেনি?

জানি, রবিনের মতই অবাক হয়েছে কিশোরও। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। তবু বলতে হচ্ছে, ওই গাধাটার সঙ্গে কোথাও দেখা হয়েছে আমার। সে জন্যেই আমাকে চিনতে পারছে। অন্তত আমার গলা যে চিনেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

সে রাতে পিরেটোর তৈরি প্রচুর পরিমাণে শিক কাবাব আর বনরুটি দিয়ে ডিনার সেরে সকাল সকাল শুতে গেল তিন গোয়েন্দা।

কয়েক ঘণ্টা পরেই ঘুম ভেঙে গেল কিশোরের। তার বাংকের পাশে জানালার বাইরে দেয়ালে গা ঘষার শব্দ। মাথা উচু করে জানালা দিয়ে দেখল, শারি। কাচের ভেতর দিয়ে নাক ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে।

নিচু গলায় ধমক দিল কিশোর। হাত মুঠো করে দেখাল। চলে যেতে বলল গাধাটাকে। কিন্তু গেল না ওটা। এখন মুসা কিংবা রবিন জেগে উঠে যদি ব্যাপারটা দেখে ফেলে, তাহলে টিটকারি দিয়ে দিয়ে তার জান জ্বালিয়ে দেবে। বিড়বিড় করে আপনমনেই গাল দিল গাধাটাকে। তারপর বিছানা থেকে নেমে পেছনের দরজার দিকে রওনা হলো। পাল্লা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে দিল শারি। তার বুকে নাক ঠেকিয়ে ঠেলতে আরম্ভ করল। সরল না কিশোর। গাধার বুকে ঠেলা দিয়ে ওটাকে বাইরে রাখার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু জানোয়ারটা ছোট হলেও গায়ে ভীষণ জোর, বালির বস্তার মত গাট হয়ে রইল যেন। কিছুতেই নড়ানো গেল না। শেষে বাধ্য হয়ে নিজেই বাইরে বেরিয়ে এল। মোলায়েম গলায় ওটার নাম ধরে কথা বলতে বলতে।

চোখের পলকে ঘুরে গেল গাধাটা। চাঁদের আলোয় কিশোর দেখল, ওটার পায়ের দড়ি নেই। মুক্ত। আবার সে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করলেই ওটাও সঙ্গে ঢুকবে। আহ, মহা জ্বালাতন! এর হাত থেকে বাঁচা যায় কিভাবে? জবাব একটাই ওটাকে মাঠে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া।

কয়েক পা এগিয়ে থমকে দাঁড়াল সে। বাড়ির একমাথার বারান্দা থেকে কথা শোনা গেছে। একজন পুরুষ, একজন মহিলা। ডজের সঙ্গে কথা না বললেও তি গোয়েন্দার সঙ্গে বেশ ভাল ব্যবহার করেছে পিরেটো, কথা বলেছে। স্প্যানিশ ভাষায় কিশোরের কাছে আমেরিকার কথা জিজ্ঞেস করেছে। লেকটার কথা বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে, ওটাতে যাতে সাঁতার কাটতে না যায়। পর্বত থেকে নেমে আসা পানি নাকি বরফের মত শীতল, কোন মানুষই কয়েক মিনিটের বেশি টিকতে পারবে না। শুনেই এখন পিরেটোর ভারি কণ্ঠ চিনতে পারল কিশোর। তবে বেশ দূরে। অস্পষ্ট। কি বলছে বোঝা যায় না।

মহিলা কে? জানার কৌতূহল হলো কিশোরের। পা টিপে টিপে এগোল দরজার দিকে। পাশে থেকে চলল শারি। ওটার গলায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে চলল কিশোর, যাতে শব্দ না করে গাধাটা।

মহিলার কথা এখন বোঝা যাচ্ছে। আমাকে সাহায্য করতেই হবে, পিরেটো। স্প্যানিশ ভাষা। পেয়ে যাওয়ার পর কি করবে আন্দাজ করতে পারছ? ওদেরকে খুনও করে বসতে পারে ডজ!

মুখ খারাপ করে মেকসিকান ভাষায় ডজকে কয়েকটা গাল দিল পিরেটো। বেশ, বলল সে। যতটা পারি, তোমাকে সাহায্য আমি করব। এখন থেকে আমি তোমার দলে।

পিরেটোকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিল মহিলা।

দ্রুত সেখান থেকে সরে এসে বাড়ির ছায়ায় অন্ধকারে লুকিয়ে পড়ল কিশোর। হালকা পায়ের শব্দ এগিয়ে যাচ্ছে চত্বরের দিকে। মহিলা চলে যাওয়ার আগে পলকের জন্যে ওকে দেখতে পেল সে। তবে এদিকে পেছন ফিরে থাকায় মুখ দেখা গেল না। চাঁদের আলো পড়েছে সোনালি চুলে।

কিশোরের গায়ে কাঁধ ঘষছে গাধাটা। এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে মাঠে ঢোকার গেটটা খোলা। শারিকে সেখানে নিয়ে গেল কিশোর। তারপর চট করে গেটের এপাশে চলে এসে পাল্লা লাগিয়ে হুড়কো আটকে দিল। বেড়া ডিঙিয়ে চলে এল আবার এপাশে। ওপর দিয়ে মাথাটা এপাশে ঠেলে দিয়ে কর্কশ গলায় ডাকতে শুরু করল গাধাটা। লাফিয়ে পেরোতে পারবে না ওটা, বুঝে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর।

ফিরে এল বিছানায়।

পরদিন সকালে ঘর থেকে বেরোনোর আগে সংক্ষেপে সব জানাল দুই সহকারীকে। বলল, জরুরি একটা টেলিফোন করতে হবে। ডজকে ঘণ্টা দুয়েকের জন্যে বের করে নিয়ে যেতে হবে বাড়ি থেকে এবং এই কাজটা করতে হবে রবিন আর মুসাকেই।

কাঁচা মরিচ মিশিয়ে মেকসিকান কায়দায় ডিম ভেজে দিল পিরেটো। কিশোরের খুব পছন্দ এই খাবারটা, কিন্তু পেট ব্যথা করছে, এই ছুঁতো দিয়ে খেল না।

ডজও বসেছেন ওদের সঙ্গে। তাকে জিজ্ঞেস করল মুসা, লেকে মাছ ধরতে যাওয়া যাবে কিনা। ডজ বললেন, যাবে। কিশোর বলে দিল, পেট ব্যথা নিয়ে সে যেতে পারবে না। ঘরেই থাকবে। আধ ঘণ্টা পর ঘরে রইল শুধু সে আর পিরেটো।

কি একটা কাজে সে ঘর থেকে চলে গেল পিরেটো। প্লেটে একগাদা রোল পড়ে আছে। চমৎকার সুগন্ধ। এদিক-ওদিক তাকিয়ে তাড়াতাড়ি তুলে নিয়ে মুখে পুরে চিবাতে শুরু করল সে। একেবারে খালি পেটে থাকা কঠিন। লাঞ্চের সময় হতে অনেক দেরি।

খাওয়া শেষ করে টেলিফোন সেটের সন্ধানে বেরোল সে। পাওয়া গেল লিভিং রুমের পাশে ডজের ছোট অফিসে। পেছনে পাল্লাটা লাগিয়ে দিয়ে এসে ডেস্কের সামনে বসল। ফোন বুক টেনে নিয়ে দেখতে লাগল ক্যালিফোর্নিয়ার ডাইরেক্ট নম্বর কত।

একবার রিঙ বাজতেই তুলে নিলেন ভিকটর সাইমন। বিখ্যাত সেই খোঁড়া গোয়েন্দা এবং লেখক, যার সঙ্গে অনেক কাজ করেছে ওরা।

কোথা থেকে করছে, জানাল কিশোর। তারপর বলল, আমাকে কয়েকটা তথ্য দিতে পারেন? আপনার টার্মিনাল থেকে আমার কম্পিউটার ইনফরমেশন সার্ভিসকে জিজ্ঞেস করলে পেয়ে যেতে পারেন।

করছি।

থ্যাংকস। আমার পাসওয়ার্ডে ঢুকে পড়বেন। ডিটেক্ট লিখতে হবেঃ ডি ই টি ই সি টি। তারপর মেনু উল্টে যাবেন যতক্ষণ এনসাইক্লোপিডিয়া পাওয়া না যায়।

বেশ। সাবজেক্ট কি?

বারো।

কী?

বারো নিশ্চয় চেনেন। ছোট জাতের গাধা। ভারবাহী জন্তু।

বুঝেছি।

বারো সম্পর্কে কি কি জানতে চায়, জানাল কিশোর।

লিখে নিলেন মিস্টার সাইমন। জেনে নিয়ে কিশোরকে জানাবেন বলে কেটে দিলেন লাইন।

কথা বলতে বলতেই ছোট অফিসটা চোখ বুলিয়ে নিয়েছে কিশোর। এমনিতে, অন্য কারও ঘরে হলে ঢোকার আগে অনুমতি নিয়ে নিত সে। কিন্তু এখানে ঢুকে কোন অপরাধবোধ হচ্ছে না তার। শুরু থেকেই ওদের সঙ্গে প্রচুর মিথ্যে কথা বলেছে ডজ। কাজেই সত্য জানার অধিকার রয়েছে তিন গোয়েন্দার।

অনেক প্রশ্ন ভিড় জমাচ্ছে কিশোরের মনে। কেন ক্রসওয়ার্ড পাজল প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে ওকে এখানে আনা হলো? কেন তার প্রতি এই আগ্রহ? কেন মেকসিকান লোকটা তাকে এখানে আসতে বাধা দিতে চাইল? আর শারিই বা কি করে তাকে এভাবে চিনে ফেলল?

আকর্ষণীয় তেমন কিছু পাওয়া গেল না ডজের ড্রয়ারে, সিয়েরা মাদ্রের বড় বড় কয়েকটা ম্যাপ বাদে। ওগুলোতে পেন্সিল দিয়ে আঁকা প্রশ্নবোধকের ছড়াছড়ি। ডজই এঁকেছে হয়তো। সবচেয়ে ওপরের ড্রয়ারটাতে রয়েছে র‍্যাঞ্চের দলিলপত্র। ওগুলোতে চোখ বোলাতে লাগল সে। নিচের স্বাক্ষরটা দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার।

পিরেটো সানচেনজো!

র‍্যাঞ্চটা তাহলে পিরেটোই ডজের কাছে বিক্রি করেছে এবং তারপরে নিজের র‍্যাঞ্চেই নিযুক্ত হয়েছে বাবুর্চি এবং রাখাল। ডজের প্রতি তার রাগের একটা ব্যাখ্যা মিলল।

একেবারে নিচের ড্রয়ারে পাওয়া গেল একটা টেপ-রেকর্ডার। ওটা বের করে ভলিয়ুম কমিয়ে প্লে করে দিল কিশোর।

সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারল নিজের গলা। বার বার শুনল নিজের কণ্ঠঃ কাম। হিয়ার। শারি। গিডি। উত্তউ। শারি। কাম। হিয়ার…

কয়েকবার শোনার পর সাবধানে ক্যাসেটটা রিউইন্ড করে ফিতেটা আবার আগের জায়গায় এনে রেকর্ডারটা ড্রয়ারে রেখে দিল সে।

কয়েক মিনিট পরে টেলিফোন বাজল। মিস্টার সাইমন করেছেন। বললেন, রেডি?

হ্যাঁ, বলুন, কিশোর জবাব দিল। কাগজ কলম নিয়ে তৈরি হলো।

এক এক করে প্রশ্নের জবাব বলে গেলেন তিনি, আর প্রতিটি প্রশ্নের নিচে ফাঁকা জায়গায় লিখে নিল কিশোর। লেখা শেষ হলে ধন্যবাদ জানাল লেখককে।

সাইমন বললেন, যে কোন দরকার হোক, টেলিফোন করো। তোমার ওই গাধা, সরি, বারো তোমাকে কোথায় নিয়ে যায় জানার জন্যে আগ্রহী হয়ে রইলাম।

জানাবে, বলে আরেকবার ধন্যবাদ দিয়ে লাইন কেটে দিল কিশোর। মুসা আর রবিনের সঙ্গে এখন আলোচনায় বসতে হবে। কিন্তু ওদের ফিরতে অরও কম করে হলেও ঘণ্টাখানেক লাগবে। অফিস থেকে বেরিয়ে আবার পাল্লাটা লাগিয়ে দিল সে।

সকাল থেকেই শারিকে দেখছে না। প্রশ্নের জবাবগুলো পেয়ে যাওয়ার পর জানোয়ারটা সম্পর্কে আরও আগ্রহী হয়ে উঠেছে। গিয়ে ওটাকে দেখার সিদ্ধান্ত নিল সে।

মাঠেই পাওয়া গেল পিরেটোকে। বারোটার সঙ্গে রয়েছে। পানি ভরছে ওটার গামলায়। কিশোরকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে ছুটে এল জানোয়ারটা। আদর করে ওটার গলায় চাপড়ে দিল সে।

দুপুরের রোদ বড় কড়া। শার্ট খুলে ফেলেছে মেকসিকান লোকটা। কিশোর দেখল, ওর বুক আর পিঠও মুখের মতই একই রকমের বাদামী। বুঝতে পারছে না এটাই কি ওর আসল রঙ, না দীর্ঘদিন রোদের মধ্যে কাজ করার ফলে ওই অবস্থা হয়েছে।

গাধাটাকে দেখিয়ে কিশোর জিজ্ঞেস করল, পায়ের দড়ি খুলে নেয়া হয়েছে কেন?

কারণ তুমি যতক্ষণ আছ আর পালাবে না। অযথা বেঁধে রেখে লাভ কি?

আমি?

স্প্যানিশ ভাষায় যা বলল পিরেটো, তার মানে করলে দাঁড়ায়, ওটা তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ।

কেন, কৃতজ্ঞ কেন?

শারির ধারণা তুমি ওর প্রাণ বাঁচিয়েছ। ওরা খুব ভাল জানোয়ার। বিশ্বাসী। কৃতজ্ঞতা বড় বেশি।

বালতি তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল পিরেটো। পেছনে চলল কিশোর। তার সঙ্গে গাধাটা। কিন্তু আর কোন প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হলো না মেকসিকান। বলে দিল তার কাজ আছে।

বেশ কয়েকটা ট্রাউট মাছ ধরে আনল মুসা আর রবিন। শিকে গেঁথে সেগুলো দিয়ে কাবাব বানিয়ে দিল পিরেটো। দুপুরের খাবার সময় হঠাৎ করেই যেন পেট ভাল হয়ে গেল কিশোরের, বেশি খেয়ে সকালেরটা পুষিয়ে নিল।

খাওয়ার পর-পরই দুই সহকারীকে বলল, চলো, হেঁটে আসি। বেশি খেয়ে ফেলেছি, হজম করা দরকার।

রবিন আর মুসা দুজনেই বুঝল ওদের সঙ্গে কথা বলতে চায় গোয়েন্দাপ্রধান। কোন প্রশ্ন না করে ওর সাথে চলল ওরা। হাঁটতে হাঁটতে মাঠ পেরিয়ে চলে এল লেকের ধারে ছোট একটা বনের কাছে। ঢুকে পড়ল ভেতরে।

বনের ভেতরে একটুকরো খোলা জায়গা দেখে সেখানে ঘাসের ওপর বসল। মিস্টার সাইমনকে যে ফোন করেছিল সেকথা জানাল কিশোর। পকেট থেকে বের করল প্রশ্নের জবাব লেখা কাগজটা।

দেখে দেখে বলল, বারোদের শ্রবণশক্তি খুব প্রখর। তবে কুকুরের মত চালাক নয়। গন্ধ শুকে চিনতে পারে না। কণ্ঠস্বর শুনে চিনতে পারে। কাউকে পছন্দ করলে তার ভীষণ ভক্ত হয়ে যায়। কণ্ঠ শুনলে সাড়া দেয়।

তারমানে, রবিন বলল, তোমাকে যে পছন্দ করেছে শারি, সেটা সারাজীবনই এক রকম থাকবে? মুচকি হাসল সে।

রেগে গেল কিশোর। বাজে কথা বন্ধ করো তো!..হ্যাঁ, যা বলছিলাম। এই গাধাটার জন্যেই ওই ক্রসওয়ার্ড পাজলের ব্যবস্থা করেছিলেন ডজ। এমন একটা কণ্ঠস্বর খুঁজছিলেন, যেটা একটা বিশেষ মানুষের কণ্ঠের সঙ্গে মিলে যায়। হবে কোন আমেরিকান, আমাদের বয়েসী, যে গাধাটাকে ভালবাসত।

পিরেটো কি বলেছে জানিয়ে বলল সে, সেই মানুষটা বারোটার প্রাণ বাঁচিয়েছিল। সে কে জানি না। টেপে আমার কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারলেন ডজ, সেই লোকটার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে আমার কণ্ঠের মিল আছে। যে যে শব্দ দরকার সেগুলোই ক্রসওয়ার্ড পাজলের মাধ্যমে কায়দা করে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। টেপে আমি জবাব দিয়ে পাঠিয়েছি। শুধু সেই শব্দগুলো বাদে আর সব মুছে ফেলেছেন। সকালে তার ড্রয়ার খুলে টেপটা পেয়েছি। সেই শব্দ নিয়ে গিয়ে শুনিয়েছেন শারিকে। মনে হয় যান্ত্রিক শব্দ চিনতে পারেনি ওটা। কাজেই জ্যান্ত মানুষটারই প্রয়োজন হয়েছে। ডজের। তখন আমাকে এখানে আনার ব্যবস্থা করেছেন। আমার গলা শোনার আগে পর্যন্ত শিওর হতে পারেননি, কাজ হবে কিনা। সেজন্যেই কাল নার্ভাস হয়েছিলেন। ব্যাপারটা জানার জন্যে আর তর সইছিল না তার। নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে গাধাটার কাছে। তারপর যখন জানলেন, নিশ্চয় খেয়াল করেছ কি পরিমাণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন।

নীরবে কিশোরের কথাগুলো ভেবে দেখল মুসা আর রবিন।

হুঁ, অবশেষে মাথা দোলাল রবিন। যুক্তি আছে তোমার কথায়…

হ্যাঁ, মুসাও একমত হলো। কিন্তু এতসব ঝামেলা করতে গেলে কেন? না হয় একটা গাধার বাচ্চা তোমার স্বর চিনে সাড়াই দিল। এর জন্য এতগুলো টাকা খরচ করবেন ডজ?

মাথা নাড়ল কিশোর। এর জবাব আমারও জানা নেই। তবে একটা কথা বড় বেশি খচখচ করছে মনে।

কি? জানতে চাইল রবিন।

একটা ব্যাপার হতেই পারে, বুঝিয়ে বলল কিশোর। দুজন মানুষের কণ্ঠস্বরে মিল থাকা সম্ভব। ইয়ার্ডের ডাকবাক্সে একটা টেপ পেয়েছিলাম, মুসা, মনে আছে? ওটাতে রেকর্ড করা কণ্ঠস্বরের সঙ্গে আমার গলা মিলে যায়।

আবার নোটের দিকে তাকাল কিশোর। বারোদের দৃষ্টিশক্তিও খুব তীক্ষ্ণ্ণ। মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। শুধু যে গলার স্বর শুনে মানুষকে চিনতে পারে, তাই নয়, চেহারা দেখেও পারে।

মাথা ঝকাল রবিন। হ্যাঁ, তার মানে… থেমে গেল সে।

অন্য দুজনও শুনতে পেল শব্দটা। দ্রুত সরে যাচ্ছে পদশব্দ, বনের গভীরে। উঠে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা। পিছু নিল নিঃশব্দে।

কিন্তু ওদের চেয়ে বনটা অনেক ভাল চেনে যে যাচ্ছে। একটু পরেই ওকে হারিয়ে ফেলল ওরা। আর শুনতে পেল না পায়ের শব্দ। কোন শব্দই নেই আর, পাখির ডাক ছাড়া।

ভাগাভাগি হয়ে গিয়ে পুরো এলাকাটা খুঁজে দেখবে ঠিক করল ওরা।

সেই মতই কাজ করল। খুঁজতে খুঁজতে সবার আগে খোলা জায়গাটায় ফিরে এল কিশোর। তারপর এল মুসা। মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে জানাল, লোকটাকে পায়নি। বসে পড়ল ঘাসের ওপর।

আরও মিনিট দশেক পর রবিন ফিরল। পকেটে হাত ঢোকানো। মুখে হাসি। এমন একটা ভঙ্গি, যেন জেনে এসেছে কিছু।

দেখেছ নাকি কাউকে? জিজ্ঞেস করল মুসা

না, জবাব দিল রবিন। একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বলল, তবে এই জিনিসটা পেয়েছি।

পকেট থেকে হাত বের করল সে। আঙুলে ধরা জিনিসটা দেখাল।

দেখল কিশোর আর মুসা। তিন ইঞ্চি লম্বা একটুকরো উল। মেকসিকান শালের। রঙ লাল।

শারিকে নিয়ে ভাবনা হচ্ছে আমার, পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে বললেন ডজ।

ডিম ভাজা মুখে পুরে দিয়ে মুসা বলল, কি হয়েছে? মন খারাপ? মুখ গোমড়া? আকাশের তারা দেখে খালি?

টেবিলের নিচ দিয়ে ওর পায়ে লাথি মারল কিশোর।

মুসার কথা যেন কানেই যায়নি ডজের। আবার নার্ভাস লাগছে তাঁকে। খাবার প্রায় খেলেনই না। মাঠে থাকলে বিপদে পড়ে যাবে বারোটা।

সকালে ওটাকে মাঠে দেখেছে মুসা। তার মনে হয়েছে আরামেই আছে জানোয়ারটা। তাজা চেহারা। ঘাস খাচ্ছিল। চোখ চকচকে, চামড়া উজ্জ্বল, মসৃণ। ছাউনির বাইরে ছিল, কিশোরকে দেখেই ছুটে এসেছে। গাধার তুলনায় জোরেই ছোটে।

সেসব বলল না কিশোর। বলা যায় না, চুপ করে থাকলে রহস্যের আরেকটা সূত্র ধরিয়ে দিতে পারেন ডজ। নিরীহ ভঙ্গিতে বলল, শারি কি খাচ্ছে না?

ওর খুর নিয়ে ভাবনা হচ্ছে আমার। কফির কাপে চুমুক দেয়ার আগে ভ্রূকুটি করলেন ডজ। জানো হয়তো, বারোদের আদি নিবাস ছিল উত্তর আফ্রিকায়। যা শক্ত, পাথুরে মাটিতে হেঁটে আস্ত মানুষের নখের মতই ওদের খুরও দ্রুত বাড়ে। শক্ত মাটিতে ঘষা লেগে ক্ষয়ে গিয়ে স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু এখানকার মত নরম মাটিতে থাকলে বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেলেও অবাক হব না। কাপটা নামিয়ে রাখলেন তিনি। আর এ হারে বাড়তে থাকলে খোঁড়া হতে সময় লাগবে না।

ছেটে ফেলা যায় না? জানতে চাইল মুসা। একবার একজনকে ক্ষুর দিয়ে গাধার খুর চেঁচে দিতে দেখেছিল সে।

নাহ! ভুরু কুঁচকেই রেখেছেন ডজ। ওর মত একটা বুনো বারো কাছেই ঘেষতে দেবে না আমাকে। ওর পা ছোঁয়ার চেষ্টা করলেই লাথি মেরে ঘিলু বের করে দেবে আমার।

কিশোর ভাবল, শারি হয়তো তাকে পা ছুঁতে দেবে। চুপ করে রইল সে। ওর মনে হলো কিছু একটা বলতে যাচ্ছেন ডজ। শারির খুরের ব্যাপার নয়, অন্য কিছু।

মনে হচ্ছে, ডজ বললেন, শেষ পর্যন্ত ছেড়েই দিতে হবে ওকে। যেখান থেকে এসেছে সেই পর্বতেই ফিরে যাক। কিশোরের দিকে তাকাল সে। কিন্তু, গোলমালটা হলো, ও এখন যেতে চাইবে না। কারণ তুমি রয়েছ এখানে।

কিশোরের মনে হলো, বহুদিন ধরেই তো আছে শারি, তার খুরও বেড়েছে, তাহলে এতদিন ওকে ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবেননি কেন ডজ? তবে জিজ্ঞেস করল না। আপনা-আপনিই সে কথায় যাবেন। আর ওটা একটা জরুরি সূত্র। তিন গোয়েন্দাকে রহস্য সমাধানে এগিয়ে দেবে একধাপ।

কিশোর, ওকে ছেড়ে আসতে হলে তোমাকে সঙ্গে যেতে হবে, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন ডজ। আসলে, যেতে হবে আমাদের সবাইকেই। ভাবছি, পর্বতের ওদিকটায় ক্যাম্পিং করতে গেলে কেমন হয়? এক এক করে তিন গোয়েন্দার দিকে তাকালেন তিনি। কি বলো?

কিশোরের কাছে ব্যাপারটা একেবারেই হাস্যকর আর ছেলেমানুষী মনে হলো। একটা গাধাকে ছাড়তে সবাই মিলে যাওয়া! রবিনের দিকে তাকিয়ে দেখল সে-ও ওরই দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ টিপল কিশোর।

সাথে সাথে বুঝতে পারল রবিন। তিনজনে মিলে একান্তে আলোচনা না করা পর্যন্ত ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে মানা করছে গোয়েন্দাপ্রধান।

ডজের দিকে তাকাল রবিন। ঠিক আছে। আমরা জানাব আপনাকে।

কখন? উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলেন ডজ। কত তাড়াতাড়ি…

যত তাড়াতাড়ি আমরা মনস্থির করতে পারব, জবাব দিল মুসা। উঠে দরজার দিকে রওনা হলো সে। দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, কিশোর, চলো ঘুরে আসি।

ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলেন কিনা ডজ, কে জানে। চুপ করে রইলেন।

কিশোর আর রবিনও উঠে মুসার পেছনে চলল। বারান্দা থেকে নেমে মাঠের দিকে এগোল তিনজনে। ঘর থেকে যাতে না শোনা যায় এতটা দূরে এসে থামল।

মনে হয় আসল সময় এসে গেছে, ঘাসের ওপর বসে বলল রবিন। পর্বতে যাওয়ার অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে। কিশোর, তোমার কি মনে হয়?

আছে, মাথা কঁকাল কিশোর। আর সেটার জন্যেই আমাকে প্রয়োজন ডজের। আমার কণ্ঠ তার প্রয়োজন। যাতে শারি পালিয়ে না যায়। কোথাও আমাদেরকে নিয়ে যাবে গাধাটা। পর্বতের কোন জায়গায়, যেখান থেকে এসেছে।

কোনখান থেকে এল? দূরের উঁচু পাহাড় চূড়ার দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। কি আছে ওখানে? স্বর্ণ?

কিংবা সিয়েরা মাদ্রের গুপ্তধন, কিছুটা ব্যঙ্গের সুরেই বলল রবিন। একটা ঘাসের ডগা ছিড়ে নিয়ে দাঁতে কাটতে লাগল। তো, কি ভাবছ, কিশোর? যাবে?

আমি তো যাবই, কিশোরের আগেই বলে উঠল মুসা। ক্যাম্পিং ওর ভীষণ ভাল লাগে। রাতে আগুনের ধারে বসে মাংস ঝলসে খাওয়া, খোলা আকাশের নিচে স্লীপিং ব্যাগের ভেতরে ঘুমানো আহ, কি মজা! তোমরা যাবে না? পথ নিশ্চয় খুব খারাপ হবে।

খারাপ মানে? রবিন বলল। খারাপের চেয়ে খারাপ। পাথর আর বালির ছড়াছড়ি। কিশোরের দিকে তাকাল। তুমি কি বলো?

বেড়াতে খারাপ লাগে না কিশোরের। যেতে কষ্ট হবে। কি আর করা। রহস্যের সমাধান করতে গেলে খাটুনি তো একটু লাগবেই। যত কষ্টই হোক, ভাবল সে, এই রহস্যের কিনারা করেই ছাড়বে।

যাব, রবিনের কথার জবাবে বলল কিশোর। চলো, ডজকে গিয়ে জানাই।

ডজের জন্যে এটা সুখবর। মুসা বলতেই চওড়া হাসি হাসলেন। তাহলে কালই রওনা হওয়া যাক, কি বলো? রাজি হলো তিন গোয়েন্দা।

হাসিমুখে বেরিয়ে গেলেন ডজ। গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন লারেটোতে, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্যে। তিন গোয়েন্দা চলে গেল একেক জন একেক কাজে। মুসা গেল লেকে মাছ ধরতে। রবিন বারান্দায় বসল ওর মেকসিকোর ইতিহাস নিয়ে। কিশোর চলল পিরেটোর খোঁজে।

রান্নাঘরে পাওয়া গেল ওকে। একটা ওয়াকি-টকি মেরামত করছে। সব যন্ত্রপাতি খুলে ছড়িয়ে ফেলেছে, কিন্তু জোড়া লাগাতে পারছে না আর।

নাহ, আমাকে দিয়ে এসব হবে না! আনমনেই বিড়বিড় করল লোকটা। আমি রেডিওর কি বুঝি? গাধার মত খুলতে গেছি! আমি হলাম গিয়ে ঘোড়ার রাখাল। ইলেক্ট্রনিক্সের কি বুঝি?

দেখি, আমার কাছে দিন, হাত বাড়াল কিশোর। এসব মেরামত করতে পারি। কি হয়েছিল?

বোবা হয়ে গিয়েছিল। একেবারে চুপ।

ঠিক করে কি করবেন?

ওয়াকি-টকি দিয়ে কি করে? কথা বলব।

এখানে এই জিনিস আর কারও কাছে আছে নাকি? কার সঙ্গে কথা বলতে চায় পিরেটো, ভেবে অবাক হলো কিশোর। লেকের অন্য পাড়ের টাওয়ারটা ছাড়া আশপাশে আর কোন বাড়িই চোখে পড়েনি তার। র‍্যাঞ্চের কয়েক মাইলের মধ্যে নেই।

জানি না, জবাব দিল পিরেটো।

তাহলে ঠিক করতে চাইছেন কেন?

আরে! নষ্ট হলে ঠিক করব না?

তার জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারল না কিশোর। আর প্রশ্ন না করে জিনিসটা নিয়ে বসল। গোলমালটা কোথায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করল। মেরামত করতে সাধারণত যে ধরনের তার ব্যবহার হয়, সেটা পেল না। তাই ইলেকট্রিকের তারের ভেতরের সরু তার বের করে নিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা করতে লাগল।

অনেক আমেরিকানের সঙ্গেই আপনার পরিচয় আছে মনে হয়, কাজ করতে করতে বলল কিশোর। অল্প বয়েসী কজনের সঙ্গে জানাশোনা আছে?

নেই, গভীর আগ্রহে কিশোরের কাজ দেখছে পিরেটো। দারুণ হাত তো তোমার! আমেরিকার সবাই পারে নাকি?

সবাই পারে না। কেউ কেউ পারে। তথ্য জোগাড়ের জন্যে আবার প্রশ্ন করল কিশোর, অল্প বয়েসী কোন আমেরিকান এই র‍্যাঞ্চে ছিল নাকি? বেড়াতে-টেড়াতে এসেছিল?

কবে?

তিন-চার মাসের মধ্যে? শারি যখন এল তখন?

হাত ওল্টাল পিরেটো। কত লোকই তো যায় এপথে। মাঝেসাঝে থামে।

ওদের কারও গলার স্বর কি আমার মত ছিল? মনে আছে?

চেহারার কোন ভাবান্তর হলো না মেকসিকান লোকটার। তবে তার কালো চোখজোড়া হাসছে। উত্তর আমেরিকার সমস্ত মানুষকে একরকম লাগে আমার।

আমি গলার স্বরের কথা জিজ্ঞেস করেছি। যাই হোক, আপনার কাছে একরকম লাগলেও শারির কাছে নিশ্চয় তা লাগে না।

মানুষের চেয়ে বারোর কানের ক্ষমতা অনেক বেশি।

নাহ, সুবিধে হচ্ছে না। কিশোর তথ্য জোগাড় করতে চাইছে এটা বুঝে ফেলেছে পিরেটো। কাজেই মুখ খুলছে না। চাপাচাপি করে লাভ নেই।

যন্ত্রটা মেরামত করে জোড়া লাগিয়ে ফেলল কিশোর। সুইচ অন করল। কল সাইন দিয়ে কোন সাড়া মিলল না। অনেক ভাবে অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে দেখল, জবাব এল না। তবে ওয়াকি-টকিটা যে কাজ করছে তাতে সন্দেহ নেই। সাড়া যেহেতু মিলছে না, তার মানে আর কারও কাছে ওয়াকি-টকি নেই। কিংবা হয়তো অন করা নেই।

হয়ে গেছে, বলল সে।

তোমরা আমেরিকানরা বড় চালাক।

কিছু কিছু ব্যাপারে আমেরিকানরা চালাক বটে, তবে কিছু ব্যাপারে আবার বোকাও, ভাবল কিশোর। যাই হোক, সে শুধু আমেরিকান নয়, বাঙালীও। আগামী দিন সকালে ওই মেকসিকান লোকটার চালাকি ধরতে চাইলে ওর আগেই ঘুম থেকে উঠতে হবে তাকে।

ওয়াকি-টকিটা তুলে নিয়ে কিশোরকে ধন্যবাদ জানাল পিরেটো। তারপর কিশোরের হাতটা ধরে আন্তরিক ভঙ্গিতে ঝাঁকিয়ে দিল। সময় করে একদিন অনেক কথা বলব তোমার সঙ্গে। একদিন, যখন… ফোন বেজে ওঠায় বাধা পড়ল তার কথায়। জবাব দেয়ার জন্যে অফিসে চলে গেল। ফিরে এল মুহূর্ত পরেই। তোমার ফোন।

নিশ্চয় ভিকটর সাইমন, ভাবল কিশোর। এখানে আর কারও তাকে ফোন করার কথা নয়।

কিন্তু মিস্টার সাইমন নন। সাড়া দিল একটা মহিলা কণ্ঠ। আমেরিকান। কিশোর পাশা?

হ্যাঁ, কে বলছেন?

তা না জানলেও চলবে। বললেও চিনবে না। তোমাকে একটা জিনিস দেখানো দরকার। তোমার জন্যে খুব জরুরি।

উত্তেজিত হয়ে উঠল কিশোর। কোন কেস হঠাৎ করে নতুন মোড় নিলে এরকম হয় তার। এখানে, র‍্যাঞ্চে চলে এলেই পারেন।

না! র‍্যাঞ্চের ব্যাপারে ভীত মনে হলো মহিলাকে। ডজ মরগানের র‍্যাঞ্চে যাওয়া উচিত হবে না আমার। বিপদে পড়ে যাব।

ডজ বাড়িতে নেই। ল্যারেটোতে গেছেন।

না, তবু যেতে পারব না, ভয় কাটাতে পারছে না মেয়েটা। অন্য কেউ দেখে বলে দিতে পারে ডজকে। আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই। লেকের অন্য পাড়ে চলে এসো।

কি করে যেতে হবে বলে দিল মহিলা। র‍্যাঞ্চ ছাড়িয়ে কয়েক শো গজ গেলে লেকের পাড়ে একটা নৌকা দেখতে পাবে কিশোর। দাঁড় বেয়ে অন্য পাড়ে গিয়ে উঠে পড়বে ওপরে। বনের ভেতর দিয়ে গির্জার টাওয়ারের কাছে গেলে ছোট একটা গ্রাম দেখতে পাবে। গ্রামের প্রধান চত্বরে অপেক্ষা করবে মহিলা।

একা আসবে, বলে দিল মহিলা। কেউ যদি তোমার সঙ্গে থাকে, কিংবা আসার সময় কেউ তোমাকে দেখে ফেলেছে বলে মনে হয় আমার, লুকিয়ে পড়ব। আর আমাকে দেখতে পাবে না।

কি দেখাতে চাইছেন? জবাব নেই।

কেটে দিয়েছে লাইন।

বারান্দায় এল কিশোর। একমনে মেকসিকোর ইতিহাস পড়ছে রবিন। সাড়া পেয়ে ফিরে তাকাল।

কি?

মহিলার কথা জানাল কিশোর।

হয়তো সেই আমেরিকানের ছবি দেখাবে, আন্দাজ করল রবিন। শারি যার ভক্ত।

শ্রাগ করল কিশোর। তারও এ কথাই মনে হয়েছে। তবে সেটা শুধুই অনুমান।

আমি আসব? জিজ্ঞেস করল রবিন।

একা যেতে বলেছে, জানাল কিশোর।

হুম! তাহলে তো, আর কিছু করার নেই। যাও। লোকজন জোগাড় করে রাখতে পারে। সেক্ষেত্রে তোমার জুডো ব্যবহার করতে হবে আর কি। হাসল রবিন।

জবাব দিল না কিশোর। নেমে পড়ল বারান্দা থেকে। লেকের দিকে চলল। লেকের পাড়ে এসে মুসাকে দেখতে পেল না। কোথায় বসল?

নৌকাটা খুঁজে পেল সহজেই। কাঠের ছোট একটা ডিঙি। সীটের নিচে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে একটা দাঁড়। নৌকাটাকে পানিতে ঠেলে দিয়ে লাফিয়ে উঠে বসল তাতে। দাঁড়ের আংটার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল দাঁড়টা।

বাইতে শুরু করল সে।

যতটা সহজ হবে ভেবেছিল ততটা হলো না। নাক সোজা রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। কারণটা বুঝতে পারছে। তীরে দাঁড়িয়ে অতটা বোঝা যায় না। পানিতে স্রোতের খুব জোর।

বেশি চাপাচাপি করতে গিয়ে হঠাৎ মট করে ভেঙে গেল দাঁড়টা। একটানে স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গেল ভাঙা অংশটাকে। হাতের টুকরোটার দিকে বোকা হয়ে তাকিয়ে আছে কিশোর। পুরানো মনে হয়েছিল তখনই, কিন্তু পচে যে এতটা নরম হয়ে আছে কল্পনাই করতে পারেনি।

দাঁড় দিয়ে নৌকা সোজা রাখতে কষ্ট হচ্ছিল, এখন তো রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। লেজ চুলকালে সেটাকে কামড়ানোর জন্যে কুকুর যেভাবে এক জায়গায় ঘুরতে থাকে তেমনি করে ঘুরতে লাগল নৌকাটা। নানা ভাবে চেষ্টা করে দেখল কিশোর। কোন কাজ হলো না। স্রোতের টানে ভেসে চলল।

স্রোতের টানে লেকের মাঝামাঝি চলে এসেছে নৌকা, দুই তীরই এখন সমান দূরত্বে। স্রোতের দয়ার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ভাঙা বৈঠা দিয়ে নৌকা বাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চালাল কিশোর। লাভ হচ্ছে না।

সাহায্যের জন্যে চিৎকার করবে কিনা ভাবল। কিন্তু তাতেই বা কি লাভ? তার চিৎকার পিরেটো কিংবা রবিনের কানে গেলেও আরেকটা নৌকা ছাড়া ওরা এসে সাহায্য করতে পারবে না তাকে।

ছুটে চলেছে নৌকা। লেক বেয়ে গিয়ে পড়বে নদীতে।

সাঁতার ভাল জানে কিশোর। ডাইভ দিয়ে পড়ে ডুব সাঁতার দিয়ে তীরে ওঠার চেষ্টা করতে পারে। মনে পড়ল পিরেটোর হুঁশিয়ারি। পানিতে গোসল করার চেষ্টা কোরো না, কয়েক মিনিটের বেশি এই পানিতে টিকতে পারবে না কোন মানুষ। পানিতে হাত ডুবিয়ে দিয়ে বুঝতে পারল কিশোর, মিথ্যে বলেনি মেকসিকান লোকটা। বরফের মত ঠান্ডা পানি।

যতক্ষণ নৌকায় রয়েছে ততক্ষণ জমে মরার ভয় অন্তত নেই। স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যাবে নদীতে। কতক্ষণ লাগবে যেতে?

গাছপালার আড়ালে অদৃশ্য গ্রামটার কথা ভাবল সে। হয়তো ওখানে কারও নৌকা আছে।

আর কোন উপায় না পেয়ে শেষে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকারই শুরু করল কিশোর। স্প্যানিশ ভাষায়। কিন্তু দুপুরের এই প্রচন্ড গরমের সময় লেকের তীর নির্জন। একটা মানুষকেও চোখে পড়ল না। ঘেউ ঘেউ করে উঠল একটা কুকুর। কোন মানুষ সাড়া দিল না।

মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করল কিশোর। বুদ্ধি একটা বের করতে হবে। নদীতে হয়তো এমন জায়গা আছে, যেখানে পানির গভীরতা কম। তাহলে হয়তো কোনমতে উঠে যেতে পারবে তীরে।

এখান থেকে বোঝা যাবে না পানি কতটা গভীর। নদীতে গেলে তার পর। মোহনা আর বেশি দূরে নেই। দেখা যাচ্ছে। কিন্তু নদীটা কোথায়?

তাই তো! কোথায়! উধাও হয়ে গেছে নাকি!

বুঝে ফেলল হঠাৎ। লেকটা সোজাসুজি নদীতে পড়েনি। কারণ লেকের সমতলে নেই নদীটা। তারমানে জলপ্রপাত হয়ে নদীতে ঝরে পড়ছে লেকের পানি। সর্বনাশ!

কিশোর!

চমকে ফিরে তাকাল কিশোর। তীরে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। সে তাকাতেই ছিপ নাড়ল।

দাঁড় ভেঙে যাওয়ার কথা নিশ্চয় জানে না মুসা। কিন্তু বুঝতে পারছে কি ভয়ানক বিপদে পড়েছে তার বন্ধু। কিশোর দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু সে পাচ্ছে, তিরিশ ফুট নিচে রয়েছে নদী। প্রচুর পাথর আছে ওখানটায়। পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরছে পানি। নৌকা নিয়ে ওখানে পড়লে আর বাঁচতে হবে না। পাথরে লেগে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে ডিঙি…

দৌড় দিল মুসা। লেকের পাড় ধরে প্রপাতের দিকে। যেখান থেকে ঝরে পড়ছে পানি, তার কিনারে এসে থমকে দাঁড়াল। আর বড় জোর ষাট গজ মত পেরোতে হবে কিশোরকে, তারপরেই পৌঁছে যাবে সে যেখানে রয়েছে সেখানটায়।

সুতোর রিলের ক্যাচটা রিলিজ করে দিল মুসা। ছিপটা তুলে ধরল মাথার ওপর। একটা সুযোগ পাবে সে। মাত্র একটা। দ্বিতীয়বার চেষ্টা করার সময়ই মিলবে না আর। শক্ত হয়ে দাঁড়াল সে। ডিঙিটার অপেক্ষায়।

সামনে চলে এল নৌকা। মাথার ওপর ছিপ ঘুরিয়ে বড়শি আর সীসা বাঁধা সুতোর মাথাটা যত জোরে সম্ভব ছুঁড়ে দিল লেকের পানির ওপর দিয়ে।

কিশোরের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল সীসাটা। পড়ল গিয়ে ওপাশের পানিতে। হাত বাড়িয়ে সুতোটা ধরে ফেলল সে।

টেনো না! সাবধান করল মুসা, ছিড়ে যেতে পারে! সীসাটা ধরে রাখ শুধু। সুতো ধরে পানি থেকে সীসাটা টেনে তুলে ধরে রাখল কিশোর।

খুব হুঁশিয়ার হয়ে আস্তে আস্তে সুতো গোটাতে আরম্ভ করল মুসা। এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে, এমন ভাবে, যাতে টান খুব কম পড়ে। অনেক বড় মাছ যেভাবে খেলিয়ে তোলে অনেকটা তেমনি করে। নাইলনের সুতো যথেষ্ট শক্ত, কিন্তু তারপরেও যে-কোন মুহূর্তে ছিড়ে যেতে পারে।

সুতোয় টান লাগছে, আর একটু একটু করে এদিকে ঘুরে যাচ্ছে নৌকার গলুই।

সুতো আরও কয়েক ফুট গুটিয়ে ফেলতে পারল সে।

মাঝখানের চেয়ে তীরের কাছাকাছি স্রোত অনেক কম। সেখানেই নিয়ে আসার চেষ্টা করছে মুসা।

আরও কিছুটা গোটাল। কমে আসছে নৌকা আর তার মাঝের দূরত্ব। স্রোতের টান থেকে প্রায় বেরিয়ে এসেছে নৌকাটা।

সুতো ছিড়ল নৌকাটা তীর থেকে দশ গজ দূরে থাকতে। তবে এখন আর অতটা ভয় নেই।

ভাঙা দাঁড়টা দিয়ে জোরে জোরে বাইতে শুরু করল কিশোর। কিন্তু দাঁড়ের চ্যাপ্টা মাথার বেশির ভাগটাই ভেঙে যাওয়ায় পানিতে তেমন চাপ রাখতে পারছে না ওটা।

সুতোর টানে যেমন ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগিয়েছিল নৌকা, এখনও তেমনিই এগোতে লাগল।

তারপর হঠাৎ করেই ভাঙা ডান্ডার মাথা দিয়ে মাটি নাগাল পেয়ে গেল কিশোর। লগি দিয়ে বাওয়ার মত করে বাইতে শুরু করল সে। আরেকটু এগোল নৌকা। পানি ওখানে ফুটখানেক গভীর। লাফিয়ে নেমে পড়ল সে। গলুই ধরে টেনে নৌকাটাকে টেনে নিয়ে এল কিনারে।

দৌড়ে এল মুসা। ওকে নৌকাটা ডাঙায় তুলতে সাহায্য করল।

থ্যাংকস! এছাড়া বলার মত আর কিছুই তখন খুঁজে পেল না কিশোর।

আজকে সবচেয়ে বড় মাছটা ধরলাম, হেসে বলল মুসা। পিরেটোকে বলব, তোমাকে যেন শিকে গেঁথে কাবাব বানিয়ে দেয়। লাঞ্চে খেতে পারব।

আরেকটু হলেই কবরে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল।

পায়ের শব্দ শোনা গেল। দুজনেই দেখল দৌড়ে আসছে রবিন। কিশোর ওকে রেখে চলে আসার পর পড়ায় আর মন বসাতে পারেনি। কৌতূহল চাপতে না পেরে কিশোর কি করে দেখার জন্যে চলে এসেছিল লেকের ধারে। দেখেছে, অসহায় হয়ে নৌকায় করে ভেসে চলেছে গোয়েন্দাপ্রধান। ওকে বাঁচানোর কোন বুদ্ধিই বের করতে পারেনি সে।

দারুণ, মুসা, কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রবিন। একটা কাজ করেছ। হলিউডের পরিচালকরা ওরকম একটা দৃশ্যের শট নিতে পারলে বর্তে যেত।

হাসল মুসা। আমি তো ভেবেছিলাম দ্য ট্রেজার অভ দ্য সিয়েরা মাদ্রের শুটিং হবে, তুমি বানিয়ে দিলে জজ! মুশকিল হলো, এই কথাটা কিছুতেই শোনানো যাবে না মেরিচাচীকে। বাহবা নিতে গিয়ে বকা খেয়ে মরব, কেন তোমাকে একলা যেতে দিলাম এই জন্যে।

কিশোরও হাসল। এই না হলে বন্ধু! বসে পড়ে ভেজা জুতো আর মোজা টেনে টেনে খুলছে সে। পানিতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড ছিল, তাতেই নীল হয়ে গেছে ঠান্ডায়। ভাগ্যিস সাঁতরে তীরে পৌঁছার চেষ্টা করেনি।

রিলের হাতল ঘুরিয়ে সুতোটা গুটাতে লাগল মুসা। রবিনকে বলতে লাগল কিশোর, কি ঘটেছে। মুসাও শুনছে ওর কথা। টেলিফোনে অচেনা কণ্ঠ। তারপর দাঁড় ভেঙে যাওয়া। কি যেন একটা রহস্য আছে বলে মনে হচ্ছে তার।

জিজ্ঞেস করল মুসা, স্রেফ ভেঙে গেল?

গেল। এতটাই পচা ছিল। ইচ্ছে করেই হয়তো রেখেছে ওই জিনিস। ডান্ডার মাথা পরীক্ষা করে দেখে বলল কিশোর, যাতে জোরে চাপ লাগলেই ভেঙে যায়। আমাকে খুন করতে চেয়েছে। এমন কায়দা করেছে, সবাই যাতে মনে করে ব্যাপারটা একটা দুর্ঘটনা।

রবিনের দিকে তাকাল সে। কাউকে দেখেছ লেকের পাড়ে?

নৌকার কিনারে বসেছে রবিন। মাথা ঝাকাল। দেখেছি। অন্য পাড়ে। একজন মহিলা। একপলক দেখলাম, তারপরেই হারিয়ে গেল বনের ভেতরে। মনে হচ্ছিল, তোমার ওপর নজর রেখেছিল সে। তুমি তখন প্রপাতের দিকে চলেছ।

দেখতে কেমন? জিজ্ঞেস করল মুসা। বলেই মাথা নাড়ল, না না, বলার দরকার নেই, বুঝতেই পারছি। সেই মেকসিকান মহিলা। লাল শাল পরেছিল যে।

মাথা নাড়ল রবিন। না। ও নয়। আমার কাছে একে আমেরিকান মনে হয়েছে। নীল জিনস পরনে, গায়ে হালকা রঙের শার্ট আর…

আর সোনালি চুল, বলে দিল কিশোর। অবাক হলো রবিন। অতি-মানবিক কোন ক্ষমতা আছে নাকি তোমার!

পরদিন সকালে পর্বতে যাওয়ার জন্যে তৈরি হলো তিন গোয়েন্দা।

জীপের পেছনে বেঁধে লারেটো থেকে একটা হর্স বক্স নিয়ে এসেছেন ডজ। চাকা লাগানো, চারপাশে কাঠের বেড়া দেয়া একটা ঠেলাগাড়ির মত। মাঠ থেকে একটা ঘোড়া ধরে নিয়ে এসেছে পিরেটো। ওটার পিঠে জিন বাঁধতে ওকে সাহায্য করছে মুসা। ঘোড়াটা খুব শান্ত। মুসা যখন ওটাকে টানতে টানতে নিয়ে চলল ট্রেলার হোমে তোলার জন্যে, একটুও বাধা দিল না।

ওটার সঙ্গে রইল সে, পরিচিত হওয়ার জন্যে। গলা চাপড়ে আদর করল, ডলে উলে চকচকে করে দিতে লাগল চামড়া। পিরেটো আর কিশোর এই সময় গেল শারিকে আনার জন্যে। মেকসিকান লোকটার সঙ্গে একা থাকার সুযোগ পেয়ে খুশিই হলো গোয়েন্দাপ্রধান। সাবধানী পিরেটোর কাছ থেকে কোনভাবে যদি কিছু তথ্য জোগাড় করতে পারে।

লেকের ধারে ওই যে নৌকায় উঠেছিলাম আমি, জিজ্ঞেস করল কিশোর। ওটা কি সব সময়ই ওখানে থাকে?

নৌকা তাহলে আর কোথায় রাখবে? রান্নাঘরে?

ওটা কার?

এই র‍্যাঞ্চের।

কেউ কি ব্যবহার করে?

মাঝেসাঝে।

কি কাজে?

মাছ ধরার কাজে।

ভীষণ চালাক লোকটা। এভাবে ওর কাছ থেকে তথ্য জোগাড় করতে পারবে বলে মনে হলো না কিশোরের। তবে একটা কথা জানতে হবে যে করেই হোক।

লেকের অপর পাড়ে সোনালি চুলওয়ালা যে আমেরিকান মহিলাকে দেখেছে, নিশ্চয় সে-ই ফোন করেছিল ওকে, সন্দেহ নেই। হতে পারে ওই মহিলাই পচা দাঁড়টা রেখেছিল। কিন্তু তাহলে ওই দাঁড় দিয়ে নৌকাটাকে এপাড়ে আনল কি করে? আর সে নিজেই বা ফিরে গেল কিভাবে?

ওপাড়ের গায়ে যেতে চাইলে, চেষ্টা চালিয়ে গেল কিশোর, কিভাবে যাবেন?

হেঁটে।

কিন্তু লেক তো অনেক গভীর। হাঁটা যায়?

ওদিকটায় অত গভীর নয়। নদীর উজানের দিকে দেখাল পিরেটো। তাছাড়া বড় বড় পাথর আছে, ওগুলোর ওপর দিয়েই হাঁটা যায়।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। জবাব এটাই হবে। ওই পাথরের ওপর দিয়েই হেঁটে পার হয়ে গেছে আমেরিকান মহিলাটা। আর রাতের বেলা বারান্দায় ওর সঙ্গেই হয়তো কথা বলেছিল পিরেটো। তারমানে ওকে চেনে সে।

গায়ে আপনার কোন বন্ধু আছে নাকি?

একজনকে চিনি। বার আর ক্যানটিনার মালিক, আমার খালাত ভাই।

কোন আমেরিকানকে চেনেন না? সোনালি চুলওয়ালা একজন মহিলা?

শারি যে মাঠে থাকে ওটার গেটের কাছে পৌঁছে গেছে ওরা। ফিরে তাকাল পিরেটো। বোকামি করছে ও। সে কথা বলেছিও ওকে। ভীষণ ভয় পেয়েছে। ভয় পেলে লোকে উল্টোপাল্টা কাজ করে বসে। তোমার যে কোন ক্ষতি হয়নি, তাতে আমি খুশি। কিন্তু…

কিশোরের কাঁধে হাত রাখল পিরেটো। পর্বতে গিয়ে সাবধানে থাকবে। সতর্ক করে দিল সে। ভয়ানক বিপদের জায়গা।

কিশোরকে দেখে উত্তেজিত হয়ে ছুটে আসছে শারি।

দরজা খুলে দেয়া হলো। কিশোরের গায়ে নাক ঘষতে লাগল জানোয়ারটা।

ওটার কানের পেছনটা চুলকে দিল কিশোর। ও-যাই করুক, চুপ করে থাক বারোটা। কিন্তু আর কাউকে কাছেই ঘেঁষতে দেয় না। পিরেটোকেও না। দূর দাঁড়িয়ে আছে সে। কিশোরকে বলল, জিন আর লাগাম ছাড়া চড়তে পারবে। কিন্তু পরানোটাই হলো মুশকিল। যতই পছন্দ করুক তোমাকে, যেই জিন পরাবে মাটিতে গড়াতে শুরু করবে, পিঠ থেকে ওটা খুলে না ফেলে আর থামবে না।

চোখ বড় বড় হয়ে গেল কিশোরের। তাই নাকি?

জীপটা রসদপত্র দিয়ে প্রায় ভরে ফেলেছেন ডজ। বীন আর চালের বস্তা, চিনি, কফি ও প্রয়োজনীয় আরও খাবার নিয়েছেন। ঘোড়ার জন্যে নিয়েছে জই। স্লীপিং ব্যাগ আর রাইফেল নিয়েছেন। মালপত্রের ফাঁকে জায়গা নেই বললেই চলে ওখানেই কোনমতে গাদাগাদি করে বসেছে মুসা আর রবিন। কিশোর বসেছে ডজের পাশে। হাতে লম্বা একটা দড়ি, এক মাথা বাঁধা রয়েছে গাধার গলায় জীপের পেছন পেছন আসছে বারোটা।

গেট থেকে বেরিয়ে এসে ফিরে তাকাল কিশোর। দাঁড়িয়ে রয়েছে পিরেটো কিশোর তাকাতে হাত তুলল। কি বোঝাতে চাইল? সাবধান করল? না গুডবাই?

ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে পাহাড়ী পথ। চার-পাঁচ মাইলের বেশি গতি বাড়াচ্ছে না ডজ। যাতে শারির আসতে অসুবিধে না হয়।

বালি আর পাথর বিছানো রয়েছে পথ জুড়ে। এক ঘণ্টা চলার পর সরু হয় এল পথ। ঢুকে গেল পাইন বনের ভেতরে।

আরও এক ঘণ্টা পর জীপ থামালেন ডজ, ইঞ্জিন ঠান্ডা করার জন্যে। পানি পড়ার শব্দ কানে আসছে। দড়ি ছোটানোর জন্যে টানাটানি শুরু করল শারি।

মনে হয় পানি খেতে চাইছে, কিশোর বলল। আমি যাচ্ছি ওর সঙ্গে। নই পালাতে পারে।

বারোটাই ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এল ছোট একটা পার্বত্য নালার কাছে। টলটলে পরিষ্কার পানি। দেখার পর কিশোরেরও খেতে ইচ্ছে করল। পিপাসা অবশ্য আগেই পেয়েছে। পিরেটোর কাছে শুনেছে, সিয়েরা মাদ্রের ঝর্না থেকে পানি খেতে মানা নেই, তবে বদ্ধ জলাশয় থেকে খাওয়া একদমই উচিত নয়। হাঁটু গেড়ে বসে আঁজলা ভরে পানি তুলে খেতে শুরু করল সে। তার পাশেই মুখ নামিয়ে খাচ্ছে শারি।

পানি খাওয়া শেষ করে পাতা চিবুতে লাগল বারো। ওর জন্যে সঙ্গে করে কিছু আনা হয়নি। ঘোড়ার মত বেছে খায় না বারো, কাজেই ওগুলোর জন্যে তেমন ভাবনা নেই। ছাগলের মত যা খুশি খেতে পারে। পিরেটো একথা বলেছে, কিশোরকে। ঠিকই বলেছে। এখন তার প্রমাণ পাওয়া গেল।

মিনিট কয়েক ঘাস আর লতাপাতা খেল শারি। এই সময় শোনা গেল ডজের ডাক। অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। বারোটাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে টানতে লাগ কিশোর। চেঁচিয়ে বলল, আয়, আয়, দেরি হয়ে গেল! কানেই তুলল না ওটা পেট না ভরা পর্যন্ত খেয়েই চলল।

রেগে গেলেন ডজ, কিন্তু কিছু বলারও নেই। বারোটা আসতে না চাই কিশোর কি করবে? সমস্ত রাগ যেন গিয়ে পড়ল ইঞ্জিনের ওপর। স্টার্ট দিয়ে অযথাই এক্সিলারেটর বাড়িয়ে গোঁ গোঁ করালেন কয়েক সেকেন্ড। খাবার বানিয়ে প্যাকেট করে দিয়েছিল পিরেটো। সেগুলো দিয়ে লাঞ্চ করেছে সবাই। রবিন, মুসা আর ডজ খেয়েছেন। কিশোর কেবল বাকি। তার স্যান্ডউইচগুলো নিয়ে বড় বড় কামড় দিয়ে খেতে শুরু করল। জীপ ততক্ষণে চলতে আরম্ভ করেছে। একহাতে গাধার দড়ি ধরে রেখে আরেক হাতে খাচ্ছে কিশোর।

আরও ঘণ্টা তিনেক চলার পর বালিতে ঢাকা সরু পথও অদৃশ্য হয়ে গেল।

এখানে জীপ রেখে যেতে হবে আমাদের, ডজ বললেন।

মালপত্র নামাতে লাগল ওরা। বাক্স থেকে ঘোড়াটাকে নামিয়ে আনল মুসা। হর্সবক্স সহ জীপটাকে পাইন বনের ভেতরে নিয়ে গেলেন ডজ। ডালপাতা দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো দুটো গাড়িকেই। ভারি ভারি বোঝাগুলো তোলা হলো ঘোড়ার পিঠে। শারির কাঁধে স্লীপিং ব্যাগগুলো তুলে দিয়ে বেঁধে ফেলল কিশোর।

তুমি আগে আগে যাও, কিশোরকে বললেন ডজ। বারোটাকে ঢিল দিয়ে দাও। ও যেদিকে যায় সেদিকেই যাবে। ওটাই পথ দেখাক।

চট করে বন্ধুদের দিকে তাকাল একবার কিশোর।

আবার শুরু হলো চলা। শারির পিঠে বসল কিশোর। যার যার ব্যাকপ্যাক পিঠে নিয়ে হেঁটে চলল রবিন আর মুসা। সবার পেছনে ঘোড়ায় চেপে আসছেন ডজ।

কয়েক মিনিট চলার পরেই বুঝে গেল কিশোর, গাধার পিঠে চেপে যাওয়াটা কতটা কষ্টকর। একটা মুহূর্তের জন্যে অসতর্ক হতে পারছে না।

দেখতে দেখতে গাছপালার মাথার ওপরে উঠে এল দলটা। ঢালের গায়ে এখন আর গাছ নেই, বন নিচে পড়ছে ক্রমশ। খাঁড়া পাথুরে ঢালে হাঁটতে ভীষণ অসুবিধে হচ্ছে রবিন আর মুসার। বার বার পা পিছলে যাচ্ছে আলগা পাথরে।

শারির কিছুই হচ্ছে না। পিরেটো বলেছে, পাহাড়ি ছাগলের মতই পাহাড় বাইতে পারে বাবোরা। তা তো হলো, কিন্তু কিশোর তো আর ছাগল নয়, বারোও নয়, কাজেই পিঠ থেকে পড়ে যাওয়া এড়ানোর জন্যে শারির গলা জড়িয়ে ধরে রাখতে হলো ওকে। ছেড়ে দিলে গড়িয়ে পড়ে যাবে পিঠ থেকে এবং তারমানে পাহাড় থেকেও গড়িয়ে পড়া।

কষ্ট হচ্ছে কিশোরের, তবে ডজের চেয়ে কম। বারোর মত পাহাড় বাওয়ায় দক্ষ নয় ঘোড়াটা। ঠিকমত ঠিক জায়গায় পা ফেলতে পারছে না। মাঝে মাঝেই এগোতে না পেরে থেমে যাচ্ছে। পিঠ থেকে নেমে তখন এগোনোর জন্যে ওটাকে ঠেলতে হচ্ছে ডজকে। কখনও বা লাগাম ধরে টেনে কোন উঁচু পাথর পার করিয়ে আনছেন। ফলে সময় নষ্ট হচ্ছে। খানিক পরেই দেখা গেল মুসা আর রবিনের প্রায় আধ মাইল পেছনে পড়ে গেলেন তিনি।

সবার আগে রয়েছে কিশোর। আর সবাই অনেক পেছনে। ওদেরকে এগিয়ে আসার সময় দেয়ার জন্যে শারিকে থামতে বলল সে, হয়া! হুয়া!

শুনতেই পেল না যেন বারোটা।

তখন ওটার কানের কাছে চিৎকার করে বলল কিশোর, হয়া! হুয়া! থামার বিন্দুমাত্র লক্ষণ নেই বারোটার। অনেক দিন পর পাহাড়ে চড়ার সুযোগ পেয়েছে বোধহয়, এগিয়ে চলেছে মহা আনন্দে। কারও জন্যে অপেক্ষা করার প্রয়োজনই বোধ করছে না। লাগাম টেনে বোঝাতে চাইল কিশোর, ওর হুকুম মেনে চলা উচিত। পাত্তাই দিল না বারো।

তারপর কিশোর যখন হাল ছেড়ে দিয়েছে, এই সময় হঠাৎ করেই থমকে দাঁড়াল।

এতই আচমকা, আরেকটু হলেই পিঠ থেকে পড়ে যেত কিশোর। যেন ব্রেক কষে দাঁড়িয়েছে জানোয়ারটা। একটা সমতল জায়গার কিনারে এসে পৌঁছেছে। পাথরের ছড়াছড়ি, তার ফাঁকে ফাঁকে গজিয়ে উঠেছে ঘাস। ঠিক সামনেই মাথা তুলেছে একগুচ্ছ ক্যাকটাস।

কিশোর আন্দাজ করল, আবার খেতে চায় শারি। শরীরটা ঢিল করে দিয়ে লাফিয়ে নামল পিঠ থেকে। তার নিজের বিশ্রামের জন্যেও জায়গাটা চমৎকার। ক্যাকটাসের পাশে একটা চ্যাপ্টা মসৃণ পাথর দেখতে পেল। ওটার দিকে এগোতে গেল সে।

সঙ্গে সঙ্গে গলা বাড়িয়ে দিল শারি, পথ আটকাল কিশোরের। পাশ কাটিয়ে সে যখন এগোনোর চেষ্টা করল, তার শার্টের ঢোলা জায়গায় কামড়ে ধরল ওটা।

রেগেই গেল কিশোর। এই, কি হয়েছে? কি করতে চাস? ঘাস খেতে কি মানা করেছি নাকি তোকে! টেনে শার্টটা ছাড়ানোর চেষ্টা করল সে। কিন্তু ধরে রাখল শারি।

হাল ছেড়ে দিল কিশোর। বারোর সঙ্গে পারবে না। ওটা যখন কিছু করবে বলে গো ধরে, কারও সাধ্য নেই সেকাজ থেকে বিরত করে। আপাতত যেখানে রয়েছে সেখানেই থাকতে চাইছে। কিশোরকেও থাকতে বলছে। কাজেই নড়ানো সম্ভব না।

যখন ওটার ঘাড়ে চাপড় দিয়ে আদর করল কিশোর, তখন ছাড়ল শার্ট। কিন্তু পথ ছাড়ল না। যেতে দিতে চায় না কিশোরকে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ক্যাকটাসের জটলাটার দিকে।

এই সময় বারোটার কানের দিকে চোখ পড়ল কিশোরের।

ঘাড়ের সঙ্গে একেবারে লেপটে রয়েছে।

ঘাড়ের বড় বড় রোমগুলো লেপটে নেই, সাধারণত যেভাবে থাকে। দাঁড়িয়ে গেছে। ভয়ে কাঁপছে থিরথির করে।

স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। চোখ ক্যাকটাসের দিকে।

হাঁচড়ে-পাচড়ে তার পাশে এসে দাঁড়াল রবিন আর মুসা।

কি হয়েছে? মুসা জিজ্ঞেস করল।

বুঝতে পারছি না। কিছু দেখে ভয় পেয়েছে শারি।

পা বাড়াতে গেল রবিন। ধরে ফেলল তাকে মুসা। বারোর ঘাড়ের রোম যে দাঁড়িয়ে গেছে সেটা সে-ও লক্ষ্য করেছে। দেখি, কি করে ও।

কিছুই করল না শারি। তাকিয়েই রয়েছে ক্যাকটাসের দিকে। পেছনে হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে এল ডজের ঘোড়া। কি হয়েছে?

শব্দটা কানে এল এই সময়। মৃদু একটা খড়খড়। ওদের কানে শব্দ পৌঁছার আগেই জেনে ফেলেছে বারোটা, সামনে মারাত্মক বিপদ।

শব্দটা আসছে ক্যাকটাসের পেছনের একটা পাথরের ওপাশ থেকে। কিসে করছে? আবার হলো শব্দ, আরও জোরাল। এবার আর খড়খড় নয়, অনেকটা মৌমাছির গুঞ্জনের মত।

ঘোড়াটার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন ডজ। জোরে শ্বাস টানলেন একবার। হাত বাড়ালেন রাইফেলের দিকে। র্যাটল স্নেক! ক্যাকটাসের পেছনেই! ভয় দেখিয়ে খোলা জায়গায় বের করে আনতে হবে, যাতে গুলি করতে পারি।

পাথর কুড়িয়ে নিল তিন গোয়েন্দা। ছোঁড়ার জন্যে তৈরি হলো। ক্যাকটাসের দিকে রাইফেল তুলে ধরলেন ডজ।

মার! বলে উঠল মুসা। একই সঙ্গে পাথর ছুঁড়ল তিনজনে। থেমে গেল গুঞ্জন। তবে নীরব হলো না।

জোরাল খটাখট আওয়াজ করে ক্যাকটাসের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল সাপটা। চার ফুট লম্বা। চ্যাপ্টা মাথাটা ওপরে তোলা। সাংঘাতিক দ্রুত গতি। শরীর মোচড়াতে মোচড়াতে পলক ফেলতে না ফেলতে ছুটে আসছে।

লাফিয়ে পেছনে সরে এল তিন গোয়েন্দা।

গুলি করলেন ডজ।

মনে হলো, লাগেনি। লাফিয়ে একপাশে সরে গিয়ে আবার আসতে লাগল।

তাকিয়ে রয়েছে যেন রবিন। সোজা তারই দিকে আসছে সাপটা। গোল গোল চোখ, লম্বা জিভটা দ্রুত বেরোচ্ছে আর ঢুকছে, লেজটা তুলে ধরা। লেজের ডগায় অনেকগুলো হাড় বোতামের মত একটার ওপর আরেকটা আলগা ভাবে বসানো, বাড়ি লেগে লেগে ওই অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। সরে যেতে চাইছে, কিন্তু পা উঠছে না। সম্মােহিত করে ফেলেছে যেন তাকে সাপটা।

রাইফেলের বোন্ট টানার শব্দ হলো। রাইফেল তুললেন ডজ।

কিন্তু ট্রিগার টেপার সুযোগ পেলেন না। নলের সামনে রয়েছে শারি, ওটার গায়ে গুলি লাগতে পারে।

চ্যাপ্টা হয়ে একেবারে ঘাড়ের সঙ্গে মিশে গেছে যেন বারোর কান। ঘুরছে। সাপটা যতই এগিয়ে আসছে, চঞ্চল হয়ে উঠছে ওটা। কিন্তু রবিনের মতই যেন সম্মােহিত হয়ে গেছে।

ফনা আরও উঁচু হল সাপটার। ছোবল মারার জন্যে প্রস্তুত।

চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে গেল হঠাৎ শারি। পেছনের দুই পা তুলে লাথি চালাল।

সাপের শরীরের মাঝামাঝি জায়গায় আঘাত হানল এক পায়ের লাথি। উড়ে গিয়ে বিশ ফুট নিচে পাথরের ওপর পড়ল ওটা। একটা সেকেন্ড নিথর হয়ে পড়ে বইল, যেন মরে গেছে। রবিনও তাই ভেবেছিল। কিন্তু ওদেরকে অবাক করে দিয়ে নড়ে উঠল ওটা। পিছলে গিয়ে ঢুকে পড়ল পাথরের ফাঁকে।

স্যাডল হোলস্টারে রাইফেলটা ঢুকিয়ে রাখলেন ডজ।

কেউ কথা বলল না। সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, ভারি নিঃশ্বাস পড়ছে। তারপর, নীরবে আবার পা বাড়াল।

সামনের দিকে এগোল না আর শারি। উপরেও উঠল না। সমতল জায়গাটাকে ঘুরে এগোল। আবার জঙ্গল চোখে পড়ল কিশোরের। তাড়াহুড়ো করে সেদিকে এগিয়ে চলল বারো-টা। মূল পথ থেকে সরে যাচ্ছে, কিন্তু থামানোর চেষ্টা করল না কিশোর। যেদিকে খুশি যাক। ডজ বলেছেন ওটাকে ওটার ইচ্ছের ওপরই ছেড়ে দিতে।

বনে ঢুকে কিছুদূর এগিয়ে থেমে গেল শারি। ওটার গলা চুলকে দিল কিশোর।

আর কিছু বলব না তোকে, বলল সে। তোর ইচ্ছে মত চলবি। বুঝে গেছি, এখানে আমার চেয়ে তোর বুদ্ধি অনেক বেশি।

মুসা আর রবিন এল। ওদের পেছনে এলেন ডজ। চারপাশে তাকিয়ে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন, রাতে ক্যাম্প ফেলার জন্যে চমৎকার জায়গা বেছেছে বারো। প্রচুর লাকড়ি আছে, সবুজ ঘাস আছে। কাছেই একটা সুন্দর ঝর্না, কিশোরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল সেখানে।

সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা কমে গেল। শার্টের ওপরে সোয়েটার পরে নিল তিন গোয়েন্দা। লাকড়ি জোগাড় করে চমৎকার একটা আগুনের কুন্ড বানিয়ে ফেলল মুসা। তারপর ঘোড়া থেকে মালপত্র নামাতে সাহায্য করল ডজকে।

শারির পিঠ থেকেও বোঝা নামিয়ে ফেলল কিশোর। জিন খুলে নিল। ঘাসপাতা খাওয়াল, ঝর্নার ধারে নিয়ে গেল পানি খাওয়াতে। তারপর সে আর রবিন মিলে রান্না করতে বসল। বড় একটা পাত্রে চাল আর বীন নিয়ে সিদ্ধ করে নিল।

এই জিনিস খাওয়া যায়! বিরস দৃষ্টিতে তাকাল ওগুলোর দিকে কিশোর। কিন্তু কি আর করা। বেঁচে থাকতে হলে খেতেই হবে। এই খাবারে দুজন লোক কিছুই মনে করল না। একজন ডজ, তার অভ্যাস আছে, আরেকজন মুসা, যার কোন খাবারেই অরুচি নেই।

খেতে খেতে ভাবছে কিশোর—আর কোন সন্দেহ নেই, সাংঘাতিক রহস্যময় একটা কেস পেয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা। সমাধান করতে ভালই লাগবে। রহস্যটার কথা ভাবতে ভাবতে কোন দিক দিয়ে যে চাল আর বীন সেদ্ধ গিলে শেষ করে ফেলল সে, খেয়ালই রইল না।

খাওয়া শেষ করে জুতো খুলে ফেলল রবিন। পায়ের পাতায় হাত বোলাতে লাগল। ঢাল বেয়ে উঠতে গিয়ে ব্যথা হয়ে গেছে। ফোসকাও পড়েছে।

আর কতদূর যেতে হবে? ডজকে জিজ্ঞেস করল সে।

তীক্ষ্ণ হলো ডজের দৃষ্টি। কেন, তোমার ভাল্লাগছে না?

রবিনের দৃষ্টি আরও বেশি তীক্ষ্ণ হলো। এভাবে এগোনোর কথা কিন্তু ছিল না। ছিল, শারির খুরের ব্যবস্থা করার কথা। ওকে পাহাড়ে ছেড়ে দিয়ে যাওয়ার কথা। এমন কোথাও যেখানে ওর খুর ঠিক থাকবে। এখানে প্রচুর, পাথর আর পাহাড় আছে। জায়গাটা ভালও লাগছে মনে হয় ওর। তাহলে আর দেরি কেন?

রূঢ় কণ্ঠে কথাগুলো বলল সে। ডজের মিথ্যে বলা শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গেছে। লোকটাকে বুঝিয়ে দিতে চায় ওরা কচি থােকা নয় যে এভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে আর অনর্গল মিথ্যে বলে বলে ধোকা দেবেন। বোঝাতে চায়, শারির খুর নিয়ে যে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই ডজের, এটা বুঝে গেছে ওরা।

হ্যাঁ, রবিনের কথার প্রতিধ্বনি করল যেন মুসা, এটা শারির জন্যে চমৎকার জায়গা। পাহাড়ের ঢালে কিছু কিছু জায়গা তো দেখলাম লোহা ঘষার উখার চেয়েও ধার। এখানেই ছেড়ে দিচ্ছেন না কেন?

সাথে সাথে জবাব দিলেন না ডজ। কয়েকটা ডাল ছুঁড়ে দিলেন আগুনে। বারোটা নিজেই বুঝিয়ে দেবে কোথায় ওকে ছাড়তে হবে। যেখান থেকে এসেছে সেখানেই চলেছে। সেখানে পৌঁছলেই থামবে।

হোম, সুইট হোম, আনমনে বিড়বিড় করল কিশোর। বাড়ির জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে ও, একথা কেন মনে হচ্ছে আপনার?

বলা কঠিন, অধৈর্য কণ্ঠে জবাব দিলেন ডজ। কখনও কখনও বুনো বারোরা বাড়ির কাছাকাছিই থাকতে চায় সব সময়। কেন, কে জানে!

এখনও যে মিথ্যে বলছেন ডজ, বুঝতে পারছে কিশোর। রবিন আর মুসাও পারছে।

তাহলে বাড়ি থেকে অতদূরে র‍্যাঞ্চে গিয়ে উঠল কেন? ফস করে জিজ্ঞেস করে বসল মুসা।

বুনো বারোরা অনেক সময়ই দলছুট হয়ে দূরে চলে যায়। তারপর আবার একই কথা বললেন ডজ, কেন, কে জানে!

এটাও মিথ্যে কথা, ভাবছে কিশোর। দলছুট হয়ে নিছক খেয়ালের বশে র‍্যাঞ্চে গিয়ে হাজির হয়েছে বারো, কিছুতেই বিশ্বাস করে না সে। কেউ ওকে নিয়ে গিয়েছিল ওখানে। এমন কেউ, যাকে বিশ্বাস করে, পছন্দ করে শারি। সেই লোকের সঙ্গে সঙ্গেই চলে গিয়েছিল। হয়তো ওর প্রাণ বাঁচিয়েছিল ওই লোক এবং যার কণ্ঠ কিশোরের মত।

ঘাস খেতে খেতে আগুনের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে বারো-টা। ওটার দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি বাড়ছে ডজের। শেষে আর থাকতে না পেরে কিশোরকে বললেন, অনেক খেয়েছে। এবার বেঁধে ফেল। রাতে যেন ছুটতে না পারে। জোর করে হাসি ফোটালেন চেহারায়। নইলে আবার কি খেয়াল হয় কে জানে! র‍্যাঞ্চে ফিরে চলে যেতে পারে। বারোর কথা কিছুই বলা যায় না।

উঠে দাঁড়াল কিশোর। শারির পিঠে চড়ার সময় বুঝতে পারেনি, কতটা ধকল গেছে, এখন পারছে। এত শক্ত হয়ে গেছে পায়ের পেশী, ঠিকমত দাঁড়াতেই পারছে না। পায়ের পাতায় যেন কাঁটা বিঁধেছে, এরকম ভঙ্গিতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে জানোয়ারটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। আদর করে চাপড় দিল পিঠে। বলল, দূরে যাসনে। আমার কাছাকাছি থাকবি।

ওসব বলে লাভ হবে না, ডজ সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। গাধা গাধাই। ওটাকে বেঁধে ফেল, গাছের সঙ্গে।

ঘুরে দাঁড়াল কিশোর। ডজের মুখোমুখি। মাথা নাড়ল। না। রাতে পিপাসা লাগতে পারে ওর। পানি খেতে যেতে পারবে না বেঁধে রাখলে।

পানি আর কত খাবে? যা খাওয়ার খেয়েছে।

রাখঢাকের সময় শেষ হয়ে এসেছে। কাজেই নমনীয় হলো না কিশোর। বেঁধে রাখতে চাইলে আপনি যান। দেখুন ছুঁতে দেয় কিনা।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চোখে চোখে তাকিয়ে রইল দুজনে। চলার সময় বস হয়ে যায় বারোটা, কিন্তু এখন বস্ হলো কিশোর। সেটাই বুঝিয়ে দিতে চাইল। সে যা বলবে তাই হবে।

বেশ, অবশেষে নরম হলেন ডজ। হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে ঢুকলেন স্লীপিং ব্যাগের ভেতরে। আমার বিশ্বাস, যতক্ষণ তুমি আছ, কাছাকাছিই থাকবে বারোটা।

কেন? কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কিশোর, আপনার এ বিশ্বাস হলো কেন? আমার প্রতি কেন এত আকর্ষণ গাধাটার?

কুইয়েন সাবে! মেকসিকানদের ভাষায়ই বললাম। কাত হয়ে শুলেন ডজ। চোখ মুদল। মানে করে দিল কথাটার, কে জানে!

অগ্নিকুন্ডের কাছে ফিরে চলল কিশোর। যাওয়ার সময় তার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল রবিন।

স্লীপিং ব্যাগে ঢুকল কিশোর। ঘুমিয়ে পড়ল চারজনে।

অন্ধকার থাকতেই ঘুম ভেঙে গেল কিশোরের। আগুন নিভে গেছে। চোখে ঘুম। প্রথমে বুঝতে পারল না কি কারণে ঘুমটা ভাঙল। তারপর শুনতে পেল শব্দ।

গাধার ডাক। শারি!

একভাবে পড়ে থেকে শক্ত হয়ে গেছে শরীর। কোনমতে বেরিয়ে এল স্লীপিং ব্যাগের ভেতর থেকে। গাছপালার ভেতর দিয়ে ছুটল ঝর্নার দিকে।

বনের ভেতর থেকে বেরিয়েই চোখে পড়ল টর্চের আলো। ওপরে, নিচে, চক্রাকারে নড়ছে আলোক রশ্মি। সেই আলোয় প্রথমে দেখল শুধু বারো-টাকে। পেছনের পায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে উঠছে বার বার, সামনের পা দিয়ে লাথি মারার চেষ্টা করছে। প্রচন্ড খেপে গেছে।

ক্ষণিকের জন্যে স্থির হল আলো, চোখে পড়ল মহিলাকে। একহাতে টর্চ, আরেক হাতে বারোর দড়ি, টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। দড়িটা ফাসের মত করে পরিয়ে দিয়েছে শারির গলায়। কিশোরের ভয় হলো, দম না আটকে যায় টানাটানিতে।

আবার চিৎকার করে উঠল শারি। গলায় দড়ি আটকানো থাকায় শব্দটা কেমন ভোঁতা হয়ে গেল। আবার লাফিয়ে উঠল ওটা। সামনের পা দিয়ে লাথি মারার চেষ্টা করল অচেনা আগন্তুককে। একই সঙ্গে টেনে ছোটানোর চেষ্টা করছে গলায় লাগানো দড়ি।

সাপটার কি গতি করেছে, দেখেছে কিশোর। আশঙ্কা হলো মহিলার জন্যে। ওই লাথি যদি মাথায় লাগে, খুলি ভেঙে ঘিলু বেরিয়ে যাবে।

ছেড়ে দিন! চিৎকার করে বলল সে।

ছুটতে শুরু করল কিশোর। চেঁচিয়ে বলতে লাগল, শারি, চুপ কর, শারি! শান্ত হ!

দড়ি ছেড়ে দিয়েছে মহিলা।

টান বন্ধ হয়ে যেতেই আবার চারপায়ের ওপর স্থির হলো শারি। ফিরে তাকাল কিশোরের দিকে। ওটার নাকে হাত বুলিয়ে দিল সে। গলার দড়িটা দেখল। আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে হ্যাচকা টানে ঢিল করে দিল ফাঁসের বন্ধনী। আবার স্বাভাবিক ভাবে দম নিতে পারল শারি। মহিলার দিকে তাকাল কিশোর।

নিভে গেছে টর্চ।

অন্ধকার হয়ে গেছে আবার। ছুটন্ত পায়ের শব্দ কানে এল কিশোরের। পালিয়ে যাচ্ছে মহিলা। ঠিক এই সময় কিশোরের পাশে এসে দাঁড়াল মুসা আর রবিন।

কি হয়েছে? জানতে চাইল রবিন। শারি অমন চেঁচামেচি করল কেন?

ওকে চুরি করতে চেয়েছিল, জানাল কিশোর। এক মহিলা…

খাইছে! মুসা বলে উঠল। আবার সেই সোনালি চুল! তোমাকে যে খুন করতে চেয়েছিল! সে এসেছে বারো চুরি করতে?

না। মাথা নাড়ল কিশোর। টর্চের আলোয় আবছাভাবে দেখেছি তাকে। মুহূর্তের জন্যে। তবে চিনতে অসুবিধে হয়নি। সেই মেকসিকান মহিলা, বাসে যাকে দেখেছি। লাল শাল। কালো বেণি।

১০

পরের দুটো দিন প্রথম দিনের মতই একটানা পথ চল ওরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, মাইলের পর মাইল, চলে চলে সিয়েরা মাদ্রের আরও গভীরে ঢুকে যেতে লাগল। এই পর্বতমালার যেন আর শেষ নেই, চলেছে তো চলেছেই। অনেক কষ্টে ঢাল বেয়ে যখন ওঠে, ভাবে ওপারে আর কিছু নেই। কিন্তু চূড়ায় উঠে দেখে ঠিকই মাথা তুলে রেখেছে আরেকটা পাহাড়।

মাঝে উপত্যকা। কোনটা সরু, কোনটা চওড়া। এখানে কয়েক মাইল ধরে চলল পাইনের বন। তারপর, সেই বন পেরিয়ে, আরেকটা ঢাল বেয়ে উঠে গাছপালার মাথা ছাড়িয়ে এল একসময়, ওপরে রুক্ষ পাথুরে ঢাল প্রায় খাড়া হয়ে উঠে গেছে।

ভাগ্যিস এখন গরমকাল, মুসা বলল। পাথর মাড়িয়ে ওঠার সময় সামনের দিকে ঝুঁকে থাকতে হচ্ছে অনেকখানি, পর্বতের খাড়াইয়ের জন্যে। শীতকাল হলে তুষারেই ডুবে যেতাম।

তাতে মন্দ হত না, রবিন বলল। দরদর করে ঘামছে পরিশ্রমে। কপাল থেকে একফোঁটা গড়িয়ে নামল চোখের পাতায়। এই গরম তো আর লাগত না।

ওদের দিন শুরু হয় এখানে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। সকালে নাস্তা সারে বীন আর চাল সেদ্ধ দিয়ে, দুপুরে লাঞ্চে ঠান্ডা বীন আর চাল সেদ্ধ-সকালে খাওয়ার পর যা বেঁচে যায়, রাতে আবার একই খাবার, গরম গরম, নতুন রান্না করে। মহা বিরক্তিকর। ঘেন্না ধরে গেছে কিশোরের। রবিনের তো এখন দেখলেই বমি আসে। মুসারও আর ভাল লাগছে না।

ফিরে যাওয়ার কথা বলল রবিন আর মুসা। কিন্তু গোঁ ধরে আছে কিশোর। এই রহস্যের শেষ না দেখে সে ছাড়বে না। দেখাই যাক না, কোথায় ওদেরকে নিয়ে যায় শারি। তবে, আর দুচারদিন ওই ভয়াবহ খাবার খেতে হলে তারও মনোবল ভেঙে যাবে।

দিনে তিন-চার বার করে খাওয়ার জন্যে থামে শারি। অন্যদেরকেও থামতে হয় বাধ্য হয়ে। এই থামাটাকে স্বাগতই জানায় তিন গোয়েন্দা। বিশ্রামের সুযোগ পাওয়া যায়। ডজ তো এক মুহূর্তের জন্যেও থামতে নারাজ। তবে একটা সুবিধে হয় তাঁর এতে। ঘোড়াটাকে নিয়ে অনেক পেছনে পড়ে যান তো, এগিয়ে আসতে পারেন। প্রচুর জই খাওয়ানো হয় ঘোড়াটাকে, তার পরেও প্রতিদিনই একটু একটু করে দুর্বল হয়ে পড়ছে ওটা। মাঝে মাঝে মাইল খানেক পেছনে পড়ে যায়। রবিন আর মুসার মত পা টেনে টেনে চলে তখন।

এ রকমই একটা বিশ্রামের সময় হাত-পা ছড়িয়ে চিত হয়ে আছে তিন গোয়েন্দা, ঘাস চিবুচ্ছে শারি। রবিন বলল, ওই মহিলাগুলো কেন এর মধ্যে ঢুকেছে, বুঝতে পারছি না। প্রথমে কিশোরকে ডুবিয়ে মারার চেষ্টা চালাল সোনালি চুলওয়ালা এক মহিলা, তারপর কালো বেনি এসে চুরি করার চেষ্টা করল বারোটাকে।

হয়তো মেকসিকান মহিলার বারোর পা ভেঙে গেছে, আন্দাজ করল মুসা। কাজেই বোঝা টানার জন্যে আরেকটা দরকার হতেই পারে।

রবিন এই যুক্তি মানতে পারল না। বারোর চরিত্র ভাল করেই জানা আছে মেকসিকানদের। জোর করে যে পিঠে সওয়ার হওয়া যায় না, জানে।

ভাবছি, কিশোর বলল। বারো-টাকে নিজের জন্যেই চেয়েছে কিনা মহিলা। কিংবা অন্য কোন কারণে ওটাকে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছে।

তাই? মুসা আর কোন যুক্তি দেখাতে না পেরে চুপ হয়ে গেল।

কিশোরেরও আর কিছু বলার নেই।

আবার শুরু হলো পথচলা।

প্রতি সন্ধ্যায়ই একটা করে জায়গা খুঁজে বের করে শারি, যেখানে আগুন জ্বালানোর জন্যে প্রচুর লাকড়ি আছে, আর খাওয়ার পানির ব্যবস্থা আছে। ওখানেই রাতের জন্যে ক্যাম্প ফেলে ওরা। এর মাঝে ওই মহিলাকে ছাড়া আর কোন মানুষ চোখে পড়েনি ওদের। মাঝে সাঝে একআধটা কুঁড়ে চোখে পড়ে, মাটির দেয়াল আর পাতার ছাউনি, অ্যাডাব বলে ওগুলোকে। সবই দূরে দূরে। ওগুলোতে কেউ থেকে থাকলেও গোয়েন্দাদের চোখে পড়ল না।

দ্বিতীয় দিনে কিশোরের পায়ের পেশী শক্ত হয়ে থাকা সেরে গেছে। আড়ষ্টতা দূর হয়ে একেবারে ঝরঝরে হয়ে গেছে। হাঁটতে এখন অনেক সহজ লাগে। কোমরের বেল্ট ঢিলে হয়ে গেছে, রওনা দেয়ার সময় যে ছিদ্রটায় ঢুকত বাকলেসের কাটা, এখন তার আগের ছিদ্রটায় ঢোকে।

বাপরে বাপ! বন্ধুদেরকে বলল সে, বারোর পিঠে চাপা-ও কম পরিশ্রম নয়!

সেদিন, একটা শৈলশিরার কাছ দিয়ে চলার সময় সামনে সাদা ধোঁয়া দেখতে পেল ওরা। থেমে গেল। তাকিয়ে রইল সেদিকে।

বিড়বিড় করল রবিন, দাবানল না তো!

হলেও অনেক দূরে, মুসা বলল। আমাদের কাছে আসতে পারবে না।

যদি বাতাস এদিকে না বয়।

এ ব্যাপারে কিশোর কোন মন্তব্য করল না। চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয়েছে ধোঁয়ার দিকে।

সেদিন এত বেশি পেছনে পড়ে গেল ডজের ঘোড়া, সন্ধ্যায় তিন গোয়েন্দার এক ঘণ্টা পরে পৌঁছল ক্যাম্পে। খুবই উদ্বিগ্ন ডজ। রাতের খাওয়ার সময় বললেন, একটা দিন বিশ্রাম দিতে হবে ঘোড়াটাকে। নইলে চলতে পারবে না। খোঁড়াও হয়ে যেতে পারে।

খাওয়া শেষ হলে বললেন, তোমরা আমাকে রেখেই এগিয়ে যাও। যত তাড়াতাড়ি পারি তোমাদের কাছে পৌঁছব।

আমাদের খুঁজে পাবেন তো? মুসার গলায় সন্দেহ।

তা পাব। এসব অঞ্চলে চিহ্ন অনুসরণ করে চলা খুব সহজ। দুজন মানুষের জুতো আর একটা বারোর খুরের ছাপ জ্বলজ্বল করবে মাটিতে।

পরদিন সকালে খাবার ভাগ করে দিলেন ডজ। রওনা হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা। স্লীপিং ব্যাগের ওপরে আরও কিছু বোঝা, এই যেমন খাবার আর রান্নার সরঞ্জাম, বহন করতে আপত্তি করল না শারি। এবার আর ওটার পিঠে চাপল না কিশোর। হেঁটে চলল। রবিন আর মুসাও রইল সঙ্গে।

সেরাতে ক্যাম্প ফেলার পর প্রচুর কথা বলল ওরা, হাসি-মশকরা করল। ডজ কানের কাছে না থাকায় কথা বলতে পারছে সহজ ভাবে।

রাতে কি খাওয়া যায়, বলো তো? কিশোরকে রান্নার জোগাড় করতে দেখে ঠাট্টা করে বলল রবিন। রাইস আর বীন?

নাহ! জবাব দিল মুসা, বীন আর রাইস।

আসলে, হেসে বলল কিশোর। তোমরা দুজনেই ভুল করলে। রান্না করব বীনস আ লা রাইস। দয়া করে বাসন নিয়ে তৈরি হয়ে যাও।

ডিনারের পর আগুনের কুন্ড ঘিরে বসল তিনজনে। হঠাৎ উত্তেজিত ডাক ছাড়ল শারি। লাফিয়ে উঠল তিনজনে। কান খাড়া।

মুহূর্ত পরেই আগুনের আলোয় একটা বড় বারোকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল গাছের আড়াল থেকে। এল এদিকেই। শারির চেয়ে বয়েস অনেক বেশি। পিঠে জিন নেই। তবে দড়ি দিয়ে বাঁধা রয়েছে কয়েকটা পোঁটলা।

ওটার পেছন পেছন এল কালো বেণি করা সেই মহিলা।

ডাকাডাকি থামিয়ে দিল শারি। স্বজাতীয়কে দেখে খুশি হয়েছে। দুলকি চালে এগিয়ে গেল। নাক ঘষাঘষি করে স্বাগত জানাল পরস্পরকে।

কাছে এল মেকসিকান মহিলা।

ঘাবড়িও না, হাত নেড়ে স্প্যানিশ ভাষায় বলল সে। এবার বারো চুরি করতে আসিনি। তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমার নাম ইসাবেল। তোমরা কে, জানি। তবে, কথা বলার আগে, আমাকে কিছু খেতে দাও। খুব খিদে পেয়েছে।

এক প্লেট রাইস আর বীন দিল ওকে কিশোর। আগুনের ধারে বসল ইসাবেল। ভাল খিদেই পেয়েছে ওর। সমস্ত খাবার শেষ করার আগে মুখই তুলল না।

বাসে বেশ কিছুটা দূর থেকে ওকে দেখেছে কিশোর। এই প্রথম কাছে থেকে ভালমত দেখার সুযোগ পেল। মহিলা খাচ্ছে, আর সে তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে।

বয়েস চল্লিশ মত হবে। মোটামুটি সুন্দরীই বলা চলে। চেহারাই বলে দিচ্ছে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। পকেট ওয়ালা ঢিলাঢালা একটা উলের স্কার্ট পরেছে। পায়ে মেকসিকান বুট। গায়ে খাটো হাতাওয়ালা একটা ব্লাউজ। চামড়ার রঙ গাঢ় বাদামী, চোখ পিরেটোর মতই কালো। সব মিলিয়ে, কিশোরের মনে হলো, ওই মহিলা ভালর ভাল, মন্দের যম।

খালি বাসনটা সরিয়ে হাতঘড়ির দিকে তাকাল ইসাবেল। পুরুষের ঘড়ি পরেছে। বেল্টটা ঢিলে। হাত খাড়া করতেই নিচের দিকে নেমে গেল ওটা। তাড়াতাড়ি আবার ওপরের দিকে কব্জির কাছাকাছি তুলে দিল সে।

সময় বেশি নেই, ইসাবেল বলল। লেকের কাছে ফিরে যেতে হবে আমাকে। যতটা তাড়াতাড়ি পারি সংক্ষেপে সব বলে যাচ্ছি তোমাদেরকে। কিশোরের দিকে তাকাল সে। আমি ইংরেজি বলতে পারি না। তবে তোমরা স্প্যানিশ জানো, জানি আমি।

পুরানো চামড়ার জ্যাকেট পরা লোকটার কথা মনে পড়ল কিশোরের। যে ওদেরকে বাসে উঠতে বাধা দিচ্ছিল। লোকটার সঙ্গে তর্ক করার সময় নিশ্চয় মহিলা শুনেছে। বুঝতে পেরেছে ওরা স্প্যানিশ জানে।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। বলতে ততটা পারি না। তবে বুঝতে পারি। আস্তে আস্তে বলুন, বুঝব।

গুড। হাঁটু ভাঁজ করে আরাম করে বসল ইসাবেল। টেনে দিল স্কার্ট। পরের পনেরো মিনিট নিচু স্বরে প্রায় একটানা কথা বলে গেল। মাঝে সাঝে একআধটা প্রশ্ন করল কিশোর। ইতিমধ্যে একবার উঠে চলে গিয়েছিল রবিন। কয়েক মিনিট পর ফিরে এসেছে।

তারপর উঠে দাঁড়াল ইসাবেল। তিন গোয়েন্দাও উঠল।

এক এক করে ওদের সঙ্গে হাত মেলাল ইসাবেল। তারপর, যেমন হঠাৎ করে উদয় হয়েছিল, রহস্যময় ভাবে, তেমনি করেই আবার বারো-টাকে টেনে নিয়ে অশ্য হয়ে গেল রাতের অন্ধকারে।

আগুনে কাঠ ফেলল মুসা। কি বুঝলে?

একটা সাংঘাতিক গল্প বলে গেল! মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে বলল কিশোর। রবিন, পঞ্চো ভিলার ব্যাপারে যা যা জানো বলো তো?

আমাকে কি মেকসিকান পাবলিক লাইব্রেরি বলে মনে হচ্ছে?

বাজে কথা রাখ। রকি বীচ থেকেই মেকসিকোর ইতিহাস পড়া শুরু করেছ তুমি। শেষ করোনি এখনও?

করেছি, হাসল রবিন। যেদিন তুমি লেকের পানিতে ডুবে আরেকটা ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছিলে, সেদিনই।

আমিও জানি, শেষ করে ফেলেছ। হাসিটা ফিরিয়ে দিল কিশোর। উনিশ শো ষোলো সালের ব্যাপারে আমার আগ্রহ। পঞ্চো ভিলার কথা কি জানো?

ওই বছর একটা বিরাট বিদ্রোহ হয়ে গিয়েছিল মেকসিকোতে। সেই বিদ্রোহেরই এক বড় নায়ক ছিল পঞ্চো ভিলা। অনেকের ধারণা, আউট-ল ছিল সে, জেসি-জেমসের মত। ব্যক্তিগত একটা সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিল। অনেকগুলো লড়াই জিতেছে।

এখানে, সিয়েরা মাদ্রেতেও এসেছিল নাকি?

এসেছিল। তার একটা ঘাঁটি তৈরি করেছিল এখানেই। মরুভূমিতে নেমে গিয়ে ট্রেনের ওপর আক্রমণ চালাত। লুটপাট করে ফিরে এসে আবার লুকিয়ে পড়ত এখানে।

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। এই কথাটা তাহলে সত্যিই বলেছে ইসাবেল।

তারমানে, তুমি বলতে চাইছ ওর ব্যাপারেই যত আগ্রহ মহিলার? মৃত একজন মানুষের ব্যাপারে?

না, তার ব্যাপারে নয়, কিশোর জবাব দিল। মনে হচ্ছে সিয়েরা মাদ্রের গুপ্তধনের পেছনেই ছুটেছি আমরা, না জেনে, যেটার কথা বহুবার বলেছ তুমি। পঞ্চো ভিলার লুটের মাল। শুনলে না, ইসাবেল বলে গেল, একদিন একটা ট্রেন লুট করে হাজার হাজার ডলার দামের সিলভার পেসো নিয়ে এসেছিল পঞ্চো। এখানে উঠে এসে কোন একটা গুহাটুহায় লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল সে সব পেসো। ইসাবেলের বলে যাওয়া গল্প আবার বলতে লাগল কিশোর। নিজেকেই যেন শোনাচ্ছে। খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে কি রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এর ভেতরে। একটা ভুল করেছিল পঞ্চো, কিংবা তার দুর্ভাগ্যই বলা যায়, পেসোর সঙ্গে একই গুহায় বারুদ রেখেছিল সে। অসাবধানে দেশলাইয়ের কাঠি ফেলেছিল তার এক সহচর, বিস্ফোরণ ঘটল বারুদে। পর্বতের একটা অংশ ধসে গেল। টন টন পাথরের নিচে চাপা পড়ল পঞ্চোর লুটের মাল, সেই সঙ্গে তার সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশ। পাথর পরিষ্কার করতে শুরু করল পঞ্চো। কিন্তু এই সময় তার শত্রুরা এসে আক্রমণ চালিয়ে বসল পর্বতের অন্য পাশ থেকে পালাতে বাধ্য হলো সে।

এক মুহূর্ত চুপ করে রইল কিশোর।

তারপর, গল্পটা শেষ করল সে। ইসাবেল বলে গেল, শুনলেই তো, মুদ্রাগুলো এখনও সেখানে আছে।

নীরবে কিশোরের কথা শুনছিল মুসা আর রবিন।

ইসাবেল জানল কি করে এসব? রবিনের প্রশ্ন। উঠে চলে যাওয়ায় অনেক কিছুই শোনেনি সে।

ও বলল, তার দাদা নাকি তার সৈন্য দলে ছিল। ও-ই গল্পটা শুনিয়ে গেছে। ওদের পরিবারকে, জবাবটা দিল মুসা।

ডজের কথা কি বলল? জানতে চাইল রবিন। ওর নাম বলতে শুনলাম। বারোটার কথাও কি যেন বলল?

কিশোর বলল, মাস তিনেক আগে নাকি ইসাবেলের এক বন্ধু, টনি নামের এক আমেরিকান তরুণ, এখানে এসেছে। সে আর তার বাবা সোনা খুঁজে বেড়িয়েছে এখানকার পর্বতে। আসলে ওরা খুঁজতে এসেছিল পঞ্চো ভিলার গুহা। ওদের ধারণা, গুহাঁটা খুঁজেও পেয়েছিল ওরা। ইসাবেলকে টনি সে কথাই বলেছে।

চুপ করল কিশোর।

বলো, তাগাদা দিল রবিন। কথার মাঝখানে থামলে কেন? ডজ আর শারি এর মধ্যে এল কিভাবে শুনতে চাই।

টনি যখন লেকে গেল, বলল কিশোর। তার সঙ্গে ছিল একটা ছোট সাদা বারো। গুহার কাছে পেয়েছিল ওটাকে। বাচ্চাটার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলল। যাওয়ার সময় নিয়ে গিয়েছিল ডজের র‍্যাঞ্চে। তারপর আবার ফিরে গিয়েছিল পর্বতে।

কেন? সাথে করে যখন আনতেই পারল, নিতে পারল না কেন? কেন ফেলে গেল র‍্যাঞ্চে?

কারণ টনির ভয়, শারি আবার পর্বতে গেলে মরে যাবে। বারোটার চিকিৎসার দরকার ছিল, আর এখানে সব চেয়ে কাছের পশুচিকিৎসক থাকেন লারেটোতে। পিরেটো গিয়ে নিয়ে এসেছিল তাঁকে। বারোটাকে চিকিৎসা করে সারিয়ে তোলা হলো।

কি হয়েছিল ওর? এটাই যদি অসুস্থ হবে, ডজের র‍্যাঞ্চ পর্যন্ত গেল কি করে?

চোখে একটা বাজে ধরনের ইনফেকশন হয়েছিল। তাতে প্রায় অন্ধই হয়ে গিয়েছিল বারোটা। ইসাবেলের গল্পের এই জায়গাটায় বিশেষ আগ্রহ কিশোরের। গলা শুনেই যে তাকে চিনেছে বারোটা, তার সঙ্গে ওই চোখের অসুখের কি কোন যোগাযোগ আছে? কেন শারি বুঝতে পারল না, সে টনি নয়, যে তাকে অন্ধত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে বাঁচিয়েছে? অন্ধ হয়ে পর্বতে কোনদিন টিকে থাকতে পারে না কোন বারো। পিরেটোর কথা মনে পড়ল কিশোরের শারি ভাবে, তুমি ওর প্রাণ বাঁচিয়েছ।

মোলায়েম শিস দিল মুসা। হুঁ, মিলতে আরম্ভ করেছে। ডজ জেনে গেছে টনি আর তার বাবা পঞ্চো ভিলার গুপ্তধন খুঁজে পেয়েছে…

তখন, মুসার মুখের কথা টেনে নিয়ে কিশোর বলল, ডজ টনিকে গুহাঁটা চিনিয়ে দেয়ার জন্যে চাপাচাপি করেছে। কিন্তু টনি খুব চালাক। পালাল। চলার পথে নিজের চিহ্ন সব মুছে দিয়ে গেল, যাতে ডজ পিছু নিতে না পারে। ডজের কাছে রয়ে গেল শারি। পথ চেনে যে। পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারে গুহার কাছে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও শারিকে বাগ মানাতে পারল না সে, কিছুতেই তাকে নিয়ে গেল না বারোটা। ডজ বুঝতে পারল, যাকে পছন্দ করবে একমাত্র তার কথা ছাড়া আর কারও আদেশ মানবে না শারি। এমন কেউ, যাকে কণ্ঠস্বর শুনেই বন্ধু হিসেবে চিনে নেবে।

তখন ওরকম কাউকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করল ডজ, মুসা বলল, যার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে টনির স্বরের মিল আছে। এ জন্যেই রহস্যময় ওই ধাঁধা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল সে।

এবং কিশোরকে খুঁজে বের করল, যোগ করল রবিন। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, ইসাবেল কেন এসব কথা ওকে বলে গেল?

ঠিক, মুসা বলল। আমাদেরকে র‍্যাঞ্চেই যেতে দিতে চায়নি যে, সে কেন এখন যেচে পড়ে সব কথা শুনিয়ে যায়?

কথাটা কিশোরের মনেও খচখচ করছে।

আমাকে কোন প্রশ্ন করতে দেয়নি ইসাবেল, কিশোর বলল। কেবল তার কথা যখন বুঝিনি, জিজ্ঞেস করেছি, বুঝিয়ে দিয়েছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। যা বলার সে নিজেই বলেছে, আমাকে কেবল শুনতে হয়েছে। ডজকে একবিন্দু বিশ্বাস করে না। ওর ঘোড়া খোঁড়া হয়ে যাবে, চলতে পারবে না, এটা বিশ্বাস করেনি। ইসাবেলের ধারণা, ঘোড়ার পা ঠিকই ছিল, ইচ্ছে করেই আমাদের পেছনে পড়েছে ডজ। কোন উদ্দেশ্য আছে। মহিলার ভয়, টনি আর তার বাবাকে দেখলেই গুলি করে মারবে ডজ। ইসাবেলকে দেখলে তাকেও মারবে। কাজেই লেকে ফিরে যাচ্ছে সে। আমাদেরকে অনুরোধ করেছে গুহায় গিয়ে টনি আর তার বাবাকে যেন সাবধান করে দিই ডজের ব্যাপারে।

আগুনের দিকে তাকিয়ে বসে রইল তিন গোয়েন্দা। দীর্ঘক্ষণ কারও মুখে কথা নেই।

অবশেষে মুখ খুলল মুসা, কিশোর, ইসাবেলকে বিশ্বাস করো তুমি?

বুঝতে পারছি না করব কিনা। তাকে সন্দেহ এবং অবিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। টনি আর তার বাবাকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে এত আগ্রহ কেন? এমনও তো হতে পারে, সে চাইছে আমরা গিয়ে পেসোগুলো খুঁজে বের করি।

হ্যাঁ, হতেই পারে, রবিন বলল। আমাদের পেছন পেছন যাবে সে। তারপর যেই আমরা ওগুলো বের করব, কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করবে।

১১

পরদিন সূর্য ওঠার আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়ল তিন গোয়েন্দা। নাস্তা সারতে সারতে আরও আলোচনা করল ইসাবেলের ব্যাপারে।

আমাকে বোকা বানাতে চেয়েছে সে, কিশোর বলল।

কিভাবে? মূসার প্রশ্ন।

লেকে ফিরে যাচ্ছে বলে! বেশ তাড়াহুড়া, এমন একটা ভাব, যেন তক্ষুণি রওনা হয়ে যাবে লেকের উদ্দেশে।

মাথা দোলাল রবিন। রাতের বেলা এসব পাহাড়ে পথ চলাই মুশকিল। যাওয়ার ইচ্ছে থাকলে সকালেও তো রওনা হতে পারত। পুরো ব্যাপারটাই আসলে ভাঁওতাবাজি।

আর ওই ঘড়িটা, কিশোর বলল, বার বার কজি থেকে নেমে যাচ্ছিল, ঠেলে ঠেলে তুলতে হচ্ছিল ওপরে। মনে হলো… শ্রাগ করল সে, …জানি, না, আলোর কারসাজি হতে পারে। ভুলও দেখে থাকতে পারি।

কি? জিজ্ঞেস করল মুসা।

ওর কব্জিতে একটা দাগ দেখেছি। শিওর না।

মুসা দেখেনি, জানাল সে কথা।

রবিন বলল, মহিলা ভীষণ চালাক। ওর অনেক কিছুই খটকা লাগার মত। আমার অবাক লেগেছে, যখন জানলাম, কন্টাক্ট লেন্স পরে। সাধারণত যা পরে না। মানুষ…

কন্টাক্ট লেন্স? বাধা দিল মুসা।

হ্যাঁ। বাসে মুছতে দেখেছি। মাথা নিচু করে রেখেছিল, প্রথমে বুঝতে পারিনি কি করছে। পরে ভালমত দেখে বুঝলাম। আরেকটা ব্যাপার আরও বেশি অবাক করেছে। চুপ হয়ে গেল রবিন।

সেটা কি? জানতে চাইল কিশোর। বলতে এত দেরি করছে রবিন, এটা সহ্য হচ্ছে না ওর।

আরেকটা ব্যাপার হলো… কিশোরের অবস্থা বুঝে হাসল রবিন। ইচ্ছে করেই দেরি করছে বলতে। তথ্য গোপন করে কিশোরও অনেক সময় ওদেরকে এরকম অস্থিরতার মাঝে রাখে। সুযোগ পেয়ে শোধ তুলছে সে।

কী! বলো না! খেপে গেল কিশোর। ওয়াকি-টকি দিয়ে এই পর্বতের ভেতর কি করে সে? প্লেটের বীন সেদ্ধ শেষ করে কয়েকটা পাইনের পাতা কুড়িয়ে নিয়ে সেগুলো দিয়ে মুছে পরিষ্কার করতে লাগল প্লেটটা রবিন। আবার চুপ।

অস্থির হয়ে উঠেছে কিশোর। এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনল। তারপর যখন খেঁকিয়ে উঠতে যাবে তখন রবিন বলল, বারোর পিঠের একটা পোটলা থেকে ওয়াকি-টকির অ্যান্টেনা বেরিয়ে আছে দেখলাম মনে হলো। পঞ্চো ভিলার ব্যাপারে যখন তোমাকে জ্ঞান দিচ্ছে, তখন উঠে গেলাম ভাল করে দেখার জন্যে। ওয়াকিটকি একটা আছে ওর কাছে।

ওয়াকি-টকি দিয়ে এই পর্বতের ভেতর কার সঙ্গে কথা বলে সে? অবাক হলো মুসা। ডজ হতে পারে না। কারণ ওকে দেখতে পারে না মহিলা। তাছাড়া ডজের সমস্ত পোটলা-পাটলি ভাল মত দেখেছি আমি। ওয়াকি-টকি নেই।

পিরেটোর আছে, কিশোর বলল। নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমি মেরামত করে দিয়েছি। কিন্তু র‍্যাঞ্চ এখান থেকে অনেক দূর। ওয়াকি-টকিতে যোগাযোগ অসম্ভব।

উঠল ওরা। সাবধানে আগুন নেভাল, যাতে ছড়িয়ে গিয়ে দাবানল সৃষ্টি করতে পারে। শারির কাঁধে মালপত্র বাঁধল কিশোর।

লেকে যদি, বারোর পিঠে আলতো চাপড় দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল কিশোর। সত্যিই না গিয়ে থাকে ইসাবেল, তাহলে কি করবে? হতে পারে, এই মুহূর্তে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে আমাদের ওপর নজর রাখুছে সে। আলো বেড়েছে। বাড়ছে ক্রমেই। চারপাশে তাকাল সে। আমরা এগোলেই আমাদের পিছু নেবে, চিহ্ন ধরে ধরে। আমাদেরকে জানতে দিতে চায় না। হয়তো, সে-ও যে ওই পেসোর পেছনে লেগেছে।

হাত ওন্টাল মুসা। যদি সেটা করতেই চায়, করবে, আমাদের কিছু করার নেই। চিহ্ন তো আর লুকাতে পারব না।

তা পারব না। শারিকে চলার নির্দেশ দিল কিশোর। তবে একটা সুবিধা আমাদের আছে।

কি?

কাল রাতে ইসাবেলের বারোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলেছে শারি। আর মিস্টার সাইমন জানিয়েছেন, বারোরা চেনা বারোকে অনেক দূর থেকেও গন্ধ শুকে চিনতে পারে। একজন আরেকজনকে ডাকাডাকি করে জানান দেয়। তাই, ইসাবেলের বারোটা যদি খুব কাছাকাছি চলে আসে, ডাক দেবেই। শারিও জবাব দেবে। মাইল দুয়েকের মধ্যে থাকলেও জেনে যেতে পারব আমরা।

সেদিনকার পথচলা অন্যদিনের চেয়ে কঠিন হল। সব চেয়ে খাড়া আর উঁচু চূড়ায় উঠতে থাকল শারি। ঢালের গভীর সব খাঁজ আর শৈলশিরার ভেতর দিয়ে একেবেঁকে উঠে চলল অনেক উঁচু চূড়াটার দিকে।

একটি বারের জন্যেও থামল না কিংবা ডাকল না ওটা। বার বার পেছনে ফিরে তাকাল তিন গোয়েন্দা, কিন্তু ইসাবেল বা তার বারোর ছায়াও চোখে পড়ল।

আরেকবার ধোঁয়া দেখতে পেল ওরা। এক জায়গা থেকে লম্বা হয়ে উড়ছে ঘন সাদা ধোঁয়া। মনে হলো, যে চূড়াটায় উঠছে ওরা, তার ওপাশ থেকে উঠছে ওই ধোঁয়া।

অদ্ভুত তো? মুসা বলল। বনই নেই, আগুন লাগল কিসে? ক্যাকটাস ছাড়া আর কিছুই দেখি না।

হুঁ, মাথা দোলাল কিশোর। পাহাড়ের অন্যপাশে আছে হয়তো।

তিক্ত কণ্ঠে রবিন বলল, এখানে যেন সবাই মিথ্যুক। ডজ মিছে কথা বলে, ইসাবেল মিথ্যে বলে, এখন পাহাড়ও দাবানল লেগেছে বলে ফাঁকি দিয়ে চলেছে আমাদের।

আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা। ধোঁয়ার রঙও কেমন আজব! সাধারণ ধোঁয়ার মত নয়।

অনেক ওপরে উড়ছে শিকারি পাখিরাঃ শকুন, ঈগল, চিল। সেদিকে তাকিয়ে রবিন বলল, দাবানল পাখিদের কিছু করতে পারে না। বনের সবাই মরলেও ওরা পালায়। আগুন ছুতেও পারে না ওদের। এদিক থেকে ওরা ভাগ্যবান।

এগিয়ে চলেছে ওরা। রহস্য সমাধানের প্রচন্ড নেশাই রুক্ষ দুর্গম পথে শারির পিছু পিছু টেনে নিয়ে চলেছে কিশোরকে। বিকেলের শুরুতে মুসা আর রবিনকে অনেক পেছনে ফেলে এল ওরা।

এই থাম! আচমকা চিৎকার শোনা গেল। এক পা এগোবে না আর!

থেমে গেল রবিন আর মুসা। মুখ তুলে দেখল ওদের অনেক ওপরে হাত তুলছে কিশোর।

এইবার আস্তে আস্তে এগোও, বলল সে। বারোটাকে অনুসরণ করো।

অবাক হয়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল দুই সহকারী গোয়েন্দা। তাই তো করছে ওরা। তাহলে কি বলতে চাইছে কিশোর?
ধীরে ধীরে যেন প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে আরম্ভ করল আবার রবিন আর মুসা। শারির একেবারে পেছনেই রয়েছে কিশোর। কোন রহস্যময় কারণে হাত তুলেই রেখেছে সে। বুঝতে পারছে না ওরা।

তারপর থেমে গেল গোয়েন্দাপ্রধান।

আর কাছে এসো না, পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলে আবার ভেসে এল কিশোর পাশার কণ্ঠ। কে তোমরা? এখানে কি চাই?

আবার একে অন্যের দিকে তাকাল মুসা আর রবিন। পুরো ব্যাপারটাই কেমন ভূতুড়ে লাগছে এখন ওদের কাছে। হচ্ছেটা কি? পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি ওরা? ওদের মাথায় যেন গোলমাল করে দেয়ার জন্যেই আবার শোনা গেল আমি কিশোর পাশা। তোমার জন্যে খবর নিয়ে এসেছি।

ওর কথা যে কি প্রতিক্রিয়া করছে ওর বন্ধুদের ওপর ভাবল না কিশোর, ভাবার অবকাশও নেই। ওর কাছেও পরিস্থিতিটা বিপজ্জনক। পথের একটা মোড় ঘুরতেই চোখ পড়েছে একটা রাইফেলের নলের ওপর। পাথরের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে আছে ওটা।

থাম! আবার আদেশ দিল আগের কণ্ঠটা। এগোবে না আর!

ওই কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দিয়েছে শারিকেও। খাড়া হয়ে গেছে কান। মোলায়েম ডাক ছাড়ল একবার।

আবার ধীরে এগোনোর আদেশ হলো। শারিকে নিয়ে এগিয়ে চলল কিশোর। নলের গজখানেক সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। এখনও রাইফেলের নল স্থির হয়ে আছে কিশোরের বুকের দিকে।
পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল কিশোরেরই বয়েসী একটা ছেলে। তবে ওর চেয়ে লম্বা। এলোমেলো সোনালি চুল, রোদে পোড়া তামাটে মুখ। পরনে জিনস, পায়ে মেকসিকান বুট, গায়ে ডেনিম জ্যাকেট। রাইফেল নামাল না। নজর শারির দিকে।

শারি, বলল সে। তুই এখানে এলি কি করে?

কেঁপে উঠল বারোর কান। মুখ ঘুরিয়ে তাকাল ছেলেটার দিকে। তারপর কিশোরের দিকে, তারপর আবার ছেলেটার দিকে। দ্বিধায় পড়ে গেছে।

আদর করে ওর গলা চাপড়ে দিল কিশোর।

আমি নিয়ে এসেছি, শারির হয়ে জবাব দিল সে। কিংবা বলা যায়, আমাকে এনেছে ও। তুমি কি টনি?

জবাব দিল না ছেলেটা। কিশোরের দিকে একই ভাবে রাইফেল তাক করে রেখে সরে এল কিনারে, নিচে তাকাল। তিরিশ গজ নিচে ধীরে ধীরে উঠে আসছে রবিন আর মুসা।

ওরা কারা? ছেলেটার কণ্ঠে সন্দেহ।

অল্প কথায় জানাল কিশোর, ওরা তার বন্ধু, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এসেছে।

তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি আমরা। আবার নাম জিজ্ঞেস করল কিশোর, তোমার নাম টনি, তাই না?

হ্যাঁ। রাইফেল নামাল না টনি। কি সাহায্য করতে এসেছ?

তোমাকে সাবধান করে দিতে যে, ডজ মরিস…

ও কোথায়? সহসা শঙ্কা ফুটল টনির চোখে। তোমার বন্ধুদের সঙ্গে আছে?

না। আমাদেরকে নিয়ে একসাথেই বেরিয়েছিল। তারপর তার ঘোড়ার পায়ে অসুখ দেখা দিল। ও তাই বলেছে। কয়েক মাইল পেছনে ফেলে এসেছি ওকে আমরা। কাল নাগাদ হাজির হয়ে যেতে পারে।
থ্যাংকস। আমাকে জানানোর জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে। সেফটি ক্যাচ অন করে রাইফেলটা কাঁধে ঝোলাল টনি। তোমরা এলে কি করে এখানে?

বললাম না শারি নিয়ে এসেছে। যেখান থেকে গিয়েছিল ও সেখানেই ফিরে এসেছে।

এত তাড়াতাড়ি ওকে পোষ মানাল কি করে ডজ?
ও পারেনি। এখনও বুনোই রয়ে গেছে বারোটা। কেবল আমাকেই কাছে ঘেঁষতে দেয়। ওর হয়তো ধারণা, আমিই ওর প্রাণ বাঁচিয়েছি। আমাকে তুমি ভেবেছে।

আমি? কেন?

কারণ, আমাদের দুজনের কণ্ঠস্বরই এক রকম মনে হচ্ছে তুমি এটা খেয়াল করনি। শারির কাছে তাই আমরা দুজনেই এক। আমার গলা প্রথমে শুনে ভেবেছে আমিই তুমি। ওর কাছে এটা সেই কণ্ঠ, যে তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে লেকের কাছে, যখন সে অন্ধ ছিল। ওকে ভাল করার জন্যে কৃতজ্ঞতা বোধ থেকেই আমাকে পছন্দ করেছে সে। আমার কথা শোনে। তোমার কথা শুনে অবাক হয়েছে। কারণ, একই রকম কণ্ঠস্বর।

বারোটার দিকে তাকিয়ে হাসল টনি। আয়, শারি। লক্ষ্মী শারি।

এখনও কাঁপছে বারোর কান। ঘোরের মধ্যে যেন কথা শুনল টনির, এগিয়ে গেল। তারপর যখন ওকে আদর করল টনি, আস্তে আস্তে ঘোর ভাঙল যেন। টনির বুকে নাক ঘষল।

রবিন আর মুসা উঠে এল সেখানে।

পরিচয় করিয়ে দিল কিশোর, আমার বন্ধু মুসা আমান। আর ও রবিন মিলফোর্ড।…রবিন, ও টনি… পুরো নাম শোনার জন্যে তাকাল ওর মুখের দিকে।

টনি ইয়ালার। হাত বাড়াল সে, হাই, তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।

রবিন আর মুসা হাসল। এখন বুঝতে পারছে, কিশোরের উল্টো পাল্টা কথার মানে। আসলে কিশোর বলেনি ওসব কথা, বলেছে টনি। তার কণ্ঠকেই কিশোরের কণ্ঠ বলে ভুল করেছে ওরা।

মনে হয় পিপাসা পেয়েছে তোমাদের, টনি বলল। যে রকম পথে হেঁটে এসেছ, পাওয়ারই কথা। এসো। দিচ্ছি। আমার ঘরটাও দেখবে।

শারির দড়ি ধরে নিয়ে চলল টনি। একটা শৈলশিরার পাশের ঘোরানো পথ ধরে ওপরে উঠে পর্বতের গায়ে দেখতে পেল প্রায় লুকানো একটা ফোকর। সুড়ঙ্গ মুখ।

মাথা নুইয়ে রাখ, সরু, নিচু সুড়ঙ্গে ঢোকার আগে সাবধান করে দিল টনি। কিছুদূর এগোনোর পর বলল, ঠিক আছে, এবার সোজা হও।
ভেতরে আবছা আলো। সেই আলোয় তিন গোয়েন্দা দেখল, বিশাল এক গুহায় এসে দাঁড়িয়েছে ওরা। ছাত অনেক উঁচুতে।

দেশলাই দিয়ে মোম ধরল টনি। কিশোর আন্দাজ করল, বেশ কিছুদিন ধরে এখানে বাস করছে সে। মেঝেতে গোটানো রয়েছে একটা স্লীপিং ব্যাগ। বাসন, হাঁড়ি-পাতিল, একটা কেরোসিনের চুলা, আধবোঝাই কয়েকটা বস্তা, গাঁইতি, শাবল রাখা হয়েছে দেয়াল ঘেঁষে। ছাত দেখেই অনুমান করা যায় এখানে কখনও বারুদ বিস্ফোরিত হয়নি। পঞ্চো ভিলার গুহা নয় এটা।

একটা বস্তা তুলে নিয়ে মেঝেতে জই ঢালল টনি। আব্বা এনেছিল, ঘোড়ার জন্যে। ভালই হয়েছে, কিছুটা রয়ে গেছে। এখানে ঘাসপাতার যা আকাল। এই জই না থাকলে না খেয়ে থাকতে হত শারিকে।
একমাত্র স্লীপিং ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন। তোমার আব্বা কোথায়?

কেন? তার কি দরকার? আবার সন্দেহ জাগল টনির চোখে।

কারণ তাকেও ডজের ব্যাপারে সাবধান করে দিতে চাই।
মাটির জগ তুলে নিয়ে একটা মাটির ছোট গামলায় শারির জন্যে পানি ঢালল টনি।

আব্বা নেই। ঘোড়া নিয়ে গেছে, খাবারদাবার আনার জন্যে। জগটা বাড়িয়ে দিল তিন গোয়েন্দার দিকে। নাও, পানি।
কোনদিকে গেছেন তিনি? জানতে চাইল কিশোর। লেকের দিকে? তাহলে ডজের সামনে পড়ে যেতে পারেন।

না, ওদিকে যায়নি। পর্বতের অন্যপাশে একটা গ্রাম আছে। গোটা দুই দোকান আছে ওখানে। সব জিনিস পাওয়া যায় না। তবে বাস থামে। আর বাস দিয়ে…

থেমে গেল টনি। সন্দেহ যাচ্ছে না। দ্বিধা করছে। মনস্থির করার চেষ্টা করছে, ওদেরকে বিশ্বাস করবে কিনা।

এখানে কেন এসেছ, বলো তো? জিজ্ঞেস করল সে।

ডজের ধারণা…

বলতে গিয়ে চুপ হয়ে গেল কিশোরও। সব কথা টনিকে বলার সময় এসেছে। জোরে একবার দম নিল সে। তারপর শুরু করল। ক্রসওয়ার্ড পাজল প্রতিযোগিতা থেকে। একে একে বলল, কি করে ওরা জানতে পেরেছে পঞ্চো ভিলার পেসোর কথা।

নীরবে শুনছে টনি। মেঝেতে তিন গোয়েন্দার পাশাপাশি বসেছে। পেসোর কথা শুনে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল সে। ওগুলোর কথা জজ বলেছে? আর কি বলেছে? পেলে লুটের মাল ভাগাভাগি করে নেবে?

না, মুসা সন্দেহমুক্ত করার চেষ্টা করল তাকে। ভুলেও একবার পেসোর কথা উচ্চারণ করেনি ডজ। ও আমাদেরকে বলেছে, পর্বতে যেতে হবে বারোটাকে ছেড়ে দিয়ে আসার জন্যে। ওটার জন্মভূমিতে। শারির খুর নাকি বড় হয়ে যাচ্ছে, পর্বতের পাথুরে অঞ্চলে ঘষা না খেলে সমান হবে না।

কী!

মুসা আরও বলল, ইসাবেল আমাদেরকে বলেছে রূপার পেসোর কথা।

ইসাবেল? চিনতে না পেরে ভ্রূকুটি করল টনি। এই ইসাবেলটা আবার কে?

চেহারার বর্ণনা দিল রবিন। কালো বেনির কথা বলল। কালো চোখ আর লাল শলের কথা বলল।

মেকসিকান? এখনও ভুরু কুঁচকেই রেখেছে টনি।

মনে তো হলো, জবাব দিল কিশোর। স্প্যানিশ ছাড়া আর কোন ভাষা বোঝে না। ওর চামড়ার রঙও মেকসিকানদের মত বাদামী। নিজেও অবাক হয়ে ভাবতে আরম্ভ করেছে এখন, আসলেই মহিলা মেকসিকান কিনা! ডজের ব্যাপারে তোমাকে সাবধান করে দিতে বলেছে আমাদেরকে। তোমার নাকি বন্ধু। তুমি তাকে চেন?

মাথা নাড়ল টনি। নামই শুনিনি কখনও। আর চেহারার যা বর্ণনা শুনলাম, তাতে বুঝতে পারছি, ওর সঙ্গে জীবনে কখনও দেখা হয়নি আমার।

১২

এই পর্বতে গুহার অভাব নেই, টনি বলল। পঞ্চো ভিলা আর তার সাগরেদরা নিশ্চয় একেক সময় একেক গুহায় ঢুকত, লুকিয়ে থাকার জন্যে। তবে আব্বার ধারণা, সে যেটাতে পেসো লুকিয়েছিল সেটা পেয়ে গেছি আমরা।

সন্ধ্যায় যার যার স্লীপিং ব্যাগ বের করে তার ওপর আরাম করে বসেছে তিন গোয়েন্দা। কেরোসিনের চুলায় এক হাঁড়ি খাবার রান্না করেছে টনি, একঘেয়ে সেই বীন আর চাল সেদ্ধ। তিনটে মোম জ্বলছে এখন। সুড়ঙ্গমুখে একটা কম্বল ঝুলিয়ে দিয়ে এসেছে সে, যাতে বাইরে আলো বেরোতে না পারে। এককোণে জই চিবাচ্ছে শারি।

যার যার প্লেটে খাবার দেয়া হলো।

কি করে জানলে তোমরা, আসল গুহাঁটাই খুঁজে পেয়েছ? মুসা জিজ্ঞেস করল। এত গুহার মধ্যে, আলাদা করে চিনলে কি করে?

কিছু কিছু চিহ্ন দেখে। পাথর পড়ে বন্ধ হয়ে ছিল গুহামুখ। ওগুলো কিছু কিছু সরিয়ে যখন ঢুকলাম, পেয়ে গেলাম ইগনাসিওকে।

ইগনাসিও?

ভিলার এক সিপাহী। উনিশশো ষোলো সাল থেকে গুহায় থেকে থেকে তার চেহারা অবশ্যই আর চেনার জো ছিল না। আসলে, চেহারাই আর অবশিষ্ট নেই। শুধুই কঙ্কাল। ইউনিফর্মের কয়েকটা টুকরো তখনও লেগে ছিল। আর তার খুলিটা…

দয়া করে এখন একটু চুপ করবে, বাধা দিয়ে বলল মুসা। আমি এখন এই রাজকীয় খানা গেলার চেষ্টা করছি।

হাসল রবিন। মরা মানুষের কথা শুনলে ভয় পায় আমাদের মুসা। বিশেষ করে অপঘাতে মৃত্যুর কথা শুনলে। মুসার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে হাসল, খাওয়ার রুচিও মষ্ট হয়ে যায়, তাই না? আবার টনির দিকে তাকাল সে। ভূতের বড় ভয়।

ও, টনিও হাসল। ভাবনা নেই, ভূত হতে পারবে না। খ্রিস্টানদের মত করেই কবর দিয়েছি তাকে। আব্বা তার কবরের ওপর একটা ক্রুশ লাগিয়ে দিয়েছে। লিখে দিয়েছে মেসিকোর মহান মিলিটারি হিরো ইগনাসিওর স্মৃতির উদ্দেশ্যে। ইগনাসিও অ্যালেন্ড ছিল অনেকটা আমেরিকানদের জর্জ ওয়াশিংটনের মত, আর…

গুহার মধ্যে তুমি ঢুকেছিলে? প্রসঙ্গটা ভাল লাগছে না মুসার, অন্য বিষয়ে চলে যাওয়ার জন্যে বলল।

মাথা নাড়ল টনি। গাঁইতি আর শাবল দিয়ে কিছু পাথর সরিয়েছি। ওই পর্যন্তই। এর বেশি আর কিছু করতে পারিনি। পেসোগুলো দেখিনি। সে জন্যেই বিস্ফোরক কিনতে গেছে আব্বা।

কখন ফিরবেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

তিন-চার দিনের আগে না। গাঁয়ে যেতে বেশিক্ষণ লাগে না, মাত্র কয়েক ঘণ্টা। ওখানে ঘোড়া রেখে যাবে আব্বা। দুটো ঘোড়া নিয়ে গেছে। দরকার আছে। আসার সময় ভারি বোঝা বয়ে আনতে হবে। যাই হোক, আব্বা চলে যাবে চিহয়া হুয়ায়। ওটাই সব চেয়ে কাছের শহর, যেখানে ডিনামাইট আর দরকারী অন্যান্য জিনিস কিনতে পাওয়া যায়।

তার মানে, রবিন বলল। ডজকে আমাদেরই সামলাতে হবে। হয়তো ইসাবেলাকেও। তবে, আমরা চারজন। দুজন মানুষকে কাবু না করতে পারার কিছু নেই।

নতুন বন্ধুদের দিকে তাকাল টনি। ভাল লাগছে আমার। একা আর সামলাতে হবে না ওদেরকে। আরও তিনজনের সাহায্য পাব। ডজের ব্যাপারে যে আমাকে সাবধান করে দিলে তার জন্যে আরেকবার ধন্যবাদ দিচ্ছি তোমাদেরকে। তোমরা আমাকে চিনতেও না।

ইয়ে… কিশোরের মনে পড়ল, ওদের পরিচয়ই এখনও দেয়া হয়নি টনির কাছে। শুধু নাম বলেছে। বলল, তোমার জন্যেই যে কেবল একাজ করছি, তা নয়। আমাদেরও আগ্রহ আছে। এটা আমাদের জন্যে আরেকটা কেস।
মানে? টনি বুঝতে পারছে না। ডিটেকটিভের মত কথা বলছ তুমি।

ডিটেকটিভই আমরা। শখের গোয়েন্দা। পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে দিল কিশোর।

অনেকক্ষণ কার্ডটার দিকে তাকিয়ে রইল টনি। ভুরু কোঁচকাল। তারপর বিড়বিড় করল, এটা কি ভাষা?

দেখি? আরে, বাংলাটা দিয়ে ফেলেছি। এটা আমার মাতৃভাষা।

তার মানে তুমি আমেরিকান নও? অবাক হলো টনি।

বাংলাদেশী। তবে আমেরিকার নাগরিকত্বও আছে আমার। ইংরেজিতে লেখা আরেকটা কার্ড বের করে দিল কিশোর।

সেটাও ঠিক মত পড়তে পারল না টনি। ইনভেসটিগেটরের উচ্চারণ করল নিভেসটিগেটর। শেষে কিশোরের হাতে দিতে দিতে বলল, তুমিই পড়ে শোনাও।

কার্ডের দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করল না কিশোর। জোরে জোরে বলল, কি লেখা আছে।
ও, আরেক দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল টনি। বলল, আমি পড়তে পারি না, তা নয়। আসলে, ডিজলেকজিয়া আছে আমার। ওটা কি জাননা?
জানি, ঘাড় কাত করল রবিন। টনির জন্যে কষ্ট হল তার। এর মানে হল, অক্ষর উল্টোপাল্টা দেখ তুমি। ইটালিতে এই রোগ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। রঙিন লেন্স দিয়ে এখনও চেষ্টা চলছে, সারানোর উপায় খুঁজছেন বিজ্ঞানীরা।

হ্যাঁ। বাড়ি ফিরলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে বলেছে আম্মা। সেটা তো বাড়ি যাবার পর। এখানে তো আমি এখন পড়তে পারি না। খুবই কষ্ট হয়। চিঠিও পড়তে পারি না। তাই যোগাযোগ রাখার জন্যে অন্য ব্যবস্থা করেছি। টেপে কথা রেকর্ড করে আদান-প্রদান করি। আম্মা আমাকে টেপ পাঠায়, আমিও আম্মাকে টেপ পাঠাই।

কিছু বলল না কিশোর। মাথার ভেতরের মগজ নামের কম্পিউটারটা তার চালু হয়ে গেছে বেদম গতিতে।

আরেকটা ধাঁধার সমাধান হলো, বসে গেল খাপে খাপে। ইয়ার্ডের ডাকবাক্সে পাওয়া টেপটায় রেকর্ড করা ছিলঃ মেকসিকোতে এসো না, প্লীজ! মারাত্মক বিপদে পড়বে…

নিশ্চয় ওটা টনিরই কণ্ঠ ছিল। ওর মা কে কোন কারণে সতর্ক করে দিয়ে পাঠানো একটা দীর্ঘ চিঠিরই কিছু অংশ আবার রেকর্ড করা হয়েছিল। কিংবা বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলো রেখে বাকি সব মুছে ফেলা হয়েছিল। তারপর রেখে আসা হয়েছিল ইয়ার্ডের ডাকবাক্সে। কিশোরকে ভয় দেখানোর জন্যে, হুমকি দেয়ার জন্যে এবং এটা করতে গিয়ে একটা চমৎকার সূত্র রেখে এসেছিল।

টনির দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করল কিশোর, তোমার আম্মা কি এখন লস অ্যাঞ্জেলেসে থাকেন?

হ্যাঁ। মনে হয়। আসলে, কখন যে কোথায়… চুপ হয়ে গেল টনি। আবার অন্য দিকে তাকাল। বলতে চায় না।

চাপাচাপি করল না কিশোর। তবে আরেকটা কথা জানা দরকার। তুমি কি তোমার আম্মার মত দেখতে? তোমার মতই সোনালি চুল?

হ্যাঁ। আমার মত চোখও নীল। কেন?

না, ভাবছি। হাই তুলল কিশোর। শুয়ে পড়ল লম্বা হয়ে। ঘুমালে কেমন হয়?

সবাই রাজি। কয়েক মিনিট পর ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দিল ওরা। সুড়ঙ্গ মুখের কাছে ঝোলানো কম্বলটা গিয়ে খুলে নিয়ে এল টনি। স্লীপিং ব্যাগে ঢুকল চারজনেই। তারপর ঘুম।

পরদিন খুব সকালে ঘুম ভাঙল কিশোরের। দেখল, বাইরে থেকে সুড়ঙ্গমুখ দিয়ে যেন চুইয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে আবছা আলো। প্রথমেই তাকাল, শারি কি করছে দেখার জন্যে। আরে! নেই তো!

তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এল সে। শারিকে খুঁজতে লাগল। গুহায় ঢোকার পথের ওপরই দেখতে পেল ওটাকে, বিশ গজ দূরে। তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। মাথা তুলে মোলায়েম ডাক ডাকল বারোটা। হুঁশিয়ারি নয়, বন্ধুত্বপূর্ণ। মুহূর্ত পরেই আরেকটা বারোর ডাক কানে এল, শারির ডাকের সাড়া দিল ওটা বাইরে থেকে। সুড়ঙ্গমুখের নিচে কোনখানে রয়েছে।

ইসাবেলের বারো, ভাবল কিশোর। দ্রুত সরে এল পেছনে। লুকিয়ে পড়ল পাথরের আড়ালে। মুহূর্ত পরেই তার পাশে চলে এল টনি, মুসা আর রবিন। ওরাও ডাক শুনেছে।

মোলায়েম ডাক বিনিময় চলতেই থাকল শারি আর অন্য বারোটার মধ্যে। তারপর একসময় দেখা গেল দ্বিতীয় বারোটাকে। পর্বতের ঢালের একটা নালা ধরে উঠে আসছে।

দুলকি চালে এগিয়ে গেল শারি। অন্য বারোটা কাছাকাছি এলে ওটার গায়ে গা ঘষতে শুরু করল।

ইসাবেলের ব্যরোর লাগাম এখনও পরানো রয়েছে, কিন্তু পিঠের বোঝাগুলো নেই। সূর্য উঠেছে। রোদ বাড়ছে, বাড়ছে আলো। আশপাশটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখন। উঁকি দিয়ে দেখতে লাগল চারজনে।

ইসাবেলকে দেখা গেল না।

চলো, দুটোকেই গুহায় নিয়ে যাই, প্রস্তাব দিল মুসা। শারিকে দেখলেই বুঝে ফেলবে ইসাবেল, আমরা এখানে আছি।

কিশোর আর টনি মিলে দুটো বারোকে বলে বলে নিয়ে গেল গুহার ভেতরে। ওদের অনুসরণ করল অন্য দুজন।

ইসাবেলকে তোমরা পছন্দ করো না, তাই না? টনির প্রশ্ন।

ওই মহিলা আরেকটা ধাঁধা, কিশোর বলল। সে আমাদেরকে বলেছে ডজের ব্যাপারে তোমাদেরকে সাবধান করে দিতে। বলেছে, সে তোমাদের পরিচিত। বন্ধু। অথচ তুমি বলছ, কখনও দেখইনি। এর মানেটা কি? মনে হচ্ছে রবিনের কথাই ঠিক। ধাপ্পাবাজ মহিলা।

দুটো বারোই ক্ষুধার্ত। গুহার ভেতরে নিরাপদ জায়গায় এনেই ওগুলোকে খাবার দিল টনি, পানি ঢেলে দিল গামলায়। মুসা বসল রান্না করতে। তাদের সেই একই খাবার, বীন আর চাল সেদ্ধ।

একসাথে খেতে বসল না ওরা। বাসন নিয়ে সুড়ঙ্গমুখের কাছে চলে গেল কিশোর, পাহারা দেয়ার জন্যে। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল সে, যাতে নিচ থেকে তাকে চোখে না পড়ে। আত্মগোপন করে রইল পাথরের আড়ালে। উঁকি দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তাকিয়ে দেখল নিচের অঞ্চল। আঁতিপাতি করে খুঁজেও ইসাবেলকে চোখে পড়ল না।

কম্পনটা প্রথমে টের পেল বুকের কাছে। হৃৎপিন্ডের ঝাঁকি নয়, বাইরে থেকে আসছে। যেন পাহাড়ের অনেক গভীর থেকে আসছে। এতটাই জোরাল হলো, হাত থেকে চামচ পড়ে গেল। ভূমিকম্প নয়। লস অ্যাঞ্জেলেসে আজীবন বাস করে আসছে, ভূমিকম্প হলে কি হয় ভাল করেই জানে। এখনকারটা হঠাৎ কোন ঝাঁকুনি নয়। বরং মহাসড়কের ধারে দাঁড়ালে আর পাশ দিয়ে ভারি কোন লরি চলে গেলে যেমন কাঁপতে থাকে মাটি অনেকটা তেমন।

ঘণ্টাখানেক পরে তার জায়গায় পাহারা দিতে এল রবিন। সেই রকম কথা হয়েছে। এক এক করে সবাই দেবে, এক ঘণ্টা পর পর।

কাঁপুনি টের পেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করল কিশোর।

পেয়েছি, রবিন জানাল। ভূমিকম্পের মত কিন্তু মনে হলো না। অন্য রকম। এই পর্বতমালাকে বিশ্বাস নেই, বইয়ে পড়েছি। এখন তার প্রমাণ পাচ্ছি। কখন যে কি ঘটে যাবে বলা মুশকিল। আচ্ছা, কাল যে বনে আগুন লাগতে দেখলাম… না, আগুন তো না, ধোঁয়া, এর কি ব্যাখ্যা, বলো তো?

ফিরে তাকাল সে। পেছনে কিছুই দেখতে পেল না। দেয়ালের মত দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের উঁচু চূড়া। গুহামুখের ওপর থেকে উঠে গেছে অনেকখানি।

কুইন সাবে? রবিনের প্রশ্নের জবাব দিল কিশোর। অর্থাৎ, জানে না।

পাহারায় বসল রবিন। নিচের দিকে তাকিয়ে ইসাবেলকে খুঁজতে লাগল তার চোখ।

কিশোর যখন এসেছিল, তার দুই ঘণ্টা পরে এসে রবিনকে মুক্তি দিল মুসা। নিচে তাকিয়ে মনে হলো তার, একটা নড়াচড়া দেখতে পেয়েছে। স্পষ্ট বুঝতে পারল না। পাখির ডাক ডেকে গুহার ভেতরে বন্ধুদেরকে জানিয়ে দিল তার সন্দেহের কথা।

কোথায়? সুড়ঙ্গমুখের কাছে আবার উপুড় হয়ে শুয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

এই যে, ওখানটায়। বাঁয়ে হাত তুলে দেখাল মুসা।

চারজনেই দেখতে পেল, অনেক নিচে মূর্তিটাকে।

একজন লোক। মাথায় স্টেটসন হ্যাট। হাতে রাইফেল নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে আসছে এদিকেই।

ডজ মরিস।

১৩

গুহায় লুকিয়ে থাকার কোন মানে নেই, কিশোর বলল। ডজ আসতে চাইলে ঠিকই চলে আসবে চিহ্ন দেখে দেখে। গুলি করতে করতে ঢুকলে তখন আমাদের কিছুই করার থাকবে না…

তাহলে লুকিয়ে থেকে প্রথম আক্রমণটা আমাদেরকেই করতে হবে, বলল রবিন।

হ্যাঁ, মাথা ঝাকাল কিশোর। একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়। এতে কাজ হতেও পারে।

বলে ফেল।

চলো, ভেতরে গিয়ে বসি। এখানে প্রাইভেসি নেই। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে আরম্ভ করল কিশোর। তাকে অনুসরণ করল অনন্যরা।

মিনিটখানেক পরে কিশোর, টনি আর রবিন বেরিয়ে এল আবার। টনির হাতে তার রাইফেল। বুকের কাছে ধরে রেখেছে। অপেক্ষা করে রইল ডজ পথের বাঁকে অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত। তারপর দ্রুত নামতে শুরু করল। পাথরে পা পিছলে যাচ্ছে, পরোয়াই করল না। নেমে চলে গেল একটা বড় পাথরের আড়ালে। তাকে অনুসরণ করে গিয়ে রবিনও লুকিয়ে পড়ল।

সুড়ঙ্গমুখের কাছে পড়ে আছে কিশোর। মাথা নিচু করে রেখেছে। যতটা না হলে ডজকে দেখতে পাবে না তার বেশি তুলছে না। রাইফেল বাগিয়ে সাবধানে উঠে আসছে ডজ, শারির পায়ের ছাপ দেখে দেখে। বিশ গজের মধ্যে চলে এল ডজ।

ডজ! চিৎকার করে বলল কিশোর, ডজ! আমি, টনি!

টনি! ঝট করে ট্রিগার গার্ডের ভেতর আঙুল চলে গেল ডজের। কোথায় তুমি?

এই যে এখানে, ওপরে, চেঁচিয়ে জবাব দিল কিশোর। আমার হাতে রাইফেল আছে। আপনার দিকে তোলা।

হেসে উঠল ডজ। তাহলে করো গুলি। ঠিক কোথায় আছ তুমি, জেনে যেতে পারব তাহলে। তারপর খুলি ছাতু করে দেব।

নালার ঠিক মাঝখান দিয়ে এসেছে পায়েচলা পাহাড়ী পথ। সেটা ধরে আবার এগোতে লাগল সে। উঠে আসতে থাকল ওপরে।

কি চাই আপনার? ভয় পেয়েছে যেন, কণ্ঠস্বরকে এমন করে তুলল কিশোর। এখানে এসেছেন কেন?

কথা বলতে। তুমি আর তোমার বাবার সঙ্গে পঞ্চো ভিলার ব্যাপারে কথা বলতে চাই।

রাইফেল ফেলে দিন! কর্কশ কণ্ঠে আদেশ দিয়ে পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল টনি। ডজের পেছনে। নলের মাথা দিয়ে জোরে গুতো মারল লোকটার পিঠে।

অবাক হয়ে গেল ডজ। বিমূঢ়।

কি হলো? ফেলছেন না কেন? আবার গুতো লাগাল টনি। কিশোরের বুদ্ধি কাজে লেগেছে। তার ফাঁদে পা দিয়ে বোকা বনেছে ডজ। সে ভেবেছিল টনির সঙ্গেই বুঝি কথা বলছে। কি কান্ড! মুহূর্ত আগে ছেলেটার কথা শুনেছে ওপরে, এখন শুনছে পেছনে। রাইফেল ফেলল না সে। তবে দ্বিধায় পড়ে গিয়ে নামাতে বাধ্য হলো।

এদিকে ফিরবেন না। মাথাও ঘোরাবেন না। আবার কঠোর গলায় আদেশ দিল টনি।

কিশোর যা আশা করেছিল তাই ঘটল, অন্তত ঘটার উপক্রম হলো।

লাফ দিয়ে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল রবিন।

মাথা না ঘোরাতে বলা হয়েছে, তবু ঘোরাতে গেল ডজ। সবে অর্ধেকটা ঘুরিয়েছে ঘাড়, এই সময় বেরোল রবিন। কাজেই তাকে চোখে পড়ল না ওর।

এক হ্যাচকা টানে ডজের হাতের রাইফেল কেড়ে নিয়ে দশ গজ দূরের একটা ক্যাকটাস ঝোপে ফেলে দিল রবিন।

গর্জে উঠল ডজ।

কারাতে যোদ্ধার পজিশন নিয়ে ফেলেছে রবিন। মুসার মত অতটা ওস্তাদ নয় সে, অত শক্তি কিংবা ক্ষিপ্রতাও নেই, তবে মন্দ বলা যাবে না। তার বিশ্বাস, ডজকে কাবু করে ফেলতে পারবে।

কিন্তু রবিনকে আক্রমণ করল না ডজ। আচমকা চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরল। হাত লম্বা করে দিয়েছে। ধাপ করে খোলা আঙুলের থাবা গিয়ে বাড়ি মারল টনির মাথায়। টলে উঠে পিছিয়ে গেল টনি। লাফিয়ে এগিয়ে গেল রবিন। কিন্তু ততক্ষণে টনির রাইফেলের নল চেপে ধরেছে ডজ। জোরে এক মোচড় দিয়ে হ্যাচকা টান দিতেই অস্ত্রটা চলে এল তার হাতে। পিছিয়ে গিয়ে সেটা তুলে ধরল রবিনের দিকে। দাঁত বের করে হিসিয়ে উঠল, বিচ্ছুর দল! হাঁটো। নিচের দিকে। রাইফেলের রেঞ্জের বাইরে যাওয়ার আগে থামবে না।

অস্ত্রহীন হয়ে গেছে। কিছুই করার নেই আর দুজনের। টনি কিছু করার চেষ্টা করলেই তাকে গুলি করবে ডজ। ধীরে ধীরে নামতে শুরু করল দুজনে।

পথ ধরে নেমে গেল প্রায় একশো গজ। তারপর ঘুরল ডজ। উঠতে শুরু করল কিশোরের দিকে।

কয়েক গজ উঠে চিৎকার করে ডাকল, বেরিয়ে এসো! নইলে গুলি শুরু করব!

উঠে দাঁড়াল কিশোর। ট্রিগারে আঙুল চেপে বসল ডজের। আরেকটু বাড়লেই গুলি বেরিয়ে যাবে।

বেশ, নেমে এসো এবার। দ্রুত চলে যাও বন্ধুদের কাছে। তবে আগে কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দাও।

লোকটাকে জুডোর প্যাচে ফেলার সুযোগ খুঁজতে লাগল কিশোর। কিন্তু রাইফেলের নল যেভাবে ওর দিকে মুখ করে আছে তাতে কিছু করা সম্ভব নয়।

টনির বাবা কোথায়? জানতে চাইল ডজ।

দ্রুত ভাবনা চলছে কিশোরের মাথায়। ডজকে বিশ্বাস করাতে হবে গুহার ভেতরে কেউ নেই।

মুসাকে নিয়ে পানি আনতে গেছে।

ওদের দেখা পাব কি করে? ঝর্নাটা মাইল দুই দূরে। পাহাড়ের আরেক পাশে। এখন থেকে দেখা যায়।

আলতো করে মাথা ঝাঁকাল একবার ডজ হাসল তালগে পেসোগুলোকে পাহারা দেয়ার এখন কেউ নেই, তুমি ছাড়া। এখন গিয়ে তোমার বন্ধুদের সঙ্গে বসে থাক। লুকিয়ে থাকবে। আমার চোখে যাতে না পড়। পিঠে ওলি খেতে না চাইলে জলদি ভাগ।

হতাশ ভঙ্গি করল কিশোর। পরাজিত, বিধ্বস্ত হয়ে যেন দ্রুত নামতে শুরু করল নালার ভেতর দিয়ে।

ও পাথরের আড়ালে হারিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল ডজ। তারপর মাথা নিচু করে দুহাতে রাইফেল ধরে ঢুকল সুড়ঙ্গের ভেতরে।

ওকে আসতে শুনল মুসা। গুহার ঠিক ভেতরেই অপেক্ষা করছে। আশা করছে, মাথা নিচু করেই ঢুকবে ডজ, ঢুকতে হবে ওভাবেই। ঘাড়ে কারাতের কোপ মারার জন্যে চমৎকার একটা সুযোগ পেয়ে যাবে তাহলে।

হাত তুলল সে। আঙুলগুলো সোজা করে শক্ত করে রেখেছে, গায়ে গায়ে চেপে লেগে রয়েছে একটা আরেকটার সঙ্গে। এভাবে ডজের ঘাড়ে একটা কোপই যথেষ্ট। মাথা তোলার আর সুযোগ পাবে না। ঢলে পড়বে মাটিতে।

গুহায় ঢুকল ডজ। সাপের মত ছোবল হানল যেন মুসার উদ্যত হাত। কিন্তু একটা বারো শব্দ করে ফেলল আর শেষ মুহূর্তে মাথা সোজা করে ফেলল লোকটা। মুসার কোপটা ঘাড়ে না লেগে লাগল তার কাঁধে। হোঁচট খাওয়ার মত ঝাঁকুনি খেয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল তার শরীরটা। হাত থেকে রাইফেল ছাড়ল না।

লাফ দিয়ে পেছনে চলে এল মুসা। আরেকবার আঘাত হানার জন্যে উঠে গেল হাত। কিন্তু সামলে নিয়েছে ততক্ষণে ডজ। রবিন আর টনিকে পরাজিত করার সময় যেমন বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিল শরীরে, তেমনি খেলল আরেকবার। অসাধারণ ক্ষিপ্র লোকটা। চিতাবাঘকেও হার মানায়। কখন ঘুরল বুঝতেই পারল না যেন মুসা। শুধু দেখল, তার দিকে ঘুরে গেছে ডজ। রাইফেলের নল বুকের দিকে তাক করা।

হাত নামাল মুসা।

পরমুহূর্তে আন্দাজ করল, ডজের তুলনায় তার একটা সুবিধা বেশি। রোদ থেকে ভেতরে এসেছে লোকটা, তীব্র আলো থেকে আবছা অন্ধকারে, চোখে সয়নি এখনও। দ্রুত কিছু করতে পারলে হয়ত কাবু করে ফেলতে পারবে ডজকে, গুলি করার আগেই।

একপাশে সরে গেল সে। বোঝার চেষ্টা করল, ডজ দেখতে পেয়েছে কিনা, কিছু করতে গেলে গুলি খাবে কিনা। কিছুই বুঝতে পারল না। এতগুলো ঘটনা ঘটে গেল মুহূর্তের মধ্যে। ঝুঁকি নিল সে। একপায়ের গোড়ালিতে ভর দিয়ে ঘুরল। পাক শেষ হওয়ার আগেই ঝট করে ওপরে তুলে সোজা বাড়িয়ে দিল ডান পাটা। ডজের বুকের সামান্য নিচে লাগল লাথি।

পুরো একটা সেকেন্ড বাঁকা হয়ে রইল ডজ। শ্বাস নিতে পারছে না।

যথেষ্ট সময় পেল মুসা। লাফিয়ে সামনে এগিয়ে কনুই দিয়ে একেবারে মেপে একটা ভয়াবহ আঘাত হানল ডজের ঘাড়ে। মারটা আরেকটু জোরে হলে মরেই যেত র‍্যাঞ্চার।

ওটোশি-হিজি-অ্যাটি সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, ডজও পারল না। ঢলে পড়ল মেঝেতে। কিছু সময়ের জন্যে বেঁহুশ।

অন্য তিনজন যখন গুহায় ঢুকল, তখনও মেঝেতেই পড়ে আছে সে। দড়ি বের করে শক্ত করে বাঁধল তাকে টনি। খানিক আগেও রাইফেল হাতে যে হম্বিতম্বি করছিল, সে এখন পুরোপুরি অসহায়। তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে চারজনে। উত্তেজনা টের পেয়েই বোধহয় খাওয়া থামিয়ে দিয়েছিল বারো দুটো। আবার মুখ নামিয়ে জই তুলে নিয়ে চিবাতে শুরু করল।

মিনিট খানেক পর রবিন বলল, হুঁশ ফেরে না কেন? দশ পর্যন্ত গুনি।

দরকার কি গোনার, কিশোর বলল। যখন ফেরে ফিরবে।

বাইরে বেরিয়ে এল চারজনে।

যেভাবে আশা করেছিলাম ঠিক সেভাবে ঘটল না, হাসল কিশোর। মুসাই শেষ রক্ষা করল। নইলে গিয়েছিল সব ভন্ডুল হয়ে।

হেসে বাতাসেই হাত দিয়ে একটা কোপ মারল মুসা। জিনিস বটে, কারাতে। খালি দুটো হাত আর পা-ই যথেষ্ট, মারাত্মক অস্ত্র হয়ে যায় ব্যবহারের গুণে।

ঠিক, রবিন বলল। কোন দিন ব্রুস লী হয়ে যাও কে জানে! কিশোর, এরপর কি করব আমরা?

প্রথমে ডজের রাইফেলটা বের করে আনব, কিশোরের আগেই জবাব দিল টনি। একটা রাইফেলের চেয়ে দুটো থাকলে অনেক সুবিধে।

দ্রুত সেই ক্যাকটাসের ঝোপে নেমে এল ওরা, যেখানে রাইফেলটা ছুঁড়ে ফেলেছিল রবিন। খুঁজতে শুরু করল।

খুঁজেই চলল, খুঁজেই চলল। প্রতিটি খাঁজ, গর্ত, পাথরের ফাঁকফোকর, কিছু বাদ দিল না। প্রতিটি কাঁটাওয়ালা ক্যাকটাসের পাতা সরিয়ে সরিয়ে দেখল।

পাওয়া গেল না রাইফেলটা।

ইসাবেল! রবিন বলল, ধারেকাছেই কোথাও ছিল। নিয়ে গেছে।

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে লাগল কিশোর। কয়েকবার জোরে জোরে চিমটি কাটার পর বলল, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।

কত বুদ্ধি যে থাকে তোমার মাথায়! গুঙিয়ে উঠল মুসা।

আমার ধারণা, কিশোর বলল, ইসাবেল এখানে কোথাও লুকায়নি। চিন্তিত ভঙ্গিটা রয়ে গেছে। ঘাঁটিতে ফিরে গেছে সে।

ঘাঁটি, ভুরু কোঁচকাল মুসা। সেটা আবার কি?

বারোর পিঠ থেকে মালপত্র নামিয়ে নিয়ে গেছে, যাতে কোথাও ক্যাম্প করতে পারে। মিস্টার সাইমন জানিয়েছেন আমাকে, বারোরা খুব বিশ্বস্ত জানোয়ার। সেটার প্রমাণও পেয়েছি আমরা। মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলে তাকে আর ছাড়তে পারে না। ফিরে ফিরে যায় তার কাছে। এখন ইসাবেলের বারোটার আকর্ষণ শারির ওপর বেশি, তাই যেতে চাইছে না। কিন্তু যদি শারিকে ওর সঙ্গে যেতে দিই, তাহলে নিশ্চয় পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে আমাকে ইসাবেলের কাছে। যেখানে ঘাঁটি করেছে মহিলা।

তোমাকে? বাঁকা চোখে কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। একাই সব ক্রেডিট নিতে চাও? আমরা বাদ পড়ব কেন? সবাই গেলে অসুবিধে কি?

অসুবিধেটা হলো, চারজন অনেক বেশি। একসাথে গেলে দেখে ফেলতে পারে ইসাবেল। আমি একা হলে সারাক্ষণ বারোগুলোর আড়ালে লুকিয়ে থেকে এগুতে পারব। আর শারিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা তোমাদের নেই। কাজেই আমাকেই যেতে হচ্ছে।

চুপ হয়ে গেল রবিন। সঙ্গে যাবার মত জোরাল যুক্তি দেখাতে পারল না আর কেউ।

ইসাবেলের ব্যাপারে অদ্ভুত একটা ধারণা বাসা বাঁধছে কিশোরের মনে। ধারণাটা হয়েছে খুব ক্ষীণ সূত্র থেকে। ক্যাম্পের সামান্য আলোয় দেখা কব্জির দাগ। রবিন বলছে কন্ট্যাক্ট লেন্স পরে মহিলা। সামান্য সূত্র, তবে অবহেলা করা উচিত নয়। অতি সাধারণ জিনিসও মাঝে মাঝে জটিল রহস্যের সমাধান করে দেয়। ইসাবেলের কব্জিতে দাগ সত্যিই আছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার একটাই উপায়, আরেকবার কাছে থেকে ভালমত দেখা।

বেশ, যাও, মুসা বলল অবশেষে। তবে সাবধানে থেক। মহিলার কাছে এখন একটা রাইফেল আছে।

বারোদুটোকে গুহা থেকে বের করে আনল টনি। জানাল, ডজের হুঁশ ফিরেছে। আমাকে দেখেই গালাগাল শুরু করল। ছাড়া পেলে আমাকে কি কি করবে, পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছে।

ইসাবেলের বারোর পেটে জোরে এক চাপড় মারল কিশোর। চলতে শুরু করল ওটা। পাশে পাশে এগোল শারি। কিশোর ঢুকে পড়ল দুটো জানোয়ারের মাঝখানে। মাথা নুইয়ে রেখেছে, যাতে সহজে কারও চোখে না পড়ে।

ওপরেও উঠল না বারোদুটো, নিচেও নামল না। যতটা সম্ভব সমান্তরাল জায়গা ধরে চলতে লাগল। এখানকার পাহাড়ের এটা এক অদ্ভুত ব্যাপার। খাড়া ঢাল আছে, আবার অনেকখানি জায়গা জুড়ে ঢালের গায়ে সমান জায়গাও আছে, টেবিলের মত।

ওপর দিকে মুখ তুলতে আরও অনেক গুহামুখ নজরে পড়ল কিশোরের। কিন্তু মাটিতে কোন চিহ্ন দেখতে পেল না, যেগুলো বলে দেবে কোন গুহাঁটার দিকে মানুষ গেছে।

চলছেই ইসাবেলের বারো। তারপর কোন রকম জানান না দিয়েই আচমকা থেমে গেল।

ওটার পাশে থমকে দাঁড়াল শারি। মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল কিশোর। শখানেক গজ ওপরে পাহাড়ের গায়ে একটা ফাটল মত চোখে পড়ল। পাথরের আড়ালে থেকে, যতটা সাবধানে সম্ভব ক্রল করে এগোল সেটার দিকে।

তাকে অনুসরণ করল না ইসাবেলের বারো। তবে নড়লও না। যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। কাছেই হোট একটা সে ঝোঁপ দেখতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল শারি। পাতা ছিড়ে চিবাতে শুরু করল। দেখাদেখি অন্য বারোটাও গিয়ে তাতে মুখ দিল। কোন শব্দ করল না।

ভুল করলাম না তো? ভাবল কিশোর। পাহাড়ের এই সরু ফাটলে নিশ্চয়ই ঢোকার পথ নেই। আর তাহলে ওখানে ক্যাম্প করাও সম্ভব নয় ইসাবেলের পক্ষে। তবু, আরেকটু কাছে এগিয়ে দেখা যাক, কিছু আছে কিনা।

ঘাড়ে হাত পড়ল এই সময়, শীতল স্পর্শ। শক্ত করে চেপে ধরেছে যেন।

তার মুখের কাছ থেকে একটু দূরেই মাটি থেকে যেন গজিয়ে উঠেছে জিনিসটা। আসলে গেড়ে দেয়া হয়েছে। একটা কাঠের ক্রুশ। আড়াআড়ি বাঁধা দুটো কাঠের বাঁধনের কাছের একটা কোণ আটকে গিয়েছিল ওর ঘাড়ে, মাথা তোলার সময়।

নাম খোদাই করা রয়েছে ক্রুশটাতে। ইগনাসিও।

পেয়ে গেল তাহলে! গুহার বাইরেই কবর দেয়া হয়েছে কংকালটাকে। তার মানে কাছেই কোথাও রয়েছে পঞ্চো ভিলার গুহা। যেটাতে লুকানো রয়েছে পেসোগুলো।

ইসাবেল কি দেখে ফেলেছে? ওই গুহাতে গিয়েই ক্যাম্প করেছে সে? নাকি ওপরে উঠে বসে আছে কোনখানে? ওই ফাটলের ভেতর?

ওপরে থেকে থাকলে এতক্ষণে বারোদুটোকে দেখে ফেলার কথা। দেখে থাকলে জানার চেষ্টা করবে কেন এসেছে ওগুলো।

মাটিতে লম্বা হয়ে পড়ে রইল কিশোর। অপেক্ষা করছে।

মিনিটখানেকের বেশি থাকতে হলো না। মেকসিকান মহিলার পরিচিত মূর্তিটা চোখে পড়ল। পশমের তৈরি ঢিলাঢালা স্কার্ট, লাল শাল, কালো বেনি। গুহা থেকে বেরিয়ে তাকিয়ে রয়েছে নিচে বারো দুটোর দিকে।

হাতে রাইফেল। বোল্ট টানার শব্দ কানে এল কিশোরের।

যাও। নিজেকে বলল কিশোর। সময় হয়েছে ইসাবেল সম্পর্কে সমস্ত কথা জানার।

মাথা নামিয়েই রাখল সে। ভাবছে, যদি তার অনুমান ভুল হয়ে যায়? যদি তার সন্দেহের জবাব রাইফেলের বুলেট দিয়ে দেয় ইসাবেল?

ঝুঁকি না নিলে জানা যাবে না। চিৎকার করে বলল সে, আম্মা, আমি! আমি টনি, আম্মা!

১৪

কিশোরের জীবনের দীর্ঘতম দশটি সেকেন্ড নড়ল না ইসাবেল।

তারপর রাইফেল হাত থেকে ফেলে দৌড়ে নামতে লাগল কিশোরের দিকে।

টনি! চেঁচিয়ে বলছে মহিলা, টনি! কোথায় তুই, বাবা! ঠিক আছিস? ভাল আছিস?

স্প্যানিশ ছাড়া অন্য ভাষা না জানার ভান করছে না এখন। পরিষ্কার ইংরেজিতে বলছে।

উঠে দাঁড়াল কিশোর। হ্যাঁ, টনি ভালই আছে। চালাকিটা করার জন্যে আমি দুঃখিত। তবে এছাড়া আপনার সাহায্য পাওয়ার আর কোন উপায় ছিল না। আমাদের সবারই সাহায্য দরকার। টনিরও।

কয়েক গজ দূরে থমকে দাঁড়িয়েছে ইসাবেল। আরও দশটি সেকেন্ড কিশোরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। হাসল অবশেষে।

এসো, ডাকল সে। বলো আমাকে, কি হয়েছে।

ফিরে তাকাল কিশোর। শান্ত ভঙ্গিতে পাতা ছিড়ছে বারোদুটো। খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত। আর কোনদিকে নজর নেই। মহিলাকে অনুসরণ করে ফাটলটার দিকে এগোল সে।

ডজ কোথায়? রাইফেলটা তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল মহিলা। পাহাড়ের নিচে যতদূর চোখ যায় তাকিয়ে দেখল লোকটা আছে কিনা।

ওকে নিয়ে ভাবনা নেই, গুহায় কি ঘটেছে জানাল কিশোর।

মাথা ঝাঁকাল ইসাবেল। সেফটি ক্যাচ অন করে দিল। টনি আর ওর বাবার চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল আমার। কাল এই গুহাঁটা দেখেছি আমি। ভেতরে দুজনের জিনিসপত্র পড়ে আছে। কিন্তু ঘোড়ার পায়ের ছাপ সব পুরানো। তাই বুঝতে পারিনি কোথায় গেছে ওরা।

কিশোর জানাল, টনির বাবা গেছে ডিনামাইট কিনতে, যাতে গুহার মুখে পড়ে থাকা পাথরের স্থূপ উড়িয়ে দিতে পারে। পঞ্চো ভিলার গুহায় ঢুকতে চায় দুজনে। কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরে আসবেন টনির বাবা।

ডজের রাইফেল পেলেন কি করে? জানতে চাইল কিশোর।

রাতে আমি ঘুমিয়ে থাকার সময় বারোটা ছুটে গেল। আজ সকালে খুঁজতে বেরোলাম। ওটাকে তো পাইনি, পেলাম এই রাইফেলটা, একটা ক্যাকটাসের গোঁড়ায়। এতে ডজের নাম খোদাই করা রয়েছে। ডজকে দেখলাম না কোথাও। মনে হল, এটা একটা ফাঁদ হতে পারে। হয়ত আরেকটা রাইফেল নিয়ে কোথাও ঘাপটি মেরে আছে সে। কিংবা বুটের মধ্যে যে ছুরিটা লুকিয়ে রাখে, সেটা হাতে নিয়ে। তাড়াতাড়ি চলে এলাম তখন এখানে। কারণ এদিক থেকে তাকে বেরোতে দেখেছিলাম।

হাসল কিশোর। ইসাবেল যখন রাইফেল তুলে নেয়, তখন ডজের কি অবস্থা সেটা ভেবে। ওই লোকটা লুকিয়ে ছিল না, ছিল হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে। আর কয়েক মিনিট আগে গেলেই সব দেখতে পেত ইসাবেল। রবিন যেখানে রাইফেল ছুঁড়ে ফেলেছিল, সেখান থেকে টনির গুহাঁটা দেখা যায় না। সেজন্যেই ওটাও দেখতে পায়নি ওর মা।

আবার হাসি ফুটেছে ইসাবেলের মুখে। কি করে বুঝলে আমিই টনির মা? স্প্যানিশ ছাড়া আর কিছু বলিনি আমি। আর এই পোশাকে একটুও আমেরিকান মনে হয় না আমাকে।

শালটা হাতে নিয়ে এক বেনি ধরে টান দিল সে। খুলে চলে এল কালো পরচুলা। পকেটে ভরে রেখে আঙুল চালাল সোনালি চুলে।

মনে হচ্ছিল। স্রেফ সন্দেহ। একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল কিশোর। দুটো ব্যাপার পরিষ্কার হওয়া দরকার। সেদিন রাতে আগুনের ধারে বসে যখন কথা বলছিলেন, বার বার হাতের ঘড়িটাকে নিচ থেকে ওপরে ঠেলে তুলছিলেন। চামড়ায় হালকা রঙের একটা দাগ দেখেছিলাম…

নিজের হাত দেখাল কিশোর। এই অভিযানে এসে দীর্ঘ সময় রোদে কাটিয়ে চামড়ার রঙ অন্যরকম হয়ে গেছে। হাত ঘড়ি খুলে নিল সে। সর্বক্ষণ ঘড়ি বাঁধা থাকায় কব্জির কাছে একটা রিঙ তৈরি হয়েছে। ওখানটাতে রোদ লাগতে পারেনি, ফলে চামড়ার আসল রঙ রয়ে গেছে। যেখানে যেখানে রোদ পড়েছে ওখানকার চামড়ার রঙ গাঢ়।

মেকসিকানদের চামড়ার রঙ সাধারণত বাদামী হয়, বলল সে। সারাক্ষণ হাতে ঘড়ি বাঁধা থাকলে ওখানকার চামড়ার রঙ বড় জোর বাদামী হবে, সাদা হতে পারে না কিছুতেই। কিন্তু অ্যাংলোদের চামড়া হয়ে যায় ফ্যাকাসে সাদা।

মাথা ঝাকাল ইসাবেল। খুব চালাক ছেলে তুমি, আমার টনির মত।

আমার বন্ধু রবিনের চোখে পড়েছে আরেকটা জিনিস। আপনার কন্টাক্ট লেন্স। অভিনয় করার সময় অনেক সময় ওসব পরে নেয় অভিনেতারা, ছবিতে তাদের চোখের রঙ বদলে দেয়ার জন্যে। সেটা যখন বলল আমাকে রবিন, সন্দেহটা আপনার ওপর বাড়ল আমার। সূত্রও বলতে পারেন এগুলোকে। মনে হতে লাগল, বাদামীটা আপনার শরীরের স্বাভাবিক রঙ নয়, আর চোখের রঙও মেকসিকানদের মত গাঢ় বাদামী নয়।

না, তা নয়। মাথা নিচু করে লেন্স দুটো বের করে আনল ইসাবেল। বেরিয়ে পড়ল চোখের আসল রঙ। একেবারে টনির মত, নীল। লেন্সগুলো একটা প্লাস্টিকের কেসে ভরে রেখে দিল স্কার্টের পকেটে।

তাছাড়া, কিশোর বলল, আপনাকে ইংরেজি বলতেও শুনেছি আমি। তবে, স্প্যানিশে যখন কথা বলছিলেন, তখন সত্যিই আপনার গলা চিনতে পারিনি। আপনিই আমাকে র‍্যাঞ্চে ফোন করে বলেছিলেন লেকের ওপাড়ের গায়ে যেতে।

কিশোরের হাত ধরল ইসাবেল। আমি সত্যি দুঃখিত। পিরেটো আমাকে ওই বুদ্ধি বলেছিল। আমি কল্পনাই করতে পারিনি, দাঁড়টা এতটা পচা। আমি তোমাকে খুন করতে চাইনি। কেবল ভয় দেখানোর চেষ্টা করছিলাম…

যাতে শারিকে নিয়ে এখানে আসতে না পারি?

মাথা ঝাকাল ইসাবেল। আমি আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম। ডজ এসে টনি আর ওর বাবাকে খুঁজে পেলে খুন করতে পারে, এই ভয়ে। পেসোগুলো পাওয়ার জন্যে সব করতে পারে সে। থামল মহিলা। এতই ভয় পেয়েছিলাম আমি, আরও বোকামি করেছি। বাসে তোমাদেরকে ঠেকাতে চেয়েছি, যাতে র‍্যাঞ্চে ঢুকতে না পার। তারপর সেদিন রাতে শারিকে চুরির চেষ্টা করেছি। আমার বোঝা উচিত ছিল, ও আমাকে কাছেই ঘেঁষতে দেবে না।

একটা পাথরের আড়াল থেকে ওয়াকিটকি বের করল ইসাবেল। ফিতে আছে ওটার। কাঁধের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাইফেলটা হাতে তুলে নিল আবার। চলো। টনির গুহায়। ওকে দেখার জন্যে অস্থির হয়ে গেছি আমি।

পিরেটোর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর। ও, তাহলে এটাও জানো! সবই জানো দেখা যায়!

দুটো বারোকে নিয়ে চলেছে কিশোর। হাসল। অনেক কিছুই অজানা আছে এখনও। এই ধরুন; আপনার আসল নাম। ইসাবেল আপনার নাম নয়, তাই না?

না, নেলি। তবে তুমি ইসাবেল বলেই ডাকতে পারো।

আসলে, আমি এমন এক দেশের মানুষ, যেখানে বয়স্কদের নাম ধরে ডাকার নিয়ম নেই। সেটা অভদ্রতা। আমেরিকায় থাকলে কি হবে, রক্তের টান আর সামাজিকতা তো ভুলতে পারি না। আপনাকে আমি আন্টি বলেই ডাকব। নেলিআন্টি।

হাসল ইসাবেল। আচ্ছা, ডেকো।

কিশোর আগের কথার খেই ধরল, আমি জানি পিরেটোর একটা ওয়াকিটকি আছে। নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, আমিই মেরামত করে দিয়েছি। আর সেদিন রাতে যখন আমাদের সঙ্গে কথা বলতে এলেন আপনি তখন রবিন আপনারটা দেখে ফেলেছিল।

উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ইসাবেল। আজ সকালে পিরেটোর সঙ্গে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছি। জবাব নেই। শেষবার যখন কথা বলেছি, বেশি দূরে ছিল না সে। বড় জোর একদিনের পথ। এতক্ষণে চলে আসার কথা…কিছু হয়েই গেল কিনা… দ্বিধা করল মহিলা। ডজ ওকে দেখে ফেলেছে কিনা কে জানে! তাহলে মেরে ফেলবে!

ডজ জানে পিরেটো ওর পিছু নিয়েছে?

না জানলেও আন্দাজ করতে বাধা কোথায়? হতে পারে, এ কারণেই ঘোড়ার পা খারাপের ছুতো দিয়ে রয়ে গিয়েছিল পেছনে। তারপর ঘুরে চলে গিয়েছিল, পিরেটোর জন্যে ঘাপটি মেরে ছিল কোথাও। আমাকেও দেখে থাকতে পারে। একটা বারো আর একজন মেকসিকান মহিলাকে কেয়ারই করবে না সে। কিন্তু পিরেটোকে করবে। ঠেকানোর জন্যে খুন করবে। আবার দ্বিধা করল ইসাবেল। হয়তো করে ফেলেছেও!

আপনি অযথা ভয় পাচ্ছেন, মহিলাকে অভয় দেয়ার চেষ্টা করল কিশোর। পিরেটোকে আমি চিনেছি। ডজ চালাক, সন্দেহ নেই। পিরেটো তার চেয়েও অনেক চালাক। ও অন্য জিনিস।

হ্যাঁ, নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার ভঙ্গিতেই যেন বলল ইসাবেল। ঠিকই বলেছ।

দ্রুত পা চালিয়েছে ওরা। যেতে যেতে কিশোর জানাল, কি করে ডজ তাকে ব্যবহার করেছে পঞ্চো ভিলার গুহা খুঁজে দেয়ার কাজে।

টনির সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে ইসাবেল, বলল। টেপে রেকর্ড করা কথার চিঠি নিয়মিত পাঠায় টনির নামে পর্বতের ওপাশের গায়ে। টনিও তার জবাব পাঠায় লস অ্যাঞ্জেলেসে। সুতরাং শারির অন্ধ হওয়া থেকে শুরু করে পশু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সব খররই জানে মহিলা। টনি এ-ও জানিয়েছে, সাবধান করে দিয়েছে, ডজ হয়তো শারির সাহায্যে তাকে আর তার বাবাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে পারে পেসোগুলোর জন্যে।

তারপর পিরেটোর কাছ থেকে একটা চিঠি পায় ইসাবেল। তাতে জানিয়েছে, লস অ্যাঞ্জেলেসে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে ডজ। সেখানে কোথায় উঠবে সে, তা-ও জানিয়েছে পিরেটো। ক্রসওয়ার্ড পাজল প্রতিযোগিতার কথাও জানিয়েছে। খামের ভেতরে ভরে পাজলের একটা কপি পাঠিয়েছে। লারেটোতে প্রিন্ট করেছে ওটা। পাজলে কি লিখেছে, জানা নেই পিরেটোর। তবে সন্দেহ ঠিকই করেছে, ডজ কোন একটা শয়তানীর মতলবে আছে।

আমিও প্রথমে কিছু বুঝতে পারিনি, ইসাবেল বলল। তবে ড্যাগউডস ওয়াইফ কি, বুঝেছিলাম। শারির কথা বলতে চেয়েছে ডজ। হোটেলটার ওপর নজর রাখতে লাগলাম, যেখানে ডজের ওঠার কথা। কয়েক দিন পরেই সেখানে গেল ডজ।

তারপর থেকে র‍্যাঞ্চারের ওপর কড়া নজর রাখতে লাগল মহিলা। একদিন তার পিছু নিয়ে গিয়ে হাজির হলো পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে। গেটের কাছ থেকেই দেখল, অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিশোরের সঙ্গে কথা বলছে লোকটা। গাড়ি একটা ঝোপের আড়ালে রেখে হেঁটে ফিরে এল ইসাবেল। জঞ্জালের আড়ালে আড়ালে নিঃশব্দে চলে গেল কিশোর আর ডজ কি কথা বলছে শোনার জন্যে।

তোমাদেরকে কথা বলতে শুনলাম, ইসাবেল বলল। চমকে গেলাম তোমার গলা শুনে। একেবারে টনির গলা।

দুয়ে দুয়ে চার যোগ করতে আরম্ভ করল তখন মহিলা। অনেক কথাই আন্দাজ করে ফেলল। মেকসিকান রমণীর ছদ্মবেশে তিন গোয়েন্দাকে অনুসরণ করে চলে গেল লারেটোতে।

তোমাদেরকে জিপে তুলে নিতে দেখলাম ডজকে। তখন আমি চলে গেলাম লেকের ওপাশের গায়ে। একটা ঘর ভাড়া নিলাম। যোগাযোগ করলাম পিরেটোর সঙ্গে। বনের ভেতর তোমাদের ওপর চোখ রাখলাম। শারি যখন তোমার কথা শুনে তোমার ভক্ত হয়ে গেল, কি ঘটতে চলেছে বাকিটা অনুমান করতে আর অসুবিধে হল না আমার।

নীরবে পথ চলল কিছুক্ষণ দুজনে। কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দেবেন? কিশোর জিজ্ঞেস করল।

করো।

পিরেটোর সঙ্গে আপনার পরিচয় হলো কিভাবে? আপনার আর ডজের মাঝে এমন কি ঘটেছে যে…

একজন আরেকজনকে এতটা ঘৃণা করি, এই তো?

হ্যাঁ।

তাহলে অনেক আগের কথা বলতে হয়। আমি ছোট থাকতেই আমার মা মারা যায়। একটা মেকসিকান কোম্পানিতে মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারের কাজ করত আমার বাবা। মা মারা যাওয়ার পর আমাকে মেকসিকোতে নিয়ে গেল। বাবা থাকত খনির কাজে ব্যস্ত, ওই সময়টাতে আমাকে মাঝে মাঝে দেখতে আসত পিরেটো। এই ব্যাঞ্চের মালিক ছিল তখন সে। ভালই অবস্থা ছিল তার। গরু পালত, ঘোড়া পালত। একদিন এল ডজ…

র‍্যাঞ্চটা নিয়ে নিল পিরেটোর কাছ থেকে। ডজের অফিসে দেখা দলিলগুলোর কথা মনে পড়ল কিশোরের।

হ্যাঁ। অনেক র‍্যাঞ্চারের মতই ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিয়ে কাজ চালাত পিরেটো। ঋণ-পত্রগুলো কিনে নিল ডজ। শেষ চেষ্টা করতে চাইল পিরেটো। গরু-ঘোড়া বিক্রি করে ধার শোধ করতে চাইল। সে সুযোগ দেয়া হলো না তাকে। র‍্যাঞ্চ দখল করে নেয়া হলো। আমি গেলাম তখন আদালতে, পিরেটোকে সাহায্য করতে। লাভ হলো না। ওখানেও ঘুষখোর লোক আছে। তাদেরকে টাকা দিয়ে বশ করল ডজ। শেষ পর্যন্ত র‍্যাঞ্চটা হারাতেই হলো পিরেটোকে।

নিচের উপত্যকার দিকে তাকাল কিশোর। সেখান থেকে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিল ওপারের পর্বতের দিকে। সে আশা করল, ইসাবেলের অনুমান ভুল, খানিক পরেই এসে হাজির হবে পিরেটো।

কিন্তু তার কোন চিহ্নই চোখে পড়ল না। আসছে না।

গরম লাগল। যেন আগুনের আঁচ। হঠাৎ করেই ঘটল ঘটনাটা। বাতাসে কোন রকম জানান দেয়নি। বদলে যেতে শুরু করেছে পরিবেশ।

গরম বাড়ছে। অন্ধকার হয়ে আসছে।

ওপরে তাকাল কিশোর। ছড়িয়ে পড়েছে ধূসর রঙের মেঘ কেঁপে উঠল পায়ের নিচের মাটি। পর্বতের চূড়াটা দেখতে পাচ্ছে। তীব্র গতিতে সেখান থেকে ওপরে উঠে গেল একঝলক ধোঁয়া। এর আগে দুবার দেখেছে ধোঁয়া, তার চেয়ে অনেক ঘন এখনকার ধোঁয়া, এবং কালো।

বুঝে ফেলল ব্যাপারটা। ইস, গাধা হয়ে ছিল নাকি এ কদিন! নিজেকেই লাথি মারতে ইচ্ছে করল তার। আরও আগেই বোঝা উচিত ছিল। মুসা তো প্রশ্নই তুলেছিল, মেঘটা অন্য রকম কেন? তারমানে, ওগুলো ধোঁয়া নয়, মেঘও নয়, বাষ্প।

আগ্নেয়গিরি!কথা সরছে না যেন কিশোরের গলা দিয়ে।

ওর হাত আঁকড়ে ধরল ইসাবেল। টেনে দাঁড় করাল। কপালের ওপর হাত নিয়ে এসে সে-ও তাকিয়ে রইল চূড়ার দিকে।

হ্যাঁ, ফিসফিসিয়ে বলল, আগ্নেয়গিরি! সিয়েরা মাদ্রেতেও আছে, জানতাম না। হাওয়াইতে দেখেছি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। জানি কি ঘটে। এটা ফাটতে যাচ্ছে!

১৫

উকণ্ঠিত হয়ে কিশোরের অপেক্ষা করছে টনি, রবিন আর মুসা। উত্তেজনাটা এতই ভারি লাগছে, ওদের মনে হচ্ছে গাঁইতি দিয়েও ছিদ্র করা যাবে না। বকবক করছিল টনি আর রবিন সময় কাটানোর জন্যে, এখন সেটাও বন্ধ। ভাবছে, কতক্ষণ আর ডজকে ওভাবে রাখতে পারবে? বাঁধন খোলার জন্যে মোড়া-মুড়ি করছে আর চেঁচাচ্ছে লোকটা।

ঘড়ি দেখল মুসা। দুই ঘণ্টা হয়ে গেল! আর কত? সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় চলে এল, দেখার জন্যে, কিশোর আসছে কিনা।

চিৎকার থামিয়ে চুপ হয়ে গেল ডজ। যেন বুঝে গেছে, এসব করে কোন লাভ হবে না। যে ভাবে বাঁধা হয়েছে, তাতে শোয়ার চেয়ে বসে থাকাটা সহজ এবং আরামের মনে হলো বুঝি তার কাছে।

টনি, অনুনয় করল ডজ, আমাকে এক গেলাস পানি দেবে? গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ঢোক গিলতে পারছি না।

পরস্পরের দিকে তাকাল রবিন আর টনি।

মাথা ঝাঁকাল রবিন।

দিচ্ছি, টনি বলল। উঠে গিয়ে মাটির জগটা নিয়ে এল ডজের কাছে।

রবিন যেখানে বসেছে সেখান থেকে ভালমত দেখতে পেল না এরপর যা ঘটল। ডজের মুখের কাছে টনিকে জগটা তুলতে দেখল সে। পরমুহূর্তেই মেঝেতে পড়ে চুরমার হয়ে গেল জগ। টনির গলার পাশে ছুরি চেপে ধরেছে ডজ।

বাঁধন খুলে ফেলেছে ডজ। দড়ির কাটা টুকরো ঝুলছে কব্জি আর গোড়ালি থেকে।

গাধার দল! হা হা করে বুনো হাসি হাসল ডজ। আমাকে ধরার পর সার্চ করা উচিত ছিল। করোনি। বুটের ভেতর ছুরিটা রয়ে গেছে দেখনি।

আরেকটু বাড়াল ছুরির চাপ। নড়লেই গলার প্রধান রক্তবাহী শিরা জুগুলার ভেইন কেটে দেয়ার হুমকি দিল।

রবিন, কর্কশ গলায় ডাকল ডজ। টনির রাইফেলটা নিয়ে এসো। জলদি করো।

খামোকা হুমকি দিচ্ছে না লোকটা। কথা না শুনলে ঠিকই কেটে দেবে টনির শিরা। দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে রাইফেলটা। তুলে নিয়ে ডজের দিকে এগোল রবিন।

রাখ ওখানেই, ডজ বলল। আর এগোনোর দরকার নেই।

ডজের কণ্ঠস্বরে এমন কিছু রয়েছে, বরফের মত জমে গেল যেন রবিনের রক্ত। টনিকে খুন করার একটা ছুতো খুজছে কেবল র‍্যাঞ্চার। রাইফেলটা হাত থেকে ছেড়ে দিল রবিন।

টনির গলায় ছুরি চেপে রেখেই হাত বাড়িয়ে রাইফেলটা তুলে নিল ডজ। লাফিয়ে উঠে পিছিয়ে গেল এক পা। ছুরিটা কোমরের বেল্টে গুঁজে রাখল। সেফটি ক্যাচ অফ করে দিয়ে বোল্ড টানল রাইফেলের। কঠিন গলায় আদেশ দিল, যাও, সরো এবার। দেয়ালের দিকে মুখ করে হাত তুলে দাঁড়াও।

কিশোরকে দেখলাম না। তবে অদ্ভুত কিছু একটা…

বলতে বলতে গুহায় ঢুকল মুসা। মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল। চোখ বড় বড় করে দেখল দেয়ালের দিকে মুখ করে হাত তুলে দাঁড়িয়েছে রবিন।

হচ্ছেটা কি… এবারেও কথা শেষ করতে পারল না মুসা। চোখ পড়ল ডজের ওপর। ওর হাতে রাইফেল। তাক করে রেখেছে মেঝেতে বসা টনির দিকে। মুসার দিকে ঘুরল নলটা। বাহ, এসে গেছ। যাও, তুমিও যাও দেয়ালের কাছে। টনিকে ধমক দিল, এই, তুমি বসে রইলে কেন?

রবিন জানাল মুসাকে, ওর বুটের ভেতর ছুরি ছিল। সেটা দিয়ে…

চুপ! ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল ডজ। মুসা আর টনিকে আবার যেতে বলল দেয়ালের কাছে।

এতই রাগ লাগছে মুসার, একটা মুহূর্তের জন্যে ভাবল, রাইফেলের পরোয়া না করে ছুটে যাবে কিনা। আবছা অন্ধকারে ছুটন্ত একটা নিশানাকে মিস করতেও পারে ডজ। পরক্ষণেই বাতিল করে দিল ভাবনাটা। পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়াল দেয়ালের কাছে। তার পাশে এসে দাঁড়াল টনি।

এবার কি করব? ফিসফিস করে বলল মুসা।

কিশোর না আসাতক এভাবেই থাক, ফিসফিস করেই জবাব দিল রবিন।

শুনে ফেলল ডজ। হ্যাঁ, থাক ওভাবেই। একদম নড়বে না। খিকখিক করে হাসল সে। নড়েচড়ে দেখতে পারো অবশ্য। তিনজনের খুলিতে তিনটে গুলি ঢোকাতে পারলে খুশিই হব এখন আমি। ঝামেলা শেষ। রাইফেলের বিরুদ্ধে কিছু করার নেই। চুপ হয়ে গেল ওরা।

এখন যা বলি, শোনো, ডজ বলল আবার। যদি বাঁচতে চাও। টনি, তোমাকে প্রশ্ন করব। ঠিকঠিক জবাব দেবে। নইলে গুলি খাবে তোমার বন্ধুরা।

চুপ করে আছে টনি।

তোমার বাবা কোথায়?

দ্বিধা করছে টনি।

এদিকে ফের।

আদেশ হলো কর্কশ কণ্ঠে।

ঘুরল টনি। দেখল, ডজের আঙুল চেপে বসছে ট্রিগারে।

পর্বতের ওপাশের গায়ে গেছে, জবাব দিল টনি।

কখন ফিরবে?

মিথ্যেটা বেরিয়ে গিয়েছিল মুখ থেকে, শেষ মুহূর্তে সামলে নিল টনি। ডজ যদি বুঝে ফেলে মিছে কথা বলছে সে, রবিন আর মুসার বিপদ হয়ে যাবে।

আরও দুদিন লাগবে।

পঞ্চো ভিলার গুহাঁটা পেয়েছ?

পেয়েছি।

ওটাই যে সেই গুহা কি করে বুঝলে?

ভিলার সৈন্যদের একজনের কঙ্কাল পেয়েছি ওখানে।

হুঁ। এক কাজ করো। দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেল তোমার বন্ধুদের। আমাকে যেমন বাধা হয়েছিল, তেমন করে।

গুহার একধার থেকে গিয়ে দড়ি বের করে আনল টনি।

মুসা, আদেশ দিল ডজ, হাঁটু গেড়ে বসো। হাত আন পিঠের ওপর।

নড়ল না মুসা। গটমট করে তার কাছে এসে দাঁড়াল ডজ। রাইফেলের নল ঠেকাল ঘাড়ে। ঠান্ডা ইস্পাতের স্পর্শে শিউরে উঠল মুসা। ঢোক গিলল।

জলদি করো!

বিড়বিড় করে নিজেকেই একটা গাল দিল মুসা, অসতর্ক হয়েছিল বলে। হাঁটু গেড়ে বসে পিঠের ওপর হাত নিয়ে এল।

ঢিল করে বাঁধল প্রথমে টনি। কিন্তু ফাঁকিটা ধরে ফেলল ডজ। শক্ত করে বাঁধার জন্যে ধমক লাগাল ওকে।

রবিনকেও বাঁধা হলো।

ডজ বলল, এবার কিছু প্রশ্নের জবাব জানা দরকার আমার। বাধাই তো আছি, রবিন বলল। আর জবাব দিয়ে কি হবে?

হেসে উঠল টনি আর মুসা।

চুপ! চেঁচিয়ে উঠল ডজ। রাইফেলের নল দিয়ে খোঁচা মারল রবিনের বুকে। রাগে জ্বলে উঠল রবিনের চোখ। কিছু বলল না। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করল।

কিশোর গেছে কোথায়? জানতে চাইল ডজ।

আমরাও তো সে কথাই জানতে চাইছি, মুসা বলল। বোধহয় পিজা-টিজা কিনতে গেছে।

বাজে কথা রাখ!

ডজের চেহারা দেখতে পাচ্ছে টনি। জবাব না পেলে অনর্থ ঘটাবে ওই লোক, বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না তার। সে তখন বলল, ইসাবেলের খোঁজে।

ইসাবেল কে?

আমরা জানি না। শুধু জানি, মহিলা মেকসিকান। তিন গোয়েন্দার কাছে যা যা শুনেছে, সেভাবে চেহারার বর্ণনা দিল। কয়েক দিন ধরে নাকি ওদেরকে অনুসরণ করে এসেছে। আজ সকালে তার বারোটাকে দেখেছি গুহার বাইরে। কাজেই শারির সাহায্যে ওটাকে নিয়ে গেছে কিশোর ইসাবেলকে খুঁজে বের করার জন্যে।

বন্দুক-টন্দুক আছে মহিলার কাছে?

দ্রুত ভাবছে টনি। আছে, সেটা বলা কি ঠিক হবে? ওরা তো নিশ্চিত নয়। বলল, আমরা জানি না।

বেশ। সতর্ক থাকতে হবে আরকি আমাকে। কালো চুলের বেনি। রাইফেলটা রবিনের দিক থেকে টনির দিকে ফেরাল ডজ। আমাকে ভিলার গুহায় নিয়ে চল। কোন চালাকির চেষ্টা করবে না। আমি তোমার পেছনেই থাকব।

গুহা থেকে বেরিয়ে গেল দুজনে। সুড়ঙ্গে ওদের জুতোর শব্দ শোনা গেল।

পদশব্দ মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঁধন খোলার চেষ্টা চালাল দুই গোয়েন্দা।

হাত খুলতে পারবে? জিজ্ঞেস করল মুসা।

হুডিনির মত জাদু জানলে পারতাম। তুমি?

একই অবস্থা। কিশোরটা যে কোথায় গেল!

চলে আসবে ঠিকমতই, দেখো। ওকে বোকা বানানো কঠিন। সব সময়ই একটা না একটা বুদ্ধি বের করে ফেলে। ডজকে দেখে ফেললেই আন্দাজ করে ফেলবে কি ঘটেছে। তাছাড়া তার সঙ্গে রয়েছে শারি। আগে থেকেই হুঁশিয়ার করে দিতে পারবে কিশোরকে।

তা বটে।…আচ্ছা, একটা গন্ধ পাচ্ছ?

নাক কুঁচকে শ্বাস টানল রবিন। মনে হয় পচা ডিমের।

বাইরে অদ্ভুত কিছু ঘটছে, মুসা বলল। আমি যে তখন বাইরে গিয়েছিলাম, দেখি, কালো হয়ে গেছে সব কিছু। যেন রাত নামছে পর্বতে। ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত আকাশে। …হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, পচা ডিমের মতই গন্ধ।

আগেও কয়েকবার ধোঁয়া দেখেছি, মনে আছে? আচমকা চিৎকার করে বলল রবিন, পচা ডিম নয়, গন্ধক! আগ্নেয়গিরিতে থাকে! খোদা, একটা জ্যান্ত আগ্নেয়গিরির ওপরে বসে আছি আমরা!

কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে যেন মুসার চোখ। খাইছে! এই গুহায় থাকলে আমাদের তো কিছু হবে না! কিন্তু কিশোরের? সে তো রয়ে গেল বাইরে।

১৬

শুয়ে পড়ুন! বলে উঠল কিশোর। জলদি! শুয়ে পড়ুন!

আগ্নেয়গিরির মুখ থেকে ভলকে ভলকে উঠছে কালো ধোঁয়া। সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে ইসাবেল। কালো কুয়াশার মত ঢেকে ফেলেছে পর্বতের চূড়া। মহিলার হাত ধরে টেনে তাকে একটা বড় পাথরের আড়ালে নিয়ে গেল সে।

কি হয়েছে?

আস্তে বলুন! ফিসফিসিয়ে বলল কিশোর। ডজ!

কিছু ছাই ঝরে পড়ল আকাশ থেকে। জোরাল বাতাস বইছে। ধোঁয়া সরিয়ে নিচ্ছে। বাতাসে রাসায়নিক পদার্থের গন্ধ। সাবধানে মাথা বের করে উঁকি দিল কিশোর। আধ মাইল মত দূরে রয়েছে র‍্যাঞ্চার। এদিকেই আসছে। সে একা নয়।

ওর আগে আগে হাঁটছে টনি। ঘাড়ের পেছনে দুই হাত তোলা। পিঠের দিকে রাইফেল তাক করে রেখেছে ডজ।

টনি! ইসাবেলও দেখেছে ছেলেকে।

হাত চেপে ধরে তাকে আটকে রাখতে হলো কিশোরকে। নইলে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছিল মহিলা।

ওভাবে হবে না, নিচু স্বরে বলল কিশোর। টনিকে বাঁচাতে পারবেন না। গুলি খাবেন ডজের।

যে-কোন মুহূর্তে, ভাবছে সে, বারো দুটোকে দেখে ফেলতে পারে ডজ। টনির ওপর কড়া নজর না থাকলে এতক্ষণে দেখে ফেলত।

রাইফেল তুলল ইসাবেল। ওর হাতে গুলি করার চেষ্টা করি। বাঁট ঠেকাল কাঁধে। নল রাখল পাথরের ওপর।

সাবধানে নিশানা ঠিক করল সে। ট্রিগারে চেপে বসতে শুরু করল আঙুল। টিপে দিল পুরোপুরি।

গুলির শব্দের অপেক্ষা করছে কিশোর। কিছুই ঘটল না। বেরোল না গুলি।

আবার ট্রিগার টিপল ইসাবেল। হলো না কিছু এবারেও। আবার টিপল। আবার।

সেফটি ক্যাচ! কিশোর বলল। অন করা আছে।

দ্রুত হাতে ক্যাচ অফ করে দিল ইসাবেল। আবার নিশানা করল। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। বারো দুটোকে দেখে ফেলেছে ডজ। লাফিয়ে এসে টনির কাঁধ চেপে ধরল। ওর শরীর দিয়ে আড়াল করল নিজেকে।

রাইফেল নামাল ইসাবেল। মৃদু কণ্ঠে স্প্যানিশ ভাষায় কি বলল, বোঝা গেল। গালই দিল বোধহয়।

বেল্ট থেকে ছুরি খুলে নিল ডজ। টনির পিঠে ঠেকাল। ওকে হাঁটতে বলে নিজেও পা বাড়াল পেছনে।

ইসাবেলের কাঁধের ওয়াকিটকিটা নিজেই খুলে নিল কিশোর। সুইচ অন করল মেসেজ পাঠানোর জন্যে। ঠোঁটের কাছে ধরে বলল, পিরেটো! পিরেটো! শুনতে পাচ্ছেন? স্প্যানিশ ভাষায় বলল সে। পিরেটো! কাম ইন! ওভার।

রিসিভ করার জন্যে সুইচ টিপল। নীরবতা।

পরের একটা মিনিট চেষ্টা চালিয়ে গেল কিশোর। একশ গজ দূরে আছে আর ডজ এগিয়ে আসছে। টনির পিঠে ছুরি ঠেকানো।

ওয়াকিটকি নামিয়ে রেখে ইসাবেলের বাহুতে হাত রাখল কিশোর। আপনার উইগ পরে নিন।

তাড়াতাড়ি পকেট থেকে পরচুলা বের করে পরে নিল ইসাবেল। দশ গজ দূরে এসে দাঁড়িয়ে গেল ডজ।

ইসাবেল, বেরিয়ে আসুন, ডাক দিল সে।

নড়ল না ইসাবেল।

ভয় পাবেন না, স্প্যানিশ ভাষায় বলছে ডজ। আমি জানি ওই পাথরের আড়ালেই আছেন আপনি। ছেলেরা আপনার কথা সব বলেছে আমাকে। আমাদেরকে অনুসরণ করে আপনি এসেছেন এখানে। আমার রাইফেলটাও পেয়েছেন। যা হবার হয়েছে। আসুন। দেখি, একটা রফায় আসতে পারি কিনা আমরা।

উঠে দাঁড়াল ইসাবেল। দুহাতে চেপে ধরেছে রাইফেল।

কিশোর বসেই রইল। ভাবছে, মুসা আর রবিনকে কোন ভাবে কাবু করে ফেলেছে র‍্যাঞ্চার। বোধহয় ওই ছুরি দিয়েই বাঁধন কেটে ফেলেছিল। যেটা ঠেকিয়ে রেখেছে টনির পিঠে। তবে যতক্ষণ ডজ না জানছে সে এখানে রয়েছে, ততক্ষণ চমকে দেয়ার একটা আশা রয়েছে। হয়ত সুযোগ বুঝে কাবু করে ফেলতে পারবে লোকটাকে।

রাইফেলের ট্রিগারে ইসাবেলের আঙুল।

আপনাকে আমি চিনি, ইসাবেল বলল, সিনর মরিস। পঞ্চো ভিলার পেসের খোঁজে এসেছেন।

ঠিকই ধরেছেন, স্বীকার করল ডজ। আপনিও এসেছেন সেজন্যেই।

মাথা কঁকাল ইসাবেল। আমি জানি কোথায় লুকানো আছে ওগুলো। আপনি জানেন না।

জেনে যাব। টনিকে ঠেলা দিল ডজ চলার জন্যে, নিজেও এগোল। এই ছেলেটা আমাকে নিয়ে যাবে সেখানে ও আর ওর বাবা মিলে জায়গাটা বের করে ফেলেছে।

ভুল বলেছে আগে জানত, এখন আর জানে না। কাল আমি গুহাঁটা পেয়ে গিয়ে পেসোগুলো সরিয়ে ফেলেছি। ছুরিটা সরান। তারপর, আসুন কথা বলি, দেখি কি করা যায়।

বেশ। ছুরিটা বেল্টে গুজল আবার ডজ। দুজনেই আমরা সমান সমান অবস্থায় আছি। দুজনের কাছেই রাইফেল। তবে পেসেগুলো এই এলাকা থেকে সরাতে হলে আপনাকে আমার সাহায্য নিতেই হবে। পর্বতের চূড়ার দিকে তাকল সে। ওটাও আর সময় পেল না আগুন ছিটানোর!

এখনও এগোচ্ছে ডজ, ধীরে ধীরে, টনিকে বর্ম বানিয়ে।

থামুন! কড়া গলায় বলল ইসাবেল। কিন্তু বিপদটা আঁচ করতে দেরি করে ফেলেছে।

ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে ডজ। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, তুমি! ইংরেজিতে বলছে সে এখন, মেকসিকান উইগ দিয়ে বোকা প্রায় বানিয়ে ফেলেছিলে! কিন্তু ওই নীল চোখ লুকাবে কোথায়, নেলি?

কন্টাক্ট লেন্স লাগাতে ভুলে গিয়েছিল ইসাবেল।

তারপর পলকে ঘটে গেল অনেকগুলো ঘটনা।

রাইফেল তুলতে শুরু করল ইসাবেল। লাফিয়ে একপাশে সরে গেল ডজ। নিশানা করল ইসাবেলের দিকে।

গুলির শব্দ শুনল কিশোর।

ডজের হাত থেকে যেন উড়ে চলে গেল রাইফেলটা। পাঁচ গজ দূরে পাথরের ওপর গিয়ে পড়ল।

লাফ দিয়ে বেরিয়ে এসে একটানে লোকটার কোমরে গোঁজা ছুরি কেড়ে নিল কিশোর।

খটাখট খটাখট শোনা গেল খুরের শব্দ।

ঘোড়া ছুটিয়ে এল পিরেটো। হাতে একটা .৪৫ ক্যালিবারের কোন্ট পিস্তল। সেটা তাক করল ডজের দিকে। হুঁশিয়ার করল, পরের বার আর বাঁটে সই করব না, মাথায় করব। ইসাবেলের দিকে তাকাল। মহিলাও তার রাইফেল তাক করে রেখেছে ডজের দিকে। এইবার সেফটি ক্যাচ অফ করা আছে।

গুলি করো না, ইসাবেলকে বলল পিরেটো। ছেড়ে দাও। গুলি করে মারলে লাশ কবর দেয়ার সময়ও পাব না। আর কবর না দিতে পারলে, খোলা জায়গায় শকুনের খাবার বানিয়ে রেখে গেলে অভিশাপ লাগবে আমাদের ওপর।

ডজের দিকে তাকাল সে। চিৎকার করে বলল, যাও, ভাগ! গিয়ে খুঁজে বের করো তোমার পেসো!

কালো হয়ে গেছে ডজের মুখ, রাগে। চোখে তীব্র ঘৃণা।

যাও! যাচ্ছ না কেন? স্প্যানিশ ভাষায় আবার ধমকে উঠল পিরেটো। পঞ্চো ভিলার গুহায় যাও। টনিকে সঙ্গে নেয়ার আর দরকার নেই। ওটাতে যাওয়ার জন্যে যথেষ্ট চিহ্ন দেখতে পাবে। পায়ের ছাপের ছড়াছড়ি এখন ওপথে।

এক সেকেও পিরেটোর দিকে তাকিয়ে রইল ডজ। ওর চোখে খুনীর দৃষ্টি দেখতে পেল কিশোর। কিন্তু কিছু করার নেই। পুরোপুরি অসহায় এখন। গুলি করে ওর রাইফেলের বাট ভেঙে দিয়েছে পিরেটো। ছুরি কেড়ে নিয়েছে কিশোর। ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল ভিলার গুহাঁটা যেদিকে রয়েছে সেদিকে।

পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল মা-ছেলে। ঘোড়া থেকে নামল পিরেটো। হতচ্ছাড়া এই ওয়াকিটকি! কাল রাতে হাত থেকে পড়ে গিয়ে আবার নষ্ট হয়ে গেছে। শব্দই বেরোচ্ছে না।

চূড়ার দিকে তাকাল কিশোর। আরেক ভলক কালো ধোঁয়া বেরোল।

রবিন আর মুসাকে বের করে আনা দরকার, বলল সে। গুহায় আটকা থাকলে মরবে।

মুখের ভেতর দুই আঙুল পুরে জোরে শিস দিল পিরেটো। ঢালের ওপাশ থেকে ছুটতে ছুটতে এল আরেকটা ঘোড়া। চিনতে পারল কিশোর ডজ ওটাতে করেই এসেছিল।

ওটাকে বাঁধা দেখলাম, পিরেটো জানাল। খুলে নিয়ে এসেছি। চলো, জলদি চলো, পালাই এখান থেকে।

কিশোর চড়ল শরির পিঠে। ইসাবেল তার নিজের বারোতে, আর টনি চড়ল ডজের ঘোড়ায়। আগে আগে রওনা হলো কিশোর, টনির গুহার দিকে।

গুহা থেকে শখানেক গজ দূরে থাকতে কি যেন এসে বিধল কিশোরের গালে। তারপর হাতে। কপালে হাত রেখে ওপরে তাকাল সে।

পাথর-বৃষ্টি হচ্ছে!

খুদে পাথর ঝরে পড়ছে আকাশ থেকে। একটা পড়ল কাঁধে। ফেলার চেষ্টা করল ওটাকে সে। ছ্যাকা লাগল হাতে। কিছুতেই শার্ট থেকে খুলতে না পেরে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। পাথর নয়। ছোট একটা কাচের পুঁতি, আগুনের মত গরম।

পাহাড়ের চূড়ায় ঘটছেটা কি? দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে। তবে সাংঘাতিক বিপদ যে আসছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

শারিকে আরও জোরে চলার তাগাদা দিল কিশোর। পেছনে শুনতে পাচ্ছে ঘোড়াগুলোও চলার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। মিনিট খানেক পরেই দেয়ালের মত ঢালটার কাছে চলে এল ওরা। থামল।

জিনের নিচে ভাঁজ করে রাখা কম্বলটা বের করল পিরেটো। ছুরি দিয়ে কেটে ফালা ফালা করতে লাগল।

ততক্ষণে রওনা হয়ে গেছে কিশোর। তাকে ডেকে বলল পিরেটো, তাড়াতাড়ি আসবে।

সুড়ঙ্গে ঢুকল কিশোর। গুহায় এসে দেখল, পিঠে পিঠ লাগিয়ে বাঁকা হয়ে আছে মুসা আর রবিন। মুসা সবে রবিনের বাঁধনের একটা গিঁট খুলেছে।

ডজের ছুরি দিয়ে দ্রুত ওদের বাঁধন কেটে মুক্ত করল কিশোর।

আমি তো ভেবেছি পিজা কিনতে দেরি করছ। হাত-পা ছড়িয়ে, ঝাড়া দিয়ে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করে নিতে লাগল মুসা। তারপর? কোথায় দোকানটা?

রবিনও মুসার মতই হাত-পা ঝাড়ছে। তাকিয়ে রয়েছে কিশোরের মাথার দিকে। ব্যাপার কি? মাথায় পুঁতি পরার শখ হলো কেন হঠাৎ?

চুলে আঙুল চালিয়ে ওগুলো ফেলার চেষ্টা করল কিশোর। ঠান্ডা হয়ে গেছে পুঁতির মত জিনিসগুলো, কিন্তু আটকে গেছে এমন করে, আঙুল দিয়ে চিরুনি চালিয়ে কিছুতেই সরাতে পারল না। আকাশ থেকে পড়ল। গরম কাচের টুকরো। এসো, বেরোও, জলদি।

সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে মাথা নিচু করে প্রায় দৌড়ে বেরোল ওরা। কাচ-বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে আপাতত। কম্বলের লম্বা কয়েকটা টুকরো ওদেরকে দিয়ে বলল পিরেটো, নাও, মাথায় জড়াও। হাতেও পেঁচিয়ে নাও। খোলা রাখবে না। ওর নিজের মাথায় আর হাতে ইতিমধ্যেই জড়ানো হয়ে গেছে।

লাল শালটা দিয়ে মাথা আর কাঁধ ঢেকেছে ইসাবেল।

চলো, এবার যাই, তাগাদা দিল পিরেটো।

কাউকে বলতে হলো না। মুসা চড়ে বসল টনির পেছনে। রবিন পিরেটোর।

এই বার আগে আগে চলল মেকসিকান। আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথে জোরে চলা বিপজ্জনক, কিন্তু পরোয়া করল না সে, বার বার তাগাদা দিতে লাগল ঘোড়াকে। নেমে চলল নিচের উপত্যকার দিকে। যে নালাটা পাহাড়ের ঢালে গভীর খাত সৃষ্টি করে নেমেছে, সেটাতে নেমে আরও তাড়াতাড়ি চলার নির্দেশ দিল পিরেটো। পেছনে ভারি একটা গুড়গুড় শোনা গেল, মেঘ ডাকার মত। বাতাসে গন্ধকের গন্ধ বেড়ে গেছে, শ্বাস নেয়াই কঠিন।

নালায় নামার খানিক পরেই ঘটল ঘটনাটা। আধ মাইল দূরেও নেই আর গুহাঁটা, এই সময় পেছনে ফেটে পড়ল যেন আগ্নেয়গিরি। মুসার মনে হলো, বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে গেছে গোটা পর্বত।

চূড়া থেকে খাড়া উঠে গেল গরম গলিত লাভা, ফোয়ারার মত ঝরে পড়তে লাগল। আরও লাভা ছিটকে উঠল ওপরে। পড়ল, উঠল। প্রতিবারেই আরও বেশি ওপরে উঠে যাচ্ছে। ওপরে উঠে এমন করে ছড়াচ্ছে, দূর থেকে দেখলে মনে হবে বাজি পোড়ানো হচ্ছে। অসংখ্য বোমা ফাটার মত শব্দ হচ্ছে জ্বালামুখের ভেতরে। কানে তালা লাগানোর জোগাড়। শুধু যে লাভা বেরোচ্ছে তা নয়, সাথে করে পর্বতের গভীর থেকে নিয়ে আসছে পাথর। ঢাল বেয়ে গড়াচ্ছে সেগুলো ৷ গনগনে কয়লার মত গরম। নামতে শুরু করেছে লাভার স্রোত।

ক্রমেই জোর বাড়ছে লাভার। শত শত ফুট ওপরে উঠে যাচ্ছে এখন। ব্যাঙের ছাতার মত ছড়িয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে ঝরে পড়ছে পাথরের ওপর। ঢাল বেয়ে নামছে। চলার পথে ঢেকে দিয়ে আসছে পাথর, গাছপালা সব কিছু। বাষ্প উঠছে। এদিক-ওদিক থেকে এসে মিলিত হচ্ছে লাভার একাধিক স্রোত। যতই নামছে চওড়া হচ্ছে আরও গলিত লাভার নদী হয়ে নামছে নিচের দিকে।

গরম ছাই, পাথরের কুচি আর কাচের টুকরোর বৃষ্টি পড়তে লাগল যেন অভিযাত্রীদের ওপর। চমকে চমকে উঠছে ভীত জানোয়ারগুলো। গরম পাথর আর কাচের ছ্যাঁকা লাগছে ওগুলোর তোলা চামড়ায়। আর সইতে না পেরে পিরেটোর ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে গেল হঠাৎ পেছনের দুই পায়ে ভর করে। পরক্ষণেই মাটিতে নেমে লাথি মেরে যেন তাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল অবাঞ্ছিত বিপদকে। পিরেটোও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না ঘোড়াটাকে। ওর কোমর জড়িয়ে ধরে রেখেছে রবিন।

শারিকে নিয়ে এসো! চেঁচিয়ে উঠল পিরেটো।

বারোটাকে নিয়ে দ্রুত এগোল কিশোর।

ঘোড়াগুলোর মাঝে ঢুকিয়ে দাও ওকে! পিরেটো বলল। শান্ত করুক!

লম্বা দম নিল কিশোর। তারপর প্রায় চোখমুখ বুজে বারোটাকে নিয়ে এগোল আতঙ্কিত দুটো ঘোড়ার মাঝের সরু ফাঁকে ঢোকানোর জন্যে।

ওদের মাঝে একটা শান্ত জানোয়ারকে দেখে ধীরে ধীরে ঘোড়াগুলোও শান্ত হয়ে এল। দুলকি চালে চলছে শারি। ঘোড়াগুলোও একই রকম করে চলতে লাগল।

পাথর-বৃষ্টি পাতলা হয়ে এল জোরাল বাতাসে। নাকে এসে ঝাপটা মারল বাতাস। গন্ধকের গন্ধে দম আটকে যাওয়ার অবস্থা হলো কিশোরের! তাড়াতাড়ি কম্বলের টুকরো দিয়ে নাকমুখ চাপা দিল। আশঙ্কা হতে লাগল তার, এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবে তো?
পেছনে ফিরে তাকাল রবিন। এগিয়ে আসছে আগুন-গরম, লাল রঙের গলিত লাভা। পাথর গলিয়ে ফেলছে। আগে আগে ছুটছে প্রাণ ভয়ে ভীত ছোট ছোট জানোয়ারের দল, চিৎকার করে উড়ছে পাখিরা। জ্বলে উঠছে ঝোঁপঝাড়। শিল-নোড়া দিয়ে কাচ গুঁড়ো করার মত একটা শব্দ উঠছে কড়কড় কড়কড় করে। লাভার নদী বয়ে আসার সময়ই হচ্ছে শব্দটা।

গেছি, ভাবল সে। এভাবেই তাহলে মরণ লেখা ছিল কপালে! মুসাকে বলল, যাক, আর দশজনের মত সাধারণ মৃত্যু হচ্ছে না আমাদের।

ঠিক, জবাব দিল মুসা। আগ্নেয়গিরির লাভায় চাপা পড়ে মরার ভাগ্য কজনের হয়?

পর্বতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে দুজনে। ছুটে আসা লাভার উত্তাপ এসে লাগছে চোখে, জ্বালা করছে। কিন্তু তার পরেও চোখ বন্ধ করল না, জোর করে পাতা মেলে তাকিয়ে রইল সেদিকে।

কাচ ভাঙার শব্দ বাড়ছে। সেই সাথে মারাত্মক ওই আগুনের নদীর ওপর কালো এক ধরনের আস্তর পড়ছে। জমে যাচ্ছে লাভা। ঢাল বেয়ে গড়ানো কমছে। আশা ঝিলিক দিয়ে গেল রবিনের মনে। গড়িয়ে গড়িয়ে যেন অনেক কষ্টে এগোল আরও কয়েক গজ, আগের সে জোর নেই, তারপর থেমে গেল একেবারেই।

ছাই আর গরম পুঁতি-বৃষ্টিও বন্ধ হয়ে আসছে। দেখতে দেখতে সেসব পেছনে ফেলে এল ভীত ঘোড়া আর বারোগুলো।

অবশেষে বিপদসীমা ছাড়িয়ে আসতে পারল ওরা।

আরও আধ মাইল পর পৌঁছল উপত্যকায়। পিরেটো ওদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল পরের পর্বতটার দিকে। কিছুদূর গিয়ে থামল।

বিষাক্ত ধোঁয়া আর গ্যাসের মধ্যে শ্বাস নিয়েছে, এতক্ষণে তার জের শুরু হলো। কাশতে আরম্ভ করল সবাই। নাক উঁচু করে বড় বড় দম নিয়ে টেনে নিতে লাগল তাজা বাতাস। ফিরে তাকাল আগ্নেয়গিরির দিকে।

পিরেটো দেখতে পেল তাকে প্রথমে। হাত তুলে দেখাল অন্যদেরকে। বহু দূরে একটা মূর্তি লাফিয়ে চলেছে পাথর থেকে পাথরে। পড়ে যাচ্ছে, হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠছে আবার, সরে আসার চেষ্টা করছে ভিলার গুহার কাছ থেকে।

পর্বতের ওদিকটায় লাভার স্রোত সবে চূড়ার একটা নিচে নেমেছে, তরল রয়েছে এখনও, নেমে আসতে শুরু করল দ্রুত। সামনে এখন জীবন্ত যা কিছু পড়বে, ধ্বংস করে দেবে ওই মৃত্যু নদী!

পর্বতের ভেতরে শব্দ অদ্ভুত সব কান্ড করে। আগ্নেয়গিরির গর্জনকে ছাপিয়েও কি ভাবে জানি শোনা গেল ডজের আতঙ্কিত চিৎকার। একবারই, তারপর হারিয়ে গেল গলিত লাভার নিচে। ঢেকে দিয়ে ছুটে নামতে থাকল মারাত্মক ওই তরল পদার্থ।

চোখ বন্ধ করে ফেলল চার কিশোর। কিশোর ভাবছে, বাজে লোক ছিল ডজ মরিস, সন্দেহ নেই। কিন্তু তার খাবার খেয়েছে ওরা, তার বাড়িতে থেকেছে, এক সঙ্গে অভিযানে বেরিয়েছে। ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। সাধারণ ভাবে মরলে এতটা খারাপ লাগত না। কিন্তু এরকম ভয়াবহ মৃত্যু! মনই খারাপ হয়ে গেল।

নিজের বুকে ক্রুশ আঁকল পিরেটো। বিড়বিড় করে প্রার্থনা করল স্প্যানিশ ভাষায়।

তোমাকে বলেছিলাম না, কিশোরকে বলল সে। বিপদ আছে পাহাড়ে। দেখলে তো।

পাহাড়ের পাদদেশের পথ ধরে এগোল আবার ওরা। পিরেটোর পাশে পাশে চলছে ইসাবেল। পিরেটো, কিছু মনে কোরো না। জানি, তোমার লোভ নেই, কিন্তু পেসেগুলো পেলে অনেক সুবিধে হত। র‍্যাঞ্চটা আবার কিনে নিতে পারতে।

কে জানে? পিরেটো বলল আনমনে, আপনাআপনিই হয়তো আমার র‍্যাঞ্চ আমার কাছে ফিরে আসতে পারে আবার।

হাসল সে। লোভের ছিটেফোঁটাও নেই সে হাসিতে।

ভিলার গুহাঁটার কথা প্রথম শুনি মায়ের কাছে, জানাল মেকসিকান। মা আমাকে বলেছিল, অভিশপ্ত ওই পেসো কেউ কোনদিন পাবে না। ভিলার বহু লোক মারা গেছে এর জন্যে। এখনও মরা সৈন্যদের প্রেতাত্মা পাহারা দিচ্ছে ওগুলোকে। একটা মুহূর্ত থামল সে। তারপর বলল, পাহারা দিয়ে যাবে আজীবন।

১৭

বিপদ সীমার বাইরে থেকে, আগ্নেয়গিরিকে বহুদূর দিয়ে ঘুরে চলতে লাগল দলটা। পর্বতের ওপাশের গাঁয়ে যাবে, যেখানে আগ্নেয়গিরির উৎপাত পৌঁছতে পারে না। তাছাড়া ঘনঘন অগ্ন্যুৎপাত হয় বলে কাছাকাছি থাকেনি লোকে, এমন জায়গায় রয়েছে যেখানে লাভা পৌঁছতে পারে না কোনমতেই। এমনকি গরম ছাইও না।

কথাবার্তা তেমন বলছে না ওরা। কিশোরের মন এখন শান্ত। রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে।

পিরেটোর কাছে ভিলার গুপ্তধনের কথা প্রথম শুনেছে ইসাবেল। ১৯১৬ সালে, ওর দাদা ছিল পঞ্চো ভিলার সেনাবাহিনীতে। ইসাবেল পিরেটোকে কথা দিয়েছিল, তার স্বামী আর ছেলে যদি পেসোগুলো খুঁজে পায় তাহলে অর্ধেক দিয়ে দেবে ওকে।

ডজ জানত না গুপ্তধনের কথা। তার কাছ থেকে এটা গোপন রাখা হয়। পিরেটো ঘুণাক্ষরেও কখনও তার সামনে উচ্চারণ করেনি। এই সময় টনি এসে একদিন হাজির হলো অন্ধ বারোটাকে নিয়ে। পিরেটোর সঙ্গে পেসোগুলোর কথা আলোচনা করার সময় শুনে ফেলে ডজ। জেনে যায় টনি আর তার বাবা গুহাঁটা আবিষ্কার করে ফেলেছে।

টনিকে রাজি করাতে না পেরে শেষে শারিকে দিয়ে গুহাঁটা খুঁজে বের করার ফন্দি আঁটে ডজ।

র‍্যাঞ্চারের বীভৎস মৃত্যুর ধাক্কাটা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি কিশোর। ডজের লোভই তাকে ওরকম মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। আগ্নেয়গিরি জেগে উঠেছে এটা দেখার পরেও যদি পেসো আনতে না যেত তাহলে আর এভাবে মরতে হত না।

একটা গর্তের ধারে থামল ওরা, জানোয়ারগুলোকে পানি খাওয়ানোর জন্যে। তারপর আবার এগোনোর পালা। কয়েক মাইল এগিয়ে একটা বিচিত্র শব্দ কানে এল কিশোরের। দূর থেকে আসা অসংখ্য বারোর মিলিত ডাক। সাড়া দিল শারি। বাড়িয়ে দিল চলার গতি।

একটা বন থেকে বেরোতেই জোরাল শোনা গেল আওয়াজ।

বিশাল উপত্যকায় ছড়িয়ে রয়েছে মাইলের পর মাইল তৃণভূমি। শত শত বুনো বারো চরে বেড়াচ্ছে সেখানে। লাফালাফি করছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, চেঁচাচ্ছে।

দাঁড়িয়ে গেছে শারি। খাড়া হয়ে গেছে লম্বা কান, ডগা কাপছে মৃদু মৃদু। হঠাৎ জোরে তীক্ষ্ণ এক ডাক ছাড়ল সে। ওর পিঠ থেকে নেমে পড়ল কিশোর। জিন আর লাগাম খুলে নিল। তারপর আদর করে চাপড় দিল গলায়।
বড় বড় কোমল চোখ মেলে তার দিকে তাকাল শারি। নাক ঘষল গায়ে, যেন বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। তারপর এগিয়ে গেল টনির কাছে। ঘোড়ার পিঠে থাকায় ওর বুক নাগাল পেল না বারোটা, পায়েই নাক ঘষল। নিচু হয়ে শারির মাথা চাপড়ে দিল টনি।

আর দেরি করল না শারি। মহা আনন্দে ছুটল স্বজাতির সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্যে।

ইসাবেলের বারোর পেছনে চড়ে বসল কিশোর।

আবার রওনা হলো দলটা। তাড়াতাড়ি করলে অন্ধকারের আগেই পৌঁছে যেতে পারবে গায়ে। ওখান থেকে চিহুয়াহুয়ায় বাবাকে ফোন করবে টনি। জানাবে সে আর তার মা নিরাপদেই পিরেটোর সঙ্গে গাঁয়ে চলে এসেছে।

পরদিন সকালে বাস ধরে আমেরিকায় রওনা হবে তিন গোয়েন্দা।

লস অ্যাঞ্জেলেসে দেখা করব আমি তোমার সাথে, একসময় রবিনকে বলল টনি। রক কনসার্ট আমার খুব ভাল লাগে। তোমার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখব। কয়েকটা।

চলে এসো, যে-কোন সময়, খুশি হয়েই দেখাব।

পাশাপাশি চলছে মুসা আর কিশোর। পিরেটো আর ইসাবেলের সঙ্গে। মুসা বলল, একটা কথা আমার মাথায় ঢুকছে না, ডজ কি করে জানল কাস অ্যাঞ্জেলেসেই পাওয়া যাবে টনির মত কণ্ঠস্বরের লোক? যেন একেবারে জেনেশুনেই গেছে, ওখানে রয়েছে কিশোর পাশা। আমেরিকার অন্য কোন জায়গায় গেল না কেন?

জেনেশুনেই তো গেছে, জবাব দিল পিরেটো।

জেনেশুনে গেছে?

তাই তো। হাসল মেকসিকান। তোমরা যে কতখানি বিখ্যাত, তা তোমরা নিজেরাও জানো না। অনেকেই চেনে তোমাদেরকে। বিশেষ করে তোমাদের ওই টিভি অনুষ্ঠান পাগল সঙ্ঘ দেখার পর।

অনুষ্ঠানটা ডজও দেখেছিল নাকি? রবিনের প্রশ্ন।

দেখেছিল। আমিও দেখেছি। টনি যখন র‍্যাঞ্চে গেল, ওর গলা শুনে তো আমি চমকেই উঠেছিলাম। আরি, টেলিভিশনের মোটুরাম এল কোথেকে! বলেই চোখ পড়ল কিশোরের ওপর। মুখ কালো করে ফেলেছে গোয়েন্দাপ্রধান। সেটা লক্ষ্য করে তাড়াতাড়ি বলল পিরেটো, সরি, কিশোর, তোমাকে রাগানোর জন্যে বলিনি। টেলিভিশনের সৌজন্যে সে-ও জানে, ওই ডাকনাম একদম পছন্দ নয় কিশোরের।

হাসল মুসা। তাহলে এই ব্যাপার। মোটুরামই ডজকে টেনে নিয়ে গেছে রকি বীচে। আসলে আমাদের জন্যে ফাঁদ পাততেই গিয়েছিল লোকটা।

এবং সেই ফাঁদে দিব্যি পা দিয়ে বসেছে রহস্য পাগল কিশোর পাশা, মুচকি হাসল টনি।

নীরবে পথ চলতে লাগল আবার দলটা।

কিশোর ভাবছে, বীন আর চাল সেদ্ধর কথা। যতদিন বেঁচে থাকবে, আর একটা বীন কিংবা চাল দেখতে চায় না সে। যদিও জানে, চাল ছাড়া থাকতে পারবে না। লস অ্যাঞ্জেলেসে থাকলেও সে ভাতেরই পাগল। সে এবং তার চাচা রাশেদ পাশা। ভাত ছাড়া চলে না। আমেরিকাতে থেকেও পুরোদস্তুর বাঙালী।

চলতে চলতে হঠাৎ মুসার চোখ পড়ল রবিনের টি-শার্টের ওপর। লেখা রয়েছেঃ সারভাইভার।

তাই তো! এর চেয়ে সত্যি কথা আর হতে পারে না ওদের জন্যে। সারভাইভার! অনেক কষ্টেই তো বেঁচে ফিরল।

পেছনে ফিরে তাকাল মুসা। তাকিয়ে রইল পর্বতমালার দিকে। এত বিপদ থেকে বেঁচে ফিরে এসেছে, তবু আবার যদি তাকে ওখানে যেতে বলা হয়, নির্দ্বিধায় রাজি হয়ে যাবে, এর এমনই এক আকর্ষণ। এই আকর্ষণই যুগ যুগ ধরে টেনেছে মানুষকে। সাড়া না দিয়ে পারেনি মানুষ। সমস্ত বিপদ, বাধা, ভয় উপেক্ষা করে ছুটে গেছে ওর কাছে। মুসাও তো মানুষ, প্রচন্ড এই আকর্ষণ এড়ানোর ক্ষমতা তার কোথায়?

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *