দত্তা – ১৫-১৬

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

পোড়া তুবড়ির খোলাটার ন্যায় তুচ্ছ বস্তুর মত এই ব্রাহ্মমন্দির হইতেও পাছে সমারোহশেষে লোকের দৃষ্টি অবজ্ঞায় অন্যত্র সরিয়া যায়, এই আশঙ্কায় বিলাসবিহারী উৎসবের জেরটা যেন কিছুতেই আর নিকাশ করিতে চাহিতেছিল না। কিন্তু যাঁহারা নিমন্ত্রণ লইয়া আসিয়াছিলেন, তাঁহাদের বাড়িঘর আছে, কাজকর্ম আছে, পরের খরচে কেবল আনন্দে মাতিয়া থাকিলেই চলে না, সুতরাং শেষ একদিন তাহাদের করিতেই হইল। সেদিন বৃদ্ধ রাসবিহারী ছোট একটি বক্তৃতা করিয়া শেষের দিকে বলিলেন, যাঁহার অসীম করুণায় আমরা পৌত্তলিকতার ঘোর অন্ধকার হইতে আলোকে আসিতে পারিয়াছি, সেই একমেবাদ্বিতীয়ম, নিরাকার পরমব্রহ্মের পাদপদ্মে এই মন্দির যাঁহারা উৎসর্গ করিয়াছেন, তাঁহাদের কল্যাণ হোক। আমি সর্বান্তঃকরণে প্রার্থনা করি, যে অচির-ভবিষ্যতে সেই দুটি নির্মল নবীন জীবন চিরদিনের জন্য সম্মিলিত হইবে—সেই শুভ-মুহূর্ত দেখিতে ভগবান যেন আমাদের জীবিত রাখেন। এই বলিয়া সেই দুটি নবীন জীবনের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, মা বিজয়া, বিলাস, তোমরা এঁদের প্রণাম কর। আপনারাও আমার সন্তানদের আশীর্বাদ করুন।

বিজয়া ও বিলাস পাশাপাশি মাটিতে মাথা ঠেকাইয়া প্রবীণ ব্রাহ্মদিগের উদ্দেশে প্রণাম করিল, তাঁহারাও অস্ফুটকণ্ঠে ইহাদের আশীর্বাদ করিলেন। তাহার পরে সভাভঙ্গ হইল।

সন্ধ্যার পর বিজয়া যখন বাটীতে আসিয়া পৌঁছিল তখন তাহার মনের মধ্যে কোন বিরোধ, কোন চাঞ্চল্য ছিল না। ধর্মের আনন্দে ও উৎসাহে হৃদয় এমনি পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল যে, আপনাকে আপনি কেবলই বলিতে লাগিল, ‘পার্থিব সুখই একমাত্র সুখ নয়—বরঞ্চ ধর্মের জন্য, পরের জন্য সে সুখ বলি দেওয়াই একমাত্র শ্রেয়ঃ।‘

বিলাসের সহিত তাহার মতের আর কোথাও যদি মিল না হয়, ধর্ম সম্বন্ধে যে তাহাদের কোন দিন অনৈক্য ঘটিবে না, একথা সে জোর করিয়াই নিজেকে বুঝাইল। বিছানায় শুইয়াও সে বার বার ইহাই কহিতে লাগিল—এ ভালই হইল যে তাহার মত একজন স্থিরসংকল্প, স্বধর্মপরায়ণ, কর্তব্যনিষ্ঠ লোকের সহিত তাহার জীবন চিরদিনের জন্য মিলিত হইতে যাইতেছে। ঈশ্বর তাহার দ্বারা নিজের অনেক কার্য সম্পন্ন করাইয়া লইবেন বলিয়াই এমন করিয়া তাহার মনের গতি পরিবর্তিত করিয়া দিয়াছেন।

পরদিন বিলাস সকলকেই করজোড়ে আবেদন করিল, তাঁহারা যদি অন্ততঃ মাসে একবার করিয়া আসিয়াও মন্দিরের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন ত, তাহারা আজীবন কৃতজ্ঞ হইয়া থাকিবে। এ অনুরোধ অনেকেই স্বীকার করিয়াই বাড়ি গেলেন।

রাসবিহারী আসিয়া বলিলেন, মা বিজয়া, তোমরা মন্দিরের স্থায়িত্ব যদি কামনা কর ত দয়ালবাবুকে এখানে রাখবার চেষ্টা কর।

বিজয়া বিস্মিত ও পুলকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, সে কি সম্ভব কাকাবাবু?
রাসবিহারী হাসিয়া কহিলেন, সম্ভব না হলে বলব কেন মা? তাঁকে ছেলেবেলা থেকে জানি—এক রকম আমারই বাল্যবন্ধু। অবস্থা ভাল না হলেও দয়াল খাঁটি লোক। তোমার জমিদারিতে কোন একটা কাজ দিয়ে তাঁকে অনায়াসে রাখা যেতে পারে। মন্দিরের বাড়িতেও ঘরের অভাব নেই, স্বচ্ছন্দে দু-চারটে ঘর নিয়ে তিনি সপরিবারে বাস করতে পারবেন।

এই বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির প্রতি বিজয়ার সত্যকার শ্রদ্ধা জন্মিয়াছিল। তাঁহার সাংসারিক হীনাবস্থা শুনিয়া সেই শ্রদ্ধায় করুণা যোগ দিল। সে তৎক্ষণাৎ রাসবিহারীর প্রস্তাব আনন্দে অনুমোদন করিয়া বলিল, ওঁকে এইখানেই রাখুন। আমি সত্যই ভারী খুশী হব কাকাবাবু।

তাহাই হইল। দয়াল আসিয়া সপরিবারে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন।

দিন কাটিতে লাগিল। পৌষ শেষ হইয়া মাঘের মাঝামাঝিতে আসিয়া পৌঁছিল। জমিদারি এবং মন্দিরের কাজ সুশৃঙ্খলায় চলিতে লাগিল—কোথাও যে কোন বিরোধ বা অশান্তি আছে তাহা কাহারও কল্পনায় উদয় হইল না।

নরেন্দ্রের কোন সংবাদ নাই। থাকিবার কথাও নহে। শুধু দু’দিনের জন্য সে দেশে আসিয়াছিল, দু’দিন পরে চলিয়া গেছে। তবে একটা ব্যথা বিজয়ার মনে বাজিত, যখনই সেই মাইক্রস্কোপ্‌টার প্রতি তাহার চোখ পড়িত। আর কিছু নয়—শুধু যদি তাহার সেই একান্ত দুঃসময়ে কিছু বেশি করিয়াও জিনিসটার দাম দেওয়া হইত। আর একটা কথা স্মরণ হইলে সে যেমন আশ্চর্য হইত, তেমনি কুণ্ঠিত হইয়া পড়িত। দু’দিনের পরিচয়ে কেমন করিয়াই না জানি এই লোকটার প্রতি এত মমতা জন্মিয়াছিল, ভাগ্যে তাহা প্রকাশ পায় নাই। না হইলে, মিথ্যা মোহ একদিন মিথ্যায় মিলাইয়া যাইতই—কিন্তু, সারাজীবন লজ্জা রাখিবার আর ঠাঁই থাকিত না। তাই, সেই দু’দিনের স্নেহ-মমতার পাত্রটিকে যখনই মনে পড়িত, তখনই প্রাণপণ বলে মন হইতে তাহাকে সে দূরে ঠেলিয়া দিত। এমনি করিয়া মাঘ মাসও শেষ হইয়া গেল।

ফাল্গুনের প্রারম্ভেই হঠাৎ অত্যন্ত গরম পড়িয়া চারিদিকে জ্বর দেখা দিতে লাগিল। দিন-দুই হইতে দয়ালবাবু জ্বরে পড়িয়াছিলেন। আজ সকালে তাঁহাকে দেখিতে যাইবার জন্য বিজয়া কাপড় পরিয়া একেবারে প্রস্তুত হইয়াই নীচে নামিয়াছিল। বুড়া দরোয়ান কানাই সিং লাঠি আনিতে তাহার ঘরে গিয়াছিল, এবং সেই অবকাশে বাহিরের ঘরে বসিয়া বিজয়া এক পেয়ালা চা খাইয়া লইতেছিল।

নমস্কা—র।

বিজয়া চমকিয়া মুখ তুলিয়া দেখিল, নরেন্দ্র ঘরে ঢুকিতেছে।

তাহার হাতের পেয়ালা হাতে রহিল, শুধু অভিভূতের মত নিঃশব্দে চোখ মেলিয়া চাহিয়া রহিল। না করিল প্রতি-নমস্কার, না বলিল বসিতে।

একটা চেয়ারের পিঠে নরেন্দ্র তাহার লাঠিটা হেলান দিয়া রাখিল, আর একখানা চৌকি টানিয়া লইয়া বসিল; কহিল, এ কাজটা আমারও এখনো সারা হয়নি—আর এক পেয়ালা চা আনতে হুকুম করে দিন ত।
দিই, বলিয়া বিজয়া হাতের বাটিটা নামাইয়া রাখিয়া বাহির হইয়া গেল। কিন্তু কালীপদকে বলিয়া দিয়াই তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া আসিতে পারিল না। উপরে যাইবার সিঁড়ির রেলিঙ ধরিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার বুকের ভিতরটা ভীষণ ঝড়ে সমুদ্রের মত উন্মত্ত হইয়া উঠিয়াছিল। কোন কারণেই হৃদয় যে মানুষের এমন করিয়া দুলিয়া উঠিতে পারে, ইহা সে জানিতই না। তথাপি এ কথা স্পষ্ট বুঝিতেছিল, এ আন্দোলন শান্ত না হইলে কাহারো সহিত সহজভাবেই কথাবার্তা অসম্ভব। মিনিট পাঁচ-ছয় সেইখানে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া যখন দেখিল, কালীপদ চা লইয়া যাইতেছে, তখন সেও তাহার পিছনে পিছনে ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল।

কালীপদ চলিয়া গেলে নরেন্দ্র বিজয়ার মুখের প্রতি চাহিয়া কহিল, আপনি মনে মনে ভারী বিরক্ত হয়েছেন। আপনি কোথাও বার হচ্ছিলেন, আমি এসে বাধা দিয়েচি। কিন্তু মিনিট-পাঁচেকের বেশী আপনাকে আটকে রাখব না।

বিজয়া কহিল, আচ্ছা, আগে আপনি চা খান। বলিয়া হঠাৎ পশ্চিমদিকের জানালাটার প্রতি নজর পড়ায় আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ও জানালাটা কে খুলে দিয়ে গেল?

নরেন্দ্র বলিল, কেউ না, আমি।

কি করে খুললেন?

যেমন করে সবাই খোলে—টেনে। কোন দোষ হয়েছে?

বিজয়া মাথা নাড়িয়া কহিল, না; এবং মুহূর্ত কয়েক তাহার লম্বা সরু সরু আঙুলের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, আপনার আঙুলগুলো কি লোহার? ঐ জানালাটা বন্ধ থাকলে পিছন থেকে সজোরে ধাক্কা না দিয়ে শুধু টেনে খুলতে পারে, এমন লোক আমি দেখিনি।

কথা শুনিয়া নরেন হো হো করিয়া উচ্চহাস্যে ঘর ভরিয়া দিল। এ সেই হাসি। মনে পড়িয়া বিজয়ার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়া উঠিল। হাসি থামিলে নরেন সহজভাবে কহিল, সত্যি, আমার আঙুলগুলো ভারী শক্ত। জোরে টিপে ধরলে যে-কোন লোকের বোধ করি হাত ভেঙ্গে যায়।

বিজয়া হাসি চাপিয়া গম্ভীরমুখে কহিল, আপনার মাথাটা তার চেয়েও শক্ত। ঢুঁ মারলে—

কথাটা শেষ না হইতেই নরেন আবার তেমনি উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল। এই লোকটির হাসি প্রভাতের আলোর মত এমনি মধুর, এমনি উপভোগের বস্তু যে, কোনমতেই যেন লোভ সংবরণ করা যায় না।

নরেন পকেট হইতে দু’শ টাকার নোট বাহির করিয়া টেবিলের উপর রাখিয়া দিয়া বলিল, সেইজন্যেই এসেছি। আমি জোচ্চোর, আমি ঠক, আরও কত কি গালাগালি ওই ক’টা টাকার জন্যে আমাকে দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। আপনার টাকা নিন—দিন আমার জিনিস।

বিজয়ার মুখ পলকের জন্য আরক্ত হইয়া উঠিল; কিন্তু তখনই আপনাকে সামলাইয়া লইয়া কহিল, আর কি কি বলে পাঠিয়েছিলুম, বলুন ত?

নরেন কহিল, অত আমার মনে নেই। সেটা আনতে বলে দিন, আমি সাড়ে ন’টার গাড়িতেই কলকাতা ফিরে যাবো। ভাল কথা, আমি কলকাতাতেই বেশ একটা চাকরি পেয়েচি—অতদূর আর যেতে হয়নি।

বিজয়ার মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, কহিল, আমার ভাগ্য ভাল।
নরেন বলিল, হাঁ। কিন্তু আমার আর সময় নেই, ন’টা বাজে—চক্ষের নিমিষে বিজয়ার মুখের দীপ্তি নিবিয়া গেল; কিন্তু নরেন তাহা লক্ষ্যও করিল না, কহিল, আমাকে এখুনি বার হতে হবে—সেটা আনতে বলে দিন।

বিজয়া তাহার মুখের প্রতি চোখ তুলিয়া বলিল, এই শর্ত কি আপনার সঙ্গে হয়েছিল যে, আপনি দয়া করে টাকা এনেছেন বলেই তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দিতে হবে?

নরেন্দ্র লজ্জিত হইয়া কহিল, না, তা নয় সত্যি; কিন্তু আপনার ত ওতে দরকার নেই।

আজ নেই বলে কোন দিন দরকার হবে না এ আপনাকে কে বললে?

নরেন্দ্র মাথা নাড়িয়া দৃঢ়স্বরে কহিল, আমি বলচি, ও জিনিস আপনার কোন কাজেই লাগবে না। অথচ, আমার—

বিজয়া উত্তর দিল, তবে যে বিক্রি করে যাবার সময় বলেছিলেন, ওটা আমার অনেক উপকারে লাগবে! আমাকে ঠকিয়ে গেছেন বলে পাঠিয়েছিলুম বলে আপনি আবার রাগ কচ্চেন? তখন এক রকম কথা আর এখন একরকম কথা?

নরেন লজ্জায় একেবারে মলিন হইয়া গেল। একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, দেখুন, তখন ভেবেছিলুম, অমন জিনিসটা আপনি ব্যবহারে লাগাবেন, এ রকম ফেলে রেখে দেবেন না। আচ্ছা, আপনি ত জিনিস বাঁধা রেখেও টাকা ধার দেন, এও কেন তাই মনে করুন না! আমি এ টাকার সুদ দিচ্চি।

বিজয়া কহিল, কত সুদ দেবেন?

নরেন্দ্র বলিল, যা ন্যায্য সুদ আমি তাই দিতে রাজী আছি।

বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিল, আমি রাজী নই। কলকাতায় যাচাই ক’রে দেখিয়েচি ওটা অনায়াসে চার শ’ টাকায় বিক্রি করতে পারি।

নরেন্দ্র সোজা উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, বেশ তাই করুন গে—আমার দরকার নেই। যে দু’শ টাকায় চারশ টাকা চায়, তাকে আমি কিছুই বলতে চাইনে।

বিজয়া মুখ নীচু করিয়া প্রাণপণে হাসি দমন করিয়া যখন মুখ তুলিল, তখন কেবল এই লোকটি ছাড়া সংসারে আর কাহারও কাছে বোধ করি সে আত্মগোপনে করিতে পারিত না। কিন্তু সেদিকে নরেনের দৃষ্টিই ছিল না। সে তীক্ষ্ণভাবে কহিল, আপনি যে একটি শাইলক, তা জানলে আমি আসতাম না।

বিজয়া ভাল-মানুষটির মত কহিল, দেনার দায়ে যখন আপনার যথাসর্বস্ব আত্মসাৎ করে নিয়েছিলুম তখনও ভাবেন নি?

নরেন কহিল, না। কেন না, তাতে আপনার হাত ছিল না। সে কাজ আপনার বাবা এবং আমার বাবা দু’জনে করে গিয়েছিলেন। আমরা কেউ তার জন্যে অপরাধী নই। আচ্ছা, আমি চললুম।

বিজয়া কহিল, খেয়ে যাবেন না?

নরেন উদ্ধতভাবে কহিল, না, খাবার জন্যে আসিনি।

বিজয়া শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা, আপনি ত ডাক্তার—আপনি হাত দেখতে জানেন?

এইবার তাহার ওষ্ঠপ্রান্তে হাসির রেখা ধরা পড়িয়া গেল। নরেন ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিয়া বলিল, আমি কি আপনার উপহাসের পাত্র? টাকা আপনার ঢের থাকতে পারে, কিন্তু সে জোরে ও-অধিকার কারও জন্মায় না জানবেন—আপনি একটু হিসেব করে কথা কইবেন; বলিয়া সে লাঠিটা তুলিয়া লইল।

বিজয়া কহিল, নইলে আপনার গায়ে জোর আছে, এবং হাতে লাঠি আছে এই ত?
নরেন লাঠিটা ফেলিয়া দিয়া হতাশভরে চেয়ারটায় বসিয়া পড়িয়া বলিল, ছি ছি—আপনি যা মুখে আসে তাই বলচেন। আপনার সঙ্গে আর পারিনে।

কিন্তু মনে থাকে যেন। বলিয়া আর সে আপনাকে সামলাইতে না পারিয়া হাসি চাপিতে চাপিতে দ্রুতপদে প্রস্থান করিল।

একাকী ঘরের মধ্যে নরেন হতবুদ্ধির মত খানিকক্ষণ বসিয়া থাকিয়া অবশেষে তাহার লাঠিটা হাতে তুলিয়া লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইতেই বিজয়া ঘরে ঢুকিয়া কহিল, আপনার জন্যই আমার যখন দেরি হয়ে গেল, তখন আপনারও চলে যাওয়া হবে না। আপনি হাত দেখতে জানেন—চলুন আমার সঙ্গে।

নরেন যাওয়ার কথাটা বিশ্বাস করিল না। তথাপি জিজ্ঞাসা করিল, কোথায় যেতে হবে হাত দেখতে?

তাহার মুখের প্রতি লক্ষ্য করিয়া এইবার বিজয়া গম্ভীর হইল, কহিল, এখানে ভাল ডাক্তার নেই। আমাদের যিনি নূতন আচার্য হয়ে এসেছেন—তাঁকে আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি—আজ দু’দিন হ’ল তাঁর ভারী জ্বর হয়েছে; চলুন, একবার দেখে আসবেন।

আচ্ছা চলুন।

বিজয়া কহিল, তবে একটু দাঁড়ান। সেই পরেশ ছেলেটিকে ত আপনি চেনেন—তিন-চার দিন তারও জ্বর। তার মাকে আনতে বলে দিয়েচি। বলিতে বলিতেই পরেশের মা ছেলেকে অগ্রবর্তী করিয়া দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, বলিল, ছেলের সমস্ত গায়ে ভয়ানক বেদনা বাবু, নাড়িটা দেখে একটু ওষুধ-টষুধ যদি দিতেন—

নরেন কহিল, তোমার ছেলেকে ঘরে নিয়ে যাও, হাওয়া-টাওয়া লাগিয়ো না, ওষুধ আমি লিখে দিচ্ছি।

মা একটু ক্ষুণ্ণ হইয়াই ছেলেকে লইয়া চলিয়া গেল। তখন নরেন বিজয়ার বিস্মিত মুখের পানে চাহিয়া কহিল, এদিকে ভারী বসন্ত হচ্ছে—একটু সাবধানে রাখ্‌তে বলে দেবেন।

বিজয়ার মুখ কালি হইয়া গেল—বসন্ত! বসন্ত হবে কেন?

নরেন কহিল, হবে কেন, সে অনেক কথা। আজও ভাল বোঝা যাবে না বটে, কিন্তু কাল ওর পানে চাইলেই জানতে পারবেন। আমার মনে হচ্চে, আপনার আচার্যবাবুকেও আর দেখবার বিশেষ আবশ্যক নেই—তাঁর অসুখটাও খুব সম্ভব কাল-পরশুই টের পাবেন।

ভয়ে বিজয়ার সর্বাঙ্গ ঝিমঝিম করিতে লাগিল। সে অবশ নির্জীবের মত চেয়ারে হেলান দিয়া বসিয়া পড়িয়া অস্ফুটকণ্ঠে কহিল, আমারও নিশ্চয় বসন্ত হবে নরেনবাবু—আমারও কাল রাত্রে জ্বর হয়েছিল, আমারও গায়ে ভয়ানক ব্যথা।

নরেন হাসিল, কহিল, ব্যথা ভয়ানক নয়, ভয়ানক যা হয়েচে তা আপনার ভয়। বেশ ত, জ্বরই যদি একটু হয়ে থাকে তাতেই বা কি? আশেপাশে বসন্ত দেখা দিয়েছে বলেই যে গ্রামসুদ্ধ সকলেরই তাই হতে হবে তার কোন মানে নেই।

বিজয়ার চোখ দুটি ছলছল করিয়া আসিল, কহিল, হলেই বা আমাকে দেখবে কে? আমার কে আছে?

নরেন পুনরায় হাসিয়া কহিল, দেখবার লোক অনেক পাবেন, সে ভাবনা নেই—কিন্তু কিছু হবে না আপনার।

বিজয়া হতাশভাবে মাথা নাড়িয়া কহিল, না হলেই ভাল। কিন্তু কাল রাত্রে আমার সত্যই খুব জ্বর হয়েছিল। তবুও সকালবেলা জোর করে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে দয়ালবাবুকে দেখতে যাচ্ছিলুম।
এখনও আমার একটু একটু জ্বর রয়েছে, এই দেখুন—বলিয়া সে ডান হাত বাড়াইয়া দিল। নরেন কাছে গিয়া তাহার কোমল শিথিল হাতখানি নিজের শক্তিমান কঠিন হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া মুহূর্তকাল পরেই ধীরে ধীরে নামাইয়া রাখিয়া বলিল, আজ আর কিছু খাবেন না, চুপ করে শুয়ে থাকুন গে। কোন ভয় নেই, কাল-পরশু আবার আমি আসব।

আপনার দয়া—বলিয়া বিজয়া চোখ বুজিয়া চুপ করিয়া রহিল। কিন্তু কথাটা তীরের মত গিয়া নরেনের মর্মমূলে বিঁধিল। প্রত্যুত্তরে আর সে কোন কথাই বলিল না বটে, কিন্তু নীরবে লাঠিটি তুলিয়া লইয়া যখন ঘরের বাহির হইয়া গেল তখন এই ভয়ার্ত রমণীর অসহায় মুখের দয়া-ভিক্ষা তাহার বলিষ্ঠ পুরুষ-চিত্তকে এক প্রান্ত হইতে আর-এক প্রান্ত পর্যন্ত মথিত করিতে লাগিল।

পরদিন কাজের ভিড়ে কোনমতেই সে কলিকাতা ত্যাগ করিতে পারিল না। কিন্তু তাহার পরদিন বেলা নয়টার মধ্যেই গ্রামে আসিয়া উপস্থিত হইল। বাটীতে পা দিতেই কালীপদ তাড়াতাড়ি আসিয়া কহিল, মায়ের বড় জ্বর বাবু, আপনি একেবারে ওপরে চলুন।

নরেন্দ্র বিজয়ার ঘরে আসিয়া যখন উপস্থিত হইল, তখন সে প্রবল জ্বরে শয্যায় পড়িয়া ছটফট করিতেছে। কে একজন প্রৌঢ়া নারী ঘোমটায় মুখ ঢাকিয়া শিয়রের কাছে বসিয়া পাখার বাতাস করিতেছে এবং অদূরে চৌকির উপর পিতা-পুত্র রাসবিহারী ও বিলাসবিহারী মুখ ভয়ানক গম্ভীর করিয়া বসিয়া আছেন। উভয়ের কাহারই চিত্ত যে ডাক্তারের আগমনে আশায় ও আনন্দে নাচিয়া উঠিল না তাহা না বলিলেও চলে।

বিলাসবিহারী ভূমিকার লেশমাত্র বাহুল্য না করিয়া সোজা জিজ্ঞাসা করিল, আপনি নাকি পরশু এসে বসন্তের ভয় দেখিয়ে গেছেন?

কথাটা এতবড় মিথ্যা যে হঠাৎ কোন জবাব দিতেই পারা যায় না।

কিন্তু প্রশ্ন শুনিয়া বিজয়া রক্তচক্ষু মেলিয়া চাহিল। প্রথমটা সে যেন ঠাহর করিতে পারিল না; তাহার পরে দুই বাহু বাড়াইয়া কহিল, আসুন।

নিকটে আর কোন আসন না থাকায় নরেন তাহার শয্যার একাংশে গিয়াই উপবেশন করিল। চক্ষের পলকে বিজয়া দুই হাত দিয়া সজোরে তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, কাল এলে ত আজ আমার এত জ্বর হতো না—আমি সমস্ত দিন পথ পানে চেয়েছিলাম।

নরেন্দ্র ডাক্তার—তাহার বুঝিতে বিলম্ব হইল না যে, প্রবল জ্বর উগ্র নেশার মত অনেক আশ্চর্য কথা মানুষের ভিতর হইতে টানিয়া আনে; কিন্তু সুস্থ অবস্থায় তাহার অস্তিত্ব, না মুখে না অন্তরে কোথাও হয়ত থাকে না। কিন্তু অনতিদূরে বসিয়া দুর্ভাগ্য পিতা-পুত্রের মাথায় চুল পর্যন্ত ক্রোধে কণ্টকিত হইয়া উঠিল। নরেন সহজে সান্ত্বনার স্বরে প্রসন্নমুখে কহিল, ভয় কি, জ্বর দু’দিনেই ভাল হয়ে যাবে।

তাহার হাতখানা বিজয়া একেবারে বুকের উপর টানিয়া লইয়া একান্ত করুণসুরে কহিল, কিন্তু আমি ভাল না-হওয়া পর্যন্ত তুমি কোথাও যাবে না বল—তুমি চলে গেলে আমি হয়ত বাঁচব না।

জবাব দিতে গিয়া নরেন মুখ তুলিতেই দুইজোড়া ভীষণ চক্ষুর সহিত তাহার চোখাচোখি হইয়া গেল। দেখিল, একান্ত সন্নিকটবর্তী নিঃশঙ্কচিত্ত শিকারের উপর লাফাইয়া পড়িবার পূর্বাহ্নে ক্ষুধিত ব্যাঘ্র যেমন করিয়া চাহে, ঠিক তেমনি দুই প্রদীপ্ত চক্ষু মেলিয়া বিলাসবিহারী তাহার প্রতি চাহিয়া আছে।

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

নরেন অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল—বিজয়ার প্রশ্নের জবাব দেওয়া হইল না। চোখের হিংস্র-দৃষ্টি শুধু মানুষ কেন, অনেক জানোয়ার পর্যন্ত বুঝিতে পারে। সুতরাং এই লোকটি যত সোজা মানুষ হোক, এবং সংসারের অভিজ্ঞতা তাহার যতই অল্প থাকুক, এ কথাটা সে একনিমেষেই টের পাইল যে ওই চেয়ারে আসীন পিতা-পুত্রের চোখের চাহনিতে আর যে ভাবই প্রকাশ করুক,হৃদয়ের প্রীতি প্রকাশ করে নাই। ইঁহারা যে তাহার প্রতি প্রসন্ন ছিলেন না তাহা সে জানিত। সে মাইক্রস্কোপ্‌টা বিজয়াকে দেখাইতে আসিয়া সে নিজের কানেই অনেক কথা শুনিয়া গিয়াছিল; এবং রাসবিহারী চাকরের হাতে যেদিন তাহার দাম পাঠাইয়াছিলেন সেদিনও হিতোপদেশ-ছলে বৃদ্ধ কম কটু কথা শুনাইয়া আসেন নাই। কিন্তু সে যখন সত্যই ঠকাইয়া যায় নাই, এবং জিনিষটা আজ যখন দুই শতের স্থানে চারি শত ঘুরাইয়া আনিতে পারে, যাচাই হইয়া গেছে, তখন সেদিক দিয়া কেন যে এখনো তাঁহাদের রাগ থাকিবে তাহা সে ভাবিয়া পাইল না। আর এই বসন্তের ভয় দেখাইয়া যাওয়া! কিন্তু সে ত ভয় দেখাইয়া যায় নাই—বরঞ্চ ঠিক উলটা। এ মিথ্যা আর কেহ প্রচার করিয়াছে, কিংবা বিজয়ার নিজের মুখেই প্রকাশ পাইয়াছে, তাহা স্থির করিবার পূর্বেই বিলাসবিহারী আর একবার চীৎকার করিয়া উঠিল। ভৃত্য কালীপদ বোধ করি নিছক কৌতূহলবশেই পর্দা একটুখানি ফাঁক করিয়া মুখ বাড়াইয়াছিল, বিলাসের চোখে পড়িতেই সে একেবারে হিন্দী-গর্জন ছাড়িল। খুব সম্ভব, হিন্দীভাষায় অধিক রোক্‌ প্রকাশ পায়। কহিল, এই শূয়ারকা বাচ্চা, একঠো কুর‌সী লাও।

ঘরের সকলেই চমকিয়া উঠিল। কালীপদ ‘শূয়ারকা বাচ্চা’ এবং ‘লাও’ কথাটার অর্থ বুঝিতে পারিল, কিন্তু ‘কুরসী’ বস্তুটি যে কি, তাহার আন্দাজ করিতে না পারিয়া সে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া একবার এদিকে একবার ওদিকে মুখ ফিরাইতে লাগিল। বৃদ্ধ রাসবিহারী নিজেকে সংবরণ করিয়া লইয়াছিলেন; তিনি গম্ভীর স্বরে কহিলেন, ও ঘর থেকে একটা চেয়ার নিয়ে এসো কালীপদ, বাবুকে বসতে দাও। কালীপদ দ্রুতবেগে প্রস্থান করিলে তিনি ছেলের দিকে ফিরিয়া, তাঁহার শান্ত-উদারকণ্ঠে বলিলেন, রোগা-মানুষের ঘর—অমন হেস্টি হয়ো না বিলাস। টেম্পার লুজ করা কোন ভদ্রলোকের পক্ষেই শোভা পায় না।

ছেলে উদ্ধতভাবে জবাব দিল, মানুষ এতে টেম্পার লুজ করে না ত করে কিসে শুনি? হারামজাদা চাকর, বলা নেই, কওয়া নেই, এমন একটা অসভ্য লোককে ঘরে এনে ঢোকালে যে ভদ্রমহিলার সম্মান রাখতে পর্যন্ত জানে না।

অকস্মাৎ প্রচণ্ড ধাক্কায় মাতালের যেমন নেশা ছুটিয়া যায় বিজয়ারও ঠিক তেমনি জ্বরের আচ্ছন্ন ঘোরটা ঘুচিয়া গেল। সে নিঃশব্দে নরেনের হাত ছাড়িয়া দিয়া দেওয়ালের দিকে মুখ করিয়া পাশ ফিরিয়া শুইল।
কালীপদ তাড়াতাড়ি একখানা চেয়ার আনিয়া রাখিয়া যাইতেই নরেন্দ্র বিছানা হইতে উঠিয়া আসিয়া তাহাতে বসিল। রাসবিহারী বিজয়ার মুখের ভাব লক্ষ্য করিতে ত্রুটি করেন নাই। তিনি একটু প্রসন্ন হাস্য করিয়া পুত্রকেই উদ্দেশ করিয়া পুনশ্চ বলিলেন, আমি সমস্তই বুঝি বিলাস। এ ক্ষেত্রে তোমার রাগ হওয়াটা যে অস্বাভাবিক নয়, বরঞ্চ খুবই স্বাভাবিক, তাও মানি, কিন্তু এটা তোমার ভাবা উচিত ছিল যে সবাই ইচ্ছা করে অপরাধ করে না। সকলেই যদি সব রকম রীতি-নীতি আচার-ব্যবহার জানত, তা হলে ভাবনা ছিল কি? সেই জন্যে রাগ না করে শান্তভাবে মানুষের দোষ-ত্রুটি সংশোধন করে দিতে হয়।

এই দোষ-ত্রুটি যে কাহার, তা কাহারও বুঝিতে বিলম্ব হইল না। বিলাস কহিল, না বাবা, এ-রকম impertinence সহ্য হয় না। তা ছাড়া আমার এ বাড়ির চাকরগুলো হয়েছে যেমন হতভাগা তেমনি বজ্জাত। কালই আমি ব্যাটাদের সব দূর করে তবে ছাড়ব।

রাসবিহারী আবার একটু হাস্য করিয়া সস্নেহ তিরস্কারের ভঙ্গীতে এবার বোধ করি ঘরের দেওয়ালগুলোকে শুনাইয়া বলিলেন, এর মন খারাপ হয়ে থাকলে যে কি বলে, তার ঠিকানাই নেই। আর শুধু ছেলেকেই বা দোষ দেব কি, আমি বুড়োমানুষ, আমি পর্যন্ত অসুখ শুনে কি-রকম চঞ্চল হয়ে উঠেছিলুম! বাড়িতেই হল একজনের বসন্ত, তার উপর উনি ভয় দেখিয়ে গেলেন।

এতক্ষণ পর্যন্ত নরেন্দ্র কোন কথা কহে নাই; এইবার সে বাধা দিয়া কহিল, না, আমি কোন রকম ভয় দেখিয়ে যাইনি।

বিলাস মাটিতে একটা পা ঠুকিয়া সতেজে কহিল, আল্‌বৎ ভয় দেখিয়ে গেছেন। কালীপদ সাক্ষী আছে।

নরেন কহিল, কালীপদ ভুল শুনেচে।

প্রত্যুত্তরে বিলাস আর একটা কি কাণ্ড করিতে যাইতেছিল, তাহার পিতা থামাইয়া দিয়া বলিলেন, আঃ—কি কর বিলাস? উনি যখন অস্বীকার করছেন, তখন কি কালীপদকে বিশ্বাস করতে হবে? নিশ্চয়ই ওঁর কথা সত্যি।

তথাপি বিলাস কি যেন বলিবার প্রয়াস করিতেই বৃদ্ধ কটাক্ষে নিষেধ করিয়া বলিলেন, এই সামান্য অসুখেই মাথা হারিয়ো না বিলাস, স্থির হও। মঙ্গলময় জগদীশ্বর যে শুধু আমাদের পরীক্ষা করবার জন্যেই বিপদ পাঠিয়ে দেন, বিপদে পড়লে তোমরা সকলের আগে এই কথাটাই কেন ভুলে যাও আমি ত ভেবে পাইনে।

একটু স্থির থাকিয়া পুনরায় কহিলেন, আর তাই যদি একটা ভুল অসুখের কথা বলেই থাকেন তাতেই বা কি? কত পাস-করা ভাল ভাল বিচক্ষণ ডাক্তারের যে ভ্রম হয়, উনি ত ছেলেমানুষ। বলিয়া নরেন্দ্রের প্রতি মুখ তুলিয়া বলিলেন, যাক—জ্বর ত তা হলে অতি সামান্যই আপনি বলছেন? চিন্তা করবার ত কোন কারণ নেই এই ত আপনার মত?

নরেন্দ্র আসিয়া পর্যন্ত অনেক অপমান নীরবে সহিয়াছিল, কিন্তু এইবার একটা বাঁকা জবাব না দিয়া থাকিতে পারিল না। কহিল, আমার বলায় কি আসে যায় বলুন? আমার ওপর ত নির্ভর করছেন না। বরং তার চেয়ে কোন ভাল পাশ-করা বিচক্ষণ ডাক্তার দেখিয়ে তাঁর মতামত নেবেন।
কথাটার নিহিত খোঁচা যাই থাক, এ জবাব দিবার তাহার অধিকার ছিল। কিন্তু বিলাস একেবারে লাফাইয়া উঠিয়া মারমুখী হইয়া চেঁচাইয়া উঠিল—তুমি কার সঙ্গে কথা কইচ মনে করে কথা কয়ো বলে দিচ্চি। এ ঘর না হয়ে আর কোথাও হলে তোমার বিদ্রূপ করা—

এই লোকটার কারণে-অকারণে প্রথম হইতেই একটা ঝগড়া বাধাইয়া তুমুল কাণ্ড করিয়া তুলিবার প্রাণপণ চেষ্টা দেখিয়া নরেন্দ্র বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া গেল। কিন্তু কেন, কিসের জন্য—কোথায় তাহার ব্যবহারের মধ্যে কি অপরাধ ঘটিতেছে কিছুই সে স্থির করিয়া উঠিতে পারিল না। আসল কারণ হইতেছে এই যে, কোথায় যে ওই লোকটার অন্তর্দাহ, নরেন্দ্র তাহা আজিও জানিত না। বিজয়া এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামের অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেশীর দল যখন বিলাসের সহিত তাহার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধের আলোচনা করিয়া সময়ের সদ্ব্যবহার করিত, তখন ভিন্ন-গ্রামবাসী এই নবীন বৈজ্ঞানিকের অখণ্ড মনোযোগ কীটাণুকীটের সম্বন্ধ-নিরূপণেই ব্যাপৃত থাকিত; গ্রামের জনশ্রুতি তাহার কানে পৌঁছিত না। তাহার পরে ব্রাহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠার দিনে যখন কথাটা পাকা হইয়া রাষ্ট্র হইতে কোথাও আর বাকি রহিল না তখন সে কলিকাতায় চলিয়া গেছে। আজ পিতা-পুত্রের কথার ভঙ্গীতে মাঝে মাঝে কি যেন একটা অনির্দেশ্য এবং অস্পষ্ট ব্যথার মত তাহাকে বাজিতেছিল বটে, কিন্তু চিন্তার দ্বারা তাহাকে সুস্পষ্ট করিয়া দেখিবার সময় কিংবা প্রয়োজন কিছুই তাহার ছিল না। ঠিক এই সময়ে বিজয়া এদিকে মুখ ফিরাইল। নরেন্দ্রের মুখের প্রতি ব্যথিত, উৎপীড়িত দুটি চক্ষু ক্ষণকাল নিবদ্ধ করিয়া কহিল, আমি যতদিন বাঁচব, আপনার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকব। কিন্তু এঁরা যখন অন্য ডাক্তার দিয়ে আমার চিকিৎসা করা স্থির করেছেন, তখন আর আপনি নিরর্থক অপমান সইবেন না। কিন্তু ফিরে যাবার পথে দয়ালবাবুকে একবার দেখে যাবেন শুধু এই মিনতিটি রাখবেন। বলিয়া প্রত্যুত্তরের জন্য অপেক্ষা না করিয়াই সে পুনরায় মুখ ফিরাইয়া শুইল। রাসবিহারী অনেক পূর্বেই আসল ব্যাপারটা বুঝিয়াছিলেন, তিনি তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠিলেন, বিলক্ষণ! তুমি যাঁকে ডেকে পাঠিয়েছ তাঁকে অপমান করে কার সাধ্য!

তারপর ছেলেকে নানাপ্রকার র্ভৎসনার মধ্যে বারংবার এই কথাটাই প্রচার করিতে লাগিলেন যে, অসুখের গুরুত্ব কল্পনা করিয়া উৎকণ্ঠায় বিলাসের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পাইয়াছে, এবং সঙ্গে সঙ্গে একমাত্র ও অদ্বিতীয় নিরাকার পরব্রহ্মের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অনেক আধ্যাত্মিক ও নিগূঢ় তত্ত্ব-কথার মর্মোদঘাটন করিয়া দেখাইয়া দিলেন। নরেন্দ্র কোন কথা কহিল না। পিতা ও পুত্রের নিকট হইতে তত্ত্বকথা ও অপমানের বোঝা নিঃশব্দে দুই স্কন্ধে ঝুলাইয়া লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, এবং লাঠি ও ছোট ব্যাগটি হাতে করিয়া তেমনি নীরবে বাহির হইয়া গেল। রাসবিহারী পিছন হইতে ডাকিয়া কহিলে, নরেন্দ্রবাবু, আপনার সঙ্গে একটা জরুরি কথা আলোচনা করবার আছে—বলিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া ছেলেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, একমাত্র ও অদ্বিতীয়রূপে বিজয়ার ঘরের মধ্যে অধিষ্ঠিত রাখিয়া দ্রুতবেগে তাহার অনুসরণ করিয়া নীচে নামিয়া গেলেন।
নরেন্দ্রকে পাশের একটা ঘরে বসাইয়া তিনি ভূমিকাচ্ছলে কহিলেন, পাঁচজনের সামনে তোমাকে বাবুই বলি আর যাই বলি, বাবা, এটা কিন্তু ভুলতে পারিনে তুমি আমাদের সেই জগদীশের ছেলে। বনমালী, জগদীশ দুইজনেই স্বর্গীয় হয়েছেন, শুধু আমিই পড়ে আছি। কিন্তু আমরা তিনজনে যে কি ছিলাম সে আভাস তোমাকে ত সেইদিনই দিয়েছিলাম, কিন্তু খুলে বলতে পারিনে—নরেন আমার বুক যেন ফেটে যেতে চায়।

নরেন চুপ করিয়া রহিল।

হঠাৎ রাসবিহারীর আর একদিনের কথাগুলা যেন মনে পড়ায় বলিয়া উঠিলেন, ওই দরকারী যন্ত্রটা বিক্রি করায় আমি সত্যিই তোমার উপর বড় বিরক্ত হয়েছিলাম নরেন। একটু হাস্য করিয়া বলিলেন, কিন্তু দেখ বাবা, এই বিরক্ত হয়েছিলাম কথাটা বড় রূঢ়। হইনি বলতে পারলেই সাংসারিক হিসাবে হয় ভাল—বলতে শুনতে সব দিকেই নিরাপদ—কিন্তু যাক। বলিয়া একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া অনেকটা যেন আত্মগত ভাবেই পুনরায় কহিতে লাগিলেন, আমার দ্বারা যা অসাধ্য তা নিয়ে দুঃখ করা বৃথা। কত লোকের অপ্রিয় হই, কত লোকে গাল দেয়, বন্ধুরা বলেন, ‘বেশ, মিথ্যা বলতে যখন কোন কালেই পারলে না রাসবিহারী, তখন, তা বলতেও আমরা বলিনে, কিন্তু, একটু ঘুরিয়ে বললেই যদি গালমন্দ হতে নিস্তার পাওয়া যায়, তাই কেন করো না?’ আমি শুনে শুধু অবাক হয়ে ভাবি বাবা, যা ঘটেনি, তা বানিয়ে বলা, ঘুরিয়ে বলা যায় কি করে? এরা আমার ভালই চায়, তা বুঝি, কিন্তু সেই মঙ্গলময় আমাকে যে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করেছেন, সে অসাধ্যসাধন করিই বা আমি কেমন করে? যাক বাবা, নিজের সম্বন্ধে আলোচনা করতে আমি কোন দিনই ভালবাসি নে—এতে আমার বড় বিতৃষ্ণা। পাছে তুমি দুঃখ পাও, তাই এত কথা বলা। বলিয়া উদাস-নেত্রে কড়িকাঠের দিকে ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া চোখ নামাইয়া কহিলেন, আর একটা কথা কি জান নরেন, এই সংসারে চিরকাল আছি বটে, চুল পাকিয়েও ফেললাম সত্য,কিন্তু কি করলে, কি বললে যে এখানে সুখ-সুবিধে মেলে তা আজও এই পাকা-মাথাটায় ঢুকল না। নইলে, তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম এ কথা মুখের ওপর বলে তোমার মনে আজ ক্লেশ দেব কেন?

নরেন বিনয়ের সহিত বলিল, যা সত্য তাই বলেছেন—এতে দুঃখ করবার ত কিছু নেই।

রাসবিহারী ঘাড় নাড়িতে নাড়িতে বলিলেন না না, ও কথা বলো না নরেন—কঠোর কথা মনে বাজে বৈ কি! যে শোনে তার ত বাজেই, যে বলে, তারও কম বাজে না বাবা। জগদীশ্বর!

নরেন অধোমুখে চুপ করিয়া রহিল। রাসবিহারী অন্তরের ধর্মোচ্ছ্বাস সংযত করিয়া লইয়া পরে বলিতে লাগিলেন, কিন্তু তার পরে আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। ভাবলাম, সে কি কথা! সে অনেক দুঃখই নিজের অমন আবশ্যকীয় জিনিসটা বিক্রি করে গেছে। তার মূল্য যাই হোক, কিন্তু কথা যখন দেওয়া হয়েছে তখন, আর ত ভাবাও চলে না, দাম দিতেও বিলম্ব করা চলে না।
মনে মনে বললাম, আমার বিজয়া-মা যখন ইচ্ছে, যতদিনে ইচ্ছে টাকা দিন, কিন্তু আমি টাকাটা পাঠিয়ে দিই-ই। সে বেচারা যখন ঐ টাকা নিয়েই তবে বিদেশে যাবে, একটা দিনও ত দেরি করা কর্তব্য নয়। তার উপর সে যখন আমার জগদীশের ছেলে!

নরেন তখনকার কটু কথাগুলা স্মরণ করিয়া বেদনার সহিত জিজ্ঞাসা করিল, তার কি দাম দেবার দেবার ইচ্ছে ছিল না?

বৃদ্ধ গম্ভীর হইয়া বলিলেন, না, সে কথা আমার ত মনে হয়নি নরেন। কিন্তু তবে কি জান—না, থাক। বলিয়া তিনি সহসা মৌন হইলেন।

চারিশত টাকায় যাচাই করা কথাটা একবারে নরেনের জিহ্বায় আসিয়া পড়িল, কিন্তু সেই সঙ্গেই কেমন একটা ক্লেশ বোধ হওয়ার এ সম্বন্ধে আর কোন কথা সে কহিল না।

রাসবিহারী এইবার দরকারী কথাটা পাড়িলেন। তিনি লোক চিনিতেন। নরেনের আজিকার কথাবার্তায় ও ব্যবহারে তাঁহার ঘোর সন্দেহ জন্মিয়াছিল যে, এখনও সে আসল কথাটা জানে না এবং এই সকল অন্যমনস্ক ও উদাসীন-প্রকৃতির মানুষগুলোর একেবারে চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া না দিলে নিজ হইতে অনুসন্ধান করিয়াও ইহারা কোন দিনই কিছু জানিতে চাহে না। বলিলেন, বিলাসের আচরণে আজ আমি যেমন দুঃখ তেমনি লজ্জা কিছু জানিতে চাহে না। বলিলেন, বিলাসের আচরণে আজ আমি যেমন দুঃখ তেমনি লজ্জা বোধ করেছি। ওই মাইক্রস্কোপ্‌টার কথাই বলি। বিজয়া একবার যদি তার মত নিয়ে সেটা কিন্‌ত, তা হলে ত কোন কথাই উঠতে পারত না। তুমিই বল দেখি, এ কি তার কর্তব্য ছিল না?
বিজয়ার কর্তব্যটা ঠিক বুঝিতে না পারিয়া নরেন্দ্র জিজ্ঞাসুমুখে চাহিয়া রহিল। রাসবিহারী কহিলেন, তার অসুখের খবর পেয়েই বিলাস যে কি রকম উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছে, এ ত আমার বুঝতে বাকি নেই। হওয়াই স্বাভাবিক—সমস্ত ভালমন্দ, সমস্ত দায়িত্ব ত শুধু তারই মাথার উপরে। চিকিৎসা এবং চিকিৎসক স্থির করা ত তারই কাজ। তার অমতে ত কিছুই হতে পারে না। বিজয়া নিজেও ত অবশেষে তা বুঝলেন, কিন্তু দুদিন পূর্বে চিন্তা করলে ত এ-সব অপ্রিয় ব্যাপার ঘটতে পারত না। নিতান্ত বালিকা নয়—ভাবা ত উচিত ছিল।

কেন যে উচিত ছিল, তাহা তখন পর্যন্তও বুঝিয়া উঠিতে না পারিয়া নরেন বৃদ্ধের প্রশ্নে সায় দিতে পারিল না। কিন্তু তবুও তাহার বুকের ভিতরটা আশঙ্কায় তোলপাড় করিতে লাগিল। অথচ, বুঝিয়া লইবার মত কথাও তাহার কণ্ঠ দিয়া বাহির হইল না। সে শুধু শঙ্কিত দুই চক্ষু বৃদ্ধের মুখের প্রতি মেলিয়া নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল।

রাসবিহারী বলিলেন, তুমি কিন্তু বাবা, বিলাসের মনের অবস্থা বুঝে মনের মধ্যে কোন গ্লানি রাখতে পাবে না। আর একটা অনুরোধ আমার এই রইল নরেন, এদের বিবাহ ত বৈশাখেই হবে, যদি কলকাতাতেই থাকো, শুভকর্মে যোগ দিতে হবে তা বলে রাখলাম।

নরেন কথা কহিতে পারিল না, শুধু ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, আচ্ছা।
রাসবিহারী তখন পুলকিত-চিত্তে অনেক কথা বলিতে লাগিলেন, এ বিবাহ যে মঙ্গলময়ের একান্ত অভিপ্রেত, এবং বর-কন্যার জন্মকাল হইতেই যে স্থির হইয়া ছিল, এবং এই প্রসঙ্গে বিজয়ার পরলোকগত পিতার সহিত তাঁহার কি কি কথা হইয়াছিল ইত্যাদি বহু প্রাচীন ইতিহাস বিবৃত করিতে করিতে সহসা বলিয়া উঠিলেন, ভাল কথা, কলকাতাতেই কি এখন থাকা হবে? একটু সুবিধে-টুবিধে হবার কি আশা—

নরেন্দ্র কহিল, হাঁ। একটা বিলাতি ওষুধের দোকানে সামান্য একটা কাজ পেয়েছি।

রাসবিহারী খুশি হইয়া বলিলেন, বেশ—বেশ। ওষুধের দোকান—কাঁচা পয়সা। টিকে থাকতে পারলে আখেরে গুছিয়ে নিতে পারবে।

নরেন এ ইঙ্গিতের ধার দিয়াও গেল না। কহিল, আজ্ঞে হাঁ।

শুনিয়া রাসবিহারী আর কৌতূহল দমন করিতে পারিলেন না। একটু ইতস্ততঃ করিয়া প্রশ্ন করিলেন, তা হলে মাইনেটা কি-রকম দিচ্চে?

নরেন্দ্র কহিল, পরে কিছু বেশী দিতে পারে। চার শ টাকা মাত্র দেয়।

চার শ! রাসবিহারী বিবর্ণ মুখে চোখ কপালে তুলিয়া বলিলেন, আহা, বেশ—বেশ, শুনে বড় সুখী হলাম।

এদিকে বেলা বাড়িয়া উঠিতেছিল দেখিয়া নরেন্দ্র উঠিয়া দাঁড়াইল। দয়ালবাবুর দুই-চারিটা বসন্ত দেখা দিয়াছিল, তাঁহাকে একবার দেখিতে যাইতে হইবে। জিজ্ঞাসা করিল, সেই পরেশ ছেলেটি কেমন আছে বলতে পারেন?

রাসবিহারী অম্লান মুখে জানাইলেন তাহাকে তাহাদের গ্রামের বাটীতে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছে—সে কেমন আছে বলিতে পারেন না।

উভয়েই ঘরের বাহির হইয়া আসিলেন। তাহাকে আবার একবার উপরে যাইতে হইবে। ছেলে তখনও অপেক্ষা করিয়া আছে; সে চিকিৎসার কিরূপ ব্যবস্থা করিল, তাহারও খবর লওয়া আবশ্যক। বারান্দার শেষ পর্যন্ত আসিয়া নরেন মুহূর্তের জন্য একবার স্থির হইয়া দাঁড়াইল, তাহার পরে ধীরে ধীরে ফিরিয়া আসিয়া রাসবিহারীকে কহিল, আপনি আমার হয়ে বিলাসবাবুকে একটা কথা জানাবেন। বলবেন, প্রবল জ্বরে মানুষের আবেগ নিতান্ত সামান্য কারণেও উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে পারে। বিজয়ার সম্বন্ধে ডাক্তারের মুখের এই কথাটা তিনি যেন অবিশ্বাস না করেন। বলিয়াই সে মুখ ফিরাইয়া একটু দ্রুতগতিতেই প্রস্থান করিল।

স্নান নাই, আহার নাই, মাথার উপর কড়া রৌদ্র—মাঠের উপর দিয়া নরেন্দ্র দিঘ্‌ড়ায় চলিয়াছিল। কিন্তু কিছুই তাহার ভাল লাগিতেছিল না। তাই চলিতে চলিতে আপনাকে আপনি সে বারংবার প্রশ্ন করিতেছিল, তাহার কিসের গরজ? কে একটা স্ত্রীলোক তাহার শ্রদ্ধার পাত্রকে দেখিবার জন্য অনুরোধ করিয়াছে বলিয়াই সে যাহাকে কখনো চোখেও দেখে নাই তাহাকে দেখিবার জন্য এই রৌদ্রের মধ্যে মাঠ ভাঙ্গিতেছে! এই অন্যায় অনুরোধ করিবার যে তাহার একবিন্দু অধিকার ছিল না তাহা মনে করিয়া তাহার সর্বাঙ্গ জ্বলিতে লাগিল, এবং ইহা রক্ষা করিতে যাওয়াও নিজের সম্মানের হানিকর ইহাও সে বার বার করিয়া আপনাকে বলিতে লাগিল, অথচ মুখ ফিরিয়া চলিয়া যাইতেও পারিল না। এক-পা এক-পা করিয়া সেই দিঘ্‌ড়ার দিকেই অগ্রসর হইতে লাগিল, এবং অনতিকাল পরে সেই নিতান্ত স্পর্ধিত অনুরোধটাকেই বজায় রাখিতে নিজের বাটীর দ্বারদেশে আসিয়া উপস্থিত হইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *