৪র্থ পর্ব : শহরটা মহামারীর হাতে

চতুর্থ পর্ব

৪.০১

সেপ্টেম্বর আর অক্টোবর মাসে ওরাওঁকে দেখে মনে হলো শহরটা মহামারীর হাতে এক অসহায় শিকার; উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে প্লেগের পায়ের সামনে। প্লেগের দয়া আর করুণাই এখন তার একমাত্র ভারসা। মানুষের কাছে সপ্তাহগুলো মনে হলো অনন্তকালের মত। দক্ষিণ দিক থেকে উড়ে এল ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি; শূন্যে অনেক উঁচুতে উড়তে লাগল নিঃশব্দে, যেন, শহরবাসীদের ছাতের উপর ঘূর্ণায়মান প্লেগের সেই যে বিশাল শস্য মাড়াইয়ের দণ্ডের কথা বলেছিলেন ফাদার প্যানালু, সেই দণ্ডটি এই শহর সম্পর্কে সাবধান করে দিচ্ছে ওদের। অক্টোবরের শুরুতে এক প্রবল বর্ষণের ফলে রাস্তা ঘাট ধুয়ে মুছে ঝকঝক করতে লাগল আবার।

রিও এবং ওর বন্ধুরা এতদিনে এই প্রথম অনুভব করল ভীষণ পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে ওরা। রিও লক্ষ করল সব ব্যাপারে কেমন যেন উদাসীন হয়ে উঠেছে সবাই।

প্লেগের সংক্রমণ যাতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সুস্থ লোকদের আলাদা করে রাখার জন্যে কিছু কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। এ-রকম একটা কেন্দ্র দেখাশোনার ভার দেয়া হয়েছিল র‍্যাঁবেয়া-র ওপর। ও যে হোটেলে থাকে সেটাও এই উদ্দেশ্যে দখল করে নেয়া হয়েছিল।  

দিনরাত কাজ করার পর এতই ক্লান্ত হয়ে পড়ে সবাই, বাসায় ফিরে খবরের কাগজের পাতা ওল্টাবার বা রেডিও শোনার ধৈর্যটুকুও কারও থাকে না। প্লেগ থেকে কেউ কেউ সেরে উঠছে, এ-ধরনের খবর শুনলে ওরা মানুষের সামনে কিছুটা আগ্রহ দেখানোর ভান করে বটে, কিন্তু মনে মনে এক আবেগহীন উদাসীনতার সঙ্গে গ্রহণ করে এইসব সংবাদ।

প্লেগের নানা রকম পরিসংখ্যান রাখার কাজ এখনও করে যাচ্ছে গ্রাঁদ। কিন্তু যে কেউ ওকে দেখলে বুঝতে পারে শরীর আর স্বাস্থ্য আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ছে ওর। এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ভাবপ্রবণ হয়ে উঠেছে ও। রিও-র কাছে জেনিকে নিয়ে নানারকম গল্প করে। জানি না কোথায় আছে ও? খবরের কাগজের পাতা ওল্টাবার সময় আমার কথা কি মনে পড়ে?

রিও একদিন অবাক হয়ে লক্ষ করল, সে নিজেও গ্রাঁদ-এর কাছে ওর স্ত্রী সম্পর্কে গল্প করছে। স্ত্রীর কাছ থেকে যেসব টেলিগ্রাম আসে, সেগুলোকে আদৌও বিশ্বাস করতে পারে না ও। তাই ঠিক করল টেলিগ্রাম পাঠিয়ে স্বাস্থ্যনিবাসে ডাক্তারের কাছ থেকে সত্যিকারের খবরটা নেবে। উত্তরে ওকে জানানো হলো, ওর স্ত্রীর শরীর ইতিমধ্যে বেশ কিছুটা খারাপের দিকে গেছে, তবে তারা সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছে। রিও গ্রাঁদকে বলল ও কাছে থাকলে স্ত্রীকে হয়তো অনেক সাহায্য করতে পারত। কথাগুলো বলেই হঠাৎ গুম মেরে গেল রিও। এরপর গ্রাঁদ অনেক প্রশ্ন করল ওকে, কিন্তু রিও সেগুলোকে এড়িয়ে গেল।

অন্যদের তুলনায় একমাত্র জ তারিউই যা কিছুটা ধাতস্থ ছিল তখনও। ওর এ-সময়কার ডাইরি পড়লে বোঝা যায় এখনও অনেক ব্যাপারে কৌতূহল আছে ওর, কিন্তু আগের মত সব ব্যাপারেই উৎসাহ আর নেই।

সবচেয়ে ক্লান্ত এবং পরিশ্রান্ত মনে হয় ডাক্তার ক্যাসেলকে। একদিন রিও-র কাছে এসে ডাক্তার জানাল, সিরাম তৈরি করে ফেলেছে সে। ঠিক হলো, মঁসিয়ে অথন-এর ছোট ছেলেটার ওপর এই সিরাম প্রথম পরীক্ষা করা হবে। কেননা, ছেলেটার তখন জীবনের কোন আশাই আর নেই।

একদিন মৃত্যুর দৈনিক, পরিসংখ্যান নিয়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎ রিও তাকিয়ে দেখে চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়েছে ক্যাসেল। ওর এই অবস্থা দেখে ভীষণ দুঃখ পেল রিও। ক্যাসেল-এর চেহারায় আগে সবসময় ফুটে থাকত একটা তারুণ্যের আভাস। আর এখন ওর ঘুমন্ত মুখে দুই ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালা।

সারা শহরে তখন একটাই মানুষ আছে, যার ভেতর ক্লান্তি কিংবা হতাশা নেই। সে মানুষটি-কটার্ড। রিও এবং র‍্যাঁবেয়াকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলে ও। কিন্তু কিছুটা জোর করেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে তারিউ-এর সঙ্গে। সুযোগ পেলেই ওর সঙ্গে দেখা করে কটার্ড। তারিউ ওর ব্যাপারটা পুরোপুরি জানে, আর ও বেড়াতে এলে খাতির যত্ন করে। কটার্ডও ওর কাছে গেলে বেশ স্বস্তিবোধ করে। কটার্ড এবং প্লেগের সঙ্গে ওর সম্পর্ক, এই শিরোনামে তারিউ ওর ডাইরিতে কিছু মন্তব্য লিখে রেখেছে।

দেখে মনে হয় স্বাস্থ্য এবং লাবণ্যে ফেটে পড়ছে লোকটা। আচরণের ভেতর বেড়েছে অমায়িক ভাব। সেই সঙ্গে বেড়েছে হাসিঠাট্টা। চারপাশের ঘটনায় এতটুকু বিচলিত হয় না মানুষটা।

মাঝে মাঝে আমাকে বলে, অবস্থা দিনদিন খারাপের দিকে, যাচ্ছে, তাই না? তবে ব্যাপার কী জানেন, আমরা এখন সবাই এক নৌকার যাত্রী।

একটা অদ্ভুত ধারণা মাথায় ঢুকেছে ওর। আমাকে বলে, যে লোক আগে থেকেই কোন কঠিন অসুখে ভুগছে কিংবা খুব মানসিক দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে, তাকে খুব সহজে কোন রোগ কিংবা নতুন দুশ্চিন্তা আক্রমণ করে না।

আপনি কখনও একই সঙ্গে কোন লোককে দুটো কঠিন। অসুখে ভুগতে দেখেছেন? এমন কখনও হয় না। আপনার ক্যান্সার কিংবা রক্তবমি হলে প্লেগ বা টাইফয়েড আপনাকে ছোঁবে না। কোন ক্যান্সার রোগীকে মোটর চাপা পড়ে মরতে দেখেছেন?

অন্যের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে কাউকে একা একা থাকতে বাধ্য করাটাকে কটার্ড ঘৃণা করে। অবরুদ্ধ শহরে অনেক মানুষের সঙ্গে বাস করতে ও প্রস্তুত, কিন্তু জেলের ভেতর নিঃসঙ্গ দিন কাটাতে মোটেও রাজি নয়।

প্লেগ যেদিন থেকে শুরু হলো সেদিন থেকে ওর পিছনে ঘোরা বন্ধ করেছে পুলিস। সত্যি কথা বলতে কি, শহরে এখন পুলিস বলতে আলাদা কোন কিছু নেই। অতীত বা বর্তমান অপরাধ বলেও কিছু নেই। এখানে শুধু একদল অভিশপ্ত মানুষ ভবিষ্যতে কবে মুক্তি পাবে, এ-রকম একটা অনিশ্চিত আশায় বর্তমানের অভিশাপ বুয়ে বেড়াচ্ছে, পুলিসও আছে ওই দলে।

একদিন ও আমাকে বলল, মঁসিয়ে তারিউ, আপনি যা খুশি বলতে পারেন, কিন্তু আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। যদি সত্যি সত্যি চান মানুষ একসঙ্গে বাস করুক, তাহলে তার একটাই মাত্র উপায় আছে। এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন মাঝে মাঝে প্লেগের আবির্ভাব হয়।

এক সন্ধ্যায় কটার্ড এবং তারিউ গেল অপেরা-হাউসে। তখন দেখানো হচ্ছে গ্লাক-এর অরফিয়স। কটার্ডই তারিউকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। সবচেয়ে দামী সীট দুটোতে বসেছে ওরা। একসারি থেকে অন্য সারির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সান্ধ্য পোশাক পরা দর্শকের দল। পরিচিত কেউ বা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা হতেই ওরা অত্যন্ত শোভনভাবে পরস্পরকে সালাম জানাচ্ছে। চারপাশ থেকে আলো এসে ছিটকে পড়ছে ওদের ওপর। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সবার মনে ফিরে এসেছে আত্মবিশ্বাস। অথচ একটু আগেও, ওরা যখন শহরের রাস্তায় হাঁটছিল তখন সবাইকে মনে হচ্ছিল হতাশাগ্রস্ত।

নাটক শেষ হতে উঠে দাঁড়াল দর্শকরা। হল ছেড়ে বাইরে যাবার জন্যে এগিয়ে চলল সবাই। প্রথমে ধীরে ধীরে নীরবে এগুলো, যেন প্রার্থনা শেষে গির্জা ছেড়ে বাইরে যাচ্ছে, কিংবা মৃতব্যক্তিকে শেষ বিদায় জানিয়ে চলে যাচ্ছে তার ঘর থেকে। তারপর দ্রুত হলো চলা। ফিসফিসানি রূপান্তরিত হলো হৈ-চৈ-এ। এরপর শুরু হলো হুড়োহুড়ি। ধাক্কাধাক্কি করে ওরা যখন বাইরে এসে রাস্তায় নামল, তখন সবারই দিশেহারা অবস্থা আশঙ্কায়, উত্তেজনায় তীব্র কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল প্রত্যেকেই।

উঠল কটার্ড এবং তারিউও। কিন্তু মঞ্চের দিকে চোখ পড়তেই হতবাক হয়ে গেল ওরা, দেখল জীবনের সবচেয়ে নাটকীয় দৃশ্য। দেখল, মূকাভিনেতার বেশে প্লেগ দাঁড়িয়ে আছে মঞ্চে; আর লাল কাপড়ে ঢাকা দর্শকদের চেয়ারের ওপর পড়ে আছে সৌখিন খেলনা, হাতপাখা, আর ঝালর লাগানো দামী দামী শাল।

.

৪.০২

রিও-র কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এতদিন টানা কাজ করে গেছে র‍্যাঁবেয়া। সেপ্টেম্বরের শুরুতে একদিন কয়েক ঘণ্টার জন্যে, ছুটি নিল ও। সেদিন দুপুরে গনজালেস এবং সেই দুই যুবকের সঙ্গে হাইস্কুলের মাঠে দেখা করার কথা ওর। ঠিক সময়ে এসে হাজির হলো গনজালেস। ওরা গল্প করতে করতে দেখল যুবক দুজনও হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে ওদের দিকে।

ওরা বলল, গেল সপ্তাহে কোন সুবিধে করতে পারিনি। এ সপ্তাহে আমাদের ডিউটি নেই। আপনাকে আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

র‍্যাঁবেয়া স্বীকার করল, আসলেই এ-ধরনের কাজে ধৈর্যের দরকার।

গনজালেস প্রস্তাব দিল, সামনের সোমবারে আমাদের সবার দেখা হওয়া উচিত। এরপর র‍্যাঁবেয়াকে বলল, আপনার এখন লুই-মার্সেল-এর বাসায় গিয়ে থাকাটাই ভাল। ঠিক আছে, আমরা দুজনে না হয় একটা দিন ঠিক করে নেব। কোন কারণে আমি যদি আসতে না পারি, আপনি সোজা ওদের বাসায় চলে যাবেন। ঠিকানাটা আমি দিয়ে দেব আপনাকে।

যুবকদের একজন গনজালেসকে বলল, আপনি এক্ষুণি আপনার বন্ধুকে নিয়ে আমাদের বাসায় এলে সবচেয়ে ভাল হয়। তাহলে খুব সহজেই আমাদের বাসাটা খুঁজে বের করতে পারবেন। আপনাদের আপত্তি না থাকলে, দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা আমাদের ওখানেই হবে।

গনজালেস রাজি হলো ওদের প্রস্তাবে। চারজনই হাঁটতে লাগল বন্দরের দিকে।

ডকইয়ার্ডের একেবারে শেষে মার্সেল আর লই-এর বাসা। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে এসেছে যে রাস্তাটা তার সামনেই একটা ফটক। আর এর সামান্য দূরে বাসাটা। ছোট। স্পেনে যেমন ছোট ছোট বাড়ি দেখা যায় তেমনি। জানালার শার্সিগুলোয় উজ্জ্বল রঙের পলিশ। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার, আসবাবপত্র নেই। লুই আর মার্সেল-এর মা, হাসিখুশি চেহারার এক বৃদ্ধা স্প্যানিশ মহিলা, খাবার এনে রাখল ওদের সামনে। তাঁর মুখের চারপাশে বয়সের ভঁজ। খাবারের বেশির ভাগই ভাত। ভাত দেখে বিস্মিত হলো গনজালেস, কেননা কিছুদিন থেকে শহরে চাল পাওয়াটা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

র‍্যাঁবেয়া খন ভাবছে সামনের সপ্তাহটার কথা। পরে, ওরা বলল ওকে দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে।

সেই দুই সপ্তাহ চোখকান বন্ধ করে উদয়াস্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেল র‍্যাঁবেয়া। বিছানায় গেল অনেক রাতে। কোন কোন রাতে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ল। এক রাতে, বার থেকে বেরিয়ে র‍্যাঁবেয়ার মনে হলো ওর পুরষাঙ্গটা কেমন যেন ফোলা ফোলা লাগছে। হাত নাড়ার সময় বগলে অনুভব করল ব্যথা। এবার তাহলে আমার পালা, ভাবল ও। মন বলল, এক্ষুণি পালাতে হবে। ছুটে শহরের বাইরে যাব। সেখানে দাঁড়াব একটা পার্কে। সেখান থেকে সমুদ্র চোখে না পড়ক, আকাশটাকে তো অনেক বড় করে দেখা যাবে। তারপর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করব প্রেমিকার নাম ধরে। যেন আমার গলার স্বর শহরের দেয়াল পেরিয়ে বাইরে গিয়ে পৌঁছায়, র‍্যাঁবেয়ার তখন এরকমই ইচ্ছে হলো। কিন্তু বাসায় ফিরে দেখল প্লেগের কোন লক্ষণই নেই ওর শরীরে। সত্যিই মাতাল হয়ে গেছিলাম, রিও-র কাছে পরে স্বীকার করল ও।

এক রাতে রিও-র কাছে বিদায় নিতে গেল র‍্যাঁবেয়া। রিও বলল, আজ সকালে মঁসিয়ে, অথন আপনার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। বললেন, আমি আপনাকে চিনি কিনা? আমি বললাম, চিনি। তিনি তখন বললেন, আমি যদি সত্যিই আপনার বন্ধু হয়ে থাকি তাহলে যেন আপনাকে সাবধান করে দিই, চোরাচালানকারীদের সাথে অত মেলামেশা না করতে।

কি বলতে চান উনি?

আমার মনে হয়, পালাবার কাজটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হবে আপনাকে।

অনেক ধন্যবাদ, রিও-র হাত ধরে ঝাঁকুনি দিল র‍্যাঁবেয়া।, দরজায় পৌঁছে ঘুরে দাঁড়াল ও। রিও দেখল, প্লেগ দেখা দেয়ার পর থেকে আজ এই প্রথম প্রাণ খুলে হাসছে র‍্যাঁবেয়া।

কিন্তু আপনি আমার যাওয়াটা বন্ধ করছেন না কেন, বলুন তো? সেটা তো সহজেই করতে পারেন।

স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মাথা নাড়াল রিও। তারপর হেসে বলল, আমি নিজেও হয়তো ব্যক্তিগত সুখের কথাটাই চিন্তা করতে শুরু করেছি।

রবিবারে র‍্যাঁবেয়া উঠল মার্সেল এবং লুইদের ছোট্ট বাসায় গিয়ে। ওকে থাকতে দেয়া হলো বসার ঘরে। দুই পাহারাদার সাবধান করে দিল, ও যেন বাইরে বেশি ঘোরাফেরা না করে। দুপুর বেলা ওরা কেউ খেতে এল না। বেশির ভাগ সময় ওকে কাটাতে হলো একাকী। মাঝেমাঝে দেখা হলো ওদের মা-র সঙ্গে। ভদ্রমহিলা কথা একটু কম বলেন। একবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ফিরে যাবার পর তোমার প্রেমিকার শরীরে প্লেগের জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে, এটা ভেবে তোমার ভয় হয় না?

ওরকম বিপদের সম্ভাবনা খুব কম। আর, অন্যদিকে আমি যদি এখানে থেকে যাই, ভবিষ্যতে আমাদের মধ্যে আর দেখা হওয়ার কোন আশাই থাকবে না।

বৃদ্ধা একটু হাসলেন। তোমার প্রেমিকা তোমাকে ভালবাসে?

খুব।

সুন্দরী?

আমার চোখে।

বুঝলাম, মাথা ঝাঁকালেন বৃদ্ধা। সেইজন্যেই তুমি ফিরে যেতে চাইছ।

প্রতিদিন সকালে গির্জায় যাওয়া বৃদ্ধার অভ্যাস। একদিন ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো?

না।

বুঝলাম, মন্তব্য করলেন তিনি, তোমার ফিরে যাওয়াই উচিত। জীবনে তোমার পাবার মত কিছু তো আর নেই।

সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরল মার্সেল আর লুই। র‍্যাঁবেয়াকে উৎসাহিত করবার মত কিছু বলতে পারল না ওরা। কেবল এটুকু বলল, পালাবার উপযুক্ত সময় এখনও আসেনি। রাতে, খাবার পর, কিছুক্ষণ গিটার বাজাল মার্সেল। এরপর ওরা তিনজনে মদ খেতে লাগল একসঙ্গে। পুরো সময়টাই আপন চিন্তায় ডুবে রইল র‍্যাঁবেয়া।

বুধবারে, বাসায় ফিরে মার্সেল বলল, কাল রাতে আপনাকে তৈরি থাকতে হবে। বেরুতে হবে মাঝরাতে। একটু এদিক-ওদিক করলে চলবে না। আমাদের সঙ্গে যে দুজন পাহারা দেয়, তাদের একজনকে প্লেগ ধরেছে। অন্যজনকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। ফটক পাহারার সম্পূর্ণ ভার এখন আমাদের ওপর। কী কী করতে হবে সেগুলো কাল রাতেই জানাব।

নিশ্চয় খুশি হয়েছ, ব্লারেয়াকে বললেন বৃদ্ধা।

পরের দিন সকাল থেকেই অসহ্য গরম পড়তে শুরু করল। আবহাওয়া কেমন ভ্যাপসা। একটা ঘোমটার আড়ালে সারাক্ষণ মুখ ঢেকে রইল সূর্য। মৃত্যুর হারও সেদিন বেড়ে গেল অসম্ভব রকম।

মার্সেল আর লুই-এর দেখাদেখি র‍্যাঁবেয়াও তার জামাকাপড় খুলে ফেলল। তবু ওর বুক আর কাঁধের দুপাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল ঘাম। পালিশ করা মেহগনি কাঠের মত চকচকে হয়ে উঠল ওদের সবার শরীর। খাঁচায় বন্দী হিংস্র প্রাণীর মত সারা ঘরে পায়চারি করে বেড়াল র‍্যাঁবেয়া।

বিকেল চারটায় ও বলল, আমি একটু বাইরে যাব।

মনে রাখবেন, বলল মার্সেল, ঠিক রাত বারোটার সময় আপনাকে হাজির থাকতে হবে।

র‍্যাঁবেয়া সোজা গেল রিও-র ফ্ল্যাটে। ওর মা বলল, শহরতলির হাসপাতালে ওকে পাওয়া যাবে।

হাসপাতালের ফটকের সামনে বেশ কিছু মানুষ, ঘোরাফেরা করছিল। কিন্তু কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল না ভেতরে। তবু সবাই দাঁড়িয়ে আছে রোদ এবং গরমের মধ্যে। পুলিস সার্জেন্টকে র‍্যাঁবেয়া ওর প্রবেশপত্র দেখাল। সে ওকে তারিউ-এর অফিসে যেতে বলল।

এখনও যাননি? ওকে দেখে বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল অরিউ।

না। রিও-র সঙ্গে একটু কথা বলব।

ও এখন ওয়ার্ডে। কিন্তু দেখা না করলেই কী নয়; অন্য কাউকে দিয়ে আপনার কাজ হবে না?

কেন বলুন তো?

ও ভীষণ ক্লান্ত। একটু বিশ্রাম দিতে চাই।

তরিউ-এর দিকে তাকিয়ে রইল র‍্যাঁবেয়া। আগের চেয়ে অনেক রোগা হয়ে গেছে। চোখে, শরীরে সবখানে ক্লান্তির ছাপ। ঝুলে পড়েছে চওড়া কাঁধ। দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকল ওয়ার্ডবয়। টেবিলের ওপর কয়েকটা ছোট কার্ড রেখে বলল, ছটি। বলেই বেরিয়ে গেল।

কার্ডগুলো টেবিলে বিছিয়ে তারিউ বলল, সুন্দর কার্ড, তাই না? অথচ এগুলোই হচ্ছে মৃত্যু।, গতরাতে কজন মারা গেছে তার হিসেব আছে এখানে।

কার্ড এবং টেবিলের ওপর ছাড়ানো অন্যান্য জিনিসপত্র গুছিয়ে উঠে দাঁড়াল তারিউ। খুব তাড়াতাড়িই আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, না?

হ্যাঁ। আজ রাত বারোটায়।

খুব ভাল লাগছে। শুধু নিজের দিকে একটু খেয়াল রাখবেন।

সত্যি বলছেন?

আমার যা বয়েস তাতে মিথ্যা বলার অনেক ঝামেলা।

তারিউ, মাফ চাইছি। কিন্তু রিও-র সঙ্গে একবার দেখা হওয়া দরকার।

জানি, রি-ওর মানবতাবোধ আমার চেয়ে অনেক বেশি। আচ্ছা, চলুন।

আমি কিন্তু সেরকম…, কথা শেষ করতে পারল না র‍্যাঁবেয়া।

তারিউ ওর দিকে তাকাল। আস্তে আস্তে ওর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল হাসিতে। 

একটা সরু বারান্দা ধরে এগিয়ে চলল ওরা। দুপাশে হালকা সবুজ রঙের দেয়াল। একবারে শেষে, কাঁচের দরজা। ওপারে, ঘরের ভেতর নড়াচড়া করছে লোকজন। ওখানে যাবার আগে পাশের একটা ছোট কামরায় র‍্যাঁবেয়াকে নিয়ে ঢুকল তারিউ। আলমারি খুলে জীবাণুনাশক ঔষধ ভর্তি একটা পাত্র থেকে কাপড়ে জড়ানো দুটো তুলোর মুখোশ বের করল ও। একটা পরতে দিল র‍্যাঁবেয়াকে।

এরপর কাঁচের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল ওরা। বিরাট ঘর। সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ। মাথার ওপর ঘুরছে পাখা। উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বদ্ধ বাতাস। দুপাশে বিছানার সারি। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে যন্ত্রণাকাতর চিৎকার। কোনটা তীক্ষ্ণ, কোনটা চাপা; মনে হচ্ছে একঘেয়ে সুরে স্তোত্র পাঠ চলছে। নীরবে এক বিছানা থেকে আর এক বিছানায় রোগী দেখে বেড়াচ্ছে সাদা অ্যাপ্রন পরা। লোকজন।

সামনে একটা বিছানায় ঝুঁকে আছে রিও। যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে একটি মানুষ। ওর দুই পা টেনে ফাঁক করে ধরে রেখেছে দুজন নার্স। রোগীর কুচকি ছুরি দিয়ে চিরে দিচ্ছে রিও। মাথা তুলল ও। একজন সাহায্যকারী একটা ট্রে এগিয়ে ধরতেই হাতের যন্ত্রপাতিগুলো রাখল ওটায়। ব্যান্ডেজ করে দেয়া হলো রোগীকে।

কোন খবর? তারিউকে জিজ্ঞেস করল রিও।

ফাদার প্যানালু কোয়ারেনটাইন স্টেশনে র‍্যাঁবেয়ার জায়গায় কাজ করতে রাজি হয়েছেন। ডাক্তার ক্যাসেল বেশকিছু টিকা তৈরি করেছেন, টিকাগুলো পরীক্ষা করে দেখা দরকার।

সুসংবাদ।

আর র‍্যাঁবেয়া এসেছেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে। ..

ঘুরে দাঁড়াল রিও। আপনি এখানে কেন? আপনার তো অন্য কোথাও থাকার কথা।

আজ মাঝ রাতেই ও চলে যাচ্ছে, বলল তারিউ।

আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে, বলল র‍্যাঁবেয়া।

আচ্ছা। এক্ষুণি আসছি। আপনি তারিউ-এর অফিসে অপেক্ষা করুন।

কয়েক মিনিট পর। গাড়ির পিছনের সীটে বসে আছে রিও, এবং র‍্যাঁবেয়া। স্টিয়ারিংয়ে তারিউ।

ডাক্তার, আমার হয়তো আর যাওয়া হলো না। আপনাদের সঙ্গেই থেকে গেলাম, বলল র‍্যাঁবেয়া।

কোন নড়াচড়া করল না তারিউ। অখণ্ড মনোযোগে গাড়ি চালাতে লাগল।

কিন্তু আপনার প্রেমিকা, তার কী হবে? অস্ফুট স্বরে প্রশ্ন করল। রিও।

এই মুহূর্তে পালিয়ে গেলে ব্যাপারটা আমার জন্যে খুব লজ্জার হবে। আমাদের সম্পর্কও নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

এ-রকম চিন্তা করা ঠিক নয়। কেউ যদি নিজের সুখকেই জীবনের প্রধান জিনিস বলে মনে করে তাতে লজ্জা পাবার কিছু নেই।

তা ঠিক। কিন্তু শুধু নিজেকে নিয়েই সুখী হওয়া, কেবল নিজের সুখের কথাটাই চিন্তা করা সেটা নিশ্চয় লজ্জার।

এবার কথা বলল তারিউ। র‍্যাঁবেয়া যদি সত্যিই অন্যের দুঃখ দুর্দশায় পাশে এসে দাঁড়ায়, তাহলে খুব তাড়াতাড়ি দেখতে পাবে নিজের সুখভোগের আর কোন অবকাশ নেই ওর।

ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। এতদিন আমি নিজেকে এই শহরে একজন বহিরাগত মনে করতাম। কিন্তু এই কদিনে উপলব্ধি করেছি আমি চাই বা না চাই, আমি এখানকারই একজন।

কেউ কোন কথা বলল না। সেদিন মাঝরাতে র‍্যাঁবেয়ার হাতে একটা ম্যাপ দিল রিও। পাশে দাঁড়িয়ে আছে তারিউ। শহরে যে অঞ্চলের ভার দেয়া হয়েছে র‍্যাঁবেয়াকে, ম্যাপটা সেখানকার।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তারিউ প্রশ্ন করল, আপনার সিদ্ধান্তের কথা ওদের জানিয়েছেন?

একটা চিরকুট পাঠিয়েছি। মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল র‍্যাঁবেয়া।

.

৪.০৩

ডাক্তার ক্যাসেল-এর তৈরি প্লেগের টিকা অক্টোবরের শেষে প্রথম। ব্যবহার করা হলো। এটাই এখন রিও-র শেষ অস্ত্র। ও জানে, এতে কাজ না হলে মহামারীর করুণার ওপর ছেড়ে দিতে হবে গোটা শহরটাকে।

 যেদিন ক্যাসেল রিও-র সঙ্গে দেখা করল ঠিক তার আগের দিন মঁসিয়ে অথন-এর ছোট ছেলেটা প্লেগের খপ্পরে পড়ল। রিও ঘরে ঢুকে দেখল বাবা-মা দুজনেই ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। ছেলেটার তখন চরম অবস্থা। কোন দিকে তাকানোর বা অনুভব করার মত কোন শক্তি তখন ওর নেই। নিজের ইচ্ছেমত ওর শরীর পরীক্ষা করল রিও। কোন বাধা দিল না ছেলেটা। মাথা তুলে রিও দেখে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন মঁসিয়ে অথন। তার পিছনে মাদাম অথন, চেহারা রক্তশূন্য, মুখ চেপে ধরেছেন একটা রুমাল দিয়ে।

মনে হচ্ছে প্লেগে ধরেছে, আস্তে কথাগুলো বললেন মঁসিয়ে অথন। এত আস্তে যে শোনাই যায় না প্রায়।

হ্যাঁ। তাই মনে হচ্ছে, বলে ছেলেটার দিকে আবার তাকাল রিও। বিস্ফারিত হলো মাদাম অথন-এর চোখ দুটো। কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোল না।

ডাক্তার আইন অনুযায়ী যা করার তা তো করতেই হবে, আগের চেয়েও ক্ষীণ স্বরে বললেন মঁসিয়ে অথন।

মাদামের দৃষ্টি এড়ানোর চেষ্টা করল রিও হ্যাঁ। যা করার এক্ষুণি করছি। আপনার টেলিফোনটা ব্যবহার করতে চাই। যাবার আগে রিও মাদামকে বলল, দুঃখিত। আপনাকেও যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে নিতে হবে।

আতঙ্কে কুঁকড়ে গেলেন মাদাম অথন। মেঝের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাতে আঁকাতে বললেন, হ্যাঁ, বুঝেছি। এক্ষুণি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।

বিদায় নেয়ার আগে ভাবাবেগের বশে ওদের কাছে জানতে চাইল রিও, ব্যক্তিগতভাবে আমার কোন সাহায্যের দরকার আছে। আপনাদের?

না, ঢোক গিললেন ম্যাজিস্ট্রেট অথন। তবে আমার ছেলেটাকে একটু দেখবেন।

মাদাম অথনকে পাঠানো হলো র‍্যাঁবেয়া যে কোয়ারাইনটা দেখাশোনা করে সেটায়। মিউনিসিপ্যাল স্পোর্টস গ্রাউন্ডের ক্যাম্পে পাঠানো হলো মঁসিয়ে অথনকে। ছেলেটাকে রাখা হলো অস্থায়ী হাসপাতালের ওয়ার্ডে। বিশ ঘণ্টা পর রিও পরিষ্কার বুঝতে পারল ওকে আর বাঁচানো যাবে না। সংক্রমণ খুব দ্রুত ওর শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে, অথচ ছেলেটার কোন প্রতিরোধ শক্তি নেই। সম্পূর্ণ ফুটে বেরুতে পারেনি, অথচ কঠিন যন্ত্রণাদায়ক, ছোট ছোট গুটিগুলো ওর অপুষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঞ্চালন বন্ধ করে ফেলছে।  

রাতে খাওয়ার পর, ও আর ক্যাসেল ছেলেটার শরীরে টিকা দেয়া আরম্ভ করল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। সকালে আবার ওরা এল ছেলেটার পাশে।

আশ্চর্য। ওর হাত-পা নড়ছে। বিছানার ওপর এপাশ-ওপাশ করছে ছেলেটা। এসময় ওখানে ছিল ওরা তিনজন-রিও, ক্যাসেল, আর তারিউ। রাতের অন্ধকার কাটিয়ে দিনের আলোে ফুটতে লাগল। একে একে অন্যারাও এল ওখানে। প্রথমে এলেন ফাদার প্যানালু। গ্রাঁদ এল বেলা সাতটায়।

ছেলেটার চোখ তখন সম্পূর্ণ বন্ধ। দাঁতে দাঁত লেগে আছে। যন্ত্রণায় মুখ এমন ভাবে খিচাচ্ছে যে মনে হচ্ছে ভেংচি কাটছে। বালিশের ওপর মাথাটাকে বারে বারে এপাশে ওপাশে নাড়াচ্ছে ছেলেটা।

র‍্যাঁবেয়া যখন ঘরে ঢুকল তখন অন্ধকার কেটে গেছে। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার পকেটে ওটা ঢুকিয়ে রাখল ও।

বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে যন্ত্রণাকাতর ছেলেটাকে দেখছিল রিও। হঠাৎ শক্ত হয়ে উঠল রোগীর কচি শরীর। বেঁকে গেল কোমর। হাত-পা ছড়িয়ে পড়ল ইংরেজি এক্স-এর মত। সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় কম্বলের নিচে শুয়ে আছে ছেলেটা। শরীর থেকে ভেসে আসছে ঘাম আর উলের গন্ধ। দাঁতে দাঁত বসে গেল ওর। এরপর আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে এল শরীর। হাত-পা গুটিয়ে নিল। মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। চোখ বন্ধ। হঠাৎ জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল, ও।

তারিউ-এর দিকে তাকাল, রিও। চোখ নামিয়ে নিল তারিউ। গত মাসে অসংখ্য শিশুকে মরতে দেখেছে ওরা; মৃত্যু কাউকেই এতটুকু দয়া দেখায়নি, কিন্তু এভাবে পলে পলে কোন ছেলের মৃতু যন্ত্রণা লক্ষ করেনি।

ঠিক সেই সময় কুঁকড়ে উঠল ছেলেটার শরীর। মনে হলো, পেটে কিছু কামড়াচ্ছে। চিৎকার করে কাঁদতে লাগল ও। অনেকক্ষণ ধরে কুঁকড়ে পড়ে রইল। এরপর খিচুনিতে থরথর করে কাঁপতে লাগল সমস্ত শরীর।

তারপর আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে গেল জ্বরের দমকা বেগ। ধীরে ধীরে উত্তাপও নেমে গেল শরীর থেকে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার সুযোগ পেল ও। অতি কষ্টে শ্বাস নিতে লাগল।

যখন তৃতীয়বারের মত, এল উত্তাপের ঝাঁপটা, বিছনা থেকে শরীরটাকে উঁচুতে তুলে, হাত-পা গুটিয়ে ফেলল ছেলেটা, বিছানার ধারে গড়িয়ে পড়ল দেহ, মাথাটা বালিশের ওপর কয়েকবার এপাশ ওপাশ করার পর শরীর থেকে ফেলে দিল কম্বল, চোখের উত্তপ্ত মণি। দুটো ফেটে গড়িয়ে পড়ল পানি। ঘাম আর অশ্রুভেজা ছোট্ট মুখটার দুপাশে হাত বুলাতে লাগল তারিউ। ওয়ার্ডের বাকি নজন রোগীও তখন বালিশের ওপর মাথা নাড়ছে আর নিচু স্বরে গোঙাচ্ছে।

ঘর থেকে বেরিয়ে গেল গ্রাঁদ। ছেলেটার চোখ দুটি তখনও বন্ধ। কিন্তু শরীর আগের চেয়ে অনেক শান্ত। ছোট ছোট আঙুল দিয়ে খাটের কিনার ধরার চেষ্টা করল ও। এরপর হাঁটু চুলকাল। তারপর হঠাৎ করে পা গুটিয়ে ঊরু দুটো রাখল পেটের ওপর। সেই ভাবেই স্থির হয়ে থাকল কিছুক্ষশ, এবং এই প্রথম চোখ খুলল।

সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল রিও। ছেলেটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। ছোট্ট মুখটা ভাবলেশহীন, যেন মাটির ধূসর মুখোশ পরে আছে। ধীরে ধীরে ওর ঠোঁট একটু ফাঁক হলো, তারপর থেকে সেই। ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল টানা চিৎকার। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল রিও-র। তারিউ বাইরে তাকাল চোখ ফিরিয়ে। র‍্যাঁবেয়া এগিয়ে এসে দাঁড়াল ক্যাসেল-এর পাশে। ফাদার প্যানালু ছেলেটার কচি মুখখানার দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলেন। মুখের চারপাশে ময়লা জমেছে। হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা শুরু করলেন তিনি, ঈশ্বর। এই ছোট শিশুটিকে তুমি রক্ষা করো…

ছেলেটা তেমনি চিৎকার করে চলল। ওয়ার্ডের অন্যান্য রোগীরাও অধৈর্য হয়ে উঠল এবার। তারাও শুরু করল আর্তনাদ। সমস্ত ওয়ার্ডে ঝড় বইতে লাগল আর্তনাদের।

ওই আর্তনাদে ঢাকা পড়ে গেল ফাদার প্যানালু-র প্রার্থনা। তখনও খাটের পাশে দাঁড়িয়ে রিও। অবসাদে, বিরক্তিতে ওর চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। এক সময় চোখ খুলে দেখে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তারিউ। আর নয়, বাইরে যেতে চাই। এ দৃশ্য সহ্য করা যায় না, বলল রিও।

ঠিক এ-সময়ে ওয়ার্ডে থেমে গেল আর্তনাদ। রিও দেখল, ছেলেটার কাতরানিও ক্ষীণ হতে হতে স্তব্ধ হয়ে গেছে। পাশে এসে দাঁড়াল ক্যাসেল। বলল, সব শেষ। তখনও ছেলেটার মুখ খোলা আছে। ফাদার প্যানালুও পাশে এলেন; তারপর চলে গেলেন।

তারিউ ক্যাসেলকে বলল, আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হবে আপনাকে, তাই না?

ঠোঁটের ফাঁকে বাঁকা এক টুকরো হাসি ফুটল ক্যাসেল-এর। মাথাটা ঝকাল কিছুক্ষণ। হ্যাঁ। তাই তো দেখছি। তবে টিকা নেয়ার ফলে দীর্ঘ সময় ধরে রোগের সাথে যুদ্ধ করার শক্তি পেয়েছিল ছেলেটা।

ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল রিও। দরজায় ফাদার প্যানালু-র সামনে পড়ে গেল। ওর চাহনি আর চলার গতি লক্ষ করে হাত বাড়িয়ে ওকে থামাতে গেলেন ফাদার। আসুন, ডাক্তার সাহেব… ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে পাদ্রির দিকে ঘুরে দাঁড়াল রিও। বলুন। কী বলার আছে আপনার? এই বাচ্চা ছেলেটা নিশ্চয় কোন পাপ করেনি। বলতে পারেন কী অপরাধ ছিল ওর?

ফাদারকে ঠেলে সরিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুত বেরিয়ে গেল রিও। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছল ছেলেদের খেলার মাঠের অপর পাশে। ছোট ছোট ডুমুর গাছের তলায় অনেকগুলো কাঠের বেঞ্চ রয়েছে ওখানে। দরদর করে ঘাম ঝরছে ওর শরীর থেকে। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে অবসাদে। বেঞ্চে বসে চোখ-মুখের ঘাম মুছল রিও।

ডুমুর গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে আগুনের ফোয়ারার মত নেমে আসছে রোদ। চারপাশ কেমন গুমোট একটা ভাব। অবসন্ন শরীরটাকে বেঞ্চে এলিয়ে দিল ও। পাতার ফাঁকে দেখল রোদে পোড়া দূরের আকাশ। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে এল ওর শ্বাস প্রশ্বাস।

পিছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেল ও। হঠাৎ এত রাগ করলেন কেন? যে দৃশ্য আপনার কাছে অসহ্য, সেটা আমার কাছেও অসহ্য।

 ফাদার প্যানালু-র দিকে চোখ ফেরাল রিও। আমার তখনকার ব্যবহারের জন্যে আমি দুঃখিত। সবকিছুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার একটা দুর্বার ইচ্ছা মাঝে মাঝে পেয়ে বসে আমাকে।

সেটা আমি বুঝি। কিন্তু যা বুদ্ধি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা যায়, না তাকে আমাদের ভালবাসার চেষ্টা করা উচিত।

ধীরে ধীরে সোজা হয়ে বসল রিও। অবসাদ কাটিয়ে বলল, আপনার কথা মেনে নিতে পারলাম না। যেখানে নিষ্পাপ শিশুদের কষ্টের শিকার হতে হয় সেখানে ভালবাসার প্রশ্ন ওঠে না।

ঈশ্বরের করুণা যে কী জিনিস এই মুহূর্তে আমি তা উপলব্ধি করেছি।

করুণা জিনিসটা যে কী তা জানার সৌভাগ্য আমার আজও হয়নি। তবে এগুলো নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভাল। আমরা এখন। একটা কিছুর জন্যে পাশাপাশি কাজ করছি। এ-কাজ ঈশ্বরের নিন্দা বা প্রার্থনার অনেক ঊর্ধ্বে।

আপনিও মানুষের আত্মার কল্যাণের জন্যে, মুক্তির জন্যে কাজ করছেন।

না। মানুষের দেহকে কীভাবে সুস্থ রাখা যায় আমার মাথাব্যথা সেটা নিয়েই।

আচ্ছা। তাহলে উঠি। পানিতে ছলছল করে উঠল ফাদারের চোখ।

দেখুন, আমার ব্যবহারের জন্যে আমি দুঃখিত। ক্ষমা করে দেবেন। এ-ধরনের ব্যবহার আর কখনও করব না।

তাতে কী। আপনার ভেতর বিশ্বাস তো জন্মাতে পারিনি এখনও।

তাতে কী আসে যায়? ফাদারের হাত ধরে রিও বলল, আসলে আমি মনে-প্রাণে ঘৃণা করি মৃত্যু, ব্যাধি এগুলোকে। আমরা এর বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করছি। এ-কাজে কেউ আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না-স্বয়ং ঈশ্বরও নন।

.

৪.০৪

রিও এবং ওর সহকর্মীদের সঙ্গে কাজে যোগ দেয়ার পর থেকে ফাদার প্যানালু-র বেশির ভাগ সময় কাটে হাসপাতালে হাসপাতালে, আর নয়তো এমন সব জায়গায়, যেখানে তাঁকে প্লেগের রোগীদের সংস্পর্শে আসতে হয়। এর ফলে ঘন ঘন মৃত্যুর দেখা পাচ্ছেন তিনি। আর তাই প্রায়ই তার মনে হয় হয়তো যে কোন মুহূর্তে তাকেও এই রোগের শিকার হতে হবে, এবং মৃত্যু সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনাও শুরু করেছেন তিনি। অবশ্য তার মানসিক প্রশান্তিতে যে ফাটল ধরেছে, এটা বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় না। কিন্তু যেদিন চোখের সামনে মঁসিয়ে অথন-এর ছোট্ট ছেলেটাকে মারা যেতে দেখলেন, সেদিন থেকে তাঁর ভেতর একটি পরিবর্তনের জোয়ার আরম্ভ হলো। তাঁর চোখেমুখে ফুটে উঠল দুর্ভাবনা আর উদ্বেগের চিহ্ন।

একদিন রিওকে ফাদার বললেন, ডাক্তারদের কাছ থেকে পরামর্শ নেয়া কি একজন ধর্মযাজকের উচিত? এই শিরোনামে আমি একটা ছোট নিবন্ধ লিখছি। খুব তাড়াতাড়ি একটা ধর্মীয়সভা ডেকে বক্তৃতা দেব। আশা করি আপনিও আসবেন।

ফাদার প্যানালু-র দ্বিতীয় ধর্মীয়সভায় আগের চেয়ে অনেক কম .. মানুষ এল তাঁর বক্তৃতা শুনতে। আগের বারের তুলনায় তিনভাগের একভাগ মানুষ এল সেদিন। কেননা ইতিমধ্যে ধর্মের প্রতি শহরবাসীদের আকর্ষণ অনেক কমে এসেছে; তারা সাধারণ ধর্মীয় আচর-আচরণের বদলে ঝুঁকে পড়েছে উদ্ভট কুসংস্কারের দিকে।

আগের বারের তুলনায় অনেক শান্ত গলায়, অনেক ভেবেচিন্তে বক্তৃতা আরম্ভ করলেন ফাদার। কয়েকবার আটকে গেল কথা। এবার আর আপনারা না বলে আমরা বলে সম্বোধন করলেন তিনি।

বললেন, হয় স্রষ্টাকে ঘৃণা করতে হবে, আর নইলে তাকে ভালবাসতে হবে। কিন্তু ঘৃণা করার সাহস আমাদের কারও আছে কী? আরও বললেন, ডাক্তারের কাছ থেকে ধর্মযাজকদের সাহায্য গ্রহণ করা উচিত নয়।

এই বক্তৃতার কয়েকদিন পরেই ফাদার প্যানালুকে গির্জায় তাঁর থাকার ঘরটা ছেড়ে দিতে হলো। প্লেগের জন্যে তখন অনেক বাসস্থানই জবরদখল করা হয়েছে। ফাদারকে থাকতে দেয়া হলো ধার্মিক এক বৃদ্ধামহিলার বাসায়।

এখানে আসার পর থেকেই দুর্বল বোধ করতে শুরু করলেন তিনি। দৈহিক এবং মানসিক, দুদিক থেকেই। এক সন্ধ্যায়, সেন্ট। ওডালিয়ার ভবিষ্যদ্বাণীর গুণাগুণ নিয়ে খুব উৎসাহের সঙ্গে, আলোচনা করছিলেন ভদ্রমহিলা, সে-সময় ফাদার কিছুটা অধৈর্যের ভাব দেখালেন। এতে ভদ্রমহিলা তার ওপর কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়ে পড়লেন।

এরপর থেকে প্রতি সন্ধ্যায় নিজের শোবার ঘরে যাওয়ার সময় ফাদার দেখতে পান ড্রয়িংরুমের চেয়ারে তাঁর দিকে পিছন ফিরে বসে আছেন ভদ্রমহিলা। এবং নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে মহিলা বললেন, আপনার জন্যে শুভরাত্রি কামনা করি, ফাদার।

এক সন্ধ্যায় ফাদার তার হাতের কবজি, বগল, এবং কপালে প্রচণ্ড তাপ অনুভব করলেন। পরের দিন সকালে ভদ্রমহিলা দেখলেন, ফাদার তাঁর ঘর থেকে বেরুচ্ছেন না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর কিছুটা ইতস্তত করে দরজায় টোকা দিলেন তিনি। ভেতরে ঢুকে দেখলেন, তখনও বিছানায় শুয়ে আছেন ফাদার। শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে, এবং ভীষণ উত্তেজিত মনে হচ্ছে তাঁকে। ভদ্রমহিলা খুব বিনীতভাবে ফাদারকে বললেন, একজন ডাক্তারকে আসতে বলি। কিন্তু তার প্রস্তাব বাতিল করে দিলেন তিনি। ফাদারের এই আচরণ ভদ্রমহিলার কাছে অভদ্রতা বলে মনে হলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘর ছেড়ে চলে এলেন তিনি। বেলা একটু বাড়লে ফাদার বাসার পরিচারিকাকে দিয়ে ভদ্রমহিলাকে ডেকে আনলেন। তাঁর অশোভন আচরণের জন্যে ভদ্রমহিলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন, তিনি বললেন, সত্যি, আমাকে প্লেগ ধরেনি। সে-রকম কোন লক্ষণই আমার শরীরে নেই। ভদ্রমহিলা বললেন, প্লেগের ভয়ে আমি ডাক্তার ডাকতে চাইনি। নিজেকে নিয়ে আমার কোন ভয় নেই। কিন্তু আপনি যতক্ষণ আমার বাসায় আছেন ততক্ষণ আপনার ভালমন্দ দেখা আমার কর্তব্য। ফাদার, এতে কোন সাড়া দিলেন না। ভদ্রমহিলা তখন তার কাছে ডাক্তার ডেকে পাঠানোর অনুমতি চাইলেন। ফাদার প্রথমে তাকে বেশি উদ্বিগ্ন হতে বারণ করলেন, পরে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে আরম্ভ করলেন। ভদ্রমহিলা এ থেকে যতটুকু বুঝলেন তাতে তার মনে হলো ডাক্তার দেখানো ফাদার ধর্মীয় নীতি বিরোধী কাজ বলে মনে করেন। তিনি অনুমান করলেন জ্বরের কারণে ফাদারের মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে। তিনি তাঁকে এক কাপ চা এনে দিলেন।

তারপর প্রতি দুঘণ্টা পর পর ফাদার প্যানালুকে দেখে আসতে লাগলেন মহিলা। সারাটা দিন একটা অস্থিরতার মধ্যে কাটালেন ফাদার। কখনও গায়ের ওপর থেকে কম্বল ছুঁড়ে ফেলে দেন, কিছুক্ষণ পর আবার তুলে নেন; কপালে হাত বুলাতে থাকেন ঘন ঘন। কপাল ঘামে ভিজে গিয়েছে তাঁর। থেকে থেকে বিছানার ওপরে বসে খুব জোরে জোরে কেশে গলা পরিষ্কার করার চেষ্টা করেন। মনে হয় ফুসফুসের ভেতর শক্ত কোন জিনিস তাঁর শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করছে। প্রতিবারই ব্যর্থ চেষ্টার পর আবার তিনি এলিয়ে পড়েন বালিশের ওপর। ফাদার বিরক্ত হতে পারেন, এই ভয়ে ডাক্তার ডাকলেন না ভদ্রমহিলা।

বিকেলের দিকে ফাদারের সঙ্গে আর একবার কথা বলার চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু কতগুলো অসংলগ্ন শব্দ ছাড়া ফাদারের মুখ। দিয়ে কিছুই বেরুল না। ডাক্তার আনার কথাটাও আর একবার। তুললেন ভদ্রমহিলা। শুনে বিছানার ওপর উঠে বসলেন ফাদার এবং দৃঢ় কণ্ঠে আপত্তি জানালেন। সবকিছু ভেবে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন ভদ্রমহিলা। অবশ্য এখানেই তিনি তাঁর দায়িত্ব শেষ করলেন না, ঠিক করলেন রাতেও ফাদারকে কয়েকবার দেখে। যাবেন। রাত এগারোটার দিকে তিনি ফাদারকে এক কাপ সুপ, দিলেন এবং এরপর থেকেই ক্লান্ত বোধ করতে লাগলেন এবং সোফায় গা এলিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।

তাঁর ঘুম ভাঙল সকালে উঠেই প্রথমে ছুটে গেলেন তিনি ফাদারের ঘরে। তখনও বিছানায় শুয়ে আছেন ফাদার। আগের দিনের মত চেহারায় লালচে ভাবটা নেই। মরা মানুষের মত পাণ্ডুর দেখাচ্ছে তাঁকে। চোখ-মুখের ফোলা ফোলা ভাবটা এখনও আছে। বিছানার পাশের জ্বলন্ত ল্যাম্পটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। ভদ্রমহিলাকে ঘরে ঢুকতে দেখে তাঁর দিকে মুখ ফেরালেন। ভদ্রমহিলার মনে হলো সারারাত ধরে কে যেন ফাদারকে একটা মুগুর দিয়ে পিটিয়েছে। এখন তাঁর মুমূর্ষ অবস্থা।

কেমন আছেন? জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রমহিলা।

ফাদার বললেন, শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। ডাক্তার ডাকার দরকার নেই। আমাকে হাসপাতালে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করতে। পারেন। এটাই সরকারি নির্দেশ।

তাঁর উদাসীন কথা শুনে চমকে উঠলেন ভদ্রমহিলা। ভয়ে ছুটলেন টেলিফোন করতে।

দুপুর বেলা এল রিও। ফাদারের সমস্ত শরীর পরীক্ষা করে ও দেখল ফুসফুসের কিছু অসুবিধা ছাড়া প্লেগের কোন লক্ষণ নেই। ব্যাপারটায় অবাক হয়ে গেল ও।

রোগের কোন চিহ্ন আপনার শরীরে দেখতে পাচ্ছি না, ফাদারকে আশ্বাস দিয়ে বলল রিও। তবে নিশ্চিত করে কিছু বলা অসম্ভব। তাই আপনাকে আলাদা রাখার ব্যবস্থা করতেই হবে।

অদ্ভুতভাবে হাসলেন ফাদার। হয়তো ভদ্রতা দেখালেন, কিন্তু কিছু বললেন না। টেলিফোন করার জন্যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রিও। ফিরে এসে বলল, আমিও আপনার সঙ্গে থাকব।

অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আপনি তো জানেন, ধর্মযাজকের জন্যে বন্ধু বলে কিছু নেই। তাদেরকে নিঃশেষে আত্মসমর্পণ করতে হয় ঈশ্বরের কাছে।

মাথার ওপর একটা ক্রুশ ঝুলছিল। ওটাকে নামিয়ে তাঁর হাতে দেবার জন্যে রিওকে অনুরোধ করলেন ফাদার। ক্রুশটা হাতে নিয়েই তিনি একদৃষ্টিতে সেটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। 

হাসপাতালে পৌঁছানোর পর থেকে একটা কথাও আর বললেন না ফাদার। তাঁর চিকিৎসার জন্যে যা যা করা হলো সবকিছুই মেনে নিলেন। শুধু কুশটাকে এক মুহূর্তের জন্যেও হাতছাড়া করলেন না। কিন্তু তাঁর রোগটা কী সেটা কেউই বুঝতে পারল না। শরীরের তাপ ক্রমাগত বেড়েই চলল। আর বাড়তে লাগল কাশি। সন্ধ্যার দিকে কাশির সঙ্গে বেরিয়ে এল একটা লালচে পদার্থ। পরের দিন সকালে মারা গেলেন ফাদার প্যানালু। তখনও তার চোখ দুটো ছিল আগের মত শান্ত, নির্বিকার। মৃত্যুর কারণ হিসেবে তাঁর কার্ডে লেখা হলো: সন্দেহজনক রোগ।

ইতিমধ্যে আর একটা নতুন জিনিস চালু হলো শহরে। হঠাৎ করেই বেড়ে গেল বর্ষাতির ব্যবহার। রাস্তায় বেরুলে দেখা যায় রবারের তৈরি চকচকে পোশাক পরে হেঁটে বেড়াচ্ছে শহরবাসীরা। কিছু দিন থেকে খবরের কাগজে প্রচার করা হচ্ছিল দুশো বছর আগে দক্ষিণ ইউরোপে প্লেগ-মহামারীর সময় সেখানকার ডাক্তাররা সংক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্যে তৈলাক্ত পোশাক ব্যবহার করত। এ-কারণেই বর্ষাতির ব্যবহার হঠাৎ করে বেড়ে গেল। এ সুযোগে দোকানদাররা পুরনো ফ্যাশনের বর্ষাতিও বাজারে ছাড়তে আরম্ভ করল।

.

৪.০৫

পাঁচ এ-বছর ‘অল সোলস ডে’তে কেউই কবরস্থানে মৃত আত্মীয়স্বজনের কবর দেখতে গেল না। অন্যান্য বছর এ-দিনটিতে দেখা যেত রাস্তায় ভাড়াটে ট্যাক্সিগুলো মৌ মৌ করছে চন্দ্রমল্লিকার হালকা সুবাসে; কবরে ফুল দেয়ার জন্যে সার বেঁধে, আত্মীয়স্বজনের কবরের দিকে এগিয়ে চলেছে মহিলারা। দীর্ঘদিন ধরে যেসব আত্মীয়স্বজন নিঃসঙ্গ পরিত্যক্ত অবস্থায় শুয়ে আছে কবরের অন্ধকারে, এইদিনে তাদের জন্যে শোক করে ওরা। কিন্তু প্লেগের বছরে মানুষ তাদের মৃতব্যক্তিদের স্মরণ করতে চাইল না। কেননা, এমনিতেই তাদের কথা বড় বেশি ভাবছে ওরা। দুঃখ আর বেদনার অশ্রু নিয়ে ওদের কাছে আবার যাবার তাই আর কোন প্রশ্ন আসে না। ওরা আর বিস্মৃত কেউ নয়, যার কাছে, বছরে একবার এসে নিজের দোষ স্থলন করে মানুষ। বরং অবাঞ্ছিত স্মৃতি ওরা, যাদের ভুলে যেতে চায় লোকে। বাস্তবিক এ কারণেই মৃতের দিনকে নীরবে অথচ ইচ্ছেকৃতভাবে উপেক্ষা করল সবাই। কেননা, কটার্ড এর ভাষায় এখন প্রতিটি দিন মৃতের দিন।

বেশ কিছুদিন সবাই যখন দেখল প্লেগে মৃত্যুর সংখ্যা খুব একটা বাড়ছে না, মৃতের সংখ্যার যে গ্রাফিক চার্টটি রোজ তৈরি করা হয় অনেকদিন সেটা ঊর্ধ্বমুখী থাকার পর একটা মন্থরগতি  এসেছে সেটায়, তখন আরও অনেকের মত ডাক্তার রিচার্ড-এর মনেও জাগল আশা।

একদিন সে মন্তব্য করল, আমার মনে হয় রোগের প্রকোপ আর বাড়বে না। আস্তে আস্তে এটা এখন কমতেই থাকবে। আর পুরো কৃতিত্ব ডাক্তার ক্যাসেল-এর বানানো সিরামের।

ডাক্তার ক্যাসেল ওর সঙ্গে একমত হতে পারল না। বলল, ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায়, ঠিক এ-রকম সময়েই একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে গেছে রোগের দাপট।

কর্তৃপক্ষ অনেকদিন থেকেই নানাভাবে চেষ্টা করছিলেন মানুষের মনোবল শক্ত রাখার। কিন্তু মৃতের সংখ্যা বাড়ার ফলে তাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। এবার এই সুযোগে তারা ডাক্তার এবং স্বেচ্ছাসেবকদের একটা সভা ডাকার প্রস্তাব দিলেন যেখানে সবাই তাদের মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ পাবে। কিন্তু সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই আবার বেড়ে গেল প্লেগের আক্রমণ, আর ওদিকে হঠাৎ করে মারা গেল রিচার্ড। আবার হতাশায় ডুবে গেলেন কর্তৃপক্ষ। প্রিফেক্ট-এর অফিস ছাড়া শহরের আর সব সরকারি অফিস এবং ঘরবাড়িতে ভোলা হলো হাসপাতাল আর নয়তো ক্যাম্প।

আগেই কোথাও কোথাও দেখা দিয়েছিল প্লেগের সঙ্গে নিউমোনিয়া। এবার তার সংক্রমণ সারা শহরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এইসব রোগী যখন কাশে তখন তাদের কফের সঙ্গে উঠে আসে রক্ত। আর রোগীরা মারাও যায় খুব তাড়াতাড়ি। সাধারণ প্লেগের চেয়ে এটাকে অনেক বেশি ছোঁয়াচে বলে মনে হলো। তাই স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবাণুমুক্ত কাপড়ের মুখোশ পরতে আরম্ভ করল।

খাদ্য-সংকটও ওদিকে ভয়াবহ রূপ নিল। যেসব খাবার দোকানে পাওয়া যায় না মুনাফাখখারদের কাছ থেকে সেগুলো চড়া দামে কিনতে হয় এখন। এর ফলে গরিব মানুষেরা চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল। ওরা কাছের শহর আর গ্রামগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে দিল যেখানে অনেক সস্তায় পাওয়া যায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল ওইসব জায়গায় যাওয়ার অনুমতি এখন কর্তৃপক্ষের দেয়া উচিত। একটা শ্লোগানে ছেয়ে গেল শহরের সব দেয়াল। খাবার আর মুক্ত বাতাস চাই। এর কিছুদিন পর থেকে বিক্ষোভ মিছিল বেরুতে লাগল।

কর্তৃপক্ষ খবরের কাগজগুলোকে নির্দেশ দিলেন যেভাবেই হোক আশার কথা প্রচার করতে হবে। সাংবাদিকরা অত্যন্ত নৈপুণ্যের · সঙ্গে তাদের কর্তব্য পালন করলেন। এসময়কার রোজকার কাগজেই লেখা হতে লাগল। শহরের অধিবাসীরা সাহস এবং ধৈর্যের চমৎকার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু যে শহরের সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, যে শহরকে পুরোপুরি নির্ভর করতে হচ্ছে নিজের ওপর, সেখানে সে-মুহূর্তে কোনকিছু লুকিয়ে রাখা যায় না। সাংবাদিকরা যাই বলে চেঁচান না কেন, শহরের সত্যিকারের খবর জানতে তারিউ ঘুরতে লাগল ক্যাম্পে ক্যাম্পে।

স্টেডিয়ামে যে ক্যাম্পটা খোলা হয়েছিল র‍্যাঁবেয়াকে সঙ্গে নিয়ে একদিন সেটা দেখতে গেল তারিউ। শহরের এক প্রান্তে স্টেডিয়াম। এক পাশে বিরাট এক রাস্তা, অপর পাশে মালভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত পোড়ো জমি। স্টেডিয়ামের চারপাশে উঁচু কংক্রিটের দেয়াল। চারটে ফটকে সবসময় পাহারা দিচ্ছে চারজন সান্ত্রী। কংক্রিটের উঁচু দেয়ালগুলো ক্যাম্পের বিচ্ছিন্ন মানুষকে বাইরে চলমান মানুষদের উৎসুক দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রেখেছে। ভেতরে আটকা পড়া মানুষরা সারাদিন ধরে বাইরে যেসব মোটর গাড়ি চলাচল করে তার শব্দ শুনতে পায়, আর ওই শব্দের কম-বেশি হওয়া থেকে অনুমান করে নেয় শহরের লোকজন কখন কাজ থেকে ঘরে ফিরছে আর কখনোই বা তারা তাদের কর্মস্থলে যাচ্ছে। এ থেকে তারা অনুমান করে নেয় বাইরের জীবন ঠিক আগের মতই চলছে।

তারিউ এবং র‍্যাঁবেয়া গেল রোববারের বিকেলে। ওদের সঙ্গে ছিল গনজালেস। র‍্যাঁবেয়া তখনও পর্যন্ত ওর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখেছে। র‍্যাঁবেয়া ওকে প্রস্তাব দিয়েছিল ক্যাম্প দেখাশোনার কাজে সাহায্য করতে। গনজালেস শুধু রোববারে কাজ করতে রাজি নয়। সেদিন ওরা গনজালেসকে সঙ্গে নিল ক্যাম্প কমান্ডারের সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দিতে।

স্টেডিয়ামে ঢুকে ওরা দেখল চারপাশ লোকে লোকারণ্য। মাঠে কয়েকশো ছোট ঘোট লাল তাঁবু। ভেতরে কম্বল, বিছানা আর কাপড়চোপড়ের বান্ডিল। ক্যাম্পের নিয়ম হচ্ছে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে নিজের নিজের তাঁবুতে ঢুকতে হবে। তারিউ, র‍্যাঁবেয়া আর গনজালেস যখন গেল তখন কেউ বসে আছে তাঁবুর সামনে, স্ট্যান্ডের ওপর; কেউবা পায়চারি করছে মাঠে। তবে সবার দৃষ্টিই উদাস, হতাশায় ভরা।

সারাদিন ধরে ওরা করে কী? র‍্যাঁবেয়াকে প্রশ্ন করল তারিউ।

কী আর করবে? করার মত কিছুই তো নেই, উত্তর দিল র‍্যাঁবেয়া। এরপর বলল, প্রথম যখন ওদেরকে এনে এখানে ঢোকানো হয় তখন ওরা এত হৈ-চৈ করত যে কোন কথা শোনা যেত না। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে সবাই কেমন যেন নির্বাক হয়ে উঠছে।

মনে মনে ওদের এই নীরবতার কারণ খোঁজার চেষ্টা করল তারিউ। কিছু দৃশ্য ভেসে উঠল ওর কল্পনায়। ওর এই সব চিন্তা ভাবনাকে ডাইরিতে লিখেও রাখে ও। লেখে: বিভিন্ন তাঁবুর ভেতর ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়েছে অসুস্থ মানুষগুলোকে। তাদের চারপাশে সারাক্ষণ ভনভন করছে মাছি। গা চুলকাচ্ছে সবাই। প্রথম দিকে ওরা একে অপরকে শোনাত নিজের শঙ্কা বা ক্রোধের কথা। তখন অনেক সহৃদয় শ্রোতা পাওয়া যেত। কিন্তু ক্যাম্পে রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাওয়ার ফলে কারও অভাব-অভিযোগ শোনার মত। শ্রোতা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াল। তাই ওরা হয়ে পড়ল নির্বাক। শুধু তাই নয়, সবার প্রতি অবিশ্বাস জন্মাল ওদের। এখন এখানে দাঁড়ালে মনে হয়, মাথার ওপর ধূসর আকাশ থেকে শিশির কণার মত অবিশ্বাস ঝরে পড়ছে লাল রঙের তাঁবুগুলোর ওপর। কিন্তু সবচেয়ে যা বেদনাদায়ক তা হচ্ছে ওদের কথা ওদের আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবরা ভুলে গেছে, এবং ওরা সেটা অনুভব করে।

ওদেরকে দেখে ক্যাম্পের ম্যানেজার কাছে এসে বলল, মঁসিয়ে অথন আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে চান। গনজালেসকে ওখানে রেখে তারিউ এবং ব্লাবৈয়াকে ভদ্রলোক নিয়ে গেল বড় চত্বরটার কাছে। সেখানে তখন একাই বসে ছিলেন মঁসিয়ে অথন। ওদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন। পোশাক আগের মতই ফিটফাট। শুধু চুল আঁচড়াননি, আর জুতোর ফিতা খোলা। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল অকে, চোখ পর্যন্ত তুলতে চাইছিলেন না। বললেন, আপনাদের দেখে খুব খুশি হয়েছিল। ডাক্তার রিও আমার পরিবারের জন্যে অনেক করেছেন। তাকে আমার ধন্যবাদ জানাবেন।

এরপর সম্পূর্ণ নীরবে কাটল কয়েকটা মুহূর্ত। অনেক চেষ্টার পর মঁসিয়ে অথন অবশেষে বললেন, আশা করি জ্যাকুইসকে খুব কষ্ট পেতে হয়নি। তারিউ এই প্রথম মঁসিয়ে অথনকে তাঁর ছেলের নাম ধরে ডাকতে শুনল। এতেই ও বুঝল, মঁসিয়ে অথনও অনেক বদলে গেছেন।

তখন পশ্চিম দিগন্তে ডুবছে সূর্য। ভাঙা ভাঙা মেঘের ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে তার শেষ কিরণ। হ্যাঁ, উত্তর দিল তারিউ, সত্যিই ও তেমন কষ্ট পায়নি। ওরা চলে আসার পরও সূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলেন মঁসিয়ে অথন।

গনজালেস-এর কাছ থেকে বিদায় নিল ওরা। ওদের পৌঁছে দেবার জন্যে বেরিয়ে এল ক্যাম্প ম্যানেজার। এ-সময় ওরা শুনতে পেল কাছের স্ট্যান্ডগুলো থেকে ভেসে আসছে কর্কশ শব্দ। আগে যেসব মাইক থেকে খেলার ফলাফল ঘোষণা করা হত, পরিচয় করিয়ে দেয়া হত নতুন খেলোয়াড়দের, সেই মাইক থেকে এখন রাতের আহারের জন্যে সবাইকে নিজের নিজের তাঁবুতে ফেরার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। এক পা দু পা করে ফিরে চলল ওরা। সবাই যখন ঢুকে গেল তাঁবুতে, ছোট ছোট দুটো ইলেকট্রিক ট্রাক, মোট বইবার কাজে যেমন দেখা যায় রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, ছড়ানো-ছিটানো তাঁবুগুলোর মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে যাত্রা শুরু করল নিজেদের। একেকটা তাঁবুর সামনে গিয়ে থামছে ওরা। আর বন্দী। মানুষ বাইরে এসে থালাসহ হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে ওপর পানে। ট্রাকের ওপর রাখা বড় বড় দুটো কড়াই থেকে লম্বা হাতায় করে। খাবার তুলে পরিবেশন করা হচ্ছে অপেক্ষমাণ থালায়। তারপর পরের তাবুর উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছে ট্রাক।

দেখছি, বেশ দক্ষ তো, মন্তব্য করল তারিউ।

খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ম্যানেজারের মুখ। তাই না? এই ক্যাম্পে আমরা সবাই আসলে দক্ষতায় বিশ্বাস করি।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। মাথার ওপর পরিষ্কার আকাশ। কতকগুলো বাদুড় ক্যাম্পের ওপর ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। দেয়ালের বাইরে ঘেউ ঘেউ করছে একটা কুকুর। তাঁবুগুলোর সামনে থেকে ভেসে আসছে প্লেটের ওপর চামচ নাড়াচাড়ার শব্দ।

.

৪.০৬

ছয় শেষ হয়ে এল নভেম্বর মাস। সকালে এখন বেশ শীত শীত করে। কিন্তু সন্ধ্যায় আবার গরম হয়ে ওঠে বাতাস। এক সন্ধ্যায় তারিউ ঠিক করল ওর জীবনের সব কথা রিওকে শোনাবে। রাত দশটায় ও রিওকে বলল, চলুন; আপনার সেই হাঁপানি রোগীর বাসা থেকে ঘুরে আসি।

ওদের দেখে বক্তৃতা দিতে শুরু করল বুড়ো, শহরের লোকেরা আস্তে আস্তে অধৈর্য হয়ে উঠছে। চিরদিন সেই একই শ্রেণীর মানুষকে দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয়। অনির্দিষ্টকাল ধরে এই অবস্থা চলতে পারে না। এরপর হাত কচলাতে কচলাতে বলল, আবার হৈ-হুঁল্লোড়ের দিন ফিরে আসবে।

এমন সময় ছাদে পায়ের শব্দ শুনতে পেল ওরা। বুড়োর স্ত্রী বলল, পাশের বাসার মেয়েরা ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মহিলা আরও জানাল, ছাদ থেকে চারপাশের দৃশ্য খুব সুন্দর দেখায়।

যান না, ওপরে গিয়ে দেখে আসুন চারপাশে কী মজার দৃশ্য, স্ত্রীর কথা সমর্থন করল বুড়ো, কী চমৎকার বাতাস।

ওপরে উঠে কাউকে দেখতে পেল না ওরা। কেবল তিনটি চেয়ার আছে ওখানে। যতদূর চোখ যায় শুধু ছাদ আর ছাদ। সবচেয়ে দূরের ছাদটা ঠেকে আছে শহরের সবচেয়ে কাছের পাহাড়টির গায়ে। রাতের আবহাওয়ায় আকাশ তখন একেবারে পরিষ্কার, তারাগুলোকে মনে হচ্ছে রূপার পাত। বন্দরের লাইট হাউস থেকে ছড়িয়ে পড়েছে হলুদ আলো। চারদিকে অখণ্ড নীরবতা।

হ্যাঁ। সত্যিই চমৎকার, একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল রিও।

সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিল তারিউ। একটুক্ষণ চুপ থাকার পর। ও বলল, হ্যাঁ। ঠিক। রিও-র পাশের চেয়ারটাতে বসল ও।

আচ্ছা, রিও, বলল তারিউ, আপনি কখনও জানার চেষ্টা করেছেন আমি কে? আপনাকে আমি বন্ধু ভাবতে পারি?

কেন নয়! আমরা তো বন্ধুই। শুধু সেটা জানানোর সময় এবং সুযোগ আমাদের ঘটেনি।

যাক। আশ্বস্ত হলাম। এই বন্ধুত্বের খাতিরে যদি আমরা ঘণ্টাখানেকের জন্যে ছুটি নিই?

হাসল রিও। বেশ। তাই হবে।

জীবন আরম্ভ করেছিলাম মোটামুটি ভাল ভাবেই। যে কাজে হাত দিতাম তাতেই সফল হতাম। মেয়েদের সাথে খুব সহজেই সম্পর্ক গড়ে উঠত, তেমনি ছাড়াছাড়িও হয়ে যেত খুব সহজে।

আপনার মত দারিদ্রের ভেতর আমাকে শৈশব কাটাতে হয়নি। আমার বাবা ছিলেন সরকারি উকিল। যেমন দয়ালু তেমনি সৎ :, প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি। আর মা ছিলেন সরল, এবং কিছুটা লাজুক। অবশ্য আমার বাবা আদর্শ স্বামী ছিলেন না। কিন্তু তাহলে কি হবে, তাঁর আচরণ কখনোই শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে যেত না। সব ব্যাপারেই তিনি মধ্যপথ অনুসরণ করতেন।

আমার বাবার একটা বিশেষত্ব ছিল। বিছানায়, তার হাতের পাশে সবসময় থাকত ট্রেনের সময়সূচি। যেসব প্রশ্নে স্টেশন মাস্টাররা রীতিমত মাথা চুলকায় সেগুলোর উত্তর বাবা চটপট দিয়ে দিতেন। প্রতি সন্ধ্যায় তিনি বসে পড়তেন তাঁর ওই জ্ঞান বাড়ানোর। সাধনায়, এ নিয়ে তাঁর এক ধরনের গর্ববোধও ছিল। বাবার এই অদ্ভুত শখ দেখে আমি ভীষণ মজা পেতাম। দুজনে মেতে উঠতাম রেল ভ্রমণের এক অদ্ভুত খেলায়। এভাবে আমাদের মধ্যে এক গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

বয়স আমার তখন সতেরো, বাবা একদিন বলনে কোর্টে গিয়ে তাঁর বক্তৃতা শুনতে হবে। তিনি হয়তো আশা করেছিলেন এতে আমি উকিল হিসেবে তাঁর নৈপুণ্য দেখার সুযোগ পাব, আর আদালতের জাঁকজমক, দেখে প্রভাবিত হব, এবং ওকালতিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করার উৎসাহ বোধ করব।

আদালতের যে ছবিটা চিরদিনের জন্যে আমার মনে গেঁথে যায় তা হচ্ছে আসামির কাঠগড়ায় সেদিন যে আসামি দাঁড়িয়েছিল তাঁর চেহারা। মাথায় ধূসর চুল, বয়স তিরিশ। দেখে মনে হচ্ছিল ভীষণ। ভয় পেয়ে গেছে সে, এবং নিজের অপরাধ স্বীকার করার জন্যে ব্যর্থ হয়ে উঠেছে। আমি লোকটার অবস্থা দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল একটা হলদে পেঁচা, যে হঠাৎ করে প্রচুর আলোর মধ্যে এসে দিশেহারা হয়ে হারিয়ে ফেলেছে তার দৃষ্টিশক্তি। ডানহাতের একটা নখ বারে বারে কামড়াচ্ছিল সে।

হৃদয়ের গহিনের একটা খামচি অনুভব করেছিলাম আমি। আমার সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সেই তুচ্ছ লোকটা। আশেপাশে কে কী বলছে কিছুই আমার কানে ঢুকছিল না। শুধু উপলব্ধি করছিলাম, চারপাশের সবাই ওই লোকটির প্রাণ নেবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু একটা আদিম অনুভূতির প্রবল জোয়ার আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল অপরাধী ওই মানুষটার পাশে। _ লাল গাউন পরা আমার বাবা উঠে দাঁড়ালেন। তখন তিনি। সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। দয়ালু ব্যক্তিটি হারিয়ে গেছে তার ভেতর থেকে। দীর্ঘ এক একটা বাক্য বেরিয়ে আসছে তার মুখ দিয়ে। আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেবার জন্যে জুরিদের কাছে আবেদন জানালেন তিনি।

সেদিনের পর থেকে বাবার শখের সেই ট্রেনের সময়সূচিটা চোখে পড়লেই আমার সারা শরীরে বয়ে যেত ঘৃণার একটা স্রোত। আদালত, আইন, বিচার, মৃত্যুদণ্ড এবং মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরী করা, এগুলো সম্পর্কে দারুণ একটা বিতৃষ্ণা জেগে উঠল আমার ভেতর। উপলব্ধি করলাম ওইসব নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময় মাঝেমাঝে বাবাকেও উপস্থিত থাকতে হয়। সেই দিনগুলোতে খুব ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠতেন তিনি। আর এজন্যে রাতেই ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতেন।

তারপরে প্রায় এক বছরের মত ওই বাড়িতে ছিলাম আমি। হঠাৎ একদিন বাবা আমার কাছ থেকে অ্যালার্ম ঘড়িটা চাইলেন। বললেন, পরের দিন খুব ভোরে তাকে ঘুম থেকে জাগতে হবে। সে রাতে আমি একটুও ঘুমোতে পারিনি। পরের দিন বাবা বাসায়। ফেরার আগেই আমি ওখান থেকে পালিয়ে আসি।

বাইরে থাকার সময় হঠাৎ একদিন তার একটা চিঠি পেলাম। আমি দেখা করলাম। আমার পালিয়ে যাবার কোন কারণ না দেখিয়ে খুব শান্তভাবে বললাম, তিনি আমাকে ফিরে আসতে বাধ্য করলে আমি আত্মহত্যা করব। অনেক বক্তৃতা, অনেক উপদেশ দেয়ার পর শান্ত হলেন তিনি। এটুকু বুঝেছিলাম প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন বাবা। বেশ কিছুদিন পরপর আমি মাঝে মাঝে মা-র সঙ্গে দেখা করতাম। তখন বাবার সঙ্গেও দেখা হত। তাকে বেশ খুশি। খুশি দেখাত। বাবা মারা যাবার পর মাকে আমার কাছে নিয়ে। এসেছিলাম। তিনিও মারা গেছেন, নাহলে এখনও আমার সঙ্গেই থাকতেন।

আঠারো বছর বয়সে দারিদ্রের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়। কিন্তু তখন এসব ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ ছিল না, আমার সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল মৃত্যুদণ্ডাদেশ। আসামির কাঠগড়ায় সেই যে পেঁচাটাকে একদিন দেখেছিলাম, তারই সাথে বোঝাঁপড়া করতে চেয়েছিলাম জীবনে। আমার মনে হত চারপাশের সমস্ত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে এই অন্যায় মৃত্যুদণ্ডাদেশের ওপর। আমি একটা রাজনৈতিক দলে যোগ দেই। আমার জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে এদের সঙ্গে। ইউরোপে এমন দেশ খুব কমই। আছে যার গণআন্দোলনে আমি অংশ নিইনি।

আমাদের দলও মাঝে মাঝে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিত। আমাদের বোঝানো হত যেখানে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বলে কিছুই থাকবে না তেমন পৃথিবীকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে এই ধরনের কিছু কিছু মৃত্যু মেনে নিতেই হবে। কিন্তু আমার ভেতর এ নিয়ে সংশয় দানা বাঁধছিল। তারপর এল সেই দিনটা যেদিন আমার চোখের সামনে একজনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরী করা হলো। ঘটনাটা ঘটেছিল। হাঙ্গেরিতে।

বধ্যভূমিতে লোকটিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বুকের যে। জায়গায় হৃৎপিণ্ড থাকে, সেই জায়গা লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছিল, একসঙ্গে কয়েকজন। বুকের ওপর যে ছিদ্রটা হয়েছিল তাতে একটা হাত ঢুকতে পারত। এরপর থেকে কোনো রাতেই আমি ঠিকমত ঘুমোত পারিনি।

আমার মনে হত আমি নিজেও পরোক্ষভাবে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্যে দায়ী। এ-ভাবে আমার জীবন হয়ে উঠল নিঃসঙ্গ। সবার মাঝে থাকলেও এই একাকিত্ব কাটত না।

আজও আমার ওই মনোভাবের পরিবর্তন হয়নি। বছরের পর বছর ধরে মনে মনে আমি লজ্জা অনুভব করে আসছি। অনুভব করেছি, আমার যত সদিচ্ছাই থাক না কেন, প্রত্যক্ষভাবে না হলেও আমি নিজেও হত্যাকারীদের একজন। তাই ঠিক করেছি, মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে বা মৃত্যুতে সাহায্য করতে পারে এমন কোনকিছুর সঙ্গে নিজেকে জড়াব না কখনও।

আমার এখনকার কর্তব্য, আপনার পাশে থেকে এই সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। রিও, আমি খুব দৃঢ়তার সঙ্গেই বলতে পারি, এই পৃথিবীতে এমন কিছুই নেই আমাকে নতুন করে জানতে হবে-শিখতে হবে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর রিও প্রশ্ন করল, জীবনে শান্তি, পাওয়ার জন্যে মানুষের কোন পথ অনুসরণ করা উচিত, সে ব্যাপারে আপনার কোন ধারণা আছে?

হ্যাঁ, জবাব দিল তারিউ, সহানুভূতির পথ।

এতক্ষণ ধরে যে মৃদু বাতাস বইছিল সেটা এখন একটু জোরে বইতে শুরু করল। সমুদ্র থেকে একটা দমকা হাওয়া উঠে এসে আশেপাশের বাতাসকে লোনা গন্ধে ভরিয়ে তুলল। ওরা শুনতে পেল ছলাৎ ছলাৎ শব্দে সমুদ্রের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে পাহাড়ের পাদদেশে।

আমার এখন একমাত্র আগ্রহ, মানুষ কীভাবে মহাপুরুষ হয় তা জানা, নির্বিকার কণ্ঠে বলল তারিউ।

কিন্তু তুমি তো ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করো না।

হ্যাঁ। আর সমস্যাটা সেখানেই। আজকে, আমাদের জীবনের একমাত্র সমস্যা এটাই।

ওরা কতকগুলো কণ্ঠের কোলাহল শুনতে পেল, আর সেই সঙ্গে একটা বন্দুকের গুলির আওয়াজ। কিছুক্ষণ পর আবার শুনতে পেল কুদ্ধ জনতার চিৎকার।

ফটকের সামনে নিশ্চয় গোলমাল বেধেছে, বলল তারিউ।

তাই মনে হচ্ছে। তবে এতক্ষণে থেমে গেছে বোধহয়, বলল রিও।

এসব গোলমাল কোনদিনই থামবে না, বরং বাড়বে; এটাই হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম।

হয়তো তাই। হয়তো তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু আমি সত্যিকারের সহানুভূতি অনুভব করি পরাজিত মানুষের জন্যে, মহাপুরুষদের জন্যে নয়। বীরত্বের কোন মূল্য আমার হৃদয়ের কাছে নেই। আমি একজন সাধারণ মানুষ এটাতেই আমি সবচেয়ে আগ্রহী।

হ্যাঁ, আমাদের দুজনের লক্ষ্যই হয়তো এক, কেবল পার্থক্য, আপনার মত কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমার নেই। দ্য প্লেগ

রিও ভাবল তারিউ হয়তো ঠাট্টা করছে। ও হাসতে হাসতে ওর দিকে ঘুরে দাঁড়াল। কিন্তু অস্পষ্ট আলোয় দেখল ওর মুখে লেগে : আছে বিষাদ আর আন্তরিকতার ছাপ।

কি ভাবছেন, বলল তারিউ, বন্ধুত্বের খাতিরে আমাদের এখন, কী করা উচিত?

আপনি যা চান তাই করব।

চলুন, একটু সাঁতার কেটে আসি। এমন নিষ্পাপ আনন্দ মহাপুরুষরাও উপভোগ করতে পারে। আপনার কী মনে হয়? _ আবার হাসল রিও। তখনও কথা শেষ হয়নি তারিউ-এর, বলল, পরিচয়পত্র সঙ্গেই আছে, বাইরের জেটি পর্যন্ত যেতে অসুবিধে হবে না। দিন রাত এই প্লেগের মধ্যে বসে থেকে শুধু প্লেগের কথা চিন্তা করা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। যারা প্লেগের শিকার তাদের বাঁচানোর জন্যে আমরা অবশ্যই সংগ্রাম করব, কিন্তু এর বাইরে আর কিছু ভাবতে না পারলে এ সংগ্রাম তো অর্থহীন।

ঠিক বলেছেন। চলুন, যাই।

কয়েক মিনিট পরে ওদের গাড়ি থামল ফটকের সামনে। পাহারাদারকে দেখাল পরিচয়পত্র। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে ওগুলো ফেরত দিল ওদের হাতে।

ফটকের বাইরে অনেকটা খোলা জায়গা, সেখানে অনেকগুলো। বড় বড় পিপা ছড়ানো। সেটা পেরিয়ে এগিয়ে চলল ওরা। বাতাস মদ আর মাছের আঁশটে গন্ধে ভারি। একটু পরে ওদের নাকে ভেসে এল আইডিন এবং সামুদ্রিক আগাছার গন্ধ। বুঝতে পারল সমুদ্রের ধারে পৌঁছে গেছে ওরা। এমন সময় শুনতে পেল ঢেউ এসে আছড়ে  পড়ছে বড় বড় উপলখণ্ডের গায়ে।

জেটির ওপর উঠতেই ওরা দেখতে পেল সামনে বিস্তৃত সমুদ্র, ধীরে ধীরে আন্দোলিত হচ্ছে। একটা পাথরের ওপর বসল দুজনা। মন্থর গতিতে উঠছে আর নামছে শান্ত ঢেউ, চিকচিক করছে আলোর প্রতিফলনে; কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে যাচ্ছে, এরপর ভেঙে চুরমার হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের বুকে। সামনে দিগন্তব্যাপী, ঘন অন্ধকার। হাতের তালুতে ক্ষয়ে যাওয়া পাথরের স্পর্শ অনুভব করল রিও। হঠাৎ এক অদ্ভুত আনন্দে ভরে উঠল ওর মন। তারিউ-এর। দিকে চোখ ফিরিয়ে ওর মুখেও একই প্রশান্তির ছাপ দেখতে পেল

কাপড়চোপড় খুলে ফেলল ওরা। প্রথমে কঁপ দিল রিও। ডোবার সময় পানি মনে হলো ঠাণ্ডা, কিন্তু ভেসে ওঠার পর অত, ঠাণ্ডা লাগল না। কিছুক্ষণ সাঁতার কাটার পর রাতের সমুদ্রকে বেশ উষ্ণই মনে হলো ওর। পিছনে পানি উছলে ওঠার শব্দ শুনল ও। অনুমান করল, ঝাঁপ দিয়েছে তারিউ। চিত হয়ে মরার মত পানির ওপর শুয়ে থাকল ও। মাথার ওপর বিশাল আকাশ, চাঁদ আর অসংখ্য তারায় ঝলমল করছে। তারিউ-এর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল ও।

আবার উপুড় হলো রিও। পাশাপাশি সাঁতার কাটতে কাটতে এগিয়ে চলল দুই বন্ধু। তারিউ ওর চেয়ে অনেক ভাল সাঁতারু। একই তালে পা পড়ছে দুজনের। বাইরের পৃথিবী থেকে এখন ওরা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। শহরের দূষিত পরিবেশ আর প্লেগের ছোঁয়া থেকে অনেক দুরে।

 প্রথমে থামল রিও। আবার জেটির দিকে ধীরে ধীরে ফিরতে আরম্ভ করল ওরা। এক জায়গায় এসে হঠাৎ বরফের মত হিম স্রোতের মাঝখানে পড়ে গেল দুজনে। ফাঁদে পড়ে শক্তি চাড়া দিয়ে উঠল ওদের; জোরে জোরে হাত-পা ছুঁড়তে লাগল ওরা। জেটিতে উঠে কাপড়চোপড় পরে নিয়ে ফিরে চলল শহরে! আবার তুলে নিতে হবে কাজের দায়িত্ব।

.

৪.০৭

সাত সারাটা ডিসেম্বর মাসই ধকধক করে জ্বলল প্লেগের আগুন। শহরের বাইরে লাশ পোড়ানোর শ্মশানটাকে দিনরাত তার খোরাক জুগিয়ে চলল প্লেগ, আর শত শত মানুষকে রোগাক্রান্ত অবস্থায় গৃহহারা করে পাঠাল ক্যাম্পে ক্যাম্পে { ঝাঁকি খেতে খেতে, অথচ নির্ভুলভাবে নিজের পথ চলায় কোন বিরতি দিল না প্লেগ। কর্তৃপক্ষ আশা করেছিলেন শীত শুরু হলে প্লেগের এই একটানা গতিতে কিছুটা বাধা আসবে, এই আশায় আশায় শেষ হয়ে গেল শীতের প্রথম ঝলক, কিন্তু প্লেগের দাপাদাপি একটুও কমল না।

শহরে খোলা হলো আর একটা হাসপাতাল। অবস্থা এমন দাঁড়াল, রিও রোগী ছাড়া আর কারও সঙ্গেই কথা বলার সুযোগ পায় না। নিউমোনিয়া-প্লেগের সংখ্যা বাড়ার ফলে রোগীদের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ করল ও। এখন সব ব্যাপারেই ও যা করতে চায় সেগুলোকে ওরা মেনে নেয়। আগে, আক্রান্ত হবার সময় কেমন যেন নেতিয়ে পড়ত, আর নয়তো একটা উন্মত্ত ভাব দেখাত। এখন ওরা নিজেরাই ওর কাছে জানতে চায় কী করলে ওদের উপকার হবে। সবসময় পানীয় কিছু খেতে চায়, শরীর গরম রাখার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বলে; নাহলে ঝগড়া-ঝাটি করে; জেদাজেদি করে।

ডিসেম্বরের শেষে রিও মঁসিয়ে অথন-এর কাছ থেকে একটা চিঠি পেল। তিনি লিখেছেন: তার ক্যাম্পে থাকার সময় শেষ হয়ে গেছে, তবু তাঁকে ক্যাম্পে রাখা হয়েছে, কারণ তার ক্যাম্পে আসার তারিখটা নিয়ে গোলমাল বেধেছে; মাদাম অথন ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাবার পর এ নিয়ে প্রিফেক্ট-এর অফিসে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে, তারা তাকে জানিয়েছে অফিসের কাজে কখনও ভুল হয় না; ব্যাপারটা সম্পর্কে খোঁজ-খবর, নেয়ার জন্যে রিওকে তিনি অনুরোধ করেন।

কয়েকদিন পর ওর সঙ্গে দেখা করতে এলেন মঁসিয়ে অথন। এর মধ্যেই অনেক রোগা হয়ে গেছেন ভদ্রলোক।

কিছু করার কথা চিন্তা করেছেন? জানতে চাইল রিও। নিশ্চয় অফিসে অনেক কাজ জমেছে।

ভাবছি কিছুদিন ছুটি নেব।

ঠিক বলেছেন। আপনার কিছুদিন বিশ্রাম নেয়া দরকার।

না। সেজন্যে নয়। আমি আবার ক্যাম্পে ফিরে যেতে চাই।

রিও ভাবল কথাটা ভুল শুনেছে ও। না বলে পারল না, এই তো কদিন আগে বেরিয়ে এলেন।

মাফ করবেন। কথাটা আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারিনি। শুনেছি কিছু কিছু সরকারি কর্মচারী স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ক্যাম্পে কাজ করছে। আমি ওদের সাহায্য করতে চাই। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাই। তাছাড়া, কথাটা একটু অদ্ভুত শোনাবে, এতে আমি এই ভেবে সান্ত্বনা পাব যে ছেলেটার সঙ্গে আমার যোগাযোগ এখনও সম্পূর্ণ কেটে যায়নি।

রিও স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মঁসিয়ে অথন-এর দিকে। আগের সেই ভাবলেশহীন কঠিন চাহনিতে সত্যিই কী কোন কোমল ভাব এসেছে? হ্যাঁ, সত্যিই তো, চোখ দুটো কেমন ভেজাভেজা, আগের সেই তীক্ষ্ণতা নেই।

হ্যাঁ। অবশ্যই, বলল রিও, আপনি যখন চাইছেন, আমি ব্যবস্থা করে দেব।

.

বড়দিনের পর্ব না আসা পর্যন্ত শহরের জীবনযাত্রায় কোন পরিবর্তন এল না। র‍্যাঁবেয়া একদিন চুপি চুপি রিওকে বলল, সেই দুই পাহারাদার ছোকরার মাধ্যমে সে তার প্রেমিকার কাছে চিঠি পাঠিয়েছে, এবং উত্তরও পেয়েছে; রিও-ও ইচ্ছে করলে গোপনে চিঠি পাঠাতে পারে।  দীর্ঘ কয়েক মাস পর এই প্রথম চিঠি লিখতে বসল রিও। কিন্তু কাজটা বড় কঠিন আর পরিশ্রমের বলে মনে হলো ওর। বহুদিনের বিস্মৃত একটা ভাষাকে নানা কৌশলে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করল ও। শেষ পর্যন্ত চিঠিটা শেষ করতে পারল এবং পাঠিয়ে দিল গোপন পথে। তবে উত্তর আসতে দেরি হলো অনেক।

আগের মতই দিন দিন কেঁপে উঠছে কটার্ড। চোরাকারবার, থেকে প্রচুর পয়সা কামাচ্ছে ও। কিন্তু গ্রাঁদ বড়দিনের আয়োজনের সঙ্গে কিছুতেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছে না।

অন্যান্য বছরের বড়দিনের উৎসবের সাথে এবারের বড়দিনের কোন মিল নেই। দোকানগুলো শূন্য, আলো নেই। মিষ্টির দোকানে চোখে পড়ে নকল চকলেট, আর নয়তো কালি ঠোঙ্গা। ট্রাম যাত্রীদের চোখমুখে ফুটে আছে উদাসীনতার ছাপ। এ-বছর শুধু। বড়লোকরাই এই উৎসব উদযাপন করল, তবে প্রকাশ্যে নয়। লজ্জায়, লুকিয়ে লুকিয়ে দোকানের পিছনে বসে অথবা নিজের ঘরের মধ্যে বসে মদ খেলো। গির্জায়, আনন্দগীতির চেয়ে প্রার্থনাই বেশি করে করা হলো।

এক সন্ধ্যায় হাসপাতালে কাজ করতে এল না গ্রাঁদ। এতে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল রিও। সকালে উঠেই ওর বাসায় গিয়ে হাজির হলো ও। কিন্তু গ্রাঁদকে খুঁজে পেল না কোথাও। ওকে খোঁজার জন্যে সবাইকে অনুরোধ করে এল রিও।

সন্ধ্যায়, র‍্যাঁবেয়া হাসপাতালে এসে বলল অনেক দূর থেকে এক মুহূর্তের জন্যে গ্রাঁদকে দেখতে পেয়েছিল ও; উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাফেরা করছিল, চেহারাও কেমন বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল; কিন্তু চোখে পড়তে না পড়তেই ভিড়ের ভেতর হারিয়ে যায় ও, অনেক চেষ্টা করেও র‍্যাঁবেয়া ওকে খুঁজে বের করতে পারেনি। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নিয়ে বেরোল তারিউ এবং রিও।

ভীষণ ঠাণ্ডা বাতাস বইছে তখন। একটা কাঠের খেলনার; দোকানের সামনে গ্রাঁদকে দেখতে পেল রিও। আলমারির কাছে মুখ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গ্রাঁদ, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। দেখেই ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠল রিও-র হৃদয়। এই নীরব অশ্রুপাতের কারণ খুব সহজেই বুঝতে পারল ও। 

মুহূর্তের মধ্যে বহুদিনের পরিচিত একটা দৃশ্য ভেসে উঠল ওর চোখের সামনে। গল্পটা গ্রাঁদই ওকে বলেছিল। এক বড়দিনের উৎসবে সুন্দর পোশাক পরে একটা দোকানের কাঁচের আলমারির সামনে দাঁড়িয়েছিল গ্রাঁদ এবং জেনি। হঠাৎ আবেগের জোয়ারে। জেনি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, কত সুখী আমি। রিও অনুভব করল, গ্রাঁদ-এর কানে বাজছে এখন জেনির সেই কণ্ঠ। গাঁদ। কী ভাবছে সেটাও অনুভব করতে পারল ও। মানুষের জীবনে এমন মুহূর্ত আসে যখন কাজের দায়িত্ব, কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠা সবকিছুকে মনে হয় ক্লান্তিকর, বেদনাদায়ক বোঝ।

কাঁচের ওপর রিও-র প্রতিফলন দেখতে পেল গ্রাঁদ। তখনও নীরবে কাঁদছে ও। এবার ঘুরে দাঁড়াল, দোকানের সামনে হেলান : দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল ওর জন্যে।

ডাক্তার, ডাক্তার…, আর কিছুই বলতে পারল না গ্রাঁদ। রিও-র মুখ দিয়েও কোন কথা বেরুতে চাইল না।

সবই বুঝতে পেরেছি। বুঝেছি আপনার দুঃখ কোথায়।

শুধু যদি একবার ওকে চিঠি লেখার সুযোগ পেতাম। শুধু একবার যদি ওকে জানাতে পারতাম…ও যেন সুখী হয়…মনের ভেতর কোন ক্ষোভ যেন পুষে না রাখে।

হাত ধরে ওকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে চলল রিও। গ্রাঁদও কোন বাধা দিল না। ভাঙা ভাঙা স্বরে বলল, ডাক্তার, সবাই জানে, আমি খুব শান্ত আর সাধারণ মানুষ। কিন্তু এটা প্রমাণ করার জন্যে কী কঠিন চেষ্টাই না করতে হয়েছে আমাকে। অথচ আজ, সেই চেষ্টাটুকু করার ক্ষমতাও আমার আর নেই।

অকস্মাৎ থমকে দাঁড়াল গ্রাঁদ। থরথর করে কাঁপছে ওর শরীর। জ্বর এলে যেমন হয় তেমনি জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটো। ওর একটা হাত মুঠোর ভেতর নিয়ে রিও-র মনে হলো প্রচণ্ড জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গ্রাঁদ-এর শরীর।

এক্ষুণি আপনাকে বাসায় ফিরতে হবে, বলল রিও। কিন্তু দৌড়াতে আরম্ভ করল গ্রাঁদ। কয়েক পা দৌড়ে থমকে দাঁড়াল ও দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে একবার এপাশে একবার ওপাশে দুলতে লাগল। তারপর একটা চক্কর খেয়ে পড়ে গেল ওখানেই। দুচোখ দিয়ে তখনও গড়িয়ে পড়েছে অশ্রু। চোখে-মুখে জমেছে ময়লা। পথচারীদের কেউ কেউ থেমে দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে দৃশ্যটা, তারপর আগের মতই এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে, কাছে আসার সাহস করল না কেউ। রিও এসে ওকে তুলে নিয়ে গেল গাড়িতে।

বিছানায় শুয়ে আছে গ্রাঁদ। শ্বাস নিতে পারছে না, ফুসফুস বন্ধ হয়ে আসছে। চিন্তায় পড়ে গেল রিও। বাড়িতে কোন লোকজন নেই। তাই ওকে হাসপাতালে নেয়ার দরকার নেই। তারিউ সাথে থাকলে ওরা দুজনেই ওর দেখাশোনা করতে পারবে।

বালিশের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে গ্রাঁদ-এর মাথাটা। দুই গালে একটা ধূসর সবুজাভা। চোখ দুটো ঘোলাটে, দৃষ্টিহীন। একটা ভাঙা পুরনো কাঠের বাক্স দিয়ে আগুনের ব্যবস্থা করছে তারিউ। সেই দিকে তাকিয়ে আছে গ্রাঁদ। আমার অবস্থা বোধহয় খুব খারাপ, বিড়বিড় করে বলল ও। কথা বলার সময় ফুসফুস দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ বের হচ্ছে। ওকে কথা বলতে নিষেধ করল রিও। যাওয়ার সময় কথা দিল খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে ও। একটু ফাঁক হলো গ্রাঁদ এর ঠোঁট দুটো। এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল সেই ফাঁকে। ডাক্তার, টুপি খুলে অভিবাদন জানাচ্ছি, আবার যেন সুস্থ হয়ে উঠতে পারি, কথাগুলো শেষ করতে না করতেই আবার নেতিয়ে পড়ল গ্রাঁদ।

কয়েক ঘণ্টা পর ওরা ফিরে এসে দেখে বিছানায় হেলান দিয়ে উঠে বসেছে গ্রাঁদ। আগের চেয়ে ওকে অনেক শান্ত মনে হচ্ছে। টেবিলের ড্রয়ার থেকে ওর লেখার পাণ্ডুলিপিটা বের করার জন্যে ওদের অনুরোধ করল ও।

তারিউ পাণ্ডুলিপিটা ওর হাতে দিতেই ও ওটাকে নিজের বুকের ওপর চেপে ধরল। তারপর রিও-র হাতে দিয়ে ইশারায় ওকে অনুরোধ করল পড়তে। পঞ্চাশ পৃষ্ঠার মত পাণ্ডুলিপিটা। বেশির ভাগ পাতায় একই কথাকে বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে লেখার চেষ্টা করা হয়েছে। মে মাস, এক অশ্বারোহিণী মহিলা, বল্গনা অ্যাভিন, এ-কথাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে; বিভিন্ন ভাবে তাদের সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এ ছাড়াও আছে অনেক নোট, ব্যাখ্যা। শেষ পাতার নিচে অত্যন্ত পরিষ্কার করে লেখা প্রিয়তমা জেনি, আজ বড়দিন…আর…। পাতার ওপরে লেখা ওর সেই প্রিয় বাক্যটির সর্বশেষ সংশোধিত রূপ। পড়ে দেখুন না, বলল গ্রাঁদ। রিও পড়ল: মে মাসের এক সুন্দর প্রভাতে ক্ষীণাঙ্গী তন্বী এক অশ্বারোহিণীকে বল্গনা অ্যাভিন ধরে উজ্জ্বল পাটল রঙের এক মাদি ঘোড়ায় চেপে অনেকেই যেতে দেখে থাকতে। পারেন। তার চারপাশে পুষ্পের…

এরকমই লেখা আছে, না? জ্বরে কাঁপছে গ্রাঁদ-এর স্বর। রিও ওর ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিল। বিছানায় ছটফট করতে লাগল গ্রাঁদ। হ্যাঁ। আমি জানি আপনি কী ভাবছেন এখন। সুন্দর শব্দটা ঠিক হয়নি। তাই… রিও খুব শক্ত করে চেপে ধরল ওর হাত দুটো।

থাক, ডাক্তার, থাক। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর সময় কোথায়…, প্রচণ্ড বেগে ওঠানামা করতে আরম্ভ করল ওর বুক। তারপর চিৎকার করে উঠল ও, পুড়িয়ে ফেলুন ওটাকে, পুড়িয়ে ফেলুন।

ইতস্তত করতে লাগল রিও। কিন্তু গ্রাঁদ ওর যন্ত্রণাকাতর গলা দিয়ে অত্যন্ত জোরে জোরে পুনরাবৃত্তি করতে লাগল কথাগুলো। চুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আগুনের মধ্যে পাণ্ডুলিপিটা ছুঁড়ে মারল রিও। দপ করে জ্বলে উঠল আগুন। আলোয় ভরে গেল ঘর। ওদের দিকে পিঠ ফিরে শুয়ে পড়ল গ্রাঁদ। দেয়ালে ঠেকল ওর মুখ। সিরাম দেয়া হলো ওকে। রাতটাও টিকবে কিনা সন্দেহ, তারিউ-এর কানে কানে বলল রিও। রাতে, ওখানেই থেকে গেল তারিউ।

সারারাত গ্রাঁদ-এর আসন্ন মৃত্যুর চিন্তায় ছটফট করল রিও। কিন্তু সকালে গিয়ে দেখে বিছানায় বসে আছে ও, গল্প করছে। তারিউ-এর সঙ্গে। জ্বর নেই। নেতিয়ে পড়ার ভাবটা ছাড়া রোগের অন্য কোন লক্ষণও নেই।

দেখুন, ডাক্তার, গ্রাঁদ বলল, আবার শুরু করব লেখাটা।

রিও তাকাল তারিউ-এর দিকে। ওকে তখন কুরেকুরে খাচ্ছে সন্দেহ। অপেক্ষা করে দেখা যাক কী দাঁড়ায়, বলল তারিউ।

দুপুরের পরেও অবস্থার পরিবর্তন হলো না। সন্ধ্যার পর গ্রাঁদকে সম্পূর্ণরূপে বিপদমুক্ত মনে হলো। এ ঘটনায় অভিভূত হয়ে পড়ল রিও। কিন্তু আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল ওর জন্যে। এর কয়েকদিন পর প্লেগ আক্রান্ত, এক মেয়েকে নিয়ে আসা হলো হাসপাতালে। পরীক্ষা করে ও দেখল বাঁচার কোন আশাই নেই মেয়েটার। মুমূর্ষ রোগীর ওয়ার্ডে পাঠানো হলো ওকে। মেয়েটা প্রলাপ বকছিল, এবং নিউমোনিয়া-প্লেগের সব লক্ষণই ছিল ওর মধ্যে। কিন্তু পরের দিন সকালে ওর জ্বর নেমে গেল। দুপুরেও তাপ বাড়ল না। পরের দিন সকালে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে আরম্ভ করল ও। পরের সপ্তাহে এ-ধরনের আরও চারটা কেস দেখতে পেল রিও।

সপ্তাহের শেষ দিনে তারিউ এবং রিও গেল সেই হাঁপানি রোগীর বাসায়। উত্তেজনায় ছটফট করছিল বুড়ো। বিশ্বাস করুন, ওগুলো আবার বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।

কার কথা বলছেন?

কেন, ইঁদুর।

এপ্রিলের পর থেকে একটা ইঁদুরও কারও চোখে পড়েনি, রিওকে বলল তারিউ। ওকে বেশ উদ্বিগ্ন দেখাল।

তার মানে আবার নতুন করে প্লেগ শুরু হতে যাচ্ছে? প্রশ্ন করল রিও।

অভ্যাসমত হাত কচলাতে আরম্ভ করল বুড়ো হাঁপানি রোগী। বুঝলেন, ডাক্তার সাহবে; ইঁদুরগুলো যেভাবে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে, সত্যি তা দেখার মত।

রিও নিজেও দুটো ইঁদুরকে বাইরের দরজা দিয়ে বাসার ভেতর কতে দেখল। ওর প্রতিবেশীরা অনেকেই ওকে বলল, তারাও ভাঁড়ার ঘরে আবার ইঁদুর দেখতে পেয়েছেন। কোন কোন বাসায় বশোনা গেল ইঁদুরের কিছু কিছু শব্দ।

প্রতি সোমবারে মৃত্যুর পরিসংখ্যান ঘোষণা করা হয়। গভীর আগ্রহে সেই ঘোষণা শোনার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল রিও। কিন্তু ঘোষণায় বলা হলো, মৃত্যুর সংখ্যা কমে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *