পিশাচদেবতা

পিশাচদেবতা

পিশাচদেবতা

হেনরিকাস ভ্যানিং-এর সেদিনের অনুষ্ঠানে যাওয়া আমার মোটেই ঠিক হয়নি। ওর দাওয়াত যদি ফিরিয়ে দিতাম, খুব ভাল করতাম। তাহলে সেই রাতের ওই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার স্মৃতি আমাকে আর তাড়া করে ফিরত না। নিউ অরলিন্স ছেড়ে যাচ্ছি। বটে, চোখ বুজলেই ভেসে উঠছে ব্যাখ্যার অতীত ঘটনাগুলো। ইস্! কেন যে মরতে সেদিন রাস্তায় বেরিয়েছিলাম।

নিউ অরলিন্স এসেছিলাম লেখালেখির কিছু কাজ করতে। এক বহুলপঠিত পত্রিকার সম্পাদক খুব করে ধরেছিলেন মিশরীয় সভ্যতার ওপর কিছু গল্প লিখে দিতে। তিনি জানতেন রহস্যময় এই সভ্যতার প্রতি আমার নিজের অগ্রহও যথেষ্ট। বিশেষ করে মিশরীয় ধর্মের বিভিন্ন দেব-দেবী এবং প্রেতশাস্ত্রের ওপর আমার পড়াশোনা প্রচুর। সম্পাদকের অনুরোধ ফেলতে না পেরে সিদ্ধান নিলাম মিশরীয় দেবতাদের নিয়ে এবার অন্যরকম কিছু গল্প লিখব। একটু নিরিবিলির জন্য তাই নিউ অরলিন্সের লুইজিয়ানা সিটিতে চলে এসেছি। এখানে এই প্রথম আমি। বেশ একা লাগল। প্রথম দুটো দিন অবশ্য গেল খসড়া তৈরি করতে। টাইপরাইটারের একঘেয়ে খটাখট শব্দে ক্লান্তি এসে গেল। মিশরীয় দেবতা নায়ারলাথোটেপ, বুবাস্টিস আর অ্যানুবিস নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে করতে বেজায় বিরক্তি ধরে গেল। ঘরের কোণে বসে থাকতে ভাল লাগল না। শরীরে ঘুণ ধরে গেছে এই দুদিনেই। তৃতীয় দিনে আর পারলাম না। ছড়ানো কাগজ-পত্র ওভাবে রেখেই সন্ধ্যা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। বুকটা খা খা করছে এক ঢোক পানীয়র জন্য। হাতের কাছের একটা কাফেতে ঢুকে পুরো এক বোতল ব্রান্ডি নিয়ে বসে গেলাম একটা টেবিলে। ঘরটা গরম, লোকের ভিড়ও প্রচুর; আজ কি যেন একটা উৎসব। তাই সবাই বিচিত্র পোশাকে সেজেছে।

চার পেগ গেলার পর পরিবেশটা আর আগের মত অসহনীয় মনে হলো না। আমার পাশে ক্লাউনের পোশাক পরা যে মোটা লোকটাকে দেখে ঘণ্টাখানেক আগে হাসি চাপা দুষ্কর হয়ে পড়েছিল, এখন ওর জন্যেই কেমন মায়া হতে লাগল। মুখোশের আড়ালে লোকটার যাবতীয় দুঃখ কষ্ট আর বেদনার চিত্র যেন উপলব্ধি করতে পারলাম আমি। আশপাশের লোকজনের প্রতিও করুণা বোধ করলাম। ওরা সবাই যেন জাগতিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে এখানে জড় হয়েছে। আমিও তো ওদের মতই একজন।

এসব আগাড়ম বাগাড়ম ভাবতে ভাবতে কখন বোতলটা শেষ করে ফেলেছি মনে নেই। বিল চুকিয়ে পা রাখলাম রাস্তায়, আরেকটু হাটব। তবে এবার আর নিজেকে আগের মত একাকী মনে হলো না। বরং উৎসবের রাজা ভাবতে ভাল লাল নিজেকে প্রতিটি পা ফেলার সময়।

উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে আমি বোধহয় একটা ক্লাব লাউঞ্জে ঢুকে পড়েছিলাম স্কচ আর সোডা খেতে, মনে পড়ছে না ঠিক। তবে আবার হাঁটা শুরু করি আমি। পা জোড়া কোথায় আমাকে নিয়ে চলেছে নিজেও জানি না। শুধু মনে হচ্ছে ভেসে চলেছি। তবে চিন্তা করার শক্তি হারাইনি।

আমি ভাবছিলাম লেখাগুলো নিয়ে। ভাবতে ভাবতে কখন প্রাচীন মিশরের হারানো সময়ে ফিরে গেছি, কে জানে!

মনে হলো হালকা অন্ধকার, জনশূন্য একটা রাস্তায় ঢুকে পড়েছি আমি।

হাঁটছি থিবস মন্দিরের মাঝখান দিয়ে, ফিংক্স-এর পিরামিডগুলো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

হঠাৎ মোড় নিলাম আলোকিত এক পথের দিকে। এখানে উৎসবে অংশগ্রহণকারীরা নাচছে।

আমিও মিশে গেলাম সাদা কাপড় পরা পাদ্রীদের মাঝে।

তারপর একের পর এক পাল্টাতে লাগল দৃশ্য।

কখনও মনে হলো ক্রিয়েল শহরে ঢুকে পড়েছি আমি। শহরের লম্বা, উঁচু প্রাচীন বাড়িগুলোর আশপাশ শূন্য, অন্ধকারে ভূতের মত দাড়িয়ে আছে। আবার কখনও মনে হলো একটা হাজার বছরের পুরানো মন্দিরে প্রবেশ করেছি আমি। মন্দিরের সেবা দাসীরা বিশ্বাসঘাতক দেবতা ওসিরিসের রক্তের মত লাল গোলাপ ছিটিয়ে দিচ্ছে আমার গায়ে।

আবার যেন বহু প্রাচীন এক নগরীতে ঢুকে পড়লাম আমি। শত বছরের পুরানো, অন্ধকার বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে এক সারে, গাদাগাদি করে। খালি ঘরগুলো যেন কঙ্কালের খুলির মণিহীন কোটর, যেন অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে খুলিগুলোতে।

রহস্য।

মিশরের রহস্য।

ঠিক এই সময় লোকটাকে চোখে পড়ল আমার। অন্ধকার, ভৌতিকূ রাস্তাটা দিয়ে ভোজবাজির মত আমার পাশে উদয় হলো সে। দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ, আমি কি করি যেন দেখতে চায়। দ্রুত পাশ কাটাতে গেলাম, কিন্তু নিথর দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার একটা ব্যাপার আমার নজর কাড়ল হঠাৎ। লোকটার পোশাক-সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক।

ঝাঁকি খেলাম যেন একটা, কল্পনার জগৎ থেকে দ্রুত ফিরে এলাম বাস্তবে।

লোকটার পরনে প্রাচীন মিশরীয় পুরোহিতদের পোশাক।

একি সত্যি দৃষ্টি বিভ্রম নাকি ওসিরিস-এর সাজে সেজেছে সে? ওই লম্বা, সাদা আলখেল্লাটাকে অস্বীকার করি কিভাবে? লোকটার হাড্ডিসার, সরু হাত দুখানা যেন সর্পদেবতা সেট-এর হাত।

লোকটার দিকে স্রেফ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। চোখে চোখ রাখল সে, পাতলা, টানটান মুখখানা শান্ত, অভিব্যক্তিহীন। একটা ঝাঁকি দিয়ে আলখেল্লার মধ্যে হাত ঢোকাল সে দ্রুত। আমি আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেলাম, হাতটা বের করল আগন্তুক পকেট থেকে-একটা সিগারেট।

দেশলাই হবে, ভাই? জিজ্ঞেস করল মিশরের পুরোহিত!

এই প্রথম হাসলাম আমি, মনে পড়েছে এই মুহূর্তে কোথায় আছি। শালার মদ আমাকে ধরেছিল খুব। কিসব উদ্ভট চিন্তা করেছি এতক্ষশ। দ্রুত মাথাটা পরিষ্কার হয়ে এল। লাইটার বাড়িয়ে দিলাম লোকটার দিকে। আগুন জ্বালল সে, শিখার আলোয় কৌতূহল নিয়ে তাকাল আমার দিকে।

লোকটার বাদামী চোখ দেখে মনে হলো যেন চিনতে পেরেছে আমাকে। অবাক হয়ে গেলাম ওর মুখে আমার নাম শুনে। মাথা ঝাঁকালাম সায় দেয়ার ভঙ্গিতে।

কি আশ্চর্য! মুখ টিপে হাসল সে। আপনিই তাহলে সেই স্বনামধন্য লেখক? আপনার তো মস্ত ভক্ত আমি, সাহেব। সম্প্রতি প্রকাশিত বইটাও পড়ে ফেলেছি। কিন্তু বুঝলাম না নিউ অরলিন্সে কি করছেন আপনি।

অল্প কথায় ব্যাখ্যা করলাম ওকে। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে।

পরিচিত হয়ে সৌভাগ্যবান মনে করছি নিজেকে। আমার নাম ভ্যানিং-হেনরিকাস ভ্যানিং। আমিও আপনার মতই প্রেতশাস্ত্রে ভীষণ আগ্রহী।

আলাপে ওস্তাদ লোক ভ্যানিং। জমিয়ে ফেলল কয়েক মিনিটের মধ্যে। অথবা বলা যায় সে একভাবে বকবক করে গেল আর আমি শুধু শ্রোতার ভূমিকা পালন করলাম। জানলাম মি. ভ্যানিং প্রচুর সহায়-সম্পত্তির মালিক, ধর্মীয় পুরাণ বা শাস্ত্রের ওপর তার সগ্রহ যেমন বিস্তর, পড়াশোনাও করেছে প্রচুর। বিশেষ করে মিশরের ওপর তার আগ্রহ সীমাহীন। কথায় কথায় ভ্যানিং জানাল ওদের একটা দল আছে যারা অধিবিদ্যা নিয়ে প্রায়ই গঠনমূলক আলোচনায় বসে, এ নিয়ে গবেষণাও করে। এ ব্যাপারটা আমাকেও আগ্রহী করে তুলতে পারে, এমন একটা আভাসও দিল ভ্যানিং।

হঠাৎ যেন আবেগে উথলে উঠল সে, আমার হাতদুটো চেপে ধরে ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চাইল, আজ রাতে কি করছেন?

জানালাম কাজ-কাম করতে ভাল লাগছে না। তাই দিবা-স্বপ্ন দেখছি। হাসল সে।

বেশ! আমি খানিক আগে ডিনার সেরেছি। বাড়ি যাচ্ছিলাম কয়েকজন অতিথিকে অভ্যর্থনা জানাতে। এরা আমার সেই ছোট্ট দল-যাদের কথা একটু আগেই বলেছি আপনাকে-ওদের নিয়ে একটা পার্টির ব্যবস্থা করেছি ওখানে। যাবেন নাকি? কস্টিউম পার্টি। মজা পাবেন।

কিন্তু আমার পরনে তো কোন কস্টিউম নেই, বললাম আমি।

তাতে কিছু হবে না। আপনি এমনিই পাটি উপভোগ করতে পারবেন। একেবারে আলাদা জিনিস। চলুন তাহলে।

ওকে অনুসরণের ইশারা করে আগে আগে হাঁটতে শুরু করল হেনরিকাস ভ্যানিং। শেষ পর্যন্ত কৌতূহলের জয় হলো। তাই সদ্য পরিচিত লোকটার পেছন পেছন এগোলাম আমি।

হাঁটতে হাঁটতে বাকপটু ভ্যানিং তার বন্ধুদের সম্পর্কে বলতে শুরু করল। ওরা যে ক্লাব করেছে তার নাম দিয়েছে কফিন ক্লাব। চিত্রকলা, সাহিত্য আর সঙ্গীত নিয়েই দলের সদস্যদের সময় কাটে। তবে তাদের আলোচনার বিষয় শিল্পকলার এই তিনটে মাধ্যমের অন্ধকার দিকগুলো।

ভ্যানিং জানান, আজ রাতে দলটা অত, নিজস্ব সাজে সাজবে। কারণ আজ তাদের এক বিশেষ উৎসবের দিন। ডাকাত, ক্লাউন, জলদস্যু ইত্যাদি গতানুগতিক সাজ আজকের দিনে মোটেই চলবে না। অতি প্রাকৃত সাজে সাজতে হবে সবাইকে। মনে মনে চিন্তা করলাম ওরা নিশ্চয়ই ওয়্যারউলফ, ভ্যাম্পায়ার, পুরোহিত, কালো জাদুকর ইত্যাদির রূপ ধরবে। এসব ব্যাপারে আমার আগ্রহও আছে। কারণ অকাল্ট শাস্ত্রের ওপর পড়াশোনা করে নিজের অজান্তে এসব আধি ভৌতিক ব্যাপারগুলোর প্রতি কবে ঝুকে পড়েছি এখন আর তা মনে নেই। ভ্যানিং-এর সাথে যেতে যেতে নতুন কিছু দেখার আশায় মনে মনে বেশ উৎসাহী হয়ে উঠছিলাম।

হেনরিকাস ভ্যানিং-এর সাথে কথা বলতে এমন মশগুল ছিলাম যে, কোথেকে। কোথায় এসে পড়েছি জানি না। শেষমেশ আমাদের গতি শ্লথ হয়ে এল গুলুচ্ছাদিত লম্বা, সরু একটি রাস্তার মুখে এসে। রাস্তাটার শেষ মাথা গিয়ে ঠেকেছে যেখানে, সেখানে দাড়িয়ে আছে আলোকিত এক রাজ প্রাসাদ।

ভ্যানিং-এর বাকচাতুরীতে মুগ্ধ আমি প্রাসাদের চারপাশে ভাল করে চোখ বোলালাম না পর্যন্ত, দরজা খোলা ছিল, সেই দরজা দিয়ে সোজা ভেতরে ঢুকে গেলাম আমরা-প্রবেশ করলাম নির্জলা এক আতঙ্কের জগতে।

বিশাল বাড়িটার সব জায়গায় আলো জ্বলছে। রক্তের মত টকটকে লাল আলো।

আমরা দাঁড়িয়ে আছি একটা হলওয়েতে; নরকের মত হলওয়ে। লাল আলোর ছুরি যেন আয়না ঘেরা দেয়ালের ওপরের অংশ কেটে বেরুচ্ছে। সিঁদুররঙা ঝালর টানানো ভেতরের প্রবেশ পথে, ফায়ারপ্লেসের ধিকি ধিকি জ্বলা আগুনের শিখার ছায়া তিরতির করে কাঁপছে গাঢ় লাল সিলিং-এ, যেন আগুন ধরে গেছে। খোদ শয়তানের মত চেহারার এক বাটলার আমার হ্যাটটা নিয়ে হাতে ধরিয়ে দিল চেরী ব্রান্ডি বোঝাই সুদৃশ্য পানপাত্র।

লাল ঘরে একা আমি, ভ্যানিং ফিরল আমার দিকে, ওর হাতেও একটা গ্লাস।

পছন্দ হয়েছে? জিজ্ঞেস করল সে। অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য ঘরটা এভাবে সাজিয়েছি। পো-র গল্প থেকে আইডিয়াটা সামান্য ধার করা।

লোকটার খেয়ালী স্বভাব আমাকে বেশ অবাক করল। কি যেন করতে চাইছে ও। মিশরের পুরোহিতের ছদ্মবেশধারীর হাতে খালি গ্লাসটা দেয়ার সময় আমি কেন জানি সামান্য শিউরে উঠলাম।

এখন চলুন-অতিথিদের সাথে দেখা করে আসি। একটা ট্যাপেস্ট্রি একপাশে ঠেলে সরাল ভ্যানিং, আমরা ডানদিকে গুহার মত একটা ঘরে ঢুকলাম।

এ ঘরের দেয়ালগুলো সব সবুজ আর কালো পর্দায় ঢাকা; কুলুঙ্গির মোমবাতি শুধু আলোকিত করে রেখেছে ঘরটাকে। আসবাবপত্রগুলো আধুনিকই বলা যায়, তবে বৈচিত্র্যহীন। আমন্ত্রিত অতিথিদের ভিড়ের দিকে যখন তাকালাম, মনে হলো বুঝি স্বপ্ন দেখছি।

ওয়্যারউলফ, দেব-দেবী এবং পিশাচ জাদুকর, বলেছিল ভ্যানিং। কিন্তু এখানে তারচেয়েও অদ্ভুত সব লোকজন হাজির, যেন নরক থেকে নেমে এসেছে সব কটা। বীভৎস এবং অশ্লীল ভঙ্গি করছে সবাই। কেউ সেজেছে এক চোখো দানব, কেউ কানা-খোড়া, কেউ আবার পিশাচ। কালো জাদুকরদেরও চোখে পড়ল। বিকট চেহারার ডাইনীও নজর এড়াল না।

এবার ভ্যানিং-এর তাড়ায় ভিড়টার সাথে মিশে যেতে হলো আমাকে, সবার সাথে পরিচয় হলো। মুখোশ খুলতেই একেকজন নিপাট চেহারার ভদ্রলোক এবং সুন্দরী নারীতে রূপান্তরিত হলো।

প্রায় ডজনখানেক অতিথি উপস্থিত ঘরে। পরিচয় হলেও খুব দ্রুত ভুলে গেলাম সবার নাম। ভ্যানিং আমার কনুই ধরে টেনে নিয়ে গেল এক কোণে। আরে, এদের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করছেন কেন? গলা নামাল সে। আমার সাথে আসুন। আসল লোকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।

ঘরের এক কোণে চারজনের একটা দল বসে ছিল। সবার পরনে ভ্যানিং-এর মত পুরোহিতদের পোশাক। এক এক করে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল ভ্যানিং।

ড. ডেলভিন, বুড়ো এক মানুষ, বেবিলোনিয়ান। আঁতিয়েন ডি মারগনি, অ্যাডোনিসের প্রিস্ট, হ্যান্ডসাম। গায়ের রঙ কালো।

প্রফেসর উইলড্যান, দাড়িওয়ালা, প্রায় বামন আকৃতির মানুষটা। মাথায় পাগড়ি।

রিচার্ড রয়েস, অল্পবয়েসী, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার তরুণ।

চারজনেই বিনীত ভঙ্গিতে আমার দিকে চেয়ে নড় করল। ভ্যানিং বলল, আমার দলের এই চারজনই আসল লোক। আমরা সবাই প্রেত চর্চায় বিশ্বাসী।

চমকালাম না। কারণ অকাল্ট শাস্ত্রের প্রতি যাদের প্রবল খিদে, প্রেত চর্চায় তাদের একটু-আধটু আগ্রহ থাকেই।

এই যে চারজনকে দেখছেন এদের মধ্যে আমার বাঁ পাশের জন অর্থাৎ ড. ডেলভিন এদেশের সবচেয়ে নামকরা জাতি বিজ্ঞানী। ডি ম্যারিগনি প্রখ্যাত অকালটিস্ট-র্যানডলফ কার্টারের সাথে যার এক সময় যোগাযোগ ছিল। রয়েস আমার পার্সোনাল এইড, আর প্রফেসর উইলড্যান বিখ্যাত মিশর-বিজ্ঞানী। ভারি মজা তো! ভাবলাম আমি। মিশর নিয়ে গল্প লিখছি। এখানেও সেই মিশর।

আপনাকে কিছু ইন্টারেস্টিং জিনিস দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। অবশ্যই তা দেখতে পাবেন। আধঘণ্টাটাক আমাদেরকে এই পার্টিতে কাটাতে হবে। তারপর আসল সেশন করতে আমরা ওপরে, আমার ঘরে যাব। আশা করি ততক্ষণ ধৈর্য ধরে থাকবেন।

ভ্যানিং আমাকে নিয়ে আবার ঘরের কেন্দ্রের দিকে এগোতে শুরু করলে ওরা চারজন বো করল। নাচ থেমে গেছে, ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সবাই গল্প-গুজবে মত্ত। দুএকজনের সাথে হালকা দুএকটা কথাও বললাম। এইসময় দেখলাম—তাকে।

স্রেফ এডগার অ্যালান পোর গল্প মনে পড়ে গেল আমার তাকে দেখে। ঘরের শেষ মাথার কালো-সবুজে মেশানো পর্দা ফাঁক হয়ে গেল, সে পা রাখল ভেতরে, যেন মাটি ফুঁড়ে বেরুল আগন্তুক।

মোমের রূপালী আলো পড়েছে তার গায়ে, হাঁটতে শুরু করল সে, প্রতিটি পদক্ষোপে অশুভ এবং ভয়ঙ্কর কি যেন একটা বিচ্ছুরিত হতে লাগল তার শরীর থেকে। এক সেকেণ্ডের জন্য মনে হলো বুঝি একটা প্রিজমের মাঝখান থেকে দেখছি তাকে, কাপা আলোয় তার নড়াচড়া আমার কাছে অস্পষ্ট এবং ক্ষীণ মনে হলো।

মিশরের আত্মা সেজে এসেছে সে।

লম্বা, সাদা আলখেল্লায় ঢাকা তার হাড্ডিসার শরীর। ঝুলঝলে আস্তিন থেকে বেরিয়ে আসা হাতদুটো পাখির নখের মত বাঁকানো, দামী আংটি পরা আঙুলের মুঠিতে ধরে আছে সোনার একটা লাঠি, আই অভ হোরাসের চিহ্ন সীল করা।

আলখেল্লার ওপরের অংশটা কালো, গলা কাটা; ওটার ওপরে, ঘোমটার আড়ালে উঁকি দিচ্ছে ভৌতিক একটা মাথা।

মাথাটা কুমিরের। আর ধড়টা মিশরীয় পুরোহিতের।

মাথাটা-এক কথায় ভয়ঙ্কর। কুমিরের মাথার মতই খুলির দিকটা ঢালু, ওপরটা সবুজ আঁশে ভরা; লোমশূন্য, পাতলা, চকচকে, দেখলে বমি আসে। বড় বড় হাড়ের কাঠামোর মাঝখানে অক্ষিকোটর, লম্বা, সরীসৃপ আকৃতির নাকটার পেছনে এক জোড়া চোখ, কটমট করে তাকিয়ে আছে। কোচকানো নাকের ফুটো, শক্ত এবং কঠিন দুই চোয়াল সামান্য ফাঁক হয়ে আছে, বেরিয়ে পড়েছে গোলাপী লকলকে জিভ, খুরের মত ধারাল দাঁতের সারিসহ।

মুখোশ বটে!

আমি প্রশংসার চোখে ওটার দিকে চেয়ে আছি, হঠাৎ যেন ঝাঁকি খেলাম একটা। এখানকার মুখোশধারীদের চেয়ে এই কুমির-মানবের মুখোশটা যেন অনেক বেশি জীবন্ত, মনে হয় সত্যি।

লোকটা বোধহয় একা এসেছে, ওর সাথে কাউকে সেধে কথা বলতেও দেখলাম না। ভ্যানিং-এর কাছে এক লাফে পৌঁছে গেলাম আমি, কাঁধে টোকা দিলাম। লোকটার সাথে পরিচিত হবার ইচ্ছে জেগেছে আমার।

ভ্যানিং আমার দিকে নজর দিল না। সে ব্যস্ত ব্যান্ড পার্টির এক লোকের সাথে কথা বলতে। আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম, কুমির-মানবের সাথে নিজেই আলাপ করব ভেবে।

চলে গেছে সে।

তীক্ষ্ণ নজর বোলালাম উপস্থিত অভ্যাগতদের ওপর। লাভ হলো না কোন। নেই সে। যেন হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেছে।

অদৃশ্য হয়ে গেল? লোকটার অস্তিত্ব সত্যি ছিল কি? ওকে আমি দেখেছি-বরং বলা যায় এক পলকের জন্য ওকে আমার চোখে পড়েছে। নাকি আদৌ সে এখানে ছিল না। গোটা ব্যাপারটাই হয়তো আমার কল্পনা। যেভাবে মিশর নামের দেশটা আমার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে তাতে দৃষ্টিবিভ্রম হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। তাহলে মনের মধ্যে খচখচ করে কেন? কেন মনে হয় কল্পনা নয়, বাস্তবিকই দেখেছি আমি তাকে।

ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ভাবনা-চিন্তার সময় পেলাম না। ভ্যানিং আধঘণ্টার ঠির ব্যবস্থা করেছে তার দাওয়াতীদের জন্য। গান-বাজনা হবে।

আলোগুলো সব নীলচে হয়ে এল-অস্পষ্ট, কবরখানার মত নীলচে কুয়াশার। অতিথিরা সবাই নিজেদের আসনে বসতে শুরু করেছে। তাদের ভৌতিক ছায়া গাঢ় দেখাল। অর্কেস্ট্রা প্ল্যাটফর্মের নিচ থেকে বেজে উঠল একটি যন্ত্র, শুরু হলো সঙ্গীতানুষ্ঠান।

আমার প্রিয় একটা সুর, চাইকোভস্কির দ্য সোয়ান লেক বাজাচ্ছে ওরা। সুষ্টা যেন গুঞ্জনধ্বনি তুলল, কেঁপে কেঁপে উঠল, কখনও ম্লান হয়ে এল, আবার যেন ভেঙচি কাটল সবাইকে। ওটা ফিসফিসানি শুরু করল, গর্জে উঠল, ভয় দেখাল, হুমকি দিল। এমনকি আমার ভেতরের অস্থিরতাকেও শান্ত করে তুলল মাতাল করা। সোয়ান লেক।

মিউজিকের তালে শুরু হলো শয়তানের নাচ; এক জাদুকর আর এক পিশাচ ভয়ঙ্কর নাচ শুরু করে দিল। গোটা ব্যাপারটাই গা কিরকির করা, নোংরা এবং বানোয়াট মনে হলো। শেষপর্যন্ত সব আলো গেল নিভে, ব্যান্ডদল পাগল হয়ে উঠল যেন এবার। এইসময় ভ্যানিং এল আমার কাছে, আমাকে নিয়ে এগোল ঘরের এক দিকে। ওখানে সেই চারজন অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

ভ্যানিং ইশারা করল ওই চারজনকে অনুসরণ করতে। প্ল্যাটফর্মের পাশের পর্দা তুলে বেরিয়ে এলাম, দেখলাম লম্বা, অন্ধকার একটা হলওয়েতে ঢুকে পড়েছি। ভ্যানিং ওক-কাঠের একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। চাবি ঢোকাল ফুটোয়, শব্দ করে খুলে গেল তালা। ঢুকলাম একটা লাইব্রেরীতে।

ঘরটা সুসজ্জিত। মদের সরবরাহও প্রচুর। চমৎকার এক গ্রাস কনিয়্যাক পান করার পরে আমার চিন্তা-চেতনাগুলো আবার কেমন ঘোট পাকাতে শুরু করল। সবকিছুই অবাস্তব আর অস্বাভাবিক মনে হতে লাগল; ভ্যানিং, তার বন্ধুরা, এই বাড়িটা, গোটা সন্ধ্যা। সবকিছুই যেন একটা কল্পনা। শুধু সেই কুমিরের মুখোশ পরিহিত লোকটা ছাড়া। ওর কথা ভ্যানিংকে জিজ্ঞেস করতেই হবে..

একটা কণ্ঠস্বর হঠাৎ আমাকে পার্থিব জগতে ফিরিয়ে নিয়ে এল। কথা বলছে ভ্যানিং, আমাকে ডাকছে। ওর গলা গুরুগম্ভীর শোনাল, অস্থিরতায় কাঁপছে যেন। মনে হলো এই প্রথম যেন ওর গলা শুনছি আমি। এখানে ও-ই একমাত্র বাস্তব, আর সবকিছু কাল্পনিক।

কথা বলছে ভ্যানিং, লক্ষ করলাম পাঁচ জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

ভ্যানিং বলল, আমি আপনাকে একটি বিশেষ জিনিস উপহার দেব বলেছিলাম। এখন সে সময় উপস্থিত। তবে বিনাস্বার্থে আপনাকে এখানে আমি নিয়ে আসিনি। আপনাকে আসলে আমার প্রয়োজন ছিল বলে নিয়ে এসেছি। আমি আপনার লেখা গল্প পড়েছি। আমার মনে হয়েছে শ্রোতা হিসেবেও আপনি খুব আন্তরিক হবেন। আপনার পরামর্শ এবং বুদ্ধি দুটোই আমার প্রয়োজন। এজন্যই আমরা একজন অপরিচিত লোককে আমাদের এই গোপন অনুষ্ঠানে নিয়ে এসেছি। আমরা আপনাকে বিশ্বাস করি-অবশ্যই বিশ্বাস করি।

সচ্ছন্দে আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারেন  শান্ত গলায় বললাম। এই প্রথম টের পেলাম ভ্যানিং শুধু উত্তেজিত নয়, নার্ভাসও হয়ে আছে। ওর হাতে ধরা সিগারেটটা কাঁপছে; মিশরীয় ঘোমটার নিচে ঘাম জমেছে কপালে। রয়েস তার কোমরের বেল্ট ক্রমাগত মুচড়ে চলেছে। বাকি তিনজন চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু তাদের নীরবতা ভ্যানিং-এর কণ্ঠের অস্বাভাবিক ওঠানামার চেয়েও অস্বস্তিকর।

কি হচ্ছে এসব? স্বপ্ন দেখছি? নীলাভ আলোর দ্যুতি, কুমিরের মুখোশ, অবশেষে নাটকীয় এক রহস্যময়তা। তারপরও এগুলোকে আমার বিশ্বাস করতে হচ্ছে।

বিশ্বাস করছি, কারণ ভ্যানিং বড় টেবিলটার একটা পায়ার সুইচে চাপ দিতেই নিচের কৃত্রিম ড্রয়ার খুলে যে ফাঁকটার সৃষ্টি হলো সে তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি। মারিগনির সাহায্যে ওখান থেকে একটা মমির বাক্স বের করে আনল ভ্যানিং। তারপর একটা শেলফ থেকে কিছু বই বগলদাবা করে ফিরল সে, কোন কথা না বলে তুলে দিল ওগুলো আমার হাতে।

বইগুলো দেখেই বুঝলাম এগুলো শুধু দুস্প্রাপ্যই নয়, অকালটিস্ট ছাড়া এসব বই কারও পক্ষে সগ্রহ করা সম্ভবও নয়। কাচের হালকা মলাট দিয়ে বাঁধানো প্রতিটি বই। এগুলোর মধ্যে আছে বুক অভ আইবন, কুল্টে দে গুলস-এর অরিজিনাল এডিশন, আর অতি বিখ্যাত ডি ভারমিস মিস্টিরীজ।

বইগুলোতে নজর বুলিয়েই আমি বুঝে ফেলেছি এগুলো কি দেখে ভ্যানিং-এর ঠোঁটে চেষ্টাকৃত হাসি ফুটল।

এগুলো আমরা বহুদিন ধরে লুকিয়ে রেখেছিলাম, বলল সে। জানেনই তো এরমধ্যে কি আছে।

জানি আমি। কারণ ডি ভারমিস মিস্টিরীজ বইটা আমারই লেখা।

ভ্যানিং আরেকটা বই-এর পাতা খুলে দেখাল। এ বইটা সম্পর্কেও আপনি জানেন নিশ্চই। এটার কথা আপনি আপনার একটা লেখায় উল্লেখ করেছিলেন।

সারসেনিক রিচুয়াল লেখা অধ্যায়ে আঙুল দিয়ে ইঙ্গিত করল সে। মাথা ঝাঁকালাম। এটাও প্রাচীন, রহস্যময় মিশর নিয়ে লেখা। আবার সেই মিশর! চট করে একবার চোখ চলে গেল মমি-কেসটার দিকে।

ভ্যানিংসহ অন্যরা আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল। একসময় শ্রাগ করল ভ্যানিং।

শোনো, আপনি থেকে তুমিতে চলে এল সে হঠাৎ। আমি বাজি ধরেছি। তোমাকে আমার বিশ্বাস করতেই হবে।

বলে যাও, অধৈর্য গলায় বললাম আমি। এক কথা বারবার ভাল লাগে না শুনতে।

ঘটনার শুরু এই বইটা থেকে, বলল হেনরিকাস ভ্যানিং। রয়েস এটার ব্যাপারে আমাকে প্রথম কৌতূহলী করে তোলে। প্রথমে আমরা বুবাস্টিস কিংবদন্তীর ঘটনায় বিশ্বাস স্থাপন করি। কর্নওয়ালে ইতিমধ্যে আমি কিছু অনুসন্ধানও চালাই-ইংল্যান্ডে মিশরীয় সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ খুঁজতে থাকি। এই সময় মিশর সংক্রান্ত ব্যাপারে আমার আগ্রহ শতগুণে বেড়ে যায় যখন প্রফেসর উইলভ্যান গত বছর এক অভিযানে মিশর যান। কিছু আবিষ্কার করতে পারলে সেটা আমি তার কাছ থেকে বেশি দামে কিনে নেব এ কথা বলি আমি তাকে। গত হপ্তায় উনি ওখান থেকে ফিরেছেন এই জিনিসটা সাথে নিয়ে।

মমির বাক্সটার দিকে পা বাড়াল ভ্যানিং। অনুসরণ করলাম ওকে আমি।

ওকে আর বেশি কিছু ব্যাখ্যা করতে হলো না। যা বোঝার বুঝে নিয়েছি।

বাক্সটার ওপর প্রতিলিপি এবং চিহ্ন দেখে বোঝা গেল ওটার ভেতরে জনৈক মিশরীয় পুরোহিতের লাশ আছে। দেবতা সেবেকের পুরোহিত। সারাসেনিক রিচুয়ালস-এ এ সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা আছে।

সেবেক সম্পর্কে যা জানি আমি চট করে মনে পড়ে গেল সব। প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানীদের মতে, সেবেক হলো মিশরের এক দেবতা, নীলনদের উর্বরতার দেবতা। যদি স্বীকত কর্তৃপক্ষের কথা সত্যি হয়, তাহলে সেবেকের চার পুরোহিতের মমি করা লাশের সন্ধান পাওয়া গেছে এ পর্যন্ত। যদিও এই দেবতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তার অসংখ্য মূর্তি এবং আকৃতি তৈরি হয়েছে, কবরে আঁকা হয়েছে ছবি। মিশরের বিজ্ঞানীরা সেবেক সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য উদঘাটন করতে পারেনি। শুধু নৃবিজ্ঞানী নুডভিগ প্রিন এ নিয়ে যাহোক কিছুটা এগোতে পেরেছিলেন। তাঁর লেখার কথা মনে পড়তেই হিম একটা স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে।

সারাসেনিক রিচুয়ালস-এ প্রিন বলেছেন মরুভূমি আর নীলনদের গুপ্ত উপত্যকার গোপন-কবরস্থান ঘুরে তিনি কি তথ্য পেয়েছেন সে সম্পর্কে।

ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত এক গল্পের বর্ণনা দিয়েছেন প্রিন। বলেছেন কিভাবে মিশরীয় পুরোহিতবাদ ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে-কিভাবে পিশাচ দেবতাদের অনুগতরা সিংহাসনের পেছনে থেকে ফারাওদের শাসন করত এবং গোটা দেশ তাদের মুঠিতে পুরে রাখত। মিশরীয় দেবতা এবং ধর্মের গোটা ব্যাপারটাই ছিল গোপন বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে। অদ্ভুত শংকর জাতীয় প্রাণীরা হাঁটত পৃথিবীর মাটিতে; দানবীয়, বিকট ছিল তাদের চেহারা-আধা পশু আধা মানুষ। মানুষের শুধু সৃষ্টি ছিল না বিশালদেহী সাপ দেবতা সেট, প্রচণ্ড পেটুক বুবাস্টিস, এবং বিরাট অসিরিস কিংবা শিয়ালমুখো অ্যানুবিস কিংবা ওয়্যারউলফ।

প্রাচীন পুরুষরা প্রবল ক্ষমতা নিয়ে দেশ শাসন করত, পশুরা ছিল তাদের আজ্ঞাবহ। দেবতাদের ইচ্ছে করলেই তারা ডেকে পাঠাত। সেই দেবতাদের চেহারা ছিল মানুষের মত, মাথা পশুর।

যখন তারা মিশরে রাজত্ব করত তখন তাদের কথাই ছিল আইন। দেশ জোড়া ছিল শুধু দামী দামী মন্দির, দেবতাদের উদ্দেশে বলি দেয়া হত মানুষ। পশুমুখো দেবতারা সব সময় উন্মাদ থাকত রক্তের তৃষ্ণায়। অমরতু আর পুনর্জন্মের লোভে তারা দেব-দেবীকে তুষ্ট করত তাদের প্রবল খিদে মেটানোর ব্যবস্থা করে। মমিতে যেন পচন না ধরে এ জন্য মানুষের রক্ত মাখিয়ে দিত কফিনে। এজন্য কত মানুষকে যে জীবন দিতে হয়েছে তার হিসেব নেই।

প্রিন সেবেক দেবতার কথাও বিস্তারিত বলেছেন। পুরোহিতরা বিশ্বাস করত উর্বরতার দেবতা সেবেক অমর জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই দেবতা কবরে তাদের অনন্তকাল পাহারা দিয়ে রাখবে যতদিন না শেষ বিচারের দিন মৃত ব্যক্তিদের আত্মা কবর থেকে ওঠে, ততদিন। আর যারা তাদের কবরে, চিরদ্রিার শান্তি বিঘ্নিত করবে সেবেক সেই শত্রুদের ধ্বংস ডেকে আনবে। এজন্য পুরোহিতরা তাকে কুমারীদের উৎসর্গ করবে তার উদ্দেশে, এদের ছিঁড়ে খাবে সোনার কুমির। আর সে কুমির হলো দেবতা সেবেক স্বয়ং, যার শরীর মানুষের, মাথা কুমিরের।

উৎসবের সেই বর্ণনা বড় ভয়ানক। পুরোহিতরা সেই ভয়ঙ্কর উৎসবে তাদের প্রভুর মত কুমিরের মুখোশ পরে। প্রতি বছর, তাদের ধারণা, সেবেক নিজে এসে হাজির হয় মেমফিসের মন্দিরে, সবচেয়ে ক্ষমতাসম্পন্ন পুরোহিতদের সামনে আধা মানুষ আধা কুমিরের বেশে।

পুরোহিতরা বিশ্বাস করত সেবে তাদের কবর পাহারা দেবে। আর তাদের এই বিশ্বাসের বলি হতে হত ওই উৎসবের দিনে অগুনতি কুমারী মেয়েদের।

প্রিন-এর বইয়ের দৌলতে এ সব কথাই আমার জানা। সেবেকের পুরোহিতের মমির দিকে দ্রুত একবার চোখ বোলালাম কথাগুলো মনে পড়তে।

দেখলাম মমির গা থেকে কাপড় খুলে ফেলা হয়েছে, শুয়ে আছে একটা গ্লাস প্যানেলের নিচে।

তুমি তো গল্পটা জানোই, আমার চোখের ভাষা পড়তে পেরেছে ভ্যানিং। হপ্তা খানেক হলো মমিটা আছে আমার কাছে; রাসায়নিকভাবে এটাকে পরীক্ষা করা হয়েছে। অবশ্য এ ধন্যবাদ উইলড্যানের প্রাপ্য। পরীক্ষা করতে গিয়ে এই জিনিসটা মমির বুকের ওপর পাই আমি।

একটা জেড পাথরের কবচের দিকে ইঙ্গিত করল ভ্যানিং, কুমির আকৃতির কবচ, গায়ে দুর্বোধ্য হরফে কি যেন লেখা।

কি এটা? জানতে চাইলাম আমি।

পুরোহিতবাদের গোপন কোড। ডি মারিগনির ধারণা এটা নাকাল ভাষা। যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায়-প্রিনের গল্পের সেই অভিশাপের মত-কবর লুঠকারীদের ওপর অভিশাপ। সেবেক নিজের হাতে তাদের শাস্তি দেবে এসব কথা। অনেক অশ্লীল ভাষা।

বাক্যবাগীশ ভ্যানিংকে জোর করে কথাগুলো বলানো হলো। ড. ডেলভিন খামোকা খক খক করে কাশতে শুরু করলেন; রয়েসকে আবার তার বেল্ট মোচড়ানো রোগে পেয়ে বসল; ডি মারিগনি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল। বামন প্রফেসর উইলড্যান এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন মমিটার দিকে, যেন মণিহীন কোটরের ভেতর থেকে সব রহস্যের সমাধান পেতে চাইছেন।

আমার ধারণার কথা ওকে জানিয়ে দাও, ভ্যানিং, মৃদু স্বরে বললেন তিনি।

উইলড্যান এখানে কিছু তথ্যানুসন্ধান করেছেন। কর্তৃপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে মমিটা এখানে নিয়ে আসতে ওঁকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে। এটার সন্ধান তিনি কোথায় পেয়েছেন তাও বলেছেন। সে বড় রোমহর্ষক কাহিনী। দেশে ফেরার সময় ক্যারাভানের নয়টা ছেলে মারা যায়, ধারণা করা হয় দূষিত পানি তাদের মৃত্যুর কারণ। একমাত্র প্রফেসরই জীবিত ফেরার সৌভাগ্য লাভ করেন।

তবে আমি আরও অনেকদিন বাঁচতে চাই, ধারাল গলায় বললেন উইলড্যান। এই মমিটাকে অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলতে বলেছিলাম। কারণ এটা অশুভ। এখানে এটাকে যে কাজে আনা হয়েছে তা কখনোই সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। কারণ আমি সেবেকের অভিশাপে বিশ্বাস করি।

আপনারা জানেন, সেবেকের মাত্র চার পুরোহিতের মমির সন্ধান মিলেছে। বাকিদের সন্ধান পাওয়া যায়নি কারণ খুব গোপনে তাদের কবর দেয়া হয়েছে। যারা এই চারটে মমির খোঁজ দিয়েছে তাদের সবার কপালেই জুটেছে নির্মম মৃত্যু। প্যারিংটন নামে একজনকে আমি চিনি। তৃতীয় মমির সন্ধান পেয়েছিল সে। অভিশাপের ব্যাপারটা সত্য কিনা তাই অনুসন্ধান করছিল প্যারিংটন। কিন্তু দেশে ফেরার পরে, রিপোর্ট প্রকাশ করার আগেই মারা যায় সে। তার মৃত্যুও হয়েছিল অদ্ভুতভাবে, লন্ডনের চিড়িয়াখানায়, ব্রিজের রেলিং ফস্কে, নিচে কুমিরের গর্তে পড়ে যায় প্যারিংটন। ওরা যখন তাকে উদ্ধার করে, ছিন্ন ভিন্ন বিকৃত লাশটাকে মানুষ বলে চেনার উপায় ছিল না।

ভ্যানিং তাকাল আমার দিকে। বেশ সিরিয়াস গলায় বলল, শুনলে তো সব কথা। এজন্যই তোমাকে এখানে ডেকে এনেছি আমি। একজন প্রেতশাস্ত্রবিদ এবং পণ্ডিত হিসেবে তোমার নিজস্ব মতামত চাই আমরা। এই মমিটাকে কি সত্যি ফেলে দেব আমরা? তুমি এই অভিশাপের গল্পে বিশ্বাস করো? আমি করি না, তবে অস্বস্তি হয় শুনলে। প্রচুর কাকতালীয় ঘটনার কথা আমি জানি, প্রীনের সত্যবাদিতার প্রতিও আমার অবিশ্বাস নেই। মমিটাকে দিয়ে আমরা কি করব বা করতে চেয়েছি সেটা মুখ্য ব্যাপার নয়। এতে হয়তো এটাকে অপবিত্র করা হবে। চাই না কোন দেবতা আমাদের ওপর গোস্বা করুক। কুমিরমুখো কোন প্রাণী আমার গলা কামড়ে দেবে তাও চাই না। এখন তুমি কি বলো?

আমার হঠাৎ সেই মুখোশধারী লোকটার কথা মনে পড়ে গেল। দেবতা সেবেকের ছদ্মবেশে সে এসেছিল।

লোকটার কথা ভ্যানিংকে জানালাম। কে সে? জিজ্ঞেস করলাম আমি। অসাধারণ ছদ্মবেশ নিয়েছিল সে।

ভ্যানিং-এর মুখ সাদা হয়ে গেল কথাটা শুনে। তার আঁতকে ওঠা দেখে মনে মনে অনুতপ্ত হলাম। এভাবে লোকটাকে ভয় না দেখালেও চলত।

আমি তো দেখিনি! শপথ করে বলেছি অমন কাউকে আমি পার্টিতে দেখিনি। লোকটাকে এক্ষুণি খুঁজে বের করতে হবে।

হয়তো ব্ল্যাকমেইল করতে এসেছিল লোকটা, বললাম আমি। তোমার কাছ থেকে টাকা হাতানোর তালে।

হতে পারে, কেঁপে গেল ভ্যানিং-এর গলা। অন্যদের দিকে ঘুরল সে।

তাড়াতাড়ি, বলল ও। অতিথিদের ঘরে যাও। সবার ওপর নজর বোলাও। ওই লোকটাকে খুঁজে বের করো। ধরে নিয়ে এসো আমার কাছে।

পুলিশ ডাকব? নার্ভাস ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল রয়েস।

আরে বোকা, না। যাও যাও। শিগগির।

তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেল চারজন। বাইরের করিডরে পায়ের আওয়াজ প্রতিধ্বনি হয়ে বাজল কিছুক্ষণ।

একটু নীরবতা। হাসার চেষ্টা করল ভ্যানিং। আমি বিমূঢ় হয়ে পড়লাম। মিশর নিয়ে যে স্বপ্ন আমি দেখি, কল্পনা করি, গল্প লিখি তা কি সব সত্যি? মুখোশধারী ওই লোকটার কথা বারবার ভাবছি কেন আমি? ওই অভিশাপের ব্যাপারটা কি সত্যি? নাকি ভ্যানিং আজগুবী একটা গল্প ফেঁদেছে।

হঠাৎ হালকা একটা শব্দ হলো…

বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে দাঁড়ালাম, দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে সেই মুখোশধারী কুমির-মানব। ওই, ওই যে সে! চেঁচিয়ে উঠলাম। সেই- টেবিলের গায়ে হেলে গেল ভ্যানিং, ছাই হয়ে গেছে মুখ। চৌকাঠের দিকে তাকাল সে, দৃষ্টি ফিরে এল আমার দিকে, উদ্ভ্রান্ত। মৃত্যুর ছায়া দেখলাম ওর চোখে।

কুমিরের মুখোশ পরা ওই লোকটা…আমি ছাড়া আর কেউ ওকে দেখেনি। একি আসলেই মুখোশধারী কেউ নাকি পিশাচদেবতা সেবেক স্বয়ং? তার কবর খোড়ার অপরাধে এসেছে প্রতিশোধ নিতে?

দোরগোড়ায় দাড়ানো মূর্তিটাকে আমার অশুভ এবং ভয়ঙ্কর মনে হলো। স্থির হয়ে আছে। হঠাৎ দড়াম করে শব্দ হতে দেখি কাঁপতে কাঁপতে ভ্যানিং আছাড় খেয়েছে মমির বাক্সটার গায়ে।

তারপর এত দ্রুত ঘটনাগুলো ঘটে গেল যে আমি নড়াচড়াও ভুলে গেলাম। সরীসৃপ আকৃতিটার দেহে বিদ্যুৎ খেলে গেল, ঢেউ খেলে যেন এগিয়ে এল সে। চোখের পলকে দাঁড়িয়ে পড়ল ভ্যানিং-এর দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে থাকা শরীরের সামনে। সাদা আলখেল্লার আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করল কঠিন, পাখির মত বাঁকানো দুটো হাত চেপে ধরল ভ্যানিং-এর দুই কাধ। হাঁ করল মুখোশধারী, খুলে গেল ক্ষুরধার দাঁতের সারি নিয়ে প্রকাণ্ড চোয়াল। নড়ে উঠল। এগোল ভ্যানিং-এর গলা লক্ষ্য করে।

বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলাম আমি বীভৎস দৃশ্যটার দিকে। দানবীয় নাকটা ঠেকে আছে ভ্যানিং-এর ঘাড়ে, কামড় বসাচ্ছে। মাথাটাই শুধু দেখছি আমি ক্যামেরা ক্লোজ-আপের মত।

মাত্র এক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটনাটা ঘটল। সংবিৎ ফিরে পেলাম হঠাৎ। সাদা আলখেল্লার একটা আস্তিন ধরে ফেললাম, অন্য খালি হাতটা দিয়ে চেপে ধরলাম খুনীর মুখোশটা।

খুনেটা ঝড়ের গতিতে ঘুরল, নিচু করল মাথা। পিছলে গেল আমার হাত, এক মুহূর্তের জন্য ছুঁয়ে গেল কুমির-মানবের নাক, রক্তাক্ত চোয়াল।

তারপর, একটা ঝলক যেন দেখলাম আমি ঘূর্ণি উঠল হামলাকারীর শরীরে, চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি ভ্যানিং-এর রক্তাক্ত, ছিন্নভিন্ন শরীরের পাশে দাড়িয়ে চিৎকার শুরু করলাম।

মারা গেছে ভ্যানিং। ওর খুনী অদৃশ্য। দূর থেকে লোকজনের হৈ-হল্লা ভেসে আসছে। আমার এখন দরজা খুলে সাহায্য চাওয়া প্রয়োজন।

কিন্তু পারলাম না। ঘরের মাঝখানে দাড়িয়ে চিক্কার দিতে থাকলাম। আমার দৃষ্টি ক্রমশ অস্পষ্ট হতে শুরু করল। মনে হলো ঘরের সবকিছু বন বন ঘুরতে শুরু করেছে-রক্তমাখা বই; শুকনো মমি, ওটার বুকেও রক্ত লেগে গেছে ধস্তাধস্তির সময়; আর রক্তাক্ত, অসাড় ওই মাংসল জিনিসটা। সব কেমন ঘোলাটে হতে লাগল।

ঠিক তখন, ওই সময় যেন চেতনা ফিরে পেলাম আমি। ঘুরেই দিলাম দৌড়।

এর পরের ঘটনা অস্পষ্টভাবে মনে পড়ছে আমার। মৃত ভ্যানিংকে রেখে চিৎকার করতে করতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি আমি। যেন মুখোশধারী সেই পিশাশদেবতা তাড়া করেছে আমাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই রাস্তায়। কারা যেন আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল।

তার পরদিনই নিউ অরলিন্স ছেড়ে চলে আসি আমি। ভ্যানিং-এর ব্যাপারে কোন খোঁজ-খবরও নিইনি। এমনকি খবরের কাগজও কিনিনি। ফলে জানা সম্ভব হয়নি পুলিশ ভ্যানিং-এর লাশ খুঁজে পেয়েছিল কিনা বা মৃত্যু রহস্য তদন্ত করেছিল কিনা। এ ব্যাপারে জানার কোন আগ্রহও নেই আমার। বলা উচিত, সাহস নেই।

এ ঘটনার কি ব্যাখ্যা দেব আমি? নিজেকে প্রবোধ দিই-মাতাল ছিলাম। আর মাতালরা নেশার ঘোরে কত কিছুই না দেখে। কিন্তু সেই ব্যাপারটিকে কি করে অস্বীকার করব আমি? সেই যে, পিশাচদেবতার মুখটা চেপে ধরেছিলাম আমি এক হাতে, আর ওটা পিছলে গেল।

সেই মুহূর্তে, যখন আমি রক্তাক্ত সরীসৃপটার নাক চেপে ধরেছিলাম, স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিলাম, আমার হাতের নিচে ওটা কোন মুখোশ নয়, জ্যান্ত একটা প্রাণী!

[মূল: রবার্ট ব্লচের দ্য সিক্রেট অভ সেবেক]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *