১ম পর্ব : আলজেরিয়ার উপকূলে ওরাওঁ শহর

দ্য প্লেগ – আলবেয়ার কামু; রূপান্তর: বাবুল আলম

দুটি কথা

বহু সমালোচকের মতেই ‘দ্য প্লেগ’ আলবেয়ার কামুর শ্রেষ্ঠ। উপন্যাস। এ উপন্যাসের জন্য ১৯৪৭ সালে তিনি প্রি দেস ক্রিটিকে পুরস্কার লাভ করেন। ‘দ্য প্লেগ’ মূলত প্রতীকী উপন্যাস। এ প্রতীক দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে ফ্রান্সে নাৎসি আগ্রাসান। কাম্যু ওই যুদ্ধে স্বাধীনতার স্বপক্ষে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছিলেন। দুটি কাহিনী কখনও সমান্তরালভাবে, আবার কখনও-বা মিলেমিশে এ উপন্যাসে এগিয়েছে। একটিতে বর্ণিত হয়েছে প্লেগ-কবলিত ওরাওঁ-বাসীদের ভয়-ভীতি, সঙ্কট ও দ্বন্দ্বের কথা, অন্যটিতে ডাক্তার বার্নাড রিও-র অসম সাহসী সংগ্রামের। দ্য প্লেগ দুরূহজটিল বৃহৎ উপন্যাস। পাঠকদের পকেট সাশ্রয় এবং প্রকাশনা ব্যয় সংকোচনের স্বার্থে, মূলভাব অক্ষুণ্ণ রেখেই, উপন্যাসটি কিঞ্চিৎ সংক্ষেপিত করা হয়েছে। পাঠকবর্গ বিশ্বমানের এ উপন্যাসটির রসাস্বাদনে সক্ষম হলে আমার শ্রম সার্থক হয়েছে বলে মনে করব।

– বাবুল আলম (অনুবাদক)

লেখক পরিচিত

আলবেয়ার কাম্যু ১৯১৩ সালে আলজেরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম জীবন কাটে উত্তর আফ্রিকায়। সেখানে পেশা হিসেবে অনেক ধরনের কাজ করেন তিনি। তার একটি হচ্ছে, আলজেরীয় ফুটবলদলের পক্ষে খেলা। এরপর তিনি চলে আসেন ফ্রান্সে, এবং শুরু করেন সাংবাদিকতা। জার্মান হামলার সময় কাম্যু সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দেন। এ-সময়, তিনি একটি গোপন পত্রিকা-কম্বাট-সম্পদনা করেন। এরপর, রাজনীতি এবং সাংবাদিকতা ছেড়ে পুরোপুরিভাবে লেখায় মন দেন কামু। ১৯৫৮ সালে তাঁকে সাহিত্যের জন্যে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। ১৯৬০ সালের জানুয়ারি মাসে এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন যশস্বী এই ঔপন্যাসিক।

.

প্রথম পর্ব

১.০১

আলজেরিয়ার উপকূলে ওরাওঁ শহর। একটা বড় ফরাসি বন্দর। জেলা সদর। ১৯৪-সালে এখানেই ঘটে ঘটনাটি।

ওরাওঁকে দেখলে মনে হয় অদ্ভুত এক চেহারার ভূখণ্ডের ওপর। দাঁড়িয়ে আছে শহরটা। উপসাগরের মুখ থেকে ওপরে উঠে গেছে বিস্তৃত উন্মুক্ত মালভূমি। চারদিকে ঝকঝকে পাহাড়। তারই মাঝখানে ওরাওঁ। সমুদ্রের দিকে পিঠ ফেরানো, তাই শহর থেকে সমুদ্র চোখে পড়ে না।

ওরাওঁ-এ শীত আর গ্রীষ্ম দুটোই প্রচণ্ড। প্রকৃতিও অত্যন্ত নির্মম আর প্রতিকূল। রাত নামে হঠাৎ করে। সৌন্দর্য বলতে কিছুই নেই শহরে। গাছে লতা নেই। পাতায় নেই মর্মর। কবুতর চোখে পড়ে না। শোনা যায় না পাখির ডানার ঝটপটানি। জিনিসপত্তরের অভাব লেগেই আছে। আর আছে মানুষের মনে অভাববোধ। এখানে কখন যে ঋতু বদল হয়, বুঝতে হলে তাকিয়ে দেখতে হয় আকাশের চেহারা। বসন্ত আসার আগে দুটো ঘটনা ঘটে। শরীরে লাগে মৃদু বাতাসের ছোঁয়া, আর শতরতলি থেকে ফেরিঅলারা ঝুড়ি ভরে ফুল নিয়ে আসে শহরে। গরমের দিনে, সূর্যের প্রখর তাপে জ্বলে পুড়ে হাড়ের মত ঠনঠনে হয়ে ওঠে বাড়িঘর। ধূসর ধুলোর আস্তর জমে দেয়ালে দেয়ালে। শরৎকালে চারদিকে থিকথিক করে কাদা। কেবল শীতে, আবহাওয়াটা সত্যি সত্যি মনোরম হয়ে ওঠে।

অন্যান্য শহরে যা হয়, এখানেও মানুষ কাজকর্ম করে, প্রেম করে, মারা যায়। এবং এসব তারা করে প্রায় একই ঢঙে। সবকিছুর মধ্যে থাকে কেমন একটা তড়িঘড়ি আর নির্লিপ্ত ভাব।

জীবন এখানে ভীষণ একঘেয়ে, অবসাদময়। সবাই শুধু অভ্যাস চর্চা করে। মানুষ কঠোর পরিশ্রম করে কেবলমাত্র বড়লোক হওয়ার জন্যে। এখানে জীবনের প্রধান লক্ষ্য বাণিজ্য।

এখানে মানুষ আনন্দ উপভোগ করে খুব সহজ উপায়ে–প্রেমলীলায়, সমুদ্র স্নানে, সিনেমা দেখে। তবে সেগুলো ওরা বরাদ্দ রাখে শনিবার বিকেল এবং রোববারের জন্যে। বাকি দিনগুলোয় শুধু টাকা উপার্জন। সন্ধের পর অফিস থেকে বেরিয়ে কেউ কাফেতে বসে, কেউ পায়চারি করে, কেউ-বা হাওয়া খায় ব্যালকনিতে বসে।

ওরাওঁ একটা আধুনিক শহর। প্রেমলীলা বলতে এখানে যা বোঝায়, নারী এবং পুরুষ খুব তাড়াতাড়ি পরস্পরকে নিঃশেষ করে ফেলে। আর নয়তো থিতিয়ে থাকে নিরুত্তেজ দাম্পত্য জীবনে। অবকাশ এবং চিন্তাশক্তির অভাবে সত্যিকার প্রেমের উপলব্ধি ছাড়াই নারী পুরুষ পরস্পরকে ভালবাসে। যুবক-যুবতীদের আবেগ যেমন তীব্র তেমনি ক্ষণস্থায়ী।

মৃত্যুর সময় মানুষকে এখানে ভীষণ কষ্ট পেতে হয়। তাপে ঝলসানো দেয়ালের মধ্যে আটকা পড়ে মুমূর্ষ মানুষ মৃত্যুর দিন গোনে। অসুস্থ হলেই মানুষ এখানে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সবকিছু থেকে।

.

১.০২

এপ্রিল ১৬। সকাল। নিজের অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসছে ডাক্তার রিও, হঠাৎ সিঁড়িতে, কী যেন নরম মত একটা পায়ে ঠেকল তার। পা সরিয়ে দেখে, একটা ইঁদুর পড়ে রয়েছে। কোনকিছু চিন্তা ভাবনা না করে, যেমন নামছিল তেমনি নেমে গেল ডাক্তার। একেবারে নিচে এসে খেয়াল হলো, আরে ইঁদুরটা ওখানে এল কী করে? দারোয়ান মিশেলকে ও বলল, এক্ষুণি ওটাকে সরিয়ে ফেলো।

খবরটা মিশেল-এর কাছে ভয়ঙ্কর বলে মনে হলো। ও জোর দিয়ে বলল, না, না। ইঁদুর আসবে কোত্থেকে।

রিও বলল, আমি নিজের চোখে দেখেছি। সম্ভবত মরা।

বিশ্বাস এতটুকু টলল না মিশেল-এর। ঘরের ভেতর কোথাও তো আমি ইঁদুর দেখিনি। তাহলে বাইরে থেকে কেউ নিয়ে এসেছে। হবে কোন বখাটে ছোকরার কাজ।

সেদিনই সন্ধ্যার পর, নিজের ফ্ল্যাটে ওঠার পথে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে চাবি হাতড়াচ্ছে রিও, এমন সময় দেখল প্রকাণ্ড একটা ইঁদুর তেড়ে আসছে ওর দিকে। টলমল করছিল ইঁদুরটা। শীরর সম্পূর্ণ ভেজা। মাঝপথে থামল ওটা। সামলে নিল নিজেকে। এগিয়ে এল কয়েক পা। আবার থামল। তারপর কিচকিচ করতে করতে পড়ে গেল, মেঝের ওপর। ফাঁক হয়ে গেল ইঁদুরটার মুখ, ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল।

দ্রুত ওপরে উঠে এল রিও। ইঁদুরের রক্ত দেখে স্ত্রীর কথা মনে পড়ে গেল। এক বছর ধরে অসুস্থ ওর স্ত্রী। কাল, এক পাহাড়ী স্বাস্থ্যনিবাসে যাবে। ঘরে ঢুকে রিও দেখল স্ত্রী শুয়ে।

ওকে দেখে হাসি ফুটল মহিলার। জানো, আজ বেশ ভাল। লাগছে।

একটু ঘুমোবার চেষ্টা করো। কাল সকাল এগারোটায় নার্স আসবে। তোমরা দুপুরের ট্রেনে যাচ্ছ, রিওর কথাগুলো উপদেশের মত শোনাল। স্ত্রীর ভেজা কাঁপালে ঠোঁট বুলাল ও। তারপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল।

পরের দিন। এপ্রিল ১৭। সুকাল আটটা। কাজে যাচ্ছিল রিও। দারোয়ান মিশেল ওর কোটে ফুল গুঁজে দিয়ে জানাল, দুষ্টু ছোকরারা আরও তিনটা ইঁদুর ফেলে রেখে গেছে। তবে যাবে কোথায়, পাকড়াও করবই বাছাধনদের।

কথাটা শুনে একটু হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল রিও। গাড়িতে উঠে শহরতলির দিকে চলল সে। এদিকের রাস্তাগুলো নোংরা। তীক্ষ্ণ। দৃষ্টিতে ডাস্টবিনগুলো দেখতে লাগল সে। এক রাস্তাতেই, কয়েকটা ডাস্টবিনে, ডজন খানেক মরা ইঁদুর চোখে পড়ল ওর।

প্রথমে হাঁপানি রোগীর বাসায় গেল ও। ভদ্রলোক বৃদ্ধ, জাতিতে স্প্যানিশ। বিছানায় বসেছিল বৃদ্ধ। ঘাড়টা পেছন দিকে ফেরানো। টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে। ঘন ঘন হাঁচি দিচ্ছে। সামনে দুটো পাত্রে শুকনো মটরদানা। রিও ঘরে ঢোকার পর বৃদ্ধের স্ত্রীও ঢুকল। হাতে পানির গ্লাস।

ইনজেকশন দেয়া হতেই, হাঁপানির রোগী, ভদ্রলোক বলল, শুনেছেন, বেরিয়ে আসছে ওগুলো। আপনি দেখেছেন?

রিওকে ভদ্রলোকের স্ত্রী বুঝিয়ে বলল, ইঁদুরের কথা বলছে। আমাদের পাশের বাড়ির ভদ্রলোক তার দরজার সামনে তিনটাকে দেখেছে। মরা।

আচ্ছা। মনে হয় খিদের জ্বালায় বেরিয়ে আসছে, জবাব দিল রিও।

রোগীদের বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে রিও বুঝতে পারল, ইঁদুর মরা নিয়ে এই এলাকায় রীতিমত জল্পনা-কল্পনা আরম্ভ হয়েছে। তাড়াতাড়ি ফিরে এল সে।

নিচে দেখা হলো মিশেল-এর সঙ্গে। ও বলল, আপনার একটা টেলিগ্রাম এসেছে। ঘরে রেখে এসেছি।

রিও জানতে চাইল, আরও মরা ইঁদুর দেখেছ?

না, জানাল মিশেল।

টেলিগ্রাম এসেছে মা-র কাছ থেকে। জানিয়েছেন পরের দিন আসছেন। রি-ওর স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তিনিই ওর দেখাশোনা করবেন।

নার্স এসে গেছে। স্ত্রীর পরনে নতুন পোশাক। কিছু প্রসাধনও মেখেছে ও। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে, বলল রিও।

.

কয়েক মিনিট পর। ট্রেনের কামরায় স্ত্রীকে তুলে দিল রিও। ওর স্ত্রী বলল, ইঁদুর মরা নিয়ে কি হয়েছে বলো তো?

এখনও ঠিক বুঝছি না। তুমি সুস্থ হয়ে ফিরে এসো। দেখবে নতুন জীবন শুরু হয়েছে।

হিসহিস করে উঠল ট্রেনের এঞ্জিন। স্ত্রীকে নাম ধরে ডাকল রিও। মুখ ফেরাল মহিলা। তখন অশ্রু ঝরছে ওর চোখ দিয়ে। এ কী, কাঁদছ তুমি? ভেবো না, লক্ষ্মীটি। দেখবে আবার সুস্থ হয়ে উঠেছ। গাড়ি ছাড়ার সময় হলো। চলি। স্ত্রীকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরল ও, তারপর পিছিয়ে প্ল্যাটফর্মে উঠে পড়ল আবার। এখন কেবল জানালায় ওর হাসিমুখ দেখতে পাচ্ছিল রিও।

শরীরের যত্ন নিও, স্ত্রীকে বলল সে। কিন্তু ওর কথা মহিলা শুনতে পেল না।

ট্রেন স্টেশন ছেড়ে চলে যাবার পর খুব দ্রুত প্ল্যাটফরম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল রিও, গেটে দেখা হয়ে গেল পুলিস ম্যাজিস্ট্রেট মশিয়ে অথন-এর সঙ্গে।

শুনছি, আজকাল ইঁদুর…, বলতে বলতে থেমে গেলেন অথন।

কী যেন বলছিলেন আপনি? প্রশ্ন করল রিও।

না। তেমন কিছু নয়।

সেই মুহূর্তে রিও দেখল, রেলের এক কর্মচারী কাঠের একটা বাক্স নিয়ে যাচ্ছে। মরা ইঁদুর ভর্তি।

সেদিনই বিকেলে, রিও সবে রোগী দেখতে শুরু করেছে, ওর সঙ্গে দেখা করতে এল অপরিচিত এক যুবক। একজন পেশাদার সাংবাদিক। নাম র‍্যাঁবেয়া। মোটা। বেঁটে। পেশীবহুল চওড়া কাঁধ। মুখে দৃঢ়তার ছাপ। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। পরনে খেলোয়াড়দের মত হালকা ফিটফাট পোশাক। প্যারিসের এক দৈনিক কাগজের প্রতিনিধি। হিসেবে এসেছে। উদ্দেশ্য, এখানে বসবাসকারী সাধারণ আরবদের জীবনযাত্রা স্বচোখে দেখা।

রিও বলল, ওদের জীবনযাত্রার মান তেমন উন্নত নয়। এরপর জানতে চাইল, আচ্ছা, সত্যি কথা প্রকাশের স্বাধীনতা আপনার আছে?

খুব বেশি না, স্বীকার করল র‍্যাঁবেয়া।

তাহলে আর কিছু লেখার কোন দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। তাই আপনার রিপোর্টের জন্যে তথ্য দিতে আমার আপত্তি আছে।

হাসল র‍্যাঁবেয়া। আপনি তো দেখছি একজন পয়গম্বর।

আমি প্রতিজ্ঞা করছি, কখনোই অন্যায়ের সংস্পর্শে যাব না বা কোন অবস্থাতেই সত্যের অপলাপ করব না।

চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল র‍্যাঁবেয়া। ধন্যবাদ। আপনার মনোভাব বুঝতে পেরেছি।

রিও দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিল ওকে। আপনি বুঝতে পেরেছেন, সেজন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। শহরে খুব বেশি সংখ্যায় ইঁদুর মারা যাচ্ছে। এটার ওপর লিখতে পারেন। নতুনত্ব আছে।

তাই? বিস্ময় প্রকাশ করল র‍্যাঁবেয়া।

বিকেল পাঁচটা। নিচে নামছিল রিও। শহরতলিতে রোগী দেখতে যাবে। সিঁড়িতে দেখা হলো অল্পবয়স্ক এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। বলিষ্ঠ শরীর। বিশাল মুখ। রোমশ জ, কোঁচকানো। নাম জাঁ তারিউ। সিঁড়িতে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে একটা ইঁদুর, সেদিকে তাকিয়ে সিগারেট টানছে তারিউ। রিওকে শুভসন্ধ্যা জানিয়ে, ও বলল, ইঁদুরগুলো দলে দলে গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে মরছে।

হ্যাঁ। ঠিক বলেছেন, সায় দিল রিও।

কপালে পড়ে থাকা চুলগুলোকে উল্টিয়ে বার কয়েক আঙুল

চালাল তারিউ। বারবার ইঁদুরটার দিকে তাকাচ্ছে ও। ততক্ষণে : নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেছে ওটার। রিও-র দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, এ নিয়ে অবশ্য দারোয়ানেরই মাথাব্যথা হওয়া উচিত।

সিঁড়ির মাথায় মিশেল-এর সঙ্গে দেখা হলো রি-ওর। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে। লালচে চেহারাটা কেমন শুকনো, মলিন।

রিও বলল, মিশেল, সিঁড়িতে একটা ইঁদুর মরে পড়ে আছে।

হ্যাঁ। জানি, বলে চলল মিশেল, মাঝে মাঝে দুতিনটিকেও একসঙ্গে মরতে দেখছি। সব বাড়িতেই এক অবস্থা। হঠাৎ ওকে মনে হলো উদ্বিগ্ন, হতাশ। অন্যমনস্কভাবে গলা চুলকাল ও।

মিশেল, তোমার শরীর ভাল তো? জানতে চাইল রিও।.

অসুখ-বিসুখ হয়তো করেনি, তবে শরীরটা ভাল লাগছে না। বোধহয়, মরা ইঁদুর দেখতে দেখতে আমার মনের ওপর চাপ পড়েছে।

পরের দিন। এপ্রিল ১৮। সকাল। স্টেশন থেকে মাকে নিয়ে ফিরল রিও। মিশেলকে দেখে ওর মনে হলো লোকটা আগের চেয়ে অসুস্থ, মনমরা। এ সময় ওর চোখে পড়ল, সিঁড়ির নিচ থেকে চিলেকোঠা পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে মরা ইঁদুর। আসার সময় রাস্তার ডাস্টবিনগুলোতেও একই দৃশ্য দেখেছে ও।

বাড়িতে ঢুকেই মিউনিসিপ্যাল অফিসে টেলিফোন করল রিও। কীট-পতঙ্গ ধ্বংস করার দফতরটির কর্মকর্তার সঙ্গে আগের থেকেই পরিচয় আছে ওর। রিও জানতে চাইল, ইঁদুর মরার খবর আপনি জানেন?

ভদ্রলোক বলল, হ্যাঁ। জানি। বন্দরের কাছে পঞ্চাশটার মত মরা ইঁদুর দেখা গেছে। আমি ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছি। এরপর সে জানতে চাইল, আচ্ছা, ব্যাপারটা কি আশঙ্কাজনক?

এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিভাগের ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

আপনি যদি তাই মনে করেন তাহলে আমি কর্তৃপক্ষকে বলে, একটা নির্দেশ জারি করার ব্যবস্থা নিতে পারি।

এক্ষুণি করিয়ে নিন, জোর দিয়ে বলল রিও।

কিছুক্ষণ পর ওর বাসার ঝি খবর দিল, ওর স্বামী যে কারখানায় কাজ করে সেখানে কয়েকশো ইঁদুর মরতে দেখা গেছে।

১৮ এপ্রিলের পর থেকে শহরে আরম্ভ হলো উদ্বেগ। রোজ মানুষের চোখে পড়তে লাগল কলকারখানা আর গুদামে মরে পড়ে আছে অসংখ্য ইঁদুর, আর নয়তো মৃত্যু যন্ত্রণায় ধুকছে।

রোগী দেখার জন্যে রিওকে ঘুরতে হয় শহরতলিতে, উপকণ্ঠে, কেন্দ্রস্থলে, অপরিচিত অলিগলি আর বড় রাস্তায়। সব জায়গায় মরা ইঁদুর দেখতে পেল সে। অগণিত মরা ইঁদুর। কোথাও নর্দমায়, কোথাও-বা ডাস্টবিনে।।

জরুরী সভা ডাকলেন পৌর কর্তৃপক্ষ। নির্দেশ দেয়া হলো জনস্বাস্থ্য বিভাগকে: প্রতিদিন সকালে, শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে মরা ইঁদুর কুড়িয়ে একখানে জড়ো করতে হবে। সেখান থেকে দুটো ভ্যান ওগুলোকে নিয়ে যাবে শহরের শেষ সীমানায়। ওখানে পোড়ানো হবে মরা ইঁদুগুলোকে।

কিন্তু অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে লাগল। বেড়ে চলল রাস্তায় পড়ে থাকা মরা ইঁদুরের সংখ্যা। আর সেই সাথে বেড়ে চলল ভ্যান দুটোর বোঝ। তিনদিন পর, বাড়ির ভেতর থেকে দলে দলে বেরিয়ে আসতে শুরু করল ইঁদুর। বাইরের আলোয় এসে প্রকাশ্যে মরতে লাগল, ওরা। তবু, শেষ হলো না ওদের বংশ। তারপরের দিন, সিঁড়িকোঠা, মাটির নিচে ভাড়ার ঘর, নর্দমা সব জায়গা থেকে সারিবদ্ধভাবে আলোয় বেরিয়ে এল ইঁদুরের পাল। প্রচণ্ড বেগে দুলছে ওদের শরীর। কেমন একটা অসহায় অবস্থা। এরপর হঠাৎ লেজের ওপর ভর করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল সবাই। কিন্তু তা আর পারল না। এর আগেই কাত হয়ে পড়ে মরে গেল।

রাতের বেলায়, বাড়ির দরজা, অলিগলি সবখান থেকে ভেসে এল মৃত্যুযন্ত্রণাকাতর কিচমিচ শব্দ। সকালে দেখা গেল, নর্দমা ভরে আছে সারি সারি মরা ইঁদুরে। প্রত্যেকটির মুখ সরু। আর এর চারপাশে তাজা লাল রক্তের ছোপ, মনে হয় যেন লাল একটা ফুল। কোনটাতে পচন ধরেছে, ফুলে উঠেছে শরীর; কোনটা সিটকে শক্ত হয়ে আছে, কিন্তু গোঁফ জোড়া এখনও চোখা, খাড়া হয়ে আছে।

কর্মব্যস্ত শহরের কেন্দ্রস্থলেও দেখা গেল ইঁদুর। কোথাও সিঁড়িতে, কোথাও বাড়ির পিছনে। কোন কোনটা দলছুট হয়ে ঢুকে পড়ে সরকারি অফিসে, স্কুলে, খেলার মাঠে, কাফের বারান্দায়।

শুধু সূর্য ওঠার সময় কিছুক্ষণ দেখা যায় না ওদের। সে সময় দৈনন্দিন আবর্জনা পরিষ্কারের কাজ চলে। এরপর, আবার আরম্ভ হয় ওদের বের হওয়া। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তেই থাকে। এভাবেই যায় সারাদিন। রাতে, রাস্তায় হাঁটলে পায়ের তলায় অনুভূত হয় বিজাতীয় একটি স্পর্শ। একটি ক্ষুদ্র গোলাকার প্রাণীদেহের উষ্ণ কোমল স্পর্শ।

২৫ এপ্রিল। বেতারে ঘোষণা করা হলো, এ কদিনে ছহাজার দুশো একান্নটা মরা ইঁদুর পাওয়া গেছে। এই অকল্পনীয় সংখ্যার কথা শুনে শহরবাসী দারুণ একটা আঘাত অনুভব করল স্নায়ুতে। ২৮ এপিল বেতার থেকে ঘোষণা করা হলো, প্রায় আট হাজারের মত মরা ইঁদুর পাওয়া গেছে। একটা অজানা ত্রাস ছড়িয়ে পড়ল শহরবাসীর মনে। সবাই পালাতে চাইল উপকূল অঞ্চলে। ঠিক পরের দিন সকালে বেতারে বলা হলো, ইঁদুর মরা কমতে শুরু করেছে। বেশ কয়েকদিন পর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল শহরবাসী।

সেদিন দুপুরে গ্যারেজে গাড়ি ঢোকাচ্ছে রিও, এমন সময় সে দেখল, একজন পাদ্রির কাঁধে ভর দিয়ে কোনরকমে ওর দিকে হেঁটে আসছে মিশেল। সামনে ঢলে পড়েছে মাথা। হাত পা কেমন বাঁকা বাঁকা দেখাচ্ছে। দম দেয়া পুতুলের মত ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগোচ্ছে। পাদ্রির নাম ফাদার প্যানালু। ওরা কাছে না আসা পর্যন্ত গাড়িতেই বসে রইল রিও। কাছে আসতেই ও দেখল, মিশেল-এর চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল। নিশ্বাসের সাথে ওর নাক দিয়ে বেরিয়ে আসছে বিশ্রী একটা শব্দ।

বহু কষ্টে মিশেল বলল, আমার চোখমুখ কেমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল। তাই হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলাম। এমন সময় শরীরের সব জায়গায় ব্যথা অনুভব করলাম। ঘাড়ে, দুই বগলে আর  পুরুষাঙ্গে।

রিও হাত বুলিয়ে দেখল, ওর ঘাড়টা গিঁট পড়ার মত শক্ত, বেশ ফুলে উঠেছে। ও বলল, মিশেল, তুমি বাসায় গিয়ে শুয়ে থাকো। আমি বিকেলে তোমাকে দেখতে আসব।

মিশেল চলে যাওয়ার পর, রিও ফাদারের কাছে জানতে চাইল, ফাদার, ইঁদুর মরা সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?

আমার তো মনে হয় মহামারী শুরু হয়েছে। চশমার বড় বড় কাঁচের আড়ালে জ্বলজ্বল করে উঠল ফাদার প্যানালুর চোখ।

বাড়ি ফিরে স্বাস্থ্যনিবাস থেকে পাঠানো স্ত্রীর টেলিগ্রামে চোখ বুলাচ্ছে রিও, হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল। ভদ্রলোক ওর একজন পুরনো, রোগী। নাম জোসেপ গ্রাঁদ। মিউনিসিপ্যাল অফিসের কেরানি। আর্থিক অবস্থা ভাল না। তাই চিকিৎসার জন্যে রিও কোন ফি নেয় না ওর কাছ থেকে।

ডাক্তার সাহেব, আমার এক প্রতিবেশীর হঠাৎ এক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আপনাকে এক্ষুণি প্রয়োজন। এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে হাঁপাতে লাগল ভদ্রলোক।

কয়েক মিনিট পর, শহরের প্রান্তে, একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে গিয়ে পৌঁছুল রিও। নোংরা সিঁড়ি, দুর্গন্ধে ভরা। অর্ধেক পথ ওপরে উঠে ও দেখল, ওকে নেয়ার জন্যে খুব দ্রুত নেমে আসছে গ্রাঁদ। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স লোকটার। বেশ লম্বা। হাঁটার সময় সামনে ঝুঁকে পড়ে শরীর। কাঁধ সরু। হাত-পা লিকলিকে। গোঁফ হলুদ, বিবর্ণ।

ডাক্তার সাহেব, ওর অবস্থা এখন একটু ভাল। প্রথমে দেখে ভেবেছিলাম, হয়তো ওকে আর ফেরাতে পারব না, কথাগুলো বলে কয়েকবার নাক ঝাড়ল গ্রাঁদ।

তিনতলায় পৌঁছে রিও দেখল বাঁ দিকের একটা দরজায় লাল চক দিয়ে লেখা: ভেতরে আসুন। গলায় দড়ি দিয়েছি।

ঘরের ভেতর ঢুকল ওরা। মাঝখানে একটা চেয়ার কাত হয়ে। পড়ে আছে। ছাদের হুক থেকে ঝুলছে দড়ি। খাবার টেবিলটা এক কোণে সরানো।

ডাক্তার সাহেব, আমি তখন বাইরে যাচ্ছিলাম। এই ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পেলাম ভেতর থেকে কেমন একটা চাপা গোঙানির শব্দ আসছে। এমন সময় ওই লেখাগুলোর ওপর আমার চোখ পড়ল। ঠিক তখুনি শুনতে পেলাম, ভেতর থেকে কে যেন আর্তনাদ করে উঠল। শুনে রক্ত হিম হয়ে গেল আমার। তারপর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। যাক, সময় থাকতে ওকে নামাতে পেরেছি। না হলে, মাথা চুলকাতে লাগল গ্রাঁদ।

দরজা ঠেলে পাশের, কামরায় ঢুকল ওরা। ঘরটা পরিষ্কার ঝকঝকে। আসবাবপত্র বলতে তেমন কিছু নেই। একটা খাটের ওপর শুয়ে আছে একজন লোক। মনে হয় অসুস্থ। ঘন ঘন শ্বাস টানছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকাল. সে। চোখ রক্তবর্ণ। রিও-র মনে হলো লোকটার শ্বাস-প্রশ্বাসে ইঁদুরের কিচমিচ শব্দ শুনতে পাচ্ছে ও। ওর শরীরের কোথাও কোন আঘাতের চিহ্ন নেই। ওকে অভয় দিয়ে রিও বলল, আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। দুএকদিনের মধ্যেই সেরে উঠবেন।

অনেক ধন্যবাদ, ডাক্তার সাহেব। লোকটার গলার স্বর ক্ষীণ।

গ্রাঁদ-এর কাছে রিও জানতে চাইল, পুলিসে খবর দিয়েছেন?

মাথা নত করল.গ্রাঁদ। বলল, না, এখনও জানাইনি। ভাবলাম, প্রথমে ডাক্তারকে…। ওকে থামিয়ে রিও বলল, ঠিক আছে। দেখা যাক কী করা যায়।

ওদের কথাবার্তা শুনে আতঙ্ক দেখা দিল লোকটার মাঝে। সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় উঠে বসল সে। বলল, ডাক্তার সাহেব, আমি এখন ভাল আছি।

আপনি ভয় পাবেন না। এতে ভয় পাবার কিছু নেই। আইনের খাতিরে এটা করতেই হবে। তাছাড়া, পুলিসকে জানান, আমার কর্তব্য, ওকে বুঝিয়ে বলল রিও।

ওহ, কান্নায় ভেঙে পড়ল লোকটা।

গোঁফে হাত বোলাতে বোলাতে গ্রাঁদ বলল, মশিয়ে কটার্ড, শাস্তু হোন। আপনি যদি এর পরে উল্টোপাল্টা কিছু করেন, তখন সব দোষ পড়বে ডাক্তার সাহেবের ঘাড়ে, বুঝতে পারছেন।

কটার্ড-এর চোখ ভরে উঠল কান্নায়। বারবার বলল সে, বিশ্বাস করুন, এ ধরনের আর কিছু ঘটবে না। তখন পাগলামি চেপেছিল, আমার মাথায়। আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। : প্রেসক্রিপশন লিখে কটার্ড-এর হাতে দিল রিও। বলল, বেশ, আপনার অনুরোধ রাখব। আপাতত জানাব না কাউকে। দিন দুই পর আবার এসে দেখে যাব আপনাকে। কিন্তু আপনি আর ছেলেমানুষী করবেন না।

সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রিও গ্রাঁদকে বলল, শুনুন, পুলিসে খবর দিতে আমি বাধ্য, তবে অফিসারকে অনুরোধ করব তিনি যেন তদন্তটা কয়েকদিন মুলতবি রাখেন। রাতে কারও থাকা দরকার। আত্মীয়স্বজন কেউ নেই ওর?

কাউকে তো দেখছি না। আমিও ভাল চিনি না ওকে। অবশ্য আজ রাতটা থাকতে পারি, সৎ প্রতিবেশীর মত কথাটা বলল গ্রাঁদ।

নিচে নামার সময় নিজের অজান্তেই সিঁড়ির অন্ধকার কোণগুলোয় নজর বোলাল রিও। গ্রাঁদ-এর কাছে ও জানতে চাইল, আচ্ছা, আপনাদের অঞ্চলে ইঁদুর মরা কমেছে? |||||||||| সুস্পষ্ট করে কিছু বলতে পারল না গ্রাঁদ। ভাসা-ভাসা কিছু এ-ব্যাপারে সে শুনেছে বটে, কিন্তু গুজবে কান দেয়া ওর স্বভাব নয়। তাছাড়া, এমনিতেই ভীষণ ব্যস্ত লোক সে।

ফেরার তাড়া ছিল রিও-র। স্ত্রীকে চিঠি লিখতে হবে। তবে সবার আগে যেতে হবে দারোয়ানের বাসায়। গ্রাঁদ-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে পথে নামল ও।

রিও শুনতে পেল, হকাররা সেদিনের তাজা খবর হেঁকে বেড়াচ্ছে। শহরের ইঁদুরের আর কোন চিহ্ন নেই। এখন সম্পূর্ণ বন্ধ। হয়েছে ইঁদুর মরা।

মিশেল-এর ঘরে ঢুকে রিও দেখল, একটা হাত দিয়ে পেট চেপে ধরে আছে ও। আর এক হাত দিয়ে ঘাড়। সেই অবস্থায় বমি করছে। রঙ, ফিকে গোলাপী। বমি করার পর হাঁপাতে লাগল মিশেল। এর পর বিছানার ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল।

থার্মোমিটার লাগিয়ে রিও দেখল একশো তিন ডিগ্রীর কাছাকাছি জ্বর মিশেল-এর। ওর গলা ফুলে উঠেছে, এবং শরীরের আরও অনেক জায়গার গ্রন্থি। দুই উরুতে ক্রমশ ফুটে উঠছে কালো কালো চাকা। মিশেল জানাল, শরীরের বেশ কয়েক জায়গায় যন্ত্রণা হচ্ছে ওর। আগুন, মনে হচ্ছে আমার গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে কেউ। অত্যধিক জ্বরে শুকিয়ে এসেছে ওর ঠোঁট; মুখ দিয়ে কথা বেরুতে চাইছে না; চোখের কোটর ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মণি দুটো। বার কয়েক বলল মিশেল, তার ভীষণ তেষ্টা পাচ্ছে।

মিশেল-এর বৌ উদ্বেগের সঙ্গে শুধাল, ডাক্তার সাহেব, দয়া করে বলুন, ওর কী হয়েছে?

ঠিক বলতে পারছি না। অনেক কিছুই হতে পারে। এখন থেকে হালকা খাবার খাওয়াবে। আর যত পানি চাইবে, দেবে।

বাসায় ফিরে ডাক্তার রিচার্ডকে টেলিফোন করল রিও। রিচার্ড ওর সহকর্মী, ভীষণ জমজমাট পশার। না, না। অস্বাভাবিক তেমন কিছু এখন দেখিনি, জানাল রিচার্ড।

ভীষণ জ্বর। জ্বালাপোড়া আছে। শরীরের কোথাও কোথাও ফোলা। এমন রোগী…?

হ্যাঁ। হ্যাঁ। মনে পড়েছে। এরকম দুজনকে দেখেছি।

সে রাতে মিশেল-এর জ্বর পৌঁছল একশো চারে। সারাক্ষণ প্রলাপ বকল ও। ওই ইতরগুলো… ওই ইতর ইঁদুরগুলো… ওই ইতরগুলোই এই সর্বনাশটা করেছে আমার।

মিশেল-এর বৌকে রিও বলল, আজ রাতে তোমাকে ওর পাশে : থাকতে হবে। খারাপ কিছু দেখলে আমাকে খবর দিও।

পরের দিন, ৩০ এপ্রিল। আগের দিনের চেয়ে রাস্তাঘাটে কোলাহল আজ অনেক বেশি। ইঁদুর মরা বন্ধ হওয়ার খবর শুনে। সবাইকে মনে হচ্ছে উচ্ছল, মুখর, আনন্দিত।

রিও-র মনও আজ বেশ হালকা। সকালের প্রথম ডাকেই স্ত্রীর চিঠি পেয়েছে। মিশেল-এর বাসায় এসে ও দেখল ওর জ্বর নিরানব্বইয়ে নেমে গেছে। কিছুটা দুর্বল দেখাচ্ছে, তবে হাসছে এখন।

আমার মনে হচ্ছে ও আজ অনেকটা সুস্থ। আপনি কী বলেন? জানতে চাইল মিশেল-এর বৌ।

হতে পারে। তবে এত তাড়াতাড়ি কিছুই বলা যায় না, উত্তর দিল রিও।

রিও-র কথাই ঠিক হলো। দুপুরে মিশেল-এর জ্বর লাফিয়ে উঠল একশো চারে। আবার দেখা দিল বিকার, বমি; অসম্ভব রকম ফুলে উঠল শরীরের গ্রন্থিগুলো; সামান্য ছোঁয়ায় যন্ত্রণা হচ্ছে এখন। রিও, লক্ষ করল, মাথাটাকে উঁচু করে ধরে রাখার চেষ্টা করছে মিশেল।

মিশেল-এর বৌকে রিও বলল, ওকে এখুনি হাসপাতালে নিতে হবে। অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর জন্যে ফোন করছি।

দুইঘণ্টা পর। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর শুয়ে আছে মিশেল, মুখ হাঁ করে। দুই কষে ময়লা জমেছে। বিড়বিড় করে চলেছে ও, ওই ইতর ইঁদুরগুলো। ওগুলোকে জাহান্নামে পাঠাব। ওরাই আমার এই সর্বনাশটা করল।

হাসপাতালে, যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেল ওর মুখ। রক্তহীন ঠোঁট দুটো শুকিয়ে খটখটে হয়ে উঠল। অনেকক্ষণ বিরতি দিয়ে টেনে টেনে শ্বাস নিতে লাগল। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ল ওর হাত পা। মনে হলো বিছানার সঙ্গে মিশে যেতে চাইছে মিশেল।  কোন আশা নেই, ডাক্তার? মিশেল-এর পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে কাঁদছে ওর বৌ।

না। ও মারা গেছে।

.

১.০৩

ইঁদুর মরার ঘটনায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল শহরবাসী, মিশেল-এর |||||||||| মৃত্যুর ঘটনায় ওরা হলো আতঙ্কিত। দুটো ব্যাপারই ওদের কাছে মনে হলো অবিশ্বাস্য, অসম্ভব।

জাঁ তারিউ ওরাওঁ-এর বাসিন্দা নয়। ইঁদুর মরার ঘটনা আরম্ভ হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে এখানে আসে সে। উঠেছিল শহরের এক বিরাট হোটেলে। এতে বোঝা যায় সে বেশ বড়লোক। আরও কতগুলো গুণ আছে ওর। ভাল সাঁতারু, কৌতুকপ্রিয়, ঠোঁটে সব সময় লেগে থাকে হাসি; জীবনকে উপভোগ করার সহজাত একটা আসক্তি আছে ওর।

প্রতিদিনের ঘটনা ডাইরিতে লিখে রাখত তারিউ। ওর ডাইরিতে সে সময়ের বেশ কিছু ঘটনার উল্লেখ আছে। ও লিখেছে :

জানালা দিয়ে রাস্তার ও-পারে একটা ছোট্ট গলি দেখতে পাই। সেখানে এক বাড়ির ব্যালকনিতে রোজ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটত।

গলির দেয়া লর ছায়ায় ঘুমোয় বেশ কিছু বেড়াল। প্রতিদিন দুপুরের খাওয়ার পর ব্যালকনিতে আসেন এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। তার। হাবভাব সৈনিকের মত। শরীরটা সব সময় টান টান করে রাখেন। পোশাকও সৈনিকদের মত। মাথার ধবধবে সাদা চুল সব সময় আঁচড়ানো থাকে।

ব্যালকনিতে ঝুঁকে, তিনি ডাকেন: পুষি, পুষি। বেড়ালগুলো ঘুমজড়ানো চোখে তার দিকে তাকায়। কিন্তু ওঠার কোন লক্ষণ দেখা। যায় না ওদের মধ্যে।

বৃদ্ধ এরপর কাগজ কুচি কুচি করে ছিঁড়ে টুকরোগুলো ছুঁড়ে মারেন নিচে। এবার, ওগুলোকে ধরার জন্যে এগিয়ে যায় বেড়ালগুলো। থাবা উঁচিয়ে ধরার চেষ্টা করে।

এ সময় বেড়ালগুলোকে থুতু ছিটান বুড়ো ভদ্রলোক। থুতু ওদের গায়ে লাগার সঙ্গে সঙ্গে খুশিতে ডগমগ করে ওঠেন তিনি।

এগুলো শহরে ইঁদুর মরা শুরু হওয়ার আগের ঘটনা। যখন ইঁদুর মরা আরম্ভ হলো সে-সময় জাঁ তারিউ লিখেছে:

আজ ব্যালকনির বুড়োর চেহারায় কেমন হতাশার ভাব। গলির ছায়ায় বেড়ালগুলোকে দেখতে পাচ্ছি না। রাস্তায় মরা ইঁদুর দেখে হয়তো শিকারী স্বভাব মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে ওদের। ভীষণ মনমরা হয়ে আছেন বুড়ো। চুল আঁচড়াননি। সৈনিকের ভাবভঙ্গি নেই। মনে মনে বেশ উদ্বিগ্ন।

কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে ঘরে ফিরে গেলেন তিনি। ফেরার আগে থুতু ছিটালেন রাস্তায়। কিন্তু আজ থুতুর দলা পড়ল শূন্য রাস্তার মাঝখানে।

তারিউ-এর ডাইরির এক জায়গায় লেখা ছি। আজ একটা ট্রামকে রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ থেমে পড়তে দেখলাম। ট্রাম থামতেই তড়িঘড়ি নেমে পড়ল তিনজন তরুণী। পরে শুনেছিলাম, ট্রামের ভেতর একটা মরা ইঁদুর পাওয়া গিয়েছিল।

তারিউ যে হোটেলে থাকত তার পাহারাদার সম্পর্কে ও লিখেছে: একদিন পাহারাদার আমাকে বলল, এভাবে দলে দলে ইঁদুর বেরিয়ে আসার অর্থ সামনে বিপদ আসছে। কী ধরনের বিপদ? আমি ওর কাছে জানতে চাইলাম। তা কেমন করে বলব? তবে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হলেও অবাক হব না। উত্তর দিল ও।

এক পরিবারের কথা লিখেছে তারিউ। আমাদের হোটেলে খেতে। আসে। দেখতে অদ্ভুত লাগে ওদের। কর্তা রোগা, দীর্ঘদেহী। পরনে কালো কোট-প্যান্ট। এই রঙের কোন বদল হয় না। কড়া ইস্ত্রি করা শার্টের কলার কড়কড়ে। মাথায় বিশাল টাক। ছোট ঘোট চোখ। ছুঁচালো নাক। মুখটা প্যাচার মত। নাম মশিয়ে অথন। পুলিস ম্যাজিস্ট্রেট। হোটেলের দরজায় প্রথমে তাকেই দেখতে পাই। কিন্তু তারপর একটু পাশে সরে দাঁড়ান তিনি। হোটেলে প্রথমে ঢোকেন তাঁর স্ত্রী।

ভদ্রমহিলা ক্ষীণাঙ্গী। দেখতে অনেকটা কালো ইঁদুরের মত। স্ত্রীর পর ঢোকেন_মশিয়ে অথন। এরপর, তাদের অনুসরণ করতে করতে ঢোকে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। দেখলে মনে হয় এক জোড়া পুতুল।

খাবার টেবিলের সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন মশিয়ে অথন। প্রথমে বসেন তাঁর স্ত্রী। তারপর বসে বাচ্চা দুটো। সবার শেষে মশিয়ে অথন।

আজ দেখলাম, ইঁদুর মরার ব্যাপার নিয়ে কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠেছে ছেলেটা। এ সম্পর্কে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ও। কিন্তু ধমকে উঠলেন মশিয়ে অথন। ফিলিপস, তোমার বোঝা উচিত, খাবার টেবিলে কেউ ইঁদুর নিয়ে কথা বলে না। তোমার বাবার কথাই ঠিক। প্যাঁচা-স্বামীকে সমর্থন করলেন ইঁদুর-পত্নী। খুদে পুতুল দুটো এরপর যতদূর সম্ভব ওদের খাবার প্লেটের ওপর ঝুঁকে পড়ে নিজেদের মুখ আড়াল করে রাখল।

ওর হোটেলের ম্যানেজারের কথাও লিখেছে তারিউ। আজকাল ওকে ইঁদুর ছাড়া অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে খুব একটা কথা বলতে দেখি না। ওর তিন-তারা হোটেলে মরা ইঁদুর পাওয়া গেছে, এ জন্যে মনে মনে। ভীষণ ক্ষুব্ধ ও।

সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে ওকে একদিন বললাম, আমরা সবাই এখন একই নৌকার যাত্রী। ঠিক বলেছেন। বেশ খুশি মনে হলো। ম্যানেজারকে।

ওর মুখ থেকেই প্রথম আমি এক ধরনের জ্বরের কথা শুনলাম। জানাল, ওর হোটেলের একজন পরিচারিকাকে ওই রোগ ধরেছে। তারপর আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে ও বলল, আমার বিশ্বাস

রোগটা ছোঁয়াচে নয়। আমি বললাম, তাতে আমার নিজের কিছু যায় আসে না। শুনে বেশ জোর দিয়ে ও বলল, আপনিও দেখছি। আমার মতই ভাগ্যে বিশ্বাস করেন। আমি অদৃষ্টবাদী নই, ওকে জানালাম।

.

১.০৪

মিশেল-এর লাশটা আলাদা ওয়ার্ডে রাখার বন্দোবস্ত করে ডাক্তার রিচার্ডকে টেলিফোন করল রিও।

এই রোগ সম্পর্কে তোমার ধারণা কী? রিচার্ড-এর কাছে জানতে চাইল ও।

না, এখনও কিছু আন্দাজ করতে পারিনি, নিজের অজ্ঞতা স্বীকার করল রিচার্ড। আমার হাতে মারা গেছে দুজন। একজন; আটচল্লিশ ঘণ্টা পর। অপরজন তিনদিন পর।

এ ধরনের রোগী পেলে দয়া করে আমাকে একটু জানিয়ো, ওকে অনুরোধ করল রিও।

আরও দুজন সহকর্মীর সঙ্গে আলাপ করল সে। ওদের কাছ থেকে জানতে পেল, ইতিমধ্যে বিশজনের মত মারা গেছে। আবার রিচার্ডকে টেলিফোন করল ও। রিচার্ড মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান। ওকে অনুরোধ করল রিও, এ ধরনের নতুন রোগীদের যেন আলাদা ওয়ার্ডে রাখা হয়।

দুঃখিত, বলল রিচার্ড। জেলা কর্তৃপক্ষের হুকুম ছাড়া তা করা যাবে না। কিন্তু রোগটা কী ছোঁয়াচে?

তেমন লক্ষণ আমি এখনও পাইনি। তবে অবস্থা আশঙ্কাজনক, উত্তর দিল রিও। রিচার্ড ওকে আশ্বাস দিল, ব্যাপারটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবে।

এ-দিকে ক্রমশ খারাপ হয়ে উঠছে শহরের আবহাওয়া। মিশেল মরার পরের দিন, গোটা আকাশ ছেয়ে গেল মেঘে মেঘে। পরপর কয়েকবার মুষলধারে বৃষ্টি হলো। কিন্তু বৃষ্টির কয়েক ঘণ্টা পর আবহাওয়া আবার হয়ে উঠল গরম, ভ্যাপসা।

শুধু রিও-র হাঁপানি রোগীর কাছে আবহাওয়াটা মনে হচ্ছিল অন্য রকম। মনে-প্রাণে যেন এরকমই চাইছিল বুড়ো। মনে হচ্ছে, শরীরের ভেতরটা সেদ্ধ করে ফেলছে, বিড়বিড় করে বলল সে। তবে হাঁপানি রোগীর জন্য এমন আবহাওয়াই দরকার।

আত্মহত্যা চেষ্টার ঘটনাটা তদন্তের ব্যাপারে কটার্ড-এর ফ্ল্যাটে এল রিও। পুলিস অফিসার তখনও আসেনি। ওঠার সময় সিঁড়িতে দেখা হলো গ্রাঁদ-এর সঙ্গে। গ্রাঁদ রিওকে নিয়ে ওর ফ্ল্যাটে ঢুকল। দুটি মাত্র ঘর। তেমন আসবাবপত্র নেই। তবে দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত দুটি জিনিস আছে। একটা বইয়ের শেলফ, অভিধানে ঠাসা। অন্যটা ব্ল্যাক বোর্ড।

গ্রাঁদ বলল, কার্ড সকাল থেকে মাথায় খুব যন্ত্রণা অনুভব করছে।

গ্রাঁদকেও ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তাছাড়া উত্তেজিত মনে হলো ওকে। সারাক্ষণ পায়চারি করছে ঘরের ভেতর। টেবিলের ওপর একটা থলে আর একটা ব্যাগ পড়ে আছে। বারবার ওগুলো খুলছে আর বন্ধ করছে।

কথার ফাঁকে গ্রাঁদ রিওকে জানাল, কটার্ড-এর ব্যাপারে বেশি কিছু ও জানে না। সিঁড়িতে দেখা হলে শুভেচ্ছা বিনিময় হত, এই পর্যন্তই। তবে লোকটা অদ্ভুত প্রকৃতির। আমার সঙ্গে মাত্র দুবার কথা হয়েছে। কয়েক দিন আগে এক প্যাকেট রঙিন চক কিনে আমি ঘরে ফিরছিলাম। সিঁড়িতে প্যাকেটটা হাত থেকে পড়ে চকগুলো ছড়িয়ে যায়। লাল এবং নীল রঙের চক ছিল ওখানে। কুটা ওর। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওগুলো তুলতে সাহায্য করে আমাকে। সে সময় ও প্রশ্ন করেছিল, রঙিন চক দিয়ে আপনি কী করবেন? আমি উত্তর দিলাম, আমি ল্যাটিন ভাষা চর্চা করি। শুনে বেশ আগ্রহ দেখাল ও, এবং আমার কাছে একটা চক চাইল। আমি এতে আশ্চর্য হলেও ওকে একটা চক দিয়েছিলাম, কথা শেষ করল। গ্রাঁদ।

আর অন্যবার কী কথা হয়েছিল? ওর কাছে জানতে চাইল রিও।

গ্রাঁদ উত্তর দেয়ার আগেই একজন কেরানিকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল পুলিস অফিসার। বলল, আমি প্রথমে মশিয়ে গ্ৰাঁদ-এর বক্তব্য শুনব।

রিও লক্ষ করল, কটার্ড-এর কথা বলতে গিয়ে গ্রাঁদ কয়েকবার উচ্চারণ করল এই হতভাগ্য লোকটা এবং ওর দুর্জয় সংকল্প।

আত্মহত্যা করতে চাইবার পিছনে কি কারণ থাকতে পারে? প্রশ্ন। করল অফিসার।

উত্তর দিতে গিয়ে গ্রাঁদ উপযুক্ত ভাষা খুঁজতে বেশ সময় নিল। শেষে বলল, কোন গোপন বেদনা!

কোন গোপন বেদনা বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?

এক রাতে আমার দরজায় টোকা দেয় কটার্ড। আমি দরজা খুললে আমার কাছে একটা ম্যাচের কাঠি চায়। আমি ওকে একটা গোটা বাক্স দিয়ে দিই।

ওর আচরণে অস্বাভাবিক কিছু ছিল কী?

হাবভাবে বুঝতাম আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। কিন্তু ও জানত আমার কাজ নিয়ে আমি ভীষণ ব্যস্ত।

এবার অফিসার রিওকে বলল, আমি এখন অসুস্থ লোকটাকে দেখতে চাই।

কট্টার্ডকে কিছু ধাতস্ত হতে সময় দেয়ার জন্যে প্রথমে ওর ঘরে একাই কল রিও। খাটের ওপর বসে আছে কটার্ড। গায়ে ধূসর একটা শার্ট। চোখে-মুখে আতঙ্ক। উৎকণ্ঠা নিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে ও।

পুলিস এসেছে, তাই না? রিওকে দেখে জানতে চাইল কটার্ড।

হ্যাঁ। কিন্তু আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? মামুলি কয়েকটা প্রশ্ন করেই চলে যাবে, ওকে অভয় দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল রিও, পিছন থেকে ডাকল কার্ড। রিও কাছে যেতেই ওর হাত চেপে ধরল ও।

অসুস্থ লোককে নিশ্চয় ওরা বিবৃক্ত করে না, ওর কণ্ঠে ঝরে পড়ল মিনতি।

এমন ব্যবহারের প্রশ্নই ওঠে না, আবার ওকে অভয় দিল রিও। কথাগুলো শুনে সুস্থ বোধ করল কটার্ড। অফিসারকে আনতে বেরিয়ে গেল রিও।

গ্রাঁদ যা যা বলেছিল পড়ে শোনানো হলো কটার্ডকে। এরপর অফিসার আরম্ভ করল জেরা।

আত্মহত্যা করতে চাইছিলেন কেন?

গ্রাঁদ-এর কথাই ঠিক। কোন গোপন বেদনার কারণে।

ভবিষ্যতেও এমন করার ইচ্ছা আছে নাকি? ধমক দিল অফিসার।

না, নিশ্চয় না। আমি একটু শান্তি চাই।

শুনুন, কড়া গলায় বলল অফিসার, আপনি সবার শান্তি নষ্ট করেছেন। চোখের ইশারায় অফিসারকে থামতে বলল রিও। বিদায় নেয়ার সময় অফিসার ওর কাছে জানতে চাইল, ডাক্তার সাহেব, যেভাবে লোক মারা যাচ্ছে তাতে শহরে কোন বিপদের আশঙ্কা আছে কী?

স্পষ্ট করে কিছু বলা কঠিন।

হয়তো আবহাওয়ার জন্যেই এমন হচ্ছে, মন্তব্য করল অফিসার।

সত্যি, দিনদিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে আবহাওয়া। যত বেলা বাড়ে। কোনকিছুতে হাত দিলে মনে হয় কেমন যেন আঠা আঠা লাগছে।

এক একজন রোগী দেখে বাসায় ফেরে রিও, আর বাড়ে ওর উদ্বেগ। সেদিন সন্ধ্যায়, শহরতলিতে হঠাৎ একজন শুরু করল বমি। প্রচণ্ড জ্বরে ছটফট করতে করতে পুরুষাঙ্গ চেপে ধরে অবিরাম প্রলাপ বকতে লাগল লোকটা। একটা গ্ল্যান্ড টসটস করছিল পুঁজে; দেখতে দেখতে পাকা ফলের মত ফেটে গেল ওটা।

শহরের সবগুলো এলাকা থেকেই ঘন ঘন ডাক আসতে লাগল রিও-র। গ্ল্যান্ডগুলোর ওপর আড়াআড়িভাবে দুটো টান দেয় ও। অমনি পুঁজ আর রক্ত একসাথে ঠেলে বের হতে থাকে। হাত-পা ছড়িয়ে নেতিয়ে পড়ে রোগী। পা এবং পেটের বিভিন্ন জায়গায় ফুটে ওঠে কালো কালো চাকা। রোগী মারা যায়।

শহরে, ইঁদুরের মত দলে দলে মরতে আরম্ভ করল মানুষ। ইঁদুর মরেছে প্রকাশ্যে, রাস্তাঘাটে। মানুষ মরছে আড়ালে, বাড়ির ভেতর। এজন্যেই সাংবাদিকরা ব্যাপারটার ভয়াবহতা অতখানি বুঝতে পারল। না। শুধু জানল ডাক্তাররা। ওরা বুঝতে পারল মহামারী শুরু হয়েছে।

একদিন রিও-র সঙ্গে দেখা করতে এলেন ডাক্তার ক্যাসেল। বয়সে তিনি রিও-র চেয়ে অনেক বড়, এবং অভিজ্ঞ।

রিও রোগটা নিশ্চয় আন্দাজ করতে পারছ তুমি?

মৃতদেহ পরীক্ষার ফলাফলের রিপোর্টের জন্যে অপেক্ষা করছি।

রিপোর্টে কী পাওয়া যাবে তা আমি আগেই জানি। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, বহু আগেই তো, পশ্চিম ইওরোপ থেকে এ-রোগ উধাও হয়েছিল। রোগটা তুমিও নিশ্চয় আন্দাজ করতে পেরেছ।

চিন্তায় ডুবে গেল রিও। চোখ মেলে দিল জানালার বাইরে। দূর দিগন্তকে ঘিরে আছে উঁচু উঁচু পর্বতশৃঙ্গ। নিষ্প্রভ হয়ে আসছে আকাশের আলো।

দেখো, ক্যাসেল, বলল ও, ব্যাপারটা এখনও আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। কিন্তু লক্ষণ দেখে আমার আর কোন সন্দেহ নেই–প্লেগই শুরু হয়েছে।

.

১.০৫

জানালায় দাঁড়িয়ে নিচে, শহরের দিকে তাকিয়ে আছে রিও। মনে করার চেষ্টা করছে প্লেগ নিয়ে কখন কী পড়েছে। আস্তে আস্তে স্মৃতিতে ভেসে উঠল ইতিহাসের পাতা। ওগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে ও দেখল আজ পর্যন্ত তিরিশটা বড় বড় প্লেগ এসেছে পৃথিবীতে। মারা গেছে দশ কোটির মত মানুষ। মনে পড়ল কনস্টান্টিনোপল-এর। প্লেগের কথা; একদিনে দশ হাজার লোক মারা গিয়েছিল ওখানে।

সত্তর বছর আগে ক্যান্টনে দেখা দিয়েছিল প্লেগ। মানুষের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ার আগে মরেছিল চল্লিশ হাজার ইঁদুর।

লাশে ভরে গিয়েছিল এথেন্স নগরী, কাকপক্ষীরাও পালিয়েছিল শহর থেকে।

ফ্রান্সের মার্সাই শহরে বিরাট বিরাট গর্তে গলিত লাশ ছুঁড়ে মেরেছিল কয়েদীরা।

প্রঁভে শহরে গড়ে তোলা হয়েছিল বিশাল প্রাচীর, যেন প্লেগের দূষিত বাতাস ঢুকতে না পারে শহরের ভেতর।

কনস্ট্যান্টিনোপলে, আশ্রমগুলোর শতচ্ছিন্ন খড়ের গদির ওপর ছড়িয়ে ছিল অসংখ্য গলিত শবদেহ। বিছানা থেকে আঁকশির, সাহায্যে টেনে তুলতে হয়েছিল ওগুলো।

ইতালির মিলানে ঘটেছিল ইতিহাসের জঘন্যতম বিকৃত ঘটনা। একদিকে প্লেগের প্রকোপে মানুষ সন্ত্রস্ত, অন্যদিকে উদাসীন নর-নারী কবরস্থানে মিলিত হয়েছে সঙ্গমে।

লন্ডন দৈত্যপুরীর মত অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। রাস্তায় রাস্তায় শুধু শোনা যেত শবদেহবাহী শকটের নিরন্তর ঘর্ঘর শব্দের প্রতিধ্বনি।

রাতের আঁধারে এথেন্স এর সমুদ্রতীরে জড়ো হয়েছিল অগণিত মানুষ। কাঁধে ওদের আত্মীয়-পরিজনের মৃতদেহ। সবাই চাইছিল শুকনো মাটিতে লাশগুলোকে কবর দিতে। কিন্তু স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। সবার হাতে ছিল মশাল। সেই মশাল দিয়ে তখন ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল ওদের ভেতর।

.

১.০৬

ঝি খবর দিল গ্রাঁদ এসেছে। গ্রাঁদ মিউনিসিপ্যাল অফিসের কেরানি হলেও পরিসংখ্যান দপ্তরে জন্ম-মৃত্যু, বিবাহ ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করার। কাজ মাঝে মাঝে করতে হয় ওকে। সে কারণেই গত কয়েকদিন ধরে যেসব মৃত্যু ঘটছিল তার একটা হিসেব রাখার দায়িত্ব পড়েছিল ওর ওপর। কৃতজ্ঞতাবোধ ওর চরিত্রের বিশেষ একটা গুণ, সেজন্যেই স্বেচ্ছায় মৃতের সর্বশেষ সংখ্যা সংবলিত একটা রিপোর্ট সে নিয়ে এসেছে ডাক্তারের কাছে।

একখণ্ড কাগজ নাচাতে নাচাতে ঘরে ঢুকল গ্রাঁদ। প্রতিবেশী কটার্ডকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, ডাক্তার।গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় এগারো জন মারা গেছে।

কটার্ড-এর সঙ্গে করমর্দন করে রিও জিজ্ঞেস করল, আপনি কেমন আছেন?

আপনাকে ও ধন্যবাদ জানাতে এসেছে। আপনাকে অহেতুক ঝামেলায় ফেলার জন্যে বেচারি দুঃখিত, বলল গ্রাঁদ।

রিও ততক্ষণে চোখ বুলাতে শুরু করেছে রিপোর্টে। জ কুঁচকে উঠল ওর। না, আর দেরি নয়। রোগের নামটা ঘোষণা করতে হবে। আমি এখনি ল্যাবরেটরিতে যাব। আপনারা যাবেন আমার সঙ্গে?

ঠিক বলেছেন আপনি, রিও-র সঙ্গে নামতে নামতে বলল গ্রাঁদ। সত্য গোপন না রাখাই ভাল।

প্যালেস দ্য আর্মস-এর দিকে হাঁটা ধরল ওরা তিনজন। তখন সন্ধ্যা নামছে। মাফ করবেন, প্যালেসের কাছাকাছি পৌঁছে বলল গ্রাঁদ। আমাকে ফিরতে হবে। সন্ধেবেলাটা আমার কাছে বড় পবিত্র।

সত্যি কথা বলেছে ও, এতক্ষণে মুখ খুলল কটার্ড। সন্ধের পর কেউ ওকে ঘর থেকে বেরুতে দেবে না।

আপনাকে কি অফিসে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়? প্রশ্ন করল রিও।

না, না, তা নয়। আমার নিজের কিছু কাজ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত আমি, জানাল আঁদ।

তাই? তা কেমন চলছে কাজ?

একটানা কয়েক বছর হলো লেগে আছি। তাই কিছু করতে পারিনি বললে আশ্চর্য শোনাবে। কিন্তু কিছুই যে করতে পারিনি সেটাও সত্যি।

জানাতে আপত্তি না থাকলে বলবেন, কী করছেন?

গ্রাঁদ-এর কান দুটো বেখাপ্পা রকমের বড়, টুপির বাইরে বেরিয়ে থাকে। এক হাতে টুপিটা টেনে কান দুটো ঢেকে নিল ও। তারপর বিড়বিড় করে অস্পষ্ট স্বরে কিছু একটা মন্তব্য করল। রিও যেটুকু বুঝল তার অর্থ-কাজটা ব্যক্তিত্বের বিকাশ সংক্রান্ত।

দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল গ্রাঁদ। রাস্তার দুপাশে ছোট ছোট ডুমুর গাছের সারি। ছোট ঘোট পা ফেলে ফিরে চলল ও।

ল্যাবরেটরির দরজায় পৌঁছে কটার্ড, বলল, আমার একটা ব্যাপারে আপনার পরামর্শ প্রয়োজন। একদিন আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

পকেটের ভেতর গ্রাঁদ-এর দেয়া রিপোর্টটা নাড়াচাড়া করতে করতে কটার্ডকে রিও বলল, কাল যখন রোগী দেখতে বসব তখন আসুন। পরক্ষণে মত বদলে বলল, কাল আপনাদের ওদিকে রোগী দেখতে যাব আমি। ফেরার সময় আপনার ওখানে আসব।

কটার্ড চলে যাবার পর নিজের অজ্ঞাতেই গ্রাঁদকে নিয়ে ভাবতে আরম্ভ করল রিও। লোকটা কেমন যেন রহস্যময়। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা সবসময় রোগের আক্রমণ এড়িয়ে যেতে পারে, ও সেই শ্রেণীর মানুষ। দেখতে লম্বা। হ্যাংলা। মাপের চেয়ে এক সাইজ বড় পোশাক পরে। ওর ধারণা পোশাক ঢোলা হলে টেকে বেশি। ওপরের মাঢ়িতে একটাও দাঁত নেই লোকটার। হাসলে গুটিয়ে যায় ওপরের ঠোঁটখানা। মুখটাকে তখন মনে হয় একটা কালো ফোকর।

রাস্তায় ওকে হাঁটতে দেখলে মনে হয় একজন পাদ্রি হাঁটছে। পথ পেয়োয় দেয়াল ঘেঁষে। কোন্ ফাঁক দিয়ে কোথায় চলে যায় বোঝাই যায় না। মনে হয় ও একটা ইঁদুর। মাঝে মাঝে ওর গা থেকে ভেসে আসে তামাক আর সিঁড়ি-ঘরের গন্ধ। এক কথায় তাৎপর্যহীন একজন মানুষের সমস্ত বৈশিষ্ট্যই লোকটার আছে।

ভীষণ লাজুক গ্ৰাঁদ। কখনও প্রতিবাদ করতে পারে না। তাছাড়া, নিজের মনোভাব প্রকাশের উপযুক্ত ভাষাও খুঁজে পায় না সে, সব সময় হাতড়াতে থাকে শব্দ।

ডাক্তার সাহেব, আপনি যদি বুঝতেন, প্রায়ই ওকে বলে গ্রাঁদ, নিজের মনোভাব কিভাবে প্রকাশ করা যায় তা শেখার জন্যে আমার প্রাণে কী যে আকুলতা!

গ্রাঁদকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে রিও-র মনে হলো, নিশ্চয় ও বই বা তেমন কিছু একটা লেখার কাজে ব্যস্ত।

.

১.০৭

পরের দিন, কর্তৃপক্ষকে রোগের ব্যাপারটা ভাল করে বোঝাল রিও। প্রিফেক্ট-এর অফিসে স্বাস্থ্য কমিটির সভায় বসতে রাজি হলো সবাই।

আসার পথে ডাক্তার ক্যাসেলকে নিজের গাড়িতে তুলে নিল রিও। শুনেছ, ক্যাসেল বলল, সারা জেলায় নাকি এক গ্রাম সিরামও নেই।

হ্যাঁ, জানি। ডিপোতে টেলিফোন করেছিলাম। আমার কথা শুনে চমকে উঠেছিল ডিরেক্টর। সিরাম এখন প্যারিস থেকে আনতে হবে। কাল টেলিগ্রাম পাঠিয়েছি।

ওদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন প্রিফেক্ট। কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হলো না, চাপা ক্রোধে জ্বলছেন তিনি। আসুন কাজ শুরু করি, ডাক্তারদের লক্ষ করে বললেন প্রিফেক্ট, আশা করি পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার দরকার নেই।

না, তার দরকার হবে না, বলল ডাক্তার রিচার্ড। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই অবস্থায় কী ব্যবস্থা নেয়া উচিত…

না, আমাদের সামনে প্রশ্ন হচ্ছে  রিচার্ডকে বাধা দিয়ে বলল ক্যাসেল, রোগটা সত্যি প্লেগ কিনা তা জানা।

এ কথার প্রতিবাদ করল দুতিনজন ডাক্তার। ইতস্তত করল অন্যরা। একটু চমকে উঠলেন প্রিফেক্ট।

এই মুহূর্তে সবার উচিত আতঙ্ক না ছড়ানো। তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়, বলল রিচার্ড।

রোগটা প্লেগ নয়, এ-কথা বললে আপনাদের যদি দুশ্চিন্তা হালকা হয় তাহলে তা বলতে আমি রাজি আছি, বলল ক্যাসেল।

আপনার কথা যুক্তিসঙ্গত হচ্ছে না, বললেন প্রিফেক্ট। মেজাজ বিগড়ে গেছে তাঁর।

রিওকে ওর মতামত জানানোর জন্যে অনুরোধ করা হলো। এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি সে।

এ পর্যন্ত যত রোগী পেয়েছি, বলল রিও, তাদের জ্বরটা টাইফয়েডের মত। সঙ্গে বমি, গ্রন্থিস্ফীতি। পুঁজ পরীক্ষা করে দেখেছি ওতে প্লেগের জীবাণু পাওয়া গেছে, কিন্তু জীবাণুর মধ্যে এমন কিছু আছে যা প্লেগের সঙ্গে মেলে না।

তাহলে আমাদের কাজ হবে আরও কিছুদিন লক্ষ করা, বলল, রিচার্ড।

না। দিন দিন এই সংক্রমণ বাড়ছে। এখুনি ব্যবস্থা নেয়া না হলে দুমাসের মধ্যে শহরের অর্ধেক মানুষ মারা যাবে।

এ ধরনের বিভীষিকার চিত্র কল্পনা করা আমাদের ভুল হচ্ছে। তাছাড়া রোগটা যে সংক্রামক তার কোন সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই। রোগীর পাশে থেকেও অনেকে সুস্থ আছে।

এর উল্টো প্রমাণও আছে। কিন্তু প্রশ্ন সেটা নয়, প্রশ্ন হচ্ছে রোগ প্রতিরোধের কী ব্যবস্থা নেয়া যায়?

সংক্রমণ আপনাআপনি বন্ধ না হলে তখন প্রতিষেধক ব্যবহার করতেই হবে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও সরকারিভাবে ঘোষণা করতে হবে প্লেগ দেখা দিয়েছে।

এ ব্যাপারে সব ক্ষমতা প্রিফেক্টকে দেয়া আছে।

ক্ষমতা অবশ্যই আমার আছে, দৃঢ় কণ্ঠে বললেন প্রিফেক্ট। সেক্ষেত্রে পেশাদার ডাক্তারদের আগে ঘোষণা করতে হবে যে রোগটা প্লেগ।

কিন্তু আমরা, ডাক্তাররা, যদি একমত না হতে পারি, তাহলে একটা ভয়ঙ্কর ঝুঁকি নিতে হবে আপনাদের। হয়তো দেখা যাবে। শহরের অর্ধেক মানুষ মরা গেছে, বলল রিও।

আমার সহকর্মী পুরোপুরি বিশ্বাস করেন, রোগটা প্লেগই। ওর কথা থেকেও তাই মনে হচ্ছে, বলল রিচার্ড।

আমি যা দেখেছি তাই বলেছি। আমি এখন জানতে চাই আমার সহকর্মী কি এমন কথা বলতে রাজি আছেন যে কোনরকম প্রতিষেধক ছাড়াই এই রোগ ভাল হয়ে যাবে?

এবার ইতস্তত করল রিচার্ড। তুমি বিশ্বাস করো রোগটা প্লেগ?

রোগের নাম আমি কী বলি না বলি সেটা বড় কথা নয়। কথা হচ্ছে সময়ের।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, বললেন প্রিফেক্ট, আপনার অভিমত হচ্ছে রোগটা প্লেগ না হলেও তারই প্রতিরোধ ব্যবস্থা এখনি নিতে হবে। হ্যাঁ। ঠিক ধরেছেন, বলল রিও।

নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু করল ডাক্তাররা। রিচার্ডকে ওদের মুখপাত্র নির্বাচন করা হলো উঠল প্রতিবাদের ঝড়। দেখানো হলো নানারকম ভয়। কমিটি-কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল রিও।

কয়েক মিনিট পর। শহরতলির দিকে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে রিও। চারদিকে মাছ ভাজা আর পেচ্ছাপের ঝাঁঝাল গন্ধ। হঠাৎ কোথা থেকে এসে ওর গাড়ির সামনে দাঁড়াল এক স্ত্রী লোক। যন্ত্রণায় চিৎকার করছে সে; উরু বেয়ে নামছে রক্তের ধারা।

.

১.০৮

মীটিং-এর পরের দিন রোগের কামড়ানি আরও কিছুটা বাড়ল। এই প্রথম মানুষ মরার খবর বেরুল দৈনিক কাগজগুলোয়। একদিন পর, রিও লক্ষ করল শহরের বেশকিছু জায়গায় টানানো হয়েছে সরকারি নোটিস। মানুষের ভেতর যাতে আতঙ্ক ছড়িয়ে না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রেখে খুব সাবধানে সাজানো হয়েছে এর ভাষা।

ওরাওঁ শহরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এক ধরনের সাংঘাতিক রোগের খবর পাওয়া গেছে; রোগটা সংক্রামক কিনা তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না; কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করেন, প্রতিটি নাগরিক মাথা ঠাণ্ডা রেখে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারবে।

কর্তৃপক্ষ কী কী ব্যবস্থা নেবেন তার একটা খসড়া দেয়া হয়েছে নোটিসে। তাতে বলা হয়েছে: নালা নর্দমায় বিষাক্ত গ্যাস ঢেলে খতম করা হবে ইঁদুর; পানি যাতে দূষিত না হয় সেদিকে রাখা হবে কঠোর দৃষ্টি; অসুস্থ মানুষের জন্যে হাসপাতালে ভোলা হয়েছে বিশেষ ওয়ার্ড।

মানুষকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে নোটিসে। উপদেশ দেয়া হয়েছে: কেউ যদি নিজের শরীরে ঘনঘন। মাছি বসতে দেখেন, তাহলে তক্ষুণি মিউনিসিপ্যাল হাসপাতালে খবর দেবেন; বাড়িতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষকে জানাবেন; তাকে পাঠাতে হবে বিশেষ ওয়ার্ডে।

আরও কিছু অতিরিক্ত নিয়ম পালনের নির্দেশ রয়েছে নোটিসে। তার একটা হচ্ছে: রোগীর ঘর এবং যে গাড়িতে রোগী চলাফেরা করেছে সেগুলো যাতে জীবাণুমুক্ত থাকে, তার জন্যে বাধ্যতামূলকভাবে ওগুলোতে জীবাণুনাশক ওষুধ ব্যবহার করতে হবে।

নোটিস পড়ে হাসপাতালের দিকে চলল রিও। ওখানে ওর জন্যে অপেক্ষা করছিল গ্রাঁদ। রিওকে দেখেই নাটকীয়ভাবে দুই হাত তুলল।

হ্যাঁ, শুনেছি, বলল রিও, মৃতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

আগের দিন দশজন মরার খবর পাওয়া গেছে।

সম্ভবত সন্ধেয় আপনার সঙ্গে দেখা হবে। তখন আমি কটার্ড-এর কাছে যাব, গ্রাঁদকে বলল রিও।

তাহলে ওর খুব উপকার হয়, গ্ৰাঁদ বলল, ভদ্রলোক হঠাৎ যেন পাল্টে গেছেন।

কিভাবে?

আগের চেয়ে ওকে এখন অনেক অমায়িক মনে হয়।

আগে অমায়িক ছিল না?

প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গেল গ্রাঁদ। কটার্ড অমায়িক নয়, এটা ও বলতে পারে না। তবে কার্ড কিছুটা চুপচাপ আর গোপন স্বভাবের মানুষ। কখনও কখনও সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকে। মাঝে মাঝে হঠাৎ বাইরে বেরিয়ে যায়। আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসে চুপি চুপি।

কটার্ড গ্ৰাঁদকে জানিয়েছে, ও মর্দজাতীয় পানীয়-র বিক্রেতা। প্রায়ই ওর কাছে দুতিনজন লোককে আসা-যাওয়া করতে দেখেছে গ্ৰাঁদ। হয়তো ওর খদ্দের।

মাঝে মাঝে সিনেমা হলে ঢোকে কটার্ড। যেসব ছবিতে মারামারি গোলাগুলি আছে সেগুলো দেখার ঝোঁক একটু বেশি ওর।

মানুষের সঙ্গ এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে কটার্ড। মানুষ সম্পর্কে ভীষণ সন্দেহপরায়ণ ও। কিন্তু গ্রাঁদ লক্ষ করেছে, কিছুদিন থেকে একেবারেই পাল্টে গেছে মানুষটা।

ইদানীং সবার সঙ্গে ও একটা ভাব গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। নিজেই যেচে আমার সঙ্গে কথা বলে, গ্রাঁদ বলল।

ইঁদুর মরা দেখে হয়তো ওর মাথায় গোলমাল হয়েছিল, মন্তব্য করল রিও, আর এখন জ্বর দেখে খুব ঘাবড়ে গেছে।

আমার মনে হয় আপনার ধারণা ঠিক নয়। আমার মতে…, কথার মাঝপথে থেমে গেল গ্রাঁদ। একটা বিকট ঝনঝন শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওদের সামনে দিয়ে পার হলো ইঁদুর ধ্বংসকারী ভ্যান।

আমার ধারণা কোন ব্যাপারে ও ওর বিবেকের কাছে অপরাধী হয়ে আছে, গম্ভীরভাবে বলল গ্রাঁদ।

.

বিকেলে ক্যাসেল-এর সঙ্গে কথা হলো রিও-র। প্যারিস থেকে এখনও সিরাম এসে পৌঁছায়নি।

এটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বলল রিও। সিরাম আদৌ কোন কাজে লাগবে কিনা সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ হচ্ছে। জীবাণুগুলো কেমন অদ্ভুত।

দেখো, রিও, ওকে বাধা দিয়ে বলল ক্যাসেল। আমি তোমার সাথে একমত নই। এগুলো আসলেই অদ্ভুত। কিন্তু আসলে ওরা একই গোষ্ঠীর।

সন্ধ্যায় কটার্ড-এর বাসায় গেল রিও। খাবার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ও। টেবিলের ওপর পড়ে রয়েছে একটা ডিটেকটিভ বই, খোলা।

আপনার শরীর কেমন? জানতে চাইল রিও।

মোটামুটি ভালই, চেয়ারে বসে বেশ ঝাঁঝের সাথে বলল কটার্ড। কেউ জ্বালাতন করবে না এই নিশ্চয়তা থাকলে আরও ভাল থাকতাম।

মানুষ সবসময় একা থাকতে পারে না।

আপনি ভুল বুঝেছেন। আমি তা বলিনি। আমি বলছিলাম সেইসব লোকের কথা, যারা একজন মানুষের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত কৌতূহল দেখায় মানুষটিকে বিপথে ফেলার জন্যে।

আমি আপনার সাথে একমত। এ ধরনের অধিকার কারুর। নেই। কিন্তু আপনার উচিত মাঝে মাঝে বাইরে বেরুনো। এভাবে সারাক্ষণ ঘরে থাকা ঠিক নয়।

বাসায় আর কতক্ষণ থাকি। সবসময় তো বাইরে বাইরেই ঘুরতে হয়, বেশ বিরক্তির সুরে বলল কার্ড।

রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেল কটার্ড-এর ঘর। ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল রিও। ওকে অনুসরণ করল কটার্ড।

হঠাৎ যদি অসুস্থ হয়ে পড়ি, আপনার ওয়ার্ডে ভর্তি করবেন, তো?

অবশ্যই।

হাসপাতাল থেকে পুলিস কখনও অসুস্থ মানুষকে গ্রেপ্তার করে?

অমন ব্যাপার আগে ঘটেছে। তবে তা নির্ভর করে অসুস্থতার ওপর।

আপনি তো শহরের দিকে যাচ্ছেন। আমাকে একটু পৌঁছে দেবেন?

শহরের মাঝামাঝি পৌঁছে কটার্ড-এর অনুরোধে গাড়ি থামাল রিও। পাশে একদল বাচচা এক্কা-দোক্কা খেলছিল। ফুটপাথের ওপর দাঁড়িয়ে কটার্ড প্রশ্ন করল, সবাইকে দেখছি মহামারী মহামারী করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। তেমন কোন আশঙ্কা আছে?  

মানুষ সবসময় একটা না একটা হুজুগ নিয়ে থাকতে চায়। এটাই তো স্বাভাবিক।

ঠিক বলেছেন। হঠাৎ দশটা লোক মারা গেলে মানুষ ভাবে কেয়ামত এসে গেছে। কিন্তু আমি এখন ওরকম কিছু আশা করি না।

তাই! তাহলে কী আশা করেন?

গাড়ির দরজাটা চেপে ধরল কটার্ড। চলে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল। চিৎকার করে বলল, ভূমিকম্প। ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প। সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাক।

পরের দিন শহরের এমাথা-ওমাথা ছুটাছুটি করল রিও। কয়েকদিন থেকে নিজের পেশাটা ওর কাছে মনে হচ্ছে এক কঠিন বোঝ। এতদিন দেখেছে, রোগীরা স্বেচ্ছায় নিজেদের পুরোপুরি ছেড়ে দেয় ওর হাতে। কিন্তু কয়েকদিন থেকে ও উপলব্ধি করছে, ওর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে চাইছে ওরা। রোগ আড়াল করতে চাইছে। কেমন একটা আক্রোশ নিয়ে ওরা তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।

রাত দশটায় হাঁপানি রোগীর বাড়ির সামনে গাড়ি থামাল রিও। আজকে এটাই ওর শেষ রোগী। সীট থেকে ক্লান্ত দেহটাকে টেনে। তুলতে রীতিমত বেগ পেতে হলো ওকে।

হাঁপানি রোগী বিছানায় বসে ওর প্রিয় পুরনো খেলাটা খেলছিল; এক পাত্র থেকে তুলে গুনে গুনে অপর পাত্রে রাখছিল শুকনো মটরদানা। রিওকে দেখে চোখ তুলে চাইল সে, আনন্দে ডগমগ করে উঠল ওর মুখ।

আসুন, ডাক্তার সাহেব। চারদিকে কলেরা শুরু হয়েছে, না?

এসব চিন্তা কে ঢোকাল আপনার মাথায়?

কেন, কাগজে দেখলাম। রেডিও-তেও শুনেছি।

না, কলেরা নয়।

উত্তেজিত হয়ে উঠল হাঁপানি বুড়োর চোখমুখ। হেসে বলল, কর্তারা তাহলে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না।

সে রাতে তিরিশজন রোগীর খবর পৌঁছল কর্তৃপক্ষের কাছে। রিওকে টেলিফোন করল ডাক্তার ক্যাসেল।

রিও, স্পেশাল ওয়ার্ডে কতগুলো বেড আছে?

আশিটা।

রোগীর সংখ্যাও নিশ্চয়ই তিরিশের বেশি হবে।

এখন দুধরনের রোগী। একদল ভুগছে আতঙ্কে। আর অন্য দল আতঙ্কিত হওয়ার আগেই চলে যাচ্ছে কবরস্থানে। এদের সংখ্যাই বেশি। না বুঝতে পারছি। কবরস্থানে লাশ পরীক্ষা করে দেখা হয়?

না। রিচার্ডকে টেলিফোনে বলেছিলাম শুধু নোটিস এবং ইস্তেহার দিয়ে কোন লাভ হবে না; রোগের বিরুদ্ধে সত্যিকারের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে; আর নয়তো কিছু না করাই ভাল।

ঠিক বলেছ। তো ও কী বলল?

বলল ওর করার কিছু নেই। ক্ষমতা নেই। এইসব অজুহাত আরকি। কিন্তু আমার ধারণা, অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে।

রিও-র কথা বাস্তবে রূপ নিল। তিন দিনে রোগীতে ভরে গেল স্পেশাল ওয়ার্ড। রিচার্ড ওকে জানাল, শিশুদের একটা স্কুল দখল করে সেখানে অস্থায়ী হাসপাতাল খোলার কথাবার্তা চলছে। রিও অপেক্ষা করতে লাগল, প্যারিস থেকে কবে আসবে সিরাম।

বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি আরম্ভ করল ডাক্তার ক্যাসেল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাল লাইব্রেরিতে। ও সিদ্ধান্তে পৌঁছাল, ইঁদুরগুলো মারা গেছে প্লেগ কিংবা তারই কাছাকাছি কোন রোগে, ফলে লক্ষ লক্ষ মাছির জন্ম হয়েছে শহরে; এখনি ওগুলোকে ধ্বংস করতে না পারলে জ্যামিতিক হারে বাড়বে প্লেগের জীবাণু।

হু-হু করে বেড়ে চলল, প্লেগের শিকার। প্রথম দিন মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল মোলোয়। দ্বিতীয় দিন চব্বিশে। তৃতীয় দিনে আটাশ। এবং চতুর্থ দিনে বত্রিশ। এ-দিনে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হলো; শিশুদের স্কুলটাতে অস্থায়ী হাসপাতাল ভোলা হয়েছে।

প্রিফেক্টকে টেলিফোন করে রিও বলল, স্যার, যেসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তাতে কোন লাভ হচ্ছে বলে তো মনে হয় না।

হ্যাঁ, সাড়া দিলেন প্রিফেক্ট। মৃতের সংখ্যা আমি দেখেছি। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে অবস্থা উদ্বেগজনক।

শুধু উদ্বেগজনক নয়, এতে সবকিছুই বোঝা যাচ্ছে।

ঠিক আছে। আমি সরকারকে নির্দেশ দেবার জন্যে অনুরোধ করব।

রিচার্ড-এর মাধ্যমে রিও-র কাছে অনুরোধ করলেন প্রিফেক্ট, বর্তমান পরিস্থিতির ওপর একটা বিবরণী তৈরি করতে হবে ওকে; কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে ওটা।

বিবরণী তৈরি করল রিও। ওতে থাকল রোগের বিভিন্ন উপসর্গের বর্ণনা, মৃতের সংখ্যা। সেদিন মারা গিয়েছিল চল্লিশজন। প্রিফেক্ট নিজে সবকিছু তদারকির দায়িত্ব নিলেন।

পরের দিন প্লেনে প্যারিস থেকে এল সিরাম। আপাতত যা, এসেছে যথেষ্ট। কিন্তু রোগের প্রকোপ বাড়লে ওতে কুলোবে না। প্যারিসে আবার তার পাঠাল রিও। উত্তর এল, জরুরী অবস্থা মোকাবিলায় যে মজুদ ছিল তার সবটাই শেষ হয়ে গেছে; নতুন করে তৈরি করার প্রস্তুতি চলছে।

এদিকে ঋতুতে এল পালা বদল। শহরতলি থেকে শহরের দিকে পা বাড়াল বসন্ত। রাস্তার দুপাশে, বাজারে, দেখা দিল ফুল বিক্রেতারা। ঝুড়িভর্তি শুধু গোলাপ আর গোলাপ। বাতাস ভারি হয়ে উঠল ওদের সুবাসে।

মহামারীর আক্রমণটাও কেমন যেন শিথিল হয়ে এল। কোন দিন মৃতের সংখ্যা নেমে আসে মাত্র দশজনে। আবার কোন দিন লাফ দিয়ে ওঠে অনেক ওপরে। এমনই একদিন, মৃতের সংখ্যা পৌঁছল তিরিশে। সেদিন, রিওকে একটা সরকারি টেলিগ্রাম পড়তে দিলেন প্রিফেক্ট।

টেলিগ্রামে লেখা আছে: ঘোষণা করো, শহরে প্লেগ দেখা দিয়েছে। বন্ধ করে দাও শহরের দরজা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *